গাড়ি চলছে সমতল পথ ধরে– মাদুরাই থেকে কোদাইকানাল রোডের দিকে, দূরত্ব প্রায় ৪৩ কিমি। এরপর অবশ্য শুরু পাহাড়ি পথ, প্রায় ৮০ কিমি কোদাইকানাল শৈলশহর পর্যন্ত। কোদাইকানাল ভারতের জনপ্রিয় শৈলশহরগুলির অন্যতম। মাদুরাই জেলার উত্তর পশ্চিমে পালানী পাহাড়ে প্রায় ৭০০০ ফুট উচ্চতায় ২১৪৬ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে এই মনোরম পাহাড়ি শহর।

কোদাই শব্দটির অর্থ অরণ্যের উপহার। সমতল পথের শেষে এবার আমরা পাহাড়ের পথে উঠছি– একদিকে পাহাড় আর এক দিকে খাদ। দূরে সবুজ পাহাড়ের প্রেক্ষাপট যেন ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড়ের শৃঙ্খল। এই পথে কলা আর ইউক্যালিপটাস গাছের জঙ্গল। পাহাড়ের ঢালে কফির খেত সঙ্গে আঙুরের চাষও হচ্ছে জায়গায় জায়গায়। যতই গাড়ি ওপরে উঠছে একটা ঠান্ডা আবেশ আমাদের স্পর্শ করে যাচ্ছে। পথে পড়ল ম্যাঞ্জেলার ড্যামের জলাধার, গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলি। আর কিছুটা এগিয়ে সবুজ পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে ফিতের মতো সরু ঝরনাধারা– নামটা অদ্ভুত, দমদম ফল্স। রাস্তার ধারে ভিউপয়েন্ট থেকে দূরের এই প্রপাতের সৌন্দর্য আস্বাদন করার ব্যবস্থা আছে।

যাত্রা শুরুতে আকাশ ছিল পরিষ্কার এখন একেবারে মেঘে ঢাকা। এখন সেপ্টেম্বর মাসের শেষ, বর্ষা পেরিয়ে গেছে তবে বৃষ্টি এদিকে যখন-তখন হয়। তামিলনাড়ুতে বছরে বর্ষা হয় দু’বার। নভেম্বর-ডিসেম্বরে এখানে দ্বিতীয় দফার বর্ষা হয়। গাড়ি আরও ওপরে উঠছে। কোদাইকানালের ৮ কিমি আগে রাস্তার এক বাঁকে সাক্ষাৎ হল এক বিশাল জলপ্রপাতের সঙ্গে। কোদাইকানালের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ সিলভার কাসকেড ফল্স। ধাপে ধাপে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে বিশাল জলধারা। ১৮০ ফুট উঁচু থেকে ঝরে পড়া এই প্রপাত যেন কোদাইকানালে আগত সমস্ত মানুষকে স্বাগত জানাচ্ছে। প্রপাতের তলায় সৃষ্টি এক ছোটো পুল সেখানে স্নানে মগ্ন অনেকেই। নানা ধরনের দোকান গড়ে উঠেছে প্রপাতের ধারে। ছবি তুলে আমরা এগিয়ে চলি। শহরের মুখে প্রচণ্ড যানজট কাটিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের নির্ধারিত হোটেলে। এটাই আমাদের আগামী দুদিনের আস্তানা।

ভারতের অন্যান্য অনেক শৈলশহরের মতো কোদাইকানালের আবিষ্কর্তাও ব্রিটিশরা। ১৮২১ সালে লেফটেন্যান্ট ওয়ার্ড প্রথম সরকারি অফিসার হিসাবে পদার্পণ করেন কোদাইকানালে। আমেরিকান মিশনারিরা রাস্তাঘাট নির্মাণে এগিয়ে আসে আর মাদুরাই-এর কালেক্টর স্যার লেভিঞ্জির এই স্থানটিকে এক সুন্দর শৈলশহর হিসাবে গড়ে তোলার প্রথম পদক্ষেপ নেন।

Travelogue Kodaikanal

হোটেলে লাঞ্চ সেরে আমরা লেকের দিকে এগোই। হোটেল থেকে লেকের দূরত্ব মাত্র ৫০০ মিটার। পরপর দুদিন ছুটি তাই আজ শহরে খুব ভিড়। পাহাড়ঘেরা তারকাকৃতি বিশাল লেক এই হিলস্টেশনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। লেকের জলে বোটিং-এর ব্যবস্থা আছে। বুকিং-এর জন্য রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন বোট হাউস তার সামনে বিশাল লাইন। এখন বৃষ্টি নেই তবে আকাশ মেঘে ঢাকা। বোটিং করছে বহু ট্যুরিস্ট। প্যাডেল বোট আর দাঁড়টানা নৌকারই প্রধান্য মোটর বোট এখানে চলতে দেখলাম না। বোটিং যখন আজকে হল না আমরা সবাই মিলে লেক প্রদক্ষিণ করতে হাঁটা শুরু করলাম। ৬০ একর বিস্তৃত লেকের চারদিক রেলিং দিয়ে ঘেরা বাঁধানো রাস্তা সেখানে ভ্রমণার্থীদের সঙ্গে ফেরিওয়ালাদের ভিড়। নানা ধরনের শীতবস্ত্র, স্ন্যাক্স, আইসক্রিম, কফি বিক্রি হচ্ছে। ঘোড়ার পিঠে চড়ে অনেকেই ঘুরছে, সঙ্গে সাইকেল চালিয়ে ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে ঘোড়াওয়ালা। অনেকক্ষণ লেকের ধারে বসে প্রকৃতি আর মানুষকে উপভোগ করলাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে এবার হোটেলে ফেরার পালা। দোকান, বাজার, বাড়িঘরের আলো সব জ্বলে উঠেছে। সন্ধ্যায় কোদাইকানাল ঝলমল করছে।

আমাদের কোদাইকানালের মেয়াদ দুদিন। তৃতীয় দিন বিকেল পর্যন্ত আমরা কোদাই উপভোগ করতে পারি কারণ কোদাইকানাল রোড স্টেশন থেকে আমাদের ট্রেন রাত ৯টার পরে। কোদাইকানালে নানা ভ্রমণ সংস্থা বিভিন্ন ধরনের টুর পরিচালনা করে। শহরের মধ্যে অর্ধদিবস করে ভ্যালি ও পার্ক টুর আছে আর শহরের বাইরে দুধরনের পিকনিক টুর একটা ট্রেকিং অন্যটা অরণ্যের। আগামীকাল আমরা যাব জঙ্গলের পিকনিক টুর আর তার পরের দিন ভ্যালি ও পার্ক টুর করে চলে যাব একেবারে কোদাইকানাল রোড স্টেশনে। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টে জঙ্গলের পিকনিক টুরের মেয়াদ। দেখানো হয় সাইলেন্ট ভ্যালি ভিউ, ফায়ার টাওয়ার, বেরিজ্যাম লেক ভিউ, ক্যাপস ফ্লাই ভ্যালি, মাথিকেট্টান ফরেস্ট ভিউ, মাথা পিছু ভাড়া ৩০০ টাকা। সারা দিন ধরে জঙ্গল সফর ভালোই হল শুধু মেঘকুয়াশার দৗরাত্ম্যে মাঝে মাঝে বিঘ্ন ঘটেছে। তবে কোদাইকানালের খ্যাতি যেসব স্পটের জন্য সেগুলি অধিকাংশ ভ্যালি ও পার্ক টুরের অন্তর্গত। অবশ্য কোদাইকানালের প্রধান দুটি আকর্ষণ সিলভার কাসকেড ফল্স ও লেক তো আমাদের আগেই দেখা হয়ে গেছে।

অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে শীত এখনও পড়েনি তবুও কোদাইয়ের হিমেল বাতাস ভোরের দিকে বেশ কাঁপিয়ে দিচ্ছে। স্নান সেরে একেবারে ব্রেকফাস্ট টেবিলে। এই হোটেলে কমপ্লিমেন্টরি ব্রেকফাস্ট বেশ মনের সুখে খাওয়া যায়। টোস্ট অমলেট মাখন জ্যাম কলা যেমন আছে তেমনি রয়েছে দোসা-ইডলি-বড়া-উত্তাপম। এর সঙ্গে ফ্রুটজুস চা কফি তো রয়েছেই। ব্রেকফাস্ট সেরে বেলা ৯টা নাগাদ বেরিয়ে পড়ি। সাইটসিইং শেষ করে সোজা চলে যাব কোডাই রোড স্টেশনে। আজ সাইটসিইং-এ বাস নয় গাড়ি। গাড়ি প্রথমে নিয়ে গেল কোকারস্ ওয়াক। পাশেই একটি সুন্দর চার্চ নাম সম্ভবত ক্রাইস্ট কিং চার্চ। কোকারস্ ওয়াক এক কিমি দীর্ঘ পিচ বাঁধানো রাস্তা অনেকটা মুসৗরির ক্যামেলস্ ব্যাক রোডের মতো। ১৮৭২ সালে মিস্টার কোকার খুঁজে পেয়েছিলেন এই ঢালু পথ। তাঁর স্মৃতিতেই রাস্তার নামকরণ।

কোদাইকানালের দক্ষিণ দিকে এই রাস্তায় চলতে চলতে নীচে উপত্যকার অসাধারণ সৗন্দর্য উপভোগ করা যায়। প্রথমে এক ঝলক শহরের রূপ চোখে পড়ল, খেলনা বাড়ির মতো নানা রঙের বাড়িঘর। এই সব বাড়িঘর কখনও টিলার মাথায়, কখনও ঢালে আবার কখনও টিলার নীচে। ফলে উচ্চতার একটা তারতম্য রয়েছে। এরপর সবুজ পাহাড়ের কয়েকটি চূড়া আর তার পায়ের কাছে সবুজ উপত্যকার অপরূপ রূপ। আকাশে মেঘ তুলোর মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। কোকারস্ ওয়াক রাস্তাটির বাইরের দিকে খাদ ঘেঁষে রেলিং দেওয়া রয়েছে আর পাহাড়ের দিকে নানা সম্ভার দিয়ে দোকান সাজাচ্ছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এই দুর্দান্ত ল্যান্ডস্কেপ দেখতে দেখতে হাঁটতে কোনও কষ্টই হয় না। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম কোকারস্ ওয়াকের শেষ প্রান্তে সেখানে টেলিস্কোপ হাউস। দূরবিনে চোখ লাগালে সেই সবুজ উপত্যকা চলে আসে হাতের মুঠোয়, দূরের পাহাড় ঝরনা যেন পাশের বাড়িতেই। নির্গমন পথ দিয়ে বেরিয়ে আসি একদম রাস্তায় যেখানে আমাদের গাড়ি অপেক্ষা করছে।

পরিচ্ছন্ন পথ বেয়ে গাড়ি চলছে শহরের বুক চিরে। রাস্তার দুপাশে পাইন, বার্চ, কমলা, কলা, ইউক্যালিপটাস গাছ। আকাশ এখনও মোটামুটি পরিষ্কার। সূর্যের তেজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীত অনেকটা কম লাগছে। গাড়ি এবার থামল আপার লেক ভিউ পয়েন্টে। অনেকটা উচ্চতা থেকে কোদাই লেক দর্শন। ভিউপয়েন্টের আশেপাশে অনেক দোকানপাট। ভিউপয়েন্ট থেকে কোদাই লেককে মনে হয় যেন এক ত্রিমাত্রিক মানচিত্র। মনে আর ক্যামেরায় গেঁথে নিই সেই ছবি।

গাড়ি এবার গোঁ গোঁ করে ওপরে উঠছে তার সঙ্গে বাড়ছে ঠান্ডা হাওয়া আর কুয়াশার প্রকোপ। গাড়ি থামল মোয়ের পয়েন্টে। এখান থেকে উপত্যকার দৃশ্য আজ দেখা গেল না সেই কুয়াশা আর মেঘের কারণে। তবে যাতায়াতের পথটি বড়োই সুন্দর। রাস্তার দুপাশেই আকাশ ঢাকা জঙ্গল। গাড়ি আবার নীচে নামছে, আমাদের পরবর্তী গন্তব্য পাইনের জঙ্গল। গাড়ি থেকে নেমে দেখি রাস্তা সংলগ্ন একটি উপত্যকায় পাইন গাছের জঙ্গল। সামনে একটু ফাঁকা ফাঁকা তবে উপত্যকা খাড়া হয়ে টিলার রূপ নিয়েছে। সেখানেও পাইন গাছের সমান্তরাল রেখা। এই স্পটে অনেক সিনেমার শুটিং হয়েছে তাই স্থানীয়রা এটিকে শুটিং স্পট হিসেবেই জানে। পর্যটকদের মধ্যে ছবি তোলার ধুম পড়ে গেছে, আমরাও বাদ গেলাম না। শুধু ছবি তোলা নয় পাইনের জঙ্গলে আলো ছায়ায় শুধু ঘুরে বেড়াতেও দারুণ লাগে।

আবার একটু এগিয়েই গাড়ি থামল। ড্রাইভার জায়গাটির নাম বলল গুনা কেভস অ্যান্ড ডেভিলস্ কিচেন। রাস্তা থেকে কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে উঠে তারপর জঙ্গলময় সমতল পথ তারপর হালকা ঢালু জমি। গাছের ডালে ডালে বানর কাঁধের ব্যাগ বা হাতে কোনও খাদ্যবস্তু থাকলে খুব সতর্ক থাকতে হবে। গন্তব্যে পৌঁছে দেখলাম বেশ মোটা মোটা গাছ তাদের শিকড় জমিতে বিছিয়ে সৃষ্টি করেছে এক অনন্য আলপনা। এই প্রাকৃতিক আলপনার মাঝে অনেকেই ছবি তুলতে ব্যস্ত, গাছের ডালে চড়ে কয়েকটি অল্পবয়সি ছেলে বানরদের নকল করে চিৎকার করছে। এটাকেই কি বাঁদরামি বলে? গাছ আর শিকড়ের আলপনাই আমার চোখে এই স্পটের সবচেয়ে দর্শনীয় বলে মনে হল। পাহাড়ের পাদদেশে পরিত্যক্ত এক গুহা। এই স্থানে গুনা নামে এক তামিল ছবির শুটিং হবার পরেই মুখে মুখে নাম হয়ে গেছে গুনা কেভস্। পাহাড়ি রাস্তার শেষে সরু পথ গ্রিল দিয়ে ঘেরা, তার ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি চলে যায় এক অতলস্পর্শী খাদে। ঢালহীন এই খাদ সোজা চলে গেছে অতলে। তবে শয়তানের রান্নাঘর তথা ডেভিলস্ কিচেনের সন্ধান পেলাম না।

আবার পথ চলা শুরু। রাস্তার একটা বাঁক থেকে দেখতে পেলাম ‘পিলার রকস্’। তিনটি উঁচু বিশাল পাথরের স্তম্ভ গায়ে গায়ে লেগে পিলারের আকারে দাঁড়িয়ে আছে উচ্চতা ৪ঙ্ম০ ফুট। কিন্তু ছবি তুলতে হলে কাছে যেতে হবে, ভিউপয়েন্টের টিকিট কাটতে হবে, ক্যামেরার চার্জ দিতে হবে। এইসব করতে গিয়ে মিনিট পাঁচেক সময় লাগল। ১০ টাকা প্রবেশ মূল্য আর ক্যামেরার চার্জ ২০ টাকা। ‘পিলার রকস্’ নামাঙ্কিত গেট পেরিয়ে একটা ঘাসে মোড়া ঝুলন্ত বারান্দায় প্রবেশ করলাম। কিন্তু এ কি ম্যাজিক, পিলার রকস্ উধাও! এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি কোনও দিকেই দেখতে পাচ্ছি না। সামনে সবুজ ঘাসে মোড়া একটা পাথুরে পথের ওপর ছোটো ঝরনা কুলকুলিয়ে বয়ে যাচ্ছে। আশপাশের ভ্রমণার্থীদের জিজ্ঞাসা করায় জানাল, কয়েক মিনিট আগেই কুয়াশা এসে ঢেকে দিয়ে গেছে পিলার রকস্। এলাকা জুড়ে বেশ কয়েকটা গাছে হলদে রঙের কলকে ফুলের মতো ফুল ফুটে রয়েছে বরং বলা যায় ঝুলে রয়েছে। কুয়াশা পরিষ্কার হওয়ার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়ি পিলার

রকস্-এর বারান্দা থেকে।

কোদাইকানাল অঞ্চলে ছোটো বড়ো ঝরনা আছে বেশ কয়েকটা। পাম্বারপুরম এলাকায় একটা ছোটো বাজারের ধারে গাড়ি থামল। তার পাশ দিয়ে ঢালু কাঁচা পথ নেমে গেছে। সামনেই একটা ঝরনা সিঁড়ির মতো পর পর নেমে আসছে। এ ঝরনার উচ্ছ্বাস নেই, উচ্চতাও খুব বেশি নয়। অনেকটা নদীর মতো, ধাপ কাটা পথে নেমে নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভার জানাল, এই ছোট্ট ঝরনার নাম পাম্বারপুরম ফল্স।

আকাশে মেঘ-কুয়াশা ঘনিয়ে আসছে। যখন গাড়ি ব্রায়ান্ট পার্কের সামনে থামল তখন ৫০ ফুট দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। মনে হল পার্কে ঢুকে কী হবে, যখন কিছুই দেখা যাবে না? তার ওপর প্রবেশমূল্য মাথা পিছু ৩০ টাকা আর ক্যামেরা চার্জ ২০ টাকা। তবুও প্রবেশমূল্য চুকিয়ে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। ২০ একর এলাকা জুড়ে এই পার্কের বিস্তৃতি। ৭৫০ ধরনের গোলাপ, নানা ধরনের দুষ্প্রাপ্য অর্কিড, ফুলের গাছ এখানে প্রধান আকর্ষণ। ব্রায়ান্ট পার্ককে বলা হয় ফুলের বাগান। পাহাড়ের ঢালে নির্মিত এই পার্কের যেদিকে তাকানো যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। বাৎসরিক ফুলের মেলা অনুষ্ঠিত হয় মে মাসে তখন ফুলের উৎসবে এলাকাটি হয়ে ওঠে নানা রঙে রঙিন।

প্রথমেই চোখে পড়ল গাছপালা ফুল দিয়ে তৈরি এক ট্রেনের মডেল। কম্পার্টমেন্ট, হেডলাইট, চাকা, ইঞ্জিন সবই নানান ফুল, পাতা, গাছের ডাল দিয়ে তৈরি। পাশেই বাগানের মধ্যে গান্ধি মূর্তি। নানা ধরনের ফুল গাছ সব ফুলের নাম তো জানি না, কিন্তু সৗন্দর্যের খাতিরে ছবি তুলি। গোলাপকে তো বিলক্ষণ চিনি। এখন সিজন নয় তবু বর্ণে গন্ধে মনকে ভরিয়ে দেয়। রয়েছে এক বিশাল পদ্মপুকুর, বেশি না হলেও কয়েকটি ফুল প্রস্ফুটিত। নানা রঙের বাঁধাকপির মতো দেখতে রঙিন ফুল ফুটে আছে, চেনা ফুল ডালিয়া, ক্রিসেনথিমাম, জিনিয়া তো আছেই। কাঁটা দেওয়া কান্ড মাথাটা পাম গাছের মতো, নাম লেখা রয়েছে ইউকা । লতানে গাছ ছেঁটে নানা ধরনের মডেল তৈরি হয়েছে। একটি রাক্ষসের মুখ তার মধ্যে আকর্ষণীয়।

বাগানের এক ধারে রয়েছে গ্রিন হাউস সেখানে রয়েছে সব দুষ্প্রাপ্য গাছ ও অর্কিড। বাগানের মধ্যেই একটা বোর্ডে ব্রায়ান্ট পার্ক সম্পর্কে নানা তথ্য দেওয়া আছে।  হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম একটা বেশ বড়ো লনের মধ্যে। চারদিক গাছ দিয়ে ঘেরা। মাঝে একটা উঁচু স্তম্ভের শীর্ষে অশোকস্তম্ভ। সামনে বেঞ্চ পাতা। লনে বাচ্চারা ছোটাছুটি করে খেলে বেড়াচ্ছে এই নির্মল পরিবেশে। পার্কের ভ্রমণের সময় সীমা পেরিয়ে গেছে, ফিরে আসি গাড়ির কাছে। ড্রাইভার চাইছে এখনই লাঞ্চ ব্রেক নিতে, আমরা চাইছি আরও একটু ঘুরে নিতে– কখন যে মেঘকুয়াশার দল আবার সব ঘিরে দেবে কে জানে!

travel kodaikanal

গ্রিন ভ্যালি ভিউ নামই বলে দিচ্ছে এখান থেকে কী দেখা যাবে। লেক থেকে দূরত্ব প্রায় ৫ কিমি। এই শহরে সমস্ত দূরত্বই লেক থেকে মাপা হয়। সামনেই এক বাজার। বাজারের মধ্যে দিয়ে সরু সিঁড়ি চলে গেছে গ্রিন ভ্যালি ভিউ পয়েন্টে। জায়গাটি রেলিং দিয়ে ঘেরা, দেখা গেল তবু কুয়াশা আর মেঘের কুণ্ডলী। এই স্পটের আগের নাম ছিল সুইসাইড পয়েন্ট এখন গ্রিন ভ্যালি ভিউ। তা হলে বোধহয় মেনে নিতে হবে এই অঞ্চলে সুইসাইড করার প্রবণতা কমে গেছে। পাশেই গল্ফ ক্লাব ৬০০০ ফুট উচ্চতায়। ১০০ একরের বেশি জায়গা জুড়ে ঢেউ খেলানো সবুজ প্রান্তরে ১৮ হোলের গল্ফ কোর্স।

এবার আমরা মন্দির দেখতে যাব– কুরুঞ্জি আন্দাভার মন্দির। মাঝারি আকারের মন্দির বিশেষ ভিড় নেই এই দুপুরে। এই মন্দিরে মুরুগান মূর্তি পূজিত হয় অর্থাৎ এটি কার্তিক মন্দির। মন্দিরে গোপুরম আছে তবে উচ্চতা বেশি নয়। তামিল ভাষায় কুরুঞ্জি মানে পার্বত্য এলাকা আর আন্দাভার মানে দেবতা। তাই মুরুগানকে এখানে পর্বতের দেবতা বলা হয়। কোদাইকানালের অন্যতম আকর্ষণ এখানকার একটি গাছ কুরুঞ্জি। এই গাছে প্রতি ১২ বছর অন্তর ফুল ফোটে। আর তখন সারা কোদাই বেগুনি রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। এই দশকের শেষ ফুল ফোটে ২০১৬ সালে। মন্দিরের বাইরে অনেক দোকান, পূজার উপকরণ ছাড়াও নানা ধরনের উপহার দ্রব্য হস্তশিল্প পাওয়া যাচ্ছে। এখানে হাতির আর রাক্ষসের মুখোশ বিক্রি হচ্ছে তার সঙ্গে চা, মশলা, হোম মেড চকোলেট, ওষধি তেলও পাওয়া যাচ্ছে।

মন্দিরের পাশেই একটি রেলিং দেওয়া বারান্দা– এটি পালানি ভিউপয়েন্ট। পরিষ্কার দিনে এখান থেকে পালানি মন্দির ও ভাইগাই ড্যাম দেখা যায়। কিন্তু আজকে এই মেঘ-কুয়াশার সাম্রাজ্যে এই দৃশ্য দেখা সম্ভব ছিল না।

একই রাস্তায় ফেরা। রাস্তার ধারেই চেত্তিয়ার পার্ক। ব্রায়ান্ট পার্ক দেখার সময় মেঘ-কুয়াশা জমাট বেঁধে ছিল, এখন অনেকটা পরিষ্কার। শহরের উত্তর-পূর্বে চেত্তিয়ার রোডের ওপর এর অবস্থান। গেট থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পার্কের মধ্যে প্রবেশ করি। পথের দুপাশে লতানে গাছ ছেঁটে পাঁচিলের আকার দেওয়া হয়েছে, মাঝে মাঝে রয়েছে আর্চ। বাগানের বিভিন্ন ধাপে নানা বর্ণের ফুল গাছ। লাল হলুদ বেগুনি গোলাপি সব রং মিলে যেন ফুলের এক রামধনু সৃষ্টি হয়েছে। চিনতে পারলাম ডালিয়া, ক্রিসেনথিমাম, জিনিয়া, মোরগঝুঁটি, ক্যানা প্রভৃতি গাছ– এছাড়া আরও অনেক ফুল। লতানে গাছ ছেঁটে বাগানের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ছাতা, ভল্লুক, ময়ূর তাও বেশ দৃষ্টিনন্দন। পার্কের মধ্যে বসার ব্যবস্থাও আছে। টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মেঘও ঘনিয়ে আসছে। আমরা পার্ক থেকে বেরোনোর উদ্যোগ নিলাম। চেত্তিয়ার রোড ধরে ফেরার পথে দেখা হল এক জৈন মন্দির– শ্রীবর্ধমান মহাবীর ভগবান মন্দির। শ্বেত পাথরের মন্দিরে মহাবীরের মূর্তি শোভা পাচ্ছে। ছোটো হলেও শ্বেত পাথরের সুন্দর কারুকার্য চোখে পড়ে। মনে হয় মন্দিরটি হাল আমলের। এবার সোজা লেকের কাছে আমাদের হোটেলের ডাইনিং হলে। আজ আমরা চাইনিজ খানা খাব, চাউমিন আর চিলি চিকেন। একটু বিশ্রাম তারপর শেষপর্বের ভ্রমণ।

আমাদের হোটেলের কাছেই মাউন্ট জিয়ন লুথেরান চার্চ এক ঝলক দেখে বেরিয়ে পড়লাম ৫ কিমি দূরে বেয়ার শোলা ফল্স দেখতে। এই প্রপাতটাতে ভল্লুক জল খেতে আসত বলে হয়তো এই নামকরণ। গাড়ি যেখানে থামল সেটা শহরের এক প্রান্তে। নতুন নতুন বাড়িঘরে এলাকাটি ঝলমল করছে। এখানে কোথায় জলপ্রপাত? ড্রাইভার অবশ্য দেখিয়ে দিল একটি সরু অরণ্যময় পথ। সেই পথে কয়েকজন স্ত্রী-পুরুষ বাচ্চা এগিয়ে চলেছে। কিছুটা তাই দেখে আশ্বস্ত হলাম। কিন্তু একটু পরেই দেখি সেই পরিবার মুখ ঘুরিয়ে ফেরার পথ ধরেছে। জিজ্ঞাসা করলাম ফল্স কত দূর?

–জানি না। সামনে জঙ্গল এগোতে ভরসা পাচ্ছি না, তাই ফিরে যাচ্ছি।

এ তো ভয়ের কথা। প্রথমে ইউক্যালিপটাস গাছের বেশ বড়ো জঙ্গল। তারপর পথ সরু হয়ে গেছে। দুপাশেই ঝোপজঙ্গল। লোহার জাল দিয়ে পথটি জঙ্গল থেকে আলাদা করা ছিল তাও ভেঙেচুরে একাকার। একটা যেন রহস্যময় পরিবেশ এলাকা জুড়ে। এছাড়া কোনও মানুষজনের এখনও দেখা পাইনি। আমরা এগিয়ে চলি সেই সরু পথ ধরে। শুকনো পাতার মচমচ শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। একটা নালার ওপর ছোটো ব্রিজ পেরিয়ে এবার পথ গেছে ডান দিকে। মিনিট দশেক হাঁটার পর জলের একটা শব্দ পাওয়া গেল। মনে হচ্ছে আমরা প্রপাতের কাছাকাছি চলে এসেছি। আরও মিনিট দুয়েক হাঁটার পর চোখের সামনে প্রতিভাত হল জঙ্গলের মধ্যে পাথরের গা বেয়ে নামছে প্রপাতের জলধারা। তবে ধারাটি খুব চওড়া নয়। সামনে বিরাট একটা পাথরের চাতাল, তার পাশ দিয়ে জল প্রবাহিত হচ্ছে। তখনই দুজন ভ্রমণার্থীর দেখা মিলল– একজন পুরুষ অন্যজন মহিলা, তারা নানা ভঙ্গিমায় ছবি তোলায় ব্যস্ত। প্রপাতটি আহামরি নয়, জলের ধারাটিও সরু কিন্তু এই পরিবেশ, পথ অনেকদিন মনে থাকবে আমার। এবার ফেরার পথ ধরি।

গাড়ি এবার কোদাই শহর ছেড়ে নীচের দিকে নামতে শুরু করল। থামল প্রায় ৬ কিমি পরে সেক্রেড হার্ট কলেজের সামনে, বড়ো রাস্তা থেকে ঢুকে একটা গলির মধ্যে। ১৮৯৫ সালে স্থাপিত এই কলেজটি বিশাল এলাকা জুড়ে আর দোতলার বারান্দাতে জিশুর মূর্তি। এই কলেজের মাধ্যমে নানাধরনের সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে আছে পরিবেশ, আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও শিক্ষা বিষয়ক নানা কাজকর্ম। স্লঁদের পরিচালনায় স্থাপিত হয়েছে শেন বাগানুর মিউজিয়াম ও অর্কিডোরিয়াম। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে, প্রবেশমূল্য ২০ টাকা। এই মিউজিয়ামে দেখলাম বিভিন্ন পাহাড়ি উদ্ভিদের সংগ্রহ, রয়েছে ৩০০ ধরনের অর্কিড। এখানে আছে স্টাফ করা নানা ধরনের পাখি ও জন্তু-জানোয়ারের দেহ। রয়েছে ফরেস্ট ঈগল, পেঁচা, হরিণ, পাইথন, নীলগিরি উড পিজন, প্যারাকিট, টিট, কোয়েল, চিল প্রভৃতির স্টাফ করা দেহ। এর সঙ্গে রয়েছে প্রজাপতি ও প্রাচীন মুদ্রার সংগ্রহ। এই পাহাড়ের জীবজন্তু, পরিবেশের চিত্র এবং মডেলও উপস্থাপিত হয়েছে।

ফেরার পথে আবার সিলভার কাসকেড ফলসে একটু বিরতি আর ছবি তোলা। কোদাইকানালের দ্বাররক্ষী এই প্রপাত যেন বলছে আবার এসো।

কীভাবে যাবেন -হাওড়া থেকে সাপ্তাহিক কন্যাকুমারী এক্সপ্রেসে কোদাইকানাল রোড স্টেশনে নেমে সড়কপথে ৮০ কিমি দূরে কোদাইকানাল। অথবা হাওড়া থেকে ট্রেনে চেন্নাই পৌঁছে, ট্রেন বদলে কেদাইকানাল রোড বা মাদুরাই হয়েও যাওয়া যায়। মাদুরাই থেকে সড়কপথে দূরত্ব ১২০ কিমি। কোদাইকানাল ঘোরার জন্য বিভিন্ন প্রাইভেট সংস্থা নানা ধরনের কনডাকটেড টুরের ব্যবস্থা করে। হোটেল থেকেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবে।

কোথায় থাকবেন – কোদাইকানালে হোটেলের অভাব নেই। তামিলনাড়ু পর্যটন দফতরের হোটেল ছাড়াও অনেক প্রাইভেট হোটেল রয়েছে। এখানে এপ্রিল থেকে জুন মাস হল সিজন টাইম। অন্য সময়ে হোটেল ভাড়ায় কিছুটা ছাড় থাকে। তামিলনাড়ু পর্যটন দপ্তরের হোটেল বুকিং ও ভ্রমণ সংক্রান্ত তথ্য জানতে যোগাযোগ করুন– জি-২৬ দক্ষিণাপন শপিং কমপ্লেকস। ২ গড়িয়াহাট রোড কলকাতা-৭০০০৬৮, ফোন ৮৯৬১৩৯৪০১৭।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...