কথা বলার ফাঁকে যোগীর ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে হাসির রেখা। কারণ কথাটা যে নিতান্তই অবান্তর ও অবাস্তব সেটা ও ভালো করেই জানে। খবরের কাগজে ওর যে কোনওদিন ছবি ছাপা সম্ভব নয়, সেটা ওর কাছে প্রায় অলীক স্বপ্নবৎ। স্বপ্ন মানুষকে যতই প্রতারণা করুক তবু লোকে স্বপ্ন দেখে। যেমন মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, তবু মৃত্যুকে মানুষ ভয় পায়।

—তোর ছবি দেইখা সবাই খুশিতে নাচব তাই না? সোনা যোগীর কথায় বিরক্তি প্রকাশ করে। তারপর কৃত্রিম গাম্ভীর্য প্রকাশ করে বলে, যা দুইটা বিড়ি ধরাইয়া আন। তুইও খা, আমিও খামু, তেষ্টা পাইছে।

—তোর তেষ্টা পাইছে তুই খা। তোরে আমি খাওয়ামু ক্যান? যোগী প্রতিবাদ জানায়।

—খাওয়াবি না ক্যান? চাইটা কাগজ বেশি বিক্রি করলি যে!

—তাতে কী? যোগীর প্রশ্ন।

—ধনীর কাছেই তো গরিবরাই হাত পাতে রে!

যোগীকে অতঃপর বাধ্য হয়ে মাশুল গুনতে হয়। সোনা পয়সা হাতে নিয়ে এক দৌড়ে ছুটে যায় দোকানের দিকে বিড়িতে অগ্নি সংযোগ করার উদ্দেশ্যে।

সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা যে সময় স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দুপুরে ঘুম থেকে উঠে বিকেলের খাবার খায়, হতভাগ্য যোগী-সোনাদের মতো ছেলেরা সেই সময় খিদে মেটায় নেশা করে। ব্যাপারটা দৃষ্টিকটূ বা অশোভনীয় লাগলেও তাদের কাছে দ্বিতীয় কোনও বিকল্প নেই। প্রকৃত স্নেহ ভালোবাসার অভাবে মানুষ যে স্বভাবতই ডানপিটে হয়ে ওঠে।

সোনা বিড়িতে সুখটান দিয়ে বলে— তোর নাম তো যোগী, তুই তো আবার সাধু! কিন্তু সাধুরা তো নেশাখোর হয়। তুই খাবি না ক্যান? খাইয়া দ্যাখ এগুলা বিষ না।

তাৎক্ষণিক ব্যবহারটা যতই মধুর হোক কথাটার মধ্যে একটা তীর্যক ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। যোগী সোনার মনের কথা বুঝতে পারে। যোগী জবাবদিহি করে এই বলে— -আমি এইসব জিনিস খাই না। আমারে মাফ কর। তোর তেষ্টা পাইছে, তুই খা।

সোনার আত্মসম্মানে ঘা লাগে। নিমেষে রেগে গিয়ে জ্বলন্ত বিড়িটা রাস্তার উপর নিক্ষেপ করে বলে— আমি খারাপ, আমি বিড়ি খাই তাই না? তুই খাইলে নষ্ট হইয়া যাবি। তুই যে কত ভালো মানুষের পো আমার জানতে বাকি নাই।

অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এখন কোন কথার পৃষ্ঠে কোন কথার জন্ম হতে পারে যোগী তা ভালো করে জানা। প্রতিবাদ না করে সে চুপ করে থাকে। লোকের কথাই ঠিক, কলঙ্ক একবার লাগলে সহজে মোছে না। পরিবারের একজন অন্যায় করলে ভুগতে হয় অন্য পরিজনদেরও। প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় বংশানুক্রমে, যুগ যুগব্যাপী।

সোনা অবজ্ঞার সুরে বলে ওঠে— তোর বাপটা তো একটা লম্পট। দীপুর মা’ডারে লইয়া পলাইছে। তোর লজ্জা করে না? আমি বিড়ি খাই আমি খারাপ আর তুই খাস না তুই খুব ভালো! তাই না?

অশ্রাব্য কথাগুলো শোনার পরে যোগীর সারা শরীরটা জ্বলে ওঠে অপমানে। মনে হয় চকিতে এক থাপ্পড়ে সোনার গাল দুটো ফাটিয়ে দেয়। কিন্তু সে অপারগ। সে দুর্বল। সেই কাজটা করতে গেলে তাকেই হয়তো দু’ঘা হজম করতে হবে। সাহসের অভাবে নীরব অভিমানে যোগী চুপ করে থাকে। শুধু ও কেন, বস্তির সবার মুখেই এখন একই আলোচনা। কার মুখে কুলুপ দেবে? যোগী দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে সোনার কথাগুলো।

আবার একসময় গাড়ি এসে দাঁড়ায়। পুত্তুলিকাবৎ ছুটে যেতে হয় জীবিকান্বেষণের প্রবল তাগিদে। এরকম কয়েকবারের প্রচেষ্টায় কাগজগুলো যখন একসময় নিঃশেষ হয়ে যায়, তখন মনে পড়ে বাড়ি ফেরার কথা। অবসান হয় প্রতিযোগিতার। দু’জনে এক সাথে গল্প-গুজব করতে করতে বাড়ি ফেরে। তখন মনের কোণে কোথাও পূর্বের ঝগড়াঝাটি বা জয়-পরাজয়ের কথা মনে থাকে না। নিবিড় বন্ধুত্ব বলতে যে ছবিটা চোখের সামনে ফুটে ওঠে, ওদের তখনকার আচরণটাও ঠিক সেইরকম।

কয়েকদিন আগেই বৃষ্টি হয়েছিল, তাই বাতাস ছিল অপেক্ষাকৃত একটু ঠান্ডা। রাস্তা থেকে অনেকটা দূরে এক নর্দমার পাশে জনবসতিশূন্য একটা খোলা জায়গায় শবদাহ হচ্ছিল। জায়গাটা শ্মশান নয় কিন্তু শ্মশানে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। পথ যাত্রীদের প্রায়ই এই দৃশ্য চোখে পড়ে। সেদিন বাতাসের দাপটে আগুনটা ক্ষণে ক্ষণে দ্বিগুন হয়ে জ্বলে উঠছিল। তারই ফাঁকে অর্ধদগ্ধ মৃতদেহটা বারংবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল।

কারওর উপস্থিতি ছাড়াই আপন মনে শবদাহ হচ্ছিল। আশেপাশে পাহারা দেওয়ার মতো কোনও লোক ছিল না। যোগী মনে মনে ভাবছিল কী নিষ্ঠুর নির্দয় মানুষের মন! অন্তিমকালে কেউ কারও নয়। পাহারা দেওয়ার সময়টুকু পর্যন্ত কারও নেই। শিয়াল, কুকুর টেনে নিয়ে গেলেও বাধা দেওয়ার কেউ নেই।

দূর থেকে মৃতের সাদা পা দুটো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সেইদিকে একভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যোগীর কৈশোর মনে ভাবালুতার সৃষ্টি হয়। যোগী হঠাৎ সোনার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে— আচ্ছা সত্যি কইরা বল দেখি আমি মরলে তুই কাঁদবি তো? আমার জন্যে তুই দুঃখ করবি তো?

সোনার মনঃপূত হয় না কথাটা। শাসনের সুরে ধমক দিয়ে বলে— চুপ কর, বাজে বকিস না তো। প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাথে অন্তর জুড়ে একে অপরের প্রতি ভালোবাসাটাও নেহাত কম ছিল না। সেই অধিকারেই শাসন।

যোগী আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলে— এইটা বাজে কথা না রে। আমি কি তোরে গালমন্দ করতাছি নাকি? আমি আমার মনের কথা কই। তোর সেই সাধুবাবাটার কথা মনে আছে? সাধুবাবাটা সেদিন কী কইছিল তুই ভুইলা গেছিস? কইছিল মৃত্যুচিন্তা করা খুব ভালো, তাতে মানুষের মৃত্যুভয় থাকে না। অহংকার দূর হয়। মানুষ পবিত্র হয়। বাল্মীকি মুনি যেমন ধ্যানে মরা মরা জপত।

সোনাকে নীরব থাকতে দেখে যোগী চুপ করে যায়। প্রসঙ্গটা হালকা করার অছিলায় বলে— তোর কী মজা তাই না। তুই বাড়ি গিয়া খাবি তারপর ঘুমাবি। আমার কপালে সেই সুখ নাই। ঘুম পাইলেও উপায় নাই। খাওয়ার পরে আবার রোজগারের ফিকিরে দৌড়ানো। দোকান পাহারা দিমু গিয়া। আর সারা রাত্তির মশার কামড় খামু। সকালে তোরা যখন ঘুম থিকা উঠবি আমি তখন ঘুমাইতে যামু।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...