রাত দুটোর সময় হঠাৎ মোবাইলের শব্দে ধড়ফড় করে উঠে বসল দীপ্ত। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ছোড়দির কল। ধড়াস করে ওঠে বুকটা, মায়ের কিছু হয়নি তো? না হলে এত রাতে ফোন? কোনওমতে ফোন অন করে বলল, ‘হ্যা ছোড়দি দীপ বলছি। এত রাতে ফোন করলি? সব ভালো তো?’
ও-প্রান্ত থেকে উত্তর এল, ‘সরি ভাই এতরাতে তোদের ডিস্টার্ব করার জন্য। চিন্তা করিস না, মা-র কিছু হয়নি। তোদের অসুবিধা না থাকলে এক মিনিট কথা বলতে পারব কি?’
ছোড়দি সুপ্রিয়ার কথা বলার ধরন দেখে দীপ আরও ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘না না অসুবিধা কেন হবে? বল না কি হয়েছে? এনি প্রবলেম?’
‘শোন তোকে আর তোতলাতো হবে না। মিতার নিশ্চয় ঘুমটা ভেঙে গেছে। ফোনটা স্পিকারে রাখ, তাহলে দুজনেই শুনতে পারবি। এবার শোন আমাদের রুমা এখন বিয়ে করতে চলেছেন। বুঝতে পারছিস রুমা বিয়ে করবে? সম্ভব হলে সামনের মাসেই।’
একটা ছোট্ট হাই তুলতে তুলতে দী৫ বলল, ‘ও… এই কথা, এর জন্য এত রাতে–’
দীপ্তকে তার কথা শেষ করতে না দিয়ে পাশ থেকে ঘুম জড়ানো চোখে, গলায় যথা সম্ভব উদ্বেগ ঢেলে দিয়ে মিতা বলে উঠল, ‘সে কি? তুমি কী করে জানলে ছোড়দিভাই? রুমা কি নিজে বলেছে তোমাকে? ছেলেটা কে? কী করে হল?
‘জানি না রে মিতা। কী করে হল? কবে হল? কিচ্ছু জানি না। কিন্তু এর পর কী হবে তা নিয়ে ভীষণ চিন্তায় আছি।’
‘বড়দি জানেন?’ মিতা জানতে চাইল
‘হ্যাঁ বড়দিই তো আমাকে মেসেজ করে জানাল। আমি তক্ষুনি ফোন করাতে জানলাম তিনি রোগী নিয়ে ব্যস্ত আছেন, পরে কথা বলবেন। তাই তোদের ফোন করলাম। সরি রে তোদের ঘুম নষ্ট করলাম। তোরা শুয়ে পড়। সম্ভব হলে সন্ধে সাতটার পরে ফোন করিস। অলোচনা করে কিছু তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
দীপ তখনও বুঝতে পারছিল না রাত দুটোর সময় হাজার মাইল দূরে ঘুমিয়ে থাকা ভাইকে ছোড়দি ঘুম থেকে তুলল এই খবরটা দেবার জন্য। এটা তো মেসেজ বা ইমেইল করেও জানাতে পারত। কিংবা দিনের বেলাতেও ফোন করতে পারত। তা না, দিল ঘুমের বারোটা বাজিয়ে। এবার জোর করে একটা হাইকে বুক থেকে টেনে মুখ দিয়ে বের করে দিতে দিতে চোখ বুজে দীপ নিদ্রাদেবীকে আহ্বান জানাল। কিন্তু পেছন থেকে তখনই মিতা একটা ছোট্ট গুঁতো মারল, ‘কি হল ঘুমিয়ে পড়লে? বুঝতে পারছ এবার কী হবে?’
‘না ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। তবে রুমা বিয়ে করবে –এই তো? হয়তো কিছু টাকা পয়সা চাইবে। দ্যটস্ ওকে। সি ইজ লাইক আ ফ্যামিলি মেম্বার।’
দী৫ আবার ওপাশ ফিরে শোবার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল অদ্ভুত কায়দায় মিতা শোয়া অবস্থা থেকে তড়াক করে উঠে বসল। দীপ ভাবল জিমটিম গিয়ে মিতা ভীষণ ভাবে ফিট হয়ে গেছে।
কিন্তু দীপ্তকে আর ভাবার সুযোগ না দিয়ে মিতা বলল, ‘সত্যি তোমার বুদ্ধির বলিহারি। তুমি টাকা দিলে আর রুমা বিয়ে করে ড্যাং ড্যাং করে নাচতে নাচতে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল। ব্যস তোমার মতে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। আরে বাবা সমস্যার শুরু তো তখন হবে যখন রুমা তোমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।’
অন্ধকার ঘরে দীপ্তর মগজের টিউবলাইট তখন জ্বলে উঠল। তাই তো গত বারো তেরো বছর ধরে রুমা মায়ের কাছে আছে। যখন এসেছিল তখন ওর বয়স বোধহয় বছর তিরিশ হবে। বিয়ের পরে বাচ্চা না হবার জন্য শ্বশুরবাড়িতে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হচ্ছিল। শেষে আর সহ্য করতে না পেরে মিউচুয়াল ডিভোর্স নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে আসে। দাদা-বৌদির সংসারে হয়তো ঠাঁই হতো কিন্তু সেটা খুব একটা সম্মানের হতো না। তাই মায়ের এক প্রাক্তন সহকর্মীর কাছে খবর পেয়ে মায়ের কাছে কাজের খোঁজে আসে।
মা তার দুবছর আগে শিক্ষকতার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। সেই সময় দীপ অনেক কষ্ট করে তার স্বপ্নের দেশ আমেরিকা-তে এসে পৌঁছেছে। বড়দি আর কৃষ্ণনদা তখন তিথিকে নিয়ে বেঙ্গালুরুতে, ছোড়দি আর সমীরদা উত্তরবঙ্গের কোনও এক শহরে। মা শ্রীরামপুরে তার নিজের বাড়িতেই থাকবার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। এ রকম অবস্থায় রুমা যখন মায়ের কাছে আশ্রয় চাইল মা তাকে না বলেননি। মনে একটু কিন্তু কিন্তু থাকলেও তারা তিন
ভাই-বোন ব্যাপারটা মেনে নেয় এই ভেবে যে, মায়ের জন্য একটা চবিবশ ঘন্টার কাজের লোক পাওয়া গেল।
রুমা থাকাতে মায়ের যে কত সুবিধা হয়েছে তা দু-বছর পরে দেশের বাড়িতে গিয়ে বুঝল দীপ্ত। দেখল মা সংসারটা রুমার হাতেই ছেড়ে দিয়েছে। রুমা সকাল থেকে সন্ধে অবধি ছুটে বেড়াচ্ছে। সকালে দীপ্তর জন্য ডালপুরি আলুর দম বানাচ্ছে তো দুপুরে মিতার পছন্দের পটলের দোলমা। তারই মধ্যে মায়ের জন্য একাদশীর ফলাহার। দীপ্তর মেয়ে দিঘি যেবার দেশের বাড়িতে গিয়ে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল রুমাই তখন রাত বারোটার সময় ওষুধের দোকান খুলিয়ে ওষুধ নিয়ে আসে। রুমা যে কবে কাজের লোক থেকে বাড়ির লোক হয়ে গেল বোঝাই গেল না।
শুধু যে মায়ের সংসারে সে অপরিহার্য হয়ে গেল তা নয়,পাড়া-প্রতিবেশীদের ছোটো খাটো প্রয়োজনেও রুমারই ডাক পড়ে আগে। সামনের বাড়ির মাসিমার টিউবলাইট-টা কাজ করছে না! রুমা দেখে যা তো বাবা, পাশের বাড়ির বউদির বাড়িতে হঠাৎ করে বাপের বাড়ির লোকজন এসেছে– ‘রুমা চট করে মোড়ের দোকান থেকে এগ রোল নিয়ে আয় তো সোনা।’
এ হেন রুমা-কে নিয়ে সুতপা সেনের সংসার ভালোই চলছিল।শুরু শুরু-তে যে ভয় ছিল কোথাও কোনও গন্ডগোল না বাঁধিয়ে বসে রুমা! সেটাও ধীরে ধীরে চলে গেল। এখন হঠাৎ করে চল্লিশোর্ধ রুমা বিয়ে করে চলে গেলে অসুবিধা তো হবেই। মা কার কাছে থাকবে? দিদিরা নিশ্চয়ই দীপ্তকে বলবে না মা-কে নিয়ে এসে নিজের কাছে রাখতে। তাও দু-তিন মাস কোনওমতে হয়তো ম্যানেজ করা যাবে কিন্তু তার বেশি তো কোনও ভাবেই সম্ভব নয়।
হঠাৎ দীপ্তর মাথায় একটা সম্ভাবনা এল। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে যে রুমা বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি না গিয়ে ওর স্বামীকে নিয়ে মায়ের কাছে থেকে গেল। তাহলে ওরা দুজনে মিলে মায়ের দেখভাল করতে পারবে। সময়ে অসময়ে একজন পুরুষমানুষ বাড়িতে থাকলে সুবিধাই হয়! প্রয়োজন হলে দীপ না হয় আরেকটু বেশি টাকা পাঠাবে। সমস্যার এমন ভালো সমাধান পেয়ে দীপ শান্তমনে আবার ঘুমের চেষ্টায় চোখ বুজল।
দুই
সুচিত্রা বেশ খুশি মনে তার চেম্বারে ঢুকল। যদিও বেশ টায়ার্ড লাগছে কিন্তু মনটা তার প্রসন্ন। সবাই বলেছিল ওই পঁয়ত্রিশ বছরের রুগ্ন তিন বাচ্চার মা পেশেন্টের সিজারিয়ান সেকশন করতে, কারণ সে একদম পুশ করতে পারছিল না আর বাচ্চাটাও বেশ বড়ো ছিল। সুচিত্রা কিছুটা জেদ করেই ফরসেপস ডেলিভারি করিয়েছে। সি-সেকশনের পরে যেরকম যত্ন নেওয়া উচিত তা এই চার সন্তানের মায়ের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সে চাইছিল যথা সম্ভব অপারেশনটা না করতে। যাক এখন সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে। বাচ্চাটা তো প্রায় সাড়ে তিন কিলো ওজনের।
সুচিত্রা অবাক হয়ে ভাবে এত রুগ্ন মায়ের পেটে এত হেল্দি বেবি কী করে হয়? আর তার মতো গাইনিকোলজিস্টকে ইনফারটাইল তকমা নিয়ে থাকতে হয়। যাকগে এই সব আজে বাজে কথা ভেবে সুচিত্রা আজকের এত ভালো দিনটা নষ্ট করবে না। সে তো এখন মা হয়েছে। অ্যাডপ্ট করা হলেও কী হবে, তিথি তো ওকে মা হবার সুযোগ দিয়েছে। নিজের ভালো হওয়া মনটাকে খারাপ হবার সুযোগ না দিয়ে চট করে ঘড়ি দেখে নিয়ে কৃষ্ণনকে মোবাইলে ফোন করল, ‘খাওয়া হয়ে গেছে?’
‘না তোর?’
‘না এক্ষুনি ওটি থেকে বেরোলাম। যে-পেশেন্টটা নিয়ে চিন্তায় ছিলাম ওর ফরসেপস ডেলিভারি করিয়েছি।। মাদার অ্যান্ড বেবি বোথ ওকে, ফিলিং স্যাটিসফায়েড।’
‘তাহলে চলে আয় আমার চেম্বারে, সেলিব্রেট করব।’ হই হই করে কৃষ্ণন বলল।
‘কী করে?’ সুচিত্রা জিজ্ঞেস না করে পারল না।
‘লুচি আর বোঁদে দিয়ে।’
কৃষ্ণনকে নিয়ে এই এক মুশকিল। ও খেতে খুব ভালোবাসে।
যে-কোনও সময় যা খুশি খেতে পারে, তা সে বিরিয়ানি দিয়ে ব্রেকফাস্ট হোক বা লস্যি দিয়ে লাঞ্চ।
চট করে ওটির জামাকাপড় চেঞ্জ করে নিয়ে কৃষ্ণনের চেম্বারে যেতে যেতে সুচিত্রা ঠিক করে ফেলল খাবার পরেই সুপ্রিয়াকে একবার ফোন করে নেবে। কাল রাতে ফোনে মায়ের কাছ থেকে রুমার বিয়ের কথাটা জেনেছিল। সকালে সুপ্রিয়াকে মেসেজ করেছিল। সরাসরি ফোন করেনি কারণ সুপ্রিয়া অল্পতেই নার্ভাস হয়ে যায়। তাই ভেবেছিল মেসেজ পড়ে কিছুটা ধাতস্থ হবার পরে ফোন করবে। কিন্তু সুপ্রিয়া সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে এত প্রশ্ন করছিল আর তার সঙ্গে নিজের মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছিল যে সুচিত্রা তার রোগীর অজুহাত দেখিয়ে ওকে কোনওমতে থামাতে বাধ্য হয়। সঙ্গে এটাও প্রমিস করিয়ে নিয়েছিল যে, ও কোনওমতেই মা বা রুমাকে ফোন করে এ ব্যাপারে কোনও আলোচনা করবে না।
কৃষ্ণনের চেম্বারের দরজায় দুবারটোকা দিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখল গাল ভরা হাসি নিয়ে কৃষ্ণন টেবিলে পুরি আর বোঁদে সাজিয়ে তারই অপেক্ষায় বসে আছে।
‘তোকে কে বলেছে এগুলো লুচি? এগুলো তো পুরি!’ সুচিত্রা ভ্রু কুঁচকে বলল।
‘লুচি আর পুরি একই হয়। বাংলার জামাই হয়ে লুচিকে আমি পুরি বলব?’
লুচি আর পুরির তর্কে না গিয়ে সুচিত্রা খেতে বসে গেল। তারপর জিজ্ঞেস করল ‘বোঁদে কোত্থেকে পেলি?’
অর্ধ নিমিলিত চোখে লুচি আর বোঁদে চিবোতে চিবোতে কৃষ্ণনের উত্তর, ‘আমার এক পেশেন্ট দিয়ে গেছে। হারনিয়া রিপেয়ার করেছিলাম। কলকাতার পেশেন্ট!’
‘কলকাতা থেকে হারনিয়া অপারেশন করাতে বেঙ্গালুরুতে এল। স্ট্রেঞ্জ, ওখানেই তো করাতে পারত।’ পুরির টুকরো ভেঙে মুখে দিতে দিতে সুচিত্রা বলল, ‘এখানে আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়া, অহেতুক পয়সা খরচ করে কী যে স্যাটিসফ্যাকশন পায় কে জানে?’
কৃষ্ণনের তখন খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করল, ‘অ্যাই সত্যি করে বল তো তুই আমার বউ নাকি শত্রু? কলকাতা থেকে পেশেন্ট আসছে, আমি দুটো পয়সা কামাচ্ছি, তা বুঝি তোর সহ্য হচ্ছে না।’ তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ‘আসলে আমার মনে হয় এটা হিউম্যান সাইকোলজি। যেটা হাতের কাছে পাই তার ভ্যালু আমরা বুঝি না। ওরা হয়তো ভাবে সাউথ ইন্ডিয়ান ডাক্তাররা ভালো, আর সেই ডাক্তার যদি বিশাল লম্বা সাউথ ইন্ডিয়ান নাম নিয়ে রোগীর সঙ্গে বাংলায় কথা বলে তাহলে তো আর কথাই নেই।’
কৃষ্ণন হয়তো আরও কিছু বলত কিন্তু তার আগেই ফোন এল– ‘অপারেশন থিয়েটার রেডি’।
চট করে উঠে চেম্বার থেকে বেরোতে বেরোতে বলল, ‘চলি রে, দুটো অপারেশন বাকি আছে। তোর তো বিকেলে চেম্বার নেই আজকে, দ্যাখ যদি সাতটার মধ্যে বাড়ি আসতে পারিস তাহলে দুজনে মিলে একটা সিনেমা দেখা যেতে পারে। আর শোন ভাবছি উইক এন্ডে তিথিকে একবার সারপ্রাইজ ভিজিট দিয়ে আসব। তুই প্ল্যান কর, আমি চলি।’
কৃষ্ণনের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সুচিত্রা ভাবল– ও সত্যি কত ভালো আছে। বিয়ের আগে সবাই কত ভয় দেখিয়েছিল। অবাঙালি ছেলে, মাছ মাংস খায় না, তার মধ্যে মায়ের একমাত্র ছেলে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এখন দেখছে কৃষ্ণনের মতো স্বামী পাওয়া, নিজের গর্ভে জন্ম না দিলেও তিথির মতো মেয়ে পাওয়া, সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার কিন্তু তাদের এই লাইফ স্টাইলের সাথে মা কি একটা দিনও মানাতে পারবে? নাকি মা এলে ওরা মা-কে বাড়িতে একা রেখে বাইরে এভাবে সময় কাটাতে পারবে? সকালে প্রিয়া ফোন করে এজাতীয় একটা প্রস্তাব রেখেছিল যেটা সুচিত্রার কাছে সম্পূর্ণ অবাস্তব মনে হয়েছিল।
সুচিত্রার চিন্তার জাল ছিঁড়ে মোবাইলটা বেজে উঠল। দেখল সুপ্রিয়ার কল… ‘হ্যাঁ প্রিয়া বল। না না শোন তুই মাথা গরম করিস না, আমি পরের সপ্তাহে শনিবার কলকাতা যাব। তুইও চলে আয়। তখন বসে কথা হবে। তুই প্লিজ মা বা রুমার সঙ্গে রাগারাগি করিস না। তুই ভাবিস না। আমি দীপ্তর সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি। আমি বুঝি রে তুই কত ব্যস্ত। তাহলে এখন রাখি? ভালো থাকিস।’
তিন
সুপ্রিয়ার কাজের অন্ত নেই। সকাল আটটার মধ্যে দশ বছরের যমজ দুই ছেলেকে তৈরি করে স্কুল পাঠাও। তার মধ্যে বেড টি নিয়ে ছেলেদের বাবাকে ঘুম থেকে তোলো। তারপর নিজে তৈরি হয়ে কোনওমতে নাকে মুখে খাবার গুঁজে সময়মতো কলেজ পৌঁছাও। ভাগ্য ভালো তার রান্নার মাসিটা খুব ভালো পেয়েছে। সে বেশ সকাল সকাল চলে আসে বলে সুপ্রিয়া রক্ষা পেয়েছে। কামাইও করে না। তবে সুপ্রিয়াও মাসিকে যথেষ্ট তোয়াজ করে রাখে। শনিবার আধা বেলা আর রবিবার তো ওর পুরো ছুটি!
শাশুড়ি মায়ের সকালের চা থেকে শুরু করে খাবার-দাবার সব তো মাসিই করে দেয়। উনি তো আমিষের ছোঁয়া খাবেন না, তাই মাসি আগে নিরামিষ রান্না করে তার পর আমিষ রান্নাগুলো করে। এর জন্য সুপ্রিয়াকে দুটো গ্যাস আভেন রাখতে হয়েছে। তারই মধ্যে ছেলে দুটো কখনও কখনও রান্না ঘরে ঢুকে কী রান্না হয়েছে দেখতে গিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি করে ফেলল তো আর দেখতে হবে না। বাড়িতে তুলকালাম কান্ড বেধে যাবে, আর সব দোষ সুপ্রিয়ার উপর পড়বে। কী যে জ্বালা! আর এখন এই ডামাডোলের মধ্যে মা-কে নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে।
রুমা এখন বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ বছর বয়সে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে বিয়ে করতে চলল। রুমা না থাকলে মায়ের পুরো দায়িত্ব সুপ্রিয়ার ঘাড়ে এসে পড়বে। হাতের কাছে তো সেই আছে। মাকে যে এখানে এনে রাখবে তারও উপায় নেই। শাশুড়িমা তার নিয়মের বেড়াজালে সংসারটাকে এমন করে বেঁধে রেখেছেন যে সুপ্রিয়ারই দমবন্ধ লাগে।
মঙ্গল আর শুক্রবারে কোনও পোড়া খেতে নেই তো বৃহস্পতি ও শনিবারে আমিষ খেতে নেই। এইমাসে লাউ খেতে নেই তো ওই মাসে কুমড়ো খেতে নেই।। আজকে সবার মাথায় তেল লাগাও তো কালকে গায়ে হলুদ লাগাও। শুরু শুরুতে তো পাগল পাগল লাগত। এখন সময়ের সাথে সবকিছু মানিয়ে নিয়েছে!
শাশুড়িমায়ের নিয়ম আছে তো সুপ্রিয়ার কাছে তার সহজ উপায় আছে। যেমন তেল বা হলুদ গোলা জল বাথরুমে রাখাই থাকে। প্রয়োজনে কপালে এক ফোঁটা ঘষে নিলেই হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে খটাখটি লাগে। শাশুড়িমায়ের বদ্ধমূল ধারণা, মায়ের প্ররোচনায় দিদি আর কৃষ্ণনদা তাদের ব্যাচমেট সমীরের ঘাড়ে সুপ্রিয়াকে চাপিয়ে দিয়েছে। যদিও সমীর প্রায় দুবছর রীতিমতো সুপ্রিয়ার সঙ্গে কোর্টশিপ করার পর তার মায়ের অনুমতি নিয়ে বিয়ে করেছে। কিন্তু কে কাকে বোঝাবে?
সমীরকে বলে লাভ নেই। সে তার চাকরি নিয়ে সব সময় এত টেনশনে থাকে যে সুপ্রিয়া ওকে আর সংসারের অসুবিধার কথা বলে ব্যতিব্যস্ত করতে চায় না। দুবছর আগে পাওয়া কলেজের এই লেকচারারের চাকরিটা সুপ্রিয়া-কে বাঁচিয়ে দিয়েছে। বাড়ি থেকে কলেজটা একটু দূরে বলে যাতায়াতের সময়টা বেশি লাগে কিন্তু সেই সময়টাই ওর একান্ত নিজস্ব। ওই সময়টায় ও নিজের মনের সঙ্গে অনেক কথা বলে। কল্পনায় কখনও একা কখনও বা সমীরের আর ছেলেদের সঙ্গে দুরে কোথাও বেড়াতে চলে যায়। এমন কোনও জায়গা যেখানে কোনও সমস্যা নেই কোনও অভিযোগ অনুযোগ নেই। যেখানে মন খুলে হাসা যায়, গান গাওয়া যায়। সুপ্রিয়া জানে না, সেদিন সত্যি তার জীবনে আসবে কিনা।
চার
আজ সকাল থেকে বাড়িতে বেশ হইচই লেগেছে। সুতপা গত এক সপ্তাহ থেকে অপেক্ষায় ছিল এই দিনটার জন্য। গত সপ্তাহে তার তিন ছেলেমেয়ে জানাল– ওরা আসবে সব একসাথে। চিত্রা আর প্রিয়া-রা দুদিন থেকে চলে যাবে, তবে দীপ্ত, বৗমা আর নাতনিকে নিয়ে এক সপ্তাহ থাকবে। তারপর ওরা মুম্বই-এ দিঘির মামার বাড়িতে কয়েকদিন থেকে আমেরিকা ফেরত যাবে।
সুতপা ভালো করেই বুঝতে পারছে ওরা কেন আসছে! তাহলেও খুব ভালো লাগছে সবাইকে একসাথে দেখতে পাবে বলে। দীপ্তরা কাল রাতেই এসে পৌঁছেছে। কিন্তু অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল বলে ভালো করে কথা হয়নি। তবে দী৫ আজ কাকভোরে উঠেই চলে এসেছে মায়ের ঘরে। মায়ের খাটে মশারির মধ্যে ঢুকে বাবু হয়ে বসে কত যে বকবক করল তার ঠিক নেই। এরই মধ্যে তাদের কথাবার্তার আওয়াজ পেয়ে রুমা চা বানিয়ে নিয়ে এসেছিল। দীপ্তর জোরাজুারিতে সুতপাকে দাঁত না মেজেই চা খেতে হল খাটে বসে। এতে নাকি চায়ের আসল স্বাদ পাওয়া যায়।
আসলে সুতপার মনে হল বাকি সবাই এসে যাবার আগেই দী৫ সুতপার সঙ্গে সময় কাটাতে চাইছিল। সুতপার সেই ছোটোবেলার দীপ্তকে মনে পড়ে যায়। সবসময় মায়ের সঙ্গে লেগে লেগে থাকত। বড়ো হবার পর সেটা কমলেও সব সময় ও সুতপার দিকে নজর রাখত। ওদের বাবা মারা যাবার পর তো আরও বেশি করে। মা সময়মতো খাচ্ছে কিনা, শরীরের খেয়াল রাখছে কিনা। চোখ দেখিয়ে চশমার পাওয়ার চেঞ্জ করা হয়েছে কিনা! এমনকী পুজোতে মায়ের কটা নতুন শাড়ি হল তাও খেয়াল রাখত।
সুতপার জীবনগাছের দী৫ ছিল এক বলিষ্ঠ ডাল। তারপর সেই ডাল আমেরিকায় গিয়ে নিজে গাছ হয়ে গেছে। শুধু কি দী৫ নাকি, চিত্রা, প্রিয়া সবাই এক একটা গাছ হয়ে নিজেদের সংসারের মাটিতে শিকড় ছড়িয়ে দিয়েছে। সত্যি সুতপার ভাবতে খুব ভালো লাগে যে, তার তিন ছেলে মেয়ে সবাই জীবনে সুপ্রতিষ্ঠ। অজান্তে তার দৃষ্টি চলে গেল দেয়ালে বড়ো ফ্রেমে টাঙানো গৗতমের ছবির দিকে।
ব্যাংকে সামান্য চাকরি করা গৌতমের এক মাত্র লক্ষ্য ছিল তিন ছেলে মেয়েকে মানুষ করা। সংসারের একটু স্বাচ্ছল্য বাড়াবার জন্য সুতপা স্কুলে চাকরি নিয়েছিল। সুতপার মনে আছে সিনেমাপাগল গৗতম তার সন্তানদের নাম সিনেমার তারকাদের নামে রাখতে চেয়েছিল। দুই মেয়ের পরে ছেলের নামের সময় সুতপা বেঁকে বসেছিল শুভেন্দু নয় সুদীপ্ত রাখতে হবে।
হঠাৎ ড্রয়িংরুম থেকে হা হা করে হাসির শব্দ সুতপার ভাবনাটাকে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। তার মুখেও একটা ছোট্ট হাসি খেলে গেল। সকালে বিছানায় বসে দীপ্তর সঙ্গে গল্প করার মধ্যেই প্রিয়া আর সমীর দুই ছেলে-সহ চলে এসেছিল। আর কিছুক্ষণের মধ্যে বোধহয় চিত্রারাও চলে আসবে। আবার জোর হাসির আওয়াজ এল, সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়ার গলা ‘মা, মা তুমি এখানে এসো তো, এরা সবাই আমাকে যা তা বলছে তখন থেকে।’
ড্রয়িংরুমে যাবার বদলে সুতপা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। তার তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রিয়া চলনে বলনে অনেকটা ওদের বাবার মতো ছিল। গান গাইত ভালো, সিনেমার পোকা ছিল, ছবি-টবিও অাঁকত। চিত্রা আর প্রিয়া প্রায় পিঠোপিঠি বোন হলেও চিত্রা অনেক বেশি যত্ন পেয়েছে। চিত্রা ছিল চুপচাপ শান্ত গোছের, প্রিয়া ছিল তার উলটো। সংসার নিয়ে প্রিয়া এত ব্যস্ত থাকে যে সুতপা জানে না– ও গান গাইবার বা সিনেমা দেখার সুযোগ পায় কিনা।
‘ও ঠাম্মা তুমি এখানে কী করছ? চলো না সবাই তোমাকে ও ঘরে ডাকছে’ দিঘি সুতপার হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জিজ্ঞেস করল।
দিঘির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সুতপা বললেন, ‘একটু কাজ আছে, তুমি যাও আমি আসছি।’
‘না তোমাকে এখনই যেতে হবে।’ দুপাশ থেকে দুই নাতি বাবুন আর টাবুন একরকম টানতে টানতে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এল।
‘দেখলে তো কেমন পেয়াদা পাঠিয়ে তোমাকে ধরে আনলাম’ প্রিয়া বলল।
‘না রে জলখাবারের ব্যবস্থা করতে হবে তো, তাই রান্নাঘরে গিয়েছিলাম’ সুতপা জবাবদিহি করতে গেলেন।
‘ব্রেকফাস্ট তো সিঙারা জিলিপি দিয়ে হবে। দিদি আর কৃষ্ণনদা এই এল বলে ওগুলো নিয়ে। এয়ারপোর্টে নেমেই কৃষ্ণনদা জানতে চাইলেন, আমরা এরকম ব্রেকফাস্টে রাজি আছি কিনা, অ্যান্ড উই অল এগ্রিড।’
‘তা হলে বাচ্চাগুলো?’ সুতপা মিতার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন।
‘ওরাও তাই খাবে’ মিতা জবাব দেবার আগেই সুপ্রিয়া তড়বড়িয়ে বলে উঠল।
‘আপনি চিন্তা করবেন না মা। আমি ইউএস থেকে ওট্স আর কর্নফ্লেক্সের প্যাকেট নিয়ে এসেছি, দিঘির সঙ্গে বাবুন টাবুনরাও খেতে পারে’ সেটা মিতা মিষ্টি করে জানিয়ে দিল তারপর সুপ্রিয়ার ভুরু কুঁচকানো গম্ভীর মুখের দিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বলল, ‘আসলে দিঘির পেটে তো সব কিছু সহ্য হয় না, তাই আমাকে ব্যবস্থা রাখতেই হয়।
ড্রয়িংরুমের আবহাওয়াটা একটু যেন থমথমে হয়ে গেল। কিন্তু পর মুহূর্তেই গেটের বাইরে থেকে কৃষ্ণনের আওয়াজ এল ‘ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল’ পাশ থেকে চিত্রার ধমক– ‘চ্যাঁচাস না, পুরো পাড়া দরজা খুলে তোকে তাড়া করবে।’
পাঁচ
দুপুরে খাওয়ার সময় আরেক চোট জমাটিয়া আড্ডা হল। তারপর সুপ্রিয়া ঘোষণা করল ‘অনেক গল্প হয়েছে এবার কাজের কথায় আসা যাক। তোমরা ভুলে যেও না যে তোমরা কলেজ রি-ইউনিয়নে আসোনি বরং একটা পারিবারিক সমস্যার সমাধানের খোঁজে এসেছ। সুতরাং বাচ্চারা বাদে সবাই বসবার ঘরে গিয়ে বসো, আমি বাবুন টাবুনকে ওদের হোমওয়ার্ক করতে বসিয়ে আসছি। রুমা তুই তোর কোনও কাজ থাকলে তাড়াতাড়ি সেরে নে। আমরা তোর সঙ্গেও কথা বলতে চাই।’
দুই ছেলেকে সুপ্রিয়া সুতপার ঘরে পড়তে বসিয়ে দরজা বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে দেখল সবাই আবার গল্পে মেতেছে। মা শুধু সকালের খবরের কাগজটা চোখের সামনে ধরে পড়বার চেষ্টা করছেন। ওরা সবাই জানে মায়ের চোখের অসুখের কথা। দুবার অপারেশন করিয়েও কোনও লাভ হয়নি। ভালো করে দেখতে পায় না আর সেই জন্যেই তো সুপ্রিয়ার অত চিন্তা হয় মাকে নিয়ে।
সুপ্রিয়াকে দেখে সবাই নড়ে চড়ে বসল। এর মধ্যে রুমাও শাড়ির অাঁচলে হাত মুছতে মুছতে মায়ের পাশে মাথা নিচু করে বসল। কেউ কিছু বলছে না দেখে সুপ্রিয়াই শুরু করল– রুমা আমরা শুনলাম তুই নাকি বিয়ে করবি। এটা কি সত্যি?
রুমা ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলাতেও আবার জিজ্ঞেস করল– ছেলেটা কে? কী করে? তোরা কবে এসব ঠিকা করলি?
রুমাকে কিছু বলতে না দিয়ে সুতপাদেবী মুখ খুললেন, ‘ছেলেটাকে আমি দেখেছি। ভালো ছেলে। আগে অটোরিক্সা চালাত এখন টোটো চালায়। রুমাকে ভালোই রাখবে।’
সুপ্রিয়া প্রায় অাঁতকে উঠল– রিক্সাওয়ালা? মানে ভাড়াতে চালায়? কী করে চিনলি ওকে? আই মিন বিয়ের ব্যাপার তো তাই জিজ্ঞেস করছি। এসব সিদ্ধান্ত ভালো করে ভেবে চিন্তে নেওয়া উচিত।
এবারেও সুতপা রুমার হয়ে উত্তর দিলেন– রিক্সা নয় অটোরিক্সা চালাত, এখন টোটো চালায়। কাছেই থাকে। ওর মা এক সময় এ বাড়িতে কাজও করেছে। তোরা হয়তো কখনও দেখেও থাকতে পারিস।
‘তার মানে রুমার উড বি মাদার ইন ল ইজ এ ঠিকে ঝি, অ্যান্ড সি ইউজড টু ওয়ার্ক ইন দিস হাউস। আই হোপ দিস ইজ নট এ প্ল্যান টু গেট সাম ফিন্যান্সশিয়াল বেনিফিট’ মিতা ইচ্ছে করে ইংরেজিতে কথাগুলো বলল যাতে রুমা বুঝতে না পারে। তারপর রুমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ‘রুমা আমরা সবাই তোমার ভালো চাই, তাই বার বার বলছি তুমি সবদিক দেখে শুনে ভালো ভাবে চিন্তা ভাবনা করে ডিসিশন নিও, বিয়ের ব্যাপারে তাড়াহুড়ো কোরো না।’
দ্যাখো তুমি এখানে যেভাবে আছো একজন অটোরিক্সাওয়ালাকে বিয়ে করে তার বাড়িতে কি তুমি সেভাবে থাকতে পারবে? হয়তো কোনও কারণে তোমার তাকে এখন ভালো লাগছে কিন্তু যখন দেখবে সংসারে অভাব অনটন আসছে তখন এই ভালোবাসা মনের জানলা দিয়ে উড়ে যাবে, পড়ে থাকবে শুধু শরীরটা। তুমি একবার কষ্ট পেয়েছ জীবনে, তাই আমরা চাই না আবার সেরকম কিছু স্লকটা হোক।’
নিজের বক্তব্য শেষ করে মিতা দেখল সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে তারিফের দৃষ্টিতে! ব্যতিক্রম একমাত্র মা আর রুমা। মিতার কথার পিঠে কথা বসিয়ে সুচিত্রাও রুমাকে বোঝাবার চেষ্টা করল, ‘মিতার কথা আমিও মানছি। আমি এত পেশেন্ট দেখি তো, সব জায়গায় একই ব্যাপার। ছেলেরা বউ-এর কাছ থেকে শরীর, সন্তান আর সেবা এটাই আশা করে। বিনিময়ে মেয়েরা কি সেভাবে আদৗ কিছু পায় স্বামীর কাছ থেকে? রুমা ভালো করে ভেবে নিয়ে বিয়ে করিস বাবা।’
‘যা বাবা হঠাৎ করে আমাদের পেছনে পড়লি কেন চিত্রা? এবার তো আমার বউ আমার উদাহরণ দিয়ে সমস্ত পুরুষজাতিকে তুলোধনা করবে’ সমীর সুচিত্রাকে কথার খোঁচা দিল। তোমার বউ পাগল নয় যে কাজের কথা থেকে সরে গিয়ে অন্য কথা বলে সময় নষ্ট করবে! সুপ্রিয়া সমীরের পাশ থেকে উঠে এসে রুমার পেছনে দাঁড়িয়ে ওর পিঠে হাত রেখে বলল, ‘রুমা তুই প্রাক্টিক্যালি ভাবার চেষ্টা কর –একজন অটোরিক্সাওয়ালা এত বছর বিয়ে না করে এখন একজন তেতাল্লিশ বছর বয়সি মহিলাকে বিয়ে করতে চাইছে কেন? শুনলাম তোর
দাদা-বউদিরও নাকি মত নেই এ বিয়েতে। তাহলে তুই বিয়েটা করছিস কেন?’
রুমা সবার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওদেরকে একবার বোঝাবার শেষ চেষ্টা করল, ‘যতিন টোটো আর ভাড়াতে চালায় না। গত মাসে ওটা ও কিনে নিয়েছে। আর বাড়িতে খালি ওর মা আছে। আমার কাজ করা নিয়েও যতিনের কোনও আপত্তি নেই। দাদা-বউদির থেকে মাসিমাই আমাকে ভালো বোঝেন, তাই বলছিলাম’ রুমার কথা শেষ করতে না দিয়েই সুচিত্রা বলে উঠল, ‘তাহলে তুই মায়ের কাজ ছাড়বি না তো? বাবা বাঁচালি।’
দেখা গেল যারা এতক্ষণ রুমার বিয়ে নিয়ে চিন্তিত ছিল তাদের চিন্তার বিষয় হঠাৎ করে বদলে গেল। কৃষ্ণন সুচিত্রাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘বাট সি হ্যাজ নট সেইড দ্যাট। ডিড সি সে দ্যাট সি উইল ওয়ার্ক হিয়ার?’ তারপর রুমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘বিয়ের পরেও কি তুমি তোমার মাসিমার কাছে থেকে তার সুবিধা অসুবিধার খেয়াল রাখতে পারবে রুমা?’
‘দ্যাট ইজ পসিবল ওনলি ইফ সি লিভস্ ইন দিস হাউস অ্যান্ড দ্যাট অলসো উইথ হার হ্যাজবেন্ড’ দীপ তার মনের কথাটা বলে দিল।
‘আর যতিনের মা? তিনি কি তার ছেলেকে ছেড়ে দেবেন। তিনিও সবার সঙ্গে চলে আসবেন। রিক্সাওয়ালা হোক বা ডাক্তার,বাঙালি মায়েরা ছেলেদের তাদের মুঠো ছাড়া করেন না। তারপর যিনি ছিলেন বাড়ির ঝি তিনিই হয়ে যাবেন মালকিন, আর আমার মা হয়তো তখন বাড়ির ঠিকে ঝির কাজটা করবে।’ সুপ্রিয়া রাগের বশে কথাগুলো বলে ফেলে বুঝতে পারল কাজটা ঠিক করেনি কারণ ততক্ষণে জলভরা চোখ নিয়ে রুমা দৗড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে!
কোনওমতে পিরস্থিতি সামাল দিতে সমীর বলল, ‘আচ্ছা আমরা তো যতিনের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারি। এমনও তো হতে পারে সকালে এসে সারাদিন এখানে থেকে রুমা রাতে যতিনের বাড়ি চলে গেল। মায়ের কাছে রাতে থাকার জন্য আমরা কোনও আয়ার ব্যাবস্থা করে দেব। অথবা রুমার বদলে অন্য কোনও চবিবশ ঘন্টার কাজের লোকও খোঁজা যেতে পারে।’
কিন্তু আমরা যদি রুমার সঙ্গে যতিনকেও এখানে রাখতে পারতাম তাহলে কিন্তু আমাদেরই সুবিধা হতো। রাত-বিরেতে বাড়িতে একজন পুরুষমানুষ থাকলে সুবিধাই হয়।’ দী৫ আরেকবার নিজের মতটা সবার ওপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করল।
‘দী৫ ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা কর। যতিন একটা রিক্সাওয়ালা সরি টোটো-রিক্সাওয়ালা। তাকে বাড়িতে রাখাটা মোটেই প্রেস্টিজিয়াস নয়। ও এখানে থাকলে দুদিন পরে ওর লেভেলের বন্ধু-বান্ধবরাও এখানে আসা যাওয়া করবে। তুই কি মনে করিস আমাদের এই সফিস্টিকেটেড পাড়াতে লোকে সেটা অ্যালাউ করবে? যেখানে সবার বাড়ির সামনে দামি-দামি গাড়ি থাকে সেখানে আমাদের বাড়ির সামনে টোটো দাঁড়িয়ে থাকবে। ‘উফ্ আমি আর ভাবতে পারছি না।’ সুপ্রিয়ার গলায় হতাশার ছোঁয়া যেন। সে কোনও মতেই রুমার বিয়ে মানতে পারছে না।’
সুতপার শরীরটা কেমন যেন করছিল। কোনওমতে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমার তো দুপরে খাবার পর একটু শোবার অভ্যাস, তোরা কথা-বার্তা বল, আমি ও-ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিই।’ নিজের ঘরে গিয়ে দেখলেন তছনছ অবস্থা। নাতিদের বইপত্র, বিছানার বালিশ, চাদর সব মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। তোশকটা খাট থেকে অর্ধেক ঝুলে আছে আর খাটের ওপর বাবুন টাবুন মারামারি করছে। দরজা বন্ধ করে কোনওমতে গেস্টরুমে এসে দিঘির পাশেই শুয়ে পড়লেন। চোখ বুজে শুয়ে পড়লেও ঘুমাতে পারলেন না কারণ তখন ড্রয়িংরুমে জোর চ্যাঁচামেচি চলছে।
সুপ্রিয়া বলছে, ‘দ্যাখ দিদি, বাবা মারা যাবার পর মায়ের যখন দরকার ছিল কাউকে নিজের পাশে পাবার, তখন তুই বা দী৫ কেউ মায়ের কথা ভাবিসনি। তোরা কি পারতিস না এখানে সেটল করতে? তা না তোরা রওনা দিলি দক্ষিণ ভারতে, ফর ব্রাইটার ফিউচার। নার্সিংহোম তো এখানেও করতে পারতিস কিন্তু করিসনি জাস্ট টু অ্যাভয়েড রেসপন্সিবিলিটিজ।’
সুচিত্রার উত্তর যেন তৈরি ছিল, বলল, ‘সেকি কিছুক্ষণ আগে তুই বললি না যে বাঙালি মায়েরা ছেলেদের হাতের মুঠোর মধ্যে রাখে। ছেলেদের সংসারের মালকিন হয়ে থাকে, তাহলে মায়ের রেসপন্সিবিলিটি তো দীপ্তর নেওয়া উচিত। দীপ এখানে থাকতে পারত অথবা মা ইউএস চলে যেতে পারত ছেলেকে মুঠোর মধ্যে নিয়ে।’ দী৫ চুপ করে বসে রইল, তারপর লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলল, কলকাতা ছেড়ে আমরা চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম তিথির জন্য। ওকে অ্যাডপ্ট করার পাঁচ বছর পরেও কোথাও দেখা হলেই চেনা পরিচিত লোকজনেরা বলত, এই বুঝি আপনাদের দত্তক নেওয়া মেয়ে। বেশ ভালো রেখেছেন তো। কোথা থেকে নিয়েছিলেন যেন। মা বাবার কোনও খোঁজ পেয়েছেন কি? ইত্যাদি ইত্যাদি। তিথি তখন বুঝতে শিখেছিল, দুঃখ পেত। আমাদের মনে হয়েছিল দূরে কোথাও চলে যাওয়াটাই ভালো।’
‘ঠিক আছে তখন প্রবলেম ছিল চলে গেছিস এখন তো তিথি দিল্লিতে হস্টেলে আছে। কৃষ্ণনদার মাও বেঁচে নেই, যে ওনার অজুহাত দেখাবি। তোরা তাহলে এখন ওখানকার পাঠ চুকিয়ে কলকাতা চলে আয়। যেখানে পড়াশোনা করলি সেখানকার লোকেদেরও কিছু সেবা যত্ন কর সঙ্গে সঙ্গে মায়ের খেয়ালও রাখতে পারবি!’ সুপ্রিয়া স্লকপ্রকার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল সুচিত্রা আর কৃষ্ণনের দিকে।
‘যেটা হয় না তা নিয়ে তর্ক করিস না ছোড়দি।’ দীপ সুপ্রিয়াকে থামাবার চেষ্টা করে।
‘তুই তো দিদির পক্ষ নিয়ে কথা বলবিই ভাই। দিদি যদি সাউথ ইন্ডিয়ায় গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছে তাহলে তুই তো আরেক কাঠি ওপরে– আমেরিকায় মহানন্দে বিরাজমান এনআরআই। তোরা সব দায়িত্ব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে যে যার মতো নিজেদের লাইফ এনজয় করছিস।’
সুচিত্রা এবার প্রায় চেঁচিয়ে উঠে ধমক দিল সুপ্রিয়াকে, ‘তুই চুপ করবি প্রিয়া? তখন থেকে খালি ঝগড়া করছিস। তুই এমন কী করেছিস যে তখন থেকে আমাদের দোষারোপ করে যাচ্ছিস।
‘করিনি আমি? মায়ের চোখ অপারেশন গত দুবছরে দুবার হল। কে এসে থাকল মায়ের কাছে? এ বছর যখন ভাইরাল ইনফেকশন থেকে মায়ের মারাত্মক জ্বর হল, কাকে দৗড়ে আসতে হল? আমেরিকার সাহেব টাকা পাঠিয়ে দিয়ে বললেন– ভালো নার্সিংহোমে ভর্তি কর আর বেঙ্গালুরুর ম্যাডাম দিনে দুবার ফোন করে জ্ঞান বিতরণ করলেন। সুপ্রিয়া কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল। তোরা সব বড়ো বড়ো ডিগ্রি নিয়ে নিজেদের ফিউচার ভালো থেকে আরও ভালো করার জন্য দৗড়োচ্ছিস আর আমি সকাল থেকে রাত অবধি দৗড়ে মরছি তোদের খুশি করার জন্য। আমি আর পারছি না।
হঠাৎ করে পুরো বাড়িটা যেন ভীষণ ভাবে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে কৃষ্ণন বলল, ‘একটু চা খেলে বোধহয় ভালো হতো, কি বলিস সমীর?
সুচিত্রা উঠতে যাচ্ছিল চায়ের বন্দোবস্ত করতে, কিন্তু মিতা বলল, ‘তুমি বসো বড়দিভাই। আমি চায়ের ব্যবস্থা করছি।’
তারপর ঘর থেকে বেরোবার আগে থমকে দাঁড়িয়ে সবার দিকে ঘুরে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘জাস্ট ইট কেম টু মাই মাইন্ড।’ এ বছরের শুরুতে রুমা একদিনের জন্য কোনও হসপিটালে বা নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিল না? একটু চিন্তা করে সুচিত্রা বলল, ‘হ্যাঁ ভাইরাল গ্যাসট্রোএনটেরাইটিস হয়ে ডিহাইড্রেশন হয়েছিল। স্যালাইন নিতে হয়েছিল। কিন্তু কেন জানতে চাইছিস এসব এখন?’
‘সত্যি কি তাই হয়েছিল, নাকি প্রেগনেন্সি টারমিনেশন? ইউ নেভার নো।’
হংসীনির মতো গ্রিবা উঁচু করে মিতা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সবার মনে এক সন্দেহের কাটা গুঁজে দিয়ে।
ছয়
তিন মাস পরে দীপ একটা ইমেইল পেল সুতপার কাছ থেকে। চোখের অসুবিধাটা বাড়াবাড়ি হবার আগে মা নিয়মিত কম্পিউটার ব্যবহার করতেন। ইদানীংকালে সেভাবে না হলেও মাঝেমধ্যে মায়ের ইমেইল পায় সে আর তাছাড়াও মাসে দুবার করে ভিডিও চ্যাটও করে। তাই ইমেইলটা পেয়ে সে মোটেই অবাক হয়নি। কিন্তু সকালে কাজের তাড়া থাকায় সেটা পড়ে উঠতে পারেনি। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে ইমেইল খুলে দেখল মায়ের হাতে লেখা একটা চিঠি অ্যাটাচড করে পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে মা লিখেছেন–
আমার প্রিয়জনেরা,
আশাকরি তোমরা সবাই ভালো আছো। আমি ইমেইলটা দীপ্তকে পাঠাচ্ছি আর আশা করব এটা পড়বার পর দীপ চিত্রা ও প্রিয়াকে পাঠিয়ে দেবে। তোমরা হয়তো ভাববে মা ফোন না করে কেন চিঠি লিখছে। কারণ আমি সেকেলে মানুষ। মনের দ্বিধা সরিয়ে সব কথা চিঠিতে যেভাবে লেখা যায় তা বোধহয় ভিডিও চ্যাট বা ফোনে হয় না।
আসলে একটা খবর দেবার জন্য তোমাদের বিরক্ত করছি। আমি আর আধ ঘন্টার মধ্যে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ভয় পেও না, নিরুদ্দেশে যাত্রা করছি না। বরং রুমা আর যতিনের সঙ্গে ওদের বাড়িতে থাকতে যাচ্ছি। যতিনের মায়ের কোনও আপত্তি নেই ছেলের বউ-এর সঙ্গে তার মাসিমাকেও বাড়িতে আশ্রয় দিতে। আমি রুমাকে বলেছিলাম– ওদের দেড় খানা ঘরের বাড়িতে আমাকে নিয়ে গেলে অসুবিধা হবে, কিন্তু ওরা শুনল না।
যতিন বারাসতের দিকে একটা জমি দেখেছে। পাকা বাড়ি বানাবার জন্য। আমি বলেছিলাম কিনে দিই, কিন্তু ও কিছুতেই আমাকে কিনতে দিল না। ছেলেটার আত্মসম্মান বোধটা প্রবল, তাই আমি জোর করিনি। যতিনের এ বাড়িতে ইন্টারনেট নেই তাই আর ইমেইল করতে পারব না যদি না দোকানে গিয়ে করি। সেইজন্য ভাবলাম কাজের কথা এখনই সেরে নিই।
একটা উইল এর কপি পাঠালাম। বাড়িটা তোমাদের তিনজনের নামে করে দিয়েছি। পাড়ার অনেকেই কিনতে ইচ্ছুক। বিক্রি করে তোমরা টাকাটা ভাগ করে নিও অথবা কোনও আশ্রমে দান করে দিও। আমার মোবাইলটা সঙ্গে আছে, যখন খুশি কথা বলতে পারো আমার সঙ্গে।
তোমাদের মা তোমাদেরই আছে খালি আমার নতুন ঠিকানাটা তোমাদের জানালাম না। তোমরা এখানে এলে ওরা অস্বস্তিতে পড়বে আর তোমাদেরও হয়তো ভালো লাগবে না। কিন্তু আমি জানি, আমি সত্যি ভালো থাকব ওদের সাথে!
ওহো তোমাদের আসল কথাটা জানাতে তো ভুলেই গেলাম। গত রবিবার যতিন আর রুমার বিয়ে দিয়েছি আমরা। তোমাদের কাছ থেকে নব বরবধুর জন্য আশীর্বাদ কামনা করি।
ইতি
তোমাদের মা–
ইমেইলটা পড়ে দীপ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে।