কোভিড ১৯, বাস্তবিকই বদলে দিয়েছে আমাদের সামাজিক চিত্র৷ দীর্ঘমেয়াদি দূরত্ব, কর্মহীন হয়ে পড়া, আর্থিক আনিশ্চয়তা, মানুষকে একা করেছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে মানুষ৷নিজেই যেখানে অসুরক্ষিত, আনিশ্চিত পথের পথিক—সেখানে সঙ্গীর দায়িত্ব বহন করা আরওই কঠিন৷

এ যেন হঠাৎ গতিশীলতায় ছেদ। জীবনের গ্রাফটা যখন ঊর্ধ্বমুখী, আমরা সবাই পা রাখছি এক সাফল্য থেকে অন্য সাফল্যে, দ্রুতি, শুধুই এগিয়ে যাওয়া। দম ফেলার ফুরসত নেই, শুধুই একটা লক্ষ্য, একটা অ্যাচিভমেন্ট। কিছু প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে অনবরত ছুটে চলা। এই যখন আমাদের জীবনশৈলী, তখন কে যেন এক অদ্ভুত ঝাঁকুনি দিয়ে থামিয়ে দিল। সব মসৃণতার সেখানেই ছেদ, সেখানেই ছন্দপতন। করোনা, বদলে দিল জীবন, বদলে দিল মানুষ-মানুষে সম্পর্ক।

ধরা যাক আপনি একজন আট বছরের ছেলের পিতা। একদিকে দেশের অর্থনৈতিক ধসে ক্রমশ বিপর্যস্ত হয়ে উঠছেন পকেটের চাপ সামলাতে, অন্যদিকে দেখছেন কীভাবে আপনার শিশুপুত্রটি, কম্পিউটার-এ নিত্যদিন স্ট্রাগল করছে অনলাইন ক্লাসের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে। সে-ও নিঃসঙ্গ হচ্ছে প্রতিদিন একটু একটু করে। কারণ স্কুল মানে তো শুধু বই-খাতা-পড়াশোনা নয়। একটা সামগ্রিক বিকাশ যেখানে আপনার শিশুপুত্র হাসে, খেলে, মন খুলে বাঁচে। বাড়িতে থেকে সে-ও শাসনে-শৃঙ্খলে বিরক্ত। ক্রমশ তিরিক্ষে, জেদি, একরোখা হয়ে উঠছে তার স্বভাব। আপনিও মানসিক চাপ সামলাতে না পেরে কখনও কখনও তার গায়ে হাত তুলে ফেলছেন। নিমেষে বদলে যাচ্ছে পরিবেশ, সম্পর্কগুলো বদ্ধভূমির মধ্যে পাক খেতে থাকছে।

ধরা যাক আপনি কারও প্রেমিকা। না একসঙ্গে থাকার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই হঠাৎই বদলে গেছে পৃথিবী। দীর্ঘ লকডাউন-এ শুরুর দিকে দুজনে স্ক্রিন শেয়ার করেছেন। দুটো বাড়ির দূরত্ব মুছতে পারেনি মনের দূরত্ব। ফোনের দুপ্রান্তে উপচে উঠেছে ইমোশন। পরস্পরকে সামলেছেন যথাসম্ভব কিন্তু সম্পর্কও নৈকট্য চায়। পারস্পরিক চাওয়া-পাওয়ার নিরিখে দাবি তৈরি হয়। শারীরিক উপস্থিতি এক ধরনের অভ্যাস। স্পর্শ এক ধরনের আবেগ আদানপ্রদানের মাধ্যম। করোনা দূরত্ব এনেছে শরীরের এবং মনের। সব স্বাভাবিক ছন্দে ফেরা শুরু করলেও, আপনারা দুজন আর পারছেন না আগের মতো শারীরিক নৈকট্যে সামিল হতে।

ধরা যাক আপনি এক প্রৌঢ়া। ছেলে বিদেশে, মেয়ে অন্য রাজ্যে সংসার। ফোন বা ভিডিয়ো কল কতটা পারে আপনার নিঃসঙ্গতা দূর করতে? আগে দুবেলা হাঁটতে যেতেন পাড়ার পার্ক-এ। সেসবই এখন বিপদের ঝুঁকি কারণ আপনার শরীরে বাসা বেঁধে রয়েছে অনেক অসুখ।

কো-মর্বিডিটির শিকার হলে কাল আপনি হয়তো মৃত্যু মিছিলে একটা সংখ্যা মাত্র। এখন আপনার সঙ্গী ফ্ল্যাটের জানলা থেকে দেখা এক-ফালি ক্যালাইডোস্কোপ আকাশ। ক্রমশ আরও একাকী ও নিঃসঙ্গ হতে শুরু করেছেন আপনি, সৌজন্যে করোনা।

ধরা যাক আপনি একজন স্ত্রী, না, করোনায় আপনি বা আপনার পরিবারের কেউ আক্রান্ত হয়নি। কিন্তু করোনার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আপনাকেও ছাড়েনি। এই ইকনমিক টার্ময়েল-এ আপনার স্বামী কর্মহীন হয়েছেন। গোটা সংসারের বোঝা এখন আপনার উপর। আপনার সাধারণ এই প্রাইভেট স্কুলের চাকরিতে বেতন কমে হয়েছে অর্ধেক। আপনার স্বামী দ্বিতীয় চাকরি পাওয়ার আশায়, এখনও এখানে-ওখানে খবর নিচ্ছেন। বদলে যাচ্ছে বাড়ির পরিবেশ, অর্থনীতি। অশান্তি বাড়ছে, অস্থিরতাও। আর বাড়ছে প্রতিদিনের বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তাও। করোনা শুধুমাত্র একটি ভাইরাস হলেও এর প্রভাব শরীর ছাপিয়ে মনে এবং এখন গোটা সমাজে। ভালো থাকার সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে নিরন্তর। বদলাতে বদলাতে রসায়নটা এখন বেঁচে থাকা আর না থাকার মাঝখানে এসে ঠেকেছে।

নেতিবাচক দিক

গবেষণা বলছে সাম্প্রতিক সময়ের ওই দীর্ঘ লকডাউন-এ মানসিক সমস্যায় আক্রান্তের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে। প্রচুর ডিভোর্স ও ব্রেক-আপও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে শারীরিক নির্যাতন বেড়েছে। ভেঙেছে দাম্পত্যের বনেদ। এটা শুধু ব্রেক আপ-এর যন্ত্রণা নয়। নিদ্রাহীন রাত কেটেছে বহু মানুষের এই সংকটপূর্ণ সময়ে শুধু জীবনযাপন কীভাবে হবে, এই অনিশ্চয়তার কথা ভেবে। প্রতি চারজনের একজন স্বীকার করেছেন, তিনি নিদারুণ ভাবে একা এই লড়াইয়ে ক্রমশ আরও একক হচ্ছেন। এই গভীর ক্ষতি বা ক্ষত আরও কত সুদূরে প্রসারিত হবে কেউ জানে না। ক্লিনিকালি ভালনারেবল যারা, পেনসন-এর উপর জীবন কাটান যারা, সিভিয়ার লাং প্রবলেম-এর সমস্যায় এমনিতেই যারা জর্জরিত, কীভাবে চলবে তাদের, যদি ভাইরাস এভাবে দীর্ঘ, দীর্ঘ সময় ধরে তাদের বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তা তৈরি করে চলে?

প্রতিবার যখন আমরা অন্য ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করি বা কথা বলি, সংক্রমণের সম্ভাবনার দিকে নিজেদের আরও একবার ঠেলে দিই। আর করমর্দন করি না বা বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে ইমোশনাল এক্সচেঞ্জ করি না। শঙ্কা এবং সংকোচ দুই-ই দূরত্ব বাড়ায়। এক্ষেত্রে প্রথমটাই প্রধান। চুম্বন ও ভালোবাসার দিন শেষ। আলিঙ্গন তো আরও দূরস্থান। বিদেশে মুঠি তে মুঠি না ঠেকিয়ে শুধু অভিব্যক্তি দিয়ে পরস্পরকে ভালো থাকার বার্তা দিচ্ছেন মানুষ। নিজেকে বাঁচানোই হয়ে উঠেছে মূল উদ্দেশ্য।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, স্পর্শ এড়ান কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন না। নিজেকে মেলামেশা থেকে দূরে রাখা যাবে না। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডকে মাধ্যম করুন প্রয়োজনে। এই করোনা আউটব্রেক এমনকী এক নতুন অ্যাপ-এরও জন্ম দিয়েছিল যার নাম কোয়ারেনটাইন টুগেদার। এটার রিমাইন্ডার আসে হাত ধোয়ার। আপনি হাত ধুয়েছেন কনফার্ম করলে প্রতিদিন এরা আপনার সঙ্গে আলাপ করায় নতুন সঙ্গীর। ভার্চুয়ালি ডেটিং-এর সুযোগ করে দেয় যাতে আপনি একা না ফিল করেন। এ সত্যিই এক নতুন পৃথিবী, যেখানে রিলেশনশিপ-এর প্রাথমিক শর্ত সেন্স অফ বিলঙিং নেই, পজেসিভনেস নেই, এমনকী রোজকার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়াও নেই। এক অন্তঃসার শূন্যতায় প্রতিদিন এগিয়ে যাওয়া আছে।

ইতিবাচক দিক

যে-লকডাউন পেরিয়ে এলাম আমরা, সেটাকে অবশ্য অনেকে পজিটিভ ভাবেও নিয়েছেন। আত্মবিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে গেছেন।যে-জীবনশৈলীতে তারা অভ্যস্ত ছিলেন, সেখান থেকে ছাঁটকাট করে শুধুমাত্র যে-টুকু প্রয়োজন বেঁচে থাকার জন্য, সেই টুকু রসদে নামিয়ে এনেছেন চাহিদা। নিত্যনৈমিত্তিক জীবন থেকে লাক্সারি একেবারেই বাদ দিয়ে অল্পে সন্তুষ্ট হওয়ার শিক্ষায় হয়তো তারা খুঁজে নিয়েছেন ভালো থাকার মন্ত্র।

কেউ হয়ে উঠেছেন কেয়ার গিভার। নিঃসঙ্গ কোনও বৃদ্ধ-বৃদ্ধার পাশে দাঁড়িয়েছেন। সপ্তাহের বেশ কয়েটি দিন এখন কাটান সেই একলা মানুষকে সঙ্গ দিতে। পার্টি-হইহুল্লোড় থেকে নিজেকে সরিয়ে আনার সংযম মানুষকে নিজের অন্তরের দিকে তাকানোর, নিজের গুণাগুণকে খুঁজে নেওয়া সুযোগ করে দিয়েছে। তাই সবটাই নেতিবাচক নয়। জীবনযাপনের, সম্পর্কের রসায়ন বদলে আমরা এক নতুন সত্ত্বায় আত্মপ্রকাশ করছি। মাস্ক ও স্যানিটাইজারে মোড়া আমাদের এই নতুন জীবন মানসিক ভাবে আত্মনির্ভর হয়ে ওঠার। নিউ নর্মাল পৃথিবী এখন বাস্তবিকই তাকিয়ে আছে কবে  আবার স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফেরা যাবে, সেই দিকেই৷ প্রতিষেধকের আপেক্ষায় আমরাও৷

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...