নম্রতারা গাড়িতে ওঠামাত্র গাড়ি ছেড়ে দিল। হোটেলের উদ্দেশ্যে পাহাড়ের নীচে দিয়ে গাড়ি নামতে থাকল। ঘড়িতে আড়াইটে বেজে গেছে। রৌদ্রোজ্জ্বল নীলাকাশ কোথা থেকে হঠাৎ করে কালো মেঘে ছেয়ে গেল। নম্রতার মতোই মেঘেরও মুখ ভার। কখন যে মনের আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে বৃষ্টি নামবে স্বামী ধ্রুব বোধ হয় তার আঁচও পাবে না।
নম্রতা জানলার দিকে উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ধাক্কা লাগা ওই অচেনা ভদ্রলোকের কথা ভাবতে লাগল। নম্রতার মন কেন তোলপাড় হচ্ছে আজ। নম্রতা ভাবল যে কেনই বা ওই একঝলক ভদ্রলোকের চোখের চাহনি তার মনকে এত নাড়িয়ে দিয়ে গেল। অত্যধিক ঠান্ডায় ভদ্রলোকের মুখের অর্ধেক অংশ মাফলারে ঢাকা ছিল। সে তো তার সম্পূর্ণ মুখ দেখতে পায়নি। শুধু ভদ্রলোকের চোখ নয়, তার গলার স্বর, হাঁটাচলা সবটাই নম্রতার পূর্ব পরিচিত। এসব কেন মনে হচ্ছে!
আশার গলার আওয়াজে নম্রতার সম্বিত ফিরল। হোটেলের সামনে গাড়ি দাঁড়াতেই আশা চিত্কার করে বলল, মাম্মা, আমরা হোটেলে চলে এসেছি। গাড়ি থেকে নেমে হোটেলের ঘরে ঢোকামাত্র অঝোরে বৃষ্টি শুরু হল।
বাথরুম থেকে নম্রতা ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই ধ্রুব বলল, হোটেলের রুমেই খাবার দিয়ে যেতে বললাম। ওয়েট করো একটু। ধ্রুব আশাকে নিয়ে বাথরুম গেল হাত মুখ ধুতে। মিনিট পনেরোর মধ্যে একটি অল্পবয়সি মেয়ে ঘরে খাবার দিয়ে গেল। খাবার খেয়ে ধ্রুব আশাকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে নিজেও ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল।
বালিশে মাথা দিয়ে নম্রতার চোখে ঘুম নেই। একটা অপরিচিত অথবা একটা অর্ধপরিচিত চোখ তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। নম্রতা আপন মনেই বলে উঠল, ইস, লোকটা তাড়াহুড়ো করে না চলে গেলে অন্ততপক্ষে নামটা জিজ্ঞাসা করা যেত। কিন্তু কেন ওই অপরিচিত লোকটার সবকিছু আমার এত চেনা লাগল! লোকটি কী সত্যিই আমার পূর্বপরিচিত! কে ওই ভদ্রলোক? লোকটার সঙ্গে আমার কি আর দেখা হবে? ধ্রুবর কথায় লোকটি টুরিস্ট যদি হয় তাহলে আবার দেখা হওয়ার সম্ভবনা আছে। দেখা হওয়ার সম্ভবনা থাকলেই বা কী লাভ! কিন্তু কী কারণে আমি লোকটিকে খুঁজছি!
ধ্রুব অর্ধ্বউন্মীলিত চোখে নম্রতার গায়ে হাত দিয়ে বলল, কী এত ভাবছ! একটু ঘুমোলে শরীরটা ফ্রেশ হতো।
নম্রতা হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, দুপুরে ঘুমোনো আমার কোনওদিনই অভ্যাসে নেই। তাছাড়া সন্ধে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ।
ধ্রুব চোখ রগড়াতে রগড়াতে বিছানা ছেড়ে উঠে দেখল পাহাড়ের গায়ে চাপ চাপ অন্ধকার নেমে এসেছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়া বইছে সোঁ সোঁ শব্দে। বৃষ্টির হওয়ার ফলে বাইরে বরফ পড়ার মতো আবহাওয়া। লাচেন নদীর গর্জন শোনা যাচ্ছে জানলার কাছে দাঁড়ালে। হোটেলের একটি ছেলে ধোঁয়া ওঠা দুকাপ কফি দিয়ে গেল। কফির কাপে চুমুক দিয়ে নম্রতা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ল। আশা বিছানায় অকাতরে ঘুমাচ্ছে।
ঘরের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে ধ্রুব নম্রতাকে বলল, তুমি আমাকে এড়িয়ে গিয়ে ভুল করছ। আমি কোনও দোষ না করেও শাস্তি পাচ্ছি। স্বাভাবিক সহজ একটা সম্পর্ককে অযথা অস্বাভাবিক জটিল করে তুলে আমরা দুজনেই ভালো থাকব না। আমিও এতে ভালো নেই। আর তুমিও ভালো থাকবে না।
নম্রতা ধ্রুবর কথার জোরপূর্বক প্রতিবাদ করে একটু উঁচু স্বরে বলল, কে বলল তোমাকে যে আমি ভালো নেই! আমি খুব ভালো আছি। ভালো না থাকার মতো তো কিছু ঘটেনি।
ধ্রুব শান্ত স্বরে বলল, জোর গলায় ভালো আছি বললেই কি ভালো থাকাটা প্রমাণিত হয়! ধ্রুবর এই কথার কোনও প্রত্যুত্তর নম্রতা দিল না। কফি শেষ করে শূন্য কফি মগটা টেবিলে নামিয়ে আশার কাছে চলে এল। আশা ঘুম থেকে উঠে পড়ে যেন নম্রতাকে স্বস্তি দিল।
দুটো দিন লাচেনে কাটানোর পর নম্রতা-রা গ্যাংটকে ফিরে এল। গ্যাংটকের হোটেলে ওরা যখন পৌঁছোল তখন ঘড়ির কাঁটায় বিকাল চারটে। ধ্রুব আর আশা গাড়ি থেকে নেমে হোটেলের রুমে চলে গেল। নম্রতা বাইরে হোটেলের লনে পায়চারি করতে করতে মেঘলা বিকেল উপভোগ করতে লাগল।
বড়ো লন জুড়ে দেশি-বিদেশি ফুলের মেলা। অদূরে পাহাড়ের চূড়ায় সূর্য মুখ লুকাচ্ছে। সকাল থেকেই ঠান্ডা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। মাথার উপর দিয়ে তুলোর মতো মেঘগুলো বিক্ষিপ্ত ভাবে চলে যাচ্ছে। ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া এসে নম্রতার চোখে মুখে চুম্বন করে যাচ্ছে। সে গায়ে উপর শালটা ভালো করে জড়িয়ে হালকা শ্বাস ছেড়ে কাঠের বেঞ্চে বসল। নম্রতার এক হাত দূরত্বে একটা লোক দাঁড়িয়ে ঘনঘন সিগারেট খাচ্ছিল। সিগারেটের গন্ধ নম্রতার কোনওদিনই সহ্য হয় না। ওই গন্ধে নম্রতার অস্বস্তি হতেই নম্রতা বেঞ্চ ছেড়ে উঠে লোকটির কাছে দাঁড়িয়ে বলল, এক্সকিউজ মি। শুনুন, আপনি স্মোক করলে দূরে গিয়ে করুন। সিগারেটের পোড়া গন্ধে আমার অসুবিধা হয়।
লোকটি মুখ থেকে মাফলার নামিয়ে বলল, আপনার যদি অসুবিধা হয় আপনি সরে বসুন। পাশে আরও বেঞ্চ রয়েছে। লোকটির গলার ভারী কণ্ঠস্বর চিনতে ভুল হল না নম্রতার। লোকটির মুখের দিকে তাকাতেই নম্রতার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। নম্রতার গোলাপি দুটো ঠোঁট ঈষৎ কেঁপে উঠল। কম্পিত গলায় সে বলল, স্বর্ণাভ। তুমি বেঁচে আছো!
বয়সের সঙ্গে স্বর্ণাভর কিছু পরিবর্তন বাহ্যিক রূপের হয়েছে। লম্বা চওড়া সুদর্শন পুরুষ স্বর্ণাভ। টিকালো নাক। বুদ্ধিদীপ্ত মুখ। ফরসা গায়ে রং বয়স বাড়ার সঙ্গে যেন আরও ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়েছে। মাথাভর্তি কালো ঢেউখেলানো চুলে অল্পবিস্তর পাক ধরেছে। শরীর স্বাস্থ্য আগের চেয়ে অনেক ভালো। ভোরের নরম আলোর মতো দুচোখে সেই পূর্বের মতোই মোহময় দৃষ্টি। বয়স প্রায় আটান্নর ঘর ছুঁয়েছে।
নম্রতারও অবশ্য বাহ্যিক পরিবর্তন হয়েছে। বয়স তেতাল্লিশের ঘরে পা দিয়েছে। আগের মতো গোলগাল চেহারা নম্রতার নেই। শরীর অনেক ভেঙে গেছে। ধবধবে ফরসা রং অনেকখানি ম্লান হয়েছে। মুখের মধ্যে হালকা বয়সের ছাপ পড়েছে। মুখে সারল্যের চিহ্নমাত্র নেই। বয়স বাড়ার ফলে মুখ অনেকখানি দৃঢ় এবং আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ। ঈষৎ বাদামি চোখের তারা ধূসর বর্ণ নিয়েছে। চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। কালো মেঘের মতো একঢাল ঘন কালো চুল উঠে তার ঘনত্ব কমিয়েছে।
স্বর্ণাভ নম্রতার কথার উওর খুঁজে না পেয়ে স্মিত হাসল শুধু। স্বর্ণাভর থেকে কোনও প্রত্যুত্তর না পেয়ে নম্রতা উঁচু গলায় বলল, তুমি হাসছ? জানো, তোমার অপেক্ষায় আমি আজও কাউকে নিজের ভাবতে পারি না। তোমার জন্য আমি সংসার করেও সংসারী হতে পারিনি। তুমি এই পৃথিবীতে থাকা সত্ত্বেও একবার আমার সঙ্গে এতগুলো বছর দেখা করলে না! কেন? কী অপরাধ করেছি আমি? এভাবে তুমি কেন মুখ লুকিয়ে থেকে গেলে!
স্বর্ণাভ হাসতে হাসতে বলল, তোমার স্বামী আছে। তোমার তো একটা মেয়ে আছে শুনেছি। অথচ তুমি কিনা সংসারী হতে পারোনি! এই কথাগুলো ফিল্মের ডায়লগের মতো। এই পৃথিবীতে কেউ কারও জন্য অপেক্ষা করে না। আমিও করিনি। সময় নিজের নিয়মে নিজের মতো বয়ে যায়। তুমিই তো নিজে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।