‘ডিভোর্স! কিছুতেই নয়।’
কাঁপা গলায় সিদ্ধান্ত জানাল রূপম। সবে অষ্টমঙ্গলা পেরিয়েছে। উপহারের প্যাকেটগুলোও সব খোলা হয়নি। ফুরোয়নি আয়োজনের প্রশংসাও। তারই মধ্য ডিভোর্স? আজকাল অবশ্য ডিভোর্স নিয়ে মানুষের সংকোচ অনেকটাই কম। পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনে তাই প্রচুর ডিভোর্সি। আধুনিকমনস্ক মানুষ হতাশা প্রশ্রয় দেয় না, ‘লেটস্ ট্রাই অ্যাগেন’-এ বিশ্বাসী। একবার ফেলিয়োর হয়েছে তো কী? পরের বার নিশ্চয়ই ক্লিক করবে। কিন্তু বাবার সামনে এসব যুক্তি অচল। নিজের পছন্দ করা পাত্রীর সঙ্গে ছেলের বিয়ে টিকল না, কিছুতেই মানতে পারবেন না। আসলে মানতে পারবেন না যে, নিজের সিদ্ধান্তে কোনও গলদ থাকতে পারে। লোকের চোখে জেদি একগুঁয়ে ঠেকলেও, রূপম জানে মানুষটার আত্মবিশ্বাস প্রবল। শুনলেই গুম মেরে যাবেন, আত্মগ্লানিতে জর্জরিত হবেন, তারপর অসুস্থ। দু’বার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গিয়েছে। আর ঝুঁকি নেওয়া যায়?
বিয়েটা হয়েছিল সম্বন্ধ করে, ঘটকমশাইয়ের সৗজন্য। পাত্রী বারাসতের। পালটি ঘর। ঠিকুজি ও রাজজোটক। চার হাত এক হতে দেরি হয়নি। বারাসত থেকে সাড়ম্বরে হাবড়ায় এসে উঠেছিল সালঙ্কারা মৃত্তিকা। তারপর রাজারহাটের ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাট বুকিংটা করেছিল বাবা-ই। স্কুল শিক্ষকের সামান্য মাইনেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। দূরদৃষ্টিতে বুঝেছিলেন, একসময় ছেলের কলকাতায় থাকার প্রয়োজন পড়বেই। তাই কষ্ট হলেও নিয়মিত মিটিয়েছেন কিস্তির টাকা। পড়াশুনায় রূপম বরাবরই ভালো। ক্লাসে ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড হয়নি কখনও। জয়েন্টও এক চান্সেই। তারপর সেক্টর ফাইভে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়র। বিয়ের আগেই ছেলের নামে ফ্ল্যাট লিখে দিয়েছিলেন বাবা। বেশিরভাগের মতো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আঁকড়ে থাকেননি। নিজের জন্য হাবড়ার বাড়িই যথেষ্ট। এইরকম একজন আত্মত্যাগী মানুষ, যিনি সারাটা জীবন ব্যয় করলেন সন্তানের মঙ্গল কামনায়, তাঁকে কেমন করে বলবে ডিভোর্সের কথা? তাও বিয়ে মিটতে না মিটতেই!
প্রথমে রূপম, মৃত্তিকা, কেউই সমস্যাটা বুঝতে পারেনি। ফুলশয্যার রাত যেন ঘোর লাগা। দুজনেরই বিপরীত লিঙ্গের প্রথম সান্নিধ্য। স্বপ্ন, বাস্তব মিলেমিশে একাকার। আদরে, কথায়, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রাত কাবার। পরদিনও বুঝতে পারেনি। তারপরদিনও না। মনে হয়েছিল নতুন-নতুন বোধহয় এরকমই হয়। আনকোরা অভিজ্ঞতায় অনভ্যস্ত শরীর-মনকে বোঝাপড়ার সময় দিতে হয়! প্রথম বুঝল মৃত্তিকা, অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়ি গিয়ে। বান্ধবীদের কাছে তাদের বিবাহোত্তর অভিজ্ঞতা শুনে আশঙ্কা জাগল। ফিরে এসেই লজ্জা, সংকোচ ত্যাগ করে রূপমকে বাধ্য করল আপ্রাণ প্রচেষ্টায়। একবার নয় বারবার। অবশেষে ক্লান্ত অনুনয়, ‘আমি ডিভোর্স চাই’।
ডিভোর্সে সন্মতি না দিলেও চিকিৎসায় সন্মতি দিল রূপম। মেনে নিল নিজের অক্ষমতা। স্বাভাবিক ভাবেই বাতিল হল হনিমুনের প্ল্যান। মৃত্তিকার মায়ের আচমকা শরীর খারাপ অজুহাতের সুবিধে করে দিল। রূপম একাই ফিরে এল রাজারহাটে। খামোখা অফিসের ছুটি নষ্ট করার কোনও মানে হয় না।এই ধরনের সংকটে সাধারণত বন্ধুরাই সহায় হয়। কিন্তু রূপমের এমন কোনও বন্ধু নেই যার কাছে অকপট হওয়া যায়। রাজারহাটে ভালো করে পরিচয়ই হয়নি কারও সঙ্গে। স্কুল-কলেজের বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই বহুদিন। হাবড়ার পাড়াতেও তেমনভাবে মেশেনি কখনও। স্কুল, লাইব্রেরি আর পড়ার টেবিলেই সময় কাটিয়েছে। বাবারও কড়া নির্দেশ ছিল পাড়ায় না মেশবার। সবাই নাকি অপগণ্ড, মিশলে ভবিষ্যৎ দফারফা। নইলে প্রায় সব পাড়াতেই একাধিক যৗন বিশেষজ্ঞ থাকে। রূপমদের পাড়াতেও হয়তো ছিল। তাদেরই কেউ না কেউ নিশ্চিত একটা উপায় বাতলাতো।
বাবাকে বলার প্রশ্ন নেই। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেও তেমন ঘনিষ্ঠ কেউ নেই। থাকলেও নির্ঘাৎ ভ্রু কোঁচকাতো। এ আবার কী উটকো ঝামেলা? ছেলেমেয়ের বিয়ে হলে ক’দিন আমোদ-আাদ করবে, তারপর বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে নিশ্চিন্ত ঘরকন্না। এভাবেই ভাবতে অভ্যস্থ মধ্যবিত্ত আটপউরে মানসিকতা। সাহায্য তো মিলবেই না, অযথা উপদেশ সহানুভূতিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে। তাই ইন্টারনেটের সাহায্য নিল রূপম। অনেক খুঁজে-পেতে বিদেশি ডিগ্রিধারী একজন ডাক্তার নির্বাচন করল। শুরু হল চিকিৎসা। বিস্তর টেস্ট, ওষুধের সঙ্গে সপ্তাহে দু’দিন কাউন্সেলিং। ফল মিলবে মাসখানেক পর। শাশুড়ির শরীর খারাপ সারলেও মৃত্তিকাকে ফ্ল্যাটে আনল না রূপম। বিষাদ প্রতিমা দেখতে কারই বা ভালো লাগে? চিকিৎসার মেয়াদ পূর্ণ হতেই আকুল আহ্বান। সুখী দাম্পত্য সাকার করতে মৃত্তিকাও এগিয়ে এল। কিন্তু বারংবার চেষ্টাতেও সুখ ধরা দিল না কিছুতেই। এবার অনুনয়ের সঙ্গে কান্না, ‘আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট কোরো না রূপম। আমাকে ছেড়ে দাও।’
হার না মানাটা বোধহয় কিছু মানুষের জন্মসিদ্ধ। পাশার দানে সর্বস্ব পণ রাখতেও দ্বিধা হয় না। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মৃত্তিকাকে নিরস্ত করল রূপম। চাইল আরও কিছু সময়। সাময়িক আবেগে ধবংসের স্পৃহা জাগালেও, ঠান্ডা মাথায় স্থির পরিস্থিতি অস্থির করা সহজ কথা নয়। তাই রূপমের প্রস্তাবে রাজি হল মৃত্তিকা।
এবার নতুন ডাক্তার। ট্রিটমেন্ট প্রসিডিওর একেবারেই আলাদা। টেস্ট এবং ওষুধের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই প্রয়োজন। দ্রুত সিদ্ধান্তে পৗঁছোনোর তাগিদে সঙ্গ দিল মৃত্তিকা। ডাক্তার ওষুধের সঙ্গে দিলেন সুখী দাম্পত্যের গাইডলাইন। মেনে চললে অব্যার্থ ফল। নিষ্ঠা সহকারে মানাও হল বেশ কিছুদিন। তবুও দাম্পত্য সুখ অধরাই। এবার গর্জে উঠল মৃত্তিকা, ‘কালই আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।’
চলে গেলেও ফিরতে হল পরদিনই। বাবা নিজে এসে পৗঁছে দিয়ে গেলেন। বাড়ি ছাড়ার কারণটা একজন অপরিণত যুবতির পক্ষে অসামান্য হলেও, অভিজ্ঞ বাপ-মায়ের কাছে ততটা নয়। বাড়ির সন্মান, সমাজ, লোকলজ্জা, অনেক কিছুই ভাবতে হয়। এত সহজে রূপমের মতো পাত্র হাতছাড়া করাও কাজের কথা নয়। তা ছাড়া ডাক্তারি চিকিৎসাই তো একমাত্র উপায় নয়। ঈশ্বর আছেন, গুরুদেব আছেন, আছে শেকড়-কবচ-মহামূল্য রত্নও। পাড়ার গনশা প্রায় পাগলই হয়ে গিয়েছিল, সেরে উঠল তো তন্ত্র-মন্ত্রের জোরেই। বলাইবাবুরা দশ বছর সন্তানসুখ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। গুরুদেবের আশীর্বাদে কোল আলো করে ছেলে এল। তাই মেয়েকে ফেরত পাঠিয়ে মা হত্যে দিলেন ঠাকুরের থানে, গুরুদেবের আশ্রমে, জ্যোতিষদের চেম্বারে। মিরাকেল আজও ঘটে।
ভয়ে বা লজ্জায় মানুষ প্রথমে পিছোতে থাকে। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আক্রমণই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। রূপম নিজের অক্ষমতা মেনে নিয়েছিল সাফল্যের বিশ্বাসে। আপাতত হেরে গেলেও, জিত সময়ের অপেক্ষামাত্র। কিন্তু নিরন্তর চেষ্টা করেও যখন ফল মিলল না, তখন রুখে দাঁড়াল। দায়ী করল মৃত্তিকাকে। মৃত্তিকার অসহযোগিতার জন্যই নাকি চিকিৎসার পূর্ণ ফল লাভ সম্ভব হচ্ছে না। মিথ্যে অনুযোগেও মৃত্তিকা নির্বিকার। ও-বাড়ি থেকে ফিরেই বিদ্রোহের আগুন নিভে গিয়েছে। জানা হয়ে গিয়েছে আজীবন গুমরে মরার ভবিতব্য। তাই রুপম চেষ্টা করতে চাইলে নির্দ্বিধায় সাড়া দেয়। অসাড় সাড়া। নগ্ন, শীতল দেহ এলিয়ে পড়ে থাকা। মৃত্তিকার নিস্পৃহভাব একসময় হিংস্র করে তুলল রুপমকে! কিছুতেই মানতে পারল না সামান্য এক নারীর কাছে পরাজয়ের গ্লানি। শুরু হল নির্যাতন। কখনও যৗন উৎপীড়ন। দু’বাড়ির কেউ জানতেও পারল না, ভরা নদীতে চর পড়ছে।
অত্যাচারে সাময়িক তৃপ্তি মিললেও, পরাজয়ের গ্লানি মোছে না। জেদ বাড়তে লাগল রূপমের। ইতিমধ্যে খান দশেক ডাক্তার পালটেছে। সকলেরই এক রা– স্ট্রেস, স্ট্রেন, অ্যাংজাইটি, টেনশনই মূল শত্রু। গুচ্ছের ওষুধ আর কাউন্সিলিংয়েই মুক্তি। কাউন্সিলিং তো নয়, যেন পুলিশি জেরা। মনটাকে নিয়ে ইচ্ছেমতো ফুটবল খেলা। একসময় বিরক্ত হল রূপম। তা ছাড়া টাকা, সময় নষ্টের ফল কী হচ্ছে, তাও জানার উপায় নেই। মৃত্তিকার মধ্যে সুখ খোঁজা অর্থহীন। মরা নদীতে জোয়ার আসে না।
কাগজে আজকাল নানারকম বন্ধুত্বের আহ্বান। তাদের মধ্যে থেকে কাউকে বেছে নিলেই হয়তো মিলতে পারে সুখের চাবিকাঠি। ভরসা পেল না রূপম। অজানা প্রলোভনে বিপদের সম্ভবনাও কম নয়। মাঝেমধ্যেই খবরের কাগজে স্পা, মাসাজ পার্লারের নানারকম কেচ্ছা বেরোয়। বাড়িতে জানাজানি হলে কেলেঙ্কারির একশেষ। সেদিক দিয়ে সোনাগাছি সুবিধেজনক। খোলা বাজারে ফেলো কড়ি মাখো তেল। আগে কখনও না গেলেও, জায়গাটা চেনা। কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েও গলির ভিতরে ঢোকেনি। প্ররোচনা, প্রলোভনও টলাতে পারেনি পিতৃদত্ত আদর্শ, নৈতিকতা। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে এবার বেপরোয়া হতেই হল। রোগের ভয় থাকলে, সুরক্ষাও আছে। দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে পা বাড়াল সোনাগাছির দিকে।
সোনাগাছিতে ঢুকে চোখ ধাঁধিয়ে গেল রুপমের। একসঙ্গে এত মেয়ে জীবনে দেখেনি। রাস্তায় সার দিয়ে দাঁড়ানো মেয়ের দল। বিভিন্ন বয়সি। পোশোকও হরেকরকম। রুপমের অনভিজ্ঞতা ধরা পড়তে দেরি হল না ওদের অভিজ্ঞ চোখে। শুরু হল ইশারা, ইঙ্গিত, হাত ধরে টানাটানি। কেউ কেউ টোন-টিটকিরিও করল। কুঁকড়ে গেল রূপম। লজ্জা, ভয় যেন একসঙ্গে চেপে ধরতে চাইল। ফিরে যাবে কি যাবে না ভাবতে ভাবতেই, কে যেন কনুইয়ের পাশ দিয়ে হাত গলিয়ে দিল। অচেনা স্পর্শে শিউরে উঠল রূপম। দেখল লাল শাড়ি, লাল ব্লাউজ, খোলা চুলের একটি মেয়ে। ফরসা মুখে লাল লিপস্টিক। যেন লালপরি। লতার মতো জড়িয়ে ধরেছে। রুপম কিছু বুঝে ওঠার আগেই জাদুকণ্ঠে বলল, ‘চলো…’, যেন কতকালের চেনা।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো চলল রূপম। কোথায় যাবে, কত টাকা দিতে হবে, কিছুই জিজ্ঞাসা করার কথা মাথায় এল না। লালপরি নিয়ে চলল রূপকথার রাজবাড়িতে। ব্রিটিশ আমলের জীর্ণ বাড়ি। লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হল দোতলায়। ছোট্ট একটা ঘরের তালা খুলে আলো জ্বালল মেয়েটি। তারপর যাদুকণ্ঠের আহ্বান, ‘ভেতরে এসো…’
নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো এগিয়ে গেল রূপম।
‘জুতো বাইরে… জুতো বাইরে’, জাদুকণ্ঠে ইষৎ ভাটা।
বাইরে জুতো খুলে ঘরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ।
‘টাকা বের করো’, জাদুকণ্ঠ উধাও হয়ে কেঠো ব্যাবসা।
ঘোর কাটল রূপমের। টাকা দিতে হবে জানত, কিন্তু সে প্রসঙ্গ যে প্রথমেই আসবে জানা ছিল না। ভেবেছিল সুখের চাবিকাঠি হাতে ধরিয়ে তারপর টাকা চাইবে। কাঁপা গলায় বলল, ‘কত?’
একটু থমকাল মেয়েটি। আপাদমস্তক রূপমকে জরিপ করে বলল, ‘সাতশো…’
মানিব্যাগ খুলে টাকা বের করে দিল রূপম। টাকা গুনতে গুনতে মেয়েটি বলল, ‘দাঁড়িয়ে রইলে কেন? তাড়াতাড়ি কাজ না সারলে আরও বেশি লাগবে কিন্তু…’
‘কাজ!’, অজান্তেই বলে ফেলল রূপম। বিষয়টা যে ‘কাজ’-এর পর্যায়ে পড়ে সেটা ওর কল্পনার অতীত।
‘ওরে আমার ন্যাকা চৈতন্য রে! কাজ করবে নাতো কী করবে? ওসব ছবি-টবি আমি তুলতে দিই না। কাজ করবে তো করো, নইলে কেটে পড়ো’, আচমকাই পরি যেন রাক্ষসী। ঠোঁটে সদ্য চোষা রক্ত।
দমে গেল রূপম। সুখের চাবিকাঠি যে এখানে মিলবে না নিশ্চিত হল।
বেরোতে গিয়েও বাধা। দরজা আগলে মেয়েটি বলল, ‘আরও শ’দুয়েক দাও। মেজাজ খিঁচড়ে গেছে, একটু মাল না টানলে মুড আসবে না’, মুরগি যখন মিলেইছে, তখন জবাই করতে দোষ কী? পরের খদ্দের নাও জুটতে পারে।
ন্যায্য যুক্তি মেনে আরও শ’দুয়েক খসাতেই হল রূপমকে।
নরম মাটি পেয়ে হালকা আঁচড় কাটল মেয়েটি। পিঠে হাত বুলিয়ে মোলায়েম আবদার, ‘পুরোপুরি হাজারই দাও…’
শরীর আর মন যেন হাত ধরাধরি করে চলে। শরীর খারাপ হলে মন খারাপ হয়, আবার মনের অসুখ শরীরকেও প্রভাবিত করে। মনের উত্তেজনা তো শরীরকে উসকে দেয়ই, শরীরও মাঝেমধ্যে মনকে উসকায়। রূপমের শরীর, মন কিছুতেই যেন একসঙ্গে চলতে চায় না। অথচ একটা সময় পর্যন্ত কিন্তু হাত ধরাধরি অটুটই থাকে। আগুন জ্বলে একসঙ্গেই। আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে মনের মানুষকে। কখন যে আবরণ খসে যায় হুঁশও থাকে না। তারপরেই ছাড়াছাড়ি। শরীর উলটো মুখে হাঁটা লাগায়। হাজার ডাকে সাড়া মেলে না।
কারণটা যে একেবারেই অজানা তা নয়। ভাবলেই লজ্জা, অনুশোচনায় কুঁকড়ে যায় মন। কদর্য অতীত যে মন-মস্তিষ্ককে এইভবে ছেয়ে ফেলবে ভাবতেও পারেনি। তবুও অস্বীকার করতে চেয়েছে, ভুলে যেতে চেয়েছে। আপ্রাণ চেষ্টা করেছে মনকে বোঝাতে যে, কোনওরকম অন্যায় ঘটেনি। বৃথা চেষ্টা। তবে সেই কারণেই এই অক্ষমতা কিনা সঠিক জানা নেই। শুধুই অনুমান। কিনারায় পৗঁছে দেওয়ারও কেউ নেই। ডাক্তারবাবুরাও নয়। ওঁরাও তো মানুষ। মানুষের কাছে মনুষ্যতর আচরণের কথা বলা যায় কখনও?
বিছানা এক থাকলেও, শোয়ার ভঙ্গি পালটেছে অনেকদিনই। দু’পাশ ফিরে দু’কোনায়। সারাদিনে কেজো কথা ছাড়া কথাও হয় না। তবুও আজকাল বউকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে রুপমের। সোনাগাছির অভিজ্ঞতার পরে বাইরের মেয়েমানুষে আর ভরসা নেই। সবাই লোভী, সুযোগসন্ধানী। কিন্তু বউকে কাছে পাবার উপায় আর নেই। মৃত্তিকা যেন ঘুমন্ত রাজকন্যা। রূপমের কাছে নেই জিওন কাঠি। তাই ফিরিয়ে নেয় প্রসারিত হাত। গুমরে কাটায় কালরাত্রি।
হঠাৎই এক হাকিমের সন্ধান পেল রূপম। মোগল আমলে হাকিমরা নাকি অসাধ্য সাধন করত। অন্তত প্রস্রাবগারের বিজ্ঞাপনে তেমনটাই দাবি করা হয়েছে। কয়েকজনের বাস্তব অভিজ্ঞতার বিবরণও রয়েছে। দেশি-বিদেশি ডিগ্রির পিছনে ছুটে লাভ কিছুই হয়নি, তাই মল্লিকবাজারের গলি-ঘুঁজি পেরিয়ে রূপম হাজির হল সেই হাকিমের কাছে। বৃদ্ধ হাকিমসাহেব মন দিয়ে সমস্যা শুনলেন, তারপর ওষুধ দিলেন। সপ্তাহ দুয়েক পরে আবার আসতে বললেন।
শ্বশুর-শাশুড়ি যেন গোদের উপর বিষফোড়া। রূপমের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও মেয়ে-জামাই দুজনকেই গুরুদেবের কবচ, জ্যোতিষিদের রত্ন ধারণ করিয়েছেন। বার বার স্মরণ করিয়েছেন পেঁয়াজ, রসুন যেন কিছুতেই না খাওয়া হয়। তা হলে কবচের ফল মিলবে না। শনিবার অবশ্যই নিরামিষ। অগ্রাহ্য করারও উপায় নেই। মাঝেমাঝেই উজিয়ে এসে বিরক্তিকর তদারক। বাবা এত কিছু জানেন না। তবুও, রূপমরা হাবড়ায় গেলে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোমরা ভালো আছো তো?’
দু’সপ্তাহ ওষুধ খাবার পর আবার মল্লিকবাজারে গেল রূপম। হাকিমসাহেব অনেকক্ষণ নাড়ি ধরে বসে রইলেন। তারপর গম্ভীর মুখে জানালেন, ওষুধের কাজ শুরু হয়েছে। তবে কতটা কাজ হয়েছে সেটা বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়েই বুঝতে হবে। ফ্যাসাদে পড়ল রুপম। মৃত্তিকার সঙ্গে আর এক্সপেরিমেন্ট সম্ভব নয়। এদিকে পরীক্ষা না করেও উপায় নেই। বলা যায় না, বিজ্ঞাপনের কথা হয়তো মিথ্যে নয়। সমাধান বাতলালেন হাকিমসাহেব।
আবার ও-পাড়ায় যেতে হল রূপমকে। এবার হাড়কাটা। হাকিমসাহেবের কথা মতো নির্দিষ্ট বাড়িতে গিয়ে চপলামাসির সঙ্গে দেখা করল। তিনিই নিয়ে এলেন বছর কুড়ির প্রতিমাকে। দেখেই পছন্দ হল রূপমের। ফরসা রং, গোল মুখ, টানা চোখ, অনেকটাই যেন আসল প্রতিমা। সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগেই রয়েছে। রেটও কম, পাঁচশো। সানন্দে রাজি হয়ে গেল রূপম। ঠিক করল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে কিছু বকশিশও দেবে।
বেশ খাতির করেই ঘরে নিয়ে এল প্রতিমা। ঘর আহামরি কিছু না হলেও চলনসই। দুষ্টু হেসে বলল, ‘বিয়ার খাবে?’
‘আমি তো… মানে… মদ খাই না…’, বলতে যেন বাধল রূপমের।
‘ওমা বিয়ার আবার মদ নাকি! তা হলে একটা সিগারেট দাও’, প্রতিমার আদুরে আবদার।
‘সিগারেট মানে…আমি তো খাই না’, লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করল রুপমের।
‘তুমি তো ভালো ছেলে গো! তা এ পাড়ায় কেন? বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া?’, হাসিতে ঢলে পড়ল প্রতিমা।
রুপম উত্তর দিল না। প্রতিমার ব্যবহারে প্রথম থেকেই মুগ্ধ। প্রতিটা কথাই হাসিমাখা, আন্তরিক। টাকাও চায়নি। মনে মনে ধন্যবাদ জানাল হাকিমসাহেবকে। শরীরও জেগে উঠছে। নিশ্চিত সাফল্যর আশায় শিহরণ জাগল।
‘কী গো… চুপ করে রইলে যে? বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করেছ, না?’, প্রতিমা প্রায় মুখের কাছে। রূপমের ইচ্ছে করল জড়িয়ে ধরতে। তখনই ফোন। সামান্য ‘হ্যাঁ’, ‘হুঁ’ করেই ফোন ছাড়ল প্রতিমা। তারপর রূপমের গাল টিপে বলল, ‘তুমি একটুখানি বোসো, আমি এক্ষুনি আসছি।’ আপত্তি করল না রূপম। মানুষের দরকার থাকতেই পারে। তা ছাড়া মেওয়া ফলাতে গেলে একটু সবুর করতেই হয়। প্রতিমা দরজা ভেজিয়ে চলে গেলে বিছানায় আধশোয়া হল। মজে গেল সুখস্বপ্নে।
‘ওমা… তুমি একলা যে! প্রতিমা কোথায়?’
চমকে উঠল রূপম। দরজায় চপলামাসি, সঙ্গে মাঝবয়সি এক মহিলা। তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। আমতা-আমতা করে বলল, ‘একটু বাইরে গেছে… দরকারে।’
‘দরকার না ছাই… গেছে ওই অটোওয়ালা কানুর খাঁই মেটাতে’, ঝাঁঝিয়ে উঠল সঙ্গের মহিলাটি।
‘তা বলে ঘরে খদ্দের বসিয়ে চলে যাবে?’, চপলা বিরক্ত।
‘যাবে না কেন? কানু যে বিয়ের লোভ দেখাচ্ছে’, মহিলার মুখ বিকৃতি।
‘থাক… আমায় আর শেখাস না মালতী। মাগি পাড়ার মেয়ে নিয়ে সংসার পাতবে ওই হারামজাদা? অত ধক আছে ওর?’ গর্জে উঠল চপলা। জীবনে পুরুষমানুষ কিছু কম দেখল না।
‘আমার অত জানার দরকার নেই মাসি। কাস্টমার দাঁড়িয়ে আছে। তোমার ঘর হবে, নাকি অন্য ঘর দেখব?’ মালতীর সাফ কথা।
বিচলিত হল চপলা। ভেবেছিল প্রতিমার ‘কাজ’ হয়ে গিয়েছে, মালতীকে ঘর দিতে সমস্যা হবে না। এখন মালতী অন্য ঘরে যাওয়া মানে সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা। কিন্তু এই খদ্দের হেকিমসাহেবের পাঠানো। অবহেলা করলে অসন্তুষ্ট হবেন। আগে নিয়মিতই আসতেন। এখনও প্রয়োজন পড়লে আসেন, মেয়েদের চিকিৎসা করেন। ভালো মানুষটাকে চটাতে মন চাইল না। অথচ প্রতিমাও যে কতক্ষণে আসবে তারও কোনও ঠিক নেই। পরিস্থিতি সামলাতে রূপমকে বলল, ‘আমি বাইরে চেয়ার দিচ্ছি, তুমি একটু বোসো বাছা। প্রতিমা আসুক, তারপর…’
ছিটকে বেরিয়ে এল রূপম। অপমানে মাথা ঝাঁঝা করছে। হাকিমসাহেবের সুপারিশে এসেছে, তাও ঘর থেকে বের করে দিল? বললে নয় বেশি টাকাই দিত। সব রাগ গিয়ে পড়ল হাকিমসাহেবের উপর। ফোনে যাচ্ছেতাই গালাগাল করল। ওখানে যে আর কখনওই যাবে না, সেটাও জানিয়ে দিল। রাগে গজগজ করতে করতে আনমনেই চলে এল মেডিকেল কলেজের সামনে। তারপর ছানাপট্টির পাশের গলিটায়। হঠাৎই চোখে পড়ল, প্রসন্নময়ী ঔষধালয়। আয়ুর্বেদীয় প্রতিষ্ঠান। স্থাপিত ১৯২৫। প্রতিষ্ঠাতা – বৈদ্যনাথ কাব্যতীর্থ (যৗনরোগ বিশেষজ্ঞ)। ‘শালা… এটাই বা বাদ থাকে কেন?’, দপদপিয়ে ঢুকে পড়ল রূপম।
কবিরাজমশাই ষাটের কোঠায়। ফাঁকা দোকানে পেসেন্স খেলছিলেন। রূপম ঢুকতেই মুচকি হাসলেন। বাধ্য হয়েই প্রপিতামহের নামের তলায় বন্ধনির বাক্যটা জুড়েছেন। এলাকায় কদর পেতে সুবিধে। ছেলেটি যে ওইটির জন্যই ঢুকেছে বুঝতে অসুবিধে হয়নি। নইলে আজকাল আর বিশেষ কেউ কবিরাজি চিকিৎসায় ভরসা রাখে না। ইয়ং জেনারেশন তো নয়ই। রূপমকে বসতে ইশারা করলেন। তারপর মুখে এক খিলি পান ফেলে বললেন, ‘এ পাড়ায় এলে রোগ হবেই, বুঝলেন। শিবের বাপেরও সাধ্যি নেই আটকায়। তবে আমি যতক্ষণ আছি ততক্ষণ চিন্তা নেই। যত ইচ্ছে রোগ বাধান, ঠিক সারিয়ে দেব।’
‘এডস্ হলেও?’, গরম মাথায় হামবড়াভাব সহ্য হল না রূপমের। প্রশ্নটা করেই ফেলল।
‘হয়েছে নাকি?’, চশমার ফাঁক দিয়ে কবিরাজের কৗতূহল।
‘হয়নি… কিন্তু হলে সারাতে পারবেন?’, রূপম চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে।
‘পরীক্ষা?… টেস্ট?’, ভ্রু কোঁচকালেন কবিরাজ। ‘শুনুন মশাই, আমরা পাঁচ পুরুষের কবিরাজ। যমেও ভয় পায় আমাদের।’
রূপম বুঝল কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। খামোখা ঝগড়া বাধবে। মাথা নেড়ে সায় দিল। খুশি হলেন কবিরাজ। ইশারায় পাশের চেম্বারে ডাকলেন। ঢুকতেই নিরুত্তাপ নির্দেশ, ‘নিন…খুলে ফেলুন।’
‘মানে?’, ঝাঁঝিয়ে উঠল রূপম। প্রথম থেকেই লোকটার হাবভাব কেমন যেন গা জ্বালানো।
‘প্যান্ট না খুললে রোগ বুঝব কী করে?’, ডাক্তারের মুখে মুচকি হাসি। ‘শালারা মাগিদের সামনে উদোম হবে, অথচ ডাক্তারের কাছে লজ্জা!’
‘না না… ওসব রোগের ব্যাপার নয়। আমার অন্য সমস্যা’, তাচ্ছিল্য ঝরাল রূপম। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস অসহ্য।
‘সমস্যাটা কী?’
বছর নয় কি দশ। গরমের ছুটিতে খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়ছিল। পড়তে পড়তেই তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে। কারও নড়াচড়ার শব্দে আচমকাই ঘুম ভাঙল। চোখ মেলেই সঙ্গে-সঙ্গে বন্ধ। ততক্ষণে বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটা শুরু হয়েছে। খানিক বাদে চোখ খুলতেই হল। প্রথমে পিটপিট, তারপর ড্যাবড্যাব। দশ হাত তফাতেই মা কাপড় বদলাচ্ছে। ঘর একটাই, অন্য সময় হলে বাইরেই যেতে বলত। কিন্তু কচি ছেলের ঘুম ভাঙাতে বোধহয় মন চায়নি। মায়ের কাছে বয়স না বাড়লেও, মহিলাদের কাপড় বদলানোর দৃশ্য যে দেখা উচিত নয়, সে জ্ঞান তখন রূপমের হয়েছে। তবুও সংবরণ করতে পারল না। হয়তো অ-দেখার কৗতূহল অথবা নিষিদ্ধের স্বাদ আহরণ। একসময় আনমনেই ঘুরে দাঁড়াল মা। সন্মোহিত রূপম ভুলে গেল চোখ বন্ধ করতে। প্রথমে বিষ্ময় তারপর একরাশ ঘৃণা ঠিকরে উঠল মায়ের মুখে। কোনওরকমে কাপড় সামলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মাসখানেকের মধ্যেই গলায় দড়ি দিল মা। পাপ, অপরাধবোধ গ্রাস করল রূপমকে।
আসল ঘটনাটা জেনেছিল অনেক পরে। মা সংসারে সচ্ছলতা চেয়েছিল। দিনরাত বাবাকে তাগাদা দিত প্রাইভেট টিউশনের জন্য। বাবার বন্ধুরা অনেকেই করত। কিন্তু বাবা নীতিগত কারণে কিছুতেই প্রাইভেট টিউশন করবেন না। টিভি নেই, ফ্রিজ নেই, টেলিফোন নেই, ভালো শাড়ি বা গয়নাও নেই। নেই-রাজ্যে কিছুতেই মানাতে পারল না মা। তার উপর বাড়িটাও শেষ করলেন না বাবা। তার আগেই ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাজারহাটে ফ্ল্যাট বুক করে বসলেন। ইটের গাঁথনির উপর অ্যাসবেস্টসের চালে থাকতে মায়ের সন্মানে বাধত। রোজই ঝগড়া, অশান্তি। কিন্তু বাবা নিজ সিদ্ধান্তে অটল। ছেলেকে কিছুতেই হাবড়ার এঁদো পাড়ায় থাকতে দেবেন না। উচ্চশিক্ষিত করে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত করবেন। যদি কলকাতার বাইরেও যায়, তা হলেও তো ফ্ল্যাটটা ছেলের ইনভেস্টমেন্ট হয়ে থাকবে। এই সব যুক্তি মানতে মা নারাজ। বর্তমান ছেড়ে ভবিষ্যতের পিছনে ছোটে কোন আহম্মকে? অশান্তি চরমে পৗঁছোল যেদিন বাবা, মায়ের এক আত্মীয়ের বিয়েতে সোনার গয়না দিতে অস্বীকার করলেন। বাবার সরল যুক্তি, নিজের ক্ষমতায় সীমাবদ্ধ থাকা। এদিকে সোনার গয়না না দিলে বাপের বাড়িতে মায়ের মান থাকে না। সেদিন রাতেই আত্মহত্যা করল মা।।
‘আপনার মা বুঝি খুব সুন্দরী ছিলেন?’
উত্তর করল না রূপম। স্মৃতিতে নাড়াচাড়া পড়ায় বিহ্বল। যে কথা আজ পর্যন্ত কাউকে বলেনি আজ রাগের মাথায় কবিরাজকে উগরে দিয়েছে।
‘আমি বলছিলাম… আপনার মা নিশ্চয়ই ফরসা ছিলেন। মুখশ্রী সুন্দর, ফিগার দারুণ, তাই না? চুল কি মাঝারি ছিল, নাকি বড়ো?’, হঠাৎ করেই কবিরাজ যেন পিঁপড়ে। রসের সন্ধান পেয়েছে। একঘেয়ে জীবনে এরকম খোরাক বড়ো একটা জোটে না।
রূপমের বুঝতে অসুবিধে হয়নি কবিরাজের উদ্দেশ্য। তবুও আমল দিল না। বহু বছর বাদে মায়ের চেহারাটা ভাবতে চেষ্টা করল। আবছা ছেঁড়া-ছেঁড়া টুকরো মনপর্দায় ভেসে উঠলেও, সম্পূর্ণ অবয়বটা কিছুতেই গড়তে পারল না। নিজের জন্মদাত্রীকে ভুলে গেল! আশ্চর্য লাগল রূপমের। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা ঘরে কোনও ছবি রাখেনি। হয়তো ইচ্ছে করেই। কুড়ি বছরের উপর না দেখা একটা চেহারা ভুলে যাওয়াই তো স্বাভাবিক। তবে চেহারাটা মনে করতে পারলে বোধহয় ভালোই হতো। একবার যদি মায়ের হাসি মুখের একটা ছবি দেখতে পেত, তা হলে হয়তো কিছুটা স্বস্তি মিলত। শত চেষ্টাতেও রূপম মায়ের কোনও ছবি আঁকতে পারল না।
কিন্তু চেহারা ভুলে গেলেও, রূপম ভুলতে পারেনি ছোটোবেলার সেই অবাঞ্ছিত ঘটনা। মায়ের আত্মহত্যার আসল কারণ জেনেও নিজেকে পুরোপুরি নির্দোষ ভাবতে পারেনি। কখন যে ভাবনাটা মনের গভীরে চারিয়ে গিয়েছে বুঝতেও পারেনি। পারল বিয়ের পর। মৃত্তিকা আবরিত থাকলে কোনও অসুবিধেই নেই। স্বাভাবিক মানুষের মতোই উত্তেজনা জাগে। কিন্তু আবরণহীন হলেই মনে পড়ে সেই অমার্জনীয় অপরাধ। জাগে পাপ, অপরাধবোধ। চোখের সামনে তখন নিকষ কালো অন্ধকার। বিদ্যুৎগতিতে শরীর ধাবিত হয় সেই অন্ধকারের দিকে। মনের কথা মনেও পড়ে না।
‘আপনার মা কী অভিনয়-টভিনয় করতেন? মানে ফিল্ম অ্যাকট্রেস বা…’, রসের নাগাল পেতে পিঁপড়ে মরিয়া।
‘আমার মা খুবই কুৎসিত ছিলেন’, নিস্পৃহ গলায় বলল রূপম। বুড়োর ভিমরতি না থামালেই নয়।
‘ও… আচ্ছা আচ্ছা…’, নিজেকে সামলে নিলেন কবিরাজ। খদ্দের চটলে লক্ষ্মীও বিরূপ হবেন। মোলায়েম হেসে বললেন, ‘তা… কী চান আমার কাছে?’
রূপম শেষভাগটাও বলল। সবটা শোনার পর কিছুক্ষণ থম মারলেন কবিরাজ। তারপর বললেন, ‘আপনাকে একটা ওষুধ দিচ্ছি। তিনদিন এক দাগ করে দু’বেলা খাবেন। যদি সমস্যা না মেটে ফোনে আমাকে জানাবেন।’
সেই এক গেরো। বউয়ের সহযোগিতা যে পাওয়া যাবে না, স্পষ্টই জানিয়ে দিল রূপম। কবিরাজ একগাল হেসে অভয় দিলেন, বেশ… সে দায়িত্বও নিলাম।’
ক’দিনের জন্য বারাসত যাব। মায়ের শরীরটা বিশেষ ভালো নয়। দিন চারেকের রান্না ফ্রিজে রাখা আছে, মাইক্রোতে গরম করে নিও।’ আপত্তি করল না রূপম। গুমোট পরিবেশে কারই বা ভালো লাগে? রাজারহাটের মতো নির্জন জায়গায় একা একা বেরনোও ভয়ের ব্যাপার। সারাদিন তাই ফ্ল্যাট বন্দি হয়েই কাটাতে হয় মৃত্তিকাকে। আগে রেস্টুরেন্ট বা শপিংমলে গেলেও, অনেকদিনই সে পাট চুকেছে। এক ছাদের তলায় থেকেও, দুজনে যেন ভিন গ্রহের বাসিন্দা।
প্রথমদিন খেয়েই রূপম বুঝল ওষুধটা অন্যরকম। কাজ হবার সম্ভবনা আছে। খাওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি। কেউ যেন শরীরময় সুড়সুড়ি দিচ্ছে, চিমটি কাটছে। মনও ফুরফুরে। দ্বিতীয়দিন আরও নিশ্চিত হল। তৃতীয়দিন পুরোপুরি আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে, তাই কবিরাজকে আর ফোন করার প্রয়োজন বোধ করল না। আবার কী ফ্যাসাদে পড়তে হয় কে জানে! ছুটল শ্বশুরবাড়ি। আচমকা আগমনে মৃত্তিকা অবাক। গাঁইগুঁই করলেও, শাশুড়ি জোর করেই পাঠিয়ে দিলেন। বউ নিয়ে সোজা শপিংমলে। মৃত্তিকাকে একটা দামি শাড়ি কিনে দিল রূপম। তারপর রেস্টুরেন্টে খাওয়া। অবাক হলেও প্রকাশ করল না মৃত্তিকা। হয়তো খুশিই হল। অসহায় মেয়েদের অ-সুখের মধ্যেই ক্ষণিকের সুখ খোঁজা ছাড়া উপায় কি?
ফ্ল্যাটে ঢুকেই ঝাঁপিয়ে পড়ল রূপম। মৃত্তিকাও সাড়া দিয়ে ফেলল। শরীর নিজের প্রয়োজনেই নিরস মনকে সরস করে তুলল। সারাদিন রূপমের ব্যবহারেও অন্যরকম ইঙ্গিত। হয়তো চিকিৎসায় ফল মিলেছে। তা ছাড়া মিথ্যের জোয়ারেও কি কখনও কখনও ভাসতে ইচ্ছে করে না? মরীচিকা তো মানুষই দেখে। মৃত্তিকাও দেখল। চাতকের মতো ছুটে গেল তৃষ্ণা নিবারণের আশায়। শৃঙ্গারের চরম পর্যায়ে খসে পড়ল আবরণ। তারপরেই বিপত্তি। নির্দ্বিধায় মনের সঙ্গ ত্যাগ করে শরীর ছুটল অন্ধকার পানে। কিছুতেই মোড় ঘোরাতে পারল না রূপম। মৃত্তিকা আবারও রূপান্তরিত হল পাষাণ প্রতিমায়।
ওষুধের উত্তেজনাও অতিক্রম করতে পারল না মনের অপরাধবোধ। তবুও হাল ছাড়ল না রূপম। শরীরের অনুভূতিই বলে দিচ্ছে কাজ হবে। হয়তো মাত্রা একটু বাড়াতে হবে। কোর্স শেষ হলেও রয়ে গিয়েছে বেশ খানিকটা ওষুধ। একসঙ্গে দু’দাগ গলায় ঢালল রূপম। অ্যাকশন শুরু হতেই আবার ঝাঁপাল। তবুও ফিরে এল অন্ধকার। এবার পুরো বোতলটাই শেষ করল। শরীর যেন আগুনের গোলা, হৃদপিণ্ডে অশ্বের গতি। টলোমলো পায়ে আবারও ঝাঁপাল। এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না মৃত্তিকা। হিংস্র বাঘিনীর মতো থাবা বসাল রূপমের গালে। আকস্মিক আক্রমণে রূপম হতভম্ব। সম্বিৎ ফিরতেই বেরিয়ে গেল ফ্ল্যাট ছেড়ে।
‘করেছেন কি মশাই? মারা পড়বেন যে!’
রূপমের ফোনে আঁতকে উঠলেন কবিরাজ। ওষুধটা নিজস্ব আবিষ্কারই বলা যায়। আয়ুর্বেদ, ইউনানি, অ্যালোপ্যাথির অদ্ভুত মিশ্রণ। নিজের উপরেও প্রয়োগ করেছেন। ফল ভালোই। বাজার চলতি ওষুধগুলোর চেয়ে তো বটেই। পঞ্চাশেও পঁচিশের জোশ এনে দেয়। তাই মওকা বুঝে দামও নিয়েছেন চড়া। কিন্তু ছেলেটির যে কেন কাজ হল না, বুঝতে পারলেন না। তা ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত সেবনে কী রিঅ্যাকশন হতে পারে একেবারেই জানা নেই। জানার প্রয়োজনও পড়েনি কখনও। তবে ভালো কিছু যে হবে না সেটা নিশ্চিত। ছেলেটিও যে কেন অসহযোগী বউয়ের সঙ্গে খামোখা লিপ্ত হতে গেল, ভেবে পেলেন না।
ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটে মারিয়া গোমসের সঙ্গে তোফা ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। অভিজ্ঞ, লাস্যময়ী, ছোকরার আড় ভাঙতে দশ মিনিটও সময় নিত না। নিজেরও ফাউ জুটত। কিন্তু সেসব চুলোয় দিয়ে এখন প্রাণ বাঁচানোই দায়। ফোনে যে পরিমাণ উত্তেজনার আঁচ পেলেন, তাতে দোকানে ঝামেলা অবধারিত। তড়িঘড়ি ঝাপ বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই। আপনি বাঁচলে বাপের নাম।
‘শালা… আটশো টাকা নিয়ে জোচ্চুরি!’ বন্ধ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আস্ফালন করা ছাড়া উপায় রইল না রূপমের। বেগতিক বুঝে কবিরাজ ফোনও সুইচ-অফ করে দিয়েছেন। কবিরাজকে ধমক-ধামক, মারধর দিলে হয়তো উত্তেজনা কিছুটা কমত। তা না হওয়াতে দিশেহারা হয়ে পড়ল রূপম। শরীরময় যেন হাজারও সাপের ছোবল। ইচ্ছে করছে পৃথিবীটা ভেঙে-চুরে, তছনছ করে ফেলতে। আচমকাই প্রতিমার কথা মনে পড়ল। ও-ই পারবে যন্ত্রণার অবসান ঘটাতে। হন্তদন্ত হয়ে চলল চপলামাসির বাড়ি। কিন্তু বিধি বাম, প্রতিমা অন্য খদ্দেরে ব্যস্ত। অপেক্ষা করতে বললেও মানতে নারাজ রূপম। পাগলের মতো দরজায় লাথি, ধাক্বা, সঙ্গে গালাগাল। বাড়িময় হইচই। কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না উন্মত্ত খদ্দেরকে। শেষে পাড়ার ছেলেদের ডেকে একরকম জোর করেই রূপমকে বাড়ি থেকে বের করে দিল চপলা।
ক্রমাগত ব্যর্থতায় রূপম হতোদ্যম। টলোমলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির সামনে। হোঁচট খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল। সামলালেন এক বৃদ্ধা মহিলা। ধমকের সুরে বললেন, ‘কী রে ছেলে, সামলাতে পারিস না তো মদ গিলিস কেন?’
মাথায় রক্ত চড়ল রূপমের। জীবনে কোনওদিন মদ ছুঁয়েও দেখল না, আর এই মহিলা কিনা বলছেন মদ গিলেছে? ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, ‘কী ভুলভাল বকছেন। কে আপনি?’
‘আমি তোর মা রে’, অবলীলায় বললেন মহিলা।
গায়ে কাঁটা দিল রূপমের। মন যেন তৈরি হয়েই ছিল। চুম্বকের মতো ‘মা’ শব্দটা গেঁথে নিল। নিমেষে এঁকে ফেলল পূর্ণ অবয়ব। লালপাড় ঘিয়ে শাড়ি, মাথায় জটা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, এই তো মা! কই মায়ের মুখে তো কোনও ঘেন্না নেই? বরং মিটিমিটি হাসছেন। তা হলে কি ক্ষমা করেছেন অবোধ সন্তানকে? অপ্রকৃতিস্থ হলেও মস্তিষ্ক যেন দ্বিধাগ্রস্ত। ঘোর লাগা চোখে রূপম বলল, ‘আপনি আমার… কে বললেন?’
‘মা রে মা… আমি তোর মা। এখন দশটা টাকা দে তো, ঘুগনি-মুড়ি খাই।’
‘মা’ ছাড়া আর কোনও শব্দই কানে ঢুকল না রূপমের। মস্তিষ্কও মেনে নিল মনের কথা। অপলকে চেয়ে রইল মহিলার দিকে। মহিলার হাসি যেন পবিত্র জলের ধারা। পাপ, অপরাধবোধ ধুয়ে-মুছে সাফ।
‘কী রে ছেলে… দে। দোকান বন্ধ হয়ে যাবে যে…’, মহিলা আন্তরিক। যেন নিজের ছেলের কাছেই চাইছেন। সম্মোহিতের মতো পঞ্চাশ টাকা দিল রূপম। হাসিমুখে আশীর্বাদ করলেন মহিলা, ‘স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখী হও বাবা’। তারপর জনারণ্যে মিলিয়ে গেলেন। রূপমকে দিয়ে গেলেন পরম প্রাপ্তি। কদর্য অতীত রূপান্তরিত হল নির্মল বর্তমানে।
দুশ্চিন্তায় ঘুম নেই মৃত্তিকার। আপশোশও হচ্ছে। অতটা বাড়াবাড়ি না করলেও চলত। নিজের অক্ষমতায় তো কোনও হাত নেই রূপমের। বরং কাটিয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। তারই মন্দ ভাগ্য যে, এইরকম একজনের সঙ্গে বিয়ে হল। তবে বিয়ের আগে রূপম যে সমস্যার কথা জানত না এটা নিশ্চিত। তবুও মাথা ঠিক রাখা মুশকিল। এত বড়ো বঞ্চনা মেনে নেওয়া বড়োই যন্ত্রণার। কিন্তু অপমানিত হয়ে রূপম যদি কিছু করে বসে? কী জবাব দেবে সবার কাছে? মোবাইলে ফোন করলেও ধরছে না। মেসেজ করলেও উত্তর আসছে না। অনুতপ্ত মৃত্তিকা ক্রমাগত ঘর-বারান্দা করতে লাগল।
ভোর রাতে রূপম ফিরল। শান্ত, সমাহিত। চুপ করে সোফায় বসে রইল। যেন বসেই থাকবে। অনন্তকাল। রূপমের এমন রূপ মৃত্তিকার অদেখা। কেমন যেন মায়া হল। সরাসরি ক্ষমা চাওয়ার অনভ্যস্ততায় হাত রাখল রূপমের কাঁধে। বোঝাতে চাইল আপশোশ, অনুতাপ। সমাহিত রূপম গ্রাহ্য করল না। কানে ক্রমাগত বেজেই চলেছে, ‘স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখী হও…’। এমন করে তো কেউ কোনওদিন বলেনি!
নিশ্চুপ রূপমকে এবার ভয় পেল মৃত্তিকা। মেন্টাল শক পেল নাকি? বউ গায়ে হাত তুললে পৗরুষে আঘাত লাগাটা খুবই স্বাভাবিক। মানসিক ভারসাম্য হারালে দায়ভার কি তার উপরেই বর্তাবে? এক ঝটকায় রূপমের মাথাটা বুকে চেপে শক্ত করে বেড় দিল মৃত্তিকা। তারপর আদরে আদরেই যেন ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগল। কখন যে নিজের শরীরে মিশিয়ে নিয়েছে টেরও পেল না। একসময় রূপম অনুভব করল শরীর, মন নিশ্চিন্তে হাত ধরাধরি করে চলেছে। পাড়ি দিয়েছে অনন্ত পথ। অতিক্রম করেছে কৃষ্ণগহ্বর।