খোঁজটা পেয়েছিলাম বেঙ্গালুরু বেড়াতে গিয়ে। অপূর্ব এক বনভূমির, যার নাম কাবিনি। বেঙ্গালুরু থেকে স্টেট হাইওয়ে ধরে গাড়ি ছুটিয়ে, মাইসোর শহর ঢোকার আগে পথ বদলে এইচডি কোটে রোড অনুসরণ করতে হবে। এইচডি কোটে ঢোকার কিলোমিটার দুয়েক আগে, রাস্তা বদলে আরও ১২ কিলোমিটার গেলেই পৌঁছে যাওয়া যায় কাবিনি রিভার লজ-এ।
কাবিনি বা কপিলা যে-নামেই ডাকুন না কেন, এ নদীর উৎসমুখ কেরলে। বান্দিপুর আর নাগরহোল জঙ্গল-মহলের মধ্যে দিয়ে বয়ে, মিশেছে কাবেরীর সঙ্গে। এর স্রোতেই তৈরি হয়েছে বিশাল জলাধার কাবিনি ড্যাম। কাবিনি ফরেস্ট রিজার্ভ পর্যটকদের বরাবরের পছন্দের জায়গা। আর আপনি সেলিম আলির ভক্ত হলে তো কথাই নেই!
আমরা ভোর ছ’টায় বেঙ্গালুরু থেকে রওনা দিয়ে, সকাল সাড়ে দশটায় এসে পৌঁছোলাম রিভার লজের দোরগোড়ায়। যদিও চেক-ইন-টাইম-এর কিছু আগেই পৗঁছে গেছি, তবু ম্যানেজারের আতিথেয়তায় আমাদের তাঁবুতে ঢুকে পড়া গেল আধঘন্টার মধ্যেই।
দক্ষিণ ভারতীয় থালি ছিল দ্বিপ্রাহরিক আহারে। ঠিক দুপুর সাড়ে তিনটেয় ডাকা হল আমাদের, জিপ সাফারির জন্য। নাগরহোল বনাঞ্চলের রোমাঞ্চকর অরণ্যযাত্রায়, এক নজরেই প্রেমে পড়ে গেলাম জঙ্গলটার। কিছু বন্য বরাহ, হরিণের ঝাঁক, ময়ূর, প্রচুর বাঁদর, বুনো কাঠবেড়ালি এবং কপালজোরে গাছের উপর একটি চিতাও নজরে পড়ল। কাছাকাছি একটি এলিফ্যান্ট ক্যাম্প-এ কিছু কুনকি হাতি দেখে ফিরে এলাম। গাইড বলল এই বনে প্রায় ১৯০০ হাতির বাস, আর আছে প্রায় ২০০টি বাঘ ও চিতা।
সাফারি-তে ঘন্টা তিনেক সময় লেগেছে। সন্ধেবেলায় প্রায় কৌতূহল মেটাতেই আয়ুর্বেদ বডি মাসাজ-এর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম, কিন্তু সেটা খুব সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। রাতের খাবার খাওয়া হলে একদল পর্যটক ক্যাম্প ফায়ারের হইহই-তে মেতে উঠল, বাকিরা গেলাম কাবিনি নদীর ধারে। চাঁদের আলোয় সেই নদী দেখার অভিজ্ঞতা, ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
কাবিনি একসময় মাইসোরের রাজাদের এবং পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ জেনারেলদের প্রিয় মৃগয়াক্ষেত্র ছিল। বর্তমানে ২টি ৭ বেডরুমের ব্লক, ৮টি কটেজ ও ৫টি তাঁবু নিয়ে গড়ে উঠেছে এই লজ, যেটির রক্ষণাবেক্ষণ করে কর্ণাটক সরকার। কাবিনি নদীর স্নিগ্ধ গতি আর এই শান্ত বনাঞ্চল, পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় এক ছুটির ঠিকানা। কাবিনি ড্যাম লাগোয়া এই বনাঞ্চল পশুদের বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে ওঠে গ্রীষ্মকালে। নদীর জল কমে গিয়ে যখন সবুজ শ্যামল তৃণভূমি জেগে ওঠে।
পরদিন ভোরে আমাদের বোট-রাইড-এ নিয়ে যাওয়া হল। মোটর চালিত বোট-এ ৪ জনের বসার ব্যবস্থা। কাবিনি নদীর বুক চিরে যেতে যেতে পাড়জোড়া বনস্থলিতে বন্য জন্তু দেখার সুযোগ মেলে। কূল ছুঁয়ে যাওয়া সেই জঙ্গলেই চোখে পড়ল প্রায় ২০টি হাতির একটি দঙ্গল। বাচ্চা-বুড়ো মিলে তাদের জলকেলি দীর্ঘক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখল আমাদের। আরও কিছুটা এগিয়ে চোখে পড়ল গাছে এক বৃহৎ পাইথন। বাইনোকুলারে চোখ রেখে দেখলাম অজস্র পাখি। মালাবার পায়েড ঈগল, ফ্লাওয়ার পেকার, জাকানা, হোয়াইট নেকড্ স্টর্ক, পাহাড়ি ময়না, বুলবুল, বারবেট প্রভৃতি। নদীর চরায় পাথরের উপর দেখা গেল এক বিশালাকার কুমির রোদ পোহাচ্ছে।
শেষদিন ভোরে আমাদের একটি ওয়াচটাওয়ারে নিয়ে যাওয়া হল। প্রচুর চিতল হরিণ, গউর, কচ্ছপ ও একদল বন্যকুকুরের দেখা পেলাম। এদিন আমাদের প্রাতরাশ সেরেই কাবিনি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা। ফেরার পথে কাবিনি জলাধার দেখে নিলাম। নরম রোদে জলে সাঁতার কাটা একঝাঁক রাজহাঁস চোখে পড়ল। বাতাসে শীতের ছোঁয়া। কাবিনিকে বিদায় জানাতে মন চায় না। অরণ্যের দিকে চোখ রেখে অনুচ্চারিত বিদায়সম্ভাষণটা রেখে এলাম সবার অগোচরে।