দুই উচ্ছলা সুন্দরী রমণীর জন্ম একই স্থানে। নাগাধিরাজের গোপন অন্তঃপুরের এক সু-উচ্চ গিরিপ্রাচীরের গাত্রে। জন্মাবধি ছুটে চলেছে পরস্পরের বিপরীতে।
হিমাচলের উত্তর-পশ্চিমে পার্বত্য গিরিশিরায় জমে থাকা বিপুল আকৃতির চলমান বরফরাশি পর্বতের খাড়া ঢাল বেয়ে নেমে এসেছে। বয়ে আনা উপল স্তূপ আর ভেঙে পড়া বরফ দিয়ে তৈরি হয়েছে বিশাল আকৃতির সরোবর ‘মানতালাই”। ঢালে অবরুদ্ধ জল লক্ষ লক্ষ পাথরের বেষ্টনী ভেদ করে ছুটে চলেছে নিম্নমুখে ‘পার্বতী নদী’ রূপে। চলার পথে আসা অসংখ্য স্রোতস্বিনী তাকে আরও পুষ্ট করে তুলেছে। এই প্রবাহ সুগভীর গিরিখাত আর নিবিড় বনানীর মধ্য দিয়ে মণিকরণ, কাসোল জনপদকে ক্লেদমুক্ত করে কুলু উপত্যকায় ভুন্টারের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছে বিপাশার গর্ভে।
রুক্ষ, উগ্র স্বভাবের চঞ্চলা পিন নদীর জন্ম গিরিশিরার উত্তর-পূর্ব দিকে। রুক্ষ, ধূসর অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত পিন উপত্যকায় সবুজের দেখা মেলে কদাচিৎ। পিন সুন্দরীর মাথায় মেঘ জমার সাহস পায় না। পবনদেব তাঁর আজ্ঞাবহ ভৃত্য। দিনরাত বয়ে চলে হু হু করে আর পরম মমতায়, অনুপম দক্ষতায় উপত্যকার গিরিরাজকে নব নব রূপে সাজিয়ে তুলেছে। গিরিশ্রেণির প্রতিটি ভাস্কর্যই নিপুণ ভাস্করের অনুপম শিল্পকর্ম। সূর্যদেবের অকৃপণ আলোকবর্ষণে সেগুলি ক্ষণে ক্ষণেই রং বদলায়। পিন নদীর গতিধারা বিলীন হয়েছে স্পিতি উপত্যকার স্পিতি নদীতে।
‘পিন পার্বতী পাস’– এমনই এক দুর্গম গিরিবা। যে সুউচ্চ গিরিপ্রাচীর জলবিভাজিকা রূপে ‘পিন আর পার্বতীর’ নদী উপত্যকাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। তারই একটি অংশে ১৭৫৫৭ ফিট উচ্চতায় ‘পিন-পার্বতী গিরিবরে অবস্থান।
হিমাচলে যেমন অসংখ্য নদী উপত্যকা আছে তেমনই আছে অসংখ্য সুউচ্চ গিরিব। এক উপত্যকা থেকে অন্য উপত্যকায় যাওয়ার পথ সংক্ষিপ্ত করতে স্থানীয় মানুষেরা দীর্ঘকাল যাবৎ এই গিরিপথগুলিকে বেছে নিতেন। বর্তমানের উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থার কল্যাণে বহু দুর্গম গিরিপথ আজ পরিত্যক্ত কিংবা কদাচিৎ ব্যবহৃৎ হয় দেশের সুরক্ষার কাজে।
১৯৮৪ সালের তৎকালীন ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারি স্যার লুইস ডেন রুক্ষ স্পিতি উপত্যকার দিক থেকে দ্রুত আসার উপায় খুঁজতে গিয়ে পার্বতী গিরিপথের সন্ধান পান। স্পিতির দিক থেকে প্রথম পিন-পার্বতী পাস অতিক্রম করেন। কিন্তু সবুজ কুলু উপত্যকা থেকে প্রথম অভিযান করেন তৎকালীন সহকারী কমিশনার উব্লিউ লি শাটলওয়ারথ (W Lee Shuttleworth) ১৯২১ সালে। এরপর দীর্ঘদিন এই গিরিপথ কেউ অতিক্রম করেনি। ১৯৮১ সালে স্যার এডমন্ড হিলারির পুত্র পিটার হিলারি ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে কারাকোরাম’ অভিযান পর্বে এই গিরিপথ অতিক্রম করেন। খ্যাতনামা বাঙালি পর্বতারোহী প্রভাত কুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে প্রথম ভারতীয় পার্বতী উপত্যকা থেকে স্পিতি উপত্যকায় সফল ভাবে অভিযান করেন। ওনার চিহ্নিত পথই বর্তমানে প্রচলিত। ১৯৯৩ সাল থেকে হিমাচল প্রদেশ সরকার সাধারণ অভিযাত্রীদের জন্য এই পথ খুলে দেয়।
কুলু ও স্পিতি উপত্যকার সীমারেখায় অবস্থানকারী সুউচ্চ জলবিভাজিকায় ‘পিন পার্বতী গিরিপথ’-কে অতিক্রম করার লক্ষ্যে, ৮ সদস্যের দল বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনায় চেপে বসলাম কালকা মেলে। চণ্ডিগড় পৌঁছে গেলাম ভোরবেলায়। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে মালপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। ড্রাইভার পাঠকের দেখা নেই, বারবার ফোনে চেষ্টা করেও পাওয়া গেল না। অবশেষে প্রায় ৫ টার সময় আমাদের সারথি পাঠক গাড়ি নিয়ে হাজির হলেন। লটবহর চাপিয়ে ২৯০ কিমি মণিকরণের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলাম। ভুন্টার পৌঁছাতে পৌঁছাতেই প্রায় বিকেল হয়ে গেল। এখানেই পার্বতী নদী বিপাশায় মিলিত হয়েছে।
হিমাচলের অপরূপ প্রকৃতি, বিপাশার কলকাকলি, উচ্ছলতা চোখ জুড়ানো উপত্যকা ছেড়ে এগিয়ে চললাম। তুলনামূলক সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি ৪০ কিমি দূরে মণিকরণের উদ্দেশ্যে। দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটে গেছে। জনবহুল রাস্তা ছেড়ে নির্জন, নিভৃত পার্বতী উপত্যকার কোল ধরে এগিয়ে চলেছি। কুলু সদর থেকে মণিকরণের দূরত্ব মাত্র ৪৫ কিমি। লোকাল বাসে কুলু বা মানালি থেকে আসা যায়।
রাস্তার পাশের লোভনীয় আপেল বাগান দেখে নিজেদের আর সামলানো গেল না। ড্রাইভার-এর ভয়ার্ত সাবধান বাণী উপেক্ষা করেই আপেল পাড়ার চেষ্টা চলতে লাগল। গাছগুলো হয় দূরে কিংবা উঁচুতে। গাড়ির ছাদে উঠলে সহজেই পাড়া যেতে পারে, কিন্তু তা করা যাবে না! এইভাবে আপেল তোলা অন্যায়ের; চোখের সামনে ঝুলতে থাকা টুকটুকে লাল, গোলাপি, সোনালি বর্ণের ফলগুলির হাতছানি থেকে নিজেদের বিরত রাখা মুশকিল হয়ে উঠল।
—আরে দাদা! ইয়ে তো কুচ ভি নেহি, আপ লোগ জিস রাস্তা পে যায়েঙ্গে। শিরফ শেওই হ্যাঁয়। শেও কা পুরা জঙ্গল।
আমরা পৌঁছে গেলাম অপূর্ব পাহাড়ি জনপদ কাসোলে। বিদেশিরা এখানে বিপুল সংখ্যায় আসে। মূলত ইজরায়েলের লোকজন। চারিদিকে আপেলের বাগান দেখতে দেখতে এখন উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত। পার্বতী নদীকে সঙ্গী করে আরও কয়েকটি বাঁক অতিক্রম করতেই পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্য মণিকরণে।
মণিকরণ হিমাচল প্রদেশের একটি বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান। ভ্রমণার্থী, পুণ্যার্থী সবার কাছেই আকর্ষণীয়। শান্ত, সৌম্য, মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। কুলকুল করে বয়ে চলেছে পার্বতী নদী। তাকালেই চোখে পড়বে বিশাল গুরুদ্বারা। লোহার ব্রিজ রয়েছে পারাপারের জন্য। বাষ্পীয় ধোঁয়ার জটাজাল তৈরি হচ্ছে উষ্ণপ্রস্রবণগুলি থেকে। কাছেই রয়েছে রাম মন্দির ও শিব মন্দির।
মণিকরণ নিয়ে অনেক পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। শিব-পার্বতী নাকি এখানে তিন হাজার বছর ছিলেন। সুখী সাংসারিক জীবন চলছিল নিরুপদ্রবেই। একদিন নদীতে অবগাহনকালে পার্বতীর প্রিয় রত্নখচিত ‘মণি’ কুণ্ডল হারিয়ে যায়। ভগ্নহৃদয়ে তা জানায় স্বামী ভূতনাথকে। দেবাদিদেব তার অনুচরদের নির্দেশ দেন খুঁজে আনতে। অনুচরদের সমস্ত চেষ্টা বৃথা যায়। রুষ্ট মহেশ্বর-এর তৃতীয় চক্ষু জ্বলে ওঠে। স্বর্গ মর্ত্য পাতাল কেঁপে ওঠে, দানব মানব দেবতারা বিচলিত, বিভ্রান্ত, ভয়ার্ত। নিকটে থাকতেন নাগরাজ শেষনাগ। পাতাল ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে কুণ্ডল ফেরত দেন। সেই সঙ্গে বেরিয়ে আসে উষ্ণ জলের স্রোত। তৈরি হয় কুণ্ড। মণিকরণ পরিণত হয় মহাতীর্থে। শিখ গুরু নানক-ও এখানে এই কুণ্ডের ধারে বসেই দীর্ঘকাল তপস্যা করেছেন; তাই এটি শিখ তীর্থও বটে।
গুরুদ্বারার লঙ্গরখানায় উদর পূরণ করে একটা বড়ো ঘরে থাকার বন্দোবস্ত হল। কিন্তু আগামীকালের ট্রেকিং-এর পুরো রেশন কিনতে হবে। গুরুদ্বারা থেকে বাজার বেশ দূরে, সমস্ত রেশন বয়ে আনা মুশকিল! এসব চিন্তাভাবনা করে বাজারের কাছে সস্তা ও সুন্দর একটি হোটেলে আশ্রয় নিলাম। এখানকার প্রতিটি হোটেল উষ্ণ প্রস্রবণের জল সরবরাহ করে। হোটেলে ঢুকে সবাই হট বাথ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সকালের দিকে কাজ না থাকায় বেরিয়ে পড়লাম মণিকরণ দর্শনে। ছোট্ট জনপদ, এখানকার উষ্ণপ্রস্রবণ প্রায় ১.৫ কিমি জায়গা জুড়ে অবস্থান করছে। শিব মন্দিরে অনেককেই দেখলাম কাপড়ের পুঁটলিতে চাল বেঁধে উষ্ণ কুণ্ডে ছুঁড়ে দিচ্ছে। জলের খনিজ গুণের কারণে মহাপ্রসাদরূপে ভক্তগণ গ্রহণ করছে। হাঁটতে হাঁটতে ১.৫ কিমি দূরের হিপিদের স্বর্গরাজ্য কাসোলেও ঘুরে এলাম।