অনুভা বিরক্ত বোধ করছিল। শহরে গাড়ির সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। গাড়ি চালানো দায় হয়ে পড়ছে। আর পার্কিং স্পেস পাওয়া একপ্রকার প্রায় অসম্ভব। হাসপাতালের পার্কিং লট-এও ঘুরে ঘুরে এতক্ষণে গাড়ি পার্ক করতে পারল অনুভা। এত সব কিছু ভাবতে ভাবতে সে হাসপাতালের সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল।

দোতলায় অনুভার বান্ধবী কাম সহকর্মী ভারতী ভর্তি রয়েছে। কিডনির পাথর অপারেশন হয়েছে গতকাল। আজ অনুভা ওকে দেখতে এসেছে।

ভারতীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে কেবিনটার চারপাশে চোখ বোলাল অনুভা। ভারতীকে নিয়ে মোট তিনজন পেশেন্ট রয়েছে। একজন তার মধ্যে বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলছে, অপরজন চুপচাপ বিছানায় বসে। অনুভার সেদিকে দৃষ্টি পড়তেই খেয়াল করল মহিলাও একদৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওরও চেনা মনে হল। মনে করার চেষ্টা করল অনুভা। মহিলার চোখদুটোও কেমন জানি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল হয়ে উঠল অনুভাকে দেখে, যেন বহুদিন পর হঠাৎ করে পরম কোনও আত্মীয়র সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে।

দুজনেই দুজনের মনোভাব পড়ার চেষ্টা করে। হঠাৎ-ই অনুভার বিস্মৃতির পরদা সরে গিয়ে পুরোনো কিছু মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মনে মনে চমকে ওঠে অনুভা। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় ওই মহিলার বিছানার কাছে। অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে, ‘নিভা না?’

ম্লান হাসি ফুটে ওঠে মহিলার ঠোঁটে, ‘চিনতে পেরেছ আমাকে?’

‘তুমি এখানে এই অবস্থায়?’ অনুভা কিছুতেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এক মুহূর্ত চুপ থেকে আবার বলল, ‘তোমার কী হয়েছে? আমি তো ভাবতেই পারছি না কোনওদিন তোমাকে এই অবস্থায় দেখতে পাব। কি চেহারা ছিল আর এখন কি চেহারা হয়েছে তোমার। কী করে এমন হল?’

বসে বসে বোধহয় হাঁপিয়ে উঠেছিল নিভা। ক্লান্তিও বোধ করছিল নিশ্চয়ই, অনুভাকে অনুরোধ করল খাটের পিছনের দিকটা উঠিয়ে দিতে যাতে পিঠটা বালিশে এলিয়ে দিতে পারে। ইশারায় অনুভাকে পাশে রাখা চেয়ারটায় বসতে বলল।

‘অনুভা, আমি জানি অনেকগুলো প্রশ্ন তোমার মনে এসে জমা হয়েছে… বুঝতে পারছি না কী করে সবগুলোর উত্তর দেব আর একদিনে এত কথা বলাও যাবে না… হাঁপিয়ে যাই… ফুসফুসের সমস্যা আমার।’

‘তোমার হয়েছে কী, সেটা বলবে?’ অধৈর্য হয়ে ওঠে অনুভা।

‘একটা রোগ হলে তো বলব… যখন একবার দেখা হয়েছে তখন জানতেও পারবে সবকিছু। রোজ এসে আমার কথা শোনার সময় আছে তোমার কাছে?’ ব্যাকুল শোনায় নিভার কণ্ঠস্বর।

‘হ্যাঁ, আমি আসব’, নিভাকে দেখে অনুভার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছিল। ওর খালি মনে হচ্ছিল, জগৎ সংসারে নিভা ছাড়া ওর যেন আর কেউ নেই এবং বেশিদিন ও নিভাকে নিজের কাছে ধরে রাখতে পারবে না। অনুভা, নিভার হাতটা নিজের হাতে চেপে ধরে।

নিভার শরীরে শিহরণ জাগে, নতুন আশার সঞ্চার হয়। এত যুগ বাদে অনুভার কথা শুনে ওর মনে হয় আজও ওর খেয়াল রাখার জন্য কেউ অন্তত আছে। বাঁচার ইচ্ছে হয় নতুন করে।

অনুভা চারপাশটা দেখে আবার প্রশ্ন করে, ‘তোমার সাথে কেউ আছে… মানে তোমাকে দেখাশোনার… তোমার বাড়ির কেউ?’

নিভার দীর্ঘশ্বাস কানে যায় অনুভার, ‘না। কেউ নেই।’

‘কেন বাড়ির লোকজন?’

‘অনুভা, যারা আমার নিজের ছিল তাদের আমি অনেক আগেই ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি, আর জীবনের চলার পথে যাদের আমি নিজের বলে মনে করে নিয়েছিলাম তারা আমাকে মাঝ রাস্তায় ছেড়ে চলে গিয়েছে। এখন আমি সম্পূর্ণ একাকী। নিজের বলতে কেউ নেই আমার। আজ কত বছর পর তোমার সঙ্গে দেখা। মনে হচ্ছে আবার সেই পুরোনো দিনগুলোয় ফিরে গেছি। এটা কি স্বপ্ন অনুভা… তুমি আবার আসবে তো?’

‘হ্যাঁ, নিভা। আমি আবার আসব। শুধু দেখা করার জন্য নয়, দেখাশোনা করারও তো কাউকে চাই… তোমার হাসপাতালের খরচা কে দিচ্ছে?’

ম্লান হাসিটা আবার নিভার ঠোঁট ছুঁয়ে মিলিয়ে যায়, ‘আছে একজন ভালোবাসার লোক। কিন্তু আমার এই অসুখটার জন্য আমার থেকে সে এতটাই দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছে যে হাসপাতালে আমাকে দেখতে একদিনও আসেনি। চাকর গোছের একটা লোককে পাঠিয়ে দেয় যে,

দু-তিনদিন অন্তর এসে হাসপাতালের টাকা আর যা-যা দরকার দিয়ে যায়। ফলে আমার চিকিৎসা ঠিকঠাকই চলছে। আমার ভালোবাসার বদলে এই উপকারটা ও আমার করে যাচ্ছে।’

অনুভা সেদিন তাড়াতাড়িই নিভা আর ভারতীকে বিদায় জানিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়ে আসে কারণ অফিস থেকে ছুটি নিয়েই ও ভারতীকে দেখতে গিয়েছিল সুতরাং অফিসে ফেরার দরকার ছিল। অফিসে কিছু কাজে মন বসাতে পারল না। খালি নিভার মুখটা মনে পড়ছিল আর কলেজের দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।

একই বিষয় ছিল কলেজে ওদের দুজনের। দুজনেই শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে। অনুভার বাবা ছিলেন আইএএস অফিসার আর নিভার বাবা আর্মিতে উচ্চপদস্থ পদে ছিলেন। দুজনেই বন্ধু ছিলেন এবং কলেজে অনুভা এবং নিভার বন্ধুত্ব বেশ গাঢ় হয়। অনুভা ছিল ঘরোয়া এবং পারিবারিক সংস্কার মেনে চলার মতো মানসিকতা ছিল অনুভার। অথচ নিভা ছিল ঠিক বিপরীত। সমস্ত নিয়মবিরুদ্ধ কাজ করাই ছিল নিভার চরিত্রের বিশেষত্ব। সম্ভবত আর্মি লাইফস্টাইলের স্বাচ্ছন্দ্য এবং স্বাধীনতায় পরিবেশে বড়ো হওয়ার জন্য নিভার স্বভাব এইভাবেই গড়ে উঠেছিল।

নিভার স্বপ্ন ছিল বড়ো অফিসার হওয়ার। অনুভার জানা ছিল না নিভা বাস্তবে কতটা সাফল্য পেয়েছে। তবে নিভা বরাবরই বিয়ে করার বিরুদ্ধে ছিল কেননা ওর মনে হতো বিয়ে মানেই অপরের দাসত্ব করা। তখন মাঝেমধ্যে লিভ ইন রিলেশনশিপ নিয়ে কলেজের আড্ডাগুলোয় ঝড় উঠত। নিভা-কে সেখানে ব্যাপারটাকে সাপোর্ট করতেই দেখেছে অনুভা। এছাড়াও অনুভা জানত কলেজের দুই তিনজন ছেলের সঙ্গে নিভার ঘনিষ্ঠতার কথা।

অনুভা নিভাকে বহুবার বুঝিয়েছে লাইফ-টা এইভাবে নয়ছয় না করার জন্য কিন্তু নিভা এতে অনুভাকে উপহাসই করেছে। শেষে অনুভাই হেরে গিয়ে সরে গিয়েছে। কলেজ শেষ করে দু’জনে আলদা হয়ে নিজেদের পথ বেছে নিয়েছে। অনুভা সরকারি পরীক্ষায় পাস করে আজ কেন্দ্রীয় সরকারে অফিসার পদে বহাল। ভালো পরিবারে বিয়ের পর এখন অনুভা দশ বছর বয়সি মেয়ের মা। অথচ এই পনেরো বছরে নিভার কোনও খবরই অনুভার কাছে ছিল না। সুতরাং ওর-ও মনে প্রবল আগ্রহ ছিল জানার এতগুলো বছর নিভা কীভাবে কাটিয়েছে যে আজ ওর এই দুর্দশা।

পরের দিন অফিস করে অনুভা হাসপাতাল যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ল। স্বামী আর মেয়েকে আগেই বলে রেখেছিল দেরি করে বাড়ি ফিরবে। অনুভা-কে দেখেই নিভার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, হয়তো ও ভেবেই বসেছিল অনুভা আসবে না। ফল নিয়ে গিয়েছিল অনুভা। মাথার কাছে রাখা টেবিলটায় নামিয়ে রেখে টুল-টা টেনে বসল নিভার সামনে। ওর হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আজ কেমন শরীর তোমার?’

হাসি ফুটে উঠল নিভার মুখে। আনন্দের হাসি। উত্তর দিল, ‘মনে হচ্ছে এবারের মতো বেঁচে যাব।’

রাতে হিমাংশু বাড়ি ফিরলে, অনুভা নিভার কথা সব খুলে বলল স্বামীকে। পরের দিন ওরা দু’জনেই হাসপাতালে গেল নিভাকে দেখতে। হিমাংশু নিভার ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে ওর শরীর সম্পর্কে খোঁজখবর করতে জানতে পারল, নিভার শুধুমাত্র ফুসফুস নয়, অত্যধিক মদ্যপান এবং স্মোকিং-এর জন্য ওর কিডনি এবং লিভারও ক্ষতিগ্রস্ত। অনুভাও নিভা সম্পর্কে অতশত জানত না, হিমাংশুর মুখ থেকে সব জানতে পেরে ও বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল।

এরপর থেকে অনুভা নিয়মিত নিভার দেখাশোনা আরম্ভ করে দিল। বাড়ি থেকে খাবার বানিয়ে অফিস বেরোবার আগে নিভাকে দিয়ে আসত। অফিস ফেরত-ও হাসপাতাল হয়ে বাড়ি ফিরত। ওর জন্য আলাদা করে আয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল অনুভা। এছাড়াও ডাক্তারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হিমাংশু বজায় রেখে দিয়েছিল, ফলে চিকিৎসাটাও সঠিক দিশায় মোড় নিল।

প্রায় একমাস লেগে গেল নিভার মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠতে। ডাক্তার জানাল ওকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যেতে পারে তবে ওষুধপত্র এখন চলবে।

বাড়ি যাওয়ার দিন অনুভা আর হিমাংশু দুজনেই এল হাসপাতালে নিভার সঙ্গে দেখা করতে। হঠাৎই অনুভার মনে হল নিভা এখনও যথেষ্ট সুন্দরী যদিও অসুস্থ অবস্থায় থাকাকালীন নিভার চেহারা এতটা মনোযোগ দিয়ে দেখেনি অনুভা। তবে উদাস মনে হল নিভাকে। অনুভা জিজ্ঞেস করল, ‘বাড়ি যাচ্ছ… এত মনমরা হয়ে বসে আছো কেন? তোমার তো খুশি হওয়া উচিত।’

উদাস দৃষ্টি মেলে ধরল নিভা, ‘বাড়ি… কার বাড়ি? আমার কোনও বাড়ি নেই।’

‘কেন? তোমার সেই বন্ধু যে তোমার চিকিৎসা করাচ্ছিল…’

ম্লান হাসির রেখা ফুটে উঠল নিভার ঠোঁটে, ‘যে মানুষ আমাকে দেখতে একটিবারও হাসপাতালে এল না, যে জানে আমার শরীরটা তার আর কোনও কাজে আসবে না, সেই লোকটা আমাকে তার বাড়িতে রাখবে?’

‘তাহলে ও কেন তোমার চিকিৎসা করাচ্ছিল?’

‘এই একটাই উপকার ও করেছে। হয়তো আমার ভালোবাসার ঋণটা ও এইভাবে মিটিয়ে ফেলতে চেয়েছে। লোকটা খুব ধনী। একটা অসুস্থ রোগীকে বাড়িতে রেখে ওর কী লাভ যেখানে টাকা ছড়ালেই এমন শয়ে শয়ে সুন্দরী মেয়েরা ওর কাছে এসে ভিড় করবে। আমি নিজেও ওর কাছে ফিরে যেতে চাই না কারণ পুরুষ সমাজ-টাকে আমি ভালো করে চিনে নিয়েছি। যদি কোনও মেয়েদের আশ্রম থাকে, আমি সেখানেই যেতে চাই’, আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে কথাগুলো বলে নিভা হাঁপাতে থাকে।

অনুভাও একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায়। কী করবে বুঝতে না পেরে হিমাংশুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। পরক্ষণেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দৃঢ় কণ্ঠে বলে, ‘ঠিক আছে তোমাকে কোথাও যেতে হবে না, তুমি আমার বাড়িতে থাকবে।’

‘তোমার বাড়িতে?’ বিশ্বাস করতে পারে না নিভা নিজের কানকে।

‘হ্যাঁ, আমার বাড়িতে। ব্যস আর কোনও প্রশ্ন নয়, চলো এবার।’

অনুভাদের চার বেডরুমের যথেষ্ট বড়ো ফ্ল্যাট। একটা রুমে ওরা নিভার থাকার ব্যবস্থা করে দিল। অনুভা আর হিমাংশুর ব্যবহারে নিভা এতটাই অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে ধন্যবাদের একটা শব্দও ওর মুখ থেকে বেরোল না।

আর্মির পরিবেশে নিভা বড়ো হয়েছিল। বাড়িতে মদ, পার্টি এসবের কোনও কমতি ছিল না। বাড়িতে পার্টি না হলেও, রোজই নিভার বাবা ক্লাব থেকে ড্রিংক করেই ফিরতেন। মা-ও পার্টিগুলোতে ড্রিংক করতেন। সুতরাং এই পরিবেশেই নিভা শৈশব পার করে যৌবনে পড়েছিল। এটাই ওর মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। যৌবনে পড়তে পড়তেই নিভার মদ এবং সিগারেটে একটা আসক্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

সরকারি চাকরির জন্য তৈরি হতে কোচিং ক্লাসে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে ছিল নিভার। সেইমতো মা-বাবাকেও জানিয়েছিল নিভা।

‘মা, আমি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে চাই। কোচিং ক্লাসের খোঁজ নিয়েছি। যাদবপুর ইউনিভার্সিটির কাছে।’

ব্যারাকপুর থেকে ‘অত দূরে যাবি রোজ কী করে? কাছে কিছু নেই?’ নিভার মা-কে চিন্তিত শোনাল।

‘ভাবছি ক্লাসের আশেপাশে পিজি-তে থেকে যাব’, নিভা উত্তর দেয়।

‘বাড়ি থাকতে পিজি-তে থাকবি?’

এতক্ষণ নিভার বাবা চুপচাপ সবকিছু শুনছিলেন। এবার স্ত্রী-কে থামিয়ে বলে ওঠেন, ‘বোকার মতো কথা বলছ কেন? রোজ যাতায়াতেই যদি সময় চলে যায় তাহলে পড়বে কখন? এছাড়া ও যথেষ্ট স্মার্ট। ইচ্ছে হলেই বাড়ি চলে আসবে। আমরাও দেখা করতে চাইলে চলে যাব। অসুবিধাটা কোথায়?’

নিভার মা চুপ করে যান। বাপ, বেটি রাজি মানে মেয়েকে কেউ আটকাতে পারবে না, সেটা উনি ভালো ভাবেই জানেন। সুতরাং কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। এক বছরের কোর্সে নিভা ভর্তি হয়ে গেল এবং বাড়ি ছেড়ে পিজিতে থাকতে শুরু করল। নিভা সুন্দরী, স্মার্ট সুতরাং কোচিং-এও ও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল। বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েরাই ওখানে পয়সাওয়ালা পরিবার থেকে। সুতরাং প্রায় দিন পার্টি মজলিস লেগেই থাকত। আর নিভাও ধীরে ধীরে প্রতিটা পার্টির মক্ষীরানি হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে পছন্দের ছেলেদের সঙ্গে রাত কাটাতেও শুরু করল নিভা।

নিভার খবর ওর মা-বাবার কাছেও বেশিদিন চাপা থাকল না। তারা মেয়েকে পিজি ছাড়িয়ে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করলেন কিন্তু মেয়ের এক গোঁ, ‘কোচিং শেষ হলে তারপর বাড়ি ফিরব।’

নিভার মা কঠোর হলেন, ‘নিভা তুমি যা যা করে বেড়াচ্ছ তাতে কি মনে হয় তুমি কোচিং-এর পড়া শেষ করতে পারবে? পড়া শেষ হলেও কম্পিটিশনের জন্য তৈরি হওয়া দরকার। আর তার জন্য পড়াশোনা করতে হবে, ছেলেদের হাত ধরে সারাদিন ঘুরে বেড়ালে কিছুই হবে না।’

‘মা, প্লিজ। বাবাকে একটু বুঝিয়ে বলো। আর তো কটা মাস’, মায়ের কথা না শোনার ভান করে নিভা।

‘না, তা হবে না নিভা। তোমার কথা শুনে তোমার বাবা খুব দুঃখ পেয়েছেন। আমি ওনাকে কিছু বলতে পারব না। তুমি যদি নিজের ইচ্ছে মতো চলতে চাও তাহলে আমরা টাকাপয়সা দেওয়া সব বন্ধ করে দেব। তারপর যা ইচ্ছে হয় তাই কোরো।’

অতএব নিভাকে নিজের বাড়ি ফিরে আসতে হয়। কিন্তু বাড়িতে হাজার প্রতিবন্ধকতা থাকাতে মনে মনে ও অধৈর্য হয়ে পড়তে থাকে। বুঝতে পারত, মা ওর উপর সারাক্ষণ নজর রাখছে।

যারা এতদিন মক্ষীরানিকে ঘিরে ছিল তারাই ওকে প্রলোভন দিতে শুরু করল। বাড়ি ছেড়ে চলে আসলে ওর প্রয়োজনীয় সব কিছু ভার এমনকী থাকা-খাওয়া-অর্থ সব তারাই বহন করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিল নিভাকে।

নিভা বুদ্ধি দিয়ে কোনওকিছুই বিবেচনা কোনওদিন করেনি, আজও তার অন্যথা হল না। একবারও মা-বাবা বা নিজের ভবিষ্যৎ ভাবল না। বন্ধুদের দেখানো প্রলোভনটাই ওর কাছে বড়ো হয়ে দাঁড়াল। একদিন মা-বাবার অনুপস্থিতিতে নিভা নিজের জামাকাপড় এবং সামান্য টাকাপয়সা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে উঠল। বন্ধুরা আগেই ওর জন্য ফ্ল্যাট দেখে রেখেছিল সুতরাং নতুন ফ্ল্যাটে শিফ্ট করতে দেরি লাগল না।

নিভার মা-বাবা নিজেরা যতটা পারলেন খোঁজাখুঁজি চালালেন কিন্তু আর্মি মহলে বদনাম হয়ে যাওয়ার ভয়ে পুলিশে রিপোর্ট লেখালেন না তাহলে হয়তো নিভার খোঁজ পাওয়া অসুবিধা হতো না। আবার এমনও হতে পারে তাঁরা উচ্ছৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্ত মেয়ের জীবন থেকে সরে যাওয়াই সব দিক থেকে শ্রেয় বুঝতে পেরেছিলেন তাই মেয়েকে ফিরে পাওয়ার এবং সঠিক পথে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার আশা পুরোপুরি ত্যাগ করেছিলেন।

 

নিভাও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পার্টি, নতুন নতুন বন্ধু নিয়ে ফ্ল্যাটে রাত কাটানো, এই ধরনের উচ্ছৃঙ্খল জীবনে নিজেকে অভ্যস্ত করে তুলল। তার শরীরের দুর্নিবার আকর্ষণে ধনী পরিবারের ছেলেরা ওর শরীরের বিনিময়ে ওর সব খরচ নিজেরাই বহন করে দিত। কিন্তু কতদিন চলত এইভাবে? ফুলের মধুও ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করল। একটা দুটো করে মৌমাছি অন্য ফুলে আকৃষ্ট হতে আরম্ভ করল। তাছাড়া কোচিং ক্লাস শেষ হতেই অনেকে পরীক্ষার জন্য তৈরি হওয়ার বাহানায় আসা কমিয়ে দিল বা বন্ধ করে দিল। রসদে টান পড়তেই নিভার চেতনা ফিরল। বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করলেই উত্তর পেত, ‘ব্যস্ততা বাড়ছে, সময় এভাবে আর কত নষ্ট করা যায়? তুই এবার নিজেও কিছু একটা কর কারণ বেঁচে থাকতে টাকার দরকার।’ অনেকেই পরামর্শ দিত, মা-বাবার কাছে ফিরে যেতে যেটা নিভার কাছে অসম্ভব ছিল।

 

কৃষ্ণেন্দুকে নিভা সবথেকে ভালো বন্ধু বলে মনে করত। ওকে একদিন নিভা বলল, ‘কৃষ্ণেন্দু, আচ্ছা বলতো তোদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখার জন্য আমি আমার বাড়ি, মা-বাবা সব ছেড়ে চলে এলাম। আর তোরা এক এক জন করে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিস। এখন তাহলে আমার কী হবে?’

 

‘নিভা, আমি যেটা বলব তোর সেটা শুনতে ভালো লাগবে না। কিন্তু আসল সত্যিটা হল, তুই আমাদের বন্ধুত্বের জন্য নয়, নিজের সুখ এবং স্বার্থের জন্য বাড়ি ছেড়ে এখানে চলে এসেছিস। বিনা স্বার্থে এখানে কেউ কারও জন্য কিছু করে না। স্বার্থসিদ্ধি হয়ে গেলে সবাই সরে যায় যেটা তোর ক্ষেত্রে এখন হচ্ছে।’

কৃষ্ণেন্দুর কথা শুনে নিভার কাঁদতে ইচ্ছে করে কিন্তু কারও সামনে চোখের জল ফেলা নিভার পক্ষে সম্ভব নয়। ভবিষ্যতের কথা ভেবে অবসাদ ঘিরে ধরে নিভাকে। বুঝতে পারে না ও এখন কী করবে?

‘আমি এখন কী করব কৃষ্ণেন্দু?’ কান্নাভেজা স্বরে নিভা প্রশ্ন করে, ‘এ আমি কী করে বসলাম?’

‘যৗবনে বহু মেয়েই এভাবে ভেসে যায় যার জন্য পরে তাদের অনুতাপ, অনুশোচনার অন্ত থাকে না।’

‘কৃষ্ণেন্দু, তুইও তো কোনওদিন আমাকে বোঝাসনি, অথচ তোকেই অমি আমার সবথেকে ভালো বন্ধু বলে মনে করতাম।’

কৃষ্ণেন্দু হাসে, ‘কী বোকার মতো কথা বলছিস নিভা? তুই কোনওদিন কোনও একটা ছেলেকে নিয়ে সন্তুষ্ট থেকেছিস? মদের অভ্যাস এবং সেক্স-এর ক্ষিদে তোর ভেতরকার মানুষটাকে কবেই মেরে দিয়েছে। এক সঙ্গে এতগুলো ছেলের সঙ্গে তোর প্রেমের সম্পর্ক, তো কোন ছেলেটা তোর সঙ্গে নিষ্ঠার সঙ্গে প্রেম করবে বলতে পারিস? সবাই আসলে তোর শরীরটাকে ভোগ করতে চেয়েছে। ভোগ করেছে, ছেড়ে চলে গেছে। সবার সঙ্গেই শুয়েছিস সুতরাং শুধু একটা ছেলের কাছ থেকে সত্যিকারের অটুট সম্পর্কের দাবি তুই কি করে করতে পারিস?’

কৃষ্ণেন্দুর কথাগুলো তিক্ত হলেও কঠোর বাস্তব সেটা নিভা বুঝতে পারছিল। হঠাৎ কৃষ্ণেন্দুর হাত দুটো চেপে ধরে নিভা, ‘কৃষ্ণেন্দু আমি ভুল করেছি। সব বন্ধুরা ছেড়ে চলে গেছে। তুই প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাস না।’

কৃষ্ণেন্দু হাত ছাড়িয়ে নেয়। ‘না-রে নিভা আমার পক্ষে তোর সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। এক বছর আমার নষ্ট হয়েছে। পরীক্ষায় পাস করতে পারিনি, বাড়িতেও সকলে খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছে। এই বছর পাস করতেই হবে, কেরিয়ারের প্রশ্ন। সরি নিভা।’

নিভা এসে আবার কৃষ্ণেন্দুর হাত ধরে, ‘কৃষ্ণেন্দু প্লিজ। আমি সত্যিই তোকে ভালোবাসি। আমি জানি আমার জীবনে বহু ছেলে এসেছে কিন্তু বিশ্বাস কর যখনই মন খারাপ হয়েছে তখনই তোরই কথা মনে হয়েছে। আমাকে এভাবে ছেড়ে যাস না।’

‘বোঝার চেষ্টা কর নিভা। তোকে ছেড়ে না গেলে আমার ভবিষ্যৎ পুরো ডুবে যাবে। আগে আমাকে জীবনে দাঁড়াতে দে।’

‘কৃষ্ণেন্দু, ভালোবাসার ভিক্ষে আমি চাইছি না। চুটিয়ে প্রেম করেছি, সেক্সলাইফ-ও এনজয় করেছি কিন্তু পেটের খিদের কাছে হার মানতেই হয়। আমার অর্থ উপার্জন করার কোনও পথ নেই। আমার ভালোবাসার বদলে এইটুকু উপকার অন্তত করে দে, থাকার জন্য একটা ঘর আর পেট চালাবার জন্য একটা যে-কোনও কাজ। বেশ্যাবৃত্তি আমি করতে পারব না।’ নিভার স্বরে কাকুতি ঝরে পড়ে।

মেয়েটাকে দেখে মায়া হয় কৃষ্ণেন্দুর। আর সকলের মতো মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে না। একটু ভেবে জিজ্ঞস করল, ‘প্রাইভেট চাকরি করতে পারবি?’

‘হ্যাঁ, এছাড়া উপায়ই বা কী আছে?’

‘তাহলে ঠিক আছে। তুই এই ফ্ল্যাটেই থাক। যতদিন না চাকরি হয় আমি ভাড়া দিয়ে দেব। বাবাকে বলে কোথাও একটা তোর চাকরির ব্যবস্থা করছি।’

‘আমি তোর উপকার কোনওদিনও ভুলব না।’ কৃষ্ণেন্দু কিছু একটা ভাবল তারপর বলল, ‘তুই কেন বাড়িতে চলে যাচ্ছিস না কাকু, কাকিমা-র কাছে?’

নিভা, কৃষ্ণেন্দুর কাছ থেকে এই প্রশ্ন আশা করেনি। আশ্চর্য হল, পালটা বলল, ‘কী মুখ নিয়ে যাব? কী বলব ওদেরকে যে এতদিন আমি কী করেছি। না কৃষ্ণেন্দু, আমি ওখানে যেতে পারব না। ওখানে গিয়ে ওদেরকে নতুন কোনও সমস্যায় আমি ফেলতে পারব না।’

কৃষ্ণেন্দু, বাবাকে বলে নিভাকে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ব্যবস্থা করে দিল চাকরির। তবে যে ধরনের লাইফস্টাইলে নিভা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, সেটা মেনটেন করার জন্য চাকরির টাকা যথেষ্ট ছিল না। উদ্দাম সেক্সলাইফ থেকে সরে এলেও নিভা মদ আর সিগারেটে আসক্তি ছাড়তে পারল না। একাকিত্ব ওকে কুরে কুরে খেতে লাগল। মা-বাবার কথা, পুরোনো সব কথা মনে পড়লেই ও মদের বোতল খুলে বসত, সবকিছু ভুলতে চাইত।

কৃষ্ণেন্দু যখনই আসত, নিভার অবস্থা দেখে ওকে সাবধান করার চেষ্টা করত, ‘এত খাস না নিভা, অসুস্থ হয়ে পড়বি।’

‘ভীষণ ভয় করে কৃষ্ণেন্দু, একাকিত্ব আমাকে গ্রাস করতে আসে’, নিভার চোখ ছলছল করে।

‘ভালো কথা বলছি নিভা, এভাবে একা একা থাকিস না। বাড়ি ফিরে যা। দেখবি কাকু-কাকিমা তোকে ঠিক ক্ষমা করে দেবেন’, কৃষেন্দু বোঝানোর চেষ্টা করে।

নিভার সেই একই উত্তর, ‘কোন মুখে ফিরব ওদের কাছে? ওরা আমাকে নিয়ে কী কী ভেবেছিল আর আমি কি হয়েছি… ক্ষমা হয়তো করে দেবে ঠিকই কিন্তু সমাজে তারা মুখ দেখাবে কী করে?’

‘কেন, এখনও তো তারা সমাজে মেলামেশা করছেন, তখনও করবেন’, প্রত্যুত্তরে বলে কৃষ্ণেন্দু।

‘হয়তো তারা আমাকে মৃত ভেবে নিয়েছেন। তুই ওদের চিনিস না। ওরা যদি আমাকে ক্ষমাই করে দিত তাহলে এতদিনে আমাকে ঠিক খুঁজে বার করত। এটা এমন কিছু মুশকিলের ছিল না। বরং আমার মনে হয় ওরা পুলিশে রিপোর্ট পর্যন্ত লেখাননি।’ কৃষ্ণেন্দুর এত বোঝানোর পরেও নিভার সেই একই গোঁ।

এরপর ধীরে ধীরে কৃষ্ণেন্দুর আসাও কমতে লাগল যত পরীক্ষা কাছাকাছি আসতে আরম্ভ করল। কৃষ্ণেন্দুর পরীক্ষাও দেওয়া হয়ে গেল এবং যথারীতি সিভিল সার্ভিস-এর পরীক্ষায় পাস করে গেল।

লখনউ-তে ট্রেনিং সুতরাং কৃষ্ণেন্দু নিভার সঙ্গে দেখা করে বিদায় জানাতে এল।

নিভা ভিতরে ভিতরে পুরোপুরি ভেঙে পড়ল এবার, ‘তুই এবার পুরোপুরি আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছিল। আর কোনওদিন কি আমাদের দেখা হবে কৃষ্ণেন্দু?’

‘নিভা, এক বছরে মানুষের মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসে। ট্রেনিং চলাকালীন আমি আর আসতে পারব না। এভাবে জীবনটা নষ্ট করিস না। যতটা নীচে নামার নেমেছিস, এবার উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা কর। অফিসে ভালো স্যালারি পাচ্ছিস, কাউকে বিয়ে করে সংসারে মন দে। আমি যতটা পারব সাহায্য করব।’

নিভা উত্তর দিল না। কৃষ্ণেন্দু লখনউ চলে গেল। চিন্তা করাও ছেড়ে দিল নিভা, সময় এবং ভবিতব্যের হাতে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে দিল। যারা নিভাকে চিনত তারা বেশ বুঝতে পারল নিভা নিজেকে শোধরাবার কোনও চেষ্টাই করছে না, বাঁচার ইচ্ছেটাই যেন ও ছেড়ে দিয়েছে।

এই ভাবেই কয়েক বছর কেটে গেল। কৃষ্ণেন্দু ভালো ভাবে সেটেল করে গেল। মাঝেমধ্যে শহরে এলেও ইচ্ছে করেই হয়তো নিভার সঙ্গে দেখা করত না কিন্তু প্রত্যেক মাসে নিভার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দশ হাজার করে টাকা জমা করে দিত যাতে নিভার কোনওরকম অসুবিধা না হয়।

নিভা বিয়ে করবে না ঠিকই করে নিয়েছিল। ও ভালো করেই জানত কৃষ্ণেন্দুকে ও কোনওদিনও পাবে না কিন্তু মনে একটা আশা টিমটিম করে জ্বালিয়ে রেখেছিল। অপেক্ষা যত লম্বা হচ্ছিল নিভার মদের মাত্রা ততই বাড়তে থাকছিল। একদিন কানে এল, কৃষ্ণেন্দু বিয়ে করে নিয়েছে। সামান্য আশাটুকুও ভেঙে গেল নিভার। মদ আর সিগারেটে নিজেকে পুরোপুরি ডুবিয়ে দিল ও। ওর এমন অবস্থা হল, রোজ অফিস যাওয়াটাও ওর পক্ষে সম্ভবপর হতো না।

সরাসরি কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে ওর আর কোনওরকম সম্পর্ক ছিল না। কৃষ্ণেন্দুর বাবার ঠিক করে দেওয়া একটা চাকর গোছের লোক নিভার খোঁজখবর নিতে আসত। ওর কাছ থেকেই নিভা কৃষ্ণেন্দুর কথা জানতে পারত আর সম্ভবত ওই, কৃষ্ণেন্দুকে নিভার সব খবর জানাত।

অতিরিক্ত মদ এবং সিগারেট খাওয়ার ফলে নিভা অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগল। কৃষ্ণেন্দুর বাবার চাকর প্রায় রোজই আসত ওকে দেখতে। ওরই সামনে একদিন নিভার রক্তবমি হল। ওই নিভাকে সঙ্গে নিয়ে এসে সরকারি হাসপাতাল ভর্তি করে দিল।

মেডিকেল রিপোর্টে ধরা পড়ল অত্যধিক মদ এবং সিগারেট খাওয়ার জন্য নিভার কিডনি, লিভার, ফুসফুস সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষ্ণেন্দু ওই লোকটির মাধ্যমে হাসপাতালের সব খরচ বহন করতে লাগল কিন্তু একটিবারও নিভাকে দেখতে নিজে হাসপাতালে এল না।

চিকিৎসায় কোনও ঘাটতি রাখতে দেয়নি কৃষ্ণেন্দু ঠিকই কিন্তু ভালো ভাবে চিকিৎসা চলতে থাকলেও নিভার উপকার খুব একটা হচ্ছিল না ডাক্তাররা বেশ বুঝতে পারছিলেন। ওর মনের বোঝাটাই শরীরের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শরীরের জন্য নয়, মনের কষ্টটাই ওকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছিল ধীরে ধীরে। নিভার যখন এই অবস্থা, ঠিক তখনই আশীর্বাদের মতোই নিভার জীবনে অনুভার প্রবেশ। নিভার নতুন জীবনের সূত্রপাত অনুভার হাত ধরেই সুস্থ হয়ে নিভা অনুভার বাড়িতে এসে গেল ঠিকই কিন্তু একটাই অস্বস্তি ওর মনের মধ্যে খচখচ করে বিঁধতে লাগল, কতদিন এভাবে আশ্রিত জীবনযাপন করবে?

মহাভারতে যক্ষের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারায় যুধিষ্ঠিরের কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের একে একে মৃত্যু বরণ করে নিতে হয়েছিল। ঠিক সেরকমই নিভার জীবনেও একটাই প্রশ্নের কোনও উত্তর ছিল না। এরপর কী হবে নিভার জীবনে? পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে অসুখে ভুগে নিভার সৗন্দর্যের ধার অনেকটাই কমে এসেছিল, চাকরিও চলে গিয়েছিল আর কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গেও সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।

অনুভার স্বামী হিমাংশু সরকারি দফতরে উঁচু পদে ছিলেন। তিনি চেষ্টা করে নিভাকে একটি সংস্থার কাজ জুটিয়ে দিলেন। সংস্থাটি অনাথ বাচ্চাদের দেখাশোনা এবং শিক্ষাদানের কাজ করত। আরও কিছুদিন অনুভার কাছে থেকে অনুভার চেষ্টাতেই নিভা একটা ছোটো ফ্ল্যাট খুঁজে নিল। ঘরদোর মোটামুটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়ে নিয়ে অনুভাকে সঙ্গে করে নতুন ফ্ল্যাটে চলে এল নিভা। দু’দিন নিভার কাছে কাটিয়ে অনুভা নিজের বাড়ি ফেরার জন্য তৈরি হয়ে নিল।

‘আমি আবার একা হয়ে যাব, অনুভা।’

‘না, তুমি একলা নও। আমরা সবাই তোমার সঙ্গে আছি। আগে স্বার্থসিদ্ধির জন্য তেমার সো-কলড বন্ধুরা তোমাকে ঘিরে থাকত, তাই তোমার পতনটাও তাড়াতাড়ি হয়েছিল। এখন তোমার জীবনের একটা লক্ষ্য রয়েছে, বাচ্চাদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরি করা। লক্ষ্য স্থির রেখে যদি অতীতের কথা চিন্তা করো তাহলে দেখবে একা রাস্তা চললেও কখনও ভুল রাস্তায় পা ফেলবে না’, অনুভা আশ্বাস দেয়।

লজ্জা পেয়ে নিভা মুখ নামিয়ে নেয়। অনুভা ওর মুখটা তুলে ধরে। নিভার চোখে জল। বহু বছর পর নিভার চোখ থেকে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...