কে দেখেছে

শেষ পর্যন্ত সোনাগাছিতেই যাবে অলকানন্দা। তার তাড়না এখন বিপদসীমা ছাপিয়ে ফুঁসে ওঠা নদীর মতো ভয়ংকর। সেই জলের তোড় এখন অলকানন্দাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে আছড়ে ফেলতে চাইছে সোনাগাছিতে। তারপর অলকানন্দা সেরে নেবে তার আসল কাজ। চকার সঙ্গে হবে তার শেষ বোঝাপড়া। একটা তুমুল হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে সে। জামার কলার ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যাবে থানায়। সবাই দেখুক গোবরডাঙার চ্যাটার্জিপাড়ার, লালবাড়ির ছোটোবউয়ের আসল মূর্তি।

অফিসে গিয়ে কদিনই সুস্থির মতো কাজে মন দিতে পারছে না অলকানন্দা। ভেতরে ভেতরে একটা ছটফটানি ভাব লেগেই আছে। সেটা খেয়াল করেছে কস্তুরী। কস্তুরীর পাশের টেবিল অলকানন্দার।

কী হল তোর?

কাল সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি।

ঘুমোতে পারিসনি? কীসের অস্বস্তি? কী ব্যাপার রে তোর? কদিন ধরে লক্ষ্য করছি, কী হয়েছে?

অলকানন্দা এড়িয়ে যেতে গিয়ে, গেল না। বলল, তোকে বলে তো কোনও সুরাহা হবে না। খুবই বিশ্রী একটা কাণ্ড ঘটে গেছে। আমি কিছুতেই ব্যাপারটা বরদাস্ত করতে পারছি না। আবার মন থেকে ঝেড়েও ফেলতে পারছি না।

সব শুনে কস্তুরী একটা বড়ো করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। জলের গেলাস হাতে তুলে বলল, তোর মাথাটা সত্যিই গেছে। এসব তো খুবই বস্তাপচা ঘটনা। তুই এতে ফালতু মাথা গলাচ্ছিস। চিরকালই তো এসব হচ্ছে। তুই ভেবেও বা করবিটা কী?

আমি সোনাগাছিতে যাব।

জলের গেলাসে সবে ঠোঁট ছুঁইয়েছিল কস্তুরী। বেমক্কা বিষম খেয়ে কাশতে লাগল। ধরা গলায় বলল, তুই কোনও সাইকায়াট্রিস্ট-কে দেখা অলোকা। আমার ধারণা, তোর মাথাটা হ্যাং মোডে চলে গেছে। ডোন্ট বি সিলি অলোকা। মাটিতে পা রেখে চল। বাস্তবটা বোঝার চেষ্টা কর। ডোন্ট টেক এনি হুইমজিক্যাল ডিসিশন লাইক দিস। এই ধরনের ছেলেমানুষি জেদের কথা তোর মুখে মানায় না। কোনও ভদ্রঘরের মেয়ে ও-পাড়ায় পা দেয় নাকি? তোর বাড়িতে ক’বছর রান্না করেছে, তো কী হয়েছে? এসব কথা কেউ স্বীকার করে নাকি? লজ্জায় চেপে গেছে।

সেই লজ্জাটাই তো ওকে দিতে চাই আমি। আবার ঠাটের কথার বহর কী! চাকরি পেয়েছি।

তোকে কি এই যুদ্ধে জিততেই হবে? একটা নোংরা ব্যাপার ঘাঁটতে গিয়ে তোকেও যে নর্দমায় নামতে হবে, তা ভেবে দেখেছিস?

ওসব আমি বুঝি না। আমি সোনাগাছিতে যাবই আর তুইও আমার সঙ্গে যাবি।

আমি যাব! তুই আমাকে নিয়ে যাওয়ার আর জায়গা পেলি না? শেষ পর্যন্ত ওই নরকে? কোনও লোচ্ছা তোর বা আমার হাত ধরে টান দিলে, আই মিন টু সে দ্যাট, তুই বা আমি ফিজিক্যালি হ্যরাসড হলে মুখ দেখাতে পারব?

ওসব ভয়  দেখিয়ে আমাকে দমিয়ে রাখতে পারবি না। আমি যাবই। আর তুইও আমার সঙ্গে যাবি। আমাকে যেতেই হবে।

সে নয় গেলি। আমিও সঙ্গে গেলাম। কিন্তু তুই তোর হাবিকে বলতে পারবি? সাহসে কুলোবে তোর?

ও জানে কেসটা। ও-ই বলেছে আমাকে।

কী বলেছে? বলেছে, ওহ, শিয়োর। ইউ মাস্ট গো টু সোনাগাছি? তাই বলেছে?

না, তা নয়। সোমা যে সোনাগাছিতে ঘর নিয়েছে, খবরটা সুজয়ই আমাকে দিয়েছে। কে নাকি সোমাকে সোনাগাছিতে দেখেছে, এই তো গত বৃহস্পতিবারেই।

রাতে অলকানন্দা শুতে যাওয়ার তোড়জোড় করছিল। সুজয় ওর স্টাডিরুমে ল্যাপটপে ঘাড় গুঁজে বসেছিল। সুজয়ের জন্য জলের গেলাস নিয়ে গজগজ করতে করতে ঢুকল অলকানন্দা। বলল, বেশি রাত কোরো না। আমাকে সাতসকালে উঠতে হবে। সোমা আমার সব সুখ কেড়ে নিয়েছে। কথা নেই বার্তা নেই দুম করে কাজ ছেড়ে দিল।

সুজয় তখনই বলল কথাটা। প্রথমটা তেমন খেয়াল করেনি অলকানন্দা। বলল, কী বললে?

সুজয় ল্যাপটপেই ঘাড় গুঁজে রেখে ফের বলল, তোমার সোমার প্রামোশন হয়েছে। সে সোনাগাছিতে ঘর নিয়েছে।

কী বলছ তুমি?

ঠিকই বলছি। ইটস ট্রু অ্যাজ ডে লাইট। নাও সোমা ইজ আ পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট অফ সোনাগাছি।

সোমা সোনাগাছিতে…!

ইয়েস, ঘর নিয়েছে। নাও সি ইজ আ কনফার্মড হোর। ওহ, আই অ্যাম সরি। দিজ ভোকাবুলারিজ আর আনকনস্টিটিউশনাল নাউ-এ-ডেজ। আজকাল ওদের ডেজিগনেশন হয়েছে। দে আর কলড সেক্স ওয়ার্কার্স। আই মিন যৌনকর্মী। ডোন্ট সে হোর, প্রস্টিটিউট অ্যান্ড সো অন…

কী নিষ্ঠুরের মতো বলছ এসব? একটুও মুখে বাধছে না তোমার?

লিসন মাই ডিয়ার, ইন দিস কেস, আম সিম্পলি হেল্পলেস। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু বি আ পেটি সিমপ্যাথাইজার লাইক ইউ, ইউ নো। আই হেট অল দিস ডার্টি থিংগস। যাও, শুতে যাও। আমাকে কাজ করতে দাও।

অলকানন্দা আর দাঁড়ায়নি। সুজযের স্টাডিরুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে এসে সোফার ওপর গা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ে। অলকানন্দা মনে মনে দুয়ে দুয়ে চার করে নেয়। নিজের সঙ্গেই কথা বলে ওঠে সে, ও তাই সোমা আমার রান্নার কাজটা ছেড়ে দিল!

দোলের পরের দিনই সোমা এসেছিল। বলল, বউদি, খুব খারাপ খবর। তোমার বাড়ির কাজ আমি আর করতে পারব না গো। শুনে অলকানন্দার মাথাটা বাঁই করে ঘুরে গেল। বলল, ইযার্কি করিস না সোমা। তুই ছাড়া আমি অচল, তুই জানিস। আমার অফিস মাথায় উঠবে, তুই না এলে।

সে তো জানি বউদি। কিন্তু, কলকাতায় আমি একটা বড়ো কাজ পেয়েছি। অনেক টাকা মাইনে!

তুই কি আমাকে মাইনে বাড়াতে বলছিস? তা অত ঘুরিয়ে নাক ধরার কী আছে? সোজা কথা বল না। দেব বাড়িয়ে জানি তোর বরের চিকিত্সার খরচ অনেক। আমি তো সবাইকে বলি, সোমা ওর বরকে নিয়ে কী লড়াইটাই না লড়ছে! এমনিতেই তোকে আমি অনেক বেশিই টাকা দিই। আরও বাড়িয়ে দেব। তবু তোকে ছাড়া আমার চলবে না সোমা।

না বউদি, চাকরিটা আমি হাতছাড়া করতে চাই না। ওর ওষুধের পেছনে কত খরচ, তা তো জানো। তিনবাড়ির রান্নার কাজে যা পাই ফুটকড়াই হয়ে যায়। সংসার চলে না। এবার মনে হয় একটু সুখের মুখ দেখব।

কী চাকরি তোর?

উঁ

উঁ না টুঁ। বলছি কাজটা কী?

ওই একটা কাজ। সে বলার মতো কিছু নয়। লেখাপড়া জানি না। অফিসের কাজ আর কে দেবে আমায়?

তবে কী? টিভি সিরিয়ালে অ্যাকটিং করবি? ওই চকা তোর মাথায় এসব ভূত চাপিয়েেছে না? আমি তোকে বলেছি না, ওসব লাইন তোর মতো মেয়ের জন্য নয়। তোর রূপের চটক আছে। কিন্তু, খুঁটির জোর আছে কি? চিল-শকুনে ছিঁড়ে খাবে তোকে, তখন কেঁদে কূল পাবি না। ওই চকার পাল্লায পড়িস না। ওটা একটা আস্ত ক্রিমিনাল। মওকা পেলে ও তোকে আরব-এ চালান করে দেবে।

সোমা বলল, না বউদি, চকাকে ওপর থেকে দেখে আম্মো তাই ভাবতাম। ও আমাকে দিদি ডেকেছে।

অলকানন্দার আন্দাজে ঢিল ছোড়াটা তাহলে লাগসই হয়েছে। রিভলভিং স্টেজ-ড্রামার মতো বাঁই করে এক চক্করে ঘুরে গেল যেন মঞ্চটা। একটা ঘাগু উকিল আর ঝানু গোয়েন্দার মতো দ্বৈত চরিত্রে ঢুকে পড়ে অলকানন্দা। অদ্ভুত ভঙ্গিতে মাথাটা দোলাতে দোলাতে বলে, তাহলে চকাই তোর মাথাটা খেয়েছে। দ্যাখ সোমা, দুনিয়াটার কিছুই দেখিসনি তুই। জানিসও না কিছুই। চকার মতো ক্রিমিনালদের কাছে মা-বোন বলে কিছু নেই রে। ওটা একটা আস্ত তোলাবাজ। ওরা শুধু চেনে টাকা আর চেনে মদ আর মেয়েমানুষ। তোকে দিদি বলল, আর তুই অমনি গলে গেলি?

চকা আজ পোজ্জন্ত আমার সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যাভার করেনি।

করেনি তোকে বাগে পায়নি, তাই করেনি। এবার পাবে।

কেন? এবার পাবে কেন?

ওই যে কৃতজ্ঞতা। তুই তো আর অকৃতজ্ঞ হতে পারবি না। তোকে অনেক টাকার কাজ জোগাড় করে দিল। তার প্রতিদান যখন চাইবে, তখন বুঝবি। যাই হোক, চাকরিটা কী? মানে কী কাজ?

সোমা বলতে গিয়ে থেমে গেল। কে যেন ওর গলা টিপে ধরল। তার চোখ, চিবুক শক্ত দেখাল। বলল, ওই একটা ছোটোখাটো কাজ আর কী। বলার মতো তেমন কিছু না। চলি। আর দাঁড়ায়নি সোমা।

 

বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকেই অলকানন্দা হাতব্যাগটাকে ছুঁড়ে দিল সোফায়। বাথরুমে ঢুকে গেল সোজা। অনেকক্ষণ ধরে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে শরীর ও মনকে স্থির করার অনুশীলন চালাল। সোমার এই পরিণতির কথা ভাবতে ভাবতে গা গুলিয়ে ওঠে তার। বেসিনের কাছে ছুটে গিয়ে ওয়াক তুলতে থাকে। খানিক ধাতস্থ হওয়ার পর চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেয়। ঘাড়ে ও পিঠে জল দেয়। হ্যাঙার থেকে তোয়ালেটাকে একটানে নামিয়ে এনে, বিছানায় শরীর গড়িয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে পড়ে থাকে। যেন চোখ খুলতেও ভয়। ছেলেবেলায় রাক্ষস-খোক্ষসের স্বপ্ন দেখার পর ভয়ে আতঙ্কে যেমন চোখ খুলতে পারত না ঠিক তেমন। ঠিক সেই আতঙ্ক গিলে রেখেছে অলকানন্দাকে। যেন জেগে শুয়ে চোখ বুজে থাকলে মনে হবে, সে সোমাকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখছিল। গোটাটাই স্বপ্ন। চোখ খুলে বাস্তবে ফিরতে চায় না সে।

ওভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে অলকানন্দা টের পায়, ওর ভেতরে স্মৃতির জলভরা বোতলটা কখন কাত হয়ে শুয়ে পড়েছে। তাই নীচের অচেতন স্তরের খড়িমাটির গুঁড়োর মতো থিতিয়ে পড়া স্মৃতিগুলো গড়িয়ে অবচেতন স্তর টপকে এল। এল একেবারে অলকানন্দার চেতন স্তরে। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে থাকে সে। তার মন বলে ওঠে, ও, তাই! তাই সোনাগাছির প্রতি তার এমন দুর্বার আকর্ষণ? এই সেই সোনাগাছি। ওহ! এ তো সেই প্রত্যভিজ্ঞা! সেই প্রত্যভিজ্ঞাই এতকাল পরে ঘুরে ফিরে অলকানন্দার সামনে এসে হাজির।

অলকানন্দা কলেজে সাইকোলজি পড়েছে। জেনেছে প্রত্যভিজ্ঞার কথা। আগের দেখা ও শোনার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া। এই যে-সোনাগাছি তাকে মাতিয়ে তুলেছে, তার মূলে তো শুধু সোমা নয়! রয়েছে আরও একজন। সে অলকানন্দার মাসতুতো দিদি মান্তুদি। অনেক বছর আগে মান্তুদি গেছিল সোনাগাছিতে। মান্তুদির বর প্রায় রাতেই বাড়ি ফিরত না। পাড়ার অভিজিত্দাই গোয়েন্দাগিরি করে, সুমনদার সুলুক সন্ধান এনে দিল মান্তুদিকে। অভিজিত্দার সঙ্গে সোনাগাছিতে গিয়ে হানা দিল মান্তুদি। এক রূপসী মহিলার ঘর থেকে মান্তুদি ওর বরকে, জামার কলার ধরে হিড় হিড় করে টেনে রাস্তায় এনে, মুখে থুতু ছিটিয়ে দিয়ে চলে এসেছিল। আর ফেরেনি।

সে আজ থেকে বছর কুড়ি আগের কথা। তখন অলকানন্দার বয়স বড়োজোর বারো-তোরো হবে। তাই বাড়ির বড়োরা ছোটোদের কানকে আড়াল করে ফিসফাস, কানাঘুষো চালাত। তখনই সোনাগাছি শব্দটা ছিটকে এসেছিল অলকানন্দার কানে। পরে সব ঘটনাই শুনেছে, জেনেছে। প্রায় এক যুগ আগের সেই পারিবারিক বিপর্যয়, মান্তুদির সেই সোনাগাছি অভিযানের কথা স্রেফ কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিল। আজ এতকাল পরে সোমার কদর্য পরিণতিতে অলকানন্দার অন্তরিন্দ্রিয়ে অচেতন স্তরে, মজে যাওয়া সেই স্মৃতি উঠে এল চেতনায়। আখেরে মান্তুদিই হল তার অ্যাকচুয়াল ইন্সপিরেশন। এই মুহূর্তে মান্তুদিই তার মনের জোর একশোগুন বাড়িয়ে দিল যেন।

রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারল না অলকানন্দা। যত রাত বেড়েছে, ততই রোখ বেড়েছে তার। কেবলই মনে হতে থাকে, ওই লোচ্ছা চকা যেন ওকে হারিয়ে দিল শেষটায়। চকাকে উচিত শিক্ষা না দিতে পারলে স্বস্তি নেই। এত দূর স্পর্ধা! একটা মেয়ে দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে তাকে ওই নরকে টেনে নিয়ে যায় কী করে? আগে সোমার গালে চড় কষিয়ে ওর দেমাক ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। তারপর সে একটা হেস্তনেস্ত করে তবেই ছাড়বে।

পার্টি-পলিটিক্স যতদূর যেতে হয় যাবে অলকানন্দা।

 

পরের দিন অফিস থেকে ফেরার পথে অলকানন্দা গেল চকাদের ঠেকে। একদল ছেলেছোকরা বসে গুলতানি করছিল একটা চা দোকানে। চকা এসে দাঁড়াল অলকানন্দার সামনে। মোবাইল ফোনে তর্জনী চালাতে চালাতেই বলল, আপনি এখানে? কী ব্যাপার বলুন তো?

অলকানন্দা বলল, সোমাকে তুমি এই পথে নামালে কেন?

কে সোমা?

তুমি ভালোই জানো কোন সোমা। ও আমাদের বাড়িতে রান্নার কাজ করত।

অ… সোমাদি। তাকে সোনাগাছিতে নিয়ে গেছি কেন? তাই তো? তা সে কি কারও কোলের মেয়ে আমি কি তাকে কারও কোল থেকে কেড়ে নিয়ে গেছি? এমন গিলাবিলা বলেন না, শুনলে শালা সাত পেগের নেশা ছুটে যায়। নিজের পায়ে হেঁটে হেঁটে হাটে গেল ঘোষ, সবাই বলে, হাই রোডেরই দোষ। সোমা তো নিজের ইচ্ছেতেই গেছে। সব জেনে তাপ্পর কথা বলুন। মাস খানেক ধরে সোমা আমার পেছনে এঁটুলির মতো লেগে পড়েছিল। শুধু বলেছে, ছেলেকে ইশকুলে ভত্তি করাবে। ওর অনেক টাকা দরকার। বলল, ও কারও দয়া নেবে না। বলল, চকা আমি রোজগার করতে চাই। যেমন করেই হোক, নিজের রোজগার। ওর স্বামীর তো প্যারলিসিস। শুনে আমার মায়া হল। তাই আমি ওকে…

চকার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অলকানন্দা বলল, তাই তুমি ওকে সোনাগাছিতে নিয়ে গেলে? বাঃ চমত্কার সোমা যে-ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাবে, দুদিন বাদে ছেলে বড়ো হয়ে যখন মায়ের আসল পরিচয়টা জানবে, তখন?

চকা আঙুলের টোকায় সিগারেটটাকে ঘরের এক কোণে ছুড়ে দিয়ে বলল, দেখুন বউদি, ছোটোমুখে একটা বড়ো কথা বলি, মায়ের পরিচয় শুধুই মা। আপনারা পিথিবির কটা মাকে দেখেছেন?

তোমার কাছে জ্ঞানের কথা শুনতে চাই না। তুমি আমাকে সোমার সোনাগাছির ঠিকানাটা একটু বলবে?

কেন? আপনি যাবেন নাকি সেখানে?

নিশ্চয়ই যাব।

বিন্দাস বলেছেন মাইরি। আপনার কলিজায় কুলোবে?

আমি ভয় পাই না।

তাওলে যান, আপনি গেলে সিনটা জমে যাবে। অবোসসো আপনি একা গেলে ওর ঠেক খুঁজে পাবেন না। সে অনেক গোলমেলে গলতা। কিন্তু, আপনি কেন যাবেন সেখানে সেটা বলবেন? মানে আপনার আসলি কাহানি?

কাহিনি আবার কী? ও আমায় বলেছে চাকরি পেয়েছে নাকি। আমি গিয়ে ওই মিথ্যেবাদীর গালে একটা ঠাস করে চড় মারব। তারপর তোমার সঙ্গে হবে আমার আসল বোঝাপড়া।

চমকাচ্ছেন? আমাকে? আপনি মেয়েছেলে, তাই চেপে গেলাম। ঠিক আছে, কবে যেতে চান, চলুন আমি নিয়ে যাব।

আমি কালই যেতে চাই। কিন্তু তুমি আগে থেকে সোমাকে কিছু জানাতে পারবে না।

সে ঠিক আছে। একটা সবুজ পাত্তি ছাড়তে হবে। মাগনা হবে না।

মানে! কত পাঁচশো?

চকা মাথা ঝাঁকিয়ে তার সম্মতি বুঝিয়ে দেয়।

অলকানন্দা বলে, ঠিক আছে দেব।

 

রাতে তুলকালাম ঝড় উঠল। অলকানন্দার প্রস্তাব শুনে সুজয়, সিংহের গর্জন তুলে গোটা বাড়ি কাঁপিয়ে দিল। এমন বিশ্রী একগুঁয়েমি, জেদের কথা শুনে সুজয় ঝাঁঝিয়ে উঠে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিল অলকানন্দার গালে। ব্যস, আর কোনও পরোয়া নেই। কোনও বাধা নেই আর। সুজয়ের চড় অলকানন্দার সোনাগাছির পাসপোর্ট পাকা করে দিল। তার সোনাগাছি অভিযানের আসন্ন সাফল্যের রোমাঞ্চ, সুজয়ের চড়ের গ্লানি মুহূর্তে মুছে দিল। আর কথা বাড়তে দেয়নি অলকানন্দা। বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। সুজয় বারবার অনুতাপ, অনুকম্পা জানাতে এলেও, মুখ তোলেনি সে।

সারারাত এক ভাবে বিছানায় পড়ে থাকে অলকানন্দা। অনেক রাত পর‌্যন্ত সুজয় আত্মপক্ষ সমর্থনে গজগজ করতে থাকে। একসময় অলকানন্দা টের পায়, তার সিংহমার্কা স্বামী নাকের গর্জন তুলছে। অলকানন্দা টুঁ শব্দেরও টুঁটি টিপে নেমে আসে বিছানা থেকে। ওদের তিনতলার ঝুলবারান্দায় একটু একটু করে রাতের আয়ু ফুরিয়ে আসতে থাকে।

খুব ভোরে আচমকা ঘুম থেকে জেগে উঠে সুজয় দেখল অলকানন্দা নেই। ওর বালিশের এক কোণে একটা ভাঁজ করা এ ফোর পেপার। তাতে লেখা, আজ অফিস ছুটির পর সোনাগাছি যাচ্ছি। তার পরের গন্তব্য আমার জানা নেই।

 

অফিস ছুটির পর অলকানন্দা ভূত দেখে চমকে ওঠে। অফিসের গেটের মুখে সুজয় দাঁড়িয়ে অলকানন্দাকে দেখে এগিয়ে এল। বলল, চলো আমিও যাব। পেছন থেকে কস্তুরী বলল, অলকা, তাহলে আমি আর যাচ্ছি না। অলকানন্দা মাথা নেড়ে হাত তুলে গুডবাই বোঝাল।

ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে চকার দাঁড়ানোর কথা। দূর থেকে চকাকে দেখা গেল। ফর্সা লম্বা মেয়ে পটানো চেহারা। নীল জিন্স-এর ওপর একটা ডার্ক টি-শার্ট। বলিউডের হিরোর স্টাইলে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অলকানন্দা বলল, ওই যে ওই ছেলেটা। চকার গা ঘেঁষেই ট্যাক্সি দাঁড়াল। অলকানন্দা মুখ বাড়িয়ে বলল, উঠে এসো চকা, সামনে বসো। ট্যাক্সি ছুটছে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে। চকা ড্রাইভারের কপালের কাছে ঝোলানো আয়নায় কেঁপে কেঁপে যাওয়া লোকটাকে দেখার চেষ্টা করছিল।

ট্যাক্সি থেকে নেমে চকা বলল, আপনারা আসুন আমার সঙ্গে। চকাকে অনুসরণ করে চলল অলকানন্দা আর সুজয়। বুক কাঁপছিল অলকানন্দার। এটাই তাহলে সোনাগাছি! আসলে পৃথিবীর এই আদিম পেশার ওপর অনেকদিনের চাপা কৌতূহল তার। সোমাই যেন হাত ধরে নিয়ে এল অলকানন্দাকে। তার অজানা ও অদেখাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সোমাই। রাস্তার দুধারের বাড়ির সামনে সব অসভ্য সাজগোজ করা রোজগেরে মেয়ে। এরাই বেশ্যা, বারবনিতা, বারাঙ্গনা আরও কত নাম এদের। এখন শুধুই যৌনকর্মী।

একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পেছন ফেরে চকা। বলে, এই বাড়িটাই, চলে আসুন। বাড়িটার একবারে গর্ভস্থলে ঢুকে পড়ল ওরা তিনজন।

অলকানন্দা বলল, বাব্বা, কত ভেতরে গো চকা।

চকা বলল, আসুন না। আরও একটু ভেতরে। সুজয় নাকে-মুখে সাদা রুমাল চেপে হাঁটছিল। অলকানন্দার বুকে ভূমিকম্পের ধকল। গলা শুকিয়ে আসছিল। অনেক কষ্টে বলল, চকা তুমি সোমাকে কিছু জানাওনি তো।

না কিছু বলিনি। আপনাদের দেখে ও বমকে যাবে।

অলকানন্দা চাপা গলায় বলল, লজ্জাও পাবে। অবশ্য এখনও যদি ওর লজ্জা বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে।

চকা বলল, এখানে ওসব লজ্জাফজ্জা চলে না। বলতে বলতে একটা ঘরে ঢুকে গেল চকা। পেছন ফিরে বলল, আসুন ভেতরে চলে আসুন। ঘরের ভেতরে ঝলমল করছে আলো। ঘরে ঢুকেই একেবারে সোমার মুখোমুখি অলকানন্দা।

সোমা ছুটে এসে অলকানন্দার হাত চেপে ধরল। বলল, দাদা-বউদি, তোমরা এখানে! চকা নিয়ে এল বুঝি? খুব ভালো করেছ এসেছ। আমি যেন স্বপ্ন দেখছি।

অলকানন্দার কথা বলার শক্তি নেই। চকা বলল, এটা এই বাড়ির কিচেন। দুবেলা পনেরো-পনেরো তিরিশটার মতো পাত পড়ে এখানে। দুজন জোগাড়েকে নিয়ে সোমা একাই সামলায় এই কিচেন। মাস মাইনে পনেরো হাজার।

সোমা বলল, তোমরা বসো বউদি, আমি তোমাদের চা করে দিই।

 

অলকানন্দার পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল। কিচেন থেকে বেরিয়ে বাইরের ছোট্ট প্যাসেজে একটা চেয়ারে স্থবিরের মতো বসে পড়ল অলকানন্দা। সুজয় পাশে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে দাঁড়াল।

চকা এসে বলল, এবার বলুন বউদি, আমার সঙ্গে কী বোঝাপড়া করবেন।

অলকানন্দার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। হাতের রুমাল দিয়ে চোখের কোণা মুছে নিয়ে বলল, আমাকে আর লজ্জা দিও না।

ঠিক তখনই চকার মধ্যে জেগে উঠল মাস্তান চকা। মাস্তানির ঢঙেই সে বলল, বউদি, সোমাকে এই সোনাগাছিতে কে দেখেছে বলুন তো? মানে সেই ডবল ভদ্দলোকটি কে?

সুজয় এবার তাড়া লাগাল। বলল, ওসব কথা পরে হবে। আমরা এখন ফিরব।

অলকানন্দার বুকের ভেতরে ভূমিকম্পে ধস নামছিল। সুজয় বলল, চলো, একটু হেঁটে এসো। ওই মোড় থেকে ট্যাক্সি নেব।

অলকানন্দা হাঁটছিল সুজয়ের পেছন পেছন। দূরত্ব সামান্য হলেও ব্যবধান ছিল। একটা লোক সুজয়কে দেখে সালাম সাব বলল। প্রায় মাঝবয়সি লোকটার পরনে চেক লুঙ্গি, কালো স্যান্ডো গেঞ্জি, গলায় চৌকো তাবিজ। অলকানন্দাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল লোকটা।

অলকানন্দা এবার পা চালিয়ে সুজয়ের পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। বলল, লোকটাকে তুমি চেনো নাকি?

কথাটা সুজয়ের কানে গেল কিনা বোঝা গেল না। অদূরে দাঁড়ানো একটা ট্যাক্সি দেখে সুজয়, ট্যাক্সি বলে চেঁচিয়ে উঠল।

উড়ান

জুনি মোবাইলে সময়টা দেখে নিল। এখনও সময় আছে পার্লার পৌঁছোনোর। আগে থেকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা, সুতরাং সময়মতো ওকে পৌঁছোতে হবে। নতুন নতুন বিয়ের পর ওর এইসব সাজগোজ, পার্লারে বসে রূপচর্চা খুব ভালো লাগত। এখন পানিশমেন্ট মনে হয়! আগে এইসব করার জন্য একটা মন ছিল ওর, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শরীর, মনে কেমন একটা শিথিলতা চলে এসেছে জুনির।

ওর বয়স এখন মাত্র সাতাশ। বড়ো বড়ো চোখ, পাতলা ঠোঁট, টিকালো নাক, কালো ঘন চুল যা কিনা স্টেপ করে কাটা, গায়ের রং একটু মাজা, যেটাকে আমরা শ্যামবর্ণ বলে থাকি। সব মিলিয়ে বেশ চোখে পড়ার মতো ব্যক্তিত্ব।

জুনি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তিন বোন, জুনি মেজো। বড়ো আর ছোটো বোন অপরূপ সুন্দরী, গায়ের রং দুধে আলতা বলতে যা বোঝায়, সেখানে জুনির গায়ের রংটাই একটু চাপা। এর জন্য মনে মনে জুনি একটু বিব্রত হতো। অথচ ওর চোখের মধ্যে এমন একটা আকর্ষণ ছিল যে, সৌমেন একবার দেখেই জুনিকে বিয়ে করতে মনস্থ করে ফেলে।

বিয়ের পাঁচ বছর পরেও জুনি আজও বুঝতে পারেনি, ওদের বিয়েতে সৌমেনের মা-বাবা আদৌ খুশি হয়েছিলেন কিনা। ওর এই একই প্রশ্ন সৌমেনকে নিয়ে। জুনি কি আদৌ সৌমেনকে খুশি করতে পেরেছে?

পার্লারে মেয়েটির দক্ষ হাত জুনির সারা মুখে মাসাজ করছে। ছোট্ট গদিপাতা বেঞ্চটায় শুয়ে আরামে চোখ বুজল জুনি, অতীতের ঘটনাগুলো চোখের সামনে এসে ভিড় করছে। সৌমেনের সঙ্গে ওর বিয়ে আজও স্বপ্ন মনে হয় জুনির। বিয়ের দিন নিজের শাড়ি, গয়না দেখে জুনি বেশ বুঝতে পারছিল ওর বোনেদের, এমনকী বান্ধবীদেরও ওকে দেখে ঈর্ষাবোধ হচ্ছে। সৌমেনদের বাড়ি থেকে পাঠানো হয়েছিল বিয়ের পুরো সরঞ্জাম। লাল বেনারসিতে ঠাসা জরির বুনন, সোনার তারের কাজ। ওড়নাতেও শাড়ির সঙ্গে মানানসই কাজ করা।

গা ভর্তি গয়না, যার বেশিরভাগটাই শ্বশুরবাড়ি থেকেই আসা। বিয়ের দিন হিরের সেট দিয়ে শ্বশুরমশাই আশীর্বাদ করে গেলেন। সত্যি, কনেকে দেখে রাজকুমারীই মনে হচ্ছিল।

নতুন বউ হয়ে শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ করার সময় বুকের ভিতরটা কেমন যেন ভয়ে কাঁপছিল। এই বিশাল বাড়িতে সৌমেন থাকে। এ তো পুরো রাজপ্রাসাদ। জুনি ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল। বউভাতের দিন রাতে বউভাতের ধড়াচুড়া ছাড়ার পর, এক ফাঁকে শাশুড়ি এসে ঘরে ঢুকেছিলেন। সৌমেন অতিথিদের ছাড়তে নীচে গিয়েছিল। একটা প্যাকেট ধরিয়ে শাশুড়ি বলেছিলেন, শাড়ি ছেড়ে এটা পরে নিও। আশা করি, আজ রাত্রে কী করতে হয় সেটা তুমি জানো? প্যাকেটের ভিতর সাদা ফাইন কাগজে মোড়া সুন্দর একটা নাইটি, যেটা বিদেশ থেকে কেনা বলেই মনে হয়েছিল জুনির। শাশুড়ির কথা শুনে জুনির গাল, কান সব লাল হয়ে উঠেছিল।

অবশ্য সৌমেন ভালোবাসার পাকদণ্ডি বেয়ে খুব যত্ন করে ধৈর্য্য সহকারে জুনিকে চলতে শিখিয়েছিল। সৌমেনের বাড়ির আদবকায়দা, রীতি-রেওয়াজ, পোশাক পরার ঢং একেবারেই জুনির বাপের বাড়ি থেকে আলাদা ছিল। ধীরে ধীরে জুনি নিজেকে শ্বশুরবাড়ির আদলেই ঢেলে সাজিয়ে তোলে।

একমাস পরে যখন ও বাপের বাড়ি কয়েকদিনের জন্য থাকতে এল, সকলে ওকে দেখে অবাক হয়ে গেল। নিজেদের বাড়ির মেয়েকেই যেন চেনা যাচ্ছে না। অতি সাধারণ থেকে রাজেন্দ্রানী। শুঁয়োপোকার খোলস ত্যাগ করে যেমন পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতির আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু এই নতুন ডানা নিয়ে কতদিন সে উড়তে পারবে, সেটা তখনও সকলের অজানাই ছিল।

শ্বশুরবাড়ি ফিরে আসতেই টিকিট কাটাই ছিল, সৌমেনের সঙ্গে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াবার জন্য বেরিয়ে পড়ল জুনি। মোট দুই মাসের টুর। দেখতে দেখতে দিনগুলো যেন পার হয়ে গেল। জুনির কাছে এটা রূপকথার সফর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ও আর সৌমেন। প্রথম মদ্যপান বিদেশেই। তখন ও বুঝতেও পারেনি এই আসক্তি ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে একদিন অভ্যাসে পরিণত হবে।

বাড়িতে ফিরে প্রথমেই খেয়াল করল, ওর বাড়ি থেকে আনা পুরোনো জামাকাপড় আর একটাও নেই। সবই আধুনিক পোশাকে বদলে ফেলা হয়েছে। শাশুড়ি একটা ফর্দ তৈরি করে জুনির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এ বাড়ির বউ, মেয়েের এগুলো শিখে রাখাটা অত্যন্ত জরুরি। আমি ব্যবস্থা করে দিয়েছি, কাল থেকেই শুরু করো।

অগত্যা দুই-তিন মাস ধরে চলল ড্রাইভিং, সুইমিং, ঘোড়ায় চড়া সবকিছু শেখার পালা। জন্মদিনে উপহার হিসেবে গাড়ি কিনে দিল সৌমেন। নিজে ড্রাইভ করে বাপের বাড়ি পেঁছোলে, জুনির মা-বাবা মেয়ের ভাগ্য দেখে, আনন্দে কেঁদেই ফেললেন।

স্বাভাবিক ভাবেই ভগবানের আশীর্বাদ বলেই মেনে নিলেন জুনির কপালকে। এত ভালো শ্বশুরবাড়ি আজকালকার দিনে ক’টা মেয়ের ভাগ্যে জোটে? বাড়ির বউকে এতটা স্বাধীনতা কে দেয়? সৌমেনের মা-বাবা মেয়েবউয়ের মধ্যে তফাত করতেন না। কিন্তু জুনির মনে হতো স্বাধীনতার উপর সকলের মৌলিক অধিকার রয়েছে। স্বাধীনতা দেওয়ার কী আছে? এটা আবার কেউ কাউকে দেয় নাকি? আধুনিক জীবন কাটাবার জন্য জুনির সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল ঠিকই কিন্তু কিছু শর্ত এবং নিয়মের গণ্ডিও মেনে চলতে হতো। মনে মনে নিজেকে পুরো স্বাধীন বলে ভাবতে পারত না জুনি। বিয়ের পাঁচ বছর পরে আজও পারে না। পার্লারে বেঞ্চটাতে শুয়ে ব্যঙ্গের হাসি ফুটে ওঠে জুনির ঠোঁটের কোণায়।

পার্লার থেকে বেরিয়ে রাস্তায় রোল কিনে খেতে ইচ্ছে করল। কিন্তু মনে পড়ল ডায়েটিশিয়ান এইসব ফাস্টফুড খেতে একেবারে বারণ করে দিয়েছেন।

বাড়ি ফিরে বিস্বাদ সেদ্ধ খাবার কোনও মতে গলা দিয়ে নামিয়ে নিজের ঘরে চলে এল জুনি একটু আরাম করতে।

সন্ধেবেলায় একটা সোশ্যাল ফাংশনে যাওয়ার কথা শাশুড়ির সঙ্গে। শাশুড়ির জন্য একটা বক্তৃতাও তৈরি করার কথা। সেটা করতে করতেই পাঁচটা বেজে গেল। ইচ্ছে করছিল একটু কফি খাবার। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই রান্নার ঠাকুর এসে এক গেলাস কিছু পানীয় ধরিয়ে দিল জুনির হাতে, এটা খেযে নাও দিদি। মা বলেছেন রাঙাআলু আর গাজরের রসটা বিকেলে চায়ের বদলে তোমাকে দিতে।

বাধ্য হয়ে ওষুধের মতো খেয়ে নিয়ে জুনি তৈরি হতে ঘরে চলে এল।

পেস্তা রঙের একটা জামদানি শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে পান্নার একটা হালকা সেট বেছে নিল। কপালে বড়ো একটা টিপ পরে, আয়নায় নিজেকে দেখে সন্তুষ্ট হল।

গাড়িতে বসে রাস্তায় যেতে যেতে বক্তৃতা পুরো পড়ে শাশুড়িকে বুঝিয়ে দিল।

ফাংশনে কিছু ভালো লাগছিল না জুনির। সে কলমের জোরে বক্তৃতাটা তৈরি করেছিল ঠিকই কিন্তু মনে মনে জানত মনের কথা কলম দিয়ে শুধু নয়, হৃদয় দিয়ে লিখতে হয়। বক্তৃতার বিষয়টা ছিল, আমার অধিকারের প্রাধান্য বেশি, নাকি পরিবারের প্রতি দায়িত্বের…

হনিমুন থেকে ফেরার পর জুনির শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছিল না। সৌমেনের, প্রেমে তখনও হাবুডাবু খাবার অবস্থা। জুনিকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল হতে দেয় না। এক প্রকার জোর করেই সৌমেন জুনিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ফ্যামিলি ডাক্তার, জুনিকে পরীক্ষা করেই বললেন, সৌমেন মিষ্টির ব্যবস্থা করো, নতুন সদস্য আসতে চলেছে।

লজ্জায় জুনির গাল লাল হয়ে উঠল কিন্তু সৌমেন খুব খুশি হয়েে বলে মনে হল না। গাড়িতে বসতেই বলল, ওষুধ যেটা দিয়েিলাম ঠিকমতো খাওনি নাকি?

জুনি ভেবে উত্তর দিল, মনে হয় যে রাতে তোমার সঙ্গে বসে হুইস্কি খেয়েছিলাম… একটু জোরেই বলে ওঠে সৌমেন, হাউ ক্যান ইউ বি সো ইরেসপন্সিবল?

জুনি চুপ হয়ে গিয়েছিল। পুরো রাস্তা আসতে আসতে ভাবছিল হয়তো সৌমেন নতুন দায়িত্ব নিতে ঘাবড়াচ্ছে। জুনিও মাতত্বের স্বাদ পেতে পাগল হয়ে উঠেছিল এমনটাও নয়। কিন্তু যে আসতে চলেছে তাকে অস্বীকার করার ইচ্ছে জুনির ছিল না।

বাড়ি ফিরে চায়ে চুমুক দিতে দিতে সৌমেন মা-কে সব কিছু খুলে বলতেই, জুনির মনে হল শাশুড়ির মুখে বিদ্রুপের ভাব ফুটে উঠল। তিনি ব্যঙ্গ করেই বললেন, মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েদের নিয়ে এই এক মুশকিল। অবশ্য এদের কাছ থেকে কী-ই বা আশা করা যায়। বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই ছেলেপুলের মা হয়ে বসা।

জুনির চোখে জল চলে এল। সৌমেন সেটা উপেক্ষা করেই বলল, বাচ্চা নেব কি নেব না, সেটা আমাদের দুজনেরই সম্মতিতে হওয়া উচিত। আমার অজান্তেই এতসব ঘটেছে এটা সত্যিই দুঃখের। কিন্তু এই দায়িত্ব নিতে আমি এখন তৈরি নই। এখন তো সবে জীবন শুরু করেছি।

অ্যাবর্শন-এর ঘটনাই প্রথম জুনির চোখ খুলে দিল। ও বুঝতে পারল ডানা তাকে দেওয়া হয়েে ঠিকই কিন্তু কতটা সে উড়বে সেটার রিমোট কন্ট্রোল তার শ্বশুরবাড়ির হাতে রয়েছে।

নার্সিংহোমে সবকিছুই ঠিক ভাবে হয়ে গেল। শরীরে কোনও ব্যথাই বোধ করল না জুনি। কিন্তু মনের ভিতরের ক্ষতটা দগদগে হয়ে উঠল। কেউ জানল না জুনির যন্ত্রণার কথা। ও কাকেই বা বলবে? এই ভাবে প্রথম ঘটনা, দ্বিতীয় ঘটনা, ঘটনাগুলো ভিড় করতে শুরু করল জুনির মনে। রোজই নতুন নতুন রং ঢেলে সাজানো হতো জুনির পাখা দুটোতে কিন্তু কেউই একবারের জন্যও জুনিকে জিজ্ঞেস করত না, রংগুলো আদৌ তার পছন্দ কিনা।

অথচ সবার চোখে জুনির মতো ভাগ্যবতী অন্য কোনও মেয়ে নজরে আসত না। সবার শ্বশুরবাড়িতেই নানা রকমের নিষেধ মানামানির ব্যাপার থাকে। অথচ জুনির কাছে আধুনিক পোশাক থেকে শুরু করে দেশবিদেশ ঘোরা, নিজের পছন্দ মতন কাজ করা, দামি পার্লারে গিয়ে রূপচর্চা করানো এত স্বাধীনতা কোন শ্বশুরবাড়ি থেকে দেয়? জুনির এই সুখ সকলের মনে ঈর্ষাই জাগাত।

বাপের বড়ি যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল জুনি। হালকা নীল রঙের চিকন কাজের সুতির সালোয়ার কামিজ পরেছিল সে। গলায় পাতলা একটা সোনার চেন আর হাতে দুটো করে সোনার চুড়ি। তৈরি হয়ে ঘরের বাইরে আসতেই মুখোমুখি হতে হল সৌমেন আর শ্বশুরমশাইযে।

একী জুনি! এই পোশাকে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ? ভালো শাড়ি কি নেই? হতভম্ব হয়ে জুনিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন শ্বশুরমশাই।

সৌমেনও বাবার সঙ্গে গলা মেলাল, বাবা ঠিকই বলেছে। ভদ্র পোশাকে যাও, এটা পরার মতো পোশাক হল? বম্বের কলানিকেতন থেকে যে-শাড়িটা কিনে দিয়েিলাম সেই সিল্কটা পরে যাও। যাও চেঞ্জ করে এসো।

কলের পুতুলের মতো জুনি আবার নিজের ঘরে চলে এল। সৌমেনের দেওয়া প্রত্যেকটা শাড়ি যেমন দামি তেমনি সুন্দর। কিন্তু জুনি কাউকে এটা বোঝাতে পারে না, এত দামি শাড়ি আর দামি দামি গয়না ওর আর বাপের বাড়ির সকলের মধ্যে একটা দেয়াল তুলে দেয়। ওর এই দামি শাড়ি, গয়না দেখে তাদের মনে একটা হীনম্মন্যতা জন্ম নেয়। প্রাণখুলে কেউই তেমন আর কোনও কথা বলতে পারে না।

গলির মুখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে জুনি পা টিপে টিপে বাড়ির ভেতর ঢোকে। জুনির মা ঠিকই টের পান মেয়ে আসা, কী রে জুনি, তুই এলি?

জুনি আবার সেই পুরোনো জুনি হয়ে ওঠে, উফ মা তুমি কী করে বুঝতে পারো বলো তো?

রান্নাঘরে এসে ঢোকে জুনি। মা রান্নায় ব্যস্ত। হাত ধুযে একটা প্লেট নিযে রান্না করে রাখা ছানার কোফতা তুলে খেতে শুরু করে দেয়।

জুনি, সাবধানে খা। এত দামি শাড়ি, একটু ঝোল পড়লেই শাড়িটা খারাপ হয়ে যাবে, মা সাবধান করলেন জুনিকে।

মা আর জুনির গলার আওয়াজ পেযে আরও দুই বোন এসে রান্নাঘরে ঢুকল। দিদি ফোড়ন কাটল, সেই ভালো জুনি, তুই ডাইনিং টেবিলে বসে কাঁটা-চামচ দিয়ে বরং খা। মা আমরা তো আছি বাসন ধুযে রান্নাঘর পরিষ্কার করার জন্য।

ছোটোবোন বলল, দি, তোকে কী দিই বলতো পা রাখার জন্য? তোর মাটিতে পা একেবারে মানায় না।

জুনি ওদের বক্রোক্তি গায়ে মাখল না। প্লেট-টা ধুযে বলল, চল, বাচ্চাগুলোর জন্য খেলনা নিযে এসেছি, দিয়ে দিই।

বিদেশ থেকে আনা খেলনাগুলো দুই বোনের ছেলেমেয়েের মধ্যে ভাগ করে দিল জুনি। ছোটো বোন হেসে বলল, দি, এত দামি দামি খেলনা প্লিজ আনিস না। খারাপ হয়ে গেলে আমরা ঠিকও তো করতে পারব না।

জুনি কী করে বলবে, সৌমেনের পছন্দ করা এসব খেলনা। জুনির কথা ওখানে কে শুনবে?

খেতে বসে মায়ের হাতের কচু শাক, লাউয়ে ঘন্ট, ছানার কোফতার ডালনা আর মাংস গোগ্রাসে জুনিকে খেতে দেখে মা হেসে ফেললেন। বললেন, কী রে শ্বশুরবাড়িতে খেতে দেয় না বুঝি? দেশবিদেশের কত রকমের খাবার খেযে বেড়াস। ওগুলো খেয়ে তোর মন ভরে না বুঝতে পারছি।

রাতটা মায়ের কাছে কাটাবারই কথা বলে এসেছিল জুনি। কিন্তু ঠিক সন্ধেবেলায় সৌমেনের ফোন এল, বড়ো পিসিমা হঠাত্ এসেছেন, তোমাকে বাড়ি চলে আসতে হবে। আমি ড্রাইভার পাঠিয়ে দিচ্ছি। ফোন রেখে দিল সৌমেন।

ড্রাইভার এসে বেল দিতেই জুনি দরজা খুলে দিল। ড্রাইভারের হাত দিয়ে শাশুড়ি সবার জন্য জামাকাপড় আর প্রচুর মিষ্টি পাঠিয়েছেন দেখল জুনি। বোনেদের হাতে উপহারগুলো তুলে দিতে দিতে জুনি স্পষ্ট বুঝতে পারল আনন্দে, লোভে ওদের চোখ চকচক করছে। জুনির ঠোঁটের মলিন একটুকরো হাসিটা সকলের চোখ এড়িয়ে গেল। মা কিছুটা ধরতে পারলেন ঠিকই, ইচ্ছে হল মেয়ে গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করেন, হ্যাঁ রে তুই ভালো আছিস তো জুনি? কিন্তু পরক্ষণেই দামি শাড়ি, জামাকাপড়, মিষ্টির মোহ তাঁরও চোখকে পর্দার আস্তরণে ঢেকে দিল।

জুনি ভালো মতোই জানত সৌমেন আর ওর মা-বাবা কিছুতেই ওকে বাপের বাড়িতে রাত্রিবাস করতে দেবে না।

বাড়ি ঢুকতেই শাশুড়ি জড়িয়ে ধরলেন জুনিকে, সৌমেনের পিসিমা তোমাকে দেখবেন বলে একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছেন। তাড়াতাড়ি শাড়ি বদলে বসবার ঘরে এসো।

জুনি আবার শাড়ি বদলে বসবার ঘরে ঢুকে পিসিমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। জুনির মাথা থেকে পা অবধি পর‌্যবেক্ষণ করলেন পিসিমা, ভালো খবরটা কবে দিচ্ছ? খাওয়াদাওয়া করো ঠিকমতন?

সোফায় এসে বসল জুনি। এবার পিসিমা এসে পাশে বসে হাত দিয়ে জুনির মুখটা তুলে ধরলেন, বললেন, বাঃ শ্বশুরবাড়ির রং তো দেখছি ভালোই লেগেছে তোমার গায়ে এখানকার সুখসুবিধে পেয়ে কেমন লাগছে তোমার?

চুপচাপ বসে রইল। কী উত্তর দেবে বুঝে ঠিক করতে পারল না জুনি।

রাতে মদ্যপান করতে করতে সময়ে খেয়াল ছিল না জুনির। চোখ বুজে আসছিল। গেলাস ভর্তি এই পানীয়টাই একমাত্র ওকে শান্তি দিতে পারে। আলাদা জগতে বিচরণ করতে পারে, যেখানে সে ছাড়া আর কেউ থাকে না। নিজের ইচ্ছেমতন যা খুশি করতে পারে।

সকালে যখন ঘুম ভাঙল জুনির তখন বাইরে রোদ ঝলমল করছে। সৌমেন অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছিল। জুনিকে দেখে বলল, এত কেন খাও যখন ওটা তোমার সহ্য হয় না?

মৃদু হাসল জুনি, তাহলে পান করার কী অর্থ নেশাই যদি না হল তো…

একাকিত্ব আর শূন্যতা ধীরে ধীরে জুনিকে গ্রাস করতে আরম্ভ করল। কিন্তু বাইরে থেকে কেউই সেটা বুঝতে পারল না। সে নিজের মতো করে জীবনটাকে বোঝার চেষ্টা করছিল কিন্তু সেটা কারওরই বোধগম্য হচ্ছিল না।

একদিন জুনি সৌমেনকে বলল, আমিও তোমার সঙ্গে অফিস যেতে চাই। সৌমেন খুশিই হল। ও রাজি হয়ে গেল। জুনি রোজ সৌমেনের সঙ্গে অফিস যেতে আরম্ভ করল। কিন্তু ওখানেও তার বিশেষ কিছুই করার ছিল না। দাবার ঘুঁটির মতো জুনির অবস্থা। এক কথায় বলতে গেলে সবকিছুই তার কিন্তু কোনও কিছুই যেন তার নিয়ন্ত্রণে নয়।

মরুভমির মতো হয়ে উঠল জুনির জীবনটা। জায়গায় জায়গায় মরীচিকা দেখা গেলেও জল কোথাও নেই সুতরাং তেষ্টা মিটবে কী করে? কয়েক মাস পরে নিজেই অফিস যাওয়া ছেড়ে দিল। অফিসে ওর পরিচিতি বলতে একটাই ছিল, সৌমেনের ওয়াইফ।

সৌমেনের কাকার ছেলের বিয়েতে বাড়িশুদ্ধু সবাই উপস্থিত ছিল। ককটেল পার্টি চলছিল। লাল রঙের অফ শোল্ডার গাউন আর রুবির গয়নার সেট-টায় অপরূপা হয়ে উঠেছিল জুনি। হালকা মিউজিকের সঙ্গে সকলেই ডান্স করছিল। কারও কারও হাতে গেলাস। দুটো পেগ আগেই খাওয়া হয়ে গিয়েিল জুনির। সৌমেনকে জড়িয়ে ধরল সে। কানের কাছে মুখ নিযে এসে বলল, সৌমেন আমি উড়তে চাই, আমাকে খাঁচায় বন্ধ করতে চেও না। আমি একটা সাধারণ মেয়ে আমাকে অসাধারণ করে তোলার জেদ ছেড়ে দাও।

কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই সৌমেন খেয়াল করল ডান্স ফ্লোরে প্রায় সকলেরই চোখ ওদের উপর। জুনি কথাগুলো আস্তে বলতে চাইলেও আশেপাশে সকলের কানেই পেঁছেছে কথাগুলো। আরও কিছু না বলে বসে, এই ভয়ে সৌমেন ওর হাত ধরে একটু জোর করেই বাইরে এনে গাড়িতে তুলে দেয়। তারপর সোজা ড্রাইভ করে বাড়ি চলে আসে। সারারাত সৌমেনের ঘুম আসে না। কেন জুনি এরকম বলল? কী অভাব রেখেছে সৌমেন? কোথায় ভুল করে বসল সে? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতে লাগল বারবার সৌমেন।

সকালে জুনি ঘুম থেকে উঠতেই সৌমেন জিজ্ঞাসা করল, তুমি সত্যি করে কী চাও জুনি? সবাই তোমার মতো জীবন পেতে চায় অথচ তোমার কাছে এরকম জীবনের কোনও কদরই নেই।

কী উত্তর দেবে জুনি? শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জানলার বাইরে। মনের মধ্যে তোলপাড় হতে থাকল, সত্যিই কি বাস্তবে জুনি এমনটাই চেয়েছিল?

সোশ্যাল ফাংশন অ্যাটেন্ড করা, এলিট ক্লাবের মেম্বার হয়ে সৌমেনের সঙ্গে পার্টি অ্যাটেন্ড করতে যাওয়া, কোনও অনুষ্ঠানে অতিথির আসন অলংকৃত করতে শাশুড়ির সঙ্গে সেখানে গিয়ে বসে থাকা, পার্লার যাওয়া নয়তো শপিং আর নয়তো বাড়িতে চুপচাপ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা। এটাই জীবন হয়ে উঠেছিল জুনির। জীবনের সব রং হারিয়ে গিয়েছিল তার জীবন থেকে।

তখনই একদিন খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ে। স্থানীয় কলেজে লেকচারারের পোস্ট। ইতিহাসের লেকচারার চাইছে। যে-বিষয়ে ও নিজে পড়াশোনা করেছে। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই আবেদন পাঠাল। সাক্ষাত্কারও চুপচাপ দিয়ে এল। জয়েনিং লেটার হাতে পেয়ে সৌমেনকে জানাল। সৌমেন বাড়ির সবাইকে।

রাতদিন হাজার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো জুনিকে।

কী দরকার ছিল এরকম চাকরি নেওয়ার। পদে পদে, যেখানে ধাক্কা খেতে হবে?

যা রোজগার হবে তার থেকে বেশি টাকা পেট্রোলেই চলে যাবে?

রোদে বৃষ্টিতে সেই দৌড়ঝাঁপ করতে হবে, তখনই বুঝতে পারবে কত ধানে কত চাল। চাকরি করার যখন এতই শখ নিজেই যাওয়া আসা করবে আর নিজের খরচ নিজেই চালাবে।

এরকম হাজারো শব্দবাণ রোজ জুনির উপর বর্ষাতে আরম্ভ করল বাড়িতে। আর চুপচাপ মুখ বুঝে সব সহ্য করতে থাকল জুনি। ভুল তো করেছিল প্রথম থেকেই। ওড়বার জন্য দুটো ডানার রিমোট কন্ট্রোলটা স্বামী আর শ্বশুর-শাশুড়িকে দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু আর নয়। নিজের উড়ান এবার সে নিজেই ঠিক করবে। মুখ থুবড়ে পড়লেও আবার উঠে দাঁড়াবে। জীবনের রামধনু রং-কে নিজের চোখে পরখ করতে উতলা হয়ে উঠেছিল জুনি।

পার্লার থেকে বেরোতে বেরোতে জুনি ভাবছিল, রাস্তা যখন আমার তখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও আমার। আমার ছোটো ছোটো স্বপ্নপূরণ করাটাই আমার মনের একান্ত ইচ্ছা। এটাই আজ থেকে সত্যি আমার জীবনে। নিজের মনের ভেঙে পড়া ডানা দুটোকে আবার জোড়া লাগাতে তত্পর হয়ে উঠল জুনি। এখনও অনেকটা পথ যাওয়া বাকি!

সং অফ দ্য সিগাল

‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল…’

সময়টা এখন ডিসেম্বরের শেষ। সাড়ে দশটার নরম হলুদ সকাল। ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেলের সামনে থাকা সুন্দর করে সাজানো লনে এসে বসেছি। সামনে আদিগন্ত নীল, শুধু নীল জল। গোপালপুর অন সি-তে আসার ইচ্ছা আমার অনেক দিনের।

‘বাবাই, ফুল ছেঁড়ে না’, চেঁচিয়ে ওঠে সুমি, ‘ওঃ, এই এক ছেলে হয়েছে, এত অসভ্য! আমি আর পারি না। রাকেশ, এই রাকেশ, দ্যাখো তোমার ছেলে একটুও কথা শোনে না।’

টঙ্কাস ততক্ষণে টবের গাছ থেকে বেশ কয়েকটি ফুল ছিঁড়ে, মুঠোয় ভরে হাসছে। ওর চোখে-মুখে দিব্যতা, দুষ্টুমি ঝরে পড়ছে।

ভায়রা রাকেশ সকলের সঙ্গে সেলফি তুলে বেড়াচ্ছিল। ছুটে এসে ছেলের মাথায় সাঁটিয়ে কষাল এক উড়ন-চাঁটি। তাতে বছর ছয়েকের টঙ্কাস একটু থতমত খেয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকাল, তবে কাঁদল না। মাথার পিছনে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে ঘটনার গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করতে লাগল সম্ভবত। ও মোটেও ছিঁচকাঁদুনে নয়। তবে খুব দুরন্ত।

রাকেশ চোখ পাকিয়ে বলে উঠল, ‘তোমাকে কতবার বারণ করা হয়েছে অসভ্যতা না করতে।’

পরিস্থিতি সামাল দিতে আমি এগিয়ে গেলাম।

ওদিকে মেয়েরা হোটেলের লনে বিভিন্ন পোজে বিভিন্ন পজিশনে কখনও একক, কখনও বা যৌথ ভাবে ফটো তুলতে ব্যস্ত। খেয়াল নেই, সকলেই প্রায় ঘরোয়া পোশাকে রয়েছে।

হোটেলের নাম ‘সং অফ দ্য সিগাল’।

নামটি শুনলেই সমুদ্রের ফেনার মতন হালকা হয়ে যায় মন। নীল জল যেখানে বালির সীমানা ছুঁয়েছে তার ওপর উড়তে থাকা শঙ্খচিলগুলোর ডাক বুঝি শোনা যায় বুকের গভীরে।

অসীম আর হরলালদা এগিয়ে আসে আমার দিকে। ওরা আমাদের খানিক পর ব্রেকফাস্ট সেরে বেরোল। হরলালদা কাছে এসে বলল, ‘আরে শালাবাবু, একটু ধূমপান চলবে নাকি?’

‘চলো, ওদিকটায় গিয়ে বসি’, বলে আমি ওদের হোটেলের গাড়িবারান্দার কাছাকাছি নিয়ে গেলাম। কয়েকটি চেয়ার টেনে বসলাম তিনজন। তারপর সিগারেট ধরালাম।

বললাম, ‘গতকাল ইস্টকোস্ট এক্সপ্রেস লেটে চলছে জেনে দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম। সঙ্গে বাচ্চা-কাচ্চা, মেয়েরা। কারণ, শুনেছিলাম গোপালপুর জায়গাটা পুরীর মতন অত জমজমাট নয়, বেশ ফাঁকা ফাঁকা।’

অসীম বলল, ‘কী আর এমন লেট করল ট্রেন? শেডিউলড টাইম ছিল দশটা পঞ্চাশ। তার জায়গায় ট্রেন ব্রহ্মপুর স্টেশনে ঢুকল সাড়ে এগারোটায়। এতেই লেট বলছ?’

‘মালপত্তর নিয়ে স্টেশন ছেড়ে বেরোতে বেরোতে আরও আধ ঘন্টা’ বলল হরলালদা, ‘আরে তুমি তো রেল কোম্পানির লোক, কোম্পানির দোষ কি আর চোখে দেখতে পাবে? কী বলো, গৌতম?’ আমার সাপোর্ট চায়।

হরলালদা সম্পর্কে অসীমের বড়ো ভায়রা হয়। ফলে সুযোগ পেলে লেগপুল করতে ছাড়ে না।

‘হ্যাঁ, সে আর বলতে’, বললাম আমি তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আবির কোথায় গেল? ওদের কি এখনও ব্রেকফাস্ট শেষ হয়নি?’

‘তোমার হ্যান্ডসাম ফ্রেন্ডকে দেখলাম এই হোটেলের মালকিনের সঙ্গে কী একটা বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন’, হরলালদা জবাব দিল।

আমি হরলালদার চোখের দিকে তাকালাম সরাসরি। ওর কথার শেষ দিকে কীসের যেন ইঙ্গিত কানে বাজল। আর মুহূর্তেই বিশালজির মিসেসের ছবিটা মাথার মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠল।

গতকাল রাতে ব্রহ্মপুর স্টেশন থেকে হোটেলে পৌঁছোতে খুব বেশি যে সময় লেগেছিল তা নয়। ট্রাভেল এজেন্ট শুভজিৎ চৌধুরি স্টেশনে দুটি গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। রাত দশটা থেকেই ড্রাইভাররা আমাদের সঙ্গে কনট্যাক্ট রাখছিল। ফলে ব্রহ্মপুর পৌঁছে গাড়ি পেতে অসুবিধা হয়নি আমাদের। সতেরো কিলোমিটার দূরত্ব। গভীর রাতের ফাঁকা রাস্তায় আসতে বড়ো জোর আধ ঘন্টাটাক। তবে এখানে তখন রাত নিশুতি।

হোটেলে পৌঁছে মেন গেটে নক করতে বিশালজি দুটি রুম-বয়কে নিয়ে এগিয়ে এলেন। হোটেলে পা রাখতেই দেখলাম বাঘের মতন বিশালকায় কালো কুকুর একবারে চেন বাঁধা অবস্থায় আমাদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। আমরা পাঁচটি পরিবার নির্দিষ্ট পাঁচটি রুমে প্রবেশ করলাম। ছেলে দুটি আমাদের লাগেজ পৌঁছে দিল প্রত্যেকের রুমে। খাওয়া-দাওয়া ট্রেনেই সেরে এসেছিলাম। ফলে শীতের রাতে বেশি দেরি না করে যে যার মতন শুয়ে পড়লাম।

চিরকালের লেট রাইজার আমি। সাড়ে আটটা নাগাদ দরজায় ঠকঠক করে নক। অনিতাকে বললাম, ‘দ্যাখো তো, কে।’

দরজা খুলে ও দ্যাখে আমার পিসতুতো বোন বুলা। ওরা ব্রেকফাস্ট করতে ডাইনিং রুমে যাচ্ছে তা জানাতে এসেছে। ওদের এগোতে বলে অনিতা ঘুম থেকে ডেকে তুলল ফুলকে।

কিছুক্ষণের মধ্যে তৈরি হয়ে আমরা ডাইনিংয়-এ গেলাম। দেখলাম সেখানে কল্পনাদি, ওর হাজব্যান্ড হরলালদা, বুলা, ওর হাজব্যান্ড অসীম, ওদের কন্যা মাম, আমার বন্ধু আবির, ওর স্ত্রী ইরা, রাকেশ, ওর স্ত্রী সুমি ওদের ছেলে-মেয়ে নিয়ে সকলেই উপস্থিত এবং পাশাপাশি তিনটি টেবিল ভরে একদম হইচই জুড়ে দিয়েছে।

আমরা যেতে আর এক প্রস্থ শোরগোল উঠল।

ব্রেকফাস্ট সেরে আমিই প্রথম বেরিয়ে এসে লনে বসেছিলাম। একে একে সবাই আসতে লাগল।

ফটো তোলা শেষ করে রাকেশ এসে বলল, ‘যাই বলো গৌতমদা, হোটেলটা কিন্তু একঘর। প্রত্যেকেই সি-ফেসিং রুম পেয়েছে।’

বললাম, ‘চৌধুরি-কে সেরকম ব্যবস্থা করতেই বলেছিলাম।’

হরলালদা বলে উঠল, ‘দেখলে তো, তোমরা হোটেল বুক করলে ট্রাভেল এজেন্ট ধরে। আমি করলাম নিজে। তাও আবার তোমাদের থেকে পাঁচশো টাকা কম রেটে।’

‘তুমি যদি আগে থেকে জানাতে এখানে বেড়াতে আসবে তা হলে তোমার জন্যও ঘর বুকিং করতে বলতাম’, বললাম আমি।

‘আমি কী করে বলব? অসীম তো সব ব্যবস্থা পাকা করে তারপর আমাকে জানাল যে তোমরা গোপালপুর যাচ্ছ।’

‘এই লালদা, একদম বাজে কথা বলবেন না কিন্তু। আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম যে আমাদের গোপালপুর যাওয়া একদম ফাইনাল। গৌতম আর রাকেশ সব ব্যবস্থা করছে। আপনি তখন কী বললেন?’

‘কী বললাম?’

‘বললেন, আরে তোমাদের ব্যবস্থা আগে করো তো দেখি। ওরকম যাবার প্ল্যান-প্রোগ্রাম অনেক হয়। তারপর সব কেঁচিয়ে যায়।’

‘যাকগে ওসব, ট্রেনের টিকিট থেকে শুরু করে হোটেল বুকিং, তাও আবার একই হোটেলে পাশাপাশি রুমে থাকার ব্যবস্থা করলাম। তোমাদের থেকে কম রেটে। এবার তো তোমরা আমাকেই গুরু বলে মানবে!’

হরলালদার মুখে সাফল্যের হাসি।

রাকেশ বলে, ‘আচ্ছা গৌতমদা, এটা কীভাবে হয়? আমরা যে রুম দু-হাজার টাকা করে পার ডে-তে থাকছি, লালদারা সেই এক রুম দেড় হাজারে থাকছে কী করে?’

‘তোরা কি চৌধুরি-কে ব্যবসা-ট্যাবসা করতে দিবি না?’ বলতে বলতে আবির এসে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। পরনে একটি গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি, আর আকাশি জিন্স।

ওর পিছন পিছন স্ত্রী ইরা। ইরা মহিলাদের দিকে এগিয়ে গেল।

রাকেশ বলল, ‘ব্যবসা বলে ব্যবসা? আমাদের চার-চারটি ফ্যামিলি চারদিন থাকবে পাঁচশো টাকা করে বেশি রুম রেন্ট দিয়ে?’

হরলালদা হাসতে হাসতে বলল, ‘বাকিটা শুনবে? তোমাকে এমন একটা খবর দেব যে গায়ে এক্ষুনি ফোসকা পড়ে যাবে।’

সবাই হরলালদার দিকে তাকাল।

একটু থেমে ও বলল, ‘আমার এক বন্ধু ফ্যামিলি নিয়ে আজ সন্ধ্যায় আসছে। ওরাও এই হোটেলেই উঠবে। ওদের জন্যও ঘর বুক করেছি আমি। একই রেটে, দেড় হাজার।’

চোখ-মুখ দেখে মনে হল, এবার বেশ রেগে গেল রাকেশ। বলল, ‘আমি যাচ্ছি, এক্ষুনি এর একটা হেস্তনেস্ত করা দরকার।’

অসীমও বলল, ‘ঠিকই তো, এটা ঘোরতর অন্যায়।’

আবির বলল, ‘বাহ্, বেশ জমেছে তো ব্যাপারটা। তবে কী জানেন অসীম, হোটেল মালিক বলবে, আপনারা আপনাদের ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিন।’

অসীম বলল, ‘গৌতম, চৌধুরি-কে একবার ফোন লাগাও তো। দেখি ও ব্যাটা কী বলে। আমাদের এত পয়সা চোট যাবে?’

বললাম, ‘শোনো, চুপচাপ মাথা ঠান্ডা করে বোসো সবাই। একটিবার ভাবো তো, চৌধুরি যদি ট্রেনের টিকিট বুক করে না দিত এই গোপালপুর ট্যুর তোমাদের হতো? তোমার ট্রাভেল এজেন্টকে তুমি বললে, সে বলল, বড়ো জোর তিনটে টিকিট ম্যানেজ করতে পারবে। রাকেশের এজেন্ট বলল, চারটে কনফার্মড, দুটো আরএসি। তার বেশি সম্ভব নয়। আবির বলল, ও এ সবের মধ্যে নেই, সব দায়িত্ব আমাদের। তোমাদের এক এজেন্ট বলল, ট্রেনের টিকিটে পার হেড আড়াইশো করে নেবে, আর একজন বলল, দুশো করে। অপরদিকে চৌধুরি কী করল? সক্বলের টিকিট কনফার্মড, যাওয়া এবং আসা। পার হেড নয়, পার টিকিটে ও দেড়শো টাকা করে নিল। পরিবর্তে রুম রেন্ট থেকে কিছুটা কমিশন ম্যানেজ করল। চার দিনে পার ফ্যামিলি দু’হাজার টাকা। সেটা কি খুবই বেশি? ও তো ব্যবসা করতে বসেছে। আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা ঠিকঠাক করে দিয়ে ও যদি দুটো টাকা রোজগার করে এতে অভিযোগের তো আমি কিছু দেখি না।’

আমার কথায় সকলে কিছুটা শান্ত হল বলে মনে হল। বললাম, বেড়াতে বেরিয়ে অত লাভ-লোকসানের কথা ভাবলে চলে? সুবিধা-অসুবিধার কথাগুলি একবার ভাবো।’

‘থাক গে ওসব, ছাড়ো’, বলে হরলালদা, ‘একটু পর বসবে তো?’

অসীম বলল, ‘সে আর বলতে? গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছে। আবির?

আবির বলল, ‘ভাবছি স্নানে যাব।’

‘আরে স্নানে তো আমরাও যাব’, চেঁচিয়ে উঠল রাকেশ।

বললাম, ‘গোপালপুর সি-বিচ সম্বন্ধে কিন্তু যথেষ্ট বদনাম আছে। বেশ কয়েকটা দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে শুনেছি।’

হরলালদা বলল, ‘আরে আমরা বেশি দূরে যাবই না। দু-পেগ করে মেরে জলে নামব।’

বললাম, ‘যা ভালো বোঝো করো।’

অসীম বলল, ‘তুমি নেবে না ড্রিংকস?’

‘নাহ্, দিনের বেলা ড্রিংকস নিতে ভালো লাগে না আমার। রাতে দ্যাখা যাবে।’

আমি চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালাম।

আবির বলল, ‘আমি নেব, দু পেগ। ওনলি টু।’ আঙুল তুলে দ্যাখাল।

আমি আবিরের দিকে তাকালাম।

ও উঠে আমার কাছে এসে কানে কানে বলল, ‘তুই তো জানিস, মদ এবং মহিলা– পৃথিবীর কেবল মাত্র এই দুটি বিষয়ে আমার ভীষণ আগ্রহ।’

ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে একবার চোখ মেরে রহস্যময় হাসি হেসে ও চলে গেল।

রাকেশ বলল, ‘এই শোনো না, বিয়ার খেলে কেমন হয়? দুপুরবেলা বিয়ারই ভালো। না না, আমি বিয়ারই খাব।’

অসীম বলল, ‘যার যা খুশি খাও না, কে বারণ করেছে! আগে চলো, রেশনটা তো তুলে আনি।’

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার খানিক পর বিশালজির সঙ্গে ঘুরে ঘুরে আমি হোটেলের চারপাশটা দেখছিলাম। প্রায় দু’বিঘা জমির ওপর দোতলা এই হোটেল। হোটেলের সামনের লন সবুজ ঘাসের নরম গালিচায় ঢাকা। সামান্য উঁচু পাঁচিল যাতে লনে বসে সমুদ্র দেখার কোনও অন্তরায় না হয়। অসংখ্য টবে নানা ধরনের ফুল গাছ। বেশ কিছু নারকেল গাছও আছে এক পাশে। লনে একটি হলুদ, একটি সবুজ ও একটি আকাশি কাঠের হেলান দেওয়া চেয়ার আছে যাতে রীতিমতন শুয়ে শীতের নরম রোদ উপভোগ করা যায়, আছে বেতের কিছু চেয়ারও।

বিশালজি বললেন, ‘ইয়ে হোটেল ম্যায়নে এক বাঙ্গালিসাব-সে খরিদা থা। আজ সে লগভগ বাইশ সাল পহলে। উস টাইম এক হি ফ্লোর থা। দুসরা ম্যায়নে বানায়া।’

বললাম, ‘পহলেসেই আপ হোটেল বিজনেস মে থে?’

‘নাহি সাব, ভুবনেশ্বর মে মেরা দো বড়িয়া দুকান থা। এক ডোমেস্টিক স্টিল অ্যাপ্লায়েন্স কা, দুসরা গারমেন্টস কা। এক মে ম্যায় বৈঠতা থা, দুসরা মে মেরি বিবি বৈঠতি থি। শুরু শুরু মে ইয়ে হোটেল ম্যায়নে লিজ মে লিয়া থা। চার সাল বাদ খরিদ লিয়া।’

‘আউর উও দো দুকান?’

‘উও দোনো আভিভি হ্যায়। লেকিন কিরায়ে পে দে দিয়া। অ্যাকচুয়ালি ইয়ে জগহ মুঝে ইতনা আচ্ছা লগা। ইতনা কাম অ্যান্ড কোয়ায়েট, পলিউশন ফ্রি। সোচা কি এহি পে রহে জাউ।’ উনি মৃদু হাসলেন।

দেখলাম, হোটেলের বাউন্ডারি ওয়ালের সঙ্গে গোপালপুরের বিখ্যাত লাইটহাউস এরিয়া একদম অ্যাডজাসেন্ট। পাঁচিলের ওপারটাই সরকারি এলাকা। লাল-সাদা রঙের সুউচ্চ লাইটহাউসটি বেশ সুদৃশ্য। তবে জানতে পারলাম, লাইটহাউস ঘিরে থাকা কয়েক বিঘা জমিতে সরকারি লোকজন থাকলেও জনসাধারণের জন্য প্রবেশ একেবারেই নিষিদ্ধ।

এই ফ্যামিলি পরিচালিত হোটেলটি আদ্যন্তই বিশালজি, তার স্ত্রী এবং জনাদশেক আঞ্চলিক ছেলে নিয়ে চালান। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। খাবার-দাবার, রুম সার্ভিস, কোনও বিষয়েই অভিযোগ করার মতন কিছু নেই। ডিসেম্বর মাস, তাই হোটেলে বোর্ডার যথেষ্ট। দু’জন ফরেনারও দেখতে পেলাম।

হোটেল দেখে রুমে ফিরে এলাম। রুম থেকে পর্দা সরিয়ে কাচে ঢাকা সমুদ্রের দিকে তাকালে কেমন মায়াবী জগৎ বলে মনে হয়। অনিতা আর ফুল নীচে সুমিদের রুমে গেছে বোধ হয়।

আমি দরজা ঠেলে ব্যালকনিতে এসে বসলাম। হাত দশেকের মধ্যে একটি নারকেল গাছ। তারপর আরও একটি। লাইটহাউসের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ওরা।

ব্যালকনি থেকে কুড়ি-বাইশ ফুট দূরে হোটেলের সামনের সীমানা পাঁচিল। সেখানে হাত দশেকের চওড়া রাস্তা। তারপর ঢাল নেমে গেছে প্রায় আড়াই-তিন তলা বাড়ির সমান। ঢালের শেষপ্রান্ত থেকে শুরু হয়েছে সি-বিচ। সি-বিচ চওড়ায় প্রায় দু-আড়াইশো ফুট, সংকোচনশীল। মোট কথা, সমুদ্র চোখের একদম নাগালে। তার জলদগম্ভীর অপূর্ব কণ্ঠস্বর বেশ স্পষ্ট এবং জোরালো ভাবেই জানান দিচ্ছে তার অস্তিত্ব।

বালির ওপর চারটি বাঁশ গেঁথে নীল পলিথিন টাঙিয়ে ডাব বিক্রি করা হচ্ছে কিছুটা দূর অন্তর অন্তর। এখন বিচে লোকজন কম। বিকেলের দিকে বোধহয় বাড়বে।

দূরে ভেসে যাচ্ছে জেলে ডিঙিগুলি।

রোদে চকচক করছে দূরের জল। তীরে ক্রমাগত আছড়ে পড়ছে ঢেউ। বেশ কয়েকটি শঙ্খচিল মন্থর ডানায় ভেসে বেড়াচ্ছে, যাকে বলে গ্লাইডিং।

সমুদ্রের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকতে একটুও বোর লাগে না আমার। ঘন্টার পর ঘন্টা সমুদ্র দেখতে পারি আমি।

সামনের নারকেল গাছে একটি কাক উড়ে এসে বসল। বেশ কয়েকবার গলা ছেড়ে ডাকল। তারপর উড়ে গেল।

লাইটহাউসের শীর্ষে বিশালাকার ব্লেডটি ঘুরে চলেছে ক্রমাগত।

আমাদের ঠিক নীচের রুমটাই রাকেশদের। ওর ছেলে ছোটো, দুরন্ত। তাই গ্রাউন্ড ফ্লোরে রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুমি ওর ছ-মাসের মেয়েকে সামলাতে ব্যস্ত। মেয়েতো নয়, যেন একটি ফর্সা গোলগাল পুতুল। যে-দেখে সে-ই অবাক হয়ে যায়, বলে, ‘কি মিষ্টি দ্যাখো বেবিটা।’

ওদের কিছু কিছু কথাবার্তা লাফিয়ে উঠে আসছে দোতলায়। দেখলাম টঙ্কাস একাই একটি বলে লাথি মেরে চলেছে ক্রমাগত। রাকেশের চিৎকার শোনা গেল, ‘বাবাই, পাঁচিলের বাইরে যাবি না।’

হরলালদা, অসীম, আবির সবাই বোধহয় বিশ্রাম নিচ্ছে।

হঠাৎ কলিংবেল বাজলে আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। ফুল বলল, ‘বাবা, কাল নাকি আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট আউট হচ্ছে।’

‘তো, তাতে কী হল?’

‘উফ্, আমার কপালটাই খারাপ। একটু শান্তি নেই। এতদিন ধরে কোথাও কিছু নেই, যেই দুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছি অমনি উৎপাত। যাচ্ছেতাই একেবারে।’

দড়াম করে টয়লেটের দরজা বন্ধ করে দিল। একটু পর পা মুছে খাটে এসে বসল। একের পর এক বন্ধুকে শুরু হল ফোন করা।

বললাম, ‘চাপ নিস না, পাশ করে যাবি। তোর ওপর তো ফার্স্ট হবার কোনও দায় নেই। তোর মা কিংবা আমি কি কখনও দাবি করেছি যে তুই ফার্স্ট হয়ে দ্যাখা?’

‘তুমি কি একটু চুপ করবে? খুব মজা লাগছে তাই না?’

যা বাব্বা, কী কথার কী উত্তর। অনিতা মুচকি মুচকি হাসছিল। হাওয়া খারাপ দেখে খাটের ধার ঘেঁষে শুয়ে পড়লাম।

বিকেলে হোটেল থেকে বেরিয়ে খানিক এগিয়ে গেলাম আমরা দল বেঁধে। ভ্রমণার্থীদের জন্য গোপালপুরে বসার একমাত্র পার্কটি চোখে পড়ল। পার্কের এক পাশে পিচের রাস্তা। অপর পাশে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে সি-বিচে।

আমরা ছোটো ছোটো গ্রুপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলাম।

হরলালদা আর অসীম চা পান শেষে ধূমপানে মনোযোগ দিল।

রাকেশ ওর বাচ্চার বায়না মেটাতে কী যেন খেলনা কিনে দিচ্ছে। আমার মেয়ে আর মাম নিজেদের মধ্যে আড্ডায় মত্ত।

বাকিরা পার্কের মধ্যে থাকা উঁচু বেদিতে বালি-সিমেন্টে তৈরি মৎস্যকন্যার সঙ্গে ফটো তুলতে ব্যস্ত। অনেক উঁচুতে স্ট্রিট লাইট। মনে হল ফটো তোলার জন্য আলো যথেষ্ট নয়।

আবিরকে সে কথা বলাতে ও বলে উঠল, ‘ফ্ল্যাশ অন করে ফটো তোল।’

একটু পরে রাকেশ, আবির আর আমি সিঁড়িতে বসে সমুদ্রের হাওয়া খেতে খেতে চা-ওয়ালাকে ডাকলাম। বলল, লিকার চা, বিট নুন আর লেবু দেওয়া। বললাম, ‘ঠিক আছে তাই চলবে।’

চা খেতে খেতে গল্পগুজব চলছিল।

অসীম আর হরলালদা কাছাকাছি কোথাও গেছে। বোধহয় রাতের প্ল্যান-প্রোগ্রাম করছে।

রাকেশ বলল, ‘গৌতমদা, কাল আমি সুমিদের নিয়ে পুরী যাচ্ছি। তুমি তো জানো ছেলের নামে একটা পুজো দিতে হবে।’

আবির বলল, ‘সে কী, এই তো এলে গোপালপুর। এখনই পালাতে চাইছ?’

‘না-না, পালাতে চাইছি না, পুজো দেবার প্রোগ্রাম আমার আগেই ছিল। গৌতমদা জানে। কী গো তোমাকে বলিনি?’

‘হ্যাঁ, তা কাল কখন বেরোবে তোমরা?’

‘লাঞ্চ করে। রাত্রে পুরীতে থাকব। পরশু পুজো দেব। আশা করছি পরশু রাতেই ফিরে আসতে পারব।’

‘দু-দুটো বাচ্চা নিয়ে চাপ হয়ে যাবে না?’

‘আরে তুমি ভেব না। পুজো তো আমাদের সকালেই দেওয়া হয়ে যাবে। দুপুরে একটু তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়ব। তোমরা চিন্তা কোরো না। পরশু রাতের পার্টিতে অবশ্যই থাকছি।’

একটু দূর থেকে সুমি হঠাৎ ওকে ডেকে উঠল, ‘রাকেশ, এদিকে একটু এসো না।’

ও উঠে গেল।

দেখলাম রাকেশের ছেলে প্যাঁ প্যাঁ শব্দে বিচ্ছিরি এক বাঁশি ক্রমাগত বাজিয়েই চলেছে। ওর বয়সি দু-তিনটে ছেলেও জুটে গেছে। বাঁশি বাজানোর ফাঁকে ফাঁকে কী সব বকে চলেছে ওদের সঙ্গে।

আবিরকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বল, তোর কী প্রোগ্রাম?’

‘ভাই তোকে সত্যি বলছি, গোপালপুর জায়গাটা মোটেও জমজমাট নয়। অন্তত তিন-চার দিন কাটানোর মতন নয়। নেহাত বিশালজির ওয়াইফ না থাকলে রাকেশের মতন আমিও পুরী কেটে পড়তাম।’

‘তুই আর পালটালি না’, বললাম আমি, ‘সেই কলেজ জীবন থেকে তো দেখছি। চল্লিশ ক্রস করেছিস, এবার তো সন্ন্যাস নেবার কথা ভাব।’

‘কী যে বলিস বন্ধু, সবে তো কলির সন্ধে। জানিস না, আফটার ফর্টি বয়েজ গেট নটি?’

‘একটা কথা বলি তোকে…’

‘হ্যাঁ বল না। তোর কথা শুনতে খারাপ লাগে না।’

‘নারী মধু নারী বিষ, বুঝেশুনে পা ফেলিস।’

সিগারেটে জোরে একটা টান মেরে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জবাব দিল, ‘নাহ্, এ প্রবাদটা আগে কোথাও পড়েছি বা শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। আয়াম শিওর, ইউ হ্যাভ কয়েনড ইট।’

মৃদু হাসলাম, কিছু বললাম না। একবার ওকে আপাদমস্তক জরিপ করলাম। প্রায় ছ’ফুট উচ্চতার সুন্দর সুঠাম চেহারা। শ্যামলা রং, চোয়ালের কাঠিন্যে প্রকট পুরুষালি দৃঢ়তা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে। চোখেমুখে অদ্ভুত এক কনফিডেন্স। দেখেছি, এসব ছাড়াও কী এক অনির্বচনীয় ব্যক্তিত্ব ওর মধ্যে আছে যা কিছু কিছু নারীর হৃদয়ে ওর আকর্ষণ অমোঘ করে তোলে।

খেয়াল করেছি, নারীদের চোখে আমিও নেহাত ফেলনা নই। তবে আমার সঙ্গে তারা মেশে, কথা বলে কেমন যেন সমীহ করে। তাদের আচার-আচরণে একটা সম্ভ্রম, শ্রদ্ধার ভাব ফুটে ওঠে। কখনওই তা মাত্রা ছাড়ায় না।

নারীদের মধ্যে যাদের সবাই আল্ট্রা মডার্ন বা ড্যাম স্মার্ট বলে জানে, শরীর নিয়ে যাদের নেকু নেকু বা পরপুরুষ ছুঁলে জাত যাবে –এমন মনোভাব নেই, সে ধরনের মহিলারাও দেখেছি আমার তেমন কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করে না। বরং ‘তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম…’ গোছের কিংবদন্তি স্লোগানের দূরত্বে রাখতেই ভালোবাসে আমাকে।

অথচ আবিরের বেলায় ঘটনাটা ঘটে সম্পূর্ণ বিপরীত। কত দ্রুত কত কাছাকাছি আসা যায় বুঝি সেরকমই একটি প্রতিযোগিতা চলে ওর আর সদ্য পরিচিতা নারীটির মধ্যে।

সিগারেট শেষ করে বাট ছুড়ে ফেলে বললাম, ‘ইরা অশান্তি শুরু করবে। সাবধান কিন্তু।’

‘করুক গে, চল যাওয়া যাক।’

রাতে ছাদে বসার ব্যবস্থা হল। টেবিল, চেয়ার, জল, খাবার-দাবার সব কিছু হোটেলের ছেলেরা তুলে দিয়ে গেল।

ছাদটা ভারি সুন্দর। বেশ ছড়ানো ছিটোনো, অনেকটা স্পেস। সামনের দিকে অনতিদূরে সুবিশাল উঁচু লাইটপোস্টে হ্যালোজেন জ্বলছে। দেখেছি দিনের বেলা ওর মাথায় একটি চিল বসে থাকে। হ্যালোজেনের আলোতে হোটেলের গেটের অংশটি স্পষ্ট ভাবে আলোকিত। সেই আলো ছাদে এসে পড়েছে আংশিক। ফলে পরিবেশটা হয়ে উঠেছে চমৎকার।

হোটেলের পিছন দিকটাতে নাগরিক আলো অল্পবিস্তর। সামনে সমুদ্রের হা হা অন্ধকার। এক পাশে লাইটহাউসের শিখরে জ্বলতে থাকা অসম্ভব জোরালো আলো দূর দিগন্তের কোনও নাবিককে দিশা দেখাতে ব্যস্ত। ক্রমশ চারপাশের কোলাহল কমে আসছে।

হোটেলের নিয়ম অনুযায়ী রাত দশটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়ার পাট শেষ করতে হবে। ঠিক হল, মহিলারা যারা ড্রিংকস নেবে না তারা বাচ্চাদের সঙ্গে ডিনার সেরে ফেলবে নির্দিষ্ট সময়ে। বাকিদের খাবার কন্টেনারে, ফয়েলে ভরে রুমে পাঠানো হবে। রুমে ফিরে যে যার মতন খেয়ে নেবে।

ছাদে আসর বসতে না বসতেই হরলালদার বন্ধু জগন্নাথবাবু এবং ওনার স্ত্রী সুইটি উঠে এলেন আলাপ করতে। প্রাথমিক পরিচয় পর্ব শেষ হতে আরও দুটি চেয়ারের ব্যবস্থা করল অসীম।

সুমি, ইরা, আমার স্ত্রী কেউই এল না আসরে। তবে কথাবার্তা হাসি-ঠাট্টা, আবৃত্তি, লোকসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত ইত্যাদিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই জমে উঠল পরিবেশ।

সকলে মিলে পরিকল্পনা করতে লাগল দারিংবাড়ি বেড়াতে যাবার। বিশেষত হরলালদার বন্ধু এবং ওনার স্ত্রী-র উৎসাহই বেশি বলে মনে হল।

আমি দারিংবাড়ি যাবার পক্ষে ছিলাম না। যতদূর শুনেছিলাম ওখানে দেখার মতন তেমন কিছু নেই। সে কথা বললাম ওদের।

অসীম বলল, ‘জানো, ওখানে বরফ পড়ে?’

রাকেশ বলল, ‘পড়ে, না কোন কালে একবার পড়েছিল?’

বললাম, ‘তোমরা কি আশা করছ এখন ওখানে গেলে বরফ দেখতে পাবে?’

‘বুলা, কল্পনাদি বলল, ‘গিয়েই দেখা যাক না। এসেছি তো ঘুরতে।’

রাকেশ আবিরকে বলল, ‘তুমি যাচ্ছ নাকি দারিংবাড়ি?’

‘আমি? নাহ্, তবে ইরা যাবে।’

বললাম, ‘ইরা জানে দারিংবাড়ির প্রোগ্রাম?’

‘জানে না, জেনে যাবে।’

‘না-ও তো যেতে পারে।’

‘যাবে না মানে? আলবৎ যাবে। একশো বার যাবে। বেড়াতে এসে আনন্দ করবে না? আমি বলব আর ও যাবে না, এত হিম্মত?’ আবিরের গলা সকলকে ছাপিয়ে গেল।

বুলা, কল্পনাদি, সুইটি– সকলে নিজেদের মধ্যেকার কথা থামিয়ে চমকে ওর দিকে তাকাল। বুঝলাম ওর নেশা চড়েছে ভালোরকম।

হঠাৎ হরলালদা গলা ছেড়ে গেয়ে উঠল, ‘এমন মানুষ পেলাম না রে যে আমায় ব্যথা দিল না। নয়নজলে বুক ভাসাইলাম…’

পরিস্থিতি লঘু করতে আবিরকে টেনে তুললাম চেয়ার থেকে, ‘চল ওদিকে। একটু ধোঁয়া টানা যাক।’

সকলে ফের গল্পে মশগুল হয়ে পড়ল।

খুব দ্রুত ড্রিংকস নেয় আবির। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বোধহয় চার-পাঁচ পেগ নিয়েছে। ছাদের আধো অন্ধকারে পেগের মাপও নিশ্চয়ই কেউ নিক্তি মেপে ঢালছে না।

যেদিকে সমুদ্র সেদিকে গিয়ে দাঁড়ালাম। উড়ে আসছে আর্দ্র বাতাস। বাতাসে জোর যথেষ্ট। অনেক চেষ্টা ও তৎপরতায় বাতাস আড়াল করে সিগারেট ধরানো হল।

সকলে আশা করেছিল সমুদ্রের কাছে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া হবে। কিন্তু দেখা গেল জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। ডিসেম্বর মাস, মনে করিয়ে দিচ্ছে ভালোরকম। মহিলারা মাথায় স্কার্ফ, দোপাট্টা জড়িয়েছে, পুরুষরা টুপি, মাফলার। নাহলে কুয়াশা মাথায় চাপলে আর দেখতে হবে না, বেড়ানো মাটি। দেখলাম আবির মাথায় কিছু দেয়নি।

বললাম, ‘একটা টুপি চাপাতে পারতিস মাথায়।’

‘নাহ্, ঠান্ডা লাগবে না। আমার গরম বেশি। তুই তো জানিস।’

বস্তুত ওর জীবনে নারীঘটিত প্রায় সকল কাহিনিই আমি শুনেছি বা জানি। এক অদ্ভুত বিজয়ীর ভঙ্গিতে ও আমার কাছে সব ঘটনার বর্ণনা করে কী এক আত্মপ্রসাদ লাভ করে কে জানে।

বললাম, ‘যা মন চায় কর, কিন্তু এভাবে সিন ক্রিয়েট করা ঠিক নয়। আই এক্সপেক্ট আ বিট ম্যাচিয়োরিটি ফ্রম ইউ।’ একটু দৃঢ়তার সঙ্গে কথাগুলি উচ্চারণ করলাম।

ছাদের রেলিং ধরে সমুদ্রের কালো অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকল, কোনও জবাব দিল না। সিগারেটে ঘন ঘন টান দিচ্ছিল। আগুনটা জোরে জ্বলে উঠছে মাঝে মাঝে। আমার দিকে একবার অস্থির দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর বলল, ‘নিরুপমাকে কেমন দেখলি?’

‘হু ইজ সি?’

‘ওয়াইফ অফ মিস্টার বিশাল শর্মা।’

বললাম, ‘হুম। কিছু মহিলাকে ঈশ্বর নারীসুলভ আশীর্বাদ উজাড় করে দেন। নিরুপমাও সেরকম একজন মহিলা।’

‘ভাই তুই তো লেখক মানুষ, তোর কাছ থেকে আরও ভালো বর্ণনা আশা করেছিলাম। শালা, কালিদাস পড়িসনি নাকি! গুরুস্তনী, গুরুনিতম্বিনী, রম্ভোরূ, আর কামনা মদির পুরু মোটা ঠোঁটকে এক কথায় কী যেন বলে?’

হেসে বললাম, ‘এবার তুইও লেখালেখি শুরু কর। যতদূর মনে হয় ভদ্রমহিলার বয়স হয়েছে।’

‘কত হতে পারে বলে মনে হয় তোর?’

‘অ্যারাউন্ড ফর্টি ফাইভ।’

‘বাহ্, তোর নারীজ্ঞান তো বেশ টনটনে দেখছি। আমারও সেরকমই ধারণা। তবে জেনে রাখ, মাঝ-সমুদ্র ওপর থেকে আপাত শান্ত দেখালেও অনেক চোরা-স্রোত বয় তার গহিন গোপনে। সেরকম ঝড় উঠলে সেও বলগাহীন হয়ে উঠতে দেরি হয় না। ডুবিয়ে দিতে পারে যে-কোনও জাহাজ।’

হেসে বললাম, ‘অনেক দূর এগিয়েছিস মনে হচ্ছে।’

ও টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। ইতিমধ্যে কেউ ওর গেলাসটি ভরে দিয়েছিল। সেটা থেকে প্রায় অর্ধেক গলায় ঢালল। তারপর গেলাস হাতে ফের এগিয়ে এল আমার দিকে। বলল, ‘শিকারি তার শিকার ঠিক চিনে নেয়। কথাটা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বাদ দে জ্ঞানের কথা, তোকে একটা সুখবর দিই, সম্ভবত বিশালজি পরশুদিন ভুবনেশ্বর যাচ্ছেন।’

বেশ অর্থপূর্ণ দৃষ্টি ছুড়ে দিল আমার দিকে।

হঠাৎ কল্পনাদি চেঁচিয়ে ডাকল আমাদের, ‘ভাই, তোরা কি নিজেদের মধ্যেই আড্ডা দিবি দুজন? আমরা বাদ?’

ওকে বললাম, ‘চল টেবিলে।’

আচমকা ছাদে নিরুপমাজি উঠে এলেন। আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ‘আরে আপলোগ ইতনি দের তক পার্টি মানা রহে হো, সোনে নেহি যায়েঙ্গে?’

সকলে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। কী জবাব দেওয়া উচিত তৎক্ষণাৎ ভেবে পেল না কেউ। এটা কি মামুলি প্রশ্ন, নাকি হোটেলের নিয়মনীতি অনুযায়ী অভিযোগ?

আবির মুহূর্তে চটুল গানের সুরে বলে উঠল, ‘আরে অভি তো পার্টি শুরু হুয়ি হ্যায়…’

সকলে হইহই করে সাপোর্ট করে উঠল।

দেখলাম নিরুপমাজীও বেশ রসিক মহিলা। রাগ তো করলেনই না বরং হেসে বললেন, ‘জরুর, জরুর। আপলোগ এনজয় করনে কে লিয়েই তো ইতনি দূর সে আয়ে হ্যায়। হম বস দেখনে আয়ে থে, সব কুছ ঠিক-ঠাক চল রহা, কি নেহি?’

হরলালদা জমিয়ে দিল, ‘ব্যস ম্যাডাম, সির্ফ আপহি কি কমি হমলোগ মেহসুস কর রহে থে।’

হাসির ফোয়ারা জেগে উঠল ফের।

সবাই বলল, ‘বৈঠ জাইয়ে ম্যাম, হামারা সাথ দো পেগ পি লিজিয়ে।’

‘না বাবা না। অভি অভি ম্যায়নে খানা খায়া। আপলোগ এনজয় করো। গুডনাইট এভরি বডি, বাই’, বলে উনি পালিয়ে বাঁচলেন।

রাকেশ প্রশ্ন করল, ‘ভদ্রমহিলা হঠাৎ ছাদে উঠে এলেন?’

বললাম, ‘খুবই স্বাভাবিক, হোটেল ওনার। শুতে যাবার আগে চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে যাবেন না, আবাসিকরা কোথায় কী অবস্থায় আছে!’

কল্পনাদির বন্ধু সুইটি ছাদের অপর দিকটি ঘুরে দেখে এসে জানালেন যে, ওদিকে ফার্স্ট ফ্লোরে একটি বড়ো ব্যালকনিতে আমাদের মতন এত বড়ো না হলেও জনা চারেক নারী-পুরুষের একটি ছোটোখাটো পার্টি বসেছে।

আমাদের কেউ কেউ উঁকি মেরে এল।

আরও কিছু সময় আড্ডা মেরে পরস্পরকে শুভরাত্রি জানিয়ে যে যার রুমে ফিরে গেলাম আমরা।

***

‘অতিদূর সমুদ্রের ’পর

হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা

সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি…’

***

পরদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে অসীম বলল, ‘তোমরা যে কী করো, খালি পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছো। সমুদ্রের কাছে এসে সূর্যোদয় না দেখলে আসাটাই বৃথা।’

‘অত রাতে শুয়ে সকালে ওঠা যায়?’ বলল কল্পনাদি।

‘আমি তো উঠলাম। উঠে সি-বীচে…’

ওর কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে হরলালদা বলে উঠল, ‘তুমি তো তাড়াতাড়ি উঠবেই। বুড়ো হলে ঘুম কমে যায়।’

সকলে হেসে উঠল। অসীম বাকরুদ্ধ দৃষ্টিতে হরলালদার দিকে তাকাল।

বললাম, ‘সি-বিচে হাঁটলে?’

‘হাঁটলাম। জেলেরা মাছ ধরে এনেছে দেখে ওদের থেকে মাছ কিনলাম।’ সকলে অবাক।

আবির বলল, ‘ওগুলো সব তেচোখো মাছ, যে খাবে সেই মরবে।’

সবাই হেসে উঠল ফের। অসীমকে রাগাতে কেউ কসুর করছে না।

অসীম রেগে বলল, ‘মোটেও না। ওদের থেকে আমি আমার চেনা মাছগুলোই কিনেছি।’

হরলালদা সিগারেটে টান মেরে বলল, ‘হুঁ, গড়িয়া বাজারে ও যে মাছগুলোকে চিনে এসেছিল ওদের এখানে কিনল। যাও, সব পচা মাছ।’

‘এই লালদা, না জেনেশুনে একদম কথা বলবেন না বলে দিচ্ছি। পচা মাছ? আপনি দেখেছেন?’

মেয়েকে কোলে সামলাতে সামলাতে সুমি প্রশ্ন করে, ‘মাছগুলো কিনে কী করলেন অসীমদা?

‘এখানে একজনকে দিয়ে মাছগুলো কাটালাম, ধুয়ে ভালো করে পরিষ্কার করালাম। তারপর মাছভাজার একটা দোকানের ফ্রিজে রেখে এলাম। পরে সময় মতন ভেজে নিয়ে আসব।’

হরলালদা বলল, ‘ওই বাজে তেলে ভাজা মাছ তুমিই খেও। ওসব খেয়ে সবাই পেট ছেড়ে মরুক আর কী। আরে এ বদমায়েশটা তো মনে হচ্ছে আমাদের সকলের দারিংবাড়ি যাবার প্রোগ্রামটা নষ্ট করার তালে আছে।’

ওর বলার ভঙ্গিতে হাসির রোল উঠল ফের।

অসীম বলল, ‘ঠিক আছে, ড্রিংকসের সঙ্গে মাছভাজা চাইলে কপালে দুঃখ আছে, মনে থাকে যেন।’

বেলা বারোটা নাগাদ রাকেশরা বেরিয়ে গেল। আর বাকিরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল সমুদ্র-স্নানে। তারপর দুপুরের খাওয়া সেরে রেস্ট নিতে গেল সকলে।

রুমে ফিরে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোর রেজাল্টের খবর কী?’

‘কাল বেরোবে বলেছে’, বলেই মোবাইলে মনোযোগ দিল।

বিকালের দিকে বললাম, ‘চল, সি-বিচে একটু হেঁটে আসি। যাবি? মনটা ভালো লাগবে।’

‘তুমি যাও। আমি ওদের সঙ্গে একটু পর বেরোব।’

আবিরকে ফোন করলাম, ভাবলাম ওকে বলি আমার সঙ্গে যেতে। ফোন বেজে গেল, ও ধরল না। বোধহয় ঘুমোচ্ছে।

প্যান্টের ওপর পাঞ্জাবি, তার ওপর একটি জ্যাকেট চাপিয়ে সি-বিচে বেড়াতে গেলাম।

একটু পর সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়বে। সূর্যোদয় তো দেখা হল না সূর্যাস্তই দেখা যাক ভেবে পশ্চিম দিকে রওনা হলাম।

দু’পা হাঁটলে ডান দিকে নজরে আসে লাইটহাউসের পাঁচিল থেকে নেমে আসা কংক্রিটের বাঁধানো ঢাল। তার গায়ে বিশালাকৃতি এক তিমির ছবি। বুঝি সেটি রাতের অন্ধকারে বাম দিকের সমুদ্র থেকে সুযোগ বুঝে লাফিয়ে উঠে পড়েছে ঢালে। আর ওখান থেকে পর্যবেক্ষণ করছে বিচের মানুষজন তথা আদিগন্ত সমুদ্র। সময় হলেই লাফিয়ে ফিরে যাবে তার অফুরান নীলে।

সি-বিচের কিছুটা সমতল কিছুটা মালভূমি সদৃশ মাঝারি উঁচু। তারপর ঠেলে উঠে গেছে অনেকটা। মানুষ যা কিছু গড়েছে বা গড়ার চেষ্টা করেছে এখানে, তা সবই হোটেলের সম-উচ্চতায়।

পুরোনো কোনও বিশালাকৃতি বাড়ি ভাঙা বিবর্ণ অবস্থায় চোখে পড়ল। বেশ কিছুটা অঞ্চল মাঝারি মাপের ঝোপেঝাড়ে ভরা। কিছুটা ঊষর।

মাঝেমধ্যে দু-একজন ময়লা মানুষ আমার বিপরীত দিক থেকে হেঁটে আসছে একা একা।

পায়ের শব্দে ছোটো ছোটো গর্ত থেকে উঠে আসা বালিমাখা স্বচ্ছ খুদে খুদে কাঁকড়া প্রাণভয়ে ছুটে যাচ্ছে আশ্রয়ের খোঁজে।

অনবরত ঢেউ ভাঙছে বিকেলের সমুদ্রে। গড়িয়ে যাচ্ছে ফেনা।

দূরে দূরে ভেসে যাচ্ছে জেলে ডিঙি।

নির্জনতা এখানে স্তব্ধতার সমাহারে অবিরত নিজেকে সাজিয়ে তুলছে অনন্ত আয়োজনে।

একটু এগোতে দেখলাম একটি দাড়িওয়ালা যুবক গিটার হাতে নেমে আসছে সি-বিচের পাশে থাকা কোনও রিসর্ট থেকে। সঙ্গে পরির মতন এক কিশোরী।

ক্রমশ আমি তাদের কাছাকাছি পৌঁছোলাম। অপূর্ব রূপসী মেয়েটি ছোট্ট একটি কালো ফ্রক পরেছে, তাতে যেন আরও ছোটো দেখাচ্ছে তাকে।

ছেলেটি প্রায় হাঁটুজলে নেমে গিটার বাজিয়ে কোনও সুর তুলল। কিশোরীটি গোড়ালি ভিজিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে একবার ডানদিক একবার বামদিকে নেচে বেড়াতে লাগল অদ্ভুত ছন্দে।

ছোটো-বড়ো-মাঝারি ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল ক্রমাগত। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় সামুদ্রিক পটভূমিতে এ দৃশ্যে আমি এত আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম যে, কিছু সময়ের জন্য স্থানটি ছেড়ে এগোতে ভুলে গেলাম। মনে হল আমি বুঝি কোনও ফিল্মের খণ্ড অংশ দেখছি যা যে-কোনও মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যাবে আমার দৃষ্টি থেকে।

সামনে এগোতে যাব হঠাৎ নজরে এল, এক বয়স্ক প্রবীণ ব্যক্তি, মধ্যপ্রদেশ যথেষ্ট স্ফীত, হাফপ্যান্ট পরা, গলায় তোয়ালে জড়িয়ে সমুদ্রের দিকে নেমে আসছেন। তার সঙ্গে সুইমস্যুটে তিন যুবতি।

যুবতি তিনজন নিজেদের মধ্যে দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলতে বলতে হাসিতে ফেটে পড়ছিল। প্রবীণ ব্যক্তিটি তাদের সঙ্গে নিয়ে স্নানে নামলেন গিটারিস্টের থেকে অনেকটা দূরত্ব রেখে।

এ দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখার মতন নয়। এগোলাম সামনের দিকে। অনেকটা দূর যাবার পর দেখলাম, একটি নৌকো দাঁড় সমেত ডান দিকের অপেক্ষাকৃত উঁচু বালিতে রাখা। নৌকোর তলার অংশ কালো, তার ওপর সাদা, তারও ওপরে লাল এবং নীল আড়াআড়ি ভাবে নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে রং করা।

খেয়াল করলাম, নৌকোটির আড়ালে একটি কালো যুবক নিজের মনে ধূমপান করে চলেছে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে। তার পাশে বৃত্তাকারে পাকে পাকে রাখা মোটা কাছি। যুবকটি আমাকে ভ্রূক্ষেপ করল না।

আরও হাফ মাইল এগিয়ে যাবার পর মনে হল বুঝি পৃথিবীর একদম কিনারে এসে পৌঁছেছি। এই নির্জন সমুদ্র সৈকতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। সমুদ্রের দিকে দৃষ্টির ঝাপসায় কালো অস্পষ্টতা। সূর্য অস্তাচলে। হু হু বাতাসে প্রকৃতির অস্ফুট কলরব। বালিতে আছড়ে পড়া ফেনাজল ফিরে যাচ্ছে তার চেনা বুকে।

পৃথিবীর আদিম প্রশান্তি আমাকে অভিভূত, আপ্লুত করে তুলল। কী এক অনন্ত ঐশ্বর্যে ভরে উঠল আমার হৃদয়। কতক্ষণ সেখানে আচ্ছন্ন অবস্থায় কাটালাম কে জানে!

হঠাৎ শীত শীত বোধ হল। ভাবলাম এবার ফেরা দরকার। যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকে রওনা হলাম। ভাঙা ঢেউয়ের মতন মানুষকে বার বার ফিরে আসতে হয় তার চেনা ঘরে।

নীল আকাশ ফুঁড়ে ক্রমাগত উঁচুতে উড়ে যাচ্ছে কোনও এক রকেট। পড়ন্ত সূর্যের মহান আলোয় রুপোর মতন ঝকঝক করছে সেটি। পিছনে ফেলে যাচ্ছে গ্রামের আলপথের মতন বিধবার সাদা সিঁথি যা ক্রমশ বিলীয়মান।

খানিক এগোতে দেখলাম মাথার ওপর একটি চিল। ভারি আশ্চর্য! আমাকে লক্ষ্য করে কিছুটা পথ সেটি পাকে পাকে উড়ে চলল। আমার মুঠোফোনে বন্দি করলাম তাকে। ল্যাপটপে হিমায়িত করে রাখতে হবে এই ক্ষণিকের সখ্যতা।

ফেরার পথে নজরে পড়ল তিনটি জলকন্যার সঙ্গে সেই প্রবীণ ব্যক্তিটি তখনও সামুদ্রিক বিলাসে মেতে আছেন। ভাগ্যবান সফল পুরুষ!

সেই গিটারিস্ট যুবক ও পরিটি নজরে এল না।

আরও খানিক এগোতে দেখলাম আমার কন্যা এবং স্ত্রী অনেকের সঙ্গে এগিয়ে আসছে। ওরা বেশি দূর যেতে রাজি হল না। ফলে সদলবলে ফিরে চললাম।

একটি জেলে-ডিঙি মাছ ধরে সমুদ্র থেকে ফিরে এসেছে। বেশ কিছু মেয়ে-মদ্দ জালবদ্ধ মাছ বেছে ঝুলিতে ভরছে। আর বেশ কিছু সবুজ মাথাওয়ালা বেঁটে বেঁটে মাছ জেলেরা জাল থেকে খুলে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছিল। ওগুলি মানুষে খায় না। কাক-চিলের খাদ্য হয় বোধ হয়। দেখলাম, বালির ওপর কুয়াশা মাখা ভোর-রঙা গোলাকার থকথকে জেলিফিশ পড়ে রয়েছে। আমরা সকলে আগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে ঝুঁকে পড়লাম। সকলের হাতে মোবাইল থাকায় ফটো তোলার বিরাম নেই।

সূর্য অস্ত গেছে কিছুক্ষণ হল। ফেরার পথে হাঁটতে হাঁটতে আমার মোবাইল থেকে পাবলো নেরুদার একটি কবিতা ইংরেজি অনুবাদে আমি পড়ে শোনালাম। কবিবন্ধু পীযূষ বাগচী দুপুরে ওটি আমাকে পাঠিয়ে ছিল। কবিতাটি শুনে মেয়ের মুখ থেকে উৎকণ্ঠার মেঘ কিছু সময়ের জন্য দূর হল বলে মনে হল।

আমরা ফিরে চললাম গোপালপুরের পার্ক সংলগ্ন অঞ্চলে। ওখানে বালির ওপর বেশ কিছু দোকান। ঝিনুক-শামুক প্রভৃতিতে তৈরি নানা উপহার সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে।

আমাদের দলের মহিলারা কেউ কেউ কেনাকাটি করল।

অসীম বলল, ‘চলো, চা খাওয়া যাক।’

নরম বালির ওপর হাঁটা বেশ কঠিন।

অবশেষে আমরা সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম। পার্ক সংলগ্ন চায়ের দোকানে চা অর্ডার করা হল।

কিছুক্ষণের মধ্যে হরলালদা, আবির এবং বাকিরা এসে হাজির। জানাল, গাড়ি বুুক করা হয়ে গেছে। আগামীকাল সকাল সাতটায় ওরা রওনা হবে দারিংবাড়ি।

বুলা, ইরা, মাম, ফুল সবাই এসে জানাল যে, ওখানে ফুচকা খেতে গিয়ে যা অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে কলকাতার ফুচকার টেস্ট ভুলে যাবার জোগাড়।

কে যেন বলল, ‘এখানে ঘুগনি যা বানায় না, অপূর্ব। একবার খেলে জীবনে ভুলবি না।’

সাড়ে আটটা অবধি আড্ডা মেরে আমরা হোটেলে ফিরে গেলাম।

পরদিন খুব ভোর নাগাদ ঘুম ভাঙলে ফুল, অনিতা আর আমি বেরোলাম সূর্যোদয় দেখার উদ্দেশ্যে। ঠান্ডা ছিল বেশ। তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হল একটু বেশি রকম। ফুলের ঠান্ডা লাগার ধাত। তাছাড়া অসুস্থতার পর ওর মায়েরও চট করে ঠান্ডা লেগে যাবার প্রবণতা।

সি-বিচে ভোরবেলা লোকজন কমই দেখা গেল। হয়তো শীতকাল বলেই! টুরিস্টদের মধ্যেও উন্মাদনা যেন তত প্রবল নয়। খানিকক্ষণ হেঁটে বেড়াবার পর কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্য যখন মুখ তুলল তখন তা আকাশের অনেকটা ওপরে।

জেলেদের মেছো নৌকোগুলি ফিরেছে। মাছ সংগ্রহের আগ্রহ আমাদের বিন্দুমাত্র নেই। তবে নৌকোগুলি ঘিরে কিছু মানুষের জটলা, ব্যস্ততা, কোলাহল ভালোই লাগল।

বাইরে এক প্রস্থ চা পান করে হোটেলে ফিরলাম। তখন অসীম, হরলালদা-রা দারিংবাড়ি রওনা হয়ে গেছে।

ব্রেকফাস্ট টেবিলে আবিরকে বললাম, ‘ইরাকে ওদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলি। তোর মতলব ভালো ঠেকছে না আমার।’

ও চোখ মেরে বলল, ‘আজ একদম আমার খোঁজ করবি না তুই।’

সামান্য গল্পগুজব করে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। কোথায় গেল কে জানে।

আমরা রুমে ফিরে এলাম।

ফোন নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম।

মেয়ে ওর বন্ধুদের সঙ্গে ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছে। খুবই টেনস্ড শোনাচ্ছিল ওর কণ্ঠস্বর। রেজাল্ট সংক্রান্ত আলোচনা চলছে।

আধ ঘন্টা পর চেঁচিয়ে উঠল আনন্দে। ব্যালকনিতে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘থার্ড পেপার, আর প্র্যাক্টিক্যালটা  নিয়ে খুব চিন্তা ছিল। ভেবেছিলাম অনার্স বোধহয় কেটেই যাবে। জোর বাঁচা বেঁচে গেছি এবারের মতন।’

বললাম, ‘এরকম রেজাল্ট করলে ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। মাস্টার্সে চান্স পাক্বা।’

‘আহা, তুমি একদম চাপ নিও না, বুঝলে? দেখবে এবার সেকেন্ড ইয়ারে কেমন পড়াশোনা করি।’

অনিতা বলে, ‘রাত দেড়টা-দুটো অবধি ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ করলে পড়াশোনা হবে কী করে। সব গোল্লায় যাবে।’

‘ওঃ মা, তুমি না…’ ওর ফোন বেজে উঠল, ‘হ্যাঁ বনিতা, বল…’

বন্ধুর সঙ্গে কথায় ডুবে গেল।

মনে মনে আমারও চাপা উদ্বেগ ছিল। মেয়েটা এ বছর এত ফাঁকি মেরেছে যে বলার নয়। পরীক্ষার আগের রাতে কান্নাকাটি করছিল, সব ভুলে যাচ্ছে। থ্যাংক্ গড, এ যাত্রায় বেঁচে গেল। মাঝারি মানের স্টুডেন্টদের যে ফাঁকি মারা উচিত নয়, সেটাই বোঝে না মেয়েটা।

সারাটি দিন শুয়ে-বসে আলসেমি আর মাঝেমধ্যে একে তাকে ফোন করেই কেটে গেল।

***

‘সব পাখি ঘরে আসে– সব নদী– ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন, থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার…’

***

গোপলপুরে শেষ রাত্রি

কাল অনেক রাতে দারিংবাড়ি টিম ফিরেছিল। রাকেশদের ট্রেন লেট করায় ওরা যখন ফিরল তখন তো রাত সাড়ে এগারোটা। হোটেলে বলা ছিল, তাই রাতের খাবার জুটেছিল। টঙ্কাস তখন গভীর ঘুমে।

ব্রেকফাস্ট টেবিলে সকলে একটু বেলা করেই ঢুকল।

সুমি সকলকে পুরীর প্রসাদ দিচ্ছিল।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেমন কাটল পুরী?’

‘ভালোই, তবে তোমাদের খুব মিস করছিলাম।’

অনিতা বলল, ‘আমরাও। আমরা তো সারাদিন একা একাই কাটালাম।

কল্পনাদিকে রাকেশ জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমরা কেমন বেড়ালে দিদি?’

‘ধুর, আর বলিস না, রাস্তার যা অবস্থা! যাওয়াটা তবু একরকম, ফেরার সময় খুব কষ্ট হয়েছে।’

বুলা বলল, ‘দেখলাম ঠিকই। তবে মন ভরল না।’

বললাম, ‘তোমার কেমন লাগল ইরাবতী?’

‘কী বলুন তো দাদা, ওখানে একটা দিন স্টে করলে হয়তো ভালো লাগত। এত জার্নি করে পোষায় না।’

দিদি বলল, ‘নারে, সত্যি কথা বলতে কী, ওখানে দর্শনীয় তেমন কিছু নেই। ওসব ছোটোখাটো ফল্স, পাহাড় দেখার জন্য অতদূর যাবার মানেই হয় না।’

হরলালদা বলল, ‘এই অসীমটাই হল যত নষ্টের গোড়া, খালি বরফ দেখব বরফ দেখব বলে লাফাচ্ছিল।’

‘দেখলে বরফ’, আমি প্রশ্ন করলাম।

‘হ্যাঁ দেখেছি। নিয়েও এসেছি পকেটে করে। রাতে তোমার গেলাসে ঢেলে দেব কিছুটা। বাকিটা অসীমের মাথায়।’

রাকেশ বলল, ‘বাদ দাও ওসব। আজ গোপালপুরে শেষ দিন। আজ রাতে গ্র্যান্ড মস্তি।’

ঠিক সে সময় আবির ডাইনিং রুমে ঢুকে বলল, ‘আজ ড্রিংক্সের টোটাল খরচ আমার।’

সকলে হইহই করে ওকে স্বাগত জানাল।

হরলালদা জিজ্ঞাসা করল, ‘কী ব্র্যান্ড খাওয়াচ্ছ?’

‘কী খাবেন বলুন?’

‘স্কচ, ভালো স্কচ চাই।’

‘দ্যাখা যাক, এখানে কী পাওয়া যায়।’

অসীম বলল, ‘তাহলে স্কচের সঙ্গে খাবার মতন কিছু ব্যবস্থা করি?’

‘তোমার ওই পচা তেচোখো মাছ?’ হরলালদা বলে।

সবাই হাসিতে ফেটে পড়ে।

‘আচ্ছা, পচা মাছ? সেদিন তো বেশ ভালোই সাঁটালেন। পমফ্রেট, পার্শে, ভেটকি, বেলে। আজ সব তেচোখো হয়ে গেল?’

‘শোনো, ভালো শিক কাবারের ব্যবস্থা করো দেখি। আর হোটেলে কী পাওয়া যায় দ্যাখো, স্পেশাল কিছু।’

সুমির বাচ্চা মেয়েটির টানে সব মহিলার ভিড় ওর ঘরেই। একবার এ কোলে নেয় তো একবার ও। সবার কোলেই যায়, একটুও কান্নাকাটি নেই। সকলেই খুশি!

তবে বাচ্চাটির ঠান্ডা লেগে গেছে। সামান্য জ্বরও হয়েছে। বেচারির নাকটি বোধ হয় বন্ধ, সারাক্ষণ মুখ খোলা।

সুমি ওর ছেলেকে ভালো করে গরম জামাকাপড় পরিয়ে দিয়েছে। যাতে ওর আবার ঠান্ডা-টান্ডা না লেগে যায়। রাকেশ কিচেনে গেল মেয়ের জন্য জল গরম করে আনতে। যাবার সময় আমাকে বলে গেল, ‘গৌতমদা, আজ আয়োজন একদম জমজমাট।’

হরলালদার ঘরে নক করতে কল্পনাদি দরজা খুলে দিল। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী রে, লালদা কই?’

‘ওই দ্যাখ না এখনও শুয়ে রয়েছে।’

বললাম, ‘কী লালদা, ভর সন্ধেবেলা শুয়ে রয়েছো। ওঠো, ওঠো, ছাদে যাবে তো।’

‘আর বোলো না, দুপুরে অনেকক্ষণ স্নান করেছি। তার ওপর পেটে দু-চার পেগ ছিল। খুব টায়ার্ড লাগছিল। লাঞ্চ করে এসে একদম নাক ডাকিয়ে ঘুম।

অসীম ঘরে ঢুকে বলল, ‘যা স্নান করলেন সে তো দেখলাম। গোপালপুরের সমুদ্র আপনাকে মনে রাখবে। হাঁটুজলে ডুবকি মেরে খাবি খেয়ে অস্থির।’

‘এই তুমি আর বোলো না। পেট ভরে, নুনজল গিলে এলে।’

‘আমি!’

‘নয়তো কে? তুমিই তো বললে, জলে খুব নুন। না খেলে, জানলে কীভাবে? থাক গে, একটা সিগারেট দাও তো। আর কিচেনে বলে দাও চা দিতে।’

দরজা খোলাই ছিল। ইরা হঠাৎ ঘরে ঢুকে বলল, ‘দিদি, তোমার কাছে মাথা ধরার কোনও ট্যাবলেট আছে?’

কল্পনাদি বলল, ‘কেন, কার আবার মাথা ধরল?’

‘সকাল থেকেই মাথাটা টিপটিপ করছিল। এখন ব্যথাটা বাড়ছে। তার ওপর আবার জেদ ধরেছে আমাকে ছাদে যেতে হবে, তোমাদের সঙ্গে বসতে।’

দিদি বলল, ‘গ্যাসের ব্যথা নয় তো? অনেক সময় গ্যাস-অম্বল থেকেও মাথার যন্ত্রণা হয়। এক কাজ কর, এই দুটো ট্যাবলেট নিয়ে যা। গরম জল দিয়ে খাবি। একটু রেস্ট নে। দেখবি আধ ঘন্টার মধে ফিট হয়ে গেছিস।’

ও ইরার হাতে দুটি ট্যাবলেট দেয়।

ট্যাবলেট নিয়ে ইরা চলে গেল।

বললাম, ‘এই ইরা কী ছিল, কী রকম দেখতে হয়ে গেল!’

ওরা আমার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে চাইল।

বললাম, ‘বছর দশেক আগে আবিরের সঙ্গে ইরাবতীকে যখন দেখতে যাই তখন ওর বয়স বছর বাইশ। ডানাকাটা পরি বললে হয়তো কম বলা হবে। যেমন রূপ, তেমনই যৌবন! আবিরের তো দ্যাখা মাত্র পছন্দ হয়ে গেল। আমারও বন্ধু-পত্নী হিসেবে নির্বাচনে দ্বিধা ছিল না। তবে একটা সমস্যা ছিল। ইরার মা-বাবা কেউই ছিল না। এক কার-অ্যাক্সিডেন্টে দুজনই মারা যান। তখন ওর বয়স দশ-কী এগারো। সেই থেকে ও মামার বাড়িতে মানুষ। ভাগ্নীর বিয়েতে মামার মোটা টাকা খরচ করার ইচ্ছা থাকলেও মামীর ভয়ে তা করার উপায় ছিল না। দেনা-পাওনার কোনও গল্প ছিল না। আর তা নিয়ে আবির কিংবা ওর বাড়ির কারও কোনও অভিযোগও ছিল বলে শুনিনি। নমো নমো করে বিয়ে হল।

একটি হোটেল বয় এসে আমাদের চা দিয়ে গেল। চায়ের কাপ তুলে সিপ করছিলাম।

কল্পনাদি বলল, ‘তারপর?’

‘বিয়ের পর বছর চারেক সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু ক্রমশই আবির আর ইরার মধ্যে মানসিক ব্যবধান বাড়তে লাগল। আচমকা ইরা অসুস্থ হয়ে পড়লে ওকে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হল। মাস তিনেক কাটিয়ে ও বাড়ি ফিরল ঠিকই কিন্তু কেমন যেন পালটে গেল। আমাদের বাড়ি ওরা মাঝেমধ্যে আসত। আমরাও যেতাম। কখনও ও খুব বেশি রকম কথা বলত আবার কখনও খুব চুপচাপ, সংযত। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি শব্দও খরচ করত না! তবে মনে হতো, ওর মধ্যে কোনও গভীর কষ্ট বা অসহায়তা আছে যা ও কখনও আমাদের বলেনি।’

‘তোকে না বলুক, অনিতাকেও বলেনি?’ দিদি প্রশ্ন করে।

‘সম্ভবত না। বললে জানতে পারতাম।’

‘তারপর?’

তারপর খুব দ্রুত ওর শরীর শুকিয়ে যেতে লাগল। আবিরকে বলতাম ওকে ভালো ডাক্তার দেখাতে। ও বলত, ‘কত ডাক্তার তো দেখালাম। কিছুই হল না। তোর জানাশোনা ভালো কোনও ডাক্তার থাকলে বল।’ কোনও ডাক্তারই ওর রোগ ধরতে পারল না। দিনে দিনে ইরা শুকনো বিবর্ণ পাতার মতন হয়ে গেল। ওকে দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়। আবিরের পাশে একদিন ও কিন্তু মোটেও বেমানান ছিল না। পরে মনে হয়েছে, হয়তো ওদের কোনও ইস্যু না থাকাই ওর অসুস্থতার মূল কারণ।

‘ডাক্তার কী বলছে, প্রবলেমটা কার?’ অসীম জিজ্ঞাসা করে।

‘বড্ড টাচি ব্যাপার। ও নিয়ে আমি ওদের কাউকে কখনও প্রশ্ন করিনি। নিজে থেকে যে যতটুকু বলে ততটুকুই শুনি।’

হঠাৎ খোলা দরজাতেই নক। দ্যাখা গেল, দরজার সামনে হরলালদার বন্ধু এবং তার ওয়াইফ। বললেন, ‘সবাই এখানে? আমাদের বাদ দিয়ে জমিয়ে গপ্প হচ্ছে? ভাবলাম ছাদে যাবার আগে একবার নক করে যাই।’

‘আসুন, আসুন ভিতরে আসুন’, অসীম বলে।

ওরা ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসলেন। অসীম আর আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম।

আটটা নাগাদ বুলা ফোন করে জানাল ছাদে যেতে। সবাই ওখানে যাচ্ছে। ভাবলাম রাকেশকে একবার ডেকে যাই। ওর রুমে গিয়ে শুনলাম কী যেন আনতে রাকেশ দোকানে গেছে। ওকে ফোনে ধরতে জানাল মিনিট কয়েকের মধ্যেই ফিরে আসছে। আমি যেন ওয়েট করি।

হঠাৎ রাকেশের যে-ফোনটি সুমির কাছে থাকে, সেটা বেজে উঠল। দৌড়ে গিয়ে সেটি তুলে নিল টঙ্কাস। বলতে লাগল, ‘হ্যালো, কে?’

ওদিক থেকে সম্ভবত কেউ প্রশ্ন করল, তুমি কে। যার উত্তরে ও বলল, ‘আমি রাকেশের ছেলে। তুমি কে বলছ?’

ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তিটি কণ্ঠস্বরে মজা পেয়ে নিজের নাম বলছে না। ওর কথা শোনার জন্য অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছে।

‘আগে বলো তুমি কে? তুমি কি কোনও চোর? সত্যি করে বলো তুমি চোর কি না?’ টঙ্কাস প্রশ্ন করে চলে।

অপর প্রান্ত কী জবাব দিচ্ছে কে জানে!

‘আমি জানি তুমি একটা চোর। বাবা আসলে বলব, তোমাকে একটা চোর ফোন করেছিল।’

সুমি এসে এক থাবা দিয়ে ফোনটি ওর হাত থেকে কেড়ে বাম হাতে সেটি কানে ধরল। প্রায় একই সঙ্গে ডান হাতে টঙ্কাসের চুলের মুঠি ধরে বার দুয়েক আচ্ছা করে ঝাঁকানি দিল। তারপর ফোনে কথা বলতে শুরু করল, ‘হ্যাঁ, কে বলছেন? ও আচ্ছা। রাকেশ আসুক, আমি ওকে বলছি ফোন করতে। আপনি কিছু মনে করবেন না দাদা। বাচ্চা, বোঝে না, কী বলতে কী বলে ফেলেছে। ও হ্যাঁ ধরুন, রাকেশ এসে গেছে, দিচ্ছি ওকে।’

‘কে গো?’ হাতের জিনিসগুলি সুমিকে দিয়ে ওর হাত থেকে ফোন নিয়ে জানতে চায় রাকেশ।

‘গিরিনদা, তোমার দোকানের ম্যানেজার’, ধরো ফোনটা।

রাকেশ ফোন নিয়ে কথা বলতে বলতে রুমের বাইরে চলে যায়।

টঙ্কাস তখন এক মনে রুমের নাইট বাল্বের সুইচটি একবার অন একবার অফ করায় মনোযোগ দিয়েছে।

সুমি চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কীরে ও…ই। কী করছিস শয়তান? ওহ্ আমি যে কী করি এই ছেলেকে নিয়ে?’

‘খেলা করছি তো’, নিষ্পাপ হাসি টঙ্কাসের মুখে।

বললাম, ‘ওরকম করে না বাবা। লাইটটা নষ্ট হয়ে যাবে। সবাই বলে, টঙ্কাস ভালো ছেলে। খুব কথা শোনে। তুমি এদিকে এসো, আমি একটা গল্প বলব।’

দেখলাম বাধ্য ছেলের মতন আমার কাছে চলে এলো, ‘বলো কী বলবে আমায়!’

‘সে কথা পরে বলছি। তুমি আগে বলো স্কুলে তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে?’

‘জুনি।’

‘সে আবার কে?’

‘একটা ভালো মেয়ে।’

‘কেমন দেখতে ওকে?’

‘খুব সুন্দর। ও তো আমাদের বাড়ি এসেছিল।

‘কবে এসেছিল?’

‘আমার বার্থ-ডে তে। সুরাইয়া, সেজুঁতি, নীল, জুনি –অনেক বন্ধু এসেছিল। খুব মজা হয়েছিল। ওরা কততো গিফ্ট দিয়েছে আমাকে! আমিও ওদের রিটার্ন গিফ্ট দিয়েছি।’

‘কেক কেটেছিলে?’

‘হ্যাঁ, সব্বাইকে দিয়েছিলাম।’

রাকেশ রুমে ফিরে এসে আমাকে বলল, ‘চলো গৌতমদা। সুমি, তোমার জিনিসপত্র দেখে নিয়েছ? আর কিছু লাগবে না তো? আমি ওপরে গেলে কিন্তু ডাকবে না বলে দিচ্ছি। একদম ডিসটার্ব করবে না আমাকে।’

সুমি নালিশ করে, ‘তোমার ছেলে গিরিনদাকে বলেছে চোর।’

‘অ্যাঁ!’ রাকেশ টঙ্কাসের মাথায় এক চাঁটি মেরে বলে, ‘কীরে, গিরিনদাকে কী বলেছিস?’

মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আমি বলেছি, তুমি কে? তুমি কি একটা চোর?’

‘তুই হঠাৎ ওকে চোর বলতে গেলি কেন?’

‘তোমরা সবাই যে বললে!’

‘আমরা সবাই!’ রাকেশ ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলে, ‘আমরা বললাম গিরিনদা চোর? কখন বললাম?’

‘ওই যে কালকে, রাত্তির বেলা। আমি তখন ঘুমোচ্ছিলাম।’

হঠাৎ ওরা স্বামী-স্ত্রী চমকে দু’জনে দুজনার দিকে তাকায় অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে।

এমন সময় অসীমের ফোন। আসছি বলে ফোন কেটে দিলাম।

রাকেশকে বললাম, ‘ছাড় ওসব। বাচ্চা মানুষের কথা ধরতে নেই। চল এখন, ওরা অপেক্ষা করছে।’

ওকে টেনে নিয়ে চললাম, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বললাম, ‘খুব সাবধান রাকেশ। তোমার ছেলে কিন্তু ডেঞ্জারাস। ও সব বোঝে।’

‘আরে গৌতমদা, কাল রাতে ওকে শুইয়ে দিয়ে সুমি আর আমি নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলাম, গিরিনদা একা দোকানে আছে কী করছে কে জানে।’

সুমি বলল, ‘দ্যাখো মালপত্তর আবার সরাচ্ছে কি না।’ ছেলে এর থেকে বুঝে নিল ম্যানেজার চুরি করছে।’

এবার থেকে মুখ সামলে কথা বলবে ওর সামনে’, আমি বললাম।

‘ঠিক বলেছ, তাই বলতে হবে দেখছি।’

ছাদে উঠে দেখি, পার্টি শুরু হব হব করছে! আমরা দুজন যেতেই সকলে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে কোথায় গেছিলে তোমরা? আমরা তো শুরু করতে পারছি না তোমাদের ছাড়া।’

দেখলাম ভারি অবাক ব্যাপার, আজকের পার্টিতে ইরাও এসেছে। বললাম, ‘তুমি!’

‘ও জোর করল’, আবিরকে দেখিয়ে বলল।

‘আরে বেড়াতে আসা মানে তো আনন্দ-ফূর্তি করতে আসা। একটু-আধটু খেলে কোনও দোষ নেই। আমি বলছি তো ওকে খেতে’, বলে আবির।

‘বছর খানেক হল আপনার বন্ধু আমাকে ড্রিংক্স নেওয়া শেখাচ্ছে।’

‘শেখাতে চাইলে আর শিখছ কই? এক পেগ, খুব জোর দু-পেগ। গেলাস নিয়েই বসে থাকে পার্টিতে। নিয়ম রক্ষা করে আর কী!’

‘কই আমাদের বাড়িতে তো মাস চারেক আগেও এলি তোরা, দেখিনি তো ওকে ড্রিংক্স নিতে?’ বললাম আমি।

‘তোর বউ খায় না, তাই ওকেও জোর করিনি। যেখানে মহল আছে সেখানে খাওয়া যেতেই পারে। তাই না হরলালদা?’

‘ঠিক ঠিক, একদম ঠিক কথা’, জোর সমর্থন জানায় লালদা।

সকলে ‘চিয়ার্স’ জানিয়ে শুরু হল পার্টি। কল্পনাদি ওর বন্ধু সুইটিকে বলল, ‘তুই একটা রবীন্দ্রসংগীত গা।’

আমরা সমস্বরে ওর অনুরোধকে স্বাগত জানালাম। ভদ্রমহিলার গলা ভারি মিষ্টি।

আমাদের অনুরোধে উনি পরপর বেশ কয়েকটি গান গাইলেন।

পারস্পরিক কর্থাবার্তার মধ্যেই চলছিল গান।

আবির বলল, ‘তোমাদের গান-টান শেষ হলে আমি কিন্তু আমার পছন্দের গান শোনাব।’

আমি একটু অবাক হলাম, ‘তুই গান গাইবি?’

ওর দ্বিতীয় পেগ শেষ। বলল, ‘বলেছি যখন গান শোনাব, তো শোনাব। তুই চাপ নিস না।’

হরলালদা হঠাৎ আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গেয়ে উঠল, ‘ওরে আমি চাইলাম যারে পাইলাম নারে … বাস করে অন্যের ঘরে।’

সকলে হই হই করে উঠল। দেখলাম, বুলা আর কল্পনাদি জমিয়ে গল্প শুরু করেছে ইরার সঙ্গে। রাকেশ আর আবির নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় ব্যস্ত। আমি ছাদের কিনারে সমুদ্রের দিকে উঠে গেলাম।

সুইটি এগিয়ে এসে আমাকে বললেন, ‘আপনার সম্পর্কে অনেক কথা শুনলাম।’

‘ভালো, না মন্দ?’

‘ভালো! যা শুনেছি সবই ভালো।’

‘কী শুনেছেন যদি বলেন’, বলে আগ্রহসূচক ভঙ্গিতে চাইলাম।

‘শুনলাম আপনি লেখালেখি করেন, অনেক বইপত্র আছে।’

‘চেষ্টা করি একটু-আধটু। আপনি ড্রিংক্স নেন না?’

‘না, আমি ঠিক স্ট্যান্ড করতে পারি না। তবে এ ধরনের আসর যদি পরিচ্ছন্ন মানুষদের মধ্যে হয় তা খারাপ লাগে না।’

‘কী খারাপ লাগে আপনার?’

‘মানুষের নীচতা, পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা– মানুষের দোষের কি আর শেষ আছে?’

‘আর কী ভালো লাগে?’

‘রবীন্দ্রনাথ, আর নাচ। আমার একটা নাচের স্কুল আছে।’

‘নাচ শেখান আপনি?’

‘ওই আপনারই মতন। চেষ্টা করি একটু-আধটু। যাকগে ওসব, কোথায় পাব?’

‘কী পাবেন?’

‘আপনার বইপত্র?’

‘খুঁজবেন! পেয়ে যাবেন।’

‘কোথায় খুঁজব? কলেজ স্ট্রিটে যাওয়া সম্ভব নয়।’

‘যেখানে সবাই খোঁজে। গুগুলে, ফেসবুকে। ফেসটা তো চিনে রাখলেন, একই নামের হলেও আইডেন্টিফাই করতে অসুবিধা হবে না। একান্তই না হলে বলবেন, ওয়েবসাইটটা বলে দেব।’

‘আপনার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারটা যদি দেন, প্লিজ! অবশ্য যদি আপত্তি না থাকে।’

‘না না, আপত্তির কী আছে।’

ভদ্রমহিলা আমার নাম্বার নিলেন। বললাম, ‘একটা মিসকল দিয়ে দিন।’

সিগারেট হাতে আবির এগিয়ে এসে বলল, ‘মিস নয়, মিসেস কল।’ আমাকে প্যাকেটটা এগিয়ে দিল।

ভদ্রমহিলা মৃদু হেসে টেবিলে ফিরে গেলেন।

উনি চলে গেলে আবিরকে ইঙ্গিত করে বললাম, ‘ইন্টারেস্টেড?’

ও হেসে বলল, ‘উঁহু জমবে না আমার সঙ্গে।’

‘কী করে বুঝলি?’

‘ঠিক যেভাবে বুঝতে পেরেছিলাম নিরুপমার সঙ্গে জমবে।’

‘ক’ পেগ নিলি?’

‘বোধ হয় চার, পাঁচও হতে পারে। তোর তো দেখলাম গেলাসটা পড়ে আছে টেবিলে।’

বললাম, ‘নিলাম তো একটা।’ ‘আজ পার্টি থ্রো করার কারণ আমি আন্দাজ করতে পারছি।’

ও ডান হাত মুঠো করে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ তুলে ইঙ্গিতে জানাল মিশন সাকসেসফুল।

‘কাল কোথায় গেছিলি? সারা দিন দেখলাম না। কয়েকবার ফোন করলাম, বেজে গেল, ধরলি না।’

‘কোথাও যাবার দরকার কী? হোটেলে এত ঘর।’

‘বিশালাজি এখনও ফেরেননি শুনলাম’, আমি বললাম।

‘রিয়েলি গড ইস সো গুড, আজ রাতেও ফিরছেন না।’

রাকেশ হঠাৎ ফোন পেয়ে নীচে ছুটল।

অসীম এগিয়ে এসে আমাকে বলল, ‘তোমার মতলব কী? চলো চলো, টেবিলে চলো।’

টেবিলে যেতেই শুনলাম টেবিল বাজিয়ে সুইটির হাজবেন্ড জগন্নাথবাবু গান শুরু করেছেন, ‘মনে পড়ে রুবি রায়…’

হঠাৎ আবির চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘ধ্যাৎ, সব বাজে গান। এবার আমি গান শোনাব।’

বললাম, ‘শোনা, তোর গান তো কখনও শুনিনি।’

সকলে আগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল। ভাবলাম গান গাইবে। ও মোবাইলে সম্ভবত প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিল। বিশেষ কোনও বাটন টিপতেই গান বেজে উঠল, ‘দো বুঁদ মুঝে ভী পিলা দে শরাবি দেখ ফির হোতা হ্যায় ক্যা…’। সঙ্গে কোমর দুলিয়ে নাচ। ওর সঙ্গে যোগ দিল হরলালদা।

অসীম একটু লাজুক প্রকৃতির। ওদের উৎসাহ দিলেও নিজে নাচে যোগ দিল না। মহিলাবৃন্দ নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় ব্যস্ত।

আমি আবার একটু সরে গেলাম সিগারেট নিয়ে। সমুদ্রের দিকে ফিরলাম। খেয়াল করলাম, পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে, পাশ ফিরতেই দেখলাম, ইরা।

‘কিছু বলবে ইরাবতী?’

ইরাবতীর হাতে গেলাস। একটু ড্রাংক মনে হল। বলল, ‘অনেক কিছুই তো বলার ছিল দাদা।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলো না, নির্দ্বিধায় বলো।’

‘দাদা, আপনার বন্ধু সম্বন্ধে আপনি অনেক কিছুই জানেন, আমাকে কিছু জানতে দেন না কেন?’

আমি চুপ করে রইলাম।

সত্যি করে বলুন, ওর চরিত্রের ব্যাপারে আপনি কিছু জানতেন না? আপনার মৌনতা প্রমাণ করছে আপনি সব জানতেন। কোনও দিন আমাকে সে কথা বলেননি কেন?’

‘বলতে পারিনি। আমি কিছু বললে ওর কি পরিবর্তন হতো বলে তোমার মনে হয়? শুধু শুধু তোমার যন্ত্রণা বাড়ত।’

একটু চুপ থেকে ইরা বলল, ‘তা হয়তো ঠিক।’

‘আমার জায়গায় তুমি থাকলে তুমিও কি বলতে পারতে এসব কথা? ভেবে দ্যাখো একবার। বন্ধু হিসাবে যতটুকু বলার অনেক বার বলেছি।’

ইরা বলল, ‘মহিলাদের প্রতি ওর দুর্বলতার কথা বিয়ের বছর খানেকের মধ্যেই জানতে পেরেছিলাম। তবে আমল দিতে চাইনি। আমার তো পাশে দাঁড়াবার মতন কেউ নেই। মা-বাবা-অর্থ-সম্পত্তি-কোনও সাপোর্টই নেই। থাকার মধ্যে ছিল কিছুটা রূপ। ঈশ্বরের অভিশাপে সেটুকুও গেছে। নারীর শেষ এবং একমাত্র সম্বল স্বামীর ভালোবাসা, সেটুুকুও…।’

ইরা চোখ ফিরিয়ে নিল, বুঝলাম ওর চোখের কোল ভিজে উঠেছে।

‘দাদা, যন্ত্রণার কথা কোথায় জানেন, আজ আমাদের সন্তান না হবার জন্যও সর্বদা ও আমাকেই দায়ী করে। বলে, আমি নাকি একটা বাঁজা। অথচ তিন-তিনবার আমি মেডিকেল চেক-আপ করিয়েছি তিনটি আলাদা ক্লিনিকে। প্রত্যেকটি রিপোর্ট আমার ফেভারে।’

আমি ওর চোখের দিকে তাকাই। যে-জ্বলন্ত দৃষ্টি মেলে আমার দিকে চেয়ে ইরাবতী কথাগুলি বলছে তা একমাত্র চরম সত্য থেকেই উঠে আসতে পারে। অবিশ্বাস জাগার প্রশ্নই ওঠে না।

‘দাদা, আমার খুব লজ্জা করছে আপনাকে এসব কথা বলতে, খুব কষ্ট হচ্ছে। তবু বলছি, ওর গালাগাল, সময়ে-অসময়ে গায়ে হাত তোলা, দুর্ব্যবহার, লোকের সামনে আমাকে অপদস্থ করা– সব, সব আমি সহ্য করি মুখ বুজে। ওর মহিলাপ্রীতি, আকণ্ঠ মদ্যপান, সব মেনে নিই কেবল একটি কথা ভেবে…।’

ও চুপ করে যায়।

‘কী কথা?’

‘যদি ওকে জানাই, মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী আমি সেন্ট পার্সেন্ট ফিট, দোষ যদি কিছু থাকে তবে তা ওরই –এ কথায় মানুষটা হয়তো বড়ো কষ্ট পাবে, আঘাত পাবে মনে। ওর মধ্যে পৌরুষের অহং যে খুব খুব বেশি। ওকে কষ্ট দিতে যে আমি পারব না দাদা… কথাটা জানলে মানুষটার যে বুক ভেঙে যাবে!’

চুড়িদারের ওড়নায় মুখ চেপে ধরে কান্না চাপার চেষ্টা করে ইরাবতী। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দমকে দমকে কাঁদতে থাকে।

ওকে সান্ত্বনা দেবার মতন ভাষা আমার নেই। এই জীর্ণ-শীর্ণ কংকালসার নারীটির অসীম শক্তির কাছে কত সামান্য আমি। কী অপার ভালোবাসা বুকে থাকলে একজন মানুষ এতটা যন্ত্রণা নীরবে মুখ বুজে দিনের পর দিন সহ্য করে চলতে পারে। শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে আসে হৃদয়। ওপরে তাকাই, মাথার ওপর কৃষ্ণপক্ষের আকাশ। সামনে সমুদ্রের সীমাহীন অন্ধকার। গোপালপুর লাইটহাউসের বিশাল ঘূর্ণায়মান ব্লেড মাথায় আলো নিয়ে অবিরাম ঘুরে চলেছে। মোবাইলের সংগীতের সুরে তখনও মেতে আছে একজনই, আবির… হাতে বোতল নিয়ে ক্রমাগত নেচে-গেয়ে চলেছে, ‘আজ কি পার্টি মেরি তরফ সে…, আজ কি পার্টি….।’

———

সেদিনের সেই দিনগুলি

অনবরত চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল স্নেহার। বারবার ফিরে যাচ্ছিল অতীতের ফেলে আসা দিনগুলোয়। আনন্দের মুহূর্তগুলো বারবার স্নেহার স্মৃতিকোঠায় ফিরে আসছিল। আর কিছুক্ষণ পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে সে তাই বোধহয় এত স্মৃতি ভিড় করে আসছে মনে।

কলেজের সেই প্রথম দিনটা। কেমিস্ট্রি-র ক্লাস চলছিল। প্রফেসর নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের কেমিস্ট্রির জ্ঞান পরখ করার চেষ্টা করছিলেন। একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন। স্নেহার আজও মনে পড়ে, ঋদ্ধ একাই প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল। ঋদ্ধর বিষয়ের প্রতি এতটা গভীর জ্ঞান দেখে সেদিনই স্নেহা ঋদ্ধর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে।

কলেজে ওদের ক্লাসে সকলেই নতুন, তাই ছাত্র-ছাত্রীদের একে অপরের সঙ্গে পরিচয় হতে বেশ কয়েকটা দিন কাটল। একদিন স্নেহা কলেজে ঢুকতে গিয়ে দেখল ঋদ্ধ কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছে। স্নেহা-কে দেখে ঋদ্ধ এগিয়ে এল, ‘এত তাড়াতাড়ি কলেজে কী ব্যাপার। ক্লাস তো প্রায় একঘন্টা পর।’

‘বাবার, এদিকে একটা কাজ ছিল তাই আমিও বাবার সঙ্গেই বেরিয়ে পড়লাম। একটু না হয় লাইব্রেরিতে বসে সময় কাটাব’, হেসে জবাব দিল স্নেহা।

‘তাহলে চল, একটু ক্যান্টিনে বসা যাক’, ঋদ্ধকে না বলতে পারল না স্নেহা। প্রথম দিন থেকেই ঋদ্ধ-র প্রতি একটু বেশি দুর্বলতা বোধ করছিল স্নেহা।

ক্যান্টিনে বসে দু’জনে কফি খেতে খেতে গল্প করছিল। মাঝেমধ্যেই স্নেহা অনুভব করছিল ঋদ্ধর দৃষ্টি ওর মুখের উপর এসে কিছু যেন খোঁজার চেষ্টা করছে। ক্লাসের সময় এগিয়ে আসাতে দু’জনে ক্যান্টিন ছেড়ে ক্লাসরুমে এসে পাশাপাশি বসে পড়ে।

বিকেলে ক্লাস শেষ হবার পর ঋদ্ধ স্নেহা-কে বলে, ‘একটু দাঁড়া। স্যারকে বইটা দিয়ে এক্ষুনি আসছি। একসঙ্গে বেরোব।’

গেট অবধি পৌঁছোতেই ঋদ্ধ চলে আসে। দু’জনে হেঁটে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যায়। স্নেহা বলে, ‘ঋদ্ধ তুই এবার যা, বাস এলে আমি উঠে পড়ব। কিন্তু তুই তো এখান থেকে বাস পাবি না। তোকে তো একটু হাঁটতে হবে।’

‘হ্যাঁ যাচ্ছি। স্নেহা তোকে একটা কথা বলার ছিল। তোকে আমার খুব ভালো লাগে, সবসময় তোকে দেখার জন্য, কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকি। এটাই বোধহয় ভালোবাসা। আমি নিশ্চিত যে আমি তোকে ভালোবাসি।’

স্নেহা ঘটনার আকস্মিকতায় থ হয়ে যায়। কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে ওর মুখ। নিজের হূৎস্পন্দন যেন নিজের কানকেই আঘাত হানছে মনে হয় ওর। বাসটা এসে পড়ায় মুহূর্তের লজ্জার হাত থেকে নিজেকে কিছুটা বাঁচাতে পারে স্নেহা। সিটে বসে জানলা দিয়ে খেয়াল করে, ঋদ্ধ তখনও দাঁড়িয়ে বাসস্ট্যান্ডে।

বাড়ি ফিরে এক মুহূর্তের জন্যও ঋদ্ধর চিন্তা মন থেকে দূর করতে পারল না স্নেহা। ওর চোখের গভীর চাহনির আকর্ষণ যেন প্রতিক্ষণেই স্নেহাকে মনে মনে চঞ্চল করে তুলতে লাগল। প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে স্নেহা ঠিকমতো মনে করতে পারল না। ঘুম ভাঙল একেবারে সকালবেলায়। অভ্যাসমতো মোবাইল-টা ঘাঁটতেই চোখে পড়ল ঋদ্ধর পাঠানো ছোট্ট মেসেজটায়, ‘সুপ্রভাত। দেখা হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।’

রোমাঞ্চ অনুভব করল স্নেহা। ভালোবাসার প্রথম অনুভূতি বুঝি এমনটাই হয়, স্নেহার মনে হল। অনেক ভেবেও উত্তরে কী লিখবে বুঝতে পারল না। চিন্তা করার শক্তিও যেন লোপ পেয়েছে। ‘সুপ্রভাত’ লিখে পাঠিয়ে দিল স্নেহা।

শুরু হল স্নেহার জীবনের নতুন অধ্যায়। ঋদ্ধর সঙ্গে আলাপ হওয়া, রোজ কলেজে একসঙ্গে বসে ক্লাস করা, ভালোবাসার উড়ানে গা ভাসিয়ে দেওয়া এই সবকিছুই স্নেহার ভালো লাগতে আরম্ভ করল। উভয়ের দেখা না হওয়া পর্যন্ত মন অস্থির হয়ে উঠত। ক্লাস অফ থাকলেই পার্কে, কখনও গঙ্গার ধারে কখনও আবার কোনও মল-এ ওদের দুজনের একসঙ্গে দেখা পাওয়া যেত। কলেজেও দুজনকে নিয়ে ভালোই চর্চা শুরু হয়েছিল।

স্নেহা জানত, ঋদ্ধর মা-বাবা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান এবং কাকা-কাকিমার কাছে ও মানুষ হয়েছে। গ্রামের বাড়িতে থাকেন

কাকা-কাকিমা। শহরে একটা ঘর ভাড়া করে ঋদ্ধ থাকে। টিউশন করে কলেজের মাইনে দেয় ঋদ্ধ। পড়াশোনায় ভালো বলে প্রফেসররা নোট এবং বই দিয়ে ঋদ্ধকে সাহায্য করতেন একথাও অজানা ছিল না স্নেহার।

সেদিন কলেজে গিয়ে স্নেহা ঋদ্ধকে কোথাও দেখতে পেল না। একটা ক্লাস হয়ে যাওয়ার পর রীতিমতো চিন্তায় পড়ল স্নেহা। এতদিন হয়ে গেল ঋদ্ধ এরকম কখনও করেনি। ফোনেও কোনও মেসেজ করেনি। স্নেহা ঋদ্ধ-র নম্বরে ফোন করল। ফোন সমানে বেজে চলেছে ওপাশ থেকে কোনও উত্তর নেই। ভয় পেয়ে গিয়ে মরিয়া হয়ে আবার ফোন করল স্নেহা। এবার উত্তর এল। অস্ফুট কণ্ঠে উত্তর এল, ‘স্নেহা আজ আমি কলেজ যেতে পারব না। প্রচণ্ড জ্বর, উঠতে পারছি না। চিন্তা করিস না। জ্বরটা কমলেই কলেজ যাব।’

পরের দিনও ঋদ্ধ কলেজ আসতে পারল না। ক্লাসে কিছুতেই মন লাগল না স্নেহার। খালি মনে হচ্ছিল একবার ঋদ্ধ-কে দেখতে যাওয়া খুব দরকার। এত জ্বরে একা একা সবকিছু কী করে সামলাচ্ছে ঋদ্ধ।

ঠিকানা জানাই ছিল। বাড়ি খুঁজে পেতে তবুও বেশ কষ্ট হল। অনেকবার দরজায় ধাক্বা দেওয়ার পর ঋদ্ধ এসে দরজা খুলল। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, চোখদুটো জবাফুলের মতো লাল। ঋদ্ধকে দেখে কষ্ট হওয়ার বদলে রাগই হল স্নেহার। ‘এতটা জ্বর আর তুই কিছুই জানাসনি? ওষুধ খেয়েছিস? বাড়ির কাউকে জানিয়েছিস?’

চোখের পাতা খুলে রাখতে পারছিল না ঋদ্ধ। সেই অবস্থাতেই শিথিল স্বরে জবাব দিল, ‘কাকা-কাকিমাকে জানিয়ে কী হবে? শুধু শুধু অত দূরে ওনারা চিন্তা করবেন। আর ডাক্তারে কাছে যাওয়ার অবস্থা আমার ছিল না।’

দুদিনেই ঋদ্ধ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। চোখের নীচে কেউ যেন কালি ঢেলে দিয়েছে মনে হচ্ছিল। ঋদ্ধর অবস্থা দেখে স্নেহার কান্না পাচ্ছিল। হয়তো দুদিন কিছুই খাওয়া হয়নি ঋদ্ধর কারণ ও নিজেই রান্না করে খেত। এতক্ষণে ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখল স্নেহা। জিনিসপত্র এধার-ওধার ছিটিয়ে পড়ে আছে। ছোটো একটা কাঠের টেবিলের উপর কাচের গেলাসে অর্ধেকটা জল পড়ে রয়েছে আর একটা বিস্কুটের খোলা প্যাকেট রাখা আছে।

স্নেহা প্রথমে একটা বাটিতে জল ভরে, রুমালের সাহায্যে ঋদ্ধর কপালে জলপট্টি দিতে লাগল যাতে জ্বরটা একটু কম হয়। কপালটা একটু ঠান্ডা হয়েছে বলে মনে হলে উঠে ঘরদোর পরিষ্কার করে, জায়গার জিনিস জায়গায় গুছিয়ে রাখল। বাইরে বেরিয়ে সামনের দোকান থেকে ব্রেড আর দুধ নিয়ে ফিরে এল। দুধ ফুটিয়ে, ব্রেড সেঁকে ঋদ্ধকে জোর করে খাওয়াল তাও একটাই ব্রেড খেতে পারল ঋদ্ধ।

নিজেদের পারিবারিক ডাক্তারকে ফোন করে স্নেহা ঋদ্ধর অবস্থা জানাল। ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধের নাম জেনে দোকান থেকে ওষুধ কিনে এনে ঋদ্ধকে খাওয়াল। সন্ধে অবধি ঠায় বসে রইল ঋদ্ধর পাশে। ঋদ্ধর কৃতজ্ঞতা ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে কপট রাগ দেখাল স্নেহা। ‘আমার পক্ষে যেটুকু করা সম্ভব সেটুকুই করলাম। তোকে আর কৃতজ্ঞতা দেখাতে হবে না।’

‘জানিস স্নেহা, ছোটো বেলায় মা-বাবা মারা যাওয়ার পর আমার জীবন থেকে খুশি উধাও হয়ে গিয়েছিল। কাকু-কাকিমা আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু ওদের জন্য আমি বোঝা। তুই আমার জীবনে আসাতে আবার আমি নতুন করে ভালোবাসা পেয়েছি। তুই আমার যা সেবা করলি হয়তো আমার মা বেঁচে থাকলে এতটাই করত। তাই কৃতজ্ঞতা নয়, এটা আমার অনেস্ট কনফেশন।

অবশ্য কাকু-কাকিমার বিরুদ্ধে আমার কোনও নালিশ নেই। আমি তো তাদের নিজের সন্তান নই। তাঁরা যে আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন এটাই আমার পক্ষে যথেষ্ট’, ঋদ্ধর চোখ জলে ভরে আসে।

‘তুই চুপ করবি ঋদ্ধ। এইসব কথা বলার সময় নয় এটা। শরীরটা আগে। নিজেকে একলা ভাবিস না, আমি সব সময় তোর পাশে আছি।’ পাশে রাখা ভিজে তোয়ালে দিয়ে ঋদ্ধর মুখটা ভালো করে মুছে দিয়ে স্নেহা উঠে দাঁড়াল। ঋদ্ধর জ্বরটা একটু কমেছে বোধ হল। এদিকে সন্ধেও হয়ে এসেছে। দেরি হলে বাড়িতে সকলে চিন্তা করবে। নিজের কলেজের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিল স্নেহা, ‘ঋদ্ধ আজ আসি। দুধ আর ব্রেড রাখা রইল। পাত্রে দুধটা একটু গরম করে খেয়ে নিস। ওষুধটাও খাবি। রাত্রে কোনওরকম অসুবিধা হলে ফোন করিস। আমি একা মেয়ে রাত্রে কী করব এই ভেবে আবার সমস্যা নিয়ে বসে থাকিস না। আমি তোর জন্য সব কিছু করতে পারি।’

বাড়িতে এসেও ঋদ্ধর চিন্তাটা কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারল না স্নেহা। রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ঘরের দরজা বন্ধ করে ঋদ্ধকে ফোন করল। ঋদ্ধ অনেকটাই সুস্থ বোধ করছে জানতে পেরে নিশ্চিন্ত হল স্নেহা। বিছানায় গা এলাতেই ঘুমের জগতে পৌঁছে গেল।

চারদিনের দিন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠল ঋদ্ধ। এই দুদিন স্নেহা সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে বাড়ি থেকে ঋদ্ধর জন্য খাবার নিয়ে গিয়ে ওকে খাইয়ে আসত। ঘন্টার পর ঘন্টা ঋদ্ধ-র কাছে বসে ওর সঙ্গে গল্প করত। পঞ্চম দিন থেকে ঋদ্ধ কলেজ আসতে আরম্ভ করল। এই ক’দিনে ওরা দুজন আরও বেশি করে পরস্পরের কাছাকাছি এসে পড়েছিল এবং দুজনেই বুঝতে পারল একে অপরজনকে ছাড়া আলাদা থাকা তাদের কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।

দেখতে দেখতে কলেজে তিনটে বছর কেটে গেল। এই তিনটে বছর স্নেহার জীবনে সবথেকে সুখের যার স্মৃতি আজও স্নেহার মনে উজ্জ্বল। কলেজ শেষ হতেই ঋদ্ধ হায়ার এডুকেশনের জন্য অন্য একটি কলেজে অ্যাডমিশন নিল। স্নেহার বাবা মেয়েকে আর পড়াশোনা করাতে রাজি হলেন না। সুতরাং ঋদ্ধ-র সঙ্গে দেখা করাটা সমস্যা হয়ে উঠল স্নেহার কাছে। ঋদ্ধ-র সঙ্গে দেখা না হলেই মন খারাপ হয়ে যেত স্নেহার। ফোনে কথা বলে আশ মিটত না ওর।

স্নেহার মা-বাবাও মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা শুরু করে দিল। মেয়ের দায়িত্ব কতদিন আর বয়ে বেড়ানো যায়! বাড়ি থেকে বেরোতে হলে হাজার কৈফিয়ত। দিনের বেলা ঋদ্ধ-র কলেজ সুতরাং দেখা করতে হলে সেই সন্ধেবেলা। সেটাও স্নেহার বাবার জন্য বন্ধ হয়ে গেল। সন্ধেবেলায় বাড়ির মেয়ের রাস্তায় কী কাজ? রোজ মিথ্যা বলা সম্ভব নয়। একপ্রকার বন্দি জীবন হয়ে উঠল স্নেহার। সুযোগ পেলেই ঋদ্ধকে ফোন করে কিছু একটা উপায় বার করার জন্য অনুরোধ জানাত স্নেহা যাতে দুজনে একসঙ্গে থাকতে পারে। কিন্তু চাকরি ছাড়া কীভাবে বিয়ে করা সম্ভব সেটা ঋদ্ধ কিছুতেই ভেবে পেত না।

ছেলের বাড়ি থেকে কেউ দেখতে এলেই স্নেহার চোখে জল চলে আসত। ঋদ্ধকে ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে জীবন কাটানোর কথা ও ভাবতেই পরত না। এদিকে

মা-বাবাকে ঋদ্ধ-র সম্পর্কে জানাতেও কিছুতেই সাহসে কুলোতে পারছিল না স্নেহা। বাবা পুলিশে ছিলেন সুতরাং শক্ত ডিসিপ্লিনের মধ্যে মানুষ হতে হয়েছিল স্নেহাকে। যদিও একটিমাত্র কন্যা হওয়ার কারণে মা-বাবার আদরের সন্তান ছিল স্নেহা। স্নেহা মনে করতে পারে না, ওর সঙ্গে বাবা কোনওদিন উঁচু গলায় কথা বলেছেন বলে।

একদিন স্নেহার মা ওকে জানালেন পাত্রপক্ষ ওকে সন্ধেবেলায় দেখতে আসবে। পাত্র ডাক্তার। মন অশান্ত হয়ে উঠল। ঋদ্ধকে ফোনে সব কিছু জানিয়ে দেখা করার জন্য সময় নির্দিষ্ট করে নিল। বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার মিথ্যা অছিলায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঋদ্ধ-র সঙ্গে দেখা করল স্নেহা। ঋদ্ধকে দেখে চোখের জল বাধ মানল না।

‘ঋদ্ধ, প্লিজ তুই কিছু একটা কর। বাবার কাছ থেকে আমাকে চেয়ে নে। তোকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।’

স্নেহার মানসিক অবস্থা দেখে ঋদ্ধও কিছুক্ষণ কোনও উত্তর দিতে পারল না। স্নেহা একটু শান্ত হলে ঋদ্ধ বলল, ‘স্নেহা, আজ আমার নিজেরই দাঁড়াবার মতো সামর্থ্য নেই, আমি কোন মুখে তোর বাবার কাছে তোর হাত চাইব? উনি যদি মানা করে দেন তাহলে আমাদের দুজনেরই আশা ভেঙে যাবে। যতক্ষণ না আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছি ততক্ষণ তোকে ধৈর্য রাখতেই হবে। যোগ্য হয়ে উঠতে দে, ততদিন কিছু বলে মা-বাবাকে বুঝিয়ে রাখ। খুব শিগগির তোর বাবার কাছে যাব।’

‘যদি সত্যি সত্যি এরকম করতে পারতাম। শেষ নিঃশ্বাস নেওয়া পর্যন্ত তোর জন্য অপেক্ষা করতে পারতাম! জানি না কেন বাবা-মা আমার বিয়ে নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে? তুই একটু তাড়াতাড়ি কর, আমি সারা জীবন তোর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।’ একটু দম নেয় স্নেহা, ‘ঋদ্ধ আমি আর কাউকে বিয়ে করতে পারব না। তোকে না পেলে আমি আত্মহত্যা করব।’

ঋদ্ধ ঘাবড়ে গেল, ‘এই ভুল খবরদার করিস না। তোকে ছেড়ে থাকার কথা আমিও ভাবতে পারি না। কিন্তু আপাতত আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।’

ঋদ্ধ-র কাছে আশ্বাস পেয়ে এক বুক আশা নিয়ে স্নেহা বাড়িতে ফিরে এল। ঋদ্ধ প্রমিস করেছে, আর কয়েকটা দিন। তারপরেই ওরা দুটিতে একসঙ্গে সংসার পাতবে। সন্ধেবেলায় পাত্রপক্ষ এসে স্নেহাকে দেখে গেল। কলের পুতুলের মতো ওদের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেল স্নেহা। আর কয়েকটা দিনের অপেক্ষা।

কয়েক দিন পরেই স্নেহার স্বপ্নের সংসার গুঁড়িয়ে চুরমার হয়ে গেল। স্নেহার মা এসে জানালেন পাত্রপক্ষ স্নেহাকে পছন্দ করেছে। ছেলে এবার নিজে আসবে স্নেহাকে দেখতে। ঘাবড়ে গিয়ে স্নেহা ঋদ্ধকে ফোন করল। কিন্তু একি? রিং হয়ে যাচ্ছে অথচ ওধার থেকে কেউই কল রিসিভ করছে না। ঋদ্ধ-র হল কী? ফোন ধরছে না কেন? উৎকণ্ঠা বাড়তে লাগল স্নেহার।

মনে হল হয়তো কোনও কাজে ব্যস্ত রয়েছে। ফোন রেখে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল স্নেহা। আবার ফোন করল কিন্তু ঋদ্ধ ফোন ওঠাল না। এরকম তো ঋদ্ধ কখনও করে না। সেই মুহূর্তে ধরতে না পারলেও পরে পরেই ফোন করে নেয়। ঘড়ি দেখল স্নেহা। মধ্যরাত, এত রাতে বাইরে থাকারও কথা নয় ঋদ্ধর। চোখের পাতায় কিছুতেই ঘুম এল না। চেষ্টা করতেই লাগল। শেষমেশ উলটো দিকে ফোন সুইচ অফ হয়ে গেল। কোনও উপায় না দেখে বালিশ অাঁকড়ে স্নেহা কান্নায় ভেঙে পড়ল।

পরের দিন সকালে বাবা কাজে বেরিয়ে গেলে মিথ্যা বাহানা করে স্নেহা বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা ঋদ্ধ যে বাড়িতে ভাড়া থাকে সেখানে গেল। দরজায় তালা দেখে আশেপাশে জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারল, ঘর খালি করে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে ঋদ্ধ কোথাও চলে গেছে। কিন্তু কোথায় গেছে কেউ-ই বলতে পারল না। কী করবে, কোথায় যাবে কিছুই ভেবে পেল না স্নেহা। কাউকে কিছু না বলে ঋদ্ধ কোথায় যেতে পারে? ও যে এরকম করতে পারে কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না স্নেহার।

সন্ধে হয়ে আসতে মায়ের জোরাজুরিতে স্নেহাকে সেজেগুজে তৈরি হতে হল। ডাক্তার ছেলেটির দেখতে আসার কথা। স্নেহার খালি মনে হচ্ছিল ছেলেটির যদি ওকে দেখে পছন্দ হয়ে যায় তাহলে ও নিজের মনকে কী করে এই বিয়েতে রাজি করাবে? ঋদ্ধ ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করাটা ওর পক্ষে কখনওই সম্ভব হবে না।

মনকে কিছুতেই মানাতে পারছিল না, ঋদ্ধ-র হঠাৎ করে কোথাও চলে যাওয়ার ঘটনাটা। তাহলে কি শুধু ফূর্তি করার জন্যই স্নেহার সঙ্গে ভালোবাসার নাটক করল ও, না, না, এটাও কী সম্ভব! ঋদ্ধ-র চোখে ওর জন্য ভালোবাসা স্পষ্ট দেখেছে স্নেহা, সুতরাং নিজের চোখকে কী করে অবিশ্বাস করে স্নেহা? তাহলে কোনও কিছু না জানিয়ে হঠাৎ-ই ঋদ্ধ-র অন্তর্ধান হওয়ার পেছনে কী রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে?

ছেলে এসে স্নেহাকে পছন্দ করে গেল। স্নেহার বিয়ে নিয়ে বাড়িতে সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। চারিদিকে খুশির পরিবেশ। স্নেহার মা, আত্মীয়স্বজন সকলকেই মেয়ের বিয়ের ঠিক হওয়ার খবরটা জানিয়ে রাখলেন। বাবাও ধুমধাম করে একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেওয়ার আয়োজন শুরু করে দিলেন। এই হইচই-এর পরিবেশ থেকে স্নেহা নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখল কারণ রোজ একটাই প্রার্থনা করত স্নেহা, যাতে এই বিয়েটা কোনওভাবে ভেঙে যায়।

এই ভাবেই প্রায় এক মাস পার হতে চলল। ঋদ্ধ-র কোনও খবর পেল না স্নেহা। তবে একটা এমন ঘটনা ঘটল যাতে স্নেহার সমস্যা কিছুটা হলেও মিটল। হঠাৎই পাত্রপক্ষ স্নেহার সঙ্গে বিয়েটা নিয়ে কিন্তু কিন্তু শুরু করে দিল। স্নেহার বাবা ভিতর থেকে খবর আনলেন যে টাকার লোভে ছেলের অভিভাবকেরা অন্য জায়গায় ছেলের সম্বন্ধ ঠিক করেছে। খবরটা পেয়ে স্নেহা সবথেকে আনন্দ পেল। বহুদিন পর ওর মুখে হাসি ফুটল।

ঘুরতে ফিরতে ঋদ্ধকে ফোন করাটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল স্নেহার। কিন্তু এত কিছুর পরেও সেই ‘সুইচ অফ’ ছাড়া ওপার থেকে কোনও উত্তর পাওয়া গেল না। মেসেঞ্জার-এও মেসেজ পাঠাল স্নেহা কিন্তু উত্তর এল না। কয়েকদিন পর স্নেহা খেয়াল করল ঋদ্ধ ওকে ফেসবুকেও ব্লক করে দিয়েছে। খুব রাগ হল ওর, যাকে কাছে পাওয়ার জন্য ও মরিয়া হয়ে উঠেছে সেই-ই ওকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদি বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল না তাহলে প্রথমে বলে দিলেই হতো, এভাবে ভীতুর মতো কিছু না জানিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কী অর্থ ছিল?

ধীরে ধীরে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দিল স্নেহা। মোবাইলে ঋদ্ধ-র ফোন নম্বরটা টাইপ করতেও আর আঙুল চলত না স্নেহার। রোজই মনে হতো ঋদ্ধ-র ফোন আসবে। কিন্তু না একটা ফোন কল আর না যে নিজে একবারের জন্যেও স্নেহার সামনে এল। দু মাস ধরে লাগাতার চেষ্টা করে করে স্নেহা অবশেষে হার মানল। মোবাইলে ঋদ্ধর নম্বর ডায়াল করাই বন্ধ করে দিল। একদিন ঋদ্ধ-র নম্বরটাই মুছে দিল নিজের মোবাইল থেকে।

সময়ের স্রোত নিজের গতিতে বইতে লাগল। ইতিমধ্যে স্নেহার বাবারও বদলির খবর এল। শিলিগুড়িতে নতুন বদলি। সুতরাং পুরো পরিবার নিয়ে স্নেহার বাবা শিলিগুড়ি চলে এলেন।

ঋদ্ধকে পাওয়ার আশা স্নেহা পুরোপুরি ত্যাগ করে দিল। শিলিগুড়িতে এসে স্নেহার মনে হল এবার অতীতকে ভোলা অনেক সহজ হবে। বাড়িতে যখনই ওর বিয়ের কথা উঠত স্নেহা নিজের ভিতরে নিজেই গুটিয়ে যেত। বিয়ে এবং ভালোবাসা এই দুটো শব্দের সঙ্গে ওর শত্রুতা তৈরি হয়েছিল। স্নেহা বাড়িতে বিয়ে নিয়ে কোনওরকম আলোচনা করতে মা-কে বারণ করে দিল।

দু’বছরের উপর স্নেহা-রা শিলিগুড়িতে কাটিয়ে ফেলল। মাঝেমধ্যেই স্নেহার মনে হতো, আদৗ কি ঋদ্ধ কখনও ওর কথা মনে করে? পুরোটাই ওর যদি ছলনা ছিল তাহলে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি কেন দিল? একবার যদি ও নিজের মনের কথা জানাত তাহলে মনে হাজার দুঃখ পেলেও ও ঋদ্ধকে ক্ষমা করে দিতে পারত। সত্যিকারের ভালোবাসা যে আজও আছে, এই ভুলটা অন্তত ওর ভাঙত।

শিলিগুড়ি আসার পর থেকে বাড়ির বাইরে খুব একটা বেরোত না স্নেহা। ওর কিছু ভালো লাগত না। একদিন ওর মা জোর করে ওকে প্রতিবেশী কাকিমার বাড়ি নিয়ে গেল। একটা ছোটোখাটো অনুষ্ঠান ছিল। কাকিমার মেয়ে রূপা-কে পাত্রপক্ষের দেখতে আসার কথা ছিল।

মায়ের মন, তাই মনে হল বিয়ের পরিবেশ দেখে মেয়ের মনে যদি কোনও পরিবর্তন আসে। সন্ধ্যাকে সাজিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে আনার দায়িত্ব এসে পড়ল স্নেহার উপর। নিজে সাজতে ভুলেই গিয়েছিল স্নেহা। রূপাকে সামনে পেয়ে অতীত এসে আবার স্নেহার সামনে দাঁড়াল। এমনই সেজেগুজে ঋদ্ধ-র কাছে যেত স্নেহা। নিশ্চয়ই ওরই মধ্যে কোনও কিছুর অভাব ছিল যার কারণে ঋদ্ধ ওর জীবন থেকে সরে গেল।

ছেলের বাড়ির সকলেই এসে গিয়েছিল। ইচ্ছে না থাকলেও কাকিমার ইচ্ছেমতো রূপার শৃঙ্গার শেষ করে ওর হাত ধরে স্নেহা বসার ঘরের দিকে পা বাড়াল।

সামনে সোফায় বসা ছেলেটির দিকে তাকাতেই স্নেহার চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে এল। প্রতিটা ক্ষণ যার অপেক্ষা করে থেকেছে, যার জন্য এত চোখের জল ফেলেছে, নিজের সুখ-শান্তি সব ছেড়েছে আর যে কিনা ভীরুর মতো চুপিচুপি ওর জীবন থেকে পালিয়ে গেছে, সেই বিশ্বাসঘাতক ঋদ্ধ ওর সামনে বসে আছে। আজ সে আর একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করবে বলে এসেছে।

‘স্নেহা… স্নেহা…’ চোখ খুলতেই সেই পরিচিত মধুর আওয়াজ স্নেহার কানে এসে প্রবেশ করে। আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কেউ ওর মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে। বহু পরিচিত একটা স্পর্শ অনুভব করতে পারছে স্নেহা। পরিচিত বাহুর বেষ্টনী ওকে ঘিরে রয়েছে।

‘চোখ খোল স্নেহা…’ আবার সেই মধুর আওয়াজ কানে আসে।

‘ঋদ্ধ না?’ না চাইতেও মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে নামটা।

‘হ্যাঁ, আমি ঋদ্ধ।’

অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে স্নেহার চোখ বেয়ে। মনের ভিতর জমে থাকা অভিমান কথার মধ্যে বেরিয়ে আসে, ‘তুই কেন এভাবে আমাকে ঠকালি ঋদ্ধ? কেন আমাকে না জানিয়ে তুই পালিয়ে গেলি? আজও তোকে আমি খুঁজে যাচ্ছি। তোর জন্য অনেক কেঁদেছি, অনেক কষ্ট পেয়েছি। যদি আমাকে ছেড়ে চলেই যাবি ভেবেছিলি তাহলে আমাকে মুখের উপর বলে দিতে পারতিস। আমিই বোধহয় পাগল ছিলাম যে তোকে নিজের করে পেতে চেয়েছিলাম।’

‘স্নেহা, তোকে ছেড়ে এসে আমিও প্রচুর কেঁদেছি’, ঋদ্ধ বলে, ‘যেদিন তুই শেষবার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলি সেই দিনটার কথা তোর মনে আছে?’

‘হ্যাঁ… কেন?’

‘সেদিন তুই চলে যাওয়ার পর, তোর বাবা চার-পাঁচজন লোক নিয়ে আমার ওখানে আসেন। সবারই গায়ে পুলিশের পোশাক ছিল।’

‘সে কী…’, বিস্ফারিত চোখে ঋদ্ধর দিকে তাকায় স্নেহা।

‘হ্যাঁ, তোর বাবা এসে আমাকে শাসান, আমি যেন তোর সঙ্গে কোনওদিন আর দেখা না করি। তোর কাছ থেকে আমি যেন অনেক দূরে চলে যাই। নয়তো ফল ভালো হবে না। ওনার কোনও সহকর্মী আমাদের দুজনকে পার্কে বসে থাকতে দেখেছিল এবং তোর বাবাকে বলে দেয়। তোর বাবা চেয়েছিলেন আমাকে দূরে পাঠিয়ে তোর তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেবেন। আমার এখানে কিছুই করার ছিল না। পুলিশের সঙ্গে কী করে লড়ব বিশেষকরে যেখানে তোর বাবা উপস্থিত। তোর জীবনে যাতে ঝড় না আসে তাই আমি চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম।

নিজের সিম কার্ড ভেঙে ফেলে দিয়ে দিল্লি চলে যাই। ওখানে বন্ধুর বাবার মাধ্যমে একটা চাকরি জোগাড় করি আর বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোর জন্য নিজেকে তৈরি করতে থাকি। একবছর বাদে পরীক্ষা দিয়ে ব্যাংক-এ অফিসার পদে নির্বাচিত হই। কিন্তু সবকিছু হলেও তুই আমার জীবনে ছিলি না তাই স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও সুখ ছিল না। এই ভেবে মনকে শান্ত রাখতাম যে, এতদিনে নিশ্চয়ই তোর বিয়ে হয়ে গেছে আর তুই নতুন জীবনে সুখে আছিস। আবার কখনও এও মনে হতো, তুই আমার ছাড়া অন্য কারও কিছুতেই হতে পারিস না।

একবার তো সাহস করে কলকাতায় যাই এই ভেবে যে, হয়তো তুই আজও আমার অপেক্ষায় রয়েছিস। কিন্তু গিয়ে দেখি সপরিবারে তোরা অন্য কোথাও চলে গিয়েছিস। অনেক চেষ্টা করার পরেও তোদের খোঁজ না পেয়ে কাকু-কাকিমার জেদ আর ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিই। এখানে কাকিমার এই আত্মীয়ার সঙ্গে আমার বিয়ের কথাবার্তা হয়েছিল তাই আমার এখানে আসা। কিন্তু তোকে যখন একবার খুঁজে পেয়েছি, আর আমি তোকে হারাতে চাই না।’

স্নেহার পুরোটাই স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। আজ ওর বিশ্বাস হল, সত্যিকারের ভালোবাসা অটুট হয়। ঋদ্ধকে নিয়ে গর্ববোধ করল যে, এত বছরেও ঋদ্ধ ওকে ঠকায়নি।

ঠেলা

সামনের রোববার বিকেলে যেন কোনও কাজ রেখো না।

শ্রীদীপ্তা ড্রেসিং টেবিলের টুলটায় বসে মুখে ময়েশ্চারাইজার ঘষছিল। বাড়তি যত্ন চল্লিশ-এর দিকে ছুটে যাওয়া শরীর চায়। শ্রীদীপ্তা সে চাওয়া সারাদিনে না পারলেও রাতে মেটায়। কমপিউটার সি্্ক্রন থেকে মুখ তুলল না জয়। রীতিমতো উপেক্ষা মনে হয় শ্রীদীপ্তা’র। বেশ কিছু বছর ধরেই চলে আসছে এই ঘটনা। শুধু ছোট্ট একটা জবাব বুঝিয়ে দিল শোবার ঘরটায় শ্রীদীপ্তা একা নেই।

–আচ্ছা।

জয় এ রকমই। সবেতেই হ্যাঁ। অথচ থেকেও যেন নেই। সবার মতের বিপক্ষে বেরিয়ে আসা। ঘুপচি একটা ঘরে ভাড়া থেকে জীবন শুরু। তখন কিন্তু জয়ের মধ্যে তাপ পেয়েছে। দাঁতে-দাঁত চিপে দু’জনের লড়াই চালানো। জীবনের সিঁড়ি দিয়ে পাঁচজনের চেয়ে একটু দ্রুতই উঠেছে। রোজগার বেড়েছে। বেড়ে গেছে দু’জনের দূরত্ব। আগে রাগ হয়ে যেত। এখন সয়ে গেছে। এই ফ্ল্যাট, তার গোছগাছ, অর্পর স্কুলে ভর্তি হওয়া–সব ব্যাপারগুলোতেই যেন জয় নিজেকে কীভাবে আলগা করে নিয়েছে। শ্রীদীপ্তা মানে, একজন মাল্টিন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ-এর হাতে আজকাল খুব বেশি সময় থাকে না তার পরিবারের জন্য। তবুও যেখানটায় ন্যূনতম দায়িত্ব পালন বা সিদ্ধান্ত নিতে মতামত দেবার দরকার, তাও পাওয়া যায় না আজকাল ।

–শুনলে?

ল্যাপটপ বন্ধ হয়েছে এতক্ষণে।

–হ্যাঁ, শুনেছি। তুমি শনিবার সকালে একবার মনে করিয়ে দিও। সোমবার হেড অফিস রিপোর্টিং থাকলে, ক্যানসেল করাতে হবে ফ্লাইটের টিকিট।

চুপ আবার জয়। অসহ্য! ছেলেও ঠিক একই স্বভাবের হয়েছে। যত কম কথা বলা যায়! বাধ্য হয়ে শ্রীদীপ্তা বলে ওঠে, –জানতে চাইলে না, কেন?

–কেন?

বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে জয়। বুঝতে পারল না শ্রীদীপ্তা, চুপ করে যাবে না কথাবার্তা আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। বলেই ফেলে শেষমেশ।

–তোমার ছেলে এবার চেস-এ ডিসট্রিক্ট চ্যাম্পিয়ন হয়েছে জুনিয়র লেভেলে। রোববার রবীন্দ্রভবনে ওরা প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন সেরিমনিটা রেখেছে। কে একজন গ্রান্ড-মাস্টার আসছে। চিঠি দিয়ে ওরা ইনভাইট করেছে পেরেন্ট-দের।

আয়নায় নিজের ক্রিম ঘষা মুখটা ভালো করে দেখল শেষবার শ্রীদীপ্তা। এবার আলো নেভাবে। গর্ব না ক্রিম কীসে মুখ এত জ্বলজ্বল করছে, হদিস পেল না। কোনও কথা ভেসে এল না দেখে বিছানার দিকে ফিরে তাকায় শ্রীদীপ্তা।

অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে মাল্টিন্যাশনালের এক্সিকিউটিভ।

দুই

বাইরে হর্ন-এর আওয়াজ। মানে, সাড়ে তিনটে। ফিরল ছেলে। ম্যাগাজিনটা কোল থেকে সরিয়ে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে সোফা ছাড়ে শ্রীদীপ্তা।

দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ফ্ল্যাটে ঢুকল ছেলে। স্কুল ইউনিফর্মে যুদ্ধের চিহ্ন। একটা জুতোর ফিতে কখন খুলে গেছে। প্রায় নিজের ওজনের থেকেও ভারী একটা ব্যাগ পিঠে। খালি হয়ে যাওয়া ওয়াটার বটলটা বেসিনের নীচে প্রায় ছুড়ে ফেলে দিয়েই সোফায় বই-এর ব্যাগটাকে নামায় অর্প। সারাটাদিন স্কুলের ধকল সামলেও ছেলে যে এখনও কিছুটা তরতাজা, এতেই শান্তি পায় শ্রীদীপ্তা।

কতকগুলো বাঁধা প্রশ্ন থাকে ছেলের জন্য রোজ। আজকেও

একটা-একটা করে ছুড়ে দেবার জন্য তৈরি হল। অর্প এখন কিছু খুঁজছে সোফায়। টিভির রিমোটটা পেয়ে যেতেই সুইচ টিপে অন করে। চ্যানেল সার্ফ করতেই চোখের সামনে সব কিম্ভূতকিমাকার কার্টুন। বিস্ময় আর আনন্দ অর্পর মুখে। কিছু বলার নেই শ্রীদীপ্তার। ক্লাস সিক্সে পড়া তার ছেলে এখনই আওয়াল নাম্বার প্রায় সবেতেই। সেন্ট নিকোলাস-এর মতো স্কুলে ফার্স্ট বয়। কমপিউটার জিনিয়াস। ড্রয়িং-এ অন্তত ছ’টা জায়গার চ্যাম্পিয়ন। উপরি পাওনা, জেলা দাবা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে কিছুদিন হল। স্কুল থেকে ফিরে এই আধঘন্টা তাই ছেলে কার্টুন নেটওয়ার্কে সময় ব্যয় করলেও খুব একটা আপত্তি থাকার কথা নয়।

ছেলের পাশে এসে বসে শ্রীদীপ্তা। চ্যানেলের আলো ছেলের চোখের মণি আর মুখটায় মেখে গেছে। বেশ মায়াবী। এলোমেলো চুলে সিঁথিটা সারাদিনের ধকলে কোথাও হারিয়েছে। মমতা মাখিয়ে প্রশ্ন ছোড়ে শ্রীদীপ্তা –টিফিন শেষ করেছ আজ?

–হুঁ।

ছেলের মনের বেশিরভাগ জায়গা জুড়েই এখন কার্টুনের দাপাদাপি। অবশ্য প্রশ্নটা না করলেও চলত। টিফিনে আজ মিক্সড চাউমিন করে দিয়েছিল। টিফিন ফেরত আসার কথা নয়। ভীষণ পছন্দ করে চাইনিজ অর্প।

–হোমওয়ার্ক কপি সব ঠিক আছে?

– হ্যাঁ।

এ প্রশ্নটাও না করলে চলত। শেষ কবে অর্প-র হোমওয়ার্ক কপিতে কারেকশান হয়েছে, মনে পড়ে না শ্রীদীপ্তার। ঘামের গন্ধ ভেসে আসছে ছেলের গা থেকে। স্কুলের ইউনিফর্মটাও বেশ নোংরা লাগছে। এবার বিরক্তি জন্মাচ্ছে শ্রীদীপ্তার ভেতর। প্যান্টের দু’পাশটা তো রীতিমতো কালো। কীসের যেন ছোপ লেগে রয়েছে। কালকেই ফ্রেশ ইউনিফর্ম দিয়েছে। অথচ আজকের মধ্যেই ড্রেসটার এই অবস্থা! কী করে অর্পটা স্কুলে! মারপিট না কি ধুলোয় গড়াগড়ি খায়! এতক্ষণে জুতসই প্রশ্ন খুঁজে পেয়েছে ছেলেকে করার মতো!

–কালকেই তো নতুন ড্রেস দিলাম। এর মধ্যেই এই অবস্থা! করোটা কী স্কুলে!

–স্কুলে নয়।

ছেলে পাত্তাই দিল না প্রশ্নটায় যেন। রাগে ভিজছে শ্রীদীপ্তা।

–তবে?

ফিরল ছেলে ওর দিকে। চোখে মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়েছে। নরম হচ্ছে শ্রীদীপ্তার রাগ।

–মাঝ রাস্তায় আজ পুলকার স্টপ হয়ে গিয়েছিল। ঠেলতে হল।

–মানে! কারা ঠেলল!

শ্রীদীপ্তা অবাক। মুখ দিয়ে বিরক্তিকর শব্দ বেরিয়ে আসে ছেলের। তারপর বলে– কারা? মনীষ, অঙ্কুর, জিৎ আর আমি।

কঠোর হতে চেষ্টা করে শ্রীদীপ্তা এবার।

–যা করেছ, করেছ। তুমি গাড়ি থেকে নামবে না। বলবে ড্রাইভার আঙ্কলকে– মা বারণ করেছে।

–কেন! ওরা একা-একা লেবার দেবে! নাঃ, স্কুলে ফাদার ব্রুজ সবসময় আমাদের টিম এফোর্ট দিতে বলেন।

শ্রীদীপ্তা চোখ পাকাতেই চুপ করে যায় ছেলে। অর্প আবার ওই একই কাজ করবে! কথা শুনবে না! শ্রীদীপ্তা জানে, তার ছেলে এরকম নয়!

তিন

বেস ফোনটা বেজে উঠতেই বিরক্ত হল শ্রীদীপ্তা। বাথরুমে চানে মগ্ন ছিল। ভেজা শরীর নিয়ে ড্রয়িং-এ আসতে ভালো লাগে না। মেঝেটা জলে জলময় হয়ে যায়। অথচ আসতেই হবে। অর্প স্কুলে, জয় অফিসে। জয়-এর ফোন করার হ্যাবিট বিয়ের বছরখানেক পরই চলে গেছে। দাদা কি! হতেও পারে। চুলে একটা তোয়ালে জড়িয়ে ভেজা শরীরেও একটা তোয়ালে জড়াল শ্রীদীপ্তা। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল। ফোনটা তুলে হ্যালো বলতেই অপর প্রান্তে একটা গম্ভীর গলা সরব হয়।

– হ্যাঁ, এটা কি ৩ছছ…..?

– হ্যাঁ, বলুন।

শ্রীদীপ্তা সহজ হচ্ছিল। আবার প্রশ্ন। এবার শ্রীদীপ্তা সচকিত হয়ে ওঠে। –আসলে… একটা পুলকার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। একটু চুঁচুড়া হাসপাতালে আসুন।

মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল। নীচের তোয়ালেটা খুলে পড়ে গেল। গা-এর জল কখন শুকিয়ে গেছে শ্রীদীপ্তার।

–অ্যাঁ!

আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে গলাটা ওকে।

–না, দেখুন সবাইকেই হসপিটালাইজড করা হয়েছে। প্রত্যেকেই স্থিতিশীল। আমরা গাড়ির মধ্যে স্কুলের ব্যাগ সার্চ করে যাদের যাদের স্কুল ডায়ারি পেয়েছি, খবর দিচ্ছি।

হাত থেকে রিসিভার পড়ে যাচ্ছিল। তবুও সব শক্তিকে একত্রিত করল শ্রীদীপ্তা।

–আপনি কে বলছেন?

–আমি সন্দীপ নন্দী, ইনভেস্টিগেটিং অফিসার, লোকাল থানা।

আর কিছু বলার আগেই ফোন কেটে যায়।

চোখ জ্বালা করছে। কান-মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। দেয়ালে ঠেস দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে শ্রীদীপ্তা। কী করবে এখন! কেউ ইয়ার্কি মারল না তো!

হঠাৎ করে খেয়াল পড়ল ড্রাইভারের ঠিকানা আর ফোন নাম্বার। নোট করা আছে ডায়ারিতে। কোনওক্রমে একটা ম্যাক্সি গলিয়ে নিজেকে ঢাকল। তারপর ডায়ারি বের করে ফোন করল। নাঃ, সুইচ অফ। তাহলে কি সত্যি সত্যিই–? চোখ দিয়ে আপনা থেকেই জলের ধারা নোনতা স্বাদ নিয়ে মুখের গোড়ায় চলে আসছে। দু’বছর চেষ্টা করেও কনসিভ হয়নি অর্প। তারপর হঠাৎই একদিন ওর আসার অস্তিত্ব ধরা পড়া! কী আনন্দ, কী খুশি! এগারোটা বছর ধরে তিলে তিলে বেড়ে ওঠা…।

চোখের জল মুছে আবার কাঁপা-কাঁপা হাতে ডায়াল করল জয়-এর মোবাইলে। অফিস থেকে আসতেও ওর সময় লাগবে। রিং হচ্ছে। তুলল জয়।।

–হ্যালো-তুমি? শোনো, এই… এইমাত্র একটা ফোন এল থানা থেকে। বলছে, অর্পদের পুলকারটা নাকি অ্যাক্সি…।

কথা শেষ করতে পারল না শ্রীদীপ্তা। গলা ভিজে গেল। দম আটকে এল। জয়-এর গলা আশ্চর্য রকম শান্ত!

–কেউ ইয়ার্কি-ফিয়ার্কি–।

–না গো না। গলাটা ভীষণ সিরিয়াস লাগল। আর তাছাড়া অমিত-এর মোবাইলেও ট্রাই করলাম। সুইচ অফ। আমি কী করব! তুমি এখুনি…।

– হ্যাঁ, আসছি। আর এমনি কেমন আছে, কিছু বলল?

– স্টেবল, হসপিটালাইজড হয়েছে।

একটু চুপ থেকে জয় ভরসা জোগাল।

–তুমি একদম সোজা হসপিটালেই যাও। আর পারো তো, লোকাল থানায় যাচাই করে নাও। আমি আসছি। আর শোনো, সাবধানে।

মাল্টিন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ-এর গলাকে অনেকদিন পর কেঁপে যেতে শুনল শ্রীদীপ্তা।

চার

হাসপাতালের সিঁড়িতেই বসে পড়েছে শ্রীদীপ্তা। একদিক থেকে চিন্তা মুক্ত হয়েছে। অন্যদিক থেকে চিন্তা শতগুণ বেড়ে গেছে। প্রাথমিক শোকের ধাক্বা কাটিয়ে এখন ও উদ্বেগের শিকার। একটু দূরে করিডরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পুলিশ অফিসার আর কনস্টেবল-এর সঙ্গে কথা বলছে জয়।।

ঘন্টা দু’য়েক হয়েছে হসপিটালে এসেছে শ্রীদীপ্তা। জয় আসার আগেই পৗঁছে গিয়েছিল। খবর পেয়ে একে একে পৌঁছে গিয়েছিল অনিরুদ্ধ, জিৎ আর মনীষ-এর বাবা-মাও। প্রত্যেকেরই চোখে জলের রেখা। উদভ্রান্ত চেহারা। গোটা হসপিটালটায় ভিড়েভিড়াক্বার। বেশ কিছু পুলিশ। খবর পেয়ে দু-তিনজন সাংবাদিকও এসে গেছে। মৃত্যুর খবর বিক্রি করে ব্যাবসা– এখনকার সমাজের নতুন ট্রেন্ড। হাত-পা থর-থর করে কাঁপছিল। অপেক্ষা বাঁধ মানছিল না। হাসপাতাল চত্বরে আসতেই এবার নিজেকে একা লাগছে শ্রীদীপ্তার।

টুকরো টুকরো আলোচনা আর ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের কথা থেকে কাহিনিটা খাড়া করল কোনওক্রমে শ্রীদীপ্তা। পুলকার কোনও কারণে আজ আবার জিটি রোডের উপর বিগড়োয় স্কুল যাবার পথে। কিছু ছেলে ঠেলতে নেমেছিল। গাড়ি স্টার্ট হতে তারা আবার উঠেও পড়ে। হঠাৎই উলটোদিক থেকে আসা একটা লরি পুলকারটাকে ধাক্বা দেয়। আন্দাজ তখন সাড়ে আটটা। চারপাশের সব দোকান খোলেওনি। রাস্তায় সেভাবে ভিড়ও ছিল না। ভিড় জমার আগেই লরিটা পালিয়ে যায়। ড্রাইভার স্পটেই শেষ। অন্তত ছ’টা বাচ্চা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে এখন।

খুব তাড়াতাড়ি বাকি বাবা-মা’র সাথে এর্মাজেন্সি ইউনিটে পৗঁছেছিল শ্রীদীপ্তা। প্রত্যেকেরই পেটে আর বুকে সিরিয়াস চোট ছিল। একজনের ব্রেনে। ব্লাডের ব্যাগ, স্যালাইনের বোতল, ব্যান্ডেজ আর ছোপ ছোপ রক্তের মধ্যে আলাদা করে অর্পকে খুঁজে পাচ্ছিল না মা’র চোখ। কাচের দরজার উলটোদিকে দাঁড়িয়ে কেবলই ভগবানকে ডাকছিল শ্রীদীপ্তা। মস্তিষ্কে চোটটা যেন অর্প’র না লাগে। ওর ব্রেনের অনেক দাম। মুহূর্তে ও যেন স্বার্থপর হয়ে উঠছিল। দু’জন তাদের ছেলেকে চিহ্নিত করে আসার পরই শ্রীদীপ্তাকে ইশারা করে একজন নার্স। থর থর করে কাঁপতে থাকা পা দুটো নিয়ে এগিয়ে যায় শ্রীদীপ্তা।

একইরকম স্কুলড্রেস, ব্যান্ডেজ, আর ওষুধের গন্ধে হারিয়ে যাচ্ছিল সবকিছু। চোখে জলের ধারা কখন বন্ধ হয়ে গেছে। বমি পেয়ে যাচ্ছে তার বদলে। বার বার চোখের দৃষ্টি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে চেনার চেষ্টা করছিল শ্রীদীপ্তা যুঝতে থাকা দেহগুলোর মধ্যে তার নিজের দেহের অংশটা কোথায়! ভীষণ অবাক হয়ে যাচ্ছিল ও। অন্য রকম অস্বস্তি গ্রাস করছিল ওকে। মা হয়েও চিনতে ভুল হবে!

জয় আসতে ও আবার ছুটেছে ওয়ার্ডে। জয়ও চেষ্টা করেছে। নাঃ, আহতদের মধ্যে অর্প নেই। পুলিশ ওদের কাছ থেকে সেইমতো স্টেটমেন্টও নিয়েছে। কিছুতেই শ্রীদীপ্তা বুঝতে পারছে না, ছেলেটা কোথায় গেল! গাড়িতে অর্পর ব্যাগ, বই, টিফিনবক্স, ডায়ারি– সবকিছুই রয়েছে। অ্যাটেন্ডিং ডাক্তার ওকে অ্যাসিওর করেছে, যে মারা গেছে সে ড্রাইভার-ই। তার বাড়ির লোক আইডেন্টিফাই-ও করেছে।

কথা বলা শেষ পুলিশের সাথে। জয় এগিয়ে আসছে। শ্রীদীপ্তা বলল, ‘কী বলছে ওরা?’

–ব্যাপারটা বেশ মিস্টিরিয়াস! ওরা বলছে, ব্যাগ গাড়িতে ছিল। গাড়ি ওরা মাইনুটলি সার্চ করেছে। আশে-পাশেও। বডি বা ইনজিওরড– কাউকেই ওরা পায়নি।

–টয়লেট করতে-টরতে–।

–মনে হয় না।

–আমাদের একবার গেলে হয় না!

–আমাদের থেকেও ওদের এসব সেন্স অনেক বেশি। এটা ওদের প্রফেশন। ওরা ঠিক যেটা দেখার দেখে নিয়েছে।

জয় বিপদেও মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে। শ্রীদীপ্তা পারছে না। ছেলেটার মুখটা! উঃ! চোখে জলের ধারা বাঁধ মানছে না শ্রীদীপ্তার! মাতৃস্নেহ…।

–ওরা যে ঠিক বলছে, তার কী মানে?

সিঁড়িতে ওর পাশটাতেই বসে পড়ল জয় হঠাৎ। ফরসা মুখটা লাল। চোখেতে জল আসব আসব করেও উথলে ওঠেনি। বাবাদের কি কাঁদতে নেই! শ্রীদীপ্তার কাঁধে একটা হাত তুলে দিল।

–ভেবে দ্যাখো একবার। বেশ পাবলিক সিমপ্যাথি পেয়েছে ঘটনাটা। আর মিডিয়া তো এখন ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পুলিশকে তার দায়িত্ব পালন করতেই হবে।

নরম জয়-এর গলা। এ গলার অাঁচ অনেকদিন পরে পাচ্ছে শ্রীদীপ্তা। ভালোবাসা বোধহয় মরে না। এতদিন পরে যেন খুব হালকা ছোঁয়া পাচ্ছে। অনেকটা দুধ কড়ায় ফোটালে পরিমাণে কমে যায়। তৈরি হওয়া সলিড ক্ষীরটা তখন বোধহয় আরও টেস্টি। এরকম বিপদে জয়কে পাশে পাচ্ছে। যেভাবে জয় ওর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে, এও তো একধরনের প্রেমই। এ রকম দুর্ঘটনাই বোধহয় মানুষের মধ্যে বোধশক্তিকে জাগিয়ে দেয়। শ্রীদীপ্তা নতুন করে জয়কে আবিস্কার করছে। জয় আর ও আবার একসাথে লড়ছে। ঠিক যেভাবে বেশ কিছু বছর আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে শুরু করেছিল। লড়াইটা সেবারও ওরা জিতেছিল। এবারও…

আপনি কি জয় ঘোষ?

সামনে খেঁকুড়েপনা একটা লোক এসে দাঁড়িয়েছে। করিডরে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি বাবা-মা’র দিকে একবার তাকিয়ে নেয় শ্রীদীপ্তা। জয় উঠে দাঁড়িয়েছে।

– হ্যাঁ, বলুন।

– আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল। আপনার মোবাইল নাম্বার তো…জ্ঝজ্জ্ব্ব….।

– হ্যাঁ, হ্যাঁ বলুন না, কী ব্যাপার।

জয়-এর ভ্রু কুঁচকে গেছে। বুকে এবার হাতুড়ি পিটছে ওর। জয় এগিয়ে গেল লোকটার সাথে। শ্রীদীপ্তাও হাঁটা দিল পেছন পেছন। কথাগুলো ভেসে আসছিল ওর কানে।

–আমার একটা চা-এর দোকান আছে। যেখানে অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে, সেখান থেকে একটুখানি।

শ্রীদীপ্তা পা চালিয়ে ওদের মধ্যে পৗঁছে গেছে। জয় দাঁড়িয়ে গেছে। ওরা এখন হসপিটাল মেন গেটের কাছাকাছি।

–হ্যাঁ, কিন্তু আমার মোবাইল নাম্বার কী করে আপনার কাছে –!

লোকটা চারদিক তাকিয়ে নেয়। তারপর হেসে বলে ওঠে– আপনার ছেলে দিল।

–মানে!

জয় চিৎকার করে উঠেছে। শ্রীদীপ্তার মনে নতুন শঙ্কা। শেষে কি ছেলে অপহরণ হল!

–কিন্তু ও কোথায়?

জয় দাঁতে দাঁত ঘষছিল। অজান্তেই খামছে ধরেছে

জয়-এর জামাটা ও।

–বাইরেই রিকশায় বসে আছে। ফোনই করতাম। একটু কিন্তু কিন্তু লাগল।

–ওর কাছে নিয়ে চলুন।

এবার শ্রীদীপ্তা মুখ খুলেছে।

–হ্যাঁ, আসুন না।

লোকটার ব্যবহারে এবার একটু একটু করে সন্দেহ কমছে শ্রীদীপ্তার।

– হ্যাঁ, ব্যাপারটা কী হল! যেতে যেতেই পুরো ব্যাপারটার রহস্য ভেদ করতে চাইছে জয়।

লোকটাও যেন তৈরিই ছিল বলার জন্য।

–আসলে অ্যাক্সিডেন্ট হবার সময় আপনার ছেলেও গাড়িটাকে বাইরে থেকে ঠেলছিল। কোনও কারণে গাড়ি বা ওর বন্ধুরা এগিয়ে যায়। আর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঘটনাটা ঘটে আপনার ছেলের চোখের সামনে। ভয়ে, আপনার ছেলে আমার দোকানে ঢুকে যায়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল শ্রীদীপ্তা। লোকটা থামতেই জয় বলে ওঠে, –তারপর?

–দোকানে তখন আমি আর আমার কর্মচারি ছিলাম। ওদিকে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিড় জমে গেল। এদিকে আপনার ছেলের এই অবস্থা। তখনও আমরা ভাবছি, ছেলেধরা-টরা হবে। দোকানের ঝাঁপ ফেলে দিলাম ভয়ে। দুধ খাইয়ে ওকে চাঙ্গা করতে আপনার নাম, ফোন নাম্বার পেলাম! খবর পেলাম, সব বাবা-মা’রা এখানেই আসছে। তাই…।

চোখে পড়েছে শ্রীদীপ্তা-র অর্পকে। চুপটি করে বসে আছে রিকশায়। দৗড়ে চলে যায় ছেলের কাছে। রিকশা থেকে ছেলে নেমে আসতেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। একদম অক্ষত ছেলে। এগিয়ে আসে জয় আর লোকটি। জয় লোকটার একটা হাতকে দু’মুঠোর মধ্যে ধরে নিয়েছে।

–কী বলে যে আপনাকে…।

– না, না। কোনও ব্যাপার নয়। আসলে ভয়ই লাগছিল নিজেরও। না কেস খাই! নতুন দোকান। কারওর ভালো করতে যাওয়াটাও আজকাল বিপদ!

শ্রীদীপ্তা ছেলের দিকে তাকায়। আর পুলকার নয়। এবার নিজেই।

নাম, ঠিকানা জানার পর ভদ্রলোককে একদিন বাড়িতে আসতে বলল জয়। হঠাৎই দিনটাকে আবার ভালো লাগতে শুরু করেছিল শ্রীদীপ্তা-র। সব রাতের শেষেই যেমন দিন, সব টেনশনের শেষে একটা স্বস্তি লুকিয়ে থাকে। শ্রীদীপ্তা’র সব টেনশন এখন যেমন আছড়ে পড়েছে হসপিটাল চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু বাবা-মা’র উপর।

শ্রীদীপ্তা হালকা ঝাঁকুনি দেয় অর্পকে।

–ওরা তো দৗড়ে ঢুকে পড়েছিল গাড়ির ভেতর। তুই কোথায় ছিলিস! অর্পর মুখ নীচু।

–জুতোর ফিতেটা খুলে গেল! বাঁধছিলাম আর ঠিক…তখনই…  ঞ্জ

ফাঁদ

হাতকাটা গোপাল ঘরে বসে ভোজালিটা একটু ধার দিয়ে নিচ্ছিল। গোপাল জীবনে এমন কোনও বাজে কাজ করতে বাদ রাখেনি। এক সময়ে টাকার জন্য ওয়াগন ব্রেকারদের সাথে রাতের পর রাত কাজ করেছে। তারপর একটা রাজনৈতিক দলে ঢুকে সত্তর-একাত্তর সালে অনেক বোমাবাজি করেছে। তাদের হয়ে বোমা বেঁধেছে। কয়েক বছর আগে বোমা বাঁধতে গিয়ে ওর একটা হাত উড়ে যাওয়ায় সবাই ওকে হাতকাটা গোপাল হিসেবেই চেনে।

কিছুদিন বর্ষাতিয়ার দলেও কাজ করেছে। এখন নিজের দল

বানিয়ে কাজকর্ম চালায় তাই বর্ষাতিয়ার সাথে প্রায়ই গণ্ডগোল লেগেই থাকে। আজকাল অপরাধ জগতে বেশ নাম-ডাকও হয়েছে। তবে গর্ব করে বলে যে গোপাল বা তার দল কোনও মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায়নি। আর ওর এই গুণটার জন্য পাড়ার লোকেরাও ওকে নিয়ে মাথা ঘামাত না।

হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ হতেই ঘরের এককোণে ভোজালিটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কারণ ওর দলের সকলকে বলা আছে, কেউ দরজায় আওয়াজ না দিয়ে ঘরে ঢুকবে না। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল ‘জাসসি’ ঘরে ঢুকছে। মুখে সেই ভুবন ভোলানো হাসি। জাসসি এখন অপরাধ জগতের ‘বিউটি কুইন’ নামেই পরিচিত। গোপাল জাসসি-র দিকে তাকিয়ে ভাবছে– মেয়েটা সুন্দরী এতে কোনও সন্দেহ নেই। শ্যাম্পু করা কালো রেশমের মতো চুল ঘরের আলোয় চকচক করছে। ওকে দেখে আর যাই হোক কুখ্যাত একটা চোরের দলের সদস্য বলে মনে হয় না।

–কিরে তুই এই অসময়ে? আমি-তো অন্য কেউ ভাবছিলাম।

–এসেছি একটা কাজে। বলেই হাতের ব্যাগটা টেবিলে রেখে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল।

ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে গোপালকে কাত করার চেষ্টা করল। এই হাসিটাই ওর একটা বড়ো সম্পদ। বলল– গোপাল, আমার ধারণা আমরা একজন আর একজনকে ভালোমতো বুঝতে পারি। সেটা বুঝতে পেরেছি বর্ষাতিয়ার দলে একসাথে কাজ করতে গিয়ে। আর এখন এটাও জেনে গেছি যে বর্ষাতিয়ার সাথে তোর

সাপে-নেউলের সম্পর্ক।

–তা তোর আসার উদ্দেশ্যটা কী বল। কী খাবি? ঠান্ডা না গরম?

–না থাক। আজ হাতে সময় নেই। তাছাড়া কেউ জানতে পারলে এতক্ষণে খবর পৗঁছে যাবে বর্ষাতিয়ার কাছে।

–তুই তো আজকাল বর্ষাতিয়ার খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিস। এমনকী শুনেছি তুই নাকি বর্ষাতিয়ার লাইফ পার্টনার হতে চলেছিস?

–সব বাজে কথা। আজকাল বর্ষাতিয়া রুমি-র সাথে খুব ঢলাঢলি করছে। অযোগ্য মেয়েটার প্রেমে মজে ওর পরামর্শে আমাকে দল থেকে বের করে দিয়েছে। এত খারাপ লাগছে তোকে কি বলব। আমার মাথায় এখন অপমানের আগুন দাউ-দাউ করে জ্বলছে। আর সে জন্যই তোর কাছে এসেছি।

–বলে ফ্যাল। তুই কি আমার দলে যোগ দিতে এসেছিস? তা যদি ভেবে থাকিস তাহলে সরি, আমি তোকে নিতে পারব না। আমার দলে আমি জেনেশুনেই কোনও মেয়েকে রাখি না। শালা, মেয়ে এলেই লাফরা শুরু হয়ে যাবে। আর তুই তো এমনিতেই মক্ষীরানি। তাই ঝগড়াটা বেশ ভালোই হবে। তুই তো সবাইকে খেলিয়ে বেড়াবি সিনেমার নায়িকাদের মতো।

মৃদু হেসে জাসসি জবাব দিল– বোকার মতো কথা বলিস না গোপাল। কোটি টাকা দিলেও আমি তোর দলে কাজ করব না। ধূর্ত শিয়ালকে বিশ্বাস করা যায় কিন্তু তোকে যায় না। যাক সে কথা। আমি এসেছি তোকে সাবধান করে দিতে।

মৃদ শিস দিতে দিতে গোপাল বলল– বল, কী বলতে এসেছিস।

–ভাবিস না হঠাৎ তোর প্রেমে পড়ে গিয়ে তোকে সব বলতে এসেছি। আমি এসেছি বর্ষাতিয়ার অবিচারের বদলা নিতে। তুই তো জানিস, দিল্লি থেকে অ্যান্টিক জিনিসের ব্যবসায়ী রামলাল আগরওয়াল এসেছে শহরে নিলামে একটা অ্যান্টিক দামি হরিণ বিক্রি করার জন্য, যেটার দাম এর মধ্যেই পঞ্চাশ লাখের ওপর উঠে গেছে। বড়ো অঙ্কের বিমা পলিসিও করিয়েছে জিনিসটার জন্য…।

–জানি, অ্যান্টিক হরিণটা সোনার তৈরি আর ওটার গায়ে নানা রকম দামি দামি রত্ন বসানো। সম্রাট আকবরের আমলের জিনিস ওটা। আগের আমলে মুখশুদ্ধি বা মশলা-দানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো ওই হরিণটা। শুধু তাই নয়, ওই হরিণটার পেটের জায়গাটাতে যেখানে মশলা রাখা হতো সেখানে একটা দামি হিরাও রাখা আছে।

ধানাই-পানাই ছেড়ে তুই আমাকে কেন এসব শোনাচ্ছিস সেটা বল।

–বর্ষাতিয়া জেনে গেছে যে তুইও হরিণটার পেছনে লেগে আছিস।

–জেনেছে তো কি হয়েছে? বয়েই গেলো। তুই কি আমাকে সাবধান করতে এসেছিস? এটা হল বিজনেস। আমি শালা বর্ষাতিয়ার বাবার পয়সায় খাই না বুঝলি। গিয়ে বলে দিস তোর বসকে। আসল কথাটা বল।

–শোন তাহলে,  রামলাল আগরওয়াল যে-বাড়ির ফ্ল্যাটে উঠেছে, সেই বাড়ির ঠিক ওপরের ফ্ল্যাটে তুই তোর দলের আববাসকে ভাড়াতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিস কারণ তুই আগেই ওই রেনডিয়ারটা হাতাতে চাস। বর্ষাতিয়ার ধারণা যে ওই রামলাল আগরওয়ালকে চোখে চোখে রাখার জন্যই তুই এটা করেছিস। তোকে সে সুযোগ দিতে চায় না বর্ষাতিয়া। আগামীকাল রাতেই বর্ষাতিয়া ওটা চুরি করতে চায়। এখন তোর উচিত, তার আগেই কাজটা সেরে ফেলা। বর্ষাতিয়া, আগরওয়ালের ফ্ল্যাটের নকল চাবি বানিয়ে ফেলেছে। ওর আয়রন সেফ খোলার পিন নম্বরও জোগাড় করে ফেলেছে। আমি সেগুলো চুরি করে নিয়ে এসেছি।

আমি জানি আমাকে ধরে ফেললে বর্ষাতিয়া আমাকে মেরে ফেলবে তাই আগামীকাল শহর ছেড়ে দেব ঠিক করেছি। তবে ভাবিস না আমি বিনা স্বার্থে এটা করছি। আমার বদলা নেওয়াও হবে আর আমার অর্ধেক ভাগ চাই আগামীকাল সকালে। তোকে আজ রাতের মধ্যেই কাজটা করতে হবে। হাতে সময় বেশি নেই। রামলাল আগরওয়াল এখন গ্র্যান্ড হোটেলে গেছে। সেখানে মদ খেয়ে নাচানাচি করছে। ফিরতেও অনেক রাত হবে। তাই আজই সবচেয়ে ভালো সুযোগ। দেরি করিস না। কাজটা চুপচাপ করে ফেল। আর আমি জানি একমাত্র তুই-ই পারবি এটা করতে। তুই যদি ওটা বিক্রির টাকা আমাকে না-ও দিস আমার দুঃখ নেই। আমি বর্ষাতিয়ার থেকে প্রতিশোধ নিতে পারলেই খুশি।

–আমাকে একটু ভাবতে দে জাসসি।

গোপাল কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। নীরবে ভোজালিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। কিন্তু মনটা অন্য কোথাও পড়ে আছে। দেখেই বোঝা যায় কি একটা চিন্তা করছে। এমন সময় বাইরে থেকে হরবোলা মন্টুর আওয়াজ শোনা গেল। মন্টুকে এলাকার সবাই চেনে। মুখ দিয়ে নানা রকম আওয়াজ করে কিছু উপার্জন করে আর বাচ্চাদের আনন্দ দেয়। উঠে গিয়ে জানলার সামনে দাঁড়াল গোপাল। দেখল মন্টু ওর দিকে তাকিয়ে আছে। গোপাল বুঝল, ওকে কোনও জরুরি খবর দিতে এসেছে। মাঝে মাঝেই দেয়। কারণ, মন্টু হরবোলা ওর চর।

জাসসি কে উদ্দেশ্য করে বিরক্তির ভঙ্গিতে বলল– দেখলি তো কি রকম আওয়াজ শুরু করেছে। টাকা না দিলে যাবে না, এরকম ভ্যা ভ্যা করতে থাকবে। যাই, দুটো টাকা দিয়ে আসি।

ঘরের বাইরে সামনের গেট দিয়ে না বেরিয়ে পেছনের গেট দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। দেয়ালের ছায়ায় দাঁড়িয়ে রাস্তার অন্য পাড়ে তাকিয়ে দেখল বেশকিছু বাচ্চার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মন্টু হরবোলা। ইশারায় কাছে ডাকল। পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে মন্টুর দিকে এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল– কি গো মন্টুদা, কোনও খবর আছে নাকি?

পাঞ্জাবির ছেঁড়া পকেট থেকে ডান হাতটা বেরিয়ে এল মন্টুর। গোপালের হাত থেকে টাকাটা নেওয়ার সময় একটুকরো কাগজ গুঁজে দিল গোপালের হাতে।

–সাবধানে থাকবেন, গোপালদা, এই কাগজে সব লিখে দিয়েছি, পড়লেই বুঝতে পারবেন। তারপর গোপালের দেওয়া ক্র্যাচে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল।

গোপাল আবার বাড়ির দরজার কাছে ফিরে এল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাগজটা ভালো করে পড়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বড়ো হাইড্রেনে ফেলে দিল। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখল জাসসি টিভিটা খুলেছে। গোপাল ঘরে ঢুকতেই জাসসি জিজ্ঞাসা করল– গোপাল, কী ঠিক করলি? হাতে কিন্তু তোর বেশি সময় নেই। আজ রাতের মধ্যেই কাজটা সারতে হবে।

গোপাল মাথাটা ঝাঁকাল। বলল– কাজটা হয়ে যাবে জাসসি। কাল সকালে খবর পেয়ে যাবি।

জাসসি একটু মুচকি হাসল, বলল– আমি জানতাম একমাত্র

তুই-ই পারবি, তাই তো তোর কাছেই এলাম। বলে ব্যাগ থেকে একটা চাবি আর এক টুকরো কাগজ বের করে টেবিলে রাখল। বলল– চাবিটা আগরওয়াল-এর ফ্ল্যাটের আর কাগজে লেখা আছে ঘরের ভেতরে যে সেফটা আছে, তার কোড নম্বর। আমি চলি রে। আমাকে এগিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। কেউ দেখে ফেলতে পারে। সাবধানে থাকিস। বলেই বেরিয়ে গেল জাসসি। যাওয়ার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেল।

( দুই )

অনেকক্ষণ চুপচাপ দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল গোপাল। কী যেন চিন্তা করছে। পরিস্থিতিটা বেশ মজার। মোবাইল থেকে  আববাসকে ফোন করল। অনেক কথা হল, কথার শেষে বলল– আববাস, আমি তোর ফ্ল্যাট-এ আসছি। দুজনের কথা হল ফোনে। তারপর চাবিটা আর কাগজে লেখা পিন কোডটা সঙ্গে নিল। রাস্তায় নেমে হাঁটতে শুরু করল অলোকনন্দা অ্যাপার্টমেন্টের উদ্দেশে। বাড়িটা খুব দূরে নয়। হেঁটে যেতে অল্প কয়েক মিনিট লাগল। বাড়ির গেটে পৌঁছে দেখল গার্ড গুমটির ভেতরে বসে বসে ঘুমোচ্ছে। নিঃশব্দে মূল গেটের কোনায় লাগানো ছোটো দরজার পাল্লাটা খুলে ঢুকে পড়ল গোপাল। খুব দ্রুত গতিতে আববাসের ফ্ল্যাটে গিয়ে পৌঁছোল। আববাস সেখানে অপেক্ষা করছিল গোপালের।

গোপাল– আববাস, আমি আগরওয়ালের ফ্ল্যাট-এ যাচ্ছি। তুই ওপরের জানালা থেকে নজর রাখ। কেউ এলে সিগন্যাল দিবি। সিঁড়ি দিয়ে নীচের ফ্ল্যাট-এ নেমে এসে দরজায় কান পেতে বোঝার চেষ্টা করল যে কেউ আছে কিনা। যখন বুঝল ভেতরে কেউ নেই তখন জাসসির চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল।

কুড়ি মিনিট পর ঘর থেকে বেরিয়ে, নিঃশব্দে দরজাটা লাগিয়ে, মৃদু শিস দিয়ে আববাসকে ডাকল। সিঁড়িতেই নেমে এল আববাস। তারপর ঘুমন্ত গার্ডের পাশ কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল দুজনে। হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে বলল– আববাস, শরবতের সাথে মনে হয় তোর ঘুমের ওষুধটা একটু বেশিই দিয়ে দিয়েছিস। তোর আর ওখানে থাকা চলবে না। বলেই নিজের ফ্ল্যাটের দিকে রওনা হল।

–ঘটনাটা কী গুরু? তুমি যখন আগরওয়ালের ফ্ল্যাটে ঢুকলে, তখন আমি দু-জন লোককে রাস্তার অন্যদিকে দাঁড়িয়ে এই ফ্ল্যাটের দিকে নজর রাখতে দেখেছি। মনে হল সাদা পোশাকে পুলিশের লোক। তুমি পিছনে লক্ষ্য করো, ওরা আমাদের ফলো করছে। হাসল গোপাল, কোনও উত্তর দিল না।

দশ মিনিট পর আববাসকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ঢুকল গোপাল। বেরোনোর সময় ঘরের লাইট, ফ্যান ও টিভিটা অন করে গিয়েছিল। গোপাল বলল– আববাস, আজ বর্ষাতিয়ার প্রেমিকা জাসসি এসেছিল। আমাকে বেশ ভালো একটা গল্প শোনাল। বর্ষাতিয়া নাকি অন্য একটা মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে আর তাই জাসসিকে তাড়িয়ে দিয়েছে। জাসসি প্রতিশোধ নিতে চায়, তাই আগরওয়ালের ফ্ল্যাটের নকল চাবি আর আয়রন সেফের কোড নম্বর লেখা কাগজ চুরি করে এনেছে বর্ষাতিয়ার থেকে। সেগুলো আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছে আজই যেন ওই দামি হরিণটা চুরি করে সরিয়ে ফেলি। তাহলে বর্ষাতিয়া আর সেটা পাবে না আর জাসসি-র-ও প্রতিশোধ নেওয়া হবে।

 

জানিস, আমার গল্পটা শুনে খুব কাঁচা মনে হয়েছে। ওটা চুরি করতে হলে আমাকে দিয়ে কেন? জাসসি তো নিজেই চুরি করতে পারত। আপন মনে যখন এসব কথা ভাবছিলাম, তখন হরবোলা মন্টুদা আমাকে সংকেত দিল। আর তখন জাসসি আমার ঘরে বসেছিল। মন্টুদাকে ভিক্ষে দেওয়ার নাম করে নীচে নেমে গেলাম। মন্টুদা কাগজে লেখা একটা মেসেজ দিল। আমাকে সাবধান করে দেওয়ার জন্য। দুদিন আগে মন্টুদা বর্ষাতিয়া, আগরওয়াল আর জাসসি-কে মিটিং করতে দেখেছে। জানলার পাশের টেবিলে বসে কথা বলছিল ওরা। সন্দেহ হওয়ায় মন্টুদা কান পেতে ওদের কথা শুনেছে।

 

আমাকে ফাঁদে ফেলার পরিকল্পনা করছিল ওখানে বসে। জাসসি যখন বলেছিল ও টাকা চায় না, তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। ও তো টাকার জন্য সব কিছু করতে পারে, তবে টাকার কথা বলাতে আমার সন্দেহটা বেড়ে গিয়েছিল। আর মন্টুদার খবরটা পেয়ে আরও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম। ওরা জানত, আগরওয়ালের হরিণটার ওপর আমার নজর আছে। ওরা ঠিক করেছিল আমাকে চুরি করার সুযোগ করে দেবে আর পুলিশ ইন্সপেক্টর বদ্যিনাথ দত্ত-কেও জানিয়ে রাখবে। পুলিশ আমার ওপর নজর রাখবে। এভাবে পথের কাঁটা সরাতে চেয়েছে বর্ষাতিয়া। অর্থাৎ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা আর কি!

–গুরু, আজকাল তুমি তো বেশ পোড় খাওয়া লোকের মতো কথা বলছ। তোমার দিমাকটাও আজকাল বেশ চলছে।

–তুই আর তেল লাগাস না তো! ওরা বুঝতে পারেনি যে আমি ওদের ফন্দিটা বুঝতে পেরেছি। ওরা হয়তো ভাবছে আমি ওদের ফাঁদে পা দিয়েছি। দেখবি একটু বাদেই হয়তো পুলিশ আসবে আমার কাছে। শুনলাম ওই দামি হরিণটা নাকি ইন্স্যুরেন্স করিয়ে রেখেছে মোটা টাকার। যাতে চুরি গেলে আগরওয়ালের কোনও ক্ষতি না হয়, বেশি টাকা পায়। এককথায় বলতে পারিস, ওরা চেয়েছিল যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে। ওরা এখনও হাতকাটা গোপালকে চেনেনি। ওরা চলে ডালে ডালে আর আমি চলি পাতায় পাতায়। তুই খালি মজাটা দেখে যা। আমি যা যা বলব তাই করে যা।

আববাস জিজ্ঞাসা করল– হরিণটা কি তুমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ?

–পাগল হয়েছিস? এসব জেনেও সঙ্গে আনব? জায়গা মতো সেট করে এসেছি। তোকে বলব তবে এখন নয় পুলিশের চলে যাওয়ার পর।

আববাস একটু থেমে বলল– আচ্ছা, আমি বুঝতে পারছি না এতে রামলাল আগরওয়ালের কী স্বার্থ আছে?

এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল– দরজা খোল। দরজা খোল, নয়তো দরজা ভেঙে ফেলব।

আববাস-এর দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে গোপাল এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। দেখল দরজার সামনে সাদা পোশাকে আরও তিনজন পুলিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইন্সপেক্টর বদ্যিনাথ দত্ত। বদ্যিনাথ দত্তকে চেনে না এই শহরে খুব কম লোকই আছে। বিশেষ করে বদ্যিনাথ দত্ত অপরাধ জগতের সবার কাছে এক বিভীষিকা। দরজাটা খুলে দিতেই ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে বলল– মালটা বের করে দে।

–কোন মালটা স্যার?

–ভেবেছিস আমি কোনও খবর রাখি না? রামলাল আগরওয়ালের চুরি যাওয়া দামি হরিণটা। আমি ওটা চাই। তোকে ওখান থেকে বেরোতে দেখেছি।

–স্যার, আমি তো আববাসের কাছে গিয়েছিলাম। বিশ্বাস করুন আমাকে। আপনি যখন এতই শিওর তাহলে খুঁজে দেখুন।

চারজন মিলে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখল ঘরগুলো। জিনিসপত্রগুলো তছনছ করল, ওলট-পালট করে ফেলল। কিন্তু কোথাও সেই দামি হরিণটা খুঁজে পেল না। একঘন্ট৆া ধরে কঠোর পরিশ্রমের পর ঘর্মাক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিল চারজনে। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ইন্সপেক্টর বদ্যিনাথ দত্ত হতাশার ভঙ্গিতে সহকারীদের দিকে তাকালেন।

গোপাল হাসিমুখে বলল– স্যার আমি তো আগেই বলেছিলাম যে আমি জিনিসটা নিইনি। প্রথমেই যদি আমার কথা বিশ্বাস করতেন তবে অকারণে আপনাদের এই কষ্টটা করতে হতো না। বরং যদি আমাকে সব ঘটনাটা খুলে বলতেন তাহলে হয়তো অনুমান করতে পারতাম যে ওটা কারা উড়িয়েছে।

ইন্সপেক্টর রেগে গিয়ে বললেন– চুপ কর শালা, আমি কি মজা করছি এতক্ষণ? তোর হিম্মত দেখে অবাক হচ্ছি। আমি চাইলে তোকে ধরে নিয়ে গিয়ে এনকাউন্টার করে দিতাম কিন্তু ওই জিনিসটা না পাওয়া অবধি তোকে মারতে পারব না। দেখ, পালাতে যাস না। পালাতে চেষ্টা করলে কিন্তু কুত্তার মতো মারব।

আমি যে সোর্স থেকে শুনেছি তাতে শিওর ছিলাম যে ওটা এখানেই পেয়ে যাব। আমার ইনফরমেশন ভুল হতে পারে না। দু’ঘণ্টা আগে তুই রামলাল আগরওয়ালের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলি আর হরিণটা তুইই চুরি করেছিস।

গোপাল– স্যার, আমার মনে হয় আপনাকে কেউ ভুল বুঝিয়েছে বা ভুল ইনফরমেশন দিয়েছে। মনে হয় রামলাল আগরওয়াল থানায় রিপোর্ট করেছে আর বর্ষাতিয়া বলেছে যে আমিই ওটা লোপাট করেছি। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আমি পালাব না। তবে আপনাকে কথা দিচ্ছি, আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়ে ঘুমোন। আগামীকাল আমি বারোটা নাগাদ আপনার সাথে দেখা করব। হরিণটা কোথায়, কার কাছে আছে আপনি জেনে যাবেন।

কঠোর দৃষ্টিতে ইন্সপেক্টর গোপালের দিকে তাকালেন। রুক্ষকন্ঠে বললেন– চুপ কর শালা, তুই একটা মহা ধড়িবাজ, শয়তান। তুই ভাবছিস তোকে আমি চিনি না। আমার আগেই ভাবা উচিত ছিল যে তুই তো এত বোকা নয় যে হরিণটা নিজের কাছে রাখবি। আমি শহরের চারিদিকে পাহারা বসিয়ে দিচ্ছি যাতে তুই পালাতে না পারিস। যাই হোক, আমি আজ যাচ্ছি। কাল থানায় ১চ্টায় তোর জন্য অপেক্ষা করব। তুই তো জানিসই ওটা না পেলে বদ্যিনাথ দত্ত কী করতে পারে। তোর ছাল ছাড়িয়ে নেব, হতভাগা। মনে থাকে যেন।

–জানি স্যার, এনকাউন্টার। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন কাল আপনি ওটা পেয়ে যাবেন।

ইন্সপেক্টর বেরিয়ে যাওয়ার পর গোপাল আববাসকে বলল– দেখে নে তো আপদগুলো চলে গেছে কিনা?

–তুমি ঠিকই করেছ গুরু। আজ মালটা হাতছাড়া হয়ে যেত আর তুমিও ফেঁসে যেতে। বেফালতু শালা আমাকেও দুটো ডান্ডা মেরে গেল। তোমার ওটা পেলে যে কি ক্যালাত তা বুঝতে পারছ?

–তাই তো মালটা নিয়ে আসিনি। যা আজ গিয়ে শুয়ে পড়। কাল একটু কাজ আছে।

( তিন )

পরের দিন সকাল দশটায় গোপাল পৌঁছে গেল স্থানীয় ইনসিয়োরেন্স কোম্পানির অফিসে। অফিসে ঢুকেই বলল– ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে চাই। পাঁচ মিনিট পর ডেকে পাঠালেন। ম্যানেজার বললেন– বলুন, আপনার কী বলার আছে?

গোপাল– আজ সকালে বিশাল একটা অঙ্কের চুরির ক্লেইম হয়তো আপনি পেয়েছেন। রামলাল আগরওয়ালের কাছ থেকে। কারণ কাল রাতেই আগরওয়াল-এর দামি হরিণটা চুরি হয়ে গেছে আর তাই গতকাল রাতেই আগরওয়াল থানায় ডায়ারি লিখিয়ে এসেছে। গলাটা একটু নীচু করে ফিস ফিস করে গোপাল বলল– জিনিসটা কোথায় আছে আমি জানি।

ম্যানেজার বিস্ময়ের চোখে তাকালেন, বললেন– আপনি জানেন? তাহলে সঙ্গে নিয়ে এলেই পারতেন। বসুন, আমি পুলিশকে খবর দিচ্ছি।

–ওসব এখনই করতে যাবেন না। পুলিশের সাথে আমার কথা হয়ে গেছে। আজই জেনে যাবেন।

–মশাই, যে করে হোক ওটা আমার চাই, নয়তো আমার কোম্পানির অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। আজই আমি একটা প্রেস রিলিজ পাঠিয়েছি তাতে লিখেছি ওই দামি হরিণটার সন্ধান যে দিতে পারবে, তাকে সাত লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। বলেই ফাইল থেকে একটা কপি বের করে দেখালেন। বললেন – আপনি ওটা পাইয়ে দিলে আপনিও টাকাটা পেতে পারেন। তবে আগে নয়।

–ঠিক আছে, আপনি আমাকে চেক দিয়ে ব্যাংকে বলে দিন যাতে আপনার অনুমতির আগে যেন ওটা রিলিজ না করে। কারণ আপনি তো জানেনই আমরা কখন, কোথায় থাকি তার ঠিক নেই। তাছাড়া আমরা অ্যাডভান্স না নিয়ে কাজ করি না।

–ঠিক আছে, তাহলে এই নিন চেক। এতটা ভরসা তো আপনাকে করতেই হবে। তবে মনে রাখবেন চালাকি করতে গেলে কিন্তু একটা পয়সাও পাবেন না বরং জেল যেতে হবে।  বলেই একটা সাত লাখ টাকার চেক লিখে খামে ভরে দিয়ে দিলেন।

গোপাল যেতে যেতে দরজা থেকে আবার ফিরে এসে বলল– আর হ্যাঁ, বেশি চালাকি করবেন না, যদি জিনিসটা পাওয়ার পরও চেকটা ক্যাশ না হয় তবে আমরা কিন্তু কোর্টে কেস করি না। আমাদের হিসেবটা একটু অন্যরকম হয়। এই পৃথিবী থেকেই তাকে সরিয়ে দিই। বিশ্বাস না হয়, এই শহরে যে কাউকে হাত-কাটা গোপালের সম্পর্কে জেনে নেবেন। বলেই দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেল।

গোপাল বেরিয়ে যেতেই ভদ্রলোক ব্যাংকে ফোন করে বলে দিলেন যে ওনার সাথে কথা না বলে যেন, চেকটার পেমেন্ট না করা হয়।

গোপাল একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ফিরে এল নিজের বাড়িতে। দেখল বারোটা বাজতে আর বেশি দেরি নেই, তাই যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। ফোন করে পুলিশ ইন্সপেক্টর ও ইনসিয়োরেন্স কোম্পানির ম্যানেজারকে-কেও কিছু বলল। এরপর ফোন করল কয়েকজনকে।

ঠিক পৗনে বারোটার সময় জাসসি যে হোটেলে থাকে, সে লিফট দিয়ে উঠতে দেখা গেল ওই হোটেলের দারোয়ানকে। হাতে

রং-বেরঙের ফুল দিয়ে সাজানো একটা সুন্দর ফুলের তোড়া। জাসসির ফ্লোরে নেমে ঘরের সামনে গিয়েই কলিং বেলটা বাজাল দারোয়ান। জাসসি দরজা খুলে দিলে তোড়াটা তার হাতে দিল। বলল– কয়েক মিনিট আগে এক ভদ্রলোক তোড়াটা আপনাকে দিতে বলেছেন। না, তাঁর নাম, ঠিকানা কিংবা পরিচয় কিছুই জানাননি ভদ্রলোক। দারোয়ানকে দশটাকার একটা নোট বকশিশ দিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিল জাসসি। আর ঠিক সেই সময় মোবাইলটা বেজে উঠতেই দৗড়ে গেল মোবাইলটা ধরতে। নম্বরটা অজানা। তাড়াহুড়োতে দরজাটা লক করতেই ভুলে গেল। ফোনটা তুলে নিতেই অন্য দিক থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এল– হ্যালো, জাসসি, আশাকরি ফুলের তোড়াটা তোর ভালো লেগেছে। পরের বার আমাকে ঠকাতে আসার আগে ভেবেচিন্তে আসিস। গুড লাক।

–গোপাল তুই কি বলছিস? এটুকু কথা বলার সাথে সাথেই ফোনটা কেটে গেল।

রাগে লাল হয়ে গেল ওর মুখটা। তোড়াটা ছুড়ে মারল মেঝেতে। মেঝেতে পড়েই তোড়াটার বাঁধন গেল খুলে। ফুলগুলো সব চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আর মেঝেতে একটা ধাতব জিনিস পড়ার আওয়াজ হতেই চমকে উঠল জাসসি। সেটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। ছড়ানো ফুলগুলোর মধ্যে চকচক করছে মনিরত্ন খচিত একটা হরিণ। ওটা হাতে তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অবাক হয়ে দেখতে লাগল জিনিসটা।

ওর বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। সাদা পোশাকপরা পাঁচজন অফিসারকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন ইন্সপেক্টর বৈদ্যনাথ দত্ত।

ইন্সপেক্টর বললেন– মিস জাসসি, আপনি যে রামলাল আগরওয়ালের দামি হরিণটা চুরি করেছেন তা হাতকাটা গোপাল আমাদের আগেই বলে দিয়েছে। আপনি আর বর্ষাতিয়া মিলে ওকে ফাঁসাতে চেয়েছিলেন।

–মিথ্যে কথা। এটার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। এইমাত্র গোপালের পাঠানো ফুলের তোড়ার মধ্যে পেলাম। নিশ্চয়ই আমাকে ফাঁসানোর জন্য গোপালই একাজ করেছে।

–চোরাই মাল আপনার কাছে পাওয়া গেছে তাই আপনাকেই আমাদের অ্যারেস্ট করতে হবে। কে কী করেছে, সেটা তদন্ত করলেই বেরিয়ে যাবে। আপাতত আপনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে। একটু থেমে ইন্সপেক্টর বললেন– আর একটা কথা, শুধু গোপাল নয়,  আপনার বস বর্ষাতিয়াও বলেছে, ওই হরিণটা আপনিই চুরি করেছেন।

( চার )

এই সুযোগে গোপাল পৌঁছে গেল ব্যাংকে। প্রায় এক ঘণ্টা বাদে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে এল গোপাল। মুখে প্রশান্তির হাসি। হরিণটার সন্ধান দিতে পারার জন্য পুরস্কার হিসেবে চেকটা এনক্যাশ করার অনুমতি দিয়েছে ইনস্যুরেন্স কোম্পানি।

নিজের বাড়ির কাছে আসতেই দেখা হয়ে গেল ইন্সপেক্টর বৈদ্যনাথ দত্তর সাথে। কঠিন হাসি হেসে ইন্সপেক্টর বললেন– টাকাটা যত তাড়াতাড়ি পারিস খরচ করে ফেল গোপাল। তোকে খুব বেশিদিন আর বাইরে থাকতে দেব না। জেলে আমি তোকে ঢোকাবই। যত চালাকিই তুই করিস না কেন! আমি জানি যে ওই হরিণটা তুই-ই চুরি করেছিলিস। এখন শুধু সেটা প্রমাণ করা বাকি।

এটুকু বলেই রাগ দেখিয়ে ইন্সপেক্টর গট গট করে হেঁটে চলে গেলেন।

বিপরীত স্রোত

রান্নাঘরে অঞ্জনের টিফিন বানাতে বানাতে নমিতা টিভির পর্দায় মাঝে মাঝেই চোখ রাখছিল। কয়েকদিন ধরেই মিডিয়াগুলো ‘মি টু’ আন্দোলন নিয়ে পড়েছে। রোজই নতুন নতুন খবর উঠে আসছে। খবরটা নমিতা নিয়ম করেই দেখে। কোথায় কী হচ্ছে নয়তো জানবে কীভাবে?

অঞ্জন এসে শেল্ফ-এর সামনে দাঁড়াল। নমিতার ফ্ল্যাটে ওপেন কিচেনের ব্যবস্থা সুতরাং রান্না করতে করতে টিভি দেখাটাও নমিতার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্বামীকে দেখে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

‘সকাল সকাল এদের আবার শুরু হয়ে গেছে। দেশে বেকারত্বের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে, চাষি আত্মহত্যা করছে, দেশের অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। আর এই মহিলাদের দ্যাখো, এদের আর কোনও কাজ নেই, মি টু-তে সমস্বরে গলা মেলাচ্ছে। আমার শুধু এদের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, যখন ঘটনাটা ঘটেছিল তখন কেন প্রতিবাদ করেনি, ব্যাপারটা গোপন করে গিয়েছিল? এখন চেঁচিয়ে কী লাভ? আসলে এরা চায় প্রচারের আলোয় থাকতে। এ হচ্ছে পুরুষদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত। বন্ধ করো টিভি, খবরে আজকাল আর কিছুই দেখাবার নেই’, বিরক্ত বদনে নিজেই এগিয়ে গিয়ে টিভিটা বন্ধ করে দেয় অঞ্জন।

টিফিন কৗটোর ঢাকনা বন্ধ করতে করতে নমিতা উত্তর দেয়, ‘আচ্ছা এইসব মহিলারা মিথ্যা বানিয়ে বলছে আর তোমরা পুরুষরা সব ধোয়া তুলসীপাতা? আমাদের সমাজটা এইভাবেই মহিলাদের চুপ করিয়ে তাদের শালীনতায় মুড়ে রাখতে চায়। গলা তুলতে গেলেই, সেটা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে সমাজ উঠেপড়ে লেগে যায়।’

‘আমি ঠিক এটা বলতে চাইনি। কিন্তু ৩০ বছরের পুরোনো কাদা ঘেঁটে লাভটা কী হবে বলতে পারো? সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট বা হ্যারাসমেন্ট যখন ফেস করেছিল তখনই দরকার ছিল প্রতিবাদ করার’, অফিসের শার্ট-টা পরতে পরতে জবাব দেয় অঞ্জন।

অঞ্জনের মনোভাব বুঝতে পেরে রেগে যায় নমিতা, ‘তোমার এটা চিৎকার-চ্যাঁচামেচি মনে হচ্ছে কারণ তুমি সত্যিটা দেখতে চাইছ না। আসলে এটা শুধু পুরুষদের দোষ নয়, সমাজের বানানো নিয়মে অত্যাচার করার পরেও ওই মেয়েগুলোকেই আবার চুপ করে থাকার জন্য ভয় দেখানো হয়।

অফিসে গিয়ে দ্যাখো মেয়েরা যৗন শোষণের বিরুদ্ধে সরব হলেই তাদের চাকরি চলে যাচ্ছে আর যারা বাড়িতে রয়েছে তাদের এত সাহস কোথায়? ছোটো থেকে মেয়েদের শেখানো হয় লজ্জাই মেয়েদের ভূষণ অথচ ছেলেদের স্বাধীনতা ছুট দিয়ে রেখেছে সমাজ।

আমার তো খুব আনন্দ হচ্ছে এই দেখে যে ভারতবর্ষের মতো দেশে এই প্রথম পুরুষরা কিছুটা ভয় পেয়েছে। আগে হয়তো এমন কোনও অপরাধ সে করে এসেছে, যেটা এই আন্দোলনের ফলে সবার সামনে ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে সে মনে মনে ভীত হয়ে পড়ছে। সীতাকে আর অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে না, এবার রামের পালা’, গর্বের সঙ্গে বলে নমিতা।

‘আচ্ছা এবার বক্তৃতা দেওয়া বন্ধ করো… খেতে দেবে তো দাও নয়তো টিফিন নিয়ে আমি অফিস বেরিয়ে যাচ্ছি’, বিরক্ত মুখে বলে অঞ্জন।

ভাতের থালাটা অঞ্জনের সামনে নামিয়ে রাখতে রাখতে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল নমিতা, ‘কী ব্যাপার বলো তো, তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন? তুমিও কি কারও সঙ্গে… ভয় পাচ্ছ নাকী যে তোমারও পুরোনো পাপ ধরা পড়ে যাবে?’

নমিতার কথা শুনে ভাত আটকে যায় অঞ্জনের গলায়। এক ঢোঁক জল খেয়ে গলাটা পরিষ্কার করে বলে, ‘কী… পাগলের মতো বলছ? বিনা কারণে আমাকে এসবের মধ্যে টেনে আনছ কেন? দোষ কেউ করেছে আর সন্দেহ আমার উপর। সকলেই জানে আমি কীরকম, সুতরাং নিজের সম্পর্কে আমি কিছুই বলতে চাই না।’

‘হুঁ, এটা ভুলো না যাদের চরিত্রের সত্যিটা আজ সকলের সামনে খুলে গেছে তাদের সম্পর্কেও কিন্তু মানুষের আগে অন্যরকম ধারণা ছিল… হঠাৎ করেই হয়তো জানতে পারলাম তুমিও কোনও মেয়ের সঙ্গে… আর আমি এটা তো শুধু উদাহরণ দিচ্ছি’, টিফিন বক্সটা অঞ্জনের হাতে দিতে দিতে নমিতা বলল।

অঞ্জন জ্বলে উঠল নমিতার কথা শুনে। ইচ্ছে করছিল টিফিনটা ছুড়ে মারে নমিতার মুখের উপর। আবিশ্বের পুরুষরা সব খারাপ আর মহিলারা সব সতীসাধবী! নিজেকে সংযত করল অঞ্জন। নমিতার সামনে প্রতিবাদ করা মানে নিজেকেই সন্দেহের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। বরং সুর নরম করল অঞ্জন, ‘এখন নিজের স্বামীকেও ভরসা করছ না? আমাকে তোমার এতটাই নীচ চরিত্রের মনে হয় যে, তুমি আমাকে এসব কথা বলতে পারছ?’

নমিতার মনে হল একটু বেশি-ই বলা হয়ে গেছে অঞ্জনকে। ও যাতে মনে দুঃখ না পায় তাই গলায় যথা সম্ভব মাধুর্য নিয়ে এসে বলল, ‘আমি তো এমনি-ই তোমাকে এইসব বলছিলাম, আমি কি তোমাকে চিনি না? আচ্ছা এবার অফিসে বেরোও, নয়তো পরে বলবে আমার জন্য তোমার অফিস যেতে দেরি হয়ে গেল।’

‘হুঁ, আজ আবার একটা মিটিং আছে অফিসে’, বলে বেরিয়ে আসে অঞ্জন। অফিস যেতে যেতে মনের মধ্যে তোলপাড় হতে থাকে ওর। ভয় বাসা বেঁধেছে ওর মনে। মি টু নিয়ে যা আরম্ভ হয়েছে তাতে ওর নিজের কেলেঙ্কারি ফাঁশ হবার আশঙ্কা কিছুতেই উড়িয়ে দিতে পারছে না। শিউরে ওঠে অঞ্জন। নমিতা কিছুতেই ওর অন্যায় বরদাস্ত করবে না, শাস্তি পাওয়ার সব ব্যবস্থা করে তবে ছাড়বে। বাচ্চাদের চোখেও ওর সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। এতদিনের চেষ্টায় সমাজে যে মান-সম্মান অর্জন করেছে, তাও আর বজায় রাখা সম্ভব হয়ে উঠবে না।

মিটিং-এও ঠিকমতো মন দিতে পারল না অঞ্জন। রোজকার মতো সবাইকে বকে ধমকে কাজ করিয়ে নেওয়ার এনার্জি কিছুতেই জোগাতে পারল না। অফিসে কিছুই ভালো লাগছিল না। সন্দীপ এসে কেবিনে উঁকি মারল।

‘কী হল, আজ এত চুপচাপ যে? ঢুকলি যখন আমার ‘গুডমর্নিং’-এ সাড়া দিলি না, আবার এখন এভাবে বসে থাকা, কারও ওপর চ্যাঁচামেচি করছিস না… কী হল কী তোর? কোনও মহিলা তোকে আবার ফাঁসিয়ে দেয়নি তো?’ সন্দীপ এমন ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল, কেবিনের বাইরে যারা বসে তাদের মধ্যে হাসির রোল উঠল।

কেবিনের বাইরে থেকে কারও গলা ভেসে এল, ‘ছাড় না সন্দীপ, বউয়ের সঙ্গে হয়তো ঝগড়া হয়েছে। ওকে ওর মতো থাকতে দে না।’ সন্দীপ বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।

অফিসে দিনটা কোনওমতে কাটিয়ে অঞ্জন বাড়িতে ফিরে আসে। হাত-মুখ ধুয়ে বসতে বসতে খেয়াল করে নমিতা ফোনে ব্যস্ত রয়েছে। নমিতার কথাগুলো কানে ভেসে আসে, ‘দেখিস লোকটা যেন কোনওমতেই ছাড়া না পায়, নিজেকে কী ভাবে বলতো? খুব তো ভদ্র সেজে ঘুরত। নাতি, নাতনি সব রয়েছে অথচ দেখ নিজের মেয়ের বয়সি একটা মেয়েকে… আচ্ছা এখন আমি রাখছি, অঞ্জন অফিস থেকে ফিরেছে’, বলে নমিতা ফোন নামিয়ে রাখে।

‘কী হয়েছে?’ অঞ্জন জানতে চায়। ‘আমি তোমাকে ফোন করতেই যাচ্ছিলাম। জানো, পাড়ার সুজিতদার উপর কোনও মেয়ে নাকি হ্যারাসমেন্টের কেস দিয়েছে, অথচ সুজিতদাকে দেখে ভদ্র বলেই মনে হতো। ভদ্রলোকের বউয়ের বক্তব্য, মেয়েটি মিথ্যা আরোপ দিচ্ছে, সুজিতদাকে নাকি বদনাম করতে চাইছে। বউদি সবাইকে বলেছে মেয়েটি সুজিতদার কাছে চাকরি করত। কোনও কারণে মেয়েটিকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করায় সুজিতদার উপর রেগে যায় মেয়েটি এবং মিথ্যা বদনাম দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমার তো বউদির উপর রাগ হচ্ছে যে একজন অপরাধীকে বাঁচাবার চেষ্টা করছেন উনি। কিন্তু যতই চেষ্টা করুন না কেন সুজিতদাকে কিছুতেই বাঁচাতে পারবেন না। ওনার বউকেও জেলে পুরে দেওয়া উচিত’, রাগে নমিতার মুখ-চোখ লাল হয়ে ওঠে।

‘হতে তো পারে যে সুজিতদাই সত্যি কথা বলছেন আর মেয়েটি মিথ্যা…’

‘মিথ্যা…?’ অঞ্জনের কথার মাঝখানেই নমিতা ওকে থামিয়ে দেয়। ‘কেন কোনও মেয়ে শুধু শুধু নিজেকে বদনাম করবে? নিশ্চয়ই ওর সঙ্গে কিছু ঘটেছে বলেই না ও গলা তুলেছে। সাধারণত মেয়েরা প্রতিবাদ করে না বলেই পুরুষরা বেঁচে যায়। আর বউগুলোকে দ্যাখো, স্বামী দোষী জেনেও তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে থাকে। সত্যি বলছি অঞ্জন, আমার স্বামী যদি এরকম করত, আমি ছাড়তাম না, জেলে পাঠিয়ে তবে বিশ্রাম নিতাম।’ নমিতার কথা শুনে ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠল অঞ্জন।

‘একবার ভেবে দ্যাখো, আমাদেরও মেয়ে রয়েছে। কেউ যদি ওর সঙ্গে এরকম করত তাহলে? ছিঃ মেয়েরা জড়পদার্থ নাকি যে, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যার যেরকম ভাবে ইচ্ছে তাকে ব্যবহার করবে? এটা সমাজের পক্ষে লজ্জাকর, অঞ্জন’, নমিতা কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে।

কথা শেষ করে নমিতার দৃষ্টি পড়ে অঞ্জনের ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখটার উপর। ‘একী, তোমার কী হল, মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন? আমি জানি তোমারও ব্যাপারটা শুনে খুব খারাপ লাগছে,

যে-কোনও ভদ্রলোকেরই ঘটনাটা জেনে ঠিক এরকমই মনোভাব হবে। আসলে কারও চরিত্র সম্পর্কে হলফ করে কিছু বলা আজ আর সম্ভব নয়’, বলে নমিতা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।

মনের মধ্যে ঝড় চলতে থাকে অঞ্জনের। আজ সুজিতদা পাড়ায় আলোচনার বস্তু হয়ে উঠেছেন, যে-কোনও দিন অঞ্জনের নামও আলোচনার বিষয় হয়ে উঠতে পারে। নিজের সন্তানদের কাছে মুখ দেখাবে কী করে? ঘেমে ওঠে অঞ্জন, চুপচাপ এসে শোবার ঘরে শুয়ে পড়ে।

রাতের খাওয়া-দাওয়া মিটিয়ে নমিতা আর বাচ্চারা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লেও, হাজার চেষ্টা করেও অঞ্জন দুচোখের পাতা এক করতে পারল না। নানা চিন্তা এসে ওকে ঘিরে ধরছিল। ওর খালি মনে হচ্ছিল সকলে এমনকী বাড়ির প্রতিটা আসবাবপত্র পর্যন্ত ওকে উপহাস করছে, বলছে, ‘দেখছ তো অঞ্জন, এতদিন স্রোতে গা ভাসিয়ে চলে এসেছ আজ স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কীরকম বোধ করছ? বাঁচতে তো তুমিও পারবে না। হ্যাঁ দেরি হয়েছে বটে কিন্তু সকলেই নিজের নিজের কর্মের ফল একদিন পাবেই, তুমিও বাদ যাবে না।’ ঘেমে নেয়ে বিছানাতেই উঠে বসে অঞ্জন। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়তে থাকে। ভয় যেন সম্পূর্ণ গ্রাস করে ওকে কিন্তু কাকে বলবে এইসব কথা এবং কী-ই বা বলবে? ওর করা অপরাধের কথা যদি সবাই জানতে পেরে যায়, তাহলে এতদিনের সংসারটা ওর তছনছ হয়ে যাবে।

নিজের মনেই হাজারো প্রশ্ন উঠতে থাকে অঞ্জনের। আবার নিজেই নিজেকে স্ত্বান্না দেয়। মন বলে এরকম কিছুই ঘটবে না, বেকার কেন ও এত চিন্তা করছে? শ্রেয়া কখনওই নিজের মুখ খুলবে না, আর যদি খোলে ওকে মিথ্যা প্রমাণ করতে কতটুকুই বা পরিশ্রম হবে? ও প্রমাণ জোগাড় করার চেষ্টা করতে পারে কিন্তু কার সাহস হবে অঞ্জনের বিরুদ্ধে কিছু বলতে? ও বরং নিজেই শ্রেয়াকে দোষী প্রমাণিত করে দেবে। অঞ্জনের চোখের সামনে ৭-৮ বছর আগেকার ঘটনাগুলো ভেসে উঠতে থাকে। শ্রেয়ার উপর করা এক-একটা অত্যাচারের পাতা পরপর খুলে যেতে থাকে অঞ্জনের চোখের সামনে।

সাত-আট বছর আগে যে কোম্পানিতে ছিল অঞ্জন, সেখানেই শ্রেয়া অঞ্জনের অধীনে কাজ করত। তন্বী চেহারার মেয়েটির এক মাথা ঘন কালো চুল, ডাগর দুটো চোখ এবং ত্বকের গোলাপি আভা অঞ্জনের দুর্নিবার আকর্ষণের কারণ ছিল। শ্রেয়াকে দেখলেই ওকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করত অঞ্জন যা শ্রেয়ার কাছে অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। ওর সামনে এলে শ্রেয়া কিছুতেই সহজ হতে পারত না, জামাকাপড় ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে উঠত যেন।

শ্রেয়া বুঝতে পারত, অঞ্জনের ওর প্রতি দুর্বলতার কারণ ওর শরীরটা ছাড়া আর কিছু নয়। আপ্রাণ চেষ্টা করত সময়ের মধ্যে সব কাজ গুছিয়ে ছুটি হলেই অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে, কিন্তু রোজ সেটা সম্ভব হয়ে উঠত না। অন্য কোনও কাজের অছিলায় অঞ্জন মাঝেমধ্যেই ওকে নিজের কেবিনে ডেকে পাঠাত। ছুটির পরেও ওকে আটকে রাখত। কাজ করতে করতেও শ্রেয়া বেশ বুঝতে পারত ওকে ঠিক কী নজরে দেখছেন অঞ্জন স্যার। মাঝে মাঝে চোখ পড়ে যেত স্যারের চোখে কিন্তু তাতেও অঞ্জন বিন্দুমাত্র বিচলিত হতো না বরং বাধ্য হয়ে লজ্জায় শ্রেয়াকেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে হতো।

ধীরে ধীরে সাহস বাড়তে আরম্ভ করে অঞ্জনের। ছলছুতো করে শ্রেয়ার গায়ে হাত দিতেও শুরু করে দেয়। কখনও পিঠে, ঘাড়ে, বুকে অনাবশ্যক হাত দিয়ে ফেলে আবার অমায়িক একটা ‘সরি’ ছুড়ে দিতেও কসুর করত না।

শ্রেয়ার রক্তাক্ত মনে অশ্রু ঝরত শুধু, প্রতিবাদ করে উঠতে পারত না। মেয়ে হয়ে জন্মানো পাপ বলে মনে হতো। বাবার হঠাৎ মৃত্যুর পর মা আর ভাইয়ের দায়িত্ব না নেওয়া ছাড়া উপায় কিছু ছিল না আর অঞ্জন স্যার ওর বাড়ির অবস্থা পুরোটাই জানতেন এবং সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে মুহূর্ত সময় নষ্ট করেননি।

সেদিনও এমনি এমনি মিথ্যা কাজের বাহানায় অঞ্জন শ্রেয়াকে নিজের কেবিনে বসিয়ে রেখেছিল। অফিস অনেকক্ষণ ছুটি হয়ে গিয়েছিল। অঞ্জন ওকে বাড়ি ছেড়ে দেবে এই অজুহাতে শ্রেয়াকে আটকে রেখেছিল। শ্রেয়া তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করছিল, হঠাৎ-ই অঞ্জন পিছন থেকে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে জোর করে টেনে নেয়। শ্রেয়ার সারা শরীরে, মুখে ত৫ চুম্বনের রেখা স্লঁকে দিতে থাকে।

শ্রেয়া নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কোনওমতে মুখ সরিয়ে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে, ‘স্যার, এটা কী করছেন আপনি? ছাড়ুন আমাকে।’

‘শ্রেয়া, এই দিনটার জন্য কতদিন আমি অপেক্ষা করেছি। আজ কী করে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেব বলো’, শ্রেয়ার চুলে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে অঞ্জন।

হঠাৎ-ই কেবিনের দরজায় টোকা। অবাক হয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেয় শ্রেয়াকে। ‘কাম ইন’, বলাতে অফিসের পিওন এসে ঢোকে যাকে আগেই ছুটি দিয়ে দিয়েছিল অঞ্জন।

‘কী ব্যাপার, তুমি ফিরে এলে যে?’

‘না স্যার, আমার টিফিনের কৗটোটা নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেটাই নিতে এসেছি’, কাঁচুমাচু ভাবে জবাব দেয় পিওন।

‘ঠিক আছে, নিয়ে নাও’, বিরক্তি সহকারে জবাব দেয় অঞ্জন।

শ্রেয়া কিন্তু মনে মনে ধন্যবাদ জানায় পিন্টুকে। হোক না অফিসের পিওন কিন্তু সবসময় সম্মান দিয়ে কথা বলে শ্রেয়া ওর সঙ্গে। ওর কেন জানি না মনে হয় কিছু একটা অঘটনের অাঁচ পেয়েই পিন্টুদা অফিসে ফিরে এসেছে। টিফিন কৗটোটা একটা বাহানা মাত্র। পিন্ঢু৆দার জন্য আজ ও বেঁচে গেল এই জঘন্য লোকটার হাত থেকে।

অঞ্জন কিন্তু মোটেই খুশি হল না। ওর এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী করল পিন্টুকেই এবং সুযোগ বুঝে শ্রেয়াও অফিস ছেড়ে বেরিয়ে এল। অঞ্জন এখানেই থেমে থাকল না, সুযোগ খুঁজতে লগল শ্রেয়াকে নিজের জালে ফাঁসাবার।

সুযোগ এল খুব শিগগির। শহরের বাইরে কাজ পড়ল অঞ্জনের। তৎক্ষণাৎ ফোন করল শ্রেয়াকে, ‘শ্রেয়া কাল তৈরি হয়ে অফিসে এসো। দুদিনের জন্য আমার সঙ্গে তোমাকে অফিসের কাজে শহরের বাইরে যেতে হবে।’

‘কিন্তু স্যার, আমার পক্ষে যাওয়া…’, শ্রেয়ার না-যাওয়ার বাহানা না শুনেই ওকে থামিয়ে দেয় অঞ্জন, ‘শ্রেয়া তোমার ইচ্ছে, অনিচ্ছে জানতে চাইনি আমি। ইট্‌স মাই অর্ডার। বসের সঙ্গে তোমার যাওয়ার সুযোগ হচ্ছে নয়তো তোমার মতো মেয়েদের সকলে জুতোর তলায় রাখে।’

শ্রেয়া ভালো করেই জানত ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে ওর শরীরটাকে ভোগ করা। অঞ্জনের হাত থেকে ওর নিস্তার নেই। অফিসে থাকতে গেলে অঞ্জন স্যারের কথামতো চলতে হবে আর নয়তো চাকরি হারাতে হবে। এই সত্য বুঝতে পেরে গিয়েছিল শ্রেয়া। মুহূর্তে নিজের মনকে তৈরি করে নিল ও। পদত্যাগপত্র লিখে জমা করে বেরিয়ে এল অফিস ছেড়ে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। অনেকদিন ধরেই অন্য চাকরির সন্ধান করছিল কারণ অঞ্জনের সঙ্গে এক অফিসে চাকরি করতে পারবে না বেশ বুঝতে পারছিল শ্রেয়া। জানে কটা দিন একটু কষ্ট করতে হবে কিন্তু পার্থ আছে ওর পাশে। কটা দিন পরেই পার্থর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। একদিক দিয়ে ভালোই হল বলে শ্রেয়ার মনে হল। এই অফিসের কেলেঙ্কারির কথা যদি বিয়ের পর পার্থ-র মা-বাবা জানতে পারতেন তাহলে কতটা লজ্জার সম্মুখীন হতে হতো সেটা ভেবে শ্রেয়া শিউরে ওঠে।

কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে একটা ভালো চাকরিও পেয়ে গেল শ্রেয়া। নতুন চাকরিতে জয়েন করার তিনমাস পরেই পার্থর সঙ্গে শ্রেয়ার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর নিজের ফোনের নম্বর বদলে ফেলল ও, যাতে অঞ্জন কোনও ভাবেই ওকে কনট্যাক্ট করতে না পারে। অতীতের দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে নতুন জীবনের সুখে নিজেকে ভাসিয়ে দিল শ্রেয়া। অঞ্জনের স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর হল ও।

শ্রেয়া জানতে পারল না, একদিন যেখানে ও অঞ্জনের মুখোমুখি যাতে না হতে হয় তার জন্য পালিয়ে বেড়াত, সেখানে আজ অঞ্জন শ্রেয়ার ভয়ে ভীত হয়ে রয়েছে। সবসময় অঞ্জনের মনে হতো এই বুঝি শ্রেয়া এসে সকলের সামনে অঞ্জনের আসল চেহারার উপর থেকে পর্দাটা সরিয়ে দেবে। রাত্রে ভালো করে ঘুমোতেও পারত না। অজানা, অচেনা কেউ বাড়িতে এলেও ভয়ে কুঁকড়ে যেত অঞ্জন। কলিংবেল বাজলে বুক কেঁপে উঠত ওর, ভাবত ওই বুঝি শ্রেয়া ওর দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে ওর কুকীর্তির সাক্ষী হয়ে।

একদিন অফিস থেকে ফিরতেই নমিতা জানাল একটি লোক অঞ্জনের নামে একটা মুখবন্ধ খাম দিয়ে গিয়েছে।

‘কোথায় রেখেছ খামটা। কী থাকতে পারে ওতে?’ শঙ্কিত হয়ে অঞ্জন নমিতার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল।

‘জানি না, হয়তো ফোটো বা ওই ধরনের কিছু হবে। দেখি খামটা খুলে’, বলে খামটা হাতে নিতেই অঞ্জন ছোঁ মেরে নমিতার হাত থেকে খামটা ছিনিয়ে নিল।

‘আমার চিঠি তুমি খুলছ কেন?’ নমিতা অঞ্জনের কান্ডকারখানা দেখে অবাক হয়ে গেল। তোমার কী হয়েছে বলো তো। আগে তোমার সব চিঠি আমি-ই তো খুলতাম, আজ হঠাৎ হল কী? তুমি তো এমন ভয় পাচ্ছ যেন মনে হচ্ছে এর মধ্যে তোমার গোপন কোনও তথ্য লুকোনো রয়েছে?’

নমিতার কথা শুনে চমকে ওঠে অঞ্জন। নমিতা কি ওকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে? কাঁপা কাঁপা হাতে খামটা খুলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। খামটাতে অন্য কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রয়েছে যেটা ওরই বন্ধু পাঠিয়েছে।

অঞ্জনের ব্যবহারে নমিতা প্রায়শই আশ্চর্য হয়ে পড়ত। মাঝেমধ্যেই মনে হতো অঞ্জনের মাথার কোনও গোলমাল হল না তো? সত্যিটা নমিতা জানবেই বা কী করে? অতীতে করে আসা পাপের দংশনই যে অঞ্জনকে ভীত, ত্রস্ত করে তুলছে। অঞ্জনের সব সময় মনে হতো একবার শ্রেয়ার সঙ্গে দেখা করে ও ক্ষমা চেয়ে নিলেই সব ঠিক হয়ে যেতে পারত। অথবা পুরোনো দিনগুলো যদি ফেরত আনা যেত তাহলে নিজের চরিত্রটা শুধরে নেওয়ার একটা সুযোগ থাকত। কিন্তু অতীত-কে ফিরিয়ে আনা কি সম্ভব?

অঞ্জন সিদ্ধান্ত নেয়, যেভাবেই হোক শ্রেয়ার সঙ্গে দেখা করে ওকে ক্ষমা চাইতেই হবে। নয়তো সারাজীবন এই অশান্তিতে ওকে কাটাতে হবে যে, কবে ও ধরা পড়ে যাবে। চেষ্টা করে শ্রেয়ার ঠিকানাও জোগাড় করে ফেলে। যাবে যাবে করতে করতে একদিন হঠাৎই শ্রেয়াকে ও দেখে একটা থানায় ঢুকতে। দেখেই মনের মধ্যে পুরোনো ভয়টা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ওর মনে হয় শ্রেয়া নিশ্চয়ই ওর বিরুদ্ধে রিপোর্ট লেখাতেই থানার দ্বারস্থ হয়েছে নয়তো শ্রেয়ার মতো মেয়ের থানায় কী কাজ থাকতে পারে?

থানার বাইরে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে অঞ্জন, শ্রেয়ার বাইরে বেরোবার জন্য কিন্তু কোনও লাভ হয় না। বাধ্য হয়ে ও ওখান থেকে চলে আসে। খালি মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন বারবার ঘুরেফিরে আসতে থাকে যে শ্রেয়া থানায় কেন গিয়েছিল?

এই ভাবেই কেটে যায় দু-তিন সপ্তাহ। এর মধ্যে অঞ্জন জানতে পারে শ্রেয়ার থানায় আসার কারণ। ওর ভাইয়ের বউ, শ্রেয়ার মা ও ভাইয়ের বিরুদ্ধে থানায় রিপোর্ট লিখিয়েছে মানসিক ও শারীরিক অত্যাচারের। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই শ্রেয়ার থানায় আসা।

একটু যেন স্বস্তি পায় অঞ্জন। শ্রেয়া পুলিশে জানালে এতদিনে নিশ্চয়ই পুলিশ বসে থাকত না, আইনি পদক্ষেপ অবশ্যই নিত। কিন্তু বলা যায় না। নমিতার কাছেই শুনছিল পাড়ার সুজিতদা আপাতত বাড়িতে ফিরেছে ঠিকই কিন্তু কোর্ট-কাছারি করতে হচ্ছে। নমিতা তো বেশ জোর গলায় বলল, যে-পাপ লোকটি করেছে তার সাজা অবশ্যই একদিন লোকটাকে পেতেই হবে। এটাই ওর ভরাডুবির কারণ হবে।

আজ অঞ্জন মনে করছে ও শ্রেয়ার হাত থেকে বেঁচে গেছে কিন্তু ভয়, আশঙ্কার খাঁড়াটা সারা জীবন ওর ঘাড়ের উপর ঝুলতে থাকবে। যে-কোনও মুহূর্তে ওটা লক্ষ্যে নেমে আসতে পারে। স্রোতের বিপরীতে থাকতে পারার জন্য মুহূর্তের আনন্দ বিষাদে বদলে যেতে পারে যদি শ্রেয়া ‘মি টু’ আন্দোলনে নিজেকে শামিল করে নেয়। এই সবই অঞ্জন ভালো করেই বুঝতে পারছিল এবং এই সত্যটাও ওর অজানা ছিল না যে, এখন থেকে সারাটা জীবন ওকে ভয়ে ভয়েই কাটাতে হবে। ভবিষ্যতে ওর ভাগ্যে কী আপেক্ষা করছে সেটা জানার আজ আর কোনও উপায় নেই।                                           ঞ্জ

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব