পাত্রপক্ষ

পিসিমা হাই সুগারের রুগি, তাই মিষ্টি খাওয়া একেবারে মানা। এটা শুনে পাত্রীর বাবা দৌড়ে গিয়ে পাড়ার হরি ময়রার দোকানের বিখ্যাত হিংয়ের কচুরী নিয়ে এলেন। লোভে পড়ে পিসিমার দ্বারা গোটা পাঁচেক কচুরী সাবাড়। আর তারপরই শুরু হল পিসিমার পেটে মোচড় দেওয়া। সে ভয়ংকর মোচড়, কোনও বাধা মানতে চায় না। পিসিমা প্রমাদ গুনলেন।

পিঠ সোজা করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনাদের বাথরুমটা কোথায় দেখান। আর একটা গামছা দেন আমারে।” পিসিমার ভাইঝি অর্থাৎ আমার শ্যালিকা পিসিমার এই কাণ্ড দেখে লজ্জায় মরে যায় আর কী। এরপর ওই বিবাহের প্রস্তাবের গাড়ি সে যে কারণেই হোক বেশি দূর এগোয়নি। শ্যালিকাও পিসিমার সাথে আর কোনও পাত্রী দেখতে যায়নি।

আমার এক খুড়শ্বশুর ভীষণ রসিক মানুষ। এবার শোনাই ওনার মুখে শোনা গল্প। আগেকার দিনে কিছু ছেলে থাকত ভীষণ লাজুক। বাবা মাকে বলত, ‘মেয়ে তোমরাই দেখে পছন্দ করো। আমার যাওয়ার দরকার নেই।”

জলপাইগুড়িতে এরকমই একটি ছেলে আমার খুড়শ্বশুরের বন্ধু, তার সম্বন্ধ এল জলপাইগুড়ির এক বিত্তশালী পরিবার থেকে। ছেলেটি দিল্লিতে চাকরি করে। বাড়িতে আসবে বিয়ের আগে। বাবা, ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে গিয়ে প্রচুর ধারদেনা করেছেন। দেনা তখনও সব মিটিয়ে উঠতে পারেননি। ছেলে এসে বিয়ের আগে বন্ধুদের আড্ডাতে পৌঁছল। বন্ধুদের মধ্যে ফিসফিসানি! এক বন্ধু বলেই ফেলল, “হ্যাঁ রে তুই মেয়ে দেখেছিস!”

ছেলে বলল, “ওসব বাবা-মা সেরেছেন। ওনাদের পছন্দ ই আমার পছন্দ।”

এরপর ছেলে বহুবন্ধু পরিবৃত হয়ে টোপর পরে ছাদনাতলায় উপস্থিত হল। কনে এল পানপাতা দিয়ে মুখ ঢেকে জামাইবাবুদের ধরা পিঁড়িতে চড়ে। ঘনিয়ে এল শুভদৃষ্টির সময়। মুখের সামনে থেকে হাতের পান সরল। ছেলে অতি আকাঙ্ক্ষিত দর্শনের পরই আমার খুড়শ্বশুরের কাঁধে মাথা দিয়ে জ্ঞান হারাল।

কনের সামনের দিকের তিনটি দাঁত বিসদৃশ ভাবে উঁচু হয়ে ছিল। তখনকার দিনে উঁচু দাঁত নীচু করে স্বাভাবিক করার চিকিৎসা আসেনি। সব শোনার পর খুড়শ্বশুরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তারপর।ত

উনি বললেন, ‘তারপর আর কী! জ্ঞান ফিরতে ওই বিয়ে করবে না বলে জেদ ধরেছিল। বিয়ের জন্য মেয়ের বাবার থেকে অনেক টাকা পণ নিয়েছিলেন ছেলের বাবা। ধমকে ছেলেকে বিয়ের পিঁড়িতে বসালেন।”

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর!’

শ্বশুরমশাই বললেন, ‘তারপর আর কী, তিনটে বাচ্চা হল। সব ঠিক হয়ে গেল।”

এর বেশি আর ‘তারপর শ্বশুরমশাইকে জিজ্ঞেস করা যায় না। তার উপর রসিকবাচন পারদর্শী শ্বশুরমশাই।

এক আত্মীয়র আন্দামানে মারাঠি মেয়ের সাথে প্রেম হয়। মেয়েটি বাংলা ভাষা খুব তাড়াতাড়ি ভালোরকম শিখে ফেলে। এতে অবশ্য তার বাঙালি প্রেমিকেরও অবদান ছিল। বিয়ের আগে মেয়ের বাড়িতে এসে মেয়েটির ভবিষ্যতের নন্দাই মজা করে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘গুঁতোর মানে জানেন’

স্মার্ট উত্তর দেয়, ‘একটু এদিকে আসলেই বুঝিয়ে দিতে পারব।’

নন্দাইমশাই উত্তর দেন, ‘যাওয়ার দরকার নেই, বুঝেছি বাংলা শেখা অনেক দূর এগিয়েছে।”

মেয়ে দেখতে আসার আগে কমজোর মেয়েদের আগে ভালো করে ট্রেনিং দেওয়া হতো। প্রথম সতর্কবাণী, বেশি কথা বলবে না। দ্বিতীয় সতর্কবাণী, আজ অন্তত লাজুক ভাবে বসে থাকবে। তৃতীয় সতর্কবাণী, গুরুজন সবাইকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে। ঠাকুমার মুখে শুনেছি কোনও একটি মেয়েকে পছন্দ হওয়ার পর সম্বন্ধ ভেঙে যায়। কারণ বেরনোর সময় মেয়েটির কথায় নির্বুদ্ধিতার প্রকাশ হওয়াতে।

মেয়েটি দরজায় দাঁড়িয়ে বিনয়ের সাথে বলেছিল, ‘এখানে সম্বন্ধ পাকা না হলেও আপনারা আবার আসবেন।’ কথাটা খারাপ কিছুই বলেনি, লোকজন খারাপ ভাবে নিয়ে নেয়।

আর আরেক জায়গায় পাত্রী অতিরিক্ত মাথা নীচু করে প্রণাম করতে করতে পাত্রপক্ষের সাথে বসে থাকা নিজের ছোটো বোনকেও প্রণাম করে ফেলেছিল।

আমার এক পরিচিতা সাত তাড়াতাড়ি বিয়ের পিড়িতে বসবে না বলে জেদ করে কোনও মেক-আপ ছাড়াই, হাওয়াই চটি পরে, গায়ে কালো শাল জড়িয়ে অনিচ্ছুক ভঙ্গিমাতে পাত্রপক্ষের সামনে এসে বসে। সেই পরিচিতা যথেষ্ট সুন্দরী এবং ভালো মনের মেয়ে ছিল। জহুরির চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি সে। পাত্র বাবা-মার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই মেয়েকে ওখানেই পছন্দ করে জানিয়ে দেয়। পরবর্তী জীবনে শ্বশুরবাড়িতে পুরো পরিবারের সবচেয়ে পছন্দের মানুষ হয়ে ওঠে মেয়েটি।

আগেকার দিনে মেয়ে গান গাইতে জানে কিনা সেটা সবচেয়ে আগে জিজ্ঞেস করা হতো। একটু আধটু গান গাইতে জানলেই চলত। মোটা মেয়ে হলে গান ধরত— আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে… আর তারপর আমার এই দেহ খানি তুলে ধর…।

আর কালো মেয়ে গাইত আপনারা ভাবছেন— কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, মোটেই না। আগ বাড়িয়ে নিজের উইক পয়েন্টের ঢাক কেউ পেটায় নাকি?

একটু বিনয়ী কালো মেয়েরা গাইত— তুমি নির্মল কর মঙ্গল কর মলিন মর্ম মুছায়ে/ তব পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে। অর্থাৎ আমি যেরকমই দেখতে হই না কেন, তুমি তোমার অন্তরের মহানুভবতা দিয়ে আমাকে উদ্ধার করো।

আবার একটু উদ্ধত কালো মেয়েরা গাইত — আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব / আমি হাত দিয়ে দ্বার খোলাব না, গান দিয়ে দ্বার খোলাব।

শেষ করি একটি মিষ্টি প্রেমের মিষ্টি পরিণতি দিয়ে। একই পাড়াতে থাকত একটি সুদর্শন ছেলে এবং অতি সুন্দরী একটি মেয়ে। দুজনেরই দু’জনকে খুব ভালো লাগত। আসতে যেতে একজন আরেকজনের দিকে না তাকিয়ে পারত না। দু’জনে সমবয়সি ছিল। ছেলেটি ভীষণ লাজুক, মেয়েটিকে গুছিয়ে কিছু বলার আগেই মেয়েটির সম্বন্ধ দেখে দিল্লিতে বিয়ে হয়ে গেল।

এরপর কর্মসূত্রে ছেলেটিও দিল্লি চলে যায়। সংসার হয় এবং পাকাপাকি ভাবে দিল্লিবাসী হয়ে যায়। এর অনেক দিন পর নিজের বিবাহযোগ্য ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে দিল্লিতে সেই মেয়েটির বাড়িতেই পৌঁছোয় ছেলেটি পাত্রর বাবা হয়ে। আর পাত্রী ছিল অল্প বয়সের প্রেম নিবেদন করতে না পারা সেই মেয়েটিরই কন্যা। এক দেখাতেই বিয়ে পাকা।

সবার আগে লাফিয়ে পড়ে ছেলের বাবা মেয়ে পছন্দ হওয়ার সম্মতি জানিয়ে দিল। দুজনেই সযত্নে এড়িয়ে গেল নিজেদের পূর্ব পরিচয়ের ঠিকানা। আইনি জীবনসঙ্গী হিসেবে জীবনে পাওয়ার প্রাপ্তি অপূর্ণ থাকলেও, ‘বেয়াইন’ হিসেবে প্রেমিকাকে ফিরে পাওয়ার প্রাপ্তির মূল্য কম কীসে?

প্রতিধ্বনি ফেরে ( পর্ব ৩ )

নম্রতারা গাড়িতে ওঠামাত্র গাড়ি ছেড়ে দিল। হোটেলের উদ্দেশ্যে পাহাড়ের নীচে দিয়ে গাড়ি নামতে থাকল। ঘড়িতে আড়াইটে বেজে গেছে। রৌদ্রোজ্জ্বল নীলাকাশ কোথা থেকে হঠাৎ করে কালো মেঘে ছেয়ে গেল। নম্রতার মতোই মেঘেরও মুখ ভার। কখন যে মনের আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে বৃষ্টি নামবে স্বামী ধ্রুব বোধ হয় তার আঁচও পাবে না।

নম্রতা জানলার দিকে উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ধাক্কা লাগা ওই অচেনা ভদ্রলোকের কথা ভাবতে লাগল। নম্রতার মন কেন তোলপাড় হচ্ছে আজ। নম্রতা ভাবল যে কেনই বা ওই একঝলক ভদ্রলোকের চোখের চাহনি তার মনকে এত নাড়িয়ে দিয়ে গেল। অত্যধিক ঠান্ডায় ভদ্রলোকের মুখের অর্ধেক অংশ মাফলারে ঢাকা ছিল। সে তো তার সম্পূর্ণ মুখ দেখতে পায়নি। শুধু ভদ্রলোকের চোখ নয়, তার গলার স্বর, হাঁটাচলা সবটাই নম্রতার পূর্ব পরিচিত। এসব কেন মনে হচ্ছে!

আশার গলার আওয়াজে নম্রতার সম্বিত ফিরল। হোটেলের সামনে গাড়ি দাঁড়াতেই আশা চিত্কার করে বলল, মাম্মা, আমরা হোটেলে চলে এসেছি। গাড়ি থেকে নেমে হোটেলের ঘরে ঢোকামাত্র অঝোরে বৃষ্টি শুরু হল।

বাথরুম থেকে নম্রতা ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই ধ্রুব বলল, হোটেলের রুমেই খাবার দিয়ে যেতে বললাম। ওয়েট করো একটু। ধ্রুব আশাকে নিয়ে বাথরুম গেল হাত মুখ ধুতে। মিনিট পনেরোর মধ্যে একটি অল্পবয়সি মেয়ে ঘরে খাবার দিয়ে গেল। খাবার খেয়ে ধ্রুব আশাকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে নিজেও ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল।

বালিশে মাথা দিয়ে নম্রতার চোখে ঘুম নেই। একটা অপরিচিত অথবা একটা অর্ধপরিচিত চোখ তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। নম্রতা আপন মনেই বলে উঠল, ইস, লোকটা তাড়াহুড়ো করে না চলে গেলে অন্ততপক্ষে নামটা জিজ্ঞাসা করা যেত। কিন্তু কেন ওই অপরিচিত লোকটার সবকিছু আমার এত চেনা লাগল! লোকটি কী সত্যিই আমার পূর্বপরিচিত! কে ওই ভদ্রলোক? লোকটার সঙ্গে আমার কি আর দেখা হবে? ধ্রুবর কথায় লোকটি টুরিস্ট যদি হয় তাহলে আবার দেখা হওয়ার সম্ভবনা আছে। দেখা হওয়ার সম্ভবনা থাকলেই বা কী লাভ! কিন্তু কী কারণে আমি লোকটিকে খুঁজছি!

ধ্রুব অর্ধ্বউন্মীলিত চোখে নম্রতার গায়ে হাত দিয়ে বলল, কী এত ভাবছ! একটু ঘুমোলে শরীরটা ফ্রেশ হতো।

নম্রতা হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, দুপুরে ঘুমোনো আমার কোনওদিনই অভ্যাসে নেই। তাছাড়া সন্ধে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ।

ধ্রুব চোখ রগড়াতে রগড়াতে বিছানা ছেড়ে উঠে দেখল পাহাড়ের গায়ে চাপ চাপ অন্ধকার নেমে এসেছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়া বইছে সোঁ সোঁ শব্দে। বৃষ্টির হওয়ার ফলে বাইরে বরফ পড়ার মতো আবহাওয়া। লাচেন নদীর গর্জন শোনা যাচ্ছে জানলার কাছে দাঁড়ালে। হোটেলের একটি ছেলে ধোঁয়া ওঠা দুকাপ কফি দিয়ে গেল। কফির কাপে চুমুক দিয়ে নম্রতা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ল। আশা বিছানায় অকাতরে ঘুমাচ্ছে।

ঘরের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে ধ্রুব নম্রতাকে বলল, তুমি আমাকে এড়িয়ে গিয়ে ভুল করছ। আমি কোনও দোষ না করেও শাস্তি পাচ্ছি। স্বাভাবিক সহজ একটা সম্পর্ককে অযথা অস্বাভাবিক জটিল করে তুলে আমরা দুজনেই ভালো থাকব না। আমিও এতে ভালো নেই। আর তুমিও ভালো থাকবে না।

নম্রতা ধ্রুবর কথার জোরপূর্বক প্রতিবাদ করে একটু উঁচু স্বরে বলল, কে বলল তোমাকে যে আমি ভালো নেই! আমি খুব ভালো আছি। ভালো না থাকার মতো তো কিছু ঘটেনি।

ধ্রুব শান্ত স্বরে বলল, জোর গলায় ভালো আছি বললেই কি ভালো থাকাটা প্রমাণিত হয়! ধ্রুবর এই কথার কোনও প্রত্যুত্তর নম্রতা দিল না। কফি শেষ করে শূন্য কফি মগটা টেবিলে নামিয়ে আশার কাছে চলে এল। আশা ঘুম থেকে উঠে পড়ে যেন নম্রতাকে স্বস্তি দিল।

দুটো দিন লাচেনে কাটানোর পর নম্রতা-রা গ্যাংটকে ফিরে এল। গ্যাংটকের হোটেলে ওরা যখন পৌঁছোল তখন ঘড়ির কাঁটায় বিকাল চারটে। ধ্রুব আর আশা গাড়ি থেকে নেমে হোটেলের রুমে চলে গেল। নম্রতা বাইরে হোটেলের লনে পায়চারি করতে করতে মেঘলা বিকেল উপভোগ করতে লাগল।

বড়ো লন জুড়ে দেশি-বিদেশি ফুলের মেলা। অদূরে পাহাড়ের চূড়ায় সূর্য মুখ লুকাচ্ছে। সকাল থেকেই ঠান্ডা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। মাথার উপর দিয়ে তুলোর মতো মেঘগুলো বিক্ষিপ্ত ভাবে চলে যাচ্ছে। ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া এসে নম্রতার চোখে মুখে চুম্বন করে যাচ্ছে। সে গায়ে উপর শালটা ভালো করে জড়িয়ে হালকা শ্বাস ছেড়ে কাঠের বেঞ্চে বসল। নম্রতার এক হাত দূরত্বে একটা লোক দাঁড়িয়ে ঘনঘন সিগারেট খাচ্ছিল। সিগারেটের গন্ধ নম্রতার কোনওদিনই সহ্য হয় না। ওই গন্ধে নম্রতার অস্বস্তি হতেই নম্রতা বেঞ্চ ছেড়ে উঠে লোকটির কাছে দাঁড়িয়ে বলল, এক্সকিউজ মি। শুনুন, আপনি স্মোক করলে দূরে গিয়ে করুন। সিগারেটের পোড়া গন্ধে আমার অসুবিধা হয়।

লোকটি মুখ থেকে মাফলার নামিয়ে বলল, আপনার যদি অসুবিধা হয় আপনি সরে বসুন। পাশে আরও বেঞ্চ রয়েছে। লোকটির গলার ভারী কণ্ঠস্বর চিনতে ভুল হল না নম্রতার। লোকটির মুখের দিকে তাকাতেই নম্রতার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। নম্রতার গোলাপি দুটো ঠোঁট ঈষৎ কেঁপে উঠল। কম্পিত গলায় সে বলল, স্বর্ণাভ। তুমি বেঁচে আছো!

বয়সের সঙ্গে স্বর্ণাভর কিছু পরিবর্তন বাহ্যিক রূপের হয়েছে। লম্বা চওড়া সুদর্শন পুরুষ স্বর্ণাভ। টিকালো নাক। বুদ্ধিদীপ্ত মুখ। ফরসা গায়ে রং বয়স বাড়ার সঙ্গে যেন আরও ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়েছে। মাথাভর্তি কালো ঢেউখেলানো চুলে অল্পবিস্তর পাক ধরেছে। শরীর স্বাস্থ্য আগের চেয়ে অনেক ভালো। ভোরের নরম আলোর মতো দুচোখে সেই পূর্বের মতোই মোহময় দৃষ্টি। বয়স প্রায় আটান্নর ঘর ছুঁয়েছে।

নম্রতারও অবশ্য বাহ্যিক পরিবর্তন হয়েছে। বয়স তেতাল্লিশের ঘরে পা দিয়েছে। আগের মতো গোলগাল চেহারা নম্রতার নেই। শরীর অনেক ভেঙে গেছে। ধবধবে ফরসা রং অনেকখানি ম্লান হয়েছে। মুখের মধ্যে হালকা বয়সের ছাপ পড়েছে। মুখে সারল্যের চিহ্নমাত্র নেই। বয়স বাড়ার ফলে মুখ অনেকখানি দৃঢ় এবং আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ। ঈষৎ বাদামি চোখের তারা ধূসর বর্ণ নিয়েছে। চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। কালো মেঘের মতো একঢাল ঘন কালো চুল উঠে তার ঘনত্ব কমিয়েছে।

স্বর্ণাভ নম্রতার কথার উওর খুঁজে না পেয়ে স্মিত হাসল শুধু। স্বর্ণাভর থেকে কোনও প্রত্যুত্তর না পেয়ে নম্রতা উঁচু গলায় বলল, তুমি হাসছ? জানো, তোমার অপেক্ষায় আমি আজও কাউকে নিজের ভাবতে পারি না। তোমার জন্য আমি সংসার করেও সংসারী হতে পারিনি। তুমি এই পৃথিবীতে থাকা সত্ত্বেও একবার আমার সঙ্গে এতগুলো বছর দেখা করলে না! কেন? কী অপরাধ করেছি আমি? এভাবে তুমি কেন মুখ লুকিয়ে থেকে গেলে!

স্বর্ণাভ হাসতে হাসতে বলল, তোমার স্বামী আছে। তোমার তো একটা মেয়ে আছে শুনেছি। অথচ তুমি কিনা সংসারী হতে পারোনি! এই কথাগুলো ফিল্মের ডায়লগের মতো। এই পৃথিবীতে কেউ কারও জন্য অপেক্ষা করে না। আমিও করিনি। সময় নিজের নিয়মে নিজের মতো বয়ে যায়। তুমিই তো নিজে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।

প্রতিধ্বনি ফেরে ( পর্ব ২ )

অবশেষে সিকিম যাওয়ার সময় হয়ে এল। সাতদিনের প্রোগ্রাম। ধ্রুব নম্রতা এবং আশাকে সঙ্গে নিয়ে রাতের ট্রেনে পাড়ি দিল সিকিমের উদ্দেশ্যে। ট্রেন থেকে সকালে শিলিগুড়িতে নেমে গাড়িতে প্রায় ছয় ঘণ্টার জার্নি। ধ্রুব অবশ্য সব আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিল। ছয় ঘণ্টা জার্নির পর ধ্রুবরা গ্যাংটকের হোটেলে পৌঁছাল। ধ্রুব এবং আশার মেজাজ ফুরফুরে হলেও নম্রতার মুড বেশ অফ। সেটা ধ্রুবর দৃষ্টি এড়ায়নি। নম্রতা-রা একদিন গ্যাংটকে থাকার পর লাচেন এবং লাচুং-এর উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

সারাদিন ঘুরে বেড়িয়ে লাচুং-এর হোটেলে দ্বিতীয় দিন রাত্রে ধ্রুব নম্রতার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করল। আশা বাচ্চা মেয়ে সারাদিন বেড়ানোর ফলে তার শরীর ক্লান্ত ছিল। বিছানায় শুতেই সে বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়ল। রাতের খাবার খেয়ে নম্রতা হোটেলের ঘরের লাগোয়া বারান্দায় নীরবে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবছিল। পাহাড়ের বুকে তারাগুলো জোনাকির মতো জ্বলছে। রাত্রের নিস্তব্ধতায় পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার জলের শব্দ, নীচে খরস্রোতে বয়ে চলা লাচুং নদীর শব্দ যেন শান্ত মনকে উত্তাল করে তুলছে। বরফাবৃত উত্তুঙ্গ হিমালয়, রাতের প্রশান্ত আকাশকে যেন চুম্বন করতে চাইছে। ধ্রুব বিছানা ছেড়ে নম্রতাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, এত ঠান্ডায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছো কেন? ঘরে শোবে চলো।

—তুমি শুয়ে পড়ো। অযথা সময় নষ্ট কোরো না।

—সময় নষ্ট! এই প্রথমবার আমি সময়ে সদ্ব্যবহার করছি। তোমাকে একা ফেলে আমি ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যেতে পারব না তা তুমি ভালো করেই জানো। তোমাকে আমি ভালোবাসি।

ধ্রুবর হাত ছাড়িয়ে একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে নম্রতা উদাস কণ্ঠে বলল, ভালোবাসার সংজ্ঞাটা যে ঠিক কি সেটাই আমি এখনও বুঝে উঠতে পারি না। কেউ আমাকে সত্যিই ভালোবাসতে পারে সে বিশ্বাসও আমি করি না।

—তার মানে তুমি বিশ্বাস করো না যে আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাই তো! আমাকে আমার ভালোবাসার প্রমাণ দিতে কী করতে হবে তাই বলো।

—আমি তোমাকে কিছু প্রমাণ দিতে বলছি না। যার প্রমাণ দেবার কথা, সে তো বিনা প্রমাণেই অনেক কিছু প্রমাণ করে দিয়ে গেল।

ধ্রুব নম্রতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার দুটো হাত জড়িয়ে ধরে বলল, কী হয়েছে তোমার! আমার সঙ্গে কি কিছু শেয়ার করা যায় না! আমি কি এতটাই তোমার অযোগ্য স্বামী হিসেবে! আচ্ছা নম্রতা, স্বামী হিসাবে নয়, বন্ধু হিসাবে তো তুমি আমাকে তোমার মনের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা শেয়ার করতেই পার। বিয়ে হওয়ার পর থেকে আমি বুঝি তুমি কষ্ট পাচ্ছো কোনও কারণে। তোমার অতীত আমি কোনওদিন জানতে চাইনি। আজ বড়ো জানতে ইচ্ছে করছে। আমাদের একটা মেয়ে আছে। তার কথা ভেবে আমাদের দাম্পত্যের দূরত্ব ঘোচাতে হবে নম্রতা। আমি আর পারছি না।

ধ্রুবর কথা নম্রতা এড়িয়ে গিয়ে বলল, রাত অনেক হল। চলো ঘরে।

ধ্রুব বলল, তুমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ!

নম্রতা বলল, এড়িয়ে যাচ্ছি না। এসব কথা বলার সময় এটা নয়। আর তাছাড়া তুমি কি আশার মতো বাচ্চা নাকি! আমি আশার জন্য এখানে বেড়াতে এসেছি। বিয়ে এত বছর পর সিকিমে এসে আমরা নিজেদের নিয়ে আলোচনা করতে আসিনি। আফটার অল, আমি এসব নিয়ে কখনও ভাবিনি। দাম্পত্য, প্রেম, ভালোবাসা আমি তোমার থেকে কিছু চাইছি না। এই সহজ কথাটা বুঝতে এত সময় লাগছে কেন! আমি এই পৃথিবীতে কারওর কাছে কিছু প্রত্যাশা করি না। প্রত্যাশা বড়ো আঘাত দেয়। কথা শেষ করে নম্রতা বিছানায় চলে গেল।

ধ্রুব কিছুক্ষণ পর বিছানায় নীরবে নম্রতার পাশে শুয়ে পড়ল। পাশে শুয়ে সে টের পেল নম্রতা চোখের জলে বালিশ ভেজাচ্ছে। মাঝে মাঝে নম্রতা কাঁদতে কাঁদতে ফুঁপিয়ে উঠছে। স্ত্রীর চোখের জলের কারণ খুঁজে না পাওয়ায় স্বামী হিসাবে ধ্রুবর নিজেকে বড়ো অসহায় মনে হল।

নতুন সকাল আসে নতুন একটা দিনের সূচনা করতে। রাতের সব কালিমাকে এক নিমেষে মুছে দিয়ে জীবনকে আলোকিত করতে। পাহাড়ি সূর্যটাও নম্রতার রাতের মলিন মুখটাকে তার রাঙা আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে। নম্রতার সারা মুখে ছড়িয়ে আছে স্নিগ্ধতার মাধুর্য। বারান্দায় কফি মগ হাতে নিয়ে সে, আশার সঙ্গে গল্পে মশগুল। রাত্রের নম্রতার সঙ্গে এই মানুষটার আকাশ-পাতাল তফাত। ধ্রুব মাঝেমাঝে আশা এবং নম্রতাকে তাড়া লাগাতে থাকে তৈরি হওয়ার জন্য। আধ ঘণ্টার মধ্যেই তারা লাচেনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবে। নির্দিষ্ট সময়মতো ড্রাইভার এসে হাজির।

পাহাড়ি সর্পিল পথ বেয়ে গাড়ি লাচুং ছেড়ে ছুটল লাচেনের উদ্দেশ্যে। চোপতা উপত্যকা, কালাপাহাড় দেখিয়ে ধ্রুবদের গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চলল গুরুদোংমার লেকের পথে। গাড়ি যত পাহাড়ের উপর উঠতে থাকল চোখে পড়ল শুধু সোনালি ধূসর পাহাড়। গাছপালা প্রায় নেই বললেই চলে। ভারতীয় সেনাদের এলাকা অতিক্রম করে গাড়ি ছুটল গুরুদোংমার লেকের দিকে। একদিকে নীচে পাহাড়ের গা বেয়ে লাচেন নদী খরস্রোতে বয়ে চলেছে অন্যদিকে রুক্ষ বিস্তৃত প্রান্তর।

উন্নতশির পাহাড়ের মাথায় সাদা বরফের মুকুট যেন আলাদা শোভাবর্ধন করছে। পাহাড়ি রাস্তার দুধারে মনে হচ্ছে কেউ যেন বরফের গুঁড়ো ছিটিয়ে রেখেছে। গাড়ির চাকা বরফ গুঁড়ো করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। অদূরে পাহাড়ের গা থেকে নেমে আসা ঝরনার জল বরফে জমাট বেঁধে যেন থমকে গেছে।

আশা বাবা-মার সঙ্গে এই বেড়াতে আসাটা খুব উপভোগ করছে। নম্রতার বর্তমান কখনও কখনও তার অতীতকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। ধ্রুব নম্রতার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করতে চাইলেও পারছে না। নম্রতার ক্ষণে ক্ষণে মুড অফ হয়ে যাচ্ছে। বিস্তীর্ণ পাহাড়ি পথ পিছনে ফেলে গাড়ি এসে পৌঁছোল গুরুদোংমার লেকে। লেকে ঘুরতে ঘুরতে নম্রতার অন্যমনস্কতার জন্য একজন লোকের সঙ্গে জোরে ধাক্কা লাগল। নম্রতার সঙ্গে ধাক্কা লাগায় লোকটির হাত থেকে জলের বোতলটা ছিটকে পড়ে গেল। নম্রতা বোতল তাড়াহুড়ো করে কুড়িয়ে লোকটির হাতে তুলে দিয়ে বলল, সরি। আমি আসলে বুঝতে পারিনি।

নম্রতা লোকটির চোখের দিকে তাকাতেই তার মাথায় তুলে রাখা রোদচশমা চোখে পড়ে ভারিক্কি গলায় বলল, ইটস ওকে। সাবধানে চলবেন তো। কথা শেষ করে লোকটি ঝড়ের গতিতে গাড়িতে ওঠার জন্য পা বাড়াল। লোকটির চোখ, হাঁটাচলা, ওই ভারী কণ্ঠস্বর নম্রতার খুব পরিচিত মনে হল।

লোকটির পিছন পিছন ছুটতে ছুটতে সে ডাকল, এই যে শুনছেন। একটু দাঁড়ান। নম্রতাকে ছুটতে দেখে ধ্রুব সামনে এসে দাঁড়াল।

ধ্রুব বলল, কাকে ডাকছ তুমি? কে ছিল?

নম্রতা ব্যাকুল গলায় বলল, আরে ওই যে ভদ্রলোক। যার সঙ্গে আমার একটু আগে ধাক্কা লাগল। ধাক্কা খেয়ে ওনার হাতে জলের বোতল পড়ে গেল।

ধ্রুব ভদ্রলোককে দেখতে না পেয়ে বলল, কেউ তো নেই ওখানে দুটো গাড়ি ছাড়া। আমাদের মতোই টুরিস্টদের গাড়ি হবে। তাড়াহুড়ো করে ভদ্রলোক ততক্ষণে গাড়ি নিয়ে ওখান থেকে কেটে পড়েছে।

আশা মায়ের হাতটা নাড়িয়ে বলল, মাম্মা, তুমি কি কাউকে খুঁজছ?

নম্রতা আনমনা হয়ে বলল, না। না তো।

ধ্রুব বলল, চলো। আমরা গাড়ির কাছে যাই। ড্রাইভার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

ফোরম্যানের টেবিল

সুরের ঝরনাধারায় মন ভরিয়ে দিয়ে দেয়ালঘড়ি জানিয়ে দিল সাড়ে চারটে বাজে। ফাইলে ডুবে থাকা পল্লব, মুখ তুলে তাকাল দরজার দিকে। কুশলের আসার সময় হল। স্টোরের চাবি জমা দিয়ে সে ক্লাসরুমের জানলা-দরজা বন্ধ করবে তারপর ওয়ার্কশপের গেটে তালা লাগাবার মুহূর্তে বেরিয়ে আসবে পল্লব, রওনা দেবে ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটবাড়ি সুঠাম আবাসন-এর দিকে।

আর মাত্র ষোলোটা মাস বাকি। তারপর এই চেয়ার-টেবিল এইসব ফাইলপত্রের ভার ইন্সট্রাকটর নবীনকে সমর্পণ করে তার ছুটি। ফোরম্যানের ভূমিকায় সমস্ত কর্তব্য পালন করলেও তাকে ফোরম্যান করা হয়নি। এই ঝঞ্ঝাট সামলানোর দায় আর তার থাকবে না। শুনতে হবে না প্রিন্সিপাল বলরাম বোসের অসূয়াযুক্ত কটূক্তি- টেবিলের ফাইলে ডুবে করোটা কী! তুমি তো বসে বসে কবিতা-গল্প লিখে লিখে পাঠাও তারপর প্রিন্টেড কপি এনে অফিস স্টাফদের পড়িয়ে বাহবা কুড়োবার চেষ্টা করো। বেতনের টাকাটা তো গুনে গুনে নাও অথচ কাজের কাজ কিছুই হয় না!

অবশ্য এই কটূক্তিতেই থেমে থাকেননি তিনি। তাঁর টেবিলের সমকোণে ছিল বহুদিনের পুরোনো ফোরম্যানের টেবিল, সেটিও ভাইস-প্রিন্সিপাল ভূতনাথ হাজরা ওই বলরাম বোসের সমর্থনে দখল করে নিয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্রের সূত্রপাত হয়েছিল অনেক আগেই। তবে সেই যুদ্ধে জিতে মাথা উঁচু করে সে যে বিদায় নিতে পারছে, এইটুকুই তার চাকুরি জীবনের সবচেয়ে বড়ো অ্যাচিভমেন্ট।

তার স্ত্রী সঞ্চারি বলেছিল, তোমার নিজের জ্ঞান আর অভিজ্ঞতাকে অস্ত্র করে লড়াই করছ তুমি! অভিমন্যুর মতো তোমায় সপ্তরথী ঘিরে ধরলেও তুমি তাদের হারিয়ে ঠিক বেরিয়ে আসতে পারবে। একদিন তারাই হাতে হাত মেলাতে ছুটে আসবে, মিলিয়ে নিও! সেই ঘটনাই ঘটে চলছে এই সময়, কেউ এসে আবার তার বুক পকেটে গোলাপও গুঁজে দিয়েছে।

ডক্টর বি সি সেন ছিলেন দূরদর্শী মানুষ। হিজলপুরের কুড়ি বিঘা জমিতে সরকারি অনুমোদন সাপেক্ষে ষাটের দশকের শুরুতেই তিনি তৈরি করেছিলেন এই ব্রাইট বয়েজ আকাদেমি। আবার পঠন-পাঠনের সঙ্গে কারিগরি প্রশিক্ষণের চিন্তাভাবনাও তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তখন কারিগরি প্রশিক্ষণও খুব প্রযোজন হয়ে পড়েছিল। তাই ওই একই জমিতে সরকারি অনুমোদনক্রমে ব্রাইট বয়েজ টেকনিক্যাল সেকশন গড়ে উঠেছিল। কুড়িজন ছাত্রের প্রশিক্ষণের জন্য ফোরম্যান, ইন্সট্রাকটর-সহ দশজন স্টাফ নিয়োগের অনুমতি মিলেছিল সেই সময়ে। চালু হয়েছিল একবছরের ফিটিং-কার্পেন্টরি কম্বাইন্ড কোর্স।

পল্লব যখন ইন্সট্রাকটর পোস্টে ইন্টারভিউ কাম টেকনিক্যাল স্কিল টেস্টে ডাক পেয়ে আসে, তখন তার প্রতিযোগী ছিল ভাইস-প্রিন্সিপাল ভূতনাথ হাজরার ভাই শ্রীনাথ হাজরা। ছিল আরও বারোজন প্রতিযোগী। অবশেষে শেষ হাসি হেসেছিল পল্লব। শ্রীনাথ হাজরা দাঁড়াতেই পারেনি, ক্লিন বোল্ড হয়ে ফিরে গিয়েছিল। তাই পল্লবকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না ভূতনাথ। গোটা ব্রাইট বয়েজ আকাদেমির বেশ কিছু স্টাফের মন ক্রমে ক্রমে বিষিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

পঁচিশ বছর আগে যখন পল্লব ইন্সট্রাকটরের চাকরিতে যোগ দিয়েছিল, তখন ফোরম্যান ছিলেন শিরীষ বোস। ভদ্রলোক ছিলেন অকৃতদার, হাসিখুশি অথচ সেই মানুষটা যে ভয়ানক সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স-এ ভোগেন এই বছর সেপ্টেম্বরের টিচার্স ডে পালনের আগে পর্যন্ত পল্লব বুঝতেই পারেনি। ততদিনে যাদের সঙ্গে তার বেশি ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, তারা সবাই তার কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়েছিল। তাদেরই অনুরোধে সেই বছর টিচার্স ডে উপলক্ষে পল্লব প্রথম কবিতা পাঠের সুযোগ পায় আর তারপরই শিরীষ বোসের আসল রূপ বেরিয়ে পড়ে।

তখন চাকরির সবেমাত্র এক বছর পূর্ণ হয়েছে, আরও এক বছর পার হলে তার প্রবেশন পিরিয়ড শেষ হবে। তবেই স্থাযী পদে নিযুক্ত হবে সে। টেকনিক্যাল সেকশনের ফিটিং-শপের সামনে একটি ছ’ফুট বাই বারোফুটের টেবিলে পুরো ব্রাইট বয়েজ আকাদেমির মানচিত্র তৈরি করেছিলেন এক নামি শিল্পী। মিড-ডে মিলের ঘর, খেলার মাঠ, ছোটো ছোটো জলাশয়, কারিগরি প্রশিক্ষণ ভবন, বিদ্যালয় ভবন, লাইব্রেরি– সব মিলিয়ে আকাদেমির পুরো চিত্রটা সেই টেবিলে উপস্থিত ছিল। তখন অবশ্য মিড-ডে মিল রুম না বলে টিফিন রুম বলা হতো।

শিক্ষক দিবস পার হওয়ার দু’-তিনদিন পর একদিন ফোরম্যান বোস বলে বসলেন, শোনো পল্লব, এই টেবিলের নির্দিষ্ট জায়গাগুলোতে ড্রিল করা আছে, যেমন ধরো টিফিন রুম, প্লে-গ্রাউন্ড, স্কুল বিল্ডিং এইসব আর কী! প্রত্যেক ড্রিলড হোলের মধ্যে তার গলিয়ে হোল্ডার পরিয়ে পুরো টেবিলটার নীচে ইলেকট্রিক ওয়্যারিং কমপ্লিট করে রাখবে তুমি, বুঝেছো নিশ্চয়ই?

পল্লবের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ইলেকট্রিক সার্কিট সম্বন্ধে সে অভিজ্ঞ নয় তাই বলল, সে কী! আমি তো মেকানিক্যাল গ্রুপের, ওয়্যারিং করিনি কখনও! আমাদের তো একজন ইলেকট্রিশিয়ান আছেনই, আমি বরং তাঁকে সাহায্য করব। নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিল পল্লব।

—টুনি-বাল্ব, সুইচ-বোর্ড সে লাগাবে, ফিনিশিং টাচ দেবে সে। ইনিশিয়াল ওয়্যারিং কমপ্লিট করবে তুমি।

—কিন্তু আমার থিওরি, প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসগুলোও তো রয়েছে!

—তার বাইরে অনেক সময় পাও তুমি! অফ পিরিয়ডে কবিতা না লিখে কাজ করে দেখাও দেখি! তারপর রীতিমতো হুমকির সুরে বলেছিলেন, এখনও প্রবেশন পিরিয়ড কাটতে গোটা একটা বছর বাকি, জানো তো নিশ্চয়ই!

ততক্ষণে কারণটা প্রাঞ্জল হয়ে গেছে পল্লবের কাছে। সে বুঝতে পারল টিচার্স ডে উপলক্ষে তার কবিতার প্রশংসার পুরস্কার হিসেবে, তার জন্য এই বংশদণ্ডের ব্যবস্থা করেছেন বোস। শাস্তি হিসেবে টেবিলের তলায় ঢুকে মশার কামড় খাওয়ানোটাকেই উপযুক্ত মনে করেছিলেন তিনি।

স্টোরকিপার মনোজ দাসকে পল্লব মনাদা নামেই ডাকত। ওয়্যারিং-এর প্রাক্কালে স্টোর থেকে এনে হ্যামার, স্ক্রু-ড্রাইভার, সোল্ডারিং আয়রন এসব টেবিলের নীচে সাপ্লাই দিত সে। চটাস-পটাস শব্দে মশা মারতে মারতে বাধ্য হয়ে ওয়্যারিং-এর কাজ করতে হতো পল্লবকে। একদিন তার মনাদা ফাঁকা পেয়ে বলল, এসব বাঁজা লোকেদের নিজেদেরই ঠিক নেই আবার অন্যের বিচার করে!

—মানে! কৌতূহলের দৃষ্টিতে পল্লব তাকিয়েছিল তার মনাদা-র দিকে।

—মানে বুঝলে না তো! এই যে চাকরি পেয়ে বছর ঘুরতে না ঘুরতে বিয়ে-থা সেরে ফেললে বোসের চোখ টাটাবে না!

—কিন্তু ফোরম্যান উনি! মোটা মাইনের চাকরি করেন, বিয়ে করেননি কেন?

—আরে বাঁজা তো!

—সে আবার কী! মেয়েদের ছেলেমেয়ে না হলেই তো বাঁজা বলে!

—দূর কিছুই জানো না তুমি! ছেলেদেরও দোষ থাকলে ছেলেপুলে হয় না। মেয়েরা এদের বিয়ে করে সুখী হয় না। ডিভোর্স হয়ে যায়, দ্যাখোনি! ওই বোসেরও সেই দোষ আছে। ও হল গিয়ে বাঁজা ব্যাটাছেলে! তাই ভয়ে বিয়ে করেনি।

যে-চার বছর শিরীষ বোস ছিলেন, তাকে খুব জ্বালাতন করেছিলেন। ডক্টর স্নেলের সূত্র উদ্ধৃত করে একটা দৃষ্টিশক্তির চার্ট বানিয়েছিল পল্লব। শিরীষ বোস সেটিকে দেখেই ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলেছিলেন, সূত্র ধরে চার্ট হয়! এই লেখাপড়া শিখেছ!

তিনি তাঁর ইচ্ছামতো চার্ট-পোস্টার লাগাতেন ওয়ার্কশপের বিভিন্ন জায়গায়। তাঁর রিটায়ারমেন্টের পর পল্লব যখন দায়িত্ব নিল, সেও বোসের লাগানো সমস্ত কিছু দূর করে দিয়ে নিজের মতো করে শপফ্লোরের দেয়াল সাজিয়ে তুলল।

শিরীষ বোস বিদায় নিলেও ভূতনাথ হাজরার হাতে তখনও বেশ কিছুকাল সময় ছিল। নতুন প্রিন্সিপাল হলেন বলরাম বোস। ভূতনাথ তাঁর কান ভারী করা শুরু করে দিলেন।

এদিকে আর এক বিপত্তি শুরু হল। ফিটিং-কার্পেন্টরির এক বছরের কম্বাইন্ড কোর্সটিকে কেন্দ্রীয় সরকারের অফিস থেকে শুরু করে অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও আর মান্যতা দিতে অস্বীকার করল। প্লেসমেন্ট অফিসার চঞ্চল তালুকদার দেখলেন ভারি মজা! তিনি প্রিন্সিপালকে জানিয়ে দিলেন— এই কোর্সের কোনও ভ্যালিডিটি নেই। খোলনলচে বদলাতে হবে। ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ ভোকেশনাল ট্রেনিং বা এনসিভিটি-র অনুমোদন সাপেক্ষে নতুন কোর্স চালু না হলে, এই কোর্স চালিয়ে কোনও লাভ হবে না। ছেলেরা চাকরি পাবে না। আমারও কিছু করার নেই।

চাকরির সুযোগ কমে যেতেই ছাত্রের সংখ্যা ক্রমশ কমতে শুরু করল। কুড়ি থেকে কমে কমে চার-পাঁচজনে এসে ঠেকল। চতুর্দিকে সমালোচনার ঝড় উঠতে লাগল। অবশ্য আড়ালে ছিল ভাইস-প্রিন্সিপাল ভূতনাথ হাজরার উসকানি। চার-পাঁচজন ছাত্রের জন্য দশজন স্টাফ। নড়ে-চড়ে বসল রাজ্য-প্রশাসন। মিড-ডে মিল থেকে শুরু করে সবরকম সুযোগ-সুবিধে কমতে শুরু করল। ছাত্রদের সঙ্গেও ঠাট্টা-তামাশা শুরু হল। তাদের নাম দেওয়া হল কম্বাইন্ড। স্কুলে প্রার্থনার সময় অতি উৎসাহী এক শিক্ষক বলে ফেললেন, কেউ আছো কম্বাইন্ড?

তিনজন ছাত্র সেদিন উপস্থিত ছিল। তারা হাত তুলতেই হেসে তিনি বললেন, এই তো কম্বাইন্ড আছে এখনও, একেবারে নিল হয়ে যায়নি!

মিড-ডে মিল খেতে গিয়ে একটি ছাত্র দু’-হাতা ভাত বেশি চেয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল, কী করতে এই মরা কোর্সটা করতে যে আসিস তোরা, বুঝি না! নে খেয়েদেয়ে বছরটা কাটিয়ে দে। তারপর তো সেই বাড়িতেই বসে থাকবি।

যে-নদী হারিয়ে পথ চলিতে না পারে… দশম শ্রেণিতে পড়া সেই ভাবসম্প্রসারণটাই মনে পড়ে যায় পল্লবের। কলকাতার সল্টলেকের কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসে যোগাযোগ শুরু করে পল্লব। তখন অবশ্য নতুন প্রিন্সিপাল বলরাম বোস সাহায্য করেছিলেন তাকে, কিন্তু সেটির পিছনে ছিল তাঁর নিজের স্বার্থ। সেখানে যাতায়াত করতে করতেই নতুন একটা দু’বছরের কোর্স তৈরি করে ফেলে সে। সেখানকার এক অফিসারই এই কোর্সের নাম দেন ফিটিং-কাম মেশিনিং কম্বাইন্ড কোর্স।

ভূতনাথ হাজরা অতসব বোঝেন না, ডিসট্যান্স- এ এমএ করে অনেক তৈলমর্দন করে ভাইস-প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন। তিনি অন্যদের উসকানি দিতে লাগলেন ওই পল্লববাবুর ছোটাছুটিই সার, মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। মনে মনে প্ল্যান করতে লাগলেন কীভাবে পল্লবকে নাস্তানাবুদ করা যায়।

দীর্ঘ বৈঠকের পরও কোর্সটি তখনও পাস হয়নি। সরকারি ফিতের ফাঁস সহজে আলগা হয় না, একথা ভূতনাথও জানতেন। তিনি তলে তলে চঞ্চল তালুকদারকে হাত করলেন। বললেন, এই যে বসে-শুয়ে গান গেয়ে দিন কাটাচ্ছেন, কোর্স চালু হয়ে গেলে, সব নষ্ট হয়ে যাবে। ছুটোছুটি করতে করতে মাথা খারাপ হয়ে যাবে, যদি সত্যি সত্যিই এনসিভিটি-র নতুন কোর্স চালু হয়ে যায়! তাই পল্লব বিশ্বাসের কনফিডেন্স লেভেল মানে আত্মবিশ্বাসের মেরুদণ্ডটাই যদি ভেঙে দিতে পারি, সব ঠিক হয়ে যাবে।

—এক্ষুনি রাজি। কী করতে হবে বলুন তো দেখি! বলে ওঠেন চঞ্চল তালুকদার।

—কিচ্ছুই নয়, শুধু আমার সঙ্গে থাকুন। যেমনটি বলব ঠিক তেমনটাই করবেন, ব্যস তাহলেই কেল্লা ফতে! বলে ক্রূর হাসি হাসলেন ভূতনাথ।

সেদিন টিফিনের পর নবীন তখন ক্লাস নিচ্ছে, অফিস রুমে বসে কাজ সারছিল পল্লব। হই-হই রবে সেই ঘরে এসে ঢুকে পড়লেন ভূতনাথ হাজরা, চঞ্চল তালুকদার আর দু’জন কার্পেন্টার। পল্লবের টেবিলকে পাস কাটিয়ে তার টেবিলের সমকোণে থাকা ফোরম্যানের জন্য নির্দিষ্ট টেবিলটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে একজন কার্পেন্টারের উদ্দেশ্যে ভূতনাথ বললেন, দ্যাখো তো, এই টেবিলটাকে কেটেকুটে নতুন একটা টেবিল বানিয়ে দিতে হবে। পারবে তো? আমার নতুন কম্পিউটার বসবে এই টেবিলেই… হয়ে যাবে নিশ্চয়ই!

পল্লব লাফিয়ে উঠল, এসবের মানে কী? আমার ঘর থেকে টেবিল নিয়ে যাবেন কেন?

—আর ঘর! সেকশনটাই উঠে যাবে আজ নয় কাল! প্রিন্সিপালকে জানিয়ে এসেছি, চাইলে ফোন করে যাচাই করে নিন। ভূতনাথ হাজরার কণ্ঠে উষ্মা ফুটে উঠল।

চোখের সামনে দিয়ে টেবিলের ওপর রাখা ফাইল-পত্র ফেলে ছড়িয়ে ওরা টেবিলটাকে বলির পাঁঠার মতো টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলে গেল। মাথায় যেন আগুন জ্বলছিল পল্লবের। নাহ্ এই অপমানের যোগ্য জবাব দিতেই হবে! তবে সেটা ঠান্ডা মাথায়, তাড়াহুড়ো একদম নয়। পল্লব শপথ নিল এর শেষ দেখেই সে ছাড়বে!

সল্টলেক অফিসের তিনজন টপ ক্লাস অফিসারই পল্লবের কাজে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তার এই হার না মানা লড়াই-এর অংশীদার হলেন তাঁরাও। জানালেন তার তৈরি দু’বছরের কোর্সটিকে চেন্নাই অফিস ছাড়পত্র দিয়েছে। কিন্তু অন্তত আরও একটি কোর্স না হলে নতুন আইটিআই চালু হবে কীভাবে?

পল্লবের মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। তাদের আকাদেমির এয়ার কন্ডিশনড কম্পিউটার রুমটিকে তো মাল্টিপল ওয়ার্কিংয়ে লাগানো যায়! ওই রুমে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর এক বছরের কোর্সটি চালু করলে আরও দশজন ছাত্র যোগ দিতে পারে। আর নতুন আইটিআই তৈরির পথের বাধাও দূর হয়।

কম্পিউটার রুম নিজের দখলে রেখে মেন কম্পিউটার-এ পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করে রাখতেন ভূতনাথ হাজরা। এবার সেই অনধিকার চর্চা বন্ধ করার সুযোগ স্বযং এসে উপস্থিত হয়েছে। ভূতনাথ তার অফিসের টেবিল কেড়ে নিয়েছেন, এবার তাঁর দখলে থাকা কম্পিউটার রুমটাই কেড়ে নেবে সে!

যথাসময়ে ইন্সপেকশন টিম এসে পুরো ওয়ার্কশপ ঘুরে ঘুরে দেখে সন্তুষ্ট হয়ে সবুজ সঙ্কেত দিতেই, প্রিন্সিপাল বলরাম বোস পুরো ওয়ান এইট্টি ডিগ্রি ঘুরে পল্লবের পাশে এসে দাঁড়াতে বাধ্য হলেন। কারণ স্কুল পরিচালন সমিতির সভাপতি ততক্ষণে পল্লবের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছেন।

দু’-দুটি কোর্স নিয়ে নতুন প্রাইভেট আইটিআই-এর উন্মেষ ঘটল। নামি একটি দৈনিকের পক্ষ থেকে দু’জন সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী এসে ছবি তুলে সংবাদ সংগ্রহ করে নিয়ে গেলেন।

সাংবাদিক পল্লবকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘নতুন আইটিআই-এ আপনার অনুপ্রেরণার মূল উৎস কী?’

নিজের অজান্তেই পল্লব উত্তর দিয়েছিল— ফোরম্যানের টেবিল।

গেরস্থালি

ঘড়ির ঢং ঢং আওয়াজে অসীমার টনক নড়ল। এক্ষুনি রঞ্জন ওর বন্ধুকে নিয়ে এসে পড়বে। রঞ্জন বারবার বলে গিয়েছিল চা-জলখাবার তৈরি করে রাখতে। অসীমা তড়িঘড়ি চোখ মুছে ঠান্ডা জলের ছিটে দিয়ে রান্নাঘরে গেল। নিজের মুখটা না দেখলেও বুঝতে পারল কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলে গেছে— জ্বালা করছে। কী যে করবে কিছুই বুঝছে না, সংসারটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল এই ক’মাসে। অসীমা জীবনের নেগেটিভ দিক, অভাব-অস্বচ্ছলতা কোনওদিন দেখেনি। আজ যেন ও মাঝপুকুরে হাবুডুবু খাচ্ছে। খড়কুটোও নেই যা আঁকড়ে ধরবে। বাবার কথা আজ এত বেশি মনে পড়ছে। বাবার জন্যই ব্যাবসায়ী হয়ে ওঠা রঞ্জনের। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল!

‘সীমা… সীমা,’ বলতে বলতে রঞ্জন বাজারের থলে নিয়ে ঢুকল রান্নাঘরে। অসীমা মুখ তুলে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগেই রঞ্জন অসীমার মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল। হাতের ব্যাগ নামিয়ে কাছে এসে নিবিড় ভাবে জিজ্ঞাসা করল ‘কী হয়েছে?’ অসীমা ট্রেতে চা-বিস্কুট নিয়ে রঞ্জনকে দিল, ‘আজ আবার সরকারবাবু এসেছিলেন।’

‘কী বললেন? চিৎকার করেননি তো!’

‘না, শুধু বললেন তাড়াতাড়ি ঘরগুলো ছেড়ে দিতে।’ রঞ্জন কিছু না বলে শুকনো মুখে ট্রে নিয়ে বাইরে চলে এল। অসীমা জানিয়ে দিল, ‘একটু বাদেই রুটি তরকারি দিচ্ছি।’ বলল বটে কিন্তু ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ওর কিছুই ভালো লাগছে না। কানের মধ্যে বাড়িওয়ালার কথাগুলোই ধাক্বা দিচ্ছে। এক মাসের মধ্যে ঘর ছেড়ে না দিলে কোর্টের কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়ে যাবে। রঞ্জনকে তো সব কথা ইচ্ছে করেই বলেনি। মানুষটাকে তো দেখছে, এত চেষ্টা করছে তবু আশার আলো দেখছে কোথায়? বিগত পাঁচ-ছ’মাস ধরে ব্যাবসার ভরাডুবি। মাথায় প্রায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। তার উপর বাড়িওয়ালার হুমকি। ‘শুধু নিজেদের নিয়ে ভাবছেন, আমার ছেলের বিয়ে, ঘর দরকার, তাই ভদ্রভাবে বলছি, উঠে যান।’

অসীমারা গত তিনমাস বাড়িভাড়ার টাকাটাও দিতে পারেনি ঠিকমতো। আসলে রাগটা সেখানেই, তাই বাহানা জুড়ে দিয়েছে। আবার কোর্টের ভয় দেখাচ্ছে। হাতে কাঁচা পয়সা এসেছে তো, তাই গুমরও বেড়ে গেছে সরকারবাবুর। আজ যে সমাজে সরকারবাবু উঠে যাচ্ছে রঞ্জন একদিন সেখানেই ছিল। সরকারবাবুর বখে যাওয়া ছেলেটা হঠাৎ শুরু করেছে প্রোমোটারি ব্যাবসা। একসময়ে সরকারবাবু সরকারি চাকরি করতেন, সেই সুবাদে উপর মহলের সঙ্গে বেশ ভালো যোগাযোগ আছে। তাই ছেলের হয়ে সুপারিশ করাটা সরকারবাবুর কাছে জলভাত। মাত্র কয়েক মাস হল বেশ জমজমাট শুরু করেছে। উঠোনের ওপাশের ঘরটা আর বৈঠকখানা নেই, হয়ে গেছে অফিস ঘর। বড়ো বড়ো করে সাইনবোর্ডে লেখা ‘নতুন ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরির জন্য যোগাযোগ করুন। প্রোমোটার – সনাতন সরকার। যোগাযোগের সময় সকাল : ১১টা – ৪টা।’

এতদিন অসীমা জানত না সরকারবাবুর ছেলের নাম। এখন সাইনবোর্ডের সুবাদে জেনে গেছে। সেই ছেলের বিয়ে। সরকারবাবুর স্ত্রীকে ব্যক্তিগত অনুরোধ করেছিল অসীমা। কিন্তু মহিলার বাচনভঙ্গির সামনে অসীমা খুবই অসহায় বোধ করছিল। উপর থেকে নীচে নেমে এসেছিল মাথা হেঁট করে। ঘরে এসে কেঁদে ফেলেছিল, আবার আপশোশও হয়েছিল রঞ্জনকে না বলে উপরে বাড়িওয়ালার কাছে গিয়েছিল আর্জি জানাতে। মাত্র কয়েক মাস আগেও অসীমারও তখন বোধহয় এখনকার মতো ছিল না। পতি গরবে গরবিনি ছিল সে। কী যে হল।

দশবছর আগে সে যখন নতুন বউ হয়ে শ্বশুড়বাড়িতে এল তখন শুধু দু’চোখে স্বপ্ন। বড়োলোক ঘরের মেয়ে অসীমা। বাবার আদুরে মেয়ের আবদারে সবাই অস্থির। সেই অসীমা এল শ্বশুরঘর করতে। তুলনায় রঞ্জন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। অসীমাদের মতন বড়োলোকি ব্যাপার না থাকলেও সম্পন্ন গৃহস্থ যৌথ পরিবার ছিল রঞ্জনদের। দুপক্ষই জানত অসীমা-রঞ্জনের মেলামেশার কথা। আপত্তি থাকলেও উভয়পক্ষই রাজি হয়েছিল এ বিয়েতে। রঞ্জনের মা-বাবা, দাদা-বউদির মনে ছিল একরাশ দ্বিধা। পারবে তো অত বড়ো ঘরের মেয়ে এই সাধারণ ঘরে এসে মানিয়ে নিতে। অসীমাকে নিয়ে রঞ্জন যেদিন প্রথম তার মায়ের কাছে এসেছিল, সেদিনটা অসীমার আজও মনে আছে। রঞ্জনের মাকে প্রণাম করতে গিয়ে উনি সহাস্যে বলেছিলেন ‘বসো মা, এই ছোট্ট ঘরে তোমায় স্বাগত জানাই। বাড়িটা তোমাদের মতো বড়ো নয় কিন্তু আমাদের সকলের মন অনেক বড়ো, তোমার এখানে থাকতে কষ্ট হতে পারে কিন্তু আদর-ভালোবাসায় কোনও খামতি হবে না।’

এই কথা শুনে অসীমা কেমন যেন বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল। এমনভাবে কেউ তো বলেনি। তার দুচোখে তখন রঙিন স্বপ্ন-উচ্চাশা। রঞ্জন যেন অতিরঞ্জিত হয়ে তার জীবনে ছড়িয়ে-মাখিয়ে আছে। অসীমা, রঞ্জনের মাকে মৃদু স্বরে জানিয়েছিল, ‘এই ছোট্ট ঘর-বাড়িই হবে তার সোনার সংসার।’

কোথায় গেল তার সোনার সংসার, স্বপ্ন! সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। ওই ছোটো বাড়িতে কিছুদিনের মধ্যেই তার দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। স্বামীর বাঁধাধরা চাকরি। বাঁধাধরা সময়। অসীমা ব্যবসায়ীর মেয়ে। বাবা-কাকা, খুড়তুতো ভাইদের সচ্ছলতা দেখতেই অভ্যস্ত। গোনা টাকায় কোনওদিন জীবনযাপন করেনি সে। সারাদিনই বাড়ি জমজমাট। সকালে বাবা-জেঠু কারখানায় যায় তো দুপুরে বাড়ি আসে, ওই সময় দুই দাদা আর কাকা যায়। বাবা-জেঠু সারাটা দুপুর বাড়িতে ভাত খেয়ে দিবানিদ্রা দিয়ে আবার বিকেল চারটের চা-পর্ব চুকিয়ে বের হয়। দাদা-কাকারা মর্জি মতো বাড়ি আসে। আড্ডা মারে, কারুর জন্য অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় না। কিংবা বাড়িতে অতিথি এলে কারখানা-দোকান যেখানে হোক ফোন করলে কেউ না কেউ এসে হাজির, এভাবেই বড়ো হয়েছে অসীমা।

এখানে রঞ্জন সকাল আটটা বাজতে না বাজতেই নাকেমুখে গুঁজে অফিস ছোটে। বাড়ি আসতে সেই সন্ধ্যা। যতই বাড়িতে জা-শাশুড়ি থাকুক, ভালো লাগে না অসীমার। রাতে রঞ্জনকে এ নিয়ে অভিযোগ জানালে রঞ্জন হেসে বলে, ‘সীমা, আমরা প্রায় পাঁচ বছর মেলামেশা করে তবেই বিয়ে করেছি, তুমি জানো আমার কাজের ধারা। অফিসের পর তুমি আমি এক জায়গায় মিট করতাম তারপর সারা সন্ধ্যা হইচই করে কাটিয়ে তোমায় বাড়ি দিয়ে আমি ফিরতাম। এখন সারারাত তুমি আমার কাছে, তবু তোমার আক্ষেপ। প্লিজ অবুঝ হয়ো না। এটাই তো জীবন, আমরা সবাই পরিবারবদ্ধ হয়ে বাস করি, চাকরিজীবী।’ অসীমা কিছুই বলার সুযোগ পায় না কিন্তু তার মন মানে না।

অসীমার বাবা এ বাড়িতে এলে প্রায়শই রঞ্জনকে ব্যাবসা করার কথা বলেন। অসীমার নামে যে মোটা অঙ্কের ফিক্স ডিপোজিট আছে তা থেকে লোন নিয়ে, ব্যাবসা শুরু করতে বলেন। কিন্তু রঞ্জনের তাতে সায় নেই। তার এক বোনের বিয়ে হয়নি এখনও। অসীমার সবসময় ভয় করত যদি রঞ্জন ওই টাকাটা চেয়ে বসে বোনের বিয়ের জন্য। বাবা-মায়ের প্ররোচনায় অসীমা বারবার বলত রঞ্জনকে ব্যাবসা করার জন্য। শ্বশুরবাড়ি গেলে শালারাও সবাই বোঝাত রঞ্জনকে ব্যাবসার পজিটিভ দিকগুলো। সকলের তাড়নাতেই বোধহয় রঞ্জন ব্যাবসা করা নিয়ে ভাবতে শুরু করল। সাথিও পেয়ে গেল ললিতকে। শ্বশুরমশাই কাপড়ের ব্যাবসায়ী। তাই কাপড়ের ব্যাবসা করাই সুবিধা। এমন ভাবনা চিন্তা নিয়েই ললিত-রঞ্জন শুরু করল কাপড়ের ব্যাবসা। মাঝারি মাপের একটা দোকান-ঘর ভাড়া নিল বড়ো রাস্তার উপরেই। মাস ছয়েকের মধ্যে রঞ্জন ইস্তফা দিল চাকরিতে। বাড়িতে সবাই ব্যাবসাটাকে খুব একটা ভালোভাবে না নিলেও কিছু বলল না।

অসীমার নিস্তেজভাব উধাও। সেই আবার ছটফটে হইচই করা, ননদের সাথে আড্ডা। যেমনটি ছিল বিয়ের পরপরই। রঞ্জনও বেশ খুশি। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে বলে অনেক ইচ্ছাই মনের কোণে চেপে রাখতে হয়। খুব শখ ছিল বাড়ির জন্য একট ফোর-হুইলার থাকবে। সে শখ পূর্ণ হয়নি। শখ ছিল মাকে, বাবাকে, বাড়ির সবাইকে নিয়ে সন্ধে হলে মাঝেমধ্যে লং ড্রাইভে যাবে। দারুণ জমজমাটি পরিবার হবে তাদের। পরিবারটা রঞ্জনদের জমজমাটি কিন্তু সাধ আর সাধ্য এক হয়ে ওঠেনি। এজন্য অবশ্য আক্ষেপ নেই। কাপড়ের ব্যাবসা শুরুর ঠিক দেড়বছরের মাথায় রঞ্জন এক্সপোর্ট পারমিট পেয়ে গেল। বাড়িতে বাবাকে বলতে খুব খুশি। তিনিই মনে করিয়ে দিলেন, ‘তোমার বোনের বিয়ের গুরুদায়িত্ব কিন্তু তোমার। তুমি ব্যাবসা করছ, দাদা চাকরিজীবী। তাই এখন তোমার ওপর আমার, দাদার অনেকটাই ভরসা।’

শ্বশুর মশাইয়ের এই ধরনের আশাভরসার কথা অসীমার মন কিন্তু সোজাভাবে নিল না। সে চেয়েছিল ব্যাবসার প্রথম লাভের টাকাটায় রঞ্জন একটা গাড়ি কিনুক। ইনস্টলমেন্টে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু শ্বশুর মশাইয়ের কথায় যেন অসীমার বাড়া ভাতে ছাই পড়ল। সে চাইল সবাই যা টাকা দেবে, তার স্বামীও তাই দেবে। এই নিয়ে অশান্তি। রঞ্জন বাবা-দাদার পক্ষ নিয়ে কথা বলতে গেলে এক ঝটকায় অসীমা থামাল তাকে, ‘কার পয়সায়, কার সাহায্যে ব্যাবসা করছ? আমার এফডি, বাবার যোগাযোগ না থাকলে তুমি পারতে আজ এমন কাজ করতে?’

অসীমার গলার স্বর বেশ উঁচু পর্দায় ছিল। ভাসুর-শ্বশুর সবই শুনতে পেল। তারাই রঞ্জনকে আলাদা ডেকে এনে কি পরামর্শ দিল কে জানে, একমাসের মধ্যে হঠাৎই রঞ্জন বাড়ি বদল করল, উঠে এল ভাড়া বাড়িতে। অসীমা খুবই অবাক হয়েছিল, বিরক্তও। কেন রঞ্জন বাড়ি বদল করছে এবং ভাড়াবাড়িতে যাচ্ছে এ নিয়ে বহু বার জিজ্ঞাসা করলেও কোনও সদুত্তর পায়নি। নিজেদের বাড়ি, নিজেদের শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে ভাড়াবাড়িতে যেতে অসীমার যথেষ্ট আপত্তি ছিল কিন্তু রঞ্জনের কঠিন মুখ, কঠোর ব্যবহার, অসীমার কেমন যেন সব গুলিয়ে গেল, এ রঞ্জনকে সে চেনে না। সে চুপচাপ নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে এসেছিল। আসার সময় সবাই প্রাণহীন পুতুলের মতো দাঁড়িয়েছিল। অসীমা-রঞ্জন আলাদা ভাড়া বাড়িতে উঠে এল। রঞ্জনের জন্যই অসীমা ভাড়া বাড়িতে এসে স্বপ্ন দেখত নিজেদের বাড়ির। রঞ্জনের পরিবারের অন্যান্য লোকেরা কষ্ট পেয়েছিল অসীমার আচরণে। রঞ্জনের মা কিছু বুঝতে না পেরে অসীমাকে বলেছিলেন, ‘ছোটো বাড়ি মা, একদিন এতটা ছোটো মনে হবে না। মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে। একটা ঘর ফাঁকা। তোমার যদি মনে হয় তুমি ওই ঘরটাও ব্যবহার করতে পারো। এভাবে চলে যেও না। সবাই একসঙ্গে থাকো, আনন্দে থাকো।’ কিন্তু অসীমা তখন অন্য জগতের মানুষ। দর্পে মাটিতে পা পড়ছে না।

অসীমা-রঞ্জন আলাদা সংসার পাতল। নতুন ভাড়া বাড়িতে যাওয়ার তিন-চার মাসের মধ্যে অসীমার বাবার স্ট্রোক হল। বাবা প্রতিমাসে মেয়েকে একটা থোক টাকা দিতেন, সেটা ঝপ করে বন্ধ হয়ে গেল। অসীমা মানিয়ে নিল, রঞ্জনের টাকাতেও তাদের দুজনের সংসার হেসেখেলে চলে যাচ্ছিল। রঞ্জন মা-বাবাকেও প্রতিমাসে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিল। ওনারা সবিনয়ে তা ফিরিয়ে দিয়েছেন।

সে যাই হোক, রঞ্জন-ললিত মিলেমিশে উদ্যোগী হয়ে কাপড়ের ব্যাবসাটা ভালোই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। মাঝেমধ্যে দুই বন্ধু নিজেদের পরিবার নিয়ে একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, ডিনার করা। বেশ কাটছিল। ললিতের মেয়েটা দারুণ ছটফটে। ললিতের বউ মেধা। বেশ নরম স্বভাবের মেয়ে। কিন্তু রঞ্জনের কথা অনুযায়ী খুব বুদ্ধিমতি ও হিসেবি। অসীমা নিজে বিএ পাশ। তাই প্রচ্ছন্ন গর্বও ছিল। মেধা বেশিদূর পড়েনি, স্কুলের গন্ডিও পেরোয়নি। একসাথে মেলামেশায় মেধা বুঝতে পারত অসীমা খুব অহংকারী। তবু অল্প সময়ের জন্য একসঙ্গে থাকা তাই খুব পছন্দের না হলেও মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থাকত হাসি মুখে। এই বন্ধু জায়াকে রঞ্জন কিন্তু বেশ পছন্দ করত।

রঞ্জন-ললিতের ব্যাবসা বেশ তরতর করে এগিয়ে চলছিল। কারও জীবনে কোনও ছন্দপতন নেই। কিন্তু এভাবে চলতে চলতে একসময় সব কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। দোকানটা সাধারণত সামলাত রঞ্জন। ললিত যেত অর্ডার আনতে। টাকা আনতে। এমনই কোনও একদিন সন্ধ্যাবেলায় এক বিদেশি অর্ডার নিয়ে মনের আনন্দে স্কুটারে দোকানের দিকে আসছিল। হঠাৎ একটা ট্রাক ব্রেকফেল করে ললিতের স্কুটার আর একটা গাড়িকে পুরো পিষে দিয়ে ধাক্বা মারল দেয়ালে।

মেধার কান্না, বিলাপ খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু রঞ্জনের কান্নাও যে চোখে দেখা যায় না। বন্ধুর জন্য এত হাহাকার। বারবার একই কথা, ‘ললিত, তুই প্রমিস করেছিলি দুজনে একসঙ্গে থাকব, পাশাপাশি বাড়ি বানাব, দুজনে ছোটো দুটো গাড়ি কিনব সব মিথ্যে, তুই মিথ্যুক ললিত। আমায় না বলে তুই চলে যেতে পারলি!’ দোকান বন্ধ করে রঞ্জন চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকে। অসীমা অনেক বোঝায় কিন্তু কিছুই হয় না। বেশ অনেকটা সময় কেটে গেল রঞ্জনের বন্ধুশোক ভুলতে। বাস্তবে ফিরে আসতে গিয়ে প্রথম ধাক্বা খেল রঞ্জনের এক্সপোর্ট বিজনেসে। ললিত যে-অর্ডারটা নিয়ে স্কুটারে আসছিল তা ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল দুসপ্তাহের মধ্যে। তা হয়নি। বিদেশি অর্ডার। অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছে কোম্পানি। বেশ বড়ো একটা ক্ষতি হয়ে গেল রঞ্জনের। বিদেশিদের কাছে একবার ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে গেলে পরবর্তী কাজ পাওয়া দুষ্কর। ললিতের কাজের দায়িত্ব এখন একাই বহন করতে হচ্ছে রঞ্জনকে, সে দিশাহারা।

এরপরেই রঞ্জনের ব্যাবসায় শুরু হল শনির দশা। দোকান কর্মচারীদের হাতে দিয়ে সারাদিন বাইরে থাকা। ক্ষতির পর ক্ষতি। লজ্জার মাথা খেয়ে বাবাকেও বলেছিল দোকানে বসার জন্য। উনি রাজি হননি। ফলে যা হবার তা হল। কর্মচারীরা সব ধুয়ে মুছে সাফ করে দিল অল্প দিনের মধ্যেই। ললিত-রঞ্জনের সংসারে নেমে এল অন্ধকারের ছায়া। দোকানটা বন্ধ হয়ে গেল।

বেশ বেলা হয়ে গেল, তবু অসীমা বাইরে এসে জলখাবার দিয়ে গেল না। রঞ্জন কয়েকবার হাঁকাহাঁকি করেও সাড়া পেল না, নিজে উঠে ভেতরে গিয়ে অবাক, রান্না ঘরেও নেই। গেল কোথায়! শোবার ঘরে গিয়ে দেখে অসীমা বিছানায়। চোখের কোনে জল, রঞ্জন অসীমার পাশে গিয়ে বসল। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘সীমা ওঠো, কখন আমায় আর গোপালকে জলখাবার দেবে। আজ প্রথম ও আমাদের বাড়িতে এসেছে, কী ভাবছে বলোতো। ঠিক আছে তুমি শুয়ে থাকো, আমি আর গোপাল সামনের দোকান থেকে কচুরি-তরকারি খেয়ে নিচ্ছি। তোমার জন্যও নিয়ে আসব।’ হঠাৎ অসীমা রঞ্জনের দিকে ঘুরে বসল, ‘আমি এই বাড়িতে আর থাকব না।’

‘কোথায় যাব? এত অগোছালো অবস্থায় রয়েছি আমরা। তুমি একটু ধৈর্য ধরো। যে-বাড়ি ছেড়ে মা-বাবাকে দূরে ঠেলে আমরা দুজনে চলে এসেছি, সেখানে কি আর ফিরে যাওয়া যায়!’ রঞ্জন কথাগুলো বলে কপালে হাত দিয়ে নিরাশ ভঙ্গিতে বসে পড়ল। অসীমা বলে, ‘তুমি জানো না,  ছেলেমেয়েরা যতই অন্যায় অবুঝ কাজ করুক না কেন, মা-বাবা দুঃখ পেলেও তাদের কখনওই মন থেকে দূরে ঠেলে না। প্রতিদিন ঈশ্বরের কাছে তাদের মঙ্গল কামনাই করে। তুমি মা-বাবার কাছে যাও। আমরা ওই বাড়িতেই ফিরে যাব।’

‘তা হয় না সীমা। যেদিন আবার আমার ব্যাবসা ঠিকঠাক চলবে, আমরা হইচই করে সেদিন আবার ও বাড়ি যাব। অসীমা কিছু না বলে একটু মুখ বেঁকিয়ে চলে গেল। রঞ্জন শুনতে পেল, ‘যার বাড়ি ভাড়া তিন মাস বাকি, সে আবার দোকান চালানোর স্বপ্ন দেখে, বড়ো ব্যবসাদার হবে। কিচ্ছু হবে না।’

রঞ্জন কেমন যেন চুপ মেরে গেল। জীবনের প্রতিকূল সময়ে তার সীমা আজ কোথায় তাকে সাহস জোগাবে তা না, আরও নিরাশ করে দিচ্ছে। রঞ্জনের মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। সে তো এমনটা চায়নি। সে অসীমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। কত বছরের প্রেম, বড়োলোকের মেয়ে। রঞ্জন সবার সঙ্গে মিলেমিশেই থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু যেদিন অসীমা একবাড়ি লোকের সামনে উঁচু গলায় টাকার কথা বলেছিল, সেদিনই তো বাবা তাকে ডেকে নিয়ে আড়ালে বুঝিয়ে বলেছিলেন, ‘সবার আগে সম্মান, শান্তি। এই বাড়িতে সবাই আমরা শান্তিতে সম্মান নিয়ে বাঁচি। এমন কথা কেউ কোনওদিন বলেনি যাতে অন্যের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। হ্যাঁ, ঝগড়া হয় তবে তা মনে দাগ কাটার মতন নয়। ওটা তো বাসনে বাসনে ঠোকাঠুকির মতন। কিন্তু আত্মসম্মান বোধে আঘাত দিয়ে কথা এ বাড়িতে কেউ কাউকে বলে না। আজ বউমা যা বলল, তুমি যদি সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাও, বউমাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাও কারণ ওর দায়িত্ব তোমারই। আমরা তোমার ভালো চাই। তুমি আমাদেরই সন্তান। তোমার মঙ্গল হোক।’ বাবার এই কথার পর রঞ্জন একটা কথাও বলেনি। ও বাড়ি বদল করেছিল।

পরের দিন রঞ্জন সকাল-সকাল উঠে স্নান করে নিল। সাড়ে ন’টা নাগাদ গোপাল এসে ডাকতেই রঞ্জন হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল, অসীমাকে কিছুই বলল না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দু’বন্ধু গেল ব্যাংকে। গোপালের জানাশোনা। গোপাল ছোটোবেলার বন্ধু। যোগাযোগ ছিল না, গত মাসেই হঠাৎ দেখা তারপর কত গল্প, স্মৃতিচারণ, কেউ কাউকে ছাড়তেই চায় না। কথায় কথায় গোপাল জানাল ও কাপড়ের ব্যাবসা করে। সোজাসুজি আহমেদাবাদ থেকে কাপড়ের রিল আনায়, তারপর ব্লিচ করে বিভিন্ন দোকানে রঙিন থান শাড়ির অর্ডার সাপ্লাই করে। বেশ ভালো লাভজনক ব্যাবসা। রঞ্জন ইতস্তত করে গোপালকে তার দুরাবস্থার কথা, ব্যাবসায়ে ক্ষতির কথা জানাল। গোপাল কথা দিয়েছিল রঞ্জনকে সে সাধ্যমতন সাহায্য করবে। এজন্যই তাদের আজ ব্যাংকে আসা।

সকালবেলাই রঞ্জন কোথায় গেল, ভাবতে গিয়ে অসীমার সব কাজে বেশ দেরি হল। চা বানিয়ে নিয়ে বসতে গিয়েই শুনতে পেল দরজায় ধাক্বার শব্দ, সঙ্গে কথা বলারও আওয়াজ। অসীমা বুঝল রঞ্জনের সঙ্গে কেউ আছে কিন্তু দরজা খুলে যাকে দেখল, চমকে গেল, মেধা। ভিতরে আসতে বলল। মেধাকে বেশ রোগা লাগছে, মুখটা শুকনো। অসীমা ওদেরকে চা দিল, মেধা চা নিয়ে অল্প হেসে অসীমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছ?’  অসীমা শুকনো গলায় বলল, ‘দেখতেই পাচ্ছ। থাকা আর না থাকা সমান। নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে।’ রঞ্জন দুজনের এই কথোপকথনে মাথা হেঁট করে বসে চা খেতে লাগল। এক দমবন্ধ করা পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে রইল।

সবাই চা শেষ করলে অসীমা চায়ের কাপ নিয়ে উঠতে উদ্যোগী হতেই মেধা নীরবতা ভাঙল। ‘ললিত চলে যাওয়াতে শুধু আমরা নই, তোমরাও বেশ অসুবিধার সামনে পড়ে গেছ। মনে হয় সবাই মিলে যদি এই ব্যাবসাটাই আবার অন্যভাবে শুরু করি।’

অসীমা রঞ্জনের দিকে তাকাল। ওরা দুজনেই ভেবেছিল মেধা হয়তো ললিতের ভাগের টাকাটা চাইতে এসেছে। কিন্তু মেধার উদ্দেশ্য শুনে দুজনেই চুপচাপ। মেধা আবার বলতে শুরু করল, ‘নিজের খরচ কমালেও বাচ্চাটার খরচ তো কমানো যায় না। তাই ভাবছি আমার তো তিনটে ঘর, যদি একটা ঘরে একজন সেলাই জানা লোক রেখে কাজ করাই আর কাঁচামাল তো রঞ্জনদাই আনবে, তাহলে বোধহয় দুটো সংসারেই সাশ্রয় হবে।’ রঞ্জন বা অসীমা কেউ-ই মেধাদের কথা ভাবেনি। নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই ব্যস্ত ছিল। কিন্তু মেধার চিন্তা ভাবনা ওদের দুজনের মাথা হেঁট করিয়ে দিল। গোপালের সঙ্গে ব্যাংকে গিয়ে মোটামুটি একটা ব্যবস্থা হয়েছে। তাছাড়া গোপালও বলেছে যদি যৌথ ব্যাবসায় উদ্যোগী হয় তারা দুজনে মিলে। মেধার ভাবনাচিন্তা রঞ্জনকে আরও বেশি উসকে দিল কাপড়ের ব্যাবসার দিকে। রঞ্জন-গোপাল-মেধা আর যদি অসীমাও তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এই কাজে তাহলে আর বাইরে থেকে লোক রাখতে হয় না। কথামতন কাজ, রঞ্জনের উৎসাহ সব থেকে বেশি। রঞ্জন হঠাৎই ভাবল, কেন অসীমা এমনভাবে ভাবল না! মেধা ললিতের পথে হাঁটতে অর্থাৎ ব্যাবসা করতেই আগ্রহী। আর অসীমা, উৎসাহ তো দেয়ই না উলটে রাগ ঝগড়া। রঞ্জনের মধ্যে এক দোলাচল শুরু হয়। মেধা জানে, ভালোবাসা মানে সবসময় পাশে পাশে সশরীরে থাকতে হবে তার কোনও মানে নেই। তার অবর্তমানেও তারই ধ্যানধারণা নিয়ে চলাই ভালোবাসা। জীবনের সঠিক জীবনসঙ্গী সে-ই, যে এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে। ললিত আজ নেই তবু মেধা চলতে চাইছে ললিতেরই স্বপ্নকে বাস্তব করতে।

রঞ্জন মেধাকে বলল, ‘অসীমাও তোমার সঙ্গে কাজের দেখভাল করবে। তিনজনে মিলে আর গোপালের সাহায্যে আমরা আগের মতন গড়ে তুলব। আমাদের ব্যাবসা ঠিক দাঁড়িয়ে যাবে।’ তাকিয়ে দেখল অসীমা হাসছে, চোখে জল।

অসীমা এতদিনে বুঝতে পারল শুধু টাকা-সম্পত্তি জীবনের শেষ কথা নয়। মানুষের জন্য মানুষের এগিয়ে আসা, দুঃসময়ে তার পাশে থাকা, মানবিকতার হাত এগিয়ে দেওয়াতেই চরম সুখ। অল্পশিক্ষিত মেধার যে সহজাত বুদ্ধি ও তৎপরতা আছে, কলেজ পাঠ শেষ করা অসীমার মধ্যে সেই বোধের অস্তিত্ব ছিল না এতদিন। অসীমা আজ নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করল।

 

রবে নীরবে

বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই, রোজের মতোই সবকিছু যেন ঠিকঠাক। কিন্তু রোমার ভিতরে ঝড়ের দাপট সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছিল। ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাটটা থেকে বেরোনোর জন্য ও ছটফট করছিল। কোথাও থেকে সুজয়কে একটা ফোন করার উপায় পর্যন্ত নেই। এভাবে কী করে দিনগুলো কাটাবে কিছুতেই রোমা ভেবে পাচ্ছিল না।

এদিকে স্বামী অয়ন সারাদিন বাড়িতে আছে। চারপাশের পরিস্থিতির কারণে বাড়ি থেকেই অফিসের কাজ করাচ্ছে ওদের কোম্পানি। অয়ন ছাড়াও রাতুলও সবসময় মায়ের পেছন পেছন ঘুরছে। ওরই বা কী দোষ, বয়স মাত্র দুবছর। রাতুলের আনন্দের কোনও সীমাপরিসীমা নেই কারণ মা-বাবা দুজনেই বাড়িতে।

ওই দুধের শিশু কী করে জানবে মায়ের মনে ঝড় উঠেছে। এটা তো ওর জানার কথাও না। অয়নও কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির কাজে রোমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করে চলেছে তবুও রোমার মুখে সর্বক্ষণ বিরক্তি এবং রাগ কিছুতেই কমবার নাম নিচ্ছে না।

অধৈর্য হয়ে একদিন অয়ন বলেই ফেলল কী হয়েছে রোমা তোমার? বাড়ির যে-কাজটা করতে অসুবিধা মনে হবে আমাকে বলে দিও, আমি করে দেব। মুখটা সবসময় হাঁড়ির মতো করে রাখো কেন? তোমাকে দেখে মনে হয় যেন হাসতেই ভুলে গেছ।

রোমা রাগে ফেটে পড়ে, চব্বিশ ঘন্টা বাড়িতে বদ্ধ হয়ে থাকতে থাকতে আমার দম আটকে যাচ্ছে।

ডারলিং, তুমি তো আগেও বাড়িতেই থাকতে। যেটা চেঞ্জ হয়েছে সেটা আমার রুটিনের। আগে অফিস যাচ্ছিলাম এখন বাড়ি থেকে কাজ করছি। কিন্তু তোমাকে তো আমি একেবারেই বিরক্ত করি না। না আমার কোনও অভিযোগ রয়েছে! তোমার আর রাতুলের মুখ দেখলেই আমি আনন্দ পাই।

রোমা ভেবে পায় না অয়নকে কী উত্তর দেবে। সুজয়কে ও ভালোবাসে, অয়নকে নয়। এর আগে রোজ পার্কে সুজয়ের সঙ্গে দেখা হতো যখন রাতুলকে নিয়ে পার্কে যেত রোমা। সুজয় শরীরচর্চা করার জন্য রোজ পার্কে দৌড়োত।

সুজয়ের সুগঠিত শরীরের আকর্ষণ চুম্বকের মতো রোমার সুবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। সুজয়ের প্রতি অনুরাগ লুকোবার চেষ্টাও করেনি রোমা। সুজয় রোমার চোখে স্পষ্টই পড়ে নিয়েছিল ওর মনোভাব। রোমার সামনে দিয়ে যখনই যেত, সামান্য হেসে পাশ কাটিয়ে চলে যেত।

চোখে চোখে কথা দিয়ে সম্পর্কের গোড়াপত্তন হলেও ধীরে ধীরে সেটা পাখনা মেলতে শুরু করেছিল। সুজয় অবিবাহিত, মা-বাবা আর ছোটো বোনের সঙ্গে একই সোসাইটিতে থাকে। অয়নের অনুপস্থিতিতে রোমা বেশ কয়েকবার সুজয়কে নিজেদের ফ্ল্যাটে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

দেখা হলেই বেশিরভাগ কথা হতো ওদের অথবা ফোনেও কথা হতো নিয়মিত। রোজ দেখা করাটা একটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সেজেগুজে পার্কে গিয়ে সুজয়ের সঙ্গে দেখা করবার জন্য সারাটা দিন উন্মুখ হয়ে থাকত রোমা।

এখন লকডাউন-এর জন্য সবকিছুই বন্ধ, পার্কও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দোকান-বাজার করার জন্যও বাইরে বেরোনো যাচ্ছে না কারণ বাজার অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ। জিনিস কেনাকাটা সবই তো অনলাইনেই। সুজয়ও বাইরে কোথাও বেরোয় না। কখনও-সখনও একটা দুটো মেসেজ দেওয়া নেওয়া চলত প্রেমিকযুগলের মধ্যে, তাও রোমা ভয়ে সেগুলো ডিলিট করে দিত যদি অয়ন দেখে ফেলে।

রোমাকে আনন্দে রাখতে অয়নের সবরকম চেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছিল। রোমার রাগ, বিরক্তি দিনদিন বেড়েই চলেছিল। রাতে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে ইচ্ছে হলে রোমা স্বামীকে সঙ্গ দিত নয়তো একপাশে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে নিশ্চুপ পড়ে থাকত।

অয়নের সরল সাদামাটা স্বভাব রোমার অজানা ছিল না। ও জানত স্ত্রী, সন্তানকে আনন্দে থাকতে দেখলেই অয়নের আনন্দ। ওর কোনওরকম দোষ রোমা কোনওদিন খুঁজে পায়নি তবুও স্বামীর প্রতি কোনও টান অনুভব করত না রোমা।

মা-বাবার চাপে পড়ে বাধ্য হয়েছিল রোমা অয়নকে বিয়ে করতে কিন্তু স্বভাবে অয়নের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল রোমা। বিবাহিতা হয়ে পরপুরুষের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রাখা নিয়ে কোনও পাপবোধ ওর মধ্যে ছিল না। বরং অয়নের সরলতার সুযোগ নিয়ে স্বামীকে আঙুলে নাচানো অভ্যাস হয়ে উঠেছিল রোমার।

কিছুদিন লক্ষ্য করার পর অয়ন একদিন রোমাকে জিজ্ঞেস করেই বসল, আচ্ছা রোমা আমাকে বিয়ে করে কি তুমি খুশি হওনি? লক্ষ্য করছি যবে থেকে আমি বাড়ি থেকে কাজ করা শুরু করেছি তুমি কেন জানি না সবসময় রেগে রেগে থাকো। তোমার মনের ভিতর কী চলছে আমাকে খুলে বলবে?

বিয়ে তো হয়ে গেছে সুতরাং আনন্দে থাকি বা দুঃখে, তাতে কী যায় আসে! রোমা অন্যমনস্ক হয়ে জবাব দিল।

অয়ন রোমাকে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে রোমার চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে বলল, আমাকে বলো, কেন আজকাল তোমার মুড এত খারাপ থাকে?

ঘরে বসে বসে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমি বাইরে বেরোতে চাই।

আচ্ছা ঠিক আছে, কোথায় যেতে চাও বলো? আমি ঘুরিয়ে আনছি কিন্তু সবই তো বন্ধ।

তোমার সঙ্গে নয়, আমি একাই যেতে চাই। কঠিন স্বরে রোমা অয়নের দিকে কথাগুলো ছুড়ে দিল।

রোমার কথা শুনে অয়ন স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। হিংস্র বাঘিনীর মতো রোমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথের দিকে নিষ্পলক খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল অয়নের বুক চিরে। অফিসের জরুরি মিটিং ছিল ফলে উঠে এসে ল্যাপটপ নিয়ে কাজে বসে গেল। কিন্তু মনটার ভিতর একটা ব্যথার উপলব্ধি ওকে কুরে কুরে খেতে লাগল। খালি মনে হতে লাগল মা-বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে ও জীবনে কী পাচ্ছে? রোমা যে ওকে পছন্দ করে না, সেটা বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল ওর কাছে।

রোমার সঙ্গে ঠিকুজি মিলিয়ে মা-বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন। জ্যোতিষী বলেছিল রাজযোটক। এই বিয়ে হলে নাকি অয়নের সুখের শেষ থাকবে না। কিন্তু কী পেল অয়ন? এখন এমন অবস্থা, নিজের দুঃখ শেয়ার করারও কোনও রাস্তা খোলা নেই ওর কাছে।

একদিন অয়ন স্নানে গেলে রোমা নিজেকে আটকাতে পারল না, সুজয়কে ফোন করল। সুজয় কোনও কাজে ব্যস্ত থাকাতে সেই মুহূর্তে ফোন ধরতে পারল না। পরে রোমার ফোন দেখে যখন কল ব্যাক করল তখন সুজয়ের ফোন দেখেও রোমা ফোন তুলতে পারল না। ঘরের মধ্যে অয়ন বসেছিল বলে।

সুজয়ের ফোন ধরতে না পারাতে সব রাগ গিয়ে পড়ল অয়নের উপর। অয়নকে জলখাবার দিতে গিয়ে এত জোরে খাবারের প্লেট-টা রোমা টেবিলে নামিয়ে রাখল যে অয়ন রাগে ফেটে পড়ল। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে? এভাবে কেউ খেতে দেয়?

রোমা মনে মনে ফুঁশছিলই। ও গলা না নামিয়ে উত্তর দিল, খেতে হলে খাও, না খেলেও আমার কিছু…

রোমার চিৎকারে রাতুল ঘুম ভেঙে উঠে পড়ে মায়ের ওই মূর্তি দেখে কাঁদতে আরম্ভ করে দিল। অয়ন ওকে বুকে চেপে ধরে চুপ করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঘটে যাওয়া ঘটনাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে অয়নের মন চাইছিল না। রোমা এভাবে কথা বলতে পারে সেটা মেনে নিতে পারছিল না অয়ন। কথা বলার ইচ্ছাটাই চলে গিয়েছিল অয়নের বরং ওর ভিতরটা আগুনের মতো জ্বলে উঠছিল। মন বিদ্রোহ করতে চাইছিল।

রোমার ব্যবহারে কেন এই পরিবর্তন কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না। রোমার ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার মানুষ নয় অয়ন। সকলেরই নিজস্ব কিছু ব্যক্তিগত জায়গা থাকে, সেটাতে হস্তক্ষেপ করা অয়নের পছন্দ নয়। রোমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিল ও। ভুলটা কোথায় হচ্ছে যার জন্য সংসারের শান্তি চলে যেতে বসেছে, সেটা ভাবতে ভাবতে অয়নের ঘুম উড়ে যাওয়ার অবস্থা হল।

একদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে রোমা ছেলেকে নিয়ে একটু শুতে এলে পর, অয়ন বেরিয়ে ল্যাপটপ হাতে বসার ঘরে গিয়ে বসল। সুযোগ বুঝে রোমা সুজয়কে মেসেজ করল এবং তৎক্ষণাৎ উত্তরও চলে এল। এভাবেই মেসেজ আদানপ্রদান করতে করতেই কখন এক ঘন্টার বেশি পেরিয়ে গেছে রোমা বুঝতেই পারেনি। তার প্রতি সুজয়ের টান দেখে মনে মনে আনন্দই হচ্ছিল রোমার।

হঠাৎই মনে হল অয়ন বাড়িতে থাকায় সুজয়ের সঙ্গে বাইরে দেখা করার কোনও উপায় নেই। সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠল রোমার। সব রাগ গিয়ে পড়ল অয়নের উপর। আর কতদিন লোকটা বাড়িতে বসে থাকবে কে জানে, ভেবে মনটা খিঁচিয়ে উঠল ওর। ফোন রেখে দিয়ে রোমা উঠে রান্নাঘরে চলে এল। উঁকি দিয়ে দেখল অয়ন একমনে অফিসের কাজ করছে।

নিজের ভেতরের রাগটা প্রকাশ করতে জোরে জোরে বাসনের আওয়াজ করতে লাগল কাজের অছিলায়। অয়ন মুখ তুলে তাকিয়ে ইশারায় রোমাকে আওয়াজ করতে বারণ করল, জানাল অফিসের একটা জরুরি মিটিং চলছে। রোমা অয়নের কথার কর্ণপাত না করে রান্নাঘর থেকে বসার ঘরে এসে টিভি চালিয়ে বসে পড়ল।

মিটিং শেষ হতেই অয়ন রাগে ফেটে পড়ল। এটা কী ধরনের অসভ্যতা রোমা! টিভি দেখাটা কি এতই জরুরি ছিল? বারণ করা সত্ত্বেও তুমি…

অয়নের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রোমাও চেঁচিয়ে উঠল, তাহলে কখন দেখব? সারাদিন তো তুমি বাড়িতে বসে আছ। কোথাও বেরোও না যে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে শ্বাস নেব। আমার এ বাড়িতে প্রাইভেসি বলে কিছু নেই। নিজের ইচ্ছেতে কিছু করতেও পারি না, বলে রাগের মাথায় টিভির রিমোট সোফার উপর ছুড়ে ফেলে দিল রোমা।

ছেলের ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে অয়ন যথাসম্ভব গলাটা নীচে নামিয়ে রোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, এত অধৈর্য হয়ে পড়ছ কেন? ঠিক আছে তুমি টিভি দ্যাখো, আমি শোবার ঘরে চলে যাচ্ছি।

রোমা মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল, টিভি দেখার মুড তো তুমি নষ্ট করে দিলে। আমিই ভিতরে যাচ্ছি, এখন একটু শোব আমি।

রোমার এই অসঙ্গত ব্যবহারের কোনও কারণ অয়ন খুঁজে পেল না। রোমা কেন এতটা বদলে গেল কিছুতেই বুঝতে পারছিল না সে। এভাবে কী করে সংসার চলবে ভেবে ভেবে কূল কিনারা করতে পাচ্ছিল না অয়ন। তারপর মনে হল হয়তো বাড়িতে সারাক্ষণ বন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে বলেই রোমার এই পরিবর্তন। এমনটা হয়তো সকলেরই হচ্ছে।

অয়ন নিজে সবকিছু মানিয়ে নিতে পেরেছে বলেই রোমাও পারবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা কোথায়? তার উপর ওইটুকু ছেলে রাতুলেরও সব দায়িত্বও তো রোমাকেই সামলাতে হয়, অয়ন নিজে আর কতটুকু পারে স্ত্রীকে সাহায্য করতে? ও নিশ্চয়ই সারাদিন কাজের চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তার উপর কাজের মেযেটাও তো করোনার কারণে কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। আগে তাও আশেপাশের ফ্ল্যাটে রোমার যাতায়াত ছিল। পার্কের খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পারত আর এখন তো বাড়িতে বসা। রাগ হওয়া তো স্বাভাবিক।

অয়নের মনে হল, রোমা ওর উপর রাগ দেখাবে না তো আর কার উপরই বা দেখাবে? নিজের লোক বলতে তো অয়নই। এখন তো কারও সঙ্গে কোনও কথা হওয়া মানেই করোনা নিয়ে আলোচনা। মানুষ আনন্দ করবে কী নিয়ে? কোথাও তো ভিতরে পুষে রাখা রাগটা প্রকাশ করতেই হবে রোমাকে।

রোমার প্রতি বিদ্বেষের পরিবর্তে অনুকম্পা বোধ করল অয়ন। শোবার ঘরে এসে রোমার পাশে বসল অয়ন। ধীরে ধীরে ওর চুলে হাত বোলাতে লাগল। রাতুল ঘুমোচ্ছিল আর রোমা সবেমাত্র সুজয়ের সঙ্গে চ্যাট করা শুরু করেছিল। অয়ন আসাতে রোম্যান্স-এ বিঘ্ন ঘটায় চিড়বিড়িয়ে উঠল রোমা। গলায় বিদ্বেষ চেপে বলল, আচ্ছা, তুমি কি ঠিকই করে নিয়েছ শান্তিতে আমাকে থাকতে দেবে না?

মুহূর্তে লাল হয়ে উঠল অয়নের মুখচোখ। কতকিছু ভেবে রোমার পাশে গিয়ে বসেছিল। চুপচাপ উঠে বসার ঘরে সোফাতে গিয়ে শুয়ে পড়ল অয়ন। দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল ওর।

অয়নদের সোসাইটির প্রত্যেক বিল্ডিং-এর পার্কিং এরিয়াতে কিছুটা করে খোলা জায়গা ছিল। রাত্রে কখনও-সখনও এক দুজন ওয়াক করতে করতে এসে পড়ত। নয়তো পার্কিং-এর জায়গাগুলো রাত্রে নির্জনই থাকত। সুজয় রোমাকে জানাল রাত নটায় ডিনার সেরে দুজনেই হাঁটতে বেরোবে। দূর থেকে হলেও দুজনের দেখা তো হবেই। আর ওখানে লোকজন না থাকলে কথা বলতেও পারবে দুজনে।

রোমা এটাই তো চাইছিল। ও ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। অয়নের সঙ্গেও সেদিন একেবারেই ঝগড়া করল না। অয়নও চুপচাপই রইল সারাদিন। সবসময় রোমার মুড অনুযায়ী চলাও সম্ভব হচ্ছিল না। রোমার সঙ্গে কাজের কথা ছাড়া আর কিছু বলা বন্ধ করে দিল। রাতুলের সঙ্গে খেলত আর কখনও কখনও বাড়ির কাজ যতটা পারত চুপচাপ করে দিত।

ডিনার সেরে রোমা একলাই বেরিয়ে গেল হাঁটতে। এটাই নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল। কোনওদিন ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে যেত না। রোজ খাওয়ার পর রোমার বাইরে হাঁটতে যাওয়া চাই-ই চাই। অয়নও এটা ভেবে চুপ করে থাকত যে এইটুকুতে রোমা যদি শান্তি পায়, আনন্দে থাকে, তাহলে ঠিক আছে। যেভাবে চলছে সেভাবেই চলুক। বাড়িতে বন্দি হয়ে পড়াতেই রোমার যত অসন্তোষ।

এদিকে সুজয়ের মা-বাবা কিছুদিন ধরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সুজয় রোমাকে জানাল, কয়েকদিন দেখা করতে পারবে না। করোনা কমে আসাতে সোসাইটির অনেক লোকই নীচে ওয়াক করতে শুরু করেছিল। সুজয়ের ভয় ছিল, বাইরে বেরোলে ওর মাধ্যমে যদি করোনার ভাইরাস মা-বাবাকে অ্যাটাক করে। সুতরাং বাড়ি থেকে না বেরোনোই ভালো বলে সুজয় মনস্থির করে নিয়েছিল।

রোমা আবার একটা ধাক্কা খেল। ওর মুড আবার খারাপ হয়ে উঠল। সুজয়ের প্রতি যেন ওর একটা নেশা ধরে গিয়েছিল। ওর সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করাতেই ওর যত উৎসাহ। সেই উৎসাহে কেউ যেন জল ঢেলে দিল। মনে মনে অয়নকেই এর জন্য দায়ী করে বসল ও। অয়ন বাড়িতে থেকেই ওর সব আনন্দ নষ্ট করে দিয়েছে বলে মনে হল। অয়নের জন্যই বাড়িতে সুজয়ের সঙ্গে ফোনেও কথা বলতে পারে না। সব রাগ আবার গিয়ে পড়ল অয়নের উপর।

রোজই ঝগড়া হতে শুরু হল। অয়নও অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। কত আর চুপ করে থাকা যায়! আবার লড়াই ঝগড়া করা ওর স্বভাবেও নেই। শান্ত স্বভাবের যে-কোনও মানুষই এইরকম পরিস্থিতিতে চুপ থাকাই সমস্যার সমাধান বলে ধরে নেন। অয়নও ওই একই রাস্তা নিল। এভাবেই কটা দিন কেটে গেল। নরমে-গরমে অয়ন আর রোমার সংসার টলমল ভাবে কোনওমতে চলছিল।

হঠাৎই আবার একদিন সুজয়ের মেসেজ এল, রোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ওদেরই সোসাইটির কাছাকাছি সুজয়দের আর একটা ফ্ল্যাট ছিল যেটা ভাড়া দেওয়া ছিল। ভাড়াটে ছেড়ে দেওয়াতে সুজয় জানিয়েছে ওই ফ্ল্যাটে ও রোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

রোমাও সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ করে জানিয়ে দিল, যাওয়াটা মুশকিল তবে ও সবরকম চেষ্টা করবে যাওয়ার। নানা ভাবে চেষ্টা করতে লাগল রোমা, কী বলে বাড়ি থেকে বেরোনো যায়। কিন্তু কিছুতেই কোনও সুযোগ হয়ে উঠছিল না। এভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল কোনও উত্তেজনা ছাড়াই।

বাড়িটা দিন দিন নরক হয়ে উঠতে লাগল রোমার কাছে। আর এসবের মূলে যে অয়ন, এই বদ্ধমূল ধারণা আরও বদ্ধমূল হল ওর মনের ভিতর। অয়নের উপস্থিতি চক্ষুশূল হয়ে উঠল রোমার কাছে।

সেদিনটা অয়নের কাজের চাপ একটু কম থাকাতে লাঞ্চ টেবিলে রোমাকে সাহায্য করতে যেতেই রোমা স্পষ্ট জানাল, থাক তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। আমি করে নেব। অয়ন কোনও উত্তর দিল না। চুপচাপ টেবিলে থালা, গেলাসগুলো গুছিয়ে রেখে দিল। আজকাল বাড়িতে কথা বলা অয়ন একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিল।

সুজয়ের সঙ্গে দেখা করতে না পারার কষ্ট এতটাই রোমার মন জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, অয়নের শুকনো ক্লিষ্ট মুখটা ওর নজরেই এল না। ভাতের গরম হাঁড়িটা রান্নাঘর থেকে নিয়ে অয়ন টেবিলে রাখবে বলে আনতে যেতেই রাগের মাথায় রোমা অয়নকে একটা ঝটকা মারল। মুহূর্তে হাঁড়িটা অয়নের হাত ফসকে ওর পায়ের উপর পড়ে গেল। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল অয়ন।

রোমা অয়নের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাটি থেকে হাঁড়িটা উঠিয়ে খাবার টেবিলে এনে রেখে দিল। যতটা ভাত মাটিতে পড়েছিল সব পড়ে রইল। হাঁড়িতে থাকা বাকি ভাতটা প্লেটে নিয়ে ছেলেকে খাওয়াতে বসে গেল রোমা এবং নিজেও খেতে শুরু করে দিল।

অয়ন নিজেই ফ্রিজ খুলে বরফ বার করে পায়ে লাগাতে শুরু করল সোফায় বসে। আড় চোখে দেখল রোমা নিশ্চিন্তে নিজে খেতে ব্যস্ত। পায়ের পাতায় অসহ্য জ্বালা অয়নের চোখে জল এনে দিল।

কে বলে পুরুষ মানুষ কাঁদতে জানে না? কাঁদতে জানে, যখন নিজের ব্যক্তিগত আনন্দ পাওয়ার লোভে রোমার মতো স্ত্রীয়েরা স্বামী, সংসার, সন্তানকে অবহেলা করতে শুরু করে তখন অয়নের মতো পুরুষ মানুষের চোখেও জল আসে।

পুরুষ মানুষের হৃদয় সাগরে নৈঃশব্দ্যের তুফান চললেও তার আওয়াজ বাইরে পর্যন্ত পৌঁছোতে পারে না। এই তুফান মানুষের প্রাণ পর্যন্ত নিতে পারে। অয়নের মুখ দিয়ে একটা প্রতিবাদও স্পষ্ট রূপ নিতে পারল না। অসহায়ের মতন শুধু তাকিয়ে রইল রোমার খাওয়ার দিকে। কীসের জন্য রোমা ওর এই শাস্তির ব্যবস্থা করেছে, কিছুই বুঝে উঠতে পারল না অয়ন!

 

শর্ত

ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে শ্বেতার চোখটা আটকে গেল নাম আর পরিচিত ছবিটা দেখে। ষোলো বছর পর দেখছে। মুখের অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই কিন্তু চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না। আর নামটা দেখলেই বোঝা যাবে শ্বেতা চিনতে ভুল করেনি। হ্যাঁ, ওই তো পরিষ্কার লেখা নীলাঞ্জনা সাহা।

কলেজের দিনগুলোয় ফিরে গেল শ্বেতা। অভিন্নহৃদয় দুই বন্ধু অথচ সামাজিক স্থিতি অনুযায়ী সকলের কাছেই বড়ো বেমানান ওদের বন্ধুত্ব। নীলাঞ্জনা ধনী পরিবারের মেয়ে বনেদি ব্যাবসাদার ওদের চোদ্দোপুরুষ। আলিপুরের মতো জায়গায় ওদের বিরাট জমিশুদ্ধ চারতলা অট্টালিকা। সেখানে শ্বেতার বাড়িটা হচ্ছে কসবার ছোট্ট একটা গলিতে। ঘর বলতে মাত্র দুটি যেখানে মা-বাবা এবং আরও দুজন ভাইবোনের সংসার। বাড়ি মেরামতিতে কতদিন হাত পড়েনি শ্বেতা ঠিকমতো মনেও করতে পারে না।

কিন্তু আর্থিক পরিস্থিতি দুই বন্ধুর মধ্যে কখনও দেয়াল হয়ে উঠতে পারেনি। বাধাহীন নদীর স্রোতের মতোই ওরা দুজনে বয়ে গেছে বন্ধুত্বের স্রোতে। শ্যামলা রঙের নীলাঞ্জনার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের কোনও অভাব ছিল না। শ্বেতা এক কথায় সুন্দরী। টানা বড়ো বড়ো চোখ, নিজেকে নিয়ে ওর যত চিন্তা ভাবনা।

শ্বেতা মনে মনে নিজেকে সবসময় নীলাঞ্জনার সঙ্গে তুলনা করত আর নিজেকে ওর আরও হতদরিদ্র মনে হতো। একমাত্র নিজের সৌন্দর্যের প্রতি মনের মধ্যে একটা গর্ব ছিল। শ্বেতা বিশ্বাস করত, সৌন্দর্যের জন্যই ও একদিন ধনীবাড়ির বউ হতে পারবে। শ্বেতা সবসময় নীলাঞ্জনাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করত। ওর মতো ব্যবহার, আদবকায়দা, কথা বলার ভঙ্গি সবকিছু।

সেদিন নীলাঞ্জনার জন্মদিন ছিল। একটি পাঁচতারা হোটেলে সব বন্ধুদেরই নিমন্ত্রণ করেছিল নীলাঞ্জনা। সেখানেই ঋষির সঙ্গে নীলাঞ্জনা সকলের পরিচয় করাল। ঋষি নীলাঞ্জনার বাবার বন্ধুর ছেলে, যে-কিনা মুম্বই আইআইটি-র ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। ছুটিতে কলকাতায় উপস্থিত ছিল ঋষি। নীলাঞ্জনার বন্ধু হিসেবে জন্মদিনের পার্টি অ্যাটেন্ড করতে এসেছিল। লম্বা-চওড়া সুন্দর চেহারার ঋষিকে দেখলে যে-কোনও পুরুষেরই হিংসা হওয়ার কথা।

সাধারণত যা হয়ে থাকে, এতগুলো মেয়ের একজায়গায় হয়ে হাসাহাসি, চ্যাঁচামেচিতে পুরো হলঘর জমজমাট হয়ে উঠেছিল। একমাত্র শ্বেতা চুপচাপ একটা কোণায় চেয়ারে বসে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিল। ঋষির শ্বেতার উপর দৃষ্টি পড়তে নীলাঞ্জনাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটি চুপচাপ একা কেন বসে আছে? ওকেও ডাক না!

সঙ্গে সঙ্গে, নীলাঞ্জনা শ্বেতার কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে টেনে তুলে এনে ঋষির সামনে দাঁড় করাল, আমার সব থেকে ভালো আর পুরোনো বান্ধবী শ্বেতা।

এরপর খাবার অর্ডার করা শুরু হল। অর্ধেকের বেশি খাবারের নাম শ্বেতা কোনওদিন শোনেইনি। ঋষি এসে শ্বেতার পাশে চেয়ার টেনে বসল। মেনু কার্ডটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে শ্বেতার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, যেটা, আমি অর্ডার করছি আপনিও সেটাই করবেন।

ঋষির কথা শুনে শ্বেতা একটু আশ্বস্ত হল। শ্বেতার মতো মেয়ের সঙ্গে আলাপ ঋষির জীবনে প্রথম। ওর নিজের মা-বোন কত আলাদা। কথায় কথায় লজ্জা পাওয়া, মুখ রাঙা হয়ে ওঠা, শাড়ির আঁচল নিয়ে খেলা করা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলে বসেও কপালে ঘাড়ে, গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠা, প্রসাধন ছাড়া নিখুঁত মুখমণ্ডল এ সব কিছুই ঋষির প্রথম দেখা।

রাত হচ্ছে দেখে নীলাঞ্জনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অটোর খোঁজে শ্বেতা হোটেলের বাইরে বেরিয়ে এল। পেছনে ঋষিও এসে দাঁড়াল। একটু ইতস্তত করে ঋষি বলল, চলুন, আমার কাছে গাড়ি আছে, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। এইসময় অটো করে যাওয়াটা খুব একটা সেফ নয়।

শ্বেতার কোনও জবাব না পেয়ে ঋষি বলল, ভয় নেই, আপনার বাড়ির দরজায় নামিয়ে চলে আসব। চায়ের জন্য আপনি বসতে বললেও বসব না।

অগত্যা শ্বেতা রাজি হয়ে গেল। গাড়িতে সারাটা রাস্তা চুপচাপই বসে রইল শ্বেতা। অদ্ভুত একটা শিহরণ অনুভব করতে পারছিল ও। বাড়ির দরজায় শ্বেতাকে নামিয়ে দিয়ে ঋষি চলে গেল। বিছানায় শুয়ে ঘুম এল না। প্রাণ খুলে আগে কেউ কখনও শ্বেতার সঙ্গে কথা বলেনি ঋষির মতো। ঋষির মুখটা আর কথাগুলো বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল শ্বেতার। ছোটোবেলা থেকে দেখে আসা স্বপ্নটা যেন এতদিনে সত্যি হতে চলেছে, বারবার এটাই মনে হতে লাগল শ্বেতার।

ধীরে ধীরে শ্বেতা নিজের সাজসজ্জার উপর বেশি নজর দিতে আরম্ভ করল। কলেজ ছাড়া বেশিরভাগ সময়টা পড়াশোনার বাহানা করে নীলাঞ্জনার বাড়িতেই কাটাতে আরম্ভ করল ও। নীলাঞ্জনা বুঝতে পারত ঋষিকে দেখতেই তাদের বাড়িতে শ্বেতার এতটা সময় পড়ে থাকা, যদি একটিবার ঋষি এখানে আসে। ঋষিকে খুব ভালো করেই চিনত নীলাঞ্জনা। ওর স্বভাব নীলাঞ্জনার অজানা ছিল না। শ্বেতার জন্য ও কষ্টবোধ করত!

একদিন থাকতে না পেরে নীলাঞ্জনা শ্বেতাকে স্পষ্টই বলল, শ্বেতা, তুই ঋষির পিছনে ছুটিস না, ও হচ্ছে মায়ামৃগ। সবার সঙ্গেই ও আপনজনের মতো ব্যবহার করে। কিন্তু বাস্তবে ওকে প্লেবয় বলাটাই বোধহয় সঠিক পরিচয় দেওয়া হবে।

কিন্তু শ্বেতার চোখে তখন ঋষি নামের ঘোর, যেটা সরতেই চায় না। নীলাঞ্জনার সাবধানবাণীও শ্বেতার মনে হল ঈর্ষাবশত। এইভাবেই নরমে গরমে ওদের তিনজনের বন্ধুত্ব এগিয়ে চলছিল। দুবছর এভাবেই কাটল অথচ এই দুই বছরে ঋষি একবারও শ্বেতার প্রতি বিশেষ ভালোবাসার কোনও দাবি জানাল না। কিন্তু শ্বেতা মনের মধ্যে নিজেকে উজাড় করে দিল ঋষির কাছে। ঋষি ছাড়া নিজের জীবনের কোনও অর্থই থাকল না শ্বেতার কাছে।

ওদিকে শ্বেতার চুপ করে সব মেনে নেওয়া, কথায় কথায় ঘাবড়ে যাওয়া ঋষিকে যেমন আকর্ষণ করত, তেমনি নীলাঞ্জনার আত্মবিশ্বাস, সহজে কোনও কথা মেনে না নিয়ে তর্ক করার অভ্যাসও সমান ভাবে ঋষিকে প্রভাবিত করত।

শ্বেতার কাছে ঋষি কোনও কমিটমেন্টে না গেলেও, শ্বেতার সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল, ঋষি একদিন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ওর কাছে অবশ্যই আসবে। দেখতে দেখতে কলেজ পার করে নীলাঞ্জনা ওর বাবার ব্যাবসায় ঢুকে পড়ল। আর শ্বেতা ঋষির প্রস্তাবের অপেক্ষায় দিন গুনতে আরম্ভ করল।

ফোনে দুজনের সবসময় কথা হতো। এরই মধ্যে ঋষি চাকরিও পেয়ে গেল। কিন্তু চাকরিটা নিয়ে ও খুব একটা খুশি হল না। আরও ভালো কিছু করার আকাঙ্ক্ষা ছিল ওর মধ্যে। ঋষি ফোন করলেই প্রতিবারই শ্বেতা ওকে বলত, ওর বিয়ের প্রচুর সম্বন্ধ আসছে। ঋষি বুঝতে পারত না শ্বেতা কেন এইসব কথা ওকে বলে!

একদিন বিরক্ত হয়ে ঋষি শ্বেতার মুখের উপরেই বলে বসল, তুই কীরকম বন্ধু রে? আমি এদিকে ভালো একটা চাকরি খুঁজতে পাগল হয়ে যাচ্ছি আর তুই তোর বিয়ে নিয়ে পড়ে আছিস! জানি তুই খুব সুন্দরী, তোর বরের অভাব হবে না। কে তোকে আটকাচ্ছে, কর না বিয়ে বলে ফোনটা কেটে দিল ঋষি।

শ্বেতার মনে হল, ঋষি নিজেকে অসুরক্ষিত ভাবছে এই ভেবে যে, শ্বেতার বিয়ে অন্য কোথাও না হয়ে যায়। খুশি হল শ্বেতা, যাক এবার তাহলে ঋষি দৌড়ে ওর কাছে এসে বিয়ের প্রস্তাবটা দেবে।

একদিন হঠাৎ নীলাঞ্জনার ফোন এল ওর কাছে, আর্জেন্ট তলব। বাগানে ফুলের পরিচর্যা করছিল নীলাঞ্জনা, শ্বেতাকে দেখেই দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল। শ্বেতা লক্ষ্য করল নীলাঞ্জনার চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। শ্বেতাকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে এসে বিছানায় বসিয়ে বলল, শ্বেতা, কাল আমার আশীর্বাদ। তুই এসেছিস খুব ভালো হয়েছে। জিজ্ঞেস করলি না তো কার সঙ্গে?

শ্বেতার মুখ-চোখ মুহূর্তে কালো হয়ে গেল, কোনওমতে বলল, কেন ইয়ার্কি মারছিস। ঋষি তো বিয়ে নিয়ে এখুনি কিছু ভাবতে চায় না। ও নিজের মুখে আমাকে বলেছে।

শ্বেতার কথা শুনে নীলাঞ্জনা হেসে ফেলল। শ্বেতার চিবুকটা হাত দিয়ে তুলে ধরে বলল, তুই বড্ড সরল রে শ্বেতা। ঋষি ওর নিজের ব্যাবসা আরম্ভ করেছে। আমার বাবারও তাতে পঞ্চাশ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। বিজনেস প্ল্যানটা আমিই ঠিক করে দিয়েছি। এটা বাবারই মাথায় প্রথম আসে, যখন আমাকে আর ঋষিকে একসঙ্গেই কাজ করতে হবে তখন একসঙ্গে জীবন কাটাতেই বা আপত্তি কোথায়।

শ্বেতা নিজেকে আর আটকাতে পারে না, চেঁচিয়ে ওঠে। বলে, তাহলে বল, তোরা টাকা দিয়ে ঋষিকে কিনে নিয়েছিস।

শ্বেতার কথাগুলো নীলাঞ্জাকে দুঃখ দিলেও নিজেকে ও সামলে নিয়ে সংযত স্বরে বলে, শ্বেতা, এটা ঋষির সম্পূর্ণ নিজের সিদ্ধান্ত। আমার বাবা ওকে কোনও জোর দেননি। এমনিই টাকা দিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু ঋষির কাছে সৌন্দর্যের থেকে নিজের কেরিয়ারের উন্নতি করাটা অনেক বেশি গুরুত্বের। তুই নিঃসন্দেহে সুন্দরী কিন্তু জীবনে এগোতে গেলে ক্ষমতা এবং স্মার্টনেসের দরকার যেটা সম্ভবত ঋষি আমার মধ্যে খুঁজে পেয়েছে।

এটা হতে পারে না নীলাঞ্জনা। ঋষি আমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারে না! আর আমি, তোর থেকে সব বিষয়ে অনেক ভালো।

নীলাঞ্জনা শ্বেতাকে ভালো করে লক্ষ্য করে। ওর মুখে ফুটে ওঠা হতাশা দেখে বলে, সব ঠিক হয়ে গেছে শ্বেতা। সৌন্দর্য সবার ফাস্ট প্রেফারেন্স না-ও হতে পারে। কিছু মানুষ আছে যারা সৌন্দর্যের থেকেও বুদ্ধি, আত্মবিশ্বাস এগুলিকে বেশি প্রাধান্য দেয়। আমার জন্যই ঋষি এই প্রোজেক্টটা শুরু করতে পেরেছে।

নীলাঞ্জনার কথাগুলো সহ্য করতে পারে না শ্বেতা। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ায় ও। বলে, নীলাঞ্জনা, তোর বাবা ধনী বলে তোর খুব অহংকার, তাই না? আর এই টাকার জোরেই তুই ঋষিকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিলি। কিন্তু তুইও আমার একটা কথা শুনে নে, আমার এই সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে অর্থ, বৈভব-কেও একদিন আমার দাস হতে হবে এবং এটা আমি তোকে করে দেখাব এই আমার প্রতিজ্ঞা তোর কাছে।

নীলাঞ্জনার ঠোঁটে হাসি খেলে গেল, বলল, শ্বেতা তোর এই চিন্তাভাবনা অত্যন্ত অন্যায়। তবুও সেই দিনটার প্রতীক্ষা আমিও করব যেদিন তোর প্রতিজ্ঞা রেখে আবার তুই আমার সামনে এসে দাঁড়াবি।

সেই দিনের পর শ্বেতা, নীলাঞ্জনা এবং ঋষির অধ্যায়কে নিজের জীবন থেকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলল। কিন্তু নিজের প্রতিজ্ঞা ও ভুলল না। জীবনে একটাই লক্ষ্যকে ও স্থির করে নিল, যেমন করেই হোক ওকে ধনী হতে হবে। তার জন্য মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা সব সম্বন্ধ ও নাকচ করতে শুরু করল। যেটা শ্বেতার পছন্দ হতো সেখানে টাকার চাহিদা দেখে শ্বেতার মা-বাবা পিছিয়ে আসতেন। শ্বেতার মর্জিমাফিক ব্যবহারে ওর পরিবারের সকলে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে লাগল।

এই করতে করতে শ্বেতার বয়স তিরিশে পড়ল। হঠাৎ-ই কোনও এক আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়ে শ্বেতা, রাজেশ্বরী দেবীর চোখে পড়ে গেল। উনি নিজের ছেলের দ্বিতীয়বার বিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়ে খুঁজছিলেন। একমাত্র ছেলে বিকাশের প্রথম স্ত্রী, দুটি সন্তান রেখে মারা যায়। শ্বেতাকে দেখেই রাজেশ্বরী দেবীর পছন্দ হয়ে যায়। বনেদি ধনী পরিবার। অর্থের অভাব নেই, প্রযোজন শুধু একজন মায়ের যে ওই বাচ্চাদুটিকে সন্তানতুল্য মানুষ করতে পারবে।

শ্বেতার মা-বাবার কাছে অবশ্য রাজেশ্বরী দেবীর প্রস্তাব একেবারেই মনঃপূত হল না। নিজের সন্তানকে দোজবরে বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে তাঁদের একেবারেই ছিল না। তার উপর পাত্রের বয়স প্রায় ৪০ ছুঁইছুঁই, যতই তারা ধনী হোক না কেন! তাছাড়া দুটি সন্তানের বাবা। কিন্তু শ্বেতাই আগ্রহ দেখিয়ে এই সম্বন্ধ স্বীকার করতে মা-বাবাকে বাধ্য করাল। বহুদিন পর এমন একটা সম্বন্ধ শ্বেতার মনের মতো হল। কারণ পাত্র কিংবা তার সন্তানের প্রতি শ্বেতার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। ওর একমাত্র নজর ছিল বিকাশের অর্থ, বৈভবের প্রতি এবং ওর সামাজিক পদমর্যাদার প্রতি।

বিয়ের পর দশটা বছর কেটে গেছে। যে টাকার জন্য শ্বেতা বিয়ে করেছিল, সেই অর্থের কোনও অভাব ছিল না ওর। বিকাশের সন্তানরা হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করত। বিকাশকে শ্বেতা নিজের ইচ্ছেমতো পরিচালনা করত। শ্বেতার কথায় বিকাশ উঠত-বসত। তবুও শ্বেতার মনের মধ্যে একটা পুরোনো ব্যথা মাঝেমধ্যেই ওকে বিষণ্ণ করে তুলত।

বিকাশ সবসময় শ্বেতাকে হাতের চেটোয় রাখার চেষ্টা করত, তবুও ওদের সম্পর্কটা স্বামী-স্ত্রীর মতো নয় বরং ভৃত্য এবং মালিকের মতো ছিল। শ্বেতার মতো অপূর্ব সুন্দরী স্ত্রী পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করত বিকাশ। স্ত্রীয়ের সৌন্দর্যের পূজারি হয়ে উঠেছিল ও, স্বামী হওয়ার কখনও চেষ্টা করেনি। বিকাশের সন্তানদের সঙ্গে শ্বেতা সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখত। ওর নিজের কোনও সন্তান হয়নি এবং এই নিয়ে ওর মনে কোনও দুঃখও ছিল না। সন্তান না হওয়াতে পনেরো বছর আগেকার ছিপছিপে ধনুকের মতো শরীর শ্বেতার বজায় ছিল। আয়নায় যখনই নিজেকে দেখত শ্বেতা, একটা অহংকার বোধ জেগে উঠত ওর মনের ভিতরে।

আজ অনেকদিন পর নীলাঞ্জনার পরিচিত মুখটা ফেসবুকে দেখতে পেয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি ওর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। সেটা ঈর্ষা না আনন্দ বুঝতে পারল না। নীলাঞ্জনা যেন দেখতে আগের থেকে আরও সাধারণ হয়ে গেছে কিন্তু ঋষি এখনও তেমনই হ্যান্ডসাম। হঠাৎ করেই আবার সেই পুরোনো অধ্যায় শ্বেতাকে নিয়ে চলল অতীতের ফেলে আসা দিনগুলোয়।

নিয়তি হয়তো একেই বলে। নয়তো নীলাঞ্জনা আর ঋষি কীভাবে আবার শ্বেতার জীবনে ফিরে এল। ঋষির ব্যাবসা সংক্রান্ত একটি জরুরি ফাইল বার করার ছিল যা কিনা একমাত্র বিকাশের সাহায্যেই করা সম্ভব ছিল।

অফিসে বিকাশ যখন জানতে পারল নীলাঞ্জনা এবং ঋষি ওর স্ত্রীয়ের কলেজের সময়কার বন্ধু, ও ঋষিদের নিজের বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানাল। শ্বেতা এতে মনে মনে খুশি হলেও বাইরে কিছুই প্রকাশ করল না। নিজের ঐশ্বর্য ওদের দেখাবার এমন সুযোগ কেই বা হাতছাড়া করতে চায়! তাছাড়া ঋষিকেও তো বোঝাতে হবে, শ্বেতাকে বিয়ে না করে ও কী হারিয়েছে আর কাচের টুকরোকে হিরে ভেবে তুলে নিয়ে গেছে। নিজের যোগ্যতা এবং আত্মবিশ্বাসের উপর নীলাঞ্জনার অহংকারের সাক্ষী শ্বেতা নিজে। সুতরাং নীলাঞ্জনাকেও বোঝাতে হবে, জীবনের দাঁড়িপাল্লায় আজ শ্বেতার বৈভব, সৌন্দর্যের ওজন নীলাঞ্জনার তুলনায় অনেক বেশি।

সময়ের আগেই নীলাঞ্জনা আর ঋষি বিকাশদের বাড়ি পৌঁছে গেল। একসঙ্গে বসে গল্প করতে করতে ওরা দুজন পুরোনো স্মৃতিতে মাঝেমধ্যে তলিয়ে যেতে থাকলেও, শ্বেতার ব্যবহারে এটাই বারবার প্রকাশ পাচ্ছিল যে, পুরোনো কথা আর কিছুই ওর মনে নেই।

কথার মাঝেই নীলাঞ্জনার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই শ্বেতা বলে উঠল, তুই কি চেহারা করেছিস! আগের থেকে কত মোটা হয়ে গেছিস। জিম-টিমে যাস না? নিজের ছিপছিপে শরীর প্রদর্শন করতে শ্বেতা শাড়ির আঁচল সারা শরীরে ছড়িয়ে দিয়ে আবার সেটা ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল, উদ্দেশ্য একটাই কোনও ভাবে ঋষির দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হল শ্বেতার। ঋষির চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল নীলাঞ্জনার প্রতি ওর ভালোবাসা এবং সম্মান।

নীলাঞ্জনা শ্বেতার কথায় মৃদু হেসে উত্তর দিল, শ্বেতা মা হওয়ার পর মেয়েদের ওজন এমনিতে বেড়েই যায়। তোর যখন নিজের সন্তান হবে তখন বুঝতে পারবি।

শ্বেতার মনে হল একটা থাপ্পড় মেরে কেউ ওর মুখ বন্ধ করে দিল। ওর মুখের গোলাপি আভা নীলাঞ্জনার কথায় ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করল। বিকাশের সঙ্গে ঋষি আর নীলাঞ্জনাও নিজেদের সন্তানের সম্পর্কে আলোচনায় মশগুল হয়ে গেল।

এই প্রথম শ্বেতা অনুভব করল, ও বিকাশের সন্তানদের সম্পর্কে কিছুই জানে না। বিকাশকে বিয়ে করেছে ঠিকই কিন্তু ওর সন্তানদের মা হয়ে উঠতে পারেনি।

খাওয়ার টেবিলে সকলে এসে বসলে শ্বেতা মনে মনে বলল, আমার রান্নার স্বাদকে ওরা উপেক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু এখানেও ও নিরাশ হল! রান্নায় এত তেল-ঝাল মশলার ব্যবহার দেখে নীলাঞ্জনা বলেই ফেলল, এত তেল-মশলা ব্যবহার কেন করিস শ্বেতা? বিকাশদার বয়স হচ্ছে তাছাড়া আমাদের সকলেরই এখন উচিত কম তেলের খাবার খাওয়া। সম্ভবত বিকাশের শরীরে মেদের প্রাচুর্য দেখেই নীলাঞ্জনার ওই উক্তি।

শ্বেতা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, ওর রূপ, ঐশ্বর্য কেন ঋষি আর নীলাঞ্জনাকে প্রভাবিত করতে পারছে না। ওর প্রতি ওদের দৃষ্টিই নেই। ঋষি আর নীলাঞ্জনার সম্পর্কের রসায়ন যে-কোনও দম্পতির মনেই ঈর্ষার জন্ম দিতে পারে, বিশেষ করে শ্বেতার মতো মহিলার মনে তো বটেই যেখানে শ্বেতার বিয়ে কেবল অর্থের জন্য হয়েছে। এছাড়া বিকাশের প্রতি শ্বেতার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।

খাওয়া শেষ হলে ঋষি আর বিকাশ কাজ নিয়ে কথাবার্তা বলতে বাগানে গিয়ে বসল। শ্বেতা নীলাঞ্জনাকে নিজের বিশাল ড্রয়িংরুমে বসিয়ে কফি আনতে ভিতরে চলে গেল।

কফিতে চুমুক দিতে দিতে নীলাঞ্জনা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। শ্বেতার মনে হল এবার বোধহয় নীলাঞ্জনা ওর আতিথেয়তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠবে। হঠাৎই বেশ জোরেই হেসে উঠল নীলাঞ্জনা। বান্ধবীকে উদ্দেশ্য করে বলল, শ্বেতা, এখনও কি তুই তোর প্রতিজ্ঞার কথা মনে রেখে দিয়েছিস? মনে হচ্ছে তুই-ই জিতে গেছিস।

শ্বেতা উত্তর দিল না। কিন্তু ও বুঝে গিয়েছিল ও নিজের প্রতিজ্ঞা রাখতে পারেনি। নীলাঞ্জনাদের কাছে ও হেরে গেছে। ওর সৌন্দর্য, বৈভব কিছুই ঋষি আর নীলাঞ্জনাকে প্রভাবিত করতে পারেনি।

নীলাঞ্জনাকে টেক্কা দিতেই ও বিকাশকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু আজ শ্বেতা বুঝতে পারছে, নীলাঞ্জনাকে টেক্কা দেওয়া ওর পক্ষে কোনওদিনই সম্ভবপর হবে না। কারণ একজন স্ত্রীয়ের সাফল্য তার সৌন্দর্যে নয় বরং তার স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক আর দৃঢ়তার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যেটা শ্বেতার বৈবাহিক জীবনে কোনও মান্যতা পায়নি।

কফি শেষ করে নীলাঞ্জনা, বিকাশ আর ঋষি যেখানে বসে, সেদিকে পা বাড়াল। শ্বেতার মনে হতে লাগল ওর অর্থহীন প্রতিজ্ঞা আজ ওকে এমন একটা মোড়ে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যেখান থেকে হয়তো সঠিক ঠিকানার দিশা ও কোনও দিনই খুঁজে পাবে না।

তিনে নেত্র

আগের মতো বাবু হয়ে বসলে মা, রানুমাসি দুজনেই আজকাল খুব বকে। অগত্যা বদলে গেল আমার বসার ঢং। কিন্তু সেবারই প্রথম দোলে, চুলের সিঁথির ফাঁকে ইচ্ছে করেই রেখে দিলাম একটু আবির রং। কেন জানি না!

আগে হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা শেষ হতো গরমের ছুটির আগে। সারা দুপুর আমাদের খুব লুডো খেলা হতো। আমার দাদার বন্ধু মৈনাকদা আসত আমাদের বাড়ি। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। এলোমেলো দাড়ি। সাজ-পোশাক পরিপাটি নয়, তবু চোখে একটা গভীরতা ছিল। আর কথায় ছিল জাদু। আমি তখন এর বেশি কিছু বুঝি না।

সেবছর ফাল্গুনে, টুটুমাসির বিয়েতে বর দেখে যেরকম ভালো লেগেছিল, সেরকম ভালো লাগে। আর ভালো লাগে আমার পাকা ঘুঁটি, দান পড়লেও মৈনাকদা কাটে না। আমার দাদা রেগে যায়, মৈনাকদা থামিয়ে দেয়। ঝগড়াও হতো মাঝেমধ্যে। সেটা ভুলে গেছি। সুযোগ পেয়ে জোড়া পাকা ঘুঁটি না খাওয়াটা আজও ভুলিনি।

চুল ঝাঁকিয়ে বেশ তবলা বাজাত মৈনাকদা। আমার সাথে সন্ধেবেলা অনেকদিন বাজিয়েছে। সেদিন আমার গান ভালো হতো না। শুদ্ধ স্বরগুলো নড়ে গিয়ে কড়ি-কোমলে লাগত। দাদা আমার থেকে দুবছরের বড়ো, তবুও আমি বড়ো হয়ে গেলাম আগে। কারণ মেয়েবেলায় ছেলেবেলাটা খুব ছোটো।

মাধ্যমিকের আগে দাদাকে বললাম, লাভ-ক্ষতির অঙ্কগুলো একটু বুঝিয়ে দিবি?

দাদার সামনে উচ্চমাধ্যমিক। দাদা বলল, কমার্স পড়তে পড়তে ওসব ভুলে গুলে খেয়ে দিয়েছি। মৈনাককে বলে দেব, ও দেখিয়ে দেবে।

পরদিন দুপুরে চিলেকোঠার ঘরে শুরু হল আমার লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষা। পরের বছর সরস্বতী পুজোয় নৃত্যনাট্যে স্টেজের পিছনে অন্ধকারে খুব অল্প জায়গায় ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছিলাম আমরা। তবলা নিয়ে মৈনাকদা আর তার ঠিক পাশেই আমি লাফিয়ে গিয়ে বসেছিলাম। ভালো লাগত বসতে। পাঞ্জাবি পরেছিল ও। গায়ে গন্ধটা চোখ বুঝলে আজও পাই। একটা জিতে যাওয়া মানুষের গায়ের গন্ধ। ওটাই শেষ পাশে বসা। মায়ের সজাগ চোখ তারপর আর কোনওদিন, আমাদের কাছাকাছি আসতে দেয়নি। বারান্দা থেকে ওর কলেজ যাওয়া দেখাটা, আমার আরও বেড়ে গেল। তবে স্বপ্নে অনেক কিছু দেখেছি, সেটা আমার একান্ত নিজস্ব। কাউকে বলা যাবে না।

আমার বাবা- মা দুজনেই চাকরি করে। রানুমাসি আমাদের সবসময়ে কাজের লোক, দেখাশোনা করে। মায়ের নির্দেশে, বেশি বেশি নজরে রাখে আমাকে। কারণ মৈনাক ভালো ছেলে হলেও, অর্থাভাবে ওদের টানাটানির সংসার। ওই বয়সে আমার কাছে সেটা অর্থহীন।

বিজয় দশমীর দিন ও প্রতিবছর আসত আমাদের বাড়ি। বাবা মাকে প্রণাম করত। দাদার সাথে কোলাকুলি করত। আর আমার সাথে চোখে চোখে যেটা হতো, শুধু সেটা নিয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। মা থালা সাজিয়ে মিষ্টি দিত। আমার, মামারবাড়িতে জামাই-ষষ্ঠীর কথা মনে হতো। মা বলত, দ্যাখ, মৈনাক কত ভালো ছেলে, যেমন পড়াশোনায়, তেমনি কি সুন্দর তবলা বাজায়।

আমার এই কথাগুলো ভালো লাগত না। এগুলো লোক ঠকানো। মৈনাকও বুঝত ভালো বিশেষণ পাওয়া সহজ। কিন্তু গ্রহণযোগ্যতার অনেক মাপকাঠি আছে। তবুও অবুঝের মতো হতাশ চোখে দেখত। আজকের মতো তখন এত মেলামেশার সুযোগ ছিল না। তখন ভালোবাসা বেশি ছিল, সাহস কম ছিল। এখন ঠিক উলটো। সাহসটা বেশি কিন্তু ভালোবাসাটা কম। আসলে বাধা-বিপত্তি না থাকলে কোনও কাজেই আনন্দ নেই।

ফল্গুর মতো একটা প্রেম বয়ে চলতে লাগল। পাড়ায় একটা চর্চা ছিল। কিন্তু কারও হাতেই কোনও প্রমাণ ছিল না। আসলে মৈনাক খুব ভীতু প্রেমিক। মৃদুমন্দ বসন্তবাতাসের মতো সারাদিন মন ভালো করে দেবে, অথচ প্রয়োজনে কালবৈশাখী হয়ে উঠতে পারবে না। না হলে এমএসসি পাশ করা একটা ছেলে তখনও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারছে না। নব্বইয়ের দশকে একটা মেয়ে নিজে থেকে উদ্যোগ নিতে পারে না।

আমার তখন গ্র‌্যাজুয়েশন হয়ে গেছে। আজকের যুগে হলে এটা জলের মতো সহজ। তবে সেটা হলে এ লেখাটাও হতো না, আর ভালোবাসার হয়তো মরণ হতো দু-ছক্কা দুই-এর সংসারের চাপে।

অনেক সাহস করে মৈনাক একদিন দেখা করেছিল একটা রেস্টুরেন্টে। প্রেম বলতে ওই একদিন আমরা করেছিলাম। গল্পের শেষে আমি যখন বলেছিলাম, বাবা-মা কিন্তু কোনওদিনই তোমার সাথে বিয়ে দেবে না।

ও কোনও উত্তর করল না। শুধু জলভরা চোখে তাকিয়ে রইল। ও যদি সেদিন আমায় এই বিশ্বসংসারের সব ছেড়ে ঝাঁপ দেবার ডাক দিত, আমি সেদিন ওর বুকে মাথা রাখতাম। ঠিক-ভুল, সময় বিচার করত। সাগর ডাক না দিলে, শুধু নদীর পক্ষে এগিয়ে গিয়ে মেলা কঠিন। মনে মনে সেদিন-ই বুঝে গেলাম, এ প্রেম আমায় সারা জীবন বিরহ যন্ত্রণা দেবে। ওঠার আগে আমার হাত চেপে ধরল মৈনাক।

একটা কান্না আমার গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠল। আসলে প্রেম তো শুধু ভালোবাসা চায় না, সে রাগারাগি চায়, ঝগড়া চায়, দোকানের ফর্দ চায়, বাজারের ভুল চায়, মুখ-ঝামটা দিয়ে ভাত বাড়তে চায়, মায়ের মতো রাগ করে আলাদা শুতে চায়, মাঝরাতে আবার মশারির ভেতরে এসে সোহাগ পেতে চায়। এসবে প্রেমের মৃত্যু হয়, না সাফল্য আমি জানি না। এখন নিজে মা হয়ে বুঝি, প্রেমের সংসার আর সংসারের প্রেমে কত তফাত।

তারপর যা হবার তাই হল। আমার কিশোরীবেলার অবুঝ প্রেম সাপলুডোর সিঁড়ি পেল না, সাপের মুখে পড়ল। বাবা-মার পছন্দের পাত্রের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল। কত কলকাকলি, তার মধ্যে বিবাহ-সংগীত, গায়ে লাল বেনারসী, রজনীগন্ধা, আগের সব গন্ধ ঢেকে দিল। কত উপহারের নীচে চাপা পড়ে গেল মৈনাকের দেওয়া গীতবিতান। অচেনা এক পুরুষকে বন্ধু করার চেষ্টা করতে লাগলাম। মৈনাকের জলছবির ওপর ধুলো জমতে থাকল।

বুঝতেই পারলাম না, কখন আমার ভেতরের দুদিকে দোল খাওয়া দু-বিনুনির ছটফটে মেয়েটা, মরে গিয়ে খোঁপায় পরিপাটি এক শান্ত বউ-এর জন্ম হল। এতদিনের গান-বাজনা, পড়াশোনা, সব টানটান বিছানা, রং মেলানো পর্দা, আর দুপুরের রঙিন কাপড় দিয়ে সেলাই করা বালাপোষের নীচে চাপা পড়ে গেল। কোলে এল মেহুল। মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি। সন্তান।

নব্বইয়ে দশকে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরে সন্তানের জন্য জীবন দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল। স্কুল, কোচিং ক্লাস, নোট নেওয়া এসবই ছিল ধ্যান-জ্ঞান। নিজের সব না-পারা ছেলেমেয়ের মধ্যে উসুল করে নেওয়া। জীবনের আয়নায় নিজের থেকে প্রতিবিম্বকে সুন্দর করে তোলা। মেহুলের নীচে চাপা পড়ে গেল আমার সব ঝাপসা অতীত।

আমার স্বামী মানুষটা খারাপ নয়। চাকরি ভালোই করে। মদ বা সিগারেট যেটুকু খায়, তাতে তাকে নেশাগ্রস্ত বলা যায় না। কর্তব্যে ফাঁকি নেই, তবে অমনোযোগিতা আছে। সুখ চারপাশে অনেক ছড়িয়ে আছে, একঘেয়েমির বিরক্তিও আছে। তবে সুপ্রিয় আমাকে খুব বিশ্বাস করে। শিকড় সমেত গাছ তুলে এনে অন্য মাটিতে বসালে যে অসুবিধাগুলো হয়, সেটা ধীরে ধীরে মানিয়ে নিলাম।

ঘড়ির কাঁটার মতো টিক টিক করে দ্বিতীয় পদবির বয়সও কুড়ি বছর হয়ে গেল। মেহুল এখন কলেজে পড়ে। আজকাল মেয়েরা, মেয়ে হওয়ার কষ্ট কমই বোঝে। একটা করে সন্তান, চারহাতে ঢাকা প্রদীপের শিখার মতো। আপন খেয়ালে বেড়ে উঠতে পারে। মেয়ে বলে কোনও আলাদা ভয় সমাজ এদের মনে ঢেলে দেয়নি। ফলে আমাদের থেকে খোলস ভাঙার ক্ষমতা এদের বেশি।

মেহুল একদিন কলেজ থেকে ফিরে বলল, মা জানো, আজকে একটা দারুণ ঘটনা হয়েছে। আমাদের কেমিস্ট্রি স্যার, এমডি আজকে হঠাৎ ক্লাসে আমাকে মার নাম জিজ্ঞেস করল। আমি তোমার নাম বললাম, আমার মাথায় হাত দিয়ে আদর করল। মা তুমি চেনো?

মুহূর্তে মনের ফুটো দিয়ে সব স্মৃতি ফিনকি দিয়ে উঠল। নিজেকে সংবরণ করলাম। শান্ত ভাবে বললাম, ওনার পুরো নাম কি?

মেয়ে বলল, মৈনাক দত্ত, দারুণ পড়ায়।

আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে উঠলাম, হ্যাঁ, তোমার মামার বন্ধু। বলেই অন্যদিকে কথা ঘুরিয়ে নিলাম। আমাদের প্রজন্মের, এ ভয়, না মরলে যাবে না। নিজের গ্রহ ছেড়ে অন্য গ্রহকে মানুষ চিনতে যাচ্ছে, অথচ একজন পুরুষকে আমি চিনতাম, সে কথা স্বীকার করার সৎসাহস আজও অর্জন করতে পারলাম না।

মেহুল রোজ এসে মৈনাকের গল্প বলত। ও বিশ্বাসই করতে চাইত না যে, মৈনাক ওর মামার বন্ধু! আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করত, মামার থেকে এত ছোটো দেখতে লাগে কেন?

আমি ওকে কী করে বোঝাব আমার মৈনাকের কথা শুনতে ভালো লাগে না। এখন শুধু একটাই আপশোশ করি, মেহুলকে একটু সুপ্রিয়র মতো দেখতে হল না কেন। যত বড়ো হচ্ছে একদম অবিকল আমি। শুধু হাঁটাটা আলাদা। দুদশক আগে আমাদের হাঁটায় শাড়ি পরে যে-সলজ্জ ভাবটা ছিল, সেটা এখন জিন্সে অনেক আধুনিক আর সাহসী।

একদিন সন্ধ্যাবেলা সুপ্রিয় তখনও ফেরেনি, মেহুল ওর নিজের ঘরে, আমি বসে টিভি দেখছি। হঠাৎ মেহুল এসে বলে, মা স্যার ফোন করেছে তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে।

আমি ইশারায় বললাম, বল মা টয়লেটে, পরে কথা বলবে।

আমার খুব রাগ হল, ও এরকম বোকার মতো করছে কেন? আসল সময়ে সাহসের খোঁজ নেই। এখন এসব করার কোনও মানে আছে। এখনকার মেয়েরা অনেক বুদ্ধিমান। কিছু যদি আন্দাজ করতে পারে কী বাজে হবে ব্যাপারটা!

স্যারের সাথে মেহুলের সম্পর্ক আরও কাছাকাছি আসতে লাগল। মেহুলকে কলেজের পর অনেক জায়গায় খাওয়াতে নিয়ে যায়। লাইব্রেরিতে অনেকক্ষণ দুজনে সময় কাটায়। কেমিস্ট্রির অনেক বই, নোটস দিয়েছে মেহুলকে। কিন্তু আমার যন্ত্রণা ক্রমশ বাড়তে লাগল। না পারছি, সুপ্রিয়কে সব খুলে বলতে… না বারণ করতে পারছি, মেহুলকে। তবে ফোনে আর কোনওদিন আমার সাথে কথা বলতে চায়নি। হয়তো বুঝে গেছে, আমি পছন্দ করছি না। মাঝেমধ্যে ভাবি মেহুলের কাছ থেকে মোবাইল নাম্বারটা নিয়ে মেহুলের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে বারণ করে দিই। এতে মেহুল জানতে পারলে, হিতে বিপরীত হতে পারে। এই নিয়ে অশান্তি আমার বাড়তেই থাকল।

সেদিন পঁচিশে বৈশাখ। আমি টিভিতে গান শুনছি। মেহুল সকালে উঠে বলল, মা, তোমার লালপাড় হলুদ শাড়িটা পরে আজকে কলেজ যাব। রবীন্দ্র-জয়ন্তী আছে।

আলমারি থেকে বার করে দিলাম। লাল ব্লাউজটা হালকা সেলাই করে দিলাম। শাড়ি পরে মেহুল এসে যখন সামনে দাঁড়াল, তখন আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। এতদিনে মা হয়ে বুঝিনি, মেহুল হঠাৎ মেয়ে থেকে মহিলা হয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে দুগ্গা দুগ্গা বলে মেয়েকে কলেজ পাঠালাম। সুপ্রিয় তখনও ওঠেনি। এক ঠ্যালা দিয়ে বললাম, তুমি এবার বিয়ের ব্যবস্থা করো।

ও ঘুমের ঘোরে বলে উঠল, কার?

আমি রেগে বললাম, তোমার।

এবার ও ধড়মড় করে উঠে বলল, কি হয়েছে বলবে তো?

ওকে বুঝিয়ে বললাম, এবার মেয়ের বিয়ের খোঁজখবর শুরু করতে হবে, কথা বললেই তো আর বিয়ে হচ্ছে না। সময় ঠিক কেটে যাবে। ফাইনাল পরীক্ষার পর বিয়ে দিয়ে দেব। তারপর পড়তে চাইলে, বিয়ের পর পড়বে।

ও ধামাচাপা দেওয়ার মতো বলল, ঠিক আছে।

সন্ধেবেলা মেহুল ফিরে এল। হই হই করতে করতে ঘরে ঢুকল। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা স্যারকে পাঞ্জাবি পরে কী লাগছিল! মনেই হয় না স্যারের বয়স পঁয়তাল্লিশ। কী দারুণ তবলা বাজাল! আমার নাচের ভিডিওটা দ্যাখো। এই বলে আমাকে অনুষ্ঠানের সব ছবিগুলো দেখাতে লাগল। হঠাৎ একটা ছবিতে মৈনাককে দেখলাম। একইরকম আছে। শুধু চোখে একটা পুরু কাঁচের মোটা ফ্রেমের চশমা।

মেহুলকে জিজ্ঞেস করলাম, তোদের স্যারের চোখে খুব পাওয়ার?

মেহুল বাচ্চা মেয়ের মতো বলে উঠল, হ্যাঁ স্যারের তো গ্লুকোমা আছে, আর তো বছর দুয়েক হয়তো দেখতে পাবে, ডাক্তার বলে দিয়েছে। স্যার আমায় সব গল্প করে, স্যার তো কলেজে পড়ার সময়ে জানত। কুড়ি-পঁচিশ বছরের মধ্যে একবারে অন্ধ হয়ে যাবে। সেই জন্যই তো স্যার বিয়ে করেনি।

সেদিন গভীর রাত। সবাই শুয়ে পড়েছে। আমার ঘুম আসছে না। আমি মেহুলের ঘরে ঢুকে মৈনাকের নাম্বারটা নিলাম। ফোন করলাম মৈনাককে। গভীর রাতে সবার গলাই খাদে নেমে যায়। ওপার থেকে গম্ভীর গলায় ভেসে এল,

হ্যালো…।

আমার সারা শরীর কাঁপছে। আস্তে করে বললাম, মালবিকা।

কেমন আছো? একবার শুধু দেখতে ইচ্ছে করে।

তোমার চোখের কথা শুনলাম।

ও কিছু না। আমি তো ওটা পঁচিশ বছর আগেই জানি। শুধু চিরকালের মতো আলো নিভে যাওয়ার আগে, একবার তোমাকে দেখতে চাই। ওটা আমার অন্ধকারের ভেতরটা আলো করে রাখবে।

আমি যাব, রাখলাম।

সারারাত আমার ঘুম এল না। দেখলাম, একটা গোটা রাত কত গভীর, কত অন্ধকার। বারবার মনে পড়ছিল, মৈনাকের লেখা কবিতার চারটে লাইন,

আমি আজ দুঃখ দিয়ে নেশা করব,

আমার কান্নায় আফিমের কারবার;

তবু…, তুমি জ্যোত্স্না মাখলে না, মহাকাশে

রটিয়ে দিয়েছি স্পর্শহীন প্রেমের ইস্তেহার।

পরদিন সকালে উঠে চা করে ওদের ডাকলাম। সুপ্রিয়র সুগার আছে, ও চিনি দিতে বললে, আমি রাগারাগি করি। আজ আমি ভুল করে ওর কাপেই দুচামচ চিনি দিয়ে দিলাম। শরীর ভারী লাগছে। কোনও কাজ করতে ইচ্ছে করছে না।

মেহুলকে বললাম, তোর কলেজে একদিন যাব।

মেহুল জড়িয়ে ধরে বলল, আমার মিষ্টি মা।

মালবিকা ভাবতে লাগল… চোখ কী শুধু দেখার, না কাঁদার!

নিতাইধনের উড়ান

এক

চিনতে কততি হবে না। মাস তিনেক আমি সামলে নেবানে। তিন মাস বেশ লম্বা টাইম। তদ্দিনে মরা বাপ-মাকেই লোকে ভুলি যায়। আর পুলিশ তো পরের দিনই দেকতি পায় না, চোখ উলটি দেয়। না হলি এত এত মরা মর্গ জুড়ে পড়ি থাকে! বড়োবাবু ছমাস পর্যন্ত রাকেন, তারপর একসাথে জড়ো করি জ্বালায় দেন।

বিশে এক লপ্তে অনেকখানি কথা বলে ফেলে হেলেপড়া বটতলায় বসে আবার একখানা বিড়ি ধরাতে চেয়ে হাত পাতল। দুপুর বেশ খরখরে। সকালে দুটো বডি বেরিয়েছে। পার্টি তাগড়াই ছিল। নেবার কালে পাঁচশো করে দিয়েছে। কিন্তু আজ আর একটা দুটো পাঁচশোর পাতি হলে ভালো হয়। আজ রাতে ঝুমরোর ডাক আছে। সেই চেতলার ব্রিজের তলায় হনুমান মন্দিরের পাশের বস্তিতে যেতে হবে। সে কবে থেকে একখান ট্যাঁকে গোঁজা ফোনের কথা কচ্ছে কিন্তু কিছুতেই জুত করতে পারছে না বিশে। তার মনে হচ্ছে, হয়ে যাবেনে আজ। আর নেপাদা শুধুমুধু তো কথা খসাচ্ছে না। সে-ও খানিক অ্যাডভ্যান্স দেবেনে মনে হয়। হাজার দুয়েক হলি আর দেখতি হবে না। আজই ঝাক্কাস একখান ফোন হাতে দাঁড়ালে ওই শাপলার নালের মতো সুন্দরী তারে বুকে টানে নিতি বেশি ভাববে নানে।

বিশে, তুই বলছিস যখন, কাজটায় এগোই। কী বলিস?

সত্যি সত্যি ভাবনা মিলে যাচ্ছে বিশের। নেপাদার হাতে নতুন দু’হাজার টাকার পাতি। ছোঁ দিয়ে তুলে নিতে নিতে বলল, তুমি চিনতে কোরো নাকো। তোমাকে এখানে আমি ঠিক নুইক্কে রাখব। তোমার বাপটা থানায় ডাইরি করবে আনে। ব্যস, কাম ফতে!

পুলিশের কাছে মিসিং ডায়েরি করার পর তো আমার কাম ফতে হবে রে বিশে ! পুলিশ হাত ধুয়ে মার পেছনে পড়ে যাবে৷আমার মোবাইল ট্র্যাক করবে৷শ্মশানঘাটের চুল্লির ভেতর থেকেও টেনে নিয়ে চলে আসবে৷

কী ছেরাদ্দর কতা কইছ ন্যাপাদা! পুলিশের খেইয়ে দেইয়ে কাজ নেই যে জোয়ান মদ্দ ছেলে হারায়ে গেলি খুঁজতি যাবেনে! মেয়েমানুষ হলি খানিক কতা ছেল। তাও তো নয়।

নে বিড়িটা ধরা বিশে। কামধেনু বিড়ি। একটু কড়া হবে। ধরা ধরা।

দু’জনের খোসগল্প আর বিড়ির ধোঁয়ায় বটগাছতলায় একখান মেঘ উঠল। মেঘের উপরে বৃষ্টি নেই। শুধু দুপুরই দুপুর। ন্যাপাদা বলল, বিশে, সেই কোন ল্যাংটোবেলা থেকে তুই আমার বন্ধু। তোকে না বলে কোনও কাজই আমি যে কেন করতে পারি না!

কাঁটাপুকুর মর্গের এগারো বছরের স্থায়ী চাকুরে ডোম বিশে বাগদি বড়োলোক বন্ধুর এই প্রশংসায় না ভিজে পারে না। সে চোখ পিটপিট করতে করতে বন্ধুর চোখে চোখ রেখে তাকে মাপে। মনের ভেতর ভালোলাগা লালা ঝরায় তখন।

এই যে দ্যাখ একটা সাদামাটা খুন করব, তাও তোকে বলছি। তোর কাছ থেকে সায় না পেলে মনে জোর হয় না রে বিশে।

আজ যেন ন্যাপাদা বিশেষ আবেগময় হয়ে আছে। সব কথা গলগল করে কইতে লেগেছে চা-র দোকানের কাঠের লম্বা বেঞ্চে বসে। তাদের বেঞ্চে অন্য কোনও লোক নেই। তাছাড়া ভরদুপুরে এমনিতেই এই চত্বরে মানুষজন কম। ন্যাপাদা কথা চালায়।

বিয়ে করার আগে তোর সাথে শলা করেছি, তোর মনে আছে? আবার সেই বিয়েকরা বউ মালতিকে সালটাতে যাবার আগেও তোর শলা নিলাম। তোর বুদ্ধির উপর আমার বেশ ভরসা রে বিশে। তুই বললি বলেই তো পাতাখোর ছিদাম গুঁইকে দিয়ে আমি মালতির পেট চিরে মাতলায় ফেলেছিলাম। পেট চিরে লাশ জলে ফেললে যে ভাসে না, তা জানতাম নাকি!

বিড়িটা হেবি কড়া ন্যাপাদা। মগজে গিয়ে ঘাই মারতিছে। তবে কতিছি কি, এবারে আর তোমারে বিপদের ধারে-কাছেও যেতি দেব নানে। বুক দে আগলে রাখব আনে।

হ্যাঁ রে সত্যি! সেবার প্রায় ফেঁসে গেছিলাম আর কী! আমার মোবাইল-এ মালতির কল ছিল। ভাগ্যিস লাশ পাওয়া যায়নি। তিন দিন থানায় রেখে খানিকটা ঠুসেছিল। কিন্তু এক বাপের ব্যাটা আমি। মুখ খোলাতে পারেনি। কোর্টে নব্বই দিনের মধ্যে চার্জশিটই জমা দিতে পারল না। তবে তাতে হাবুলদা-র হাত দিয়ে থানাকে হাজার দশেক খাওয়াতেও হয়েছিল।

গুরু শোনো। ঝ্যাকোন তোমার ইস্তিরিকে মারতি গিছিলে বড্ড তাড়াহুড়ো ছেল। এবার সময় নিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে করতি হবে। আরে খুন করা একটা আর্ট। তা শিখতি হয়, জানতি হয়। এ লাইনে যে যত বড়ো শিল্পী তার তত দর।

ন্যাপাদা বিশেকে বলতে দেয়। সে যেন ভাজামাছ উলটে খেতে জানে না এমন ভঙ্গি করে বিশের মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে। ন্যাপাদা জানে বিশে একটু বকতে পারলে খুশি। তা তার খুশিতে বাগড়া দেবার দরকার কী! তাছাড়া এবার বিশের সাহায্য খুবই দরকার ন্যাপাদার। খুনের আগে পরে লুকিয়ে রাখা, বাবাকে দিয়ে মিসিং ডায়ারি করানো, নতুন সিম ভরা মোবাইলে অনেক অনেক কাজ। এসবের জন্য একদম কাছের একটা লোক দরকার। আর তা ডোম বিশে হলে সোনায় যে সোহাগা তা জমি, বাড়ির দালাল ন্যাপাদা বেশ ভালোই জানে।

বিশে বিড়ির শেষটুকুতে ফুস ফুস করে জোরালো দুটো টান দিয়ে বলতে থাকে। ধরো তুমি নিজেই নিজেরে সুপারি দেচ্ছ। তুমিই মালিক, তুমিই কর্মচারী। দু-দু’খান কাজ করতি হবে তোমারে। খুব যত্নের কাজ। ওই যে যেরাম ক্যারামবোর্ডের এদিক থেকে পোঙা ঘষটে গিয়ে একবার সাদা গুটি আবার উলটো দিকে ফিরে আসি কালো গুটিরে প্যাঁদাতে হয়, ত্যামোন। কাউকেই ছাড়ি দেয়া যাবে না।

ন্যাপাদা চায়ের দোকানির দিকে ফিরে আঙুল দিয়ে আরও দুটো চায়ের অর্ডার দিয়ে রংচটা ময়ালামাখা প্লাস্টিকের টেবিলের উপর কনুই-এর ভর রেখে হাতের তালুতে মুখ মেলে বেশ জাঁদরেল একটা মনোযোগী পোজ দিল। বিশে বলে চলেছে তার কথা।

হ্যাঁ, এক নম্বর কাজ হল গে, খুনের বরাত দেবার সময় সব ইনফর্মেশন আর মোটিভ যত্ন করি খুনিরে বলি দেয়া। আর খুনের পরে নিজেরে বোকা পাঁঠার মতো সাজ্যে রাখা। মানে তুমি যে গোবেচারা ভালোমানুষের পো, তা যেন জনে জনে কতি থাকে।

ন্যাপাদার বিড়িও ফুরিয়ে এসেছিল। সে হাতের নিভে যাওয়া বিড়ির টুকরো রাস্তার ধারের কালো নিকাশি খানার ভেতর টিপ করে ছুড়ে ফেলে দিতে সক্ষম হয়ে, বেশ একটা হিরো হিরো ভাব খায়। জিন্সের পকেট থেকে ধবধবে সাদা ভাঁজ করা রুমাল বের করে পুরু ঠোঁটের উপর বিড়ির কশা দাগ মুছে দিতে বার দুয়েক ঘষে। বিশের ঢ্যামনা মার্কা মুখের উপর সে রুমাল ঝেড়ে আবার ভাঁজ করে প্যান্টের হিপ পকেটে রেখে দিতে দিতে নিজের গুরুত্ব বোঝায়।

ঠিক বলেছিস বিশে। এই কাজটা এক্কেবারে নিখুঁত করে করতে চাই। শালা ঘাটের মড়া বাবাটারে খচ্চা করে দিতে পারলে ওই ভাঙাচোরা চুন-সুড়কি, কড়ি-বরগার বন-বাদাড় নিকেশ করে একখান স্বর্গের ইন্দ্র-বাড়ি বানাতে পারব। তাই পা মেপে মেপে এবার কাজ করছি। বউ মালতিদের সম্পত্তি হাতাবার সময় একটু কাঁচা ছিলাম। এখন বুদ্ধি আমার বেশ পেকে গেছে রে!

বিশে গামছা দিয়ে পিঠের মাছি সরাতে সরাতে বলে, হ্যাঁ, বলো দিনি কিরাম ভাবিছ বরাত দেবার জন্যি! এট্টুস শোনাও। ফাঁকফোকর থাকলি আমি ভরে দেবানে।

ভাবা-টাবার জায়গায় আর নেই রে! এখন কত তাড়াতাড়ি কাজটা নামানো যায় তাই দেখার। তুই-ই বল আমার পাঁচ-সাত কোটি টাকা আটকে আছে এখানে! তিন বিঘের এই জমিটাতে কম করে পাঁচটা টাওয়ারের কমপ্লেক্স উঠে পড়বে। এক একটা টাওয়ার থেকে কম করে এক-দেড় কোটি নাফা আসবেই। তো বাপ শালাটাকে আর কদ্দিন বাঁচিয়ে রেখে আমি নিজেকে ঠকাব, অ্যাঁ! সে তো ওই ভাঙা বাড়িতেই ডবকা শালিকে নিয়ে নিজে মস্তি মারছে। এদিকে ছেলেটা যে মাস ছয় হল বউ হারিয়ে বিবাগি হতে বসেছে, সে খেয়াল আছে তার!

ঠিক বলেছ ন্যাপাদা। ঝে খুন করাবে সে ঝ্যানো মনের ভেতর থে হইচই করি ডাক পায়। খুব জোরাল হতি হবে খুন করানোর মোটিভ। নরম-সরম হলি কাজ কমপ্লিট হবে না, সব কুবোকাত। তোমার দেখছি দু-দুখানা মোটিভ আছে। খুনের জন্যি একদম পাক্কা সওয়াল করিছ। পেছু হটার কোনও উপায় নেই।

ন্যাপাদা মেয়েছেলে দোকানির হাত থেকে চায়ের গেলাস নামিয়ে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে, বিশের দেয়া নম্বর নিজের পিঠে যোগ করে বেশ ভারি হয়ে ওঠে। কথায় সেই ওজন ধরা পড়ে। নে বিশে, চা ধর। বিস্কুট খাবি? বাপুজি কেকও খেতে পারিস। ঘুগনি মুড়িও আছে। যেটা খুশি।

বিশে বিড়িটা খেয়ে বেশ মেজাজে আছে। সে তা নষ্ট করতে চায় না। চা-এর সাথে অন্য কিছু না নিয়ে সে কথার সংযোগ রাখে। বলে, এবার হল গে দুই নম্বর কাজ। মানে ধরি নাও, তুমি খুনের বরাত পেয়ে গেছ। মানে খুনি হিসেবে ইদিক-উদিক, ঠিক-বিঠিক ভাবতি হবে। মানে কাজের আগে মনের ভেতরে নানা গলিপথ সড়কপথ ধরে ঘুরিফিরি রেকি করা আর কী! মানে কোনও ক্লু না রেখে, পুলিশকে ঘোল খাইয়ে কাজ হাসিল করার ছক কষা।

খুন তো আমি করে ফেলব রে বিশে। কিন্তু সমস্যাটা হল গে তারপর পুলিশ যেন দুয়ে দুয়ে চার না করে! মানে পরদিন খবরের কাগজে তিন নম্বর পাতার পাঁচ নম্বর কলমে হয়তো লেখা হল, সম্পত্তির লোভে বাবাকে খুন। আজকাল মিডিয়া এমন উসকে দেয় পুলিশকে যে কুচো চিংড়ির মতো পুলিশ লাফাতে থাকে।

ধইয্য ধরো গুরু। এইখানে তো আমি আমার খেল দেখাবানে। প্রথমে এক মাস হারায়ে যাও। লোকে জানবে তোমারে পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর কাজ সালটে আরও এক মাস গোপনে থাকতি হবে। শেষকালে ভাদোর মাসের পর আশ্বিনে পুজোর সোরগোলের ভেতর সন্ন্যাসীরাজার মতো ফিরে এসে বাড়ির জমি-দলিল নিজের করি নিতি হবে। ব্যস! এই কয়’মাস আমি তোমাদের বাড়ি নজর রাখব আর তোমার নুক্কে থাকার দেকভাল করি দেব।

কিন্তু বিশে, তোর তো চাপ বেড়ে যাবে রে। একদিকে আমাকে লুকিয়ে রাখা আবার অন্য দিকে আমার বাবাকে দিয়ে থানায় মিসিং ডায়ারিটা করানো, খুব সহজ কাজ নয়। আমার বাবাটা যা একখান খচ্চর মাল! সে বলে বসতে পারে, হারিয়ে গেছে তো আপদ চুকেছে। আর থানা-পুলিস হ্যাপা করতে হবে না।

মেজাক ঠান্ডা রাকতি হবে ন্যাপাদা। বাড়ি নিয়ে অতশত ভেব না তো! মেশামেশাই-এর সাথে আমার যা সম্পক্ক, ঠিক সালটে নেব। দরকারে দুটো হুইস্কির বোতল পেন্নামি ঠুকে দেবানে! ও তুমি ভেবোনিকো। আর তুমি তো কঞ্জুষগিরি করতিছ না। মাল পটাপট ছাড়তিছ। এই তো দু’হাজার দিলে, আবার দেবে। আমি তার থে এট্টুস খরচাপাতি করতে পারব না! পারব পারব।

তুই পারলে আমিও পারব। কাচের গেলাসের শেষ নিংড়ে গলায় তিতকুটে লাল চা-টুকু চালান করে দিতে দিতে বিশের মুখের কাছে মুখ এনে ন্যাপাদা ফিসফিসায়।

দোকানি দু’একবার দুই পুরুষমানুষের ওরকম ঘন তাকান আর ফিসফিসানি নজর যে করেনি, তা নয়। ওরকম চোখে চোখে কথায় যে শরীর সিরসির করে, সে জানে। এ-পাড়ার চোলাই বেচা জোয়ান ছেলেটা, ওই যে হারান, মাঝে মাঝে একটু বেশি রাতের দিকে এসে অমনি করে। ছেলেটা ভালো। একফোঁটা চোলাই নিজে খায় না। খানিক টাকাকড়িও করেছে। চায়ের গেলাস নিতে এসে হাত ছুঁয়ে দিয়ে ফিসফিস করে। বলেও তো, ওই বুড়ো হার জিরজিরে লোকটা তোকে কী দেবে! কিছু দিতে পারবে না। চল পালাই।

কিন্তু দোকানি মনে মনে ওই ভালোলাগা কথাগুলোকে শুধু আওড়ায়। পালায় না। ওটুকু ভালোলাগা সে কৃপণের মতো সঞ্চয় করে রাখে। খরচ করে না। সে এখন সেরকম ফিসফিসানি যেন টের পাচ্ছে ওই দুই দামড়া লোকের কথায়। দোকানে অন্য খদ্দের আছে, অত সময় কোথায় কান পেতে শোনার! থাকগে, বলুক গে। তার মনে হয়, এ দুটোই বুঝি জমির দালালি নিয়ে কথাবার্তা কইছে। সব দালালেরা ওরকম করে।

ন্যাপাদা ছুকরি দোকানির দিকে এক ছুঁক তাকিয়ে বোঝে সে পাশে দাঁড়িয়ে কথা শুনছে। খানিকটা অস্বস্তি হয়। কথা থামিয়ে দুটো গেলাস-ই দোকানির হাতে ধরিয়ে জায়গা হালকা করাতে চায়। তারপর দোকানি চলে গেলে আবার কথা শুরু করে। হ্যাঁ, যা বলছিলাম রে। এক মাস তোর এখানে লুকিয়ে থেকে একদিন রাতের অন্ধকারে গিয়ে বাবাটাকে সালটে দেব। তারপর আবার এখানে ঢুকে পড়ব। মাসখানেক এখানে কাটিয়ে একদিন দূরে কোথাও ট্রেনে পকেটমারি-টারি করে ধরা পড়ব।

বিশে টেবিলে একটা নরম করে ঘুসি মেরে বলল, দারুণ! দারুণ ছক তোমার। তবে দেকে নিও ধরা দেবার সময় সিকেনে ঝ্যানো পুলিশ থাকে। নালে পাবলিকের ঝাড় খেয়ে সগ্গে গেলে আমার ফ্ল্যাটে থাকার স্বপ্নের প্যাট খসে পড়ে যাবেনে।

না না তুই চিন্তা করিস না। আমার কাছে তো মাল পাবে না। শুধু পকেটমারির অভিনয় করব। আর বিনা টিকিটের যাত্রী হব। দুটো কেসে সাকুল্যে মাসখানেকের জেল। একমাস জেল খাটব। তারপর ফিরে এসে পাল সাম্রাজ্যের আমিই অধিশ্বর। আর হ্যাঁ বলে রাখছি, লেখা-পড়া করেই দেব তোকে দু’কামরার একখান ফ্ল্যাট। সেখানে তুই নিয়ে আসতে পারবি চেতলার ওই মাগিটাকে।

বিশে অবাক হয়ে লজ্জা পেতেও ভুলে যায়। ন্যাপাদার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। সে জানল কী করে!

হ্যাঁ, আমি জানব না কেন রে!

হকচকিয়ে যাওয়া বিশের মুখের উপরে হাত নেড়ে তার ঘোর ভাঙাতে চায়। আর মুখের কথা সরে গেছে দেখে, ন্যাপাদা বিষয়টা নরম করতে গিয়ে আরও খানিক বলে, একটু রাতের বেলায় ইয়েছিয়ে করবি। মানে মস্তি-টস্তি করবি। তাই তো তোকে দু’হাজার টাকার নোটটা দিলাম রে! যা, একটু সিনেমা-টিনেমা দেখে ফুরফুরে হয়ে নে। পরশু থেকে তো আবার আমার দেখভাল করতে হবে! চাইলেও কোথাও যেতে পারবি না।

ও তুমি চিনতে কোরো না গুরু। তোমারে ভালো রাখার দায়িত্ব আমার। গদগদ স্বর বিশের। ধরা পড়ে যাওয়ার পর নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টাও যে এটা, তা বিশের অঙ্গভঙ্গি থেকেও বোঝা যায়।

আর হ্যাঁ বিশে, বাবার লাশ তো পুলিশ এই মর্গেই আনবে। তুই আমাকে একবার ট্রে নাম্বার জানিয়ে দিবি। ভেতরে বসেই পেন্নাম-টেন্নাম ঠুকে শ্রাদ্ধ-শান্তি করে নেব।

তা গুরু, খালাস করার ভাবনাটা ভাবিছ? মানে কীভাবে খুনটা করতি চাও! মানে কতিছিলাম ম্যালা ফ্যাচাং যেন না হয়। মানে খুনের আগে পরে তোমাদের বাড়ির কেউ যেন তোমারে দেখতি না পায়।

হ্যাঁ, আগে পাশের ঘরে বাপের শালিকে মারব মুখে বালিশ চেপে। তারপর বাপকে মাথায় এক সাবলের বাড়ি মেরে ভবের জ্বালা মিটিয়ে দেব। আর দুটোরই কাপড়-চোপর এমন এলোমেলো করে রাখব যে লোকে ঘরে ঢুকে ওদের দিকে তাকাতে লজ্জা পাবে।

বিশে একটু অবাক চোখে চেয়েছে। মানে নিজের বাবা আর মাসিকে ওরকম ন্যাংটোফ্যাংটো করে বাইরের লোককে দেখাবার দরকার কী, সে বুঝতে পারছে না।

ন্যাপাদা বিশের ভাবনা বুঝতে পেরে বলে,  খুনের মোটিভকে ঘুলিয়ে দিতে হবে না! লোকে চট করে যেন অন্য ভাবনায় চলে যায়। মানে ধর ওই সেক্সুয়াল ভাবনায় গেলে আর সেখান থেকে লোকে বের হতে পারে না। মানে ভাবনাটা শরীর দিয়ে ঘুরপাক খাবে। নানা গল্প বানাবে। বুড়ো বাপের চরিত্র নিয়ে কথা তুলবে। কেচ্ছায় কেচ্ছায় নানা রঙের মিলন হবে। খুনের কথা লোকে তেমন ভাববে না। সন্দেহের তির চোরা স্রোতের ভেতর ঘুরতে থাকবে। বুঝেছিস!

গুরু, তোমার এলেমের তুলনা নেই। গার কাপুড় হটায়ে পোগ্রাম একদম সড়সড়ে করে দিছ গো!

আরে এমনিতেই তো দুটোই নিয়ম করে, মানে আমার বাবা আর মাসি রোজ রাতে মালটাল খেয়ে ওইসব করে। ওদিনও শেষবারের মতো সেসব করবে। তারপর আমার কাজ সেরে, আলমারি ভেঙে কিছু গয়না আর টাকা হাতিয়ে দোতলার জানলার ভাঙা রডে শাড়ি আর ধুতির দড়ি ঝুলিয়ে নেমে আসব। শোন, চাইলে তোকে একখান বিছেহার দিয়ে দিতে পারি। তুই বরংচ আমার হয়ে তোর ওই চেতলার বস্তির ছেমড়িকে সেটা উপহার দিয়ে দিস। আর বাকিগুলো আমার থাকবে। এই কেসটা সালটে নিতে পারলে, ভাবছি আবার একটা বিয়ে করে ফেলব। একা একা কাটানোটা বেশ টাফ্ রে।

দুই

 প্রথম চোটেই ঘুম এসে গেছে। হলদেটে আলোয় ঘেরা চওড়া প্যাসেজ। মর্গের ভেতরটা সাদা টাইলস-এ বাঁধানো। তকতকে পরিষ্কার। কোথাও ময়লার ছিটেফোঁটা নেই। বিশেকে বলা ছিল ভালো করে ট্রে যেন পরিষ্কার করে। বরফ-টরফ ফেলে দিয়ে অগুরু-টগুরু দিয়ে যেন জায়গাটা ফুরফুরে রাখে। পই পই করে বলেছে, আরে মরা মানুষ না জ্যান্ত লোক শোবে। তার মতো ব্যবস্থা করবি।

এখানে ঢোকার আগে বিশের সাথে অনেকটা মাল টেনেছিল ন্যাপাদা। শুয়োরের মাংস আর পরোটাও সেঁটেছিল। বিশে বলছিল পেট ভরাট থাকলে মন চলবে না। মন না চললে ভয়-ভীতের সম্ভাবনা কম। আর মালের গুঁতোয় এক ঘুমে রাত কাবার হবে। ভোর ভোর আমি তোমাকে ট্রে থেকে নামিয়ে মর্গের টয়লেটে পাঠিয়ে দেব। সেখানে হাগা-মোতা স্নান সেরে, চা-টা খেয়ে আবার নিজের জায়গায় সেঁধিয়ে যাবে এ তল্লাটে কেউ আসার আগেই। দুপুরবেলায় ওখানে শুয়ে শুয়ে খাবে। এক ফাঁকে আমি খাবার পৌঁছে দিয়ে আসব। রাতের বেলায় সবাই চলে গেলে তোমাকে বের করে এনে আবার মদ আর খাওয়া-দাওয়ার মস্তি। সমস্যাটা প্রথম রাত নিয়ে জেগে উঠলে আবার ভয়-টয় পেও না।

ভয় পাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। পকেটে বিদেশি পয়েন্ট বত্রিশ বোরের পিস্তল সব সময় থাকে ন্যাপাদার। ভূত-ফুত ব্যাপারটাই ভূতুড়ে। সব মনের দুর্বলতা। আর ন্যাপাদা অমন দুবলা মন নিয়ে জন্মায়নি। এখনও মনে আছে পুরুলিয়ায় গিয়ে হোটেলে সেই মাগিটার ছ্যাঁচড়ামোর কথা। কলকাতা থেকে তিন দিনের কড়ারে নিয়ে গিয়েছিল। বিছানায় শুয়ে টাকা টাকা করে খুব চিৎকার করেছিল সে মাগি। আর ধৈর্য রাখতে পারেনি ন্যাপাদা। গলা টিপে ধরে চ্যাঁচানি জন্মের মতো খতম করে দিয়েছিল। কিন্তু বিছানায় রাতের মস্তি কী করে হবে! কলকাতা থেকে গাড়ি ভাড়া করে গিয়ে শেষমেশ মস্তি হবে না! তখন ওই মরা মাগিটাকেই ন্যাংটো ফ্যাংটো করে সারা রাত ধরে যা করার করেছিল সে। তারপর সকাল বেলায় মরা মাল ট্রলি ব্যাগে পুরে হোটেল থেকে বেরিয়ে ধা। আসার পথে ড্রাইভারকে পানমশলা আনতে দূরে পাঠিয়ে পাহাড়ের উপর থেকে জঙ্গলের ভেতর ট্রলিব্যাগের মায়া কাটিয়েছিল। মানে মাগিটাকে ব্যাগশুদ্ধ শান্তিস্বর্গে পাঠানো। তারপর পান পরাগে গা গরম করে নেয়া ছাড়া বিশেষ কিছু করতে হয়নি।

এখানে কেউ এসে হুজ্জতি করলে দান ছেড়ে দেবে না ন্যাপাদা। মেরে দেবে। কিন্তু গলাটা চেনা চেনা লাগল যেন!

কী যেন একটা মিষ্টি গন্ধও নাকে এসে লাগছে। ন্যাপাদার এই গন্ধটা চেনা। চোখ বন্ধ করে বুক ভরে সেই মিষ্টি গন্ধটা নিচ্ছে সে। কী যে মন আকুল করা সে গন্ধ! ন্যাপাদা পাশ ফিরে মশারির ভেতর শুয়ে আছে যেন।

অনেক রাত। জানলা দিয়ে জ্যোত্স্না এসে এমন রামপুরহাটের বন বাংলোর ভেতরের দোতলা ঘরটাকে ভাসিয়ে নিচ্ছে! ন্যাপাদার মনে হল সে আকাশে উড়ছে। তার নতুন বউটিও তার সাথে হাওয়ায় ভাসছে। তারা দু’জনেই তো পোশাকবিহীন তখন। এক একটা শাল, পিয়াল, সোনাঝুরি, ইউক্যালিপটাসের মাথায় তারা সামান্য একটু বসে জিরিয়ে নিচ্ছে। আবার হাত ধরাধরি করে উড়ে যাচ্ছে। মহুয়াফুলের হলদেটে সাদা রং মালতির বড়ো করে বাঁধা খোঁপায় জোনাকির মতো গুঁজে দিতে ইচ্ছে করল।

মহুয়া গাছের গায়ে হাত বুলিয়ে তারা গাছকে শুধোল, গাছ তোমার কাছ থেকে দুটো ফুল নিই? রাগ কোরো না।

নিতাইধন, কী গো রাগ করেছ!

হ্যাঁ এই গলাটা চেনা তো! আরে এই নাম তো সে ভুলে গেছে। এই পিতৃদত্ত নামে কে এমন করে ডাকে! কে! সে যে কী করে নিতাইধন থেকে ন্যাপাদা হয়েছে আজ আর তা মনে নেই। এমন ভালোবাসা মাখিয়ে তার হারিয়ে যাওয়া একান্ত নিজের নামটা কানে আসতে কেমন যেন আচ্ছন্নতার ঘোর। প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে।

নিতাইধন, রাগ কোরো না। কতদিন আমরা একসাথে উড়ি না। এসো উড়বে। নীল ঘুড়ি, লাল ঘুড়ি আকাশে একসাথে উড়ছে। ফিসফিস করে সোঁ সোঁ হাওয়ায় কথা কইছে। দেখোনি তুমি! আমাদের রামপুরহাটের হানিমুন মনে পড়ছে না! চলো নিতাইধন আমরা আবার উড়ি।

হ্যাঁ, তার গলা। সে। সে যে মালতি বউ। বড্ড সুরেলা ছিল তার দেহ। মাচার উপরে উঠে পুঁইডগা যেভাবে ডগমগায়, সে-ও তো তেমন করে বাইকের পেছনে বসে ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে উড়ে যেত। নিতাইধনের পিঠে খিলখিল করে হাসত তার যৌবন।

ন্যাপাদা চোখ খুলতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। দেখতে তো হবে মালতিকে। এখানে কোথা থেকে এল! দুটো স্লিপিং ব্যাগের ভেতর ঢুকে আছে বটে, কিন্তু তাতে ঠান্ডার প্রকোপ কম হলেও লাগছে। হাত দিয়ে চেনটা না খুললে মালতিকে ছোঁবে কী করে!

নিতাইধন, তোমার পিঠের নীচে আমার একটা প্রিয় জিনিস রয়েছে। একটু পাস করো না।

হ্যাঁ, ন্যাপাদার মনে হল, পিঠের নীচে কী যেন একটা খোঁচা খোঁচা লাগছে। সত্যি তো। ওটা নেবেই বা কী করে! তার এই ধুমসো শরীর সরিয়ে সে নেবে বা কী করে! ন্যাপাদা কাত হয়। চোখ খোলে না। বুকের উপরে থাকা স্লিপিং ব্যাগের চেন খুলে হাত বের করে। তারপর পিঠের নীচ থেকে গোলাকার একটা বস্তু বের করে চোখের সামনে মেলে দেখার চেষ্টা করে।

নিতাইধন, আমার হাতের আংটি ওটি। তুমি বিয়ে সময় হাতে পরিয়ে দিয়েছিলে। দাও দাও। ওটা আমার খুব প্রিয়। তোমার বন্ধুই তো, ওই যে বিশে পাগলা, সে-ই যত নষ্টের গোড়া। তড়িঘড়ি করে তোমার থাকার জায়গা করে দিতে আমাকে তাড়িয়েছে এখান থেকে। মর্গের পেছন দিকে আশ-শ্যাওড়ার নোংরা বনে পুটুলি করে আমাকে রেখে এসেছে। কাল সকালে হয়তো জ্বালিয়ে দেবে। কিন্তু আমার হাতের আঙুল থেকে আংটিটা খুলে পড়ে গেছে। দাও নিতাইধন, আমাকে দাও।

হু হু করে ঠান্ডা ঢুকছে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর। চেন খোলা বুকের। নিতাইধন ওরফে ন্যাপাদা আপ্রাণ চেষ্টা করছে চোখ খোলার। আংটিটা তো একবার দেখতে হবে। মালতিকে তো একবার দেখতে হবে। মালতির হাতে আংটি পরিয়ে সে আজ আবার একটু উড়বে। দুজনে মিলে উড়বে। আজ সেরকম গন্ধময় বাতাস। জ্যোত্স্না রাঙানো আবহ। আজ মাটির থেকে অনেকটা উপরে ওঠা চাই তাদের। যেমন জ্যোত্স্নার গায়ে কোনও মলিনতা নেই।

দস্তানা

হোয়্যার ইজ দ্য রিভার?

সকালে উঠেই সিঁড়ি বেয়ে সোজা নীচে। সে রিসেপশনে হামলে পড়ল। কেতাদুরস্ত (যেমন হয়) রিসেপশনিস্ট যুবকটিকে সামান্য সুপ্রভাত জানানোর সুযোগটাও দিল না। তার হাঁসফাঁসে চেহারাটা দেখে ছেলেটি নিজেকে সামলে নিল, হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল– দেয়ার ইউ হ্যাভ আ ব্যাক ডোর, ওপ্ন ইট, অ্যান্ড দেয়ার ইউ গো। বাট ইট্স অফুলি কোল্ড আউটসাইড, মর্নিং ইন জার্মানি ইজ ভেরি ভেরি চিলি। হোয়্যার ইজ ইওর ওভারকোট ম্যাম? ইট্স আ মাস্ট বিফোর ইউ থিংক অফ গোইং আউট।

রিমি এক মুহূর্ত ভাবল। নদী তার জন্য অপেক্ষা করবে না? সামান্য একটা শীতের পোশাক পরে বেরোতে? এই নদী তো আজন্ম তার, হ্যাঁ, তারই জন্য সে অপেক্ষা করেছে। যেমন সুদূর কলকাতায় তার জন্য অপেক্ষা করছে অভি।

সে সিঁড়ির রাস্তা ধরছিল। রিসেপশনিস্ট ছেলেটি তাকে আগের মতোই মধুর গলায় বলল– হ্যাভ আ লুক অ্যাট ইওর লেফট, দেয়ার ইজ আ লিফট।

রিমি লিফটে উঠল। উঠেই মনে হল, দয়ালু ছেলেটিকে সে একবারও ধন্যবাদ জানায়নি। লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ার মুহূর্তে সে ফাঁক দিয়ে চেঁচিয়ে বলল– ডাঙ্কে, ডাঙ্কে শ্যুন।

জার্মানিতে আসার পর সে হাতে গোনা যে ক’টি জার্মান শব্দ শিখেছে তার মধ্যে এই একটা– ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ।

ওভারকোটটা পরে সে যখন রিসেপশন ডেস্কের পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে বেরোল, মুখে এসে ঝাপটা মারল তীক্ষ্ম তিরের মতো ঠান্ডা হাওয়া। কিন্তু রিমি তা আগ্রাহ্য করল। সামনে দিয়েই চলে গেছে একটা সোজা চকচকে রাস্তা, আর তার ওপারে… রিমি স্বপ্নেও ভাবেনি তার সঙ্গে রাইন-এর কোনওদিন দেখা হবে! কিন্তু না, দেখা তো হল! সত্যি! সে রাস্তাটা দৌড়ে পার হল। এরপর তার সামনে সেই নদী। রিমি প্রাণ ভরে তাকে দ্যাখে। ওভারকোটের পকেট থেকে ক্যামেরা বার করে। ছবির পর ছবি, তারও পর ছবি।

সে রাইন-এর ধার ধরে ধরে হাঁটতে শুরু করল। বিশ্বাস হচ্ছে না। পটাপট ছবি তুলছে। ছবি তুলতে গেলে দস্তানা পরলে একটু অসুবিধে হয়। কিন্তু ঠান্ডাটা বড্ড বেশি। সে ছবি তোলায় ক্ষান্ত দিয়ে ওভারকোটের পকেটে ক্যামেরাটা পুরে ফেলে দস্তানা হাতড়ায়। সর্বনাশ, সে দস্তানা না নিয়েই বেরিয়ে পড়েছে! এবার কী হবে!

এই ঠান্ডায়!

রিমি হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা চলে এসেছে। নদীর সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার উচ্ছ্বাসে আর ছবি তোলার উৎসাহে এতক্ষণ দস্তানার অভাবটা মালুম পড়েনি। এখন পড়ছে। ওভারকোটের পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে সে ফেরার পথ ধরে। কিন্তু এতক্ষণ সে হেঁটেছে হাওয়ার দিক বরাবর। এবার হাঁটতে হচ্ছে হাওয়ার উলটোদিকে। আপাতত তার নাক বলে কিছু নেই, জমে পাথর হয়ে গেছে। একটা জায়গায় নদীর ধারে ছোট্ট একটা খাঁড়িতে কিছু হাঁস খেলা করছে, ওদের শীত লাগছে না? রিমি পকেট থেকে ক্যামেরা-সহ হাত বার করল, সঙ্গে সঙ্গে তার আঙুলগুলো যেন ঠান্ডায় বেঁকে গেল। সে দ্রুত হাত আর ক্যামেরা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। যথেষ্ট হয়েছে, আর হাত বার করা যাবে না, শুধু চোখ দিয়ে প্রাণ ভরে দ্যাখো, দেখে যাও। কিন্তু সেখানেও কি শান্তি আছে! ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটায় চোখ জ্বালা করে জল পড়ছে। এত ঠান্ডা! বাপ রে বাপ!

রিমি জার্মানি এসেছে একটা প্রোজেক্টের কাজে। সে মানবীবিদ্যার ছাত্রী। যেসব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান নারী, সেখানকার নাগরিকেরা কেমন আছে, এই তার গবেষণার বিষয়। নানা শহর ঘুরে সে এসেছে এই বন শহরে। যা পূর্বতন পশ্চিম জার্মানির রাজধানী ছিল। ভারি সুন্দর সাজানো শহর। আর ওই নদী, যেন তার গলার হার। কিন্তু আপাতত কাব্যি করার চাইতে হোটেলের নিয়ন্ত্রিত উষ্ণতায় ঢুকে পড়া তার পক্ষে বিশেষ দরকারি।

হ্যাঁ, সে কবিতা লেখে। সেসব তেমন কিছু নয়। নিজের ল্যাপটপের এক কোণায় সেভ করে রাখা। তারা ওখানেই নিশ্চিন্তে ঘুমায়। তাদের বাইরে টানাটানি করাটা রিমির পোষায় না। ওসব তার একান্ত ব্যক্তিগত আবেগের প্রকাশ, কারও সঙ্গে সে তা ভাগ করে নিতে চায় না।

সে সোজা ডাইনিং হলে ঢুকে পড়ল। এখানে হোটেলের চার্জের সঙ্গে প্রাতরাশটাও মুফতে। সে পরে হবে’খন। আগে পরপর দু’কাপ কফি। তারপর অন্য সব। বাব্বা, ঠান্ডা কাকে বলে!

প্রাতরাশ সেরে সে যখন লিফটে উঠছে, রিসেপশনিস্ট ছেলেটির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। সুভদ্র হেসে বলল– হাউ ডিড ইউ লাইক ইট?

– হোয়াট? মাই ব্রেকফাস্ট?

– ও নো নো, দ্য রিভার।

– অ্যসাম বিউটি, অফুলি চিলি!

– আই টোল্ড ইউ। হোপ ইউ ওন্ট ক্যাচ কোল্ড।

– গড ব্লেস মি, আই হ্যাভ লোড্স অফ ওয়ার্ক টু ডু।

– ইউ উইল বি হিয়ার ফর থ্রি ডেজ, নো?

– ইয়াপ, মাই ওয়ার্ক ডিমান্ডস দ্যাট।

– ওকে, মাই বেস্ট উইশেস ফর ইওর ওয়ার্ক, হোয়াটেভার ইট মে বি।

– ডাঙ্কে, ডাঙ্কে শ্যুন।

– ওহ, ইউ গট ইট, হা হা হা, মোস্ট ওয়েলকাম!

রিমি ঘরে ঢুকল। এতক্ষণে সে একটু ধাতস্থ হয়েছে। কিন্তু গ্লাভ্সগুলো কোথায় গেল? তার তো ঘরে বসে থাকলে চলবে না। বেরোতে হবে, বাইরে ঘুরতে হবে। সে সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজে দেখল, কোত্থাও নেই। তাহলে সে কি আগের কোনও শহরে ফেলে এল তাদের। তবে তো গ্লাভ্স একজোড়া কিনতেই হচ্ছে। রিসেপশনের ছেলেটিকেই জিজ্ঞেস করতে হবে কোথায় কোন দোকানে পাওয়া যেতে পারে।

সে ল্যাপটপ খুলে বসে। কিছু তথ্য সে সংগ্রহ করেছে। সেগুলো গোছাতে হবে। এমনিতে সে কাজের ক্ষেত্রে খুব গোছানো। ফেলে ছড়িয়ে কাজ তার পোষায় না। তবু… ওই দস্তানা জোড়া… ধ্যুৎ… কোথায় যে গেল।

হারিয়ে যাওয়া দস্তানা থেকে তার মনও যেন কোথায় হারিয়ে যেতে চাইছে। সে ল্যাপটপে নতুন একটা পাতা খুলল…

আমাকে একাকী ফেলে

কোথায় হারিয়ে গেলে

উষ্ণতা, এসো ফিরে

প্রিয় নদীটির তীরে

এরপর আর কাজ হয় না। সে রিসেপশনে একটা ফোন লাগাল।

– ইয়েস ম্যাম, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?

– লিসন, আই লস্ট মাই ওল্ড পেয়ার অফ গ্লাভ্স, আই নিড টু বাই আ নিউ ওয়ান। ক্যান ইউ সাজেস্ট মি আ মার্কেট অর আ শপিং মল হোয়াটেভার হোয়্যার আই ক্যান গেট দ্যাট?

– উপ্স, ইউ ওয়াক্ড বাই দ্য রিভার উইদাউট ইওর গ্লাভ্স!

– ইউ বেট!

– আর ইউ ফ্রি টুডে?

– ইন দ্য মর্নিং, ইয়েস। আফটার ওয়ান আই অ্যাম অকুপায়েড।

– ওকে, আই সার্টেনলি ক্যান ডু ওয়ান থিং, আয়্যাম গিভিং সামওয়ান টু অ্যাকম্পানি ইউ টু দ্য শপ ফ্রম হোয়্যার ইউ ক্যান বাই ইট, উইল দ্যাট বি ওকে?

– ও থ্যাংক ইউ, থ্যাংক্স ভেরি মাচ।

– ওহো, ইউ ডোন্ট রিয়েলি লাইক মাই সাজেশন।

– হোয়াট মেক্স ইউ থিংক লাইক দ্যাট!

– আদার ওয়াইজ ইউ উড হ্যাভ সেড ডাঙ্কে, ডাঙ্কে শ্যুন।

– ওহ্, হা হা হা …আই উইল সেভ দ্যাট ফর আ বেটার

মোমেন্ট, ওকে?

– ওকে! অ্যাজ ইউ উইশ ম্যাম!

এগারোটা নাগাদ ছেলেটি ফোন করল রুমে। তার পথপ্রদর্শক এসে গেছে। এবার গ্লাভ্স কিনতে বেরোতে হবে। রিমি ভালো দেখে বেছে এক জোড়া গ্লাভ্স কিনল। তাতে হাত গলিয়ে এমন আরাম হল, যেন হাত দু’টো গ্লাভ্সের মধ্যে ঘুমিয়েই পড়বে। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লে তো চলবে না। অনেক কাজ, সামনে অনেক কিছু করা বাকি।

সে তার সঙ্গের ছেলেটিকে ধন্যবাদ ও বিদায় জানিয়ে হোটেলে ফিরল। রিসেপশনের ছেলেটির দিকে তাকিয়ে একটা ধন্যবাদ

(ইংরেজিতেই) জানিয়ে সোজা চলে গেল রুমে। হাতগুলো দস্তানার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ছে। না, না, ওদের জাগাতে হবে, জাগাতে হবে।

সে ল্যাপটপটা খুলে রেখেই বেরিয়ে গেছিল। খোলা সাদাপাতা, তাতে চারটি পঙ্ক্তি, তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কি আরও কিছু বলতে চায়? সে দস্তানা জোড়া বিছানার ওপর ছুড়ে ফেলল, তারপর ল্যাপটপটা কোলে টেনে নিয়ে…

আমাকে একাকী ফেলে

কোথায় হারিয়ে গেলে

উষ্ণতা, এসো ফিরে

প্রিয় নদীটির তীরে…

আমার নগ্ন হাতে

ছোঁয়াছুঁয়ি কার সাথে

নদী, বলো তার নাম

কাকে ভালোবাসলাম…

দুপুরের পর থেকে রিমি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একটু দেরিই হয়ে গেল বেরোতে। তারপর পাঁচ জায়গায় ঘোরাঘুরি। দস্তানা জোড়া সে খুব সাবধানে রাখল। আবার যেন না হারায়। হোটেলে ফিরতে ফিরতে সাতটা বাজল। এখন ভারতে রাত সাড়ে এগারোটা। অভি, তার প্রেমিক অভিমন্যু ফোন করবে। কিংবা সেও অভিকে ফোন করতে পারে। যে-কোনও একজন আগে করে ফেলতে পারে, এতে অত হিসেবের কিছু নেই। রুমে ঢুকে ল্যাপটপের ব্যাগ, কাগজপত্তরের আরেকটা ঢাউস ব্যাগ, ওভারকোট, মাফলার, আর হ্যাঁ, দস্তানা জোড়াও সে বিছানার ওপর ছড়িয়ে ফেলল। ডাবল বেড, কাজেই একপাশে তার শোওয়ার মতো জায়গা আছে। সে জুতো মোজা না খুলে হাত-পা ছড়াতে না ছড়াতেই রুমের ফোনটা বাজল। নিশ্চই অভি। মোবাইলে না পেলে হোটেলেও ফোন করে। রিমি এলিয়ে পড়েছিল, একটু কষ্ট করে উঠল

– হ্যালো!

– ইউ হ্যাভ আ কল ফ্রম ইন্ডিয়া ম্যাম। উড ইউ লাইক টু টেক ইট ইন ইয়োর রুম?

– ইয়েস, প্লিজ।

– রিমি, কখন ফিরলে?

– এই মাত্র। আজ খুব খাটনি গেছে। তোমার খবর বলো।

– আমি ঠিক আছি। আমিও একটু আগে ফিরলাম। শোনো, তুমি ওখানে থাকাটা আর বেশি বাড়িও না। মা খুব তাগাদা দিচ্ছে। তোমার মায়ের সাথে আজ কথা হল, উনিও চাইছেন না তুমি আর বাইরে থাকো।

রিমির ক্লান্ত লাগে। এই একটাই কথা অভি আজকাল প্রায়ই বলে। এটা নাকি দু’জনের বাড়ি থেকেই চাইছে। মা’ও সেদিন ফোনে একই কথা বলছিল। আশ্চর্য, সে কি মজা করার জন্য এই নির্বান্ধবপুরীতে একা একা খেটে মরছে! সেই হতাশাটাই তার উত্তরে প্রকাশ পেল – অভি, আমি কাজটা শেষ করি তুমি চাও না?

– নিশ্চই চাই, কিন্তু তাই বলে এতদিন বাইরে বাইরে থাকাটা… আমাদের বিয়েটা সেরে ফেললে হতো না?

– বিয়ে তো সারা হবেই, সোনা। তার আগে আমায় আরেকটু সময় দাও। প্লিজ। এই প্রোজেক্টটা সাকসেসফুল হলে তোমার আনন্দ হবে না? কত আর বেশি দেরি হবে? মাস তিন-চার? এর মধ্যে আমরা কি বুড়োবুড়ি হয়ে যাব?

– তা বলছি না, কিন্তু একা একা…

– একা বলেই তো তোমার কাছে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছি, তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ করে নিয়েই এক লাফে তোমার পিঠে চেপে বসব, রাইট?

অভিমন্যু মানতে চায় না। রিমির আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। সে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে। এখন সে একটু বাথটবে গরমজল ভরে শোবে, শুয়ে শুয়ে একটু রেড ওয়াইন পান করবে, তারপর সোজা বিছানায়, লেপের তলায়। এর মধ্যে তার মনে হয় যত দিন যাচ্ছে অভি বড়ো ঘ্যানঘ্যান করছে। তার মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে।

– সরি অভি, আজ আর কথা বলতে পারছি না, সারাদিন বড্ড ঘোরাঘুরি হয়েছে, এবার একটু রিল্যাক্স করতে চাই।

– তোমার উড-বি-হাজব্যান্ডের সঙ্গে কথা বলাটা কি রিল্যাক্সেশনের মধ্যে পড়ে না? আর শোনো, আমিও আজ সারাদিন অফিস করেছি। বসের সঙ্গে ঝামেলা করেছি। ফেরার পথে আমার গাড়িটাকে একটা স্কর্পিও ফ্রম নো হোয়্যার এসে রিয়ার ভিউটা ঠুকে দিয়ে গেল। আমিও যথেষ্ট ক্লান্ত। তোমার সঙ্গে কখন কথা হবে সেই কথা সারাদিন ভাবি, আর তুমি আজকাল কথাই বলতে চাও না!

– ওহ্ না না অভি! কে বলেছে কথা বলতে চাই না? অন্যদিন তো বলি! আজ কেন কে জানে… শোনো, আমি শিগগিরি একটা ডিসিশন নিয়ে নেব ফেরার ব্যাপারে… আমার কাজটা তার মঝ্যে ঝটপট করে ফেলতে হবে… জাস্ট বিয়ার উইথ মি ফর সামটাইম… ঠিক আছে সোনা আমার? …লাভ ইউ লাভ ইউ লাভ ইউ…

– ওকে

– তুমি লাভ ইউ বললে না?

– হ্যাঁ, লাভ ইউ, ছাড়ছি।

– গুড নাইট বেবি!

ওদিক থেকে আর কোনও সাড়া এল না। অভিমন্যু লাইন কেটে দিয়েছে।

রিমির কেমন যেন একটা লাগে। উঠে বাথটাবের গরমজলের কলটা খুলে দিয়ে আসা দরকার। জল ভরতে ভরতেই কাগজপত্রগুলো গোছগাছ করে রাখা দরকার। জামাকাপড় ছাড়া দরকার। একা থাকার এই এক সুবিধা। ইচ্ছেমতো নগ্ন হওয়া যায়। কিন্তু সে কিছুই করল না। বিছানায় হামাগুড়ি দিয়ে ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা বার করল… কী যেন লেখা ছিল ওই পাতাটায়?

আমাকে একাকী ফেলে

কোথায় হারিয়ে গেলে

উষ্ণতা, এসো ফিরে

প্রিয় নদীটির তীরে…

আমার নগ্ন হাতে

ছোঁয়াছুঁয়ি কার সাথে

নদী, বলো তার নাম

কাকে ভালোবাসলাম…

রিমি তার ক্লান্ত আঙুল কি প্যাডে রাখতেই তারা কেমন আপনা থেকেই সচল হয়ে উঠল,

তাকে বলো, ভালোবাসি

বলো, তোমার কাছে আসি

পেতে এতটুকু ওম

কী নরম কী নরম!

এবার এখানে ঠান্ডা বেশি পড়েছে। আজ সকাল থেকে শহরে তুষারপাত হচ্ছে। জানলা দিয়ে সেই ঝরে পড়া ছোটোছোটো তুলোর বলের দিকে তাকিয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। রিমির আজ কাজে বেরোতে মন চায় না। লেপের তলায় শুয়েই থাকে। কী একটা অবসাদ জড়িয়ে ধরেছে তার হৃদয়। তাকে আরও অনেকদিন এখানে থেকে যেতে হবে। তার দেশের থেকে দূরে, তার পরিবার থেকে দূরে, তার প্রেমিক, যে তার ভাবী স্বামী, তার থেকে দূরে। কিন্তু, ব্যাপার হল, তার মানসিক অবসাদ ঠিক এই জন্য নয়। কী জন্যে যে, সে নিজেই ভালো বোঝে না।

হ্যাঁ, একটা বিয়ে তার আশু কর্তব্য। কিন্তু কেন! তার যদি অভিকে আর ভালো না লাগে! এই অবধি ভেবে রিমি তার মনকে নিয়ন্ত্রণে আনল। ছি, এসব আবার কী কথা। সে কি চিরদিন একা একা এইখানে পড়ে থাকবে নাকি! সে দেশে ফিরবে, তার বহুদিনের প্রেমিক অভিকে বিয়ে করবে, তাদের একটি-দু’টি সন্তান হবে, সন্তানেরা বড়ো হবে, তাদের স্কুলে ভর্তি করতে হবে, তারা ভালো চাকরিবাকরি করবে, তাদের বিয়ে হবে, নাতিপুতি হবে… হা হা হা– মানুষের জীবনে এই গতানুগতিক সুখের চেয়ে বড়ো আর কিছু হয় কি?

অবসাদ… অবসাদ… এরকম একটা জীবনের কথা মনে আসতেই কেন কে জানে রিমির বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে। সে লেপের তলায় পাশ ফিরে শোয়।

তখনই তার রুমের ফোনটা বেজে ওঠে,

– হ্যালো!

– হ্যালো ম্যাম, গুড মর্নিং

– গুটেন মর্গেন

– হা হা হা গুটেন মর্গেন ইনডিড, বাট মর্নিং শোজ দ্য ডে। উই আর গোইং টু হ্যাভ আ মিজারেবল ডে।

– ইউ নো ইট বেটার।

– এনি ওয়ে, ম্যাম, হ্যাভ ইউ হ্যাড ইওর ব্রেকফাস্ট?

– নট ইয়েট। আয়্যাম স্টিল ইন বেড।

– ওহো, আয়্যাম সরি।

– নো নো, ইট্স অলরাইট, টেল মি।

– অ্যাকচুয়ালি… মাই ডিউটি আওয়ার ইজ ওভার। আই জাস্ট এনকোয়ার্ড হোয়েদার ইউ নিড সামথিং।

– ওহ, সো নাইস অফ ইউ। রাইট নাউ আই নিড সাম স্লিপ। দেয়ার মাস্ট বি সামওয়ান দেয়ার আফটার ইউ লিভ। আই উইল লেট হিম অর হার নো ইফ আই নিড এনিথিং।

– রাইট ম্যাম। আই অ্যাম লিভিং। হ্যাভ আ বেটার ডে।

– হা হা হা, ইউ বেট! ডাঙ্কে শ্যুন!

– মোস্ট ওয়েলকাম, ম্যাম!

ছেলেটি ফোন কেটে দিল। রিমি হঠাৎ দেখল তার মন ভালো হয়ে গেছে।

তুষারপাত হয়েই চলেছে। রিমি রেস্টুরেন্টে গিয়ে কাপুচিনোর মাগ নিয়ে বসল। সে মোবাইলে সর্বদা অনলাইন। কে একটা মেসেজ পাঠাল কোনও চেনা নাম নয়। অরূপ মহাজন। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। রিমি তার প্রোফাইলে গেল। মনে হয় নতুন প্রোফাইল খুলেছে। কোনও ছবি নেই, ওয়ালপেপার নেই। কোনও কিছু আপলোড করা নেই। সে ইনবক্সে জিজ্ঞেস করল – আপনি কে?

কোনও উত্তর নেই। তারপর – ক্যান আই চ্যাট উইথ ইউ?

– নো, সরি, অ্যাট ফার্স্ট আই মাস্ট নো হু ইউ আর।

– আ নিউ ফ্রেন্ড।

– ফ্রেন্ডস নো ইচ আদার।

– ওকে, মে বি সাম আদার ডে। বাই।

রিমি বিরক্ত হয়ে ফোনটা টেবিলের ওপর রাখল। সে আজ কাজে বেরোয়নি ঠিকই, ভেবেছিল বিশ্রাম নেবে। কিন্তু তার মাথা গজগজ করছে চিন্তায়। তার কাজ আর অভিকে নিয়ে একটা টানাপোড়েন শুরু হয়েছে বেশ কয়েকদিন হল। সে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। যে-প্রোজেক্টটা নিয়ে সে এখানে এসেছে, সেটা তার কাছে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। তার আগাগোড়া মেধাবী কেরিয়ার এতে উজ্জ্বলতর হবে। অভি কেন বুঝতে চাইছে না? যদিও সে জানে, এই দীর্ঘদিনের অসাক্ষাৎ তাদের দু’জনের পক্ষেই বেদনাদায়ক। দু’মাস হয়ে গেল দু’জনের দেখা নেই। যদিও ওয়েব ক্যাম-এ পরস্পরকে দেখতে দেখতেই তারা চ্যাট করে। কিন্তু অভির মুখে বিরহের পরিবর্তে বিরক্তিই বেশি।

রিমির মাঝে মাঝে মনে হয়, ভৌগোলিক দূরত্ব কি তাদের মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি করছে। এরকমটা হয় সে জানে। কিন্তু… না না না… তাদের ক্ষেত্রে অন্তত এটা সত্যি না। এই তো ক’দিন আগে এক বছরের ডেপুটেশনে অভিকে অফিস থেকে দিল্লি পাঠাল, তখনও তারা চ্যাট করত, ফোনে কথা বলত, রিমি যথেষ্ট ‘ভাল্লাগে না ভাল্লাগে না’-ও করত। কিন্তু এত চাপ সৃষ্টি করত না। হঠাৎ করে সে জার্মানিতে আসার পর থেকেই বিয়ের ছটফটানি শুরু হল কেন? তার ছাব্বিশ চলছে, অভির তিরিশ। এতে কি বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে!

কাপুচিনোটা শেষ হয়ে গেছে। রিমি রুমে এসে ওভারকোটটা গা’য়  চাপিয়ে মাথার হুডটা তুলে নিল। মাফলার, দস্তানা, ওয়াটারপ্রুফ জুতো জোড়া। তারপর রুমের ল্যাচটা টেনে লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তুষারপাতটা বেড়েছে। তবু সে রাইন নদীর ধার ধরে হাঁটতে লাগল। মুখে শানানো ছুরির মতো কনকনে ঠান্ডার আঘাত। সে হাঁটছে হাঁটছে হাঁটছে। কোথা থেকে? কোথায়? সে জানে না। মনে হয় সে সত্যিই অভির থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আর এটা হয়েছে জার্মানিতে আসার আগেই। শুধু বোঝা গেছে আসার পর।

এই শহরের বাকি যা কাজ, কালকের মধ্যে সেরে ফেলতে হবে। ব্যাপারটা চাপের হয়ে গেল, শুধু শুধু একটা দিন নষ্ট করল সে। পরশু সে কোলোন চলে যাবে। তবু, আজ যদি দিনটা সে রাইনের হাত ধরে অনেক দূর চলে যেতে পারে, সেও তো কম পাওয়া নয়।

ফোনটা কাঁপছে। সে পকেটের মধ্যে থেকে ফোন বার করল। অভি। অনলাইন।

– ওখানকার কাজ শেষ হল?

– নাহ্, আজ কোনও কাজ হল না, জানো! কালকে সব সারতে হবে, হয়ে যাবে। চিন্তার কিছু নেই।

– রুমে পেলাম না, কোথায় বেরিয়েছ?

– এই হাঁটছি, রাইনের ধার ধরে। বরফ পড়ছে, জানো! আর কী ঠান্ডা হাওয়া।

– শুধু শুধু ঠান্ডা লাগাচ্ছ কেন, হোটেলে ফিরে যাও।

রিমির মনে হল, অভি যদি তার সঙ্গে থাকত, সে বোধ হয় এভাবে এই কথাগুলো বলত না। বরং বলত – চলো আরও হাঁটি।সেই একসঙ্গে হাঁটার দিন কি তাদের ফুরিয়ে এল!

সারাদিন এদিক ওদিক উলটোপালটা ঘুরল সে। ভাগ্যিস তার কাছে দু’টো দরকারি জিনিস ছিল। এক – শহরের একটা ম্যাপ, দুই – হোটেলের ফোন নাম্বার। সন্ধে নাগাদ বরফ আর হাওয়ার দাপট বাড়ল। এবার হোটেলে ফিরতে হবে। বিরাট বিরাট শপিং প্লাজাগুলি আলো-ঝলমল, কিন্তু রাস্তায় কোনও লোক নেই, গাড়িও হাতেগোনা। রিমি হোটেলে ফিরে এল।

রুমে ফিরে বাঁ হাতের দস্তানাটা টেনে খুলবার জন্য ডান হাত বার করল। আশ্চর্য, ডানহাতের দস্তানাটা কোথায়! অভিকে মেসেজ করার সময় সে ডানহাতের দস্তানাটা খুলেছিল। তারপর নির্ঘাত পকেটে ঢোকাতে গিয়ে পড়ে গেছে। রিমির কান্না পায়। এই এক জোড়া গ্লাভ্স তাকে জ্বালিয়ে মারল। সে নীচে নেমে এল। রিসেপশনে একটি মেয়ে। তাকে এগিয়ে যেতে দেখে গম্ভীর মুখে বলল – ইয়েস ম্যাম?

– আই লস্ট মাই… এই অবধি বলেই রিমির মনে হল সেই ছেলেটি, যে তাকে গ্লাভ্সের দোকানে নিয়ে গিয়েছিল, সেরকম কাউকে তো মেয়েটি ঠিক করে দেবে না, আর সে নিজেও রাস্তা চিনে চিনে এই অন্ধকারে যেতে পারবে না। সে বাকি কথাটা গিলে নিল, বলল – আই থিংক আই লস্ট মাই রুম কি।

মেয়েটি চাবি ঝোলানো বোর্ডের দিকে তাকিয়ে বলল – ইয়োর রুম নাম্বার?

রিমি বলল। মেয়েটি গম্ভীর মুখেই বলল – নো, ইট্স দেয়ার। ইউ সাবমিটেড বিফোর গোইং আউট।

– ওঃহো, থ্যাংক্স আ লট।

কেন কে জানে মেয়েটিকে তার ডাঙ্কে শ্যুন বলতে ইচ্ছে করল না।

পরের দিন কাজে কাজেই সময় কেটে গেল। দস্তানা আর কেনা হল না। রাত্রিবেলা ঘরে ফিরে সে রিসেপশনের দিকে একবার তাকাল। না, পরিচিত ছেলেটি নেই। থাকলে সে একটু বিদায় নিত। কাল ভোর ভোর বেরিয়ে পড়তে হবে।

ভোরে বেরোনোর সময় লাগেজ নিয়ে নীচে নেমে রিমি রিসেপশনে চাবি জমা দিতে গেল। গিয়ে দেখল ছেলেটি আছে। রিমি খুশি হল। চেনা মানুষ দেখলে যেমন আনন্দ হয়। সে বলল – ইউ নো হোয়াট, আই লস্ট আ গ্ল্যাভ্স এগেন।

– ও মাই গড! হাউ?

– ডোন্ট রিমেমবার, মে বি আই ড্রপড ইট ফ্রম মাই পকেট। অ্যাকচুয়ালি আই ওয়াজ মেসেজিং মাই বয়ফ্রেন্ড, মাই উড-বি।

– ওহ, ওয়াও! ছেলেটি হঠাৎ আরও ভদ্র হয়ে গেল। – কনগ্র্যাটস অ্যান্ড গ্রিটিংস টু বোথ অফ ইউ।

– ডাঙ্কে, ডাঙ্কে শ্যুন।

– মোস্ট ওয়েলকাম!

রিমি হাত বাড়াল, তার দস্তানাবিহীন নগ্ন ডানহাত।

ছেলেটি হাতটা ধরল। উষ্ণ স্পর্শ। বলল – হ্যাভ আ ওয়ানডারফুল লাইফ। ফাইনালি, বিফোর উই পার্ট, মে উই ইনট্রোডিউস আওয়ারসেলভ্স আ বিট মোর পার্সোনালি?

– ও শিওর শিওর, ইউ আর সো হেল্পফুল, আই উইল রিমেমবার ইউ। প্লিজ টেল মি ইয়োর নেম।

– হ্যালো, দিস ইজ অরূপ মহাজন।

দু’মুহূর্ত দু’জনেই চুপ, তারপর দু’জনেই একসাথে হেসে উঠল। রিমি বলল

– বাট ফ্রম হোয়্যার দা হেল ইউ গট দ্যাট ইন্ডিয়ান নেম!

– উই হ্যাড আ বোর্ডার ফ্রম ইন্ডিয়া আ ফিউ ডেজ এগো।

– হা হা হা, হাউ ফানি। নাউ ইউ মাস্ট টেল মি ইয়োর রিয়েল নেম।

– অলিভার, অলিভার ম্যাথাউজ।

– হাই, আয়্যাম রিমি, রিমি বোস।

– হ্যালো রিমি, ইট ওয়াজ আওয়ার প্লেজার টু হ্যাভ ইউ হিয়ার ইন আওয়ার হোটেল।

– ওকে, নো ফর্মালিটিজ, বি জাস্ট দ্য ওয়ে ইউ আর, অ্যান্ড সেন্ড মি ইওর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট, আই উইল অ্যাকসেপ্ট। বাই।

রিমি খেয়াল করেনি তার ডান হাতটা তখনও ছেলেটির মুঠোতে ধরা।

তার দস্তানার অভাব এভাবে পূরণ হলে মন্দ কী?

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব