অনেকেই হয়তো ‘সোরিয়াসিস’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নন। অবশ্য পরিচিতি না থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ, এটি চিকিৎসা পরিভাষা। আসলে, সোরিয়াসিস হল এক ধরনের চর্মরোগ। সাধারণ ভাবে পুরুষদের তুলনায় এই রোগ বেশি হয় মেয়েদের। তবে রোগটি সাধারণ হলেও, এর ব্যাপক কুপ্রভাব পড়তে পারে শরীরে এবং মনে। তাই, সতর্কতা জরুরি। ডা. অভিষেক দে রোগটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানালেন সম্প্রতি।
সোরিয়াসিসে আক্রান্ত হওয়ার কারণ কী?
একমাত্র বংশগত কারণ ছাড়া, সোরিয়াসিস রোগের নির্দিষ্ট কোনও কারণ নির্ণয় করা দুরূহ। তবে এটি ত্বকের প্রদাহজনিত একটি রোগ। কোশ বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেলে এই রোগ হয়।
সোরিয়াসিস-এ আক্রান্ত হলে বোঝা যাবে কীভাবে?
সোরিয়াসিস-এ আক্রান্ত হলে দেহের বিভিন্ন অংশ যেমন– হাত, পা, বাহু, কনুই এবং হাঁটুর চামড়া ফেটে যায়, আঁশযুক্ত ও লাল-লাল দাগ হয়ে যায়। অনেক সময় ফুসকুড়ি বেরোয়।
এই সময় কী রকম সমস্যা হয় রোগীর?
সোরিয়াসিস-এর লক্ষণ দেখা গেলে নানারকম শারীরিক অস্বস্তি হয়। চামড়ার ওই অংশে চুলকানি হতে পারে, জ্বালা ভাব হতে পারে, এমনকী রক্তও পড়তে পারে।
কী প্রভাব পড়ে শরীরে?
সোরিয়াসিসের প্রভাব পড়তে পারে দেহের হাড়ের সন্ধির ওপর। এতে চলাফেরায় অসুবিধা হতে পারে এবং অক্ষমও হয়ে পড়তে পারেন। এছাড়া, যাদের সোরিয়াসিস রয়েছে তাদের ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ, চোখের অসুখ এমনকী মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
বিশেষজ্ঞ হিসাবে কী পদক্ষেপ নেন প্রথমে?
চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ হিসাবে, যখন প্রথম আমরা কোনও রোগীকে দেখি, তখন আমাদের প্রাথমিক গুরুত্ব থাকে চামড়ার ওপর সোরিয়াসিসের দৃশ্যমান লক্ষণগুলিকে পরীক্ষা করে দেখা, অবস্থাটাকে নির্ণয় করা এবং উপযুক্ত চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া। আমরা প্রায়ই এটা দেখতে পাই যে, একাধিক কারণে মহিলাদের ওপর সোরিয়াসিসের নেতিবাচক প্রভাব বেশি পড়ে। ফলে আমাদের দায়িত্ব এসে পড়ে সেই সমস্যাগুলির মোকাবিলা করা এবং এটা নিশ্চিত করা যাতে রোগীরা প্রয়োজনীয় যত্ন পান।
সোরিয়াসিসে আক্রান্ত হলে কতটা মানসিক অবসাদ আসতে পারে?
যাদের সোরিয়াসিস নেই, তাদের তুলনায় যাদের সোরিয়াসিস রয়েছে, তাদের মানসিক অবসাদে ভোগার সম্ভাবনা দেড়গুণ বেশি। রোগীরা যখন অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তাদের সোরিয়াসিসের লক্ষণগুলি আরও খারাপের দিকে যায়। এর উলটোটাও হতে পারে। অর্থাৎ যখন সোরিয়াসিসের লক্ষণগুলি বেড়ে ওঠে, তা থেকেও মানসিক অবসাদ ছড়াতে পারে। সোরিয়াসিস ও মানসিক অবসাদের মধ্যে একটা জীববৈজ্ঞানিক যোগাযোগ রয়েছে। দেহের যে-রাসায়নিকগুলি চামড়ার ওপর নানা উপসর্গ ফুটে ওঠার পিছনে সক্রিয় থাকে– সেইগুলোই মানসিক অবসাদে আক্রান্তদের শরীরে আরও বেশি পরিমাণে দেখা যায়। তাছাড়া, চামড়ার ওপর দাগ-দাগ হয়ে থাকার দৃশ্যটা রোগী বা অন্যদের কাছে উদ্বেগজনক কিংবা বিরক্তিকর হতে পারে। এটাও জানা তথ্য যে, মদে আসক্তি এবং সোরিয়াসিসের মধ্যেও সম্পর্ক রয়েছে, যা থেকে আরও অবসাদগ্রস্ত ভাব আসতে পারে।
স্বাভাবিক ভাবেই এটা সব রোগীদের কাছেই একটা সমস্যা। বিশেষত যে-সব মহিলা কর্পোরেট কিংবা রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে কাজ করেন এবং যাদের অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতে হয়, তাদের কাছে এটা সমস্যা তো বটেই। বেশিরভাগ মহিলা চান, তাদের চেহারা যেন নিখুঁত থাকে। যাদের সোরিয়াসিস রয়েছে তারা সবসময় চামড়ার সেই অংশটি ঢেকে রাখার বিষয়ে সচেতন থাকেন, যাতে অন্যরা তা দেখতে না পান। কখনও কখনও মোটা কোনও কাপড় বা স্কার্ফ দিয়ে তারা জায়গাটা ঢেকে রাখেন। এতে ফল আরও খারাপ হয়।
সোরিয়াসিস কি ছোঁয়াচে?
সোরিয়াসিস বিষয়টি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা অসম্পূর্ণ। লোকে মনে করে, সোরিয়াসিস ছোঁয়াচে এবং তাদেরও এই রোগ ধরবে যদি তারা সোরিয়াসিস আছে এমন কোনও মহিলার সংস্পর্শে থাকেন। এথেকে এমন একটা ভয় জন্ম নিতে পারে, যার ফলে সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারেন। যেমন স্কুলের কোনও অনুষ্ঠানে, সোরিয়াসিস রয়েছে এবং তা দেখা যাচ্ছে এমন কোনও মেয়েকে বাবা-মায়েরা আলাদা করে দিতে পারেন। কিংবা, সোরিয়াসিস রোগীর কাছ থেকে সহকর্মীরা দূরত্ব বজায় রাখতে পারেন। এতে রোগীর মানসিক কষ্ট আরও বেড়ে যায় এবং তাতে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ে। বিশেষত মহিলারা এর ফলে আত্মবিশ্বাস হারাতে পারেন, তাদের আত্মবিশ্বাস তলানিতে ঠেকতে পারে এবং নিজেদের সম্পর্কে তারা একটা খারাপ ধারণা নিয়ে বসে থাকতে পারেন।
কেউ যদি মনে করেন তার জীবনের সব আশা শেষ হয়ে গেছে, যদি তার কাজে তিনি মনঃসংযোগ করতে না পারেন, যদি অন্যদের চেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত বোধ করেন কিংবা যদি আদৌ কোনও খিদে না থাকে, ক্লান্তি ও অবসাদে ভোগেন এবং কোনও কিছুতেই উৎসাহ না পান, যদি তার ঘুমোতে অসুবিধা হয় কিংবা আদৌ না ঘুমোন, তাহলেই ধরে নিতে হবে তিনি অবসাদগ্রস্ত। তবে কিছু সময় অনেকে নানারকম কারণে খুব স্বাভাবিক ভাবেই চিন্তায় থাকেন। অবশ্য তার মানে এই নয় যে, সেই ব্যক্তি অবসাদগ্রস্ত। কিন্তু যদি একই অবস্থা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চিকিৎসা করানোর প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
গর্ভাবস্থায় এবং মা হওয়ার পর কোনও বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে কি রোগীকে?
যেসব মহিলারা সোরিয়াসিসে আক্রান্ত হওয়ার পর গর্ভবতী হয়েছেন, তাদের উদ্বেগের বড়ো বিষয় হল, এই রোগের কারণে তাদের সন্তানধারণে এবং সন্তান হলে তাকে বুকের দুধ খাওয়াতে কোনও সমস্যা হবে কিনা! রোগীদের আমি এই আশ্বাস দিতে চাই যে, সোরিয়াসিসের ফলে গর্ভধারণে কোনও সমস্যা হয় না। তাই সন্তানধারণের পরিকল্পনা তারা করতেই পারেন। তবে গর্ভাবস্থার সময় হরমোন ও শারীরবৃত্তিয় পরিবর্তন কীভাবে ঘটবে এটা আগে থেকে বলা খুবই কঠিন। আবার বুকের দুধ খাওয়ালে, শারীরিক অবস্থার ওপর তার প্রভাব পড়তে পারে। কিছু মহিলার ক্ষেত্রে লক্ষণের কোনও পরিবর্তন হয় না। আবার অন্যদের ক্ষেত্রে কারওর সোরিয়াসিসের লক্ষণ ও চামড়ার ওপর তার প্রকোপ বা প্রভাব পড়তে পারে কিংবা আরও খারাপও হতে পারে। অনেক মহিলার আবার সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর-পরই তাদের সোরিয়াসিসের লক্ষণগুলি আরও বেড়ে যেতে পারে।
এসব কারণে মহিলাদের পক্ষে এটা প্রয়োজনীয় যে, যদি তারা গর্ভধারণ করতে চান, তাহলে সেটা চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশারদকে বিষয়টি জানাবেন। গর্ভাবস্থার সময় কিছু রোগের চিকিৎসা করানোটা উচিত নয়, কারণ তাতে বেড়ে ওঠা ভ্রূণের ক্ষতি হতে পারে। কিংবা বলা যায়, এই ধরনের চিকিৎসায় বেড়ে ওঠা শিশুর ক্ষতি হতে পারে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট গবেষণা হয়নি। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময়, মহিলাদের সাধারণ ভাবে পরামর্শ দেওয়া হয় যাতে স্তনের ওপর তারা যেন কোনও ওষুধ না লাগান। ওই চিকিৎসার প্রভাব সরাসরি ওই শিশুর শরীরে যাতে চলে না যায়, সেটা আটকাতেই এই পরামর্শ দেওয়া হয়।
আদর্শ ব্যবস্থা হল, রোগীর সহযোগিতায় চিকিৎসক বিভিন্ন ধরনের বিকল্প চিকিৎসার সুবিধা ও ঝুঁকি দুটি বিষয়েই বিবেচনা করবেন এবং তার মধ্যে থেকে সেরা বিকল্পটা বেছে নেবেন। গর্ভধারণের সময় কিছু সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা ও হালকা থেরাপির (ফোটোথেরাপি) সুপারিশ করা যেতে পারে। বায়োলজিক্স ও মুখে খাওয়া যায় এমন ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসার প্রেসক্রিপশন দেওয়া যেতে পারে।
শারীরিক ঘনিষ্ঠতায় সোরিয়াসিস কোনও প্রভাব ফেলতে পারে কি?
যাদের চামড়ায় সোরিয়াসিস ফুটে ওঠে, এটা সোরিয়াসিসের সবচেয়ে সাধারণ রূপ, তেমন ১০ জনের মধ্যে ৬ জন রোগীর জননেন্দ্রিয়ে কিছু সময়ের জন্য সোরিয়াসিসের দাগ দেখা যেতে পারে। এতে যন্ত্রণা হতে পারে, অস্বস্তি হতে পারে, ওই জায়গায় কিছু ফোটানোর মতো বা জ্বালাপোড়ার মতো অনুভূতি হতে পারে। এটা হতে পারে যৌন মিলনের সময় কিংবা তার পরে। যাদের সোরিয়াটিক আর্থারাইটিস রয়েছে,তারা ক্লান্তি অনুভব করতে পারেন বা তাদের হাড়ের সন্ধিতে ব্যথা হতে পারে। ফলে তাদের পক্ষে যৌন মিলন উপভোগ করাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়াও, যদি জননেন্দ্রিয়ের আশপাশে চামড়ার ওপর কোনও লাল দাগ নাও থাকে, সোরিয়াসিসের দরুণ মানসিক অস্বস্তি, কোনও দম্পতির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে বাধা হয়ে উঠতে পারে। এসবের জেরে মেয়েদের যৌন ভোগান্তি অনেক বেশি হয়। এর মধ্যে পড়ে চুলকানি, লিবিডো বা যৌন আকাঙক্ষা কমে যাওয়া ইত্যাদি। এরফলে সম্পর্কের পরিণাম ভয়ংকর হতে পারে। যাইহোক, এব্যাপারে আমাদের সংশ্লিষ্ট ও পদ্ধতিগত চিকিৎসা রয়েছে, যার সাহায্যে এই ধরনের সমস্যা মেটানো যেতে পারে। জীবনশৈলীতে কিছু পরিবর্তন, যেমন হালকা ক্লিনজার ব্যবহার করা, সুগন্ধিযুক্ত কন্ডোম ব্যবহার না করা, কিংবা টাইট অন্তর্বাস ব্যবহার না করা। এই নিয়ম মেনে চললে সুফল পাওয়া যেতে পারে।
সোরিয়াসিস রয়েছে এমন রোগীদের কী পরামর্শ দেবেন?
আমি বলতে চাই যে, তাদের অনুভূতি কী রকম বা নতুন কোনও লক্ষণ দেখা গেল কিনা, সেগুলো শারীরিক নাকি মানসিক, এ নিয়ে কথা বলার সময় চিকিৎসকদের কাছে বিব্রত হওয়ার দরকার নেই। বিশেষ করে চিকিৎসকদের কাছে মহিলাদের খোলাখুলি সব কথা বলতে হবে, তাদের দৈনন্দিন জীবনে সোরিয়াসিসের প্রভাব সংক্রান্ত সবকিছু খোলাখুলি জিজ্ঞেস করতে হবে। সেইসঙ্গে, চিকিৎসকের দেওয়া সব ওষুধ প্রতিদিন নিয়ম করে খেতে হবে। চিকিৎসক এই পরামর্শও দিতে পারেন যে, রোগী কোনও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে যান বা যৌন স্বাস্থ্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কারও কাছে যান। তাদের পরামর্শে পরিস্থিতির মোকাবিলায় আরও ভালো ভাবে সাড়া দিতে পারেন রোগীরা।
———