বড়দার কাছে মাকে পৌঁছে দিয়ে কিছুটা স্বস্তি বোধ করল শিউলি। এখানে কাজের লোকের সমস্যায় জেরবার হয়ে উঠেছিল। অথচ সে কথাটা কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছিল না ওদের, বিশেষ করে বড়োবউদিকে। বড়োবউদির ধারণা এটা শিউলির একটা চাল। কথাটা এরমধ্যেই কানেও এসেছে শিউলির। অদ্ভুত! শিউলি অবাক হয়ে ভাবে, যখনই ও কোনও অসুবিধার কথা বলেছে তখনই এই ধরনের প্রতিক্রিয়া দিয়েছে বড়োবউদি। একা থাকে বলে মাকে দেখার দায়িত্বটা নিতে হয় শিউলিকেই। অথচ এটা তো ওদেরই করার কথা। তবুও করে শিউলি। কারণ মা ওর কাছে এলে একটু প্রাণ খুলে বাঁচতে পারে, দুটো মনের কথা বলতে পারে। মা ওদের কাছে এখন উচ্ছিষ্ট বস্তু, নেহাত ফেলে দিতে পারে না তাই রেখেছে।
মায়ের অবদান ওরা মানে না। বড়দার ডাক্তারি পড়া প্রায় বন্ধ হতে বসেছিল। মা নিজের গয়না বন্ধক রেখে বাবার হাতে টাকা তুলে দিয়ে বলেছিল, আমরা আধপেটা খেয়ে থাকব, কিন্তু ওর পড়া বন্ধ করতে দেব না। বড়দা ডাক্তারি পাশ করল। ধীরে ধীরে যত ওর পসার বাড়তে লাগল, একটা চমকপ্রদ বিলাসবহুল জীবন নাগালের মধ্যে ধরা দিল, বড়দা তত বেশি করে অতীতটাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল। অতীত যেন একটা সিঁড়ি, শুধু ওপরে ওঠার কাজে লাগে। এ কেমন ওপরে ওঠা! ভেবে পায়নি শিউলি।
বখাটে, বাউন্ডুলে মেজদা যখন বন্ধু-বান্ধব আর রাজনীতির চক্বরে পড়ে উচ্ছন্নে যেতে বসেছিল, বাবা হাল ছেড়ে দিলেও মা কিন্তু বুক চিতিয়ে লড়েছিল। একটু একটু করে তুলে এনেছিল ডুবন্ত ছেলেকে। পায়ের তলায় মাটি দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল শক্ত ভূমিতে। মেজদা এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে রয়েছে ওর কারবার। সুযোগ পেলেই উপদেশ দেয়, মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যের নির্মাতা। অর্থাৎ ওর ভাগ্যের বাড়বাড়ন্তের মাঝখানে কেউ নেই, কেউ কোনও দিন ছিল না। কত বড়ো বেইমান! ওদের জীবন কাহিনি তো শিউলির জানা। কী করে পারে এত বড়ো মিথ্যে বলতে?
শিউলির ডিভোর্স নিয়েও কম কথা বলেনি ওরা। বড়দা তো সুযোগ পেলে এখনও শোনায়– ডিসিশনটা একটু বেশি তাড়াতাড়ি নিয়ে ফেললি বুড়ি… আর একটু ভাবতে পারতিস।
বড়দার সাথে সমান ভাবে তাল মিলিয়ে গেছে বড়োবউদি, মেজদা, মেজবউদি। আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সবাইকে বলে বেড়িয়েছে, দোষটা আসলে শিউলির-ই। সুযোগ বুঝে দেবদাস নিজেকে দেবদূত প্রতিপন্ন করার সব চেষ্টাই করে যাচ্ছে। ওদের সাথে দেবদাসের এখনও যোগাযোগ আছে, জানে শিউলি। পর হয়ে গেছে শিউলিই। বড়দা, মেজদা কেউই দরকার ছাড়া কথা বলে না শিউলির সাথে। দরকার বলতে অবশ্য একটাই, সেটা হল মা। মায়ের জন্য ওদের ফরেন টুর আটকে যায়, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার ভীষণ ক্ষতি হয়। স্বাভাবিক আনন্দ উৎসবে একটা বিষাদের ছায়া হয়ে সব আনন্দটাকে শুষে নেয় মা। সেই বিষাদমূর্তিকে শিউলির ঘাড়ে চাপিয়ে ওরা মাঝেমধ্যে একটু আনন্দ উপভোগের অবকাশ পায়। মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথে শিউলির এই কদর এক লহমায় ধূলিসাৎ হবে জানে শিউলি।
বলার কিছুই নেই, তবুও বড়ো বউদি খোঁটা দিতে ছাড়ল না– ‘মা ছেলের কাছে আসবে, থাকবে, এ তো ভালো কথা। এই কর্তব্য তো করতেই হবে। তোমার দাদাও সে কথা বলে। কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি শিউলি, তোমার মায়েরও কিছু দোষ আছে গো। সব ব্যাপারে নাক না গলিয়ে উনি থাকতে পারেন না। সংসারটা আমাকে সামলাতে হয়। হঠাৎ করে উনি মাঝখানে না বুঝেশুনে মন্তব্য করে বসলে কেমন লাগে বলো তো?’
শিউলি জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেল। মাকে ভালো করেই চেনে শিউলি। একসময় স্কুলের দিদিমণি ছিল। যথেষ্ট ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা। সেই তুলনায় বিদ্যে ও ব্যক্তিত্বের দৗড়ে অনেক পিছিয়ে বড়োবউদি ও মেজবউদি দুজনেই। আর এখানেই বউদি-দের সমস্যা। মায়ের ব্যক্তিত্বের মোকাবিলা করতে না পেরে এভাবে বদনাম করে বেড়ায়।
বড়োবউদির পক্ষ নিয়ে বড়দা বলল– ‘কথাটা সত্যি রে। মা আজকাল কেমন জানি হয়ে গেছে। সব কিছুতেই বড্ড বেশি রিআ্যক্ট করে। আরে বাবা, তোমার বয়স হয়েছে, খাও দাও, রেস্ট করো। সব কথার মাঝখানে যাওয়ার কী দরকার? যাইহোক যাওয়ার আগে সেই কথাটা মাকে একটু ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে যাস।’
এসব কথা মাকে বলার প্রয়়োজন বোধ করেনি শিউলি। বলা মানে ওদের মিথ্যেটাকে প্রশ্রয় দেওয়া। কেন বলবে এসব?
প্রণাম করে বেরিয়ে আসার সময় মায়ের সজল চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর কেমন জানি করে উঠল। কোনওরকমে বলল– ‘লেখাটা থামিও না মা। আমি পৌঁছে ফোন করব।’
শিউলির স্কুলটা কলকাতা থেকে ঘণ্টা তিনেকের পথ। এমন একটা দূরত্ব, না ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করা যায়, না ওখানকার গ্রাম্য পরিবেশে থাকা যায়। শেষপর্যন্ত স্কুলের কাছাকাছি একটা গঞ্জ এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়েছে দুজনে মিলে। ইচ্ছে করলেই ছুটির দিনগুলোতে কলকাতায় আসতে পারে। কিন্তু আসে না। উঠবে কোথায়? ডিভোর্সের পর নিজের ঘর বলতে তো আর কিছু নেই। বড়দা বা মেজদার বাড়িতে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। ওরাও সেটা বোধহয় চাইবে না। সব মিলিয়ে শিউলি এখন কলকাতা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন বলা যায়।
সুধাদেবী ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েই রইলেন যতক্ষণ না শিউলির গাড়ি গলি পেরিয়ে বড়ো রাস্তায় অদৃশ্য হল। মেয়েটা চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ একটা অসীম শূন্যতা গ্রাস করে রাখল সুধাদেবী-কে। মেয়েটা তার অন্য রকম। ছেলে দুটোর মতো স্বার্থপর, বিবেকহীন নয়। তবু মেয়ে তো ! ওর কাছে থাকতে মন চাইলেও উপায় থাকে না। ওর দিকটাও দেখতে হয়। ওর অসুবিধাগুলো নিজের চোখে দেখে এসেছেন সুধাদেবী। স্থায়ী কোনও কাজের লোক নেই। ঠিকে কাজের মেয়েটা অসম্ভব কামাই করে। এই অবস্থায় শিউলি চাকরি সামাল দেবে, না মায়ের সেবা করবে? তবুও ওর মধ্যেই যথাসাধ্য করে যাচ্ছিল। কিন্তু সুধাদেবীরই ভালো লাগছিল না। জেদটা তিনিই ধরেছিলেন। নিজের সুখের জন্য ওকে কষ্টে রাখতে মোটেও ভালো লাগছিল না।
একসময় অলস পায়ে ঘরে এসে ঢুকলেন। কিছুই ভালো লাগছিল না। বারবার শিউলি আর মণিদীপার কথা মনে পড়ছিল। ওর স্কুলের আর এক দিদিমণি। ওরা দুজনে মিলেই একটা বাড়ির দুটো পার্টে ভাড়া নিয়েছে। মণিদীপা শিউলির চেয়ে বছর তিন চারেকের বড়ো। ভারি আন্তরিক স্বভাবের মেয়ে। ওর বাড়ি ঘর, স্বামী, সন্তান সবই আছে। কিন্তু দূরত্বের কারণে ভাড়া নিতে হয়েছে। ছুটির দিনগুলো বাড়িতে কাটিয়ে আসে। ওই মেয়েটা-কেও ভালোবেসে ফেলেছেন সুধাদেবী। আসার সময় কান্না চেপে রাখতে পারেননি। মণিদীপাও কাঁদছিল।
এখন আর বেশি কথা বলেন না সুধাদেবী। অবসর সময় লেখালেখি করেন। একটা সময় লেখার অভ্যাস ছিল। মাঝখানে ছেদ পড়ে গিয়েছিল। শিউলির তাগিদেই আবার শুরু। সেসব সত্যিকারের সাহিত্য হয়ে ওঠে কিনা বুঝতে পারেন না। তবে লিখতে ভালো লাগে। মনের জমে থাকা কথাগুলো একটা পথ খুঁজে পায় যেন। শিউলি পড়ে। পড়ে বলে, দারুণ লিখেছ মা, আরও লিখে যাও। হয়তো মন জোগানোর জন্য বলে। তবুও সুধাদেবী খুশি হন।
সুধাদেবীর এই পরিবর্তন দেখে তার বড়োবউমা তো হেসেই অস্থির! ছেলেরাও…
–খাতা ভর্তি করে এসব হিজিবিজি কী লিখছেন মা?
সুধাদেবী হাসেন– ওসব তুমি বুঝবে না মা। আমিও কী সব বুঝি? মন বলে, আমি লিখে যাই। সব সময় বকবক করার চেয়ে তো ভালো। এই জগতের মধ্যেই এ এক আলাদা জগৎ যেন। চাইলে তুমিও পড়তে পারো।
–দূর… ওসব পড়ার সময় কোথায় আমার? ওতে আপনি কী লিখবেন সেটা তো বুঝতেই পারছি। নিশ্চয়ই আমাদের নিন্দা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছেন। আমরা আপনাকে কতভাবে কষ্ট দিই এই সবই তো?
–তোমাদের নিন্দা গাথা লিখে আবার তোমাদেরকে সেটা পড়তে দেব… এটুকু বোধও তোমার কাজ করল না? না পড়েই তুমি অদ্ভুত একটা মন্তব্য করে দিলে। ওসব কথা আমি লিখিনি। কেন লিখব? তোমাদের নিন্দে করা মানে তো আমার নিজেকেই নিন্দে করা। এই বয়সে এসে আর জীবনটাকে নীচে নামাতে ইচ্ছে করে না। যদি কোনওদিন মনে হয়, একটু পড়ে দেখো। আসলে আমার লেখার মধ্যে দিয়ে আবার একবার নিজেকে দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। পুরোনো আমিটাকে দেখতে গিয়ে দেখছি, সারা জীবনে কত না ভুল করেছি!
–বাববা… এইটুকু লিখেই তো দেখছি আপনার মাথা ঘুরে গেছে। এসব পোকা কী শিউলি আপনার মাথায় ঢুকিয়েছে?
–যদি ঢুকিয়েই থাকে অন্যায় তো কিছু করেনি। সবদিক থেকেই ভালো হয়েছে। মাঝখানে আমি কেমন জানি হয়ে গেছিলাম! তোমাদের অহেতুক বিরক্ত করতাম। তখন বুঝতাম না, এখন একটু একটু করে তফাতটা বুঝতে পারছি। ভালো করে বেঁচে থাকতে হলে নিজস্ব একটা জগৎ তৈরি করে নিতে হয়। শিউলি সেটাই শিখিয়েছে আমাকে। শিউলির জায়গায় তুমিও হতে পারতে সেটা। সব সময় মা-ই যে শেখাবে এমন তো কোনও কথা নেই। কখনও কখনও মেয়েরাও মাকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিতে পারে।
–আপনারা দুজনেই স্কুলের দিদিমণি, কত কিছু জানেন। আমরা তো আবার ওসব হতে পারিনি। ঘরদোর, সংসার, ছেলে-পুলে এসব নিয়েই কাটিয়ে দিলাম। শিউলি একদিক থেকে ভালোই করেছে। একটা মুক্ত, স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারছে। নিজের মতো যেমন খুশি চলতে পারছে। বাধা দেওয়ার কেউ নেই।
ইঙ্গিতটা ধরতে অসুবিধা হল না সুধাদেবীর। নোংরা ঘেঁটে যার আনন্দ, তার মন সব কিছুতেই নোংরা দেখে। সুধাদেবী কোনও কথা বললেন না। এসব কথার কোনও প্রতিবাদ হয় না। প্রতিবাদ করতে গেলে সেটার অন্য ব্যাখ্যা করে এক্ষুনি কাদার মধ্যে নামিয়ে আনা হবে, জানেন সুধাদেবী। হয়তো সেটাই চাইছে তার বড়োবউমা। কিন্তু সতর্ক সুধাদেবী আজ সেই সুযোগটা দিলেন না।
দেবদাস এখন এ বাড়িতে নিয়মিত আসা যাওয়া করছে।
খাওয়া-দাওয়া, হই-হুল্লোড়, সবকিছুতেই ওর ডাক পড়ে। সুধাদেবীর কয়েক মাস অনুপস্থিতির সুযোগে ওরা এটা নিয়ম বানিয়ে ফেলেছে। সুধাদেবী অবাক হন। কেমন ভাই তোরা? যে-ছেলেটা তোদের বোনকে অপমান করে ডিভোর্স দিল, তার সাথেই তোরা এভাবে মেলামেশা করছিস? বোনের মনে কতটা কষ্ট হবে একবারও ভেবে দেখলি না? বউমাদের আদিখ্যেতা দেখলে মনে হয় ওরা ইচ্ছে করেই আরও বেশি করে এসব করছে।
সুধাদেবী ওদের পাতা ফাঁদে পা দিলেন না। এখন কিছু বলতে যাওয়া মানেই ওদের হাতে ঝগড়ার উপাদান তুলে দেওয়া এবং সবশেষে সবার কাছে ‘দজ্জাল বুড়ি’ হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করার সুযোগ করে দেওয়া। হঠাৎ সুধার মনে হল, শিউলি কী এসব জানে? আজ না জানলেও একদিন তো ঠিক জানতে পারবে। তখন? সেদিন অসম্ভব কষ্ট পাবে মেয়েটা। বউদিরা না হয় পরের মেয়ে, কিন্তু নিজের দাদারা কী করে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে? এমন ছেলেদের পেটে ধরেছিলেন তিনি? কেমন জানি অসহায় লাগে সুধাদেবীর।
কিন্তু সহ্যের তো একটা সীমা থাকে। সেটারই বাঁধ ভেঙে গেল একদিন। শিউলিকে নিয়ে ওরা সেদিন ওনার সামনেই যা নয় তাই শুরু করে দিল। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না সুধাদেবী। নিজের ছেলে বউমাদের না ধরে সরাসরি দেবদাসকেই ধরলেন। –তুমি কেমন ধরনের ছেলে বাবা! লজ্জা শরম বলে কী কিছুই নেই তোমার শরীরে? এভাবে এই বাড়িতে তোমার আসাটা কি ঠিক বলে মনে করো তুমি? কোন সম্পর্কের ভিত্তিতে তুমি এখানে আসো? একসময় তুমি আমাদের জামাই ছিলে, এখন তো নেই তাই না?
দেবদাস রাগ দেখাল না। খুব শান্ত ভাবে মাথাটাকে হেলিয়ে ঠোঁটের কোণে একটা দুষ্টু হাসি খেলিয়ে বলল– ‘এসব কথা আমাকে না বলে ওনাদের-কে বলুন না। বড়দাই তো আমাকে ডেকে আনেন। আমি যে ইচ্ছে করে আসি তা কিন্তু নয়।’
সুধাদেবী বড়োছেলে তথাগতের দিকে তাকালেন।
তথাগত ভীষণ অপ্রস্তুত। বড়োবউমা সুতপা অবস্থা বেগতিক দেখে ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে পড়ল। –আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন মা, দেবদাস একজন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। ডাক্তারদের সাথে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ-দের একটা সম্পর্ক থাকে। বিজনেস ফিল্ডে দেবদাসের খুব নাম। আপনার মেয়ে ওর সাথে সম্পর্ক রাখতে পারেনি। তার দায় আপনি সবার ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। দেবদাস তবুও নানা ভাবে আপনার ছেলেকে হেল্প করে। নেহাত ওর বড়ো মন তাই।
সুধাদেবী ভীষণ অবাক হন। বিজনেসের সম্পর্ক আর পারিবারিক সম্পর্ক এক হল! কথাগুলো শিউলিকে আর না জানিয়ে পারলেন না। অন্য লোকের মুখে শোনার চেয়ে নিজের মায়ের মুখেই শুনুক নির্মম সত্যটা। ফোনে সবটাই খুলে বললেন।
সব শুনে শিউলি হেসে বলল– ‘আমি সব জানি মা। তুমি এসব নিয়ে মন খারাপ কোরো না। কাউকে কিছু বলতেও যেও না।’
সুধাদেবী অবাক হয়ে বলেন– ‘কার মুখে শুনলি তুই এসব? কে বলল?’
–বড়োবউদিই বলেছে। বলে অনেক আনন্দও পেয়েছে। আসলে দেবদাস ওদের কোম্পানি থেকে বড়দাকে একটা ইউরোপ টুরের বন্দোবস্ত করে দিচ্ছে। পুরো ফ্যামিলি সমেত। সমস্ত খরচা ওরাই দেবে। তার জন্যেই এত খাতির যত্ন। হয়তো মেজদাও কিছু সুযোগ পাবে। শুধু তাই নয়, ওরা সবাই মিলে দেবদাসের জন্য একটা পাত্রীরও সন্ধান করেছে। বড়োবউদি যে-পাত্রীর খবর দিয়েছে, ঘটনাক্রমে মেয়েটি আমার চেনা। ওরা অবশ্য সেটা জানে না। ওই মেয়েটাই ফোনে আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। গল্পের ছলে জানতে চাইছিল, ডিভোর্সটা কেন হয়েছিল।
–তুই কী বললি? সত্যিটাই বলে দিয়েছিলি তো…?
–আমি শুধু বলেছি, এসব প্রশ্ন আমাকে কোরো না, কারণ আমার উত্তর তোমার কাছে একতরফা লাগবে। ওর সাথে কথা বলে যেটুকু বুঝলাম তাতে বড়দা, বড়োবউদি ডিভোর্সের সমস্ত দায় আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে ভালো রকমের ব্রেন ওয়াশ করে দিয়েছে। তারপরে অবশ্য আর কোনও প্রশ্ন করেনি। তবুও বিয়েটা যদি কোনও ভাবে ভেঙে যায়, দোষটা ঘুরেফিরে আমার ঘাড়েই এসে পড়বে জানি। আমার কপালটাই বোধহয় এমন!
কিছুক্ষণ কোনও কথা বলতে পারলেন না সুধাদেবী। ফোনের ওপার থেকে ক্লিষ্ট হাসি হেসে শিউলি বলল– ‘বুঝতে পারছি এসব দেখেশুনে তুমি খুব কষ্ট পাচ্ছ। কিন্তু এটাই তো সত্যি মা। সত্যি নির্মম হলেও তাকে মেনে নিতেই হয়। তোমার মেয়ের ভাগ্যটাই যে এমন! তবে বেশি ভাবার কিছু নেই। আমি তো একেবারে জলে পড়ে নেই। দু-মুঠো অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা তো আছে। কেউ তোমার মেয়েকে মাটিতে ফেলে পিষে অন্তত মারতে পারবে না। লতানো গাছেরাও পৃথিবীতে বেঁচে থাকে মা।’
সুধাদেবী অসহায় ভাবে বললেন– ‘কিন্তু একটা অবলম্বন লাগে তাদের… বাড়তে, ফুল দিতে, ফল দিতে। আমি বলি কি, তুই একটা বিয়ে করে নে মা। দেবদাস যদি করতে পারে, তবে তুই কেন পারবি না?’
শিউলি হেসে বলল– ‘তুমি কী আমাকে প্রতিযোগিতায় নামাতে চাইছ?’
তারপরেই অন্যমনস্ক ভাবে বলল– ‘বিয়ে মানে তো দেবদাসের মতো পুরুষের সাথে একটা বন্দোবস্ত। যে-বন্দোবস্তে একতরফা ভাবে কতকগুলি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরাজিত পক্ষের মতো মেয়েদের-কেই সব সময় চুক্তির সমস্ত শর্ত মেনে নিতে হয়। না মানলেই শর্ত লঙঘনের দায় চাপিয়ে চলে পেষণ। তবে এটাও মানি, সহমর্মী পুরষেরাও এই পৃথিবীতেই থাকে। যদি কখনও তেমন কারও সাথে দেখা হয়ে যায়… অবশ্যই বিয়ে করব।’
সুধাদেবী আর কোনও কথা বললেন না। অদ্ভুত একটা অনুভূতি খেলে গেল তার মস্তিষ্কে। তার মনে হল, আর একটা সুধা যেন তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে চলে গেল বহু দূরে শিউলির ঘরে। শিউলির মাথায় হাত রেখে সে পরম মমতায় বলল, ‘অন্তরের টান থাকলে মানুষ সব পায়। অন্তরের শক্তিই তাকে সব এনে দেয়। টাকা, গাড়ি, বাড়ি নয়… তুই শুধু একটু ভালোবাসা চেয়েছিস। ঠিক পাবি মা! এ আমার আশীর্বাদ। মায়ের আশীর্বাদ কখনও বিফলে যায় না।’