থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ইলা। মায়ের ঘরে আধাখোলা দরজাটার ভিতর থেকে কথাগুলো ভেসে এসে ইলার কানে তপ্ত  তরল ঢেলে দিল যেন… অফিস থেকে ফিরে বাইরের ঘরের দরজাটা খোলা দেখেই মেজাজ-টা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল ইলার। সবাই নিশ্চয়ই ভিতরে বসে গল্পে মশগুল… পাড়ায় আজকাল দিনে দুপুরে চুরি হচ্ছে… অথচ বাড়িতে দ্যাখো কারও হুঁশ নেই…। মনে মনে তৈরি হয়ে ছিল মা-কে ঝাড়বে বলে কিন্তু মায়ের ঘরের সামনে এসে আর এগোতে পারল না ইলা, ওখানেই পাথরের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল।

ঘরের ভিতর থেকে ছোটো ভাই শিবুর গলা ভেসে এল, ‘দ্যাখো মা, এরপর আমি আর এখানে আসব না। সারা পাড়ায় দিদিকে নিয়ে যেভাবে চর্চা চলছে তাতে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। কারও সঙ্গে দেখা হলে লজ্জায় চোখ তুলে কথা বলতে পারি না। কী দরকার দিদির, সম্রাট স্যারের সঙ্গে টুরে যাওয়ার? নিজের কথা নাই বা ভাবল, অন্তত বাড়ির লোকেদের সম্মানের খেয়ালটা তো রাখা উচিত।’

আধখোলা পাল্লাটার ভিতর থেকে মায়ের উপর দৃষ্টি পড়ল ইলার। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে খানিকক্ষণ চুপ করে থাকল মা। তারপর ভাইকে উদ্দেশ্য করে মা-কে বলতে শুনল, ‘আমিই বা কী করি বল? বাড়ির সমস্ত দায়িত্ব ও নিজের কাঁধে নিয়ে আমারও তো মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু বলতে গেলেই রেগে ওঠে। আমার এই বাড়িতে দম বন্ধ হয়ে আসে। কিছু বললেই আত্মহত্যা করবে বলে ভয় দেখায়। এবার আমি তোর সঙ্গে তোর ওখানে চলে যাব, ও থাকুক এখানে একা। বাপের সব দায়িত্ব নিয়েছে বলে কি মাথায় চড়ে নাচবে? এমন কার্যকলাপ করছে যে মুখে কালি লাগতে আর দেরি নেই। কত সম্বন্ধ এল কিন্তু তোর দিদির কাউকেই পছন্দ হল না। এখন এত বয়সে কোন ছেলেই বা ওকে বিয়ে করবে? তার উপর একবার যদি বদনাম রটে যায়…’

মায়ের পুরো কথাটা কানে ঢুকল না ইলার। মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল ওর। অনেক কষ্টে চোখের জল আটকাবার চেষ্টা করতে করতেই ছোটো বোন এষার গলা কানে এল, ‘দিদি আর সম্রাটের গল্প আমার শ্বশুরবাড়িতেও পৌঁছে গেছে। শাশুড়ি তো আমার মুখের উপরেই দিদিকে ‘নির্লজ্জ বলতে দ্বিধা করেন না। এমনকী দেওরও কথায় কথায় আমাকে বলে, তোমার দিদির অফিসে এত হোল্ড, তা দিদিকে বলো না সম্রাট-কে বলে ওখানে আমার একটা চাকরি করে দিতে। অনিলও মাঝেমধ্যেই দিদিকে নিয়ে আমায় পরিহাস করে। সত্যিই মা, লজ্জায় শ্বশুরবাড়িতে আমার মাথা কাটা যায়।’

‘ঠিকই বলেছিস এষা, বেয়ান বাড়িতে আমার সম্মানটা ধুলোয় মিশে গেল। এসব কথা আরও বাড়িয়ে চড়িয়ে সকলে আলোচনা করে। কারও সাহস আছে ইলাকে কিছু বোঝাবার। মায়ের কথাগুলো ইলার মনে ছুরির মতো বিঁধে গেল, দরজায় দাঁড়িয়ে একটা প্রতিবাদের শব্দও মুখ থেকে বেরোল না।

‘দিদি সবাইকে জ্ঞান দিত, এটা করিস না, এই জামাটা পরিস না, অমুকের সঙ্গে মিশিস না, ছেলেদের সঙ্গে বেশি কথা বলা উচিত নয়– আর এখন দ্যাখো নিজেই এর একটা কথাও মেনে চলে না, এষার কথাগুলো ইলাকে সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।

মনে মনে ইলা ভাবে পরিবারের কাছ থেকে এটাই ওর পাওনা ছিল অথচ এই পরিবারের জন্যই সমস্ত স্বার্থত্যাগ করে এই কঠিন দায়িত্বভার অক্লেশে নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল বাবার মৃত্যুর পর। না চাইতেও চোখে জল চলে এল ইলার। ওর প্রতি সকলের অভিযোগের কারণ কী সেটা জানতে এবং তার একটা সুযোগ্য উত্তর দেওয়ার জন্য ঘরে ঢুকতে গিয়েই আবার থেমে গেল ইলা। সব থেকে ছোটো বোন ইমনের কথাগুলো কানে গেল ওর, ‘আমার শ্বশুরবাড়িও দিদির ব্যাপারে সব কিছুই জানে কিন্তু আমার সামনে কখনও কিছু বলে না। অলোক একদিন আমাকে বলছিল, ‘তোমাদের উচিত সকলে মিলে একটা ভালো পাত্র দেখে দিদির এবার বিয়ে দিয়ে দেওয়া। তোমাদের জন্য দিদি যতটা স্বার্থত্যাগ করেছে তাতে তাকে নিয়ে এইসব আলোচনা করা একেবারে অনুচিত। শিবুকে বলো ভালো পাত্র খোঁজ করে দিদির বিয়ে দিতে আর মা-কে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখতে।’ মা, আমারও এই ব্যাপারে একই মত। এত আলোচনা না করে দিদিকে সংসারী করে দেওয়াটা এবার আমাদেরই দায়িত্ব।’

শিবু সব শুনে রাগত স্বরে বলে, ‘তাহলে ইমন, তুই অলোককেই বল না দিদির জন্য একটা ভালো পাত্রের সন্ধান করতে। বসে বসে অমন লেকচার সবাই দিতে পারে।’

ইমনের কথায় ইলা একটু হলেও স্বস্তি অনুভব করে। পরিবারে কেউ তো একজন এমন আছে যে ওর সম্পর্কে কিছু ভালো ভাবে। ভাবতে ভাবতে ইলা দরজা ঠেলে ঘরের ভিতর ঢুকে আসে। হঠাৎ ওকে দেখে সকলেরই মুখ বন্ধ হয়ে যায়, ঘরের মধ্যে নেমে আসে এক অস্বস্তিকর নীরবতা।

পরিস্থিতি সামাল দিতে মা-ই প্রথম এগিয়ে আসেন, ‘আরে ইলা, তুই ভিতরে কীভাবে ঢুকলি? নিশ্চয়ই এষা আজও দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেছে?’ থেমে থেমে জিজ্ঞেস করেন মেয়েকে।

‘বোধহয় নিয়তির এটাই ইচ্ছে… ওই ইচ্ছে করে দরজা খোলা রেখে দিয়েছে যাতে আমি আমার আপনজনদের মুখোশের তলায় লুকিয়ে থাকা আসল মুখটাকে দেখতে পাই। আমার সম্পর্কে তোমাদের মনে এতটা বিষ জমা হয়েছিল সেটা হঠাৎ করে না এসে পড়লে আমি জানতেই পারতাম না। আমার জন্য তোমাদের সকলের সামনে লজ্জিত হতে হয়! ভালোই হল সবকিছু আমি নিজের কানে শুনে নিলাম। ’ কোনওমতে চোখের জল আটকে ইলা মায়ের দিকে ফিরল, ‘মা, আমি আগে তোমার অভিযোগের উত্তর দিতে চাই। তুমি সত্যিই কি সেই দিনগুলো ভুলে গেলে যখন বাবার মৃত্যুর পর সব আত্মীয়স্বজনরা আমাদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেছিল? তোমার সামনে তখন পাহাড় প্রমাণ দায়িত্ব… তুমি কী করবে দিশাহারা হয়ে পড়েছিলে, সবসময় ছেলে-মেয়েদের নিয়ে আত্মহত্যার কথা ভাবতে। তোমাদের চারজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কত রাত যে ঘুমোতে পারিনি সেটার হিসেব আজ কে করবে? তিন ভাইবোনের ভবিষ্যতের প্রশ্ন আমার সামনে তখন, সুতরাং নিজের স্বপ্নের গলা টিপে ধরা ছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিল না। নিজের পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বাবার জায়গায় ওই কোম্পানিতে চাকরি নিতে বাধ্য হই… আইএএস হওয়ার স্বপ্ন আমার চুরমার হয়ে যায়। পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হই। মা, আমারও অনেক স্বপ্ন ছিল। আমিও চেয়েছিলাম আমার নিজের সংসার, যেখানে আমি সকলের মধ্যমণি হয়ে থাকব। তুমি তো মা, তুমি কেন আমার সেই রামধনুরঙের স্বপ্নগুলো দেখতে পাওনি? নিজের স্বামীর সমস্ত দায়িত্ব আমার কাঁধে ফেলে দিয়ে নিজে সুখের নিদ্রায় ডুবে গেছ। শিবু, এষা, ইমন যে-যার জীবনে সেটেল হয়ে গেছে। আজ এতদিন পর তোমরা আমার খারাপটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছ, অথচ ভালোটা কখনও তোমাদের চোখেই পড়ল না। মা, আমিও তোমার মেয়ে। তুমি কেমন মা যে-কিনা নিজের তিন সন্তানের জীবন সুন্দর করে গড়ে দিতে গিয়ে বড়ো মেয়ের জীবন ছারখার করে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করোনি?’

মা-কে পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকতে দেখে ইলা চুপ করে যায় কিন্তু নিজের রাগকে কিছুতেই সংযত করতে পারে না। ভাইয়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে, ‘আজ লজ্জায় তুই মাথা তুলতে পারছিস না… সেদিন এই বস্তুটা কোথায় ছিল যখন মেডিকেল এন্ট্রান্স পরীক্ষায় তিন তিনবার ফেল করেছিলি? ডোনেশন দিয়ে নাম ঢোকানোর জন্য বেশ কয়েক লাখ টাকার প্রয়োজন হয়েছিল? এর জন্য কতটা মূল্য আমাকে দিতে হয়েছিল কোনওদিন খোঁজ নিয়েছিস… তোকে ডাক্তার বানাবার জন্য আমার কুমারীত্ব বিসর্জন দিতে হয়েছিল। তখন তোদের বয়স এতটাও কম কিছু ছিল না যে তোরা কিছুই বুঝতে পারিসনি এত টাকা দিদি কীভাবে নিয়ে এল? অথচ আজ যখন তোদের দরকার ফুরিয়েছে তখন আমি তোদের চোখে এত খেলো হয়ে গেলাম?’

শিবু মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল, কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না। তবুও ইলার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে মুখ খুলতে বাধ্য হল, ‘তুই ভুল বুঝছিস দিদি… আমি ঠিক এটা বলতে চাইনি।’

আহত বাঘিনির মতো গর্জে উঠল ইলা, ‘চুপ কর… আমি নিজের কানে শুনেছি তোরা আমার সম্পর্কে কী ভাবছিস… আর এষা তুই কী করে ভুলে গেলি যেদিন পাড়ার ওই গুন্ডা ছেলেটার সঙ্গে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলি? ভাগ্যিস সম্রাট স্যারের ড্রাইভার তোদের দেখে ফেলে স্যারকে তৎক্ষণাৎ জানিয়েছিল…। সেদিন ওই সম্রাট-ই আমাকে জানাবার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ থানায় যাওয়ার জন্য গাড়িটাও আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তোকে পাত্রস্থ করার জন্য কতটা কাঠখড় আমাকে পোড়াতে হয়েছিল কোনওদিন খবর নিয়েছিস… তোর শ্বশুরবাড়ির ডিমান্ড পূরণ করার জন্য কত টাকা আমি ধার নিয়েছি জিজ্ঞাসাও করিসনি কখনও। বাড়ির কেউ জানতে চায়নি কখনও এত টাকার ব্যবস্থা আমি একা কীভাবে করলাম? আর আজ আমার জন্য শ্বশুরবাড়িতে তোকে লজ্জা পেতে হচ্ছে! পাঠিয়ে দিস তোর দেওরকে। কিছু না কিছু বন্দোবস্ত আমি আমাদের কোম্পানিতে ঠিকই করে দিতে পারব।’

দিদির মুখে পুরোনো কথাগুলো শুনে হঠাৎই অনুতাপে দগ্ধ হতে থাকল এষা। সত্যিই দিদির এতবড়ো ত্যাগ স্বীকারের বদলে ওরা দিদির জন্য কী করেছে? চোখের জল মুছে নিয়ে দিদিকে যেন নতুন করে দেখল। সবার সামনেই বলে উঠল, ‘সেদিন পালিয়ে যেতে দিতিস আমাকে ছেলেটার সঙ্গে…। কী দরকার ছিল আমার জন্য নিজের এত বড়ো ক্ষতি করার…। পড়াশোনা করিয়ে আমাদের যোগ্য করে তুলেছিস, আমাদের উচিত ছিল বাড়ির দায়িত্ব ভাই-বোন সকলে মিলে তোর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। নিজের জন্য বিষটা তুলে রেখে আমাদের অমৃত খাইয়েছিস, আর আমরা তোর এই ভালোবাসার কী প্রতিদান দিলাম? কেন আমাদের জন্য নিজেকে এভাবে নিঃশেষ করে দিলি? নিজে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে গেলি অথচ আমাদের গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগতে দিলি না।’, আর কথা বলতে পারল না এষা, কান্নায় ভেঙে পড়ল।

মা এতক্ষণ মুখ নীচু করে সবকিছু শুনছিলেন, এবার বড়ো মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সত্যি ইলা, আমরা এতটা নির্দয় কী করে হতে পারলাম। মেয়ের স্বার্থত্যাগকে সম্মান করার বদলে তোর প্রতি এতটা কঠোর কীভাবে হয়ে উঠলাম… ইমন যা তো মা, তোর দিদির জন্য চা করে নিয়ে আয়।’

‘আমার জন্য কাউকে চা করতে হবে না’, বলে ইলা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

বিছানায় এসে বসতেই পুরোনো সব স্মৃতি এক এক করে চোখের সামনে ভিড় করতে লাগল। এই পরিবারটার জন্য কী না করেছে ও। সম্রাট স্যার ওর জন্য অনেক কিছু করেছেন, কিন্তু উনিও তো সবকিছু পাওনা-গন্ডা পুরোপুরি উশুল করে নিয়েছেন ওর দেহটাকে ব্যবহার করে। তা সত্ত্বেও পরিবারের সকলকে সুখী করতে পেরেছে এই ভেবে নিজের ক্ষতিটা নিয়ে কোনও অনুতাপ ও কোনওদিন করেনি। সবকিছু ভুলে জীবনে এগিয়ে যাওয়ারই চেষ্টা করেছে। যখনই দায়িত্বের বোঝা নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে, তখনই তার মূল্য দিতে হয়েছে শরীর দিয়ে। অথচ এই নিয়ে কারও কাছে কোনওদিন নালিশ জানায়নি ইলা।

অথচ একটা সময় কত স্বপ্ন ছিল ওর চোখে। কিন্তু অন্যদের স্বপ্নপূরণ করতে গিয়ে নিজের দিকে তাকাবার সময় পেল কোথায়? হঠাৎ করে আজ এতদিন পর শেখরের চেহারাটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল যে কিনা ইলাকে নিজের প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবাসত। যার সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখত ইলা।

অথচ ইলাকে তিল তিল করে পরিবারের জন্য মরতে দেখতে পারত না শেখর। বহুবার বিয়ের প্রস্তাব রেখেছে ইলার সামনে। ইলাই পারেনি সেই ডাকে সাড়া দিতে। শেষে অভিমান করে সরে গেছে শেখর। শুধু ইলার উপরেই অভিমান নয়– সমস্ত পৃথিবীর প্রতি দুর্বার অনীহা নিয়ে ঈশ্বরের কোল-কে বেছে নিয়েছিল শেখর।

আজ এত বছর পর আপশোশের আগুনে দগ্ধ হতে থাকে ইলা। শেখর চেয়েছিল ইলার দায়িত্ব ভাগ করে নিতে কিন্তু আত্মসম্মান হারাবার ভয়ে সেদিন ইলা শেখরকে ফিরিয়ে দিয়েছিল খানিকটা জেদবশতই। কঠোর করে নিয়েছিল নিজেকে। আজ, কে মূল্য দেবে তার চোখের জলের?

অনেকটা সময় পেরিয়ে যেতেও ইলা দরজা না খোলাতে ইলার বাড়ির সকলে চিন্তিত হয়ে পড়ল, যদি মেয়েটা অভিমান করে খারাপ কিছু একটা করে বসে। সকলে দরজার বাইরে ওকে ডাকাডাকি আরম্ভ করে দিল। কিন্তু বাড়ির সকলের থেকে পাওয়া আঘাত ইলাকে পাথর করে তুলেছিল। ভাই-বোনের শত ডাকাডাকিতেও ইলার আচ্ছন্ন ভাব কাটল না। মরার মতো পড়ে রইল বিছানায়।

পরিস্থিতির গুরুত্ব শিবুকে চিন্তায় ফেলে দিল। ঘাবড়ে গিয়ে এবং মায়ের পীড়াপীড়িতে ও ইলার অফিসের সহকর্মী জাভেদকে ফোন করল তাড়াতাড়ি ওদের বাড়িতে চলে আসার জন্য। জাভেদের বাড়ি ইলার বাড়ি থেকে খুব দূরে নয় বলেই পনেরো মিনিটের মধ্যে জাভেদ পৌঁছে গেল ইলাদের বাড়ি।

জাভেদ এসে ইলার নাম ধরে ডাকাডাকি করতেও দরজা বন্ধই রইল। জাভেদ এবার ভয় পেল, ঝোঁকের বশে ইলা কিছু করে বসেনি তো?

‘শিবু, আমার মনে হয় দরজা ভেঙে ফেলাই উচিত হবে, জাভেদের গলার স্বরে ব্যাকুলতা স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠল।

বহু বছরের দৗড়ঝাঁপের পর ইলার নিজেকে বড়ো ক্লান্ত লাগছিল। ঘুমে আচ্ছন্ন হয়েছিল ওর মস্তিষ্ক, ওর সারা শরীর। হঠাৎ ঘোরের মধ্যে দূর থেকে বহু পরিচিত একটা কণ্ঠ ভেসে আসতে শুনল। হঠাৎই মনে হল ওর নাম ধরেই ডাকছে পরিচিত কণ্ঠটি। কোনওমতে টেনে তুলল শরীরটাকে, টলতে টলতে এসে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলতেই প্রথমে যার উপর দৃষ্টি পড়ল, নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারল না ইলা। টলোমলো পায়ে এগিয়ে আসতেই জাভেদের মজবুত বাহু জড়িয়ে ধরল ইলাকে শক্ত করে। জাভেদের চোখের গভীরে লুকিয়ে থাকা নিশ্চুপ ভালোবাসার সমুদ্রে তলিয়ে যেতে যেতে নতুন করে আবার যেন বাঁচার ইচ্ছা জেগে উঠল ইলার মনে। ধবংসের অতলে তলিয়ে যেতে যেতেও বাঁচার স্পৃহা ইলাকে চেপে ধরল।

একমাসের মধ্যে জাভেদের সঙ্গে ইলার কোর্ট ম্যারেজ হয়ে গেল। জাভেদের স্ত্রী দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিয়েই মারা যায়। জাভেদের বৃদ্ধা মা ফতিমা বেগমও জাভেদের দুই সন্তানের দেখাশোনাও আর করতে পারছিলেন না। একই কলেজে পড়ার সময় থেকেই ইলাকে নিজের জীবনসঙ্গিনী করার স্বপ্ন ছিল জাভেদের। কিন্তু ধর্মের দূরত্ব জাভেদের পায়ের বেড়ি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কলেজের দিনগুলোতে সেটা লঙঘন করার ক্ষমতা জাভেদের ছিল না। ইলাও কোনওদিন জানতে পারেনি ওর প্রতি জাভেদের মনোভাব, আর জানলেও হয়তো সম্পর্কের মান রাখা সেদিন তার পক্ষেও সম্ভব হতো না।

জাহিদার সঙ্গে বিয়ের পরেও ইলাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি জাভেদ। জাহিদার মৃত্যুর পর ইলাকে নিজের করে পাওয়ার ইচ্ছা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। ইলাও জাভেদের চোখের ভাষা পড়তে ভুল করল না। অফিস থেকে আসতে যেতে মাঝেমধ্যেই ইলা চলে যেত জাভেদের বাড়ি। ওখানে বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে নিজের অতৃপ্ত মাতৃত্বের অভাব পূরণ করার চেষ্টা করত। জাভেদের সঙ্গে সঙ্গে ফাতিমা বেগমও ইলার আসার অপেক্ষায় চোখ চেয়ে থাকতেন। বহুবার ইলা জাভেদের দ্বিতীয় বিয়ে দেবার কথা তুলেছে কিন্তু ফাতিমা বরাবরই বাচ্চাদের সৎমার কথা ভেবে শিউরে উঠেছেন।

বাচ্চাদের প্রতি টান অনুভব করলেও জাভেদকে বিয়ে করে ধর্মের উঁচু দেয়াল পেরোবার সৎসাহস ইলা তখন জোটাতে পারেনি কিন্তু আজ এই কাঁটাতার ও অনায়াসে পার করে নিতে পারল। কে কী বলবে, পারিবারিক বা সামাজিক প্রতিক্রিয়া কী হবে, এসব ভাবনা দূরে সরিয়ে রেখে জাভেদের সবল বাহুতে নিজের ক্লান্ত শরীর মনকে একসাথে সঁপে দিল। জাভেদেরও বহু বছরের জমে থাকা ভালোবাসা ফল্গুনদীর ধারায় ইলার প্রতি ঝরে পড়তে বিলম্ব হল না। ফাতিমা বেগমও নিজের বিয়ের ওড়না দিয়ে ইলাকে জড়িয়ে দুহাতে নিজের বুকে টেনে নিলেন।

ইলার অফিসেও এই বিয়ে নিয়ে আলোচনার বদলে সকলে খুশি হয়ে একটা পার্টির আয়োজন করল। সম্রাট স্যারও অনুষ্ঠানের অনেকটা দায়িত্বই নিজের উপর নিয়ে নিলেন। বিয়ের সাজে সজ্জিত হয়ে ইলা আর জাভেদ অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ হয়ে উঠল। ছাইয়ের গাদায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ-কে পুনরুজ্জীবিত করতে, নতুন আলোয়, নতুন খুশিতে জীবনকে ভরে তুলতে দুজনে একে অপরের কাছে অঙ্গীকার বদ্ধ হলও।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...