চিলাপাতা অরণ্যের রহস্যময় পথের প্রতিটি বাঁকেই রোমাঞ্চ। অত্যন্ত ঘন সবুজের অলিন্দে বাতায়নে অদ্ভুত স্তব্ধতা। অরণ্যের সাহচর্য, মাদকতা আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
অরণ্যের নিবিড় সান্নিধ্যে মনে পড়ছে, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন—
‘আমরা অরণ্যের চেয়েও আরো পুরোনো অরণ্যের দিকে
চলেছি ভেসে
অমর পাতার ছাপ যেখানে পাথরের চিবুকে লীন
তেমনই ভুবনছাড়া যোগাযোগের দেশে ভেসে চলেছি
কেবলই— ‘
মুহূর্তরা পড়ে রয়েছে জঙ্গলের ওপারে। কোচ রাজাদের প্রাচীন মৃগয়াক্ষেত্র চিলাপাতা জঙ্গল আদপে জলদাপাড়া অভয়ারণ্যেরই বিস্তৃত পরিসর। তোর্সা, কালচিনি, বুড়িবাসরা, বেনিয়া নদীগুলি চিলাপাতার অন্দর দিয়ে প্রবহমান। তোর্সা নামের মিষ্টি নদীটি জলদাপাড়া ও চিলাপাতাকে ভাগ করেছে দু’ভাগে। তোর্সা জলদাপাড়ার পূর্ব থেকে চিলাপাতার পশ্চিমে বয়ে চলেছে।
সবুজের স্নিগ্ধ বর্ণমালার চিলাপাতার জঙ্গল প্রকৃত অর্থেই অরণ্য। এখানে অন্যান্য জঙ্গলের মতো সীমাহীন ঘাসজমির বিস্তার নেই। সেই জায়গা পূরণ করেছে প্রবীণ অরণ্যগল্পের মতো শিরীষ, মেহগনি, শাল, শিশু, চিলৌনি, সেগুন, চিকরাশি, শিমুল, কাটুস, নাগেশ্বরী ইত্যাদি মহীরুহরা। এই জঙ্গলেই রয়েছে বিখ্যাত রামগুয়া নামের এক বৃক্ষ। যে বৃক্ষে আঘাত করলে রক্তক্ষরণের মতো লাল রস নিঃসৃত হয়। স্থানীয়দের বিশ্বাস, কিছু অনুগত সৈন্য আজও রামগুয়া বৃক্ষের রূপ ধরে এখানকার শতাব্দী প্রাচীন নলরাজার দুর্গটিকে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে।
নদীর ওপারে বালুচরের ধূসর বিস্তৃতি জঙ্গল-আবহকে আরও রহস্যময় করে তুলছিল। একটানা ঝিঁঝিডাক অন্যমাত্রা আনে, যেমন উত্তরবঙ্গের প্রতিটি জঙ্গলেরই এটা চেনা শ্রুতস্বর। তার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করছিল— ময়ূরের কেকাধ্বনি, টিয়াপাখি ঝাঁকের তীক্ষ্মস্বর। পাখিদের খুনসুটির শব্দ ছাড়া বাকি সব নিস্তব্ধ।

চিলাপাতা বনাঞ্চলকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মেন্দাবাড়ি, কোদাল বনবস্তি এবং কুরমাই বনবস্তি। এই তিনটি এলাকাই জঙ্গল লাগোয়া। এইসব অঞ্চলের হোমস্টেগুলির সীমানায় ইলেকট্রিক সংযোগ তার দিয়ে ঘেরা। গাছগাছালি ছাড়াও চিলাপাতা জঙ্গলে রয়েছে হাতি, হরিণ, ময়ূর, গাউর, সম্বর, একশৃঙ্গী গণ্ডার, প্রচুর প্রজাপতি, সাপ, অসংখ্য প্রজাতির পাখপাখালি। এত নিবিড় জঙ্গল যে, এক বনপথ থেকে যত অন্য বনপথে গাড়ি ঢুকছে, আরও ঘন হচ্ছে জঙ্গল। কোনও জায়গায় এতটাই ঘন যে, মনে হচ্ছে সবুজ অন্ধকার নেমে এসেছে। পর্যটকরা চিলাপাতা থেকেই ১৫ কিলোমিটার দূরে জলদাপাড়া অরণ্য অথবা ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে বক্সা অরণ্য ঘুরে নেন। আবার উলটোটাও করেন।
এই অরণ্যে কোচ রাজারা প্রায়শই শিকার করতে আসতেন। কোচবিহারের রাজার সেনাধ্যক্ষ চিল্লার-এর নাম অনুসারে এই জঙ্গলের নাম হয়েছিল চিলাপাতা। অন্য মতে, কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণের ভাই শুক্লধ্বজ চিলা রায়ের নাম থেকে নামকরণ এই জঙ্গলের। কথিত আছে, কোচ রাজবংশের আদি পুরুষ বিশ্বসিংহের তৃতীয় পুত্র চিলা রায় নাকি চিলপক্ষীর মতো ক্ষিপ্রতায় শত্রুপক্ষকে নাকাল করতেন। চিলা রায় নির্মিত দুর্গটি রাজা নরনারায়ণের নামে পরবর্তীকালে নলরাজার দুর্গ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।
অনেকে মনে করেন, সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নেতা ভবানী পাঠকের গুপ্ত ঘাঁটি ছিল চিলাপাতা জঙ্গল। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা নাকি এখানেই আত্মগোপন করে থাকতেন। এছাড়া নল-দময়ন্তীর পুরাণগাথা জড়িয়ে রয়েছে এই অরণ্যে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, চিলাপাতার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেকটাই।
নিবিড় জঙ্গলে অবস্থিত বিখ্যাত নলরাজার গড়টি দেখার মতো। প্রাচীন স্থাপত্য ও পুরাকীর্তির বনেদিয়ানা এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মতে দুর্গটি গুপ্তযুগে নির্মিত। পরবর্তী পাল যুগেও দুর্গটি কার্যক্ষম ছিল। অন্য মতে, ভুটান রাজাদের আগ্রাসন থেকে রক্ষার নিমিত্ত কোচ রাজার সৈন্যরা এই সুরক্ষিত দুর্গে থাকতেন এবং বানিয়া নদী দিয়ে যাতায়াত করতেন। গাছের গায়ে টাঙানো জলদাপাড়া বন্যপ্রাণ বিভাগের নোটিশ বোর্ডে লেখা, নলরাজার গড়ের কাগুজে নাম ‘মেন্দাবাড়ি গড়’। ইংরেজরা বলতেন ‘চেচাকোটার গড়’। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এই অঞ্চলের যুদ্ধের তথ্য যথাক্রমে তবক্য-ই-নসিবী ও মার্কোপোলোর বিবরণীতে পাওয়া যায়।
একদা নলরাজার গড়ের চারদিকে চারটি প্রবেশদ্বার ছিল। ইট-নির্মিত তোরণ, সুদৃঢ় প্রাচীর, গবাক্ষ, কার্নিশ, খিলান, কুলুঙ্গি প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ এই গড়। নলরাজার গড়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বানিয়া নদী। বন্য আদিমতায় গা ছমছমে পরিবেশে নলরাজা গড়ের ধ্বংসাবশেষ পঞ্চম শতকের গুপ্তযুগের মহান স্বর্ণযুগের অতীত ইতিহাসকে উসকে দেয়।




 
        
    
