এখন বেপরোয়া জীবনযাপন মানেই জীবনহানির আশঙ্কা প্রবল। কারণ, এই অতিমারীর আবহে, সামগ্রিক জীবনধারণ পদ্ধতিটাই বদলে গেছে। তাই, প্রচলিত স্বাস্থ্যবিধির পাশাপাশি, বিশেষ কিছু নিয়মকানুন মেনে চলা আবশ্যক হয়ে উঠেছে। সতর্ক থেকে সামগ্রিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে, শারীরিক এবং মানসিক ভাবে নিজেকে যত বেশি সুস্থ রাখতে পারবেন, আখেরে লাভ আপনারই। কারণ, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গেলে, টীকা নেওয়ার পরও সুরক্ষার স্বাস্থ্যবিধিগুলি এড়িয়ে চললে বিপদ আছে৷এই রোগের কবল থেকে সুস্থ থাকা এখন অত্যন্ত জরুরি। ডা. দিব্যেন্দু মুখোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিলেন।

এই অতিমারীর আবহে, একেবারে প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে চিকিত্সক হিসাবে কী পরামর্শ দেবেন আপনি?

ছোটোবেলা থেকে আমরা যা শিখে এসেছি, সেইসঙ্গে আর সামান্য কিছু নিয়ম মানলেই, প্রাথমিক দাযিত্ব পূরণ করতে পারবেন। অর্থাত্, বাইরে থেকে এসে হাত-পা-মুখ যেমন সাবান দিয়ে ধুতেন, তেমনই ধোবেন। আর সেইসঙ্গে, বাইরে বেরোলেই মুখে ত্রিস্তরীয় মাস্ক পরবেন এবং বাড়ি ফিরে সেই মাস্ক ও পরনের পোশাক সাবান দিয়ে ধুয়ে কড়া রোদে শুকিয়ে নেবেন। আর রোদ না থাকলে মাস্ক এবং জামাকাপড় গরম জলে সাবান সহযোগে ধুয়ে নেবেন অথবা শুকিয়ে যাওয়ার পর প্রেস (আয়রন) করে নেবেন। সেইসঙ্গে মনে রাখবেন, অন্তত কুড়ি সেকেন্ড হাতে সাবান রেখে হাত ধোবেন, রাস্তায় বেরোলে চোখে-মুখে হাত ছোঁয়াবেন না এবং হাতে ভালোমানের ব্র‌্যান্ডেড স্যানিটাইজার ব্যবহার করবেন। আর বাড়ি কিংবা অফিসে দরজা-জানলার হাতল, সিঁড়ির রেলিং, টিভির রিমোট, কম্পিউটার কী-বোর্ড প্রভতি অবশ্যই স্যানিটাইজ করবেন।

 এখন অনেককেই কর্মক্ষেত্রে যেতে হচ্ছে এবং অফিস-এর কমন টয়লেট ব্যবহার করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে কী ধরনের সাবধানতা বজায় রাখা জরুরি?

পুরুষরা ইউরিনাল ব্যবহারের আগে জীবাণুনাশক তরল ঢেলে নেবেন অবশ্যই এবং মহিলারা কমোড ব্যবহারের আগে জীবাণুনাশক তরল তো ঢালবেনই, সেইসঙ্গে, সিট কভার-এর উপর স্যানিটেশন স্প্রে ব্যবহার করবেন। ওষুধের দোকানে পাওয়া যায় এই স্যানিটেশন স্প্রে। সম্ভব হলে বড়ো ওষুধের দোকান থেকে শি-পি কিনেও ব্যবহার করতে পারেন মহিলারা। এই উপকরণটি ব্যবহার করলে মহিলারাও দাঁড়ানো অবস্থায় মূত্রত্যাগ করতে পারবেন। বিদেশের মতো আমাদের দেশেও এই উপকরণটির ব্যবহার বাড়ছে। আর সবসময় টয়লেট ব্যবহারের পর, অবশ্যই সাবান দিয়ে হাত ধোবেন। কারণ, শৌচালয়ে দরজার হাতলে, করোনা ছাড়াও থাকতে পারে অন্য ভাইরাস।

বাইরের থেকে বাড়ি ফিরে ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং নিজেকে কীভাবে জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে?

প্রথমে বাড়ির বাইরে জুতো খুলে রাখুন। তারপর জুতোর উপর-নীচে ভালো ভাবে স্যানিটেশন স্প্রে ব্যবহার করে, নির্দিষ্ট জায়গায় তুলে রাখুন। বাড়ির চাবি, গাড়ির চাবি, চশমা এবং ছাতা লিকুইড সাবানজলে ভালো ভাবে ধুয়ে শুকিয়ে নিন। ঘড়ি এখন না পরাই ভালো। আর যদি পরেন তাহলে কিছুটা তুলোয় বা শুকনো কাপড়ে স্যানিটেশন স্প্রে নিয়ে ঘড়ি মুছে নিন। মোবাইলের ক্ষেত্রে ক্যামেরার লেন্সটুকু বাদ দিয়ে ঘড়ির মতো একই ভাবে স্যানিটাইজ করে নিন। ব্যাগ-এ স্প্রে করুন স্যানিটাইজার। সাবান দিয়ে কেচে নিন ব্যবহৃত পোশাক। স্নান করুন সাবান মেখে। সম্ভব হলে হালকা গরম জলে মাথায় শ্যাম্পু করুন।

শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে কী কী করণীয়?

দেখুন, আমাদের দেশে যেভাবে বাসে-ট্রামে যাতায়াত করতে হয়, সে ক্ষেত্রে বাস্তবিক ভাবে শারীরিক দূরত্ব খুব বেশি বজায় রাখা যায় না অনেক সময়। তাই, অফিস কিংবা বাড়িতে ঢুকে নিজেকে স্যানিটাইজ করে নেওয়াই প্রধান উপায়। তবে সতর্ক থাকতে হবে যতটা সম্ভব। হাঁচি-কাশি হচ্ছে, এমন ব্যক্তির থেকে দূরে থাকতে হবে। হোটেল, রেস্তোরাঁ, সেলুন, শপিং মল প্রভতি জায়গায় এখন না যাওয়াই ভালো। গণপরিবহন মাধ্যমকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলাই ভালো। আর তা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে যানবাহনে বসার জায়গায় স্যানিটেশন স্প্রে ব্যবহার করে বসুন এবং নেমে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত রাখুন। কারও সঙ্গে কথা বলার সময় অন্তত ছফুট দূরত্ব বজায় রাখুন। অফিসেও অন্যের থেকে একই ভাবে দূরত্ব রেখে বসুন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে অন্যের মুখোমুখি বসে দীর্ঘসময় কাটাবেন না।health awareness

সাধারণ স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে উপযোগী আর কী কী মেনে চলা উচিত?

কফ, থুতু, পানের পিক প্রভতিতে পা ফেলবেন না। ধূমপান, মদ্যপান কিংবা অন্য কোনও মাদকদ্রব্য গ্রহণ কঠোর ভাবে বন্ধ রাখুন। বাইরের খাদ্য এবং পানীয় এড়িয়ে চলুন। পরিবর্তে, বাড়ির খাবার খান। বাড়িতে এবং অফিসে নিজের খাবার এবং জলপানের পাত্র আলাদা রাখুন। জলের বোতলের বাইরের অংশ সাবানজলে ধুয়ে ব্যবহার করুন। পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট জলে মিশিয়ে শাকসবজি, ফলমূল ধুয়ে নিন অথবা কিছুক্ষণ রোদে রেখে তারপর রান্না করুন অথবা খান। লন্ড্রি থেকে আনা জামাকাপড় অন্তত দুদিন রেখে ব্যবহার করুন। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে অবশ্যই টাটকা শাকসবজি এবং ফল খান। প্রোটিনও যেন থাকে খাদ্য-তালিকায়। আর শরীরচর্চা করতে ভুলবেন না।

মাথার চুল এবং হাতপায়ে নখ কীভাবে জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে?

মাথার চুল জীবাণুমুক্ত রাখতে হলে বাইরে বেরোনোর আগে সার্জিক্যাল হেয়ার-ক্যাপ ব্যবহার করুন এবং বাড়ি ফিরে হালকা গরমজলে শ্যাম্পু করে নিন। আর হাত ও পায়ে নখ কেটে পরিষ্কার রাখুন সবসময় এবং মাঝেমধ্যে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন।

মুখগহ্বরের স্বাস্থ্যরক্ষার উপায় কী?

সামান্য সুযোগ পেলেই মুখের ভিতরে ব্যাক্টেরিয়া বাসা বাঁধে। মুখগহ্বরে সঠিকমাত্রায় লালারস ক্ষরিত হলে, মুখে বাস করা ব্যাক্টেরিয়া অনেকটাই ধ্বংস হয়।

কিন্তু অতিরিক্তি ধূমপান ও মদ্যপান করলে এবং নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ সেবন করলে, মুখের ভিতরে লালাক্ষরণ কমতে থাকে। তাই, সমস্যা সৃষ্টিকারী এইসব উপাদান পরিত্যাগ করতে হবে। সেইসঙ্গে, মুখগহ্বরে যাতে কোনও জীবাণুর সংক্রমণ না ঘটে, তার জন্য প্রতিদিন সকালে এবং রাতে খাওয়ার পর অবশ্যই ভালোমানের টুথব্রাশ ও টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মাজতে হবে। আর সম্ভব হলে মাঝেমধ্যে মাউথওয়াশ দিয়ে এবং হালকা গরম জলে গার্গল করতে হবে। এছাড়া, কোনও ভাবেই হাতের অপরিষ্কার আঙুল মুখে ঢুকিয়ে দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা খাবার বের করবেন না এবং দাঁত দিয়ে নখ কাটবেন না। দাঁতে আটকে থাকা খাবার বের করার জন্য পরিষ্কার টুথব্রাশ ব্যবহার করুন।

শারীরিক মেলামেশার ক্ষেত্রে কী কী বিধিনিষেধ মানা উচিত?

এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ, স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বসবাস করলে, দীর্ঘদিন শারীরিক সম্পর্ক বন্ধ রাখা প্রায় অসম্ভব। তাই এই করোনার আবহে যতটা সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। স্বামী-স্ত্রী দুজনে সাবান দিয়ে সম্পূর্ণ স্নান করে তারপর শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন। সেইসঙ্গে, কন্ডোম অবশ্যই ব্যবহার করবেন এবং শারীরিক মিলনের পর অবশ্যই নিজেদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখবেন।

গর্ভবতী মহিলাদের কী করণীয়?

তাকেও একই ভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং বাড়তি গুরুত্ব হিসাবে, তাকে নির্দিষ্ট গাইনিকোলজিস্ট-এর পরামর্শ মেনে চলতে হবে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...