মূল্যবোধের সঠিক শিক্ষা নিয়ে বড়ো হোক সন্তান

সঠিক উপলব্ধি এবং মূল্যবোধ-ই সন্তানকে জীবনে এগিয়ে যেতে প্রেরণা জোগায়। অথচ, আমাদের সমাজে মূল্যবোধ কমে যাচ্ছে। তবে, প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে সন্তানকে সব দিক দিয়ে সফল করতে মা- বাবা চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেন না। একদিকে উপলব্ধি কিংবা বোঝার চেষ্টা আর অন্যদিকে জীবনের সঠিক মূল্যবোধগুলির সঠিক নির্মাণ করতে করতেই বাচ্চাদের জীবন চলতে থাকে। আসলে, মূল্যবোধের লিস্ট বিশাল লম্বা কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কতটা কাকে গুরুত্ব দিতে হবে এটা নিয়ে বাচ্চারা কনফিউজড হয়ে পড়ে। কিছু কিছু মূল্যবোধ যেমন শালীনতা, নম্রতা, ত্যাগ, সহানুভূতি, দায়িত্ব,কর্তব্যপরায়ণতা, সততা ইত্যাদির সঠিক অর্থ অনেক মা-বাবাও জানেন না হয়তো।

সাইকোলজিস্টদের মতে, তোতা পাখিকে বুলি শেখানোর মতো বাচ্চাদের জীবনের মূল্যবোধ শেখানো যায় না। যদি মা-বাবা নিজেরা সৎ এবং ধৈর্য রেখে বাচ্চাদের ভালো কিছু শেখান, তবেই তারা জীবনে সফল হবে। আর তা যদি না হয়, অর্থাৎ মুখস্থবিদ্যার মতো করে যদি বাচ্চারা মূল্যবোধের শিক্ষা নেয়, তাহলে হয়তো এমন পরিস্থিতিতে বাচ্চাটিকে পড়তে হতে পারে, যেখানে তার শিখে আসা মূল্যবোধকে টিকিয়ে রাখা তার কাছে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। ইভা বাড়িতে মা-বাবার কাছে সবসময় বড়োদের সম্মান করার কথা শুনেছে এবং সেই মতো চলারও চেষ্টা করে। স্কুলে শিক্ষিকাদেরও যথেষ্ট সম্মান করে কিন্তু সামান্য একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে ওদের ইতিহাসের শিক্ষিকা ইভা-র উপর ক্ষুব্ধ হন। ইভা ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার পরেও, পরীক্ষার খাতায় ইভা-র প্রতি বিদ্বেষ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খাতা নিয়ে সরাসরি ইভা ওই শিক্ষিকার সঙ্গে কথা বলে এবং শিক্ষিকা মানতে না চাইলেও, মা-বাবার বারণ অগ্রাহ্য করে ইভা স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার কাছে নালিশ জানায়। এখানে ইভা-র মূল উদ্দেশ্য কিন্তু শিক্ষিকাকে অসম্মান করা ছিল না। তার বিদ্রোহ ছিল নিজের উপর হওয়া অবিচারের বিরুদ্ধে।

প্রভাব পড়ে ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপরেও

শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুরা একতাল ভিজে মাটির মতো। যেমন শেপ দিতে চাইবেন, সেই ছাঁচে ঢেলে নিতে হবে। এই দায়িত্বটা কিন্তু মা-বাবার। তাদের সন্তানকে কীভাবে তারা গড়ে তুলবেন, তা তাদের একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। জীবনের মূল্যবোধগুলো বাচ্চারা শেখে বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে। এখনকার জেনারেশন নতুন টেকনিক্যাল গ্যাজেটস-এর উপর নির্ভরশীল। ছোটো বয়সেই শিশুদের হাতে মা-বাবারা স্মার্টফোন, আইপ্যাড, আইফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদি তুলে দিচ্ছেন এই ভেবে যে, তাদের বাচ্চা স্মার্ট কিড তৈরি হবে। অথচ মা-বাবা সন্তানকে যা যা শেখাবার বা বলার চেষ্টা করেন, তার পঞ্চাশ শতাংশই বাচ্চারা কানে তোলে না। এইভাবেই স্কুল থেকে কলেজে এবং কলেজ থেকে চাকরির জায়গাতেও এই বাচ্চারাই অন্যের কথা শুনতে চায় না, এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বড়ো হয়েও। এই ধরনের মানসিকতা শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপরেও প্রভাব ফেলে।

এখন অভিভাবককেরা বেশিরভাগই ওয়ার্কিং। সুতরাং স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং-ও আগের তুলনায় অনেক উঁচু। বাচ্চা কিছু চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবার কাছ থেকে সেটা সে পেয়ে যায়। চাইল্ড সাইকোলজিস্টদের মতে, স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং না বাড়িয়ে বরং অভিভাবরকদের উচিত স্ট্যান্ডার্ড অফ গিভিং বাড়ানো। অবসর পেলেই বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটানো উচিত, ওদের প্রয়োজনে সবসময় ওরা যেন মা-বাবাকে পাশে পায়। অন্যের মুখ থেকে না শুনে নিজের বাচ্চার থেকে শুনে তবেই কোনও মতামত দেওয়া উচিত বড়োদের।

আজকাল কোনও অনুষ্ঠান অথবা পার্টিতে বাচ্চারা জমায়েত হলে সেখান থেকে বাড়ি ফিরে মা-বাবার সঙ্গে আনন্দ শেয়ার না করে, নিজেদের মোবাইল ফোন নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে ভালো গল্প বলার ক্ষমতাও নতুন প্রজন্মের মধ্যে অনেকই কম। বাচ্চাদের কথার মধ্যে অ্যাগ্রেসিভ ভাব এখন অনেক বেশি। এই প্রজন্মের অ্যাগ্রেসিভনেস টোন করা খুব জরুরি। বাচ্চাকে কোনও কিছু করতে বারণ করা হলে তার কারণটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলাও খুব প্রয়োজন। বাচ্চাকে শিষ্টাচার শেখাতে চাইলে মা-বাবারও জীবনের মূল্যবোধ সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত।

আত্মবিশ্বাসও প্রভাবিত হয়

এখন বেশিরভাগই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, যেখানে বাচ্চারা শুধুমাত্র মা-বাবার সঙ্গেই মেলামেশা করার সুযোগ পায়। এক্সটেনডেড ফ্যামিলি বলতে আর কিছু থাকে না। দাদু, ঠাকুমা, অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বছরে হয়তো দেখাই হয় শুধু কয়েকবারের জন্য। জীবনের মূল্যবোধ শেখা শুরু হয় ডাইনিং টেবিলে বসে। কলেজ ক্যান্টিনে বন্ধুদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে খাবার খাওয়াটা ‘টিমওয়ার্ক’ হয়ে ওঠে। এইসবের প্রভাব পড়ে বাচ্চার আত্মবিশ্বাস গঠনের উপরেও।

অভিভাবকেরা এর জন্য কতটা দায়ী

অভিভাবকরা বাড়িতে থেকেও, ‘বাবা-মা বাড়িতে নেই’ বলে বাচ্চাকে দিয়ে বাইরের লোকেদের বার্তা পাঠান। এই ধরনের ব্যবহার বাচ্চাদের আরও কনফিউজ করে দেয়।

মনোবৈজ্ঞানিক এবং পেরেন্টিং এক্সপার্টদের মতে, শিশু ছোটো থেকেই পরিবারের মধ্যে থেকে মূল্যবোধগুলো সম্পর্কে শেখে। তাই মা-বাবার উচিত নিম্নোক্ত কিছু জিনিস খেয়াল রাখা।

  • বাচ্চাকে সারাদিনে কম করে এক ঘণ্টা সময় দিন, যে-সময়টাতে আপনি শুধু বাচ্চার কথাই শুনবেন
  • বাচ্চাকে যেটা বলবেন করতে, সেটা নিজেও পালন করার চেষ্টা করবেন
  • বাচ্চার মধ্যে সহানুভূতির উদ্রেক করার চেষ্টা করুন। মুখে বলার থেকে কাজের মধ্যে দিয়ে শিশুর মনের গভীরে প্রবেশ করবার চেষ্টা করুন
  • নিজের মূল্যবোধগুলি সম্পর্কে বাচ্চাকে বলুন এবং সেগুলো কেন জরুরি সেটাও ওকে বুঝিয়ে দিন
  • জীবনে মূল্যবোধ থাকাটা কেন দরকার সেটা বিশ্লেষণ করাটা খুব প্রয়োজন
  • বাচ্চার সঙ্গে কথা বলুন, উপদেশ নয়। ভালো কিছু করলে তাকে বাহবা দিন
  • খাতা কলমে জীবনের মূল্যবোধকে আটকে রাখবেন না, বাচ্চা সেটা মানছে কিনা খেয়াল রাখুন। বাচ্চা সেটা না মানলে, কারণ অনুসন্ধান করুন। সমাধানের রাস্তা খুঁজুন এবং বাচ্চাকে বলুন
  • জীবনের মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গে টাকার গুরুত্বও তাকে বোঝান।

দাম্পত্য-সুখের কৌশল রপ্ত করুন

সম্প্রতি এক বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলার শুনানিতে রায় দেওয়া হয়েছে যে, যদি কোনও স্ত্রী তার স্বামীকে ইচ্ছাকৃত ভাবে যৌনসুখ দিতে অস্বীকার করেন, তাহলে ১৯৫৫ সালের হিন্দু বিবাহ আইন মোতাবেক, দোষী সাব্যস্ত হবেন ওই স্ত্রী। আদালত এও স্মরণ করিয়ে দেয় যে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক টিকে থাকার অন্যতম উপায়ের মধ্যে আছে শারীরিক সুখভোগ। আসলে এই রায় সত্যিই অভিনব, কারণ বাস্তবে স্ত্রী যদি যৌনসুখ না পান স্বামীর দ্বারা, তাহলে তিনি অভিযোগের আঙুল তোলেন স্বামীর দিকে। কিন্তু এক্ষেত্রে অসুখী স্বামীর পক্ষে প্রথম রায় দিয়েছে আদালত।

এখন প্রশ্ন, নারী-পুরুষ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় কি শুধু শারীরিক সুখলাভ আর বাচ্চার জন্ম দেওয়ার জন্য? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো ‘না’ হবে। কারণ, দাম্পত্য সম্পর্কের আরও অনেকগুলি স্তর আছে। ধর্মমত যাইহোক না কেন, বিবাহ মানে নারী শুধু বাচ্চার জন্ম দেবে আর স্বামীকে যৌনসুখ দিয়ে খুশি রাখবে, আজকের নারী সমাজ আর তা মেনে নিতে নারাজ। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে যৌনসুখ দেবেন এবং সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাবেন, এই দুটি বিষয় অবশ্যই বিয়ের অলিখিত চুক্তি কিংবা প্রতিশ্রুতি। তবে এটাই যে বিবাহের একমাত্র উদ্দেশ্য, তা কিন্তু নয় নিশ্চয়ই।

বিবাহের পর আইনি বন্ধন এক বিষয় আর দাম্পত্যে ভালোবাসা, সম্মান প্রদর্শন কিংবা সংবেদনশীলতা অন্য এক বিষয়। আসলে আইনের বাইরে আছে অন্য এক মানবিক দিক। তাই দাম্পত্যে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন, এটাই কাম্য। কিন্তু তার পরিবর্তে যদি কেউ একজন অতিরিক্ত অধিকার ফলান, অসম্মান কিংবা ইমোশনাল অত্যাচার করেন, তাহলে তা আদালতের বিচারে যে রায়-ই ঘোষিত হোক-না কেন, স্বামী-স্ত্রী উভয়েই এক্ষেত্রে ক্ষতির শিকার হবেন, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

দাম্পত্যে যৌনসুখ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তা একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না। সুখ-দুঃখে পরস্পরের সঙ্গে থাকা এবং শারীরিক- মানসিক অসুবিধা কিংবা যন্ত্রণায় সহানুভূতিশীল হওয়া অবশ্যই কর্তব্য। সঙ্গীর মৃত্যুর পর তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি যেমন আইন মাফিক ভোগ করার অধিকার পেয়ে যান জীবিত ব্যক্তিটি, ঠিক তেমনই, এই বিষয়টিকে মাথায় রেখে সঙ্গীর জীবদ্দশায় তার প্রতি যতটা সম্ভব মানবিক হওয়া উচিত।

বুদ্ধিধারীরা জানেন যে, দাম্পত্য সম্পর্কের ভালোমন্দের বিষয়টি একটি সরু সুতোর উপর দাঁড়িয়ে থাকে। তাই সর্বদা সতর্ক থাকতে হয় যে, সুতোর উপর দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ভারসাম্য রেখে এমন ভাবে চলতে হবে, যাতে পড়ে না যান কিংবা সুতোটা ছিঁড়ে না যায়।

আরও যে বিষয়টি দাম্পত্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে, তা হল – স্পেস। পরস্পরকে বিশ্বাস রেখে স্পেস দিতে হবে। কারণ, বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হলেও, প্রত্যেক মানুষের একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে। আর তাই প্রত্যেককে সেই ব্যক্তিগত জীবন- যাপনের জন্য সুযোগ দিতে হবে। এটা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। তবে স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়, এটাও মাথায় রাখতে হবে স্বামী- স্ত্রী দুজনকেই।

আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী নিজেদের বাইরে আর যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন না নীতিগত ভাবে। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে পরিবার কিংবা সমাজ বহুগামিতার অনুমতি দেয় না সাধারণত। আর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কেউ একজন যদি পরকীয়াতে জড়িয়ে পড়েন কিংবা চিট করেন পার্টনার-কে, তাহলে সেক্ষেত্রে বেশিরভাগই সম্পর্ক ভেঙে যায়। অবশ্য শুধু শারীরিক-ই নয়, মানসিক সম্পর্কও অনুমোদন পায় না স্বামী-স্ত্রীর বাইরে।

এই ব্যাপারে আমাদের ভারতীয় নাগরিকদের মানসিকতা এখনও সেই প্রাচীন যুগেই বিরাজমান। তাই, বিবাহিত সম্পর্ককে টিকিয়ে রেখে, এক্সট্রা অ্যাফেয়ার্স সম্ভব হয় না বেশিরভাগ দাম্পত্যে। এর ফলে, কেউ স্বাধীন ভাবে শারীরিক সুখভোগ করতে চাইলে, বিবাহবিচ্ছেদ করে যৌন স্বাধীনতা উপভোগ করেন। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে।

এখন যেহেতু বেশিরভাগ মেয়েরা আর্থিক ভাবে সাবলম্বী এবং আধুনিক মনস্ক, তাই তারা স্বামীর বাধ্য না হয়ে, ভয়হীন কিংবা দ্বিধাহীন ভাবে গোপনে অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে শারীরিক কিংবা মানসিক সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেন। আর এক্ষেত্রে পুরুষদের কথা নতুন করে কিছু বলার নেই। কারণ, অনেক পুরুষ দাম্পত্য সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেও অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন।

আসলে, সম্পর্কের বিষয়টিতে পুরুষরা ভারসাম্য বজায় রাখতে অনেক বেশি পারদর্শী কিন্তু এক্সট্রা রিলেশন-এর ক্ষেত্রে শুরুর দিকে মেয়েরা গোপনীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করলেও, কিছুদিন পরে আবেগে অতিরিক্ত সাহসী হয়ে ওঠেন এবং স্বামী কিংবা সমাজের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেন না কিংবা তোয়াক্কা করেন না।

অতএব ধরা পড়ার পর মেয়েরা স্বামীর সঙ্গে আর বিবাহিত সম্পর্কে থাকতে পারেন না এবং যার পরিণতি বিবাহ-বিচ্ছেদ কিংবা মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ায়। শুধু তাই নয়, এই এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার্স-এর জন্য অনেক সময় আত্মহত্যা কিংবা খুনের ঘটনাও ঘটে যায়।

আসলে, বিবাহিত জীবনে স্বামী-স্ত্রী ‘মেড ফর ইচ আদার’ হয়ে উঠতে না পারলেই অশান্তি চূড়ান্ত রূপ নিতে পারে। যৌনসুখ না পেলেই যে শুধু বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে কিংবা দাম্পত্য অশান্তি তৈরি হয় এমনটা নয়। নানারকম কারণে ঘটতে পারে বিবাহ-বিচ্ছেদ। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কেউ একজন কিংবা দুজনেই বদমেজাজি হলে, কেউ একজন অসুস্থ থাকলে, আর্থিক অভাব-অনটন থাকলে, বিচক্ষণ না হলে, মতের মিল না থাকলে, একজন অন্যজনের কেয়ার না নিলে কিংবা দুজনে সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের হলেও সংসার ভাঙতে পারে। তাই, যৌনসুখের অভাব বিবাহ-বিচ্ছেদের একমাত্র কারণ হতে পারে না।

কথায় আছে, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’। তাই, বিয়ের আগে পরস্পরকে ভালো ভাবে জেনেবুঝে তারপর যদি মনে হয় লাইফ পার্টনার হওয়ার উপযুক্ত, তবেই বিয়ে করুন। আর সবকিছু দেখেশুনে বিয়ে করার পরও যদি কোনও সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে রাগ না দেখিয়ে, মন খারাপ না করে, ধৈর্য নিয়ে সমস্যার উৎস খুঁজুন এবং সমাধানের পথ বের করুন।

মনে রাখবেন, সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে। কারণ, যে সমস্যার সমাধান নেই, সেটা কোনও সমস্যাই নয়। আর এক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, কারওর যদি লাইফ পার্টনার-কে পছন্দ না হয়, তাহলে সন্তানের জন্মের আগেই বিবাহ-বিচ্ছেদ করে নেওয়া ভালো। নয়তো, স্বামী-স্ত্রীর বোকামোর কারণে, সন্তানকে অকারণে শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে আজীবন।

কেমন হওয়া উচিত মা-মেয়ের সম্পর্ক?

বাড়ির আর সকলের থেকে শিশুকন্যাটির সব থেকে কাছের মানুষ হয়ে ওঠে তার ‘মা’। প্রতিদিন একটু একটু করে বড়ো হয়ে ওঠার সমস্তটাই কিন্তু তার মা-কে ঘিরে। এইভাবেই সে ধীরে ধীরে মায়ের উপর হয়ে ওঠে নির্ভরশীল। বিশ্বাস করতে শেখে মা-কে। কারণ, তার কাছে মা-ই হচ্ছে একমাত্র ভরসার জায়গা। মায়ের কাছেই শিক্ষার নতুন পাঠে তার প্রবেশ। আর তাই মা আর মেয়ে- যুগ যুগ ধরে চলে আসা এ এক আশ্চর্য সম্পর্ক।

মেয়ে পা-রাখে শৈশবে। স্কুল জীবনের প্রারম্ভ। মায়ের নিশ্চিত আশ্রয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাইরের জগতে প্রথম পদক্ষেপ। প্রথম প্রথম আগের থেকে বেশি করে আঁকড়ে ধরে মা-কে। তারপর মুঠি আলগা হতে শুরু করে। বন্ধুবান্ধব এবং আরও অনেক সম্পর্কের ভিড়ে মা ও মেয়ের সম্পর্ক নেয় নতুন এক মোড়।

মায়ের স্নেহ মিশ্রিত শাসন শুরু হয়। এর সঙ্গে মায়ের কাছ থেকে মেয়ে জীবনের শিক্ষারও প্রথম পাঠ নিতে শুরু করে। জীবনের পাঠক্রমে শাসন এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। শিশু যা এতদিন নিজের ইচ্ছেমতোন করে এসেছে, হঠাৎ করে সেখানে বাধা পেতে শুরু করে। ‘এটা কোরো না’,  ‘ওটা করে আসা তোমার উচিত হয়নি’, ‘আমাকে জিজ্ঞাসা না করে এটা করবে না’ কিংবা ‘ওখানে যাবে না’— এরকম মায়ের নানা ‘মানা’-র সম্মুখীন হতে হয় মেয়েটিকে।

একদিকে যেমন নিজস্বতা তৈরি হতে থাকে, তেমনই নানা খুনসুটির মধ্যে দিয়ে ভালোবাসার সম্পর্ক শিকড়বাকড় ছড়িয়ে মা ও মেয়ের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে তোলে। মায়ের সাজগোজের জিনিস কন্যাসন্তানকে শিশু বয়সে সবথেকে বেশি আকর্ষণ করে। মায়ের লিপস্টিক, শাড়ি, গয়না এমনকী মায়ের চটিতে পা গলিয়েই কেটে যায় তার শৈশব। মা বাড়িতে হয়ে ওঠে মেয়ের খেলার সাথী।

অনেক সময় মায়ের প্রতি সামান্য ঈর্ষাও হয়তো মেশে ছোট্ট মেয়েটির মনে। মা কেন এত সাজগোজ করবে, তার কেন এই প্রসাধনের জিনিসগুলো নেই, শুধুমাত্র মা-এর ব্যবহারের জন্যই কেন এগুলি কেনা হয়— এরকম বহু অযথা প্রশ্ন এবং অনুযোগ শিশুমনে উদয় হয়। এর জন্য অনেক সময়ে ছোট্ট মেয়েটি মায়ের প্রতি কিছুটা বিদ্রোহীও হয়ে ওঠে।

এ সমস্ত আচরণগুলি-ই কিন্তু কন্যা সন্তানের বাইরের মনোভাব মাত্র। এর মধ্যে দিয়েই মা ও মেয়ের বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, স্নেহ বাড়তে থাকে। মায়ের জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে করতে কখন যেন সে কৈশোরের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছোয়। কিশোরী মেয়ের খেয়াল রাখা, তাকে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করা যেমন মায়ের অধিকারের মধ্যে পড়ে, তেমনই মেয়েটিও কেমন করে নিজের অজান্তেই মায়ের দিকে আসা প্রতিটি বিপদের সামনে নিজেকে ঢাল হিসাবে তৈরি করতে থাকে। বাড়িতে এবং বাড়ির বাইরে মায়ের প্রতি যে-কোনও ধরনের রূঢ় আচরণ মেয়েটির মনকে নাড়া দেয়। তার ক্ষমতায় অন্যায়ের প্রতিবাদও করে সে।

এরপর কৈশোরের হাত ধরে আসে যৌবন। মা ও মেয়ে উভয়েরই জীবনের কঠিনতম সময়। এই পর্যায়ে মেয়েরা হয় মুক্তপ্রাণ। সবকিছুই তার চোখে তখন সুন্দর, নতুন। সমাজের কুৎসিত রূপটাকেও আস্বাদ করার ব্যাকুলতা তার মধ্যে হয়ে ওঠে প্রবল। মেয়ের প্রতি মায়ের সজাগ দৃষ্টি আরও প্রসারিত হয়। প্রতিমুহূর্তে পদস্খলনের ভয়। মায়ের মন মেয়ের জন্য সবসময় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে। ফলে শাসনের মাত্রা বাড়তে থাকে। মেয়ের মনে মা-ই হয়ে ওঠে তার জীবনের পরম শত্রু।

এতদিন যে-মেয়ের জীবন ছিল মায়ের কাছে খোলা পাতা, হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ার বেগ সেটাই এলোমেলো করে দেওয়ার উপক্রম করে। এই সময়ে মা ছাড়া আর সকলকে মনে হয় বন্ধু। জীবনের অনেক নতুন অনুভূতি মেয়েরা এইসময়ে মায়ের কাছে গোপন রাখতে চেষ্টা করে। মায়ের মনেও যে অভিমান জন্মায় না এমন নয়, কিন্তু মায়ের মন বুঝতে পারে তার সেই ছোট্ট মেয়েটি, যে ‘মাতৃকবচ’-এর সুরক্ষার বেড়ায় ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে।

শুধুমাত্র মাতৃস্নেহে বেঁধে রাখার সময় সে পেরিয়ে এসেছে। যুবতি মনে অন্য সম্পর্কে পা রাখার আকাঙ্ক্ষা তার মনে তৈরি হয়েছে। অভিমান ঝেড়ে ফেলে মা নেমে পড়ে জীবনযুদ্ধে। মনে তখন মায়ের নতুন উদ্যোগ। এতে মায়ের প্রতি মেয়ের রাগ কমে না, বাড়েই। মায়ের দায়িত্ব থেকে মাকে টলাতে না পেরে, মেয়েরাও মায়ের প্রতি কিছুটা ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে। কোথা থেকে মা পায় এত শক্তি— এই প্রশ্ন ওঠে প্রতিটি যুবতির মনে।

মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। মায়ের প্রতীক্ষা শেষ হয়। মায়ের মন শূন্য করে মেয়ে চলে যায় অন্য সংসারে। মায়ের কাছে মেয়ের চলে যাওয়াটা শরীরের একটা অংশ কেটে বাদ দিয়ে ফেলার মতোই বেদনাদায়ক। তবুও মায়ের মনে সান্ত্বনা যে, মেয়ে নিজের সংসারে গেছে, যেখানে তার আদরের মেয়ে সমান আদর-যত্নে স্বামীর সংসারে রাজত্ব করবে। শত কষ্টেও মেয়ের সুখের কথা ভেবে মায়ের মুখে হাসি লেগে থাকে। দূর থেকেই মেয়েকে আশীর্বাদ করে, মেয়ের খোঁজখবর রাখে। বয়সের ভার যেন মায়ের অস্তিত্বকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে চায়।

নিজের সংসারে এসে, সংসারের দায়িত্ব নিতে নিতে মেয়ে উপলব্ধি করতে পারে, তার জীবনে মায়ের অবদান কতখানি। মায়ের মতো প্রিয় বান্ধবীর জায়গা কেউ যে নিতে পারবে না, সেটা বুঝতে তার কষ্ট হয় না। মায়ের স্নেহ, শাসন সবটাই সন্তানের কাছে কতটা প্রয়োজনীয়, এতটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর মেয়ে বুঝতে পারে। মায়ের সঙ্গে নাড়ির টানটা নতুন করে অনুভব করে। মায়ের সতর্কতা, শাসনের কড়া বুলিই যে তাকে চোরাগলির অন্ধকার থেকে বাঁচিয়ে এসেছে, সেটাতে কৃতজ্ঞ বোধ করে। মন চলে যায় মায়ের কাছে, ফিরে আসে ছোটোবেলার স্মৃতি।

মেয়ের হাত ধরে, জীবনের এতটা পথ পার করিয়ে দিয়েছে মা। ঝড়, জল মেয়েকে স্পর্শ করতে পারেনি। মেয়েকে রাস্তা দেখাবার প্রয়োজন আর নেই। সেই পাঠ তার শেষ হয়েছে। আজ মায়ের পাশে দাঁড়াবার প্রয়োজন মেয়ের।  তার এই সফরে মেয়েই একমাত্র বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়াতে পারে। কৈশোরে অজান্তে যে মেয়ে মায়ের ঢাল হয়ে সমাজে দাঁড়াতে চেয়েছিল, আজ সত্যি করেই সে মায়ের ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। নতুন বন্ধুত্ব, হৃদয়ের বন্ধন নতুন করে আবার স্থাপিত হয়। মায়ের ভালোমন্দের দায়িত্ব, দেখাশোনা করার দায়িত্ব, মেয়ে নিজেই তুলে নেয় নিজের হাতে। জীবনের প্রান্তবেলায় মা ও মেয়ের সম্পর্কের সমীকরণ কিছুটা বদলে যায়। শাসন এবং দায়িত্বের গাম্ভীর্যে মেয়েই হয়ে ওঠে ‘মা’।

বন্ধুত্বের জন্য শব্দের প্রয়োজন

‘এ দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে, তোড়েঙ্গে দম মাগর তেরা সাথ না ছোড়েঙ্গে, এ মেরি জিত তেরি জিত, তেরি হার মেরি হার, শুন লে মেরি ইয়ার, তেরা গম মেরা গম, মেরি জান তেরি জান, অ্যায়সা আপনা প্যার’ -এই গানের কথাগুলো আজও আমরা যখন শুনি, তখন মনে প্রশ্ন জাগে, আজকের এই প্রতিযোগিতার ইঁদুরদৌড়ের যুগে এমন বন্ধুত্ব কি সম্ভব? আজ যখন লোকেরা বড়ো বাড়ি, বড়ো ব্যাবসা, বড়ো অ্যাপার্টমেন্ট, বড়ো গাড়ি-র মালিক হওয়ার স্বপ্ন সফল করতে ব্যস্ত, তখন বন্ধুত্ব তৈরি হওয়ার-ই সুযোগ নেই, তো বিচ্ছেদের প্রশ্ন আসবে কোত্থেকে!

বর্তমানে মানুষে-মানুষে এই যে ভেদাভেদ কিংবা দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি কিন্তু কোনও অলৌকিক সুখ ভোগের পিছনে ছুটে চলার জন্য নয়, এর আসল কারণ লুকিয়ে আছে মুঠোফোনে, টিভি কিংবা কম্পিউটার-এর স্ক্রিন-এ। এখন বন্ধুত্ব আসলে ফেসবুকে কিংবা মোবাইল ক্যামেরা-র গ্যালারিতে জমা থাকে, হৃদয়ে নয়। তাই এই বন্ধুত্ব অস্তিত্বহীন।

৫ শতক আগে আমজনতার অক্ষরজ্ঞান ছিল না, তারা শুধু শুনতো রাজা কিংবা ধর্মের দোকানদারদের কথা। সুযোগ বুঝে বোকা মানুষগুলোর মগজধোলাই করতো ধান্দাবাজরা। কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও, সেই যুগের বোকা মানুষগুলোর মধ্যেও বন্ধুত্ব ছিল নির্ভেজাল।

ধর্মীয় ক্ষেত্রেও বোকা বানানোর রীতি প্রচলিত। সব ধর্মেই একই শব্দ ৪-৫ বার উচ্চারণ করতে বলা হয় ভক্তদের। কিন্তু যখন থেকে মুদ্রণ প্রযুক্তি চালু হল, তখন থেকে ছবিটা বদলাতে শুরু করল। একই কথা বারবার উচ্চারণ না করেও, মুদ্রিত শব্দ মস্তিষ্কে স্টোর করা সম্ভব হল। কিন্তু সুবিধাবাদীরা এখানেই থেমে থাকল না। তারা এরপরও সভামঞ্চে বক্তৃতা দিয়ে আবার বাড়তি মগজ ধোলাই করার পথে হাঁটল।

এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক নির্বাচনী প্রচারের দিকে। শাসক কিংবা বিরোধী, সমস্ত দলের নেতা-মন্ত্রীদের আশ্বাসবাণীতে ভরিয়ে তোলা হচ্ছে চারিদিক। সবাই এমন ভাবে নিজেদেরকে তুলে ধরছেন, যেন তারা জনগণের প্রকৃত বন্ধু! ভোটদাতাদের মন ভোলানোর জন্য এমন সব শব্দ প্রয়োগ করছেন, যেন তাদের সর্বস্ব নিবেদন করবেন জনগণের পদতলে। অথচ, নির্বাচন ফুরোলেই একেবারে উলটো ছবি দেখা যায়। এই রকম বিষাক্ত পরিবেশে বন্ধুত্ব কীভাবে বেঁচে থাকবে ভাবতে পারেন?

এখন তো সবই কপি পেস্ট চলছে কিংবা কপি ফরওয়ার্ড-এর শর্টকার্ট পথ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বন্ধুকে নিজের মন থেকে ৫০-টি শব্দ লিখে পাঠানোর সময় কোথায় এখন? হোয়াটস অ্যাপ কিংবা ফেসবুক-এ ‘গুড মর্নিং’ জানালেই বন্ধুত্ব বজায় থাকে না আসলে। মৃত ব্যক্তির ফেসবুক কিংবা হোয়াটস অ্যাপ থেকেও ‘গুড মর্নিং’ বার্তা পাওয়া গেছে অনেক সময়, কারণ মৃত ব্যক্তির ওই ফেসবুক কিংবা হোয়াটস অ্যাপ-এর মালিক এখন তারই পরিবারের কোনও সদস্য!

অতএব, বন্ধুর জন্য হৃদয়ের শব্দ প্রয়োজন। আর এই শব্দ এমন হবে, যা পরস্পরকে প্রেরণা জোগাবে, দুঃখ ভোলাবে, আনন্দে বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে। যেমনটা দেখানো হয়েছে ‘শোলে’ ছবিতে। এই ছবির দুই মুখ্য অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন এবং ধর্মেন্দ্র-র মধ্যে বন্ধুত্বকে এমন ভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যা বন্ধুত্বকে জাগ্রত করে। ‘সঙ্গম’ ছবিতে রাজ কপূর এবং রাজেন্দ্র কুমারের চরিত্রের মাধ্যমেও বন্ধুত্বকে খুব সুন্দর ভাবে দেখানো হয়েছে।

মায়েদের অবদান সীমাহীন

শিল্প-সংস্কৃতি এবং সভ্যতার অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য ভারত বিশেষ ভাবে পরিচিত সারা বিশ্বে। প্রত্যেক ভারতবাসী এর জন্য গর্ব অনুভব করেন। আর এই অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য বেশিরভাগ কৃতিত্বের দাবিদার ভারতীয় নারীরা। আর এই নারীদের মধ্যে অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছেন মায়েরা। কারণ, ‘মা’ এই শব্দটি শুনলেই ভালোবাসা, মমত্ব, করুণা, দয়া, ত্যাগ, সেবা প্রভৃতি ভাবমূর্তি ফুটে ওঠে চোখের সামনে। আসলে, মা মানেই নিরাপত্তা এবং ভালোবাসার আশ্রয়স্থল। এইসব গুণ মায়েরা পেয়েছেন প্রকৃতিগত ভাবেই।

বেশিরভাগ পরিবারে দেখা যায়, মা তার সমস্ত গুণ এবং শক্তি দিয়ে পরিবারকে সুখময় করতে চান। প্রাকৃতিক নিয়মেই মায়েরা সংসারের হাল ধরেন শক্ত হাতে। এর জন্য তারা অনেক সময় আত্মসুখ বিসর্জনও দিয়ে থাকেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এই যে, এত কিছু ত্যাগ স্বীকার করার পরও মায়েদের উপর অত্যাচার বন্ধ হয়নি আজও। আর এইসব অত্যাচারের প্রতিফলন ঘটছে, কুপ্রভাব পড়ছে তাদের দেহে-মনে। তাদের চিত্ত তাই দোলাচলে। কখনও তারা বিরক্ত, কখনও তৈরি হচ্ছে মানসিক অস্থিরতা এবং অস্তিত্বের সংকট। কিছু ক্ষেত্রে মায়েরা আজ দিশাহারা, তাই খুঁজছেন অস্তিত্বের অর্থ। কিন্তু কবে কাটবে এই অস্তিত্বের সংকট?

সন্তান প্রসঙ্গে

লিঙ্গ নির্ধারণ দণ্ডনীয় অপরাধ, তবু আজও কি তা বন্ধ হয়েছে পুরোপুরি? প্রশ্ন থেকে যায়। বিস্ময় জাগে মনে, আজও কেন বন্ধ হয়নি কন্যাভ্রূণ হত্যা! মায়েদের আত্ম-নির্ভরতা তো অনেক দূরের বিষয়, কন্যা সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানোরও সুযোগ পান না কেউ কেউ। অথচ পৃথিবীর কোনও মা-ই হয়তো চান না যে, তিনি শুধু পুত্র সন্তানের মা হবেন, কন্যা সন্তান পছন্দ করবেন না।

মানসিকতার তফাৎ

স্ত্রী-র সফলতা যে ফিল্ড-এই হোক-না কেন, অনেক স্বামীর তাতে গাত্রদাহ হয়, ইগো প্রবলেম হয়। স্ত্রী যদি উপার্জনও করেন, মা হয়ে ঘরে বাইরে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন— তাহলেও তাকে স্বামীর হাতে মার খেতে হয় অনেকসময়।

অনেক স্বামী আছেন যারা এমনও ভাবেন যে, বাড়ি ছেড়ে আর যাবে কোথায়, দাসীর মতো-ই থাকতে হবে তার কাছে। আর যারা স্ত্রী-কে চাকরি কিংবা ব্যাবসা করার অনুমতিও দেন, তারা স্ত্রী-র উপার্জিত টাকা আত্মসাৎ করেন।

অবশ্য এটা ঠিক যে, ধনী পরিবারের অনেক মায়েরা হয়তো প্রচুর টাকা খরচ করেন নানা ভাবে। তারা হয়তো দামি শাড়ি, গয়না কেনেন, বিউটি পার্লারে যান কিংবা কিটি পার্টিতে টাকা খরচ করেন। এসব আসলে স্ত্রী-র মন ভালো রাখার জন্য স্বামীরা করতে দেন কিন্তু স্ত্রী-কে তার আনুগত্যে রাখার এও এক কৌশল। এরপর স্ত্রী হয়ে যান স্বামীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি। যেভাবে ইচ্ছে তিনি সেই সম্পত্তি ব্যবহার করার অধিকার কায়েম করেন।

কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার, অকারণে স্ত্রীর চরিত্র কলুষিত করার কোনও অধিকার স্বামীর নেই। এটাও মনে রাখতে হবে যে, অন্যায় করার পর আদালতের নির্দেশে স্ত্রী এবং সন্তানের জন্য ১০ হাজার টাকা খোরপোশ দিলেই স্বামী মহান ব্যক্তি হয়ে যান না।

বিষয়টা হল এই যে, যাদের স্বার্থে ঘা পড়ছে, তারাই স্ত্রীর উপর জুলুমবাজি করছেন। আর অন্যদিকে সাধারণ এক শ্রেণির মহিলা আছেন যারা পৃথিবীর যে-প্রান্তেই থাকুন না কেন, অত্যন্ত ধর্মভীরু প্রকৃতির। সংসারের শৃঙ্খলে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে এমনই বেঁধে ফেলেন যে, যেখান থেকে তাদের মানসিক উত্তরণ আর ঘটে না।

এই মানসিকতার ধর্মভীরু দুর্বল মায়েদের দৃষ্টিভঙ্গি তাদের প্রায় ১২০০ বছর পিছিয়ে দিয়েছে। হয়তো আধুনিক প্রযুক্তি সামান্য পরিমাণে তাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িয়েছে কিন্তু মানসিক ভাবে অনগ্রসরই রয়ে গেছেন তারা।

আসল কথা

আসলে আইনের সীমাবদ্ধতা নয়, এই সীমাবদ্ধতা আমাদের সমাজের মানসিকতার এবং পরিকাঠামোগত দুর্নীতির। একবার অপরাধী পার পেয়ে গেলে, তা অন্যদের আরও সাহসী করে তোলে। ক্ষমতা ও অর্থ সব অপরাধকে লঘু করে দেয়। কখনও ধর্মের জোরে, কখনও অর্থের জোরে পুরুষশাসিত সমাজ মায়েদের আরও বেশি করে যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দেয়। দোষ দেবেন কাকে? কে আসল অপরাধী?

আধুনিকতা আজ পুরোনো চিত্রটা বদলে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু গ্রামের চেহারার পরিবর্তন শহরের তুলনায় কম। এখনও সেখানে পুরুষের সমান অধিকার মেয়েদের দেওয়া হয় না। পরিবারে মায়েরা স্বাধীনতা দাবি করতে গেলেই লাগে দ্বন্দ্ব। ভারতবর্ষের সমাজব্যবস্থা আজও মায়েদের সঠিক মান স্থাপন করতে পেরেছে কিনা মাঝে মাঝে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থাকে। রাস্তায় যেতে আসতে অনেক সময়েই শুনতে হয়, ‘কীসের জন্য চাকরি করছ যখন তোমার স্বামী এত ভালো উপার্জন করছেন? সন্তানের যত্ন নাও ঠিক করে।” এইসব মানসিকতার লোকেদের এটাই হয়তো মনে হয়, ‘মা মানেই শুধু দাসীর মতো কর্তব্য পালন করে যাবে। আর যদি চাকরি করে, তাহলে সে তার সন্তানকে অবহেলা করছে নিজের স্বার্থে অর্থ উপার্জনের জন্য।’ অথচ আধুনিক মায়েরা চাকরি করব বলেই যে মনস্থির করেন, সেটা ঠিক নয় সবসময়। সংসারের আর্থিক চাহিদা মেটানোর জন্যই হয়তো পুরুষদের মতোই চাকরি করতে শুরু করেন তারা। এটাই স্বাভাবিক আজ তাদের কাছে।

বিবাহ পরম্পরায় মেয়েরা স্বামীর সম্পত্তি হিসাবে এক গৃহ থেকে অন্য গৃহে যান। কোনও কোনও জায়গায় তো বহুবিবাহ প্রথা এখনও চালু আছে। স্বামীর একাধিক স্ত্রী দ্বারা সন্তান উৎপাদনের অধিকার থাকলেও, কোনও স্ত্রী যদি পরপুরুষের সঙ্গে সম্পর্কের দরুন সন্তানসম্ভবা হয়, তাহলে সেই সন্তান অবৈধ হিসাবে গণ্য হয়। অর্থাৎ মেয়েদের মনেই বপন করা আছে এক প্রাগৈতিহাসিক ন্যায়-অন্যায়ের বোধ, যার দরুন বাস্তবটা তাদের চোখে পড়ে না।

পরিবর্তন

কিছুদিন আগে পর্যন্ত মায়েদের হাতের কলম কেড়ে নিয়ে ঘরকন্নার কাজে তাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। শিক্ষার আলোর বদলে টেনে নামানো হতো সংসার নামক অন্ধকারের জাঁতাকলে। সেটাই তাদের জীবন, বারবার মনে করানো হতো। তবে আশীর্বাদ এটাই যে, কিছু মানুষ বদলাচ্ছে, সচেতনতা বাড়ছে। কন্যাসন্তানের প্রতি মা-বাবা, সমাজের ধারণায়ও কিছু পরিবর্তন এসেছে।

অনেক সময় দেখা যায় স্বামী কর্মসূত্রে অন্যত্র থাকে। সেই পরিস্থিতিতে স্ত্রী-কেই বাড়ির পুরো দায়িত্ব পালন করতে হয়। বাড়ির বাইরের কাজ যেমন, বাচ্চাদের পড়াশোনা, স্কুলের নানা ঝামেলা, বিভিন্ন বিলের পেমেন্ট, দোকানবাজার— এসব কিছুও স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্ত্রীকেই করতে হয়। এছাড়াও তার নিজস্ব সোশ্যাল লাইফ, বন্ধুবান্ধব, নানারকম পলিটিক্যাল কাজে যোগদান করা ইত্যাদিও তার জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবেই জড়িয়ে থাকে।

সবসময় চাকরি করতে বাড়ির বাইরেই যেতে হবে এমন কনসেপ্ট-এ বিশ্বাস করেন না আধুনিক গৃহবধূরা। নিজেদের সোশ্যাল লাইফ, স্ট্যাটাস, মডেল রোল বজায় রাখার জন্য বাড়িতে বসেই অর্থ উপার্জনের বিভিন্ন পন্থা বেছে নেন। অনেকে সফট টয়, চিত্রকলা, ফুলের বোকে বানিয়ে প্রদর্শন করেন এবং বিক্রিও করেন। আবার ছাত্র-ছাত্রী জোগাড় করে বাড়িতে ব্যাচ বানিয়ে নানা ধরনের বিষয়ের উপর ক্লাসও কনডাক্ট করেন। এর থেকেও অর্থ উপার্জনের এবং স্বাধীন থাকার একটা সহজ রাস্তা অনায়াসে বেরিয়ে আসে আধুনিক মায়েদের।

এখন অনেক বাড়ির মায়েরা এতটাই আত্মসচেতন হয়ে গেছেন যে, বাড়িতে তাদের স্বামীরাও স্ত্রী-কে খুশি ও আরামে রাখার জন্য, বাড়ির প্রতিটি কাজে শ্রমদান করতে এতটুকু ইতস্তত করেন না। শিক্ষার দৌলতে এবং সোশ্যাল এক্সপোজারের কারণে এখন অনেক মা ম্যাচিওর হয়ে গেছেন। সুতরাং তারা শক্ত হাতে ‘ঘর ও বাহির’ সামলাচ্ছেন। চাকুরিরতা মহিলা এবং গৃহবধূর মধ্যে আজ আর কোনও তফাৎ নেই। দিনের শেষে দু’জনেই নিজেদের কাজে পারফেক্ট।

মনে রাখতে হবে, এই মায়েরা মুখ বন্ধ করে পরিবারের প্রত্যেকের জীবনের ওঠা-নামার সঙ্গে নিজেকে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রাখেন। সোনার কাঠি ও রুপোর কাঠির ছোঁয়ায় পরিবারের প্রত্যেককে রূপকথার কাহিনির পাত্র-পাত্রী করে তোলেন। তাই তাদের দয়া নয়, সামাজিক অধিকারগুলির বিষয়ে সচেতন করা দরকার।

বিবাদ বাদের শিক্ষা দিন সন্তানকে

দুই শিশুর মধ্যে ঝগড়া-মারামারিতে মৃত এক।’ –বিরল হলেও, এমন ঘটনা মাঝেমধ্যে উঠে আসে খবরের শিরোনামে। আমরা শিহরিত হই। ভয়ে নিজের সন্তানকে আগলে রাখার চেষ্টা করি। কিছুদিন এই নিয়ে চর্চা চলে। কিন্তু, সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধানের রাস্তা খোঁজেন খুব কম বাবা-মা। তাই, সমস্যার শিকড় উৎপাটিত হয় না। আবারও কোথাও ঘটে যায় অপ্রীতিকর ঘটনা।

এই বিষয়ে মা-বাবাকে অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ। তাই ওদের ঠিকভাবে গড়ে তুলতে হবে। ওরা তো আসলে কাদামাটির মতো। যেমন গড়বেন, তেমনই গড়ে উঠবে। আর এই গড়ার কাজটা করতে হবে একেবারে ভ্রুণ অবস্থা থেকে। কীভাবে? চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, মাতৃগর্ভে ভ্রূণ থেকে ধীরে ধীরে যখন শরীর তৈরি হয়, তখনও কিন্তু নানারকম প্রভাব পড়ে শিশুর মস্তিষ্কে। ওইসময় মা-কে অনেক সতর্ক থাকতে হয়।

হবু সন্তানের জন্য মা-কে যেমন পুষ্টিকর খাবার খেতে হয়, হাঁটাচলা কিংবা উপযুক্ত ব্যায়াম করতে হয় কিংবা পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রামের প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনই মানসিক শাস্তিও বজায় রাখতে হয়। কোনওরকম উত্তেজনা, শারীরিক আঘাত, শব্দদূষণ প্রভৃতি এড়িয়ে চলতে হয় মা-কে। শুধু তাই নয়, বিকৃত যৌনসঙ্গমের ফলে তৈরি ভ্রূণেও পড়তে পারে খারাপ প্রভাব। এর ফলে শিশু চঞ্চল মস্তিষ্কের হতে পারে। অবাধ্য এবং মারকুটে হতে পারে বোধবুদ্ধির অভাবে।

জন্মানোর পরও শিশুকে সঠিক আদরযত্নে মানুষ করতে হবে। ভালোবাসা দিতে হবে। শিশু যখন বোধবুদ্ধি অর্জন করবে, তখন তাকে সবার সঙ্গে মেলামেশা করা শেখাতে হবে, ভাগ করে খাওয়ার অভ্যেসও তৈরি করাতে হবে। এর জন্য সময় পেলে শিশুকে নিয়ে খেলার মাঠে যেতে হবে। সঙ্গে নিয়ে যাবেন খেলার সামগ্রী এবং কিছু খাবার। এর কারণ, ওই খেলার সামগ্রী এবং খাবার অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে শিখবে আপনার শিশুসন্তান এবং শিশুর বন্ধুরাও ওর থেকে একই ভাবে ভালো কিছু শিখবে।

সাধারণত দেখা যায়, কোনও খেলার জিনিস (যেমন পুতুল, বল ইত্যাদি) নিয়ে কিংবা খাবার নিয়ে মাঝেমধ্যে শিশুদের মধ্যে ঝামেলা বেধে যায়। স্কুলে বেঞ্চ-এ বসা নিয়ে কিংবা ছোটোখাটো পেন-পেনসিল নিয়েও শিশুদের মধ্যে কাড়াকাড়ি, ঠেলাঠেলিতে মনোমালিন্য কিংবা অনেকসময় হাতাহাতিও শুরু হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক কিংবা শিক্ষিকার উচিত, ওদের বুঝিয়ে বিষয়টা মিটমাট করে দেওয়া। আর যদি স্কুল কর্তৃপক্ষ বারবার কোনও শিশুর অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করেন এবং কন্ট্রোল করতে না পারেন, তাহলে অভিভাবককে ডেকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের পথ বের করেন। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষের থেকে সন্তানের অস্বাভাবিক আচরণের অভিযোগ পেয়ে ভয় কিংবা দুঃশ্চিন্তায় মাথা খারাপ করা উচিত নয়। বরং, অভিযোগ শোনার পর সহানুভূতির সঙ্গে বিচার করুন।

প্রথমে দেখুন, সমস্যার বীজ কোথায় লুকিয়ে আছে এবং শুভাকাঙক্ষীদের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের পথ খুঁজুন। যেমন ধরুন প্রতিদিনই আপনার সন্তান কোনও সহপাঠীর সব টিফিন খেয়ে নিচ্ছে জোর করে, এমন অভিযোগ যদি পান, তাহলে কেন এমন করছে তার কারণ জানার চেষ্টা করুন নিজের সন্তানের মুখ থেকে। যদি দেখেন সহপাঠীর আনা খাবার ওর খুব পছন্দ হওয়ার কারণে খেয়ে নিচ্ছে, তাহলে পরের দিন থেকে আপনার বাচ্চাকেও ওই খাবার দেওয়ার চেষ্টা করুন কিংবা ওকে বোঝান, এরকম করা ঠিক নয়— এতে অন্যরা কষ্ট পাবে। আর এরপরও যদি সমস্যার সমাধান না করতে পারেন, তাহলে মনোবিদের শরণাপন্ন হয়ে কাউন্সেলিং করান, ভালো ফল পাবেন।

সামান্য বিষয় নিয়ে যদি শিশুদের মধ্যে ঝগড়া কিংবা মনোমালিন্য হয়, তাহলে এতে বাবা-মায়ের নাক গলানো উচিত নয়। কারণ ওটা সাময়িক সমস্যা। দেখবেন, আবার ওরা সবকিছু ভুলে গিয়ে একসঙ্গে হাসছে খেলছে।

শিশুদের শেখাবেন কী কী করা উচিত আর কী কী করা উচিত নয়। ওদের প্রতিযোগী করে তুলবেন না। ‘তোমাকে প্রথম হতেই হবে’ এটা না শিখিয়ে, ‘তুমি ভালো ফল করার চেষ্টা করবে’ —এমন কথা বলাই ভালো। কারণ প্রতিযোগিতা হিংসার জন্ম দেয়।

শিশুদের মন ভালো রাখার চেষ্টা করুন। ওদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশুন। ওদের অভাব অভিযোগগুলি গুরুত্বের সঙ্গে শুনুন। খারাপ কিছু শিখলে তা যাতে আর না করে, বন্ধুর মতো বোঝান শিশুকে।

কারও প্রতি শিশুর যাতে রাগ, হিংসা এসব তৈরি না হয়, সেই দায়িত্ব নিয়ে কিছু কর্তব্য পালন করতে হবে বাবা-মা- কে। যেমন—

O শিশুকে সামাজিক করে তুলতে উৎসব-অনুষ্ঠানে সবার সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ করে দিন।

O প্রতিদিন খেলার মাঠে নিয়ে গিয়ে কিছুটা সময় অন্যদের সঙ্গে খেলাধুলোর সুযোগ করে দিন।

O কোনও অতিরিক্ত বায়না করলে সরাসরি ‘না’ বলবেন না। আবদার করা থেকে বিরত রাখুন কৌশলে।

O কারও সঙ্গে ঝগড়া-মারামারি করলে, তা প্রথমে বুদ্ধি করে থামান এবং এরকম আর না করলে ওর কোনও প্রিয় জিনিস উপহার দেবেন— এমন প্রস্তাব রাখতে পারেন।

O প্রয়োজনে কলহে জড়িয়ে পড়া দুই শিশুকে পরস্পরের কাছে ‘সরি’ বলান এবং হাত মিলিয়ে দিন।

O শিশুর মন ভালো রাখতে, ওকে মাঝেমধ্যে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যান।

O বাড়িতে থাকলে অবসর সময়ে ভালো বই পড়ার সুযোগ করে দিন। বিশেষকরে নীতিগল্প পড়তে দিন। এতে শিশু মানবিক হবে, ভালো কিছুও শিখবে।

আজকাল ছেলেমেয়েরা দিনরাতে অনেকটা সময় মুঠোফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এ বিষয়েও সতর্ক থাকুন। কারণ, নানারকম সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, দীর্ঘসময় মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে, মস্তিষ্কে খারাপ প্রভাব পড়ছে শিশুদের। ওরা মেজাজ হারাচ্ছে। ফলে, অনেকসময় অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ফেলছে। যা কাম্য নয়। তাছাড়া ছেলে-মেয়েরা মুঠোফোনে কী দেখছে, তাও নজরে রাখা উচিত। কারণ বিভিন্ন সিনেমা কিংবা ধারাবাহিকে হিংসা, প্রতিহিংসা, মারামারি, খুনোখুনি প্রভৃতি দৃশ্যে ভরপুর থাকে। যা দেখলে শিশুদের সুকোমল বৃত্তিগুলি হারিয়ে গিয়ে, ক্ষতিকারক মানসিক পরিবর্তন ঘটতে পারে।

এ প্রসঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, শিশুরা যদি কোনও ভুল বা অন্যায় করে, তাহলে কী করা উচিত মা-বাবার?

এর উত্তরে জানাই, দোষারোপ করবেন না। দোষারোপ করলে অপরাধী হয়ে উঠতে পারে। ওকে ভালো খারাপের বিষয়টি বোঝান বন্ধুর মতো। ওদের নিরাপত্তা দেওয়াও মা-বাবা এবং স্কুল-শিক্ষকদের দায়িত্ব। কারণ নিরাপত্তা দিলে আত্মবিশ্বাসী হবে, অন্যদের সঙ্গে হেসে খেলে কাটাবে। ওদের লেখাপড়া, আঁকা, নাচ-গান, বাজনা কিংবা বিভিন্ন কাজের সাফল্যেও প্রশংসা করুন। কারণ প্রশংসা করলে শিশুও অন্যদের সঠিক কাজের মূল্যায়ন করতে শিখবে।

আর শিশুদের সামনে নিজেদের মধ্যে (মা-বাবা) ঝগড়া-মারামারি করবেন না। কারণ শিশুরা যা দেখে, তাই করে অনেকসময়। অতএব আপনার সন্তানকে সুসন্তান করে তোলার জন্য আপনার বোধবুদ্ধি দিয়ে তার প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করুন এবং সুশিক্ষা দান করুন। আর প্রয়োজনে কলহে জড়িয়ে পড়া দুই শিশুকে পরস্পরের কাছে ‘সরি’ বলান এবং হাত মিলিয়ে দিন।

পতি এখন আর পরমেশ্বর নয়

পুনেতে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে, যা নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। রেনুকা খন্না নামের এক মহিলা যে- ঘটনা ঘটিয়েছেন, সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার দিকে আঙুল উঁচিয়ে শুধু দোষারোপ করা উচিত, নাকি ইউনিক ঘটনার ট্রেন্ড স্টোর আখ্যা দেওয়া উচিত— তা বোঝা যাচ্ছে না! আসলে ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে পুনের এক শহর এলাকায়। বিল্ডার স্বামী নিখিল খন্না-র সঙ্গে বচসার জেরে স্বামীর নাকে ঘুসি মারেন রেনুকা। এর ফলে শুধু নাকের হাড় ভেঙে যাওয়াই নয়, দীর্ঘ সময় অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়ার কারণে স্ত্রীর হাতে মার খাওয়া ওই ব্যক্তির মৃত্যুও হয়।

রেনুকাকে দোষারোপ এই কারণে করা যেতে পারে যে, তিনি এমন জোরে ঘুসি মেরেছিলেন যে, তার মারের চোটে স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। আর ইউনিক ঘটনার ট্রেন্ড স্টোর এই কারণে বলা যেতে পারে যে, মহিলারাও এখন এক ঘুসিতে স্বামীকে মেরে ফেলতে পারেন! তাই এক্ষেত্রে প্রমাণিত যে, ঘুস না খাওয়া সরকারি কর্মচারীর যেমন সংখ্যা কম, ঠিক তেমনই মুখ বুজে মার খাওয়া মহিলাদের সংখ্যাও কমছে। এখন এটাও বোঝা যাচ্ছে না যে, রেনুকা শুধু হাতে ঘুসি মেরে নিখিলের নাক ফাটিয়েছিলেন নাকি ভারী কোনও বস্তু ব্যবহার করেছিলেন! আর যদি সত্যিই শুধু রেনুকার হাতের ঘুসিতেই নিখিলের মৃত্যু হয়ে থাকে, তাহলে পুরুষ সমাজের কাছে এটা বড়ো বার্তা যে, নারীকে আর অসহায় কিংবা কমজোর ভাবা উচিত নয়।

মনে রাখতে হবে, সেই রামায়ণের রামও এখন নেই, আবার সীতাও নেই। অতএব, সাধু সাবধান! কারণ, নারী এখন আর অবহেলার পাত্রী নয় কিংবা মুখ বুজে হিংসার বলি হওয়ার জন্যও নয়। নারী এখন শারীরিক কিংবা মানসিক ভাবে সক্ষম। কারণ আজ তারা শিক্ষিতা, আর্থিক ভাবে সাবলম্বী এবং লড়াই করে বাঁচতে জানে। অনেক ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়েও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে মেয়েরা।

পুনের ওই ঘটনার থেকে শিক্ষা নিয়ে বিবাহিত পুরুষদের সতর্ক থাকা উচিত বলেই অনেকে মনে করছেন এখন। তাই পতি এখন পরমেশ্বর নয় ববং প্রতিদ্বন্দ্বী বলা যায়। হয়তো আইন আইনের পথে চলবে কিংবা রেনুকার বিরুদ্ধে আদালত কী ব্যবস্থা নেবে তা আমাদের জানা নেই— তবে এখন স্ত্রী-র সঙ্গে ঝগড়া কিংবা মারামারি করার আগে দু’বার অবশ্যই ভাববেন স্বামীরা।

শৈশব কি হারিয়ে যাচ্ছে?

ঝরনার বয়স ১১। ওকে অনেকদিন পর বারান্দায় আসতে দেখে উলটো দিকের ফ্ল্যাটের চৌধুরিদের বড়ো মেয়ে দৃষ্টি জিজ্ঞেস করল, ‘ঝরনা অনেক দিন পর তোমাকে দেখছি, এখানে ছিলে না?’

ঝরনা উত্তর দিল, ‘এখানেই ছিলাম, কোথাও যাইনি। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত স্কুল, টিউশন, স্কুল আর টিউশনের হোমওয়ার্ক, বন্ধুদের ফোন ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ততার কারণে বাইরে বেরোবার সময় পাই না।’

ঝরনার উত্তর শুনে দৃষ্টির সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল নতুন এই সমাজ ব্যবস্থায় পুষ্ট হয়ে ওঠা হিউমান রোবটের দৈনন্দিন জীবনের নতুন একটা রূপ।

এই ঘটনা দক্ষিণ কলকতার হলেও আজ সমস্যা প্রতিটি শহরের টিনএজারদের জন্য প্রায় একইরকম। ব্যস্ত জীবনশৈলীর কারণে আজকের ছেলেমেয়েরা একটা স্পেসিফিক জীবনচর্যায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। শৈশবেই বাড়ি, পরিবার, মা-বাবা, ভাই-বোনের থেকে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে তারা নিজের মধ্যেই গড়ে তুলছে বিচ্ছিন্ন এবং একক জীবন।

২০১৬-তে দিল্লির একটা স্কুলের ঘটনা আজও বাকরুদ্ধ করে দেওয়ার মতো। এগারো ক্লাসের এক ছাত্র ৭ বছরের প্রদ্যুমন-কে হত্যা করে শুধুমাত্র পরীক্ষা এবং পিটিএম মিটিং থেকে বাঁচার জন্য। পড়াশোনার চাপ, পরীক্ষার ভয়, পিটিএম-এ শিক্ষক এবং অভিভাবকদের থেকে ভর্ৎসনার আশঙ্কা ওই ছাত্রকে মানসিক ভাবে এতটাই বিপর্যস্ত করেছিল যে, সে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।

২০১৯-এ সারা বিশ্বে কোভিড অতিমারি ছড়িয়ে পড়লে চারদিকে হাহাকার পড়ে যায়। ইউনিসেফ-এর একটি সমীক্ষা অনুসারে ভারতে প্রায় ৩৩০ মিলিয়ন শিশু মানসিক ভাবে কোভিড দ্বারা প্রভাবিত হয়। টোটাল লকডাউন এবং কোভিডের বাড়বাড়ন্ত মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে। স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়, পাবলিক প্লেসে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। বাচ্চাদের পড়াশোনাও অনলাইন নির্ভর হয়ে ওঠে।

সব ক্ষেত্রেই মানুষের রিয়েল ওয়ার্ল্ড-এর সঙ্গে সম্পর্ক ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। বাড়ির ভিতরের অন্দরমহল-ই বাস্তব হয়ে ওঠে সকলের জন্য। খেলনার জায়গা অধিকার করে মোবাইল এবং মানুষের উপর সোশ্যাল মিডিয়ার থাবা ক্রমশ গভীরতর হয়ে ওঠে।

একটি সমীক্ষা অনুসারে ভারতে ইন্টারনেট ইউজারের সংখ্যা প্রায় ৭০ কোটি যার মধ্যে ৫ থেকে ১৫ বছরের বাচ্চাও রয়েছে। এখানে জনসাধারণ প্রায় পাঁচ ঘন্টা ফোন এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ব্যস্ত জীবনশৈলীর কারণে মানুষ সামাজিক স্তরে একাকিত্ব ভোগ করছে এবং মানসিক যাতনাও ভোগ করছে। একাকিত্বের প্রভাব এতটাই যে কৈশোরেই ক্রিমানাল অ্যাক্টিভিটি-তেও অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে। কোভিড ও লকডাউনের পরিস্থিতি চলাকালীন বাচ্চারাও ইন্ট্রোভার্ট হয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে।

সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে নতুনত্ব এবং সতেজতা আনতে হবে জীবনে (শেষ পর্ব)

মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই পরিবর্তন চায়। জীবনে যখন একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে বা একঘেয়েমি থাকে, তখন তা জীবনে ছন্দপতন ঘটায়। এই একঘেয়েমি প্রতিটি মানুষই কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে। এজন্য নতুন নতুন সমাধান খোঁজে। সেটা খাদ্য বা জীবিকা যে-কোনও বিষয়ই হোক না কেন। মানুষ সবসময় পরিবর্তন চায়।

এটি একটি গুরুতর বিষয় এবং এর একটি মনস্তাত্ত্বিক দিক রয়েছে। পুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক কল্পেশ দেশাই-এর মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, মানুষের মস্তিষ্কে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে দুটি গ্রন্থি রয়েছে। এই উভয় গ্রন্থি ২৪ ঘন্টা সক্রিয় থাকে। এমনকী আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি তখনও পরোক্ষ মস্তিষ্ক সজাগ থাকে এবং দিবাস্বপ্ন রূপে মনের অসম্পূর্ণ আকাঙ্ক্ষাগুলি পূরণ করতে থাকে। এই লুকানো আকাঙ্ক্ষাগুলির মধ্যে একটি হল যৌন কল্পনা বা সেক্স ফ্যান্টাসি।

অধ্যাপক দেশাই এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘এই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত দম্পতিরা তাদের মনের মধ্যে যে কাউকে কল্পনা করতে পারেন। সেটা তাদের ক্রাশ বা কলেজের পছন্দ কেউ হতে পারে, আবার লোকালয় বা বাড়ির আশেপাশের যে কোনও ছেলে বা মেয়েও হতে পারে। এটা অবশ্যই আপনি যাকে পছন্দ করেন। তারা এটিকে তাদের কল্পনার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। হয়তো এটি তাদের যৌন জীবনে একটি নতুন রোমাঞ্চ নিয়ে আসে ঠিকই কিন্তু এটা মানসিক ভাবে ভুল। আপনি যার কথা ভাবছেন তার ব্যক্তিত্বকে আপনি অন্য রূপে কল্পনা করছেন। এর ফলে কল্পনার মানুষটির আসল ব্যক্তিত্বকে আপনি জেনেশুনে হত্যা করছেন। এটা তার আত্মসম্মানে আঘাত করা হল। অজান্তেই তাকে অপমান করা হচ্ছে। সেক্সোলজিস্টরা এটিকে ওষুধ হিসাবে বিবেচনা করতে পারেন তবে মনোবিজ্ঞানীরা কখনওই এটির পরামর্শ দেন না।’

অধ্যাপক কল্পেশ দেশাই-র এই বিশ্লেষণ গৌরবকে দ্বিধায় ফেলে দিলে, তিনি বিষয়টি সমাধানের জন্য মুম্বাইয়ের শহরতলি মালাডের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অঞ্জলি মালভাঙ্করের সাথে দেখা করেন। তিনি গৌরবকে বলেন, ‘যৌন প্রক্রিয়ায় শরীর এবং মন দুই-ই সমান ভাবে ইনভলভড। এই পুরো প্রক্রিয়ায় প্রায় ২০০ ক্যালোরি বার্ন হয়। সহজ কথায় বলতে গেলে, এই পুরো প্রক্রিয়াটি মস্তিষ্ক এবং প্রজনন অঙ্গগুলির মধ্যে একটি সম্পর্ক গড়ে তোলে। মস্তিষ্ক অনেকগুলি হরমোনকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রধানত ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন এবং টেস্টোস্টেরন। এই লুব্রিকেন্টগুলি কেবল তখনই উৎসারিত হয় যখন আমরা স্বাস্থ্যকর ফোরপ্লে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাই। এর মানে হল যে ফোরপ্লে, মেডিকেল দৃষ্টিকোণ থেকেও যৌন প্রক্রিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর যদি ফোরপ্লে-র জন্য সেক্স ফ্যান্টাসি অবলম্বন করতে হয় তবে তাতে কিছু ভুল নেই।”

খোলাখুলি কথা বলুন

ডা. অঞ্জলি আরও বলেন, “আমাদের ৯০ শতাংশ মহিলা যৌনতা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী কিন্তু তারা এটি সম্পর্কে কথা বলতে লজ্জা পান। তবে এই মহিলারা গুগলে যৌনতা সম্পর্কে সর্বাধিক অনুসন্ধান করেন। তারা যৌনতা জড়িত নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন। একটি সমীক্ষা অনুসারে, ৮০ শতাংশ মেয়েরা যৌনতা এবং অর্গ্যাজম সম্পর্কে অনুসন্ধান করেন, যেখানে মাত্র ৫৫ শতাংশ পুরুষ এই বিষয়গুলিতে অনুসন্ধান করেন। পুরুষরা সেক্স ফ্যান্টাসি সম্পর্কে জানতে অনেক বেশি উৎসুক মহিলাদের থেকে। এটি সম্পর্কে জানার আগ্রহ মহিলাদের মধ্যে প্রায় নেই বললেই চলে। যদিও মহিলাদের এই বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা করা উচিত এবং ডাক্তারদের পরামর্শ নেওয়া উচিত কারণ ভুল চিকিৎসা বা ভুল ওষুধও ক্ষতির কারণ হতে পারে।’

যৌন কল্পনার সংবেদনশীল দিকটি বিবেচনা করলে, এটি সত্য যে, আশা এবং আকাঙ্ক্ষার কোনও শেষ নেই। এটি এমন একটি আকাঙ্ক্ষা যা একজন ব্যক্তি সর্বদা কামনা করে এবং শেষ পর্যন্ত তার মরীচিকায় পথভ্রষ্ট হয় সে। অতএব, এই মরীচিকার পিছনে দৌড়ানোর পরিবর্তে, এর বিকল্প খুঁজে বের করাই ভালো। আমাদের প্রাকৃতিক যৌনপ্রবৃত্তি এবং সঠিক বিকল্প অর্থাৎ ফোরপ্লে-তেই ফিরে যাওয়াই সঠিক পন্থা।

সেক্স ফ্যান্টাসির কথা বলতে গেলে বলতে হয়, এটি যদি সেক্স প্রসেসে একঘেয়েমি দূর করে, তাহলে এর আশ্রয় নেওয়ায় কোনও ক্ষতি নেই। তবে মনে রাখতে হবে যে— সেক্স ফ্যান্টাসি, সমস্ত বিকল্পগুলির মধ্যে একেবারে শেষে থাকাই বাঞ্ছনীয়। যৌনক্রীড়ার একটি চূড়ান্ত সমাপ্তি হওয়া উচিত শারীরিক পরিতৃপ্তির কারণেই। আমরা সুখী যৌন জীবনের জন্য আকাঙ্ক্ষা যদি রাখি তাহলে মনে রাখতে হবে, এই সুখের ভল্টটি কেবল সন্তুষ্টির চাবিকাঠি দিয়েই খোলে, অন্য আর কিছু দিয়ে নয়।

সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে নতুনত্ব এবং সতেজতা আনতে হবে জীবনে (পর্ব-০১)

তিন মাস হতে চলল আরুশির বিয়ের। বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল ওর মনে। আরুশি আর সিদ্ধার্থর বিয়েটা সম্বন্ধ করেই। আরুশি বরাবরই বিয়েটা নিয়ে খুব ফ্যানটাসাইজ করত। কিন্তু বিয়ের পর কার্যক্ষেত্রে স্বামীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গঠনের সময় একটা বড়োসড়ো ধাক্কা খেল সে। কল্পনায় সিদ্ধার্থকে যতটা রোমান্টিক ভেবেছিল সে বাস্তবে ততটা আদৌ নয়। এটা যখন বুঝল আরুশি, মানসিক ভাবে বড়ো ধাক্কা খেল সে। বিবাহিত সম্পর্কের ভিতটাই টলমল হয়ে উঠল। সুতরাং এটাই মনে রাখতে হবে যে, একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে সেক্স ফ্যান্টাসির সঙ্গে বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে সম্পর্কটির মূল্যায়ন করা দরকার।

একঘেয়েমি যখন যৌন প্রক্রিয়াতেও আসে, তখন একজন সঙ্গী সেখান থেকেও বেরিয়ে আসার বিকল্প রাস্তা খোঁজে। এই কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও দূরত্ব বাড়তে শুরু করে কিছুদিন পর থেকেই। দূরত্বের কারণ যাই হোক না কেন, এর মৌলিক ভিত্তি সম্ভবত সেই একঘেয়েমি। এই দূরত্ব বৃদ্ধি পায় এবং শেষ পর্যন্ত পরিণতি বিবাহবিচ্ছেদে গিয়ে দাঁড়ায়। এটা সত্য যে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা দিন দিন অবিশ্বাস্য ভাবে বাড়ছে। কেন বেডরুমে এই একঘেয়েমি আসে এবং এই একঘেয়েমি এড়ানোর বিকল্প কী ?

একঘেয়েমি এড়ানোর উপায়

লুইস এ ওয়ার্ডসওয়ার্থের জনপ্রিয় বই ‘এ টেস্ট বুক অন সেক্সোলজি’তে বলা হয়েছে, ‘বেডরুমের একঘেয়েমি এড়ানোর জন্য দম্পতিদের ক্রমাগত নতুন ভাবে যৌন প্রক্রিয়া গ্রহণ করা উচিত। নতুন নতুন পোজের পরীক্ষানিরীক্ষার মানসিকতা থাকা উচিত। কখনও কখনও জায়গা পরিবর্তন করে কিছুদিন হিল স্টেশনে কাটিয়ে আসাটাও একটি ভালো বিকল্প।’

লুইস আরও লিখেছেন, ‘কিছুদিন পর তাদের মধ্যেও পৌনঃপুনিকতা বা একঘেয়েমি দেখা দেয়। ফলত দম্পতি আবার যৌন প্রক্রিয়ার থেকে বেরিয়ে আসার একটি বিকল্প উপায় খুঁজে বার করার চেষ্টা করে। বর্তমানে নতুন একটি নাম বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং তা হল সেক্স ফ্যান্টাসি, যা পশ্চিমি দেশগুলোর তরুণদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অনেকেই আছে যারা বিশ্বাস করে যে এটি সঠিক। তবে এমন লোকও রয়েছে যারা এটি ভুল প্রমাণ করতেই উদ্যত।’

মুম্বইয়ের বিখ্যাত সেক্স কাউন্সেলর ডা. রুস্তম-এর মত হল, ‘এই বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো খুব দরকার। তিনি বলেন যে, তাঁর কাছে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আজকের প্রজন্মের কাছে খুব তাড়াতাড়ি সব কিছু পেয়ে যাওয়ার চাহিদা অনেক বেশি। ফাস্ট ফুডের মতো তাদেরও ফাস্ট আনন্দ দরকার। এর জন্য ধৈর্য ধরতে তারা প্রস্তুত নয়। যদিও মনে রাখতে হবে যে,যৌনতা আবেগের খেলা।’

তিনি আরও বলেন— যৌন প্রক্রিয়ায় শুধু শরীরেরই অংশ থাকে না, মনও সমান ভাবে যুক্ত থাকে। তাই সেক্স প্রসেসের আগে ফোরপ্লে অর্থাৎ শারীরিক স্পর্শ, আলিঙ্গন, চুম্বন, জড়িয়ে ধরা প্রভৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা আজকের তরুণ প্রজন্মকে উপেক্ষা করতে দেখা যায়। অবশ্য এটা হয়তো পুরোপুরি তাদের দোষ নয়। কাজের চাপ, অন্যান্য স্ট্রেস এতটাই বেশি যে, তাদের মানসিক অবসাদ খুব দ্রুত গ্রাস করে। এই কারণে, ফোরপ্লে-তে যতটা সময় দেওয়া উচিত তা হয় না। ফলস্বরূপ, আজকের প্রজন্ম, যৌন প্রক্রিয়ায় এক্সটেসি, চরম আনন্দ বা অর্গাজম (সেক্সুয়াল ক্লাইম্যাক্স) অর্জন করতে সক্ষম হন না। এখানেই যৌন প্রক্রিয়ার প্রতি তার বিরূপ মনোভাব তৈরি হওয়া শুরু হয়, যা ধীরে ধীরে একঘেয়েমিতে পরিণত হয়। এই একঘেয়েমি, দূরত্ব তৈরি করতে শুরু করে এবং দূরত্ব ধীরে ধীরে বিবাহবিচ্ছেদের পর্যায়ে পৌঁছে যায়।

শরীর এবং মন উভয়ই কার্যকর

ডা. রুস্তমের কাছে যৌনসমস্যা নিয়ে আসেন গৌরব গ্রোভার এবং তার স্ত্রী নেহা গ্রোভার। তাদের কাছেই জানা গেল যে, তারাও নিজেদের যৌনজীবন নিয়ে একঘেয়েমিতে ভুগছেন। সেই জন্যই তারা ডা. রুস্তমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেক্সের প্রতি তারা আর কোনও রকম আকর্ষণ বোধ করেন না।

তারা জানান, ‘আমরা মাত্র দুই বছরের বিবাহিত। কিন্তু যৌন প্রক্রিয়ার প্রতি আমাদের আগ্রহ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এটির প্রতি আর কোনও আকর্ষণ নেই। অন্যান্য সমস্ত জিনিসের মতো, যৌনতাও আমাদের কাছে প্রতিদিনের মতো বিরক্তিকর মনে হতে শুরু করেছে।’ গৌরব আরও বলেন, ‘আমাদের যৌন জীবনে রোমাঞ্চ আনতে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। সেক্সের উপর বিভিন্ন ভিডিও দেখার পর কিছুটা উত্তেজনা বোধ করি। অনেক ওষুধও ব্যবহার করে দেখেছি। সাপ্তাহিক ছুটিতেও আমরা হোটেলে থাকতে শুরু করি। এটি অবশ্যই কয়েক দিনের জন্য আমাদের একঘেয়েমির অবসান ঘটিয়েছে। আমরা এই পরিবর্তনটি উপভোগ করতে শুরুও করেছিলাম। কিন্তু কয়েক দিন পরে, আমরা এটিতেও বোর হতে শুরু করি। অবশেষে আমরা ডা. রুস্তমের কাছে এসেছি। তিনি আমাদের খুব ভালো কিছু টিপ্স দিয়েছেন। এগুলো থেকে আমরা অনেক লাভবান হচ্ছি।’

সেক্স ফ্যান্টাসি

গৌরব জানালেন, ‘ফ্যান্টাসি মানেই কল্পনার জগৎ। চিকিৎসক আমাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, আমরা বেডরুমে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের দুজনকেই কল্পনার জগতে যেতে হবে। মানে, বেডরুমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি আমার স্ত্রীকে রুপোলি পর্দার প্রিয় নায়িকা ভাবতে শুরু করি এবং স্ত্রীও আমাকে তার প্রিয় হিরো ভাবতে শুরু করে। এতে প্রথমে মনের মধ্যে হাসি পেলেও, দুজনেই একে অপরের প্রতি আকর্ষিত হই৷’

(ক্রমশ…)

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব