গর্গর্- গর্গর্-ফচাক্। গর্গর্… গর্র্র্র্-অর্র্র্-ফচাক্। নয় দশবার গার্গেলের পর শুরু হল“ ঘ্যাঙর ঘ্যাং, ঘ্যাসো, ঘ্যাসো, অ্যা…অ্যা… থু থু থুঃ!’

‘খ্যাক থু করতে পারো না মুখ ঝুঁকিয়ে মাধ্যাকর্ষণের ওপর ভরসা করার কী আছে? ও কী? ওয়াক তুলছ যে! কচি বাচ্চা নাকি যে কফ তুলতে গিয়ে বমি করে ফেলবে? এখন ঠ্যাকায় পড়ে গার্গেল করছ। রোজ একটু ভেপার নিতে কী হয়?’

কাশির দমকে বলাকা, শীর্ষের কথার জবাব দিতে পারল না।

শীর্ষ বলে চলল, ‘ছোটোবেলা থেকে কোনও হেলদি হ্যাবিট গ্রো করোনি। সকালে একটা নির্দিষ্ট সময়ে উঠে একটু গরম জলে মধু লেবু দিয়ে খেলে, দিনে একটা নির্দিষ্ট সময়ে স্নান করলে, টাইমলি খাবার খেলে, একটু এক্সারসাইজ করলে। তা নয়। কোনও ডিসিপ্লিন শেখোনি। শুধু পটাপট ওষুধ খেয়ে ঝিমিযে থাকবে।’

নাক-গলায় তীব্র জ্বালা আর শ্লেষ্মার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে বলাকা জুতসই উত্তর ভাবতে লাগল। এই ঠান্ডা লাগা নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে কম কথা শুনতে হয়নি। শাশুড়ির বক্তব্য, এত খারাপ স্বাস্থ্য নিয়ে নাকি বিয়ে করাই উচিত হয়নি। যেন বলাকার মা-বাবা চিকিত্সা না করিযে রোগ লুকিযে বিয়ে দিয়েছেন। মা বলছে বলছে, ছেলে কোথায বউ আর  শ্বশুরবাড়ির সম্মান রক্ষা করবে, তা নয় মায়ের কথায় দোয়ারকি দেয়। শীর্ষ খুব ভালো করে জানে বলাকা প্রথমটায় গার্গেল, বাষ্প, প্রশ্বাস ইত্যাদি করেও ফল না পেলে, তখনই ওষুধের শরণাপন্ন হয়। নিতা্ অপারগ হলেই ব্রহ্মাস্ত্র অর্থাত্ স্টেরয়েড। ব্যায়াম যোগাসন করে না ঠিকই কিন্তু ঠান্ডা যাতে না লাগে সে ব্যাপারে যথেষ্ট সাবধানী।

পচা গরমেও কনকনে জল খায় না, ঠান্ডা পানীয় পান করে সইয়ে সইয়ে গাড়িতে চাপলেই গলায় মাথায় স্কার্ফ জড়িয়ে নেয়। নিশ্ছিদ্র আবরণের ফাঁকফোকর দিয়ে তাও যদি ঠান্ডা ঢুকে পড়ে, তো কী করার আছে? ধুলো-ধোঁয়া এড়ানো কি বলাকার হাতে থাকে? ঘর পরিষ্কার করবে না? আরও কোনও কিছুতে অ্যালার্জি আছে কিনা অনেকবার পরীক্ষা করিয়ে জানতে চেয়েছে। সে দিকে শীর্ষর গাফিলতি। শুধু সব দোষ বলাকার ঘাড়ে চাপিযে খালাস। যদি বউ অসুস্থ হয়ে থাকে তার চিকিত্সা করানো তোমার কর্তব্য, ব্যস্! কথা বলতে গেলেই নাক গলার ভেতর থেকে শ্লেষ্মা জড়িয়ে ধরছে, তার সাথে নাক ও টাকরায় অসহ্য জ্বালা করে উঠছে। এমনিতেই গলার একদিকে যেন তলোয়ারবাজি চলছে, শূল ফুটে আছে।  কিছু খেলে, বিশেষ করে গরম কিছু পান করলে গলাটা সাময়িক রেহাই পায়। চা-জলখাবারের পর হয়তো একটু কষ্ট কমতে পারে। তখন বরের এক তরফা বাক্য বর্ষণটাকে ঝগড়ায রূপান্তরিত করা যাবে।

পেশার কারণে বকবক করতে হয় বলে গলায় চাপ পড়েই থাকে। কলেজ ছুটির কয়েকটা মাস একটু যেন ভালো থাকা যায়।

‘আপনি কি ডাক্তার? “ডাক্তার ভদ্রলোক কঠিন চোখে তাকালেন বলাকার দিকে।’

‘না, একজন এক্সপিরিয়েন্সড রোগী।’

‘কতদিনের এক্সপিরিয়েন্স আপনার? আমি ষোলো বছর প্র‌্যাক্টিস করছি।’

‘আমার বয়েস উনত্রিশ। প্রথম দশ-বারো বছর ভুগলেও অত রোগবালাই চিনতাম না। তারপর থেকে ভুগে ভুগে আর ডাক্তার দেখিয়ে দেখিয়ে অসুখের নাম আর ওষুধের নাম সবই মোটামুটি…’

‘নিজের অসুখ তো নিজেই ডিটেক্ট করে বসে আছেন৷ ওষুধও সাজেস্ট করছেন। আমার কাছে এসেছেন কেন?’

‘আমার প্রেসক্রিপশন লেখার রাইট নেই ডাক্তারবাবু। তাছাড়া ওষুধও তো চেঞ্জ হচ্ছে। আগে যে-ওষুধকে অব্যর্থ মনে করা হতো, সেগুলোয় আর কাজ হতে চায় না। জীবাণুরাও নিজেদের প্যাটার্ন চেঞ্জ করছে, থার্ড জেনারেশন অ্যান্টিবায়োটিকেও রেজিস্টেন্টস গ্রো করে ফেলেছে। রক্সিথ্রোমাইসিনে আমার কোনও কালেই কাজ হয়নি। অ্যাজিথ্রোমাইসিন আসার আগে আমায় গলার কষ্ট বিটাডাইন দিয়ে গার্গেল করে না কমলে স্টেরয়েড খেতে হতো। ওই বিটাডাইন বা ওকাডাইন গার্গেল আর অ্যাজিথ্রোমাইসিন ছাড়া আমার কষ্ট কিছুতেই কমবে না।’

‘আপনি এসেছেন আমার অ্যাডভাইস নিতে। আমি আপনার অ্যাডভাইসে চলব না। এত জানেন যদি নিজের প্রেসক্রিপশন নিজে লিখে ওষুধ কিনে নিন। ফিজিশিয়ানের প্রেসক্রিপশন ছাড়াও তো ওভার দ্য কাউন্টারও ওষুধ বিক্রি হয়। যেমন দেশ, কোনও আইন কানুনের বালাই নেই।’ ডাক্তার সাহা প্রায় দাঁতে দাঁত পিষে বললেন। এইসব ডেঁপো রোগীগুলো সব জেনে বসে আছে। ডাক্তারের ফি বাঁচাতে নিজেরাই ওষুধ খাবে।

‘কিন্তু আমি নিজে ওষুধ কিনলে অফিস থেকে রি-ইমবার্সমেন্ট পাব না। আপনি কাইন্ডলি যদি ওগুলো প্রেসক্রাইব করেন…’

ডাক্তার সাহা খিঁচিয়ে উঠলেন, ‘আমি কি আপনার কাছে ডাক্তারি শিখব নাকি? ইচ্ছামতো প্রেসক্রিপশন পেতে গেলে কোনও কোয়াককে ধরুন। আপনার অত ওষুধের নাম জানার তো প্রয়োজন নেই। আপনার কী কষ্ট জানাবেন, ডাক্তার সেই বুঝে ওষুধ দেবে। বেশি বুঝে গিয়ে সমস্যা বাড়িয়েছেন। জানেন কি সেল্ফ মেডিকেশন ইজ আ ক্রাইম? বিদেশে কোনও সিভিলাইজড কানট্রিতে উইদাউট প্রেসক্রিপশন একটাও মেডিসিন বিক্রি হয় না। এখানে সবাই সবজান্তা। আমি এভাবে ট্রিটমেন্ট করি না।’

শীর্ষ তার বাগ্মী স্ত্রীকে থামতে ইঙ্গিত করছিল। এবার বিরক্ত গলায় বলল, ‘তুমি চুপ করো না। ডাক্তারবাবুকে ডিসাইড করতে দাও। এতদিন তো নিজের মতো চললে। ওনার কাছে এসেছ যখন’

‘কিন্তু রক্সিথ্রোমাইসিনে আমার কাজ হবে না। নুন জলে গার্গেল করলে আমার কষ্ট আরও বেড়ে যায়।’

ডাক্তার সাহা এবার ফেটে পড়লেন, ‘স্যরি ম্যাডাম, আমি আপনার চিকিত্সা করব না। আপনি যা ভালো বোঝেন করুন, যে ডাক্তার আপনার কথা শুনে চলবে তার কাছে যান। নেক্সট’ বেল বাজিয়ে দিলেন।

শীর্ষ রোষকষায়িত চোখে বলাকার দিকে তাকাল। বলল, ‘আপনি আপনার মতো প্রেসক্রাইব করুন।’

বলাকা মন্তব্য করল, ‘হ্যাঁ, ভিজিট যখন দিতেই হবে’

শীর্ষ বলাকার হাতে একটা মোক্ষম চিমটি কাটল। বাইরে এসে ওষুধ কিনল বলাকার দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে। ওষুধের দোকানের ভেতরেই ছোটো পলিক্লিনিক। একমাত্র বউ রাস্তায় অত্যন্ত তালকানার মতো হাঁটে বলে সঙ্গে থাকলে পারতপক্ষে হাত ধরে রাস্তা পার করে দেয়। আজ ওষুধ কিনেই পিছু ফিরে না তাকিয়ে হনহন করে রাস্তা পার হয়ে গেল। বলাকা বরকে প্রথমে দোকানে ও পরে রাস্তার ভিড়ে কোথাও খুঁজে না পেয়ে এদিক ওদিক চাইতে লাগল। রাস্তার ওপারে দেখতে পেয়ে ছুটে যানবাহন না দেখেই রাস্তা পেরোতে গেল। একটা বাস প্রায় গা ঘেঁষে বেরিযে যেতেই আবার চেষ্টা করল। বাধা পেল এক সারি অটো আর গাড়ির জন্য। শীর্ষ একটা অটো থামিয়ে ছেড়ে দিল। গত পনেরো মিনিটে প্রথম বলাকার উদ্দেশ্যে চিত্কার করল। ছুটে রাস্তা পেরিয়ে বউয়ের বাহু চেপে ধরে প্রচণ্ড ধমক, ‘ইএনটি হল। এবার কি সোজা আইসিইউ?’

অটোয় চেপে আবার কথা বন্ধ। বলাকা একা বকবক করে থেমে গেল। বাড়িতে এসে খাবার টেবিলে ওষুধের প্যাকেট নামিয়ে শীর্ষ মেশিনগান চালিয়ে দিল, ‘একটু চুপ করে থাকতে পারো না? ডাক্তার কি তোমার স্টুডেন্ট যে তোমার অ্যাডভাইসে চলবে? শুনলে না সেল্ফ মেডিকেশন একটা অপরাধ? নিজে নিজে যখন যা ইচ্ছে ওষুধ খেয়ে আজ এই হাল করেছ। তোমার বাবাকেও দেখেছি একটা ঢেঁকুর উঠতে না উঠতেই পট করে অ্যান্টাসিড খেয়ে ফেলেন। সারাদিন শুযে থাকলে রাতে ঘুম আসতে দেরি হবেই, ব্যস্ অমনি পটাপট ঘুমের ওষুধ। তোমার মাকেও বলতে শুনেছি, জোড়া ট্রাপেক্স, জোড়া অ্যালজোলাম। সব জোড়া জোড়া। তুমিও জোড়া জোড়া অ্যাভিল, জোড়া জোড়া সেট্রিজিন। একটা ওষুধ খেয়ে কিছুক্ষণ ওয়েট করবে তো কাজ করার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে রিলিফ না হলেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে আর একটা। তারপরেই স্টেরয়েড। তোমরা একেবারে ইনকরিজিবল্।’

‘কথা হচ্ছিল আমার অসুখ নিয়ে আমার মা বাবাকে টেনে আনলে কেন? সেই ছোটোবেলা থেকে কষ্ট ভোগ করে করে আর ভালো লাগে না। যদি প্রাথমিক অবস্থায় ওষুধ না খাই, ব্যাপারটা এত এক্সাজেরেট করে যে, তখন কিছুতেই কমতে চায় না। কষ্ট ভোগ করি আমি, তুমি তো করো না, বুঝবে না। শখ করে ওষুধ গিলি না। এই যেগুলো আনলে, হ্যাঁ-অ্যাঁ-আমি হানড্রেড পার্সেন্ট শিওর, ওগুলোতে কষ্ট কমবে না। … হ্যাঁ-চ্চো…।’ নাক দিয়ে সর্দি বেরিয়ে আসায় বলাকা ছুটল বাথরুমে।

বেসিনে নাক ঝেড়ে বাইরে আসতেই শীর্ষ বলল, ‘আগেই ধরে নিচ্ছ কেন কাজ হবে না? একেবারে বাবার কার্বন কপি!’

‘তুমিও তোমার মায়ের ফোটোকপি। কথায় কথায় আমার বাবা-মার পিণ্ডি চটকাও কেন? কাজ এতকাল হয়নি, তাই বলছি হবে না। আমাকে অ্যাজিথ্রোমাইসিন এনে দাও। তুমি না পারো আমি নিজেই বেরোব। দোকানে আমার একটা কথাও শুনলে না, জবাবই দিলে না। অটো থেকে নেমেও বললাম প্রপার ওষুধটা নিয়ে বাড়ি ঢুকি, তাও করতে দিলে না। শোনো গলায় অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে, একটু আদা দিয়ে চা করো। আমি গা ধুয়ে এসে ভাত বসাচ্ছি, আজ আর রুটি করার এনার্জি নেই। হতচ্ছাড়া ডাক্তার একটা ইনহেলারও লিখে দিল না। ওগুলোর কী দাম। আর এই ওষুধে কাজ না হলে সেই নিজেদেরকে কিনতে হবে, একটার দামও তুমি অফিস থেকে পাবে না। অবশ্য ক্লেমও করো না। আমার পার্টটাইম চাকরি। পার্মানেন্ট হলে নিজের ব্যবস্থা নিজেই করতাম, তোমাকে তেল দিতাম না।’

শীর্ষ খুলে রাখা জুতো জুতোর তাকে ঢুকিয়ে বাইরের চটি পায়ে গলিয়ে বলল, ‘আগে তোমার প্রেসক্রিপশনটা ফলো করি, তারপর ফিরে এসে চা, রাতের রান্না সব করছি। ততক্ষণে তুমি ছটা অ্যাভিল আর দশটা সেটজিন খেয়ে ঝিমোও। আর কী আনতে হবে, সেলেস্টোন, বেটনাসল?’

‘ওমনাকর্টিল।’

‘এটার নাম শুনিনি তো, কবে থেকে শুরু করলে?’

‘সেলেস্টোন বহুদিন হল বন্ধ হয়ে গেছে। বংশীকাকু সেলেস্টোনের বদলে এটা দিল। তুমি শুনেছ, ভুলে গেছ। ওমনাকর্টিল টেন কিন্তু।’

‘তোমার বংশীকাকু কি ডাক্তার? তোমার মাকেও দেখেছি, ওফ্!’ শীর্ষ দড়াম করে সদর দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল।

চুকুস্, চুকুস্, চুকুস্। এক রাশ ওষুধ খেয়ে গার্গেল করে আর এক প্রস্থ গরম জলের ভাপ নিয়ে বোধহয় একটু আরাম পেয়েছে। অঘোরে ঘুমোচ্ছে মেয়ে। কেন যে এত ভোগে? কলেজে পর পর দু’দিন ক্লাস নিয়ে ফিরলেই শুরু হয়ে যায়। এবারে ট্রপিকালে নিয়ে গিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করাতে হবে। কিংবা এই সরকারি আরএমও-এর চক্করে থাকলে চলবে না। আরও বড়ো ইএনটি দেখাতে হবে।

‘উঠিয়ে মেমসাব। খানা লগা দিয়া। কষ্ট কমেছে? চুকুস্ চুকুস্ চুক্ চুক্ চুক্…’

‘উঁ। তখন থেকে কেবল ডান গালে হামু খেয়ে যাচ্ছে। জানো না একদিকে আদর করলে আমার অস্বস্তি হয়?’

শীর্ষ মাথাটা গাল থেকে ফুট খানেক নামিয়ে এনে নাইটির ওপর দিয়ে ডান পাশে ঠোঁট দিয়ে আলতো কামড় বসিয়ে বলল, ‘আজ আমি দক্ষিণপন্থীই থাকব। দেখি কত রাগতে পারো। উম্ম্ম্…’

‘ধ্যাত্, ছাড়ো! কটা বাজে? খাবে না?’

‘খাচ্ছি তো। এটা তো অ্যাপেটাইজার। মেইন কোর্স ডিনারের পরে…’

‘লাইট জ্বালিয়ে কী করছ এত রাতে?’

‘একটা অ্যালপ্রাজোলাম খেলাম।’

‘সকালে হিয়াকে স্কুলে পাঠাতে হবে, কটা বাজে দেখেছ? রাত তিনটের সময় ঘুমের ওষুধ খেয়ে সকালে উঠতে পারবে? তোমার কালকেও তো কলেজ আছে।’

‘কাল মা-বাবা ছোটোকাকুর বাড়ি যাবে। হিয়াকে ও বাড়িতে রাখা যাবে না। আমি কাল কলেজে যাব না। সকালে প্রিন্সিপালকে ফোন করে জানিয়ে দেব।’

‘কালকেই যেতে হবে? পরশু তোমার অফ ডে, পরশু যেতে বলো। রাতে তাড়াতাড়ি শুযে পড়লে ঠিক ঘুম চলে আসে। ওষুধ একটা নেশা তোমাদের…’

‘দীপের হবু বউকে দেখতে যাবে। ওরা পরশু না তরশু ব্যাঙ্গালোর ফিরে যাবে। কাকিমা মাকে ফোন করেছিল। বড়ো দাদা-বউদিকে তো বিরাট কিছু মান্য করে না কিন্তু হবু পুত্রবধূকে দেখানোর খুব শখ। নিজেরাও তো বিয়ে পর বউ নিয়ে সংসার করতে পারবে না। ছেলে, ছেলের বউ দুজনেই ব্যাঙ্গালোর চলে যাবে। তাই এইবেলা ডাকছে। রীতশ্রী তো দীপের চেয়ে উঁচু পোস্ট-এ আছে।’

কথাগুলো স্বগতোক্তি হয়ে গেল। কারণ শীর্ষর নাক ডাকছে আবার বিকট জোরে। মেয়ে বাবাকে জড়িয়ে ঘুমোচ্ছিল। শব্দকল্পদ্রুমে চমকে কেঁদে উঠল। বলাকা মশারির মধ্যে ঢুকে মেয়েকে চাপড়াতে লাগল। ঘুমের ওষুধ সে নিজে নিজে ধরেনি। বাচ্চা-পেটে রাতে ঘুম হয় না শুনে, বলাকার গাইনি ডাক্তারই লিখে দেন। বলাকা অভ্যাস হয়ে যাবে বলে দ্বিধা প্রকাশ করাতে বলেন, ‘ঘুমের ওষুধ খেলে আপনার যা ক্ষতি হবে, তার চেয়ে অনেক বেশি আপনার বেবির ক্ষতি হবে যদি আপনি রাতে না ঘুমোন।’

শীর্ষর নাসিকা গজর্নের প্রাবল্য একটু কম হলে হয়তো বলাকাকে ঘুমের ওষুধ ধরতেই হোত না। কিন্তু এ কথা বললে শীর্ষ এক্ষুণি অন্য ঘরে গিয়ে শোবে। বলাকার এক দিদি বিয়ে পর পরই বলেছিল, ‘বরের সঙ্গে যতই অশান্তি হোক, কখনও বিছানা আলাদা করবি না। করলে কিন্তু ফেরা যায় না।’

চাকরিটা শেষ পর্যন্ত ছেড়েই দিতে হল। অধ্যক্ষা মহাশয়া বলাকাকে দিয়ে এলোপাথাড়ি ক্লাস করাতেন। বলাকার স্পেশালাইজেশন নিউক্লিযার ফিজিক্স, কিন্তু ও অধিত বিদ্যা প্রয়োগের অভাবে ভুলে যেতে চায় না। তাই গোটা মর্ডান ফিজিক্স ও ইলেক্ট্রনিক্সটাই পড়াতে হতো। এমনকী ধ্রুপদী পদার্থবিদ্যার কোনও কোনও অংশও একটু ঝালিয়ে নিয়ে ক্লাস নিতে পারে জেনে, পদার্থ বিজ্ঞানের যখন

যে-অধ্যাপক বা অধ্যাপিকা অনুপস্থিত, তখনই বলাকাকে দিয়ে পাস কোর্সের ক্লাস করিয়ে নিতেন অধ্যক্ষা।

অনার্সের ক্লাসটা তবু সামলানো যায় কিন্তু পাস কোর্সের ছেলেগুলো এক একটা অবতার। একে তো সংখ্যায় অনেক, তারপর বলাকাকে যে-কোনও ভাবে অপদস্থ করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। যা পড়াতে ঢুকেছে তার দিকে মন নেই, কেবল বাইরের প্রশ্ন করে শিক্ষিকাকে প্যাঁচে ফেলাতেই তাদের আনন্দ। মেয়েগুলো সরাসরি অসভ্যতা না করলেও গোলমালের মধ্যে নিজেদের মধ্যে গজালি করে নিত। অথচ বলাকার মতো নিজের বিষয নিয়ে সম্যক জ্ঞান খুব কম শিক্ষাদাতার আছে। কোনওটাই ওপর ওপর ছুঁযে যেত না, সব প্রশ্নেরই, মানে যে-প্রশ্নের উত্তর হয়, সেগুলোর জবাব দিত। কিন্তু ক্লাসে শোরগোল থামাতে পারত না।

যে-শিক্ষিকা তার বিষযে ওপর যে-কোনও অধ্যায় ভালো ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে, কোনও প্রশ্নের উত্তরই এড়িয়ে যায না, পূর্বতন অধ্যাপকের ভুল বোঝানো বা এড়িয়ে যাওয়া বিষযটা ছাত্রছাত্রীদের প্রাঞ্জল ভাবে বুঝিযে দিতে পারে, পড়ানোর সময় সে কেন শিক্ষার্থীদের মনঃসংযোগ ধরে রাখতে পারত না, এটাই বিস্ময়ের। বিশাল ব্যাখ্যা শুনত গুটিকয় ছেলেমেয়ে, সবাই প্রাইভেট কোচিং নেয়। সেখানে নোটস্ও পায়, যা বোঝার বুঝেও নেয়। কলেজের শ্রেণিকক্ষের বক্তৃতায় মনোযোগ না দিলেও চলে যেন। বলাকা ক্লাসে নোট দিলেও অনেকেই লিখত না। বলত বান্ধীদের কাছ থেকে পরে ফটোকপি নিয়ে নেবে। বলাকা রেগে কাউকে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে বললে সেটাও শুনত না। বলাকা নিজে চলে যাওয়ার হুমকি দিলেও হেলদোল নেই। এই শাখামৃগের দলই আবার বলাকার নামে অধ্যক্ষাকে নালিশ জানিয়ে এসেছিল যে, সে ক্লাসে বসে বসে বত্তঞ্জতা দেয়, যা সিলেবাসে নেই তাই নিয়ে আলোচনা করে, ক্লাস নিতে নিতে পঞ্চাশবার গলা ঝাড়ে, রুমালে নাক মোছে, সর্দি নিয়ে তেমন বেকায়দায় পড়লে বাথরুমে চলে যায, ইত্যাদি।

ওদিকে নেট উত্তীর্ণ হওয়ায় গবেষণার সুবিধা হলেও চাকরিটা পাকা হচ্ছিল না। শিক্ষার্থীদের সেই নালিশ জানানোর পর থেকে বলাকার ক্লাসের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। পাঠ্যক্রম সম্পূর্ণ করতে হবে। কিন্তু বাড়তি ক্লাসের জন্য বাড়তি টাকা পাবে কিনা প্রশ্ন করায় প্রিন্সিপাল এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। তবু দ্বিধা ও গোলমালের মধ্যে চালিয়ে যাচ্ছিল। ওর তরফ থেকে সমস্যা ছিল একটাই কখনও শরীর, কখনও মেয়ের জন্য কামাই করতে হতো। কষ্ট স্বীকার করে যে কলেজে যাবে, কীসের অনুপ্রেরণায়? অনার্সের ছেলেমেয়ে অতটা বেয়াড়া না হলেও সহযোগিতাও করত না। তাদের তো একই বিষযে একাধিক টিউশনি। আর পাস কোর্সের ক্লাসে যাওয়া তো বিভীষিকা হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কামাই করলেও সেটা পরের ক্লাসে পুষিযে দেওয়ার চেষ্টাও করত আপ্রাণ। তবু ছ’মাসের বেশি টিঁকে থাকা গেল না। সেই সাথে এক ইউনিয়নবাজ ছোকরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বলাকার সাথে ঘনিষ্ঠতা করার লাগাতার মাস দেড়েক চেষ্টা করে, রণে ভঙ্গ দিয়ে বেশ কিছুদিন যাবত্ হাতে কাঠি নিয়ে বলাকার পেছনে ওঁত্ পেতে থাকত। ব্যাটা পলসায়েন্স, ফিজিক্সের বুঝিস কী? সেও বিদ্রোহীদের সাথে হাত মেলাল বলাকার নামে প্রিন্সিপালের কান ভারী করতে। এমনকী ঢোলা কুর্তির ওপর ওড়না কেন নেয়নি তাও আলোচনার বিষযবস্তু করে তুলল।

অধ্যক্ষা এক রাশ অভিযোগ সহ গ্রীষ্মের ছুটির আগে বলাকাকে আর আসার প্রয়োজন নেই জানিয়ে দিলেন। মে মাসের মাঝামাঝি ছুটি। এপ্রিলের মাইনে তখনও দেয়নি। অ্যাকাউন্টস্ থেকে দু মাসের জন্য দুটো ভুলভাল বানান লেখা চেক ধরিয়ে দিল। এতদিনেও ওরা বন্দ্যোপাধ্যায় বানানটা ঠিক করে লিখতে পারল না। সংশোধনের জন্য গেলে বলে, ‘এত বিচ্ছিরি পদবি রেখেছেন কেন? ব্যানার্জী লিখতে পারেন না?’

পদবি কি ও নিজে রেখেছে, না তার বানানটা নিজে ঠিক করেছে? ঈশ্বরচন্দ্র থেকে মমতা সকল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইংরেজি বানান যা, বলাকারও তাই। আসলে বলাকা বরের পদবি, গুহ ব্যবহার করে না, সেটাই মল্লিকবাবুর আক্রোশের কারণ। বহুবার কটাক্ষ করেছে এই নিয়ে কুমারীবেলার পদবি রেখে দিলেই কি দেশে নারী স্বাধীনতা চলে আসবে? ফেমিনিজম আসলে একটা শহুরে ব্র‌্যান্ড, যা শিক্ষিত মেয়েরা কাজে লাগায়, ইত্যাদি। মনে হয় ভদ্রলোক ইচ্ছা করেই এই ভুলটা করে। স্বামীর পদবি নেয়নি বলে ওর এত গায়ে জ্বালা কিন্তু বামুনের মেয়ে হয়ে কায়েতের ছেলেকে বিয়ে করেছে বলে কোনও বক্রোক্তি করেনি। সে যদি একেবারে অ্জ শ্রেণির কাউকে বিয়ে করত, তাহলেও লোকটার একই অভিযোগ থেকে যেত। জাতপাত আর স্বামীর পরিচয দাঁড়িপাল্লায় বসালে পুরুষতান্ত্রিক নিক্তিতে সম্ভবত দ্বিতীয়টিই ভারী প্রতিপন্ন হয়।

সেই চেক সংশোধনের জন্য আবার অত দূর ট্রেন, অটো, রিক্শা ঠেঙিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা হয়নি। অন্যবারের মতো এবারও ব্যাংক-এ বলে-কয়ে ভাউচারে ডিক্লারেশন লিখে চেক জমা দিয়েও। বাউন্স করলে দেখা যাবে। যে-ক’দিন পড়াত, সে ক’দিন ওষুধ খেয়ে গলায় সাময়িক আরাম হলেও আবার শুরু হতো। তখন আর অল্প মাত্রয় কাজ হতে চাইত না। গলা-জ্বালা, নাক-জ্বালা, গার্গেল, কোমরে ব্যথা, মেয়েকে নিয়ে রোজকার টানাপোড়েন, নাকে-মুখে ভাপ নেওয়া, মনে চাপ নেওয়া, ইত্যাদির মিশ্র ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় এমন পরিস্থিতি দাঁড়াচ্ছিল যে, চাকরিটা ছেড়েই মনে হল এক গঙ্গাস্থল হল।

এখন সে কয়েকজন প্রকাশকের সঙ্গে কথা চালাচ্ছে উচ্চমাধ্যমিক, বিএসসি পাস কোর্সের জন্য পদার্থবিদ্যার বই লিখতে চায়। বাংলা কবিতা, গল্প কি সাহিত্যের বইয়ে খুব একটা কাটতি না হলেও, সাধারণত স্কুল কলেজের পুস্তক প্রণেতাদের ভালোই খাতির আছে। তাদের নিজের পয়সা বিনিয়োগ করে বই বার করতে হয় না। কিন্তু বলাকার বেলায় বুঝি সবই উলটো হয়ে যায়। বই বার করা নিয়ে এক এক জন প্রকাশকের এক এক রকম টালবাহানা। তার পিএইচডি শেষ হওয়ার মুখে। তারও তো একটা ভার আছে। এক হতচ্ছাড়া প্রকাশক মন্তব্য করে, ‘ওরকম হাজার হাজার পিএইচডি ফ্যা ফ্যা করছে।’ এই অপমান হজম করেও আইসিএসই বোর্ডের অষ্টম শ্রেণির একটা অংক বই আর উচ্চমাধ্যামিকের প্রশ্নোত্তরের গাইড বুক নিয়ে এখনও লড়ে যাচ্ছে। প্রকাশকদের জানায়নি যে তার কলেজের পার্টটাইমটা গেছে।

জানায়নি নাটকের রিহার্সালের বন্ধুদেরও। দু-একটি ছাত্রছাত্রী ছাড়া বাকিরা সবাই কোথাও না কোথাও চাকরি করে। একজনের ব্যাবসা আছে। যারা এখনও পড়ুয়া তাদের স্বপ্ন আছে ভবিষ্যতে কিছু করবে, যারা করে তাদের ব্যস্ততা আছে, আর বলাকার সব খুইয়ে আছে কেবল অসুখ। এই অসুখটাই ওর বিশ্বস্ত জীবনসঙ্গী, চিতায় উঠে সহমরণে যাবে। হতভাগাকে যত তাড়াতে চায় কিছুতেই ওকে ছেড়ে নড়বে না। মাঝে মাঝে কেবল আলিঙ্গন শিথিল করে এই যা।

মহড়ার সময় ক্লাবঘরটায় দুটো মশা তাড়ানো ধূপ জ্বালিয়ে রাখা হয়। এখানে মাস দেড়েক ধরে এসেও এখনও কোনও চরিত্র পায়নি, একদিনও বলাকাকে কিছু পড়ে শোনাতে বা আবৃত্তি করতেও বলা হয়নি। সামনে একটা কল শো, তারও জোরদার প্রস্তুতি চলছে। তারপর হয়তো হবে। এটুকু ধৈর‌্য তো রাখতেই হবে। কিন্তু যেটা হাতেনাতে পাওয়া গেল, সেটা হল মশা-মারা ধূপের বিষাক্ত ধোঁয়ায় অবর্ণনীয় নাক-গলা জ্বালা আর মাথা ব্যথা। শীর্ষকে লুকিযে আবার অ্যান্টিবায়োটিকের পাশাপাশি স্টেরয়েডও খাচ্ছে। সাধারণত এই ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করলে ঠান্ডা বা দূষণ কোনওটাই কুপোকাত করতে পারে না৷ কিন্তু মশার ধূপ? সব দুষণ বারবার, কচ্ছপের কামড় একবার।

কলেজ স্ত্রিট থেকে শিয়ালদায় আসার সময় ঠিক করে নেয় বালিগঞ্জের মহড়ায় যাবে, না নৈহাটির বাড়িতে। গলার জ্বালা আর কোমরের যন্ত্রণা বলল নৈহাটি লোকাল ধরে বাড়ি। এই যন্ত্রণাটা শুরু হয়েছে হিয়া হওয়ার পর থেকে। কোমরের কাছে শিরদাঁড়ায় ইনজেকশন দিয়ে লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া করা হয়েছিল সিজারের আগে। বাপ রে! জ্ঞান সম্পূর্ণ হারায়নি কিন্তু মাথাটা একেবারে পেগলে গিয়েছিল।

‘আপনি কিন্তু ছুরি চালাবেন না। আমি সব টের পাচ্ছি।’

‘আমারা কি খুনি যে ছুরি চালাব? এটা স্ক্যালপেল। ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। আপনি টেরই পাবেন না। আগে দেখি বাচ্চার মাথাটা কোন দিকে।’

‘কিন্তু আপনি যে পেটে চাপ দিচ্ছেন সেটা বেশ বুঝতে পারছি। এখন পেট কাটবেন না কিন্তু।’

‘বুঝতে পারছেন? বেশ বাঁপা-টা তুলুন দেখি।’

পা তুলবে কী, বলাকা নিজের ডান-বাঁ কোনও পাই খুঁজে পায়নি।

ওর শরীরের লক্ষণ দেখে অনেকেই বলেছিল ছেলে হবে। মনটা খুব উত্ফুল্ল ছিল না তাই। রাস্তাঘাটে বাচ্চাদের পোশাকের সম্ভার দেখলে, চোখটা মেয়েদের পোশাকের দিকেই টানত। ওটি-তে ডাক্তারের মুখে মেয়ে হয়েছে শুনে বলাকা তাকে এমন করে উচ্ছ্বসিত হয়ে থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ করেছিল, যেন কৃতিত্বটা বরের নয় ডাক্তারের। তারপর শুরু হল মাথায় বর্ণনাতীত যন্ত্রণা। টানা সাত দিন প্রচণ্ড বমিভাবের সঙ্গে মাথা যন্ত্রণা। অ্যানেস্থেশিয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। কাটা তলপেটে চাড় পড়ত বলে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারত না। মেয়েকে দুধ খাওয়ানোটা তো মনে হতো শাস্তি।

ওহ্! ফুকলি মাড়ির কামড়ে যা যন্ত্রণা দিত, তার বাবা বত্রিশ পাটি নিয়ে কোনও দিন তা দেয়নি। আবার কিছুক্ষণ বিরতি পেলেও বুকে দুধ জমে টনটন করত। সেই সাথে প্রথম চব্বিশ-পঁচিশ দিন ধরে সেই ব্যাপারটা তো ছিলই, ঘষা খেয়ে উরু ছড়ে যেত। যে-সব পণ্ডিতরা বলে নিযমিত রক্তপাতের ফলে মেয়েরা নাকি কম অসুখে ভোগে, তারা ডাহা মিথ্যে কথা বলে। নিয়মিত ক্ষরণটাই তো মস্ত অভিশাপ, সেই নিয়ে গাইনিদের চেম্বারে ভিড় উপচে পড়ে। আর তা সত্ত্বেও সব ধরনের ডাক্তারের চেম্বারে দেখেছে মহিলা রোগীরই ভিড় বেশি। হৃদয়ঘটিত হোক বা বৃক্কজনিত। আর হাড়ের অসুখে তো একচেটিয়া মেয়েদেরই রাজত্ব। কে জানে, প্রথম ছ’মাস বুকের দুধ ছাড়া বাচ্চাকে জলস্পর্শ করানো যাবে না, সেটাও যেন পুরুষবাদী ষড়যন্ত্র মনে হয়।

শীর্ষ ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, হিয়া কোথায়?

‘আজকে আনতে পারিনি ওবাড়ি থেকে। কোমরে যন্ত্রণার জন্য হট ওয়াটার ব্যাগ নিয়ে শুয়ে আছি।’

‘আমি নিয়ে আসছি। এক্সারসাইজ করবে না, কেবল বারো মাসে তেরো পার্বণের মতো অসুখ বিসুখ উদ্জাপন করে যাবে। পেইন কিলার আনতে হবে? আর অ্যান্টাসিড আছে না আনব?’

‘মেয়ে তো ক’দিন আগে পর্যন্ত রোজই দাদু-দিদার কাছে থাকত। আজও নয় রইল।’

‘এই অসুখ অসুখ তোমার একটা ম্যানিযা। দিব্যি বিছানায় গড়িয়ে আরাম করে নাও। আমার শরীর অশরীর থাকতে নেই, না?’

বলাকার চাকরি যাওয়ার পর শীর্ষ আর অদরকারে শ্বশুরবাড়ির ওপর নির্ভর করতে চায় না। তাছাড়া সারাদিন অফিস করার পর রাতে মেয়েকে পাশে চাই-ই। রাত নটার সময় তিন কিলোমিটার দূরে বাইক নিয়ে কন্যাকে আনতে বেরিয়ে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যে দরজা ঘণ্টিতে টিংটং। শীর্ষ।

‘কী হল? গেলে না?’

‘পেটটা সকালে ঠিক…’

শীর্ষ ঘাড়ে তোয়ালে নিয়ে স্নানঘরে ঢুকে গেল। একেবারে গা ধুয়ে বেরিয়ে এসে দেখল রাত সাড়ে ন’টা। নাহ্! রাত দশটার সময় দাদু-দিদার কাছ থেকে মেয়েকে নিয়ে আসা বাড়াবাড়ি কেন, অসভ্যতা হয়ে যাবে। ওখানে থাকতে হিয়া ভালোই বাসে।

‘দিনে পাঁচবার করে মধুপুর যাওয়া তোমার ম্যানিয়া নয়?’

‘সেটা পেট পরিষ্কারের ম্যানিয়া, তোমার মতো পাঁচদিন পেটে হাগু পুষে রাখার চেয়ে ভালো। ছি ছি! এত পরিচ্ছন্নতার বাই, পিটপিটিনি, আর পেটের মধ্যে ময়লা জমিয়ে রাখতে ঘেন্না করে না?’

‘পাঁচদিন মোটেই না। দু-তিনদিন হয়ে যায়।’

‘রোজ সকালে একটু উষ্ণ জল খেয়ে যথাস্থানে গিয়ে বসবে, ঠিক হবে।’

‘ঠিকমতো বেগ না এলে বসেও লাভ হয় না। এমনিই বেরিয়ে আসতে হয়।’

‘রোজ একটা নির্দিষ্ট সময় বসার অভ্যেসটা কি করেছ? যতক্ষণ না বেরিয়ে আসার উপক্রম হচ্ছে ততক্ষণ বাথরুমে যাবে না।’

কেরল বেড়াতে যাওয়ার সব ব্যবস্থা হয়ে রয়েছে। বলাকার মা-বাবা, দাদা-বউদি ও ভাইপোও সঙ্গে যাবে। ট্রাভেল এজেন্ট-এর সঙ্গে কথা বলে ছয়জন বড়ো ও দুটো বাচ্চার জন্য পুরো প্যাকেজ বুকিংটা বলাকাই করেছে। যাক চাকরি না থাকার একটা সুবিধা পাওয়া গেছে। শীর্ষর সময় হচ্ছিল না, রন্তিদা মানে বলাকার দাদার ভাবটা এমন, যেন গিয়ে উদ্ধার করে দিচ্ছেন। এই যাচ্ছি যাচ্ছি সময়টাই যেন বেশি উপভোগ্য।

‘হ্যালো।’

‘এই শোনো না, আজ একটা কাণ্ড হয়েছে।’

‘বলে ফেলো। কাণ্ড তো তুমি রোজই বাধাও।’

‘বাড়িতে ট্যাংরামাছ বিক্রি করতে এসেছিল। ছোটো ছোটো মাছ। ব্যাটা কিছুতেই বেছে দিল না। আমি বঁটিতে কাটতে গিয়ে সামনের একটা দাঁড়া বুড়ো আঙুলে ঢুকে গেছে। ওটা টেনে বার করতে গেলে মর্মান্তিক লাগছে। রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। পাশের ফ্ল্যাটের দীপুদের বলতে গেলাম, ওরা কেউ বাড়ি নেই। খোকনের ওষুদের দোকানে গেলাম, ওরা বলল হাসপাতালে যেতে। এমন আড়ে কাটে বেধেছে টানাটানি করলে প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। দাঁড়ার গায়ে অসংখ্য কাঁটা কাঁটা, রাক্ষস খোক্ষসদের কাঁটাওয়ালা মুগুরের মতো। টানা যাচ্ছে না।’

‘দু’দিন পরে বাইরে যাব। তোমাকে এখন ট্যাংরা মাছ কিনতে কে বলল? আমি বাইরে যাওয়ার আগে বেশি বাজার করে ফেললে কথা শোনাও, নিজে হঠাত্ মাছ কিনতে গেলে কেন? ফ্রিজে তো মাংস রয়েছে। আর কিনলেই যদি অমলাকে বললে না কেন, সে কেটে দিত?’

‘অমলা বলল সে ট্যাংরা কাটতে-বাছতে পারবে না। তাছাড়া ওর চলে যাওয়ার ঠিক আগেটাতেই মাছওয়ালা এসেছিল। আমার কিন্তু খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি বকে যাবে না কিছু ব্যবস্থা করবে? দাঁড়া-ফোটা গোটা মাছটা এখনও আমার হাতে, উঃ!’

‘একটা রিপোর্টে একটু গন্ডগোল আছে, ওটা ঠিক করে একটা ফ্যাক্স পাঠাতে হবে হেড অফিসে। তারপর বেরোচ্ছি। টিটেনাস নিতে হবে তো। ওষুধের দোকানে গিয়েছিলে, বুদ্ধি করে একটা টেডভ্যাক তো নেবে! হাজারটা ওষুধের নাম জানো নিজে নিজে ডাক্তারি ফলাও, আর এটুকু বুদ্ধি হল না?’

‘আমার যন্ত্রণায় গা বমি করছে, মাথা ঘুরছে। আমি রোদের মধ্যে আর একা একা বেরোতে পারছি না। যদি আসতে পারো তো এসো, না হলে আমি ধনুষ্টংকারে বেঁকে যাই। মাকে ফোন করে দিচ্ছি, হিয়া আজ ওখানেই থাকবে।’

হাত পেকে ফুলে বলাকার জ্বর এসে এমন অবস্থা, যাওয়াটা শেষ মুহূর্তে বাতিল করতে হল। যাত্রার সময়কালে মাত্র পঁচিশ শতাংশ টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। শীর্ষ আর বলাকা মা-বাবা, দাদা-বউদিকে বলেছিল ওঁরা যেন ঘুরে আসেন। কিন্তু মেয়ে বা বোনকে এমন অবস্থায় ফেলে বেড়াতে যেতে মন চায়? চক্ষুলজ্জাতেও বাধে। আর দাদাভাই বেড়াতে যাবে হিয়াকে ফেলে? সামলানো যাবে মেয়েকে? বাচ্চাদুটো অবশ্য হতাশ হলেও এক সাথে খেলতে পেলেই খুশি।

মাত্র কয়েকটা আর্ন লিভের সঙ্গে বড়োদিনের ছুটি শনি রবি মিলিয়ে বেশ সুবিধা হয়েছিল এবার। অসুখ যদি না করে তো দুর্ঘটনা ডেকে আনতে হবে? অফিসে আজ একটু খিটখিটে মেজাজে শীর্ষ। দফতরে শীর্ষের রুগ্ন বউয়ের ভালোই পাবলিসিটি আছে, কয়েকজন সহকর্মী মাঝে মাঝেই আওয়াজ দেয়। কোনও দিন একটু আগেভাগে বেরোলেই প্রশ্ন করে, কী গুহদা বউদির আবার কিছু হয়েছে? সেই সাথে হাজারো পরামর্শ তো আছেই। কলকাতা, মুম্বই, ভেলোর, ব্যাঙ্গালোর, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি, হাকিমি, ইউনানি, জ্যোতিষী, যোগাসন, রামদেব, কামদেব… কত কী! এবারের টপিক অসুখ নয়, অ্যাক্সিডেন্ট।

সত্যি শীর্ষ গুহর বউ পারেও বটে, কোনও কিছু বাধাতে পারেনি তো হাতে ট্যাংরার কাঁটা ফুটিয়ে বরকে ফোন করছে। শীর্ষদাও কম যায় না, কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখার আন্তরিকতার জন্য তাকে অনেকেই আড়ালে গুহদার বদলে হাগুদা বলে উল্লেখ করে। এই সূত্রে কার বউয়ের, কার ছেলের, কার মেয়ের, মা, বাবা, শালা, শালি, দেওর, জা, শ্বশুর-শাশুড়ির কী কী অসুখ, কে কোন দুর্ঘটনায় মারা গেছে, কে পঙ্গু হয়ে গেছে, কে বড়ো ফাঁড়া থেকে বেঁচে ফিরে এসেছে- তার জমজমাট আড্ডা বসে গেছে পাশে অমর দত্তর টেবিল ঘিরে। সেই থেকে কার সাথে কার কী লটরঘটর চলছে, তাই নিয়ে কার সংসারে কত অশান্তি সেই আলোচনাও বাদ থাকছে না।

শীর্ষ বিরক্ত গলায় বলল, ‘আঃ, দত্তদা আপনাদের কি আর কোনও আলোচনা নেই? অফিসে কিছু লোক গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘোরে বলেই আমাদের কয়েকজনকে ঘাড় গুঁজে কাজ করে যেতে হয়। আমার বউ আমার জ্বালা। আমাকে এই নিয়ে সারা জীবন জ্বলতে হবে।’

‘তুমি আর কী জ্বলছ ভায়া? চট্টোরাজকে দ্যাখো, দেখে শেখো। বেচারার বউ পরকিয়ায় লেঙ্গি খেয়ে ডিপ্রেশনে ভুগছে বলে সাইকায়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাচ্ছে।’

কথাগুলো কিছুটা টনিকের কাজ করল। খিটখিটে ভাবটা চলে গিয়ে এক ধরনের প্রশান্তি এল৷ মোবাইল তুলে বলাকাকে ফোন করল শীর্ষ, ‘হ্যালো। শরীর কেমন? আর মন? ভাবছি কেরল হল না তো কী, হাতটা সারলে সবাই মিলে একটা গাড়ি বুক করে শঙ্করপুর কি মন্দারমণি ঘুরে আসি।’

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...