সম্পর্কের এই টানাপোড়েনের দায় কার? মা না যৌবনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা তার মেয়েটির? এভাবে ভাবলে হয়তো পারিপার্শ্বিক সমাজ-কেও কিছুটা দায়ভার গ্রহণ করতে হবে বই-কি। মেট্রো শহরগুলিতে মেয়েদের সেফ্টি-টাও অবহেলা করার নয়। রোজই নানা ঘটনা ঘটছে।  এখন কিন্তু উঠতি বয়সি মেয়েদের নিয়ে মায়েরা অনেক বেশি সচেতন। তার কারণও আছে। সব বাড়িতেই প্রায় বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েরা একটু যেন বেশি উগ্র স্বভাবের। অদ্ভুত একটা চাপানউতোর তাদের চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশেপাশে তাকালেই বোঝা যায়, ব্যবহারে নম্রতা হারিয়ে ফেলছে আজকের নতুন এই প্রজন্ম। কাঠিন্যের বর্মে সহূদয় কোমল প্রাণ আজ শৃঙ্খলবদ্ধ।

বয়সের তুলনায় শারীরিক এবং মানসিক ভাবে একটি মেয়ে যেন খুব তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে উঠছে এবং এর জন্য বর্তমান সামাজিক পরিবেশ কিছুটা হলেও দায়ী। তাদের ম্যাচিওরিটি লেভেল খুব তাড়াতাড়ি বাড়ছে, ফলে অভিভাবকেরা চিন্তিত হতে বাধ্য।

সাধারণত বয়ঃসন্ধির সময়টাতে একটি মেয়ের সৌন্দর্য সবচাইতে বেশি আকষর্ণীয় হয়ে ওঠে। জীবনীশক্তিতে ভরপুর মেয়েটির তখন একটাই লক্ষ্য, সঠিক সুযোগ এলেই ডানা মেলে উড়ে যাওয়ার। অথচ মানসিক ভাবে তখনও কিন্তু সে প্রায় সদ্যোজাত শিশু, সবেমাত্র পা ফেলে দাঁড়াতে শিখছে। সুতরাং চলার পথে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। গন্তব্য কী সেটাও সঠিক জানা নেই। আপামর জনসাধারণের চোখে নিজের পরিচিতিকে সুষ্ঠু করতে গিয়ে ভুল পথে পা বাড়িয়ে বসে, যার ফলাফল মাঝেমধ্যে ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায়। যার জন্য নিজেও দুঃখ পায় এবং মা-বাবাও পরিবারেরও অসম্মানের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

যৌবনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ের মানসিকতাকে বোঝাটা খুব দরকার তার অভিভাবকদের। কারণ এই সময়টা তাদের জীবনের একটা কঠিন অধ্যায় এবং বেশিরভাগ টিনএজাররা প্রায় একই রকম মানসিকতার মধ্য দিয়ে এই পুরো সময়টা অতিবাহিত করে।

বয়ঃসন্ধির মেয়েরা নিজেদের প্রাপ্তবয়স্ক প্রমাণ করে দেখাতে সাধারণত নিজেদের শরীরকে ব্যবহার করে বসে। প্রাণপণ চেষ্টা করে বড়োদের কপি করতে এবং এর শুরুটা হয় সাজগোজ দিয়ে এমনকী ‘যৌনতা-কেও কাজে লাগাতে তারা দ্বিধা করে না। কাজটা ভালো না লাগলেও তারা ভেবে বসে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার এটাই বুঝি একমাত্র পাসপোর্ট। এই বয়সটাতে না তারা তাদের থেকে বয়সে ছোটোদের সঙ্গে মিশতে পারে কারণ ম্যাচিওরিটির তারতাম্য, আবার প্রাপ্তবয়স্করাও তাদের নিজেদের দলে ঢোকাতে নারাজ। ফলে একাকিত্ব, ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয় তারাই সব থেকে বেশি। জীবনের গাড়িকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জ্বালানি মজুত থাকলেও অভিজ্ঞতার অভাবে সঠিক দিশা তারা নিশ্চিত করতে পারে না।

এই পরিস্থিতিতে বাড়ির বড়োদের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়া শুরু হয় মেয়েটির। অভিভাবকেরা ভালো কিছু বললেও সেটা ডিফাই করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যদি তর্ক করার কোনও কারণ না থাকে তাহলেও তারা একটা কারণ তৈরি করে নেয় নিজেরাই।

সমস্যা সমাধানের উপায়

হাত বাড়ালেই বন্ধু। ঠিক এই বন্ধুর স্থানটাই মা-কে নিতে হবে। সাহায্য এবং পরামর্শ-র জন্য সন্তান যদি অভিভাবককে পাশে না পায়, তাহলে অন্য কারও কাছে সে সাহায্যের প্রত্যাশা করতেই পারে। এই অন্য কারও বলতে, কোনও সুযোগসন্ধানী টিনএজার ছেলে অথবা প্রাপ্তবয়স্ক কোনও লোক হতে পারে যে-কিনা সুযোগ পেয়েই মেয়েটির ক্ষতি করতে পারে। অভিভাবককে নিজের ব্যবহার সংযত রাখতে হবে। মেয়ের কোন ব্যবহার সঠিক এবং কোনটি ভুল সেটা বুঝিয়ে বলতে হবে এবং নিজের ডিসিশনে ফার্ম থাকাটা একান্ত প্রয়োজন। এর জন্য পরিবারে শৃঙ্খলা রাখাটাও খুব দরকার। সাধারণত মায়ের থেকেই মেয়ে সামাজিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা লাভ করে। বয়ঃসন্ধিক্ষণে ভুল হওয়াটা অসম্ভব নয় এটা অভিভাবককে বুঝতে হবে এবং সেই ভুল-টা মেনে নেওয়ারও সৎ সাহস নিজেদের মধ্যে তৈরি করতে হবে। পরিস্থিতি এমন ভাবে সামলে নিতে হবে যাতে মেয়ের না মনে হয়, মায়ের আদর্শ লঙঘন করার জন্য তাকে কোনওভাবে শাস্তি দেওয়ার চক্রান্ত করা হয়েছে।

কখনও কখনও পরিস্থিতির সঙ্গে আপস করার দরকার পড়ে বড়োদেরও। ছোটো ছোটো জিনিসে সময় ও শক্তির অপচয় করা অনুচিত। আবার কিছু জিনিসের সঙ্গে আপস করা চলে না যেমন বন্ধু নির্বাচন, যৗনতা, পার্টিতে কী ধরনের আচরণ করছে এবং মদ ও ড্রাগের প্রতি আসক্তি। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার অবস্থা হলে মেয়ের বাবাকে পরিস্থিতি সামলাবার দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ মেয়ের সবথেকে কাছের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষটি হল তার ‘বাবা’।

কিছুটা প্রাইভেসি টিনএজার মেয়েকে দিতে হবে কারণ এটা খুবই সংবেদনশীল জায়গা। মেয়ে নিজেকে বড়ো ভাবতে শুরু করলেও তার মনের মধ্যে সব সময় একটা ভয় থেকেই যায় যে, কেউ ওর উপর লক্ষ্য রেখেছে।

ভাবার চেষ্টা করতে হবে মেয়ে যেটা করছে সেটা কেন করছে। নিজেকে প্রশ্ন করুন, ‘আমি কি প্রয়োজনের চেয়েও বেশি সতর্ক? আমি কি যথেষ্ট সময় দিচ্ছি মেয়েকে? ডিসিপ্লিনের ক্ষেত্রে আমি কি বেশি সহজ? মেয়ের প্রতি আমার প্রত্যাশা কি অনেক বেশি? মেয়ের সঙ্গে যত বেশি সময় কাটাবেন তত বেশি ভালো করে মেয়েকে বুঝতে পারবেন।

মেয়ে যদি কোনও ভুল করেও ফেলে, তাহলে সেটাই তার পতনের সূচনা এই বোধ, এই অনিশ্চয়তা মেয়ের মনে যাতে না আসে, মা-কে তার খেয়াল রাখতে হবে। কোনটা ভুল সেটা বুঝিয়ে দেওয়াটা মায়ের দায়িত্ব যাতে মেয়ে দ্বিতীয়বার সেই ভুল না করে। প্রয়োজনে সব সময় তার পাশে থাকুন, যদি সে ভুলও করে থাকে। এমনিতেই ভুল করলে তার মনে হতে থাকে সবাই বুঝি তার বিরোধী হয়ে উঠেছে ভুল করার জন্য। এই দলে তার মা-বাবাও আছে এই বোধ যেন তার মনে না আসে এটা দেখার দায়িত্ব কিন্তু মায়ের। মেয়ের মনে যদি ঢুকে যায় একটা ভুল করে সে সকলের কাছে নীচ প্রতিপন্ন হয়েছে এবং এই অসম্মান থেকে বেরোনো আর তার পক্ষে সম্ভবপর নয়, তাহলে মনে রাখবেন এই হার শুধু আপনার মেয়ের নয় আপনাদের উভয় স্বামী-স্ত্রী-রও। এটা প্রমাণ করবে যে আপনারা এই পরিস্থিতি সামলাতে অসমর্থ।

মেয়ের প্রশংসা করুন, তাকে উৎসাহ দিন কিন্তু কিছু করার জন্য তাকে বাধ্য করবেন না। পরিবারের একজন হিসেবে তাকেও মতামত প্রকাশ করার অধিকার দিন। বাড়ির পরিবেশ এমন রাখুন যেখানে মেয়ে তার বন্ধুদের নিয়ে আসতে গর্ববোধ করবে। যদি মেয়ের কাছে তার বাড়ি মনের মতো জায়গা হয়ে ওঠে তাহলে তাকে এখানে-ওখানে সময় কাটাবার জন্য ভাবতে হবে না। মা-বাবার তার প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা, সম্মান আছে বুঝতে পারলেই, বাড়ি তার কাছে আকষর্ণীয় হয়ে উঠবে।

স্বভাবে নম্র, ভদ্র ভালো একটি সন্তান যার অভিভাবকেরাও অত্যন্ত ভালো, হঠাৎ করে সে ‘খারাপ-এ পরিণত হতে পারে না। সন্তানের সঙ্গে সুস্থ, স্বাভাবিক ভালো সম্পর্ক যদি ধরে রাখা যায় তাহলে তার সামান্য ভুল বা অশোভন আচরণ বড়োদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করবে না। সুতরাং প্রপার গাইডেন্স-এর মাধ্যমে ভুল পথে চলে যাওয়া টিনএজার মেয়েকে সঠিক রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে আসতে পারে তার মা বা তার অভিভাবকেরা।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...