বিকেল তিনটে নাগাদ গাইড রাজা সব সঙ্গীদের নিয়ে হাজির। রান্নার দায়িত্ব সামলাবে দীপক, ছোট্ট চেহারার ছেলেটি নাকি মানালির অনেক হোটেলের হেঁশেল সামলেছে। কুলিদের মাথা নিম্বু, এই পথে বহুবার লটবহরের দায়িত্ব সামলেছে। গাইড রাজা ঠাকুরকে গাইডের থেকে ‘নায়ক’ বেশি লাগছে। গুরুদ্বারায় সবার থাকার বন্দোবস্ত করে বেরিয়ে পড়লাম বাজার করতে। লিস্ট মিলিয়ে বাজার করতে গিয়ে বারংবার ধাক্কা খাচ্ছি। প্রায় প্রতিটি জিনিসের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে, কারণ হিসেবে বলছে— ‘এ লোগ জ্যাদা খাতে হ্যায়, রাস্তা ভি কাফি লম্বা; খানে মে তকলিফ নেহি হোনা চাহিয়ে।’

কেনাকাটা ও প্রাথমিক গোছগাছ করতেই রাত্রি আটটা বেজে গেল। সকাল সকাল রওনা দেব তাই অহেতুক রাত্রি জাগরণ না করে সবাই শুয়ে পড়লাম।

(2)

পরেরদিনের গন্তব্য – ক্ষীর গঙ্গা, দূরত্ব – ১০ কিমি, উচ্চতা – ৯,১৮০ ফুট। আগেরদিন ঠিক করে রাখা একটা বড়ো টেম্পো ট্রাভেলারে সমস্ত মালপত্র তুলে চেপে বসলাম বারসেনির উদ্দেশ্যে। এ পথের শেষ বড়ো গ্রাম এবং হাঁটাপথের শুরু। গাড়ি মণিকরণ ছেড়ে এগিয়ে যেতেই দু’পাশে দেখা পেলাম সারি সারি আপেল বাগানের। সবুজ, গোলাপি, সোনালি রঙের আপেল ঝুলে রয়েছে সারা গাছ জুড়ে। যেমন মিষ্টি তেমন সুস্বাদু। হিমাচলের কুলু উপত্যকায় সবচেয়ে বেশি আপেলের চাষ হয়।

পার্বতী নদীকে সঙ্গী করে আমাদের গাড়ি দুলতে দুলতে এগিয়ে চলল। গাড়ি থামিয়ে মাঝে মাঝেই চলল ফটো সেশন। সকাল প্রায় ন’টায় পৌঁছে গেলাম বারসেনীতে। সমুখে পার্বতী নদীর উপর ব্রিজ দেখা যাচ্ছে। ওই ব্রিজ পেরিয়ে আমরা যাব আজকের গন্তব্য ক্ষীর গঙ্গায়। এখান থেকে দুটি পথ আছে ক্ষীর গঙ্গা যাওয়ার। একটি পথ অপেক্ষাকৃত খাড়াই ও সুন্দর। জঙ্গল ঘেরা পুলগা ফরেস্ট বাংলোর পাশ দিয়ে চলে গেছে। দ্বিতীয় পথটি হল আমাদের, অপেক্ষাকৃত সহজ পথে নাকথান গ্রাম হয়ে ক্ষীর গঙ্গা।

উত্তর দিক থেকে প্রবল বেগে বয়ে আসা তোশ নালা এখানে পার্বতী নদীতে মিলিত হয়েছে। এই নদীর উজান পথে এগিয়ে গেলে পাওয়া যাবে তোশ গ্রাম। সেখান থেকেই পথ চলে গেছে ‘সারা উপমা লা’-র দিকে। (লা অর্থাৎ গিরিপথ) এই গিরিপথের ওপারে লাহুল উপত্যকা। সেখান থেকে গাড়ি করে কুনজুম গিরিবর্ত্ত পেরিয়ে যাওয়া যায় স্পিতি উপত্যকায়। যাত্রা শেষে আমরা ওই পথ ধরেই ফিরে আসব মানালিতে।

কুলি সর্দার নিম্বুর তত্ত্বাবধানে সমস্ত মালপত্র বণ্টন হচ্ছে মালবাহকদের মধ্যে। চললাম সামনের হোটেলে সবার জন্য প্রাতরাশ কাম দ্বিপ্রাহরিক আহারের বন্দোবস্ত করতে। আলু পরোটা, দই ও ডিমের ওমলেট। চলছিল খাওয়া ও গল্প, শেষ হওয়ার আগেই যা আশা করেছিলাম সেই খবর চলে এল।

গিয়ে দেখি, নিম্বু একটা ওজন যন্ত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মালের ওজন ২০ কেজির বেশি নেবে না! অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও রাজি হল না। কী হবে! আমরা নিজেদের ব্যাগ নিজেরাই বইব, সেখানে অতিরিক্ত কিছুই নেওয়া সম্ভব নয়। কোথায় পাব এক্সট্রা মালবাহক? এক বয়স্ক লোক যেতে রাজি হল। কিন্তু শর্ত, পুরো রাস্তাই নিয়ে যেতে হবে। কয়েকদিনের জন্য প্রয়োজন। অবশেষে একজন কুলিকে অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দিতে হবে এই শর্তে নিম্বু সবাইকে রাজি করাল।

পার্বতী ব্রিজ পেরিয়ে এলাম, দুই পাশের আপেল বাগানের মধ্য দিয়ে হালকা চড়াই পথ উঠে গেছে। চারিদিকে আপেল ঝুলে থাকলেও ভয়ে পাড়তে পারছি না! হোটেলের লোকজন সাবধান করে দিয়েছে, আপেল না তুলতে। অনুমতি না নিয়ে আপেলে হাত না দিই। কী মুশকিল! জনমানবশূন্য এলাকা… একটা প্রাণীও নেই বললেই হবে! নাকের ডগায় ঝুলে রয়েছে অথচ তুলতে পারব না? না পাওয়ার বেদনায় হাঁটার কষ্ট বেড়ে যাচ্ছে। দেড় ঘণ্টা হাঁটার পর একটা লোককে দেখতে পেলাম। সবাই পটাতে শুরু করল।

—ভাইসাব, চায়ে মিলেগা?

—হ্যাঁ মিলেগা, আপলোগ আইয়ে। নিয়ে গেল ছোট্ট একটা কুঁড়েঘরে। পুরো ঘর জুড়ে আপেলের স্তূপ। যৎসামান্য টাকার বিনিময়ে চা খেলাম। আপেল চাই বলতেই, বলল— ‘জিতনা চাহিয়ে লে লিজিয়ে। পেড়সে মৎ তোড়িয়ে।”

প্রাণের সুখে যে যা পারল নিয়ে নিল। কিন্তু বইতে হবে যে! সঙ্গে সঙ্গেই ১০টার বদলে সংখ্যা ৫ হয়ে গেল। আপেল খেতে খেতেই এসে গেলাম এ পথের শেষ গ্রাম নাকথানে। ছোট্ট গ্রাম, অল্প কয়েকটি বাড়ি রয়েছে। মণিকরণ থেকে উৎসাহীরা এখানে আসতে পারেন। দু-একটি ধাবা রয়েছে খাওয়ার জন্য, থাকার জন্য রয়েছে হোম স্টে।

চা খেতে খেতেই পরিচয় হল বিপিন সিং পারমার সঙ্গে। বয়স্ক লোক, দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির খোঁজখবর রাখেন। লোকজনের জীবন-জীবিকার কথা জিজ্ঞাসা করায় বললেন— ‘এই সময় মহিলা ও পুরুষরা আপেল খেতেই কাজ করে। বছরের বাকি সময় কুলি কিংবা হোটেলের কাজে লেগে যায়।”

ঘরে ঘরে দেখলাম আপেল বাছাইয়ের কাজ করছে মূলত বাড়ির মহিলা ও বাচ্চারা। এক মহিলা সুন্দর দুটো টুকটুকে আপেল উপহার দিল। আমি আর জ্যোতি গল্পগুজব করে নাকথান থেকে একটু দেরিতে হাঁটতে শুরু করলাম।

এখান থেকে রুদ্রনাগের দূরত্ব মাত্র আধ ঘণ্টার। দুই পাশের খাড়া পর্বত দেয়ালের মাঝে এই পার্বতী উপত্যকা। আপেলের বাগান আস্তে আস্তে কমে আসছে। এক বুড়ি নাতিকে নিয়ে আপেল বাগান পাহারা দিচ্ছে। জ্যোতির্ময়-এর ইচ্ছে আপেল গাছে উঠে আপেল পেড়ে খাওয়া। বুড়ি ঠাকুমাকে টুপি পরানোর চেষ্টা করেও পারল না।

অনেক দেরি হয়ে গেছে। সবাই অপেক্ষা করছে গালাগালি দেওয়ার জন্য। প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে পৌঁছে গেলাম।

আহা! কী অপূর্ব স্বৰ্গীয় স্থান। দুরন্ত এক ঝরনা লাফিয়ে নামছে মন্দিরের পিছনে। তাঁবু ফেলার আদর্শ স্থান। বহু লোকের সমাগম হয়েছে আজ। বোধ হয় রুদ্রনাগের আজ বিশেষ পুজোর দিন। বহু পুণ্যার্থী দল বেঁধে আসছে। তাদের জন্য চলছে রান্না।

চা খাওয়ার পর পার্বতী নদীর উপরে নড়বড়ে ব্রিজ পেরিয়ে এগিয়ে চললাম ক্ষীর গঙ্গার দিকে। এখান থেকে পুরো খাড়া পথ উঠে গেছে ঘন অরণ্যানীর মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ বনস্পতি ও ঘন ঝোপের আড়ালে চলে গেছে পথ। প্রথম দিনের কষ্ট সামলে পৌঁছে গেলাম বিস্তৃত বুগিয়াল ক্ষীর গঙ্গায়। উচ্চতা ৯,১৮০ ফুট। এখানে রয়েছে বিখ্যাত উষ্ণ প্রস্রবণ। জলের গুণমান নাকি মণিকরণের থেকেও ভালো। প্রথম দিনের ব্যথার উপশমে এই প্রস্রবণের জল মহৌষধি। এখানে থাকা ও খাওয়ার বন্দোবস্ত রয়েছে।

(সাম্প্রতিককালে মাননীয় হাইকোর্ট এখানে তাঁবু ফেলা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে দূষণের কারণে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে বিশেষ অনুমতি না নিলে সমূহ বিপদে পড়তে পারেন।)

আমরা কুণ্ড থেকে একটু নীচে তাঁবু ফেললাম। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল মোবাইল ফোনের সিগন্যাল খুঁজতে। নানা বিচিত্র ভঙ্গিতে এদিক ওদিক সবাই ঘুরে বেড়াতে লাগল। এরপর ট্রেক শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে না।

এই স্থান নিয়েও নানা পৌরাণিক গল্প আছে। সিদ্ধিদাতা গণেশ এখানে তপস্যা করতেন। একদিন হর-পার্বতী এসেছেন সন্তানকে দেখতে। পরম মমতায় রান্না করেছেন ক্ষীর ভোগ। এর থেকেই নাকি নাম হয় ক্ষীর গঙ্গা!

এবার গন্তব্য ক্ষীর গঙ্গা থেকে তুণ্ডাভজে। উচ্চতা ১২,০০০ ফুট। দূরত্ব ১২ কিমি। রোদ ঝলমলে সকাল আমাদের স্বাগত জানাল। লম্বা পথ হাঁটতে হবে। সকালে ভারী প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম। নিম্বু ও দীপকরা তাঁবু গুটিয়ে পরে আসবে। সংকীর্ণ পথে ঝোপঝাড় ভেঙে কিছুটা উতরাই পথে নেমে এলাম পার্বতী নদীর কোলে। গভীর বনভূমির সবুজ-শ্যামলিমা আমাদের ঘিরে রয়েছে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...