লাল ধুলো উড়িয়ে বাসটা চলে গেল। নামেই পিচ রাস্তা। কোথাও এতটুকু পিচের চিহ্নমাত্র নেই। গাছের পাতা ঘাস সব লাল ধুলোয় ঢাকা পড়েছে। কেউ বলে না দিলে বোঝার কোনও উপায় নেই যে এই রাস্তায় বাস চলাচল করে। সূর্য মাথার ওপর দপদপ করে জ্বলছে। ব্যাগ থেকে জলের বোতল নিয়ে গলায় ঢালতেই গোটা শরীর গুলিয়ে উঠল। প্লাস্টিকের বোতলের জল গরম হয়ে বিস্বাদ হয়ে গেছে পুরো। হড়হড়িয়ে বমি উঠে এল মালতীর। সেই সকালে ভাত খেয়ে ট্রেন ধরেছে। তারপর একটানা আড়াই ঘন্টার ওপর বাসে এসেছে।

প্রথম দিকে রাস্তা খুব ভালো ছিল। তারপর বাস যত এগিয়েছে ততই রাস্তার কালো রং ফিকে হতে হতে লাল হয়ে গেছে। বাসের দুলুনিতে তার এমনিতেই বমি আসে। এতক্ষণ খুব চেপে রেখেছিল। কিন্তু আর পারল না। বোতলের গরম জল নিয়েই চোখেমুখে দিল। সুধাকরবাবু বা তার লোক কেউ তো এল না এখনও। সুধাকর বাবুই তো বলে দিয়েছিলেন চণ্ডীতলার মোড়ের মাথায় নামতে। না হলে কন্ডাক্টর একেবারে মন্দিরতলায় নামাত। ওখান থেকে বড়ো রাস্তা আছে গ্রামে ঢোকার।

প্রথম যেদিন ইন্টারভিউ দিতে এসেছিল সেদিন ওখানেই নেমেছিল। চোখে মুখে জল দিয়ে কিছুটা সতেজ লাগছে মালতীর। কিন্তু ভর দুপুর বেলায় এখানে দাঁড়িয়ে কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না মালতী। এখানে নামাটাই তার ভুল হয়েছে। মন্দিরতলায় নামলে কাউকে না কাউকে পেতই। কিন্তু এই মাঠের মাঝে কেউ নেই। একটা সরু পায়ে চলা পথ চলে গেছে গ্রামের দিকে। দূরে গ্রামের বাড়িগুলো রোদের তাপে কাঁপছে মনে হচ্ছে। বাস যাওয়া লাল রাস্তাটা সোজা গিয়ে বাঁক নিয়েছে ডান দিকে। পরের স্টপেজটাই মন্দিরতলা। রোদের জোর বাড়ছে ক্রমশ। মালতী বোতল থেকে আবার কিছুটা জল নিয়ে মুখে চোখে ঝাপটা দিল। রুমালে মুখ মুছে তাকাতেই সুধাকরবাবুকে দেখল সাইকেলে চেপে দ্রুত আসছেন।

সাইকেল থেকে নেমেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘মাপ করবেন ম্যাডাম, আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। একটা কাজে আটকে গিয়েছিলাম। আসুন আমার সঙ্গে।’

আলের সরু রাস্তাটা ধরে দুজনেই হাঁটছে। হাঁটার অভ্যেস মালতীর আছে। ঝিরঝিরে হাওয়া দিচ্ছে বলে বমি বমি ভাবটাও কেটে গেছে অনেকক্ষণ। দূরের বাড়িগুলো এখন অনেকটা কাছে চলে এসেছে। আরও কিছুটা হাঁটতেই স্কুলের কাছে চলে এল ওরা। স্কুলে ঢুকে সুধাকরবাবু সাইকেলটা স্ট্যান্ড করতে করতে বললেন, ‘আগে জয়েন করে নিন, তারপর আমাদের বাড়িতে গিয়ে কিছু খাওয়াদাওয়া করবেন। এখান থেকে মিনিট পাঁচেক গেলেই আমাদের বাড়ি।’

রাস্তায় ছিল বলে ঝিরঝিরে হাওয়া গায়ে লাগছিল। টিনের চালের অফিস ঘরে আবার গুমোট ভাবটা মালতীর অস্বস্তি বাড়াচ্ছে। মালতী ঘাম মুছে নিয়ে চেয়ারে বসতেই হেড স্যার রেজিস্টার খাতাটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এখানে সাইন করুন ম্যাডাম, আর আপনার যা কাগজ-পত্র আছে তা এই ফাইলে রেখে দিন। আপনাকেই তো সব সামলাতে হবে। আপাতত এই ট্রাংকটা দিচ্ছি। ওটাতেই সব কাগজপত্র রাখবেন।

মালতী বেশ মুষড়ে পড়ল। হাজিরা খাতায় মাত্র ন’জন ছাত্রীর নাম। ফাইভ আর সিক্সেই কেবল ভর্তি হয়েছে। বাকি ক্লাসে একটাও ছাত্রী নেই। হেড স্যারকে জিজ্ঞেস করল মালতী, ‘এখন আমাকে কী করতে হবে? ক্লাসে যাব? কোন দিকে ফাইভ আছে বলে দিন।’মালতীর গলায় একরাশ হতাশা ঝরে পড়ল! এ কেমন স্কুলে চাকরি নিল সে! এখনও স্কুলটাই তৈরি হয়নি।

গ্রামে মেয়েদের আলাদা স্কুলের জন্য সুধাকরবাবু একা চেষ্টা করেছেন। স্কুলের নামে দু-বিঘে জমি দান করেছেন। রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে। এরপর সেখানে স্কুলের বিল্ডিং উঠবে। মালতীই প্রথম শিক্ষিকা ইন্দুমতী জুনিয়ার বালিকা বিদ্যালয়ের। সুধাকরবাবুর মায়ের নামে স্কুল। বয়েজ স্কুলের দুটো রুম নিয়ে আপাতত স্কুল শুরু হয়েছে।

এত দূরে এই প্রত্যন্ত গ্রামে চাকরি করতে আসতে তার ইচ্ছে হচ্ছিল না। মালতীর বাবা মায়েরও তেমন ইচ্ছে ছিল না। একা একা থাকতে হবে। এত দূরে বাবা-মা-কে এনে রাখা এখনই সম্ভব নয়। তার ওপর বাবার রিটায়ার হতে এখনও অনেক দেরি আছে। কোলিয়ারির চাকরিতে স্বেচ্ছায় রিটায়ারমেন্ট নেওয়া যায়। মালতীর বাবার ইচ্ছে ছিল নিজে ভল্যান্টারি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে মালতীকে ঢুকিয়ে দেবেন সেখানে। বড়ো সাহেবের কানে কথাটা তুলেও ছিলেন।

মালতীর ইচ্ছের বাইরে একদিন বড়ো সাহেবের অফিসে মালতীকে নিয়েও গিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে এসেই মালতী পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল, কোলিয়ারির চাকরি সে করবে না। বড়ো সাহেবের ধূর্ত লোভী চোখ দুটো সে অনেকদিন ভুলতে পারেনি। আবেদন করার সময় সে ভাবেওনি যে চাকরিটা পেয়ে যাবে। ভেবেছিল এলাকার কাউকেই নেবে কমিটির লোকেরা। দেড়শো টাকা মাইনের এই চাকরির জন্যেও আবেদন পড়েছিল বেশ কয়েকটা। তবে তার মাস্টার ডিগ্রিটা থাকার জন্যই বোধহয় চাকরিটা হয়েছে।

‘আজ আর ক্লাস নিতে হবে না আপনাকে। আমার সঙ্গে আসুন। আপনার থাকার জায়গাটা আগে দেখে নিন’, সুধাকর দত্ত বাইরে থেকেই বলল।

হেডস্যারকে জোড় হাত তুলে নমস্কার করে বাইরে এল মালতী। মাটির বাড়ি। টিনের চালের লম্বা স্কুল বাড়িটা পেরিয়ে এসে লাল মোরামের রাস্তায় উঠে এল। কৌতুহলী চোখগুলো যে এদিক ওদিক থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে মালতী বেশ বুঝতে পারছিল। সুধাকর দত্ত সাইকেলের হ্যান্ডেলটা এক হাতে ধরে মালতীর একদম পাশে পাশে হাঁটছিল। মালতীর যে অস্বস্তি হচ্ছে লোকটা কি বুঝতে পারছে না? মালতী একটু একটু করে পিছিয়ে পড়তে চাইছিল। রাস্তাটা বাঁ-দিকে বেঁকে যেতেই সুধাকর দত্ত থেমে গেল।

‘এই আমাদের বাড়ি, আপনি এখানেই থাকবেন।’

বাড়ি দেখেই চমকে গেল মালতী। রাস্তায় কোনও কিছুর দিকে না তাকালেও একেবারে সামনের দিকে যে যে বাড়িগুলো চোখে পড়ছিল তাদের হতশ্রী দশার সঙ্গে এই বাড়ির তুলনা হয় না। এ একেবারে রাজবাড়ি। পুরোনো লাল ইটের তৈরি উঁচু খিলান যুক্ত বিরাট বাড়ি দেখে মালতীর গা বমি ভাবটা ফিরে এল। বাবার অফিসের বড়োবাবুর চোখটা মনে পড়তেই সুধাকর দত্তের দিকে তাকাল। শান্ত সৗম্য চেহারার সুধাকর বাবুর চোখে কিছুই খুঁজে পেল না। কোথায় সেই ধূর্ত লোভী দৃষ্টি, বরং সারা মুখমণ্ডলে এক ছেলেমানুষি কৌতুক খেলা করছে।

‘কি ম্যাডাম, স্কুল ঘর নেই বলে ভেঙে পড়ছিলেন তো, আশা করি এই বাড়ি দেখে আপনার ভালো লাগবে। আজ থেকে এখানেই থাকবেন। দাঁড়ান বাড়িতে খবরটা দিয়ে আসি।’

সুধাকরবাবুকে যেতে হল না তার আগেই একজন বয়স্ক মহিলা এলেন। মুখের মিল দেখে সহজেই মালতী বুঝতে পারল ইনি সুধাকরবাবুর মা। কাছে আসতেই হাত তুলে নমস্কার করল মালতী।

চক মিলানো বিরাট বাড়ির দরজা পেরিয়ে এসে মালতী দাঁড়িয়ে রইল আড়ষ্ট হয়ে। এখনও তার মাথায় ঢুকছে না সুধাকরবাবুর বাড়িতে সে কেন থাকবে। চাকরি করতে এসেছে সে। নিজের থাকার ব্যবস্থা তাকে নিজেকেই করতে হবে। রোজ রোজ তার পক্ষে এত দূর যাতায়াত করা সম্ভব নয়। ইন্টারভিউ দিতে এসেই ভেবেছিল চাকরিটা হলে তাকে এখানেই থাকতে হবে। সেই মতো কিছুটা মানসিক প্রস্তুতি নেওয়াই ছিল। কিন্তু জয়েন করা থেকে তার সব হিসেব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। সে যেন একটা বিরাট ফাঁদে আটকে পড়েছে। কিছুতেই আর বেরুতে পারবে না।

বাড়িতে থাকলেই কোলিয়ারির চাকরির টোপ। বড়োবাবু নাকি বলেছে মেয়ের চাকরির জন্য তাকে রিটায়ারমেন্ট নিতে হবে না। তারা মেয়েকেও চাকরি দেবে। ওই ধূর্ত চোখগুলো মনে পড়লেই তার গোটা শরীরটা গুলিয়ে ওঠে। সে কিছুতেই বাড়ি ফিরে যাবে না। আবার সুধাকরবাবুর বাড়িতেও থাকবে না। কিন্তু কথাটা বলতে পারছে না কিছুতেই। কীভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সুধাকরবাবুকেই জিজ্ঞেস করা দরকার অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা হতে পারে কিনা।

বাড়ির উঠোনের এক কোণে বিরাট কুয়ো। কপিকলের সাহায্যে জল তুলতে তুলতে সুধাকরবাবুর মা বললেন, ‘এখানে এসে হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিন, তারপর আপনার বাড়ি দেখতে যাবেন।’

মালতীর মনের মেঘটা কেটে গেল মুহূর্তের মধ্যে। সুধাকরবাবুর বাড়িতে নয়, তার জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চার পাঁচটা বাড়ির পরে আর একটা বাড়ি আছে সুধাকরবাবুদের। সেখানে তার বিধবা পিসি থাকে। মালতীর জন্য সেই ঘরেই থাকার ব্যবস্থা করেছেন সুধাকরবাবু। সুধাকরবাবুর পিসিও থাকবেন মালতীর সঙ্গে। তবে মালতীকে নিজের সব কাজ নিজেকেই করে নিতে হবে।

স্কুলের কাজে সময়গুলো দ্রুত কেটে যাচ্ছে মালতীর। এক বছর হয়ে গেল সে এই চণ্ডীপুরের শিক্ষিকা হয়ে এসেছে। এখন আর একা থাকতে অসুবিধা হয় না তার। মাঝে মাঝে মা এসেও থাকে। সুধাকরবাবুরা নিতে না চাইলেও সে জোর করে এখন বাড়ি ভাড়া দিচ্ছে। কতদিন আর বিনা পয়সায় থাকা যায়। এক বছর আগেও যেটা ফাঁকা মাঠ ছিল সেখানে আজ একতলা লম্বা স্কুল বিল্ডিং। দেড়শোর কাছাকাছি ছাত্রছাত্রী আর চার জন দিদিমণি নিয়ে ইন্দুমতি জুনিয়র বালিকা বিদ্যালয় এখন বেশ শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে।

সুধাকরবাবুর অবদান মালতী কিছুতেই ভুলতে পারবে না। রাত দিন এক করে স্কুল তৈরির কাজে সাহায্য করেছেন। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ছাত্রী ভর্তি করানোর ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছেন। জুনিয়র থেকে মাধ্যমিক যাতে হয় সে চেষ্টাও করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। মালতীর সঙ্গে কোনও বিষয়ে আলোচনা থাকলে স্কুলেই আসেন। স্কুলের বাইরে বা বাড়িতে এসে কোনওদিন আলোচনা করতে আসেননি। সুধাকর দত্তের এই সম্ভ্রম বোধ মালতীকে আকৃষ্ট করে খুব। মালতী কি সুধাকর দত্তের প্রতি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে।

গত সপ্তাহে মা এসেছিল। সোজাসুজি মালতীকে বলেছে আর কত দিন এইভাবে বিয়ে না করে দুজনে স্কুল নিয়ে মেতে থাকবি। মায়ের কথায় চমকে উঠেছে। দুজনে মানে! কে কে দুজন? মায়ের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি সে। আবার স্বীকারও করেনি। মালতী নিজেই এখনও জানে না। সুধাকরকে সে বুঝতে পারে না।

এত বিষয় সম্পত্তি ছেড়ে সারাদিন স্কুল নিয়ে পড়ে আছে। ব্যাবসার কাজে মাঝেমধ্যে শহরে গেলেও একটানা বেশিদিন থাকে না। ইদানীং স্কুলে সুধাকর এলেই বাকি স্টাফেদের মধ্যে একটা মুখ টেপাটেপি, হালকা হাসি, কিছুটা কৌতুকের ছোঁয়া পায় মালতী। রোদে পোড়া বসন্তে মালতীরও একটু একটু করে পুড়তে ইচ্ছে করে। পুড়েও যায় ভিতরে ভিতরে।

একা একা মালতী পুড়ে যাচ্ছে আজ তিনদিন হল। প্রচন্ড জ্বর। লু বইছে বাইরে। মাথায় জলপটি দেওয়ার কেউ নেই। তিনদিন স্কুল যেতে পারেনি অথচ কেউ খোঁজ নিতেও আসেনি। কেউ যে আসবে না সেটা মালতী জানে। চাকরিটাই হয়তো আর থাকবে না। গত সোমবার মিটিং হয়েছে। মালতী এই সবের কিছুই জানত না। সে গিয়েছিল সুধাকরবাবুর সঙ্গে ডি আই অফিসে। একাই যেত সুধাকর, কিন্তু ইন-চার্জ হিসেবে মালতীকে থাকতেই হতো।

মাধ্যমিকে উন্নীত করার আবেদন ছাড়াও অন্যান্য কিছু কাজ ছিল। মালতী বাসেই যেতে চেয়েছিল। কিন্তু এই প্রথমবার সুধাকর তাকে অনুরোধ করে একসঙ্গে তার গাড়িতে যেতে। সুধাকরের চোখের দিকে তাকালে বাবার অফিসের বড়োবাবুর লোলুপ চোখের কথা ভুলে যেতে পারে, সুধাকরের সামনে তার গাম্ভীর্যের মুখোশ খুলে বেরিয়ে আসে সেই কিশোরী মেয়েটি যে কিনা চুলে বিনুনি করে উদাস চোখে হেঁটে যায় আকাশ দেখতে দেখতে।

সুধাকর কখনও তাকে নাম ধরে ডাকেনি। তাই প্রথম বার মালতী ডাক শুনে মালতী আপাদমস্তক পুড়ে গিয়েছিল। গাড়িতে বসে কেউ কোনও কথা বলেনি। সুধাকর এক মনে গাড়ি চালাচ্ছিল। যেন গাড়ি চালানো ছাড়া ইহজগতে আর কোনও কাজ নেই তার। কখন যে তারা ডি আই অফিসে পৌঁছে গিয়েছিল খেয়াল করেনি। যন্ত্রের মতো মালতী একটার পর একটা কাগজে সাইন করে যাচ্ছিল। সুধাকর ব্যস্ত ভাবে একবার এদিক একবার ওদিক ছুটে বেড়িয়ে সব কাগজপত্র জমা করে যখন বেরিয়ে এল তখন আকাশ লালে লাল। সূর্যটা একটু ছোঁয়া পেলেই ভুস করে ডুবে যাবে।

গাড়িতে ওঠার আগে সুধাকর মালতীর হাতটা আলতো করে ধরল। মালতী কেঁপে উঠল ভিতরে ভিতরে। সাইকেলে চেপে আসা সুধাকর দত্তের সেই রোদে ঝলসে যাওয়া প্রথম দিনের মুখটা মনে পড়ল মালতীর। এই হাতের মধ্যেই কখন যে নিজেকে সঁপে দিয়েছে মালতী নিজেও জানে না। মালতীর হাতটা ছেড়ে গাড়িতে উঠে এল সুধাকর। মালতীও উঠে এসে তার পাশের সিটে বসল।

লাল আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ সুধাকর বলল, ‘এই লাল রং একদিকে যেমন প্রেমের রং আবার তেমনি এই রং বিপ্লবের, নতুন ভোরের, নতুন সূর্যোদয়ের। দেখে নিও মালতী ওরা যতই বাধা দেওয়ার চেষ্টা করুক আমরা নতুন ভোর আনবই। মালতী সুধাকরের গলায় তুমি সম্বোধন শুনে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল।

প্রথম দিকের কথাগুলো তেমন শুনতে পায়নি মালতী। কিন্তু সুধাকরের শেষের দু’একটা কথা শুনে চমকে গেল। এসব কি বলছে সুধাকর! দিনের শেষ সূর্যেরও তেজ আছে বেশ। মালতীর কপাল পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। মালতীও পুড়ে যাচ্ছে ভিতরে ভিতরে। ডি আই অফিস থেকে ফিরেই সে প্রবল জ্বরে পড়েছে। সুধাকরকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে শুধু এইটুকুই জানে মালতী। সুধাকরের খবর আর কে দেবে তাকে। মালতী দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

‘আপনারা জানেন সুধাকর সেদিন কি বলেছিল আমাকে?’

বিরাট হলঘরের একটাও চেয়ার ফাঁকা নেই। সকলের প্রিয় বড়দির আজ চাকরি জীবনের শেষ দিন। দীর্ঘ তেত্রিশ বছরের চাকরি জীবনের আজ ইতি। বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রীরা ও তাদের অভিভাবকদের ভিড়ে ঠাসা হল ঘরে একটানা নিজের চাকরি জীবনের কথা বলতে বলতে থেমে গেল মালতী।

দ্রুত সময় বদলে যায়। মালতী ডি আই অফিস থেকে ফিরেই জ্বরে পড়েছিল। কিছুটা সুস্থ হয়ে যখন স্কুলে ফিরল অবাক হয়ে দেখল সব কিছু কেমন ম্যাজিকের মতো পালটে গেছে। তাকে না জানিয়েই তার ইনচার্জের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ক্লাস নিতে যাওয়ার আগেই তাকে একটা খাম দিল নতুন ইনচার্জের দায়িত্বে আসা নীলিমা বসু।

‘সাত দিনের মধ্যে উত্তর দেবেন কেন আপনাকে সাসপেন্ড করা হবে না?’

খামটা হাতে নিয়ে বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইল মালতী। তারপর ধীরে ধীরে চলে গেল ক্লাসে।

সুধাকর তাকে সব বলেছে। সুধাকর দিন বদলের ডাক দেওয়া ডাক হরকরা। লাল রং বুকেতে নিয়ে সুধাকর চলে গেছে বিপ্লবের দেশে। কেউ জানে না। চাকরিটা ছাড়তে পারবে না মালতী।

ছোট্ট করে এক লাইনে উত্তর লিখল মালতী, ‘স্কুলের টাকার যা কিছু হিসেবের গরমিল হয়েছে, কমিটি যেন তার বেতন থেকে প্রতি মাসে কেটে নেয়। আর সুধাকরের সঙ্গে আমার কোনও অবৈধ সম্পর্ক নেই। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে কারওর কাছে কোনও কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই’।

মালতী থামল। কাচের গেলাসে রাখা জল এক নিশ্বাসে শেষ করে মুখটা মুছল। চোখের কোণটা চিকচিক করে উঠল।

সুধাকরকে যখন আনা হল তখনও বুকের বাঁ দিকটা লাল হয়ে ছিল। গুলির দাগটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল সবাই।

বিদায় অনুষ্ঠান অনেকক্ষণ আগে শেষ হয়েছে। সুধাকরের দেওয়া দলিলটা স্কুলের কমিটির হাতে তুলে দিতে পেরে নিজেকে খুব হালকা মনে হচ্ছিল। মঞ্চে দাঁড়িয়ে যখন কথাগুলো বলছিল মালতী তখন বুঝতে পারছিল সুধাকর নেমে এসেছে হলের মধ্যে। মালতীর প্রতিটি কথা তার বুকে বিঁধে থাকা বুলেটের ক্ষতে মলম বুলিয়ে দিচ্ছিল।

লাল ইটের তৈরি চক মিলানো বিশাল বাড়িটা পাকাপাকি ভাবে আজ থেকে ইন্দুমতি বালিকা বিদ্যালয়ের অংশ হয়ে গেল।

লাল মোরামের রাস্তা আর নেই। কালো পিচের রাস্তা থেকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে স্কুল বাড়িটা।

সুধাকর তাকে যেখান থেকে প্রথম দিন নিতে এসেছিল সেই জায়গায় এসে দাঁড়াল মালতী। ডি আই অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার সময় সুধাকর মালতীর হাতটা ধরতেই মালতীর ভিতরটা খাঁ খাঁ দুপুরের মতো পুড়ে গিয়েছিল।

সুধাকরের কথাগুলো তার কানে গরম সিসা ঢেলে দিচ্ছিল।

‘মালতী আমি আর মাত্র তিন দিন গ্রামে থাকব। তারপর আমাকে অনেক দূরে চলে যেতে হবে। ওরা আমাকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না। আমার বিপুল সম্পত্তি অথচ আমি আমরণ দলের সঙ্গে আন্দোলন করে একটা নতুন দিন বদলের স্বপ্ন দেখতে পারি, আজ আর আমার দলের ভিতরেই কেউ বিশ্বাস করছে না। আমাকে ওরা বুর্জোয়া ভাবছে। তোমাকে ভালোবাসাটাও ওদের কাছে অন্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমি নাকি তথ্য পাচার করছি। আমার নাম ওদের হিট লিস্টে উঠে গেছে। আমার প্রমাণ করার কিছুই নেই মালতী। আমি কিছু বলবও না। তবে ওরা তোমাকেও জড়াতে চাইছে। স্কুল ফান্ডের টাকা আত্মসাৎ করেছ এই অভিযোগে ওরা তোমায় সাসপেন্ড করবে। আর আমার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, আর মাত্র তিনদিন তোমার সঙ্গে থাকব। আমাকে কি ভালোবাসো মালতী?  মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আমায় বিয়ে করবে?’

মালতী উত্তর দিতে পারেনি। সুধাকরকে এতদিন খুব কাছ থেকে দেখছে। সুধাকর নকশাল আন্দোলন করে তা সে জানে। তার প্রতিটা কাজকেই সে মনেপ্রাণে সমর্থন করে।

‘তুমি আমাকে ভালোবাসো?’, মালতীর প্রশ্নে সুধাকর ভেসে গেল মুহূর্তকাল।

দমকে দমকে কান্না এসে ঘিরে ধরল মালতীকে। সুধাকরের বুকে মাথাটা রেখে বলল, ‘চলো দূরে কোথাও চলে যাই যেখানে কেউ কোনও দিনও আমাদের খুঁজে পাবে না।’

‘না মালতী, পালিয়ে গেলে ওরা সহজেই তোমাকে আমাকে চোর প্রমাণ করতে পারবে। বিশ্বাসঘাতকের নাম মুছে ফেলবে সব জায়গা থেকে। তুমিও কি স্কুল ছাড়া থাকতে পারবে? তার থেকে যা হবে হোক, তুমি একা ফিরে যাও গ্রামে। তুমি একটা সই করে এই দলিলটা মায়ের হাতে দেবে। মা সবই জানেন।’

মালতীকে নামিয়ে দিয়ে সুধাকর যখন চলে গেল তখনও মালতী কিছু বলতে পারেনি। গোপন বিচার সভা বসবে আজ রাতেই। বাহাত্তর ঘণ্টা আয়ু মানুষটার। অথচ কেউ কিছুই করতে পারবে না।

সারা রাস্তাটা আর কোনও কথা বলেনি কেউ। নিস্তব্ধ বিকেলটা ধীরে ধীরে অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল।

দূরে স্কুল বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মালতী মাঠের থেকে সুধাকরকে উঠে আসতে দেখল। সবুজ আলপথের ওপর লম্বা লম্বা পা ফেলে সুধাকর আসছে।

দুপুরের হলুদ সূর্যটা ক্রমশ লাল হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে একটা বিন্দুতে পরিণত হল। সুধাকরের বুকের ওপর লাফিয়ে নামল সূর্যটা। একেবারে বাঁ দিক ঘেঁষে নেমে এসে ধীরে ধীরে ফুল হয়ে ফুটে উঠল।

মালতী কালো পিচের রাস্তার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে একা একা মিশে গেল আধো অন্ধকারে।।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...