বর্ষার বারিধারা গরম দূর করে যতই স্বস্তির স্পর্শ নিয়ে আসুক না কেন, ভুললে চলবে না একই সঙ্গে নিয়ে আসে শারীরিক নানা সমস্যা। আবহাওয়ায় এতটাই আর্দ্রতার পরিমাণ বেড়ে যায় যে, বাড়ি, অফিস যেখানেই হোক এমনকী বাইরে বেরিয়েও অস্বস্তি কিছুতেই কমতে চায় না। পরিবেশের কারণে এবং বাড়তি আর্দ্রতার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ত্বক। ফলে এই মরশুমে ত্বকের বিশেষ খেয়াল রাখার দরকার পড়ে। অনেকেরই বর্ষার সময় ত্বকে ফাংগাল ইনফেকশন হয়ে থাকে সুতরাং যদি সাবধানতা অবলম্বন করা যায় তাহলে এই সমস্যাগুলি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
ডার্মাটোলজিস্টদের মতে বর্ষায় শরীরের ইমিউনিটি লেভেল কম হয়ে যায়। বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের ফলে শরীরে অনেক রকমের অসুস্থতা বাসা বাঁধে। পেটের সমস্যা যেমন বদহজম, পেট খারাপ, টাইফয়েড ইত্যাদি অসুখগুলো মাথা চাড়া দেয়। এর সঙ্গে নিঃশ্বাসের কষ্ট, হাঁপানি, সর্দি-কাশিও মহামারির রূপ নেয়। ত্বকের সমস্যাও দৈনন্দিন জীবনকে অতিষ্টকর করে তোলে। এগজিমা, ফুসকুড়ি, ঘামাচি, ব্রণ ইত্যাদির প্রবণতা বেড়ে যায়। জমা জল পারিপার্শ্বিক বর্ষার মরশুমে পরিবেশকেও দূষিত করে তোলে।
ত্বকের যত্নের জন্য খেয়াল রাখতে হবে যে ত্বক দুই থেকে তিন ধরনেরই হয়ে থাকে সাধারণত। ড্রাই, অয়েলি এবং এই দুটির সমন্বয়।
ড্রাই স্কিন যাদের, তাদের উচিত প্রচুর পরিমাণে জল খাওয়া। জল, শরীরকে হাইড্রেট করে এবং বর্জ্য টক্সিন শরীর থেকে বার করে দেয়। ক্লিনজার ব্যবহার করা উচিত। বারেবারে ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করতে পারলে ত্বকের উপরের পরত ঠিকমতো হাইড্রেটেড থাকবে ফলে ত্বকও নরম, মোলায়েম এবং উজ্জ্বল হবে। গোলাপজল এবং গ্লিসারিনের ব্যবহার ত্বককে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে। অ্যালকোহল-যুক্ত টোনার ব্যবহার না করাই ভালো।
তৈলাক্ত ত্বকের জন্য ৩-৪ বার মুখ জল দিয়ে ধোওয়া উচিত যাতে অতিরিক্ত তেল মুখ থেকে বেরিয়ে যায়। ফেসিয়াল স্ক্রাবের ব্যবহার রোজ করলে রোমছিদ্রগুলি আটকে যাওয়ার ভয় থাকবে না, উপরন্তু তা মৃত কোশের পরত সরিয়ে দিয়ে ত্বককে এক্সফলিয়েট করতে সাহায্য করবে। কেমিক্যাল-যুক্ত স্ক্রাবের থেকে প্রাকৃতিক স্ক্রাব ব্যবহার করতে পারলে ভালো হয়। দুধ, বেসন, লেবুর রস এবং মধু দিয়ে তৈরি ফেসিয়াল প্যাক ত্বককে রিজুভিনেট করতে সাহায্য করবে এবং ত্বকও ফ্রেশ এবং গ্লোয়িং দেখাবে।
যাদের ত্বক ড্রাই এবং অয়েলি, এই দুটোরই সংমিশ্রণ, তাদের উচিত ত্বকের বিশেষ যত্ন নেওয়া। ত্বকের ড্রাই অংশ পরিষ্কার রাখা এবং ময়েশ্চারাইজ করা দরকার এবং তৈলাক্ত অংশ সঠিক উপায়ে পরিষ্কার করা, স্ক্রাব এবং টোন করা উচিত, যাতে দুই ধরনের ত্বকে ভারসাম্য রক্ষা হয়।
বর্ষায় সংক্রমণ দূরে রাখতে হালকা গরমজলে স্নান করা উচিত এবং অ্যান্টি-ফাংগাল ক্রিম, সাবান এবং পাউডার ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়। এছাড়াও নীচে আরও কিছু টিপস দেওয়া হল।
বর্ষায় ত্বকের যত্নের জন্য –
১) বর্ষাকালে ত্বক পরিষ্কার রাখতে ২ থেকে ৩ বার ফেসওয়াশ দিয়ে ত্বক ধোওয়া উচিত যাতে ত্বকের উপর জমা হওয়া তৈলাক্ত পদার্থ যেমন ধুলো, মাটি জমতে না পারে।
২) মনসুন সিজনে অ্যান্টিব্যাক্টিরিয়াল টোনার ব্যবহার বেশি লাভজনক। এটি ত্বককে সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচায়।
৩) বর্ষায় অনেক সময় অনেকেই সানস্ক্রিন লাগাতে চান না অথচ বর্ষাকালেও সূর্যের ক্ষতিকারক আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির প্রভাব আমাদের ত্বকে পড়ে। সুতরাং বর্ষায় সানস্ক্রিন লোশন অথবা ক্রিম অবশ্যই লাগান।
৪) বর্ষায় অনেকেই জল কম খান ফলে ত্বকের আর্দ্রতা কম হয়ে যায়, ত্বক রুক্ষ হয়ে পড়ে। এই সময় সারাদিনে ৫ লিটার জল অবশ্যই খাওয়া উচিত।
৫) ত্বক পরিষ্কার রাখতে স্ক্রাবারের ব্যবহার এই সময় অপরিহার্য।
৬) এই মরশুমে হেভি মেক-আপ করা উচিত নয়।
৭) খাদ্য তালিকায় ফলের রস, স্যুপ বেশি করে রাখুন। সবরকম সবজি রান্না ও খাওয়ার আগে খুব ভালো করে ধুয়ে নেওয়া দরকার। হালকা গরম জলে ধুতে পারলে আরও ভালো হয়।
৮) বাইরে থেকে বাড়িতে ফিরেই হালকা গরম জলে সাবান ব্যবহার করে হাত-পা ভালো করে ধুয়ে ফেলা উচিত। শুকিয়ে গেলে ময়েশ্চারাইজর লাগিয়ে নিন।
বর্ষাকালে পায়ের বেশি করে যত্ন করা উচিত। বর্ষার কারণে বেশি সময় পা ভিজে থাকার ফলে আঙুলের ফাঁকে ফাংগাল ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই মরশুমে বন্ধ এবং ভিজে জুতো কখনও পরা উচিত নয়। যদি বর্ষায় জুতো ভিজেও যায়, তাড়াতাড়ি শুকোবার ব্যাবস্থা করা উচিত আর নয়তো বর্ষায় ব্যবহারের জন্য এক জোড়া এক্সট্রা জুতো বাড়িতে সবসময় রাখা বাঞ্ছনীয়। এছাড়াও মাঝেমধ্যে পেডিকিওর-ও করান।
বর্ষায় বিশেষ করে চুলের যত্ন নেওয়াটা খুব দরকার। এই মরশুমে মাথার ত্বকও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর অন্যতম কারণ ঘাম হওয়া এবং বৃষ্টিতে চুল ভিজে যাওয়া। সপ্তাহে অন্তত ২ বার শ্যাম্পু করা দরকার এবং কন্ডিশনার লাগাতে ভুলবেন না। বৃষ্টির জলে চুল ভিজে গেলে বাড়ি এসে পরিষ্কার জলে চুল ধুয়ে ফেলুন এবং তোয়ালে দিয়ে শুকনো করে চুল মুছে ফেলুন। সপ্তাহে একবার মাথায় হালকা গরম তেল মালিশ অবশ্যই করবেন।
বর্ষায় সিন্থেটিক পোশাকের ব্যবহার বেশি করা উচিত যাতে বর্ষায় ভিজে গেলেও চট করে শুকিয়ে যায়। কিন্তু নাইলন ধরনের ফ্যাব্রিক ত্বকের নিঃশ্বাস রোধ করে, ফলে ত্বক নির্জীব হয়ে পড়ে। বর্ষা ঋতুতে টাইট পোশাক না পরলেই ভালো এবং সুতির পোশাকই পরা ভালো। এছাড়াও বেশি গয়নাগাটিও ত্বককে সুস্থ ভাবে নিঃশ্বাস নিতে বাধা দেয়।
বর্ষায় ত্বক ভালো রাখতে মাঝেমধ্যে ঘরোয়া কিছু প্যাক ব্যবহার করা যায়, যেমন–
১) বেদানার দানা অ্যান্টিএজিং-এর কাজ করে এবং এতে ভরপুর মাত্রায় ভিটামিন সি থাকার ফলে রুক্ষ ত্বকের জন্য উপকারী। বেদানার দানা বাটা ২ চামচ, ১ কাপ কাঁচা ওটমিল একটি বাটিতে নিয়ে ২ বড়ো চামচ মধু, এবং সামান্য ছাছ্ মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন। মিশ্রণটি ১০ মিনিট ত্বকে লাগিয়ে রেখে হালকা গরম জলে পরিষ্কার করে ধুয়ে ফেলুন।
২) একটি আপেল ভালো করে থেঁতো করে নিন। ওতে ১ চামচ চিনি এবং ১ চামচ দুধ মেশান। ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে ওতে কয়েক ফোঁটা ক্যামোমিল মিশিয়ে একটি প্যাক বানান। প্যাকটি ১৫ মিনিট মুখে লাগিয়ে রেখে ধুয়ে ফেলুন। রুক্ষ, নির্জীব ত্বকে গ্লো ফিরে আসবে।