জুনি মোবাইলে সময়টা দেখে নিল। এখনও সময় আছে পার্লার পৌঁছোনোর। আগে থেকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা, সুতরাং সময়মতো ওকে পৌঁছোতে হবে। নতুন নতুন বিয়ের পর ওর এইসব সাজগোজ, পার্লারে বসে রূপচর্চা খুব ভালো লাগত। এখন পানিশমেন্ট মনে হয়! আগে এইসব করার জন্য একটা মন ছিল ওর, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শরীর, মনে কেমন একটা শিথিলতা চলে এসেছে জুনির।
ওর বয়স এখন মাত্র সাতাশ। বড়ো বড়ো চোখ, পাতলা ঠোঁট, টিকালো নাক, কালো ঘন চুল যা কিনা স্টেপ করে কাটা, গায়ের রং একটু মাজা, যেটাকে আমরা শ্যামবর্ণ বলে থাকি। সব মিলিয়ে বেশ চোখে পড়ার মতো ব্যক্তিত্ব।
জুনি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তিন বোন, জুনি মেজো। বড়ো আর ছোটো বোন অপরূপ সুন্দরী, গায়ের রং দুধে আলতা বলতে যা বোঝায়, সেখানে জুনির গায়ের রংটাই একটু চাপা। এর জন্য মনে মনে জুনি একটু বিব্রত হতো। অথচ ওর চোখের মধ্যে এমন একটা আকর্ষণ ছিল যে, সৌমেন একবার দেখেই জুনিকে বিয়ে করতে মনস্থ করে ফেলে।
বিয়ের পাঁচ বছর পরেও জুনি আজও বুঝতে পারেনি, ওদের বিয়েতে সৌমেনের মা-বাবা আদৌ খুশি হয়েছিলেন কিনা। ওর এই একই প্রশ্ন সৌমেনকে নিয়ে। জুনি কি আদৌ সৌমেনকে খুশি করতে পেরেছে?
পার্লারে মেয়েটির দক্ষ হাত জুনির সারা মুখে মাসাজ করছে। ছোট্ট গদিপাতা বেঞ্চটায় শুয়ে আরামে চোখ বুজল জুনি, অতীতের ঘটনাগুলো চোখের সামনে এসে ভিড় করছে। সৌমেনের সঙ্গে ওর বিয়ে আজও স্বপ্ন মনে হয় জুনির। বিয়ের দিন নিজের শাড়ি, গয়না দেখে জুনি বেশ বুঝতে পারছিল ওর বোনেদের, এমনকী বান্ধবীদেরও ওকে দেখে ঈর্ষাবোধ হচ্ছে। সৌমেনদের বাড়ি থেকে পাঠানো হয়েছিল বিয়ের পুরো সরঞ্জাম। লাল বেনারসিতে ঠাসা জরির বুনন, সোনার তারের কাজ। ওড়নাতেও শাড়ির সঙ্গে মানানসই কাজ করা।
গা ভর্তি গয়না, যার বেশিরভাগটাই শ্বশুরবাড়ি থেকেই আসা। বিয়ের দিন হিরের সেট দিয়ে শ্বশুরমশাই আশীর্বাদ করে গেলেন। সত্যি, কনেকে দেখে রাজকুমারীই মনে হচ্ছিল।
নতুন বউ হয়ে শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ করার সময় বুকের ভিতরটা কেমন যেন ভয়ে কাঁপছিল। এই বিশাল বাড়িতে সৌমেন থাকে। এ তো পুরো রাজপ্রাসাদ। জুনি ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল। বউভাতের দিন রাতে বউভাতের ধড়াচুড়া ছাড়ার পর, এক ফাঁকে শাশুড়ি এসে ঘরে ঢুকেছিলেন। সৌমেন অতিথিদের ছাড়তে নীচে গিয়েছিল। একটা প্যাকেট ধরিয়ে শাশুড়ি বলেছিলেন, শাড়ি ছেড়ে এটা পরে নিও। আশা করি, আজ রাত্রে কী করতে হয় সেটা তুমি জানো? প্যাকেটের ভিতর সাদা ফাইন কাগজে মোড়া সুন্দর একটা নাইটি, যেটা বিদেশ থেকে কেনা বলেই মনে হয়েছিল জুনির। শাশুড়ির কথা শুনে জুনির গাল, কান সব লাল হয়ে উঠেছিল।
অবশ্য সৌমেন ভালোবাসার পাকদণ্ডি বেয়ে খুব যত্ন করে ধৈর্য্য সহকারে জুনিকে চলতে শিখিয়েছিল। সৌমেনের বাড়ির আদবকায়দা, রীতি-রেওয়াজ, পোশাক পরার ঢং একেবারেই জুনির বাপের বাড়ি থেকে আলাদা ছিল। ধীরে ধীরে জুনি নিজেকে শ্বশুরবাড়ির আদলেই ঢেলে সাজিয়ে তোলে।
একমাস পরে যখন ও বাপের বাড়ি কয়েকদিনের জন্য থাকতে এল, সকলে ওকে দেখে অবাক হয়ে গেল। নিজেদের বাড়ির মেয়েকেই যেন চেনা যাচ্ছে না। অতি সাধারণ থেকে রাজেন্দ্রানী। শুঁয়োপোকার খোলস ত্যাগ করে যেমন পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতির আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু এই নতুন ডানা নিয়ে কতদিন সে উড়তে পারবে, সেটা তখনও সকলের অজানাই ছিল।
শ্বশুরবাড়ি ফিরে আসতেই টিকিট কাটাই ছিল, সৌমেনের সঙ্গে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াবার জন্য বেরিয়ে পড়ল জুনি। মোট দুই মাসের টুর। দেখতে দেখতে দিনগুলো যেন পার হয়ে গেল। জুনির কাছে এটা রূপকথার সফর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ও আর সৌমেন। প্রথম মদ্যপান বিদেশেই। তখন ও বুঝতেও পারেনি এই আসক্তি ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে একদিন অভ্যাসে পরিণত হবে।
বাড়িতে ফিরে প্রথমেই খেয়াল করল, ওর বাড়ি থেকে আনা পুরোনো জামাকাপড় আর একটাও নেই। সবই আধুনিক পোশাকে বদলে ফেলা হয়েছে। শাশুড়ি একটা ফর্দ তৈরি করে জুনির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এ বাড়ির বউ, মেয়েের এগুলো শিখে রাখাটা অত্যন্ত জরুরি। আমি ব্যবস্থা করে দিয়েছি, কাল থেকেই শুরু করো।
অগত্যা দুই-তিন মাস ধরে চলল ড্রাইভিং, সুইমিং, ঘোড়ায় চড়া সবকিছু শেখার পালা। জন্মদিনে উপহার হিসেবে গাড়ি কিনে দিল সৌমেন। নিজে ড্রাইভ করে বাপের বাড়ি পেঁছোলে, জুনির মা-বাবা মেয়ের ভাগ্য দেখে, আনন্দে কেঁদেই ফেললেন।
স্বাভাবিক ভাবেই ভগবানের আশীর্বাদ বলেই মেনে নিলেন জুনির কপালকে। এত ভালো শ্বশুরবাড়ি আজকালকার দিনে ক’টা মেয়ের ভাগ্যে জোটে? বাড়ির বউকে এতটা স্বাধীনতা কে দেয়? সৌমেনের মা-বাবা মেয়েবউয়ের মধ্যে তফাত করতেন না। কিন্তু জুনির মনে হতো স্বাধীনতার উপর সকলের মৌলিক অধিকার রয়েছে। স্বাধীনতা দেওয়ার কী আছে? এটা আবার কেউ কাউকে দেয় নাকি? আধুনিক জীবন কাটাবার জন্য জুনির সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল ঠিকই কিন্তু কিছু শর্ত এবং নিয়মের গণ্ডিও মেনে চলতে হতো। মনে মনে নিজেকে পুরো স্বাধীন বলে ভাবতে পারত না জুনি। বিয়ের পাঁচ বছর পরে আজও পারে না। পার্লারে বেঞ্চটাতে শুয়ে ব্যঙ্গের হাসি ফুটে ওঠে জুনির ঠোঁটের কোণায়।
পার্লার থেকে বেরিয়ে রাস্তায় রোল কিনে খেতে ইচ্ছে করল। কিন্তু মনে পড়ল ডায়েটিশিয়ান এইসব ফাস্টফুড খেতে একেবারে বারণ করে দিয়েছেন।
বাড়ি ফিরে বিস্বাদ সেদ্ধ খাবার কোনও মতে গলা দিয়ে নামিয়ে নিজের ঘরে চলে এল জুনি একটু আরাম করতে।
সন্ধেবেলায় একটা সোশ্যাল ফাংশনে যাওয়ার কথা শাশুড়ির সঙ্গে। শাশুড়ির জন্য একটা বক্তৃতাও তৈরি করার কথা। সেটা করতে করতেই পাঁচটা বেজে গেল। ইচ্ছে করছিল একটু কফি খাবার। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই রান্নার ঠাকুর এসে এক গেলাস কিছু পানীয় ধরিয়ে দিল জুনির হাতে, এটা খেযে নাও দিদি। মা বলেছেন রাঙাআলু আর গাজরের রসটা বিকেলে চায়ের বদলে তোমাকে দিতে।
বাধ্য হয়ে ওষুধের মতো খেয়ে নিয়ে জুনি তৈরি হতে ঘরে চলে এল।
পেস্তা রঙের একটা জামদানি শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে পান্নার একটা হালকা সেট বেছে নিল। কপালে বড়ো একটা টিপ পরে, আয়নায় নিজেকে দেখে সন্তুষ্ট হল।
গাড়িতে বসে রাস্তায় যেতে যেতে বক্তৃতা পুরো পড়ে শাশুড়িকে বুঝিয়ে দিল।
ফাংশনে কিছু ভালো লাগছিল না জুনির। সে কলমের জোরে বক্তৃতাটা তৈরি করেছিল ঠিকই কিন্তু মনে মনে জানত মনের কথা কলম দিয়ে শুধু নয়, হৃদয় দিয়ে লিখতে হয়। বক্তৃতার বিষয়টা ছিল, আমার অধিকারের প্রাধান্য বেশি, নাকি পরিবারের প্রতি দায়িত্বের…
২
হনিমুন থেকে ফেরার পর জুনির শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছিল না। সৌমেনের, প্রেমে তখনও হাবুডাবু খাবার অবস্থা। জুনিকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল হতে দেয় না। এক প্রকার জোর করেই সৌমেন জুনিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ফ্যামিলি ডাক্তার, জুনিকে পরীক্ষা করেই বললেন, সৌমেন মিষ্টির ব্যবস্থা করো, নতুন সদস্য আসতে চলেছে।
লজ্জায় জুনির গাল লাল হয়ে উঠল কিন্তু সৌমেন খুব খুশি হয়েে বলে মনে হল না। গাড়িতে বসতেই বলল, ওষুধ যেটা দিয়েিলাম ঠিকমতো খাওনি নাকি?
জুনি ভেবে উত্তর দিল, মনে হয় যে রাতে তোমার সঙ্গে বসে হুইস্কি খেয়েছিলাম… একটু জোরেই বলে ওঠে সৌমেন, হাউ ক্যান ইউ বি সো ইরেসপন্সিবল?
জুনি চুপ হয়ে গিয়েছিল। পুরো রাস্তা আসতে আসতে ভাবছিল হয়তো সৌমেন নতুন দায়িত্ব নিতে ঘাবড়াচ্ছে। জুনিও মাতত্বের স্বাদ পেতে পাগল হয়ে উঠেছিল এমনটাও নয়। কিন্তু যে আসতে চলেছে তাকে অস্বীকার করার ইচ্ছে জুনির ছিল না।
বাড়ি ফিরে চায়ে চুমুক দিতে দিতে সৌমেন মা-কে সব কিছু খুলে বলতেই, জুনির মনে হল শাশুড়ির মুখে বিদ্রুপের ভাব ফুটে উঠল। তিনি ব্যঙ্গ করেই বললেন, মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েদের নিয়ে এই এক মুশকিল। অবশ্য এদের কাছ থেকে কী-ই বা আশা করা যায়। বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই ছেলেপুলের মা হয়ে বসা।
জুনির চোখে জল চলে এল। সৌমেন সেটা উপেক্ষা করেই বলল, বাচ্চা নেব কি নেব না, সেটা আমাদের দুজনেরই সম্মতিতে হওয়া উচিত। আমার অজান্তেই এতসব ঘটেছে এটা সত্যিই দুঃখের। কিন্তু এই দায়িত্ব নিতে আমি এখন তৈরি নই। এখন তো সবে জীবন শুরু করেছি।
অ্যাবর্শন-এর ঘটনাই প্রথম জুনির চোখ খুলে দিল। ও বুঝতে পারল ডানা তাকে দেওয়া হয়েে ঠিকই কিন্তু কতটা সে উড়বে সেটার রিমোট কন্ট্রোল তার শ্বশুরবাড়ির হাতে রয়েছে।
নার্সিংহোমে সবকিছুই ঠিক ভাবে হয়ে গেল। শরীরে কোনও ব্যথাই বোধ করল না জুনি। কিন্তু মনের ভিতরের ক্ষতটা দগদগে হয়ে উঠল। কেউ জানল না জুনির যন্ত্রণার কথা। ও কাকেই বা বলবে? এই ভাবে প্রথম ঘটনা, দ্বিতীয় ঘটনা, ঘটনাগুলো ভিড় করতে শুরু করল জুনির মনে। রোজই নতুন নতুন রং ঢেলে সাজানো হতো জুনির পাখা দুটোতে কিন্তু কেউই একবারের জন্যও জুনিকে জিজ্ঞেস করত না, রংগুলো আদৌ তার পছন্দ কিনা।
অথচ সবার চোখে জুনির মতো ভাগ্যবতী অন্য কোনও মেয়ে নজরে আসত না। সবার শ্বশুরবাড়িতেই নানা রকমের নিষেধ মানামানির ব্যাপার থাকে। অথচ জুনির কাছে আধুনিক পোশাক থেকে শুরু করে দেশবিদেশ ঘোরা, নিজের পছন্দ মতন কাজ করা, দামি পার্লারে গিয়ে রূপচর্চা করানো এত স্বাধীনতা কোন শ্বশুরবাড়ি থেকে দেয়? জুনির এই সুখ সকলের মনে ঈর্ষাই জাগাত।
৩
বাপের বড়ি যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল জুনি। হালকা নীল রঙের চিকন কাজের সুতির সালোয়ার কামিজ পরেছিল সে। গলায় পাতলা একটা সোনার চেন আর হাতে দুটো করে সোনার চুড়ি। তৈরি হয়ে ঘরের বাইরে আসতেই মুখোমুখি হতে হল সৌমেন আর শ্বশুরমশাইযে।
একী জুনি! এই পোশাকে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ? ভালো শাড়ি কি নেই? হতভম্ব হয়ে জুনিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন শ্বশুরমশাই।
সৌমেনও বাবার সঙ্গে গলা মেলাল, বাবা ঠিকই বলেছে। ভদ্র পোশাকে যাও, এটা পরার মতো পোশাক হল? বম্বের কলানিকেতন থেকে যে-শাড়িটা কিনে দিয়েিলাম সেই সিল্কটা পরে যাও। যাও চেঞ্জ করে এসো।
কলের পুতুলের মতো জুনি আবার নিজের ঘরে চলে এল। সৌমেনের দেওয়া প্রত্যেকটা শাড়ি যেমন দামি তেমনি সুন্দর। কিন্তু জুনি কাউকে এটা বোঝাতে পারে না, এত দামি শাড়ি আর দামি দামি গয়না ওর আর বাপের বাড়ির সকলের মধ্যে একটা দেয়াল তুলে দেয়। ওর এই দামি শাড়ি, গয়না দেখে তাদের মনে একটা হীনম্মন্যতা জন্ম নেয়। প্রাণখুলে কেউই তেমন আর কোনও কথা বলতে পারে না।
গলির মুখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে জুনি পা টিপে টিপে বাড়ির ভেতর ঢোকে। জুনির মা ঠিকই টের পান মেয়ে আসা, কী রে জুনি, তুই এলি?
জুনি আবার সেই পুরোনো জুনি হয়ে ওঠে, উফ মা তুমি কী করে বুঝতে পারো বলো তো?
রান্নাঘরে এসে ঢোকে জুনি। মা রান্নায় ব্যস্ত। হাত ধুযে একটা প্লেট নিযে রান্না করে রাখা ছানার কোফতা তুলে খেতে শুরু করে দেয়।
জুনি, সাবধানে খা। এত দামি শাড়ি, একটু ঝোল পড়লেই শাড়িটা খারাপ হয়ে যাবে, মা সাবধান করলেন জুনিকে।
মা আর জুনির গলার আওয়াজ পেযে আরও দুই বোন এসে রান্নাঘরে ঢুকল। দিদি ফোড়ন কাটল, সেই ভালো জুনি, তুই ডাইনিং টেবিলে বসে কাঁটা-চামচ দিয়ে বরং খা। মা আমরা তো আছি বাসন ধুযে রান্নাঘর পরিষ্কার করার জন্য।
ছোটোবোন বলল, দি, তোকে কী দিই বলতো পা রাখার জন্য? তোর মাটিতে পা একেবারে মানায় না।
জুনি ওদের বক্রোক্তি গায়ে মাখল না। প্লেট-টা ধুযে বলল, চল, বাচ্চাগুলোর জন্য খেলনা নিযে এসেছি, দিয়ে দিই।
বিদেশ থেকে আনা খেলনাগুলো দুই বোনের ছেলেমেয়েের মধ্যে ভাগ করে দিল জুনি। ছোটো বোন হেসে বলল, দি, এত দামি দামি খেলনা প্লিজ আনিস না। খারাপ হয়ে গেলে আমরা ঠিকও তো করতে পারব না।
জুনি কী করে বলবে, সৌমেনের পছন্দ করা এসব খেলনা। জুনির কথা ওখানে কে শুনবে?
খেতে বসে মায়ের হাতের কচু শাক, লাউয়ে ঘন্ট, ছানার কোফতার ডালনা আর মাংস গোগ্রাসে জুনিকে খেতে দেখে মা হেসে ফেললেন। বললেন, কী রে শ্বশুরবাড়িতে খেতে দেয় না বুঝি? দেশবিদেশের কত রকমের খাবার খেযে বেড়াস। ওগুলো খেয়ে তোর মন ভরে না বুঝতে পারছি।
রাতটা মায়ের কাছে কাটাবারই কথা বলে এসেছিল জুনি। কিন্তু ঠিক সন্ধেবেলায় সৌমেনের ফোন এল, বড়ো পিসিমা হঠাত্ এসেছেন, তোমাকে বাড়ি চলে আসতে হবে। আমি ড্রাইভার পাঠিয়ে দিচ্ছি। ফোন রেখে দিল সৌমেন।
ড্রাইভার এসে বেল দিতেই জুনি দরজা খুলে দিল। ড্রাইভারের হাত দিয়ে শাশুড়ি সবার জন্য জামাকাপড় আর প্রচুর মিষ্টি পাঠিয়েছেন দেখল জুনি। বোনেদের হাতে উপহারগুলো তুলে দিতে দিতে জুনি স্পষ্ট বুঝতে পারল আনন্দে, লোভে ওদের চোখ চকচক করছে। জুনির ঠোঁটের মলিন একটুকরো হাসিটা সকলের চোখ এড়িয়ে গেল। মা কিছুটা ধরতে পারলেন ঠিকই, ইচ্ছে হল মেয়ে গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করেন, হ্যাঁ রে তুই ভালো আছিস তো জুনি? কিন্তু পরক্ষণেই দামি শাড়ি, জামাকাপড়, মিষ্টির মোহ তাঁরও চোখকে পর্দার আস্তরণে ঢেকে দিল।
জুনি ভালো মতোই জানত সৌমেন আর ওর মা-বাবা কিছুতেই ওকে বাপের বাড়িতে রাত্রিবাস করতে দেবে না।
বাড়ি ঢুকতেই শাশুড়ি জড়িয়ে ধরলেন জুনিকে, সৌমেনের পিসিমা তোমাকে দেখবেন বলে একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছেন। তাড়াতাড়ি শাড়ি বদলে বসবার ঘরে এসো।
জুনি আবার শাড়ি বদলে বসবার ঘরে ঢুকে পিসিমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। জুনির মাথা থেকে পা অবধি পর্যবেক্ষণ করলেন পিসিমা, ভালো খবরটা কবে দিচ্ছ? খাওয়াদাওয়া করো ঠিকমতন?
সোফায় এসে বসল জুনি। এবার পিসিমা এসে পাশে বসে হাত দিয়ে জুনির মুখটা তুলে ধরলেন, বললেন, বাঃ শ্বশুরবাড়ির রং তো দেখছি ভালোই লেগেছে তোমার গায়ে এখানকার সুখসুবিধে পেয়ে কেমন লাগছে তোমার?
চুপচাপ বসে রইল। কী উত্তর দেবে বুঝে ঠিক করতে পারল না জুনি।
রাতে মদ্যপান করতে করতে সময়ে খেয়াল ছিল না জুনির। চোখ বুজে আসছিল। গেলাস ভর্তি এই পানীয়টাই একমাত্র ওকে শান্তি দিতে পারে। আলাদা জগতে বিচরণ করতে পারে, যেখানে সে ছাড়া আর কেউ থাকে না। নিজের ইচ্ছেমতন যা খুশি করতে পারে।
সকালে যখন ঘুম ভাঙল জুনির তখন বাইরে রোদ ঝলমল করছে। সৌমেন অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছিল। জুনিকে দেখে বলল, এত কেন খাও যখন ওটা তোমার সহ্য হয় না?
মৃদু হাসল জুনি, তাহলে পান করার কী অর্থ নেশাই যদি না হল তো…
৪
একাকিত্ব আর শূন্যতা ধীরে ধীরে জুনিকে গ্রাস করতে আরম্ভ করল। কিন্তু বাইরে থেকে কেউই সেটা বুঝতে পারল না। সে নিজের মতো করে জীবনটাকে বোঝার চেষ্টা করছিল কিন্তু সেটা কারওরই বোধগম্য হচ্ছিল না।
একদিন জুনি সৌমেনকে বলল, আমিও তোমার সঙ্গে অফিস যেতে চাই। সৌমেন খুশিই হল। ও রাজি হয়ে গেল। জুনি রোজ সৌমেনের সঙ্গে অফিস যেতে আরম্ভ করল। কিন্তু ওখানেও তার বিশেষ কিছুই করার ছিল না। দাবার ঘুঁটির মতো জুনির অবস্থা। এক কথায় বলতে গেলে সবকিছুই তার কিন্তু কোনও কিছুই যেন তার নিয়ন্ত্রণে নয়।
মরুভমির মতো হয়ে উঠল জুনির জীবনটা। জায়গায় জায়গায় মরীচিকা দেখা গেলেও জল কোথাও নেই সুতরাং তেষ্টা মিটবে কী করে? কয়েক মাস পরে নিজেই অফিস যাওয়া ছেড়ে দিল। অফিসে ওর পরিচিতি বলতে একটাই ছিল, সৌমেনের ওয়াইফ।
সৌমেনের কাকার ছেলের বিয়েতে বাড়িশুদ্ধু সবাই উপস্থিত ছিল। ককটেল পার্টি চলছিল। লাল রঙের অফ শোল্ডার গাউন আর রুবির গয়নার সেট-টায় অপরূপা হয়ে উঠেছিল জুনি। হালকা মিউজিকের সঙ্গে সকলেই ডান্স করছিল। কারও কারও হাতে গেলাস। দুটো পেগ আগেই খাওয়া হয়ে গিয়েিল জুনির। সৌমেনকে জড়িয়ে ধরল সে। কানের কাছে মুখ নিযে এসে বলল, সৌমেন আমি উড়তে চাই, আমাকে খাঁচায় বন্ধ করতে চেও না। আমি একটা সাধারণ মেয়ে আমাকে অসাধারণ করে তোলার জেদ ছেড়ে দাও।
কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই সৌমেন খেয়াল করল ডান্স ফ্লোরে প্রায় সকলেরই চোখ ওদের উপর। জুনি কথাগুলো আস্তে বলতে চাইলেও আশেপাশে সকলের কানেই পেঁছেছে কথাগুলো। আরও কিছু না বলে বসে, এই ভয়ে সৌমেন ওর হাত ধরে একটু জোর করেই বাইরে এনে গাড়িতে তুলে দেয়। তারপর সোজা ড্রাইভ করে বাড়ি চলে আসে। সারারাত সৌমেনের ঘুম আসে না। কেন জুনি এরকম বলল? কী অভাব রেখেছে সৌমেন? কোথায় ভুল করে বসল সে? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতে লাগল বারবার সৌমেন।
সকালে জুনি ঘুম থেকে উঠতেই সৌমেন জিজ্ঞাসা করল, তুমি সত্যি করে কী চাও জুনি? সবাই তোমার মতো জীবন পেতে চায় অথচ তোমার কাছে এরকম জীবনের কোনও কদরই নেই।
কী উত্তর দেবে জুনি? শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জানলার বাইরে। মনের মধ্যে তোলপাড় হতে থাকল, সত্যিই কি বাস্তবে জুনি এমনটাই চেয়েছিল?
সোশ্যাল ফাংশন অ্যাটেন্ড করা, এলিট ক্লাবের মেম্বার হয়ে সৌমেনের সঙ্গে পার্টি অ্যাটেন্ড করতে যাওয়া, কোনও অনুষ্ঠানে অতিথির আসন অলংকৃত করতে শাশুড়ির সঙ্গে সেখানে গিয়ে বসে থাকা, পার্লার যাওয়া নয়তো শপিং আর নয়তো বাড়িতে চুপচাপ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা। এটাই জীবন হয়ে উঠেছিল জুনির। জীবনের সব রং হারিয়ে গিয়েছিল তার জীবন থেকে।
তখনই একদিন খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ে। স্থানীয় কলেজে লেকচারারের পোস্ট। ইতিহাসের লেকচারার চাইছে। যে-বিষয়ে ও নিজে পড়াশোনা করেছে। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই আবেদন পাঠাল। সাক্ষাত্কারও চুপচাপ দিয়ে এল। জয়েনিং লেটার হাতে পেয়ে সৌমেনকে জানাল। সৌমেন বাড়ির সবাইকে।
রাতদিন হাজার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো জুনিকে।
কী দরকার ছিল এরকম চাকরি নেওয়ার। পদে পদে, যেখানে ধাক্কা খেতে হবে?
যা রোজগার হবে তার থেকে বেশি টাকা পেট্রোলেই চলে যাবে?
রোদে বৃষ্টিতে সেই দৌড়ঝাঁপ করতে হবে, তখনই বুঝতে পারবে কত ধানে কত চাল। চাকরি করার যখন এতই শখ নিজেই যাওয়া আসা করবে আর নিজের খরচ নিজেই চালাবে।
এরকম হাজারো শব্দবাণ রোজ জুনির উপর বর্ষাতে আরম্ভ করল বাড়িতে। আর চুপচাপ মুখ বুঝে সব সহ্য করতে থাকল জুনি। ভুল তো করেছিল প্রথম থেকেই। ওড়বার জন্য দুটো ডানার রিমোট কন্ট্রোলটা স্বামী আর শ্বশুর-শাশুড়িকে দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু আর নয়। নিজের উড়ান এবার সে নিজেই ঠিক করবে। মুখ থুবড়ে পড়লেও আবার উঠে দাঁড়াবে। জীবনের রামধনু রং-কে নিজের চোখে পরখ করতে উতলা হয়ে উঠেছিল জুনি।
পার্লার থেকে বেরোতে বেরোতে জুনি ভাবছিল, রাস্তা যখন আমার তখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও আমার। আমার ছোটো ছোটো স্বপ্নপূরণ করাটাই আমার মনের একান্ত ইচ্ছা। এটাই আজ থেকে সত্যি আমার জীবনে। নিজের মনের ভেঙে পড়া ডানা দুটোকে আবার জোড়া লাগাতে তত্পর হয়ে উঠল জুনি। এখনও অনেকটা পথ যাওয়া বাকি!