পর্ব – ৫

দেখুন পুলিশের চাকরিটাই এ রকম, ইচ্ছা না থাকলেও নানা অপ্রীতিকর কাজ করতে হয় তাদের মাঝেমধ্যে। ওই ব্যাপারটা মনে রেখে কষ্ট পাবেন না। আর আমি আপনাকে সে রকম কিছু জিজ্ঞাসা করব না।

ঠিক আছে, বলুন কী জানতে চান?

রণিদা ডায়ারি ও পেন নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বলল আপনার স্বামীর সঙ্গে কমলেশ খাস্তগীর এবং সুবিমল সোমের সম্পর্ক কীরকম?

আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় ছাবিবশ বছর। শুনেছি তারও আগে থাকতে বন্ধুত্ব ওদের।

ওরা ছাড়া আর কার কার সঙ্গে মিশতেন, মি. মণ্ডল?

কমবেশি সকলের সঙ্গেই কথা বলতেন তবে বন্ধু বলতে ওরা দুজনই ছিল যাদের ওপর ও খুব নির্ভর করত। আসলে ও একটু ইনট্রোভার্ট প্রকৃতির মানুষ ছিল– যেচে কারও সঙ্গে যেমন আলাপ করতে পারত না, তেমনি কারও সঙ্গে একটানা দীর্ঘক্ষণ কথা বলতেও দেখিনি ওকে কোনওদিন।

শুনেছিলাম, ভায়ের সঙ্গে ওনার একটু মনোমালিন্য হয়েছিল দিন কয়েক আগে?

ভদ্রমহিলা চুপ করে রইলেন। হয়তো মনে মনে ভাবলেন এ প্রসঙ্গে কীভাবে মুখ খোলা উচিত তার।

তারপর বললেন, ঠাকুরপো একটু অন্য প্রকৃতির মানুষ। তা নিয়ে বাবা-মায়ের দারুণ দুঃখ ছিল। মা আগেই মারা যান। বাবা মারা যাবার পর সম্পত্তির ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে দাদার সঙ্গে গণ্ডগোল হতো ওর। ওর অন্যায় দাবি দাদা মেনে নিতে পারেনি। তাতে খুব রেগে যান ঠাকুরপো। বলেন, এ সম্পত্তি তুমি কীভাবে ভোগ করো আমিও দেখে নেব।

উনি এখন কোথায়?

বলতে পারব না, মাঝে মাঝে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া ওর পুরোনো অভ্যাস।

মিসেস মণ্ডল, রণিদা বলল, আপনি এই পরিবারের মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। আপনি স্বামী ও ঠাকুরপোকে দীর্ঘদিন যাবৎ খুব কাছ থেকে দেখেছেন। একটি প্রশ্নের উত্তর দিন, আপনার কি মনে হয় মি. মণ্ডলকে তার ভাই খুন করতে পারে?

মাথা নীচু করে ভদ্রমহিলা মিনিটখানেক চুপ করে থেকে জবাব দিলেন, বলতে পারব না।

যাক গে ওসব কথা, আপনার ছেলে-মেয়েরা কোথায়?

ওপরের ঘরে।

ছেলে কি বড়ো?

না মেয়ে, বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক হল।

আপনার ছেলে কত বড়ো?

এ বছর কুড়িতে পড়ল। ডাকব?

না থাক, এখন দরকার নেই ওদের। বলল রণিদা, আচ্ছা মিসেস মণ্ডল, আপনার স্বামী তো রেলে চাকরি করতেন ওনার অফিসটা ঠিক কোথায় বলুন দেখি?

কয়লাঘাটা ব্রাঞ্চ।

উনি কি অফিস থেকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়েই বাড়ি ফিরতেন?

হ্যাঁ প্রতিদিনই। যেদিন কোথাও যাবার কথা থাকত বলে যেত আমায় যে, ফিরতে দেরি হবে।

সেদিন নিশ্চয়ই তেমন কিছু বলে যাননি উনি?

না। মাথা নাড়েন মিসেস মণ্ডল।

ধন্যবাদ, আর একটি কথা, আপনার স্বামীর এভাবে খুন হবার পিছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

কারণ? ভদ্রমহিলাকে বিধবস্ত দেখায়। আপনার এই প্রশ্নটা পুলিশও আমাকে করেছিল।

কী উত্তর দিয়েছিলেন পুলিশকে?

তখন বলতে পারিনি। তবে পরে অনেক ভেবে মনে হয়েছে একটি ঘটনার কথা।

আমরা নড়েচড়ে বসলাম, আগ্রহ বাড়ল।

কী সেই ঘটনা? প্রশ্ন করে রণিদা।

দিন কুড়ি আগে পাড়ার বেশ কিছু ছেলে এসে ক্লাবের উন্নয়নের জন্য দশ হাজার টাকা চাঁদা চায় ওর কাছে।

সে কী। আমরা চমকে উঠি, তারপর?

ও জানায় অত টাকা দিতে পারবে না। বড়ো জোর শ’পাঁচেক দিতে পারে। এতে ছেলেগুলির সঙ্গে ওর কথা কাটাকাটি হয়। আমার ছেলে এগিয়ে যায়, প্রতিবাদ করে। শেষে অল্পবিস্তর হাতাহাতি হয়। স্থানীয় কয়েকজনের মধ্যস্থতায় সেদিনকার মতন ঘটনাটা চাপা পড়লেও যাবার আগে ছেলেগুলি ভয়ংকর ভাবে আমাদের শাসিয়ে যায় দেখে নেবে বলে।

ঘটনাটা তখন থানায় জানাননি?

আমি ওকে বলেছিলাম জানাতে, কিন্তু ও রাজি হয়নি।

খুব ভুল করেছেন। তা ছাড়া গত দুদিনে পুলিশকে এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা না দিয়ে আরও বড়ো ভুল হয়েছে, যাই হোক, ছেলেগুলিকে চেনেন আপনি?

আমার ছেলে চেনে–হাতকাটা জগা, বরফি, কীসব নাম যেন ওদের।

তা হলে শেষ পর্যন্ত চাঁদা ওরা নিল না?

এক দাদার মাধ্যমে দু-হাজার টাকা আমরা পাঠিয়েছিলাম ক্লাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই টাকাটা ওদের হাতে পৌঁছেছে কি না, ওরা ওই টাকা আদৌ নিয়েছে কি না বলতে পারব না।

রণিদা বলল, আশ্চর্য। এমন মারাত্মক একটি ঘটনা অথচ তিনজনের একজনও সেদিন ব্যাপারটার উল্লেখ করলেন না। যাক গে, যা হয়ে গেছে গেছে। ঘটনাটা সম্বন্ধে খবর নিচ্ছি আমি। আইও রাতুল রায়কেও জানাচ্ছি খবরটা। আজ আমরা উঠি মিসেস মণ্ডল, আপনাকে কষ্ট দেবার জন্য মার্জনা চাইছি।

না, না ঠিক আছে, ভদ্রমহিলাকে বেশ আশ্বস্ত দেখাল। সম্ভবত আমাদের সঙ্গে কথা বলে উনি কিছুটা নির্ভার বোধ করছেন।

আর একটি প্রশ্ন আছে আমার, রণিদা বলে।

হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন না।

আপনার ঠাকুরপো রাধেশ্যাম মণ্ডল কি কোনও নেশাটেশা করতেন?

আমি যতদূর জানি সবরকম নেশাই ওর ছিল, অনেকটা ফ্রি শোনাল ওনার কণ্ঠস্বর।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে মিসেস মণ্ডল, এটা আপনার কাছে রাখুন, বলে একটি কার্ড বের করে রণিদা এগিয়ে দেয় ভদ্রমহিলার দিকে, আমার ফোন নম্বর এতে দেওয়া আছে। যে-কোনও প্রয়োজনে রিং করবেন।

ধন্যবাদ, সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে উনি দরজার দিকে হেঁটে এগিয়ে গেলেন।

গাড়িতে বসে দেখতে পেলাম গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রওনা অবধি ভদ্রমহিলা দরজার দুটি পাল্লায় হাত রেখে অবিচল দাঁড়িয়ে আছেন–বিষণ্ণতা সিল্যুটে হিমায়িত।

মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল।

গলির মুখে আমাদের গাড়িটা বাঁক নিতেই দৃষ্টির অক্ষমতার তুলি দৃশ্যটিকে অন্ধকারের শ্লেটে মুহূর্তে মুছে দিল।

পর্ব – ৬

পরদিন সকালে রণিদার সঙ্গে কথা হচ্ছিল আমার। আসলে তখনও ঢোলগোবিন্দবাবু এসে পৌঁছোননি।

রণিদা বলল, তদন্তের এ পর্যন্ত এসে কী বুঝছিস রঞ্জন?

তুমি হয়তো মনে মনে অনেকদূর এগিয়ে গেছ রণিদা যেহেতু এ বিষয়ে বরাবরই তোমার ব্রেন আমার থেকে অনেক দ্রুত চলে। তবে আমার মনে হয়, গুছিয়ে বলার মতন জায়গায় কিন্তু আমরা এখনও এসে পৌঁছোইনি।

একটু ঝেড়ে কাশ।

মানে এখনও তদন্তের অর্ধেকটাই সারা হয়নি।

যেমন?

যেমন এ কেসে সন্দেহের আসল তির যার দিকে তাকে জেরা করবার কিংবা চাক্ষুস দেখবার সৌভাগ্য আমাদের এখনও হয়নি যেটা অত্যন্ত জরুরি।

অর্থাৎ ঘনশ্যাম মণ্ডলের ভাই রাধেশ্যাম মণ্ডল।

ঠিক তাই।

তোর কি মনে হয় রাধেশ্যাম মণ্ডল খুন করতে পারে?

অসম্ভব বলে পৃথিবীতে কিছুই নেই, বললাম আমি। রাধেশ্যাম মণ্ডল তার দাদার হত্যাকারী হতে পারে, আবার নাও পারে। একথা তো ঠিক যে ঘনশ্যাম মণ্ডলের মৃত্যুতে যদি কারও ডাইরেক্ট ইম্মিডিয়েট গেইনের ব্যাপার থাকে তবে সেটা রাধেশ্যাম মণ্ডলের।

গুড, ভেরি গুড।

তা ছাড়া আমি ইতস্তত করি।

তা ছাড়া কী?

তা ছাড়া দেখলে না, মিসেস মণ্ডল পর্যন্ত নির্দ্বিধায় রাধেশ্যাম মণ্ডলকে নির্দোষ বলতে পারলেন না। আমি একটি জিনিস জানি রণিদা, মহিলাদের সিক্সথ সেন্সটা কিন্তু প্রখর। ওরা এমন কিছু জানতে, বুঝতে বা অনুভব করতে পারেন অতি সহজে, যা পুরুষদের পক্ষে চট করে পারা সম্ভব নয়।

উনি কিন্তু ডেফিনিটলি বলেননি যে রাধেশ্যাম মণ্ডল খুনি, রণিদা পালটা যুক্তি দেখায়।

সেটা বলা ওনার পক্ষে সম্ভব কি?

তা অবশ্য ঠিক, বলে রণিদা, তা হলে এবার আসা যাক পরবর্তী প্রসঙ্গে  অর্থাৎ অফিস কলিগ জনমেজয় মিত্তির ও নীলাক্ষি দাসগুপ্তের কথায়।

কিন্তু রণিদা, প্রফেশনাল জেলাসিবশত এত বড়ো একটি কাণ্ড ঘটানো কি সম্ভব?

সেটা ভাবার বিষয় অবশ্যই, বলল রণিদা, তবে তোর কথা টেনে বলতে হয়, নাথিং ইজ ইম্পসিবল আন্ডার দি সান। আমাদের ও ব্যাপারটা ঝালিয়ে দেখতে হবে শিগগির।

আচ্ছা রণিদা, সুবিমল সোম এবং কমলেশ খাস্তগীর এদের দু’জন সম্বন্ধে তুমি কী ভাবছ?

দেখ, তদন্ত এখনও পর্যন্ত যে-পর্যায়ে আছে তাতে ওদের দুজনের কাউকেই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যাচ্ছে না।

কিন্তু কাউকে খুনি ভেবে নিলেই তো হল না, যাকে খুনি ভাবছি–তাকে কেন খুনি ভাবছি তার একটি কোজেন্ট গ্রাউন্ড নিশ্চয়ই থাকা উচিত।

অর্থাৎ তুই বলতে চাইছিস মোটিভ। মার্ডারের মোটিভটা কী? বলে রণিদা সিগারেট ধরায়।

জাস্ট রাইট। ঘনশ্যাম মণ্ডলকে হত্যা করে সুবিমল সোম কিংবা কমলেশ খাস্তগীরের লাভটা কী সেটা আগে খুঁজে বার করতে হবে আমাদের। কারণ ভেবে দেখলেও এ পর্যন্ত আমাদের হাতে এমন কোনও স্ট্রং এভিডেন্স বা তথ্য আসেনি যার ওপর বেস করে আমরা এদের খুনি ভাবতে পারি।

সোফায় মাথা হেলিয়ে সিগারেটের রিং ছুড়তে ছুড়তে রণিদা বলে, খুনি ভাবতে না পারলেও সন্দেহ কিছু এসেই যাচ্ছে।

কী রকম? জানতে আগ্রহ হয় আমার।

ওদের কথার মধ্যে বেশ কিছু অ্যানোম্যালি আছে। কিছু তথ্য গোপন করতে চাইছে দুজনই।

যেমন?

যেমন সুবিমল সোমের সঙ্গে জেরক্স সংক্রান্ত কোনও ব্যবসায় ঘনশ্যামবাবু সম্ভবত জড়িয়েছিলেন যেটা উনি চেপে যান আমাদের কাছে–তথ্যটা জানা যায় কমলেশ খাস্তগীর মারফত। সেটা কেন?

হতে পারে উনি বন্ধুর মৃত্যুর পর ওই টাকা আর ওনার পরিবারকে দিতে চাইছেন না, বললাম আমি, কিন্তু তুমি কমলেশ খাস্তগীরের কথায় কী অসংগতি পাচ্ছ?

তোর মনে আছে আমি কমলেশবাবুকে প্রশ্ন করেছিলাম খুনের দিন সন্ধ্যাবেলা আপনি কী করছিলেন?

হ্যাঁ মনে আছে।

উত্তরে উনি কী বলেছিলেন বল দেখি?

উনি বলেছিলেন, সেদিন একটা বিয়েবাড়ি গেছিলেন।

রাইট, বলল রণিদা, তুই পাঁজি খুলে দেখ, ওই দিন কোনও বিয়ের ডেট নেই।

তাতে কি প্রমাণ হয় উনি খুন করেছেন?

না, তা হয় না ঠিকই, তবে আমাদের ভাবার একটি জায়গা এসে যায়–ওই দিন ভদ্রলোক তাহলে কোথায় ছিলেন, কী করছিলেন, কেনই বা তিনি মিথ্যা বললেন আমাদের কাছে?

ঠিক আছে, মানলাম তোমার কথা, বললাম আমি, আর কী উল্লেখযোগ্য ব্যাপার আছে ওই ভদ্রলোক দুজনের?

কেন? খেয়াল করিসনি–ওরা দুজনেই বল দুজনার কোর্টে ঠেলে দিচ্ছেন?

কী রকম? কী রকম?

একবার সুবিমল সোম বলছেন, উনি শুনেছেন যে, ঘনশ্যাম মণ্ডল এবং কমলেশ খাস্তগীরের মধ্যে কোনও গোপন বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হচ্ছে,

আবার ওদিকে কমলেশ খাস্তগীরও বলছেন, উনি শুনেছেন সুবিমল সোমের নতুন জেরক্স মেশিন বসানো নিয়ে ওদের বচসার কথা কানে এসেছিল ওনার, রণিদার কথাটা সম্পূর্ণ করলাম আমি।

এগজ্যাক্টলি, বলল রণিদা, এদের যে-কোনও একজন তদন্তটাকে অযথা গুলিয়ে দিতে চাইছেন মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে। তাহলে সেক্ষেত্রে দুটো প্রশ্ন এসে যাচ্ছে, রণিদা থামে একটু।

আমি চুপচাপ ব্যগ্র দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে।

তারপর ও ফের বলতে শুরু করে, প্রথম প্রশ্ন, এদের দুজনের মধ্যে কে সেই উদ্দিষ্ট ব্যক্তি? দ্বিতীয় প্রশ্ন, এভাবে তদন্ত ডিরেলড করায় তার ইন্টারেস্ট কী?

খুবই যুক্তিযুক্ত কথা, তবে রণিদা, আমার মনে হয় মার্ডারের দ্বিতীয় মোটিভটা সম্বন্ধে আমাদের একটু ভেরিফাই করে নেওয়া উচিত, নয় কি?

অর্থাৎ তুই বলতে চাইছিস, হোয়েদার ইট ইজ আ কেস অফ রিভেঞ্জ অর নট?

হ্যাঁ, লোকাল ছেলেদের সঙ্গে ভদ্রলোকের বিবাদের ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও হেলাফেলার নয়। বিষয়টা নিয়ে একটু খোঁজখবর নেওয়া দরকার। কারণ ওই এলাকায় বেশ কিছু ডেঞ্জারাস অ্যান্টিসোশ্যাল এলিমেন্ট আছে। ওরা করতে পারে না এমন কোনও কাজ নেই।

ঠিকই বলেছিস তুই, ও ব্যাপারটা দেখছি পরে, সিগারেটের অবশিষ্টাংশটি ছাইদানে গুঁজে নিভিয়ে দিতে দিতে বলল রণিদা, এখন একটু দেখা যাক আমাদের দারোগাবাবু তদন্তের কী অগ্রগতি ঘটালেন।

টেবিল থেকে মোবাইলটা তুলে ফোন করল ও।

হ্যালো রাতুল রায় বলছেন? আমি রণজয় চক্রবর্তী, প্রাইভেট ডিটেকটিভ বলছি।

ও-প্রান্ত থেকে কী উত্তর আসছে আন্দাজ করতে পারছিলাম।

শুনলাম রণিদা এদিক থেকে বলছে

কতটা প্রসিড করল কেসটা?… এসেছে? কী বলছে মেডিকেল রিপোর্ট?.. অ্যাঁ… ডেথ ডিউ টু অ্যাসফিক্সিয়া হুইচ ইজ অ্যান্টি-মর্টেম অ্যান্ড হোমিসাইডাল ইন নেচার… হ্যাঁ এটা তো মোটামুটি জানা ছিলই। আর চিঠিগুলি? ওগুলি এগজামিনেশনের জন্য পাঠাতে ডিসির ফরওয়ার্ডিং লাগবে?

হ্যাঁ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠান, কেননা রিপোর্ট আসতেও তো বেশ কিছুদিন লাগে… কিন্তু স্ট্যান্ডার্ড রাইটিং কার নিলেন? আই সি… আই সি… আর, ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের কোনও খবর?… সে কী এখনও পাঠাননি?… পরে? আচ্ছা… না না নো প্রবলেম, রিপোর্ট পেতে কোনও অসুবিধা হলে বলবেন, ঈশ্বরের আশীর্বাদে আমার বন্ধুভাগ্য ভালো… হ্যাঁ সিএফএসএল-এ আমার দুজন বন্ধু আছেন…. হ্যাঁ, ডা. কাশ্যপকে তেমন হলে ফোন করে দেব আমি… রিলেশন তো রাখতেই হয়, না হলে কাজের অসুবিধা… হ্যাঁ, বাই, ঠিক আছে, গুড… ছাড়ছি তা হলে, হ্যাঁ বাই।

ফোনে কথা বলা শেষ করে রণিদা আমার দিকে তাকাল, তারপর জিজ্ঞাসা করল, কীরে যা শুনলি বুঝলি কিছু?

পাক্বা, তা না হলে তোমার সঙ্গে এতদিন রয়েছি? সমঝদার-কে লিয়ে ইশারাই কাফি হোতা হ্যায়, বললাম আমি। কিন্তু একটি জায়গায় খটকা থেকে গেল।

কোন জায়গায়?

পুলিশ অফিসার চিঠিগুলি কার সঙ্গে মেলাবার জন্য পাঠাচ্ছেন… মানে সাসপেক্ট কাকে করছেন?

কেন ঘনশ্যাম মণ্ডলের ভাই রাধেশ্যাম মণ্ডলকে।

উনি ফিরে এসেছেন?

এখনও না। তবে বাড়িতে ওর লেখা কিছু কাগজ পত্র ছিল, মিসেস মণ্ডল বের করে দিয়েছেন। ওগুলিকেই এর স্টান্ডার্ড রাইটিং হিসাবে পুলিশ সিজ করেছে।

তদন্ত জোর কদমে এগোচ্ছে তাহলে?

হ্যাঁ, এবার চল, একটু বেরোব, বলল, রণিদা।

কোথায় যাবে, বিবিডি বাগ?

রণিদার চোখে বিস্ময়। বলল, তুই কি আজকাল থট রিডিংও শিখছিস না কি?

পর্ব – ৭

ঘনশ্যামবাবুর অফিসে পৌঁছে রণিদা নিজের কার্ড দেখিয়ে ওনার ইমিডিয়েট বস মি. জে পূজারির সঙ্গে দেখা করতে চাইলে মিনিট দুয়েকের মধ্যে ডাক এল।

শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কার্পেটে মোড়া ওয়েল ফার্নিশড চেম্বার মি. পূজারির। ঘরে ঢুকে সম্রম জাগল মানুষটিকে দেখে।

আসুন মি. চক্রবর্তী, প্লিজ টেক ইয়োর সিট।

থ্যাংক ইউ মি. পূজারি।

পূজারি বেল টিপলেন।

ঘরে উঁকি দিল বেয়ারা, সাব?

দো-কফি, সংক্ষিপ্ত আদেশ মি. পূজারির কণ্ঠে।

চলে গেল বেয়ারা।

হাঁ বোলিয়ে, মি. চক্রবর্তী, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ? কাল তো থানা থেকে এক অফিসার এসে অনেক কুছু জিজ্ঞাসাবাদ করে নিল।

রণিদা বলল, আমি আপনার বেশি সময় নেব না মি. পূজারি। দু’চারটে মাত্র প্রশ্ন।

হ্যাঁ, বোলিয়ে প্লিজ। কণ্ঠস্বরে ব্যস্ততা।

ঘনশ্যাম মণ্ডল কেমন মানুষ ছিলেন বলে মনে হয় আপনার?

উনি বেশ পুরোনো লোক। এই অফিসে আমি দশ-এগারো মাস হল ট্রান্সফার নিয়ে এসেছি। এ পর্যন্ত যা দেখেছি–কাজের ব্যাপারে উনি খুব কড়া ছিলেন, আ বিট পারফেকশনিস্ট ইউ ক্যান সে। যে-কোনও কাজ চোখ বন্ধ করে ওর ওপর ছেড়ে দেওয়া যেত। ইন ফ্যাক্ট, আয়াম ভেরি সরি টু নো দ্যাট উনি এভাবে খুন হলেন।

এ ব্যাপারে আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?

সন্দেহ? আমার? নো নো, একদম না।

ওনার কোনও রাইভাল ছিল এ অফিসে যে ওকে ঈর্ষা করত বলে মনে হয়?

একটু ভেবে মি. পূজারি বললেন, না, তেমন কিছু শুনিনি কোনও দিন।

এমন সময় দরজা ঠেলে বেয়ারা কফি নিয়ে ঢুকল।

খানিক নীরবতা।

পেয়ালা ও চামচের ছন্দিল টুংটাং। সেগুলি একে একে আমাদের দুজনের দিকে এগিয়ে দিল বেয়ারা।

মি. পূজারি বললেন, প্লিজ।

ধন্যবাদ দিয়ে কফিতে চুমুক দিলাম আমরা।

শুনলাম ওনার একটি প্রোমোশন ছিল সামনে? কোটার গ্রাউন্ডে উনি দুই সিনিয়ারকে সুপারসিড করে ওটা পাবার কথা ছিল। কথা বলা যাবে ওদের দুজনের সঙ্গে?

একটু ভাবলেন মি. পূজারি।

তারপর বললেন, আই সি, এ ব্যাপারটা মাথায় একদম ছিল না আমার। ঠিক আছে, এক্ষুনি ডেকে দিচ্ছি আমি ওদের।

ফের বেল টিপলেন ভদ্রলোক। বেয়ারা দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল, উন্মুখ দৃষ্টি।

ওই মিত্তির আর দাশগুপ্তকে বলো, আমার ঘরে একবার আসতে, এক্ষুনি।

তারপর আমাদের দিকে ফিরে বললেন, কিন্তু মি. চক্রবর্তী আমার মনে হয় না এর জন্য একজন মানুষ আর একজনকে খুন করতে পারে।

পারে মি. পূজারি, পারে। ক্ষেত্র বিশেষে সবই সম্ভব। কদিন আগে এই কলকাতার বুকেই মাত্র পাঁচশ টাকার বিনিময়ে একজন ভাড়াটে খুনি একটি নিরপরাধ মানুষকে খুন করেছে। ইয়েস, ওনলি ফর ফাইভ হানড্রেড রুপিজ, কেটে কেটে বলে রণিদা। ঘটনাটা কাগজে বেরিয়েছিল, খুব সম্ভব নিউজটা আপনি মিস করে গেছেন। মাই এক্সপিরিয়ন্স সেজ, এভরিথিং ইজ পসেবল।

রণিদার ধাতব কণ্ঠস্বরে আত্মপ্রত্যয়।

আই সি, একটু ঘাবড়ে গেলেন বলে মনে হল ভদ্রলোক।

গলায় এখন আর ব্যস্ততার সুর নেই। প্রথম দিকে রণিদাকে একটু আন্ডার এস্টিমেট করছিলেন বলে আমার মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন ওনার ধারণাটা সম্পূর্ণ উবে গেছে।

আ-স-ব স্যার?

দরজা ঠেলে মিনমিনে কণ্ঠস্বর যুক্ত একটি বছর পঞ্চাশেক বয়সের মুখ উঁকি মারল।

হ্যাঁ, প্লিজ কাম ইন। মি. পূজারির বোল্ড উত্তর।

ঘরে ঢুকলেন দুই ভদ্রলোক।

পূজারি বললেন, আসুন আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই–ইনি মি. রণজয় চক্রবর্তী, একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। ঘনশ্যাম মণ্ডলের মার্ডার কেসের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এসেছেন। আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে চান। আর মি. চক্রবর্তী, ইনি হলেন জনমেজয় মিত্তির, আওয়ার সিনিয়র অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আর ইনি নীলাক্ষি দাশগুপ্ত।

ওদের নমস্কারের উত্তরে প্রতি নমস্কার জানাল রণিদা।

জনমেজয় মিত্তির বললেন, কিন্তু দাদা, আমি মানে, ঘনশ্যামের খুনের ব্যাপারে…

আমতা আমতা করতে থাকেন ভদ্রলোক।

কিছুই জানেন না, তাই তো? রণিদা কথা সম্পূর্ণ করল।

ভদ্রলোক মাথা নাড়েন ইতিবাচক।

সেটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা একটি কথা বলুন মি. মিত্তির– ঘটনার দিন অর্থাৎ গত তেরোই ফেব্রুয়ারি ঘনশ্যামবাবু তো অফিসে এসেছিলেন, কি ঠিক বলছি?

হ্যাঁ, ঠিক বলছেন।

অর্থাৎ আপনিও এসেছিলেন?

ঠিক তাই।

কিন্তু ওই দিন সন্ধেবেলা অর্থাৎ অফিস ছুটির পর আপনি কোথায় গেছিলেন বলবেন কি?

আমি?… আমি… কেন বাড়ি চলে গেছিলাম সো-জা, উত্তর দেন জনমেজয়বাবু।

আপনার বাড়ি কোথায়?

আজ্ঞে শ্যামনগর, নর্থ চবিবশ পরগনা। হ্যাঁ মনে পড়েছে ওই দিন স্টেশনে নেমে যথারীতি স্টেশনের টি-স্টলে চা খেয়েছিলাম আমরা।

আমরা মানে?

আমি আর এক ডাক্তারবাবু, নীতিন পাকড়াশি। ট্রেন থেকে নামতেই দেখা হয়ে গিয়েছিল ওনার সঙ্গে। ডাক্তার মানুষ যখন তখন কাজে লাগে আমাদের। তাই চা খেতে আমন্ত্রণ জানাই ওনাকে।

ঠিক বলছেন?

প্রয়োজনে প্রমাণ দিতে পারি স্যার। ওনার ফোন নম্বর এখানেই আছে, মানে আমার অফিস ব্যাগে, দেব স্যার?

না থাক, ধন্যবাদ।

যা বোঝার দ্রুত বুঝে নেয় রণিদা। তারপর চোখ ফেরায় নীলাক্ষি দাশগুপ্তের দিকে।

হ্যাঁ, মি. দাশগুপ্ত, আপনাকে দু-একটি প্রশ্ন করতে পারি?

করুন, বেশ গম্ভীরস্বরে উত্তর দিলেন ভদ্রলোক।

মোটা চশমার কাচ, ভারী মুখ, মাঝারি উচ্চতার মানুষটি প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশি মোটা। মাথার মাঝখানে বিস্তৃত টাক। চারিপাশ ঘিরে পাকা চুল অল্পবিস্তর।

দেখলেই মনে হয় বেশ ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক মানুষটি।

আপনার চাকরি কতদিন হল মি. দাশগুপ্ত?

সামনের জানুয়ারিতে রিটায়ার করব, খুব সংক্ষিপ্ত এবং মাপা জবাব এল।

আপনার তো সামনেই একটি প্রোমোশন আছে, তাই না?

হতো না, হয়তো এবার হয়ে যাবে।

কেন?

উত্তরটা আপনি জানেন, গলায় শীতল উষ্মা।

দাশগুপ্তর কাটা কাটা উত্তর আমার মোটেও ভালো লাগল না, অভদ্রজনক বলে মনে হল। দেখলাম, রণিদা স্থির দৃষ্টিতে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে।

মি. পূজারি বললেন, উঁহু, ডোন্ট বিট অ্যাবউট দ্য বুশ। প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিন দাশগুপ্ত।

ওকে, ওকে, রণিদা হাত তুলে মি. পূজারিকে আশ্বস্ত করে। তারপর বলে, দেখুন মি. দাশগুপ্ত, ভুল বুঝবেন না, একচুয়ালি উই নিড ইয়োর কোঅপারেশন।

আপনি যদি আমাদের সন্দেহই না করতেন তা হলে এই গোটা অফিসে এত লোক থাকতে কেবল আমাকে আর মিত্তিরকেই ডেকে পাঠাতেন না, গলায় ঝাঁজ স্পষ্ট হল।

এ ধরনের ঋজু ও কঠিন মনোভাবাপন্ন মানুষদের জেরা করবার অভিজ্ঞতা নতুন নয়, ওকে তো চিনি। এসব চরিত্রের মানুষকে কীভাবে ট্যাকল করতে হয় সেটা ও ভালো ভাবেই জানে। তবে এই ব্যক্তিটিকে একটু বেশি ট্যারা বলে মনে হচ্ছে।

ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। জল কোন দিকে গড়ায়।

রণিদা একটু থেমে সরাসরি ভদ্রলোকের চোখের দিকে চেয়ে বলল, তা হলে সেই কমন প্রশ্নটা করেই ফেলি, কী বলেন?

করুন।

ঘটনার দিন সন্ধেবেলাটা আপনি কীভাবে কাটিয়েছিলেন দয়া করে যদি একটু বলেন।

আউট্রাম ঘাটে হাওয়া খেয়ে, জবাব দিলেন মি. দাশগুপ্ত।

বুঝতে পারলাম, উনি বিন্দুমাত্র সহযোগিতা করতে চান না।

নিশ্চয়ই একা?

অবশ্যই।

গুড, এটা কি আপনার রোজকার অভ্যাস?

না, সে দিন কী মনে হতে গেছিলাম একটু।

তারপর, হাওয়া খেয়ে ফিরলেন কটায়?

রাত সাড়ে আটটা-পৌনে ন’টা নাগাদ। দেখুন মি. চক্রবর্তী, ভদ্রলোক এবার উত্তেজনায় বুঝি ফেটেই পড়লেন, আপনি যদি ভেবে থাকেন, চাকরির শেষ প্রান্তে এসে একটি প্রামোশনের লোভে আমার সহকর্মীকে আমি খুন করব, তা হলে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি আমার সম্বন্ধে নিতান্তই ভুল ভাবছেন।

রণিদা সম্ভবত এই মুহূর্তটুকুর জন্যই অপেক্ষা করছিল যে কখন ভদ্রলোক ব্রেক করেন।

মিনিট খানেক নীরবতা।

রণিদার শাণিত দৃষ্টি ভদ্রলোকের চোখে।

আচমকা ও উঠে দাঁড়ায়, তারপর বলে, মি. দাশগুপ্ত, আপনার মতন মানুষদের মুখোমুখি আমি এর আগেও হয়েছি। আমি জানি আপনি একজন সৎ ও নির্দোষ মানুষ। আপনাদের মতন আবেগপ্রবণ মানুষেরা আর যাই করুক এতটা হীন কাজ করতে পারে না। আপনার ভুল কেবল এটাই হয়েছে যে প্রথম থেকেই আপনি ধরে নিয়েছেন আমি আপনাকে খুনি ভেবেছি।

একটু থেমে রণিদা ফের বলতে শুরু করে, যতদূর শুনেছি, আপনি ঘনশ্যামবাবুর একদম পাশের টেবিলেই বসতেন, ওই দিন ওনার মধ্যে বিশেষ কোনও আচরণ লক্ষ্য করেছিলেন কি?

বিশেষ কোনও আচরণ? না, ঠিক সে রকম তো, কণ্ঠস্বর এবার বেশ নরম দাশগুপ্তবাবুর।

আমি একটি কথা বলব স্যার? মিনমিনে কণ্ঠস্বর।

সরু করে গোঁফ ছাঁটা, চাপা গাল, ময়লা রং, রোগাটে শরীরের জনমেজয় মিত্তিরকে দেখে কেন জানি না আমার যাত্রাদলের একস্ট্রার কথা মনে পড়ল।

আমরা উপস্থিত সকলেই আগ্রহ নিয়ে তাকালাম জনমেজয় মিত্তিরের দিকে।

হ্যাঁ, প্লিজ জবাব দিল রণিদা।

আমি মণ্ডলের ঠিক অপোজিট টেবিলে বসি, মানে বসতাম আর কী। একটি কমন ফোন আমার টেবিলে থাকে। যতদূর মনে পড়ছে ওই দিন বিকাল বিকাল নাগাদ একটি ফোন এসেছিল মণ্ডলের।

ফোন? সেটাই স্বাভাবিক, ওই প্রশ্নে আমি যেতাম শিগগিরই, যাই হোক বলুন, বলল রণিদা।

হ্যাঁ ফোনটা আমিই তুলেছিলাম। মণ্ডলকে চাইতে ওকে ডেকে ফোনটা দিলাম।

ঠিক ক’টা নাগাদ ফোনটা এসেছিল বলতে পারেন?

যদ্দূর মনে পড়ছে পাঁচটা নাগাদ।

আচ্ছা এক মিনিট, কণ্ঠস্বরটা কি আপনার চেনা? মানে ওই কণ্ঠস্বরযুক্ত ব্যক্তিটি আগে কখনও ফোন করেছিল কি না বলতে পারবেন?

ঠিক বলতে পারছি না।

কোনও কথোপকথন ওভারহিয়ার করেছিলেন?

না, ঠিক ওই সময়েই আমাকে টেবিল ছেড়ে উঠে যেতে হয়েছিল। তবে যতদূর মনে হয় ওর কোনও পরিচিতজনই ফোনটা করেছিল। তা ছাড়া–

তা ছাড়া কী?

তা ছাড়া মণ্ডল বরাবরই একটু চাপা স্বভাবের। কথা বলত কম। টেলিফোনে কথাবার্তার সময় কেবল হ্যাঁ, হুঁ ইত্যাদির মধ্যেই বেশিরভাগ সীমাবদ্ধ থাকত ওর দিককার কথা।

ফোনটা রিসিভ করবার পর কী ঘটেছিল বলতে পারেন? প্রশ্ন করে রণিদা।

মিনিট দশেক পর আমি টেবিলে ফিরে এসেছিলাম। এসে শুনি কী একটি আর্জেন্ট কাজে ও একটু আগে আগেই বেরিয়ে গেছে অফিস থেকে।

সাংকেতিক ভাষায় রণিদা কীসব অনবরত নোট নিচ্ছিল, এটা ওর বরাবরের স্বভাব।

তারপর বলল, আচ্ছা মি. মণ্ডলের ফাইনানসিয়াল কনডিশন কেমন ছিল বলতে পারেন?

প্রশ্নটা ছিল মি. পূজারির উদ্দেশ্যে।

হামি যতদূর জানে ভালোই ছিল, কি মিত্তির? উনি সঠিক বলতে পারবেন, জবাব দিলেন ভদ্রলোক।

বরাবরই মণ্ডল ছিল একটু সঞ্চয়ী। কৃপণ বলে অফিসে বন্ধুবান্ধবেরা প্রায়ই টোন কাটত। ইনকাম ট্যাক্সের জন্য প্রয়োজনীয় জমার থেকে বেশি টাকাই জমাতো ও। আর্থিক অসুবিধা কিছু ছিল বলে তো…

হঠাৎ কী যেন মনে পড়ায় ভদ্রলোক থেমে গেলেন।

কী ব্যাপার? বিশেষ কিছু মনে পড়ছে কি? রণিদার দৃষ্টিতে আগ্রহ বাড়ে। বাকিরাও উৎসাহিত।

হ্যাঁ একটি ব্যাপার কিন্তু আমার খুব আশ্চর্যের বলে মনে হয়েছে স্যার, জনমেজয় মিত্তির বলেন।

কোন ব্যাপারটা?

মণ্ডলের মতন একজন সঞ্চয়ী মানুষ আচমকা প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে তিন লাখ টাকা একবারে তুলে নিল!

এতে আশ্চর্যের কী আছে? যার টাকা সে তুলবে তার প্রয়োজনে এটাই স্বাভাবিক, মি. পূজারি বললেন।

টাকাটা উনি কবে তুলেছিলেন বলতে পারেন? রণিদা প্রশ্ন করে উৎসাহ ভরে।

একটু ভেবে মিত্তির বললেন যতদূর মনে পড়ছে এই মাস আটেক আগে, হ্যাঁ, ওই রকমই হবে।

আট মাস, অর্থাৎ লাস্ট জুলাইতে, ঠিক বলছি?

রেজিস্টার দেখে এগজ্যাক্ট ডেট বলে দিতে পারব, তবে জুলাইতেই, এ আমি নিশ্চিত স্যার।

আচ্ছা, টাকাটা তোলার জন্য উনি কী গ্রাউন্ড উল্লেখ করেছিলেন বলতে পারেন?

ওয়াইফস মেডিকেল ট্রিটমেন্ট, একটুও না ভেবেই এবার উত্তর দিলেন ভদ্রলোক।

সকল প্রয়োজনীয় তথ্যাদি দ্রুত নিজস্ব কোড ল্যাঙ্গুয়েজে লেখা বোধহয় সম্পূর্ণ হল। কারণ এরপর আচমকাই রণিদা বলে উঠল, অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে। থ্যাংক ইউ ফর ইয়োর কর্ডিয়াল কোঅপারেশন। আশা করছি খুব শিগগিরই এই রহস্যের জট খুলে যাবে। আপনাদের প্রিয় সহকর্মীর হত্যাকারীকে কয়েকদিনের মধ্যেই আমি ধরে ফেলতে পারব। আজ আমরা আসি, বাই।

আমরা উঠে পড়লাম।

বাই, বলে, হ্যান্ডশেক করলেন মি. পূজারি।

একে একে জনমেজয় মিত্তির এবং নীলাক্ষি দাশগুপ্তের সঙ্গেও হাসিমুখে করমর্দন করে অফিস ছেড়ে গাড়িতে এসে বসলাম আমরা।

রহস্য বাঁক নিচ্ছে রঞ্জন, কিছু আন্দাজ করছিস? কেসটা জটিল হচ্ছে ক্রমশ, রণিদা বলে।

চলন্ত গাড়িতে এক আকাট মূর্খের মতন চেয়ে রইলাম রণিদার দিকে, কিছু মাথায় এল না। দেখলাম ওর চোখে মুখে আর এক রহস্য খেলা করছে।

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...