ধীরে ধীরে কখন যে অন্যদের থেকে দূরে চলে এসেছি, বুঝতে পারিনি। যদিও পথ হারানোর ভয় নেই। সরু পথরেখা হারিয়ে গেছে পথের বাঁকে, ঝোপের আড়ালে। সহজ পথে দ্রুত গতিতে আপন মনে এগিয়ে চলেছি, পথ খোঁজার নেশায়। পিছনে কারও কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি না! কেবল পার্বতী নদীর গর্জন আর পাখির কূজন। ক্রমশ বেড়ে চলল অজানা বন কুসুমের সুঘ্রাণ। বনস্পতির ছায়ায় গন্ধটা যেন আরও সুমিষ্ট হয়ে উঠেছে। কী নিভৃত শান্তি! কী অদ্ভুত নির্জনতা! কতক্ষণ হেটে চলেছি? দেড় ঘণ্টার কম নয়! বন্য পাখির কাকলি জলস্রোত-এর গর্জন ছাড়া অন্য শব্দ শুনিনি। পায়ের চাপে পথে পড়ে থাকা শুকনো পাতায় নূপুরের শব্দ। মানুষের চিহ্ন নেই কোনওদিকে।

ওপারে পাহাড় চূড়ায় মেঘের দল কালো গাভীর মতো চরে বেড়াচ্ছে। পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে যে-কোনও সময় ধেয়ে আসতে পারে! শৈলমালার শীর্ষ দেশ থেকে পাদদেশ পর্যন্ত প্রসারিত আকাশের গায়ে অসংখ্য জলধারা লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে। রুক্ষ পর্বতের দেয়াল ধুয়ে নেমে আসছে অসংখ্য রুপোলি রেখা।

হঠাৎ বুকের মধ্যে ভয় ধরিয়ে দিল আগুয়ান তীব্র শব্দে। মনে হল বনভূমি ভেঙে ধেয়ে আসছে কোনও যমদূত! অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে গেল৷ হাঁটা থামিয়ে পাথরের আড়ালে অপেক্ষা করতে লাগলাম অনাহূত আগন্তুকের। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তীব্র গতিতে ছুটে চলে গেল কালো দূত। বুনো শুয়োর, হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে চলে গেল।

আর একাকী এগিয়ে যেতে মন চাইল না। অপেক্ষা করতে লাগলাম বাকিদের। নির্বাক, নিস্পন্দ হয়ে বেশ কিছু সময় কেটে গেল। সবাই মিলে আরও কিছু সময় বিশ্রাম নিলাম। ক্রমশ ধূসর থেকে আকাশ কালো বর্ণ ধারণ করল। যে-কোনও মুহূর্তেই শুরু হয়ে যাবে বৃষ্টি। সবাই পলিথিন শিট বার করে নিল। কয়েক পা এগোতে না এগোতেই শুরু হয়ে গেল মুশলধারায়। হাঁটার গতি শ্লথ হয়ে গেল।

অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছি। ঢালু রাস্তায় গাছের পাতা আর ছোটো পাথর মিলেমিশে ভয়াবহ পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে। তখন সময় প্রায় বারোটা, ঢালের নীচে একটা কুঁড়েঘর দেখতে পেলাম। ধোঁয়া উড়ছে, তার মানে মানুষ আছে! পায়ের গতি বেড়ে গেল।

—চায়ে মিলেগা?

—কিউ নেহি! বইঠিয়ে।

দেখলাম তিন-চারজন লোক আগুনের পাশে বসে গল্প করছে। কিছু বাসনপত্র, কুঁড়েঘরের চাল থেকে ঝুলে থাকা শুকনো মাংস। কাছেই কোনও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হচ্ছে, সেখানকার কুলি-কামিন ও অফিসারদের জন্য লোকটি দোকান দিয়েছে। আলাপচারিতায় আরও জানা গেল ৫৫ বছরের গোবিন্দ সিং, স্ত্রী-পুত্র সবাই থাকা সত্ত্বেও কেউ খেতে দেয় না। মাত্রাতিরিক্ত নেশা তার এই দশার কারণ। এই এলাকা চরসের স্বর্গরাজ্য। হিপিরা দলে দলে আসে এই এলাকায় নেশার টানে। আসার পথে কিছু বিদেশিদের দেখেছি গাছের তলায় বসে ছিলিমে টান দিতে। চরস, মদের নেশায় ঘরছাড়া করেছে গোবিন্দ সিংকে।

চায়ের পরিবর্তে জুটে গেল ভাত ও রাজমার ঝোল। বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। এখনও যেতে হবে অনেক পথ। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। পিছল পথে আছাড় খেতে খেতে এগিয়ে চলেছি। কাদা অংশ ছেড়ে জ্যোতি রাস্তার ধার দিয়ে যেতে গিয়ে এমন আছাড় খেল যে, গড়িয়ে নেমে গেল বেশ কিছুটা। জল-কাদায় মাখামাখি হয়ে হাঁচড়-প্যাঁচোড় করে উঠে এল। যদিও ভয়ের কিছু নেই, বড়ো বড়ো বনস্পতির ঠাস বুননে আটকে যাবে শরীর। এর আগে অবশ্য জ্যোতির পায়ে পা মিলিয়ে চলতে গিয়ে ছোট্ট ডোবার মধ্যে হাবু-ডুবু খেয়েছি। চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ানোতেই এই বিপত্তি। কাদামাটি, পাতা ধুয়ে আবার এগিয়ে চলা।

আছাড় খেতে কারও বাকি নেই, একাধিকবার। একটাই ভয় পড়ে গিয়ে কারও আঘাত না লাগে। বৃষ্টি কাদার পিছল পথ হাঁটতে হাঁটতে সবাই ক্লান্ত, অবসন্ন। সঙ্গে থাকা রাজাকে কতটা পথ বাকি প্রশ্ন করে উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। নিম্বুর কাছে জানতে পারলাম এই পথে প্রথমবার আসছে আমাদের গাইড বাবাজি। বার বার মনে হচ্ছে খাড়া ঢালের এই বাঁক পার হলেই এসে যাবে আমাদের গন্তব্য তুণ্ডাভুজ।

খাড়া ঢালের পিচ্ছিল কাদার মধ্যে পা চলছে না। বেশিরভাগ সময় দাঁড়িয়ে থাকছি, ভাবছি কোন দিক দিয়ে উঠব? কয়েকজন কুলি ধপ ধপ করে আমাদের ছেড়ে এগিয়ে গেল। জিজ্ঞাসা করলাম আমার বন্ধুরা কতটা পিছনে।

—বহুৎ পিছে সাব! আনেমে কাফি টাইম লাগে গা।

—অউর কিতনা দূর হাম লোগো কো জানা হোগা?

—নজদিক আ চুকে আপ লোগ। অউর ১০ মিনিট।

ধড়ে প্রাণ এল। বাকিদের জন্য দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল, ওরা কত দূরে! ঠিক কত সময় লাগবে? আসতে পারবে তো?

বাঁক ঘুরতেই দেখতে পেলাম নদীর পাড়ে কুলি ও গাইড বসে আছে। বসে থাকতে দেখেই মেজাজ বিগড়ে গেল। একে তো গাইড রাস্তার কিছুই জানে না, তার উপর তাঁবু না খাটিয়েই বসে আছে। কোথায় কিচেন টেন্ট লাগিয়ে গরম চা বা স্যুপ করার চেষ্টা করবে..!

নীচে গিয়েই চেঁচামেচি করে ফেললাম। গাইড রাজাকে বললাম, দু’জন কুলি নিয়ে একদম পিছনে যারা আছে নিয়ে আসতে। বাকিরা আমাদের সাহায্য করুক তাঁবুগুলো লাগাতে। বৃষ্টির মধ্যে সবাই ক্লান্ত। তাঁবু লাগাতে গিয়ে বুঝলাম শরীরে কিছু অবশিষ্ট নেই। অনেক কষ্টে দুটো তাঁবু দাঁড় করালাম। ব্যাগ ও মালপত্রগুলো তাঁবুর মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম। দীপক এসে গেল, জানা গেল মৃন্ময় ও জ্যোতি ক্লান্তিতে হাঁটতে পারছে না। আসতে অন্তত ১ ঘণ্টা লাগবে। আনতে যাওয়া মালবাহকরা ব্যাগ নিয়ে নিলে আশা করা যায় নির্বিঘ্নে চলে আসবে। প্রায় চারটের সময় বন্ধুরা হাজির হল। ক্লান্ত অবসন্ন বন্ধুদের গরম স্যুপ ও স্লিপিং ব্যাগের উষ্ণতায় চাঙ্গা করার চেষ্টা চলল।

( 3 )

পরের দিনের গন্তব্য- তুণ্ডাভুজ থেকে ঠাকুরকুঁয়া। দূরত্ব প্রায় ১২ কিমি, উচ্চতা ১১,১৫৫ ফিট।

কাল মধ্যরাত পর্যন্ত বৃষ্টি পড়েছে। গতকালের অমানবিক ক্লান্তিতে সবাই বেরোতে দেরি করে ফেললাম। জামাকাপড় জুতো সবই ভিজে। জামাকাপড় বদলানোর সুযোগ থাকলেও ভিজে জুতো পরতে হল। এখনও টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, থামার অপেক্ষা না করে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পথে।

বাঁদিকে পার্বতী নদী গভীর খাতের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে। নদীর ওপারে খাড়া পাথরের দেয়াল। চারিদিক সাদা মেঘে ঢাকা। পরপর তিনটি ঝরনা অন্তত ৫০০ ফিট নীচে পার্বতী নদীতে গিয়ে পড়ছে। আজকের পথ অপেক্ষাকৃত সহজ৷ সমস্ত পথই সামান্য চড়াই-উতরাই। কিছুটা চড়াই ভাঙার পর দেখলাম দক্ষিণ দিক থেকে প্রবল বেগে বয়ে আসছে এক নালা। সে দিকে তাকালেই দেখা যায় একটা রকি পিক। সম্ভবত এটাই বাসুকী পিক এবং নালাটি বাসুকী নালা। মেষপালকদের তৈরি সেতুর উপর দিয়ে পেরিয়ে এলাম।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...