জার্মান মনোচিকিৎসক অ্যালয়েস অ্যালজাইমার এই রোগটি সম্পর্কে প্রথম বিস্তারিত জানান। তাই তাঁরই নামানুসারে এই রোগটির নামকরণ হয় ‘অ্যালজাইমার্স’।
এটি স্মৃতিভ্রংশের প্রাথমিক রূপ। সাধারণত ষাটোর্ধ্ব নারী-পুরুষ বেশি আক্রান্ত হন এই অসুখে। তবে বর্তমানে এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন কম বয়সিরাও। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ক্রমশ বাড়ছে এই রোগের প্রকোপ এবং চিকিৎসকরা মনে করছেন, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি ৮৫ জন ষাটোর্ধ্ব মানুষের মধ্যে অন্তত ১জন আক্রান্ত হতে পারেন এই রোগে। তাই, রোগটি সম্পর্কে সচেতনতা জরুরি। ডা. দেবাশিস চক্রবর্তী রোগটির কারণ, ফলাফল এবং চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানালেন সম্প্রতি।
অ্যালজাইমার্স কী?
অ্যালজাইমার্স ডিজিজ হল একটি নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার। এটি ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশের প্রথম ধাপ। শুধু ষাটোর্ধ্ব নারী-পুরুষই নয়, কম বয়সিরাও আক্রান্ত হতে পারেন এই অসুখে।
অ্যালজাইমার্স-এর কারণ কী?
কী কারণে এই রোগ হয়, তা সঠিক ভাবে উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি এখনও। তবে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে জানা গেছে, এটি মস্তিষ্কের প্লাক ও টেঙ্গুল অর্থাৎ, হাইড্রোফসফোরাইলেটেড টাউ প্রোটিনের সমষ্টির কারণে ঘটে। ফলে, অ্যালামাইড প্লাক, নিউরোফাইব্রিলারি টেঙ্গুল এবং অ্যাসিটাইলকোলিন উপাদানের অস্বাভাবিক উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় আক্রন্তের মস্তিষ্কে। অনেকের মতে, এই রোগের সূত্রপাত হয় অ্যামাইলয়েড বিটা নামের এক ধরনের প্রোটিন উৎপাদনের মাধ্যমে, যা পরবর্তী সময়ে মস্তিষ্কের রক্তকণিকার ভিতরে দলা পাকিয়ে অ্যামাইলয়েড প্লাক তৈরি করে। আর এই অ্যামাইলয়েড প্লাক-ই নিউরন বা মস্তিষ্ককোশের মৃত্যুর জন্য দায়ী। সাধারণত অ্যামাইলয়েড প্লাক দুটি ঘটনার মাধ্যমে মস্তিষ্ককোশের মৃত্যু ঘটায়। এক, প্রদাহ ও জারণক্রিয়ায় স্নায়ুর ক্ষতি করে। দুই, নিউরোফাইব্রিলারি টেঙ্গুল গঠনের মাধ্যমে। মস্তিষ্কের কর্টেক্সে ও সম্মুখভাগে পিরামিড আকৃতির অ্যাসিটাইলকোলিন নিউরন থাকে, যা অ্যাসিটাইলকোলিন ক্ষরণের মাধ্যমে বুদ্ধিমত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই রোগে টাউ প্রোটিনের গাঠনিক পরিবর্তনের কারণে এই অ্যাসিটাইলকোলিন নিউরনের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে স্মৃতি হ্রাস পেতে থাকে।
কী কী লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায় এই রোগের ক্ষেত্রে?
তাৎক্ষণিক কিছু ভুলে যাওয়া এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণ। তবে এই প্রাথমিক উপসর্গকে অনেকেই ভুল করে বার্ধক্যজনিত সমস্যা কিংবা মানসিক চাপের বহিঃপ্রকাশ মনে করেন। কিন্তু উপসর্গ দেখে অসুখ ধরতে না পারলে কিংবা চিকিৎসা না করিয়ে অবহেলা করলে কী কুফল ভোগ করতে হয়, তা রোগী টের পান কিছুদিন পরে। কারণ, রোগ বাড়লে দ্বিধাগ্রস্থতা, অস্থিরতা, রাগ বেড়ে যাওয়া, ভাষা ব্যবহারে অসুবিধা, দীর্ঘ সময় কিছু মনে না পড়া প্রভৃতি সমস্যা প্রকট হতে থাকবে।
শোনা যায় অ্যালজাইমার্স-এর কিছু রিস্ক-ফ্যাক্টর আছে, সত্যিই কি তাই?
হ্যাঁ, অ্যালজাইমার্স ডিজিজ হওয়ার সঙ্গে কিছু রিস্ক-ফ্যাক্টর যুক্ত থাকে। এগুলি এই রোগ তৈরিতে এবং তীব্রতায় প্রভাব ফেলে। যেমন–
- নিম্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণি
- বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন
- দুর্বল সামাজিকতা
- অলস মস্তিষ্ক বা মস্তিষ্কের যথোপযুক্ত ব্যবহার না করা
- প্রবল পারিবারিক চাপজনিত বিষণ্ণতা
- হাইপারটেনশন ও ব্লাড সুগারের মতো ভাস্কুলার রিস্ক ফ্যাক্টরসমূহ, যা মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ হ্রাস করে, যার ফলে ডিমেনশিয়া বৃদ্ধি পায়। যদিও, এরফলে সরাসরি অ্যালজাইমার্স ডিজিজ তীব্রতর হয় না
কাদের সর্বাধিক আশঙ্কা রয়েছে অ্যালজাইমার্স ডিজিজ হওয়ার?
নিম্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পন্ন, একাকী থাকা, সারাদিন করার মতো কিছু না থাকা ও এভাবে কোনও সক্রিয়তার সঙ্গে নিজের মস্তিষ্কের ব্যবহার না করা এবং প্রবল পারিবারিক চাপের জন্য বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন যে-কোনও ব্যক্তির ভবিষ্যতে আলজাইমার্স ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বয়স্ক মানুষজনের মধ্যে অ্যালজাইমার্স বেড়ে যাচ্ছে কেন?
পরিবর্তিত সামাজিক কাঠামোয় জয়েন্ট ফ্যামিলির তুলনায় নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরও উন্নত জীবিকার সন্ধানে তরুণ প্রজন্ম শহর ছেড়ে বা দেশ ছেড়ে যাচ্ছে বলে পরিবারের পুরোনো প্রজন্ম হয় একা থাকছে নয়তো কারও সহায়তা নিয়ে বাস করছে। এর ফলে মস্তিষ্কের কোশে ‘স্লো ডিগ্রেডেশন’ হতে থাকে পর্যাপ্ত ‘স্টিমুলেশন’-এর অভাবে। এটিই রোগ বৃদ্ধির সম্ভাব্য অন্যতম কারণ।
অ্যালজাইমার্স ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে জীবনযাত্রায় কী ধরনের সহজ পরিবর্তন আনা যেতে পারে?
যেসব ব্যক্তির কোনও সক্রিয় জীবন নেই, তারা ক্রসওয়ার্ড পাজল সমাধান করতে পারেন, নিয়মিত সামাজিক কর্মকাণ্ডে যোগ দিতে পারেন এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ভিত্তিক বিতর্কে অংশ নিতে পারেন। এর ফলে মস্তিষ্ক সর্বদা সক্রিয় থাকবে। আর মস্তিষ্ক সক্রিয় রাখতে পারলে, অ্যালজাইমার্স ডিজিজকেও দূরে রাখা সম্ভব।
অ্যালজাইমার্স কি সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব?
না। এই রোগের কোনও স্থায়ী প্রতিকার নেই। এর চিকিৎসা, রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গ দেখে কিছু ওষুধ এবং কাউসেলিং-এর মাধ্যমে করা হয়। এক কথায়, এই রোগের চিকিৎসা প্রতিরোধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই, আগাম সতর্কতার যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনই এই রোগে আক্রান্তদের সুস্থ রাখার জন্য এগিয়ে আসতে হবে প্রতিটি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে। আন্তরিক যোগাযোগ এবং সামাজিক মেলামেশার মাধ্যমেই সুস্থ রাখতে হবে রোগীকে।