এই ভুলটা তুমি কী করে করলে ইশা?

ভুল! তুমি বলছ এই কথা অমিত? সতর্ক তো তোমারও হওয়া উচিত ছিল।

আচ্ছা বেশ, আমাদের দুজনেরই ভুল। কিন্তু এখন কী করবে?

এই প্রথম অমিতকে এতটা নার্ভাস দেখল ইশা। এতদিন ধরে মিশছে, পরস্পরকে চেনাও প্রায় চার বছর কিন্তু এরকম পারস্পরিক দোষারোপের ঘটনা কখনও ঘটেনি। তাই ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা অবাক সে। তবে প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়ে সে অমিতকে বলে সিদ্ধান্তটা আমার একার নয় অমিত। দুজনকেই ভেবে একটা রাস্তা বের করতে হবে।

কেরলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজনেই বাযোকেমিস্ট্রি নিয়ে মাস্টার্স করেছে তারা।

ইশা মার্টিন আর অমিত ভট্টাচার্যের প্রেমটা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয ক্যাম্পাসে হয়নি। ক্যাথোলিক ক্রিশ্চান ইশা কেরলেরই মেয়ে, অমিতই ভিনরাজ্য থেকে এসেছে এখানে পড়তে। একা ঘরভাড়া নিয়ে থাকে অচেনা শহরে। একবার ভযংকর অসুস্থ হয়ে পড়ে কলেজ ক্যাম্পাসে। সহপাঠি ইশার মা নার্স হওয়ার সুবাদে ইশাই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। ইশার মায়ের শুশ্রূষায়ে ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠে অমিত। সেই সুবাদেই অন্তরঙ্গতা বাড়ে অমিতের, এই ক্রিশ্চান পরিবারের সঙ্গে। পরিবার বলতে ইশা এবং তার মা। ইশার বাবা ব্যাবসাসূত্রে কুয়েতে রয়েছেন শুনেছে অমিত।

অমিত পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে। পড়াশোনায ভালো। বাবা ছিলেন শিক্ষক। তাঁর অকাল মৃত্যুর পর মা-ছেলের সংসার চলে বাবার পেনশনে ও কিছু ধানিজমির ফসল তোলা টাকাতে। তাদের ব্রাহ্মণ পরিবারটিকে গ্রামের সকলে খুব মান্য করে। বাবার মাস্টারমশাই হিসেবেও সুনাম ছিল একসময। তাই ভিনরাজ্য হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে হাতছাড়া করেনি অমিত।

ছোটো ছোটো ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে জীবনটা একরকম মসৃণ-ই কাটছিল ইশা ও অমিতের। কিন্তু সেদিন দুপুরের অসতর্ক মুহূর্তে ঘটে যায় ঘটনাটা। যার ফলে অমিতের ভালোবাসার বীজবপন হয়ে যায় ইশার শরীরে। পারস্পরিক সম্মতিতেই মিলিত হয়েছিল দুজনে। আসলে সেদিন ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর দুজনেই বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিল। হয়তো সেই কারণেই খানিকটা অসতর্ক হয়ে পড়েছিল।

তবে ইশার প্রতি একটু রুড হয়ে গেছে সে, বুঝতে পারে অমিত। দিন সাতেক পর তাই ইশাকে সঙ্গে করে রেস্তোরাঁয নিয়ে যায় অমিত তার মন ভালো করার জন্য। সেই সঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথাও ইশাকে জানানো দরকার। হালকা হাসি মস্করার পর অমিত কথাটা বলার আগে একটু গলা পরিষ্কার করে নেয়।

বাড়িতে কিছু জানিয়েছ ইশা?

না, এখনও জানাইনি। কিন্তু মুশকিল হল কদিনই বা লুকিয়ে রাখতে পারব। শরীরে তো ফুটে উঠবে লক্ষণ। কথাটা বলার সময একটু নার্ভাস দেখায ইশাকে।

আমি ভাবছি রেজাল্ট বেরোনোর আগে কদিনের জন্য মায়ের কাছ থেকে ঘুরে আসব। তারপর চাকরি-বাকরির চেষ্টা।

তুমি এই অবস্থায আমাকে একা রেখে যাবে অমিত?

বোঝার চেষ্টা করো ইশা। আমাদের ব্যাপারটা আজ নয় কাল তো মা-কে জানাতেই হবে। আমি ভাবছি মা-কে সরাসরি সব বলে বিয়ে করার অনুমতিটাও নিয়ে আসব।

তোমার মা দেবেন অনুমতি?

দেবেন যে সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। কারণ বুঝতেই তো পারছ, এসব গাঁ-গঞ্জের ব্যাপার। আমাদের গ্রামটা খুবই রক্ষণশীল। অন্য জাত-ধর্মে বিয়ে কি আর সহজে মেনে নেবে?

যদি না মানেন তোমার মা, তখন?

উৎকণ্ঠাটা ইশার চোখ মুখে স্পষ্ট। প্লেটে চামচ দিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করছে, কিন্তু মুখে তুলতে ভুলে গেছে যেন। অমিত তুলনায নিজেকে অনেকটা স্টেডি করে ফেলেছে। সে বলে, ভয় পেও না। একান্তই যদি না মানে কোর্ট ম্যারেজ করতে হবে।

(২)

আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। ক্যালেন্ডারে মনসুন। বর্ষা এসে গেছে কেরলে। সেই যে দিন দশেক আগে অমিত তার গ্রামের বাড়িতে গেল পুরুলিয়ায, নিযমিত ভাবে আর ফোন করে না। বৃষ্টি নামল ঝেঁপে। স্কুলে যাওয়া বাচ্চা আর তাদের মায়েদের হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য দেখছিল ইশা তার ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে আর মাঝে মাঝে অমিতকে ঘিরে দুশ্চিন্তা দানা বাঁধছিল মাথায়। তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা সে। এবার শরীরে চিহ্নগুলো ফুটে উঠতে আরম্ভ করবে। কীভাবে লুকোবে সে এই সত্য!

এদিকে অমিতও যে বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে আছে, তেমন নয়। এই গ্রাম যেন এক অন্য ভারতবর্ষ। এখানকার মানুষজন এখনও জাত-ধর্ম, কুসংস্কার এসব নিয়ে গড়ে নিয়েছে এক আলাদা পৃথিবী। অমিতের মা-ও এর ব্যতিক্রম নন। অমিত ইশার কথাটা মা-কে বলেছে সুযোগ বুঝে। প্রথমে অবাক, তারপর অভিমান এবং ক্রমশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন অমিতের মা নিরুপমা। স্পষ্ট ভাষায বলে দিয়েছেন বউমা হিসাবে কোনও ক্রিশ্চান মেয়েকে তিনি মেনে নিতে রাজি নন। গ্রামে তাহলে তাকে একঘরে করবে সকলে। মাস্টার মশাইয়ে ছেলে, গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে এক বেজাতের মেয়েকে ঘরে তুলে জাতধর্ম খোয়াতে তিনি নারাজ। অমিত অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে। মা অনুমতি দেননি। শুধু বলেছেন, অমিত যদি মনে করে এই সিদ্ধান্ত সে বদলাবে না, তাহলে তাকে এই গ্রাম ছেড়ে, তার মা-কে ছেড়ে বরাবরের মতো চলে যেতে হবে।

দ্বিধাবিভক্ত হয়ে আজ ফোনে ব্যাপারটা ইশাকে জানিয়ে দিল অমিত। তাই সন্ধে থেকে ভীষণই দিশাহারা লাগছে ইশার। সে একবার অসহায় ভাবে বলেছিল অমিত, তুমি যে বলেছিলে মা মেনে না নিলে আমরা কোর্ট ম্যারেজ করব!

না ইশা, মায়ের অমতে এখনই এতবড়ো সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি তো জানোই বাবা মারা যাওয়ার পর, মা কত কষ্ট করে আমায পড়াশোনা চালিয়েছেন।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইশা। ফোনের এপারে নৈঃশব্দ্য টের পেয়ে অমিতই বলে, তুমি চিন্তা কোরো না। আমি তোমার কাছে শিগগিরি ফিরব। মা-কে রাজি করানোর চেষ্টা করব।

এই ঘটনার দিন পাঁচেক পর আবারও ফোন আসে অমিতের। এবার সে আরও একটি আশাহত হবার মতো খবর দেয়। না, সে এখনই আসতে পারবে না ইশার কাছে। তার মা পড়ে গিয়ে কোমরের হাড় ভেঙেছেন। এই অবস্থায অন্তত মাস তিনেক, তার মা-কে ফেলে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়।

ফোনে খবরটা পেয়ে কান্নায ভেঙে পড়ে ইশা। কী করবে ভেবে পায় না। তার মা জুলিয়া অতর্কিতে ঘরে ঢোকেন। ইশাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে বারবার জানতে চান, কী ঘটেছে। বেশ কয়েবার পীড়াপীড়ি করাতে শেষপর্যন্ত সত্যিটা বলেই দেয় ইশা। সঙ্গে আরও একটা সিদ্ধান্তের কথাও তার মুখে থেকে বেরিয়ে আসে।

মা আমি অ্যাবর্শন করাতে চাই।

প্রমাদ গোনেন জুলিয়া। বলেন, তুই পাগল হয়েছিস। আমাদের ধর্মে অ্যাবর্শন পাপ।

তাহলে আমি কী করব মা?

জানি না ইশা, তুই যা করেছিস তাতে কোথায মুখ লুকোব বুঝতে পারছি না। আর মাস দশেক পর তোর বাবাও ফিরে আসবেন কুয়েত থেকে। তাকেই বা কী বলব। ইশা হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, সরি মা, আমার মরে যাওয়াই উচিত। আমি তোমাদের মান-সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিলাম…

কান্না থামা। তুই কথা বলেছিস অমিতের সঙ্গে?

বলেছি মা, কিন্তু ওদের পরিবারে মেনে নেবে না আমাদের বিয়ে।

এরকম পরিবারের ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার আগে তোর ভাবা উচিত ছিল।

আমায় অ্যাবর্শনটা করাতেই হবে মা। হাযদরাবাদের একটা হাসপাতাল থেকে আমার একটা চাকরির অফার এসেছে। আমায মাসদুয়েক পরই কাজটায় জয়েন করতে হবে।

জুলিয়া কিছু একটা ভাবলেন, তারপর মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন, তুই এক কাজ কর। হাযদরাবাদের ওই হাসপাতালে যোগাযোগ করে তোর জয়েনিং ডেট-টা আরও মাস চারেক পিছিয়ে দে। মাঝের এই সমযটা তুই কোভালম-এ বড়ো মাসির বাড়ি চলে যা।

ইশা একটু অবাক হল প্রথমে। বড়ো মাসি রিটায়ার্ড নার্স। বিয়ের এক বছরের মধ্যে বিধবা হয়েছিল বড়ো মাসি। তারপর আর বিয়ে বা সংসার করেনি। হাসপাতালে চাকরি আর একার সংসার এই নিয়ে কাটিয়ে দিল এতগুলো বছর। হয়তো মা ঠিকই বলছে। সমাজে কুমারী মা মেনে নেবে না কেউ। ইশার এই মুহূর্তে বড়ো মাসির বাড়িটাই সবচেয়ে সেফ আশ্রয়।

(৩)

কোভালম-এ সমুদ্রের ধারে ছোট্ট একটা বাড়িতে থাকেন ভিভিলা, ইশার বড়ো মাসি। সবকিছু শোনার পর তিনিও ইশাকে অ্যাবর্শনের অনুমতি দিলেন না। বরং পরম মমতায় বললেন, ইশা এই সন্তান ঈশ্বরের দান। এর জীবন নেওয়ার অধিকার আমাদের নেই। তুই বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আন। ওকে মানুষ করতে আমি সাহায্য করব তোকে।

কিন্তু কুমারী মা-কে কে মেনে নেবে মাসি?

অতশত ভাবিস না তুই। বিপদ যিনি দিয়েছেন, পরিত্রাণের রাস্তা তিনিই দেখাবেন। তুই শুধু তোর চাকরির ব্যাপারটা পাকা কর। বাচ্চাটা জন্মানো অবধি বা হয়তো আরও মাস দুয়েক, তোকে সময় চেয়ে নিতেই হবে।

দিন যায়। ইশার শরীরে অস্বস্তি বাড়ে। এখন আয়নায় নিজের বেঢপ চেহারাটা দেখে নিজেই অবাক হয় ইশা। অমিতকে যতটা সম্ভব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছে ইশা। মাঝে মাঝে ডিপ্রেশন হলে, মাসির কাছে এসে বসে। সেদিনও ভিভিলার কাছে এসে বসে ইশা। ভিভিলা বলেন, মুখ-চোখগুলো কেমন হয়ে আছে তোর। যা চিরুনি নিয়ে আয়। চুলগুলো ছাড়িয়ে বিনুনি করে দিই।

ইশা বাধ্য মেয়ে মতো উঠে চিরুনি নিয়ে আবার ফিরে আসে। ভিভিলা তার চুলের জট ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, ইশা, জীবনে সব সময সবকিছু প্ল্যান মাফিক হয় না। যা ঘটে সেটা অ্যাকসেপ্ট করতে হয়। তোর এই কুমারী মা হওয়ার বদনাম আর বইতে হবে না। ঈশ্বর মুখ তুলে চেয়েছেন।

ইশা অবাক হয়ে ঘুরে তাকায ভিভিলার দিকে।

মানে কী বলতে চাইছ তুমি?

ভিভিলা রহস্য ছেড়ে এবার অকপটে বলেন, আমার বন্ধুর ছেলে, জেমস দুবাইয়ে চাকরি করে। খুব ভালো ছেলে বুঝলি, কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য বিয়ের ছমাসের মধ্যে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় ওর বউ মারা গেছে। ছেলেটির জন্য আমার বান্ধবী হন্যে হয়ে পাত্রী খুঁজছে।

তো? কী বলতে চাইছ তুমি?

আমি তোর জন্য ভাবছি ইশা। আমি ওকে জানিয়েছি তোর কথা।

বাহ্ জানিয়েছ আর ওরাও আমার মতো একটা মেয়েকে, বাচ্চা সমেত অ্যাকসেপ্ট করে নেবে! একি সিনেমা নাকি?

করবে ইশা। সবাইকে তোর ওই অমিত ভাবিস না। পৃথিবীতে ভালো মানুষ এখনও আছে। জেমসকে আমি ছোটো থেকে দেখেছি। ওরকম ভালো ছেলে চট করে পাওয়া যায় না।

তাই বলে আমায়!

ভিভিলা ইশাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, থাম তুই, তোকে অ্যাকসেপ্ট করবে না কেন? সে-ও তো বউ হারিয়েছে। এটা তার দ্বিতীয বিয়ে। চট করে এমন পাত্রী পাবে?

ইশা যখন জেমস-এর সঙ্গে জীবনের এক নতুন অধ্যায়ে সূত্রপাত করবে কিনা এই নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত, ঠিক সেই সময জুলিয়া জীবনের তিনটি বড়ো মিথ্যে বলে পরিস্থিতি সামলাচ্ছিলেন। হ্যাঁ, অমিত একদিন হঠাৎই এসেছিল ইশার খোঁজে। জুলিয়া বাধ্য হয়েছিলেন অমিতকে অপমান করতে। কারণ জুলিয়া জানতেন অমিতের কোনওদিনই ক্ষমতা হবে না তার মায়ের অমতে ইশাকে বিয়ে করার। সেটা বুঝেই প্রথম মিথ্যেটা তিনি বলেছিলেন অমিতকে। আর সেটা হল ইশার বিয়ে হয়ে গেছে। সে অন্য শহরে সুখে সংসার করছে। দ্বিতীয মিথ্যেটাও তিনি অমিতকেই বলেছিলেন। ইশার সন্তানের ব্যাপারে অমিত জানতে চাইলে জুলিয়া বলেন, ইশা অ্যাবর্শন করাতে বাধ্য হয়েছিল, না হলে তার জীবনের ঝুঁকি থেকে যাচ্ছিল।

তিন নম্বর মিথ্যেটা জুলিয়াকে বলতে হয় ইশার বাবার কাছে। ডেভিড হঠাৎই কুয়েত থেকে দিন সাতেকের জন্য কেরল আসেন ব্যাবসার কাজে। একটা বিরাট প্রোজেক্ট এসেছে তাঁর হাতে যেটা শেষ হতে অন্ততপক্ষে একবছর লাগবে। সেটারই কিছু যোগাড়যন্ত্র করতে এবং একইসঙ্গে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে একটি সপ্তাহ বাড়িতে কাটিয়ে গেলেন ডেভিড। ফোনে ইশার ব্যাপারে একটা ডাহা মিথ্যে বললেন জুলিয়া। বললেন জেমস-এর সঙ্গে মাসির বাড়ি বেড়াতে গিয়ে আলাপ ইশার। ওরা পরস্পরকে ভালোবাসে। জেমস তিনমাসের ছুটি নিয়ে কোভালম ফিরেছে। তার ইচ্ছে ইশাকে বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার।

সব কথা শুনে ডেভিড এমন সুপাত্রকে হাতছাড়া করতে না করেন জুলিয়াকে। ইশার বিয়ের জন্য টাকা পযসার ব্যবস্থা করে যান। এই মিথ্যেগুলোর সাক্ষী থাকেন জুলিয়ার দিদি ভিভিলা। অভিজ্ঞ ভিভিলা জুলিয়াকে বলেন, যে মিথ্যেতে কারও ক্ষতি হয় না, ভালোই হয়, সেটা বলার মধ্যে কোনও পাপ নেই। বিচার করার অবস্থায জুলিয়া ছিলেন না। জীবন তাকে অনেকটা শক্ত করে দিয়েছে।

একটা শুভ দিন দেখে চার্চ-এ গিয়ে ইশার বিয়ে হয়ে গেল জেমস-এর সঙ্গে। এর মাসদুয়েক পর মা হল ইশা। জেমস ফুটফুটে বাচ্চাটির নাম দিল ড্যানি। ড্যানি ও ইশাকে রেখে দুবাইয়ে নিজের কাজে যোগ দিতে ফিরে গেল জেমস। ইশাও নতুন মাতৃত্বের আনন্দে ভরে উঠল। এখন দিনের বেশিরভাগ সমযটাই তার কাটে, ড্যানির দেখাশোনায়। এভাবে কয়েকটা মাস কেটে যাওয়ার পর ইশার হাসপাতালে জয়েন করার ডেট এগিয়ে এল। অত ছোটো বাচ্চাকে রেখে কীভাবে যে কাজে যোগ দেবে এসব কথা যখন ইশা ভাবছে, তখনই খবর এল প্রাথমিক ভাবে তাকে কয়েকমাস ত্রিভান্দ্রামে ট্রেনিং দেবে হাসপাতাল কতৃপক্ষ। ফলে হাযদরাবাদ যাওয়াটা আরও কিছু দিনের জন্য পিছিয়ে গেল। কোভালম থেকে ত্রিবান্দ্রম যাতায়াত করে সে দিব্যি সামলে ফেলল ট্রেনিংটা। আর ভিভিলার সময় কেটে গেল ছোট্ট ড্যানিকে নিয়ে।

(৪)

জীবন থেমে থাকেনি অমিতের। মা-কে ধীরে ধীরে সুস্থ করে তোলাই তার সেই মুহূর্তের লক্ষ্য ছিল। নিরুপমাও অপারেশনের পর বিছানা ছেড়ে, ফিজিযোথেরাপির সাহায্যে এবং ওয়াকার নিয়ে একটু একটু করে হাঁটতে শুরু করলেন। একদিন মনমরা অমিতকে ডেকে বললেন, তোকে এভাবে মুখ শুকনো দেখতে আমার ভালো লাগে না বাবু। একটা বিয়ে কর।

চাকরি ইত্যাদির বাহানায় অমিত বিষযটাকে প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইলেও, পরে বুঝল মা নেহাত ভুল বলছে না। কী আশায় সে অপেক্ষা করবে। ইশা তো এখন বিবাহিত।

চেন্নাইয়ে ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি এবং অমিতের বিয়ে এই দুটো ঘটনা প্রায় পর পরই ঘটল। ওই গ্রামেরই মেয়ে সুপর্ণাকে বিয়ে করে মা-কে নিয়ে অমিত চেন্নাই চলে এল তার কর্মস্থলে যোগ দিতে। সুপর্ণা এমএ পড়ছে। খুব সহজ সরল মেয়ে। অমিতকে শুধু একটাই অনুরোধ করেছিল যে, সে এমএ কমপ্লিট না করে মা হতে চায় না।

বছর দুয়েক পর মাস্টার ডিগ্রি পেল সুপর্ণা। অমিতেরও চাকরিতে একটা প্রমোশন হয়েছে। সুপর্ণা বিএড করার ইচ্ছাপ্রকাশ করলে, নিরুপমা খানিকটা বিরক্তই হলেন। বললেন, সারাজীবন যদি পড়াশোনাই করো বউমা, আমি তাহলে নাতি-নাতনির মুখ কবে দেখব!

(৫)

কেটে গেছে আরও দুটো বছর। সুপর্ণা এর মধ্যে বার দুয়েক প্রেগন্যান্ট হলেও, দুবারই মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। নিরুপমা মুখে না বললেও হয়তো আড়ালে চোখের জল ফেলেন আর নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করেন। ইশার সঙ্গে অমিতের সম্পর্কচ্ছেদ করিয়ে ছিলেন নিজের পরিবারের সম্মান বাঁচাতে। কিন্তু তিনি নিজে জানতেন, এতে ইশা এবং অমিতকে কতটা মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল। তারপর কেটে গেছে সাত সাতটা বছর। কিন্তু অপরাধবোধটা ইদানীং খানিকটা চিনচিন করে তাঁর বুকের মধ্যে। তিনি বোঝেন অমিত, সুপর্ণাকে তাঁর কথায় বিয়ে করেছে ঠিকই, কিন্তু মন থেকে সুখী হতে পারেনি। গতরাতে তিনি ওদের বেডরুম থেকে ভেসে আসা কথাগুলো শুনেছেন। ডক্টরের চেম্বার থেকে দুজনে ফিরে আসার পর থেকেই কথা কাটাকাটির সূত্রপাত। খুব পরিষ্কার বিষযটা না বুঝলেও এটুকু বুঝেছেন, ডাক্তারবাবু দুজনেরই স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন। হয়তো খতিয়ে দেখতে চান, সুপর্ণার বারবার গর্ভপাত হয়ে যাওয়ার কারণ। গত রাতের ঝগড়ায় অমিত বারবার বলার চেষ্টা করছিল, তার টেস্ট করার প্রয়োজন নেই, কারণ সে নিশ্চিত দোষটা সুপর্ণার শরীরেই। সুপর্ণা এসব শুনে কান্নাকাটি করেছে।

সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে সুপর্ণার মুখ থমথমে দেখে নিরুপমা তাকে কাছে ডাকলেন। বললেন, দুশ্চিন্তা না করতে। তার টেস্টগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করিয়ে নিতে। সুপর্ণা বলে, সে তার এক ডাক্তার বান্ধবীর থেকে একটা সেকেন্ড অপিনিয়ন নিতে চায়। কিছুতেই অমিতকে রাজি করাতে পারছে না তার কাছে যেতে।

নিরুপমার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত সেই ডাক্তার বান্ধবীর চেম্বারে যেতে রাজি হল অমিত। ডাক্তার  পরিষ্কার বললেন টেস্ট-এর রিপোর্ট দেখে, সমস্যাটা সুপর্ণার। তাদের আইভিএফ পদ্ধতির সাহায্য নিতে হবে। অথবা দত্তক। সুপর্ণার মা হওয়া সম্ভব নয় স্বাভাবিক নিয়মে। তিনি একটি বিশেষ ক্লিনিক রেফার করেছেন যেখানে এই আইভিএফ পদ্ধতিতে একবার টেস্ট করে দেখবেন সুপর্ণার মাতৃত্ব সম্ভব করানো যায় কিনা। তবে এক্ষেত্রে সারোগেসির সাহায্য নিতে হবে সুপর্ণাকে। যেটা ওই ক্লিনিক থেকেই ব্যবস্থা করে দেবে। ডাক্তার তার প্যাড-এর পেছনে লিখে দিলেন ওই ক্লিনিকে গিয়ে কার সঙ্গে দেখা করতে হবে তার রেফারেন্স দিয়ে।

(৬)

ক্লিনিকের রিসেপশনে অপেক্ষা করছে সুপর্ণা ও অমিত। কাগজে বহুবার এই ক্লিনিকের বিজ্ঞাপন দেখেছে অমিত। বস্তুত চেন্নাইয়ে এই ক্লিনিকটি একটা শাখা। মূল ক্লিনিকটি কেরলে। সুনাম অর্জন করার পর কেরলের পর এরা শাখা প্রসারিত করেছে চেন্নাইয়ে।

রিসেপশনিস্টকে নিজের কার্ড ও ডক্টরের রেফারেন্স সমেত অমিত জানিয়েছে তারা কার সঙ্গে দেখা করতে চায়। সেইমতো খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর ডাক এল নির্দিষ্ট চেম্বারে। দরজা ঠেলেই ভেতরে ঢুকতে দেখা গেল একটি বছর সাতেকের ছেলেকে চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন এক মহিলা। আগুন্তুকরা দরজা ঠেলে ঢুকছে দেখে মহিলা বাচ্চা ছেলেটিকে তার পাশের চেয়ারটিতে বসতে বলল। এবার চমকানোর পালা অমিতের। চেয়ার ছেড়ে ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে ওই মহিলাও। বিস্ময় কাটিয়ে মহিলা অমিতের উদ্দেশ্যে বলেন, একি অমিত! তুমি এখানে?

অমিতও অবাক। কী বলবে ভেবে পায় না। কোনওরকমে বলে, ইশা তুমি এখানে কী করছ?

আরে এ তো আমাদেরই ক্লিনিক। মানে আমি এবং আমার স্বামী এই ক্লিনিক খুলেছি কেরলে। এটা শাখা অফিস। আমি এটা সামলাই আর ও কেরলেরটা।

হোয়াট আ সারপ্রাইজ!

ইশা নিজে বসে এবং দুজনকেই বসতে ইঙ্গিত করে।

তোমার বউ বুঝি অমিত?

হ্যাঁ, ও হল সুপর্ণা।

বুঝেছি। তোমাদের ডক্টর বান্ধবী আমাকে ফোন করে বলেছে তোমাদের সমস্যাটা। সুপর্ণা একটু অবাক, কীভাবে এরা পরস্পরকে চেনে, সেটা ভেবে। কিন্তু প্রশ্ন করে না। ইশা অমিতের দিকে তাকিয়ে বাচ্চাটিকে দেখে বলে, বাই দ্য ওয়ে এটা আমার ছেলে, ড্যানি। অমিতের আরও একবার অবাক হবার পালা। ড্যানি নামের ছেলেটি হুবহু তার মতোই দেখতে। ঠিক যেমনটি ছিল অমিত ছোটোবেলায। ইশা কথা ঘোরায়। সরাসরি কাজের কথায ঢুকে পড়ে। দশ মিনিট কথা বলার পর ইশা বলে দেয় অমিতকে, কী কী করতে হবে। তারপর বলে, এবার তোমরা এসো। আমায় একটু বেরোতে হবে। অমিত সুপর্ণাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিল। কিন্তু মনে যে খটকাটা থেকেই যাচ্ছে। সে সুপর্ণাকে বাইরে একটু অপেক্ষা করতে বলে, কিছু জিগ্যেস করার আছে ইশাকে, এই অছিলায় আরও একবার ইশার চেম্বারে ঢোকে। ইশা বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অমিতকে ফিরে আসতে দেখে কিন্তু অবাক হয় না। বলে, আমি জানতাম, তোমার প্রশ্ন এখনও শেষ হয়নি।

হ্যাঁ ইশা, সত্যি করে বলো ও কার ছেলে? মানে ওর বাবা কে?

ইশা শুধু তাকিয়ে থাকে অমিতের দিকে। সেই চাহনিতে এমন কিছু ছিল যে অমিত চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হয়। উত্তরটা সে জানে। সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সুপর্ণা অপেক্ষা করছে। সন্তান লাভের আশায় নতুন করে বুক বেঁধেছে সুপর্ণা। একটা অদ্ভুত কান্না গুমরে ওঠে অমিতের মনে। পিতৃত্বের জন্য আজ সে হাহাকার করছে! বড্ড অসহায় আর অসম্পূর্ণ লাগে নিজেকে। সুপর্ণার হাত ধরে রাস্তায় নেমে এসে একটু জোরেই যেন চিৎকার করে, ট্যাক্সি…!

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...