ছেলেটির হাবভাব দেখে তদুপরি শীতের রাতে ওর চোখের কোণে জলের ফোঁটা লক্ষ্য করে মনটা যারপরনাই একটু অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠেছিল। ভাঙা-ভাঙা হিন্দি সহযোগে ওকে বাংলা বলতে শুনে বুঝেছিলাম ছেলেটি নিঃসন্দেহে নির্ভেজাল এক বঙ্গ সন্তান। হিন্দি ভাষাটিকে সে তখনও ভালো মতো আয়ত্ত করতে পারেনি। আমার বাঙালিসুলভ মনটা ওর কথা শুনে সেদিন বড়োই বেদনা অনুভব করেছিল।

পাক-বাংলা যুদ্ধটাই ওদের গৃহছাড়া হওয়ার একমাত্র কারণ। পিতৃপুরুষদের ভিটে-মাটি ছেড়ে ওরা বাঁচার আশায় পালিয়ে এসেছিল এপারে — সুদূর দিল্লি শহরে। সেই সঙ্গে লাভ করেছিল এক নতুন উপাধি— উদ্বাস্তু। আশ্রয় বলতে আকাশের নীচে মাটির উপর শতাব্দী প্রাচীন গাছের তলায়। কারওর আবার কালো পলিথিনে ছাওয়া রোদ-বৃষ্টি থেকে কোনও মতে বাঁচার মতো ক্ষণস্থায়ী আচ্ছাদন। জীবিকা বলতে দিনমজুরি। কারওর আবার স্বাধীন ব্যাবসা অর্থাৎ পাঁপড়, বড়ি আর ঠোঙা বেচে দিনযাপন। ভদ্রলোকেরা সচরাচর বড়ো একটা পা মাড়ায় না এদিকটায়। ওটা সীমাপুরী বস্তিপাড়া নামে কুখ্যাত। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই আর খুন এই অঞ্চলের প্রতিদিনের ঘটনা।

বস্তিপাড়ার নাবালক দুটো ছেলে রোজ বিকেলে আইটিও-র চৌরাস্তায় এসে দাঁড়ায় রোজগারের ফিকিরে। এক নজরেই বয়সের তফাৎটা খুব সহজেই অনুমান করা যায়। ছোটো ছেলেটির বয়স নয়-দশ, নাম যোগী আর বড়োটির নাম সোনা, বয়স তেরো-চৌদ্দ। যোগীর কঙ্কালসার চেহারা, পরনে ছিন্ন বস্তু। অবয়বে দুঃখ-বেদনার মলিন আস্তরণ। গায়ের রং ফরসা কিন্তু খুবই শান্ত প্রকৃতির। অন্যদিকে সোনা দেখতে কালো, স্বভাব হিংসুটে, বেপরোয়া এবং পরশ্রীকাতর। অবয়বে কমনীয়তার লেশমাত্র নেই।

লাল বাতির সংকেতে যানবাহনের গতি শ্লথ হতে দেখলেই দু’জনে যন্ত্রচালিত পুতুলের ন্যায় সিমেন্ট বাঁধানো ফুটপাথ ছেড়ে পিচ ঢালা রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। দু’হাতে কাগজগুলো শক্ত করে বুকে চেপে ধরে জেব্রা ক্রসিং-এ দাঁড়ানো গাড়িগুলোর দিকে ছুটে যায়। তারপর নিটোল অভ্যস্ত স্বরে একই অনুরোধ ও সকরুণ প্রার্থনা— বাবু, ইনভিং লিউজ পড়ুন, ইনভিং লিউজ! দম দেওয়া পুতুলের ন্যায় অবিরাম আওড়াতে থাকে ভুল শব্দগুলো। ওদের তখন আগু-পিছু দেখার সময় থাকে না। কে কত শীঘ্র বেশি কাগজ বিক্রি করতে পারে সেই চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকে। মাত্র দেড় মিনিটের বিরতি, তার মধ্যে একজনও যেন বাদ না পড়ে। দু’জনার মধ্যে চলে তীব্র প্রতিযোগিতা। তাদের লক্ষ্য করলে জীবনের একটি গূঢ় তথ্যের সন্ধান মেলে, অর্থাৎ যেহেতু মানুষের আদি জন্ম অরণ্যে, সেই হেতু মানুষ যত আধুনিকই হোক না কেন একে অন্যকে পরাস্ত করে বিজয়ী হওয়াতেই তার পরম শান্তি ও প্রধান লক্ষ্য। একে অন্যের উপর আধিপত্য বিস্তার করার সূক্ষ্ম প্রবণতা সে এখনও মনের গভীরে লালন করে চলেছে সযত্নে।

রাতের অন্ধকারে শুভ্র চাঁদের আলোয় অভিভাবকেরা ছেলেদের হাত থেকে লাভের অংশটি বুঝে নিয়ে বিন্দুতে সিন্ধু গড়ার স্বপ্ন দেখে। লাভের অংশটি যেদিন বেশি হয় সেদিন নিজেদের অজান্তে খুশির জোয়ারে প্লাবিত হয়ে যায় তাদের সারা তনু-মন-প্রাণ। অধর কোণে ফুটে ওঠে স্মিত হাসি। হাসির মূল্যটা ওরা ছোটো বয়স থেকেই অনুধাবন করতে শিখে যায়। সেই কারণে ধনী ঘরের ছেলেদের তুলনায় অভাবী ছেলেরা হয় অতীব তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন আর সংসারের প্রতি প্রখর দায়িত্বশীল। অভাব থাকার দরুন এটা তাদের প্রতি বিধাতার অমোঘ আশীর্বাদের ফল বলা যায়।

কাগজগুলো অবশ্য একবারে কখনওই বিক্রি হয় না। তার জন্যে ঘাম ঝরাতে হয় প্রচুর। যতবার গাড়িগুলো লাল বাতিতে এসে থামে, ততবার নতুন আশায় বুক বেঁধে ছুটে যেতে হয় তাঁদের দিকে। অনুমান, ধারণা বস্তুগুলি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতাপ্রসূত। এখন চোখে চোখ পড়লে বুঝতে বাকি থাকে না যে, কার প্রয়োজন আছে বা নেই। তবুও যাচাই করতে হয় একে একে সবাইকেই।

মাত্র কিছুক্ষণের বিরতি। তারপর সবুজ বাতির সংকেতে গুটি গুটি পা ফেলে তারা পুনরায় ফুটপাথের সিমেন্ট বাঁধানো পরিত্যক্ত আসন দখল করে। পাশাপাশি বসে শুরু হয় হিসেব কষা। প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া পরাজিত সৈনিক সোনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিহঙ্গ দৃষ্টিতে ফিরে তাকায় যোগীর দিকে। সাধারণত সোনার কৌতূহলটাই এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। বয়োকনিষ্ঠ যোগীর কাছে সোনা হার স্বীকার করতে নারাজ। বিশেষ করে আর্থিক পরাজয়টা সে মোটেই বরদাস্ত করতে পারে না। এটা আজ নতুন নয়, অতি পুরাতন দ্বন্দ্ব। অর্থাৎ যখন থেকে এই প্রতিযোগিতার সূত্রপাত।

একসময় সোনাই প্রথম মৌনতা ভঙ্গ করে প্রশ্ন করে জানতে চায়— কটা বেচলি?

যোগীর নির্লিপ্ত জবাব— সাতটা।

প্রত্যুত্তরে যোগীকে আর প্রশ্ন করতে হয় না। সোনা পরম নিরুৎসাহিত কণ্ঠে নিজের অক্ষমতার কথা ব্যক্ত করে এই বলে— আমি মাত্র তিনটা।

আবার কিছুক্ষণের নীরবতা। সোনার নীরব থাকার অর্থ অনুশোচনা। আরও চারখানা কাগজ বিক্রি করতে না পারার জন্য তীব্র হতাশা। যোগীর কাছে তার পরাজয় অনেকটা কষাঘাতের মতো।

অন্যদিকে যোগীর নীরব থাকার অর্থ সোনার প্রতি আন্তরিক সমবেদনা। কারণ প্রতিবারই জয়ের বরমাল্যটা ওর গলাতেই জড়িয়ে পড়ে। কোন দৈব প্রক্রিয়ায় এটা হয় সেটা যোগীর বিচারে এক পরম বিস্ময়। ও জয়ী হতে চায় না। ওর মনের ভাবখানা একটু অন্যরকম। সতীর্থ হয়ে একে অন্যকে ডিঙিয়ে যাওয়ার কথাটা ও কল্পনাও করতে পারে না।

কথার ফাঁকে যোগী একসময় তার মনের অবদমিত কৌতূহল প্রকাশ করে বলে ওঠে— দেখ, পত্রিকা জুইড়া কত ছবি! সোনাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে যোগীর দ্বিতীয় প্রশ্ন— এত ছবি ছাপে কী কইরা কইথে পারিস? একটু নীরবতা পালনের পরে সে আবার বলে ওঠে— ইশ যদি আমার ছবি ছাপত কোনওদিন, তাইলে খুব খুশি হইতাম। বস্তির সবাইরে গিয়া দেখাইতাম।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...