অফিসে লাঞ্চটাইম চলছে। অসিত খেয়াল করল শ্রেয়া এক মনে নিজের টেবিলে বসে কাজ করছে। ওর পিছনে লাগার ইচ্ছেটা কিছুতেই দমন করতে পারল না অসিত। শ্রেয়ার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল, কী ম্যাডাম, এরকম একজন স্মার্ট হ্যান্ডসাম পুরুষমানুষ আপনার সামনে দাঁড়িয়ে অথচ আপনার চোখ টেবিলে রাখা খাতায় নিবদ্ধ। এটা আমার প্রতি অবিচার নয়?

কোনওরকম ভনিতা ছাড়াই শ্রেয়া মুখ তুলে অসিতের দিকে চাইল, মুখে একটু হাসি টেনে উত্তর দিল, উফঃ অসিত আবার তুমি আরম্ভ করেছ?

ম্যাডাম আমি এটাই জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলাম আজ রাতের ডিনার কি আমাকে একাই খেতে হবে, নাকি ম্যাডাম তাঁর মহামূল্যবান সময়ে কিছুটা আমার জন্য ব্যয় করতে পারবেন?

অসিতের অতি নাটকীয়তা দেখে শ্রেয়া আর গম্ভীর থাকতে পারে না, হেসে ফেলে।

কারণটা জানতে পারি অসিত?

একটা ভালো রেস্তোরাঁর কথা সন্দীপ বলছিল।

আমাকে এসব বলার মানে কি?

ওখানকার ইটালিয়ান ফুড নাকি দারুণ পপুলার।

তো?

প্লিজ আজ রাতে আমার সঙ্গে ওখানে ডিনারের জন্য হ্যাঁ করে দাও।

সরি, অসিত, আমার একটা…।

কাজ আছে। এই ডায়লগ আমি রোজ শুনি তোমার মুখে। এবার অ্যাটলিস্ট ফর এ চেঞ্জ হ্যাঁ বলে দাও।

না, আর এবার আমার মাথা খাওয়া বন্ধ করো। হাসতে হাসতে ধমকের সুরে বলে শ্রেয়া।

অসিত শ্রেয়ার সামনে রাখা চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে বসতে আহত স্বরে বলে, শ্রেয়া, আমাকে কি তুমি ভালো বন্ধু বলে মনে করো না?

তোমার থেকে ভালো বন্ধু আমার আর কেউ নেই।

তাহলে তুমি আমার সঙ্গে কেন ডিনারে যেতে পারো না?

কারণ তুমি বন্ধুত্বের সীমা লঙ্ঘন করে আমাকে ফাঁসাবার চক্করে রয়েছ।

আমাদের বন্ধুত্ব ভালোবাসার পরিণতি পেলে বরং ভালোই। এতে তোমার এত আপত্তি কেন? কখনও না কখনও তো তোমাকে নিজের জীবনসঙ্গী খুঁজে নিতেই হবে, তাই না? সুতরাং আমার থেকে ভালো জীবনসঙ্গী তুমি কোথায় পাবে? অসিত খুব কায়দা করে নিজের কলার উঠিয়ে এমন মুখভঙ্গি করল, শ্রেয়া খিলখিল করে হেসে উঠল।

তাহলে কটার সময় এবং কোথায় দেখা হচ্ছে? শ্রেয়াকে হাসতে দেখে সাহস করে অসিত প্রশ্ন করল।

কোথাও না।

আবার কী হল। এই তো রাজি হয়েছিলে।

এখন এটা হল যে, তোমার মতো ছেলেরা যারা মেয়েদের পিছনে ঘুরঘুর করে, আমার তাদের একদম পছন্দ নয়। কেউ আমার মিথ্যে প্রশংসা করে আমাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলতে পারবে আমি একেবারেই এই ধরনের মেয়ে নই অসিত। এখন প্লিজ আর আমায় বিরক্ত করো না, হাতজোড় করে মিনতি করে শ্রেয়া।

উঁহু, এখুনি ছাড়ছি না। প্রথম কথা হল মেয়েদের পিছনে নয়, শুধুমাত্র একটি মেয়ের পিছনেই ঘুরঘুর করি, যদি তার মনে আমার জন্য একটুও দুর্বলতা জন্মায়, এই আশায়। আর দ্বিতীয়ত আমি কখনওই তোমার মিথ্যা প্রশংসা করি না। আমার চোখে তুমিই সবথেকে সুন্দরী। অসিতের চোখে নিজের প্রতি গভীর প্রেম অনুভব করে শ্রেয়া, জুতসই কোনও জবাব দিতে পারে না।

গভীর শ্বাস নেয় শ্রেয়া। তারপর খুব কোমল স্বরে বলে, অসিত তুমি আমার সম্পর্কে কিছুই জানো না। প্রেম এবং বিয়ে এই দুটোতেই আমার আপত্তি আছে। তুমি খুব ভালো মনের মানুষ। বরং তুমি অন্য কোনও মেয়ের মন জয় করার চেষ্টা করো। আমি তোমার উপযুক্ত জীবনসঙ্গিনী কোনওদিন হতে পারব না।

ঠিক আছে, কিন্তু এই কথাগুলো আমরা ডিনার করতে করতেও তো আলোচনা করতে পারি।

আজ বাবার সঙ্গে ডিনার করার কথা আছে। সরি অসিত অন্য কোনওদিন।

তাহলে আজ তোমার বাবার সঙ্গেই আমাকে আলাপ করিয়ে দাও। বিয়ে প্রস্তাব নিয়ে কখনও না কখনও তোমার মা-বাবার সঙ্গে গিয়ে আমাকে দেখা করতেই হতো।

অসিত মজার ছলে কথাগুলো বললেও, শ্রেয়া হঠাৎই গম্ভীর হয়ে উঠে। মুহূর্তে কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলে, ও কে। আজ রাত ৯টায় এই ঠিকানায় আমাদের বাড়িতে চলে এসো, বলে একটা কাগজে নিজের ঠিকানা লিখে অসিতের হাতে ধরিয়ে দেয়।

অসিত এতটাও ভাবেনি। শ্রেয়া যে এরকম একটা পদক্ষেপ করবে তা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। কিছুটা আমতা আমতা করেই বলল, থ্যাংক ইউ শ্রেয়া। দেখো আজ আমি তোমার মা-বাবার মন জয় করে নেব। অসিতকে খুবই আনন্দিত মনে হচ্ছিল। শ্রেয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করল।

 

রাত্রে ঠিক সময় অসিত শ্রেয়াদের বাড়ি উপস্থিত হল। স্মার্টলি ড্রেসআপ করে এসেছে অসিত। তাকে দেখে শ্রেয়া হেসে ফেলল। অসিত ভ্রূকুটি করে বলল, কী স্মার্ট লাগছি কিনা বলো?

দারুণ! হাসতে হাসতেই শ্রেয়া অসিতের হাত ধরে ওকে ড্রযিংরুমের দিকে নিয়ে চলল।

এই হাত আর কখনও ছেড়ো না শ্রেয়া, রোমান্টিক স্বরে আস্তে আস্তে শ্রেয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে অসিত বলল।

শাট আপ, ধমক দিল শ্রেয়া। ততক্ষণে ড্রযিং রুমে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা। অসিত লক্ষ্য করল তিনজন রয়েছে সেখানে।

অসিত, এই সুন্দরী মহিলা হলেন আমার মা। আমরা দুজন একসঙ্গে কোথাও গেলে লোকে মাকে আমার দিদি বলে ভুল করে! ইনি হলেন আমার বাবা, রাজনীতি নিয়ে আজকাল একটু বেশিই মাথা ঘামাচ্ছেন তাই খাদির কুর্তা-পাজামা ছাড়া কিছুই পরেন না এখন আর। ইনি হলেন আমার স্টেপফাদার… অরুণকাকু। আমার যখন বারো বছর বয়স তখন মা-বাবার ডিভোর্স হয়ে যায় এবং এর কিছুদিন পরেই মা অরুণকাকুকে বিয়ে করে। এই বাড়িটাও অরুণকাকুর।

আর এ হচ্ছে অসিত, আমরা একসঙ্গে কাজ করি আর অফিসের ছুটির পরেও অসিত আমার সঙ্গে সময় কাটাবার নানা রকম বাহানা খুঁজতে থাকে। আমি নানা ভাবে ওকে না বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাকে বিয়ে করার ইচ্ছে মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারেনি। এখন তোমরা পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করো, আমি ততক্ষণে টেবিলে খাবার সাজাবার ব্যবস্থা করছি, শ্রেয়ার হাসিতে ব্যঙ্গ ফুটে ওঠে যেটা অসিতের চোখে পড়ে যায়। নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় শ্রেয়া।

শ্রেয়ার মা-বাবার ডিভোর্স সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না অসিতের। সেই মুহূর্তে ওখানে বসে অসিতের মনে হল, সত্যি সত্যি শ্রেয়ার ব্যক্তিগত জীবনটা তার একেবারেই অজানা। মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিল অসিত। আজেবাজে চিন্তা মাথা থেকে বার করে তিনজনের প্রশ্নের উত্তর দিতে তৈরি হয়ে নিল সে।

শ্রেয়ার মা অসিতের পরিবারের সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। অসিতের শখ, ভবিষ্যতে কী করার ইচ্ছে, এসব নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করলেন। অসিতও যথাসম্ভব উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিল, তাও ভদ্রমহিলার প্রশ্ন করার ধরন দেখে তার বারবার এটাই মনে হচ্ছিল, মহিলা কিছুতেই তার উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না।

বরং শ্রেয়ার নিজের বাবা মানুষটা অনেক সহজ মনে হল। কিছুটা মন খুলে অসিত ওনার সঙ্গে কথা বলতে সফল হল। মনে হল অসিতের প্রতি ভদ্রলোক বেশ সন্তুষ্ট হয়েছেন। শ্রেয়ার সৎ বাবা কম কথা বলছিলেন। কিন্তু মুখের ভাব দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছিল সকলের কথাই উনি মন দিয়ে শুনছেন। যতবার অসিতের চোখ পড়ছিল ওনার উপর, ততবারই তার নজরে পড়ল ভদ্রলোকের মুখের অমাযিক হাসিটা। ওই হাসি যেন অসিতের মনোবল বাড়াবার কাজেই লাগছে।

যেটা বলার জন্য এতক্ষণ ছটফট করছিল অসিত, সুযোগ বুঝে মুখ খুলল, দেখুন আমি শ্রেয়াকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। আপনারা প্লিজ ওকে বিয়ে জন্য রাজি করাতে আমাকে সাহায্য করুন। আমি কথা দিচ্ছি ওকে আমি সবসময় সুখে আর আনন্দে রাখব।

এতক্ষণ কথাবার্তার মধ্যে শ্রেয়া এসে একবারও তাদের মধ্যে বসল না। বেশ অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ার পর শ্রেয়ার গলার আওয়াজ শোনা গেল, সকলকে টেবিলে খেতে ডাকছে।

খাওয়া শেষ করে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অসিত বাইরে এসে দাঁড়াল। শ্রেয়া এসেছিল ওকে বাইরে অবধি ছাড়তে। শ্রেয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে অসিত বলল, তোমার মা-কে শুধু রাজি করাবার ভার তোমার উপর। তোমার বাবা আর অরুণকাকুর আমাকে পছন্দ হয়ে গেছে।

অরুণকাকু একটু তোমার সঙ্গে বেরোবেন। যা বলবেন তাই করবে, শ্রেয়া ধীর স্বরে অসিতকে এই কথা বলতেই অসিত চমকে উঠল। এরকম একটা আকস্মিকতার জন্য সে একেবারেই তৈরি ছিল না।

আমি একটু বাজার হয়ে আসছি, বলে অরুণকাকু অসিতের মোটরবাইকে উঠে বসলেন।

 

ভিতরে এসে শ্রেয়া প্রথমে ডাইনিং টেবিল পরিষ্কার করে তারপর অবশিষ্ট খাবার ফ্রিজে তুলে রাখে। তারপর ড্রইংরুমে এসে কোনও ভমিকা না করেই বলল, আসিতকে বিয়ে করতে আমি খুব একটা উৎসুক নই। কিন্তু ও আমাকে বিয়ে করার জন্য একমাস ধরে পাগল করে দিয়েছে। এখন তোমরা দুজন কী ভাবছ আমার আর অসিতের বিয়ে নিয়ে সেটা আমি এখনই স্পষ্ট করে তোমাদের মুখ থেকে শুনতে চাই।

আমার তো অসিতকে বুদ্ধিমান এবং গুণী ছেলে বলেই মনে হল। আমার মতে ও তোর জন্য খুবই ভালো পাত্র, নির্দ্বিধায় ওকে বিয়ে করতে পারিস, মনের কথা জানালেন শ্রেয়ার বাবা।

আমার তো মনে হয়, তাড়াহুড়ো করে কোনও সিদ্ধান্ত না নেওয়াই ভালো। যতক্ষণ না শ্রেয়া তোমার মন এই বিয়ে জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত, ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ভালো হবে। শ্রেয়ার মায়ে গলার আওয়াজে এটা স্পষ্টই বোঝা গেল যে, তিনি অসিতকে জামাই হিসেবে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।

মা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বোলো না। পরিষ্কার করে বলো তো কেন তোমার অসিতকে পছন্দ হয়নি? তীক্ষ্ণ স্বরে শ্রেয়া মা-কে চ্যালেঞ্জ করল।

এমনিতে ছেলেটির স্বভাব-চরিত্র ভালোই মনে হল কিন্তু তোদের দুটিকে ঠিক যেন মানাচ্ছে না। ছেলেটি একটু বেশি রোগা আর পার্সোনালিটির বড়োই অভাব। তার উপর চোখে চশমা, অসিতকে পছন্দ না হওয়ার কারণ পরিষ্কারই মেয়ের কাছে স্বীকার করলেন তিনি।

শ্রেয়া, মায়ের বুদ্ধিহীন কথাবার্তায় একেবারে কান দিস না। শ্রেয়ার বাবা রীতিমতো বিরক্ত হলেন, শ্রেয়া, তোর মা মানুষের সৌন্দর‌্য দেখে তার ক্ষমতা কতদূর সেটা ডিসাইড করে। মানুষের ভিতরটা দেখার চেষ্টা করে না। অসিত তোকে সত্যিই ভালোবাসে এটার কোনও গুরুত্ব নেই তোর মায়ে কাছে।

শুধু ভালোবাসলেই পেট ভরে যাবে? ব্যক্তিত্ববান পুরুষ হলে শ্রেয়া নিশ্চয়ই ওর প্রতি আকর্ষিত হতো, শ্রেয়ার মা-ও থেমে থাকার পাত্রী নন।

দুজনেই ভালো রোজগার করে। আমার বিশ্বাস শ্রেয়াকে ও সুখেই রাখবে।

নিজের স্ত্রীকে সুখী করতে হলে শুধু টাকাপয়সা হলেই হয় না, একে অপরকে বোঝাটাও খুব দরকার হয়। নিজেদের মধ্যে সঠিক বোঝাপড়া এবং একে অপরকে ভালো লাগাটা গুরুত্বপূর্ণ।

শ্রেয়া, বিবাহিত জীবনে নিশ্চিন্ত থাকার জন্য ব্যাংকে মোটা টাকা থাকা বেশি জরুরি। বাড়ির ভিতর সুখ-শান্তি থাকলে ভালোবাসা আর বোঝাপড়া ঠিকই আপনে আপ তৈরি হয়ে যায়।

তাহলে আমাদের ডিভোর্স কেন হয়েছিল? ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন শ্রেয়ার মা।

তোমার অকৃতজ্ঞতা এবং চরিত্রহীনতার কারণে, শ্রেয়ার বাবা কথাগুলো বলতেই আগুন ছিটকে পড়তে থাকে শ্রেয়ার মায়ে চোখ দিয়ে।

-তোমার হাতে দিনরাত অসম্মানিত হওয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য আমি ডিভোর্স চেয়েছিলাম। তুমি তো টাকা রোজগারের মেশিন ছিলে। আমার জন্য তোমার কাছে এতটুকু কোনও সময় ছিল? যখনই তোমার সঙ্গে নিজের মনের কথা শেয়ার করতে চেয়েছি, তুমি মারধোর করে আমার মুখ বন্ধ করে দিয়েছ। ডিভোর্স না হলে হয়তো আমি পাগল হয়ে যেতাম, আর নয়তো আমাকে আত্মহত্যা করতে হতো।

-তোমার এইসব মিথ্যা কথা শ্রেয়া এখন আর বিশ্বাস করে না। কেন শুধু শুধু মিথ্যা কথাগুলো বলছ? সবাই জানে অরুণের হিরোর মতো চেহারা দেখেই আমাকে ঠকাবার কথা তোমার মাথায় আসে। তুমি শরীরের সৌন্দর্য ছাড়া কখনও কিছু বোঝোনি আর আজও কিছু বোঝো না। আর এই জন্যই শ্রেয়াকেও ভুল উপদেশ দিচ্ছ।

-নিজেকে বেশি স্মার্ট দেখাবার চেষ্টা কোরো না।

একে অপরকে দোষারোপের পালা চলল অন্তত পনেরো-কুড়ি মিনিট ধরে। কেউ-ই ছাড়বার পাত্র নয়। শ্রেয়া এতক্ষণ চুপ করেই বসে ছিল। হঠাৎই উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল। শ্রেয়াকে উঠতে দেখে ওর মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া যেমন হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল, তেমনি হঠাৎই স্তব্ধ হয়ে গেল।

কোথায় যাচ্ছিস? মায়ের এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শ্রেয়া ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

খানিকক্ষণ পর শ্রেয়া আবার ঘরে ঢুকল। এবার সঙ্গে অরুণ আর অসিত। মা-বাবাকে আশ্চর্য হতে দেখে এবার শ্রেয়া মুখ খুলল, অবাক হওয়ার কিছু নেই, ওরা দুজন বাইরে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে তোমাদের ঝগড়া শুনেছে। আমি এখন অসিতের সঙ্গে কথা বলব। আর এর মধ্যে তোমরা যদি কেউ কথা বলেছ, তাহলে আমি এই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে চলে যাব আর নিজের থাকার আলাদা ব্যবস্থা করে নেব।

শ্রেয়ার বাবা-মা মেয়েকে এতটা রাগতে কোনও দিন দেখেননি। সুতরাং ওনারাও আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। শ্রেয়া এবার অসিতের দিকে সোজাসুজি তাকাল, এবার বুঝতে পারছ তো বিয়ের উপর কেন আমার এত ঘেন্না! এতটা অ্যালার্জি! বারো বছর বয়স পর্যন্ত খুব কমই আমি এদেরকে ভালো ভাবে কথা বলতে দেখেছি বা শুনেছি। বাবা যখন মায়ের গায়ে হাত তুলত, মাকে বাঁচাতে গিয়ে কতবার যে বাবার হাতে মার খেয়েছি, গুনে বলতে পারব না। ডিভোর্সের পর মা সকলের সামনে প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে, মা একলাই আমাকে ভালো ভাবে বড়ো করে তোলার ক্ষমতা রাখে। আমার কেরিয়ার গড়ে দেওয়ার নাম করে মা-ও শারীরিক আর মানসিক ভাবে কিছু কম অত্যাচার করেনি আমার উপর।

এরা কোনওদিনই ভালো স্বামী-স্ত্রী হতে পারেনি। আর ভালো মা-বাবাও না। এদের জন্যই আমি সারা জীবন বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অসিত, তুমি আমাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দাও। বাড়ি যাও, অনেক ভালো মেয়ে ভালো পরিবার তুমি পাবে।

এই প্রথম অসিত কোনও উত্তর খুঁজে পেল না। শ্রেয়ার মা-বাবার ঝগড়া তাকে ভিতরে ভিতরে অনেকটাই বিহ্বল করে দিয়েছিল। খুব ডিপ্রেসড মনে হচ্ছিল।

এতক্ষণ অরুণ একটা কথাও বলেননি। অসিতকে চুপ করে থাকতে দেখে প্রথম কথা বললেন, এই পরিস্থিতি বিবেচনা করে কিছু কথা আমারও মনে হচ্ছে, সেটা আমি তোমাদের দুজনের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। হয়তো আমার কথা শুনলে তোমরা সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারবে। ডিভোর্সের আগে আমি আর সীমা মানে শ্রেয়ার মা ভালো বন্ধু ছিলাম। সীমা আমার সঙ্গে তার দুঃখ, ডিপ্রেশন, একাকিত্ববোধ সব কিছুই শেয়ার করত। ভালো বন্ধু হিসেবে এবং সীমার মনোবল যাতে ভেঙে না পড়ে, তার জন্য যতটুকু আমার পক্ষে সম্ভব করতাম। সীমাকে খুশি রাখা, ওকে হাসতে, কথা বলতে দেখলে তখনও আমি আনন্দ পেতাম আর এখনও পাই। সীমা অসম্ভব মুডি একটা মানুষ কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসে না। যে-কোনও পরিস্থিতিতে আমি ওকে শুধু খুশি দেখতে চাই।

আমি তোমাদের দুজনকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই এবং আশা রাখি সততার সঙ্গে তোমরা উত্তর দেবে। অসিত, শ্রেয়াকে খুশি হতে দেখে তুমিও কি মনে আনন্দ পাও?

হ্যাঁ, প্রচণ্ড আনন্দ পাই। কাকু, শ্রেয়া যখন আমার কোনও কথায় হেসে ওঠে, আমি যখন ওর কোনও কাজে আসতে পারি কিংবা ও যদি হঠাৎ হঠাৎ ব্যক্তিত্বের পর্দা সরিয়ে স্বভাবসুলভ মিষ্টি ভাবে আমার সঙ্গে কথা বলে, তখন সেই আনন্দ আমি কোথায় রাখব বুঝতে পারি না।

শ্রেয়া, অসিতের কোন গুণ তোমাকে সব থেকে বেশি আকর্ষণ করে? কোমল স্বরে অরুণ শ্রেয়ার কাছে প্রশ্নটা রাখেন।

কিছুক্ষণ ভেবে শ্রেয়ার ঠোঁটের কোণায় অল্প একটু হাসি ফুটে ওঠে। অসিতের দিকে তাকিয়ে শ্রেয়া জবাব দেয়, এই পাগলটা আমাকে

যে-কোনও পরিস্থিতিতে হাসাতে পারে। অসিত পুরো জোকার।

আমার প্রশংসা করার জন্য ধন্যবাদ, নাটকীয় ভঙ্গিতে সামনে অল্প ঝুঁকে অসিত বলে।

এবার শ্রেয়া খিলখিল করে হেসে ওঠে। কাকু তুমি দ্যাখো অসিতকে।

শ্রেয়া, অসিত তোমাকে হাসাতে পারে, এটাকে কিন্তু খুব ছোটো করে দেখো না। তোমরা দুজনে এমনিতেই খুব ভালো বন্ধু। এই বন্ধুত্বের ভিতকে আরও শক্ত করার লক্ষ্যে তোমরা দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাও।

তোমার বাবা-মার জীবনে যেটা হয়েছে সেটা তোমার জীবনেও ঘটবে এমন কোথাও লেখা আছে কি? অসিত তোমাকে জীবনসঙ্গী করতে চায় সুতরাং ওকে সুযোগ তো দাও। নিশ্চয়ই তোমাদের বিয়ে সফল হবে। শ্রেয়া তুমি খুব ভালো করেই জানো একটা বিয়ে একটা সম্পর্ক কী কী কারণে ভাঙতে পারে। সুতরাং বিয়ে না করার ভাবনা মন থেকে সরিয়ে সম্পর্কের ভিত কী ভাবে মজবুত করবে, সেটা চিন্তা করো। তোমার মা-কে বোঝাবার দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। কথা দিচ্ছি আমাদের সকলের আশীর্বাদ তোমাদের সঙ্গে থাকবে। অরুণ স্নেহভরে শ্রেয়ার মাথায় হাত রাখে আর অসিতকে আলিঙ্গনবদ্ধ করে।

শ্রেয়া অসিতকে বিয়ে করে নে। একলা জীবন কাটানো খুব কঠিন। একাকিত্ব আমাকে এমন জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যে, তোর মা যদি অরুণকে ছেড়ে আমার কাছে ফিরে আসতে চায়, তাহলে এই বদমেজাজি মহিলাকেও ফিরিয়ে নিতে দ্বিধা করব না, শ্রেয়ার বাবার রসিকতায় সকলেই হেসে ওঠে। পরিবেশ অনেকটাই হালকা হয়ে ওঠে।

শ্রেয়া প্লিজ, এবার তো হ্যাঁ বলে দাও। কালকের পার্টি-টা নিয়ে আলোচনা করতে হবে, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে ওঠে অসিত।

কী পার্টি অসিত? অবাক হয় শ্রেয়া।

আমার হবু বউয়ে সঙ্গে অফিসের কলিগদের পরিচয় করাব আর ওরা পার্টি না নিয়ে আমাদের ছেড়ে দেবে ভেবেছ?

শ্রেয়া অসিতের চোখে চোখ রাখে। সেখানে নিজের প্রতি অসিতের ভালোবাসা, সম্মান, সমস্ত অনুভতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিজের মনের ভিতর উঁকি দেয় শ্রেয়া। অসিতের জন্য ভালোবাসা, প্রেম ছাড়া কিছুই নজরে পড়ে না তার। এগিয়ে এসে অসিতের চোখে চোখ রেখেই ছোট্ট একটা হ্যাঁ বলে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করে অসিতের বাহুবন্ধনে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...