লাক্ষাদ্বীপের আগত্তি দ্বীপে নেমে চূড়ান্ত আশ্চর্য হয়েছিলাম। ছোট্ট দ্বীপ আগত্তি, চওড়ায় কোথাও বা ৫০০ মিটারেরও কম। সেই দ্বীপের এক ধারে দেখেছিলাম সাদা-ঘোলাটে জলের উত্তাল সমুদ্র আর অপর পাড়ে তুঁতে নীল শান্ত সমুদ্র। চিলিকা হ্রদের মধ্যে এক ছোট্ট দ্বীপ রাজহংস সেখানে দেখলাম প্রকৃতির আর এক বিস্ময়। এক পাড়ে উত্তাল বঙ্গোপসাগর আর এক পাড়ে স্বল্প গভীরতার চিলিকার ঈষৎ লবণাক্ত জল। রাজহংস দ্বীপ যেতে হলে প্রথমে যেতে হবে সাতপাড়া। আর সাতপাড়া ভ্রমণ করতে হলে শুরু করতে হবে পুরী থেকে।

পুরীতে আমরা এসেছিলাম ২০-২৫ জনের একটা বড়ো দল নিয়ে। মুখ্য উদ্দেশ্য এক ফটোগ্রাফি ওয়ার্কশপে যোগদান। তারই অঙ্গ হিসাবে আমরা যাত্রা করেছি পুরী থেকে চিলিকার পথে। আমাদের চিলিকা ভ্রমণ শুরু হবে সাতপাড়া থেকে। সাধারণত পর্যটকরা রম্ভা বা বরকুলের পর্যটন আবাস থেকে চিলিকা ভ্রমণ করেন কিন্তু পুরী থেকে সে দূরত্ব অনেকটাই বেশি। এদিকে পুরী থেকে সাতপাড়া মাত্র ৬০ কিমি, ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে সড়কপথে পৌঁছানো যাবে। চিলিকার কোলে তৈরি হয়েছে নব পর্যটন কেন্দ্র সাতপাড়া। এখানে পর্যটক আবাসও গড়ে তুলেছে ওড়িশা পর্যটন দফতর। আর এখান থেকেই প্রাইভেট বোটে বা সরকারি ব্যবস্থাপনায় ভেসে পড়া যায় চিলিকার বুকে।

পুরীর হোটেল থেকে ৩টি গাড়ি একসঙ্গে ছেড়ে দিল সাতপাড়ার উদ্দেশ্যে। পুরী শহর ছেড়ে গাড়ি এগিয়ে চলল। ঘন্টাখানেক চলার পর পেরিয়ে এলাম ব্রহ্মগিরি। এখানে দু-চারটে দোকানপাট চোখে পড়ল, গ্রামও রয়েছে। কাছেই আলারনাথ মন্দির। আমরা পুরী থেকে ২০-২৫ কিমি চলে এসেছি। একটু পরেই চোখে পড়ল দূরে চিলিকা হ্রদ। রাস্তার একপাশে চাষের জমি অন্যপাশে জলাভূমি পার হয়ে চিলিকার নীল জল। গাড়ি ছুটে চলেছে গ্রাম ছাড়িয়ে মাঠ-ঘাট পেরিয়ে রিঠা ফলের বড়ো বড়ো জঙ্গল ফেলে রেখে। পুরী জেলার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সাতপাড়ার যোগসূত্র দহিখিয়া পুল দিয়ে। এপারে মানিক পাটনা আর ওপারে সাতপাড়া।

গাড়ি এসে থামল সাতপাড়া যাত্রীনিবাসের সামনে। পুরী থেকে সময় লাগল ঘন্টা-দুয়েকের একটু বেশি। বেলা এখন সাড়ে ন’টা। ব্রেকফাস্ট সেরেই আমরা বেরিয়েছি। যাত্রীনিবাসে রেস্তোরাঁ আছে, সেখানে দুপুরের খাবারের অর্ডার দিয়ে এখন শুধু এক কাপ চা নিয়ে বসলাম। সাতপাড়ার কাছাকাছি চিলিকায় দেখতে পাওয়া যায় ডলফিন। তাই চিলিকার এই দ্বীপটিকে পর্যটন দফতর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। দ্রুত উন্নতি ঘটে সাতটি পাড়া দিয়ে গঠিত এই দ্বীপগ্রাম সাতপাড়া পর্যটন কেন্দ্রের।

১৯৯৭ সালে ওড়িশার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জনকীবল্লভ পট্টনায়েক দ্বারোদ্ঘাটন করেন সাতপাড়া যাত্রীনিবাসের। আর এই সময়েই নির্মিত হয় দহিখিয়া পুল। যাতায়াতের পথ তাতে আরও সুগম হল, একদম লেকের কোলে এই যাত্রীনিবাস। খান দশেক দ্বিশয্যাবিশিষ্ট স্নানাগার সংলগ্ন ঘর। রেস্তোরাঁও রয়েছে। পাশেই জেটিঘাট, সেখান থেকেই চিলিকা ভ্রমণের সব নৌকো ছাড়ে। ঘাটের ধারেই বোট বুকিং-এর কাউন্টার বসেছে। এক ঘন্টা থেকে আট ঘন্টা সময়সীমার নানা ধরনের টুর সাজানো রয়েছে। তারই মধ্যে আমরা বেছে নিলাম একটি। সাড়ে ৩ ঘন্টার টুর, নিয়ে যাবে ডলফিন দেখাতে সঙ্গে রাজহংস দ্বীপ ও চিলিকা-সমুদ্রের মোহনা। ১্৩০০ টাকা যাতায়াত, যেতে পারবে বোটপিছু ৮ জন যাত্রী। আমাদের প্রয়োজন ৩টি বোট, তারই তোড়জোড় চলতে লাগল। বিভিন্ন রুটে বিভিন্ন সময় সীমায় পর্যটকদের বোট নিয়ে যায়। বোর্ডে তার গন্তব্য, সময় ও অর্থমূল্য লেখা রয়েছে।

জেটির আশেপাশে একটু ঘুরতে থাকি। বোট ছাড়তে আধঘণ্টা দেরি হবে। নতুন পাকা জেটির নির্মাণ কাজ চলছে, হয়তো বছর খানেকের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। কাছাকাছি কয়েকটি চা-জলখাবারের দোকানও গড়ে উঠেছে। মাঝি-জেলেরা সব দোকান ঘিরে গল্প-গুজব করছে। একটি মাছরাঙা পাখি অনেকক্ষণ ধরে গাছের এ-ডাল ও-ডাল ওড়াউড়ি করছিল। তার পিছনে অনেকক্ষণ ছুটোছুটি করে ছবি তোলা গেল।

আলাপ হল স্থানীয় এক দোকানদারের সঙ্গে। সে তো বেশ গল্প জমিয়ে দিল। কাছাকাছি গ্রামেই তার বাড়ি। তার কাছেই জানতে পারলাম সাতপাড়ার ৪ হাজার অধিবাসীর মধ্যে অধিকাংশই মৎস্যজীবী না হয় মাঝি সম্প্রদায়ের। তবে এখানকার গ্রাম আর পিছিয়ে পড়ে নেই। আধুনিকতার সব সরঞ্জামই এখানে উপস্থিত। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ টেলিফোন, কেবল টিভি সবই রয়েছে। আরও জানা গেল জেটির অন্যধারে রাস্তার ওপরেই গড়ে উঠেছে চিলিকা ডেভেলপমেন্ট অথরিটি পরিচালিত ভিজিটিং সেন্টার আর চিলিকা ইকো পার্ক। এদিকে বোটে ওঠার ডাক পড়েছে, ভিজিটিং সেন্টার আর ইকো পার্ক ফিরে এসেই দেখব।

বোটের ব্যবস্থা খুব আরামপ্রদ বা সুখকর নয়। কাঠের পাটাতনেই বসার ব্যবস্থা, মাথার উপর ছাউনি আছে। জোরে বৃষ্টি হলে মাথা ছাড়া আর কিছু রক্ষা পাবে না। আজকে রৌদ্রজ্বল দিন বেলা তখন সাড়ে দশটা। মাছধরা জালের ঘেরাটোপ এড়িয়ে এগিয়ে চলেছে বোট। দু’একটা পানকৌড়ি ছাড়া আর কোনও পাখি নজরে আসছে না। মাঝি জানাল পাখি দেখতে হলে যেতে হবে নলবন এখান থেকে ঘণ্টা আড়াইয়ের জলপথ। মিনিট কুড়ি চলার পর মাঝি বোট থামাল। বলল চুপচাপ থাকুন এইখানেই দেখা যাবে ডলফিন। দূর থেকে ভেসে যাওয়া জলজ উদ্ভিদ বা জলের মধ্যে ডুবে থাকা ড্রাম দেখেই আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়ছি এই বুঝি ডলফিন দেখা গেল।

ইতিমধ্যে ওই স্পটে আমাদের বোটগুলি ছাড়াও আরও কয়েকটি নৌকো এসে জড়ো হয়েছে। সেই নৌকোর যাত্রীদের উদ্দেশ্যও এক– ডলফিন দর্শন। হঠাৎ-ই নজরে এল ডলফিনের ঝাঁক। কখনও পিঠ কখনও বা লেজের খানিকটা অংশ দেখিয়ে মুহূর্তের মধ্যে জলে ডুব দিচ্ছে। অতি দ্রুত ডুবে লাফিয়ে চলেছে সাঁতার কেটে। চট করে নজর করতে না পারলে বোঝা মুশকিল, ছবি তোলাতো দূর অস্ত। অনেকগুলি ডলফিনই এভাবে দেহের আংশিক দেখিয়ে দ্রুত বেগে হারিয়ে গেল জলের অন্তরালে। ইরাওয়াড়ি ডলফিন নামে পরিচিত এই শুশুকগুলি আকারে অবশ্য বেশি বড়ো নয়।

ডলফিনের এলাকা ছেড়ে আমরা এগিয়ে চলি। লেকের জল স্থির, রং তার সবজে নীল, কাছে-দূরে ছোটো বড়ো দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। কখনও আমরা দ্বীপের থেকে দূরে সরে যাচ্ছি আবার কখনও এগিয়ে যাচ্ছি তার দিকে। বর্ষার সময় চিলিকা হ্রদের এলাকা বেড়ে দাঁড়ায় ১১৬৫ বর্গ কিমি আর গ্রীষ্মে তা ছোটো হয়ে ৯৬০ বর্গ কিমি। ওড়িশার পুরী, খুরদা আর গঞ্জাম জেলার অংশবিশেষ নিয়ে এই হ্রদের বিস্তৃতি। এই বিশাল জলরাশির মধ্যে ছড়িয়ে আছে ২২টি ছোটো-বড়ো দ্বীপ। এই দ্বীপগুলির জনসংখ্যা প্রায় ৩০,০০০ আর হ্রদের দুপাশ জুড়ে আছে প্রায় ১৪৪টি গ্রাম। প্রায় সকলেই এখানে ধীবর সম্প্রদায়ের মৎস্যজীবী।

এই হ্রদের গভীরতা কিন্তু বেশি নয় ২ ফুট থেকে ৬ ফুটের মধ্যে। অল্প গভীরতায় বোট থেকে দেখা যাচ্ছে স্বচ্ছ জলের মধ্যে দিয়ে নীচের জলজ উদ্ভিদ, ছোটো ছোটো মাছের বিচরণ– ঠিক যেন এক বিশাল অ্যাকোয়ারিয়াম। প্রায় ২ছ৭ প্রজাতির মাছ আর ২৯ প্রজাতির চিংড়ি পাওয়া যায় চিলিকায়। এক বিশাল সংখ্যক ধীবরদের জীবিকা নির্ভর করে এই মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে। ৫চ্-টি নদী ও নালার জল এসে চিলিকাকে সমৃদ্ধ করেছে। এর সঙ্গে মেশে সমুদ্রের জল। মিষ্টি জলের সঙ্গে সমুদ্রের জল মিশে তৈরি হয় ঈষৎ লবণাক্ত জল। এই মিশ্র জলের পরিবেশে সৃষ্টি হয় নতুন নতুন প্রজাতির মাছ। আর এই বিশাল মাছের জোগানের জন্যই আকর্ষিত হয় ডলফিনের দল।

জলে ভেসে বেড়াচ্ছে এখন অনেক বোট। তার মধ্যে অধিকাংশই মাছ ধরার জন্য আর কয়েকটি ঘুরছে পর্যটকদের নিয়ে। রোদের তেজ ভীষণ বেড়ে গেছে। মাথার ওপর ছোটো আচ্ছাদনে আর তেজ রোখা যাচ্ছে না। ঘণ্টাখানেক জলবিহারের পর আমরা পৌঁছোই আমাদের পরবর্তী গন্তব্য রাজহংস দ্বীপে। ছোট্ট দ্বীপের ছোট্ট জেটিতে আমরা একে একে বোট থেকে নামলাম। সবুজ দ্বীপটি দেখেই মন ভরে যায়। দ্বীপটি বেরহামপুর বনবিভাগের অন্তর্গত।

চিলিকা ওয়াইল্ড লাইফ ডিভিশনের মধ্যে সাতপাড়া রেঞ্জের মধ্যে এর অবস্থান। এগিয়ে চলি দ্বীপের অভ্যন্তরে। সামনেই এক নজরমিনার তবে খুব একটা উঁচু নয়। সিড়ি বেয়ে তার ওপর উঠে দ্বীপটি একটু নজরদারি করি। সারা দ্বীপ জুড়ে ঝাউবনের আধিক্য, সঙ্গে আছে পোলাং গাছ। এই পোলাং গাছ থেকে তেল পাওয়া যায়। তারই মধ্যে দিয়ে সবুজ মাঠের বুক চিরে চলে গেছে লাল টালির বাঁধানো পথ। এক শান্ত মায়াময় পরিবেশ, নির্জনতাকে যারা ভালোবাসে তাদের পক্ষে একেবারে আদর্শ। তবে জায়গাটি পর্যটনক্ষেত্র হিসাবে এখনও গড়ে ওঠেনি। দ্বীপটির আড়াআড়ি প্রস্থ বরাবর হাঁটতে থাকি লাল টালি বাঁধানো পথ ধরে। পথে পড়ল এক ফরেস্ট রেস্ট হাউস– দুটি ঘর রয়েছে সেখানে। একটা রাত এখানে কাটাতে পারলে এক অনন্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হবে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

রেস্টহাউসের গায়ে দিক নির্দেশ দিয়ে লেখা রয়েছে ‘ওয়ে টু বিচ’ অর্থাৎ সামনেই সমুদ্র সৈকত। সেই নির্দেশিত পথে মিনিট দশেক হেঁটে পৌঁছে গেলাম সমুদ্র-সৈকতে, যেখানে বঙ্গোপসাগরে জলরাশি গর্জন করে আছড়ে পড়ছে রাজহংস দ্বীপের বালুকাবেলায়।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুন্দর সৈকত– কটা লোকই বা আসে যে নোংরা করবে। হলুদ বালির সৈকতে ঢেউ আছড়ে পড়ে ফিরে যাচ্ছে ফেনা হয়ে। জুতো খুলে জলে পা ডুবিয়ে উপভোগ করি সমুদ্রের মাদকতা। ভাবতে থাকি প্রকৃতির কি অদ্ভুত সমন্বয়! এক ধারে হ্রদের জল মাঝে ঝাউবনের জঙ্গলে ঘেরা দ্বীপ আর অপর পারে উত্তাল সমুদ্র। ফিরে চলি বোটে সেই একই পথে। মনে মনে স্বপ্ন দেখি, দ্বীপের এই অপার নির্জনতার মধ্যে একটা রাত কাটানোর সৌভাগ্য কবে হবে!

বোট আবার ছেড়ে দেয়। সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে জল। চেয়ে থাকি চিলিকার বিশালত্বের দিকে। বিশাল বালির চড়া সৃষ্টি করেছে এই বিশাল হ্রদ। সমুদ্রের নোনা জল, নদীর ও বৃষ্টির মিষ্টি জল সৃষ্টি করেছে এই অপার জলরাশি। আমরা চলেছি ‘সি-মাউথের’ উদ্দেশে অর্থাৎ যেখানে সমুদ্র প্রবেশ করেছে এই চিলিকা হ্রদে। আরো প্রায় ৪০-৪৫ মিনিট নৌকোযাত্রার পর পৌঁছোলাম সি মাউথ তথা মোহনার কাছে। দূর থেকে অবশ্য সমুদ্র দেখা যাচ্ছে না। তীরে অনেকগুলি প্লাস্টিক শিট আচ্ছাদিত দোকানঘর, অনেকগুলি বোট বাঁধা, লোকজনের এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি।

এখানে সে রকম কোনও জেটি নেই। বালির উপর একে একে সবাই নামলাম। নামতেই দুজন লোক এগিয়ে এল। হাতের গামলায় রয়েছে বন্ধ ঝিনুক। ভেঙে দেখাল ভেতরে রয়েছে মু্ক্তো। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা মনে হল কেমন যেন লোক ঠকানো। প্লাস্টিক ছাউনির নীচে অনেক দোকান– চা, কফি, ডাব, ঠান্ডা পানীয় মাছভাজা, ভাত চিংড়ির পদ এমনকী চিলি চিকেনও পাওয়া যাচ্ছে। খদ্দেরও অনেক। হ্রদের ধারে বালি এসে উঁচু ঢিবির মতো চড়াই হয়ে গেছে। সেই বালির চড়াই ভেঙে উপরে উঠলাম। এবার সমুদ্র দর্শন হল। নীল আকাশ, নীল সমুদ্র, সাদা ঢেউ সাদা ফেনা সমুদ্র তটে হাতে গোনা দু-একজন। ডাবের মধ্যে স্ট্র ডুবিয়ে জল পান করতে করতে কিছুক্ষণ সমুদ্র দর্শন, ছবি তোলাও হল। প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সমুদ্র ও হ্রদের মোহনা। বালির উপর দিয়ে হাঁটা বেশ পরিশ্রমসাধ্য, তার উপরে গনগনে রোদ। হ্রদের জল ও সমুদ্র যাতে মিশতে পারে তাই একফালি পথ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে বালির চড়ার মধ্যে দিয়ে। সেই পথ দিয়ে সাদা ফেনার মুকুট পরা ঢেউ ঢুকছে চিলিকা হ্রদে।

এখানে আর বেশি সময় দেওয়া গেল না, দুপুরের খাওয়া সাতপাড়ার রেস্তোরাঁয় গিয়ে করতে হবে। অতএব আবার বালির পথ পার হয়ে নৗকোয় ফেরা। তীর ধরে বোট চলছে। নজরে এল তীরের ধারেই এক বালির টিলা তার মাথায় ঝাউগাছের সারি। পথে আর কোথাও থামা নয় একেবারে সোজা সাতপাড়া ঘাটে।

খিদেয় পেট জ্বলছে। তবে খাবার প্রস্তুতই ছিল। যাত্রীনিবাসের ডাইনিং হলে ভাত, ডাল, আলুভাজা, রুই মাছের ঝোল ও চাটনি খেয়ে পিত্ত রক্ষা করা গেল। হাতে বেশি সময় নেই, আধঘণ্টার মধ্যেই পুরীর উদ্দেশে রওনা হব। ছুটলাম ভিজিটিং সেন্টার দেখতে। চিলিকা ডেভেলপমেন্ট অথরিটি পরিচালিত এই ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার। এই কেন্দ্রটি ২০০২ সালে ওড়িশার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক উদ্বোধন করেন। বাইরে থেকে বাড়িটি দর্শনীয়, চারদিকে বাগান ফুলগাছ। দশ টাকার টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করি।

নানা তথ্যসমৃদ্ধ লেখা ও ছবির সাহায্যে দেখানো হয়েছে হ্রদের নানা বৃত্তান্ত। অনেকগুলো ঘর জুড়ে এই ভিজিটিং সেন্টার। একটি প্যানেলে মিষ্টি জলের মাছ সম্পর্কে তথ্য। এখানে জানানো হয়েছে ইলিশ সমুদ্রের জল থেকে এসে মিষ্টি জলের মোহনায় ডিম পাড়ে। চিলিকার ইলিশের উৎস বোঝা গেল।

অন্য একটি প্যানেলে প্ল্যাংকটন সম্পর্কে তথ্য– এরা হল অতি ক্ষুদ্র গাছ বা জীব যা শুধুমাত্র অনুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখা যায়। এরা জলের উপরে ভাসমান ও মাছের খাদ্যের প্রধান উৎস। নলবন পাখিরালয় সম্পর্কেও তথ্য রয়েছে। শীতে এখানে ২২৫ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে, এই ১৫ বর্গ কিমি দ্বীপে। এই অঞ্চলে দেখা যায় এমন জীবজন্তু, পাখিদের মডেলও প্রদর্শিত হচ্ছে ভিজিটিং সেন্টারে।

এছাড়াও দেখানো হয়েছে নানা ধরনের পাখিদের খাওয়ার ধরন। এলাকার ধীবর সম্প্রদায়ের জীবন যাত্রা। মাছ ধরার নানা প্রণালী, নানা ধরনের মাছ ধরার জাল ও ফাঁদের বিশেষত্ব। একটি হাঙরের কঙ্কালও প্রদর্শিত হচ্ছে। একটি মডেলে ডলফিন সংরক্ষণে নাতিদীর্ঘ তথ্য ও আলোচনা রয়েছে।

ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার দেখা মোটামুটি শেষ করে ছুটি এবার রাস্তার ওপারেই চিলকা ইকো পার্কের গেটে। গেটের মুখেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিজু পট্টনায়কের মূর্তি। এখানে প্রবশের জন্য কোনও মূল্য দিতে হল না। চিলিকা ডেভেলপমেন্ট অথরিটির তত্ত্বাবধানে নির্মিত এই পার্ক। ঢুকেই চোখে পড়ে মখমলের মতো নরম সবুজ ঘাসের লন আর তাঁর মধ্যে দিয়ে লাল টালি বসানো আঁকাবাঁকা পথ বিভিন্ন দিকে চলে গেছে।

ছোট্ট নালার উপর অলংকৃত ছোট্ট সেতু পেরিয়ে চললাম বাগানের এক প্রান্তে। সেখানে নারকেল গাছের সারি, একটি সাদা-কালো লাইটহাউস আর কাচের আচ্ছাদনের মধ্যে একটি হাঙরের কঙ্কাল। তার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চিহ্নিত করা রয়েছে। পার্কের মাঝখানে ফোয়ারা আর একটি ছোটো ঘর। হয়তো এটি বাগানের কেয়ারটেকারের বাসস্থান। এখন হু-হু করে হাওয়া দিচ্ছে। নারকেল গাছগুলি সেই হাওয়ায় দুলছে আর তার ছায়া, বাগানের ঘাসের উপর সৃষ্টি করছে এক রৌদ্রছায়ার দোদুল্যমান মানচিত্র। ঘড়িতে দেখি সময় অতিক্রান্ত, দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলি যাত্রীনিবাসের দিকে, যেখানে আমাদের গাড়িগুলি অপেক্ষা করছে।

(১) ডলফিন ট্যুর এক থেকে দেড় ঘন্টা, ৭০০ টাকা

(২) ডলফিন হেভেন্স আইল্যান্ড লিটল বার্ড , ২ ঘন্টা, ১২০০ টাকা

(৩) ডলফিন, মোহনা, কালিজাই মন্দির , তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা, ১৩০০ টাকা

(৪) ডলফিন হেভেনস অ্যাইল্যান্ড, দেড় ঘন্টা, ১০০০ টাকা

(৫) ডলফিন, নলবন পক্ষীনিবাস , ৪ ঘন্টা, ১৫০০ টাকা

(৬) ডলফিন, নলবন, কালিজাই , ৭ ঘন্টা, ২৫০০ টাকা

(৭) ডলফিন, কালিজাই, বরকুল, ৮ ঘন্টা, ২৭০০ টাকা

প্রয়োজনীয় তথ্য

(১) পুরী থেকে সড়কপথে সাতপাড়ার দূরত্ব ৬০ কিমি। গাড়ি ভাড়া করে অথবা ওড়িশা পর্যটনের কনডাকটেড টুরে ঘুরে নেওয়া যায়।

(২) নিজের পছন্দমতো জলপথে চিলিকা ভ্রমণের রেট নির্দিষ্ট করা আছে।

(৩) পুরীতে অথবা সাতপাড়ার যাত্রীনিবাসে রাত্রিবাস করা যাবে।

(৪) যোগাযোগ ওড়িশা পর্যটন, উৎকল ভবন, ৫৫ লেনিন সরণি, কলকাতা-৭০০ ০১৩। ফোন – ২২৪৯-৩৬৫৩, ২২১৬-৪৫৫৬।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...