মায়ের সঙ্গে সন্তানের নাড়ির বন্ধন। শিশুর জন্মের পর প্রথম যখন তাকে মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তখনই মাতৃমনে সন্তানের সঙ্গে অটুট বন্ধনেরও সূচনা হয়। সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনের মানসিকতা তৎক্ষণাৎ জন্ম নেয় মায়ের মনে। এরজন্য একজন মা-কে আগে থেকে পড়াশোনা বা ট্রেনিং নিয়ে আসার দরকার পড়ে না। মায়ের মন সন্তানের সব প্রয়োজন নিজেই বুঝে যায়। শুধু নিজের উপর কনফিডেন্স রাখাটা দরকার। নতুন যারা মা হয়েছেন তারা হয়তো ছোটোখাটো ভুলচুকের মাধ্যমে ধীরে ধীরে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। প্রকৃতিই মায়ের মনে এনে দেয় মাতৃত্বের কোমল অনুভূতি। আসুন জানি কীভাবে কনফিডেন্টলি বাচ্চাকে বড়ো করে তুলবেন।

বাচ্চার স্নানের সময়

অনেক মায়েরাই নবজাতককে প্রথমবার স্নান করাতে গিয়ে ভয় পান অথচ নবজাত শিশুকে স্নান করানোর সঠিক পদ্ধতি জানা থাকলে কাজটা সাবধানের সঙ্গে খুব সহজেই সেরে ফেলা যায়। স্নানের নিয়ম

১)       বাথটাব-এ বাচ্চাকে স্নান করানো উচিত এবং খেয়াল রাখা উচিত টাব যেন খুব গভীর না হয়

২)       ঈষদুষ্ণ জলে বাচ্চাকে স্নান করান। জলের উষ্ণতা মাপার জন্য নিজের কুনই দিয়ে আগে জলটা চেক করে তারপর বাচ্চাকে ওই জলে স্নান করানো বাঞ্ছনীয়

৩)      প্রথমে হুড়হুড় করে বাচ্চার মাথায় জল না ঢেলে বাচ্চার গায়ে জলের ছিটে দিন। তারপর ধীরে ধীরে একটু একটু করে জল ঢালুন

৪)       বাচ্চাদের জন্য তৈরি প্রোডাক্ট-ই ওদের জন্য ব্যবহার করুন। খেয়াল রাখতে হবে ওতে যেন প্যারাবেন্স, এসএলএস অথবা এসএলইএস-এর মতো তত্ত্ব না থাকে

৫)       বাচ্চার কানে বা নাকে যাতে জল না ঢোকে খেয়াল রাখতে হবে

৬)      সরাসরি বাচ্চার মাথায় জল ঢালবেন না। শিশুর ঘাড়ের নীচে হাত রেখে হাত দিয়ে জল তুলে ধীরে ধীরে মাথা ধুইয়ে দিন। জোরে জল ঢাললে মাথায় আঘাত লাগতে পারে

৭)       স্নান করানো হয়ে গেলে তোয়ালে দিয়ে শিশুর শরীর পুরো জড়িয়ে নিন এবং ত্বক ভালো করে মোছানো হয়ে গেলে লোশন লাগিয়ে দিন

বাচ্চা অতিরিক্ত কাঁদলে

অনেক সময় বাচ্চা কাঁদতে আরম্ভ করলে বাচ্চাকে চুপ করানো মুশকিল হয়ে যায়। তিনমাস বয়স পর্যন্ত বাচ্চা কোনও কারণ ছাড়াও কাঁদতে পারে। ওই সময় কোলে তুলে বাচ্চাকে একটু ঘোরালেই বাচ্চা চুপ করে যায়। যদি তাতেও তার কান্না বন্ধ না হয় তাহলে খিদে পাওয়া, ডায়াপার নোংরা হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যাও হয়ে থাকতে পারে। সুতরাং সেই খেয়ালও মা-কে রাখতে হবে।

অনেক সময় খিদে পেলে বাচ্চা কাঁদতে থাকে। খাওয়া শেষ হলে কাঁধের উপর ফেলে বাচ্চাকে ঢেঁকুর তোলানো উচিত, যাতে বাচ্চার পেটে গ্যাস জমতে না পারে। গ্যাস জমলেও বাচ্চার পেট ব্যথা করে। অনেক সময় ঢেঁকুর তোলানো সত্ত্বেও বাচ্চা তারপরেও কাঁদতে থাকে কারণ অল্প সময়ের ব্যবধানে বাচ্চার খিদে পেতে থাকে। বাচ্চার খাওয়ার সঠিক সময় কী, খেয়াল রাখাটা খুব জরুরি।

এছাড়াও আরও কয়েকটি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে

১)       বাচ্চার ডায়াপার সম্পূর্ণ ভিজে গেলে বাচ্চা অস্বস্তি বোধ করতে থাকে এবং বাচ্চা ঘুমোতে পারে না, কাঁদতে থাকে। তাই কিছু সময় বাদে বাদে ডায়াপার চেক করাটা খুব জরুরি। ভিজে ডায়াপার বদলে দিলেই বাচ্চা শান্ত হয়ে যাবে

২)            কখনও কখনও ভিজে ডায়াপারে বাচ্চাকে অনেকক্ষণ রাখলে বাচ্চার ত্বকে র‍্যাশ বেরোয়। জায়গাটা ব্যথা করে এবং চুলকায়। সুতরাং র‍্যাশ বেরিয়েছে কিনা চেক করাটা খুব দরকার। ন্যাপি বদলাবার সময় জিংকঅক্সাইড যুক্ত ন্যাপি ক্রিম, লাগানো উচিত

৩)      ছয় থেকে আট মাসের মধ্যে বাচ্চার নতুন দাঁত গজায়। সেই সময়ও বাচ্চার শারীরিক কিছু সমস্যা হয়, যার ফলে বাচ্চা কান্নাকাটি করে

৪)       অনেক সময় বাচ্চা এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে, কীসে সে আরাম পাবে কেউই সেটা বুঝে উঠতে পারে না। এই সময় মায়ের কোলই তার বিশ্রামের সঠিক জায়গা। মায়ের কোলে গেলেই সে একমাত্র নিশ্চিত হয়ে ঘুমোতে পারে

বাচ্চার সারারাত জেগে থাকা

নবজাত শিশু সাধারণত সারারাত জেগে থেকে দিনে ঘুমোয়। অনেক বাচ্চা আবার দিনেও ঠিক করে ঘুমোয় না, আবার রাতেও জেগে থাকে। ফলত বাচ্চার মা-বাবাকেও বাচ্চার সঙ্গে জেগে থাকতে হয়। কোনওরকম অসুবিধাবোধ করলেও বাচ্চা জেগে থাকে। কী অসুবিধা হচ্ছে বাচ্চার সেটা মা-কেই বুঝে নিতে হয়।

কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখুন

১)           রাত্রে বাচ্চা বহুবার ঘুম থেকে উঠে পড়ে খিদের জন্য। তখন বারবার বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে হয়। একবারে অনেকটা দুধ বাচ্চা খেতে পারে না। ব্রেস্টপাম্পের সাহায্যে মায়ের দুধ স্টোর করে সারারাত ধরে সেটা বাচ্চাকে খাওয়ানো যেতে পারে। এতে মায়েরও খানিকটা বিশ্রাম হয় আর বাচ্চাকেও খিদের জ্বালা সহ্য করতে হয় না

২)       বিশেষ কোনও খেলনা বা চাদর বা অন্য কিছু নিয়ে যদি বাচ্চার শোয়ার অভ্যাস থাকে, তাহলে মা-কে খেয়াল করে সেটা বাচ্চার কাছে রেখে দিতে হবে যাতে শিশুর ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে

৩)      একটি নির্দিষ্ট সময় ধরেই বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানো উচিত যাতে সেটা তার অভ্যাস হয়ে যায়। বড়োদের মর্জিমাফিক বাচ্চার শোবার সময় এধার-ওধার হলে বাচ্চার ঘুমের অসুবিধা হবে

৪)       জ্বর, সর্দি, পেট বা কানে ব্যথার মতো সমস্যার কারণেও বাচ্চার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে সুতরাং সেটাও লক্ষ্য রাখা দরকার

খেলনার প্রয়োজনীয়তা

শিশুর জন্মের পরেই তার মা-বাবা বিভিন্ন ধরনের খেলনা কিনে বাচ্চার ঘর সাজিয়ে তোলে, যাতে প্রতিমুহূর্ত খেলনার সঙ্গে তার সময় কাটে। কখনও শুধু চোখে দেখে বা কানে শুনে অথবা হাতে নিয়েও খেলনার সঙ্গে বাচ্চা সময় কাটায়। প্রথমেই খেলনার কোয়ালিটি যাতে ভালো হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে কারণ বাচ্চার অভ্যাস হয় খেলনা হাতে নিয়েই মুখে পুরে দেওয়া।

টাঙানো যায় এমন খেলনা, যাতে নানা রঙের পশুপাখি ঝোলানো থাকে যেমন ভল্লুক, হাতি, ঘোড়া, টিয়াপাখি ইত্যাদি শিশুর জন্য ভালো। এটা দেখে বাচ্চা খুশিও হয় এবং চোখের মাধ্যমে মনযোগ কেন্দ্রিভূত করাও শেখে।

কোনও কোনও খেলনায় ঘন্টা লাগানো থাকে। বাতাসে দুললে টুংটাং আওয়াজ হয় এবং আওয়াজে বাচ্চা চুপ করে যায়। এছাড়াও কাপড়ের তৈরি নরম খেলনাও বাচ্চাকে দেওয়া যেতে পারে।

মুখ দিয়ে খাবার তোলার অভ্যাস

বাচ্চার তিনমাস বয়স হওয়া পর্যন্ত বাচ্চা কিছু খেলেই সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা খাবার মুখ দিয়ে তুলে দেয়। মায়েরা এতে চিন্তায় পড়ে যান যে এই অভ্যাস কীভাবে বদলাবেন।

এই ক্ষেত্রে বাচ্চার অভ্যাস নয়, বড়োদের নিজেদের অভ্যাস কিছুটা বদলাবার দরকার। বাচ্চাকে দুধ খাইয়ে সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চার সঙ্গে খেলা করা উচিত নয় বা কোলে তুলে নাচাবার দরকার নেই। বরং কাঁধে ফেলে ধীরে ধীরে বাচ্চার পিঠ চাপড়ানো উচিত যাতে দুধ হজম হয়ে বাচ্চার ঢেঁকুর উঠে যায়। অনেক সময় ঠান্ডা দুধ খাওয়ালেও বাচ্চা মুখ দিয়ে দুধ বার করে দেয় কারণ ঠান্ডা দুধ শিশু পছন্দ করে না।

ঘামাচি হলে

গরমের সময় বাচ্চাদের ঘামাচি হতে প্রায়শই দেখা যায়। কিছু সাবধানতা মেনে চললে এই সমস্যা এড়ানো যায়।

১)       গরমের সময় বাচ্চাকে হালকা, ঢিলে এবং নরম সুতির পোশাক পরানো উচিত। ত্বকে ফুটবে, অস্বস্তি হবে এমন পোশাক এড়িয়ে চলুন

২)       বাচ্চার জন্য সব ধরনের ট্যালকম পাউডার ব্যবহার করবেন না। রাইস স্টার্চযুক্ত বেবি পাউডারই খালি ব্যবহার করবেন। এতে র‍্যাশ হবে না

৩)      বাচ্চার যেখানে ঘামাচি হয়েছে সেই জায়গাটা দিনে ২-৩ বার পরিষ্কার জল দিয়ে ধুয়ে দিন বা স্পঞ্জ করে দিন

৪)       সুগন্ধ-যুক্ত সাবান দিয়ে বাচ্চাকে স্নান করাবেন না বা তেল লাগাবেন না। এতে কেমিক্যাল মেশানো থাকে যা বাচ্চার স্পর্শকাতর ত্বকের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক

কনফিডেন্ট হয়ে বাচ্চার মালিশ করুন

১)       বাচ্চার পা থেকে মালিশ শুরু করুন। হাতে তেল নিয়ে থাই থেকে ক্রমশ হাঁটু হয়ে নীচের দিকে টেনে টেনে মালিশ করুন। গোড়ালি, পায়ের নীচেও ভালো করে মালিশ করুন এবং পায়ের আঙুল চক্রাকারে ঘুরিয়ে মালিশ করুন

২)       বাচ্চার বুক, পিঠ, হাত, হাতের আঙুল সব জায়গায় মালিশ করুন

৩)      দুধ খাওয়ার পর বা শোবার সময় বাচ্চাকে মালিশ করবেন না

৪)       মালিশের সময় বাচ্চা কাঁদলে কোলে নিয়ে চুপ করান

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...