আট বছরের মাথায় আবার একটা ফ্ল্যাট। গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে একেবারে সাততলায়। ছোটো প্রমোটারের, বস্তির পাশ থেকে সরকার-মিলিওনেয়ারের জয়েন্ট ভেঞ্চার। ইএম বাইপাসে বেঙ্গল-ডিসুজার ‘স্বর্ণলতা’ আবাসন। বারো বছরের পুরোনো, কিন্তু অরুণালোকের ঠিক চাহিদা মতো।
আট বছর আগে, নতুন ফ্ল্যাট জীবনের প্রারম্ভে, পরেও সৃজা নিজস্ব বাড়ির পক্ষে ওকালতি ছাড়েনি। তখন কুড়ি লাখে একটা বাড়ি কেনা সম্ভব ছিল না। এখনও না। দাম বেড়ে তিনগুন হয়েছে। তাই ফ্ল্যাটের পক্ষে যুক্তিগুলো মেনে নিয়ে বত্রিশ লাখে আটশো স্কোয়ার ফুট, সাততলায়। ঝুটঝামেলা কম। ব্যালকনি থেকে দেখা যাবে— সবুজ দারুচিনি দ্বীপ!
দশ বছর আগে গ্রামের শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে কলকাতা চলে আসে সৃজা। এক মেয়ে এক ছেলে। অরুণালোক এক কামরা ঘরে ভাড়া থাকত। পালটে দু’-কামরা ঘর নিল। শুরু হল জলের সমস্যা। অন্য ভাড়াটিয়াদের সঙ্গেও বনল না। আরও ভালো পরিবেশে, আরও ভালো ঘর ভাড়া নিতে যা খরচ— অরুণালোক বলল, ‘তার চেয়ে হাউসিং লোন নিয়ে ছোটো ফ্ল্যাট কিনে ফেলি। ঘরভাড়ার খরচে ইএমআই হয়ে যাবে।’
ডাবল বেড, ডাইনিং-কাম-ড্রইং, কিচেন সবই ঠিক, কিন্তু বাজেটে না থাকায়, দু’টো ব্যাপারে ওদের আপোশ করতে হয়েছিল— এক- গ্রাউন্ড ফ্লোর; দুই- একটা বাথরুম। বাথরুমের বিষয়টা ব্যক্তিগত থেকে গেলেও গ্রাউন্ড ফ্লোরের নিরাপত্তাহীনতা ছড়িয়ে পড়ল সৃজার বাপের বাড়ি, অরুণালোকের অফিস, অন্যান্য পরিচিত ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে। আরও এক লাখ পারলে একই সাইডে দোতলায় ফ্ল্যাট হতো ওদের। অরুণালোক রাজিও ছিল, ‘হোয়াইট’ মানি হলে ব্যাংক থেকে আরও লোন নিতে পারত, ডেভেলপার চাইল ‘ব্ল্যাক’-এ।
গ্রাউন্ড ফ্লোর শুনে কেউ কেউ বলত, ‘ভালো করেছ। সিঁড়ি ভাঙা নেই, পাম্প খারাপ হলে উপরে জল তোলার সমস্যা নেই। বোরিং লাগলে চট করে বাইরে এসে একটু পায়চারি করতে পারবে।’
অরুণালোক বা সৃজা যুক্তি খণ্ডন করে বলত, ‘হলেও গ্রাউন্ড ফ্লোরে উলটোপালটা অনেক বেল বাজে। একটু কোথাও বেরোলেও জানলা বন্ধ করে যেতে হয়। ল্যাপটপ, জামা-কাপড় চুরির ভয়।’
গ্রাউন্ড ফ্লোর শুনে যারা বলত, ‘কেন উপরে পেলে না? তাদের সমস্যা না শুনিয়ে ওরা সুবিধার কথা বেশি বেশি বলত। যেমন—গ্রাউন্ড ফ্লোর হলেও পনেরো ফুট ছেড়ে প্রাচীর। দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবধি রোদ। বাতাস খেলে। বাইরেটা ব্যবহার করতে পারি। পিছনে ব্যালকনি কেটে গেট বানিয়ে নিয়েছি, ইচ্ছে হলে চেয়ার পেতে বসা যায়। সামনেই কেয়ারটেকারের ঘর। এক ডাকে হাজির। তবু হিতাকাঙ্ক্ষীরা সন্তুষ্ট হয় না। বলে, “তাছাড়া কলকাতায় যা সব ঘটনা শুনি, কেয়ারটেকারকেই বা ভরসা কী!’
অরুণালোক তখন গলা চড়িয়ে জয় ঘোষণা করত, ‘সন্তোষপুরের মতো এলাকায় আড়াই হাজার টাকা স্কোয়ার ফিট, ভাবা যায়! আমি তো প্রথমে ওয়ান বেডরুমের ফ্ল্যাটের কথা ব্রোকারকে বলেছিলাম। তবে চারজনে একটা বাথরুম এই যা প্রবলেম।’
বাইরের লোক যে যাই বলুক বা বাইরের লোককে যাই বলা হোক অরুণালোকেরা এই ফ্ল্যাটে খুশি নয়। এই ‘বিধান অ্যাপার্টমেন্ট’-এর সামনের ফ্ল্যাটগুলো বেশ বড়ো। বিশেষকরে ড্রইং-কাম-ডাইনিং বড়ো হওয়ার জন্য যথেষ্ট খোলামেলা হয়েছে।
সবচেয়ে কম দামের ফ্ল্যাট আমরা নিলাম, এই হীনমন্যতাবোধ প্রতিপদে কুরে খেতে লাগল সৃজাকে। অরুণালোক সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, “থাক না। প্রায় শূন্য হাতে হাউসিং লোন নিয়ে একটা তো কিনলাম। এটাই ভাড়ায় নিলে মাসে আট হাজার টাকা লাগত। পনেরো বছর ভাড়া গুনলে কত টাকা হিসেব করো। তাছাড়া ভাড়া তো আর সবসময় এক থাকত না, বাড়ত। অথচ নিজের কোনও দিনই হতো না। অল্পদিন গ্রাম থেকে কলকাতায় এসে সাধারণ একটা চাকরির উপর নির্ভর করে একটা ফ্ল্যাট কেনা কি সহজ কথা! আমরা কোথায় ছিলাম, কোথায় এসেছি— সেটা তো ভাবতে হবে। আমার বয়সটাও দেখো, এখানে সবার চেয়ে কম।’
কথাগুলো তো ঠিকই, সৃজা ভাবে। তবু ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। শুধু তো ফ্ল্যাট কেনা নয়, সাজানোরও বিরাট খরচ আছে। ‘বিধান অ্যাপার্টমেন্ট’-এ ছটা কার স্পেস। সৃজার ইচ্ছা ছিল একটা কিনে রাখে। হয়তো একদিন গাড়ি হবে। তিনটে প্রথমেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। ক্রমে চার নম্বর, পাঁচ নম্বর। সৃজা মনে মনে চাইছিল
ছ’-নম্বরটা যেন অন্য কেউ না কেনে। একদিন সে ওটা কিনবে। যখন সেটাও বিক্রি হয়ে গেল, বেশ কিছুদিন মন খারাপ ছিল সৃজার। অরুণালোককে অপদার্থ মনে হয়েছিল। মেজাজ খিটখিটে হয়েছিল।
ছ’শো স্কোয়ার ফুটের একটা ফ্ল্যাট হল তো মন মতো সাজানো গেল না। অথচ এই ফ্ল্যাট কেনার আগে ভাড়া বাড়িতে থাকতে ঘর সাজানোর কথা বললে অরুণালোক বলত, ‘এ ঘর আর কী সাজাব। ফ্ল্যাট কিনি তারপর দেখো।’ ফ্ল্যাট কেনার পরও নানা বাহানা। ‘এই ধারগুলো আগে শোধ করি।’ ঋণ কমল তো বলল, ‘এবার রেজিস্ট্রিটা করি। তারপর মিউটেশন, বকেয়া ট্যাক্স, ছেলে-মেয়েদের স্কুলের খরচ— সে নানা ফিরিস্তি।’ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আসবাবও ভরে উঠল। আহামরি কিছু নয়। মেগা সিরিয়ালের মতো সাজানো নয়, যেমনটা আরও কয়েকজনের আছে।
মন মতো ফ্ল্যাট হল না, গ্যারেজ হল না, ঘর সাজানোও যেমন তেমন। সৃজার খোঁচা খেয়ে অরুণালোক আবার বলত, ‘দাঁড়াও না এবার দশতলায় ফ্ল্যাট কিনব। নো মশকুইটো, নো ফ্রগ, নো স্নেক, নো থিফ, নো ড্যাকোইট।’
মশার সমস্যা তো জানা কথা, গ্রাউন্ড ফ্লোরে দু’-একটা ব্যাঙ আসাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু কলকাতা মহানগরের কেন্দ্রে বাস করে সাপকে ভয় পেতে হবে ভাবা যায়নি। নিকাশি নালা গিয়েছে কাছ দিয়ে। সেখানে ঢোঁড়া জাতীয় সাপ দেখা যায়। কিন্তু ঝোপঝাড় ভর্তি পাশের প্লটে যে সাপ আছে—সেই সাপ একটাই ফ্ল্যাট বেচে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। অরুণালোকও বুঝতে পারল আজীবন এ ফ্ল্যাটে থাকা যাবে না। তখনই লাখ সাতেক টাকা বেশি খরচ করতে পারলে এখানেই মন মতো ফ্ল্যাট হতে পারত। কিন্তু তখন সাত লাখ এক্সট্রা বের করার মতো সামর্থ্য ছিল না।
বেতন বাড়ছিল, কমছিল সুদের হার। অরুণালোক আবার শুরু করল যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ। একদিন হঠাৎ-ই চোখ আটকে গেল বেঙ্গল-ডিসুজায়। বাড়ি-বাজারের বিজ্ঞাপনের ভিড়েও চকচক করে উঠল— ‘জলের দরে’।
ভদ্রমহিলা বাপের বাড়ির কাছে নিউটাউনে ফ্ল্যাট কিনে শীঘ্র উঠে যাবে। অরুণালোক ব্যাংক-এ কথা বলল। নো প্রবলেম।
প্রথম ফ্ল্যাটে আসার আগে যেমন তুলনা চলত— -দু’-কামরা বনাম তিন-কামরা, ভাড়া বনাম ইএমআই, জলের প্রবলেম বনাম ওভার-ফ্লো…। এবারও তেমনই শুরু হল— একতলা বনাম সাততলা, সিঁড়ি বনাম লিফট, তিন বনাম চার কামরা, সাপ বনাম ঘুড়ি-লাটাই।
দুই
আবার গোছগাছ। আবার যা যা মূল্যবান মনে হয়েছিল তার অনেক কিছুকে মূল্যহীন করে ফেলে যাওয়া। ভাড়াবাড়ি থেকে প্রথম ফ্ল্যাটে আসার সময় বেমানান বলে অনেক কিছু আনা যায়নি। এবারও অরুণালোক বলে, “না না এসব ফেলে দাও। ছড়িয়ে দাও। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘উদ্বাস্তু’ কবিতার মতো।’
সৃজা বলল, ‘থাক, এটা মামণির অন্নপ্রাশনের জামা।’
অরুণালোক মুচকি হাসল।
সৃজা ছেলের জামা হাতে নিয়ে বলল, ‘থাক, এটা মাত্র দু’বার পরেছে। একেবারে নতুনের মতো আছে।’
অরুণালোক আবার হেসে বলল, ‘না না, সাততলার ফ্ল্যাটে ভার বাড়িয়ে লাভ নেই।’
সৃজার মতো অরুণালোকও কোনও বই বা ম্যাগাজিন হাতে থমকে যেত। কোনটা অর্ধেক পড়া হয়েছে পরে পড়বে বলে সময় হয়নি বা খুঁজে পায়নি।




 
        
    
