সারাদিনের কাজের ফাঁকে এই বিকেলটুকুই, নন্দিতার মিনিট কুড়ির নিজস্ব সময়। এই সময় সে দক্ষিণের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুলের জট ছাড়িয়ে চুল বাঁধে। কোমর অবধি লম্বা চুল। এই সামান্য পরিচর্যাটুকু তার অনেক দিনের অভ্যাস। বিয়ে হয়েছে মাস দুয়েক। কলকাতা ছেড়ে ধানবাদ চলে আসতে প্রথমে মন চায়নি। কিন্তু সত্যি বলতে কী, তাকে অন্য কোনও বিকল্পও দেওয়া হয়নি।
বাবাকে হারিয়েছে নন্দিতা, মাত্র দশ বছর বয়সে। তার থেকে আট বছরের বড়ো দাদা আর মা-ই তার পৃথিবী ছিল। বাবার পেনশনের টাকায় মা সংসার চালিয়েছে, দাদা যতদিন না নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। দাদা স্বাবলম্বী হওয়ার অনেকদিন পরে বিয়ে করেছে। একটু লেট ম্যারেজ-ই বলা যায়। বউদির সঙ্গে নন্দিতার খুব বেশি বয়সের তফাত নয়। তার বিয়ে, কাগজে বিজ্ঞাপন দেখেই দাদা আর মা মিলে দিয়েছে। সত্যি বলতে কি, বেশি বাছাবাছির অবকাশ ছিল না। সাধারণ পরিবারের মেয়েকে পার করতে বেশি বাছাবাছির বিলাসিতা করা চলে না।
চুলে বিনুনি বাঁধতে বাঁধতে নন্দিতার আজ বড্ড বাপের বাড়ির জন্য মনকেমন করতে লাগল। কেমন আছে তার গল্পের বইগুলো, তার ছাদের পায়রাগুলো, আর বারান্দায় গা ঘেঁষে ওঠা কনকচাঁপা গাছটা! ওই গাছ আর ফুলের গন্ধ খুব মিস করে নন্দিতা। ওই ফুলগুলো সে নিজের হাতে কুড়িয়ে এনে তার পড়ার টেবিলে জড়ো করে রাখত। সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ত ফুলের গন্ধটা। অভ্যেসেই যেন একবার জোরে নাক টেনে বাতাসে সেই গন্ধটাই খোঁজার চেষ্টা করল নন্দিতা। নাহ্ এই ধুলোধুসরিত কোলিযারি শহরে, ফুলের মতো নরম সব অনুভতিগুলোই মরে গেছে তার গত দুমাসে।
খুব অভিমান হল তার মায়ের উপর, দাদার উপর। কেন তারা এরকম একটা সম্বন্ধ দেখে বিয়ে দিয়ে দিল তার। কেন সুখী হতে পারছে না নন্দিতা? সে আর যাই হোক তার নিজের বাড়িতে অসম্ভব আদরের ছিল। যে-দাদার চোখের মণি ছিল নন্দিতা, বিয়ের পর সেই দাদাও যেন বেশি ঝুঁকে পড়ল তার বউয়ের দিকে। নন্দিতার ভালোমন্দ নিয়ে কি সেই জন্যই তেমন বিচলিত হল না দাদা?
বউদিকে কি মনে মনে ঈর্ষা করতে শুরু করেছিল নন্দিতা? তার আদরের জায়গাটা কি ক্রমশ দখল করে ফেলছিল তার বউদি? নতুন বলে বাড়ির সবার থেকে বাড়তি মনোযোগ পেতে শুরু করেছিল কি সে? মা কথায় কথায় বলত, আহা নন্দু ও তো তোরই মতো ছেলেমানুষ। মা-বাবাকে ছেড়ে এখানে এসেছে। আমাদের উচিত ওর বাড়ির ওই অভাবটা ওকে বুঝতে না দেওয়া। কই এমন করে তো এ বাড়িতে কেউ তার কথা ভাবে না!
(২)
ঘড়ির অ্যালার্মটা আবার তারস্বরে বাজছে। ৬টা বাজে বুঝতে পারছিল নন্দিনী কিন্তু ঘুম ভাঙতে চাইছে না। ক্লান্তি আর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে সে। বিরক্ত হয় সঞ্জয়, উঠতে পারো না তো অ্যালার্ম দাও কেন।
সঞ্জয়ের ঝাঁঝিয়ে ওঠার জন্যই ধড়ফড় করে উঠে বসে নন্দিতা। নাইটিটা ঘামে ভিজে তখনও গায়ে সঙ্গে লেপটে আছে। খুব বিরক্ত লাগে নন্দিতার, সঞ্জয়ের উপর। দুমাস হয়েছে বিয়ে বলেই যেন তাকে প্রতিরাতে নিজেকে সঞ্জয়ের ভোগের সামগ্রী হয়ে উঠতে হবে। এটা সঞ্জয়ের একটা অধিকারের মতো। অনেক রাত অবধি সে তার সেই অধিকার ফলায়। তখন তার খেযাল থাকে না নন্দিতাকে সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে, নাহলে কপালে জুটবে ননদ আর শাশুড়ির বাক্যবাণ।
নন্দিতা তাড়াহুড়ো করে ঢুকে যায় বাথরুমে। ফ্রেশ হয়ে বেরোতে বোরোতে প্রায় সাতটা হয়ে গেল। নীচে থেকে কেতকীর গলা ভেসে এল, চা হয়ে গেছে বউদি। কেতকীর মুখ না দেখেও নন্দিতা যেন তার গলার বিরক্তি আর রাগটা বেশ টের পেল। ঠিক তখনই শাশুড়ির গলা ভেসে এল। রেখে দে চা, বউ তো নয় নবাবনন্দিনী!
আর দাঁড়িয়ে থাকা গেল না, সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে এল নন্দিতা। শাশুড়ি আর কেতকী মুখ চাওয়াচাই করল। নন্দিতা টেবিলে রাখা, ঠান্ডা চা-টা কোনওরকমে গলাধঃকরণ করে রান্নাঘরে ঢুকে এল।
এত দেরি কীসের বউমা?
জামাকাপড় কাচতে গিয়ে একটু দেরি হল মা।
তোমাদের বাড়িতে কী নিয়ম জানি না বাপু, আমাদের এখানে স্নান না করে অপরিষ্কার কাপড়ে রান্নাঘরে ঢোকার নিয়ম নেই। শাশুড়ির কড়া কথায় নন্দিতা কিছু না বলে মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। কেতকী আটা চালতে চালতে ফুট কাটে, বউদির বাড়িতে বোধহয় সবাই এরকম কুম্ভকর্ণের মতোই বেলা অবধি ঘুমোয়, তাই না বউদি?
শ্লেষটা গায়ে এসে বিঁধল নন্দিতার। কিন্তু সে রাগটা চেপে নিয়ে বলল, তুমি তৈরি হয়ে নাও ঠাকুরঝি, আমি রুটি করে দিচ্ছি।
কেতকী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আটার থালাটা এগিয়ে দিয়ে সে অফিসের জন্য তৈরি হতে গেল।
কেতকীর ডিভোর্স হয়ে যাওযার পর থেকেই সে এই সংসারে এসে বসেছে। রোজগেরে বলে কেউ তাকে ঘাঁটায় না। সংসার খরচ দেয়, তাই তার মেজাজও বেশি। শ্বশুর মারা যাওযার পর থেকে তার স্বামী সঞ্জয় হোলসেল ব্যাবসাটা চালায়। এ-বাড়িতে শাশুড়ির প্রতাপ অতিমাত্রায় চলে। সঞ্জয় একেবারে মায়ের কথায় ওঠে বসে। মা তাকে প্রথম থেকেই শিখিয়ে রেখেছে, বউ-কে টাইট রাখবি বাবা। সঞ্জয়ও সেই নীতিবাক্য মেনেই চলে। তার ভালো লাগা, খারাপ লাগা এসবের কোনও মূল্যই দেয় না সঞ্জয়।
এ বাড়িতে আরও একজন আছে অবশ্য। সে সঞ্জয়ের ভাই সৌরভ। নন্দিতা আর সৌরভ, বয়সে পিঠোপিঠি। সৌরভ একেবারেই বাড়িছাড়া। সে তার দাদার মতো একেবারেই নয়। ব্যাবসাতেও যে খুব মন আছে তা নয়। একটু খামখেযালি প্রকৃতির। সে বই পড়ে, ছবি আঁকে আর মাঝেমধ্যে অনিচ্ছা সত্ত্বেও দোকান সামলায়। তার সঙ্গে নন্দিনীর একটা আলাদা ইকয়েশন কোথাও যেন কাজ করে, টের পায় নন্দিতা। সেটা হয়তো সৌরভ বোঝে। নন্দিতা একেবারেই আলাদা। সে ঠিক এ-বাড়ির মতো নয়। তাই তার মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও, এ-বাড়ির মতো হয়ে উঠতে পারছে না।
টেবিলে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে সকালের পুরো ঘটনাটাই দেখেছে সৌরভ। নন্দিতা লজ্জায় পড়ে গেছে এত অপমানিত হয়ে তাই সরাসরি চোখ তুলে তাকাতে পারছে না, সে জানে। কেতকী তৈরি হয়ে নেমে আসতে, মা তাকে এক গেলাস গরম দুধ আর খান চারেক বিস্কুট ধরিয়ে দেয়। সে সেটা খেয়ে, মা আসছি বলে দরজার দিকে পা বাড়ায়।
নন্দিতা রান্নাঘরের ভেতর থেকে একটা টিফিনবক্স নিয়ে ছুটে বেরিয়ে আসে, ঠাকুরঝি এটা নিয়ে যাও, এটা নিয়ে যাও। কেতকী যেন ইচ্ছাকৃত ভাবেই তাড়াহুড়ো দেখিয়ে বলে, থাক বউদি, আর দাঁড়ালে চাকরিটা খোয়াব, তখন তোমরাই বলবে ঘাড়ে বসে খাচ্ছি। নন্দিতা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, কিন্তু খুব দেরি তো হয়নি ঠাকুরঝি…। তার কথাকে সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে কেতকী বেরিয়ে যায়। নন্দিতার মুখটা কালো হয়ে যায়। সে জানে এবার শাশুড়িমা তাকে আরও খারাপ কিছু কথা শোনাবেন। তার চোখদুটো ছলছল করে ওঠে।
ব্যাপারটা চোখ এড়ায় না সৌরভের। সে বলে, যাক নিয়ে যখন এসেছ শিগগিরি ওগুলো প্লেটে ঢালো তো বউদি। পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে।
নন্দিতা হেসে ফেলে, বলে দাঁড়াও প্লেট নিয়ে আসি।
তোমার খাবারটাও আনো, একসঙ্গে খাব।
না-না, বাড়ির সবাইকে আগে দিই। তুমি খেয়ে নাও সৌরভ।
শাশুড়িমা ঝাঁঝিয়ে ওঠেন সৌরভকে, তোকে আর আশকারা দিতে হবে না। তুই তোর খাবারটা খেয়ে কী রাজকার্য আছে কর গিয়ে। সৌরভও দমবার পাত্র নয়। বলে, তুমি আর বদলালে না মাম্মি ডার্লিং।
দুপুরে চোখটা একটু লেগে এসেছিল। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় যেন সে গন্ধ পাচ্ছিল, তার ঘরজুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে ওই কনকচাঁপার সৌরভ। কিন্তু গন্ধটা যেন তার চৈতন্যের স্তরের চেয়ে এবার আরও স্পষ্ট। চোখ খোলে নন্দিতা। তার খাটের একদিকে একটা প্লেটের উপর ৬-৭টা কনকচাঁপা ফুল রাখা, আর সামনের চেযারে বসে মিটিমিটি হাসছে সৌরভ।
এ কি এগুলো কোথায় পেলে! বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে বলে ওঠে নন্দিতা।
কেন খারাপ? হাসে সৌরভ।
খারাপ কেন হবে, তুমি জানলে কী করে এগুলো আমার প্রিয় ফুল?
ও মা জানব না? এই দু-মাসে অন্তত সাতাশ বার বলেছ তোমাদের বাড়ির কথা, তোমার নানা প্রিয় জিনিসের কথা, আর তোমাদের বারান্দার পাশের ওই কনকচাঁপা গাছের কথা। আস্ত গাছটা তো আনতে পারতাম না। তাই ফুলগুলোই দেখতে পেয়ে নিয়ে এলাম। আমার বন্ধুর বাড়ির গাছের। সৌরভের মুখের হাসিটা তখনও মেলায়নি। ফুলগুলো দেখে নিমেষে মন ভালো যায় নন্দিনীর। সে থালাটা নাকের কাছে এনে বড়ো করে নিঃশ্বাস টানে। চোখদুটো আবেশে বুজে যায়। এ বাড়িতে এই প্রথম যেন তার একটা নিজস্ব ভালোলাগার জায়গা অনুভব করে। সৌরভ তার দিকে অপলকে চেয়ে আছে। নন্দিতার কেমন অস্বস্তি হয়। ক্ষণিকের জন্য যেন ভালো লাগার আবেশটা দুটো হৃদয়ের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। কিন্তু দুজনেই আবেগের ঢেউটাকে প্রাণপণে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে।
দিন তিনেক পর একদিন সকালে নন্দিতা রান্নাঘরে জলখাবার বানাতে ব্যস্ত। সৌরভ পেছনে এসে চুপিচুপি বলে, বউদি খুব বেশি করে লংকাকুচো দিয়ে ঝাল ঝাল আলুর পরোটা করে দাও তো।
কিন্তু বাড়িতে বাকিরা তো ঝাল খায় না।
তাতে কী? আমারটা স্পেশাল, বলে চোখ টিপে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায় সৌরভ।
খাবার টেবিলে আলুর পরোটা খেতে খেতে প্রশংসা করছিল সৌরভ, উফ বউদি তোমার রান্নার কোনও জবাব নেই!
কেতকী যেন বিরক্ত হয়ে ওঠে, একটা ছুটির দিন একটু আয়েস করে খবরের কাগজ পড়ছি, বড়ো বেশি কথা বলিস তুই ভাই।
শাশুড়িও যেন সইতে পারেন না নন্দিতার প্রশংসা, থাম তুই। আমার রান্না খেয়ে এত বড়ো হলি, আর দুদিনের রাঁধুনির প্রশংসা!
সঞ্জয়ের সব কথাতেই মাকে সাপোর্ট করা অভ্যাস। সে সঙ্গে সঙ্গে বলে, হ্যাঁ মা তোমার হাতের নারকেল চিংড়ি, আর কষা আলুর দম! আজও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার। নন্দিতা মাঝে মাঝে, মায়ের থেকে রান্না করাটা শিখলেই তো পারো।
নন্দিনী অপমানিত হয়, কিছু বলে না। বলে সৌরভ, বউদি এত ভালো পরোটা খাওযালে, এর জন্য তোমার একটা প্রাইজ প্রাপ্য। চলো আজ তোমায় দঙ্গল দেখাতে নিয়ে যাব। বিকেলে তৈরি হয়ে থেকো। সৌরভ কথা বলে বেরিয়ে যায় তখনকার মতো। কিন্তু নন্দিতা লক্ষ্য করে কেতকী ব্যাপারটা ভালো ভাবে নেয় না। সে চোখের আড়াল হওয়া মাত্র, কেতকী সঞ্জয়কে বলে, দাদা বউকে অত ছাড় দিস না। বেশি সুতো ছাড়লে পরে আর গোটাতে পারবি না। ভাই যেন একটু বেশিই বউদির ব্যাপারে…
সঞ্জয় কথাটা শোনে, নন্দিতা এসে পড়ায় কিছু আর বলে না। কিন্তু নন্দিতা টের পায় কেতকীর কথার কিছু একটা প্রভাব সঞ্জয়ের ওপর পড়েছে। সিনেমা দেখে ফিরে আসার পর থেকেই তার মুখ ভার। রাত্রে সেটা আরও বেশি করে টের পায় নন্দিতা। সঞ্জয়ের আদর করার মধ্যে কোনও আবেগ নেই, পাশবিক ভাবটা যেন বেশি। সে ওই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তেও বলে, সিনেমা যাওযার ফূর্তিটা না করলেই চলছিল না? নন্দিতা যেন ভেতর থেকে আড়ষ্ট হয়ে যায়। শরীরে আর কোথাও সে থাকে না। তার মন তখন অনেক দূরে। বড্ড বাড়ির জন্য মনকেমন করে।
সপ্তাহখানেক পর এক সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি বাড়ি ঢোকে সঞ্জয়। এসেই গায়ে ঘামে ভেজা শার্টটা বাথরুমে ছুড়ে দিয়ে টিভির ঘরের মেঝেতে এসে বসে। পাশের ছোট্ট খাটে গা এলিয়ে ছিলেন শাশুড়ি। মায়ের কোলে মাথা রেখে আধশোয়া হয়ে টিভি দেখতে থাকে সঞ্জয়। নন্দিতা আমতা আমতা করে অনুমতি নেবার মতো করে বলে, বলছি বড্ড বাড়ির জন্য মনকেমন করছে, কটা দিন মায়ের কাছে যেতে চাই। একটু পৌঁছে দেবে এই রবিবার?
শাশুড়ি যেন তিরিক্ষে হয়ে উঠলেন, কেন এখানে তোমার আরাম আয়েসটা কম কী হচ্ছে, যে বাপের বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নিতে হবে? সঞ্জয়ও মায়ের পক্ষ নেয়, তুমি চলে গেলে মায়েরও পরিশ্রম বেড়ে যাবে। আমার বিয়ে মা দিয়েছে, যাতে মা একটু বিশ্রাম পায়। নন্দিতা আর কিছু বলে না। রান্নার কাজ শেষ করে।
এরপর তাসের আসর বসল। কেতকী, সঞ্জয় ও মা। রোজই খেলা চলে অনেক রাত পর্যন্ত। সৌরভের তাসের নেশা নেই। সে তার ঘরে ছবি আঁকে বা বই পড়ে। নন্দিতা ওপরে উঠে এল। মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। নন্দিতার বাড়িতে তার বউদিকে এরকম ব্যবহার পেতে সে দ্যাখেনি। বউদি ওখানে মেয়ের মতোই আদর পায়। মা তার আলমারি গুছিয়ে দেয়, জামাকাপড় ইস্ত্রি করে দেয়, নন্দিতারগুলো যেভাবে করে দিত। এতটা তফাত দুটো বাড়ির মানসিকতায়!
নিজেকে প্রশ্ন করে নন্দিতা, আচ্ছা মা কিংবা দাদা যদি জানতে পারে নন্দিতা এতটা কষ্টে আছে, তারা কি তার পাশে দাঁড়াবে না? তারা কি ওকে পর করে দিয়েছে। ভাবতে ভাবতেই চোখে জল চলে আসে নন্দিতার। রোজই সকালে একবার করে মা-কে ফোন করে সে। খোঁজখবর নেয়। কিন্তু তার নিজের কথা বলতে, কোথাও যেন বাধে।
ভাবনার জাল ছিঁড়ে যায় দরজার একটা টোকায়। পরক্ষণে সৌরভ মুখ বাড়িয়ে বলে, কী ম্যাডাম, আসব? নন্দিতা নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলে, কী ব্যাপার, আজ ছবি আঁকতে ইচ্ছে করছে না বুঝি?
এঁকেছি তো। দ্যাখো কেমন হল। একটা ছোট্ট ক্যানভাস এগিয়ে দেয় সৌরভ। নন্দিতার বুঝতে ভুল হয় না ক্যানভাস-এ কার মুখ। সে বলে, এতো দেখছি আমার ছবি! খুব ভালো হয়েছে সৌরভ। তারপর একটু ইতস্তত করে বলে, তুমি এবার একটা বিয়ে করো। মা-কে বলি তোমার জন্য মেয়ে দেখতে!
খেপেছ, বিয়ে করে তোমার যা হাল দেখছি এ বাড়িতে। আবার কাকে নিয়ে আসব তার কপাল পোড়াতে! হা হা করে হেসে ওঠে সৌরভ। খাটের একপাশে সে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। নন্দিতা শিঁটিয়ে খাটের এক কোণায় বসে থাকে। সৌরভ হঠাৎই বলে, তোমার ডায়েরিটা বের করো তো বউদি।
কোন ডায়েরি?
আরে কবিতার ডায়েরি, আবার কোন ডায়েরি?
কী হবে ওসব হাবিজাবি দেখে। লিখিও না কতদিন!
লেখো না বলেই তো বের করতে বলছি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নন্দিতা। সত্যি সে কত বদলে যাচ্ছে। দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এ বাড়িতে আসার পর থেকেই ভুলে গেছে তার একটা নিজস্ব সত্তা ছিল, তার একটা লেখালেখির জগৎ ছিল।
কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে সে লিটল ম্যাগাজিনে রীতিমতো জনপ্রিয় ছিল তার লেখার গুণে। ডায়েরিটা বের করে পরম মমতায় হাত বোলাচ্ছিল পাতায়, সৌরভ কেড়ে নিতে আসে। নন্দিতাও দেবে না আর সৌরভেরও চাই ওটা। এই কাড়াকাড়ি করতে করতে কখন যে তারা খুব কাছে চলে এসেছে পরস্পরের, খেয়ালই করেনি নন্দিতা। হঠাৎই সেই হাসাহাসিকে থামিয়ে দিয়ে সজোরে একটা চড় এসে পড়ে নন্দিতার গালে।
যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠে দেখে সঞ্জয় দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। মুখ গনগনে আগুনের মতো লাল। দরজায় শাশুড়ি ও কেতকী। সবার চোখ তার দিকে। সৌরভও যেন কুঁকড়ে গিয়ে কিছুটা সরে দাঁড়িয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় সে নিজেও অবাক। নন্দিতার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে।
সে এই চূড়ান্ত অপমানটার জন্য তৈরি ছিল না। আজ পর্যন্ত কেউ এভাবে গায়ে হাত তোলেনি তার। সৌরভ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। যাওযার আগে তার দাদার দিকে তাকিয়ে বলে, ছিঃ। আমার লজ্জা হচ্ছে নিজেকে তোর ভাই বলে ভাবতে।
সঞ্জয় চিৎকার করে বলে, যাও, সরে যাও সবাই। নাটক দেখছ নাকি! কেতকী শাশুড়িমাকে নিয়ে সরে যায় দরজা থেকে। সঞ্জয় সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। নন্দিতা জানে, সঞ্জয়ের এর পরের প্রতিক্রিয়া কী হবে। কিন্তু না, আর এই পাশবিকতা সে সহ্য করবে না। বিছানায় মরার মতো পড়ে থাকে নন্দিতা। সঞ্জয় তার শারীরিক পশুবৃত্তি শেষ করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। ভোর হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে নন্দিতা।
(৩)
ট্রেনের কামরায় বসে আজ অনেকদিন পর যেন অনেকটা আকাশ দেখল নন্দিতা। তার যা কিছু সামান্য জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে সে চলে এসেছে। আর একটা চিঠিতে জানিয়ে এসেছে, বরাবরের মতো চলে যাচ্ছে সে বাড়ি ছেড়ে। এই সম্পর্কের বোঝা আর সে টানতে চায় না। সৌরভকেও আর কষ্টে রাখতে চায় না সে। বাড়িতে ফিরে গেলে নিশ্চয়ই তার মা কিংবা দাদা তাড়িয়ে দেবে না তাকে। কিন্তু এভাবে নিজের জীবনটাকে নষ্ট করতে রাজি নয় আর। একটা চাকরির তার ভীষণ দরকার। একটা আত্মনির্ভর জীবন। কারও অঙ্কশাযিনী হওয়াটাই তার নারী জীবনের মোক্ষ নয়। সে বাঁচতে চায় তার নিজের শর্তে।
শিকড়ের টান বড়ো প্রবল। সে জানে ওই বাড়িটা, তার জন্ম ভিটেটা কী ভীষণ ভাবে আজ টানছে তাকে। তাই বইয়ের হলদে পাতাগুলোয় বহুক্ষণ মুখ ডুবিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আর ইচ্ছে করছে ওই কনকচাঁপা গাছটার গায়ে হাত বোলাতে। নাক ভরে গন্ধ নিতে ফুলগুলোর।