ফোকোমেলিয়া একটি বিরল জন্মগত ব্যাধি। যার বৈশিষ্ট্য হল— অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অনুপস্থিতি বা খুব ছোটো হয়ে যাওয়া। যার ফলে ওই অঙ্গকে মাছের পাখনার মতো দেখতে লাগে। ফোকোমেলিয়া-র কারণে বাহু, পা অথবা উভয় অঙ্গেরই স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়ে অঙ্গগুলি ছোটো থেকে যেতে পারে। আর এই ‘ফোকোমেলিয়া’ শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘ফোক’ থেকে এসেছে। যার অর্থ— সিল মাছের মতো অঙ্গ বা পাখনা। এই বিষয়ে তুলে ধরা হচ্ছে টেকনো ইন্ডিয়া ডামা হাসপাতাল-এর শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ধ্রুবজ্যোতি হালদার-এর বক্তব্য এবং পরামর্শ।
২০২৪ সালের প্যারা অলিম্পিকে মিক্সড কম্বাইন্ড আর্চারিতে ব্রোঞ্জ পদক প্রাপ্ত শীতল দেবী এই ফোকোমেলিয়া নামক গুরুতর রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু, জম্মু ও কাশ্মীরের একটি ছোট্ট গ্রাম লোইঘর অঞ্চলের এই মেয়ে তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে, খেলার জগতে প্রবেশ করেছিলেন এবং তিনি প্রমাণ করেছেন যে, সাহস রাখলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাও হার মানে।
আসলে, ফোকোমেলিয়া এমন এক অসুখ, যেখানে হাত কিংবা পায়ের বিকাশ বন্ধ হয়ে যায় এবং শীতল দেবী-রও তাই হয়েছিল। অর্থাৎ, তাঁর হাত আর বৃদ্ধি পায়নি। তবে তিনি হার মানেননি। ব্রোঞ্জ পদক জিতে তিনি ভারতের সর্বকনিষ্ঠ প্যারা অলিম্পিক পদকজয়ী এবং প্যারা অলিম্পিকের ইতিহাসে দ্বিতীয় বাহুবিহীন তিরন্দাজ হয়ে ওঠেন। শীতল দেবীর এই সাফল্য প্রেরণাদায়ক।
ফোকোমেলিয়া–র কারণ
জেনেটিক কারণ, পরিবেশগত প্রভাব অথবা উভয় কারণেই কারওর সন্তান ফোকোমেলিয়া-র শিকার হতে পারে। ফোকোমেলিয়া- 1-র সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণগুলির মধ্যে একটি হল— গর্ভাবস্থায় থ্যালিডোমাইড ওষুধের ব্যবহার। এই ঘটনা প্রথম সামনে এসেছিল ১৯৫০ সালের শেষের দিকে। সাধারণ অসুস্থতা দূর করার জন্য গর্ভবতী মহিলাদের থ্যালিডোমাইড দেওয়া হতো। কিন্তু পরে দেখা যায় যে, এটি বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার শিশুর মধ্যে ফোকোমেলিয়া সহ গুরুতর জন্মগত ত্রুটি সৃষ্টি করছে।
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিকাশ ব্যাহত হওয়ার জন্য দায়ী থাকতে পারে নির্দিষ্ট জিনের পরিবর্তনের বিষয়টিও। এই জিনগত পরিবর্তনগুলি উত্তরাধিকারসূত্রে আসতে পারে কিংবা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ঘটতে পারে। গর্ভাবস্থায় নির্দিষ্ট রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া কিংবা ভুল ওষুধ সেবনের ফলেও সন্তান ফোকোমেলিয়ার শিকার হতে পারে।
লক্ষণ এবং রোগ নির্ণয়
ফোকোমেলিয়া-র প্রাথমিক লক্ষণ হল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হওয়া। যা হালকা থেকে গুরুতর পর্যন্ত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আংশিক ভাবে গঠিত হতে পারে আবার কিছু ক্ষেত্রে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত থাকতে পারে। অতিরিক্ত লক্ষণগুলির মধ্যে মুখের অস্বাভাবিকতা, যেমন ঠোঁট কাটা-ফাটা অবস্থায় সন্তান জন্ম নিতে পারে।
ফোকোমেলিয়া-র রোগনির্ণয় সাধারণত গর্ভাবস্থায় মায়ের শারীরিক পরীক্ষা এবং ইমেজিং স্টাডি, অর্থাৎ এক্স-রে কিংবা আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে করা হয়, যাতে সন্তানের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বৃদ্ধি ব্যাহত হবে কিনা তার আভাস পাওয়া যায়। যে-কোনও অন্তর্নিহিত জিনগত পরিবর্তন শনাক্ত করার জন্য জেনেটিক পরীক্ষাও করা যেতে পারে।
চিকিৎসা এবং পরিসেবা
ফোকোমেলিয়া-র নির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা নেই। তবে বিভিন্ন সহযোগী চিকিৎসার মাধ্যমে জীবনের মান উন্নত করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে মেডিসিন এবং মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা পরিসেবা দেওয়া হয় রোগীর চাহিদা অনুসারে।
প্রস্থেটিক্স এবং অর্থোটিক্স: কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন করে (প্রস্থেটিক্স এবং অর্থোটিক্স) ফোকোমেলিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের জীবনযাপনের মান উন্নত করা যেতে পারে।
শারীরিক ও পেশাগত থেরাপি: এই থেরাপিগুলি শক্তি, সমন্বয় এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে, যা ফোকোমেলিয়া-র শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মনোবল বাড়িয়ে দিতে পারে।
শল্য চিকিৎসা: কিছু ক্ষেত্রে, সংশ্লিষ্ট অস্বাভাবিকতা হ্রাস করতে কিংবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা উন্নত করতে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে।