গাড়ি পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। দুপাশে সারি সারি পাইন গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ গাছগুলোর প্রায় প্রতিটি একই আকৃতির। গাছের তলায় মাটি সংলগ্ন অঞ্চলটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মাটির দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল অসংখ্য পাইন কোন এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। আমরা গাড়ি না থামিয়ে পারলাম না।

কয়েকজন গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম এবং প্রায় দুই তিন ব্যাগ বোঝাই করে ফেললাম পাইন কোন। এমন দৃশ্য আগে দেখিনি, পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়া হয়েছে অনেক, কিন্তু এতো পাইন ফল আগে এভাবে চোখে পড়েনি। এটা উত্তরাঞ্চলের আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য কিনা জানি না। ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম গাছে গাছে, পাতার ফাঁকে ফাঁকে পাইন ঝুলে আছে। চমৎকার দৃশ্য।

আমরা চলেছি রানিক্ষেত হয়ে কৌশানির দিকে। রানিক্ষেত থেকে কৌশানির দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার। অসম্ভব সুন্দর মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে দিয়ে বাঁক নিতে নিতে এগিয়ে চলেছি। কৌশানি বাগেশ্বর জেলায় অবস্থিত একটি আধা শহর। কথিত আছে মহাভারতের যুগে কৌশিক মুনি এখানে তপস্যা করেছিলেন বহুদিন, তাই এই অঞ্চলের নাম হয়েছে কৌশানি।

কৌশানি থেকে হিমালয়ের দৃশ্য বড়োই নয়নাভিরাম। প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার ওয়াইড প্যানোরমিক ভিউ এখান থেকে পাওয়া যায়। কৌশানি থেকে হিমালয়ের বিস্তার কিছুটা হলেও বোঝা সম্ভব। হিমালয়ের প্রায় নয়টি শৃঙ্গ যেমন ত্রিশূল, নন্দাদেবী, চৌখাম্বা, পঞ্চচুল্লি ইত্যাদি এখান থেকে দেখা যায় এবং বলতেই হয় প্রত্যেকটি তার আলাদা আলাদা রূপ ও সৌন্দর্য নিয়ে অহংকারের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বিরাজমান। অপূর্ব সুন্দর এই ধ্যানগম্ভীর হিমালয়ের সামনে সবকিছুই কেমন তুচ্ছ মনে হয়।

এখানকার অন্যতম একটি আকর্ষণীয় স্থান হল গান্ধি আশ্রম। ১৯৩৯ সালে গান্ধিজি এখানে এসেছিলেন। এই স্থানের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তিনি প্রায় ১৪ দিন এখানে কাটান। গান্ধিজির ভাষায় কৗশানি হল ভারতের সুইটজারল্যান্ড। এই আশ্রমে থেকে তিনি ‘অনাসক্তি যোগ’-এর ওপর একটা বই লেখেন। সেই থেকেই এই আশ্রমের নামকরণ করা হয় অনাসক্তি আশ্রম।

খানিকটা চড়াই পথ উঠে পৌঁছোতে হয় গান্ধি আশ্রমে। এখান থেকে সূর্যোদয়ের দৃশ্য চমৎকার। চারিদিকে মেঘ আর পাহাড় ঘেরা আশ্রমটির পরিবেশ খুবই শান্তিপূর্ণ। কৌশানিতে থাকার জন্য অনেক হোটেল আছে। তবে সূর্যোদয় দেখার জন্য গান্ধি আশ্রমই শ্রেষ্ঠ। এই আশ্রমেই থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আশ্রমের সন্নিকটে কিছুটা হেঁটে গেলেই চোখে পড়ে পাইন, ফার, দেবদারু ইত্যাদি সরলবর্গীয় গাছের অরণ্য। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে প্রকৃতির কোলে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে নিতে চাইলে কৗশানি আসা সার্থক।

কৌশানি থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রুদ্রধারি জলপ্রপাত ও মন্দির। প্রাচীন গুহা পরিবেষ্টিত এই মন্দিরে যেতে অবশ্য অনেকটা পথ হাঁটতে হয়। এছাড়া এখানে চা বাগান উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। তবে দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ির তুলনায় এটি নিতান্তই ছোটো মনে হতে পারে। এখানে এক দিন থেকে পরদিন আমরা রওনা হলাম মুন্সিয়ারির উদ্দেশে। যাওয়ার পথে ১৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত প্রাচীন ঐতিহ্যশালী পার্বতীমন্দির বৈজনাথ। মন্দিরটি  গোমতী নদীর পাশে অবস্থিত। মন্দিরটি  দ্বাদশ শতকে তৈরি। এখানে একই সাথে শিব, গণেশ, পার্বতী, কুবের ইত্যাদি দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। মন্দিরের প্রাচীনত্ব এবং নির্মাণ শৈলী আমাদের মুগ্ধ করল।

কৌশানি থেকে বাগেশ্বর হয়ে মুন্সিয়ারির দূরত্ব প্রায় ১১৫ কিলোমিটার। মুন্সিয়ারির উচ্চতাও অনেকটাই বেশি। দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ গোমড়া, –দূরের পাহাড়গুলো মেঘের আবরণে ঢেকে গেছে। আমাদের ড্রাইভার ভাই প্রমাদ গুনলেন, বললেন, ‘আবহাওয়ার অবস্থা ঠিক নয়, বৃষ্টি হতে পারে।’ ধীরে ধীরে মেঘের রাজ্যে প্রবেশ করলাম। চারপাশ অদৃশ্য হয়ে পড়ল। সঙ্গে শুরু হল টিপ টিপ বৃষ্টি।

অভিজ্ঞ ড্রাইভার সুদক্ষ ভাবে গাড়ি ড্রাইভ করে চলেছেন। তবে ওনার মুখ দেখে বুঝলাম উনি সম্ভবত দুশ্চিন্তা করছেন এবং তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। এমন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় চিন্তা হওয়াটাও অমূলক নয়। কোথা থেকে ঘন মেঘের পাহাড় এসে যেন আমাদের পথ অবরুদ্ধ করে ফেলল। চার-পাঁচ হাত দূরে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। তার ওপর এমন কঠিন দুর্গম রাস্তা। এই খারাপ আবহাওয়ায় পাহাড়ি পথে ড্রাইভ করতে যথেষ্ট এলেম লাগে। এমন দুর্যোগে তো আমাদের প্রাণ হাতে এসে ঠেকল।

গাড়ি যত এগিয়ে চলেছে বৃষ্টি তত বাড়তে লাগল। আমরা এবার আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। বললাম গাড়িটা রাস্তার একপাশে থামিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে হয় না। ড্রাইভার ভাইয়া এখানকার লোক, আমাদের থেকে ওনার অভিজ্ঞতাও বেশি। উনি বললেন– এক পাশে দাঁড়ালে উলটোদিক থেকে গাড়ি এসে ধাক্বা মারতে পারে, তাছাড়া এখানে পাহাড়ে যখন তখন ধস নামে। বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই, মাটি আলগা হয়ে পড়ে এবং মাটির সঙ্গে বড়ো বড়ো গাছগুলো খড়কুটোর মতো নীচে গড়াতে থাকে। আমাদের সকলের তখন যে ঠিক কি অবস্থা তা কথায় প্রকাশ করা খুব কঠিন।

ওদিকে দুর্যোগ ক্রমে বেড়েই চলেছে। বৃষ্টির সঙ্গে বড়ো বড়ো বরফের ফোঁটা পড়তে লাগল, প্রকৃতি মহারোষে যেন শিলাবৃষ্টি শুরু করল। আমরা বারবার জিজ্ঞাসা করলাম, কাছাকাছি কোনও বসতি অঞ্চল, বাজার আছে কিনা, একবার সেই পর্যন্ত পৌঁছোতে পারলে জীবনটা এ যাত্রা রক্ষা পায়! যা অবস্থা যে-কোনও সময় গাড়ির চাকা স্লিপ করে অতল খাদে গড়িয়ে পড়লে আমাদের চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট থাকবে না। প্রকৃতি যদি কৃপা করে তবেই এই যাত্রা বাঁচা সম্ভব। কিন্তু তেমন কোনও আভাস নেই। গাড়ির সামনের কাচে বরফের বড়ো ফোঁটা এসে পড়ছে। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বরফের

আস্তরণ-এ রাস্তা ঢেকে গেছে।

খুব ধীরগতিতে সন্তর্পণে আমরা বেশ খানিকটা পথ পার করে এলাম। সামনের একটা বাঁক নিতে দেখলাম দু একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এখানে রাস্তাটা বেশ চওড়া। বৃষ্টি আগের চেয়ে একটু ধরেছে। ড্রাইভার ভাইয়া সামনের গাড়ির পিছনে আমাদের গাড়ি দাঁড় করালেন। কিছুটা দূরে একটা দুটো দোকানঘর, কিন্তু সবগুলোই বন্ধ। গাড়ি থেকে নেমে একটু খোঁজ নিয়ে জানা গেল সামনে কিছুটা দূরে

দু-একটা হোটেল আছে। রাস্তায় আমাদের অনেকটা সময় লেগে গেছে। এখনও আমরা অর্ধেক রাস্তাও পৌঁছোতে পারিনি। তাছাড়া যে-বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে বেঁচে ফিরেছি, আজ আর যাত্রা করা ঠিক হবে না হয়তো। রাস্তা লাগোয়া হোটেলে ঘর পাওয়া গেল। সুতরাং ঠিক করা হল আজ রাতটা এখানে কাটিয়ে কাল মুন্সিয়ারির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া যাবে।

পরদিন সকালে উঠে দেখলাম মেঘের পর্দা সরে গেছে, পরিষ্কার আকাশে যাত্রা শুরু হল। বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ের চূড়াগুলো দূর আকাশে উঁকি দিচ্ছে। কাছের পাহাড় উপত্যকায় সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে। এ এক অভাবনীয় দৃশ্য। নীল আকাশ ধূসর সাদা মেঘ, মিলেমিশে এক অকৃত্রিম স্বর্গীয় সৗন্দর্য তৈরি করেছে। আমি চোখ ফেরাতে পারছি না! এই দৃশ্য ক্যামেরায় ধরার চেষ্টা বৃথা।

গাড়ি পাকদন্ডি পথে চড়াই-উতরাই পার করে এসে দাঁড়াল বির্থি জলপ্রপাতের সামনে। পাহাড়ের বুক চিরে দুধ সাদা জল উচ্ছল গতিতে নীচে এসে পড়ছে। ১চ্৬ মিটার উঁচু জলপ্রপাত মুন্সিয়ারি থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের পৗঁছোতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গেল।

মুন্সিয়ারি পিথোরাগড় জেলায় অবস্থিত, উচ্চতা ২চ্ঙ্ম০ মিটার। স্থানটির প্রাকৃতিক সৗন্দর্য অতুলনীয়। মুন্সিয়ারি শব্দটি তিববতি শব্দ ‘মুন’ অর্থ তুষার কণা এবং ‘শিয়ারি’ অর্থ খেত থেকে এসেছে। এর

ইংরেজি অর্থ– ‘দ্য প্লেস অফ স্নো’। পাহাড় এবং উপত্যকা জুড়ে বসতি, দূরে হিমায়িত তুষার শৃঙ্গ এক মনোমুগ্ধকর শৈল্পিক সৗন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বিকেলে আড়াই কিলোমিটার দূরে বিখ্যাত এবং প্রাচীন নন্দাদেবী মন্দিরে গেলাম। প্রায় সাড়ে সাত হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর সমতল জায়গা, তার শেষ প্রান্তে অবস্থিত পাহাড়ের এক কোণে মন্দিরটি অবস্থিত। পাথুরে সরু রাস্তা মন্দির পর্যন্ত চলে গেছে। মন্দিরটি আকারে ছোটো, বাইরে ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। দূরে-কাছে হিমালয়ের বিভিন্ন শৃঙ্গ। ওপাশের কাছের পাহাড় জুড়ে ধাপ চাষ করা হয়েছে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে কতকগুলো সবুজ সমান্তরাল রেখা পাহাড়ের গায়ে অাঁকা হয়েছে। এই বিশাল হিমালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।

পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙল। আবছা আলোয় বরফচূড়াগুলো জেগে আছে। পূর্ব আকাশ লাল হতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে আলোর রশ্মি পর্বতচূড়ায় এসে পড়ল। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। ধূসর পর্বতের শৃঙ্গগুলি গেরুয়া আভায় যেন জ্বলে উঠেছে। যেন পাণ্ডবরা আরও একবার রন্ধন কার্য সম্পন্ন করতে চুলায় আগুন ধরাল। এই হল বিখ্যাত পঞ্চচুল্লি। আমার মনে হল নামটা বড়ো সার্থক। গনগনে আগুনে কেবলমাত্র পর্বতের উপরের অংশের শৃঙ্গগুলির লাল আভা যেন চারিপাশে সকালের বার্তা বহন করে আনল। এ দৃশ্য ভোলার নয়। তবে দিনের বিভিন্ন সময়ের আলোতে পঞ্চচুল্লির সৗন্দর্য বিভিন্ন রকম।

এখানকার অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে ট্রাইবাল হেরিটেজ মিউজিয়াম অন্যতম। মুন্সিয়ারি বাজার থেকে দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই মিউজিয়ামটিতে স্থানীয় মানুষদের ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিসপত্র রয়েছে। যেমন রান্নার পাত্র, হুঁকো, গয়না, কয়েন, সংগীতের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। এছাড়া প্রায় সাত কিমি দুরে অবস্থিত খালিয়া টপ,  রয়েছে কালামুনি মন্দির ইত্যাদি।

মুন্সিয়ারির স্বর্গীয় স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে আমরা চললাম পরের গন্তব্য পাতাল ভুবনেশ্বর এর উদ্দেশ্যে। এটি পিথোরাগড় জেলায় অবস্থিত। নিকটবর্তী শহর ৩৮ কিলোমিটার দূরে চৗকরি। হোটেলে লাগেজ রেখে আমরা রওনা হলাম রোমাঞ্চের সন্ধানে, পাতাল ভুবনেশ্বর-এর উদ্দেশ্যে।

দূর থেকে দেখা যায় পাইন, ফার, দেবদারু গাছে ঢাকা পাহাড়ের গায়ে ছোটো মন্দির পাতাল ভুবনেশ্বর। এটি ১ছ০ মিটার দীর্ঘ এবং ৯০ ফুট গভীর চুনাপাথরের গুহা। অন্ধ্রপ্রদেশের আরাকুর উপত্যকার বোরা কেভ-এর কথা মনে পড়ছিল। কিন্তু এই গুহার প্রবেশপথটি বড়োই

সংকীর্ণ কোনওমতে বসে, শুয়ে বা হামাগুড়ি দিয়ে একজন প্রবেশ করতে পারে। অনেককে দেখলাম ভয়ে আর সেই ঝুঁকি নিতে চাইলেন না।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম কতদূর পর্যন্ত এই ভাবে যেতে হবে? একজন বললেন, অসুবিধা নেই ভেতরে গাইড আছে, সে-ই আপনাদের সব রকম সাহায্য করবে। দুই আড়াই ফুটের সংকীর্ণ পথ দিয়ে ১ঙ্ম০ ফুট নীচে যেতে হয়। প্রবেশপথ বড়োই ছোটো, নীচে অবশ্য অনেকটা বৃহৎ জায়গা রয়েছে। কপাল ঠুকে নামতে শুরু করলাম। ভেতরে মোটা চেন ঝোলানো আছে যাতে গুহার ভেতরে প্রবেশকারীরা ওটার সাহায্য নিয়ে নীচে নামতে পারেন। কোনও মতে ওই সরু পথ বেয়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, অবশ্যই মাথা বাঁচিয়ে নীচে নেমে এলাম। গুহার মধ্যে বিদ্যুতের আলো রয়েছে। তবে তা বড়োই নিস্তেজ।

নীচের জায়গাটি বেশ প্রশস্ত। চারিদিকে চুনাপাথরের নানান প্রাকৃতিক কারুকার্য রয়েছে। তবে গাইড আমাদের নিয়ে গেলেন সেই পৗরাণিক যুগে। ত্রেতাযুগের সূর্য বংশের রাজা ঋতুপর্ণ প্রথম এই গুহা আবিষ্কার করেন। উনি এখানে প্রবেশ করে দেবাদিদেব মহেশ্বর এবং ৩৩ কোটি দেবদেবীর দর্শন পেয়েছিলেন। এই গুহার পরতে পরতে বহু দৈবীক কাহিনি চিত্রিত রয়েছে। এখানে রয়েছে শেষনাগ, যার মুখগহ্বর ভিতর দিয়ে গুহার বাকি পথ চলতে হয়। চলতে চলতে দর্শন মেলে আদিগণেশ, সহস্রদল কমল, যজ্ঞকুণ্ড, কালভৈরব ইত্যাদি দেবতা এবং তাদের আখ্যান। অনেকটা এগিয়ে দর্শন পাওয়া যায় কেদারনাথ, বদ্রিনাথ, অমরনাথ তথা চারধামের। দেখা মেলে হস্তীপদ এবং আরও কত কি।

আমি যেতে যেতে ভাবছি ভেতরে যতটা দেখতে পেলাম গুহাটা তার চেয়ে না জানি কত বড়ো। গাইড-কে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ভেতরের ফাঁকফোকরের সংকীর্ণ পথ যে কোথায় শেষ হয়েছে, তা তারাও জানে না। কথিত আছে এই পথ কৈলাস পর্বতে গিয়ে মিশেছে। মহাভারতের যুগে পাণ্ডবরা এই গুহায় বহুদিন কাটিয়েছিলেন।

সে যাই হোক রামগঙ্গা, সরযূ, গুপ্তগঙ্গা ইত্যাদি নদী এই চুনাপাথরের পাহাড়ের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চুনাপাথরের গর্ভে যে অসামান্য স্ট্যালাকটাইট, স্ট্যালাগমাইট এবং অন্যান্য ভাস্কর্য তৈরি করেছে তা যে-কোনও বড়ো ভাস্কর্যশিল্পী কে-ও অবলীলায় হার মানাবে। আমি মুগ্ধ, বিস্মিত, অভিভূত এবং অবশ্যই রোমাঞ্চিত। ফিরে এলাম হোটেলে।

চৌকরি পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট একটি জনপদ। এখানকার স্থানীয় মানুষরাও সরল এবং আন্তরিক। এই স্থান থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য বড়োই আকর্ষণীয়। চৌকরি যে-পাহাড়ে অবস্থিত, সেখানে থেকে সামনে দেখা যায় বহু স্তরের পর্বতমালা। একেবারে কাছে পাহাড়গুলি গাঢ় সবুজ। তার পেছনে যে-পর্বত রয়েছে সেগুলো ধূসর রঙের। আর একেবারে শেষে শ্বেতশুভ্র হিমালয় পর্বত। যেন নীল আকাশের গায়ে স্তরে স্তরে কেউ তুলি দিয়ে ছবি এঁকে রেখেছে। এখান থেকে নন্দাদেবী, নন্দাকোট, চৗখম্বা, ত্রিশূল এবং পঞ্চচুল্লির দেখা পাওয়া যায়।

এখানে দেবদারু, পাইন বনে দেখা মেলে বিভিন্ন ধরনের পাখির। গাছের ছায়ায় পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আপনি পৗঁছে যেতে পারেন এক কল্পনার স্বর্গরাজ্যে। এখানের অরণ্যে কস্তুরী মৃগর দেখা পাওয়া যায়। চৗকরি-তে বেশ কয়েকটা দর্শনীয় মন্দিরও রয়েছে। এই নিরিবিলি নৈসর্গিক স্থান ছেড়ে যেতে মন চায় না। তবে যেতে তো হবেই। আমরা আলমোড়া হয়ে কাঠগোদাম স্টেশনে পৗছোলাম। এবার বাড়ি ফেরার পালা।

কৌশানি, মুন্সিয়ারি এবং চৌকরির সঙ্গে রানিক্ষেত এবং নৈনিতাল, ভীমতাল, আলমোড়া, জিম করবেট ইত্যাদি একসঙ্গে ঘুরে আসা সম্ভব। শুধু হাতে একটু বেশি সময় নিয়ে যাত্রা শুরু করতে হবে। তবে বলতেই হয় কুমায়ুন হিমালয়ের সৗন্দর্য মনের মাঝে পাকাপাকি জায়গা করে নিল। এ স্মৃতি বহুদিন মনের গভীরে থেকে যাবে।

কীভাবে যাবেন – হাওড়া বা কলকাতা স্টেশন থেকে উত্তরাখন্ড পৗঁছোনোর জন্য অনেক ট্রেন আছে। কাঠগোদাম স্টেশনে নেমে প্রাইভেট গাড়ি ঠিক করে রানিক্ষেত হয়ে কৌশানি পৗঁছোনো যায়। প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করেই মুন্সিয়ারি এবং চৌকরি যাওয়া ভালো। এছাড়া বায়ুপথেও উত্তরাখন্ড যাওয়া সম্ভব।

কোথায় থাকবেন – কৌশানি, মুন্সিয়ারি ও চৌকরি-তে থাকার জন্য বহু হোটেল আছে। তবে আগে থেকে বুক করে যাওয়াই সুবিধাজনক।

কখন যাবেন – বর্ষাকাল ছাড়া বছরের যে-কোনও সময় কুমায়ুন গাড়োয়াল হিমালয়ের সৌন্দর্য অবলোকন করতে রওনা হওয়া যায়। তবে বর্ষাকালে পাহাড়ের সৌন্দর্য অন্যরকম।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...