বুদ্ধিটা প্রথমে দিগন্তর মাথায় এসেছিল। রাহুলকে নিয়ে যদি একটা তিন চার মিনিটের ভিডিও বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া যায় তাহলে হয়তো কিছু একটা করা যেতে পারে। তিন্নি শুরুতে মোটেই রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু ওর বাকি বন্ধুরাও ব্যাপারটাতে সায় দিল। বলল রাহুলের জন্য ফান্ড রেইজিং… এরচেয়ে ভালো উপায়ে আর করা যাবে না। ওদের জোরাজুরিতে নিমরাজি হলেও তিন্নি বলল রাহুলের সঙ্গে কথা বলে ও দু তিন দিনের মধ্যে ওদেরকে জানাবে।

দীপা, অরুণাভ আর সুপর্ণা নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করে তিন্নিকে আবার বোঝাবার চেষ্টা করতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই দিগন্ত বলে উঠল, ‘দেখ তিন্নি, রাহুল যেমন আমাদের বন্ধু তেমনই তুইও। গত চার পাঁচ মাস থেকে তোর ওপর দিয়ে কেমন ঝড় ঝাপটা যাচ্ছে আমরা সবাই সেটা দেখতে পাচ্ছি। সত্যি বলতো আর কত দিন তুই এভাবে টানতে পারবি? তোর ফিজিক্যাল স্ট্রেন, মেন্টাল স্ট্রেস তো আমরা শেয়ার করতে পারব না কিন্তু বন্ধু হিসেবে যদি ফিন্যানশিয়াল প্রবলেম কিছুটা লাঘব করতে পারি তো তাহলে আমাদেরও ভালো লাগবে। তুই চিন্তা করে রাহুলের সঙ্গে কথা বলে আমাদের তাড়াতাড়ি জানাস।’

দিগন্তর গলার আওয়াজটা বোধহয় সামান্য উঁচুর দিকে ছিল, তিন্নি ওকে ইশারাতে আস্তে কথা বলতে বলল তারপর চট করে উঠে গিয়ে ওদের এই বাড়ির একমাত্র বেডরুমের দরজাটা আলতো করে খুলে দেখে নিল রাহুল জেগে আছে কিনা। রাহুলকে চোখ বন্ধ করে ঘুমোতে দেখে দরজাটা সাবধানে টেনে দিয়ে বসার ঘরে এসে দেখল ওর বন্ধুরা ভিডিও বানাবার আলোচনায় মগ্ন।

তিন্নির মনে পড়ে যায় মাত্র সাত বছর আগে ওদের জীবনটা কত অন্যরকম ছিল। এমএসসি-র রেজাল্ট বেরোবার পরে ওরা সবাই যখন সেলিব্রেট করতে গিয়েছিল সেখানেই রাহুল হাটে হাঁড়িটা ভাঙল যে ও আর অপরাজিতা মানে তিন্নি ডেটিং করছে আর খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চলেছে। সবাই ভীষণ ভাবেই চমকে উঠেছিল। চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা পরা গুড বয় রাহুল আর দুই বেনি ঝুলিয়ে শাড়ি পরে শহরতলি থেকে কলকাতার কলেজে পড়তে আসা সাধাসিধে মেয়ে তিন্নির মধ্যে তলে তলে প্রেম চলছে।

তিন্নির বাড়ি থেকে এই বিয়েতে মত থাকলেও রাহুলের বাড়ি থেকে ছিল না। রাহুলের মা বাবা না থাকাতে দিদি জামাইবাবু-ই ছিলেন ওর অভিভাবক। তারা প্রথমে রাজি না হলেও পরে মেনে নেন আর পাঁচ বছর আগে তিন্নি, অপরাজিতা চৗধুরী থেকে মিসেস সেন হয়ে এই ওয়ান বিএইচকে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে। রাহুলকে নিয়ে নিজের সংসার সাজাতে তিন্নি এতই ব্যস্ত ছিল যে ওর মনেই হয়নি বাকি বন্ধুদের মতো ওরও একটা চাকরি করা দরকার। এমনকী রাহুল বার বার বলা সত্ত্বেও পিএইচডি করার কথাও ভাবেনি। তিন্নি জানত রাহুল সবসময় ওর সাথে আছে বড়ো একটা গাছ হয়ে, যার ছায়ায় তিন্নি নিরাপদে থাকবে। বছরে একবার দুবার দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া ছাড়াও টুকটাক উইক এন্ডে কাছাকাছি কোথাও যাওয়া বা বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে গল্পগুজব করা, মাসে একবার বা দুবার উত্তরপাড়ায় গিয়ে মাকে দেখে আসা এসব নিয়ে তিন্নির পাঁচটা বছর যে কীভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারল না।

রাহুলের অসুখের ব্যাপারটা প্রথম প্রকাশ পেল গত বছর উটিতে বেড়াতে গিয়ে। একদিন একটু চড়াই রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে রাহুল পড়ে গেল। তারপর কোনওমতে দাঁড়িয়ে হাঁটতে গিয়ে দেখল ওর ডান পা-টায় তেমন জোর পাচ্ছে না। কোনওমতে হোটেলে ফিরে এসে ডাক্তার দেখাবার কথা বলাতে রাহুল প্রস্তাবটা হেসে উড়িয়ে দিল। পরেরদিন আবার সব ঠিকঠাক।

কলকাতায় ফিরে তিন্নি আর রাহুল ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু সপ্তাহ দুয়েক পরে রাহুল একদিন অফিসের সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গেল। অফিসের লোকজন ওকে নিয়ে কাছাকাছি একটা হাসপাতালে দেখিয়ে কিছু ওষুধপত্র দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিল। পরদিন তিন্নি রাহুলকে অফিস যেতে দিল না। বন্ধুবান্ধবরা বাড়ি এসে একচোট হইচই করে গেল। বলল রাহুলের পদস্খলন হয়েছে– সব সময় বউ-এর কথা চিন্তা করে তাই  আশে পাশে চোখ রেখে চলতে পারে না, এর একমাত্র চিকিৎসা সংসারে তৃতীয় জনের আগমন।

তিন্নির মা আর বড়ো ননদ একই কথা অন্য ভাবে তিন্নিকে বলেছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু ও যখনই রাহুলকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে গেছে রাহুল বলেছে, ‘আরে আগে লাইফটাকে এনজয় করো। ছেলে-মেয়ে মানুষ করার জন্য তো সারা জীবন পড়ে আছে, কথা দিচ্ছি পঁয়ত্রিশ হবার আগেই বাবা হয়ে যাব।’

তিন্নি আঁতকে উঠে বলেছিল, ‘তোমার পঁয়ত্রিশ মানে তো আমারও পঁয়ত্রিশ। বাচ্চা বড়ো হবার আগেই তো আমি বুড়ি হয়ে যাব।’

‘ভেব না তুমি বুড়ি হলেও আমি অত সহজে বুড়ো হব না। আমি তোমাদের সবার খেয়াল রাখব’, তিন্নিকে স্ত্বান্না দিয়ে রাহুল বলেছিল। কিন্তু সেই রাহুল আজ গত দু-মাস থেকে সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী। অফিস যাওয়া বন্ধ করেছিল পাঁচমাস আগে। বার কয়েক যেখানে সেখানে পড়ে যাবার পর তিন্নি ওকে বেশ কিছু ডাক্তার দেখিয়ে নানা রকম পরীক্ষা করিয়ে যেদিন জানল, রাহুলের মোটর নিউরন ডিজিজ হয়েছে– ওর জীবনের সব আলোগুলো হঠাৎ করে নিভে গিয়েছিল।

শহরের বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট যখন ওদের ওই অসুখ সম্বন্ধে বিভিন্ন রকম তথ্য দিচ্ছিলেন তখন তিন্নির মাথায় কিছু না ঢুকলেও, রাহুল কিন্তু আগ্রহ নিয়ে ডাক্তারের সব কথা শুনেছে, প্রশ্ন করেছে, চিকিৎসা সম্বন্ধে জানতে চেয়েছে। তারপর বাড়িতে এসে তিন্নিকে বলেছে, ‘এবার তোমাকে একটা চাকরি জোগাড় করতে হবে তিন্নি। আমি হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই গৃহবন্দি হব। হাঁটতে চলতে এমনকী হয়তো কথা বলতেও পারব না। তোমার জন্য কিছুই করতে পারব না। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার একটা চাকরি মানে সোর্স অফ ইনকাম জোগাড় করা খুবই দরকার।’

তিন্নি বোঝাবার চেষ্টা করেছিল, ‘ডাক্তারবাবু তো বললেন কত রকমের চিকিৎসা আছে এই অসুখের। তুমি এখনই ভেঙে পড়ছ কেন?’

একটা বিষাদভরা হাসি হেসে রাহুল বলেছিল, ‘তিন্নি এটা সাধারণ অসুখ নয় যে ওষুধ খেলাম আর অসুখ সেরে গেল। এটা মোটর নিউরন ডিজিজ, যেখানে আমাদের ব্রেনের আর স্পাইনাল কর্ডের নার্ভগুলো ড্যামেজ হয়ে যায়, যার ফলে আমাদের শরীরের পেশিগুলো কাজ করতে পারে না, কমজোর আর ক্ষয় হয়ে যায়। মজার কথা কি জানো– আমি দেখতে পারব, শুনতে পারব, কে কি করছে বা বলছে, বুঝতে পারব কিন্তু রিঅ্যাক্ট করতে পারব না।’

তিন্নি রাহুলের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলেছিল, ‘চুপ করো, একদম বলবে না ওসব কথা। আমরা কাল থেকেই ডাক্তারবাবুর কথা মতো চিকিৎসা শুরু করব।’

তিন্নিকে জড়িয়ে ধরে রাহুল বলেছিল, ‘আই লভ ইউ তিন্নি। কিন্তু একটা সময় আসবে যখন আমি এই কথাগুলো বলতে পারব না। ট্রিটমেন্ট আমি করাব কিন্তু জানি এই অসুখ সারানো যায় না, শুধু অসুখের লক্ষণগুলোকে বিলম্বিত করা যায়।’

পরেরদিন রাহুল তার অফিসে অসুস্থতার কথা জানিয়ে ছুটির দরখাস্ত করে। তার সঙ্গে আরও জিজ্ঞেস করে যদি সে কর্মক্ষম না থাকে তাহলে ওর স্ত্রী তিন্নির ওখানে কোনও চাকরি পাবার সম্ভাবনা আছে কিনা। ওদের কোয়ালিফিকেশন তো একই। অফিস থেকে রাহুলের ছুটি মঞ্জুর হলেও তিন্নির ব্যাপারে ম্যানেজমেন্ট পরিষ্কার জানিয়ে দেয় তিন্নির কোনও জব এক্সপিরিয়েন্স না থাকাতে দুর্ভাগ্যবশত ওরা ওকে কোনও চাকরি দিতে পারবে না। এই প্রাইভেট কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী ওদের ব্যাপারটা ‘কম্প্যাশনেট জব অফারের’ এক্তিয়ারে পড়ে না, তাই ম্যানেজমেন্ট চাইলেও কিছু করতে পারছে না, –যদিও ওরা সব সময়ে রাহুলের পাশে আছে আর ওর দ্রুত আরোগ্য কামনা করছে।

এদিকে রাহুলের চিকিৎসা আর ওদিকে তিন্নির জন্য নানা জায়গায় চাকরির দরখাস্ত করা, দুটোই একসাথে চলতে থাকল কিন্তু কোনওটাতেই কিছু করা গেল না। যথাসম্ভব চিকিৎসা চললেও রাহুলের শরীরের দ্রুত অবনতি হতে থাকল। প্রথমে ডান-পা তারপর বাঁ-পা তারপর কোমরের নীচে থেকে পুরোটাই প্যারালিসিস হয়ে যায়। তিন্নি খোঁজখবর নিয়ে একটা মোটর অপারেটেড হুইল চেয়ার নিয়ে আসে যাতে রাহুল অন্তত ঘরের মধ্যে চলা ফেরা করতে পারে।

কিন্তু মাস খানেকের মধ্যে রাহুলের শরীরের উপর অংশ-ও কমজোর হতে হতে সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়। তখন থেকে তিন্নি

সকাল-দুপুর-সন্ধে-রাত্রি শুধু রাহুলের সেবা-শুশ্রুষায় নিজেক ব্যস্ত রাখল। শুরুতে অনেকে নার্স রাখতে বলেছিল, কিন্তু আর্থিক অবস্থার কথা ভেবে তিন্নি নার্স বা রাতে একজন আয়া রাখার পরিকল্পনাও ত্যাগ করল। প্রতিদিনের ঠিকে কাজের মাসিকেও ছাড়িয়ে দিল। ধীরে ধীরে তিন্নির সাধের বাড়ি, সাধের সংসারে দৈন্যতা গ্রাস করল।

তিন্নি আজ সকাল সকাল উঠে পড়েছে। অবশ্য রাতে তাকে তিন চার বার এমনিতেই উঠতে হয় রাহুলের জন্য। কিন্তু আজকে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে না উঠলে চলত না। বাড়ি-ঘরদোর পরিষ্কার করে ওদের জন্য কিছু খাবার-দাবারও তো বানাতে হবে। রাহুলকেও তৈরি করতে হবে। দিগন্তর কথামতো তিন্নি গতকাল রাহুলের দাড়ি কামিয়ে দিয়েছিল। দিগন্ত বলেছিল একদম ক্লিনশেভ হলে অসুস্থ মনে হবে না আবার চার পাঁচ দিনের বেড়ে যাওয়া দাড়িতে ভীষণ অপরিচ্ছন্ন লাগবে তাই ভিডিও তোলার সময় যেন রাহুলের গালে একদিনের দাড়ি থাকে।

এই ভিডিও তোলার ব্যাপারে রাহুলের সেরকম সায় ছিল না। কিন্তু রাহুল আজকাল ভালো করে কথা বলতেও পারে না। দুটো তিনটে শব্দ বললেই হাঁপিয়ে যায়। তাই তিন্নির কাছে ফান্ড রেইজিং-এর ব্যাপারটা শুনেও নিজের অপরাগতার কথাটাও বলতে পারেনি। তিন্নি রাহুলের মনের কথাটা বুঝতে পেরেও না বুঝতে চাইছিল। সত্যিই তো তিন্নির থেকে কে আর ভালো জানে যে ওদের আর্থিক অবস্থা কতটা খারাপ। আর বন্ধুরা তার জন্য এতটা ভাবছে তারও তো একটা মুল্য আছে।

সুপর্ণার পিসতুতো বোন কৃপা এসেছে আমেরিকা থেকে। সুপর্ণার কথায় সেও রাজি হয়েছে ভিডিওতে থাকতে, যাতে ও ওর আমেরিকার বন্ধুদের কাছেও ভিডিওটা শেয়ার করে ফান্ড রেইজিং এ অ্যাপিল করতে পারে এবং আশা করা যায় সেক্ষেত্রে রেসপন্স ভালো পাওয়া যাবে।

ঠিক দশটার সময় ওরা মানে দিগন্ত, দীপা, অরুণাভ, সুপর্ণা আর কৃপা চলে এল। বেশ গল্প করার মতো করে একটা তিন চার মিনিটের ভিডিও তুলল দিগন্ত। রাহুলের চার পাশে বসে তিন্নি আর বাকি বন্ধুরা কিছুটা বাংলায় কিছুটা ইংরেজিতে রাহুলের ব্রাইট পাস্ট ও স্ট্রাগলিং প্রেজেন্ট সম্বন্ধে বলল। তারপর সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিল, ‘আমরা কি কিছুই করতে পারি না রাহুলের জন্য।’

ওরা চলে যাবার পর তিন্নি বেশ হাসি মুখে রাহুলের কাছে এসে বলল, ‘কি কেমন লাগছে? এখন কত লোক তোমার ভিডিও দেখবে, তোমার কথা জানবে। কৃপা তো বলছিল অনেক দেশে নাকি এমএনডি সোসাইটি বলে সংস্থান আছে, যারা এমএনডি পেশেন্ট নিয়ে রিসার্চ করে, ওদের নানা ভাবে সাহায্য করে এমনকী ওদের বাড়ির লোকেদেরও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে বলে, মানে শেয়ারিং দ্য এক্সপিরিয়েন্স আর কি।’ তিন্নিকে খুশি দেখে রাহুলেরও খুব ভালো লাগছিল। ও তিন্নির চোখে চোখ রেখে হাসবার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না।

তিন্নি এগিয়ে এসে রাহুলের মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলল, ‘আর চিন্তা কোরো না। আজকে রাতের মধ্যে ভিডিওটা সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড হয়ে যাবে। দিগন্ত ওর ব্যাংকে আমার নামে তোমার জন্য একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিচ্ছে। ও তো বলছিল প্রচুর ডোনেশন আসবে। এমন কি বাইরের দেশ থেকেও কেউ হয়তো তোমার চিকিৎসার জন্য স্পনসরও করতে পারে। আমি তো বলেছি ওদের যে আমাদের পাসপোর্ট তৈরি করা আছে।’

তিন্নি হয়তো আবেগের বশে আরও কিছু বলত কিন্তু তার আগেই রাহুলের চোখের জলে ওর কামিজের বুকের কাছটা ভিজে যাওয়ায় ও চুপ করে যায়। তারপর নিজের চোখের জল চেপে রেখে রাহুলের চোখ দুটো পরম আদরে মুছিয়ে দেয়।

তিন

আজ পুরো এক মাস হয়ে গেল রাহুলের ভিডিওটা সোশ্যাল মিডিয়ায় আসার পর। আগে থেকে করা প্ল্যানমতো ওরা বন্ধুরা একে অন্যকে ট্যাগ করে শেয়ার করছিল যাতে ওটা বেশ কিছুদিন মিডিয়াতে থাকে। এই এক মাসে প্রচুর লোকে প্রচুর কমেন্ট করেছে , চোখের জল ফেলেছে, এমএনডি-র চিকিৎসা নিয়ে কথা বলেছে, তিন্নির প্রশংসা করেছে, পুরোনো বন্ধু-বান্ধবরা ফোন করেছে। ফুলের তোড়া, ফলের ঝুড়ি নিয়ে দেখা করে উঁহু-আহা করে গেছে কিন্তু তার নতুন খোলা অ্যাকাউন্টে মাত্র সাড়ে চোদ্দো হাজার টাকা জমা পড়েছে। আর তার মধ্যে আত্মীয়স্বজনরা এই নিয়ে খোঁটা দিতেও ছাড়ছে না।

ওর নিজের বউদি তো সেদিন বাড়ি বয়ে এসে শুনিয়ে গেল, ‘তোর তো অনেক বুদ্ধিরে তিন্নি, কি মর্মস্পর্শী ভিডিও বানিয়েছিস নিজের স্বামীকে নিয়ে। তা এখন অবধি কত পেলি ওটা থেকে?’ তারপর তিন্নি কোনও উত্তর দিচ্ছে না দেখে নিজে থেকেই আবার বলে উঠল, ‘আর আমাদের দ্যাখ, তোর দাদার একার রোজগারে আমাকে পাঁচজনের

সংসার চালাতে হয়। মায়ের ওষুধের জন্যই তো কত টাকা খরচা হয়ে যায়, কিন্তু তা বলে তো লোকের কাছে হাত পাততে পারব না। তোর দাদার সন্মানটারও তো খেয়াল রাখতে হবে।’

তিন্নি জানে মায়ের টুকটাক অসুখবিসুখ প্রায়ই হয়। আগে তিন্নি গিয়ে মাকে ডাক্তার দেখানো বা ওষুধ কেনা এগুলো করত। কিন্তু এখন সেটা করতে পারছে না। এমনকী আগে মাকে যে হাত খরচের টাকা দিত সেটাও গত দুমাস দেয়নি, দাদাই মানা করেছিল। কিন্তু বউদি যে পাঁচজনের সংসার বলল তার মধ্যে চারজন তো ওরাই , তাহলে সব অসুবিধা মা-কে নিয়েই। তিন্নি যে মা-কে নিয়ে এসে এখানে রাখবে তাও তো সম্ভব নয়, তাই সেদিন বউদির কথাগুলো চুপচাপ শুনে যাওয়া ছাড়া তিন্নির আর কিছু করার ছিল না।

তিন্নির চিন্তার জালটা ভেঙে হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল। ফোনটা চালু করে বলল, ‘হ্যালো।’ ও-প্রান্ত থেকে এক মহিলা কণ্ঠস্বর, ‘হ্যালো অ্যাই অ্যাম সারা কলিং ফ্রম মুম্বই। অ্যাম অ্যাই স্পিকিং টু মিসেস অপরাজিতা সেন?’

অপরিচিত আওয়াজে অন্যরকম উচ্চারণে নিজের নামটা শুনে তিন্নি বেশ ঘাবড়ে গিয়ে কোনওমতে বলল, ‘ইয়েস আমি তিন্নি মানে, অ্যাই অ্যাম অপরাজিতা সেন।’

‘দ্যটস্ গুড! ইয়োর ফ্রেন্ড কৃপা গেভ মি ইয়োর ডিটেলস্ অ্যাজ উই আর ডুইং রিসার্চ অন এমএনডি। ওয়ান অফ আওয়ার ক্লায়েন্ট হ্যাজ পাসড্ অ্যাওয়ে ডে বিফোর ইয়েস্টারডে সো উই আর লুকিং ফর আনাদার পার্শন হু ক্যান হেল্প আস টু ফিনিশ আওয়ার রিসার্চ। ডু ইউ থিংক ইয়োর হ্যাজবেন্ড উইল লাইক টু গেট ইনভলভড ইন দিস রিসার্চ?’

হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো করে তিন্নি বলল, ‘ইয়েস ইয়েস উই আর রেডি।’

‘নো ইট ইজ নট ফর ইউ বাট ফর ইয়োর হাজবেন্ড। উই নিড হিজ কনসেন্ট আনলেস ইউ হ্যাভ দ্য মেডিকেল পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি ফর হিম। ইউ নো উই হ্যাভ টু কাম ফ্রম মুম্বই সো উই ডোন্ট ওয়ান্ট এনি লিগ্যাল হ্যাসেল।’

‘ইয়েস হি ইজ উইলিং টু পার্টিসিপেট, ইউ ক্যান টক টু হিম’ বলে দৗড়ে গিয়ে রাহুলের কাছে গিয়ে বলল, ‘ওরা ফোন করেছে ফরেন থেকে– মানে এখন মুম্বই থেকে, তোমার সঙ্গে কথা বলবে, মানে কনসেন্ট না কি যেন নেবে, তুমি কিন্তু হ্যাঁ বলবে।’

রাহুল ফোনে এক দুবার ‘ইয়েস’ আর ‘ওকে’ বলার পর ফোনটা তিন্নিকে দিল। সারা জানাল ও আর শ্যাম, ওর রিসার্চ পার্টনার কাল বা পরশু রাহুলকে দেখতে আসবে, হয়তো দু তিন দিন লাগবে ওদের কাজ শেষ করতে। তিন্নির মুষড়ে পড়া মনটা আবার একটা আশার আলো দেখতে পেল। শোবার ঘরে গিয়ে রাহুলের পাশে শুয়ে পড়ে দেখল রাহুল টিভি-টার দিকে তাকিয়ে থাকলেও যেন অন্য কিছু ভাবছে। জিগ্যেস করল, ‘কী হল তুমি কি ভাবছ?’

বড়ো একটা শ্বাস টেনে রাহুল বলল, ‘কত দেবে?’

‘কি কত দেবে?’

‘টাকা কত দেবে?’

তিন্নি অবাক হয়ে উঠে বসে বলল, ‘টাকা কেন দেবে? ওরা তো রিসার্চ করবে, আমরা কত লাকি বলো যে ওরা আসছে আমাদের এখানে।’

‘গিনিপিগ-রা লাকি হয় না’ রাহুল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ‘রেমিউনিরেশন দেওয়া নিয়ম, টাকাটা অবশ্য নিও।’

তিন্নি আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি রাহুলকে অক্সিজেন মাস্কটা দিল।

রাহুলের মাস্কটা লাগিয়ে তিন্নি ভাবল, দিগন্তকে ফোন করে খবরটা দেবে। কিন্তু এরই মধ্যে কলিংবেল বেজে উঠল, কেউ এসেছে। দরজার আইহোল দিয়ে দেখল এক মধ্য তিরিশের ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন দরজার সামনে, দেখে মোটেই সেলসম্যান মনে হচ্ছে না। দরজাটা সামান্য খুলে তিন্নি জানতে চাইল, ‘কাকে চাইছেন?’ হাতজোড় করে নমস্কার করে ভদ্রলোক বললেন, ‘নমষ্কার বউদি আমি মৃদুল, বাবলুদা-র কাছ থেকে আসছি।’ তারপর তিন্নিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার বলল, ‘বাবলুদা মানে অনুপম সিকদার যাকে আপনারা ভোট দিয়ে জেতালেন এবার। আমাকে বাবলুদা পাঠালেন আপনাদের মানে রাহুলবাবুর খোঁজখবর নেবার জন্য। উনি নিজেই আসতেন কিন্তু একটা বিশেষ কাজে ওনাকে দিল্লি যেতে হল হঠাৎ তাই–’

নিজের অজান্তেই থতোমতো খেতে খেতে তিন্নি কখন যে দরজাটা খুলে দিয়েছিল তা সে নিজেই বুঝতে পারেনি। তারপর খেয়াল হতেই হাত জোড় করে নমস্কার করে বলল, ‘দেখুন আপনাকে তো আমি ঠিক চিনি না, তাছাড়া আমি তো অনুপমবাবুকে কিছু বলিনি রাহুলের সম্বন্ধে। এখন একটু ব্যস্ত আছি, তাই–’

‘না না বউদি আমি আপনার সময় নষ্ট করব না, আমি জানি আপনি রাহুলদাকে নিয়ে কতটা ব্যস্ত, বাবলুদা কিছু ফল টল পাঠিয়ে ছিল সেটা যদি আপনি নিতেন তাহলে বাবলুদার ভালো লাগত। তারপর তিন্নিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঘাড় ঘুড়িয়ে হাঁক দিল, ‘অ্যাই বিশু ওটা বউদির ঘরে রেখে দে।’

এতক্ষণে তিন্নির নজরে পড়ল আরেকটি বেঁটে, গাঁট্টা-গোট্টা ছেলে সিঁড়ির একধাপ নীচে দাঁড়িয়ে ছিল। সে পায়ের কাছে রাখা পেল্লাই একটা ঝুড়ি তুলে নিয়ে তিন্নিকে প্রায় ধাক্বা দিয়ে সরিয়ে ঘরে ঢুকে টেবিলে ঝুড়িটা রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে যেতে বলল– ‘চললাম মৃদুলদা,আমার ব্যাপারটা ভুলো না কিন্তু। কাল ক্লাবে আসব।’

হতবাক তিন্নিকে কথা বলা থেকে রেহাই দিয়ে মৃদুল নিজেই বলে চলল, ‘কি আশ্চর্য দেখুন আমরা প্রায় একই পাড়ায় থাকি অথচ রাহুলদার ব্যাপারটা জানতেই পারিনি। ক্লাবের একটা ছেলে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ওনার অসুস্থতার কথাটা জানতে পেরে আমাদের বলল! আসলে বুঝলেন তো সারাদিন এত ব্যস্ত থাকি। বাবার বয়স হয়েছে তাই পারিবারিক ব্যাবসাটাও দেখতে হয় তার ওপর অনুপমদার-ও টুকটাক বেশ কিছু কাজ থাকে। সেগুলো করতে হয়, উনি আমাকে ছোটোভাই-এর মতো দেখেন। মা-তো বলেন আমি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই। কিন্তু বলুন বউদি বনের মোষ তাড়াবার জন্যও তো উপযুক্ত লোক দরকার।’ মৃদুল হয়তো আরও কিছু বলে যেত কিন্তু ঘরের ভিতর থেকে রাহুলের আওয়াজ পেয়ে তিন্নি তাড়াতাড়ি বলল, ‘রাহুল বোধহয় কিছু চাইছে। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে পরে কথা বলব– বুঝতেই পারছেন তো।’

মৃদুল অমায়িক হাসি হেসে পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে তিন্নির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘না না মনে করব কেন। আমি তো জানি আপনি কত ব্যস্ত। মনে রাখবেন আজ থেকে আপনি একা নন আপনার সঙ্গে আমরা আছি। আমার কার্ডটা রাখুন, প্রয়োজন হলে জাস্ট একটা ফোন করে নেবেন, আমি চলে আসব।’

তিন্নির হাতে কার্ড ধরিয়ে হাত জোড় করে নমস্কার করে মৃদুল যখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল তিন্নি বুঝতে পারল না মৃদুলের আঙুলগুলো কি ইচ্ছাকৃত ভাবেই তিন্নির আঙুলগুলোকে একটু অন্যরকম ভাবে ছুঁয়ে গেল নাকি ওর বুঝতে ভুল হল।

ওরা মানে শ্যাম আর সারা প্রায় আধ ঘন্টা আগে চলে গেছে। ছিল প্রায় ঘন্টাখানেক। তিন্নি ভাবেইনি এতো তাড়াতাড়ি ওদের কাজ হয়ে যাবে। শুরুতে ওদের সাথে রাহুলের কাছে মিনিট দশেক ছিল তারপর ওরা যখন রক্ত আর স্যালাইভা স্যাম্পল নেওয়া শুরু করল তখন তিন্নি আর ওখানে বসে থাকতে পারেনি। ওদেরকে বলেই শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বসার ঘরটায় বসেছিল। কাল রাতে এমনিতেই ঘুম হয়নি।

মৃদুলবাবু চলে যাবার পর তিন্নি যখন দিগন্তকে ফোন করে আজকে রাহুলের অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথাটা বলে ছোট্ট করে মৃদুলের কথাটাও বলেছিল, তখন মনে হল দিগন্ত যেন ওর কথাগুলো শুনেও শুনছে না। তিন্নি তো সময়টা দেখেই ফোন করেছিল যাতে দিগন্ত বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিতে পারে। তিন্নি ভেবেছিল দিগন্তকে আজকে আসতে বলবে কারণ ও যদি সারাদের সঙ্গে ঠিকঠাক কথা বলতে না পারে। কিন্তু দিগন্তর কেমন গা ছাড়া ভাব দেখে তিন্নি আর কিছু বলে উঠতে পারেনি। পরে বেশ রাতে সুপর্ণার ফোন পেয়ে তিন্নির কান্না পেয়ে গিয়েছিল। অত রাতে সুপর্ণার ফোন পেয়ে তিন্নি বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল।

রাহুলের পাশ থেকে উঠে গিয়ে বসার ঘরে ঢুকে সুপর্ণার সঙ্গে কথা বলে তিন্নি যা বুঝল সেটা হল সোশ্যাল মিডিয়ায় রাহুলের

ভিডিওটা-তে কেউ একজন গত মাসে তিন্নির প্রেগন্যান্সি টারমিনেশনের কথাটা পোস্ট করেছে আর সেই নিয়ে বেশ কিছু খারাপ মন্তব্য আসছে। কোনওমতে কথাটা শেষ করে সুপর্ণা বলেছিল, ‘দ্যাখ তিন্নি কাউকে প্লিজ বলিস না যে আমি তোর সঙ্গে গিয়েছিলাম তোর টারমিনেশন করাতে। জানিস তো আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি। যাতে কেউ জানতে না পারে তাই সবাই ঘুমোবার পর তোকে ফোন করছি। আমার শ্বশুরবাড়ি ভীষণ রক্ষণশীল, আমি এর মধ্যে আছি জানলে আর রক্ষা নেই!’

সুপর্ণার সঙ্গে কথা বলার পর তিন্নি বাকি রাতটা আর ঘুমোতে পারেনি, এমনকী ভিডিওটায় পোস্ট করা কমেন্টগুলো পড়বার সাহসও পায়নি। তিন্নি যখন তার প্রেগন্যান্সির কথা জানতে পেরেছিল ততক্ষণে রাহুলের অসুখ অনেক অ্যাডভানস্ড স্টেজে পৗঁছে গিয়েছিল, তাই রাহুলকে ব্যাপারটা বলে ওর কষ্ট আর বাড়াতে চায়নি। দোনামনা করে একটু সময় নিয়েই টারমিনেশন করাবার সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল কারণ ওদের পক্ষে সত্যি করে বাচ্চা রাখা সম্ভব ছিল না। তিন্নি আর কী করতে পারত? ওর নিজের মনে যে কত কষ্ট জমে আছে তা কি লোকে বুঝতে পারছে না?

পড়ন্ত বিকেলের দিকে তাকিয়ে তিন্নি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল, রাহুলের বিকেলের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। রাহুল তো ভালো করে চিবিয়ে খেতে পারে না, আর আজকে অনেকটা ধকল গেছে ওর ওপর দিয়ে। তাই ভাবল আজকে একটু নরম করে নোনতা সুজি বানিয়ে দেবে। রাহুলের বেশ পছন্দের খাবার এটা। রাতের জন্য চিকেন স্যুপটা পরে না হয় চটপট বানিয়ে নেবে।

রান্নাঘরে ঢোকা মাত্র ওর ফোনটা বেজে উঠল, দেখল দিগন্তর ফোন।

‘কি রে কেমন আছিস? রাহুলের কি খবর? ওরা এসেছিল?’ দিগন্ত জানতে চাইল।

‘হ্যাঁ একটু আগে কাজ শেষ করে ওরা গেল।’ তিন্নির ছোট্ট উত্তর।

ওপাশ থেকে দিগন্ত কিছু বলছে না দেখে তিন্নি জিজ্ঞেস করল, ‘তোর কী খবর? কোনও কারণে আপসেট আছিস মনে হচ্ছে?’

‘একটু আপসেট আছি রে। বাড়িতে প্রবলেম হচ্ছে।’

‘কেন রে? কী হল হঠাৎ? সংগীতা ঠিক আছে তো?’ তিন্নি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘জানিস তো সংগীতা প্রেগন্যান্ট– সিক্স মান্থ চলছে। তোর ব্যাপারে কিছু লোক উলটো-পালটা কথা লিখছে আর এদিকে আমার বউ আমাকে সন্দেহ করছে। কাল তোর সঙ্গে কথাও বলতে পারলাম না সেইজন্য। ভাবলাম অফিসে এসে তোকে বুঝিয়ে বলব।’

তিন্নি বুঝতে পারছিল না এর থেকে আর কী খারাপ হতে পারে। কোনওমতে বলল, ‘তুই কি চাইছিস আমি সংগীতার সঙ্গে কথা বলি? ওকে আমার অবস্থাটা বুঝিয়ে বলব।’

‘না না প্লিজ ওকে ফোন করিস না। তোর সঙ্গে আমি কথা বলেছি জানলে আরও ঝামেলা হবে। আমার এত খারাপ লাগছে যে কী বলব। তোর এই বিপদে তোর পাশে থাকব বন্ধুর মতো তা নয়, আমি এখন আমার ঘর সামলাতে ব্যস্ত। শোন প্লিজ আমাকে ভুল বুঝিস না। আমার মোবাইলে বা বাড়িতে ফোন না করে প্রয়োজন হলে তুই আমার অফিসের নাম্বারে ফোন করিস। তা ছাড়া আমি তোকে রেগুলার ফোন করব অফিস থেকে।’

‘আচ্ছা, ভালো থাকিস।’ দিগন্তকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিন্নি ফোন অফ করে দিল।

নিজেকে যতটা পারে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও রাহুলের কাছে তিন্নি বোধহয় ধরা পড়ে গেল। যখন ওকে সুজিটা খাওয়াতে গেল রাহুল প্রথমে চোখের ইশারায় বার কয়েক জানতে চাইল কী হয়েছে? তারপর তিন্নি এড়িয়ে যাচ্ছে দেখে মুখ ফুটে জিগ্যেসই করে ফেলল, ‘কী হয়েছে?’

তিন্নি একটু শুকনো হাসি হেসে বলল, ‘কী আবার হবে? কিছু হয়নি। একটু টায়ার্ড লাগছে। আজ একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ব। কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি।’

তিন্নি যখন রাহুলের চোখকে ফাঁকি দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি তার জন্য আরও কী অপেক্ষা করছে।

সন্ধ্যাবেলায় রাহুলের সঙ্গে বসে ঘন্টাখানেক টিভি দেখার পর সবে চিকেন স্যুপটা বানাতে গেছে, দরজায় ঘন্টির আওয়াজ পেল।

দরজার সামনে রাহুলের দিদি আর জামাইবাবুকে দেখে বেশ ঘাবড়ে গিয়ে দরজা খোলামাত্র দিদি ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে সোজা রাহুলের কাছে গিয়ে কেঁদে বলল, ‘তুই আমাদের কি নিজের বলে ভাবিস না ভাই? কেন এটা করলি?’

রাহুলের থতোমতো ভাব দেখে দিদি আবার বলে উঠল, ‘তোরা একবার তো আমাদের জিগ্যেস করতে পারতিস, তোরা না পারলেও তোদের বাচ্চার দায়িত্ব না হয় আমরা নিতাম। কেন ওকে পৃথিবীতে আসতে দিলি না?’

রাহুল লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, ‘কার বাচ্চা? কী বলছ?’

‘তোদের বাচ্চা। আজকেই তো জানলাম যে তিন্নি গতমাসে টারমিনেশন করিয়েছে। কেন করলি তিন্নি? রাহুল বললেই কি তোকে মানতে হবে?তোর তো বাচ্চা, তুই তো আটকাতে পারতিস।’

‘রাহুল এ ব্যাপারে কিছু জানে না দিদিভাই। ওকে আমি জানাইনি। যা করার আমিই করেছি।’ তিন্নি শান্ত স্বরে প্রতিটা কথা কেটে কেটে বলল।

দিদি তার কান্না ভুলে রাহুলের পাশ থেকে সরে এসে তিন্নির সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কি বললি ভাই জানতই না তোর প্রেগন্যান্সির কথা। তার মানে তুই টারমিনেশন করিয়েছিস সেটাও জানে না। তুই কী করে এত নিষ্ঠুর হতে পারলি তিন্নি?’

রাহুলের দিকে না তাকিয়েও তিন্নি বুঝতে পারছিল যে ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ও খুব জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তাড়াতাড়ি ওকে অক্সিজেন মাস্কটা দিতে গেল কিন্তু রাহুল বার বার মাথা সরিয়ে নিল। কিছুতেই মাস্ক পরাতে দিল না।

তিন্নি সামান্য হেসে বলল, ‘দিদিভাই আমি একটা বাচ্চা নিয়েই খুব ভালো আছি– আরেকটা নিয়ে কি করতাম? রাহুলই আমার সবকিছু দিদিভাই। আমার যে আর কিছুর দরকার নেই।’

তিন্নির গলার আওয়াজে হয়তো এমন কিছু ছিল যে, দিদি একটু থমকে গেল কিন্তু তার পরেই আবার বলল, ‘তুই এসব কথা বলে রাহুলকে চুপ করাতে পারবি তিন্নি কিন্তু আমাকে নয়। তোর একবারও মনে হল না যে, রাহুল না থাকলেও ওর একটা অংশ তোর সঙ্গে থাকতে পারত। তোর একবারও মনে হল না বাচ্চাটা থাকলে আমাদের বংশটা এখানেই শেষ হতো না? তুই নিজে হাতে আমাদের বংশটাকে শেষ করে দিলি তিন্নি।’

তিন্নি চোখের জল চেপে ছুটে রান্নাঘরে যাবার চেষ্টা করতেই দিদি পিছন থেকে ওর হাতটা টেনে ধরে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস? তোকে বলতে হবে কার পারমিশন নিয়ে তুই এটা করালি?’

দিদি হয়তো আরও কিছু বলত কিন্তু জামাইবাবু বসার ঘর থেকে উঠে এসে দিদিকে ধমক দিয়ে বলল, ‘কী আরম্ভ করেছ রেখা? চ্যাঁচামিচি কোরো না। রাহুল অসুস্থ এটা ভুলে যেও না।’

দিদিও ফোঁস করে উঠল, আমার ভাই যে ভীষণ অসুস্থ সেটা আমি ভালো করেই জানি। আর তাই তো বলছি ভাইয়ের শেষ চিহ্নটাও তিন্নি মুছে ফেলল। মানুষ কী করে এত নিষ্ঠুর হতে পারে? নাকি লোকে যা বলছে সেটাই সত্যি! –ওটা আদৗ ভাই এর ছিল না।’

তিন্নি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়াল, তারপর দিদির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘একটু আগেই তুমি বললে না বাচ্চাটা আমারও ছিল। হ্যাঁ, এটা আমার বাচ্চাই ছিল তাই যেটা উচিত মনে হয়েছে আমি করেছি। বাচ্চার বাবার বা বাড়ির লোকের পারমিশন নেবার দরকার মনে করিনি।’

‘তা করবি কেন? এটা তো তোর পাপ তিন্নি। রাহুল তো কবে থেকেই–’

‘চুউপ, চুউ’ দিদির কথা শেষ হবার আগেই রাহুল বীভৎস চিৎকার করে উঠল।

রাহুলকে নিয়ে ওরা যখন চলে গেল তখনও তিন্নি কাঁদতে পারল না। রাহুলের শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনে অজস্র প্রশ্ন একের পর এক জমা হচ্ছিল। তাহলে সবার মতো রাহুলও ওকে ভুল বুঝল। রাহুলের জন্য ওর ভালোবাসা, ওকে ভালো করে তোলার এত প্রচেষ্টা, এত কষ্ট সহ্য করা সব বিফলে গেল, শুধুমাত্র একটা সিদ্ধান্ত নিজে নেবার জন্য! রাহুল যদি জানত তাহলে কি তিন্নিকে টারমিনেশন করাতে দিত? যদি বাচ্চাটা আসত। পৃথিবীতে তাহলে তিন্নি কী ওকে একা মানুষ করতে পারত? রাহুল ছাড়া তিন্নি নিজেকে কী করে সামলাবে তাই জানে না সেখানে একটা বাচ্চা না নিয়ে ও কি খুব ভুল করেছে? সারা জীবন প্ল্যান করে চলা রাহুল কেন তাদের আনপ্ল্যান্ড প্রেগন্যান্সি নিয়ে তিন্নিকে ভুল বুঝল? না কি কারওর অনুমতি না নিয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই তার অপরাধ?

রাহুলের এভাবে চলে যাবার জন্য কি তিন্নি দায়ী?

তিন্নির এইসব আকাশ-পাতাল চিন্তার মাঝে বাড়ি ধীরে ধীরে খালি হয়ে গেল। কাল রাতে বাড়ি চলে যাবার পর দিদি খবর শুনে আজ সকালেই আবার চলে এসেছিল, অনেক কান্নাকাটি করেছে কিন্তু তিন্নির দিকে ঘুরেও তাকায়নি কথা বলা তো দুরের ব্যাপার। জামাইবাবু যতটা সম্ভব সব কিছু সামলেছেন। দিদি কাঁদতে কাঁদতে কয়েকবার অজ্ঞান হয়ে যাবার পর তাকে ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি পৗঁছে দিয়ে আবার ফেরত এসেছেন। বন্ধুদের কয়েকজন রাহুলের সঙ্গে গেছে। দিগন্ত কোনও কাজে আটকা পড়ে এখানে আসতে পারেনি বলেছে সোজা ওখানে চলে যাবে রাহুলকে শেষবারের মতো দেখতে।

দাদা গেছে বউদিকে উত্তরপাড়ায় রেখে আসতে। ছেলে দুটোর পরীক্ষা তাই বউদি ওদের পাশের বাড়িতে রেখে এসেছিল। দাদা বলেছে যত রাতই হোক বউদিকে বাড়ি পৌঁছিয়ে ও এখানে ফেরত আসবে। থাকবে ক’দিন তিন্নির কাছে। এখন বাড়িতে শুধু তিন্নি আর মা রয়েছে। এমন সময় হঠাৎ করে শ্যাম হাজির। ও গতকালই বলেছিল যে আজ বিকেলে আসবে রাহুলের আরও কয়েকটা টেস্ট করার জন্য। এত কিছুর মধ্যে তিন্নি ওকে ফোন করতে ভুলেই গিয়েছিল। শ্যাম চটপট ব্যাপারটা বুঝে যথা সম্ভব দুঃখ প্রকাশ করে যখন বেরিয়ে যাচ্ছে, সে সময়ে দরজায় মৃদুলবাবু আর তার সেদিনের সাকরেদের আবির্ভাব। তিন্নি চটপট শ্যামকে বলল,  শ্যাম কুড ইউ প্লিজ স্টে হিয়ার ফর সাম টাইম। আই নিড টু ডিসকাস সামথিং উইথ ইউ।’

তারপর মৃদুলবাবুর মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, ‘আমি দুঃখিত মৃদুলবাবু। শুনেছেন বোধহয় যে আজ ভোরে রাহুল চলে গেছে। বাড়ি-তে এখন কেউ নেই তাই যদি পরে আসতেন তো ভালো হতো।’

মুখে কোনওমতে একটা সহানুভূতির ভাব এনে মৃদুল বলল, ‘হ্যাঁ খবরটা একটু আগেই পেলাম আর শুনেই তাই ছুটে এসেছি। জানেন তো সারাদিন এতো কাজে ব্যস্ত থাকি তাই হয়তো খবরটা পেতে দেরি হল। ভাবলাম বাড়িতে হয়তো একা আছেন একটা কথা বলার লোক পেলে হয়তো ভালো লাগবে। তাই খবরটা শোনা মাত্রই কাজ ফেলে ছুটে এলাম, বলেই ঘাড় ঘুড়িয়ে হাঁক দিল, অ্যাই বিশু ফুলগুলো রাহুলবাবুর ঘরে রেখে আয়।

বিশু একপা এগোবার আগেই তিন্নি দরজা আগলে দাঁড়িয়ে বলল, ‘অতগুলো ফুল রাখার জায়গা তো নেই আমার বাড়িতে। কিন্তু আপনারা কষ্ট করে এনেছেন বলে একটা মালা খালি আমি নিচ্ছি আর শুনুন আমি এখন ব্যস্ত আছি আপনার সঙ্গে এখন কথা বলার সময় পাব না। কিছু মনে করবেন না যেন।’

‘না না ঠিক আছে। দেখতেই পারছি আপনি ব্যস্ত আছেন। পরে কখনও না হয় আবার আসব।’ শ্যামের দিকে একঝলক তাকিয়ে মুখটা স্বাভাবিক রেখে মৃদুল কথাগুলো বললেও তার আওয়াজে মনের রাগটা সহজেই বোঝা গেল।

মৃদুলবাবু সিঁড়ি দিয়ে নামার আগেই তিন্নি শুনতে পেল ফিচেল স্বরে বিশু বলছে– ‘শ্যাম এসেছে রাধার কাছে, গুরু তুমি কি আর নাগাল পাবে?’

সকাল চারটে– ঠিক চব্বিশ ঘন্টা আগে রাহুল চলে গেছে। হয়তো অভিমান নিয়ে, তিন্নির ওপর রাগ করেই রাহুল চলে গেছে। এই চব্বিশ ঘন্টায় তিন্নি অনেক ভেবেছে, নিজের জীবনটাকে ফালা ফালা করে চিরে দেখেছে, নিজেকে আসামির কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়ে নিজেই সওয়াল জবাব করেছে। এখন তার মন অনেকটা শান্ত হয়েছে। ধীরে ধীরে মায়ের পাশ থেকে উঠে রান্নাঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ল্যাপটপটা খুলল। ভিডিওতে যত সব মন্তব্য এসেছে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ল তারপর টাইপ করতে লাগল–

‘কাল ভোর রাতে রাহুল চলে গেল। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আপনারা নানাভাবে আমার মনোবল বাড়িয়েছেন। আপনাদের সহানুভূতি, বক্রোক্তি, কটূক্তি সব কিছুই আমাকে নিজেকে খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে। আমি নিজের নারীসত্ত্বাকে চিনতে পেরেছি, আর তাই আমি মাথা উঁচু করে কোনওরকম দ্বিধা না রেখেই বলছি, আমি আমাদের পরিস্থিতি চিন্তা করেই আমার বাচ্চাকে সরিয়ে নিয়েছি পৃথিবী থেকে। এব্যাপারে আমি মনে করি না যে আমার কারওর থেকে অনুমতি নেবার দরকার ছিল বা আমাকে কারওর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আর কয়েক ঘন্টা পরে ভিডিয়োটা তুলে নেওয়া হবে। কিন্তু আপনাদের কাছে অনুরোধ আমাকে বা আমার মতো অন্য হতভাগ্যাদের-কে নিজের মতো করে বাঁচতে দিন।’

তার কমেন্টটা পোষ্ট করে দিয়ে তিন্নি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিল। তারপর যখন চোখ খুলল দেখল রান্নাঘরের পুব দিকের একমাত্র জানলা দিয়ে ভোরের সূর্য উঁকি মারছে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...