আমার শ্যালক সুজয়কুমার শিল্পী। শিল্পীরা একটু খামখেয়ালি হয়। আর শিল্পী মানেই বড়ো মাপের প্রেমিক। সবকিছু ঠিকঠাক চললে তার প্রেমের নিদর্শন এতদিনে দৃষ্টান্ত হতো। অন্তর্ঘাতের জন্যে হয়নি। নিজেকে প্রমাণ করতে না পারার ব্যর্থতা তাকে আজও কষ্ট দেয়। বাড়িতে নতুন কেউ এলে যে-কোনও অজুহাতে ছাদে নিয়ে যায়, যেখানে খোদাই করে লিখেছিল ‘দোলনচাঁপা’। পাশে পায়রার ফাঁকা বাক্স। এখানে দাঁড়িয়ে দোলনচাঁপাদের বাড়ির ছাদ এবং ওর ঘরের জানালা দেখা যায়। প্রথম পরিচয় থেকে শুরু করে দোলনচাঁপার বিয়ে পর্যন্ত সবটাই শ্রোতাকে ধৈর্য ধরে শুনতে হয়। কেবল ব্যাগ চুরির ঘটনাটা চেপে যায়। হয়তো দোলনচাঁপার থেকেও গৃহত্যাগ করতে না পারার ঘটনা তাকে বেশি কষ্ট দেয়। আরও কষ্ট হয় যখন বাড়ির মানুষগুলো উপহাস করে। যেন প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার থেকে হাস্যকর আর কিছু হয় না।
কাউকে বিশ্বাস করে না সুজয়। না বাড়ির, না বাড়ির বাইরে কারওকে। একমাত্র আমাকে যা একটু ভরসা করে। হতে পারে একসময় আমি শিল্পচর্চা করতাম বলে, এখনও খোঁজখবর রাখি বলে। তার চেয়েও বড়ো কথা সুজয়ের ছবির সমঝদার। দ্বিতীয় কারণটি পারিবারিক। সুজয়ের দিদিকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি। বাড়ির অমতে, পালিয়ে। সুজয়দের বাড়ি থেকে মেনে নিয়েছে বছরখানেক পরে। সেখানে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে বড়ো ভূমিকা ছিল সুজয়ের। এখন সকলের সাথে ভালো সম্পর্ক। একমাত্র শ্বশুরমশাই এখনও সেভাবে মেনে নিতে পারেননি। কথা বলেন প্রয়োজনে।
আমার শ্বশুরবাড়ি এখনও একান্নবর্তী। শ্বশুরমশায়ের পাঁচ মেয়ে চার ছেলে, আমি বলি নবরত্ন। জ্যাঠতুতো ভাইবোন ধরলে পনেরো। ভাগ্যিস কাকাশ্বশুর বিয়ে করেননি। করলে সংখ্যাটা কোথায় যেত সন্দেহ! সব পিঠোপিঠি ভাইবোন। বন্ধুর মতো সম্পর্ক। দল বেঁধে ফুটবল খেলছে, সিনেমায় যাচ্ছে, এ ওর পেছনে লাগছে, হৈ-হুল্লোড় লেগে আছে সবসময়। সবচেয়ে বেশি পেছনে লাগে সুজয়ের। সুজয়ের খ্যাপাটে আচরণ, গোলমেলে কথাবার্তা আর আজব কাজকর্মের জন্যই হয়তো।
শিল্পী সুজয়ের কদর কেউ না বুঝুক সুজয় জানে, এই সময়ের সে ব্যতিক্রমী প্রতিভা। ছবির বিষয়, আঙ্গিক এবং উপস্থাপন সবেতেই স্বতন্ত্র। তবে চিত্রকলা নয়, ভাস্কর্যে তার আগ্রহ বেশি। কিছু দিন মূর্তি নির্মাণ শিখেছিল। ইচ্ছা আছে শুশুনিয়া পাহাড়কে ভবিষ্যতে সাধনপীঠ হিসাবে বেছে নেবে। দেশে হিমালয়ের মতো পাহাড় থাকতে শুশুনিয়া কেন? কারণ শুশুনিয়া চুনা পাথরের। চুনা পাথরই বিবর্তনের ফলে মার্বেল পাথরে রূপান্তরিত হয়। শুশুনিয়া এখন মাঝামাঝি অবস্থায়। অপেক্ষাকৃত নরম চুনা পাথর কুঁদে মূর্তি বানানোয় কষ্ট কম, ভবিষ্যতে সেই মূর্তি মার্বেল মূর্তিতে পরিণত হবে। কয়েক হাজার বছর সময় লাগবে হয়তো। মহাকালের নিরিখে এটা এমন কিছু সময় নয়। কেবল সে থাকবে না তখন। না থাকুক, তার শিল্প থাকবে। আর শিল্প থাকলেই শিল্পীর অমরত্ব। কাজটা সময়সাপেক্ষ। প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। সুজয় পয়সা জমাতে শুরু করেছিল।
একসময় তার জীবনে প্রেম এল।
বাড়ির উলটো দিকে ফাঁকা জায়গাটা কিনে বাড়ি বানালেন একজন মাস্টারমশাই। স্বামী-স্ত্রী আর তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ছোটো সংসার। ছেলেটি ছোটো। বড়ো মেয়ে দোলনচাঁপা প্রথমবর্ষের ছাত্রী। সুজয়ের ঘরের জানলা দিয়ে বাড়িটা দেখা যায়, ছাদে উঠলে দোলনচাঁপার ঘরের জানলা। কিছু দিনের মধ্যে সুজয়ের বোনেরা আবিষ্কার করল, সুজয়ের ক্যানভাস জুড়ে দোলনচাঁপার মুখ। ততদিনে দুই পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, সুজয়ের বোনদের সাথে দোলনচাঁপার বন্ধুত্ব হয়েছে, বিকালের দিকে সুজয়দের বাড়ি আসে গল্পগুজব করতে। কথাটা তার কানেও উঠল এবং সুজয়ের বোনদের সাথে হাসিতে মাতল। আড়াল থেকে লক্ষ্য করল সুজয়, খারাপ লাগল তার। অপমানটা জমে থাকল ভেতরে।
দুদিন বাদে কলেজ থেকে ফেরার সময় দোলনচাঁপার পথ আটকাল সে, আপনার সাথে কথা আছে।
দোলনচাঁপা জানত সুজয়ের দুর্বলতা, এমন কিছু যে ঘটতে পারে সে আশঙ্কাও ছিল। মানসিক ভাবে একরকম প্রস্তুত ছিল। তবু না বোঝার ভান করল, ওমা এখানে কেন! বাড়িতে বললেই তো পারতেন।
–সব কথা বাড়িতে বলা যায় না। আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে।
–তাহলে তো আমার মা-কে জানানো উচিত। একদিন আসুন না আমাদের বাড়ি। মা-র সাথে আলাপ করিয়ে দেব।
–সেদিন অমন বিশ্রী ভাবে হাসলেন কেন? আপনার ছবি অাঁকা অন্যায় না হাস্যকর? আপনি আপনাকে হাস্যকর ভাবতে পারেন, আমি ভাবি না। আমার জীবনে আপনি…
–এমা ছিছি, এ তো আমার সৗভাগ্য। আপনার মতো গুণী শিল্পী…
সুজয় খুশি হল, আপনি দেখেছেন?
–দেখেছি। আপনার অনুমতি না নিয়েই আপনার ঘরে ঢুকেছিলাম।
–ভালো লেগেছে?
–ভীষণ।
–আসলে ছবির আপনি তো শুধু আপনি নন, কল্পনায় আপনাকে যেভাবে দেখি… কথাটা কীভাবে বলব ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি ভুল বুঝলে…
দোলনচাঁপা বিষম খেতে খেতে সামলে নেয়, বুঝেছি। সত্যিই অন্যায় হয়ে গেছে। আপনার অনুমতি ছাড়া ঘরে ঢোকা উচিত হয়নি।
–আমি সে কথা বলছি না। আপনার যখন খুশি যাবেন, যতক্ষণ খুশি থাকবেন, চাইলে সারা জীবন…
এবার আর সামলাতে পারল না, বিষম খেল। একটু ধাতস্থ হলে বলল, ফুচকা খাবেন? আমার ফেভারিট।
–আমারও।
–চলুন।
–পয়সা কিন্তু আমি দেব।
–অফার আমি করেছি, আপনি কেন দেবেন?
–আমার ইচ্ছা।
–পরের দিন কিন্তু আমি দেব।
পরের দিন ফুচকা নয়, রেস্টুরেন্ট। ফিস কবিরাজির ভিতর কাঁটা চামচ চালাতে চালাতে আসল কথাটা বলে ফেলল সুজয়, কিছু বুঝতে পারছেন?
–কী?
–আমি আপনার প্রেমে পড়েছি।
টকাস করে এক টুকরো ফিস কবিরাজি মুখে পুরে দোলনচাঁপা বলল, থ্যাংক য়ু।
সুজয় থতমত খেল। এই কথায় এই উত্তর! তালগোল পাকিয়ে যায় কেমন। কথা খুঁজে পায় না। দোলনচাঁপা মুখ নামিয়ে হাসি চাপার চেষ্টা করছিল। মুখের খাবার শেষ হলে সোজা তাকাল সুজয়ের দিকে। স্বাভাবিক ভাবে বলল, কেউ ভালোবাসে শুনলে কার না ভালো লাগে বলুন। এই একটা ব্যাপারে আমি কিন্তু ভাগ্যবান, অনেকের মুখেই কথাটা শুনেছি। তবে আপনার মতো শিল্পী যখন বলে…
–আমি বোধহয় আপনাকে বোঝাতে পারছি না।
–পেরেছেন। সত্যি কথা বলতে কী, এ ব্যাপারে আমি অসহায়। দোলনচাঁপা এবার সিরিয়াস হয়, মেঘ করে আসে মুখে। দমধরা গলায় বলে, সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। বাবার আবদার তার পছন্দে বিয়ে করতে হবে, না হলে আত্মহত্যা করবে। বাবাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি, সে আঘাত পায় এমন কোনও কাজ করতে পারব না।
–বিষয়টা আমার উপর ছেড়ে দাও। তোমার বাবাকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। আমি তোমার মতামত জানতে চাইছি।
–বললাম তো, বাবার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা।
সুজয় খুশি হয়। দোলনচাঁপা তাকে হতাশ করেনি, বরং আশার আলো দেখিয়েছে। এই ছোট্ট আলোকবিন্দু একদিন দাবানলে পরিণত হবে।
সুজয় পক্ষীরাজ হয়ে ওড়ে, পিঠে দোলনচাঁপা। কখনও ভিক্টোরিয়া, রবীন্দ্রসদন, কখনও সিনেমা, নাটক। দেদার পয়সা ওড়ে। জমানো টাকায় হাত পড়ে একসময়। তবে এসব প্রসঙ্গ গৗণ। ভালোবাসার কাছে পৃথিবীর সমস্ত অর্থও কিছু না। তার শিল্পকর্মেও জোয়ার আসে। একটার পর একটা দোলনচাঁপার পোর্টেট। কখনও ওয়াটার কালার, কখনও অয়েল পেইন্টিং, কখনও স্রেফ পেন্সিল স্কেচ। ততদিনে দোলনচাঁপাদের বাড়ির দরজাও খুলে গেছে। দোলনের মা তাকে পছন্দ করে। সুজয় ডাকে মাসিমা। মাসিমার এটা-ওটা ফাইফরমাস খেটে দিতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করে।
বছর দুই কেটে যায় এভাবে উড়তে উড়তে। দোলনচাঁপা বিএ ফাইনাল দেয়। সুজয়ের মনে হয় এবার দোলনের বাবাকে জানানো উচিত। অথচ বলি বলি করেও বলা হয় না।
মাসখানেক বাদে একদিন অসময়ে সুজয়ের ঘরে এসে হাজির হয় দোলনচাঁপা। অপরাধী অপরাধী ভঙ্গিতে একটা বিয়ের কার্ড সুজয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, বাবা হঠাৎ ঠিক করে ফেলল।
আচমকা আঘাতে সুজয় হতভম্ব। কার্ডটা মুঠো করে ধরে চুপচাপ বসে রইল। কিছু বলতে পারল না।
কাছে এগিয়ে এল দোলনচাঁপা, সুজয়ের ডানহাতটা চেপে ধরে অনুনয় করল, বিয়েতে থেকো কিন্তু। না হলে বুঝব… শিল্পীর ভালোবাসার কোনও মূল্য নেই। সব মিথ্যে…
সাচ্চা প্রেমের প্রমাণ দিতে বিয়ের দিন আর পাঁচজন নিমন্ত্রিতের মতো সেও উপস্থিত থাকল। কিছু কিছু দায়িত্ব পালন করল। সাতপাকের সময় পিঁড়ি ধরল। শুভদৃষ্টির সময় প্রত্যাশা করল এক বারের জন্য হলেও তার দিকে তাকাবে। শেষপর্যন্ত না তাকালেও দুঃখ পেল না। ভাবল সংকোচে…
পরদিন সন্ধ্যায় চাকুরীজীবী বরের হাত ধরে শ্বশুরঘরে যাওয়ার পর সবার অলক্ষ্যে ছাদে উঠে এল সুজয়। বিয়ের চিঠি হাতে পেয়ে দুঃখে ছাদ খোদাই করে সেখানে দোলনচাঁপার নাম লিখেছিল। পাশে পায়রার বাক্স। পায়রা পোষার শখ সুজয়ের ছোটোবেলা থেকে। বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় গোটা তিরিশেক পায়রা এই মুহূর্তে তার জিম্মায়। দরজা খুলে সবগুলোকে উড়িয়ে দিল। অনেক রাত অবধি চোখের জল ফেলল। চাঁদ তারা সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করল, শিল্পীর ভালোবাসায় খাদ থাকে না। প্রমাণ আমি করবই। কেবল তোমার কাছে না, তামাম দুনিয়ার কাছে…
এরপর থেকে সময় পেলেই ছাদে আসে। বিশেষ করে রাতের দিকে। দোলনচাঁপা-র সামনে। ফাঁকা পায়রার খোপের দিকে তাকিয়ে থাকে। দোলনচাঁপাদের বাড়ির দিকে তাকায় না। দিনেরবেলা যতক্ষণ ঘরে থাকে দরজা বন্ধ করে রাখে। বোনেদের কারও কারও সন্দেহ হওয়ায় গোয়েন্দাগিরি শুরু করে দিল। বিশেষ কিছু উদ্ধার করতে না পারলেও এটুকু বুঝছে, রহস্যের মূলে আছে একটা বড়ো ব্যাগ। সাধারণত টুরে যাওয়ার সময় যে-ধরনের ব্যাগ ব্যবহার হয়। তবে কি সুজয় কোথাও যাচ্ছে! বাড়ি থেকে বেরনোর সময় দরজায় তালা লাগিয়ে বেরোয়। কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞাসা করলে বলে না। তবু খবর আসে বাড়িতে। বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন পরিচিত সকলের কাছ থেকে টাকা ধার করছে। কারও কারও কাছে অনুদান হিসাবেও নিয়েছে। কারণ হিসাবে বলেছে, বাড়িতে আর ভালো লাগছে না। গৃহত্যাগী হয়ে পাহাড়ে যাবে।
বাড়ির লোকজন ভয় পায়। এবার আর সুজয়ের আচরণে হাসে না। সুজয়ের অনেক বিপজ্জনক ক্ষ্যাপামির স্মৃতি এখনও তারা ভুলতে পারেনি। সুজয়ের বাবাও চিন্তায় পড়েন। ছেলের জেদ তিনি জানেন। কারও কথায় সিদ্ধান্ত বদলাবে না। একমাত্র তার এই অপ্রিয় জামাইটি চেষ্টা করলে হয়তো পারতে পারে। এই একটি মানুষকেই সে যা একটু সমীহ করে। তাই জরুরি তলব পাঠালেন।
গেলাম। প্রথমে দেখা করলাম সুজয়ের সাথে। দোলনচাঁপার বিয়ের খবর আগেই পেয়েছিলাম। স্ত্বান্না দিলাম ভুলে যাওয়ার জন্যে। নতুন করে জীবন শুরু করার পরামর্শ দিলাম। সুজয় উত্তর দিল না। চুপচাপ শুনল। বুঝলাম আমার কথা ভালো লাগছে না। বাধ্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, গৃহত্যাগী হচ্ছ শুনলাম?
–হু।
–দোলনচাঁপার মতো একটা ফালতু মেয়ের জন্য?
-না, আমার প্রেমের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে।
–কোথায় যাচ্ছ?
–শুশুনিয়া।
–তোমার সেই প্রোজেক্ট?
–হ্যাঁ।
–বিষয় ঠিক হয়েছে?
–আমার প্রেম। দোলনচাঁপা। দোলনচাঁপার মূর্তি বানাব।
ব্যাখ্যা যাই হোক রোগের নাম দোলনচাঁপা। শিল্পী মেয়ে। ও মেয়ে যে দাগা দেবে প্রথমবার দেখেই মনে হয়েছিল। বাড়ির সবাই বুঝত। যে কারণে কেউ মাথা ঘামায়নি। কিন্তু তার পরিণতি এমন হবে কেউ কল্পনাও করেনি।
বললাম, গুড আইডিয়া। কবে যাচ্ছ?
–সামনের বুধবার। কিছু ছেনি ছিল, কিছু বানাতে দিয়েছি। ওগুলো পেতে পেতে মঙ্গলবার। বিভিন্ন মাপের গোটা দশেক হাতুড়ি কিনেছি।
–আমার কোনও সাহায্য লাগলে বোলো। সাধ্যমতো চেষ্টা করব।
–দেখবেন বাড়ির কেউ না জানে। আটকাতে পারবে না জেনেও দল বেঁধে ঝামেলা পাকাবে। শুভকাজে যাওয়ার আগে ঝামেলা ভালো লাগে না।
–বেশ, তুমি যা চাও তাই হবে।
সুজয়ের পর শ্বশুরমশাই। সে অর্থে এই প্রথমবার মুখোমুখি। প্রথমবার কোনও সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলোচনা। এর আগে কুশল বিনিময় ছাড়া কোনও কথা হয়নি। বেশ অসহায় আর উৎকণ্ঠিত মনে হল ভদ্রলোককে। জানতে চাইলেন, কিছু জানতে পারলে?
–জেনেছি। আমাকে বিশ্বাস করে বলেছে। কাউকে বলতে বারণ করেছে। তবু আপনাকে বলব, বলা প্রয়োজন তাই…। কাউকে বলতে পারবেন না। কথা দিতে হবে।
–বিশ্বাস করতে পারো।
শ্বশুরমশাইকে সব কথা বললাম। শুনে তাঁর কপালের ভাঁজ আরও গভীর হল। চুপচাপ ভাবলেন কিছুক্ষণ, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, কী মনে হয়, সত্যিই যাবে?
–আপনার ছেলেকে আপনি জানেন। যেভাবে ক্ষেপে উঠেছে মনে হয় না আটকানো যাবে।
–কত দিনের প্রোগ্রাম?
–বলা কষ্ট। দু বছর হতে পারে, পাঁচ বছর হতে পারে আবার সারা জীবনের জন্যও হতে পারে।
–অসম্ভব। এ হতে দেওয়া যায় না। ওকে আটকাও। একাজ একমাত্র তুমি পারবে। তোমার কথা শুনবে।
–কারও কথা শোনার মতো মানসিকতা ওর নেই।
–তোমার উপর আমার ভরসা আছে।
খুশি হই। উপভোগ করি ভদ্রলোকের অসহায়তা। আনন্দ হয় আমার শরণাপন্ন হওয়ায়। গত দশ বছর ধরে নিঃশব্দে আমাকে অপমান করে চলেছে। এখন বিপদে পড়ে…
আমি চুপ করে থাকি।
এক ভোরে বাড়িসুদ্ধ মানুষের ঘুম ভাঙল সুজয়ের চিৎকারে। সবাই ছুটে এল। ঘটনা গুরুতর, টাকাপয়সা ছেনি-হাতুড়ি সহ পুরো ব্যাগটাই গায়েব। অথচ দরজা জানলা যেমন বন্ধ ছিল তেমনই আছে। পড়ে আছে কেবল একটা বাটালির আছার। রসিকতা করতে ইচ্ছে করে ফেলে গেছে। বাড়ির সবাইকে উদ্দেশ্য করে হুংকার ছাড়ল, একাজ তোমরা করেছ। ভালো চাও তো ফেরত দাও।
এ ওর মুখের দিকে চাইল। কথা বলল না। এত বড়ো বুকের পাটা কার আছে ভাবার চেষ্টা করল সবাই। সবাই সবাইকে সন্দেহ করল। সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে না পেরে আবার প্রথম থেকে ভাবতে শুরু করল…। সবাই সবাইকে জিজ্ঞাসা করল। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছোল, ব্যাগটা চোরেই নিয়েছে।
সুজয়ের হম্বিতম্বিতে চোরের বিশেষ কিছু এসে গেল বলে মনে হল না।
সর্বস্ব খুইয়ে সব দিক থেকেই ভেঙে পড়ল সুজয়। সারাদিন বাড়িতে থাকে। ঘর থেকে বেরোয় না। দরকার ছাড়া কথা বলে না। ভাইবোনেরাও তার পেছনে লাগে না। তবে চোখে চোখে রাখে। অসঙ্গতি কিছু দেখলে নজরদারি আরও বাড়িয়ে দেয়।
স্বাভাবিক হতে অনেকদিন সময় লেগেছিল সুজয়ের।
এর পরের গল্পে কোনও বৈচিত্র্য নেই। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পাত্রী খুঁজে বছরখানেকের মধ্যে সুজয়ের বিয়ে দিলেন শ্বশুরমশাই। বছর দেড়েকের মাথায় একটি কন্যাসন্তান হল। এখন সেই মেয়ের বয়স আড়াই বছর। পাঁচ বছরের ব্যবধানে দোলনচাঁপার শোক এখন ফল্গুধারায়, আলাদা করে কোনও বহিঃপ্রকাশ নেই। দোলন বাপের বাড়ি ঘুরতে এলেও মুখোমুখি হয় না। তবু কোনও কোনও তারাভরা রাতে ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়। লেখাটা এখনও একইরকম আছে, একটু যা ছ্যাতলা পরেছে। পায়রার খোপগুলো ফাঁকা।
দোলনচাঁপার ঘরে এখন তার ছোটোভাই থাকে।
কেবল খোয়া যাওয়া ব্যাগটার দুঃখ এখনও ভুলতে পারেনি। সুজয়ের বিশ্বাস, তার সাথে অন্তর্ঘাত হয়েছিল। বাড়িরই কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ব্যাগটার প্রসঙ্গ উঠলে এখনও সে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। সারাজীবনের সমস্ত স্বপ্ন ওই ব্যাগটায় গচ্ছিত ছিল। প্রেমিকা তো গেছেই, ব্যাগটার সাথে প্রেমও গেল। গ্রীষ্মের দুপুরে কিংবা শীতের ভোরে, বর্ষার মেঘে কিংবা বসন্তের পলাশে-মাদলে শুশুনিয়ার নেড়া মাথায় তা দীর্ঘশ্বাস হয়ে ঘোরে।
আর কোনওদিনও শুশুনিয়া যাবে না সুজয়।
সুজয় এখন আর ছবি অাঁকে না।
গত পাঁচ বছরে শ্বশুরবাড়ির সাথে আমার সম্পর্কের আরও উন্নতি হয়েছে। গুরুত্ব বেড়েছে। গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। সামান্য পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেও আমার পরামর্শ নিতে ভোলেন না আমার শ্বশুরমশাই। তাঁর সাথেও সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। এখন আমি তাঁর প্রিয় জামাই।
ব্যাগটা শুধু অণুঘটকের কাজ করেছে।