পর্ব – ৮

রেড রোডে বরাবরই গাড়ির গতি বেশি থাকে।

কার টেপে রবীন্দ্রসংগীত বাজছিল। জানি, রণিদা রবীন্দ্রসংগীতের একনিষ্ঠ ভক্ত হলেও এ সময় ও গান শুনছে না, জটিল অঙ্কের সমাধানে ব্যস্ত।

গানটা ওর মস্তিষ্কে অনুভূত হচ্ছে অন্যভাবে, এক অপার্থিব আবহ সৃষ্টিতে যা ওকে পারিপার্শ্বিক অন্যান্য ভাবনাচিন্তা দূরে ঠেলে দিয়ে মনকে একাগ্র করতে সাহায্য করছে। ওর এইরকম আচরণ আমার সুপরিচিত।

আমি এখনও মূকাভিনয় করে যাচ্ছি।

আচমকা রণিদার মোবাইলটা যান্ত্রিক সুরে গেয়ে ওঠে– ‘আমার বেলা যে যায় সাঁঝ বেলাতে…’

নমস্কার, রাতুলবাবু, বলুন কী খবর?

ওর কণ্ঠস্বরে বুঝতে পারি চমকপ্রদ কিছু ঘটেছে।

বলেন কী? এরই মধ্যে আসামি অ্যারেস্টও হয়ে গেল? নাহ্, মনে হচ্ছে এ যাত্রা আমার পরিশ্রমটা বৃথাই গেল। হ্যাঁ, হ্যাঁ, এক্ষুনি আসছি আমি। আপনার কাছাকাছিই আছি এখন। ওকে, ধন্যবাদ।

ফোন রেখে রণিদা ড্রাইভ করতে করতে আমাকে বলে, দারুণ খবর রঞ্জন, ঘনশ্যাম মণ্ডলের খুনি ধরা পড়েছে।

সে কী?

হ্যাঁ, ঠিকই বলছি, হাসে রণিদা।

আমি অবাক, রণিদা এভাবে হেরে গেল। এ তো প্রায় অসম্ভব। কোনও মতে ঢোঁক গিলে বললাম, কে সেই খুনি?

কেন, রাধেশ্যাম মণ্ডল।

মানে ঘনশ্যাম মণ্ডলের ভাই।

এগ্জ্যাক্টলি, তবে এটা পুলিশের ধারণা।

ওকে কোথায় পেল পুলিশ?

গতকাল রাতে ও নাকি বাড়ি ফিরে আসে। ঘনশ্যামবাবুর স্ত্রী ব্যাপারটা ফোন করে থানায় জানান। পুলিশ ওকে রাতেই বাড়ি থেকে অ্যারেস্ট করে তুলে নিয়ে আসে।

তারপর?

তারপর আর কী, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ওর জবাব না কি স্যাটিসফ্যাক্টরি ছিল না। আজ সকালে কোর্টে পেশ করে পুলিশ রিমান্ডের প্রেয়ার দেয়।

নিশ্চয়ই কোর্টও সেটা মঞ্জুর করেছে?

অবশ্যই।

তা হলে আমরা এখন ময়দান থানায় যাচ্ছি?

ঠিকই বলেছিস, জবাব দিল রণিদা।

বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম ক্রস করছিল তখন আমাদের গাড়ি। কিছু সময়ের মধ্যেই ময়দান থানায় পৌঁছোলাম।

থানায় প্রবেশ করে ইনভেস্টিগেটরস রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম রণিদা আর আমি। ঘরে ঢুকতেই আইও রাতুল রায় বলে উঠলেন, গুড আফটারনুন মি. চক্রবর্তী।

গুড আফটারনুন মি. রায়, রণিদা প্রত্যুত্তর দেয়, আমি হাসি।

বসুন, একটু চা চলবে কি?

হ্যাঁ, হলে মন্দ হয় না। কিন্তু আপনার আসামি কই মি. রায়?

এক্ষুনি আনাচ্ছি, বলে মি. রায় অপেক্ষাকৃত উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, সেন্ট্রি, সেন্ট্রি।

স্যার ডাকছেন? এক রাইফেলধারী স্মার্ট ইউনিফর্মে।

হ্যাঁ, লক আপ থেকে আমার আসামিটাকে বের করে আনুন তো একটু।

স্যার, বলে চলে গেলেন সেন্ট্রি কনস্টেবল।

একটু পর আমাদের সামনে যে-মানুষটিকে উপস্থাপিত করা হল, তাকে দেখা মাত্র যে কেউ একবাক্যে খুনি বলে ধরে নিতে দ্বিধা করবে না।

ময়লা রং, দোহারা চেহারায় বলিষ্ঠ গড়ন। উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট সাত-আট হবে। চোখে রক্তাভা। মুখে দাড়ি-গোঁফ অপরিচ্ছন্ন। দৃষ্টিতে বিষণ্ণতা ও রুক্ষতার এক অদ্ভুত মিশেল।

একটি বিশেষ জিনিস লক্ষ্য করলাম, এসব ক্ষেত্রে সাধারণত অপরাধীরা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু এই লোকটির তেমন হাবভাব দেখা গেল না। কেমন একটি কৗতূহলী দৃষ্টি মেলে আমাদের দিকে তাকাল মানুষটি। মনে হল, আমাদের জরিপ করছে, মুখে কিছু বলল না।

রাতুলবাবু বললেন, এই হতভাগা, ওনারা যা যা জিজ্ঞাসা করেন ঠিক ঠিক উত্তর দিবি।

কেবল ঘাড় নাড়ল লোকটি, মুখে কিছু বলল না।

রণিদা প্রথম প্রশ্ন করল, আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন রাধেশ্যামবাবু?

রণিদার ব্যবহারে কেবল দারোগাবাবুই নয় আমিও বিস্মিত হলাম, কারণ ওর গলার সুর কেমন যেন ভ্রাতৃসুলভ মমতা মাখা। একবার রণিদার দিকে, একবার রাধেশ্যামের দিকে চাইলাম।

উত্তর কাশী, ছোট্ট জবাব এল।

নিশ্চয়ই বেড়াতে?

হ্যাঁ।

আপনি কি একাই গেছিলেন, না সঙ্গে কেউ ছিল? মানে বন্ধুবান্ধব আর কি।

কেউ না, আমি একাই গেছিলাম।

এরকম প্রায়ই যান?

হ্যাঁ, মাঝেমধ্যেই। পকেটে কিছু টাকা-পয়সা এলেই বেরিয়ে পড়ি এদিক সেদিক।

কীভাবে আসে ওগুলি?

মানে?

বলছি টাকা-পয়সা সাধারণত কীভাবে আপনার হাতে আসে, আই মিন, ঠিক কী করেন আপনি?

এবার মানুষটি চোখ নামায় নীচের দিকে, কোনও জবাব দেয় না।

উত্তর দেন রাতুলবাবু, কী আর করবে? মস্তানি, তোলাবাজি, লোককে ভয় দেখানো– এই সবই করে বেড়ায়। হয়তো ব্যাটা

ড্রাগস-ফাগসের ব্যাবসাও করে। খবর আমি পেয়ে যাব খুব শিগগির। তারপর দেখাচ্ছি ব্যাটাচ্ছেলেকে।

বাবার সম্পত্তির সত্তর ভাগ দাবি করেছিলেন আপনি?

রাধেশ্যাম নিরুত্তর।

আপনার মনে হয়নি এটা অন্যায্য?

দাদা তো সরকারি চাকরি করে, প্রচুর টাকা। সত্তর পারসেন্ট আমাকে দিতে আপত্তি কোথায়? কেউ না জানুক আমি তো জানি দাদার চাকরিটা বাবাই করে দিয়েছিলেন।

রণিদা আর ওই প্রসঙ্গে কথা বাড়াল না, অন্য দিকে এগোল। কাল ক’টার সময় ফিরেছেন?

হাওড়ায় পৌঁছেছি রাত নটা নাগাদ।

সোজা বাড়ি এলেন?

হ্যাঁ।

পথে, আই মিন, পাড়ায় কোনও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা হল না কাল?

না।

দাদার মৃত্যুর খবরটা জানতেন?

না, বাড়ি এসে শুনলাম।

কে বলল? বউদি?

না, কাজের লোক।

বউদি, ভাইপো-ভাইঝিদের সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কেমন?

একটু ভেবে জবাব দিল, মনে হয় ওরা কেউই আমাকে পছন্দ করে না। আমার অবশ্য ওদের কারও ওপর কোনও রাগ নেই।

বাড়ি এসে কী করলেন?

স্নান করে খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। মাঝরাতে অফিসার আমাকে তুলে নিয়ে এলেন। বোধহয় বউদি ফোন করেছিল।

এ ব্যাটারও সিগারেটের নেশা আছে, বুঝলেন মি. চক্রবর্তী? আবার ব্রান্ডটাও উল্লেখযোগ্য, বললেন রাতুল রায়।

রণিদা আর আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম।

চারমিনার, চোখে হাসির ঝিলিক দিল ভদ্রলোকের।

তাই নাকি? প্রশ্নটা ছিল রাধেশ্যামের প্রতি।

রণিদার প্রশ্নের উত্তরে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল ও।

আচ্ছা, রাধেশ্যামবাবু… দাদার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি কোনও দিনই ভালো ছিল না?

নাহ্, কোনও দিনই না, তবে…

তবে কী?

তবে একটি কথা আমি আপনাকে দিব্যি করে বলতে পারি যে দাদাকে আমি খুন করিনি, বিশ্বাস করুন, দাদাকে খুন আমি করিনি।

মানুষটার চোখে-মুখে কেমন একটি অসহায়তা ফুটে উঠল।

হ্যাঁ, হ্যাঁ ধরা পড়ার পর সববাই একই কথা বলে, বলল পুলিশ অফিসার।

বিষয়টা রণিদার চোখও এড়াল না বোধ হয়। তবে একই সঙ্গে কোনও সিমপ্যাথেটিক ওয়ার্ডও বেরোল না ওর মুখ থেকে। কেবল ঝকঝকে ব্লেডের ধারালো দৃষ্টিতে রাধেশ্যামের চোখে চোখ রেখে তাকাল একবার।

তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে অফিসারকে প্রশ্ন করল, একে নিয়ে আপনার পরবর্তী পদক্ষেপ কী মি. রায়?

ওর কয়েক পাতা হাতের লেখা আগামীকাল ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্পেসিমেন রাইটিংস হিসাবে নেব। তারপর সেগুলি পাঠাব এক্সপার্টের কাছে।

একবার যে পাঠালেন?

ওগুলি ওর বহুদিন আগের লেখা। কনটেমপোরানিয়াস রাইটিংস পেলে রিপোর্ট পজিটিভ হবার সম্ভাবনা বাড়ে।

তাহলে তো আবার ডিসির ফরোয়ার্ডিং লাগবে?

না, দ্বিতীয়বার একই কেসে ডকুমেন্ট অ্যাডিশন করলে সেক্ষেত্রে ডিসির ফরোয়ার্ডিং না হলেও চলে।

আচ্ছা, এগুলি এগজামিনেশনের জন্য কোথায় পাঠান আপনারা?

ভবানী ভবনে।

ওটা তো বেঙ্গল পুলিশের আন্ডারে, আই মিন, সিআইডি-র হেডকোয়ার্টার তাই না?

হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন।

কেন আপনাদের ক্যালকাটা পুলিশে ডকুমেন্ট এগজামিনেশনের কোনও ইউনিট নেই?

এখনও পর্যন্ত তো নেই, হেসে জবাব দিলেন অফিসার।

তা কত দিন লাগতে পারে রিপোর্ট পেতে?

আগে তো এক সময় এক দেড় বছর লাগত রিপোর্ট পেতে, এখন ওখানে এক ঝাঁক ইয়ং এক্সপার্ট আসায় রিপোর্ট আমরা মানে আইওরা এক-দেড় কি বড়ো জোর দুমাসের মধ্যেই পেয়ে যাচ্ছি।

গুড, কোনও ভাবে রিপোর্টটা তাড়াতাড়ি পাওয়া যায় না?

হতে পারে, স্পেশাল কিছু কেসের ক্ষেত্রে। সেক্ষেত্রে ডিসির একটি প্রায়োরিটি লেটার দিতে হয় কেসের গুরুত্ব উল্লেখ করে, দ্রুত জবাব দেন অফিসার।

দেখুন কী করা যায়? আর সিগারেটের স্পেসিমেনটা নিয়ে কী করবেন ভাবছেন?

এক্ষুনি ওটা এগজামিন করাতে চাইছি না, কারণ টেস্টটাতে প্রচুর খরচ। তাই গভর্নমেন্টের পারমিশন পেতে একটু ঝামেলা হয়। আর একটু কনফার্ম হয়ে নিই, তারপর পাঠাবার কথা ভাবব।

ঠিক আছে মি. রায়, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, এভাবে সহযোগিতার জন্য। ইন ফ্যাক্ট, এই রাধেশ্যাম মণ্ডলকে জেরা করাটা আমার কাছে ভাইটাল ছিল। আজ আসি, ফোনে আপনার সঙ্গে টাইম টু টাইম যোগাযোগ রাখব।

বাই, হাত নাড়লেন মি. রায়।

থানা ছেড়ে আমরা রওনা হলাম বাড়ির পথে।

হঠাৎ রণিদা বলল, চল তোর বাড়ি যাই, একটু আড্ডা মারব জমিয়ে।

চলো, এতে আর বলার কী আছে?

গাড়ি চলছিল মাঝারি গতিতে। গান চালাল রণিদা।

আমি জানালা দিয়ে পথশোভা দেখছি। মাথার মধ্যে ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে ভাবনাচিন্তার ভোমরাগুলি। হঠাৎ বললাম, রণিদা এটা কি ঠিক হচ্ছে?

কোনটা?

এই যে তদন্তের মাঝে মাঝে তুমি ঢোলগোবিন্দবাবুকে বাদ দিয়ে দিচ্ছ, সঙ্গে নিচ্ছ না। হাজার হোক ভদ্রলোক তোমার কাছে গোয়েন্দা হবার ট্রেনিং নিতেই এসেছেন। শেষে হয়তো বলে বসবেন, আমরা কৃতিত্ব নেবার জন্য নিতান্ত স্বার্থপরের মতন কাজ করেছি ইত্যাদি, ইত্যাদি।

তুই তো সারাক্ষণ আমার সঙ্গেই আছিস, কী কী ঘটেছে তার একটি ডিটেলস রিপোর্ট দিয়ে দিবি গোবিন্দদাকে, রাস্তার দিকে চেয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে বলছিল কথাগুলি তবে মনে হল, কোনও গভীর ভাবনায় ডুবে আছে।

বাড়ির কাছাকাছি আসতেই রণিদা বলে উঠল, তুই নেবে যা রঞ্জন। আজ তোর বাড়ি ঢুকব না। বেশ কিছু খবর নেওয়া বাকি। পরে ফোন করিস।

অবাক হলাম না। ওর আচার-আচরণ আমার পরিচিত। জানি, এখন হাজার রিকোয়েস্ট করলেও বাড়িতে নিয়ে গিয়ে এক কাপ চা ওকে খাওয়াতে পারব না। অগত্যা বাধ্য ছেলের মতন বললাম, ক’টা নাগাদ ফোন করব বলো।

এই সাতটা-সাড়ে সাতটা নাগাদ, আসছি।

গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যায় রণিদা।

পর্ব – ৯

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ রণিদাকে ফোন করলে ও বলল, একবার চলে আয় এ বাড়ি।

নির্দেশ পাওয়ামাত্র আমি একটি ট্যাক্সি নিয়ে রওনা হলাম।

রণিদার বাড়ি পৗঁছে দেখলাম পরিবেশ বেশ গুরুগম্ভীর।

দোতলার ড্রয়িংরুমে রণিদার ঘরে ডিম লাইট জ্বলছে। নীচু স্কেলে বাজছে রবীন্দ্রসংগীত।

দরজার দিকে পিছন করে সোফায় ঘাড় এলিয়ে বসে আছে রণিদা, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।

পা টিপে টিপে যথাসম্ভব সতর্কতাসহ ঘরে ঢুকলাম।

রণিদা টের পেয়ে গেল তবুও, বলল রঞ্জন বস। হরিদা এক্ষুনি কফি নিয়ে আসবে। মিনিট দশেকের মধ্যেই বেরোব।

সোফায় দেহ রাখলাম আমি।

রণিদা আর কোনও কথা বাড়াল না। এক মনে সিগারেট ফুঁকে ফুঁকে রিং বানাতে লাগল অভ্যাস মতন। বুঝলাম, ভাবনায় ডুবে আছে।

হরিদা তিন কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে এলে আমি জিজ্ঞাসু চোখে রণিদার দিকে তাকালাম।

আসছে, হাত নেড়ে আমায় আশ্বস্ত করল রণিদা।

ঠিক সেই সময় লোহার গেটের ঠকাং করে আওয়াজ পেলাম। বুঝলাম তৃতীয় কাপটি ঢোলগোবিন্দবাবুর জন্য।

মিনিট দুয়েকের মধ্যে ভদ্রলোকের মোলায়েম কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কী হে ভায়া, ঘর অন্ধকার করে বসে আছো সন্ধেবেলা?

হাত বাড়িয়ে সুইচ টেপে রণিদা, মুহূর্তে টিউবের আলোয় হেসে উঠল গোটা ঘর।

চোখ সইয়ে দেখলাম বেরোবার জন্য রণিদা একদম রেডি।

রণিদা বলল, কফি নিন গোবিন্দদা।

ভারী মানুষ, ধপাস করে বসে পড়লেন সোফায়। বললেন, দাঁড়াও একটু দম নিয়ে নিই। একদম তৈরি হয়েই আছো দেখছি।

উনি কফি তুলে নিলেন হাতে, একটি দীর্ঘ সিপ দিলেন।

রণিদা উঠে দাঁড়াল, বলল, আর পাঁচ মিনিট কিন্তু আমাদের হাতে টাইম আছে গোবিন্দদা।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল ও।

কফি খেতে খেতে ঢোলগোবিন্দবাবুর সঙ্গে আমার কথাবার্তা হচ্ছিল। বেশিরভাগটা উনিই বলছিলেন, আমি কেবল শুনছিলাম। তদন্তের মাঝে উনি বাদ পড়ে যাওয়ায় অনুযোগের শেষ ছিল না। হঠাৎ খেয়াল হল, নীচ থেকে গাড়ির হর্নের আওয়াজ আসছে।

বুঝলাম ডাকছে রণিদা।

গাড়িতে উঠে ও বলল, বল দেখি রঞ্জন, কোন দিকে যাব আমরা এখন?

কোথায় আর, ঘনশ্যাম মণ্ডলের বাড়ি, বিজ্ঞের মতন জবাব দিলাম আমি একটুও না ভেবেই। আন্দাজে ঢিল মারলাম একটি।

গুড, হেসে বলল রণিদা।

ঢিলটা তা হলে লেগে গেল ঠিক জায়গায়, মনে মনে বললাম।

গাড়িতে যেতে যেতে ঢোলগোবিন্দবাবু আচমকা বলে উঠলেন, আমার মনে হয় মিথ্যেই আমরা দৌড়ঝাঁপ করে মরছি এখন।

তার মানে? আমি অবাক, খানিকটা বিরক্তও।

এটাই স্বভাব ভদ্রলোকের, মাঝে মাঝে এমন সব উৎপটাং কথা বলে বসেন যে আমরা তাজ্জব হয়ে যাই। অবশ্য এ জন্য ওনাকে ভালোও লাগে।

মানে, বলতে চাইছি কেসটা অলরেডি ডিটেকটেড, বেশ গম্ভীর দেখায় ওনাকে।

কী বলতে চাইছেন দয়া করে ঝেড়ে কাশবেন একটু?

ব্যাপারটা জলবৎতরলং অর্থাৎ কিনা জলের মতো তরল। ঘনশ্যামবাবুকে হত্যা করেছে তার ভাই রাধেশ্যাম মণ্ডল। কিন্তু সে এই কাজ একা করেনি।

আমি মুখে কোনও কথা বললাম না, বুঝতে পারলাম উনি সাসপেন্স বাড়াতে চাইছেন।

রণিদার কোনও ভাবান্তর হল কি না বুঝতে পারলাম না। পিছনের সিটের কথাবার্তা ওর কানে যাচ্ছে বলেও মনে হল না, গাড়ি চালানোতেই ব্যস্ত ও।

একটু থেমে দ্বিগুন উৎসাহে ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন, রাধেশ্যাম এই কাজ করেছে ওর বন্ধুদের সহযোগিতায়। নিশ্চয়ই তোমাদের মনে আছে সেদিন মিসেস মণ্ডলের কথাগুলি?

কোন কথার কথা বলছেন আপনি?

ওই যে ভদ্রমহিলা বললেন না, পাড়ার কিছু রাউডির সঙ্গে ঘনশ্যামবাবুর চাঁদা নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল? ওরা যাবার আগে দেখে নেবে বলে শাসিয়েও ছিল?

তাতে হলটা কী?

এ তো সহজ সমীকরণ–রাধেশ্যাম মণ্ডল নিজেও একটি রাউডি। ওর নিজস্ব লোকজন আছে। খুবই দুর্নাম ওর। শাসিয়ে যাওয়া বদমায়েশগুলির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা ওর পক্ষে মোটেও কঠিন নয়। আমি বলছি, ও সেটাই করেছে–ওই দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজের দাদাকে সরিয়ে দিয়েছে। এতে দু’পক্ষেরই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল। আরে রামায়ণ পড়োনি নাকি?

ওনার এ যাবৎ ব্যাখ্যাটা মোটামুটি খারাপ লাগেনি, হলে হতেও পারে। কিন্তু এর সঙ্গে রামায়ণের মিল কোথায় বুঝলাম না। তাই প্রশ্ন করলাম, এতে রামায়ণ পেলেন কোথায় আপনি?

কেন কিষ্কিন্ধা কাণ্ড, সুন্দরা কাণ্ডের কথা একবার মনে কর–সুগ্রীব-বিভীষণ–নাহ্, কিছু পড়াশোনা নেই তোমার দেখছি। এই বিদ্যা নিয়ে তুমি রিপোর্টারগিরি করছ? ছ্যা, ছ্যা।

শুনতে পেলাম রণিদা বেশ শব্দ করে হেসে উঠল।

ভীষণ রাগ হল আমার। কিছু বললাম না তখনকার মতন, ভাবলাম একবার বাগে পাই, লেগপুল করা বার করছি।

সত্যি! কী দারুণ ব্রেন আপনার গোবিন্দদা, কত সহজে মামলাটার সমাধান করে ফেললেন, বলল রণিদা।

তুমি দেখে নিও ভায়া পুলিশও শেষ পর্যন্ত ব্যাটাচ্ছেলের কাছ থেকে এই কথাই বার করবে। ওকে পিসিতে টেনেছে কি আর এমনি এমনি? চার ডান্ডা লাগালেই দেখবে হুড়মুড় করে সব কথা বেরিয়ে আসছে, সহাস্য জবাব এল ঢোলগোবিন্দবাবুর কাছ থেকে।

পুলিশের আর সে সুদিন নেই দাদা, আসামী কিংবা সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে ডান্ডা লাগাতে গেলে পুলিশ নিজেই এখন ঠান্ডা হয়ে যাবে, হেসে বললাম আমি, হিউম্যান রাইটস্ বলে একটি কথা আছে শুনেছেন নিশ্চয়ই? আমাদের দেশ এখন সেই রাইটস্ মানুষের ওপর, বিশেষত আসামীদের ওপর বলবৎ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ফলে থানায় পুলিশ, আসামীদের মারধোর করার পরিবর্তে গরম দুধ খাওয়ায়, দুবেলা ডাক্তার দিয়ে চেক আপ করায় শুধু নিজের চাকরি বাঁচাতে। জানেন কিছু? এবার পারলে নিজের চোখে দেখে আসুন গিয়ে।

এতক্ষণ পর একটু স্বস্তি লাগছে, বেশ করে ঝেড়ে দিয়েছি, বলে কিনা কিছু পড়াশোনা নেই।

সে যাই হোক, পুলিশের অনেক উপায় আছে কথা বার করার জন্য, ঢোলগোবিন্দবাবু সিদ্ধান্তে অবিচল।

দেখা যাক, তবে আমার কিন্তু কেসটা মোটেও সরল বলে মনে হচ্ছে না, কারণ রণিদাকে এর আগে এতটা সিরিয়াস হতে দেখিনি কখনও, আমি বললাম।

আমার কথায় রণিদা সামান্য হেসে বলল, আমাকে বুঝি খুবই সিরিয়াস দেখাচ্ছে?

ঘনশ্যাম মণ্ডলের বাড়ি পৗছে দরজায় বেল টিপলাম। দরজা খুলে দিলেন মিসেস মণ্ডল। ওনার প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হল রণিদা আমাদের আসার কথা আগেই ফোনে জানিয়ে দিয়েছিল।

ঘরে গিয়ে বসতে মিসেস মণ্ডল ওনার ছেলে এবং মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে আমাদের সকলের আলাপ করিয়ে দিলেন।

আজ ভদ্রমহিলাকে অনেকটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। ব্যবহারে যথেষ্ট আন্তরিকতা লক্ষ্য করলাম।

কথাবার্তা শুরু করল রণিদা।।

মিসেস মণ্ডল, আপনি নিশ্চয়ই চান আপনার স্বামীর হত্যাকারী ধরা পড়ুক?

সে তো অবশ্যই চাই, বললেন ভদ্রমহিলা।

সে ক্ষেত্রে আমি কি আপনাকে একটু ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্ন করতে পারি? আপনার উত্তরের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

রণিদার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যে মুহূর্তে পরিবেশটা একদম বরফঠান্ডা হয়ে পড়ল।

ভদ্রমহিলা সহজ ভাবেই বললেন, বলুন কী জানতে চান?

এখন থেকে মাস আটেক আগে অর্থাৎ জুলাই মাস নাগাদ বা তার কাছাকাছি সময়ে আপনি কি কোনও বড়ো-সড়ো অসুখে পড়েছিলেন।

আমি? অসুখে!

ভদ্রমহিলা বুঝি আকাশ থেকে পড়লেন। হয়তো বা তার অসুস্থতার সঙ্গে খুনি ধরা পড়বার যোগাযোগটা ঠিক কোথায়–এ কথা ভেবেই তার বিস্ময় বাড়ল।

একটু ভেবে নিয়ে উনি জবাব দিলেন, ছোটোখাটো কিছু হলে হতে পারে কিন্তু তেমন বড়ো কিছু তো মনে পড়ছে না।

এমন কোনও রোগ বা অপারেশন যার জন্য লাখ তিনেক টাকা লাগতে পারে? রণিদা আরও গভীরে যায়।

তিন লাখ! না, না অমন কোনও কিছু আমার কেন, আমার পরিবারের কারও কোনও দিন হয়নি যার চিকিৎসায় অত টাকা ব্যয় হতে পারে।

বাড়ি ঘরের রেনোভেশান কিছু হয়েছিল ওই সময়?

না, হয়নি তো। আচ্ছা, ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন আমাকে? মিসেস মণ্ডল বলেন।

আপনার স্বামী ঘনশ্যাম মণ্ডল গত জুলাইতে তিন লাখ টাকা পিএফ থেকে তোলেন আপনার চিকিৎসার জন্য। আই মিন ওই গ্রাউন্ডে।

তাই নাকি! উনি বেশ অবাক হলেন বলে বোধ হল।

অর্থাৎ ব্যাপারটা আপনার অজানা?

এ প্রশ্নের উত্তরে মিসেস মণ্ডলকে খানিকটা অপ্রস্তুত লাগল। উনি আমতা আমতা করে বললেন, আসলে কী জানেন, টাকা পয়সার ব্যাপারে যা কিছু সিদ্ধান্ত বরাবর ও একাই নিত। আমার সঙ্গে কোনও আলাপ-আলোচনা করত না। তা নিয়ে অবশ্য কোনওদিন আমার কোনও অভাব-অভিযোগ ছিল না।

একটু থেমে উনি আবার বলতে থাকেন, লোকাল ব্যাংকে ওর সঙ্গে আমার একটি জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট ছিল। তাতে কিছু টাকা-পয়সা থাকত ঠিকই তবে আমার মনে পড়ে না শেষ কবে আমি ব্যাংক থেকে নিজে সই করে টাকা তুলেছি।

অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন, মণ্ডলবাবু যদি ওই পরিমাণ টাকা তুলেও থাকেন সেটা আপনি জানেন না, তাই তো?

সম্মতিজ্ঞাপক মাথা নাড়েন ভদ্রমহিলা।

সে ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে গেল, বলল রণিদা তবে ইন্ডিয়ান ল অনুযায়ী স্বামীর অবর্তমানে ওনার যাবতীয়

স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিক এখন আপনি। তাই এখন নিশ্চয়ই ওগুলি নাড়াচাড়া করার অসুবিধা নেই আপনার?

দেখুন অসুবিধা আগেও ছিল না। কোনও দিন কোনও প্রয়োজনে টাকার দরকার হলে কোনও কারণ জিজ্ঞাসা করেনি ও। কেবল জানতে চাইত কত দিতে হবে? আমাদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ছিল অটুট। আসলে আমি ঘর-সংসার নিয়েই ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসতাম বরাবর। টাকা-পয়সা-সম্পত্তির ব্যাপারে কোনওদিন কিছু জানতে চাইনি, আগ্রহও হয়নি তেমন।

কথাটা ঠিক আমি ওভাবে বলতে চাইনি মিসেস মণ্ডল, রণিদা বলল, এই কেসের স্বার্থে ওই টাকাটার হদিশ আমাকে বের করতেই হবে কারণ ওটাই মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।

সোফা ছেড়ে রণিদা উঠে পায়চারি করতে লাগল ঘরের মধ্যে। বিড়বিড় করে বলতে লাগল, একজন সংসারি হিসেবি মানুষ আচমকাই তিন লাখ টাকা পিএফ থেকে তুললেন বিশেষ কোনও কারণ ছাড়াই? যত দূর জানা যায় মানুষটি সৎ, কোনও বদ নেশা তার ছিল না যে তাতে তিনি পয়সা উড়িয়ে দেবেন। বরং বলা যায় উনি যথেষ্ট সঞ্চয়ী। তা হলে ধরে নিতে হবে টাকাটা উনি এমন কোনও কিছুতে ইনভেস্ট করতে চেয়েছিলেন যাতে জিপিএফ-এর ধরা বাঁধা ইন্টারেস্টের থেকে লাভ বেশি পাওয়া যেতে পারে। সেটা কী?

পায়চারি করাকালীন বাম হাতের তালুতে মুষ্টিবদ্ধ ডানহাতখানা দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করছিল রণিদা। তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, দেখুন মিসেস মণ্ডল, গত জুলাইতে ঘনশ্যামবাবু পিএফ থেকে তিন লাখ টাকা তুলে ছিলেন এটা ফ্যাক্ট। অফিস নিশ্চয়ই টাকাটা ওনাকে ক্যাশে দেয়নি, চেকে দিয়েছিল। তাহলে সেই চেক এনক্যাশও হয়েছিল, টাকাটা ওনার অ্যাকাউন্টে থাকার কথা। ব্যাপারটা হয়তো খুবই পার্সোনাল, তবু বাধ্য হয়েই বলছি, দয়া করে ওনার ব্যাংকের পাশবইটা যদি একটু নিয়ে আসেন… রণিদা ইতস্তত করে।

রণিদার কথা সম্পূর্ণ হতে না হতেই ভদ্রমহিলা বললেন, একটু অপেক্ষা করুন, আমি নিয়ে আসছি।

ইতিমধ্যে চা ও জলখাবার নিয়ে এল কাজের লোক। মিসেস মণ্ডলের মেয়ে একে একে আমাদের হাতে তুলে দিলেন ওগুলি।

মিনিট তিনেকের মধ্যেই ভদ্রমহিলা তিনখানি ব্যাংকের পাশবই নিয়ে এসে রণিদার হাতে দিয়ে বললেন, দেখুন মি. চক্রবর্তী, আলমারির লকারে এই তিনটি পাশবই আমি পেলাম, সঙ্গে চেকবইগুলিও নিয়ে এসেছি।

দারুণ কাজ করেছেন, এগুলিও দরকার, কোনওমতে বলল রণিদা।

ওকে এত উত্তেজিত হতে আগে কখনও দেখিনি। প্রায় ছোঁ মেরেই ভদ্রমহিলার হাত থেকে পাশবইগুলি নিয়ে গভীর আগ্রহ ও উৎকণ্ঠা ভরে সেন্টার টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে রণিদা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল ওগুলি।

দ্রুত দুটি পাশবই দেখেই সরিয়ে রাখল পাশে। তারপর তৃতীয় বইটি খুলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বুঝি অভীষ্ট লাভ হল ওর।

বলল, এই তো তিন লাখ টাকা এনক্যাশ হয়েছে। কিন্তু একি! একদিন পরই ওই অ্যামাউন্টটা সাইফন হয়ে গেছে। কিন্তু গেল কোথায় টাকাটা? চেক বইটা একবার দেখি। কনসার্ন ব্যাংকের চেক বই-এর পাতা ওলটাতে লাগল দ্রুত… শেষ পাতায় সাধারণত সবাই লিখে রাখে কোন চেক কবে কাকে দেওয়া হল… এই তো গত আঠাশে জুলাই তিন লাখ টাকার একটি চেক ইস্যু করা হয় সঞ্জীব আগরওয়াল নামে এক ব্যক্তিকে। নামটার পাশে ব্র্যাকেটে আবার লেখা কে কে, সারপ্রাইজিং।

আচ্ছা মিসেস মণ্ডল, এই আগরওয়ালাকে আপনি চেনেন? সঞ্জীব আগরওয়াল?

আগরওয়াল। হতভম্ব দেখাল ভদ্রমহিলাকে। ওই নামের কোনও লোকের সঙ্গে ওর আলাপ ছিল বলেও কোনও দিন শুনিনি।

আপনারা কেউ? রণিদা ওনার ছেলে-মেয়ের দিকে তাকায়।

না। দুজনেই মাথা নাড়ে।

রণিদা তখন আবার চেকবইটার ওপর ঝুঁকে পড়ল। বিড়বিড় করে বলতে লাগল, আরে এখানে দেখছি সঞ্জীব আগরওয়াল, মনিশ রূংটা, শিশুমার পোড়েল এদের বেশ কয়েকবার চেক ইস্যু করা হয়েছে। অবশ্য সব ক্ষেত্রেই অ্যামাউন্টটা কম ছিল, বিশ-পঁচিশ হাজারের মধ্যে।

বলা বাহুল্য, আমিও হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলাম চেক বইয়ের ওপর।

ঢোলগোবিন্দবাবুকে অবশ্য খানিকটা নিস্পৃহ দেখাল এ ব্যাপারে। উনি এক মনে খাদ্যবস্তুগুলির সদ্ব্যবহারে ব্যস্ত। ওই ব্যাপারটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হল ওর ক্ষেত্রে।

রণিদা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনারা তা হলে এই চেক বই মারফত মি. মণ্ডল কাকে কখন কী পরিমাণ টাকা দিচ্ছেন তার কোনও খবরাখবর জানেন না?

না, মা ও ছেলে-মেয়ে সকলেই মাথা নাড়েন। জামাইকে ঘরে দেখা গেল না।

রণিদা তখন পাশবই ও চেকবইগুলি মিসেস মণ্ডলের হাতে তুলে দিয়ে বলল, এগুলি যত্ন করে তুলে রাখুন।

হাত বাড়িয়ে ভদ্রমহিলা ওগুলি নিলেন।

রণিদা এগিয়ে এসে এবার চা-টা তুলে নিয়ে বেশ বড়ো একটি সিপ দিয়ে আবার টেবিলে নামিয়ে রাখল। একটু পায়চারি করে সোফায় এসে বসল। এক মনে চা খেল।

কেউ কোনও কথা বলছিল না।

চা শেষ হলে উঠে দাঁড়াল রণিদা। তারপর বলল, মিসেস মণ্ডল, অনেক কষ্ট দিলাম আপনাকে। এ বিষয়টা জানা আমার অত্যন্ত জরুরি ছিল। বিষয়টা জানার পরও অনেকটাই অজানা রয়ে গেল। দেখি কী করা যায়। তবে আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন–কাল-পরশুর মধ্যেই প্রকৃত খুনিকে আমি ধরে ফেলব।

কিন্তু পুলিশ তো ঠাকুরপোকে ধরে নিয়ে গেছে, কী সব

প্রমাণ-ট্রমানও নাকি পেয়ে গেছে মিসেস মণ্ডল বললেন।

হ্যাঁ, ওদের ইনভেস্টিগেশন ওদের মতন চলুক, আমারটা আমার মতন, হাসল রণিদা।

আসলে রণিদাকে দারুণ কনফিডেন্ট দেখায়।

আজ আসি, বিদায়, বলল রণিদা।

আমি ও ঢোলগোবিন্দবাবুও উঠে দাঁড়িয়ে ওকে অনুসরণ করলাম। ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে বসলাম। গাড়ি এগিয়ে চলল।

আশুতোষ মুখার্জী রোডের দিকে বেরোই, কী বল? রণিদা বলল, আচ্ছা, আজ তোর বাড়ি গেলে কেমন হয়?

কালকের মতন? হেসে জবাব দিলাম।

না, না আজ পাক্বা, হাসল রণিদাও।

গাড়ি চারুমার্কেট রেলব্রিজের তলা দিয়ে এগিয়ে চলল। আনায়োর শা মোড়টা টপকাতেই হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেল এক বিশেষ দৃশ্যে–চিনতে মোটেও ভুল হবার নয়, কমলেশ খাস্তগীর।

পাশে বসে থাকায় রণিদাকে কনুই দিয়ে গুঁতো মারতে সুবিধা হল। গুঁতো মেরে বললাম, রণিদা, খাস্তগীর।

ইঙ্গিত মাত্রই রণিদার চোখ পড়ল ওই দিকে।

নিজের গাড়িতে হেলান দিয়ে ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে ময়লা এক লুঙ্গিপরা মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন।

রণিদা খানিকটা স্লো করেই স্পিড বাড়াল গাড়ির।

বিড়-বিড় করে বলল, মুন্না। ওর সঙ্গে খাস্তগীরের কী কথা থাকতে পারে?

তুমি চেন ওই লোকটাকে?

হ্যাঁ, মুন্না এদিককার একটা সাট্টা ডনের পেনসিলার। কিন্তু ওর সঙ্গে কমলেশ খাস্তগীর… তা হলে কী… তাই যদি হয়… দুয়ে দুইয়ে চার হতে… চমৎকার রঞ্জু, মনে হচ্ছে মেঘ সরে যাচ্ছে বুঝলি… ক্রমশ ফরসা হচ্ছে আকাশ।

আমি হাঁ করে ভ্যালভ্যালে দৃষ্টি মেলে রণিদাকে দেখলাম। মেঘ কেটে কোথায় যাচ্ছে কে জানে?

রণিদার সামনে নিজেকে মাঝে মাঝে বড়ো আন-স্মার্ট লাগে।

সম্ভবত আমার চোখ-মুখ দেখেই ফিক করে হাসল রণিদা, বলল তোকে দারুণ দেখাচ্ছে জানিস?

নিজেকে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে সচেষ্ট হলাম।

বাড়ি এসে ঝপাঝপ গাড়ি থেকে আমি আর ঢোলগোবিন্দবাবু নামলাম।

রণিদা বলল, তোরা এগো, মাসিমাকে বল চা খাব। কড়া করে। গাড়িটা পার্ক করে সিগারেট নিয়ে এক্ষুনি আসছি। সিগারেট শেষ।

আমি দরজায় বেল বাজালাম।

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...