মধ্যমগ্রামের এই পাড়াটা বেশ নিঝুম। পাড়াজুড়ে ছোটো ছোটো বাড়ি, খান দুয়েক পুকুর। মধ্যবিত্ত বসতি বললেও ভুল হয় না। কিন্তু সব জায়গাতেই এখন প্রোমোটারের চোখ। তারা গৃহস্থকে বসতবাড়ি বেচে, ফ্ল্যাট আর নগদ টাকার লোভ দেখাচ্ছে অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করার অভিপ্রায়ে। সেই লোভেই মধুসূদনবাবু তাঁর পৈতৃক ভিটে আর সংলগ্ন বেশ কিছুটা বাগান বেচে দিয়েছেন দুলাল প্রোমোটারকে। সেখানেই গড়ে উঠেছে এই বসুন্ধরা অ্যাপার্টমেন্ট আধুনিক জি প্লাস ফোর ফর্মুলায়।
এ পাড়ায় এত বড়ো বাড়ি এই মুহূর্তে ওই একটিই। অ্যাপার্টমেন্ট-এ বাকি বাসিন্দারা সকলেই এসেছেন অন্যান্য জায়গা থেকে। একতলাটা পুরোটাই মধুসূদনবাবু ও তাঁর পুত্রের পরিবারের দখলে। দুতলার দুটি ফ্ল্যাটের একটিতে প্রভাতিদেবী একাই থাকেন। একসময় রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী ছিলেন। বিয়ে করেননি। অন্য ফ্ল্যাটটি আগাগোড়াই তালাবন্ধ। কোণার দিকের দুটি ফ্ল্যাটের মাঝের দেয়াল ভেঙে একটাই করে নিয়েছেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার শোভন সোম। বছরে ছমাস জলে, ছমাস স্থলে থাকেন তিনি। বিরাট ফ্ল্যাটে বেশির ভাগ সময়টাই তাঁর বউ কেয়া, একাই থাকে।
তিনতলায় একটি ফ্ল্যাট সদ্য বিক্রি হয়েছে। কিন্তু বাসিন্দারা এখনও আসেননি। বাকি তিনটিতে থাকেন, মানস ও রূপা সান্যাল ও তাদের দুটি ছেলেমেয়ে চক্রবর্তী পরিবারের মোট ছজন। আর কোণার ফ্ল্যাটটায় সোনালি ও শুভম নামের এক নবদম্পতি।
চারতলায় ফ্ল্যাটে থাকে সাহা পরিবার। এক ছেলে, বউ, নাতিকে নিয়ে স্বপন সাহাবাবু। স্ত্রী বিয়োগের পর ছেলে এখানেই নিয়ে এসেছে তাঁকে। অন্য তিনটিতে যথাক্রমে প্রবীর জানা, মহেশ জালান, হাবিবুর রহমান ও তাঁদের পরিবার৷
বস্তুত বসুন্ধরা অ্যাপার্টমেন্ট যেন এক মিনি ভারতবর্ষ। বিবিধের মাঝে মিলন মহান। অর্থাৎ ফ্ল্যাটের সকলে সকলের পরমাত্মীয়। হোলি, দীপাবলি, ইদ, সরস্বতী পুজো, সবই ছাদে হয় ধুমধাম করে। আর মাঝে মাঝে ছাদের উপর ছোটোখাটো পিকনিক বা ফিস্ট তো লেগে থাকেই।সারাদিন ছাদে হুটোপাটি করে বেড়ায় জানা, জালান ও সান্যালদের ছেলেমেয়েরা। বিকেলে ছাদে চুল বাঁধতে ওঠে বাড়ির গিন্নিরা। এ ওর চুলের পরিচর্যা করে দেয়। বিনুনির গিঁটে বাঁধা থাকে কত সুখ-দুঃখের সখ্যতার গল্প। সকলে সকলের পাশে থাকে বিপদে আপদে। চক্রবর্তী গিন্নীর পায়ে বাতের তেল মালিশ করে দিচ্ছিল রূপা। আয়েশে চোখ বুজে সদ্য বিবাহিতা সোনালিকে বলেন চক্রবর্তী গিন্নি,
-হ্যাঁ লা সোনালি কবে বাচ্চাকাচ্চা আনবি তুই। যেভাবে বাতে ধরেছে আমায়, আর কবে মানুষ করব তোর ছেলে!
সবাই হাসিতে ফেটে পড়ে, সোনালি লাল হয়ে যায় লজ্জায়।
-আহ্ জেঠি, তোমার যত তাড়া। একটু হাসতে খেলতে দাও মেয়েটাকে। সদ্য বিয়ে হয়েছে, আগে কটা দিন একটু সোহাগ করুক, বলে রূপা। আবার হাসিতে ফেটে পড়ে সকলে। এভাবেই নানা সুখ-দুঃখ-আনন্দ নিয়ে রোজ বিকেলে ছাদের এই মজলিশ বসে বসুন্ধরা অ্যাপার্টমেন্ট-এর বাসিন্দাদের।
মাস খানেক পর দুপুরে তিনতলার মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের বউ কেয়া খেয়ে উঠে স্নান করে কলঘরে রাখা ভিজে জামাকাপড় বারান্দায় মেলতে এল। নীচে তাকাতেই খেয়াল করল একটা বড়ো ম্যাটাডর থেকে কাদের যেন প্রচুর আসবাব, জিনিসপত্র নামানো হচ্ছে। একটা ইনোভা গাড়ি থেকে নামলেন এক দম্পতি। দুজনেই পঞ্চাশোর্ধ। তারাই তদারক করে তাদের অ্যাপার্টমেন্ট-এ মালগুলো তোলাতে শুরু করলেন। কেয়া বুঝল, তার ফ্লোরের বিক্রি হওয়া ফ্ল্যাটটির বাসিন্দারা এসে গেছে।
আইপিস দিয়ে দেখল, যা ভেবেছে তাই। একটা নেমপ্লেট লাগানোর কাজ চলছে, তাতে লেখা, নির্মল চ্যাটার্জী-সোমা চ্যাটার্জি। কেয়া একটু নিশ্চিন্ত হল, যাক একই ফ্লোরে কথা বলার দুটো লোক পাওয়া যাবে। এমনিতে তো তার একা একাই কাটে বছরের ছটা মাস। ফোনে বাকি ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সুখবরটা জানিয়ে দেয় কেয়া।
সবাই হইহই করে নেমে আসে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে, আলাপ জমাতে। মিসেস জানা, পার্বতী জালান, সফিউন্নিসা সবাই খুব আন্তরিক ভাবেই এগিয়ে যায়, জিনিসপত্র ঘরে ঢোকাতে সাহায্য করে।
কেয়া এগিয়ে এসে বলেন কাকিমা আজ রাতে আর রান্না করতে হবে না। আমার কাছেই খাবেন।
রূপা বলে আপনারা একটু জিরিয়ে নিন, আমি এখুনি চা নিয়ে আসছি।
সাহাবাবুর বউমা স্বরলিপি বলে, কাকিমা আপনার গ্যাসের কানেকশন যতদিন না হচ্ছে, আমি আমার এক্সট্রা সিলিন্ডারটা দিয়ে যাব। আপনার অসুবিধে হবে না।
এরকম প্রতিবেশী পাওয়া বিরল। কিন্তু এক্ষেত্রে ঘটল ঠিক উলটো। সোমা চ্যাটার্জী প্রায় তিরিক্ষি মেজাজে সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন আপনাদের কারও থেকে কোনও সাহায্য লাগবে না। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা না দেখে যে-যার ঘরে ঢুকে যান। আমরা সব সামলে নেব। অযথা গায়ে পড়া আমার পছন্দ নয়।
ওনার স্বামী নির্মলবাবু বাধা দিয়ে বলতে যান
-আহ্ সোমা…
-তুমি থামো তো! সাহায্যের নামে সব কৌতুহল মেটাতে এসেছে। বুঝি না আমি! বললেন সোমা।
এরপর আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। যে যার ঘরে ঢুকে গেল। এরকম অপ্রীতিকর একটা পরিস্থিতি কখনও হয়নি বসুন্ধরা অ্যাপার্টমেন্ট-এ। পুরো বাড়িটা কেমন থম মেরে গেল। বাচ্চারা অন্যান্য দিনের মতো আজ সিঁড়ি দিয়ে দৌড়োদৌড়ি করল না বড়োদের নিষেধ মেনে।
দিন দুয়েক পর বাকিরা কিছুটা স্বাভাবিক হলে, সেদিন প্রায় সারারাত অবধি তারস্বরে ঝগড়া চলল সদ্য আগত চ্যাটার্জী দম্পতির মধ্যে। এমনই সেই ঝগড়া আর বাসন ছোড়ার শব্দ যে, বাসিন্দারা হতবাক।
পরদিন বিকেলে ছাদের মজলিশে নিচুস্বরে ওই একটিই প্রসঙ্গ আলোচিত হল। চক্রবর্তী গিন্নি সব শুনে বললেন,
– নিশ্চয়ই ওদের মধ্যে কিছু নিয়ে অভাব বোধ আছে, বুঝলি। পয়সাই কী সব নাকি!
সত্যি বলতে কী সবার কৌতুহল বাড়ল। এই বয়সি দম্পতি এভাবে ঝগড়া করে কেন!
সপ্তাহ খানেক পর বাচ্চারা সিঁড়িতে হইচই করছিল। সোমা চ্যাটার্জী দরজা খুলে ঠাস করে একটি বাচ্চার গালে এক চড় লাগিয়ে দিলেন।
-পুজোয় বসেছি, আর তোরা চিত্কার করছিস, আপদের দল!
বাচ্চারা খেলা থামিয়ে মুখ চুন করে যে যার বাড়ি চলে গেল। এই দম্পতি তাদের কাছেও ত্রাস হয়ে উঠল।
দিন যায়, চ্যাটার্জী দম্পতির ঝগড়ার মাত্রাও বাড়ে। ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে বাকিদের প্রাণ। অ্যাপার্টমেন্ট-এর মিটিং-এ ডাক পড়ে চ্যাটার্জীদের। ওঁরা কেউ আসার প্রয়োজনই মনে করেন না।
চক্রবর্তী মশাই বলেন, ওদের নিয়ে ভেবে লাভ নেই। মাথায় গণ্ডগোল আছে মনে হয় মহিলার। প্রসঙ্গটা তখনকার মতো চাপা পড়ে গেল। ঠিক হল, সামনেই হোলি। প্রতি বছরের মতো এবছরও বিকেলে ছাদে বসন্ত উত্সব হবে। তারপর খাওয়া দাওয়া। ওঁদেরও নিমন্ত্রণ করা হবে। এলে ভালো, না এলে আর কোনও কিছুতেই ওদের আমন্ত্রণ জানানো হবে না।
২
হোলি হ্যায়… আজ আর বাচ্চাগুলোকে আটকায় কার সাধ্যি। সবার ফ্ল্যাটে ঢুকে ঢুকে রং মাখাচ্ছে তারা। আনন্দ জিনিসটা খুব ছোঁয়াচে। বড়োরাও তাদের সঙ্গে সামিল হয়ে যাচ্ছে আবির খেলায়। কমবয়সি বউ-রা মিলে একটা থালায় আবির নিয়ে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে গিয়ে বড়োদের পায়ে আবির দিচ্ছে। এই উত্সবের দিনে সোমা চ্যাটার্জীকেও বাদ দিতে ইচ্ছে হল না তাদের। সাহস করে কলিংবেল বাজিয়ে ফেলল কেয়া। অপমানিত হবে ভেবেও তারা ঠিক করেছে, আজ কাকিমা খারাপ কিছু বললেও, তাঁকে টেনে নিয়ে আসবে রঙের খেলায়। রাতের খাওয়াদাওয়ার তো জোগাড় করতে হবে সবাই মিলে। জানাবাবু, রহমানসাহেব বাজারে গেছেন সব কিনেকেটে আনতে।
বেল বাজিয়ে কেয়ারা অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু দরজা খুলে যিনি বেরিয়ে এলেন, তিনি যেন তাদের চেনা ওই রণচণ্ডী সোমা কাকিমা নয়। যেন সদ্য তার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে, এরকম অসহায় উদ্বিগ্ন একটা চেহারা নিয়ে সোমা কাকিমা দাঁড়িয়ে৷
-কী হয়েছে কাকিমা? স্বরলিপি প্রশ্ন করে। কিছু বলতে পারেন না সোমা, হাউহাউ করে কেঁদে ওঠেন। বাথরুমের দিকে আঙুল দেখান। সকলে সেদিকেই ছুটে গিয়ে দেখে মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ে আছেন নির্মলবাবু অচেতন অবস্থায়, রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। সোফায় সোমাকে বসিয়ে কেয়া জানতে চায়,
– কী করে এসব হল কাকিমা!
-সকালে একটু আগে বাথরুম গেল। শরীরটা ভালো নেই কাল রাত থেকে। আমি বললাম, দরজাটা ভেতর থেকে লক কোরো না বাথরুমের। আমি রান্নাঘরে ছিলাম। হঠাৎ খুব জোরে একটা শব্দ হয়। ছুটে এসে দেখি এই দৃশ্য!
এরপর ছোটাছুটি, অ্যাম্বুল্যান্স। বাইপাসের একটা বড়ো নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয় নির্মলবাবুকে। স্ট্রোক হওয়ায় এই বিপত্তি। মাথার পেছনের একটা অংশ ফেটেও গেছে, পড়ার সময় কোমোডে ধাক্কা লেগে। বেশ কটা দিন ভর্তি থাকতে হবে নির্মলবাবুকে।
রোজ পালা করে কেউ না কেউ সোমা চ্যাটার্জীর সঙ্গে নার্সিংহোমে গেল বসুন্ধরা অ্যাপার্টমেন্ট থেকে। সোমা স্বীকার করেছেন, তাঁর এই রূঢ়ভাষণের জন্য সব আত্মীয়রা সম্পর্কচ্ছেদ করেছে তাঁদের সঙ্গে। আসলে সন্তানহীনতায় পারস্পরিক দোষারোপ, তাদের দাম্পত্য সম্পর্কটা তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছিল। এই ঘটনা না ঘটলে হয়তো সোমা অনুভব করতেন না, ফল্গুর স্রোতের মতো কোথাও একটা অব্যক্ত অদেখা ভালোবাসার স্রোত তার ভেতর এখনও বয়ে চলে। শুধু নির্মলের জন্যই নয়, আশপাশের মানুষগুলোর প্রতি ব্যবহারেও একটা পরিবর্তন আনার জন্য, হয়তো খুব দরকার ছিল এই ঘটনাটার।
দিন পনেরো সময় লাগল বটে কিন্তু আস্তে আস্তে নার্সিংহোমে সুস্থ হতে শুরু করলেন নির্মল। প্রতিদিনই সোমা গিয়ে তাঁর সঙ্গে বেশ খানিকটা সময় কাটায়। একদিন খুব খুশি হয়ে সোমা জানালেন, ডাক্তারবাবু অনুমতি দিয়েছে, নির্মলকে এবার বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে।
যথা সময়ে দিনকুড়ি পর বাড়ি ফিরলেন নির্মল। সবাই দেখতে এল। বসুন্ধরা অ্যাপার্টমেন্ট-এ আজ আবার খুশির জোয়ার। হোলির দিনের সেই আনন্দানুষ্ঠান পণ্ড হয়েছিল। সোমা তাই ঘোষণা করলেন এবার একদিন পিকনিক-এর আয়োজন করো তোমরা, সব খরচা দেব আমি আর তোমাদের কাকু। সফিউন্নিসা তুমি বিরিয়ানি রাঁধবে। হইহই করে ওঠে সকলে। এ যেন এক নতুন মানুষকে ফিরে পেল তারা। শুধু নির্মলবাবুরই যে নবজন্ম হল তা নয়, সোমাও যেন এক নতুন অধ্যায় শুরু করলেন তাঁর জীবনের।
৩
এরপর আরও প্রায় তিনমাস কেটে গেছে। চ্যাটার্জী দম্পতি ঠিক করলেন কদিনের জন্য বৃন্দাবন ঘুরে আসবেন। যা ঝড় গেল জীবনের উপর। মন শান্ত করতে একটু তীর্থ করলে ভালোই লাগবে। শেষ অবধি বাক্স গুছিয়ে একদিন রওনা হলেন নির্মল ও সোমা।
বৃন্দাবনের মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি, কর্পূরের গন্ধ, সবমিলে মনটা ভারি শান্ত হয়ে এল সোমার। চাতালের এক কোণে বসে সেই শান্তিই অনুভব করছিলেন তিনি। আশপাশ দিয়ে বহু পর্যটক ও ভক্তদের আনাগোনা দেখছিলেন সোমা। অসংখ্য বিধবার জীবন কেটে যায় মন্দিরের চাতালে বসে, ভোগ প্রসাদ খেয়ে৷ এ এক দুঃখের অধ্যায়, যার সঙ্গে জীবনে এই প্রথমবার পরিচিত হচ্ছিলেন সোমা।
হঠাৎই চোখ গেল মন্দিরের এক কোণায় এক প্রৌঢ় ভদ্রলোকের পা ধরে একটি বছর কুড়ির বউ কান্নাকাটি করছে আর জড়ানো গলায় কী যেন বলছে। প্রৌঢ়টি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিছুটা বিহ্বল হয়ে যেন কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। কৌতূহল চাপতে না পেরে সোমা এগিয়ে গেলেন সেদিকে। শুনলেন মেয়েটি কাতর স্বরে বলছে,
-মুঝে ছোড়কে না জাইয়ে ঠাকুরজি, ম্যায় এক কোণে মে পড়ি রহুঙ্গি। ঘর মে রহনে দিজিয়ে ঠাকুরজি।
মেয়েটি এবার অঝোরে কাঁদতে শুরু করে। পাশে একটা পুঁটলি রাখা। সাদা থান পরা এত অল্পবয়সি বিধবা দেখে মায়া হল সোমার। মেয়েটির সঙ্গের ওই প্রৌঢ়র এবার চোখ যায় সোমার দিকে। সোমা অস্বস্তি কাটিয়ে প্রশ্ন করেন,
– কী হয়েছে ওর!
প্রৌঢ় বলেন, কা বলু বহনজি। এ হামার কপাল। এ আমার সব সে ছোটা ভাইয়ের বউ আছে। শাদি হল কি এক মাস পরেই ভাই মরে গেলো। ঘর মে সব একে ডাইন বলল। সবাই চাইল কি এই বেওয়াকে আমি এই মন্দিরেই ছোড়ে যাই।
সোমা প্রায় আঁতকে উঠলেন ঘটনাটা শুনে। মন্দির প্রদক্ষিণ সেরে নির্মলও তখন এগিয়ে এসেছেন এদের দিকে। সব শুনে তিনিও হতবাক। বললেন,
– এই যুগে কোথায় পড়ে আছেন আপনারা! এমন আবার হয় নাকি। কম বয়সি একটা মেয়ে৷ ওতো অন্ধকারে হারিয়ে যাবে, এখানে ফেলে রেখে গেলে।
-সে আমি কুছু জানি না বাবু। আমরা বিহারের আরা জিলার লোক। আমাদের গ্রামে অনেক ঝামেলা হোবে যদি একে আমি লিয়ে যাই।
সোমা ও নির্মল পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। কী যেন ভাবলেন দুজনেই। তারপর সোমা মেয়েটিকে বললেন,
– তুম হমারে সাথ কলকত্তা যাওগি? মেয়েটি অসহায়ের মতো একবার তাদের দিকে একবার ওই প্রৌঢ়ের দিকে তাকাচ্ছে। প্রৌঢ়ও খানিক অবাক হয়ে বললেন,
-আপনারা ওকে লিয়ে যাবেন, সত্যি? বলে পা দুটো ধরে ফেললেন নির্মলের।
নিয়ে যান বাবু, পিংকি খুব ভালো মেয়ে খুব সেবা করবে আপনাদের। ঘরের সব কামকাজ করে নিবে।
পিংকি নামের মেয়েটি বাংলা বলতে না পারলেও, কথোপকথনটা বুঝতে পেরে, চোখের জল মুছে একটু ধাতস্থ হল। হয়তো বুঝল ভাগ্যকে মেনে নিতেই হবে তাকে। এখানে এই বৃন্দবনের মন্দিরে তার বৈধব্যকাল কাটাতে পারবে না সে। অচিরেই কারও কুদৃষ্টি পড়বে। শেয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে খাবে তাকে।
৪
বসুন্ধরা অ্যাপার্টমেন্ট-এ আজ আবার নতুন অতিথির আগমন। পিংকির কাহিনি শুনে সকলে বেশ অবাক। দশদিনের বৃন্দাবন সফর সেরে চ্যাটার্জী দম্পতি একা ফেরেননি, একটি ফুটফুটে যুবতিকে উদ্ধার করে এনেছেন এই কাহিনি এখন সবার মুখে মুখে।
দিন যায়, পিংকিও এখন অনেকটাই অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছে কলকাতার আদবকায়দার সঙ্গে। চ্যাটার্জী দম্পতি মোটেই কাজের লোকের মতো আচরণ করেননি তার সঙ্গে। বরং সে এ বাড়িতে রয়েছে তাদের মেয়ের মতোই। উলটোদিকের ফ্ল্যাটের কেয়ার কাছে রোজ দুপুরে বাংলা লেখা-পড়া শিখতে যায় পিংকি। যে-কোনও জিনিস চট করে শিখে নেওয়ার ক্ষমতা তার আছে। ফলে বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ের ছাপটা, সে মাস দুয়েকের মধ্যে বেশ কাটিয়ে ফেলেছে।
পিংকি ক্রমশ বসুন্ধরা অ্যাপার্টমেন্ট-এর হৃদস্পন্দন হয়ে উঠল। আজ এ ডাকে পিংকি আয় ফুচকা বানিয়েছি খেয়ে যা, তো কাল অন্য ফ্ল্যাটে ডাক পড়ে পিংকি শপিং-এ যাচ্ছি, যাবি? ফ্ল্যাটের বাচ্চাদেরও প্রাণ পিংকি দিদি৷ ছাদে ক্রিকেট খেলা থেকে ব্যাডমিন্টন, সবেতেই তাদের পিংকিকে চাই। এভাবেই প্রায় একটা বছর কেটে গেল। পিংকিকে এখন দেখলে কেউ বলবে না যে, সে অবাঙালি। সোমারও একটা মনের মতো সঙ্গী হয়েছে পিংকি।
এক দুপুরে সোমার আলমারি গুছিয়ে দিতে দিতে পিংকি বলল,
– মা একটা কথা কদিন ধরেই তোমায় বলব বলব করছি। রাগ করবে না বলো, তাহলে বলতে পারি।
-আরে বল না পাগলি, অত দ্বিধা না করে।
-বলছি যে মা, আমি বিউটি পার্লারের কাজ শিখতে চাই।
-কেন রে, তোর কী অভাব আছে এখানে?
-না মা, অভাব নয়। যে-সম্মান তোমরা আমায় দিয়ে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি আমি পাব।
চোখে জল এসে যায় পিংকির। সে সোমার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
-মা আমি সম্মানের সঙ্গে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।
পিংকির মুখের দিকে তাকিয়ে সোমা বোঝেন এই মেয়ের আত্মবিশ্বাস আর আত্মসম্মান দুই-ই প্রচুর। সোমা আর বাধা দেন না। পিংকির বিউটিশিয়ান কোর্স শুরু হয় পরের মাস থেকেই।
পিংকি কোর্স শেষ করে একটি পার্লারে কাজ পেয়ে যায়। তার আরও কদর বাড়ে বসুন্ধরা অ্যাপার্টমেন্ট-এ। কারও ফেসিয়াল, কারও আইব্রো, রোজ কারও না কারও ফ্ল্যাটে ডাক পড়ে পিংকির। পিংকির স্বপ্ন এবার সে ব্যাংক লোন নিয়ে একটা বিউটি পার্লার খুলবে বসুন্ধরার গ্যারাজে।
কিন্তু জীবন হয়তো পিংকির জন্য আরও কিছু সুখবর জমিয়ে রেখেছিল। এক শীতের দুপুরে চক্রবর্তী গিন্নি বাতের ব্যথা সামলে এলেন সোমার ফ্ল্যাটে। সোমা তখন একটা সোয়েটারের জন্য সবে ঘর তোলা শুরু করেছেন। পিংকি গেছে পার্লারে আর নির্মলবাবু দিবানিদ্রায় মগ্ন।
একটু আমতা আমতা করে কথাটা পেড়েই ফেললেন চক্রবর্তী গিন্নি। বললেন,
– শোনো সোমা, পিংকি মেয়েটি বেশ ভালো। এতদিন তো ওকে দেখছি। কিন্তু তুমিই বা সারাজীবন ওর কী করে দায়িত্ব নেবে। কিছু কি ভেবেছ ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে
সত্যিই কিছু ভাবেননি সোমা। কথাটা শুনে একটু যেন থতমত খেলেন। চক্রবর্তী গিন্নি তার পানের ডিব্বা খুলে এক খিলি পান সোমার দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্যটি নিজে গালে পুরলেন। তারপর একটু মিঠে রস চোখ বুজে গলধঃকরণ করে বললেন,
– ভেবো না অত। আমি পিংকির জন্য এক সুপাত্রের খোঁজ এনেছি।
এবার সোমার সত্যিই অবাক হওয়ার পালা। বললেন,
– মানে? কোথাকার পাত্র! কী ভাবে খোঁজ পেলেন দিদি?
-আরে তোমার চক্রবর্তীদাকে যাঁর কাছে দেখাই, ডক্টর ঝা, ওই মোড়ের মাথায় যাঁর চেম্বার, ওঁর ছেলেও এখন ডাক্তার হয়েছে। বাবার চেম্বারেই বসছে, প্রতি বুধ আর শুক্কুরবার। সেদিন তোমাদের দাদাকে নিয়ে দেখাতে গেছিলাম ডাক্তারখানায়। পিংকিও সঙ্গে গেল না?
-হ্যাঁ সে তো বললেন আপনার রিক্সা থেকে নামা-ওঠা কষ্ট, পিংকি গেলে একটু সুবিধা হয়।
-হ্যাঁ, ঠিক তাই। ওখানেই ডাক্তারের ছেলে দেখেছে পিংকিকে। দেখতে শুনতে ভালো, চটপটে এমন মেয়ে– কচি ডাক্তার তো ভারি পছন্দ করে ফেলেছে গো তোমাদের পিংকিকে!
-তাই নাকি! কী নাম ছেলেটির?
-ওর নাম পবন। ডক্টর ঝা-এর স্ত্রী আমার অনেকদিনের চেনা। মল্লিকা। সে-তো আমায় তার দিনদুয়েক পরেই ফোন করেছে। কে এসেছিল তোমার সঙ্গে। পবনের খুব পছন্দ তাকে। শিগগিরি বলো। তা আমি বাপু সবই বলেছি। ওর ব্যাপারে কিছু লুকোইনি।
-ঠিকই করেছেন দিদি। লুকোনোর প্রয়োজনই বা কী। সব শুনে যদি ওকে কেউ বিয়ে করতে চায়, আমাদের আপত্তি নেই।
-তুমি ভেবো না সোমা। পিংকি আমাদের ভালোই থাকবে। মল্লিকা আমার ছোটোবেলার বন্ধু। ও আমার বাপের বাড়ি ধানবাদেরই মেয়ে৷ডা. ঝা-দের পরিবার খুব দরাজ মনের। উনিও বিহারের একটা ছোটো গ্রাম থেকে উঠে এসে আজ ডাক্তার হিসেবে নাম করেছেন। ছেলেটিও প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করেছে।
এরপর আর দ্বিধার কোনও অবকাশই থাকে না। এর পরের কয়েকটা মাস কারও দম ফেলার ফুরসত থাকে না বসুন্ধরা অ্যাপার্টমেন্ট-এ। বিয়ে বলে কথা। সবাই একটিই পরিবার হয়ে লেগে পড়ে বিয়ের তোড়জোড়ে। পিংকি প্রথমে কিঞ্চিৎ আপত্তি তুলেছিল, মা-বাবাকে ছেড়ে সে যেতে চায় না বলে। কিন্তু পাড়াতেই তার শ্বশুরবাড়ি, সুতরাং বসুন্ধরা অ্যাপার্টমেন্ট থেকে খুব দূরে তাকে যেতে হচ্ছে না শুনে রাজি হয়েছে।
শীত পেরিয়ে বৈশাখের এক শুভদিনে পিংকি আর পবনের বিয়ের দিন স্থির হয়েছে। গোধূলি লগ্নে বিয়ে যে-বিউটি পার্লারে কাজ করত পিংকি, আজ সেখান থেকেই তাকে সাজানোর জন্য এসেছে। কনের সাজে চেনাই যাচ্ছে না পিংকিকে। সে সোমার সামনে এসে দাঁড়াতে, সোমার চোখের পলক পড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই হু হু করে জল এসে গেল দুজনের চোখেই। নিজের সন্তান তার হয়নি বটে, কিন্তু আজ পিংকিকে বিদায় দেওয়ার সময় তিনি অনুভব করলেন এ আসলে নাড়ির টানের চেয়ে কম নয়।
কে যেন বলল ওরে সানাইটা বাজা। বিকেলের রাগে শানাই ধরলেন বিসমিল্লা খাঁ। গোধূলির আকাশটা যেন নববধূর মুখের মতোই রাঙা হয়ে উঠল।