অন্ধ্রপ্রদেশ তখন অবিভাজিত ছিল। হায়দরাবাদের এক প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, একসঙ্গে পড়ত আকাশ এবং সুমনা। আকাশ ছিল স্থানীয় যুবক। আর সুমনার বাড়ি ছিল কলকাতায়। ওদের দুজনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক। ফাইনাল ইয়ার-এর পরীক্ষা হয়ে ক্যাম্পাসিং-এ জব-অফারও ছিল দুজনের। কিন্তু দুজনেরই শখ ছিল এমবিএ করার। তাই ওরা টেস্ট দিয়ে ভর্তি হয় হায়দরাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ বিজনেস-এ।

আকাশ ধনী পরিবারের ছেলে। তার বাবা পুলিশ, উচ্চ পদে কর্মরত। আকাশ তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। দামি গাড়ি আছে তাদের। গাড়ি ড্রাইভ করতে ভালোবাসে আকাশ।

সুমনা কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তবে তার বাবা ভালো চাকরি করেন। আকাশের মতো সুমনাও মা-বাবার একমাত্র সন্তান।

আকাশ এবং সুমনার সম্পর্কের বিষয়টি জানতেন দুই বাড়ির লোকেরা। সুমনার মা-বাবা বিষয়টিকে খুব স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছিলেন কিন্তু বিয়ের কথা উঠতেই আপত্তি তুলেছিলেন আকাশের মা-বাবা। কারণ, তারা তাদের ছেলের সঙ্গে একই ভাষাভাষির স্থানীয় কোনও মেয়ের বিয়ে দেবার ইচ্ছে পোষণ করেন। কিন্তু আকাশের অনিচ্ছার জন্য তার মা-বাবা পিছু হঠতে বাধ্য হন। তাই, আকাশ ও সুমনার সম্পর্ক আরও গাঢ় হতে থাকে।

তারা মাঝেমধ্যে লং ড্রইভ-এ যেত। কারণ, আকাশ গাড়ি চালিয়ে দূরে যেতে ভালোবাসত এবং গাড়িও চালাত ভালো। শুধু তাই নয়, ধীরে ধীরে সুমনাকেও গাড়ি চালানো শিখিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল আকাশ। আসলে, তারা তখন নিজেদের শখ-আহ্লাদ পূরণে ব্যস্ত ছিল। এতটাই ব্যস্ত ছিল যে, একটি সংস্থার কিছু ইউনিক কাজ করে সাফল্য পেলেও কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেনি সুমনা। অথচ, ওই সংস্থা সুমনার কাজে এতটাই খুশি ছিল যে, তাকে অ্যাওয়ার্ড দেয় এবং স্থাযী চাকরি অফার করে।

সময় এগিয়ে চলে তার নিজের গতিতে। কলেজের ফাইনাল ইয়ার-এ পৌঁছে পরীক্ষায় ভালো ফল করে আকাশ এবং সুমনা। সেই সঙ্গে, একাধিক সংস্থায় চাকরির অফারও পায় তারা। কলেজের অন্যান্য স্টুডেন্টরাও একই ভাবে ভালো রেজাল্ট এবং কর্মজীবনে প্রবেশ করার অফার পেয়ে খুশি ছিল। তাই, সবাই চাইল এক বিদায়ী জমায়েত। হলও তাই। তারা সবাই একটি গেস্ট হাউস ভাড়া নিল। সেখানে সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত চলল খানাপিনা, হইহুল্লোড়।

এই অবসরে নাচ, গান, অভিনয়, আবৃত্তি যার যা প্রতিভা আছে, সে তা প্রদর্শন করল। গান গেয়ে সবচেয়ে বেশি করতালি কুড়িয়েছিল শুভম নামের কলকাতার-ই এক বাঙালি ছেলে। গান গেয়ে প্রশংসা পেয়েছিল সুমনাও। তাই, সবার অনুরোধে ডুয়েট গাইতে হল সুমনা এবং শুভমকে। এই সুবাদে কলেজের বাইরে এই প্রথম একটু বেশি কথা এবং ফোন নাম্বার আদানপ্রদান করল শুভম এবং সুমনা। সবটাই খুব স্বাভাবিক ভাবে সহপাঠি হিসাবে হল এবং আকাশের সামনেই। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হল, শুভমও প্রথমে সুমনা ও আকাশের মতো ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করার পর ম্যানেজমেন্ট করল।

স্টুডেন্টদের ওই বিদায়ী সমাবেশ-এর পর কেটে গেছে এক সপ্তাহ। আকাশ এবং সুমনার ইচ্ছেমতো হায়দরাবাদের এক রেস্তোরাঁয় আযোজন করা হয়েছিল রিং-সেরিমনির। কলকাতা থেকে সুমনার মা-বাবাও উপস্থিত ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। মূল অনুষ্ঠান পর্বের পর, সুমনা এবং আকাশের বাড়ির সবাই যোগ দিয়েছিলেন খাওয়াদাওয়া এবং আড্ডায়। আকাশ এবং সুমনাও খুব খুশি ছিল। তারা দুজনে হঠাৎই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, রামোজি ফিলম সিটি গিয়ে দুদিন কাটাবে আর দুই বাড়ির বড়োরা ওই দুদিন একসঙ্গে হই-হুল্লোড় করবেন আকাশের বাড়িতে।

সিদ্ধান্তমতো আকাশ গাড়ি বের করল। তারা দুজনে ঠিক করল, প্রথমে আকাশ গাড়ি চালাবে, তারপর সুমনা। আকাশের বাড়ি থেকে রামোজি ফিলম সিটির দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। স্টিয়ারিং আকাশের হাতে। পাশে সিট বেল্ট পরে বসল সুমনা। কিছুটা দূরে গিয়ে একটি পেট্রোল পাম্প থেকে তেল ভরল গাড়িতে। তারপর ওদের গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। একবার গাড়ি থেকে নেমে একটা ধাবাতে ঢুকে দুজনে স্পেশাল লস্যি খেল। আর ওই ধাবাতে বসেই আকাশ সুমনাকে বলল, কথামতো আর পাঁচ কিলোমিটার আমি গাড়ি চালাব। তারপর আরও ভালো রাস্তাও পেয়ে যাবে এবং তখন তুমি গাড়ি চালাবে।

আকাশের কথার পর সুমনা থামস আপ শো করল আর বলল, কিন্তু, তোমার মতো এত স্পিড-এ চালাব না। আমি স্পিড লিমিট রাখব ৫০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায়। রাজি তো?

আকাশ ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। এরপর আকাশের হাতে স্টিয়ারিং থাকল আরও কিছুক্ষণ। তারপর একটা ফাঁকা জায়গায় এসে গাড়ি থামাল আকাশ। গাড়ি থেকে নেমে কথামতো স্টিয়ারিং ধরাল সুমনাকে আর সুমনার জায়গায় নিজে গিয়ে বসল আকাশ।

ওদের গাড়ি গন্তব্যে পেঁছোতে আর বেশি সময় লাগবে না, তাই মাঝারি গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল সুমনা। পাশে বসে সুমনার গাড়ি চালানোর তারিফ করছিল আকাশ। এরই মধ্যে বৃষ্টি নামল। মুহূর্তের মধ্যে চারদিক ঝাপসা হয়ে এলে সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ির ওয়াইপার চালু করে সামনের কাচ পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করল সুমনা। বৃষ্টির আবহে কার ড্রাইভ করতে বেশ ভালোই লাগছিল সুমনার এবং আকাশও বেশ খুশি ছিল।

হঠাৎ সুমনা দেখতে পেল, সামনের দিক থেকে তীব্র গতিতে ছুটে আসছে একটা বাস এবং বাসটি কোনও একটা সাইড না ধরে প্রায় রাস্তার মাঝখান দিয়ে চলছিল। সুমনা নিজের গাড়িকে যতটা সম্ভব বাম দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হল না। সুমনাদের ইনোভা গাড়িটাকে সজোরে ধাক্কা মেরে চলে গেল বাসটি। একটা বিকট আওয়াজের পর ওদের গাড়িটি ছিটকে গিয়ে ওলটপালট খেতে খেতে পড়ল একটা বড়ো গর্তে থাকা পাথরের উপর। কাছাকাছি কিছু দোকান ছিল, তাই, তীব্র আওয়াজ শুনে অনেকে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসে দুর্ঘনাগ্রস্ত জায়গাটিতে।

চালক এবং অন্য আরোহীকে গাড়ির ভেতর থেকে দ্রুত উদ্ধার করার চেষ্টা করে সবাই মিলে। কিন্তু, আরোহীকে গাড়ির ভেতর থেকে বাইরে আনা সম্ভব হলেও, চালকের দিকটা এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে, পুলিশ আসার পর গ্যাস কাটার দিয়ে কেটে তবে গাড়ি থেকে চালককে বের করা সম্ভব হয়েছিল।

সুমনা তখন বেহুঁস। শরীরের নানা জায়গা থেকে রক্ত ঝরছিল তার। তুলনায় আকাশের চোট কম। কারণ, উলটো দিক থেকে আসা বাসটি চালকের দিকেই ধাক্কা মেরে পালিয়ে গিয়েছিল। তাই তার আঘাত ছিল গুরুতর। তবে পুলিশ এবং স্থানীয় মানুষের সহায়তায়, সুমনা এবং আকাশ দুজনকেই নিকটবর্তী একটি বড়ো প্রাইভেট হাসপাতালে অ্যাম্বুল্যান্স-এ করে দ্রুত নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা শুরু করা হয়েছিল।

আকাশের হুঁস ছিল, তাই সে দুজনের বাড়ির লোকের মোবাইল নাম্বার দিতে পেরেছিল। খবর পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে থানা থেকে গাড়ি নিয়ে অন ডিউটিতেই হাসপাতালে পেঁছে গিয়েছিলেন আকাশের বাবা। অন্যদিকে আকাশের মা এবং সুমনার মা-বাবা সবাই অন্য একটি গাড়ি করে পৌঁছেছিলেন হাসপাতালে। ভয়ে তখন সবার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। তবে আকাশের চোট কম ছিল, তাই প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল তাকে।

ছাড়া পেয়ে আকাশ পৌঁছল সুমনার কেবিনের দিকে। কেবিনের সামনে সবাই বসে অপেক্ষা করছিলেন চিকিৎসকের জন্য।

চিকিৎসক বেরিয়ে জানালেন, আগামী ৪৮ ঘন্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ পেশেন্ট-এর জন্য। মাল্টিপল ফ্র‌্যাকচার আছে। পেইন রিলিফের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে। কিছু টেস্ট চলছে, কিছুক্ষণ পরেই সবটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করব ওকে দ্রুত সুস্থ করার। কিন্তু আপনাদের ধৈর্য ধরতে হবে।

সুমনার আঘাত কতটা গুরুতর তা জানার জন্য আরও কয়ে ঘন্টা অপেক্ষা করতে হল সবাইকে। সন্ধে নাগাদ চিকিত্সক আবার এসে জানালেন, পেশেন্ট-এর সিরিয়াস ইনজুরি আছে। হিপ-জযে্ট এবং কলার-বোন্স ছাড়াও ফ্র‌্যাকচার আছে রিব্স-এ। তাই, লাং-এ প্রেশার পড়ছে। রিব্স-এ কোনও সার্জারি হয় না, তাই সেন্স ফিরলে অন্য ভাবে ট্রিটমেন্ট করতে হবে। আর হ্যাঁ, পেশেন্ট-এর লোয়ার লেভেল-এও চোট আছে। হুঁশ ফিরলে আবার টেস্ট করলে জানা যাবে। তবে লাক ভালো যে, ওর ব্রেন-এ কোনও ইনজুরি নেই।

চিকিৎসকের কথা শোনার পর উদ্বেগ জড়ানো গলায় সুমনার বাবা জিজ্ঞেস করলেন, আমার মেয়ে সুস্থ-স্বাভাবিক হয়ে উঠবে তো ডক্টর?

লাইফ-রিস্ক হয়তো নেই, তবে সময় লাগবে সবকিছু ঠিক হতে। আমরা ট্রাই করছি যতটা সম্ভব। তবে হিপ-জযে্ট এবং আরও কয়েটা বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। ধৈর্য রাখুন।

পরের দিন হুঁশ ফিরল সুমনার। বাবা, মা, হবু শ্বশুর-শাশুড়ি ছাড়াও আকাশকে সামনে বসে থাকতে দেখল সুমনা। চোখ ফেরাতেই দেখল শুভমও বসে আছে একটু দূরে। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে বন্ধু হিসাবে শুভমও দেখতে এসেছে সুমনাকে।

পা নাড়ানোর চেষ্টা করতেই নার্স মানা করল ইশারায়। আকাশ, সুমনার মাথায় হাত রাখতেই তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। সে আকাশের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কোনও ক্ষতি হয়নি দেখে ভালো লাগছে। কত স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা! নিজেদের কোম্পানি খোলার কত ইচ্ছে ছিল। সব মাটি হয়ে গেল! আমি তো কখনও কারও ক্ষতি চাইনি, তাহলে এমন শাস্তি পেলাম কেন?

আশা রাখো, মনের জোর বাড়াও, বলেই আবার সুমনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল আকাশ।

হাসপাতালের বিছানায় সুমনার কেটে গেছে কয়েক সপ্তাহ। তার বাবা-মা আর কলকাতায় ফিরতে পারেননি। আকাশের বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন হায়দরাবাদের একটি হোটেলে।

সুমনার বুকের ভাঙা পাঁজর আবার জুড়ে গিয়ে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। সার্জারির পর কলার বোন্স নিয়ে আর কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয়েছিল হিপ-জযে্ট এবং ইউটেরাস-এ। দুর্ঘটনার আঘাত এতটাই জোরালো ছিল যে, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসক পরে জানতে পেরেছিলেন সুমনার করুণ পরিণতির কথা। তাকে যে সারাজীবন হুইল চেয়ারেই জীবন কাটাতে হবে, একথা চিকিৎসকের থেকে জেনে নিয়েছিল সুমনা। কিন্তু সে যে আর কোনওদিন মা হতে পারবে না, এ কথা চিকিৎসক সুমনাকে জানাতে পারেননি জানিয়েছিলেন সুমনার বাবাকে। আসলে, দুর্ঘটনার সময় গাড়িতে থাকা এমন কিছুর মাধ্যমে তার ভ্যাজাইনাল ট্র‌্যাক-এ আঘাত লেগেছিল যে, যার প্রভাব পড়েছিল ইউটেরাস পর্যন্ত।

এক সময় সুমনা মনস্থির করল যে, এভাবে হাসপাতালের বেড-এ শুয়ে না থেকে কিছু কাজ করবে। তাই সে বাবা-কে দিয়ে ল্যাপটপ আনাল হস্টেল থেকে। কী করবে ভাবতে ভাবতে মাথায় এল একটা বুদ্ধি।

বিজনেস ম্যানেজমেন্ট-এর আগে, ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ডিগ্রি নিয়ে সে যে-সংস্থার কাজ করে প্রশংসা পেয়েছিল, ই-মেইল-এর মাধ্যমে আবার যোগাযোগ করল তাদের সঙ্গে। সংস্থার টেকনিক্যাল হেড সব জেনে সুমনাকে কিছু মেশিনারি গুডস ডিজাইন-এর কাজ দিলেন। সুমনা তা দক্ষতার সঙ্গে করে পাঠাবার পরই, ওই সংস্থা স্থাযী ভাবে তাকে নিযোগ করল এবং জানাল, ওয়ার্ক ফ্রম হোম করার কথা।

চিকিৎসকের অনুমতি নিয়ে কাজ করে সুমনা বেশ খুশি-ই ছিল। কিন্তু মন খারাপ হয়ে গেল আকাশের দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে।

আসলে, সুমনা হাসপাতালেই আছে প্রায় দুমাস। প্রথম দিকে প্রায়ই দেখা করতে আসত আকাশ। কিন্তু ধীরে ধীরে আসা কমতে থাকে। আর গত প্রায় এক মাস আর আকাশের দেখা পাওয়া যায়নি। নার্স-এর অনুমতি নিয়ে দুতিনবার আকাশকে ফোনও করেছিল সুমনা কিন্তু ফোন বেজে গেছে, ধরেনি আকাশ।

এরপর কেটে গেছে আরও এক সপ্তাহ। হাসপাতাল থেকে সুমনার ছাড়া পাওয়ার দিন তার মা-বাবা ছাড়াও আকাশ এবং আকাশের বাবা উপস্থিত। সুমনার জন্য কেনা হুইলচেয়ারে বসে আছে সুমনা। হঠাৎ আকাশের বাবা সুমনার উদ্দেশ্যে বললেন, তোমার প্রতি পূর্ণ সহানুভতি আছে আমাদের কিন্তু ডক্টর জানিয়ে দিয়েছেন, সারাজীবন হুইল চেয়ার অবলম্বন করতে হবে তোমাকে। একটু থেমে আবারও আকাশের বাবা বললেন, আর ডক্টর এও জানিয়েছেন, তুমি আর মা হতে পারবে না কোনও দিন।

সুমনাকে ডক্টর নিজে না বললেও, তার বাবা তাকে সবটাই জানিয়ে দিয়েছিলেন। অতএব, সুমনা নিজের মনকে আগেই শক্ত করে নিয়েছিল। তাই আকাশের বাবা-র বলা কথার উদ্দেশ্য বুঝতে অসুবিধা হয়নি, সুমনা এবং তার মা-বাবার। এবার মুখ খুললেন সুমনার বাবা। জানালেন, আমরা জানি সবকিছু কিন্তু ও তো আমার মেয়ে তাই, যাই ঘটুক, ভবিষ্যৎ যেমনই হোক না কেন, মা-বাবার থেকে ও আগের মতোই ভালোবাসা পাবে। তাই কোনও কথাতেই এখন আর আমরা দুঃখ পাব না। আরও কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন নির্দ্বিধায়।

আকাশের বাবা এবার বললেন, আই অ্যাম সরি! বলতে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু আকাশ আমার একমাত্র সন্তান। তাই, সুমনার সঙ্গে তার বিয়ের প্রতিশ্রুতি আর রক্ষা করতে পারব না। উই আর এক্সট্রিমলি সরি!

এবার আকাশের বাবার কথা কেড়ে নিয়ে সুমনা জানাল, আঙ্কল, প্লিজ নো এক্সকিউজ। আপনি আমার মনের কথাটাই বলে দিয়েছেন। আমিও চাই, আকাশ অন্য কারওর সঙ্গে জীবন গড়ুক। বেস্ট অফ লাক আকাশ।

আকাশ চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল তার বাবার ঠিক পিছনেই। এমন সময় আকাশের বাবা, সুমনা এবং তার মা-বাবাকে থ্যাংকস জানিয়ে আাকশের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, চলো আকাশ।

ওরা চলে যাওয়ার পর সুমনা তার মা-বাবার চোখে জল দেখে বলল, বাবা, তোমরা সবসময় আমাকে সাহস জুগিয়ে। আজ আর চোখের জল ফেলে আমাকে দুর্বল করে দিও না।

সুমনার বাবা সুমনার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তুই আমার সাহসী মেয়ে দুঃখ জয় করতে শিখে গেছিস। গড ইজ গুড! সম্পর্কটা ভেঙে গিয়ে হয়তো ভালোই হল।

মা-বাবার সঙ্গে সুমনা এখন কলকাতায় থাকে। বাড়িতে থেকেই অফিস করছে স্থাযী ভাবে। তার কাজে অফিসও এখন ভীষণ খুশি। প্রোমোশনও হয়েছে। মোটা টাকা বেতন পায় সুমনা। তাই, হুইল চেয়ারের বিষয়টা ছাড়া, মা-বাবার সঙ্গে বেশ আনন্দে থাকারই চেষ্টা করে চলেছে সে।

একদিন হঠাৎ শুভমের ফোন এল। সুমনা, তুমি এখন কোথায়? কেমন আছো? জানতে চাইল শুভম। সুমনা জানাল যে, সে এখন কলকাতায় আছে এবং হুইল চেয়ার-ই এখন তার অবলম্বন। তবে সে বাড়ি থেকেই যে চাকরি করছে, এটা জানাল শুভমকে। তারপর শুভমের কী খবর, কেমন আছে জানতে চাইল সুমনা। উত্তরে শুভম জানাল, প্রথমেই সরি বলে নিচ্ছি, দীর্ঘদিন খোঁজখবর নিতে পারিনি বলে। আসলে, হায়দরাবাদে একটি সংস্থার ডিজাইন ইউনিটে মেশিন ট্রায়াল রান-এর সময় চেক করতে গিয়ে আমি দুর্ঘটনার শিকার হই। ডান হাতটা হারিয়েছি কবজি থেকে। টানা দুমাস বেড রেস্ট-এ খুব মানসিক অবসাদের মধ্যে কাটিয়েছি। তারপর হঠাৎ তোমার কথা মনে পড়তেই মনে জোর পেলাম। ভাবলাম, সুমনার তুলনায় আমার দুর্ঘটনা নগণ্য। তাই, সে যদি মনের জোর রাখতে পারে, তাহলে আমিই বা পারব না কেন?

শুভমের দুর্ঘটনা এবং হাত কাটা যাওয়ার বিষয়টা শুনে খুব দুঃখ পেয়ে সুমনা বলল, খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আমার কাছে এ বিষয়ে কোনও খবরই ছিল না। তা, তুমি এখন কোথায় আছো?

আমি কলকাতায় ফিরে এসেছি। আমার কোম্পানি আমার অসহায় অবস্থা দেখে আমাকে কাজের সুবিধে করে দিয়েছে। মাসের কুড়ি দিন আমি কলকাতায় থেকে টেলি কনফারেন্স এবং ভিডিযো কনফারেন্স-এর মাধ্যমে জুনিয়র স্টাফদের গাইড করি আর ওখানে থেকে সপ্তাহখানেক ফিজিক্যালি গাইড করি।

এরপর আরও কয়েবার দূরভাষ কথোপকথনের পর, সুমনাদের বাড়িতে আসে শুভম। সুমনা ছাড়াও, শুভম আড্ডা দেয় সুমনার মা-বাবার সঙ্গে। এভাবেই আরও কয়েবার সুমনাদের বাড়ি এসে আড্ডা জমিয়েছে শুভম। সুমনা এবং শুভমের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়েছে। তাদের বন্ধুত্বে সুমনার মা-বাবাও ভীষণ খুশি হন। একদিন আড্ডার মধ্যেই সুমনার মা শুভমকে হাতে ধরে বলেই বসেন, বাবা, তোমরা দুজনে তো ভালো বন্ধু, পারবে না একসঙ্গে বুড়ো হতে?

মায়ের কথা শুনে সুমনা একটু কপট রাগ দেখিয়ে বলল, মা, তুমি যে কী বলো না, শুভমের জন্য একটা উজ্জ্বল, সুখের ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। ও কেন আমার জন্য স্যাক্রিফাইস করবে? এটা তোমার অন্যায় আবদার মা। তুমি চিন্তা কোরো না, বাকি জীবনটা আমি একাই কাটিয়ে দিতে পারব।

সুমনার কথা শেষ হতেই শুভম মুখ খুলল। সুমনার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ওর মায়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, কাকিমা, আমার মনের কথাটা আপনি বলে দিয়েছেন। সুমনা চাইলে আমি তাকে বিয়ে করতে পারি।

শুভমের কথা শুনে কয়ে সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর সুমনা ধরা গলায় বলল, কিন্তু…

কোনও কিন্তু নয়। তুমি তো আমাকে তোমার সমস্ত প্রতিবন্ধকতার কথা শেয়ার করেছ বন্ধু হিসাবে, জানাল শুভম।

উত্তরে সুমনা জানাল, ভুল করবে, আমরা বন্ধু হিসাবেই তো ভালো ছিলাম! তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করলে সুখী হতে। আমি তো তোমার সন্তানের মা হতে পারব না কোনও দিন।

সুমনাকে থামিয়ে দিয়ে শুভম বলল, অসহায় কোনও বাচ্চাকে আমরা দত্তক নিলে, সে নতুন জীবন পাবে। প্লিজ সুমনা, তোমার মতো লড়াকু মনের মেয়েকে আমি জীবনসঙ্গী হিসাবে পেলে খুশি থাকব।

এরপর আর বেশি কথা বাড়ায়নি সুমনা। তার মনের কোণেও হয়তো কোথাও একটা গভীর ভালোবাসার জায়গা তৈরি হয়েছিল শুভমের জন্য। তাই, মাসখানেকের মধ্যেই তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হল। আর ফুলশয্যার রাতে দুজনেরই মনে পড়ে গেল ম্যানেজমেন্ট-এর পর বিদায়ী সমাবেশে একসঙ্গে গান গাওয়ার স্মৃতি। হয়তো মনের কোণে সেদিনই সূচনা হয়েছিল ভালোবাসার।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...