সুমন এখান থেকে মুক্তি চায়। এখানে আকাশের গায়ে কথারা দানা বাঁধে না। এখানে এসে কবিতার দল তাকে ছেড়ে গিয়েছে। কিন্তু পালাবার পথ নেই। আজকাল কিছু ভালো লাগে না। গত কয়েকদিন পিয়ালির মিলনের ডাক উপেক্ষা করছে সুমন। বারবার গায়ের জোরে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে পিয়ালিকে। এইভাবে সে আর মিলিত হবে না। এমন পরিস্থিতিতে এখানকার মেয়েরা প্রশাসনকে জানাতে পারে। তখন কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি হয় পুরুষটির। কিন্তু সুমন ভালোবাসা চায়। ভালোবাসাবিহীন যৌনতায় লাভ নেই। অবশ্য পিয়ালি কাউকে কিছু জানায়নি।
সেদিন মেডিটেশনের সময় একটা ঘটনা ঘটল। তখন পিয়ালি বাড়ি ছিল না। হঠাৎ বহুদূর থেকে একটা ডাক শুনতে পেল সুমন।
—সুমন শুনতে পাচ্ছিস?
ওই গলা শুনেই সুমন আনন্দে লাফিয়ে উঠল। এই কণ্ঠস্বর তার কাকার। মানসিক তরঙ্গ দিয়ে যোগাযোগ করেছে তার সঙ্গে।
—শুনতে পাচ্ছি কাকা।
—শোন সেদিন আমার একটা ভুলে তুই ব্ল্যাক হোলে পড়ে গিয়েছিলি। অকস্মাৎ ইউনিভার্সাল বোসন পার্টিকলের ভাইব্রেশনের কম্পাঙ্ক বদলে গিয়েছিল। তাই ব্ল্যাক হোল খুলে যায়। তখন তুই ঘরে থাকলে তোর কিছু হত না। আমি অনেক কষ্ট করে মানসিক তরঙ্গ দিয়ে তোকে খুঁজে বের করেছি।
—মা কেমন আছে কাকা?
—ও কথা পরে হবে। শোন ওখানকার হিসেবে আজ থেকে সাতদিন পর আবার ব্ল্যাক হোল খুলবে। এনার্জি ইমপাল্স রিডারের রিডিং সেই কথাই বলছে। তৈরি থাকিস। ওটাই তোর ফিরে আসার রাস্তা।
সেদিন অকস্মাৎ কী হয়ে গেল সুমনের ভিতর। তার ভিতরে তখন কত সুখ। পিয়ালি বাড়ি ফিরেছিল তাড়াতাড়ি। তবে সুমনের কাছে আসেনি। সেদিন সুমন নিজেই পিয়ালিকে আক্রমণ করল। পিছন থেকে অকস্মাৎ ওর বুকে হাত রাখল সুমন। হঠাৎ এমন আক্রমণে হকচকিয়ে গেল মেয়েটি। জীবনে এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম। পুরুষ এমন ভাবে বলিষ্ঠ হাতে আক্রমণ করবে এ পিয়ালি ভাবতেও পারে না।
—এই, পিয়ালির প্রথম শিৎকার।
সমস্ত নিয়ন্ত্রণ তখন সুমনের হাতে। মিলন কাকে বলে পিয়ালিকে শেখাল সুমন। প্রথমবার অনাবিল সুখে ভেসে গেল ওরা।
পরদিন প্রশাসন থেকে মেয়েরা এসেছিল। এখনও সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়নি। পিয়ালি পুরুষ বদলাবে কিনা জানতে চাইল ওরা। কুড়ি হাজার সাতশো তার পুরুষটাকে বদলাতে রাজি হল না। তারপরের দিনক’টা সুমনের কাটল বড়ো আনন্দে। এই ক’দিন পুরুষসুলভ স্বাভাবিকতায় ও নিজেই এগিয়ে গেছে। নীরব আত্মসমর্পণ করেছে মেয়েটা। গুঙিয়েছে, সুমনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। চুমু খেয়েছে তীব্র আশ্লেষে। ফেরার আনন্দে তখন সুমন মশগুল।
পাঁচদিন পর পিয়ালি জানাল, যুদ্ধ বাধতে চলেছে। তাকে যুদ্ধে যেতে হবে। সে মারা গেলে সুমন অন্য কোনও মেয়ের কাছে জায়গা পাবে। সুমন জানে পিয়ালি না থাকলেও তার কিছু না। ব্ল্যাক হোল খুলে গেলেই সে ফিরবে পৃথিবীতে। সেখানে স্থানকালের হিসেব আলাদা।
দু-দিন পর যুদ্ধ শুরু হল। লেগেছে পাশের দেশের সঙ্গে। তারা অযাচিত ভাবে হানা দিয়েছে এদেশের সীমানার ভিতর। তারা এদের জমি কেড়ে নিতে চায়।
এখানকার দেশগুলো খুব ছোটো ছোটো। প্রাচীন পৃথিবীর মতো। এখানকার সমাজতাত্ত্বিকদের মতে, দেশ ছোটো হলে শাসন করতে সুবিধা হয়।
যুদ্ধের দিন সীমান্তে একটা বড়ো ময়দানে মুখোমুখি দাঁড়াল দুই দল। দুই দল উলঙ্গ মেয়ে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছে। এক তরফে আক্রমণকারী হানাদার মেয়েদের দল। অপর দিকে এদিকের মেয়েরা।
দু-পক্ষের সেনা জমায়েত বেশ বড়ো। এখানে খালি হাতে যুদ্ধ হয়। তাই দূর থেকে যুদ্ধ দেখা যায়। ময়দান থেকে নিরাপদ দূরত্বে একটি ঢিবির উপর গিয়ে দাঁড়াল সুমন। তার মতো এখানকার আরও অনেক ছেলে যুদ্ধ দেখতে এসেছে। জুল জুল চোখে তাকিয়ে আছে ছেলেরা। তাদের চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। তাদের অনেকেরই ঘরের মেয়েরা রয়েছে ময়দানে।
এক সময় উভয় তরফ থেকে বিউগলের মতো বাজনা বাজল। যুদ্ধ শুরু। প্রথমে উভয় তরফ থেকেই শুধু প্রথম সারির মেয়েরা পরস্পরের মুখোমুখি হল। একের বিরুদ্ধে এক লড়াই। অপরপক্ষ যথেষ্ট মল্লযুদ্ধ পটু এবং শক্তিশালী। এইপক্ষের সবক’টা মেয়েকে ওরা মেরে ফেলল। এবার উভয় তরফের দ্বিতীয় সারির পালা। কিন্তু সেই লড়াইতেও এইপক্ষের মেয়েরা দাঁড়াতে পারল না। ওরা সবাইকে মেরে ফেলল। এবার গেল তৃতীয় সারি। পিয়ালি নামল ময়দানে। মনের মধ্যে কেমন একটা উৎকণ্ঠা অনুভব করল সুমন। এই প্রথমবার। অন্য ছেলেরা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রয়েছে।
কিছুক্ষণ লড়াইয়ের পর আবার এইপক্ষের মৃত্যুমিছিল শুরু হল। সুমন খেয়াল করল পিয়ালিকেও কোণঠাসা করে ফেলেছে তার প্রতিদ্বন্দ্বী। একটি ঢিবির কাছে নিয়ে গেছে পিয়ালিকে। আর হয়তো কিছুক্ষণ। মেয়েটি নিশ্চিত মেরে ফেলবে পিয়ালিকে।
ঠিক তখনই একটা আবছা কণ্ঠ। সুমনের কাকা। ‘সুমন তাড়াতাড়ি। ব্ল্যাক হোল খুলছে। এনার্জি ভাইব্রেশনের কম্পাঙ্ক বদলাচ্ছে। তাড়াতাড়ি ব্ল্যাক হোলে ঢুকে পড়।”
আশ্চর্য হয়ে নিজের থেকে কয়েক হাত দূরে, একটা কালো গহ্বরকে খুলে যেতে দেখল সুমন। এই সুযোগ। ওদিকে পিয়ালি ততক্ষণে ধরাশায়ী হয়েছে মাটিতে। হঠাৎ মনের ভিতর কেমন যেন ঝটকা দিল সুমনের। বুকে যেন কীসের ঝড় উঠল! মনের ভিতর ও কীসের অনুরণন! সুমন লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ল ওদের দু’জনের মাঝখানে। পিয়ালির প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য কমান্ডো ট্রেনিং নেওয়া সুমনের একটা আঘাত যথেষ্ট। সুমনের একটা ঘুষিতে ঘুরে পড়ে গেল মেয়েটি। আর উঠল না।
এই আশ্চর্য ঘটনায় চমকে গিয়েছিল যুদ্ধরত মেয়েরা। যুদ্ধ থামিয়ে তারা হাঁ করে তাকিয়ে ছিল এইদিকে। ঘোর কাটিয়ে অপরপক্ষের দু’জন মেয়ে তেড়ে এল এইদিকে। তবে সুমনের পরের আঘাতে ওদের একজন ধরাশায়ী হতেই অপরজন পালাল। এই দৃশ্য দেখে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদের মধ্যে কী হল কে জানে! তারা রে রে করে ময়দানের দিকে ছুটে আসতে লাগল। অপরপক্ষের মেয়েদের ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া তখন শুরু হয়ে গেছে।
তখনই আবার কাকার গলা। ‘সুমন আর তিরিশ সেকেন্ড বাকি। কুইক।”
পিয়ালিকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়েই ব্ল্যাক হোলে ঝাঁপ দিল সুমন। এখানে কে আর আছে মেয়েটার। কুড়ি হাজার সাতশোর ঠোঁটে তখন মৃদু হাসি। চোখের কোলে দুটো টলটলে মুক্তো। এই জীবনে প্রথমবার। আজ থেকে আকাশের গায়ে আবার কথারা দানা বাঁধবে।





