–হ্যাঁ মা বলো।

–কোথায় আছিস রে? এতক্ষণ ধরে ফোন করেই যাচ্ছি কোনও রেসপন্স নেই।

–কেন আমি তো টিউশনে ছিলাম। তোমাকে তো বলেই এলাম, কলেজ ফিরতি টিউশন করে ফিরব। কিছু কি দরকার আছে? এতগুলো মিস্ কল!

–তোর বাবার ফোন অনেকক্ষণ ধরে বন্ধ আছে। তোকে কি কিছু বলে গেছে?

–না তো। দুটো নম্বরই বন্ধ?

–হ্যাঁ। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি। সেই দুপুর থেকে।

–কোথাও গেছে হয়তো।

–আজ পর্যন্ত কোনও দিন তোর বাবা না বলে কোথাও গেছে? অফিসে দেরি হলেও ফোন করে জানিয়ে দেয়।

–তুমি চিন্তা কোরো না, আমি দেখছি। তুমি একবার বীরেনকাকুকে ফোন করে দ্যাখো।

–তিন্নি, অফিসে ফোন করেছিলাম। বলল, সেই দুপুরেই বেরিয়ে গেছে।

তিন্নি আর কথা না বাড়িয়ে ফোনটা কেটে বাবার নাম্বার ডায়াল করল। বাবা ওয়ান, বাবা টু। সুইচড অফ। মোবাইলে দেখল আটটা কুড়ি। স্ট্যান্ডে না গেলে অটো পেতে সমস্যা হবে। কিন্তু বাবা গেল কোথায়? একে একে ব্যাচের ছেলে মেয়েরা সব বাড়ির দিকে পা বাড়াল। তিন্নির সাথেও দুজন এল। একজন মাঝ রাস্তাতেই অটো পেয়ে গেল। তিন্নি অন্য আরেক ব্যাচমেটের সাথে কয়েকটা পা এগিয়ে এসে একটা এটিএম কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে সঙ্গীকে এগিয়ে যেতে বলে, নিজে এটিএম কাউন্টারের ভিতরে ঢোকে। টাকা তুলে স্ক্রীন-এ চোখ রাখতেই চমকে ওঠে। একি! এত টাকা! প্রিন্ট বের হল না। এই এক নতুন সমস্যা এসেছে, অর্ধেক কাউন্টারে প্রিন্ট বের হয় না। মেসেজটা বাবার মোবাইলে যাবে, তিন্নির নাম্বার ট্যাগ করেনি। কিন্তু এতগুলো টাকা হিসেব মিলছে না। কেউ কি, তাহলে ইচ্ছে করে এতগুলো টাকা ব্যাংকের আকাউন্টে ফেলে দিল? তাও আবার দু’লাখ। বাবার চিন্তার মাঝে আচমকা এই টাকার চিন্তাও পেয়ে বসল। এত সমস্যা এই ভাবে চলে আসবে ভাবেনি, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। বাবা এতক্ষণেও না ফিরলে মা এখন একা।

(২)

এক কথা বলতে বলতে প্রকাশের জিভে পলি পড়ে গেল। একেক সময় রেগে যায়, পরেক্ষণেই নিজেকে বোঝায়, বেচারা এরাই বা কোথায় যাবে, কয়েকদিন আগেই সেই টাক মাথার ভদ্রলোক এসে প্রকাশের ডেস্কে চেল্লাতে আরম্ভ করেছিলেন, ‘এর থেকে আমাকে একটু বিষ এনে দিন, খেয়ে সবাই মিলে বাঁচি। কোথায় ছিল আর কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে।’প্রকাশ সেদিন রাগেনি। ক্যাজুয়াল স্টাফ সমীরকে বলে, ‘এনাকে এক গেলাস ঠান্ডা জল দাও তো।’ জল পান করে ভদ্রলোক বেশ শান্ত স্বরেই বলেন, ‘বলুন তো ম্যানেজারবাবু, এভাবে ইন্টারেস্ট কমালে খাব কি? রাজ্য সরকারের চাকরি করতাম, রিটায়ার করে কতই বা পেয়েছি। এতে খাব, ডাক্তারকে দেব, না জমাব।’

ভদ্রলোকও সব বোঝেন, কিন্তু কী করা যাবে, নিয়ারেস্ট গায় দ্য গিলটি ওয়ান। এদিকে দিন দিন কাজের চাপটাও বাড়ছে। টিফিন খেতেই সময় পায় না। দুটো থেকে আড়াইটের সময় কিছু না কিছু কাজ এসে যায়। নিদেন পক্ষে লিংক ফেলিওর। একে ওকে ফোন করা তো আছেই। তবে কাস্টমাররা ভাবে এটা হয়তো ব্যাংকের লোকেদের ফাঁকিবাজির নতুন অস্ত্র। কথায় কথায় লিংক ফেলিওর। অর্ধেকজন বোঝে না এই ভার্চুয়াল ব্যাংকিং-এর যুগে অন্তর্জালই প্রধান স্তম্ভ। এত বোঝা সবার কম্ম নয়। ঘরের ভদ্রমহিলাই বোঝে না। কাজ করবার ফাঁকে একবার মোবাইলের স্ক্রীন-এ চোখ রাখল। না, এখনও পর্যন্ত মিস কল নেই। ভালোই আছে, দরকার হলে মিস্ কল দিয়ে ছেড়ে দেয়। কিছু বললে জবাব দেয়, ‘তুমি কেন্দ্রীয়, আমি রাজ্য। জানোই তো কতটাকা কম বেতন পাই।’ মায়ের দেখে মেয়েটাও হয়েছে ওইরকম। কথা বলতে না বলতেই, ‘বাপি কিছু ফান্ড ট্রান্সফার করে দেবে?’

–কত?

–বেশি নয়, হাজার পাঁচেক দিলেই হবে।

–হাজার পাঁচ! ভগবান, বাড়ি ভাড়া লাগে না নিজেরা রান্না করে খায়, তাও হাত খরচ হাজার পাঁচ, সেটা আবার শেষ মাসে। প্রথমে আরেক প্রস্থ পাঠানো হয়। মায়ের থেকে টাকা নেওয়া তো আছেই। প্রকাশ ঘড়িটার দিকে আরেকবার তাকাল। দুটো চল্লিশ। সিগারেট খেতে হবে। খিদেও পেয়েছে। কী টিফিন দিয়েছে কে জানে? প্রকাশ ব্যাগ খুলে টিফিন কন্টেনার বের করল। মুড়ি, একটুকরো শসা। প্রতিদিন এক। নিকুচি করেছে টিফিনের। উঠে ডাস্টবিনে পুরো টিফিনটা ফেলে সমীরকে বলল, ‘রায়বাবুকে বলবে খেতে যাচ্ছি। দেরি হবে একটু।’ম্যানেজার শোনে, কিন্তু রুমা শোনে না। ব্যাংকের দরজার বাইরে পা দেওয়া মাত্র মিস্ কল। একসাথে পাঁচবার। প্রকাশ একটু বিরক্তির সাথেই ফোন ডায়াল করে বলল, ‘কী হলটা কী? এত তাড়া কীসের?’

–কোথায় আছো?

–ভাগাড়ে। এইসময় কোথায় থাকি তুমি জানো না?

–শোনো আমি আজ বিকালেই তিন্নির কাছে যাচ্ছি। ওর শরীর খারাপ। তুমি এই কটা দিন একটু হোম ডেলিভারি থেকে আনিয়ে চালিয়ে নেবে। আমি কবে ফিরব জানি না।

–তিন্নির কী হয়েছে? চমকে ওঠে প্রকাশ।

–শরীর খারাপ বললাম না।

–শরীর খারাপ শুনলাম, কিন্তু কী হয়েছে সেটা তো জানতে হবে।

–তোমায় এইসব মেয়েলি ব্যাপারে নাক গলাতে হবে না।

–অদ্ভুত তো। মেয়েটা কি তোমার একার?

–শোনো অতো বকার সময় নেই। আমি রাখছি, আর হ্যাঁ কিছু টাকা ট্রান্সফার করে দেবে।

–কেন সিরিয়াস কিছু, ভর্তি করতে হবে?

–তুমি বড্ড ইনকুইজিটিভ হয়ে যাচ্ছ।

–এক কাজ করো কার্ড নিয়ে যাও সে রকম হলে কোথাও ভর্তি করে দেবে। ক্যাশলেস হয়ে যাবে।

–তোমাকে যা করতে বললাম তাই করো। এরকম বেসলেস কথা বোল না। আমি চিন্তা ভাবনা করে যেটা ভালো ভাবব, সেটাই করব। তোমাকে কিছু বলতে হবে না।

–ভালো। আমি টাকা দেব, কিন্তু কোনও আলোচনাতে থাকব না? আমার মেয়ে অথচ শরীর খারাপ হলে কী করবে সেটা বলবারও অধিকার নেই। এই না হলে বাবা। তা তুমি যাচ্ছ যে তোমার অফিস কী হবে?

–ইন্টিমেশন দিয়ে যাচ্ছি, ছুটি নিয়ে নেব। আর শোনো ডোন্ট বি সেন্টিমেন্টাল প্রকাশ। এখন ওসবের সময়ও নেই, লেট হার কিওর সুন।

প্রকাশ অনেকক্ষণ ধরে চেপে রাখা একটা শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলল, ‘আমি একবার তিন্নিকে ফোন করছি।’

– না না। রুমা প্রায় চমকে উঠল।

–না না মানে?

–ওকে এখন ফোন করতে হবে না। আমি পৗঁছে সব কিছু তোমাকে জানাব।

রুমার ফোনটা রাখবার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ কিছুসময় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কী হল তিন্নির! আর খাবার মুখে উঠবে না। এক কাপ চা বলল। বিস্কুটটা ভিজিয়ে মুখে তোলার আগেই মাটিতে পড়ে গেল। এরা বড্ড বেশি চিন্তা দেয়। রুমার এই স্বভাবটা ইদানীং হয়েছে। আগে এরকম করত না! কথাবার্তা সমস্ত কিছু শেয়ার করত। এমনকী চাকরি পাওয়ার বছর দুই পরে আপার ডিভিশনের একটা ছেলেকে ভালো লাগত। সে কথাও গোপন করেনি। তিন্নির স্কুলে পড়বার সময় অঙ্কে রিপিটেড কম নম্বর পাওয়া, বা এক বন্ধুর বার্থডে পার্টিতে ড্রিংক করে বাড়ি আসা, সবই প্রকাশের থেকে রুমাই বেশি বলত। সেসময় বরং প্রকাশ বোঝাত, শান্ত করবার চেষ্টা করত। এইচএস পাস করবার পরেই সব হিসাব কেমন যেন গোলমাল হয়ে যেতে আরম্ভ করল। উলটে যেতে লাগল সব কিছু। তিন্নি কোনওরকমে ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করল। প্রকাশ বলল, ‘শোনো ওর যা মেরিট তাতে সাধারণ লাইনে গ্র্যাজুয়েশন করুক। তারপরে না হয় কোনও একটা প্রফেশনাল কোর্স করানো যাবে। রুমা প্রথমে সব কথা শুনেও ছিল। প্রকাশের কথাতে রাজিও হল। কিন্তু বাধা এল রুমার দিদির কাছ থেকে। দিদির ছেলেটাও হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছে। জামাইবাবু একটা সরকারি জীবনবিমা কোম্পানির ডেভেলপমেন্ট অফিসার। হাবেভাবে টাকা আছে জাহির করে। কথায় কথায় বলে, ‘বুঝলে ভায়া সন্ধেবেলা ঠিক জল খেতে ইচ্ছে করে না।’ ঘরে ড্রিংক ক্যাবিনেটও আছে। বছরে দু’একবার প্রকাশও যায়। তবে দুইবোনের সাথে কী সব কথা হয় কে জানে?

একদিন অফিস থেকে প্রকাশ বাড়ি ফিরতেই রুমা বলে, ‘তিন্নিকে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি করে দাও। রাকাও ভর্তি হচ্ছে।’

–কোথায়?

–কলকাতায়।

কথাগুলো শুনে প্রকাশ এক্বেবারে আকাশ থেকে পড়ল। রুমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আরে দাঁড়াও, আমি সব কিছু আগে ভেবে দেখি। কোন কলেজ, কি তার ইনফ্রাস্ট্রাকচার, ক্যাম্পাসিং কী হচ্ছে, এই সব কিছু না দেখে শুনে তো আর ভর্তি করা যায় না। তাছাড়া এখন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বাজার ভালো নয়।’

–ও সব কিছু তোমাকে দেখতে হবে না। তুমি ও-সব বুঝবেও না, তার থেকে যে দেখছে তার ওপরেই সব কিছু ছেড়ে দাও।

–কার ওপর, তোমার জামাইবাবু? তা হলেই হয়েছে।

–সে তো হবেই দু দুটো ফ্ল্যাট, গাড়ি, সব তো তুমি কিনেছ তাই না?

– বাদ দাও।

–বাদ দেওয়ার কিছু নেই, জামাইবাবু সব কিছু দেখে এসেছে। খোঁজ খবরও নিয়েছে। রাকা তিন্নি দুজনেই ওখানে ভর্তি হবে।

–থাকবে কোথায়?

–কেন, গড়িয়াতে জামাইবাবু অতো বড়ো ফ্ল্যাট কিনেছে, ওখানেই থাকবে।

–শুধু দু’জন এই বয়সে এক সাথে! ব্যাপারটা ক্রুশিয়াল হয়ে যাবে না?

–তোমার কাছে হতে পারে, আমার কাছে নয়, ওদের কাছে তো নয়ই। তাছাড়া মাঝে মাঝে আমরা যাব, জামাইবাবুরা যাবে।

প্রকাশ আর কথা না বাড়িয়ে উত্তর দিল ‘ভালো। সবই যখন ঠিক করেই নিয়েছ তখন আর আমাকে বলবার কী আছে?’

রুমার কথামতোই তিন্নি ভর্তি হল। ক্লাসও চলল। সাত মাস কেটেও গেল। তারপরেই একদিন অফিসে ফোন করে রুমার এই সব কথা বলে, তিন্নির শরীর খারাপ নিয়ে এই রকম অদ্ভুত নাটক তৈরি করে, এই রকম আচমকা চলে যাওয়া।

রুমা ফোন করতে বারণ করলেও প্রকাশ তিন্নিকে ফোন করে। এক, দুই, তিন বার। না ফোন সুইচ অফ। রাকাকেও ফোন করে। বেজে গেল, ধরল না।

রুমার ফিরতে ফিরতে দিন দশ কেটে গেল। এর মাঝে প্রতিদিনই প্রকাশ ফোন করে যাওয়ার কথা বলতেই রুমা বলে ওঠে, ‘না না আমি যখন তোমাকে বারণ করেছি তখন তুমি আসবে না।’ একদিন অফিস ফেরত রাকাকেও ফোন করে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল। রাকাও কোনও স্পষ্ট উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিল। সীমা আবার নিজের বোন রুমাকে দোষ দিয়ে বলল, ‘আমার বোনটাই বাজে। সাধারণ একটা ঘটনাকে তাল বানিয়ে দিল।’ ভাইরাভাই আবার হাসতে হাসতে বলে উঠল, ‘আমি আবার ওসব মেয়েলি ব্যাপারে থাকি না।’

তিন্নি বাড়িতে ফিরে আসার পরেও প্রকাশ কিছুই জানতে পারেনি। তিন্নি সব সময় চুপ থাকে। রুমাকে কিছু প্রশ্ন করলেই রেগে রেগে উত্তরটা দেয়, ‘তুমি বড্ড বেশি মেয়েলি স্বভাবের হয়ে যাচ্ছ। মেয়ের গাইনিকোলজিক্যাল প্রবলেম, তোমাকে সব জানতে হবে? যেগুলো মেয়েলি ব্যাপার সেগুলো আমাদের মধ্যেই রাখতে দাও। তুমি ফল টল আনো। ওকে এখন বেশি করে ফল খেতে হবে। আর একটু সুস্থ হলে এখানকার কোনও একটা কলেজে ভর্তি করে দাও, ও আর ওখানকার কলেজে পড়বে না।’

এরপর প্রকাশ আর একবারের জন্যেও কাউকে কোনও প্রশ্ন করেনি। অফিস থেকে দেরি করে বাড়ি ফিরে খেয়ে শুয়ে পড়ে। ছুটির দিনে কোনও না কোনও কাজ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। রুমার কথা মতো তিন্নিকে একটা প্রাইভেট কলেজে একটু বেশি ফিজ দিয়ে ভর্তি করে দিয়েছে। এরপর শুধু ফল কেনা, টাকা পয়সা দেওয়ার কোনও রকম গাফিলতি করে না। প্রয়োজনের থেকে বেশিই কেনে। ফল পচে যায়, জামাকাপড় আলমারি ছাড়িয়ে যায়। কারওর সাথে কোনওরকম অতিরিক্ত কথা বলে না। একদিন শুধু একটা দরকারে তিন্নির আলমারি খুলে একটা ব্যাগ বের করে প্যান কার্ড আর আধার কার্ড বের করেছে, তাও অবশ্য তিন্নিকে বলেই। এর বেশি আর কিছু না।

(৩)

প্রকাশের নিরুদ্দেশ হওয়ার প্রায় মাস সাত হয়ে গেল। তিন্নি ও রুমা অনেক চেষ্টা করেও প্রকাশের কোনও ঠিকানা জোগাড় করতে পারল না। এমনকী মানুষটা বেঁচে আছে না মারা গেছে, প্রথম কয়েক দিন তো সেটাই বুঝতে  পারেনি। সাতদিন পরেই তিন্নির মোবাইলে ব্যাংকে দ্বিতীয়বারের জন্যে টাকা ক্রেডিট হওয়ার মেসেজ আসে। ব্র্যাঞ্চে গিয়ে শোনে ড্রপ বক্সের চেক থেকে ক্যাশ করা হয়েছে। যে ফেলেছে তার ঠিকানা বলা সম্ভব নয়। প্যান নম্বর দেওয়া থাকায় সমস্যা হওয়ারও কোনও কথা নয়। তবে ব্রাঞ্চের এক চেনাজানা কাকুকে প্রকাশের কথা জিজ্ঞেস করতে উনি বলেন, উনি তো ভিআরএস নিয়ে নিয়েছেন, এখন কোথায় আছেন কেউ জানে না। টাকা পাওয়ার আগে মাঝে মাঝেই আসতেন, সব টাকা পেয়ে যাওয়ার পরে আর তো আসেননি। এর মাঝে মা মেয়েতে অবশ্য অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বাদ পড়েনি কেউই। সবার মুখে সেই এক কথা। মাঝে অবশ্য বেশ কয়েকবার তিন্নির মোবাইলে টাকা জমা পড়বার মেসেজ এসেছে। রুমা ও প্রকাশের জয়েন্ট আকাউন্টেও টাকা জমা পড়বার মেসেজ এসেছে। এই কয়েকমাসে দিদির সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেলেও দিদি জামাইবাবু এমনকী রাকাও এসেছে। সব শুনে পাশে থাকবার আশ্বাস দিয়ে গেছে। প্রকাশকে খোঁজার চেষ্টা করবার কথাও বলেছে। কিন্তু সেখানে কিছুই লাভ হয়নি।

দিনদিন তিনকামরার ফ্ল্যাটের ভিতরের শূন্যতা দুটি মানুষকে গ্রাস করে ফেলেছে। সেই একাকিত্ব এতটা তীব্র, কষ্টদায়ক, এর আগে কোনওসময় কেউই বোঝেনি। অথবা বোঝবার চেষ্টাও করেনি। প্রয়োজনের আগেই প্রয়োজন মেটানোর যে দায় একজন কাঁধে চাপিয়ে নিয়েছিল, তার কাঁধের ব্যথা বা না ব্যথার কথাও কেউ জিজ্ঞেস করেনি। কিন্তু আচমকা কাঁধ অর্ধেকটা সরে যাওয়াতে ভূমিকম্পের আরম্ভ। সেখান থেকেই টালমাটাল অবস্থা। রুমা বা তিন্নিকে হাতে হাতে সব কাজ করা আরম্ভ করতে হল। সেই দোকান, বাজার, ইলেকট্রিক বিল এমনকী ব্যাংকে লাইন দিয়ে টাকা তোলা। দুজন এক সাথে এই প্রথম তৃতীয় আরেকজনের জন্যে অকাতরে কাঁদতে আরম্ভ করল। অবশ্য এই কান্না তৃতীয়জনের অলক্ষে।

রুমা এই কয়েকমাসে নিজের অফিস আর বাড়ির চাপে আরও অসুস্থ হয়ে গেল। কথায় কথায় রেগে যায়, তিন্নির ওপর তো এক্বেবারে খাপ্পা হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে হাতও চালিয়ে দেয়। তিন্নিও গুম হয়ে থাকে। কিছু বলতে পারে না। কলেজেও নিয়মিত যায় না, টিউশনেও অনিয়মিত। নিজেকেই সব সময় দোষারোপ করে, মাঝে মাঝে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথাও ভাবে, পরেই আবার নিজেকে সামাল দেয়। মাকে মাঝে মাঝেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়। এমনি চেক আপ হলেও ডাক্তার বলেন, টেনশনের থেকে হাই সুগার ধরেছে, সঙ্গে প্রেশার, কোলেস্টেরল, রক্তে ক্রিয়েটিনিন বেশি থাকায় কিডনিও কিছুটা আক্রান্ত হয়ে গেছে। নিশ্চিন্তের বিশ্রাম দরকার, শারীরিক ও মানসিক। অফিস থেকে ছুটি নেয়, কিন্তু মানসিক বিশ্রাম?

আরও দুই মাস পরে এক দুপুরে খেতে বসে ভাতের থালাতে আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করবার সময় দিদির ফোন পেয়ে রুমা চমকে ওঠে। ফোনটা রেখেই মাখা ভাত ফেলে তিন্নিকে বলে, ‘রেডি হয়ে নে, মাসিরা আসছে। তোর বাবাকে খুঁজে পাওয়া গেছে, তবে কোথায় জানি না, মেসো জানে।’

কলকাতা শহর ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটে যায় উত্তর চবিবশ পরগণার বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে। রুমা, তিন্নি ছাড়াও দিদি জামাইবাবু এমনকী রাকাও সঙ্গে থাকে। অবশ্য রাকা আর তিন্নি দুজন বসে দু’প্রান্তে। একজন পিছনের সিটে  একজন সামনের সিটে। গ্রামের মেঠো রাস্তার বুক ধরে কিছুটা গিয়ে গাড়ি দাঁড়াল একটা ছোটোগাছ আর বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা জায়গায়। অনেকটা জায়গা। ভিতরে ছোটো ছোটো ঘর। গাড়িতে যেতে যেতে রুমা শুনল জামাইবাবু আগে একবার নিজে এসে সব খোঁজ খবর নিয়ে গেছে। প্রকাশের সাথেও দেখা করে সবাইকে নিয়ে আসবে কিনা জিজ্ঞেস করে গেছে। প্রকাশের একটা জীবনবিমার পলিসি ম্যাচিওর হয়ে যাওযার সূত্র ধরেই গোপনে খোঁজ খবর চালিয়ে প্রকাশের ডেরা খুঁজে পেয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে দিদি জামাইবাবু, রুমা আর তিন্নিকে ভিতরে যেতে বলে নিজেরা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। রুমা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিল, ‘তোমরা আগে যাও আমরা একটু পরে যাচ্ছি।’

বাইরে তখন পচা ভাদ্রের রোদ। শরীরে আছড়ে পড়া ঝলসানো আলো আর তাপ সহ্য করে রুমা আর তিন্নি এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘেরা জায়গাটার ভিতরে ঢুকে এগিয়ে চলে। কিছুদূর যাওয়ার পরেই কমবয়সি একটা ছেলে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা কি কাউকে খুঁজছেন?’

রুমা একটু আমতা আমতা করে সব কিছু বলতেই সেই নাম না জানা ছেলেটি একটা ঘরের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলে, ‘উনি এখন ওই ঘরে ক্লাস নিচ্ছেন।’

– ক্লাস নিচ্ছেন!

চাকরি পাওয়ার আগে প্রকাশ চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি টিউশন করত। চাকরি পাওয়ার পরেও প্রথম দিকে অভ্যাসটা চালিয়ে গেছিল। তারপর টুকটাক একে ওকে এমনি দেখিয়ে দিলেও আর টিউশন আরম্ভ করেনি। তিন্নিকে পড়াত। নিজেও অবসর সময়ে চাকরির বিভিন্ন বইপত্র নাড়াচাড়া করত। রুমা কিছু জিজ্ঞেস করলে বলত, ‘আপডেট থাকা যায়।’

কিন্তু সেদিন কথাগুলো শুনে দুজনেই অবাক হয়ে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে ছেলেটির দেখানো ওই ঘরটির দিকে এগিয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। ঘরের ভিতর তখন তিন্নির বয়সি বা ছোটো বড়ো, জনা কুড়ি ছেলেমেয়ের সামনে ক্লাস নিচ্ছে প্রকাশ। দরজার বাইরে দুজনকে আকস্মিক দেখে প্রথমে কেউ কোনও কথা বলতে পারল না। কিছু সময় পরে প্রকাশ বলল, ‘আমার ঘরে গিয়ে বোসো আমি আসছি।’ তারপরেই একজন ছাত্র এগিয়ে এসে রুমা আর তিন্নিকে প্রকাশের ঘরে বসিয়ে এল।

রুমা ও তিন্নি ঘরের ভিতরে একটা তক্তার ওপর বসে চারদিকটা দেখতে লাগল। সাদামাটা ছিটে বেড়ার ঘর। দুটো জানলা আছে। একটা টুলের ওপর রাখা রয়েছে একটা টেবিল ল্যাম্প। চারদিকে ঝোলানো রয়েছে কয়েকটা শার্ট, প্যান্ট কয়েকটা গেঞ্জি। এককোণে থাক থাক করে বেশ কয়েকটা বই। দরজার বাঁদিকের দেয়ালে টাঙানো রয়েছে রুমার শ্বশুর-শাশুড়ির একসাথে একটা ছবি। নতুন ঘরে আসার পরে ছবিটা স্টোররুমের স্ল্যাবে তোলা ছিল।

কিছুসময় পরে প্রকাশ ঘরের ভিতর আসতেই রুমা বেশ উত্তেজিত ভাবে বলে উঠল, ‘এর মানে কী? এরকম ভাবে কাউকে কিছু না বলে চাকরি বাকরি ছেড়ে, এই অজ গ্রামে এসে তুমি কী আরম্ভ করেছ?’

–চা খাবে? এই কয়েকমাসেই তো খুব রোগা হয়ে গেছ।

–যা জিজ্ঞেস করলাম উত্তর দাও।

প্রকাশ একটা শ্বাস নিয়ে বলল, ‘আমাকে আর তোমাদের দরকার নেই এই সত্য উপলব্ধি করেই চলে এলাম। তবে তোমাদের কাউকে ঠকাইনি। ব্যাংক থেকে একপয়সাও তুলিনি। যা টাকা পেয়েছি সব দিয়ে দিয়েছি।’

–বাবা সব কিছু কি টাকার হিসাবে মেলে, না চলে?

–ঠিক তো আজ তোরা বুঝেছিস, কিন্তু যেদিন আমার আপত্তি অগ্রাহ্য করে মায়ের কথা শুনে রাকার সাথে থাকতে গেলি, তারপর…। প্রকাশ একটা লম্বা শ্বাস ফেলে কথা বন্ধ করে দিল।

পাশ থেকে তিন্নি বলে উঠল, ‘থামলে কেন? বলো…’

–থাক। আমার কাছে তো সব কথাই গোপন করেছিলি, তাই না। খুব রাগ হয়ে ছিল, ভাবলাম এবার তোরা তোদের মতো করে থাক আমি আমার মতো। তবে এখন আর অতটা রাগ নেই, তোদের খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল।

প্রকাশের কথা শুনেই রুমা তিন্নি দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুসময় পরে তিন্নি বলে, ‘আমি তো কিছু গোপন করিনি বাবা।’

প্রকাশ মুচকি হাসে, ‘সবাই খরগোশ নয় রে। তারপর আবার কিছুসময় চুপ থেকে বলে, ‘জানিস আমাদের সমাজ, শাস্ত্র, কাছের আত্মীয়দের সাথে বিয়ের অনুমতি দেয় না, তবে আগে দিত। মহাভারতে অনেক উদাহরণ আছে। আবার তুতেনখামেন তার নিজের বোন আনাক-সু-নামুনকে বিয়ে করেছিল। দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বিয়ে এখনও প্রচলিত।’

–এসব আমাকে বলছ কেন? আমি জেনে কী করব?

প্রকাশ তিন্নির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আসলে এখানে ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে শুধু তোর কথাই ভেবেছি, ভেবেছি ভুল কার তোর, না আমার?’

–তুমি যে কী বলছ কিছুই বুঝতে পারছি না।

একটা লম্বা শ্বাস ফেলে প্রকাশ বলে উঠল, ‘তোরা কিছু না বললেও আমি কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম। তোর মনে আছে একদিন তোর আলমারি খুলে তোর প্যান কার্ড বের করেছিলাম, সেদিন ব্যাগের মধ্যে নার্সিংহোমের একটা ফাইল পাই। প্রথমে ভয় লেগে গেছিল তারপর কয়েকটা পাতা পড়তেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। তাও রাকাকে ফোন করে ওর কলেজ গেলাম। প্রথমে রাকাও সব অস্বীকার করছিল, একটু জোর করতে হয়েছিল, বুঝলাম এত বড়ো ঘটনা যখন আমার কাছেই গোপন করা হল, তখন তোদের কাছে আমার কোনও মূল্যই নেই।’

রুমার গলাতে অবাক হয়ে যাওযার স্বর।

‘না শোনো তুমি ব্যাপারটা ওরকম ভাবে ভেব না। আসলে তিন্নির সাথে আমার নিজেরও খুব লজ্জা করছিল। তিন্নি যে এত বড়ো একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে ভাবতে পারিনি।’

–এটা তোমার দূরদৃষ্টির অভাব রুমা। আমি কিন্তু প্রথমদিনেই বলেছিলাম। তুমি বিশ্বাস করোনি আমার ওপরেই রেগে উঠে বলেছিলে, ‘নোংরা হয়ে যাচ্ছ তুমি, ভাই বোন একসাথে থাকবে তাতে এরকম ভাবাটাই অন্যায়।’

–তুমি বিশ্বাস করো আমার খুব খারাপ লেগেছিল।

–খারাপ! কীসের খারাপ? সব কিছু হয়ে যাওয়ার পরে খারাপ? রুমা আমরা তো বুদ্ধি দিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করি। এখানে খারাপ ভালোর তো কোনও প্রশ্ন নেই। দুটো টিনএজ ছেলেমেয়ে এক সাথে এক ঘরে থাকলে অনেক কিছুই হতে পারে, সেখানে অনেক সম্পর্কই গৌণ হয়ে যায়। আবার একটা দুর্ঘটনাও ধরা যায়।

–তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি এখন সব সাপোর্ট করছ। এমনি ভাবে তুমি সবকিছু মেনে নেবে? তুমি এমন ভাবে বলছ যেন কোনও ব্যাপারই ঘটেনি। বিয়ে, মহাভারত সব কিছু নিয়ে আসছ।

–আমাদের এই বাংলার হিন্দু সমাজে এইরকম মাসতুতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ের প্রচলন নেই। তবে ওদের ক্ষেত্রে আমার মেনে নেবার বা না নেবার সাথে কি কিছু এসে যায়? যেটা ওরা ঠিক করবে সেটাই হবে। আমি অবশ্য এটাও জানি না ওদের এটা প্রেমশূন্য না অন্যকিছু?

–না, ওদের ঠিক করবার কিছু নেই। রাকার সাথে তিন্নি এখন আর মেশে না।

–বেশ ভালো তো। তবে বিপদের আগে সাবধান করতে হয়, কিন্তু বিপদে পড়লে তো সাহায্য করতেই হবে। প্রকাশ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল।

তিন্নি থামিয়ে বলে উঠল, ‘বাবা, তুমি কবে ফিরে আসবে বলো?’

প্রকাশ হালকা হেসে উঠল, ‘মা’ রে তোদের জন্যে মন খারাপ করলেও এখানে দিব্যি আছি। সকালে একটা স্কুল চলে বিকালের দিকে আশেপাশের ছেলে মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি হয়। আজকে অবশ্য স্কুল ছুটি তাই ওরা এই সময় ক্লাস করছে। এরা সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। বেশ ভালো আছি বুঝলি, বেশ ভালো।’

–তাহলে আমরা কী করব? রুমা প্রকাশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

–তোমার দিদি জামাইবাবু এসেছে তো?

–রুমা কিছুসময় চুপ থেকে উত্তর দিল, হ্যাঁ। কথাতে জড়িয়ে থাকা কান্নাটা প্রকাশের কানে গেল।

–ওদের ডাকো। তারপরেই তিন্নির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘কিরে তুই কি করবি? রাকাকেও ডাকব?’

রুমা তখন সেই মাত্র উঠে বাইরে দিদি জামাইবাবুদের ডাকতে যাচ্ছিল। তিন্নি পিছন থেকে ডেকে বলে উঠল, ‘মা, দাঁড়াও। মাসিদের ডাকতে হবে না।’ তারপরেই প্রকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবা যেটা বেরিয়ে গেছে সেটা শুধু মাত্র একটা প্রাণ ছিল না। তাও বলছি সব দোষও আমার, ভুলও। আমাকে আর একটা সুযোগ দেবে না? আমি আর ওই সম্পর্কের কথা ভাবতেও চাই না। শুধু তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই। তুমি বাড়ি ফিরে চলো।’

বাইরে তখন দারুণ রোদ। গরম হাওয়া দরমার ঘরে ঢুকলেও প্রকাশের বেশ শান্তি লাগল। তিন্নিকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠল, ‘খেপি একটা।’

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...