পর্ব – ৩

ঘটনার তিন দিন পর রণিদা মোবাইলে জানাল, আজ বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমার বাড়ি চলে আসিস, তোকে নিয়ে বেরোব একটু।

কোথায় যাবে রণিদা?

কেন তদন্তে, ওদিকটা এই ক’দিনে কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে নিশ্চয়ই, জবাব দিল ও।

তা হলে কি আমরা মণ্ডলবাবুর বাড়িই যাচ্ছি প্রথমে?

উঁহু, হল না। ঠিক প্রথমেই নয়, ভাবছি যাব একটু ঘুর পথে। প্রথমে আমরা যাব সুবিমল সোমের বাড়ি। তুই আয়, তারপর কথা হবে।

এক মিনিট রণিদা, ঢোলগোবিন্দবাবুকেও নিচ্ছো নিশ্চয়ই? তা না হলে উনি আবার আগের মতন বলবেন, আরে ভায়া, তোমরা আমাকে অর্ধেক জায়গায় নিয়েই যাও না, আমি আর কী তোমাদের ইনভেস্টিগেশনে সাহায্য করব? মনে আছে তোমার, সেইবার কিরিবুরুর গুহাদানবের কেস-এ?

তা যা বলেছিস, রণিদার গলায় মজা টের পেলাম, তা হলে ওনাকেও আসতে বলছি বিকালে।

সোয়া পাঁচটা নাগাদ গাড়ি ছাড়ল আমাদের।

ঠাকুরপুকুর থেকে দুই নম্বর চেতলা হাট রোড পৌঁছোতে মিনিট পঁচিশেক লাগাল।

বাড়ি খুঁজে পেতে দেরি হল না। পাশেই একটা ক্লাব– চেতলা যুব সংঘ। ক্লাবের সামনে ছেলেদের জটলা। জিজ্ঞাসা করতেই আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল সুবিমল সোমের বাড়িখানা।

ঢোলগোবিন্দবাবু বললেন, কলকাতার এই একটা বিষয় লক্ষ্য করবার মতন। মানুষকে ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলে ধৈর্য ধরে শুনবে, তারপর সঠিক জায়গা দেখিয়ে দেবে। প্রয়োজনে অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করে হলেও তোমাকে সাহায্য করবে। রাস্তার ঘোরপ্যাঁচ থাকলে অনেককে দেখেছি নিজে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দিয়ে আসে। কিন্তু দিল্লি বা মুম্বইতে কাউকে ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলে দেখবে ওরা ধরাবাঁধা তিনটে কথাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছে।

কী বলে ওরা? আগ্রহ বাড়ে আমার। দেখলাম রণিদার চোখে মুখেও জানবার ইচ্ছা।

ব্যাটারা হয় বলে, মুঝে মালুম নেহী, না হয় বলে, মুঝে পাতা নেহী, আর একটু বেশি চালাক হলে বলে, পুঁছকর বাতায়েঙ্গে। হতভাগারা কবে কাকে পুঁছবে, আর চলমান পথিককে কবে কীভাবে বাতাবে কে জানে?

গাড়ি থেকে নেমে এসে রাস্তার ওপর একটা দোতলা বাড়ির দরজার গায়ে লাগানো কলিং বেল টিপলাম আমি।

কিছুক্ষণ নীরবতা।

তারপর স্লিপারের চটাস চটাস শব্দ সিঁড়ি ভেঙে নেমে এল নীচে। মনে হল দরজার আই-হোল দিয়ে কেউ চেনার চেষ্টা করছে আমাদের। একটা কণ্ঠস্বর জেগে উঠল, কে-এ-এ?

মি. সুবিমল সোম আছেন? আমরা ওনার পরিচিত।

দরজা খুলে গেল। আমাদের সামনে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক বললেন, আপনারা কোত্থেকে আসছেন?

ঠাকুরপুকুর থেকে, রণিদাই জবাব দিল, ওনাকে একটু বলুন, রণজয় চক্রবর্তী দেখা করতে এসেছেন।

ভদ্রলোক আমাদের তিনজনকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন, তারপর বললেন, একটু দাঁড়ান।

দরজা আধ-খোলা অবস্থায় রেখে উনি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেলেন।

মিনিটখানেকের পর ওই পথে নেমে এলেন সুবিমল সোম। বললেন, কিছু মনে করবেন না। দাদা ঠিক আপনাদের চিনতে পারেননি। আসুন, আসুন আপনারা।

পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি হাতে জ্বলন্ত সিগারেট–সুবিমল সোমকে অনুসরণ করে দোতালায় একটি বেশ বড়োসড়ো ড্রয়িং-রুমে পৌঁছোলাম আমরা।

বসুন আপনারা, আমি এক্ষুনি আসছি, ভদ্রলোক ভেতরে গেলেন।

আমরা সোফায় বসলাম। টেবিল, চেয়ার, দেয়ালের গায়ে কাঠের আলমারি, টিভি ট্রলিতে টিভি– যেখানে যেমনটি দরকার একদম সাজানো। একদিকের দেয়ালে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ ও সুভাষচন্দ্র। ঠিক তার উল্টোদিকের দেয়ালের জানলার পাশে গত বছরের একটি বাংলা ক্যালেন্ডার।

একবার রণিদার দিকে তাকালাম, দেখলাম স্বভাববশত ওরও চোখ ঘুরছে। ঢোলগোবিন্দবাবুর ভাবটা এমন, যেন দারুণ কোনও রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন উনি।

মিনিট দুয়েক পর সুবিমল সোম ফিরে এলেন ঘরে। আর ঠিক তার পিছন পিছন ট্রেতে কাচের গেলাসে জল নিয়ে বেয়ারা।

আমরা প্রত্যেকে একটি করে গেলাস তুলে নিলাম। সেন্টার টেবিলে ট্রে নামিয়ে রেখে ফিরে গেল বেয়ারা।

সুবিমলবাবু ওকে বললেন, রামু চা-টা একটু দেখ।

রণিদা বলল, আপনি ও নিয়ে ব্যস্ত হবেন না প্লিজ।

কেসটা তা হলে আপনি নিলেন? হেসে বললেন ভদ্রলোক।

নিলাম। একরকম বাধ্য হয়েই বলতে পারেন, জবাব দিল রণিদা, কেমন একটি অপরাধবোধ জাগছে ভেতর থেকে।

কিন্তু এ রকম একটি অবস্থায় আপনাকে পেমেন্টটা কে করবে বুঝতে পারছি না, মানে ঘনশ্যাম তো আর বেঁচে নেই।

ও নিয়ে আপনি ভাববেন না সুবিমলবাবু। ঈশ্বরের আশীর্বাদে টাকা-পয়সার খুব একটি টানাটানি আমার নেই। তদন্তটা আমার নেশা, পেশা নয়। আপনি ঘনশ্যামবাবুর বন্ধু, খুব কাছেরই বন্ধু সম্ভবত। অনুগ্রহপূর্বক এই কেসে আমাকে যদি একটু সহযোগিতা করেন তো উপকার হয়।

অবশ্যই, অবশ্যই। আমি আমার সাধ্যমতন আপনাকে সব ব্যাপারে সহযোগিতা করব। বলুন কী জানতে চান?

ঘনশ্যামবাবুকে আপনি কতদিন ধরে চেনেন?

একচুয়ালি ঘনা, আমি আর কমলেশ স্কুল বয়সের বন্ধু, ওর এভাবে চলে যাওয়াটা বরদাস্ত করা কঠিন।

আপনি নিশ্চয়ই চান ঘনশ্যাম মণ্ডলের খুনি ধরা পড়ুক?

অতি অবশ্যই, বেশ জোর দিয়ে বলেন ভদ্রলোক।

তা হলে দয়া করে আমার প্রশ্নগুলির ঠিক ঠিক জবাব দিন। কোনও তথ্য তা যতই অপ্রিয় হোক, লুকোবার চেষ্টা করবেন না।

না, না লুকোব কেন? বলুন না কী জানতে চান?

কেমন মানুষ ছিলেন ঘনশ্যামবাবু?

মানুষ হিসাবে তো ভালোই, তা নাহলে এতকাল আর বন্ধুত্ব টিকে থাকবেই বা কেন? তবে…

তবে কী?

দেখুন ও আজ আমাদের মধ্যে নেই, এসব কথা বলা এখন ঠিক হবে?

সব রকম আবেগের ঊর্দ্ধে দাঁড়িয়ে বিচার-বিবেচনা করার সময় এখন, কণ্ঠস্বর দৃঢ় শোনায় রণিদার।।

টাকা-পয়সার প্রতি ওর আকর্ষণ একটু বেশি ছিল, মৃদুস্বরে বলেন ভদ্রলোক।

এ কথা কেন বলছেন?

এমন সময় বেয়ারা চা আর কিছু স্ন্যাক্স নিয়ে ঘরে ঢুকল এবং সেন্টার টেবিলে রাখল।

নিন, চা নিন, বললেন সুবিমলবাবু।

আমরা প্রত্যেকেই কাপ প্লেট তুলে নিলাম হাতে। ঢোলগোবিন্দবাবুকে বেশ উৎফুল্ল দেখাল। উনি চায়ের পাশাপাশি

টা-য়ের দিকেও হাত বাড়ালেন।

চা খেতে খেতে সুবিমলবাবু জবাব দিলেন, বরাবরই এ কথাটা মনে হয়েছে আমার।

কিন্তু কেন? দেয়ার মাস্ট বি সাম রিজন?

সব সময়ই ও চাইত চাকরি ছাড়াও অন্য কোনওভাবে যদি ইনকাম আরও কিছুটা বাড়ানো যায়।

সৎ বা অসৎ– যে কোনও উপায়েই, তাই তো?

না, না অসৎ কোনও পথে ও কোনওদিন সে চেষ্টা করেছে বলে আমি শুনিনি, জবাব দিলেন সুবিমলবাবু।

দেখুন একজন মানুষ তার আর্থিক উন্নতির চেষ্টা করবেন, গুড থেকে বেটার পজিশনে যেতে চাইবেন–ব্যাপারটা কি খুব দোষের?

দোষের কথা বলছি না, বলছি যে টাকার প্রতি ওর আসক্তিটা একটু বেশি বলেই চিরদিন মনে হয়েছে আমার।

আপনি কী করেন? ইচ্ছে করেই প্রসঙ্গ পালটায় রণিদা।

তেমন কিছু না। আপনাকে বলেছি বোধ হয়, ব্যাংকে চাকরি করতাম। শরীর পারমিট করল না। ভিআরএস. নিলাম। নীচে দুটো দোকান আছে। একটি ভাড়া দিয়েছি। অন্যটা নিজেই চালাই। একটি ছেলে আছে দেখভালের জন্য। সময় কেটে যায়–এই আর কী।

ছেলেমেয়ে ?

মেয়ে নেই, ছেলে একটিই। খড়্গপুর আইআইটি-তে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।

বড্ড সিগারেট খান আপনি।

ওই একটি জায়গায় আমাদের তিন বন্ধুতে ভীষণ মিল।

কিন্তু ঘনশ্যামবাবুকে তো সেদিন আমাদের বাড়ি সিগারেট খেতে দেখলাম না?

বোধহয় খুব ঘাবড়ে গেছিল। ওকে তো বছর দুয়েক আগে ডাক্তার স্মোকিং পুরোপুরি ছেড়ে দিতে বলেছিল। ডাক্তারের ধমকে কাজও হয়েছিল। হপ্তাখানেক বন্ধ ছিল কিন্তু তারপর আচমকাই ফের স্মোকিং ধরেছিল দ্বিগুন উৎসাহে। আমি আর কমলেশ অবশ্য মাঝে কোনও গ্যাপ দিইনি, হেসে বলে ভদ্রলোক।

সেদিন ঘনশ্যামবাবুর ভায়ের নামটা জানা হয়নি।

রাধেশ্যাম মণ্ডল।

উনি এখন কোথায় ?

বলতে পারব না। মাঝে মধ্যেই উধাও হয়ে যায়। ফিরে আসে আবার। এবার দুই ভাইয়ে সম্পত্তির ভাগ নিয়ে নাকি তুমুল ঝগড়া হয়েছিল। যাবার আগে শাসিয়েছিল দাদাকে, দেখে নেবে বলে।

রোজগারপাতি?

সে ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানি না। ওদের বাবা বেঁচে থাকতে ওনার কাছ থেকেই টাকাপয়সা কিছু কিছু নিত। তা নিয়ে অশান্তির শেষ না ছিল বাড়িতে। নেশা-ভাঙ করত। পাড়ার রেপুটেশনও ভালো নয়।

গুন্ডা-মাস্তানি করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার মারধোর খেয়েছে বলে শুনেছি। পুলিশের খাতায় নাম আছে কিনা বলতে পারব না।

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি, বলল রণিদা, আপনার বন্ধু কমলেশ লোকটি কেমন?

কেন, ভালোই। ও খুব খেতে ভালোবাসে জানেন? আর লোকজনকে খাওয়াতেও ভালোবাসে। চেহারাখানা দেখেছেন তো!

কী করেন ভদ্রলোক?

ব্যবসা।

কীসের ব্যবসা?

জমির দালালি, গাড়ির দালালি, প্রমোটিং ইত্যাদি। তাছাড়া ওর একটি স্টেডি ইনকাম আছে বাড়ি ভাড়া থেকে।

বাঃ, তাহলে তো ভদ্রলোক বেশ সলভেন্ট বলতে হয়।

তা বলতে পারেন। তা ছাড়া ও খুব শৌখিন, বিশেষ করে গাড়ির ব্যাপারে।

তার মানে?

ওর একটি বদ খেয়াল হল কোনও গাড়িই ও বেশিদিন চড়ে না। বড়ো জোর ছমাস। তারপর ওটা বেচে আর একটি কেনে।

ইন্টারেস্টিং, এতক্ষণে মুখ খুললেন ঢোলগোবিন্দবাবু।

আমারও সে রকমই মনে হচ্ছে, বলল রণিদা, ঠিক আছে আজকের মতন আমরা আসি। হয়তো তদন্তের স্বার্থে আপনার কাছে আবার আসতে হতে পরে।

স্বচ্ছন্দে, হেসে জবাব দিলেন সুবিমলবাবু।

উঠে আসতে আসতে রণিদা হঠাৎ ফিরে বলল, আর একটি কথা সুবিমলবাবু–

হ্যাঁ বলুন।

আপনাদের তিন বন্ধুতে কখনও কোনও মনোমালিন্য হয়নি? বিশেষ করে ঘনশ্যামবাবুর মৃত্যুর কয়েকদিন আগে। ভেবে বলুন।

খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে উনি বললেন, এত দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্বে সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি, মান-অভিমান, কিংবা কথা কাটাকাটি হয়ে থাকতেই পারে। তবে সে সবের ঊর্দ্ধে আমরা পরস্পরের বন্ধুই ছিলাম বরাবর। তবে…

কী একটি কথা মনে পড়ায় ভদ্রলোক একটু থেমে যান।

রণিদার দৃষ্টি তীক্ষ্ন হল, তবে কী সুবিমলবাবু?

হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়ছে–আপনাদের বাড়িতে যেদিন প্রথম–আমরা দেখা করতে যাই কেসটা নিয়ে তার ঠিক দিন দুই পর, কোনও বিশেষ কারণে ঘনশ্যামের সঙ্গে কমলেশের কী নিয়ে যেন একটু তর্কাতর্কি শুনেছিলাম। মনে পড়ছে। আমি এসে পড়ায় ওরা হঠাৎ থেমে গেছিল। মনে হয়েছিল, বিষয়টা এমন কিছু যা ওরা আমাকে জানতে দিতে চায় না। আমিও আর উৎসাহ দেখাইনি ও নিয়ে।

ওদের কথাবার্তার কোনও সংলাপ মনে করতে পারেন? বিষয়টা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

রণিদার কথায় সুবিমলবাবু বেশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন বলে মনে হল।

খানিক চিন্তা করে বললেন, যতদূর মনে পড়ে, ঘনা সামান্য উত্তেজিত কণ্ঠে বলছিল, ‘চুক্তি অনুসারে ওর অর্ধেক আমার।’

‘অর্ধেক আমার!’ রণিদা বিড়বিড় করে বলে কথাগুলি। তারপর প্রশ্ন করে, আর কিছু?

নাহ্, আর কিছু আমি শুনিনি।

ওকে, থ্যাংক ইয়ু ফর ইয়োর কাইন্ড অ্যাসিসটেন্স। একটি অনুরোধ, আপনার সঙ্গে যা কথাবার্তা হল গোপন রাখবেন। অন্তত মৃত বন্ধুর মঙ্গলের কথা চিন্তা করে। বাই, আবার দেখা হবে।

আমরা উঠে পড়লাম।

বাই, চলুন আপনাদের এগিয়ে দিই, বলে সুবিমলবাবু আমাদের সঙ্গে উঠে এলেন।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম আমরা। দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানালেন ভদ্রলোক।

রাস্তা ক্রস করে ওপারে রাখা গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম।

রণিদা বলল, এবার কমলেশবাবুর বাড়ি যেতে হবে।

পর্ব – ৪

গাড়ি স্টার্ট দিতেই রণিদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কমলেশ খাস্তগীরের বাড়িটা কোথায়?

ফিফটি সিক্স প্রতাপাদিত্য রোড।

তাহলে তো কাছেই।

হ্যাঁ, আর ভিক্টিম ঘনশ্যাম মণ্ডলের বাড়িটা কোথায় জানিস নিশ্চয়?

কী করে জানব? সেদিন কার্ডখানা একবার দেখে নিয়েই তো নিজের পকেটে ফেললে।

রণিদা একটু হেসে বলল, তাই বুঝি? কিন্তু গোয়েন্দার সঙ্গে তার সহকর্মীদেরও সিক্সথ সেন্স থাকে বলে কোথায় যেন পড়েছিলাম।

আমি বললাম, তা হলে সেই সিক্সথ সেন্স এর নির্দেশ মতন বলছি, ঘনশ্যাম মণ্ডলের বাড়ি এই…

কালিঘাট এলাকাতেই, কথাটা আমার মুখ থেকে কেড়ে সম্পূর্ণ করলেন ঢোলগোবিন্দবাবু।

এই তো চাই, সোৎসাহে বলে উঠল রণিদা, কিন্তু এবার কথা থামানো যাক, কারণ মনে হচ্ছে আমরা প্রতাপাদিত্য রোডের ফিফটি সিক্স… ফি-ফ-টি… সিক্স–হ্যাঁ পেয়ে গেছি।।

গাড়ি থামিয়ে রাস্তার এক পাশে পার্ক করল রণিদা।

আমি আর ঢোলগোবিন্দবাবু গাড়ি থেকে নেমে ওকে অনুসরণ করলাম। এলাকাটা বেশ শান্ত মনে হল। কাউকে জিজ্ঞাসা করতে হল না। রাস্তার ওপর বিশাল বাড়ি। বাড়ির গায়ে নম্বর লেখা।

আজ ঢোলগোবিন্দবাবুর মাথায় চমৎকার একটি সাহেবে গলফ হ্যাট। সেটা খানিকটা নীচু করে নিলেন উনি ডান হাতে। তারপর গটমট করে হেঁটে এগিয়ে গেলেন এবং বাড়ির নাম্বার মিলিয়ে সর্বাগ্রে উনিই কলিং বেল পুশ করলেন।

কক-কক-কক-কক-কক-কক, মুরগি ডেকে উঠল ঘরের ভিতরে। স্পষ্ট কানে এল আমাদের।

দরজা খুললেন স্বয়ং কমলেশ খাস্তগীর। পরনে সাদা

পাজামা-পাঞ্জাবি, হাতে মোবাইল।

আমাদের দেখে মুহূর্তে ক্ষণিকের জন্য ভ্রূজোড়া কুঞ্চিত হয়েই স্বাভাবিক হল ফের। আনন্দে ফেটে পড়লেন ভদ্রলোক, আরে আসুন, আসুন স্যার। কী সৗভাগ্য আমার। গরিবের কুটিরে পদধূলি দিন।

কমলেশবাবুকে নমস্কার জানিয়ে ওনার পিছু পিছু এগিয়ে গেলাম আমরা।

গ্রাউন্ড ফ্লোরেই বসার ঘরে উনি নিয়ে গেলেন আমাদের। তারপর হাতের ইঙ্গিতে বসতে বললেন।

আমরা ধন্যবাদ জানিয়ে বসতেই কণ্ঠস্বরে উচ্চতা বাড়ল ওনার, এই কে আছিস…

যেমন বপু তেমনই আওয়াজ। প্রায় দৌড়ে এল এক চাকর, বাবু ডাকছেন?

হ্যাঁ গিন্নিমাকে গিয়ে বল, বাবুর কয়েকজন বন্ধু এসেছেন।

কমলেশবাবুর চোখের ইঙ্গিতে অভিজ্ঞ চাকরের সম্ভবত বুঝে নিতে দেরি হল না, ক’জন এসেছে সেটা দেখে যেতে। চাকরটি দ্রুত ভেতরে চলে গেল।

ভদ্রলোক আমাদের সামনের সোফায় বসলেন। তারপর কী মনে হতে উঠে গিয়ে টেবিলের ড্রয়ার টেনে একটি ক্ল্যাসিকের প্যাকেট ম্যাচ সহ এগিয়ে দিলেন রণিদার দিকে। মুখে বললেন, প্লিজ।

থ্যাংকস জানিয়ে রণিদা ও দুটো হাতে তুলে নিল। সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে জ্বালাতে জ্বালাতে বলল, আপনার বুঝি এ ব্র্যান্ড চলে না?

নাহ্, চারমিনারের নেশা আমার ছোটোবেলার। ভদ্রলোকে নিজের প্যাকেট থেকে একটি জ্বালালেন।

রণিদা সিগারেট প্যাকেট আর ম্যাচটা আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে ওনাকে প্রশ্ন করল, ছোটোবেলার মানে?

মানে ওই স্কুলে পড়ার সময়, যে-বয়সে লুকিয়ে সিগারেট ফুঁকে নিজেকে খানিকটা বড়ো বড়ো লাগে আর কী। তখন হ্যাঁ, নাইন-টেন-এ পড়ি বোধহয়। পরে আর ছাড়তে পারলাম না। বলে না, প্রথম প্রেম, ভোলা কঠিন।

ভদ্রলোকের ঠোঁটের কোণায় মুচকি হাসি দেখতে পেলাম। বেশ ভালো লাগল মানুষটিকে। রসিক লোক মনে হচ্ছে।

গোটা ঘরে চোখ বুলিয়ে সে ধারণা আরও দৃঢ় হল। ঘরের আসবাব থেকে শুরু করে, দেয়ালের পেইন্টিংস, মূর্তি, ফ্লাওয়ার ভাস, মেঝেয় পাতা গালিচা, জানলার পর্দা– সব কিছুতেই বৈভব এবং রুচির সুপরিকল্পিত, সুচিন্তিত ভাবনার প্রকাশ।

শুনতে পেলাম ভদ্রলোক বলছেন, বলুন মি. চক্রবর্তী এই অধম আপনার কী সেবা করতে পারে?

প্লিজ ওভাবে বলবেন না, রণিদা বলল, আমি এসেছিলাম আপনার বন্ধুর মৃত্যুর তদন্তে সামান্য সাহায্য প্রার্থী হয়ে।

আপনি নিঃসঙ্কোচে যে-কোনও প্রশ্ন করতে পারেন আমায়। ঘনশ্যামের কেসটা আপনি নিয়েছেন দেখে আমি কী বলব আপনাকে–দারুণ, দারুণ খুশি হয়েছি। আমি চাই আমার বাল্যবন্ধুর হত্যাকারী ধরা পড়ুক।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমার প্রথম প্রশ্ন আপনার বন্ধু ঘনশ্যাম মণ্ডল কেমন মানুষ ছিলেন? কোনও বদ নেশা-টেশা? কিছু মাইন্ড করবেন না প্লিজ।

না, না ওসব কোনও বদ গুণ ওর ছিল না। ছেলেবেলা থেকে দেখছি তো। চা-সিগারেট ছাড়া কোনও দিন অন্য কোনও নেশা ও করেনি। আমি তো মশাই ওকে এই নিয়ে কত ঠাট্টা-ইয়ার্কি করেছি। আমার আবার একটু, হাতের ভঙ্গিতে বিশেষ কিছু বোঝান ভদ্রলোক, ইয়ে-টিয়ে চলে আর কী, বুঝলেন কিনা?

রণিদা,ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, বলুন দেখি, ওর এমন কে শত্রু থাকতে পারে যে কোনও কিছুর জন্য ওকে খুন পর্যন্ত করতে পারে?

কমলেশ খাস্তগীর একটু চুপ করে কিছু ভাবলেন মনে হল। তারপর বললেন, দেখুন যে-কোনও মার্ডারের পিছনেই একটি মোটিভ থাকে। কারও কিছু গেইনের ব্যাপার-স্যাপার থাকে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে প্রাথমিক সন্দেহ আসে রাধেশ্যামের প্রতি, অর্থাৎ ঘনশ্যামের ভায়ের প্রতি। কারণ ঘনশ্যামের মৃত্যু হলে ওর পথের কাঁটা নির্মূল হল। শতকরা সত্তর ভাগ না হোক, পঞ্চাশ ভাগ পেতে অন্তত আর কোনও বাধা রইল না।

হু-ম্, রণিদাকে চিন্তিত দেখাল, তা ঠিকই, কিন্তু…

কিন্তু কী রণজয়বাবু?

বলছিলাম, একবার ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারলে ভালো হতো।

ওকে আপনি কোথায় পাবেন এখন, ও তো নিরুদ্দেশ। মাঝে মাঝে ডুব মারা ওর চিরকেলে অভ্যাস, কম দিন দেখছি। ব্যাটা পাক্বা রাউডি একটি।

আপনার দেখছি ওর প্রতি বেশ রাগ আছে মনে হচ্ছে? সামান্য হেসে বলল রণিদা।

আর বলবেন না দাদা, এই সেদিন, পাড়ার কিছু ছেলে নিয়ে এসে ও কিনা আমাকে চমকাচ্ছে।

সে কী! কেন? ঢোলগোবিন্দবাবু দারুণ বিস্মিত। আমার ও রণিদারও অবাক লাগল ব্যাপারটা।

ওই একটি বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে আমার কাছে পার্সেন্টেজ খেতে চায়।

বলেন কী?

ভাবুন একবার, চোখ উঁচিয়ে বললেন কমলেশবাবু।

তারপর, তারপর? ঢোলগোবিন্দবাবুর আগ্রহ বাড়ে।

তারপর আর কী? কিছু কথা কাটাকাটি হল। ঘনশ্যামের মুখ চেয়ে ওকে ছেড়ে দিলাম। বেশ কিছু টাকা খসল, এই আরকী। তবে চাইলে ওকে আমি দেখে নিতাম। এ লাইনে কাজ করি দীর্ঘদিন।

পার্টি-থানা–সব লাইন ঠিক রেখে চলতে হয় আমাদের। তবে এর পর আসলে ওর কপালে দুঃখ আছে।

যাক গে, বাদ দিন ওসব। যা বলছিলাম–ঘটনাটা ঘটেছে সম্ভবত তেরোই ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায়। ওই দিন ওই সময় আপনি কোথায়, কার সঙ্গে ছিলেন?

রণিদার আচমকা এমন ক্ষুরধার প্রশ্নে কমলেশবাবুকে খানিকটা বিপর্যস্ত দেখাল। তিনি কোনও মতে বললেন, আপনি কি আমাকে সন্দেহ করছেন না কি?

কিছু মনে করবেন না, এটা আমাদের একটি রুটিন মাফিক অত্যন্ত কমন প্রশ্ন, হ্যাঁ, বলুন ওই দিন ওই সময় কী করছিলেন আপনি?

আমি….আমি…যতদূর মনে পড়ছে এক বন্ধুর ছেলের বিয়েতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলাম।

কোথায়?

অ্যাঁ?

বলছি জায়গাটা কোথায়?

বরানগর।

বিয়ে না বৌভাতের নেমন্তন্ন ছিল ওটা?

বিয়ের, আমি একাই নয়, আমার ফ্যামিলিও সেদিন গেছিল বিয়ে অ্যাটেন্ড করতে, জবাব দিলেন কমলেশবাবু।

আই সি, …রণিদার কথা সম্পূর্ণ হল না। কারণ এই সময় বেয়ারা সঙ্গে আর একজনকে নিয়ে ঘরে ঢুকল দুই বিশাল আকৃতির ট্রে-তে করে মিষ্টি, নোনতা ইত্যাদি নিয়ে। আমি আর রণিদা আঁতকে উঠলাম খাবারের বহর দেখে। প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম, করেছেন কী?

তবে ঢোলগোবিন্দবাবুকে বেশ খুশি খুশিই দেখাল। খাদ্যের পরিমাণ ও প্রকৃতি তার মনপসন্দ হয়েছে।

অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে কমলেশবাবু বললেন, এই যৎসামান্য আয়োজন আর কী ?

তারপরই সুর পালটে ধমকে উঠলেন, হতভাগা, দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? চা-টা নিয়ে আয় এক্ষুনি।

চাকর দুটি বাবুর আদেশ তালিম করতে যাবে এমন সময় রণিদা বেশ একটু ভারী গলায় বলে উঠল, এই তোমরা দাঁড়াও, এদিকে এসো।

চাকর দুটি কঁচুমাচু হয়ে খানিক এগিয়ে এল।

কমলেশবাবু অবাক।

রণিদা বলল, আমি বলছি, এখানে মাত্র একটি প্লেট রেখে বাকিগুলি ভেতরে নিয়ে যাও।

না, না কী যে বলেন আপনি। এটুকু খেতেই হবে। চেঁচিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক।

রণিদা বলল, দেখুন কমলেশবাবু, আমি বা আমার এই ভাই–দুজনার কেউই মিষ্টির ভক্ত নই। মিষ্টি ভালোবাসেন আমাদের এই ভদ্রলোকটি–ঢোলগোবিন্দবাবু। আপনার আতিথেয়তাকে সম্মান জানাতে একটি প্লেট রাখছি, একটিই যথেষ্ট। আপনি বরং আমাদের একটু চা খাওয়ান।

চাকর দুটি হতবুদ্ধি। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না।

কমলেশবাবু আমতা আমতা করে বললেন, এটা কি ঠিক হল? প্রথম দিন আমার বাড়ি এলেন অথচ একটু মিষ্টি মুখে তুলতে চাইছেন না আপনারা।

আমি বললাম, প্লিজ, আপনি আদারওয়াইজ ভাববেন না। এই আমরা মিষ্টি খাচ্ছি, প্লেট থেকে একটি সন্দেশ তুলে মুখে পুরলাম আমি। তারপর রণিদার দিকে এগিয়ে দিলাম প্লেটটি।

দেখলাম রণিদা প্লেট থেকে একটি মিষ্টি তুলে মুখে দিল, তারপর প্লেটটি বাড়িয়ে দিল ঢোলগোবিন্দবাবুর দিকে।

আমি চাকর দুটিকে মৃদু ধমক দিলাম, দাঁড়িয়ে দেখছ কী? নিয়ে যাও এগুলি।

ওরা ওসব নিয়ে ভেতরে চলে যেতেই রণিদা আগের প্রশ্নে ফিরে গেল, হ্যাঁ, মি. খাস্তগীর, বন্ধুর বিয়ে তা হলে ভালোই জমল বলুন?

বন্ধুর নয়, বন্ধুর ছেলের বিয়ে ছিল।

আই সি, সুবিমল সোমের সঙ্গে ঘনশ্যামবাবুর সম্পর্ক কেমন ছিল বলতে পারেন?

ভালোই। তবে ইদানীং…

আবার বাধা পড়ল আমাদের কথায় কারণ ট্রেতে করে চা নিয়ে প্রবেশ করল এক ভৃত্য।

সাবধানে, দেখিস, গায়ে পড়ে না যেন, কমলেশবাবু চাকরকে সজাগ করে দেন।

রণিদা আর আমি এগিয়ে ধরা ট্রে থেকে চা তুলে নিলাম। ঢোলগোবিন্দবাবু ইঙ্গিতে বোঝালেন ওনার চা-টা আপাতত টেবিলেই থাক, কারণ উনি এখন ব্যস্ত।

কমলেশবাবুও প্লেট সমেত একটি কাপ তুলে নিয়ে চায়ে চুমুক দিলেন।

চাকরটি চলে গেলে কথাবার্তা শুরু হল আমাদের।

কী একটি কথা বলতে যাচ্ছিলেন যেন আপনি? রণিদা ভদ্রলোককে মনে করিয়ে দেয়।

হ্যাঁ, বলছিলাম ইদানীং টাকাপয়সা নিয়ে কিছু একটি ঝামেলা চলছিল ওদের দুজনার মধ্যে। সুবিমলের ছেলেটা আইআইটি খড়গপুরে পড়ে, প্রচুর খরচ হয়। ওর দোকানে দ্বিতীয় জেরক্স মেশিনটা বসাবার সময় শুনেছি ঘনশ্যাম কী একটি শর্তে ওকে এক মোটা অঙ্কের টাকা ধার দেয়। ওই নিয়ে ওদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল একদিন। আমি আচমকাই শুনে ফেলি। আপনি আবার এসব কথা বলে দেবেন না যেন।

না না নিশ্চিন্ত থাকুন আপনি, কাউকে কিছু বলা হবে না, এ ব্যাপারে, আশ্বাস দেয় রণিদা।

হঠাৎ রণিদার দৃষ্টি কমলেশবাবুর ফোনের দিকে গেল। বলল, মডেলটা তো চমৎকার। একটু দেখতে পারি?

অবশ্যই, একটু গদগদ চিত্তে কমলেশবাবু ফোনটা তুলে দিলেন রণিদার হাতে।

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খানিকক্ষণ মনোযোগ দিয়ে রণিদা দেখতে লাগল সেলফোনটা।

আমার আশ্চর্য লাগল, হঠাৎ করে ওর আবার সেলফোন প্রীতি জেগে উঠল কেন?

একসেলেন্ট, রণিদার কণ্ঠে উচ্ছ্বাস, জানেন কি এর একটি নিজস্ব নম্বর আছে?

আমার ফোন নম্বরের কথা বলছেন তো?

না, না, আমি বলছি আপনার এই সেলটার নিজস্ব একটি আইডেন্টিফাইং নম্বর আছে, সেটি জানেন কি?

আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারছি না, কমলেশবাবু বেশ খানিকটা হতভম্বের মতন বললেন।

দেখুন, সিমকার্ড যে নাম্বার দেয় সেটা আপনার ফোন নম্বর, অর্থাৎ কেউ ফোন করলে আপনাকে ওই নম্বরেই পাওয়া যাবে–এটা নিশ্চয়ই পরিষ্কার আপনার কাছে?

হ্যাঁ, মাথা নাড়েন ভদ্রলোক।

যে-কোনও সেলফোনের একটি মডেল নম্বর থাকে, এটাও জানেন নিশ্চয়ই?

জানি, এবারও সম্মতিজ্ঞাপক মাথা নাড়েন ভদ্রলোক।

এ ছাড়াও এই সেলটার একটি সম্পূর্ণ নিজস্ব আইডেনটিফাইং নম্বর আছে যা প্রতিটি সেলের ক্ষেত্রেই ভিন্ন ভিন্ন–সেটা জানেন কি?

সেটা জেনে লাভ?

লাভ আছে, সেটাই বলছি– ধরুন অসাবধানতা বশত ফোনটা আপনার হারিয়ে গেল কিংবা চুরি হয়ে গেল। আপনি সেক্ষেত্রে কী করবেন?

কেন, থানায় যাব।

গুড, থানায় গিয়ে আপনি আপনার ফোন নম্বর আর মডেল নাম্বার ও কোম্পানির নাম ইত্যাদি দিয়ে একটি মিসিং ডায়রি করবেন, তাই তো?

মাথা নাড়েন ভদ্রলোকে, যার অর্থ হ্যাঁ-বাচক।

ধরুন তার দু’দিন পর পুলিশ এই কোম্পানিরই একই মডেলের পাঁচখানা ফোন উদ্ধার করে আপনাকে বলল, আপনারটা চিনে নিতে। কী করে চিনবেন আপনি? কারণ চোর নিশ্চিতভাবেই সেলফোনটা চুরি করে প্রথম যে-কাজটি করবে তা হল আপনার সিম-কার্ডটি খুলে ফেলে দেবে। ফলে গেল আপনার নিজস্ব ফোন নম্বর। এবার কী করবেন আপনি?

তাই তো? হতবাক কমলেশবাবুর মুখ থেকে কথা সরল না।

ঢোলগোবিন্দবাবু মিষ্টি শেষ করে চায়ের কাপ-প্লেট হাতে তুলে নিয়েছিলেন, চুমুক দিতে ভুলে গেলেন। তিনিও হাঁ করে চেয়ে রইলেন রণিদার দিকে।

দাদা, চা-টা খান, ঠান্ডা হয়ে গেল যে, বললাম আমি।

সে ক্ষেত্রে, আবার বলতে শুরু করে রণিদা, সে ক্ষেত্রে আপনার সেলের নিজস্ব আইডেন্টিফাইং নম্বরটাই কাজ দেবে নিজের ফোন চিনে নিতে। অবশ্য যদি ফোনের কাগজপত্র সব যত্ন করে রাখা থাকে তা হলে প্রবলেম হয় না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন পর আর ওসব মাথায় রাখেন না।

আপনি যে-নম্বরের কথা বলছিলেন ওটা কীভাবে জানা যেতে পারে, কমলেশবাবু আগ্রহ দেখান এবার।

আপনি অনুমতি দিলে সেটা আমি অপারেট করে বের করতে পারি, জবাব দিল রণিদা।

হ্যাঁ দেখান না।

রণিদা এবার ওর কেরামতি দেখিয়ে সেলফোনটার কীসব বাট্ন টেপাটেপি করল দ্রুত, তারপর ফোনটা তুলে ধরল কমলেশবাবুর চোখের সামনে।

দেখা গেল মনিটরে ভাসছে পনেরো ডিজিটের একটি নম্বর।

এটাই?

হ্যাঁ, এটাই সেই গুরুত্বপূর্ণ আইডেন্টিফাইং নম্বর যেটা আপনার নিজের ফোন চিনে নেবার জন্য অতীব দরকারি।

ভালো জিনিস শিখলাম তো, কমলেশবাবুকে উৎফুল্ল দেখাল।

শুধু তাই নয়, এটা যদি আপনার নোট করা থাকে তবে থানায় মিসিং ডায়ারি করার পর ওই ডায়ারি নম্বর উল্লেখ করে যদি সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে আপনি জানান যে আপনার এই আইডেন্টিফাইং নম্বরযুক্ত ফোনটি হারিয়ে গেছে, এতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে যা পাচার হয়ে গেলে আপনার সমূহ বিপদ হবে, তা হলে ওরা ওই মুহূর্তে ফোনটি এমনভাবে ব্লক করে দেবে ওদের ওখান থেকে যে, আপনার কোনও তথ্য কেউ আর পাবে না।

দারুণ তো! কীভাবে নম্বরটা বার করা যায় শেখাবেন একটু?

অবশ্যই, বলল রণিদা, তারপর ফোনটা ওনার হাতে দিয়ে বলল, প্রথমে স্টার টিপুন।

টিপলাম, বললেন ভদ্রলোক।

এবার হ্যাশ।

হ্যাশ।

এবার জিরো।

এবার সিক্স।

সিক্স।

টিপেছেন এবার ফের হ্যাশ মারুন।

মারলাম, আরে… চমৎকার। ভদ্রলোকের চোখে মুখে খুশির উচ্ছ্বাস, দারুণ জিনিস শিখলাম একখানা।

শিখলেন তো? এবার এই নম্বরটা কোনও ইম্পর্টেন্ট জায়গায় লিখে রাখবেন, প্রয়োজনে কাজে দেবে। আজ উঠি।

উঠবেন? ঠিক আছে, উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক।

আমরা দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম।

কমলেশবাবু বললেন, যে-কোনও প্রয়োজনে স্মরণ করবেন, উইদাউট এনি হেজিটেশন।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, বলল রণিদা।

ধন্যবাদ আপনাদেরও।

গাড়িতে এসে আমি বললাম, কী ব্যাপার বলো তো রণিদা? হঠাৎ মোবাইল নিয়ে পড়লে?

ভালো লাগল সেটটা, খুব নির্লিপ্ত শোনাল ওর কণ্ঠস্বর।

কিন্তু আমি জানি মাঝে মাঝে ওর এই বেড়াল তপস্বী ভাবটা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। কিছু একটা ছক কষছে মনে মনে। উত্তর দেবে না জানি, তাই আর ঘাঁটালাম না।

***

পর্ব – ৫

কমলেশ খাস্তগীরের বাড়ি থেকে বেরোতেই আমি বললাম, এরপর আমাদের গন্তব্যস্থল নিশ্চয়ই ঘনশ্যাম মণ্ডলের বাড়ি?

হ্যাঁ, বত্রিশের বি, কালীদাস পতিতুণ্ডি লেন, জবাব দিয়ে গাড়িতে উঠে বসল রণিদা।

মেন রাস্তা ধরে গলি বরাবর সামান্য এগোলেই বত্রিশের বি।

কড়া নাড়া দিতেই দরজা খুলে দাঁড়ালেন এক বিধবা মহিলা, বললেন, কাকে চান আপনারা?

ভদ্রমহিলাকে দেখে কষ্ট লাগল। চোখ দুটি করুণ।

বছর পঁয়তাল্লিশের সদ্য স্বামী হারা শোকনম্রা ঘনশ্যাম মণ্ডলের স্ত্রী অত্যন্ত সাদামাটা পোশাকে।

ঢোলগোবিন্দবাবু বললেন, আমরা মানে ক’দিন আগে ঘনশ্যামবাবু…

হ্যাঁ, উনি আমার স্বামী, ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বরে কোনওরকম ভাব প্রকাশিত হল না।

দরজা ধরে দাঁড়িয়ে উনি।

ওনার মৃত্যুর তদন্তের ব্যাপারে আমরা এসেছিলাম, এবারও ঢোলগোবিন্দবাবুই উত্তর দিলেন।

ও পুলিশের লোক আপনারা? ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বরে কাঠিন্য।

রণিদা নিজের পকেট থেকে আইডেন্টিটি কার্ড বের করে ওনার দিকে এগিয়ে দিল। মুখে বলল, রণজয় চক্রবর্তী–দুর্ঘটনার কয়েকদিন আগে আপনার স্বামী দুই বন্ধুকে নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে গেছিলেন।

ভদ্রমহিলা কার্ডে চোখ বোলাচ্ছিলেন।

তারপর স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে বললেন, বুঝতে পেরেছি। দয়া করে ভেতরে আসুন আপনারা।

ওনাকে অনুসরণ করলাম।

মাঝারি মাপের এক ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে সোফায় বসলাম আমরা।

একটু স্থির হতে ভদ্রমহিলা বললেন, কিন্তু শুনেছিলাম, আপনি কেসটার তদন্তে আগ্রহী নন।

দেখুন ম্যাডাম, রণিদা বলতে লাগল, হুমকি চিঠির ক্ষেত্রে আমাদের তেমন কিছু করার থাকে না। তবে ওনাকে লোকাল পিএস-এ সব কিছু জানিয়ে একটি জেনারেল ডায়ারি করে রাখার পরামর্শ দিয়েছিলাম।

হ্যাঁ, সেটা উনি করেছিলেন। গতকাল পুলিশ এসে কালীঘাট থানার ওই জিডি নম্বরটা নিয়ে গেছে। আপনি যদি চান তা হলে…

না, তার দরকার নেই। সেদিন আনুষ্ঠানিক ভাবে কেসটা না নিলেও আপনার স্বামীকে চিঠির এনভেলাপগুলি আমাকে দিয়ে আসতে বলেছিলাম এবং উনি তা দিয়েও এসেছিলেন। ফলে দয়া করে এটা ভাববেন না যে ঘনশ্যামবাবুকে আমি যথেষ্ট গুরুত্ব দিইনি। আসলে বিষয়টা তখন এত সামান্য ছিল যে তার জন্য অ্যাডভান্স নিতে আমার বিবেকে বাধছিল সেদিন। যাইহোক, আপনি ভাববেন না, এখন এই কেসটার তদন্তে আমি হাত দিয়েছি, অপরাধীকে খুঁজে বার করবই।

রণিদার কথায় ভদ্রমহিলাকে বেশ খানিকটা আশ্বস্ত বলে মনে হল। উনি বললেন, দেখুন ভাই, ওর মতন মানুষের যে কোনও শত্রু থাকতে পারে…

কান্নায় কণ্ঠ বুজে এল ভদ্রমহিলার, উনি আঁচলে মুখ চাপলেন।

আপনি ভেঙে পড়বেন না, প্লিজ, আপনার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছি আমরা। বলতে পারেন সে জন্যই দিন দুই পর আপনার বাড়ি এলাম।

ধন্যবাদ, একটু স্বাভাবিক হলেন মিসেস মণ্ডল।

কেসের তদন্তে আপনার সহযোগিতা আমার দরকার, রণিদা বলল।

বলুন, আমি কীভাবে আপনাদের সহযোগিতা করতে পারি? দয়া করে কোনও অপ্রীতিকর প্রশ্ন করবেন না।

হঠাৎ এ কথা বলছেন কেন? রণিদার সঙ্গে আমরাও বেশ অবাক হলাম।

গত দু’দিন ধরে পুলিশের জেরায় জেরায় আমি কাহিল। ও এভাবে চলে গেল। এত মানসিক চাপের মধ্যে আমি আছি যে বলে বোঝানো কঠিন। তার ওপর পুলিশের অসংখ্য প্রশ্ন। অনেক ক্ষেত্রে উত্তর দেবার সময় আমার মনে হয়েছে, যেন ওর মৃত্যুর জন্য পুলিশ আমাকেই সন্দেহ করছে।

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...