পর্ব – ১০

চা খেতে খেতে রণিদা বলল, একটু তাস খেললে কেমন হয় রঞ্জন?

আমি অবাক, কেসটা এমন এক পর্যায়ে এসে থমকে আছে, কোথায় রণিদা তাই নিয়ে ডিসকাস করবে, তা নয় হঠাৎ তাস খেলার প্রস্তাব?

একটু আমতা আমতা করে বললাম, হ্যাঁ, সে তো খেলাই যায়। কিন্তু আর একজন পার্টনার লাগবে যে?

কেন শুক্লা নেই?

বোন তো কলেজে গেছে, বললাম আমি।

ওঃ হো, ওর তো আবার ইভনিং কলেজ। ঠিক আছে তা হলে এক কাজ কর–দাবাটা নামা, এক হাত খেলা যাক।

অগত্যা দাবা নামানো হল, সাজানো হল ঘুঁটি।

রণিদা বলল, আসুন গোবিন্দদা, দেখি আজকে আপনি হারতে কতক্ষণ সময় নেন?

ঢোলগোবিন্দবাবু বললেন, এমন একটি ভাব করছ যেন তুমি বিশ্বনাথন আনন্দ। নেহাত দাবাটা আমি তেমন ভালো জানি না তাই মাঝেমধ্যে হেরে যাই তোমার কাছে।

মাঝেমধ্যে?

ওই হল আর কী।

খেলা আপনি ভালোই জানেন দাদা, যেটা জানেন না সেটা হল সঠিক চাল। আর সেটা দিতে এটাতে কিছু থাকতে হয়, নিজের মাথায় টোকা মেরে রণিদা ঘিলুর ইঙ্গিত করে।

এটা কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে রণি, এত অহংকার ভালো নয়।

বেশ, তবে বাজি ধরা যাক, বলল রণিদা।

কী বাজি?

যদি আমি আপনাকে দশ মিনিটের মধ্যে হারাতে পারি তবে কাল আপনি আমাদের দু’জনকে রেস্টুরেন্টে খাওয়াবেন, আর যদি আপনি আমাকে হারাতে পারেন বা আমি হারতে দশ মিনিটের বেশি সময় নিই তা হলে কাল আমরা দু’জন আপনার খরচে রেস্টুরেন্টে খাব।

ঢোলগোবিন্দবাবু এক মনে ঘুঁটি সাজাচ্ছিলেন।

রণিদার কথাটা উনি প্রথমে ধরতে পারলেন না। কিন্তু সেটা বোধগম্য হওয়া মাত্র নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, এটা কেমন কথা হল ভায়া? খেলায় আমি হারি বা জিতি, যাই রেজাল্ট হোক না কেন আমাকেই খাওয়াতে হবে?

আমি হো-হো করে হেসে উঠলাম। বললাম সেই মহান শর্তটার কথা মনে আছে ঢোলগোবিন্দবাবু?

কোনটা ভাই?

ওই যে, হয় তুই মাছের লেজা খা, আমি মাছের মাথা খাই, না হয় আমি মাছের মাথা খাই, তুই মাছের লেজা খা।

দুজনেই হাসিতে যোগ দিল।

এমন সময় মা আমাদের জন্য চা আর ডালমুট নিয়ে এল। রণিদাকে দেখে বলল, ভালো আছ বাবা?

হ্যাঁ, আপনি ভালো তো মাসিমা?

আর বাবা ভালো, আমাদের এই বয়সে কি আর ভালো থাকা যায়? ওই আছি আর কী। আপনি কেমন আছেন দাদা?

খু-উ-ব ভালো, হেসে জবাব দিলেন ঢোলগোবিন্দবাবু।

মা চায়ের কাপ-ডিশ আমাদের দিকে এগিয়ে দিল একে একে। তারপর বলল, তোমরা কথা বলো বাবা, আমি আসি।

মা অন্য ঘরে চলে গেল।

আমি বললাম, তোমরা দুজন বসে খেলবে। আর আমি বসে বসে বুঝি ভ্যারেন্ডা ভাজব?

ভাজ না, ভাজ। চায়ের সঙ্গে ভাজা-ভুজি ভালোই লাগে, আমাকে উত্তেজিত করতে বলল রণিদা।

ঢোলগোবিন্দবাবু বললেন, না না রঞ্জন তুমি দর্শক। দর্শক ছাড়া কোনও খেলা জমে?

রণিদা বলল, হ্যাঁ, তুই দর্শক কাম হেল্পার। অবশ্য গোবিন্দদার সাইডে।

তা হলে ওকে কি আমরা ‘পরিদর্শক’ বলতে পারি?

তার মানে? আমি ঘাবড়ে যাই।

নির্লিপ্তভাবে ঢোলগোবিন্দবাবু জবাব দেন, দর্শনের পাশাপাশি যিনি পরিচালনাও করেন তিনি তো পরিদর্শকই, কি বলো রণি?

ওফ্, ঢোলগোবিন্দবাবু আপনি না।

রণিদা বলল, পরিদর্শক হিসাবে তোর দায়িত্বটা কিন্তু মোটেও কম বলে ভাবিস না রঞ্জন। মনে রাখিস, যখন কেউ দাবা খেলে সে তার সব চালই সঠিক বলে মনে করে, কিন্তু পাশে থাকা ব্যক্তিটি খুব সহজেই তার ভুল চাল ধরে ফেলে।

ঘড়ি দেখে শুরু হল খেলা।

রণিদা বলল, সময়টা নোট কর রঞ্জন, এখন কিন্তু পাক্বা ন’টা পঞ্চাশ।

দু’পক্ষেই চার-পাঁচটা চাল দিল দ্রুত। তারপর ক্রমশ উভয়েই ধীর গতি হল।

রণিদা বলল, এই কেসের একটি বিষয় খুবই লক্ষণীয় সেটা কী বল তো রঞ্জন?

কী?

সব কটি মানুষই একই ব্র্যান্ডের সিগারেট খায়।

যেমন? আমি প্রশ্ন করি।

কেন প্রথম দিন কি আমরা দেখিনি যে ভিক্টিমের দুই ক্লোজ ফ্রেন্ড কমলেশ খাস্তগীর এবং সুবিমল সোম উভয়েই চারমিনার খান। আবার দেখ, ভিক্টিম নিজেও ওই সিগারেট খেতেন। শুধু তাই নয়, এ মুহূর্তে সন্দেহের জালে জড়িয়ে পড়া প্রধান সাসপেক্টও ভালোবাসে ওই একই ব্র্যান্ডের সিগারেট। এমন আশ্চর্যজনক কো-ইন্সিডেন্স আমি আগে কখনও দেখিনি।

এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্যপ্রমাণ সবই রাধেশ্যাম মণ্ডলের বিপক্ষে। বেচারা মারা পড়ল মনে হয়, বললাম আমি।

ধ্যুর, তুই একটি যা-তা, একটু লজিক্যালি ভাবনা-চিন্তা করার চেষ্টা কর।

এ কথা কেন বলছ?

দেখ রঞ্জন, রাধেশ্যাম মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলে একটি জিনিস নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়েছে যে, মানুষটির মধ্যে ক্রিমিনাল টেনডেন্সি কিছু থাকলেও প্রকৃতপক্ষে উনি একজন সুস্থ মস্তিষ্কেরই মানুষ। বাবার সম্পত্তির সত্তর ভাগের দাবি করলে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ যে উনি পাবেনই সেটা নিশ্চিত জানতেন। অন্তত আইন তাই বলে। মিছিমিছি দাদাকে খুন করতে যাবেন কেন? তাতে যে ওর দু-কুলই যাবে সেটা বোঝার মতন বুদ্ধি ওনার আছে বলেই আমার বিশ্বাস।

হুমকি চিঠিগুলির সঙ্গে লেখা মেলাবার জন্য ওর হাতের লেখা সংগ্রহ করে পুলিশ হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্টের কাছে পাঠিয়েছে শুনলাম, বললাম আমি।

আমি সেন্ট পার্সেন্ট সিওর যে রিপোর্ট আসবে নেগেটিভ অর্থাৎ ওগুলি রাধেশ্যাম মন্ডল লেখেননি।

আর সিগারেট বাটের ফরেনসিক রিপোর্ট? সেদিন ভিক্টোরিয়ায় ঘটনাস্থল থেকে সেলোফেন পেপারে তুমি যেগুলি সংগ্রহ করে রাতুল রায়কে দিলে? অফিসার নিশ্চয়ই তখন ওটার পজিটিভ রিপোর্টের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করবেন?

সমস্যাটা কোথায় জানিস রঞ্জন? –পুলিশ সব সময় চেষ্টা করে আগে আসামীকে ফিক্স আপ করতে। তারপর ক্রিমিনাল টু ক্রাইমে মুভ করে। তাতে মিসলিড হবার চান্স বেশি থাকে। আর আমি করি ঠিক তার উলটোটা অর্থাৎ ক্রাইম টু ক্রিমিনাল এ মুভ করতে। আর একটি ব্যাপারও ইনভেস্টিগেশনের ক্ষেত্রে সব সময় মাথায় রাখা উচিত।

সেটা কী?

শার্লক হোমস পড়িসনি তুই? স্যার আর্থার কোনাল ডয়েল এক জায়গায় বলেছিলেন, যেখানে আপাত তথ্যগুলি বড়ো বেশি ভিভিডলি ছড়ানো থাকে, সেখানে মূল সত্য থাকে আর একটু গভীরে।

হুম, আমি বিজ্ঞের মতন মাথা নাড়ি।

পাড়ার ছেলেদের আক্রোশের ব্যাপারটা ভুলে গেলে চলবে না, ওসব অ্যান্টিসোশ্যালরা অনেক কিছু করতে পারে। মানুষ মারা ওদের কাছে জলভাত, বললেন ঢোলগোবিন্দবাবু। আর রাধেশ্যামের ওরকম বন্ধুবান্ধবের অভাব ছিল না।

অকাট্য যুক্তি। ভেবে দেখার মতন, জবাব দিল রণিদা।

তবে কথাটি ও ব্যাঙ্গার্থে বলল না সিরিয়াসলি সেটা ওর কণ্ঠস্বরে পরিস্ফুট হল না।

তুমি যাই বলো না কেন রণি, আমি বলছি তুমি মিলিয়ে নিও, পুলিশ শেষ পর্যন্ত ওই রাধেশ্যাম মন্ডলকেই দোষী সাব্যস্ত করবে। গোবিন্দবাবুর কণ্ঠস্বরে যথেষ্ট জোর।

সে যাই হোক, আপনি এবার কিস্তি সামলান গোবিন্দদা। রণিদা শেষ চাল দিল। ফের বলল, আশা করি ঘড়িতে এখন কাঁটায় কাঁটায় দশটা।

এঃ হে, গেল মনে হয় দানটা, বললেন ভদ্রলোক।

ঠিক তারপরই বলে উঠলেন, এটা কিন্তু তোমার ঠিক পলিসি নয় রণি–বিপক্ষকে একটি জটিল আলোচনায় ডুবিয়ে রেখে গোপনে নিজের কাজ হাসিল করা।

গোপনে কোথায়? বোর্ডে ঘুঁটি তো সর্বসমক্ষে সাজানো, হেসে উত্তর দিল রণিদা, তাছাড়া স্বয়ং পরিদর্শকও রয়েছেন।

ওসব বললে চলবে না, তুমি আমাকে বোর্ডে কনসেনট্রেটই করতে দিলে না এটা-সেটা গল্প করে।

গল্পের উপসংহারটা সম্ভবত আগামীকালই লেখা হবে, জানা যাবে প্রকৃত অর্থে হু ওয়াজ দ্য অথর অফ দি ক্রাইম, বলল রণিদা।

কালই! আমি বিস্মিত ওর কনফিডেন্স দেখে।

হ্যাঁ, কাল বিকালের মধ্যেই কেসটার একটি গতি হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। আজ উঠিরে রঞ্জন, চলুন গোবিন্দদা।

ওরা দুজনে উঠে দাঁড়াল। আমিও সঙ্গে সঙ্গে, উদ্দেশ্য দরজা অবধি এগিয়ে দেওয়া।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললাম, তুমি কি এখন বাড়ি যাবে রণিদা?

নাহ্, বেশ কিছু ইনফরমেশান কালেক্ট করতে হবে। তার আগে অবশ্য গোবিন্দদাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যাব।

বেরোবার মুখে বোনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ওদের।

কখন এলে রণিদা? জিজ্ঞাসা করল বোন।

এই খানিকক্ষণ হল। পড়াশোনা কেমন চলছে?

ভালো, মাথা নাড়ে বোন। তারপর বলে, গোবিন্দবাবু আপনি কেমন আছেন?

ভালো আছি রে মা, একদম ফার্স্ট ক্লাস, হেসে জবাব দিলেন ভদ্রলোক।

বিদায় নিয়ে রণিদা ও ঢোলগোবিন্দবাবু রওনা হল। তবে যাবার আগে রণিদা বলে, কালকের সন্ধেটা ফ্রি রাখিস রঞ্জন। আশা করছি কালই এর একটি হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে।

গাড়ি স্টার্ট দেয়। হাত নেড়ে শুভরাত্রি জানাই ওদের।

পর্ব – ১১

গত রাতে ভালো ঘুম হয়নি। ঘুরে ফিরেই একটি প্রশ্ন মাথায় আসছিল। তা হল, ভিক্টোরিয়া মার্ডার কেসের পরিণতি কী? কে শেষ পর্যন্ত খুনি হিসাবে অভিযুক্ত হতে চলেছে? সত্যি বলতে কী আমার স্থূল বিচার-বুদ্ধিতে বার বার রাধেশ্যাম মন্ডলের কথাই মনে হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের ঢোলগোবিন্দবাবুর যুক্তি মন্দ লাগেনি আমার।

কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছে, ব্যাপারটা যদি অত সহজই হতো, রণিদা কেসটা নিয়ে এত মাথা ঘামাত না। ওর মতন তীক্ষ্নধী, সাহসী এবং আত্মবিশ্বাসী মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি।

তাই ওর ওপর আমার পূর্ণ আস্থা। দুষ্কৃতকারী যত বুদ্ধিমানই হোক না কেন, ষড়যন্ত্রের জাল সে যত সুচিন্তিত ভাবেই বিছিয়ে থাকুক না কেন, রণিদার শাণিত মননের কাছে সেসব নস্যি। ওর যুক্তিশীল মন তদন্তের গভীরে ঢুকে সব ফালাফালা করে আপাতত অন্ধকারাচ্ছন্ন বিভ্রান্তি থেকে আসল অপরাধীকে টেনে বার করে আনবেই, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

যাই হোক, সকাল থেকেই রণিদার ফোন এক্সপেক্ট করছিলাম। কিন্তু সে ফোন যখন এল তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল।

বললাম, হ্যাঁ বলো রণিদা।

বলছি যে সন্ধে সাতটা নাগাদ ঘনশ্যাম মন্ডলের বাড়ি চলে যাস, মনে রাখিস, অন ডট সাতটা।

পৌনে পাঁচটা থেকে সাতটা–মধ্যবর্তী এই সময়টা আমার কীভাবে কাটল তা বলে বোঝাবার নয়। কারণ রণিদার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যা অভীষ্ট লাভের গাঢ় অনুভূতি। মনে হল, ছিপে মাছ অলরেডি গাঁথা হয়ে গেছে, কেবল একটু খেলিয়ে টেনে তোলারই যা অপেক্ষা।

সাতটা বাজবার মিনিট পাঁচেক আগেই গিয়ে উপস্থিত হলাম মন্ডলবাবুর বাড়ি।

এখানে পৌঁছে দেখলাম আমার মতন আরও অনেকেই আবেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে দুরু দুরু বক্ষে অপেক্ষা করছেন।

রণিদা তো আছেই, সঙ্গে ঢোলগোবিন্দবাবু।

সেই সঙ্গে সেই ঘরে উপস্থিত মিসেস মন্ডল, তার ছেলে, মেয়ে এবং জামাই। আছেন কমলেশ খাস্তগীর, জনমেজয় মিত্তির, এমনকী নীলাক্ষি দাশগুপ্তও।

ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে সময় মিলিয়ে ঘরে ঢুকলেন এই কেসের সঙ্গে যুক্ত আর এক ব্যক্তি অর্থাৎ সুবিমল সোম।

এতক্ষণ যাবৎ টেবিলের ওপর মাথা নীচু করে একটি প্যাডে কী সব লিখছিল রণিদা ওর নিজস্ব কোডে।

সুবিমল সোম ঘরে প্রবেশ করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল ও।

বেশ কনফিডেন্টলি রণিদা বলতে শুরু করল, দেখুন আমার মনে হয় এই মুহূর্তে এই কেসের সঙ্গে যুক্ত প্রায় প্রতিটি মানুষই এখানে উপস্থিত, কেবল একজন ছাড়া।

কেউ কেউ এ ওর দিকে চাইল কৌতূহলী দৃষ্টিতে।

অনুপস্থিত ব্যক্তিটি রাধেশ্যাম মন্ডল। আপনারা সকলেই জানেন উনি এখন পুলিশ হেফাজতে। আর আমি নিশ্চিত, আপনারা সকলে নিশ্চয়ই  এটাও এতক্ষণে বুঝে গেছেন যে এ কেসে যদি প্রকৃতই উনি অপরাধী হতেন তা হলে আজ আপনাদের এখানে ডেকে আনা হতো না।

তার মানে ঘনশ্যামের হত্যাকারী রাধেশ্যাম নয়? সুবিমল সোমের কণ্ঠস্বরে বিস্ময়।

আপনি বলতে চান পুলিশের তদন্ত ভুল? নীলাক্ষি দাশগুপ্তর কণ্ঠস্বরে বিরক্তি ঝরে পড়ল।

রণিদা ওদের বিস্ময় কিংবা বিরক্তির ব্যাপারে গেল না। বরং শুরু করল অপেক্ষাকৃত শান্ত ভঙ্গিতে।

ঘটনাটি ঘটেছিল গত তেরোই ফেব্রুয়ারির কোনও এক অশুভ সময়, বলতে লাগল রণিদা, ওই দিন মি. মন্ডল অফিস গেছিলেন। কি আমি ঠিক বলছি মি. মিত্তির?

হ্যাঁ স্যার, বাঁ দিকে বেশ খানিকটা ঘাড় বাঁকান ভদ্রলোক।

সেদিন যদি কারও সঙ্গে পূর্ব পরিকল্পিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকত তাহলে উনি সে কথা মিসেস মন্ডলকে বলে যেতেন কারণ সেটাই ওনার অভ্যাস, তাই না মিসেস মন্ডল?

এবার মিসেস মন্ডলও সম্মতিজ্ঞাপক মাথা নাড়েন।

রণিদা ফের বলতে শুরু করে, তা হলে আততায়ীর সঙ্গে ঘনশ্যামবাবুর মিটিংটা যদি একটি আন-প্ল্যানড মিটিং হয়ে থাকে ওনাকে ডেকে নেবার জন্য আততায়ী নিশ্চয়ই একটি ফোন কলের সাহায্য নেবে এবং বাস্তবে সেটাই ঘটেছিল। ওই দিন প্রায় পাঁচটা নাগাদ ঘনশ্যাম মন্ডল একটি ফোন রিসিভ করেন। ঠিক বলছি তো মিত্তিরবাবু?

হ্যাঁ স্যার, এবারও বাঁ দিকে ঘাড় বাঁকান ভদ্রলোক ইতিবাচক ভঙ্গিতে।

ঘনশ্যামবাবু সম্ভবত পৌনে ছ’টা নাগাদ ভিক্টোরিয়ার নির্ধারিত স্থানে পৌঁছোন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার আততায়ীর সঙ্গে দেখা হয়। অথবা এর উলটোটাও হতে পারে অর্থাৎ আততায়ী ওনার আগেই অকুস্থলে পৌঁছোয়। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, আততায়ী ঘনশ্যামবাবুর কোনও অতি পরিচিত ব্যক্তি যার ফলে তার দুরভিসন্ধির ব্যাপারে ভদ্রলোকের বিন্দুমাত্রও সন্দেহ জাগেনি।

ঘরের সকলে রুদ্ধ নিঃশ্বাসে রণিদার কথাগুলি গিলছিল। বেশ কয়েকজনের কপালে এই ঠান্ডাতেও ঘাম দেখা গেল। পিন পড়লেও বুঝি শোনা যাবে।

রণিদা ফের শুরু করল

আততায়ীর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলেছিল ঘনশ্যামবাবুর। সম্ভবত খুনি অপেক্ষা করছিল কখন স্থানটি আরও একটু নির্জন হয়।

ঘটনাচক্রে ওই দিন ভিক্টোরিয়ার যে গার্ড সান্ধ্যকালীন চেক আপের দায়িত্বে থাকার কথা তিনি অসুস্থ ছিলেন। ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিতভাবেই আততায়ীর অনুকূলে যায়।

এর পর কথাচ্ছলেই এক সময় আততায়ী উঠে দাঁড়ায় তার অভিপ্রায় বোঝা অসম্ভব ছিল ঘনশ্যামবাবুর কাছে। কারণ তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে সামান্য টাকার জন্য তার এত দিনের পরিচিত কোনও ব্যক্তি তাকে খুন পর্যন্ত করতে পারে।

তারপর? প্রশ্ন করেন নীলাক্ষিবাবু।

তারপর আচমকাই আততায়ী কোনও শক্ত দড়ি জাতীয় কিছু দিয়ে পিছন থেকে মন্ডলবাবুর গলা পেঁচিয়ে ধরেন যতক্ষণ না তার প্রাণবায়ু পুরোপুরি বেরিয়ে যায়, এক সময় স্থির হয়ে যায় দেহটা নিঃশব্দে। সামান্য কিছু ছটফটানি জনিত শব্দ হয়ে থাকলেও তা কারও কানে পৌঁছোয় না। ঘটনা সুষ্ঠু ভাবে মিটলে আততায়ী তার মার্ডার উয়েপনটা নিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে কারণ সে ওটা ওখানে ফেলে যাবার মতন বোকা নয়। যাবার আগে অবশ্য সে একটি কাজ করে যাতে প্রমাণ হয় আততায়ী একজন অত্যন্ত কুল ব্রেনের মার্ডারার।

সেটা কী? এবার প্রশ্ন করি আমি।

সেটা হল এই যে, যাবার আগে খুনি মৃতদেহটিকে বেঞ্চের এক কোণায় এমন ভাবে বসিয়ে রেখে যায় যাতে হঠাৎ দেখলে মনে হয় উনি জীবিত এবং বসে সামনের জলশোভা দেখতে মগ্ন। এতে তার লাভ কী? প্রশ্নটা জাগতেই পারে আপনাদের মনে। উত্তরে বলি, লাভ এটাই যে মৃতদেহ আবিষ্কারে যত দেরি হবে আততায়ী নিজেকে গুছিয়ে নেবার ততটাই বেশি সময় পাবে।

এ পর্যন্ত বলার পর রণিদা একটু থামে। তারপর আবার বলে, সংক্ষেপে মোটামুটি এটাই ছিল সেদিনকার ঘটনা। এবার আমি দ্বিতীয় পর্বে যাব।

ঘনশ্যামবাবু মারা গেলেন, কিন্তু কেন? কী সেই কারণ যার জন্য মানুষটিকে মরতে হল?

মানে তুমি বলতে চাইছ, মোটিভ? ঢোলগোবিন্দবাবু বললেন।

ইয়েস, শুধু শুধু একটি মানুষ খুন হয় না। তার পিছনে কোনও না কোনও কারণ থাকবেই। তা হলে এবার প্রশ্ন জাগে, এই ঘনশ্যাম মন্ডল মারা যাবার পিছনে কী কারণ থাকতে পারে? কে কোন দিক থেকে কতটা লাভবান হতে পারেন?

ক্রাইম হিস্ট্রি সম্বন্ধে যাদের পড়াশোনা আছে তারা নিশ্চয়ই জানেন কত সামান্য, কত তুচ্ছ কারণে পৃথিবীর বুকে কত অসংখ্য হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। তাই সন্দেহের তালিকায় আমি প্রথম পর্যায়ে রাধেশ্যাম মন্ডল থেকে শুরু করে সুবিমল সোম, কমলেশ খাস্তগীর, নীলাক্ষি দাশগুপ্ত, জনমেজয় মিত্তির, এমনকী তাঁর স্ত্রী মিসেস মন্ডলকেও বাদ দিইনি।

দেখলাম সকলের প্রতি রণিদার ধারালো অথচ শীতল দৃষ্টিপাত আছড়ে পড়ল নিঃশব্দে।

উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা ক্রমশ সহ্যসীমা অতিক্রম করছিল।

রণিদা ফের শুরু করে।

প্রাথমিক কথাবার্তা ও অনুসন্ধানে একটি জিনিস পরিষ্কার হয়ে যায়, মিসেস মন্ডল পতিপরায়ণা, সংসারের নিবেদিত প্রাণ, একজন অত্যন্ত সুশীলা মহিলা। স্বামীর মৃত্যুতে তার কোনও লাভের ব্যাপার নেই।

তা হলে এর পরই আসছে রাধেশ্যাম মণ্ডলের নাম। যার সামাজিক রেপুটেশন খুবই পুওর। সম্পত্তির ভাগ নিয়ে তার দাদার সঙ্গে বিবাদের খবর সর্বজনবিদিত। এমন কী তার বউদি পর্যন্ত নিশ্চিত নন যে এই খুনে তার হাত আছে কি না। ঘটনার আগে সে দাদাকে শাসিয়ে গেছে দেখে নেবে বলে। ঘটনার সময় সে ফেরার। এরপরও তাকে আসামী না ভাবার কোনও অবকাশই থাকতে পারে না। ফলস্বরূপ, এই মুহূর্তে মানুষটি পুলিশের লক আপে।

এর মধ্যে মিসেস মন্ডল আমাকে জানান যে মাত্র কিছুদিন আগে তার স্বামী ও পুত্রের সঙ্গে লোকাল কিছু রাউডির বচসা ও হাতাহাতি হয়। অতএব প্রতিহিংসাবশত খুনটা তারাও করতে পারে।

কিন্তু আমার সিক্সথ সেন্স বলে, খুনি ঘনশ্যামবাবুর পরিচিত। তা না হলে হাত কাটা জগা, বরফি প্রভৃতির মতন দুষ্কৃতকারীরা তাকে ফোনে ডাকলে তিনি একা একা কাউকে কিছু না জানিয়ে ভিক্টোরিয়ায় চলে আসবেন–এটা ভাবা বোধহয় আমাদের বড়ো বেশি বোকামি হয়ে যাবে। তা ছাড়া আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ঘটনাচক্রে ওই বচসার দিন দুয়েক পরই কালীঘাট থানার পুলিশ ওদের বেশ কয়েকজনকে একটি কেসে অ্যারেস্ট করেছে, ওরা এখন জেলে।

সন্দেহের তালিকায় এবার থাকছেন জনমেজয় মিত্তির এবং নীলাক্ষি দাশগুপ্ত, রণিদা বলতে থাকে, ঘনশ্যামবাবু কোটায় প্রোমোশন পেলে ওনারা ডিপ্রাইভড হবেন ঠিকই, কিন্তু ওঁরা সরকারি কর্মচারী এবং ঘোরতর সংসারী মানুষ। একজন সরকারি চাকুরে তার জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে এতটা রিক্স নেবার দুঃসাহস দেখালেও হয়তো দেখাতে পারেন, কিন্তু এক্ষেত্রে ওঁরা জড়িত নন। কারণ ওই দিন যখন ফোনটা আসে, ওঁরা দুজনই তখন অফিসে উপস্থিত।

মনে হল, বুঝি ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল জনমেজয় মিত্তির এবং নীলাক্ষি দাশগুপ্তর কারণ রণিদার কথা শেষ হওয়ামাত্র দুজনেরই প্রায় একসঙ্গে দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল।

এক গেলাস জল হবে? রণিদা বলল।

হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই, বললেন ঘনশ্যামবাবুর ছেলে।

মিনিট খানেকের মধ্যেই চলে এল জল। ঢকঢক করে এক নিশ্বাসে জলটা শেষ করল রণিদা।

তারপর ফের বলতে শুরু করল, এবার আসছি আমার সন্দেহের তালিকায় একদম নীচের দিকে থাকা দুটি নামে, অর্থাৎ সুবিমল সোম এবং কমলেশ খাস্তগীর যারা হলেন ঘনশ্যাম মন্ডলের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন দুই প্রিয় বন্ধু।

মজার কথা হল, এনারা দুজনই কিন্তু মন্ডলবাবু বেঁচে থাকাকালীন ওনার সঙ্গে আমার বাড়ি এসেছিলেন হুমকি চিঠি তদন্তের কিনারার উদ্দেশ্যে।

প্রথম দিকে অবশ্য আমি কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি একটি বিষয়ে দুজনের প্রায় একই রকম বক্তব্যে। দুজনেই বলেন, তারা মন্ডলবাবুর সঙ্গে অপর বন্ধুর কথা কাটাকাটির কিছুটা আচমকা শুনে ফেলেছেন।

তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই রকম যে এদের দুজনের একজন নিশ্চয়ই সুপরিকল্পিত ভাবে আমার তদন্তকে বিপথে চালিত করতে চাইছেন। প্রশ্ন হল, কে সেই মহান ব্যক্তি?

এরই মধ্যে হঠাৎ উপস্থিত হন ঘনশ্যাম মণ্ডলের ছোটো ভাই রাধেশ্যাম মন্ডল। গোটা ঘটনাটা একটি নাটকীয় মোড় নিল। সকলের চোখ তার ওপর গিয়ে পড়ল কারণ ঘনশ্যামবাবুর মৃত্যুতে আপাত দৃষ্টিতে তার লাভই সব থেকে বেশি। ওদিকে আসল অপরাধী তখন অনেক দূরে বসে মুচকি মুচকি হাসছে। কারণ তখনও পর্যন্ত ভাগ্য শুধু নয়, ঈশ্বরও তার সহায়।

ঘনশ্যামবাবুর মার্ডার কেসটা গোড়া থেকেই বেশ জটিল ছিল। কারণ ভদ্রলোক ছিলেন বড়োই ইনট্রোভার্ট প্রকৃতির মানুষ। কারও সঙ্গে তেমন মিশতেন না। এমন কী টাকা-পয়সার বিষয়গুলিতে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে পর্যন্ত কোনওরকম আলাপ-আলোচনা করতেন না।

এ পর্যন্ত একটানা বলার পর সম্ভবত সামান্য দম নেবার জন্য রণিদা একটু থামে। তারপর ফের পূর্ণ উদ্যমে শুরু করে–

আপনার ছেলের তো এবার লাস্ট ইয়ার, তাই না সুবিমলবাবু?

আচমকা আক্রমণে ভদ্রলোক একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন।

আমার ছেলের?… হ্যাঁ মানে, কিন্তু তাতে কী? কোনও মতে ঢোঁক গিলে বললেন ভদ্রলোক।

না, মানে বলছিলাম, ছেলের পড়াশোনার খরচ তো বেশ বেড়ে গেছে, ঠিক কি না? রণিদা প্রশ্ন করে।

আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন মি, চক্রবর্তী।

আপনার ক’টি জেরক্স মেশিন সুবিমলবাবু?

দুটি, সংক্ষিপ্ত উত্তর দেন ভদ্রলোক।

শুনেছি তার একটিতে মি. মন্ডল কিছু টাকা ইনভেস্ট করেছিলেন, কথাটা কি সত্যি?

চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ।

আপনি ওনাকে মাসে মাসে একটি নির্দিষ্ট অ্যামাউন্টের টাকা দেবেন এই প্রতিশ্রুতিতে, কি ঠিক বলছি?

একবার ঢোঁক গিলে ভদ্রলোক বলেন, হ্যাঁ, মানে সেইরকমই কথা হয়েছিল আমাদের মধ্যে। কিন্তু সে তো খুবই সামান্য টাকার ব্যাপার। আপনি কি বলতে চাইছেন ওই সামান্য টাকার জন্য আমি আমার বাল্যবন্ধুকে খুন করেছি?

না, মি. সোম, আপনার বন্ধু মি. মন্ডল মারা গেছেন আরও অনেক অনেক বেশি টাকার জন্য। আমি কেবল সর্বসমক্ষে আমার বক্তব্যকে যথাসম্ভব পরিচ্ছন্নভাবে উপস্থাপনার চেষ্টা করছি।

এই খুনের ঘটনায় আপনি যে জড়িত নন তা আমি খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত–ঘটনার দিন আপনি বাড়িতেই ছিলেন তা আমি জেনেছি।

এরপর রণিদা আচমকাই বিশালদেহী কমলেশ খাস্তগীরের দিকে শাণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, এখন এক একটি ইনফোসিস শেয়ারের মূল্য কত মি. খাস্তগীর?

অসম্ভব ভীত ও শঙ্কিত হয়ে পড়লেন বলে মনে হল ভদ্রলোককে। মানে, যতদূর জানি প্রায় কুড়ি হাজার টাকা।

আপনি ঠিক জানেন মি. খাস্তগীর। এই ঘরে শেয়ার মার্কেট সম্বন্ধে আপনার থেকে বেশি আর কেউ জানে না।

তারপর গলাটা আর একটু চড়িয়ে রণিদা ফের বলতে থাকে, আপনারা শুনে অবাক হবেন আজ থেকে মাত্র আট মাস আগে এক একটি ইনফোসিস শেয়ারের মূল্য ছিল মাত্র একশো থেকে দেড়শো টাকা, হ্যাঁ ঠিক তাই।

আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতন ঘনশ্যামবাবুরও পয়সার প্রতি আকর্ষণ ছিল, হয়তো একটু বেশি। কে না চায় বলুন, আর একটু ভালো ভাবে বাঁচতে। সম্ভবত সে জন্যই ফাটকা কিছু লাভের উদ্দেশ্যে ভদ্রলোক মাঝেমধ্যেই শেয়ারে টাকা বিনিয়োগ করতেন। ওনার চেক বুকের পিছনের পাতায় সঞ্জীব আগরওয়াল, মনীশ রূংটা, শিশুমার পোড়েল প্রভৃতি নামগুলি তার প্রমাণ।

আপনারা বলবেন, এরা কারা? এদের নামে চেক ইস্যু করা হচ্ছে অথচ মন্ডল পরিবারের কেউ এদের চেনা দূরে থাক, নামই শোনেনি।

উত্তরে বলি, এরা হলেন শেয়ার মার্কেটের এক একজন শেয়ার ব্রোকার। ঘনশ্যাম মন্ডল একজন সরকারি কর্মচারী। শেয়ারে টাকা বিনিয়োগ ও ফাটকা লাভের ব্যাপারটা উনি সম্ভবত ওনার ইনকামট্যাক্স ফাইলে ঢোকাতে চাননি অথবা বন্ধু কমলেশ খাস্তগীরকে উনি একটু বেশিই বিশ্বাস করেছিলেন। ওনার নিজস্ব কোনও ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট ছিল না, তাই উনি শেয়ারে বিনিয়োগ করতেন কমলেশবাবুর ডিম্যাট অ্যাকাউন্টে। কি কমলেশবাবু, আমি ঠিক বলছি তো? দেখবেন, ভুল হলে শুধরে দেবেন।

উনি চুপ করে থাকেন খানিক, তারপর বলেন, বলে যান যা বলতে চান।

গত জুলাইতে ঘনশ্যামবাবু ওনার জিপিএফ. থেকে তিন লাখ টাকা তোলেন এবং কমলেশবাবুর মাধ্যমে সেই টাকা ইনফোসিস শেয়ারে লাগান যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ছ’কোটি টাকা।

ছ কোটি টাকা! বিস্ময়ে চোখ কপালে ওঠে সবার।

ইয়েস, সিক্স ক্রোরস রুপিজ, কেটে কেটে বলে রণিদা এবং চুক্তি অনুসারে এর অর্ধেক ঘনশ্যামবাবুর প্রাপ্য ছিল, তাই না মি. খাস্তগীর?

কীসের চুক্তি?

আপনার সঙ্গে মি. মন্ডলের নিশ্চিত ভাবেই কোনও লিখিত বা মৌখিক বোঝাপড়া ছিল, আপনি এখন বিষয়টা অস্বীকার করতে পারেন। একদিন সেই নিয়ে আপনাদের দুজনার মধ্যে বাদানুবাদও হয়, নয় কি?

বাজে কথা।

গত জুলাইতে আপনি তিন লাখ টাকা দিয়ে তিন হাজার ইনফোসিস শেয়ার ধরেছিলেন কথাটা কি ঠিক নয়?

কথাটা ঠিকই, তবে টাকাটা আমাকে ঘনশ্যাম দেয়নি, বলেন খাস্তগীর।

আপনার নামে চেক ইস্যু করা হয়নি ঠিকই, চেকটা সঞ্জীব আগরওয়ালের নামে, অবভিয়াসলি সেই চেকের তলায় ঘনশ্যাম মন্ডলের সই ছিল। চেকটা আগরওয়ালের অ্যাকাউন্টে এনক্যাশ হয়েছে অপরদিকে আপনার ডিম্যাট অ্যাকাউন্টে গত জুলাইতে জমা পড়েছে তিন হাজার ইনফোসিস শেয়ার। আপনার চেকবুক ভেরিফাই করলেই প্রমাণ হয়ে যাবে যে ওই সময় আপনি আগরওয়ালকে তিন লাখ টাকা মূল্যের কোনও চেক ইস্যু করেননি। অন্তত রেকর্ড তাই বলছে।

এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন, আমার অন্য এক বন্ধু আমাকে টাকাটা দিয়েছিল, খাস্তগীর বললেন।

শুধু শুধু মিথ্যা বলছেন মি. খাস্তগীর। ব্যাপারটা এখন আপনার হাতের বাইরে চলে গেছে। মনে রাখবেন মানুষ মিথ্যা বলে কিন্তু ডকুমেন্ট মিথ্যা বলে না।

আপনি বলতে চাইছেন ঘনশ্যামকে আমিই হত্যা করেছি? ওই হুমকি চিঠিগুলি আমিই লিখেছি?

অত বোকা আপনি নন কমলেশবাবু। হুমকি চিঠির লেখাগুলি আপনার হাতের লেখার সঙ্গে মিলবে না তা আমি জানি, বলল রণিদা, চিঠিগুলি যে কাউকে দিয়ে অতি সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে লিখিয়ে নেওয়া আপনার পক্ষে মোটেও কঠিন নয়।

তা হলে কী প্রমাণ আছে আপনার হাতে যার জন্য আপনি আমার বিরুদ্ধে এ রকম সাংঘাতিক অভিযোগ আনছেন? প্রচণ্ড উত্তেজিত দেখায় কমলেশ খাস্তগীরকে।

প্রমাণ আমার হাতে নয়, আপনার হাতে রয়েছে কমলেশবাবু।

অত্যন্ত শীতল কণ্ঠস্বর রণিদার।

তার মানে?

কেন, আপনার হাতের ওই দামি চমৎকার সেল ফোন? গত তেরোই ফেব্রুয়ারি বিকেল চারটে বেজে ছাপান্ন মিনিটে আপনার ওই সুদৃশ্য সেলফোন থেকে একটি কল বাতাসের ডানায় ভেসে উড়ে যায় ঘনশ্যামবাবুর কয়লাঘাটা অফিসে, অ্যান্ড দ্যাট ওয়াজ অলসো রেকর্ডেড। বিষয়টা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ থেকে ভেরিফাই করে নেওয়া খুব একটা কঠিন কাজ কি? আপনাকে সেলফোনের ব্যাপারে সেদিন এক নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে আপনার ফোনের সিরিয়াল নাম্বারটা বের করে নিলাম কি এমনি এমনি?

শ-য়-তা-ন, তোকে আমি, দাঁত কিড়মিড় করে তেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলেন মি. খাস্তগীর, কিন্তু আচমকাই ধড়াম করে সশব্দে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন ভারী মানুষটা। হাত থেকে ছিটকে গেল মূল্যবান সেলফোন।

ব্যাপারটা ঠিক মতন বুঝে উঠতে সময় লাগল।

আসলে হয়েছিল কী, ভ্যাবলাকান্তের মতন চুপচাপ বসে থাকা ঢোলগোবিন্দবাবু পরিস্থিতি বিবেচনা করে অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় আক্রমণকারীর দিকে আচমকাই একটি পা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন–আর তাতেই খাস্তগীরের অধঃপতন।

ঢোলগোবিন্দবাবু নির্লিপ্ত ভাবে কেবল বললেন, উঁহু, ক্রোধ জিনিসটি মোটেও ভালো নয়, কমলেশবাবু।

ঢোলগোবিন্দবাবুর তৎপরতায় সকলে বিস্মিত।

আঘাতটা বেশ জোর পেয়েছিলেন ভদ্রলোক, কোনও মতে মেঝেতে উঠে বসলেন। রণিদা ওনার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, উঠুন, উঠে নিজের জায়গায় শান্ত হয়ে বসুন মি. খাস্তগীর।

বাধ্য ছেলের মতন রণিদার হাত ধরে উঠে ভদ্রলোক নিজের জায়গায় ফিরে বসে পড়লেন।

তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে উনি বললেন, এইসব হাবিজাবি প্রমাণ দিয়ে আপনি আমাকে ফাঁসাবেন ভেবেছেন?

রণিদার মুখে হাসি।

ও বলল, ঘটনার দিন ভিক্টোরিয়ায় সন্ধ্যাবেলা আপনি ও ঘনশ্যামবাবু যে চা-ওয়ালার কাছে চা খেয়েছিলেন খুব সহজেই সে আপনাকে টি-আই প্যারেডে আইডেন্টিফাই করে দেবে– সেটা ভুলে যাবেন না।

একটু থেমে রণিদা ফের বলে, সেখানেই শেষ নয়–ডিএনএ. ফিঙ্গারপ্রিন্ট টেস্ট বলে একটি শব্দ আছে, সেটা শুনেছেন কি? না শুনে থাকলে সেটা আপনার অজ্ঞতা। আপনি হয়তো জানেন না ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী ওটা একটি কনক্লুসিভ এভিডেন্স। আপনি একজন চেইন স্মোকার। ওই দিন অকুস্থলে কিছু ফিল্টারবিহীন সিগারেট বাট পাওয়া যায়, যেগুলি সযত্নে সংগ্রহ করে ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের হাতে আমি তুলে দিয়ে এসেছি। সেগুলি সুরক্ষিতই আছে।

আমি একাই চারমিনার খাই না, শেষ চেষ্টা করেন মি. খাস্তগীর।

আপনি এ ব্যাপারে একেবারেই মূর্খ কমলেশবাবু সেটা বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কার। আপনার স্যালাইভা বা অন্য কোনও বডি ফ্লুয়িড সংগ্রহ করে ওই সিগারেট বাটগুলির সঙ্গে পরীক্ষা করলে তার যে-কোনওটির সঙ্গে পুরোপুরি ম্যাচ করে যাবে ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্ট টেস্টে–আয়াম ডেড শিওর। আর ব্যাপারটা কোর্টও গ্ল্যাডলি অ্যাকসেপ্ট করবে, কি বলুন?

কমলেশ খাস্তগীরের মুখ থেকে আর একটিও শব্দ বের হল না। উনি দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললেন।

রণিদা ঘড়ি দেখে। সিঁড়িতে ভারী বুটের আওয়াজ পাওয়া যায়। আমরা সচকিত হই।

রণিদা বলে, আমিই মি. রায়কে বলেছিলাম পাক্বা সাড়ে সাতটায় এখানে আসতে।

রাতুল রায় ঘরে ঢুকে বললেন, অ্যারেস্ট হিম।

তার সঙ্গে থাকা কনস্টেবল দুজন তৈরি হয়েই এসেছিলেন। ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র কমলেশ খাস্তগীরের হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গেল কর্তব্যরত মানুষ দুটি।

অনেক ধন্যবাদ মি. চক্রবর্তী, বাকি ব্যাপারটা এবার আমিই দেখছি, বাই, বলে চলে যেতে উদ্যত হন মি. রায়।

এক মিনিট অফিসার, বলে সোফার তলা থেকে নীচু হয়ে খাস্তগীরের সেলফোনটি তুলে আনে রণিদা। তারপর সেটি ওনার হাতে দিয়ে বলে, এটি আপনার কেসের সম্পত্তি। এটিও সিজ করুন। কোর্টে কাজে লাগবে।

ডেফিনিটলি, থ্যাংক ইউ ওয়ান্স এগেইন, বাই, বলে চলে যায় অফিসার।

বিদায় অফিসার, বলে রণিদা, আপনারা তা হলে এবার আমাকে অনুমতি দিন।

রণিদার চোখেমুখে বিজয়ীর হাসি ফুটে ওঠে।

কী যে বলেন মি. চক্রবর্তী, আজকের মতন দিনে আপনাকে আমরা এভাবে চলে যেতে দিতে পারি? বলে বাড়ির জামাই এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে প্রায় জড়িয়ে ধরে রণিদাকে।

ঢোলগোবিন্দবাবু বলে ওঠেন, এমন দিনে একটু চা জলখাবার না খেয়ে গেলে গৃহস্থের অকল্যাণ হবে।

সকলে হো হো করে হেসে ওঠেন।

মিসেস মন্ডল বলেন, তা যা বলেছেন। উনি দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান।

বুঝলি রঞ্জন, গোয়েন্দা হতে গেলে সর্বপ্রথম যেটা দরকার তা হল ইনটুইশন, যার দ্বারা একজন মানুষকে এক্সরে আই ফেলে মুহূর্তে পড়ে নেওয়া যায়। আমাদের বাড়িতে যেদিন কমলেশবাবু প্রথম আসেন সেদিনই আমার মনে হয়েছিল মানুষটি মোটেই সুবিধার নয়।

সেটা কীভাবে বুঝলে? প্রশ্ন করি আমি।

ওনার দৃষ্টিতে, কেমন একটি জরিপ করার অভিপ্রায় ছিল ওনার দুচোখে, আর…

আর শুরু থেকেই তাই ভদ্রলোককে তুমি চোখে চোখে রাখতে শুরু করলে ঢোলগোবিন্দবাবু বললেন।

অবশ্য গোয়েন্দাদের এই ইনটুইশনের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ পার্সোনাল একটি বোধ। তবে রঞ্জন, তোর সহযোগিতা ছাড়া এ কেস সলভ করতে হয়তো আরও বেশি সময় লেগে যেত।

ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না, জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে রণিদার দিকে চাইলাম।

কমলেশ খাস্তগীরকে সেদিন আনায়োর শা-র মুখে তুই আবিষ্কার করেছিলি মনে আছে?

হ্যাঁ, উনি সাট্টার কোনও পেনসিলারের সঙ্গে কথা বলছিলেন, বললে তুমি।

মুন্না, মুন্নার সঙ্গে। ব্যাপারটা দেখামাত্র আমার মাথার একটি জটিল অঙ্কের সমাধান হয়ে গেল। তার মানে লোকটির মধ্যে ফাটকা খেলার একটি প্রবণতা আছে। সাট্টা ছাড়া দ্বিতীয় যে-পন্থাটা এক্ষেত্রে মনে আসে, তা হল শেয়ার।

প্রথম দিন যেদিন উনি আমাদের বাড়ি এসেছিলেন তুই খেয়াল করিসনি কিন্তু ঢোলগোবিন্দবাবু দেখেছিলেন ওনার হাতে একটি খবরের কাগজ।

হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে।

কিন্তু গোবিন্দদা এটা বলতে পারেননি যে কাগজটা ছিল ইকনমিক টাইমস যা থেকে শেয়ার সম্পর্কিত সমূহ খবরাখবর পাওয়া যায়। আমার ধারণা পরিষ্কার হয় যে উনি শেয়ারে টাকা লাগান।

শেয়ার মার্কেটে আমার কিছু বন্ধুবান্ধব আছে। সঞ্জীব আগরওয়ালের নাম বলতেই চিনতে পারল। তার কাছ থেকে কমলেশ খাস্তগীরের খোঁজ পাওয়া গেল। ঘনশ্যামবাবুর তিন লাখ টাকা বিনিয়োগের রহস্যের জট খুলে গেল। আরও পরিষ্কার হল যখন মনে পড়ল ওনার চেকবুকে যেখানেই শেয়ার ব্রোকারদের নাম লেখা তার পাশেই ব্রাকেটে ‘কে কে’ লেখা অর্থাৎ কমলেশ খাস্তগীর। বাকি সব তথ্যগুলি যাচাই করতে আরও কিছুটা দৗড়ঝাঁপ করতে হল।

তুমি যাই বলো ভায়া, তোমার যাবতীয় তথ্য কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার তত্ত্বের ওপর নির্ভর করেই উতরে গেল। থমথমে মুখে বললেন ঢোলগোবিন্দবাবু।

আমি অবাক, রণিদাকেও সেরকমই মনে হল।

ওই যে বলেছিলাম মনে আছে, যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন। শেষ পর্যন্ত সিগারেটের ছাইই তোমার কাজে লাগল, বলে উনি নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলেন হো হো করে।

অমিও যোগ দিলাম হাসিতে।

কিন্তু রণিদা চুপ করে রইল। তারপর বলল, এবার তা হলে কয়েকটা কথা বলি–প্রথমত, তত্ত্বটা আপনার নয়। দ্বিতীয়ত, সেদিন তত্ত্বটির আসল শব্দটাই প্রয়োগে ভুল করেছিলেন এবং তৃতীয়ত, ছাই নয়, এক্ষেত্রে আমাদের প্রয়োজনে লাগছে সিগারেটের বাটটুকু।

ওই একই হল, তত্ত্ব বলো, তথ্য বলো, সিগারেট, কিংবা তুমি আমি যা কিছুই হোক না কেন, সক্বলেরই শেষ পরিণতি কিন্তু ওটিই, নিজের বক্তব্যকে দাঁড় করাতে ভদ্রলোক দার্শনিকতার মোচড় দেন।

এবার রণিদার চোখে হাসির ঝিলিক দেয়, আমার দিকে তাকিয়ে বলে, কিছু বুঝলি রঞ্জন?

বলেই আচমকা গাড়িটি একটি বড়ো রেস্তোঁরার সামনে দাঁড় করাল ও।

কী ব্যাপার, এখানে থামলে কেন?

রণিদা বলল, মনে নেই কাল রাতে দাবা খেলার কথা? বাজিতে হেরো গোবিন্দদা আজ আমাদের ডিনার খাওয়াবেন।

রণিদার হাসিতে আমি যোগ দিই।

ঢোলগোবিন্দবাবু অস্ফুটে বলে ওঠেন, হা গোবিন্দ!

——-

সমাপ্ত 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...