বাতাসে আর বারুদের গন্ধ নেই। হাতে নেই অত্যাধুনিক অস্ত্র। চিড় ধরা অবিশ্বাসী মনে উন্নয়নের অনুকূল প্রলেপ। সবুজ হয়েছে আরও সবুজ। লাল ভাঙাচোরা পথে অজগর সদৃশ পিচ সড়ক। বাধা কাটিয়ে সেই সবুজ সমুদ্রে গা ভাসতে চলে যান জঙ্গল মহল। হয়তো ঝাড়া হাত পায়ে দুদিনের ছুটিতে ঝাড়গ্রাম গেছেন। রাজবাড়ি, চিড়িয়াখানা আর চিলকিগড় গিয়ে চিলতে ভ্রমণের ইতি টানতে চান। কিন্তু দিন বাড়িয়ে যদি পা বাড়ান বেলপাহাড়ি, তাহলে কেমন হয়?
দহিজুড়ি, বিনপুর, শিলদা হয়ে ৩৮ কিলোমিটার দূরে বেলপাহাড়ি। এখানে শাল, মহুয়া, সোনাঝুরি, পিয়াল, ইউক্যালিপটাস ও কেন্দুগাছের নিবিড় সমাবেশ। আদিবাসী অধু্যষিত এই অঞ্চলকে সাজাতে ঈশ্বর এতটুকু কার্পণ্য করেননি। যেখানে প্রকৃতির কোলে এক অদ্ভুত মাদকতা মিশে রয়েছে। লাল কাঁকুড়ে পথঘাটের সঙ্গে মিশে রয়েছে মহুয়ার মৌতাত।
বেলপাহাড়ি বাজারে আসতেই দেখবেন, রাস্তা বেঁকেছে নানাদিকে। জিপিএস থমকে গেলে, বাজারের মুখটায় বোর্ডটা দেখে নিন। স্থানীয়দের সহযোগিতা পাবেন একশো শতাংশ।
প্রথমে গ্রাম্য পথ দিয়ে গাড়ি ছুটবে কানাইশোল। লাল কাঁকুড়ে পথ এখন পিচমোড়া। আদিম জঙ্গলে মোড়া পাহাড়তলির কানাইশোল-এর সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। তবে পাহাড় ঘেরা ছোট্ট লেক দেখতে হলে চড়াই রাস্তায় উঠতে হবে অনেকটা। রাজ্য বিভাজনের পাহাড়ও বলা চলে কানাইশোলকে। এই পাহাড়ের উলটো দিকেই ঝাড়খণ্ড রাজ্য। উদার আকাশ আর নয়নাভিরাম সবুজের সৌন্দর্য আগত পর্যটকদের বিমুগ্ধ করবে। ভিন্ন রাস্তায়, ভিন্ন গ্রাম্য পরিবেশকে দুচোখে দেখতে দেখতে, আবার বেলপাহাড়ি বাজার।
এবার গাড়ি ঘুরবে ঘাঘরা-র দিকে। বাজার থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে ঘাঘরা। ঘাঘরা পাথুরে রূপকথার চঞ্চলমতি এক ঝরনা। তাকে পাহারা দিচ্ছে শাল, পিয়াল, অমলতাস, ইউক্যালিপটাস-এর ছড়ানো প্রকৃতি। শীতে তার জলধারা ক্ষীণ। সবুজ দিগন্তের মাঝে বিস্তীর্ণ ব্ল্যাকস্টোনের কোলে সবুজ নীলাভ স্বচ্ছ জল। জলের আঘাতে পাহাড়গুলোর আকৃতি স্থানীয় ভাষায় গাগরি, অর্থাত্ কলশির মতো।
এখানকার নির্জন পথে দেখবেন মাথায় জ্বালানি কাঠের বোঝা নিয়ে চলেছে স্থানীয় মহিলারা। রোজ সকালে এরা কাঠ কুড়োতে জঙ্গলে যায়। কাঠ বিক্রি করেই এদের সংসার চলে। অতীতে ১৮৭০ সালে বেলপাহাড়ির ব্রিটিশশাসক, ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে ঘুরতে ঘাঘরা-য় উপস্থিত হয়েিলেন। সেখানে দলবল নিয়ে বনভোজনও করেছিলেন। ক্রমেই এখানকার সৌন্দর্য মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে।
ঘাগরা থেকে কিছুটা দূরেই রয়েছে তারাফেনি ব্যারেজ। কংসাবতী নদীকে জলবন্দি করা হয়েছে এখানে। ১০ লকের বাঁধ নীল সাদা রঙে আবদ্ধ। ব্যারেজের পাশেই পুলিশ ক্যাম্প। উলটো দিকের প্রকৃতি জুড়ে খেজুর গাছের ব্যাপ্তি। শীতে এখানে ভালো খেজুরগুড় মেলে। এখান থেকে জল শোধিত হয়ে বেলপাহাড়ি যাচ্ছে। তবে এর আর-একটা পরিচয়ও আছে। ঘাগরা সংলগ্ন তারাফেনি অববাহিকা অঞ্চলে, প্রাচীন জীবাশ্ম ও প্রস্তর যুগের কিছু চিহ্ন মিলেছে।
এবার মধ্যাহ্ন ভোজনের পালা। তার জন্য বেলপাহাড়ি বাজারে কাঁচালংকা রেস্টুরেন্টকে চুজ করতে পারেন। আবার গাড়ি ছুটবে ১২ কিলোমিটার দূরে গাড়রাসিনির দিকে। ঝিলিমিলি-র দিকে কয়ে কিলোমিটার দৌড়ানোর পরই বাম দিকের পথ ধরুন। সর্পিল পাহাড়ি পথ ধরে গাড়রাসিনির আঙিনায়। পাহাড় পাদদেশে অরণ্য মাঝে এক ধর্মীয় আশ্রম। তার চূড়ায় মন্দির। সেখানেই সিদ্ধি লাভ করেছিলেন সন্ন্যাসী সত্যানন্দ মহারাজ। এই গাড়রাসিনি পাহাড়ের পূর্বদিকে পড়বে খাঁদারানি ড্যাম। এই বাঁধের পান্না সবুজ জল আর পারিপার্শ্বিক সবুজ অরণ্যের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হবেন।
হাতে সময় থাকলে চলে যেতে পারেন ২২ কিলোমিটার দূরে কাঁকড়াঝোড়। পাহাড়ঘেরা ঝরনা ঝংকৃত সবচেয়ে সুন্দর বনাঞ্চল এই কাঁকড়াঝোড়। এখনও পড়ে রইল লালজল গুহা, মযূর ঝরনা, তালবেড়িয়া ড্যাম। এসব দেখতে আরও একটা দিন অন্তত হাতে সময় রাখুন। এবার ঝাড়গ্রাম ফিরবেন, না ঝিলিমিলি, রানিবাঁধ, মুকুটমণিপুর-এর দিকে গাড়ি ছোটাবেন সেটা আপনার মর্জি।
কীভাবে যাবেন : হাওড়া থেকে ঝাড়গ্রাম পৌঁছোতে দক্ষিণ পূর্ব রেলপথের ট্রেন ধরুন। তালিকায় রয়েছে ইস্পাত, স্টিল, লালমাটি, হাতিয়া, জনশতাব্দীর মতো ট্রেন। ঝাড়গ্রাম থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে বেলপাহাড়ি ঘুরতে নিজস্ব গাড়ি রাখলেই ভালো হয়।
কোথায় থাকবেন : সরকারি গেস্ট হাউসের মধ্যে ঝাড়গ্রাম টুরিস্ট কমপ্লেক্স (০৩৩-২২৩৩৪০), ঝাড়গ্রাম টু্যরিজম ডেভলপমেন্ট কমিটি (৯৪৩৪৫০৮০২৮), ঝাড়গ্রাম প্রকৃতি পর্য্যটন কেন্দ্র (০৩৩-২২২৮৫৪৯)। ভাড়া ২০০০ টাকার মধ্যে। এছাড়াও বিভিন্ন মানের বিভিন্ন দামের অনেক বেসরকারি হোটেল রয়েছে। ভাড়া মোটামুটি ৬০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে।
প্রযোজনীয় তথ্য : এই রুটে বাস চললেও ঝাড়গ্রাম থেকে ভাড়া গাড়ি করে নেওয়াই সুবিধা। বেলপাহাড়ি ঘুরতে ১৫০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকার মধ্যে গাড়ি ভাড়া পড়বে।
ঝাড়গ্রামে সরকারি রুম বুকিং-এর জন্য কলকাতায় যোগাযোগের ঠিকানা : ৩/২ বিবিডি বাগ, কলকাতা-৭০০ ০০১ এবং ৬৫, রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার, ৭ম ফ্লোর, কলকাতা-৭০০ ০১৩।