আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা অনুযায়ী দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষাতেই নির্ণয় হয়ে যায় শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ। পরীক্ষার্থী যদি ভালো ভাবে উতরে যায়, তাহলে তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, আর অকৃতকার্য হলে সারাজীবন মুখ লুকিয়ে থাকতে হবে, চাকরি না পেয়ে বেকারত্বের শিকার হয়ে।

ঠিক এই কারণেই মায়েদের কাছে সন্তানের দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা যেন অগ্নিপরীক্ষারই মতো। দাঁতে দাঁত চেপে এই দহন সহ্য করেন মায়েরাই। পরীক্ষার ফল বেরোনোর পর যদি দেখা যায় সন্তান বা সন্ততি কম নম্বর পেয়েছে, তখনও মাকেই মাথা হেঁট করে থাকতে হয়, যেন এটা বস্তুত তাঁরই পরাজয়।

আজকাল মায়েরাই বেশি সময় দেন সন্তানের পড়াশোনার জন্য। সন্তানকে সঙ্গে করে কোচিং ক্লাসে নিয়ে যাওয়া, প্রতিযোগিতামূলক নানা পরীক্ষায় বসানো, অনলাইন অ্যাসেসমেন্ট-এর জন্য রাজি করানো থেকে রাত জেগে সন্তানের পড়ার টেবিলের পাশে বসে থাকা– সবই মায়েদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। মায়েদের জগৎটা সন্তানকে ঘিরে এমনই আবর্তিত হতে থাকে যে তিনি আত্মীয়স্বজন ত্যাগ দিয়ে শুধু সন্তানের জন্যই সময় অতিবাহিত করেন। কাকভোরে উঠে সন্তানকে তৈরি করা, তার জন্য খাবার বানানো দিয়ে দিন শুরু হয়ে, মধ্যরাতে সে যতক্ষণ না শুতে যাচ্ছে, ততক্ষণ পাশে থাকাটাই মায়ের রুটিন। এরপরও যদি সন্তান আশানুরূপ ফল না করতে পারে, তাহলে মুখ লুকিয়ে ঘোরা ছাড়া মায়ের আর রাস্তা কী?

এ আমাদের সরকারি নীতির ব্যর্থতা যে, শিক্ষা এখন শুধুই অন্তসারশূন্য এক সিলেবাসের সীমাবদ্ধতায় আটকে গেছে। পরীক্ষাগুলির ধরন যেমন, তাতে ছাত্রছাত্রীর সঠিক মান নির্ণয় হয় না। মধ্য বা নিম্ন-মেধার পড়ুয়া আগেও ছিল, কিন্তু অন্তত তারাও সুযোগ পেত নিজের মান অনুযায়ী রুজি-রোজগার করার মতো কেরিয়ার বেছে নেওয়ার। যবে থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় ৯৮ বা ৯৯.৫ শতাংশ নম্বর ওঠা শুরু হয়েছে, ৯০-য়ের নীচে নম্বর পাওয়া প্রতিটি শিক্ষার্থীই সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে শুরু করেছে, আর অসফল হলে তো কথাই নেই। কিন্তু ৯০-য়ের উপর নম্বর পাওয়া পরীক্ষার্থীর সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। ফলে তাদেরও ইচ্ছেমতো বিভাগে সুযোগ পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকছে না। দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষাতেই তো থেমে থাকলে চলবে না, রয়েছে আইআইটি বা জয়েন্ট এন্ট্রান্স-এর মতো কেরিয়ারমুখী নানা পরীক্ষার প্রতিযোগিতা। মধ্য-মেধা বা নিম্ন-মেধার শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এসব সুযোগ নেই, ফলে তাদের জন্য পড়ে থাকে অ্যামাজন বা ফ্লিপকার্টের পণ্য পরিবহনের কাজ, বা কল সেন্টারের লাঞ্ছনা সহ্য করার চাকরি। বস্তুত দ্বাদশ শ্রেণির এই পরীক্ষা প্রায় চিনের প্রাচীরের মতোই অলঙঘনীয়। যদি বা টপকানো গেল, তারপর এমবিএ, এমবিবিএস বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেই মাসিক লক্ষাধিক টাকার চাকরি মিলবে, তেমন নিশ্চয়তা কোথায়? কিন্তু চাকরি প্রার্থীর সংখ্যাটা যেরূপ ক্রমবর্ধমান, তাতে একটা মোটামুটি মাইনের চাকরি পাওয়াই বিরাট ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ৯০-এর বেশি বা কম যেটাই পাক না কেন সন্তান, মায়েদের চিন্তা থেকে মুক্তি নেই।

কেবল বেকারত্বকে ইস্যু করে বিপক্ষ দলনেতারা ভোটের বাজার গরম করেছেন এবার। নরেন্দ্র মোদির তো বক্তব্য, বালাকোট-এ হামলা করে পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়ে গেছে, গো-বধ নিষিদ্ধ করা হয়ে গেছে, ভারত মাতা কি জয় বলার মধ্যে দিয়ে দেশভক্তি সঞ্চার করা হয়ে গেছে। ১০০ কোটির দেশে এতেই সব দুঃখ মোচন করা হয়ে গেছে। এদিকে কেবল মায়েরাই জানেন দ্বাদশ শ্রেণির গাঁট না- পেরোনো মেয়ের, বিয়ের বাজারে কদর কমে। ছেলে একটি যুথসই কেরিয়ার গড়ায় অসফল হওয়া মানে ঠিক কি?

বস্তুত আমাদের দেশের পড়ুয়াদের আরও অনেক কেরিয়ার অপশন্স নিয়ে এই মুহূর্তে সরকারের ভাবা উচিত। যাতে শুধু মেধাবীরাই নয়, কম মেধার ছেলেমেয়েরাও কেরিয়ার তৈরি করা থেকে বঞ্চিত না হয়। শিক্ষার মান উন্নয়ন করার মধ্যে দিয়ে শুধু মেধার চাষ করাটাই সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়, প্রয়োজন সমস্ত পরীক্ষার্থীর রোজগারের পথকে সুগম করা। প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীই যাতে নিজের যোগ্যতা ও মেধা অনুযায়ী কোনও না কোনও পথ খুঁজে পান, জীবন নির্বাহের জন্য। এর দ্বারাই সমাজ এগোবে, শুধু মেধার জয় জয়কার করলেই হবে না।

 

 

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...