সৌগত তাড়াতাড়ি সব কাজ শেষ করে তৈরি হয়ে বেরোতে যাবে, কেট জিজ্ঞেস করল, এখনই যাচ্ছ? জুতো পায়ে গলাতে গলাতে সৌগত উত্তর দিল, হ্যাঁ, আর কী, দুঘন্টা তো এয়ারপোর্ট পেঁছোতেই লেগে যাবে।

সৌগত কিছুতেই উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছে না। সামনেই সোফাতে ওর দুই ছেলে-মেয়ে চুপচাপ বসে বাবাকে লক্ষ্য করেলেমেয়ে কারওকেই বাবার এই উত্তেজনা স্পর্শ করেছে বলে মনে হল না। পাথরের মতো দুজনে বসে রইল।

সৌগত ইশারায় স্ত্রীর কাছে, ছেলে-মেয়ে চুপ করে থাকার কারণ জানতে চাইল। কেটও ইশারাতেই জানাল চিন্তা না করে, এয়ারপোর্টের জন্য রওনা হতে। সৌগত-র মধ্যে দ্বিধার ভাব লক্ষ্য করে আশ্বাসের সুরে বলল, দেরি কোরো না। মা বাবাকে যতক্ষণে নিয়ে বাড়ি ফিরবে, তার মধ্যে আমরা সবাই চানটান করে রেডি হয়ে থাকব।

একুশ বছর হয়ে গেছে, এই প্রথম শোভনবাবু আর গৌরীদেবী একমাত্র সন্তান সৌগতর গোছানো সংসার একবার চোখের দেখা দেখতে লন্ডন আসছেন। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সেই যে চাকরি নিয়ে বিদেশ এসেছে, আর ফিরে যায়নি সৌগত।

প্রথম এসেই লন্ডনের রিচমন্ড এলাকায় এক কামরার একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিল সে। নীচে বাড়িওয়ালারা থাকতেন আর উপরের একটা ওয়ান রুম কিচেন বাথরুম নিয়ে সৌগত ভাড়াতে থেকে গিয়েছিল। ঘরটা ভারি পছন্দ হয়ে গিয়েছিল তার। ঘরের এক দিকটায় বড়ো বড়ো কাচের জানলা ছিল, যেখানে দাঁড়ালে টেমস নদীটা নজরে পড়ত।

সেসময় ভাড়াও খুব বেশি ছিল না। বাড়িওয়ালার একমাত্র মেয়ে কেট দিব্যি ভাব জমিয়ে ফেলেছিল সৌগতর সঙ্গে। যেদিন অফিস থেকে ফিরতে একটু বেশি দেরি হয়ে যেত সৌগতর, কেট এসে মেন গেট খুলে দিত। গুছিযে রাতের খাবারটা হাতে ধরিযে দিত যাতে, রাত্রে আর সৌগতকে হাত পুড়িয়ে রান্না না করতে হয়।

বিদেশে যেখানে দুটো মনের কথা বলার জন্য মানুষ ব্যাকুল হয়ে ওঠে, সেখানে কেটের মিষ্টি স্বভাব, অপরকে সাহায্য করার মানসিকতা সহজেই সৌগত-র হৃদযে জায়গা করে নেয়। দুজনেই একে অপরের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করতে থাকে। কেট মুখে কিছু না বললেও, তার চোখের ভাষা পড়তে সৌগতর ভুল হয় না।

কেটকে বিয়ে করায় মনস্থ করলে, সব থেকে বড়ো চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় সৌগতর কাছে নিজের মা-বাবা। ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে হয়ে বিদেশিনি খ্রিস্টান মেয়েে বিয়ে করার অনুমতি বাবা কখনও দেবেন না বলেই সৌগত ভেবে নিয়েছিল। পুরোনো দিনের মানুষ তাঁরা। কেটের মা-বাবা সৌগতর মতো জামাই পাবেন বলে আপত্তি করেননি। কিন্তু নিজের মা-বাবাকে কী বলবে সেটাই ভাবতে তিনদিন সময় নিয়েছিল সৌগত।

শেষে মনে সাহস সঞ্চয় করে কলকাতায় নিজের বাড়িতে ফোন করেছিল সে। সোজাসুজি তখন ফোন করার অসুবিধা ছিল। ট্রাংক কল বুক করতে হয়েছিল। বাবা ফোন ধরতেই বিয়ে প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিল সৌগত। কিছুক্ষণ চুপ করেছিলেন শোভনবাবু। তারপর মাযে সঙ্গে কথা বলে জানাবেন বলে ফোন ছেড়ে দিয়েছিলেন।

তারপরের দশটা দিন সৌগতর কী যে অস্থিরতায় কেটে ছিল, আজ ভাবলে হাসি পায়। কিন্তু ফোন করেননি শোভনবাবু বরং মাযে লেখা চিঠি পেয়েছিল সৌগত। ওনাদের শুধু একটাই শর্ত, মেয়ে এবং মেয়ে বাড়ির লোককে কলকাতায় আসতে হবে। বিয়ে কলকাতাতেই হবে। সৌগত শর্তে রাজি হয়ে গিয়েছিল। কলকাতাতেই ধুমধাম করে কেটের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেন শোভনবাবু আর গৌরীদেবী।

বিয়ে দুবছর পর অন্বেষার জন্ম আর পাঁচ বছরের মাথায় অনির্বাণের। ছেলে সংসারে মন দিয়েছে, বিদেশে ছেলেকে দেখাশোনা করার জন্য লক্ষ্মীসম বউমা রয়েছে ভেবেই গৌরীদেবীর মন আনন্দে ভরে উঠত। এর মধ্যে নাতি-নাতনি হওয়ার সুখবর তাঁদের স্বামী স্ত্রী দুজনকেই নতুন করে খুশির সীমাহীন জগতে নিয়ে গিয়ে ফেলে। নাতি-নাতনীর মুখ দেখার জন্য উৎসুক হয়ে ওঠেন। ছেলের আসার অপেক্ষায় দুজনে দিন গুনতে থাকেন।

এরই মধ্যে চাকরি ছেড়ে সৌগত কেটের বাবার প্রকাশনা ব্যাবসায় ঢুকেছে তাঁরই অনুরোধে। দিনরাত খেটে ব্যাবসাকে এমন পর্যায়ে দাঁড় করিযেছে সৌগত, যেখানে লন্ডনের মান্যগণ্যদের মধ্যে সৌগতকে চেনে না এমন কেউ নেই। বাড়ি আলাদা করে আর কিনতে হয়নি তাকে। একমাত্র মেয়েজামাইকে উইল করে বাড়ি লিখে দিয়েছেন কেটের বাবা। তিনি আর তাঁর স্ত্রী অবসর জীবনযাপন করছেন সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়ে। ব্যাবসার দাযিত্ব পুরোটাই সামলাচ্ছে সৌগত।

সময় পেলেই কেট আর বাচ্চাদের নিয়ে কলকাতায় ঘুরে যাওয়াটাও এতদিন দাযিত্ব মনে করেই পালন করেছে সৌগত। কখনও তাঁদের অবহেলা করেনি। লন্ডনে থেকেও নিজে এবং কেট প্রায় প্রতিদিন ফোনে খবরাখবর নিতে ভোলেনি শোভনবাবুর আর গৌরীদেবীর। কিন্তু বাচ্চারা যখন থেকে বড়ো হয়েছে ওদের পড়াশোনা, অন্য কোথাও ছুটি কাটাবার আগ্রহ ইত্যাদি নানা কারণে কলকাতায় যাওয়া-আসাটা অনেকটাই কমিয়ে ফেলতে হয়েছে সৌগতকে।

গতবছর পুজোর আগে কেট কলকাতার খবরাখবর নেওয়ার জন্য ফোন করলে, গৌরীদেবী মনের ইচ্ছেটা প্রকাশই করে ফেলেন কেটের কাছে, কেট অনেকদিন হয়ে গেল তোমরা ইন্ডিয়া আসোনি। এবার শীতে কিছুদিনের জন্য ঘুরে যাও। তোমাদের সকলকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

কেট কিছুটা ইতস্তত করে জবাব দেয়, না মা এখন কিছুতেই আসা সম্ভব নয়। বাচ্চাদের ক্লাস এখন একেবারেই মিস করানো যাবে না।

ওপারের স্তব্ধতা কেটকে বিচলিত করে। একটু ভেবে হঠাৎই বলে, মা আপনারা বরং এখানে চলে আসুন। সকলকে দেখা হবে আর একটু ঘোরাও হয়ে যাবে। কলকাতা ছেড়ে আপনারা তো কোথাওই যান না। চলে আসুন। আপনার ছেলেকে বলব সব ব্যবস্থা করে দেবে।

ব্যস তারপর দৌড়োদৌড়ি, ভিসার কাগজপত্র জমা দেওয়া, আরও যা কিছু করণীয়। সবশেষে আজ শোভনবাবু আর গৌরীদেবী সুদূর লন্ডনে পা রাখতে চলেছেন। প্রথম বিলেত সফর সুতরাং উত্তেজনায় দুজনেই প্লেনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গহ্বরেও ঘেমে নেয়ে উঠছেন।

 

সৌগত অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল, প্লেন কখন ল্যান্ড করবে। দূর থেকে বাবাকে আগে দেখতে পেয়ে হাত নাড়ল সৌগত। শোভনবাবু একটু স্বস্তি বোধ করলেন। এই দূর অচেনা মাটিতে তাঁর আসার ইচ্ছে একবিন্দুও ছিল না। কী করবেন, স্ত্রীর জোরাজুরিতে আর ছেলে-বউমার বারবার অনুরোধে তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতেই হল।

ভিড় ঠেলে সৌগত এগিয়ে এল। বাবার হাত থেকে ব্যাগেজের ট্রলিটা জোর করে নিজের হাতে নিতেই মা এসে জড়িয়ে ধরলেন ছেলেকে। চোখের জল বাঁধ মানল না। একমাত্র সন্তানকে কাছে পাওয়ার আনন্দ অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ল গৌরীদেবীর দুচোখ বেযে সৌগতও চোখের ভেজা ভাবটা অনুভব করল। পরিস্থিতি হালকা করতে মা-কে জড়িয়ে ধরে মুখে হাসি টেনে বলল, মা, তুমি সবে এসেছ। তোমার কান্না দেখে সবাই ভাববে তোমাকে সব কিছু ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে।

বাড়ির পথে অবাক হয়ে তাকিযে রইলেন শোভনবাবু আর গৌরীদেবী গাড়ির কাচে চোখ রেখে। হুহু করে পেরিযে যাচ্ছে রাস্তা। চারিদিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, রাস্তায় কুকুর বেড়াল চোখে পড়ে না। সর্বত্র অনুশাসনের ছাপ স্পষ্ট। রাস্তার ধারে ধারে সবুজের সমারোহ মন কেড়ে নেয়। হর্নের কান ফাটানো আওয়াজ, ট্র‌্যাফিকের ভিড় নেই কোথাও।

অন্যমনষ্কতা ভাঙল সৌগতর কথাতে। হাঁ করে কী দেখছ তোমরা? আজ তোমাদের ভাগ্য ভালো যে রোদ উঠেছে নয়তো বেশিরভাগ সময়ই বৃষ্টির আবহাওয়া থাকে এখানে।

গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কেট ওনাদের আসার অপেক্ষা করছিল। গাড়ি এসে দাঁড়াতেই সানন্দে গেট খুলে কেট ওনাদের বাড়ির ভিতরে স্বাগত জানাল। সৌগত গাড়ি থেকে সুটকেস নামিয়ে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেল। নীচের তলাতেই একটা বড়ো ঘরে কেট ওনাদের থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছিল। সুটকেসগুলো ওই ঘরে দিয়ে ওনাদের ফ্রেশ হতে বলে কেট চা-জলখাবার আনতে কিচেনে চলে গেল।

সৌগত বাথরুমে গরমজলের ব্যবস্থা সব দেখিযে বাইরে এসে বসল। দুজনে হাত-মুখ ধুযে ঘাড়ে মাথায় সামান্য গরমজল বুলিযে নিলেন। তাতে ধকলটা একটু কম মনে হল। বাইরের পোশাক ছেড়ে সুটকেস খুলে পরিষ্কার জামা-কাপড় বার করে পরে বাইরে এলেন।

সৌগত সোফাতেই বসে ছিল। কেট জলখাবারের ট্রে হাতে নিয়ে ঢুকে টেবিলে নামিয়ে ওনাদের সামনে খাবার আর চায়ের কাপটা এগিয়ে দিল।

কী ব্যাপার অন্বেষা আর অনির্বাণকে দেখছি না কেন? ওরা কোথায়? গৌরীদেবী আর শোভনবাবুর চোখ আদরের নাতি-নাতনিকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।

সৌগত ওদের নাম ধরে ডাকতেই দুজনে উপর থেকে নীচে নেমে এল। চোখের ইশারায় ওদের ঠাকুমা-ঠাকুরদাকে প্রণাম করার কথা বলতে, দুজনে প্রণাম করে দাঁড়াতেই ওদের বুকে টেনে নিলেন দাদু-ঠাকুমা।

অন্বেষা আর অনির্বাণ তোমরা কত বড়ো হয়ে গেছ! কলকাতায় শেষ যখন এসেছিলে তখন বেশ ছোটো ছিলে। কতদিন হয়ে গেছে তোমাদের দেখিনি। বলতে বলতে চোখে জল চলে আসে গৌরীদেবীর।

অথচ এই ইমোশন যেন ছুঁতে পারে না বিদেশের মাটিতে বড়ো হওয়া অন্বেষা আর অনির্বাণ-কে। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে দুজনে, মুখে ফুটে ওঠে বিরক্তির ভাব। দুজনের ব্যবহারে মনে মনে বিরক্ত বোধ করে সৌগত। ভিতরে ভিতরে রাগ বাড়তে থাকে তার। কুশল বিনিময়টুকু করতে ভুলে গেছে কী করে তার সন্তানেরা। কেট মুহূর্তে পড়ে ফেলে সৌগতর মন। পরিস্থিতি সামাল দিতে ছেলেমেয়ে দিকে তাকিযে কেট বলে, তোমরা এখন যাও, পড়াশোনা শেষ করো।

ছোটো থেকেই কেট ভারতীয় সংস্কৃতিকে ভালোবেসে এসেছে। বাড়ির আশেপাশে বহু ভারতীয় পরিবারকে খুব কাছের থেকে দেখেছে। সৌগতর সঙ্গে বিয়ের পর সেই ভালোবাসা আরও গাঢ় হয়েছে। ফলে সৌগতর মা-বাবাকে আপন করে নিতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি কেটের। শ্বশুর-শাশুড়ির থেকেও পেয়েছে স্নেহের উষ্ণতা। সবাইকে নিয়ে সুন্দর সংসার গড়ে তোলার পরিকল্পনা সবসমযে কেটের মনের মধ্যে লালিত হয়েছে। কিন্তু এই একটা জায়গায় এসে সে হেরে গেছে। দুই সন্তানকে যেমনটা চেযেছে তেমন করে মানুষ করতে পারেনি। সে নিজেও এই বিদেশের মাটিতে জন্মেছে কিন্তু বড়োদের অসম্মান করার মানসিকতা কখনও তার হয়নি।

পাশ্চাত্য দেশের ছেলেমেয়েরা অনেকটাই আলাদা। নিজের শিকড়কে অস্বীকার করে বিদেশের সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরার মানসিকতা প্রবল তাদের মধ্যে। অন্বেষা এখন আঠারো বছরের আর অনির্বাণ পনেরো। কিন্তু বিদেশের আদব-কায়দা তাদের রক্তের ভিতর ঢুকে গেছে। কেটের ক্ষমতা নেই তাদের সেখান থেকে বার করে নিয়ে আসে।

শোভনবাবু আর গৌরীদেবী কিছুটা পরিবেশের সঙ্গে ধাতস্থ হলে, সৌগত আর কেট ওনাদের নিয়ে উইক-এন্ডে সারা লন্ডন ঘুরিযে ঘুরিযে দেখিযে নিয়ে এল। লন্ডনের মিউজিয়াম দেখে শোভনবাবু একটাই মন্তব্য করলেন, এই ব্রিটিশরা শুধু ভারতবর্ষকে নয়, সমগ্র বিশ্বকে লুঠ করে নিজের দেশকে ধনী বানিয়েছে।

 

শোভনবাবুদের আসার তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। সৌগতর সময় না হলেও কেট ওনাদের নানা জায়গায় ঘুরিযে এনেছে। ভারতীয় সংস্কৃতির তুলনায় লন্ডনের সংস্কৃতি যে সম্পূর্ণ ভিন্ন, তা এতদিনে বেশ বুঝতে পেরেছেন শোভনবাবুরা। এখানে সবাই ব্যস্ত। কারও জন্যই কারও কাছে সময় নেই। সন্তানদের নিজেদের জীবন নিয়ে ভাবার স্বাধীনতা দেওয়া আছে। মা-বাবার সেখানে কিছু বলা চলবে না। বিয়ে আগে একসঙ্গে থাকা বা পছন্দ না হলে ছেড়ে চলে যাওয়াটা এখানে কেউ গুরুত্ব দিয়ে দেখেই না। অদ্ভুত এক মিশ্র সংস্কৃতির বাড়-বাড়ন্ত। যা-কিনা গৌরীদেবী বা শোভনবাবু কেউই মন থেকে মেনে নিতে পারছিলেন না কিছুতেই।

প্রথমে এসেই গৌরীদেবী খেযাল করেছিলেন, সৌগত আর কেট কেউই সকালে অফিস যাওয়ার সময় খেযে বেরোয় না। একদিন না থাকতে পেরে বলেই ফেললেন, তোদের সময় না থাকে, আমি সকালে কিছু একটা বানিয়ে দেব। এভাবে না খেযে সারাদিনের জন্য বেরোনো উচিত নয়।

এতে সৌগত হেসে উত্তর দিয়েছিল, মা তুমি মিথ্যা চিন্তা করছ। আমরা রাস্তা থেকে স্যান্ডউইচ আর কফি কিনে খেযে নিই। দুপুরেও অফিসে আর সবার মতো পাশেই একটা রেস্তোরাঁ থেকে খাবার নিয়ে এসে অফিসেই খেযে নিই। কেট-ও তাই করে। বাবা আর তুমি টিভি দ্যাখো, এনজয় করো। আমাদের নিয়ে ভেবো না। এই লাইফে আমরা অভ্যস্ত।

আর কিছু বলেননি গৌরীদেবী। ছেলের সংসার যেমন চলছিল তেমনিই চলতে লাগল। বাচ্চারা স্কুল, কলেজ বেরিযে যেত, সৌগত নিজের ব্যাবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল আর কেট বাড়ি আর অফিস একসাথে সামলাতো।

কিছুদিন ধরে গৌরীদেবী দেখছিলেন অন্বেষা যখন কলেজ থেকে ফেরে, একটা কালো মতন ছেলে ওকে ছেড়ে দিয়ে যায়। অন্বেষার থেকে বয়সে অনেকটাই বড়ো মনে হল ছেলেটিকে। একদিন সন্ধেবেলা জানলায় দাঁড়িয়ে বাইরের শোভা দেখছিলেন গৌরীদেবী। হঠাৎ-ই খেযাল হল রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ির আড়ালে, অন্বেষা আর ছেলেটি গভীর চুম্বনে ব্যস্ত।

পায়ে তলার মাটি কেঁপে উঠল তাঁর। কী বয়স অন্বেষার আর এখনই এইসব করে বেড়াচ্ছে! তারপরেই মনে হল যে-দেশে বড়ো হচ্ছে বাচ্চারা, সেখানকার সংস্কৃতিকেই ওরা আপন করে নেবে, এতে দোষটা কোথায়? ওরা তো যেমন দেখবে তেমনই শিখবে। অগত্যা চুপ করে গেলেন, কাউকে কিছু বলা উচিত মনে করলেন না।

শুধু নিজের স্বামীকে না জানিয়ে পারলেন না, এই তো একটা বাচ্চা মেয়ে, কোনও ভুল পথে পা দেবে না তো? শোভনবাবু স্ত্রীকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, এত চিন্তা কোরো না, কিছু একটা উপায় বার করতে হবে! আমি দেখছি কী করা যায়।

 

সকাল সকাল চায়ের কাপ হাতে নিয়ে গৌরীদেবী ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। দূর পর‌্যন্ত বিস্তৃত রিচমন্ড হিল এবং টেম্স নদীর সৌন্দর‌্য এক মনে অবলোকন করছিলেন। সেন্ট পিটারস্ চার্চ-টা এখান থেকেই চোখে পড়ে আর তার চারপাশে মনোরম সবুজ ঘাসের গালিচা মুহূর্তে মন উদাস করে দেয়।

কিন্তু প্রকৃতির এই অপরূপ শোভা কিছুতেই গৌরীদেবীর মনকে শান্ত করতে পারছিল না। গত সন্ধের দৃশ্যটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। মনে মনে উদ্বিগ্ন বোধ করছিলেন। খানিক পরে কেটও চায়ের কাপ নিয়ে গৌরীদেবীর পাশে এসে দাঁড়াল। কিছুটা সংকোচ কাটিযে সন্ধের ঘটনাটা খুলেই বললেন কেটকে, তোমাকে না বলে পারলাম না তুমি মা। ও আমাদের বাড়ির সন্তান। ঘটনাটা এড়িয়ে তো যেতে পারি না।

তুমি ঠিক বলেছ মা। তোমার চিন্তা করাটাই স্বাভাবিক। অন্বেষা যেটা করেছে অন্যায়, আমি সেটা বুঝি। কিন্তু এখানে আমরা কিছুই বলতে পারব না কারণ এটা ওর জীবন। এখানকার সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতির থেকে অনেক আলাদা। ছোটো থাকতেই এখানে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। অনেক সময় সেটা বিয়ে অবধিও গড়ায়। আবার কখনও সম্পর্ক ভেঙেও যায়। এটা ওদের সম্পূর্ণ নিজস্ব ডিসিশন। এটা আমাদের হাতের বাইরে। খুব অল্প শব্দের মধ্যে কেট ওযে্টার্ন সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ শাশুড়িকে পরিষ্কার করে বুঝিযে দিল ঠিকই কিন্তু গৌরীদেবী কিছুতেই এটা মন থেকে মেনে নিতে পারলেন না।

কলেজের জন্য তৈরি হতে হতে মা আর ঠাকুমার কথাবার্তা সবই অন্বেষার কানে এসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুমার এই অনাবশ্যক নাক গলানো ওর কাছে অসহ্য মনে হল। অন্বেষা ব্যালকনিতে এসে কেটকে লক্ষ্য করে বেশ জোর দিয়ে বলল, মম, আজ সন্ধে বেলায় ফিরতে আমার দেরি হবে। আমি আমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে একটা পার্টি-তে যাব। আমার ফেরার অপেক্ষা কোরো না, বলে ব্যাগ নিয়ে বেরিযে গেল।

সবাই সবার মতো কাজে বেরিযে গেলে শোভনবাবু খবরের কাগজ নিয়ে বসতেন। খবরের কাগজের নানা ঘটনা নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতেন। তাতেই গৌরীদেবী আরও বেশি করে ওখানকার কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে নানা ধরনের মানসিক সমস্যা বাড়তে থাকার ঘটনাগুলো সম্পর্কে জানতে পারতেন। ওখানকার ছেলেমেযো অল্প বয়সেই অবসাদের শিকার, কিশোরাবস্থায় গর্ভধারণ, হিংসাত্মক প্রবৃত্তি, অসামাজিক ব্যবহার, ছোটো থেকেই ড্রাগ ও মাদকদ্রব্যে আসক্তি বাড়া ইত্যাদি নানা খবর গৌরীদেবীকে আরও বেশি করে চিন্তাগ্রস্ত করে তুলতে লাগল।

একদিন যখন শোভনবাবু স্ত্রীর সঙ্গে বসে এগুলো নিয়ে আলোচনা করছেন, সৌগত এসে হাজির হল সেখানে। মন দিয়ে বাবার কথা শুনতে শুনতে বলে উঠল, বাবা, এখানে বাচ্চাদের মুখে বলে বোঝাতে পারো তো খুব ভালো। যদি তোমার কথা মেনে নিল তাহলে তোমার ভাগ্য! তুমি কোনও ভাবেই ওদের উপর জোর ফলাতে পারবে না।

কিন্তু এটা তো ভুল শিক্ষা। মা-বাবা, বাড়ির বড়োরা, শিক্ষকেরা সন্তানের ভালো চান বলেই না তাদের বকাবকি করেন, শাসনে রাখেন। তারা তো ছেলেমানুষ, এটাই তো শেখার বয়স। সঠিক শিক্ষা দিতে হবে, বোঝাতে হবে তবেই না ওরা শিখবে। শোভনবাবু নিজের মতামত জোরের সঙ্গে ব্যক্ত করলেন ছেলের কাছে।

তোমার কথা ঠিক, আমি মানছি বাবা। এখানেও এখন এই পয়েন্টগুলো অনেকেই তুলছেন। তোমার মতোই তাদেরও একই মত। কিন্তু কী করা যাবে, এখানকার আইন তো অন্যরকম। সৌগতর কথা শেষ হওয়ার আগেই অন্বেষা এসে ঘরের মধ্যে দাঁড়াল। ওহ… কাম অন ড্যাড, তুমি কাকে কী বোঝাবার চেষ্টা করছ? এখানে শুধু জেনারেশন গ্যাপ-ই নয় সংস্কৃতিরও একটা বিরাট পার্থক্য আছে।

অন্বেষা যবে থেকে মা আর ঠাকুমার কথাগুলো শুনেছিল, তবে থেকেই ঠাকুরমার প্রতি একটা অসন্তোষ ওর মনের মধ্যে জমা হচ্ছিল। ঠাকুমার সঙ্গে কথা বলা একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছিল। চোখের দৃষ্টিতে সুযোগ পেলেই মনের ভাব প্রকাশ করে ফেলতে দ্বিধা করত না অন্বেষা। কথার মাঝে কটুক্তি করে সোজা নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিত।

সৌগত আর কেটের মধ্যে কথা হচ্ছিল। সৌগত বলছিল কেটকে, কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি, অন্বেষা অনেক বদলে গেছে। অনির্বাণও। তুমি কি কিছু জানো?

না, তবে ওদের এখন পিউবার্টি-র সময় যাচ্ছে। চারিত্রিক একটু পরিবর্তন তো হবেই। তোমাকে বলা হয়ে ওঠেনি সৌগত, অনির্বাণ একটা স্কলারশিপ পেয়েছে। ঠিক কলেজে বলব না, অন্য ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়েছিল। সেরকম একটা কলেজ থেকে ডাক এসেছে, যারা কমপ্লিট স্কলারশিপ দেবে বলেছে। দুই বছরের কোর্স আর কলেজটা পাকিস্তানের লাহোরে।

চমকে ওঠে সৌগত, পাকিস্তান? পাকিস্তান কেন, লন্ডন ছেড়ে কেউ পাকিস্তান যায়?

অনির্বাণ পাকিস্তানে গিয়ে পড়তে চায়। অনেক বুঝিযেছি কিন্তু মনে হচ্ছে ব্রেনওয়াশ করেছে কেউ। কেটের মনের সন্দেহ কণ্ঠে ফুটে ওঠে।

এই সময় শোভনবাবুও ঘরে এসে ঢোকেন। ছেলে-বউমার কথাবার্তা কিছুটা ওনার কানে গিয়ে পৌঁছোয়। নিজেই এগিয়ে এসে বলেন, কিন্তু কেট তোমাদের ওকে এতদূরে পাকিস্তানে পাঠানো ঠিক হবে বলে মনে হয় না। বাচ্চা ছেলে এত দূরের শহর বাছার কী দরকার ছিল। তার ওপর তোমরা ওখানে কাউকে চেনো না। বিপদ-আপদ ঘটলে কী করবে?

বাবা, জানোই তো আমরা বললেও কিছুতেই শুনবে না অনির্বাণ। ও মনস্থির করে ফেলেছে, হতাশ শোনায় কেটের স্বর।

সৌগত আর কেটের মত আছে শুনে আর কথা বাড়ালেন না শোভনবাবু। কিন্তু মনটা অনির্বাণের জন্য খচখচ করতে লাগল। লন্ডনে জন্ম, বড়ো হওয়াও এখানে। এসব ছেড়ে লাহোর গিয়ে কেন ও পড়াশোনা করতে চাইছে? আসতে হলে ভারতে আসতে ক্ষতি কী ছিল? এখানে ওর আপনজনেরা রয়েছে, নিজের দেশ সেটা। এইসব ঘটনাচক্র ধীরে ধীরে শোভনবাবু আর গৌরীদেবীর মন ভারাক্রান্ত করতে লাগল।

একদিন সবাই বাইরে কাজে বেরিযে যাওয়ার পর, গৌরীদেবী কযেদিন ধরে বহন করা মনের কথাটা স্বামীর কাছে তুলে ধরলেন, অনেক তো হল, চলো এবার আমরা দেশে ফিরে যাই। ছেলে কেমন সংসার করছে নিজের চোখে একবার দেখার ইচ্ছে ছিল, দেখা হয়ে গেছে। এক মাসের ওপর আমরা এখানে রয়েছি। আর ভালো লাগছে না।

কলকাতার জন্য খুব মন কেমন করছিল গৌরীদেবীর। অনেক পুরোনো বাসিন্দা ওনারা। আশেপাশের বহু প্রতিবেশী খোঁজখবর নিতে আসে শোভনবাবুর কাছে। বিজয়ার সময় সকলে এসে পায়ে হাত দিয়ে দুজনকে প্রণাম করে যায়। তাদের ভালোমন্দের খবরটুকু তারাই কেউ না কেউ এসে নিয়ে যায় প্রায়দিনই। বিশেষ প্রযোজনে তারাই সবসময় এগিয়ে আসে। কতদিন হয়ে গেছে, তাদের কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না। ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে পড়েন গৌরীদেবী।

শোভনবাবু স্ত্রীকে ভালোমতোই জানেন, তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয় না এতটুকুও। তাঁর নিজেরও আর ভালো লাগছে না। অগত্যা উঠে শোভনবাবু সৌগতর ঘরের দিকে চললেন ছেলেকে ইন্ডিযা ফেরার টিকিট কেটে দেওয়ার জন্য বলতে। অনির্বাণের ঘরের সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অনির্বাণের ঘর থেকে ভেসে আসছে ওরই গলা। ও নিজেকে কারও কাছে খালিদ হাসান বলে দাবি করছে।

দরজায় কান পাতলেন শোভনবাবু। অনির্বাণ এটা কী বলছে? সে নিজেকে কেন খালিদ হাসান বলছে? ওর স্বর ভেসে এল বন্ধ দরজার বাইরে, হ্যাঁ, ওমর শরিফের কথা আমিও শুনেছি। তিনিও এখানকার কিংস কলেজ থেকে পড়াশোনা করেছেন। তিনজন ব্রিটিশ এবং একজন আমেরিকানকে কিডন্যাপ করার জন্য ভারতে ধরা পড়েন। এর পর

যাত্রী-সহ এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেন হাইজ্যাক করেন, আমেরিকান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বোমা মেরে উড়িয়ে দেন এবং ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ড্যানিয়ে পার্লকেও কিডন্যাপ করে হত্যা করেন। আমার ওনার জন্য গর্ব হয়। জানি অনেকগুলো বছর আমরা পেরিযে এসেছি তবুও। হ্যাঁ আমি জানি, সিরিযাতে হাজারের বেশি ব্রিটিশ ছেলে-মেয়ে জিহাদের জন্য লড়াই করছে। আমি ওদের জন্য গর্ব অনুভব করি।

এরপর সব চুপচাপ। শোভনবাবু বুঝলেন ফোনের ওপার থেকে অনির্বাণ কারও কথা শুনছে। খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। আবার অনির্বাণের গলা শুনতে পেলেন। ও বলছে, আপনি চিন্তা করবেন না। অন্বেষা আগে যাবে, কযেদিনের মধ্যে আমি আসছি। নেটওয়ার্কিং সাইটে দেখে নিয়েছি পুরো ব্যবস্থা করা হবে। যখন আপনারা আমাদের সব সুবিধার খেযাল রাখছেন তখন আমরাও পিছু হটব না।

যে-লক্ষ্য নিয়ে যাব সেটা সম্পূর্ণ করেই আসব। কথা দিচ্ছি শেষ নিশ্বাস পর‌্যন্ত জিহাদের জন্য লড়ব। কেউ বাধা দিতে চাইলে পৃথিবী থেকে তাকে সরিযে দেব।

শোভনবাবুর হাত-পা কাঁপছিল। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। পনেরো বছরের ছোট্ট ছেলেটা এসব কী বলছে? কোনওমতে শরীরটাকে টেনে এনে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। চিন্তা করার ক্ষমতাও লোপ পেয়েছে। ভিতর থেকে একটা শূন্যতা যেন পাক দিয়ে দিয়ে উঠে শোভনবাবুর গলা চেপে ধরেছে।

খানিক্ষণ সেভাবেই পড়ে রইলেন। ভাবলেশহীন শুধু একটা শরীর। অনেক কষ্টে নিজেকে টেনে তুললেন। এই জন্যই কি অন্বেষা আর অনির্বাণ লন্ডন ছেড়ে পাকিস্তান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে? ওরা কি কোনও সন্ত্রাসবাদী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে? ওরা কি ধর্মান্তরিত হয়েছে? তাঁর নিজের পরিবার শেষে এভাবে ভাঙতে চলেছে? এসব নানা প্রশ্নের কোনও উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না শোভনবাবু। একটা নিঃশব্দ বেদনা, অস্থিরতা, তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। কী করবেন তিনি? বাচ্চাদের শাসন করবেন? ভালোবেসে লজিক দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করবেন? চিন্তায় চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছিল শোভনবাবুর।

এতদিন খবরের কাগজেই পড়ছিলেন, লন্ডনের রাস্তায় জিহাদের কালো ঝান্ডা তুলে বুক ফুলিযে সব ঘুরে বেড়াচ্ছে। অক্সফোর্ড স্ট্রিট, আরও অনেক জায়গায় আইএস-এর মতো সন্ত্রাসবাদী গ্রুপের সমর্থনকারীদের দেখা গেছে। কিন্তু কে জানত তাঁর নিজের পরিবারেও সন্ত্রাস তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছে? কে ভাবতে পারে একটা শিক্ষিত, সম্পন্ন, সাংস্কৃতিক পরিবারের ছেলেমেয়ে সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন ছেড়ে এভাবে জীবন নষ্ট করতে গর্ব অনুভব করবে!

কিন্তু হেরে গেলে চলবে না। মন শক্ত করেন শোভনবাবু। একসময় দেশের জন্য লড়েছেন। দুচোখ ভরে দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছেন। আর এ তো নিজের পরিবার বলে কথা। মন শক্ত করে উঠে দাঁড়ান। পরিস্থিতি কীভাবে সামলাবেন একটা ছক কষেন মনে মনে।

 

সেদিন সকালে একটু তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যাওয়াতে গৌরীদেবী চোখে-মুখে জল দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। বড়ো প্রিয় এই জায়গাটা ওনার। সবে আলো ফুটতে আরম্ভ করেছে। খেযাল করলেন এক পাশে চুপ করে কেট দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি সুদূর প্রসারী। এত তাড়াতাড়ি উঠে কী করছে মেযো চিন্তিত হলেন! ডাকলেন, কেট।

ওঃ তুমি উঠে পড়েছ, চমকে ফিরে তাকাল কেট। কেটের চোখ-মুখের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে গৌরীদেবী কাছে এসে দাঁড়ালেন, এ কী অবস্থা, সারা রাত ঘুমোওনি? কী হয়েছে?

কেটের মুখ থেকেই জানলেন, অন্বেষা গর্ভবতী। কালো ছেলেটি ওর সঙ্গেই কলেজে পড়ত। হঠাৎই কলেজ ছেড়ে কোথাও চলে গেছে। ফোন করেও কোনও লাভ হচ্ছে না। সুইচ অফ। অগত্যা নিরুপায় হয়ে গত রাতে মা-র কাছে সবকিছু খুলে বলেছে অন্বেষা।

নিজের মেয়ে হলে হয়তো গাযে হাত তুলে দিতেন গৌরীদেবী কিন্তু একটা মাত্র নাতনি, বড়ো মায়া ওর উপর। রাগ দমন করে কেট-কে শান্ত করলেন। বেলা বাড়লে কেট এবং অন্বেষার সঙ্গে ডাক্তারের কাছে গেলেন। সেখান থেকে গর্ভপাত করাবার জন্য ওনাদের হাসপাতালে পাঠানো হল। এক সেকেন্ড-ও অন্বেষার বিছানার পাশ থেকে উঠলেন না গৌরীদেবী। শক্ত করে অন্বেষার হাত ধরে রইলেন। বাড়ি ফেরা না অবধি সেই হাত আর ছাড়লেন না।

অ্যানি বলে কোনওদিনই গৌরীদেবী নাতনিকে ডাকেননি। অন্বেষাই বলে এসেছেন বরাবর। অন্বেষার এটা একেবারেই পছন্দ ছিল না। কিন্তু ঠাকুমার এই ডাকে এখন আর তার বিরক্ত লাগে না। ওর মধ্যে এই পরিবর্তনটা দেখে আর কেউ না হোক, কেট সবথেকে খুশি হয়েছিল। গৌরীদেবী কত গল্প বলেছেন কেট-কে। যে-গ্রামে গৌরীদেবী জন্মেছেন, বড়ো হয়েছেন সেখানকার গল্প। কলকাতায় বিয়ে হয়ে এসে শহুরে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। শ্বশুরবাড়ির একান্নবর্তী পরিবারে সকলের মন জিতে নেওয়া সব শুনিয়েছেন কেট-কে। কেটও নিজের দেশ ছেড়ে ভারতীয় সংস্কৃতির উপর অসম্ভব একটা টান অনুভব করে।

 

এখন অন্বেষাও বাড়ি এলেই ঠাকুমার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। কলকাতার গল্প শুনতে চায়। অবাক হয়ে শোনে। এত গুরুত্ব দেওয়া হয় মানুষের সম্পর্ককে যে, ও নিজের জন্মস্থানকে তুলনা করে ভারতের সঙ্গে। সম্পর্ক শব্দটা যে এত দামি, ধীরে ধীরে এখন বুঝতে শিখেছে অন্বেষা।

অন্বেষাকে নিয়ে আর কোনও চিন্তা ছিল না শোভনবাবুদের কিন্তু অনির্বাণকে নিয়ে কী করা যাবে তা ভেবে কূল পাচ্ছিলেন না।

সন্ধেবেলায় অন্বেষা আর গৌরীদেবী বারান্দায় বসে কেটের দেওয়া গরম গরম সু্প খেতে খেতে গল্পে মেতেছিলেন। সৌগত তখনও বাড়ি ফেরেনি। অনির্বাণ-কে, বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকতে দেখে শোভনবাবু এগিয়ে এলেন, অ্যান, আজকের খবরটা শুনেছ? ফ্রান্সের নিস শহরে সন্ত্রাসবাদী হামলার? এরা এত অমানুষ যে, ওখানকার সাধারণ নাগরিকদের মেরে ফলতে ওদের হাত কাঁপে না। আর এরাই মুখে শান্তির কথা বলে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েছের নিজেদের জালে ফাঁসায়। ভগবান এদের ঠিক শাস্তি দেবেনই।

শোভনবাবু যেটা চাইছিলেন, সেটাই হল। তির লক্ষ্যভেদ করল। সন্ত্রাসবাদীদের সাপোর্ট করে অনির্বাণ মুখ খুলল, তুমি কি জানো ওদের বিষযে ওদের উদ্দেশ্য আর আইডিযালিজম আমাদের থেকে অনেক বেশি উন্নত। আমরা শুধু নিজেদের কথা ভাবি আর ওরা দেশ, ধর্ম সবকিছুকে বাঁচাবার লক্ষ্যে লড়ছে। এটা সন্ত্রাস নয়, জেহাদ। জেহাদের বিষযে কখনও শুনেছ তুমি?

অ্যান, আমার জন্ম ভারতে। সেখানকার মাটি আজ কত বছর ধরে সন্ত্রাসের শিকার। তুমি যে-জেহাদের কথা বলছ, সেটা আমি মন থেকে মানি না। জেহাদের মাধ্যমে যদি স্বর্গের রাস্তা খুলে যায়, তাহলে বড়ো বড়ো পলিটিশিযান, ধনী ব্যক্তিদের ছেলেমেযো দূর বিদেশে গিয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আরামদায়ক জীবন যাপন করছে কেন? কেন তারাও আর-চারটে সাধারণ ছেলেমেয়ে মতোই, জেহাদের জন্য নিজেদের হাতে বন্দুক তুলে নিচ্ছে না? আর যারা সন্ত্রাসের বাণী দিচ্ছে, তারা সামনে না এসে সোশ্যাল মিডিয়ার পর্দার আড়ালে লুকিযে অপরকে নির্দেশ দিচ্ছে আর মরবার জন্য অন্যের বাড়ির ছেলে-মেয়েদের বোকা বানাচ্ছে!

তোমরা এখনকার প্রজন্ম, ইন্টারনেট গুলে খেয়েছ। নেটে গিয়ে দ্যাখো যাদের বাড়ির জোয়ান ছেলে সন্ত্রাসে নাম লিখিযে মারা গেছে, তাদের কী হাল? এরা গরিবকে অর্থের লোভ দেখিযে সন্ত্রাসবাদী বানায় আর অর্থের প্রযোজন নেই যাদের, তাদের ব্রেনওয়াশ করে। বাড়ির এক ছেলে মারা গেলে অন্য ছেলেদেরও এরা দলে টানার চেষ্টা করে। এভাবে একটা প্রজন্ম থেকে আরেকটা প্রজন্মের ছেলেমেয়ে জীবনও নষ্ট করে, বাধ্য করে সন্ত্রাসে নাম লেখাতে।

শোভনবাবু, সরাসরি অনির্বাণকে কথায় আক্রমণ না করে আশেপাশের পরিস্থিতির উদাহরণ দিয়ে ওকে বোঝাতে সফল হচ্ছেন, সেটা অনির্বাণের মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলেন। ভযে ওর মুখ শুকিয়ে এসেছিল। লন্ডনের ঠান্ডাতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছিল অনির্বাণের কপালে। শোভনবাবুর কথাগুলো যে কতটা সত্যি, সেটা মনে মনে অস্বীকার করার জায়গা ছিল না অনির্বাণের।

পরের তিনদিন ঘর থেকে কোথাও বেরোল না অনির্বাণ। ভেতরে ফোনে মাঝেমধ্যেই কথা বলার আওয়াজ খালি কানে আসত বন্ধ ঘরের দরজা ভেদ করে। শোভনবাবু ছাড়া কেউই এর নেপথ্যের ঘটনা কিছু জানত না, তাই কেউই অনির্বাণের এই ব্যবহারে চিন্তিত হল না।

একমাত্র শোভনবাবুই মাঝে মাঝে নাতির ঘরের সামনে এসে দাঁড়াতেন। ঘরের ভিতর ঢোকার প্রবল ইচ্ছেটাকে দমন করে আবার ফিরে আসতেন। নিজের উপর এবং নিজের রক্তের উপর একবারের জন্যও বিশ্বাস হারাতে দেননি।

তিনদিনের দিন দরজা খুলে অনির্বাণ যখন বাইরে এল, শোভনবাবু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। অনির্বাণের দুচোখে শুধু হাজারো প্রশ্নের ভিড়। শোভনবাবু ওর হাত ধরে বাইরের ঘরে এসে বসলেন। সামনে কেট-কে দেখে অনির্বাণ শোভনবাবুর দিকে তাকিযে সামান্য হেসে বলল, মা, আমি পাকিস্তান যাচ্ছি না। আমি খোঁজ নিয়েছি কোর্সটা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়।

 

সপ্তাহের শেষে ছুটির দিন দেখে সৌগত, মা-বাবার ইন্ডিযা ফেরত যাওয়ার টিকিট বুক করার জন্য, ইন্টারনেটে বসে তারিখ জিজ্ঞেস করছিল শোভনবাবুকে। সে সময় অন্বেষা ঘরে ঢোকে, দাদা, আমি তোমাদের সঙ্গে ভারতে যেতে পারি? শোভনবাবুকে জিজ্ঞেস করে অন্বেষা।

ওটা তোমার নিজের বাড়ি। অবশ্যই তুমি আমাদের সঙ্গে যেতে পারো, আর যতদিন ইচ্ছে থাকতে পারো।

আর দিদি চলে গেলে আমি বুঝি এখানে একা থাকব? অনির্বাণও ঘরে এসে ঢোকে।

প্লেনের জানলা দিয়ে টুকরো টুকরো মেঘগুলোর ইতিউতি ভেসে বেড়ানো দেখছিলেন শোভনবাবু আর গৌরীদেবী। ওই একই সময় অন্বেষা আর অনির্বাণ মোবাইলে মা-বাবার সঙ্গে নানা পোজে সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...