ওক পাইন ঘেরা পাহাড়ি আলোছায়ার মাঝে আকাশে আনমনা মেঘ কথা কয়। কুয়াশার আবডালে জেগে থাকে গ্রামগুলি দূরে দূরে। কুমায়ুন হিমালয়। কুমায়ুন মানেই বরফাবৃত পাহাড় ও হিমবাহ। হরিতবর্ণ অরণ্য ও পার্বত্য ঢালে শ্যামল বুগিয়াল। হ্রদ ও ফেনায়িত জলপ্রপাত। পাখপাখালি ও পশুখামার। প্রজাপতি ও ফুল্লকুসুমিত প্রান্তর। মেলা ও উৎসব। পুরাণকথা ও ইতিহাস। এই সমস্ত কিছুই একত্রে উদ্বেলিত হয় কুমায়ুনের প্রায় প্রতিটি শৈলশহরে।

উত্তরাখণ্ডের উত্তরপূর্ব হিমালয়ের অংশটুকু নিয়ে কুমায়ুনের বিস্তার। হিমালয়ের কোলে ৬টি পাহাড়ি জেলা আলমোড়া, বাগেশ্বর, চম্বাবত, নৈনিতাল, পিথোরাগড়, উধম সিং নগর নিয়ে কুমায়ুনের বিস্তৃতি। যেখানে রযেছে একাধিক শৈলশহর, যেমন নৈনিতাল, আলমোড়া, বিনসর, কৌশানি, মুক্তেশ্বর, রামগড়, রানিখেত, মুন্সিয়ারি, চকৌরি, দিনাপানি, বৈজনাথ, ধওলছিনা ইত্যাদি।

 

আলমোড়া:

কাশ্যপ পাহাড়কোলে পাইন, ওকের সরলবর্গীয অরণ্যের মাঝে, কুমায়ুন হিমালয়ের দ্বিতীয বৃহত্তম এবং মহাব্যস্ত বাণিজ্যিক শহর আলমোড়া। ইতিহাসের পাতা উলটে দেখা যায়, অতীতে চাঁদ সাম্রাজের রাজা কল্যাণ চাঁদ-এর হাতে ১৫৬০ সালে গড়ে ওঠে এই ছোট্ট পাহাড়ি রাজ্যটি। ৫৯৪২ ফুট উচ্চতায়, ৭.৬ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে রাজ্যটি চাঁদ সাম্রাজ্যের অধীনে থাকলেও পরে ১৭৮৯ সালে গোর্খা, তারও পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসনের অধিকারে আসে।

লোকশ্রুতি আলমোড়া পাহাড়ি অঞ্চলে এক ধরনের পিঙ্গলবর্ণের ক্ষুদ্র উদ্ভিদ দেখা যায়, যার স্থানীয নাম কিলমোড়া বা ভিলমোড়ি গাছও বলা হয়। সেই কিলমোড়া বা ভিলমোড়ি থেকে পরে আলমোড়া হয়েছে। তবে চাঁদ সাম্রাজ্যের পূর্বে এই অঞ্চলের নাম ছিল রাজপুর। সেই সময়ে রাজা ভীষ্ম চাঁদ অঞ্চলটির নাম পালটে রাখেন আলমনগর। আলমোড়া নামটি সেখান থেকেও আসতে পারে বলে দ্বিমত রয়েছে।

আলমোড়াকে কুমায়ুনের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়। বর্তমানে অত্যাধিক যানজট, ফলত ওয়ান ওয়ে ট্র‌্যাফিক, জনবসতি, দোকানবাজার, হোটেল, জনবহুল শৈলশহর। আলমোড়া থেকে এক্কেবারে খালি চোখে বাধাহীন ভাবে দেখা যায় বরফাবৃত পঞ্চচুল্লি, নন্দাদেবী, নন্দাকোট, ত্রিশূল, চৌখাম্বা ছাড়াও আরও বেশ কিছু দিগন্তব্যাপী হিমশৃঙ্গরাজি। হিমালয়ের কাছে নতজানু হলেই পালটে যায় জীবনবোধ।

travelogue
travelogue

শহরের প্রাচীন ঘড়িমিনারটি ১৮৪২ সালে ব্রিটিশদের দ্বারা নির্মিত। প্রায় ৫ কিলোমিটার প্রশস্ত কিছুটা লম্বাটে আকারের গড়ন শহরটির। শহরের চারপাশ ঘিরে সুউচ্চ পাহাড়। হিন্দু অধ্যুষিত এই অঞ্চলের প্রতিটি পাহাড়চূড়ায় একটি করে মন্দির। স্কন্দপুরাণ মতে সালমেল ও কৌশিকী নদীর মাঝে অবস্থানরত কাশ্যপ পাহাড়ে স্বযং বিষ্ণুর অধিবাস। শহর জুড়ে রযেছে একের পর এক মন্দির। রঘুনাথ মন্দির, মুরলীমনোহর মন্দির, কাঁসারদেবী থান, মহাবীর মন্দির, রত্নেশ্বর মন্দির, বনারীদেবী, পাতালদেবী, ভৈরবীদেবী, ত্রিপুরদেবী মন্দির, নন্দাদেবী মন্দির, চিতাই গোলু মন্দির, কাটরমল সূর্যমন্দির ইত্যাদি অগণিত মন্দির।

আলমোড়া শহরের দশেরা উৎসব, নন্দাদেবী মেলা, ফুলদেই মেলা, হারেলা মেলায় দূর-দূরান্ত থেকে আসেন ভক্তের দল। মেলার প্রাচুর্যে তখন ঝলমলে হয়ে থাকে ছোট্ট শৈলশহরটি। এখানকার বাসিন্দরা মূলত কুমায়ুনি ভাষায় কথা বললেও, পর্যটকদের সঙ্গে কথ্য হিন্দি ভাষায় কথা বলেন।

আলমোড়া শহরের মধ্যেই এক ছোট্ট পাহাড়-টিলার টঙে কুমায়ুন মন্ডল বিকাশ নিগম-এর পর্যটকবাস। কলকাতায় থাকতেই অনলাইন বুকিং-এর মাধ্যমে দুদিনের ঘর স্থির করা ছিল। নীচের সড়ক থেকে হঠাৎই অনেকটা খাড়াই টপকে কেএমভিএন হলিডে হোমের দোরগোড়ায পৌঁছোতে হয়। বযস্কদের পক্ষে এতটা খাড়াই পায়ে হেঁটে উঠে হলিডে হোমে পেঁছোনো বেশ কষ্টকর। ভাগ্যিস আমাদের কাঠগোদাম থেকেই ভাড়াগাড়ি সঙ্গে ছিল। হলিডে হোমের রিসেপশনের মহিলাটি কম্পিউটারে নথিপত্র দেখে আমাদের দোতলার ২০৪ নম্বর ঘরে পাঠিয়ে দিলেন।

সরকারি ব্যবস্থাপত্র বেশ ভালোই। কাচের জানলার ভারী পর্দা সরাতেই নীচে শহর ও দূর পাহাড়ের ঝলক। জিনিসপত্র ঘরে রেখেই সময় নষ্ট না করে চলে গেলাম সিমতোলা ইকো পার্ক। উদয়শংকর সুদীর্ঘকাল সিমতোলা এলাকায় তাঁর নাচের প্রতিষ্ঠান চালিয়েছেন। সেখানে শিক্ষাব্রতী ছিলেন অমলাশংকর, রবিশংকর, জোহরা শেহগল, গুরু দত্ত, রুমা গুহঠাকুরতা এমন কতজন। আলমোড়ার ৩ কিলোমিটার দূরে অশ্বখুরাকৃতি একটি পাহাড়চূড়ায় রযেছে উদযশংকর নামাঙ্কিত এই নাচের স্কুল। পাইন ও দেওদার ছাওয়া মনোরম সিমতোলা এখানকার একটি নামকরা পিকনিক স্পটও।

গুণী ও বিশিষ্টজনদের আনাগোনা ছিল এই শহরে। এখানে বিবেকানন্দ এসে থেকেছেন। এই শহরেই জন্ম বিশিষ্ট স্বতন্ত্রতা সেনানী গোবিন্দবল্লভ পন্থ, রোনাল্ড রস, পিসি যোশী প্রমুখ ব্যক্তিত্বের। এখানে কিছুদিন বসবাস করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অ্যালেন গিন্সবার্গ, জহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধি। ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথ এখানে থেকেই লেখেন শিশু কাব্যগ্রন্থের নয়টি কবিতা। কিছু ছবিও আলমোড়ায় বসে আঁকেন কবি। ক্যান্টনমেন্ট এলাকার একটি পাহাড়চূড়ায় রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য ঔপনিবেশিক এই কুঠি, টেগোর ভবন নামে পরিচিত। স্থানিক দৃশ্যও অসাধারণ। হিমালয়ের নৈসর্গিক শোভা বুঁদ করে রাখে আমাদের মতো সমতলে বসবাসকারী পর্যটকদের।

বাসস্ট্যান্ডের কাছেই অতীতে কাতু্য়রি বংশ ও চাঁদ রাজাদের দুর্গ ছিল। আজ যদিও এখানেই আদালত বসেছে। বিগত আমলের কুমায়ুনি ঐতিহ্য ও শিল্পসংস্কৃতির ধারক একটি অসাধারণ সংগ্রহশালা হল ১৯৮০ সালে পুনর্নির্মিত গোবিন্দ বল্লভ পন্থ পাবলিক মিউজিয়াম। এখানে কতু্য়রি ও চাঁদ সাম্রাজ্যের নানান চারুকলার নিদর্শন রযেছে। এগুলির মধ্যে দুর্লভ শিল্পকৃতি, কাষ্ঠ শিল্পকলা ও ভাস্কর্য, কুমায়ুনি ঐতিহ্যবাহী আইপেন যেটি মূলত জ্যামিতিক ডিজাইনে দেবদেবীর মূর্তি ও প্রাকৃতিক সামগ্রীর উপাদান এইসব শিল্পকলা সযত্নে রক্ষিত রয়েছে। সাধেই কী আর কুমায়ুনের সাংস্কৃতিক পীঠস্থান বলা হয় আলমোড়া শৈলশহরকে। আলমোড়ার তামতা বা তামার বাসনকোশনের খ্যাতি আছে। আঙ্গোরা খরগোশের লোম থেকে প্রস্তুত আঙ্গোরা বস্ত্র এখানকার উল্লেখযোগ্য বস্ত্রসম্ভার।

আলমোড়া মূল শহর থেকে ২ কিলোমিটার দূরে দ্য ব্রাইট এন্ড কর্ণার যা এখন বিবেকানন্দ কর্ণার নামেই সমধিক পরিচিত। সড়কপথ থেকে ১৪৬ টি সোপান নেমে ১৯১৬ সালে স্বামী তূরীয়ানন্দ মহারাজ প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম। স্বামী বিবেকানন্দের কিছু দিন বসবাসের স্মারক এখানকার ওকলে হাউস। এখানেই স্বামীজি ভগিনী নিবেদিতাকে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষাদান করেছিলেন। এক অনির্বচনীয শান্তি এখানকার প্রতিটি কোণায় কোণায়।

ব্রাইট এন্ড কর্ণার ভিউপয়েন্ট থেকে তুষারাচ্ছাদিত হিমালয়ের অনাবিল দৃশ্য স্রেফ টুকে রাখার মতো। মেঘের উপদ্রব না থাকলে পঞ্চচুল্লি, নন্দাদেব্‌ নন্দাকোট, ত্রিশূ্‌ চৌখাম্বা ও অন্যান্য শিখরসমূহ এক্কেবারে চোখের আঙিনায। দূর পাহাড়ের কোলে আকাশ জুড়ে মারকাটারি রঙের খেলা দেখিয়ে সূর্যদয় ও সূর্যাস্তের উদয়-অস্ত শোভা অতুলনীয়।

আলমোড়ার মেথোডিস্ট চার্চটি ম্যালের উত্তরদিকের শেষ প্রান্তে। ১৮৯৭ সালে নির্মিত পাথরে স্থাপিত চার্চটি রেভারেন্ট বার্ডেন, যিনি কুমায়ুন অঞ্চলে ৪০ বছর ধর্মপ্রবর্তক ছিলেন, তাঁর স্মরণে। রাজা উদ্যোত্ চাঁদ আলমোড়ায় অনেকগুলি হিন্দুমন্দির স্থাপন করেন। যেমন ত্রিপুরসুন্দরী মন্দির, চন্দেশ্বর মন্দির, পর্বতেশ্বর মন্দির। পর্বতেশ্বর মন্দিরটিই বর্তমানে নন্দাদেবী মন্দির নামে পরিচিত। মূল শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে কতু্য়রি কাটরমাল্লা নির্মিত ২১১৬ মিটার উচ্চ সূর্যমন্দিরের স্থাপত্যও দেখার মতো। কাঠের খোদাই করা তোরণ, কপাট অপূর্ব সৃষ্টি নৈপুণ্যের দাবি রাখে।

হোটেলে ফিরতি পথে গেলাম ২০০ বছরের প্রাচীন লালাবাজার। আদপে এটি একটি পথের পাশের বিখ্যাত বাজার। সবসময় ভিড়ে ঠাসা। এখানে যোগলাল শাহ শপ থেকে আলমোড়ার বিখ্যাত বাল মিঠাই অল্প পরিমাণে কেনা হল। ৩০০ টাকা কেজি। তবে অত্যাধিক মিষ্টি। যদিও আমাদের যাওয়া হয়ে ওঠেনি, ৪ কিলোমিটার দূরে কারকানৌলি ও ফুলসীমা। এখানে প্রাচীন রক পেন্টিং দেখার মতো।

১৮ কিলোমিটার দূরে বড়েচিন্না গ্রামে লাখুদিয়ার একটি অত্যন্ত দ্রষ্টব্যস্থান। লাখুদিয়ার শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল এক লাখ গুহা। এখানে সুয়াল নদীর ধারে শতাব্দীপ্রাচীন গুহাকন্দর আছে। প্রস্তরযুগে নির্মিত এই অঞ্চলে গুহাচিত্রগুলি নাকি অসাধারণ। আগামীকাল যাব বিনসর, ওখানেই এক রাত থাকা। আলমোড়ার মায়াময় সৌন্দর্যে কেটে যায় ভালো লাগায় বিভোর দুটি দিন।

 

বিনসর:

বিনসরকে কুমায়ুনবাসীরা বলেন ঝান্ডিধার। পর্যটকমহলে অবশ্য স্থানটি বিনসর নামেই পরিচিত। আলমোড়া থেকে ৩১ কিলোমিটার দূরবর্তী ৭৯৩৯ ফুট উচ্চতায় প্রত্যন্ত এলাকা বিনসর। নিরেট পাইনের জঙ্গল নিয়ে অভয়ারণ্যে ঢোকার কিছুটা পর থেকেই দেখি কিছু গাছের মাথা কেমন লালে লাল। ওগুলো রডোডেনড্রন গাছ। যত ওপরে উঠি লাল রডোডেন্ড্রনের বাহার। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিযে চলার পথটি বেশ রোমাঞ্চকর। সেখানে হিমালয়ের হরেক অচিন পাখিদের ওড়াওড়ি। নিস্তব্ধতা এখানে প্রকৃতির অলংকার।

আলমোড়া থেকে বিনসর যাওয়ার পথে আমাদের গাড়ি এসে থামল একটি মন্দিরের সামনে। মন্দিরে ওঠার প্রধান প্রবেশদ্বারে একটি বিশাল ঘণ্টা। পুরো মন্দিরচত্বর লাল ফিতে বাঁধা ছোটো, বড়ো, মাঝারি ঘন্টায় ছয়লাপ। ঘন্টার সঙ্গে চিরকুটে বাঁধা ইচ্ছাপূরণের আর্তি ও প্রার্থনা। রযেছে বিবিধ স্ট্যাম্পপেপার লটকানো। কুমায়ুনের অত্যন্ত জাগ্রত চিতোই গোলু মন্দির এটি। ন্যায় বিচারের দেবতা। কুমায়ুনিদের বিশ্বাস সংসারে যখন ন্যায় ভেঙে পড়ে তখন গোলু মন্দিরের চাতালে বা গাছে মনস্কামনা জানিয়ে চিঠি বেঁধে রাখলে সুবিচার পাওয়া যায়। এই পথেই কাঁসারদেবীর মন্দির। স্বামী বিবেকানন্দ এখানে থেকেই অনুভব করেন তাঁর আধ্যাত্মিক জীবন মানুষের সেবায় নিযোজিত করা কর্তব্য।

যে-গুহায় স্বামীজি ধ্যান ও আধ্যাত্মসাধনা করেছিলেন, সেটি বর্তমানে উত্তরাখণ্ড সরকার সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। প্রচুর বিদেশি পর্যটক এখানে নিপুণ প্রকৃতি সান্নিধ্যে আসেন।

আলমোড়া থেকে দিনাপানি ছুঁয়ে বিনসর যাওয়ার পথটি অসামান্য সৌন্দর্যের দাবি রাখে। কাপরখান নামের জনপদ থেকে পথটি দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। উত্তরমুখী পথটি চলে গেছে সরযু ও গোমতী নদী সঙ্গমে পবিত্র শৈবতীর্থ বাগেশ্বরের দিকে। ডাইনের পথটি পাহাড় বেয়ে বিনসর অভয়ারণ্যের দিকে। দিনাপানি থেকে ঝান্ডিধার-বিনসর স্যাংচুয়ারি গেট পর্যন্ত, সমস্ত পথটুকুই পাইনে ছাওয়া। বিনসর অভয়ারণ্যের প্রবেশদ্বার থেকে আরও ১১ কিলোমিটার জঙ্গলঘেরা পথে সন্তর্পণে গাড়ি চলে এল। আমরা উশখুশ করছিলাম কিছু বন্যপ্রাণী অন্তত চোখে পড়বে। এই অরণ্যে উল্লেখযোগ্য প্রাণী হল চিতা, বন্য শুয়োর, কালো ভল্লুক, বার্কিং ডিয়ার, বনবিড়াল, বাঁদর, হনুমান। কিন্তু কোথায কী! কিচ্ছুটি নজরে এল না।

কুমায়ুন বিকাশ নিগমের,বিনসর টু্রিস্ট রেস্ট হাউস আমাদের রাত্রিবাসের ঠিকানা। এই অঞ্চলের একমাত্র পর্যটক আবাস। এই সরকারি পর্যটক আবাসে থাকতে না পারলে কিন্তু বিনসর ভ্রমণের মজাটাই খানিক বিফল। নির্জন অরণ্য, নিঃশব্দ প্রকৃতি, জঙ্গল পথে অজস্র রডোডেনড্রন। প্রবেশমাত্রই রডোডেনড্রন ফুলের নির‌্যাস দিযে তৈরি স্বাগত পানীয দিযে আপ্যাযনপর্ব। লাল টালির রঙে ওপরটা, সাদা দোতলা  বিল্ডিং। পুরো পরিসরটাই ফুলের সমাহার, লতাগুল্ম দিযে সুন্দর ভাবে সাজানোগোছানো। আপাদমস্তক শান্ত একটি সুসজ্জিত বসতবাড়ি। ওপাশে সাদা চাদরে ঢাকা আদিগন্ত হিমালয়। এখানকার পর্যটক আবাসে বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই। জেনারেটর সহযোগে আলো জ্বলে সন্ধ্যা ৬ থেকে রাত ৯ পর্যন্ত। দু-হাত প্রসারিত করলেই যেন হিমালয়ের ওই বিশাল বৈভবকে ছুঁয়ে ফেলা যাবে। বাউন্ডুলে শহুরে মন আর দিগন্ত বিস্তৃত হিমালয়, সামযিক দূরে সরিযে রাখে দৈনন্দিন জীবনের আটপৌরে পরাজয়গুলোকে।

একটা অদ্ভুত মনোরম জায়গা এখানে সূর্যোদয় দেখার। সেটা হল এই আবাসের ছাদ। পাথরে বাঁধানো দারুণ পথ চলে গেছে ছাদের কাছ পর্যন্ত। এখান থেকে চোখের নাগালেই ধরা দেয ৩৫০ কিলোমিটার বিস্তারিত বরফশৃঙ্গগুলি নন্দাঘুটি, নন্দাকোট, ত্রিশূল, মৃগথুনি, নন্দাদেবী, পঞ্চচুল্লি এমনকী নেপাল হিমালয়ের কযেটি শৃঙ্গও দৃশ্যমান। ছাদে বসেই কেটে যাবে সময়ের অনেকখানি। এখানেই আমাদের বেড-টি দেওয়া হল সূর্যোদয় দেখার সময়। তাহলে আর কী? জমাটি ঠান্ডায় হাতে-গরম চায়ের কাপ নিয়ে অর্ক দেবের বিচ্ছুরণ-দৃশ্য, মনের ঝাঁপিকে সমৃদ্ধ করে নিল আগামী দিনের জন্য।

সবুজে সবুজ প্রাচীন গাছেদের মধ্যে দিযে এবড়োখেবড়ো পথে হাঁটতে বড়ো ভালো লাগে। জিরো পয়েন্ট এর পথ, যেটা নজরমিনার পর্যন্ত গেছে, বেশ গা ছমছমে। আলোছায়া মেশানো এ পথের নির্জনতাই একমাত্র সম্বল। সন্ধ্যায় পাহাড়মুখী ছাদে বসে চা পান করতে করতে কত যে দার্শনিকতা মন ভারাক্রান্ত করে। পাশের জঙ্গল-পাহাড়গুলি হয়ে ওঠে তখন জোনাকিময়। আঁধারে প্রকৃতির কাছে একলা বসে থেকে কত সুখ-দুঃখের কথা মনে মনে আওড়াই।

 

কৌশানি:

কুমায়ুনের আরও এক নিরিবিলি জনপদ ৬২০০ ফুট উচ্চতায় পাইন, ওক, ফারে ছাওয়া শৈলশহর কৌশানি। সেই সঙ্গে দেওদার, রডোডেনড্রন, বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাস ও রঙবাহারি বুনো ফুলের মেলা। কথিত আছে এই স্থানে কৌশাম্বি ঋষি তপস্যা করেছিলেন, তাই এই পাহাড়ি জনপদের নাম কৌশানি।

অনুকূল আবহাওয়ায এখান থেকে ৩৬০ ডিগ্রি দৃশ্যময়তায় চোখে পড়ে উত্তর দিগন্তে তুষারধবল গিরিশৃঙ্গ চৌখাম্বা, কামেট, নন্দাদেবী, নন্দাঘুন্টি, ত্রিশূল, মৃগথুনি, নন্দাকোট, পঞ্চচুল্লি। সারা দিনমান এইসব শৃঙ্গে রং বদলের খেলা চলে। যেমন এখানকার সূর্যোদয় দৃশ্য, তেমনি সূর্যাস্ত। আঁক কেটে যায় পাহাড়ি বন্য ফুল, ফার্ন, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, দূরের উপত্যকা, শ্রুতিকথন, পৌরাণিক কাহিনি, মনোরম পাহাড়ি শোভা।

আমরা এখানে কুমায়ুন মণ্ডল বিকাশ নিগমের পর্যটক আবাস কটেজ ৫-এ আছি। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সুন্দর সব কটেজ। কটেজে ঢুকেই একটা এক শয্যাঘর ও ঘরের আগাপাশতলা কাচের জানলা। ওপারেই আদিগন্ত হিমালয় ও নীচে গরুড় উপত্যকা। ভেতরে দ্বিশয্যা বিশাল ঘর, ছোটো সাজঘর, বেশ বড়ো স্নানাগার। কটেজে বসেই সামনের পাহাড়শ্রেণি ও গরুড় উপত্যকার দৃশ্য দুর্দান্ত দেখাচ্ছে।

বিকেলে গেলাম কৌশানির বিখ্যাত অনাশক্তি আশ্রম। লাল রঙের একটি লম্বাটে ঘর। সামনে গান্ধিজির পূর্ণাবযব মূর্তি। রযেছে বহুল পরিচিত তিন বাঁদর মূর্তিও। ১৯২৯ সালে মহাত্মা গান্ধী এখানে দুই সপ্তাহ কাটান এবং এখানে বসেই অনাশক্তি যোগ নিয়ে নিবন্ধ লেখেন। প্রতিষ্ঠিত হয় অনাশক্তি আশ্রম, যেটি গান্ধি আশ্রম নামেও পরিচিত। সামনে পাহাড়মুখী দুটি সিমেন্টের বসার জায়গা। এখানকার সংগ্রহশালায় গান্ধিজি ব্যাবহৃত চরকা, চিঠিপত্র, পুস্তক ও প্রচুর ছবি রয়েছে। কয়েকধাপ সিঁড়ি উঠে হিমালয় দর্শন নামে একটি মঞ্চ। পাশেই বিদেশিনী ক্যাথারিন হিলম্যান অর্থাৎ গান্ধিজির প্রিয় শিষ্যা সরলাবেন, ১৯৬৪ সালে একটি আশ্রম নির্মাণ করেন। অনুন্নত মেয়েদের জন্য স্কুল ও স্বাবলম্বী হওয়ার হস্তশিল্পকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন।

অদূরেই রযেছে একটি ইকো পার্ক। একটু উতরাই পথে নেমে কৌশানি চৌরাহা ও বাজার এলাকা। একটি ফুটপাথের দোকানে চা ও ম্যাগি সহযোগে বিকেলের জলখাবার সেরে একটু আরও চড়াই উঠে এলাম কৌশানি খাদিভাণ্ডার। মোমের সুগন্ধি সামগ্রী এইসব অঞ্চলে খুব বিখ্যাত। বিভিন্ন হস্তশিল্প সামগ্রী ও শীতবস্ত্র পাওয়া যায়। সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে এসেছে। পাহাড়ি এলাকায় সন্ধ্যা নামে তাড়াতাড়ি। কটেজে ফিরে আসি কেনাকাটা করে। রাত বাড়ে কৌশানির নিভৃত চরাচরে।

ভোর-সকালে কৌশানির সূর্যোদয় মন ভরিযে দিল। প্রাতরাশ সাঙ্গ করে চললাম, মূল বাজারের কাছেই প্রখ্যাত হিন্দি কবি সুমিত্রানন্দন পন্থের জন্মভিটে ও তাঁর নামে গড়ে তোলা সংগ্রহশালা দেখতে। একটি পুরাতন কুমায়ুনি বসতবাড়ি। এখানে রক্ষিত হাজারের ওপর হিন্দি ও ইংরাজি বইয়ের সংগ্রহ ঈর্ষা করার মতো। মলিন সৌধফলকে কবির লেখা পংক্তি উদ্ধৃত রয়েছে। প্রতিবছর ২০ মে এখানে কবিদের আলোচনাসভা বসে।

কৌশানি চা-বাগিচাটিও দেখার মতো। জাযগাটার নাম পিংলাকোট। কৌশানি মূল শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে। বাগানের প্রবেশপথের উলটোদিকেই উত্তরাঞ্চল টি স্টোর অ্যান্ড ন্যাচারাল অর্গ্যানিক প্রোডাক্টের দোকান। বিভিন্ন মানের গিরিয়াস চা পাতার সম্ভার এখানে। বাড়ির জন্য কিনে নিলাম এখানকার গ্রিন টি, সাদা মধু, অর্গ্যানিক হলুদ, হার্বস। এছাড়াও পাওয়া যাচ্ছিল হরেক ধরনের আচার, জ্যাম, জেলি, ভেষজ মশলা, আযুর্বেদিক তেল ইত্যাদি।

শহরের ৫ কিমি দূরে পিনাট ও বুদা-পিনাট নামে আরও দুটি চা বাগান আছে। মার্চের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চা-বাগান খোলা থাকে। শহর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে দেওদার, পাইনে ঘেরা পথে রুদ্রধারী শিবমন্দির। স্থানীয়দের বিশ্বাস এইখানেই ছিল কৌশাম্বি মুনির তপস্যাক্ষেত্র।

গোটা কুমায়ুন অঞ্চলটাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর। প্রায় প্রতিটি জায়গা থেকেই হিমালয় দেখা যায়। পাহাড় আমাদের নতমস্তক হতে শেখায়। হিমালয়ের তুষারধবল শৃঙ্গগুলির রমনীয দৃশ্য কৌশানিকে সেরা করে রেখেছে। মুগ্ধতার চূড়ান্ত অধিকারটুকু অচিরেই কেড়ে নেবে কুমায়ুনের হৃদয় উদ্যত কৌশানি-আলমোড়া-বিনসর। বেবাক আমি, সফরনামা খুলে শুধু দুই হাত পেতে বসে থাকি। বেশ টের পাই, ঋণী হয়ে পড়ছি রূপসি কুমায়ুনের কাছে।

 

কীভাবে যাবেন: রেলপথ ও সড়কপথে কুমায়ুন হিমালয়ের প্রধান প্রবেশপথ কাঠগুদাম। সেখান থেকে স্থানীয বাসের ভরসা না করে, আলমোড়া বা কৌশানি বা বিনসর গাড়ি ভাড়া করে চলে আসা যায়। পর্যটন মরশুমে গাড়ি ভাড়া দরদাম চলে।

কখন যাবেন:  সারা বছরের জন্যই সুন্দর। তবে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি যথেষ্ট শীত পোশাক থাকা জরুরি। গ্রীষ্মে আর শরতে মনোরম তাপমাত্রা। তবে সন্ধ্যার পর তাপমাত্রা কমতে শুরু করে।

কোথায থাকবেন:  কুমায়ুন মন্ডল বিকাশ নিগমের পর্যটক আবাসগুলি সবচেযে স্থানিক আকর্ষণীয় জায়গায়। অনলাইনের মাধ্যমে বুক করে নেওয়া যায়। এছাড়াও আলমোড়া ও কৌশানি অঞ্চলে প্রচুর হোটেল, রির্সট, রিট্রিট আছে। বিনসরে জঙ্গলের ভেতর শুধুমাত্র কেএমভিএন-এর সরকারি আবাস আছে। ইকো বিনসর নামের জায়গাটি অরণ্যের বাইরে।

কেনাকাটা: উলের শীতবস্ত্র, ভেষজ মধু, চা পাতা, ভেষজ মশলা, রডোডেনড্রন ফুলের নির্যাস দিয়ে প্রস্তুত শরবত, নানান ধরনের আচার, সুগন্ধি মোমবাতি, মোমের গিফট আইটেম, আযুর্বেদিক তেল ইত্যাদি। এছাড়াও আলমোড়ায় প্রসিদ্ধ বাল মিঠাই ইত্যাদি কেনা যেতে পারে।

 

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...