গল্পকার হয়ে ওঠার গল্প

এক গাদা সাংবাদিকের ভিড় মানেই কানের কাছে আজকাল মশা-মৌমাছির ভোঁ ভোঁ শব্দ শুনতে পাই। প্রেস ক্লাবে পা রাখতেই ভনভনানিটা চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরল। বইয়ের প্রকাশ আর বিক্রির মধ্যিখানে এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ সালতামামি। খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিনের লোকজন ছাড়াও প্রায় সবকটি বাংলা খবরের চ্যানেলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত। অথচ লেখিকা অপর্ণা ঘোষের এটি প্রথম গল্পগ্রন্থের প্রকাশ। কিন্তু এতে সবটা বলা হল না।

লেখিকা অপর্ণা ঘোষ মৃত স্বনামধন্য লেখক পঙ্কজ ঘোষের স্ত্রী। যার অন্তত তিনটি উপন্যাস আর দুটি গল্পগ্রন্থ দৈনিকের বেস্টসেলারের তালিকায় হামেশায়-ই দেখা যায়। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রার কারণে বছর দুয়েক আগে এই লেখকের মৃত্যুতে গোটা বাংলার সাহিত্যকুলকেই প্রায় গেল গেল রব তুলতে দেখেছিলাম। সামনের মাসেই পঙ্কজ ঘোষের জন্মদিন। যে-কাগজে কাজ করি, তার রবিবারের সাপ্লিতে পঙ্কজ ঘোষ সংখ্যা হবার কথা হয়ে আছে। ঠিক এই সময় পঙ্কজ ঘোষের স্ত্রীর নিজের গল্পগ্রন্থ প্রকাশ সংবাদেরই বিষয় বটে।

প্রশ্ন-উত্তর পর্ব এখনও শুরু হয়নি। মনে হচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আসরে প্রবেশ করবেন অপর্ণা ঘোষ। বেশ ব্যস্ত ভাবে এদিক সেদিক দৌড়োদৌড়ি করছে সুদীপ্ত মজুমদার। দীর্ঘদিন ধরে পঙ্কজ ঘোষকে আপ্তসহায়তা করে এসেছে এই সুদীপ্ত মজুমদার। ঘোষ পরিবারের বিশেষ স্নেহধন্য ছিল জানতাম। লেখকের স্ত্রী আবার ওকে নিজের জন্য পুনর্বহাল করলেন কি না ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। কামানো মুখ আর পাট ভাঙা হলুদ পাঞ্জাবিতে নিজের মধ্যে প্রাণপনে একটা লেখক লেখক ভাব আনার চেষ্টা করছে সুদীপ্ত।

জেট নিউজের কৌশিকের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সামনের মুলোর মতো দাঁত দুটো বের করে মন ভুলিয়ে দেওয়া একটা এক্সপ্রেশন ঝাড়ল। যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রিত ভাবে হাসিটা ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে সদ্য ইলেকট্রনিক্স-এ জয়েন করার পরে নিজের মধ্যে একটা হামবড়াই ভাব এনেছে কৌশিক। তবে ওর দেঁতো হাসির উপহার সবাই পায় না। সম্পাদকীয় বিভাগে থাকলে কেউ কেউ ওর এই হাসি উপহার পায়। যেমন আমি।

এতজন মানুষের উপস্থিতিতে কিনা জানি না এসি-র কনকনে ঠান্ডা ভাবটাও শরীরকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল না, যে-শীতল অনুভূতিটা পেতে চাইছিলাম। অপর্ণা ঘোষের সাক্ষাৎকার পর্ব কয়েকটা পয়েন্ট-এর আকারে তুলে নিয়ে ছুটতে হবে আবার অফিসে। প্রতিবেদন আকারে সেটার পেজ সেটিং না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি নেই। দৈনন্দিন কাজের মধ্যে কেমন করে যেন একঘেয়েমি ঢুকে পড়ছে।

একটু গুঞ্জন, তারপরই অপর্ণা ঘোষের প্রবেশ। সাদামাটা, হালকা ঘি রঙের তাঁতের শাড়িতে বিধবাভাবকে লুকোনোর কোনও চেষ্টা নেই। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এবং কাটা মুখে চোখ দুটো আমার নজরে এল। দামি রিমলেস চশমার আড়ালে সে চোখ বেশ উজ্জ্বল এবং বুদ্ধিদীপ্ত মনে হচ্ছে। গরমের মধ্যে আসতে হয়েছে, তাই বোধহয় তৃষ্ণা দূর করতে টেবিলের উপর রাখা জলের গেলাসের অনেকটা জল এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেললেন।

আমি ছাড়াও, অনেকেই প্রস্তুত। মনেই হচ্ছিল সোজাসুজি কাজের কথায় যেতে বিশ্বাসী লেখিকা।

অনন্ত বার্তা দৈনিকের বিকাশ সেন-ই প্রথম প্রশ্ন ছুড়লেন। অপর্ণাদি, পঙ্কজবাবুর মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর আপনার প্রথম গল্পগ্রন্থের প্রকাশ। বেশ অবাক ঘটনা নয় কি?

বেশ সাবলীল ভাবেই উত্তর বেরিয়ে এল লেখিকার মুখ থেকে, আসলে সংসারের আকর্ষণটা তখন অনেক বেশি করে কাজ করছিল ভিতরে। ওর হঠাৎ চলে যাওয়ায় বেশ কিছুটা দিশাহারা লেগেছিল। একসময় আবিষ্কার করলাম সংসারের সেই ভয়ানক আকর্ষণটা যেন পেনের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। বলতে পারেন পেন যেন সংসারকে প্রতিস্থাপন করল।

বিকাশদার পরবর্তী প্রশ্নের আগেই সান্ধ্য খবরের রমা ঘোষ ফায়ার করল, দিদি পঙ্কজবাবু বাংলা সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য সাহিত্যিক। তাঁর লেখা ছোটো গল্প এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে টেক্সট বুকে স্থান পেয়েছে। তিনি বর্তমানে থাকলে আপনার এই বই প্রকাশ কতটা প্রাসঙ্গিক হতো?

অল্পক্ষণের জন্য লেখিকাকে স্মৃতিমেদুরতায় ডুবতে দেখলাম। কিছু বলবেন উনি। অপেক্ষা করছি আমরা। কার মোবাইল ফোন নিজের অস্তিত্ব জাহির করে বসল। পিছন ফিরে দু-একজন তাকাতে তড়িঘড়ি সেটি বন্ধ হয়। বাঁ হাতে রুমাল ধরে থাকা হাত নিজের মুখের ওপর একবার বুলিয়ে নিয়ে ব্যাখ্যা দিলেন উনি, অনেকটাই। উনি যে-মানসিকতার মানুষ ছিলেন তাতে তো মনে হয় এ ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়াটাই ওনার পক্ষে ছিল স্বাভাবিক।

আবার প্রশ্ন উড়ে এল, আচ্ছা ম্যাডাম এ গল্পগ্রন্থে স্থান পাওয়া গল্পগুলি কি কোনও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত?

না-সূচক ঘাড় নাড়লেন অপর্ণা। না, লেখা অনেকদিন আগেই হয়ে গিয়েছিল। আসলে লেখাগুলোর কনস্ট্রাকশন সম্পর্কে একদম নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। তাই বারবার এডিট করতে হচ্ছিল। বই যে করতে হবে সে ব্যাপারে চাপটা অবশ্য সুদীপ্তর তরফেই আসে, তৃপ্তি মেশানো এক মায়াময় হাসি ছুটে যায় সহকারীর দিকে।

নড়েচড়ে উঠি আমি। অস্বস্তিকর গরমটা কিছুতেই যেন ছেড়ে যাচ্ছিল না। লেখিকা অপর্ণার সঙ্গে বারবার লেখক পঙ্কজের নামটা জুড়ে যাচ্ছিল। আমরা এখানে যারা এই বই প্রকাশ কভারেজ করতে এসেছি, ঠিক কার কাছে এসেছি! লেখিকা অপর্ণার সত্তাটা স্বাধীন কিনা দেখে নেবার ইচ্ছা জাগছিল। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে প্রশ্নটা এগিয়ে দিই, দিদি একটু অন্যরকম প্রসঙ্গ। লেখিকা অপর্ণা যদি পঙ্কজবাবুর স্ত্রী না হতেন তবে কি তাঁর বইপ্রকাশ ঘিরে সংবাদ মাধ্যমের এই উচ্ছ্বাস থাকত?

মুখে লেগে থাকা হাসিটা যেন ওনার একটু ম্লান হয়ে এল। ক্লান্তি মেশানো স্বরে বলে উঠলেন, কী মন্তব্য করি বলুন তো? সেটা আপনারাই ঠিক করুন না।

রাতে অফিস থেকে যখন বেরোলাম, তখনও ঘুরে ফিরে লেখিকা অপর্ণার মুখটা আমার মধ্যে ফিরে আসছিল।

দুই

একটা ঘোরের মধ্যে কাজ করে যাচ্ছিলাম। রোববারের পাতার জন্য ফিচার চেয়েছিলাম পরিচিত এক লেখকের কাছে। সাবধানি চোখ নিয়ে তার জমা দেওয়া লেখাটা পড়ছিলাম। লেখার বাঁধুনিটা ভীষণ ভালো। কিন্তু প্যারাগ্রাফের চেঞ্জগুলো একদম ঠিকঠাক করতে পারেননি। সেগুলিকেই সম্পাদকীয় দৃষ্টিতে যতটা সম্ভব দেখে নেবার চেষ্টা করছিলাম।

সামনে এসে দাঁড়াল অনিরূপা। বছর ২৭-এর মেয়েটি রবিবারের পাতার সম্পাদকীয় বিভাগে আছে প্রায় দেড় বছর। তারও আগের দু-বছর প্রথম শ্রেণির একটা দৈনিক ডেস্কে চাকরি করে এসেছে। বাংলা ভাষায় এত কম বয়সে এই জ্ঞান খুব কম মেয়ের মধ্যে দেখা যায় অথচ কোনওরকম আঁতলামো নেই, উলটে এক নম্বর ফক্কড়। সাহিত্যলোকের এ সপ্তাহতেই প্রকাশিত সংখ্যাটা আমার দিকে এগিয়ে ধরে চোখ দুটো বড়ো করে বলল, সৌম্যদা, এবার না তুমি খবর হয়ে যাবে।

নিজের হাতঘড়িটা কনুইয়ে দিকে একটু ঠেলে তুলে দিয়ে বলি, কেন রে!

অপর্ণা ঘোষের স্টোরিটা তুমি করেছিলে না?

হ্যাঁ, তো!

ভালো করে পড়ে দেখো এটা। চলে যায় অনিরূপা।

সাহিত্যলোকের বইয়ে আলোচনার বিভাগটা খুলে রেখে গেছে ও। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি। বাজারে এই মুহূর্তে সাহিত্য পত্রিকার সংখ্যা অনেকগুলো। সদ্য প্রকাশিত বইগুলির আলোচনাও থাকে সে সমস্ত সংখ্যায়। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে সাহিত্যলোকের আলোচনা বিভাগটিকে অন্যরকম গুরুত্ব দিই। দীর্ঘদিন ধরে এই বিভাগটিতে লেখেন গণেশ মুখোপাধ্যায়। লোকটার পড়াশোনা, বিশ্লেষণ এবং তথ্য পেশ করার ক্ষমতা চমকে দেবার মতো। গণেশ মুখোপাধ্যায়ের মতো সমালোচক কোনও লেখক বা বই সম্পর্কে যে মন্তব্য করবে, সেটা আমার মতো অনেকের কাছেই আপ্তবাক্য। সবচেয়ে বড়ো কথা লোকটা সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার ক্ষমতা রাখে। সুতরাং, তার মতো ব্যক্তিত্ব যখন অপর্ণা ঘোষের লেখার সঙ্গে পঙ্কজ ঘোষের লেখার অত্যাশ্চর্য মিল খুঁজে পেয়েছে, সেটা আর যাই হোক ধান ছড়িয়ে বুলবুলিতে খাওয়ার মতো ঘটনা নয়।

স্টোরিটা করার সময় অপর্ণা ঘোষের বইয়ের দুএকটি গল্প পড়ে আমি কিছু মন্তব্যও করেছিলাম। সত্যি কথা বলতে গেলে কী, কোনও লেখিকার প্রথম গল্প গ্রন্থেরই ভাষা এত সাবলীল অথচ গভীর হতে পারে তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। গোটা স্টোরিটাই তৈরি করেছিলাম একটু মুগ্ধ ভাব নিয়ে। গণেশ মুখোপাধ্যায়ের আলোচনার কোনও কোনও অংশ ব্যাঙ্গাত্মক তীর হয়ে যে আমার কাগজের রবিবারের স্টোরিটাকেও বিদ্ধ করেছে স্পষ্টই বুঝতে পারলাম। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর লেখার ধরনের মধ্যে মিল থাকা কি খুব অস্বাভাবিক! দীর্ঘদিন একজনের সাথে থাকতে থাকতে তার অনেক কিছুই তো অজান্তেই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। তবে সাহিত্যলোকের আলোচনাটা যে অপর্ণা ঘোষের সদ্য শুরু হওয়া সাহিত্য জীবনকে অনেকটাই জটিল করে তুলবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই।

হাতের কাছে রাখা নিজের মোবাইল থেকে সান্ধ্য নিউজের রমাদি-কে ধরলাম। ভদ্রমহিলার লিটারেচার ফিল্ডের জ্ঞানটা যেমন গভীর তেমনি খবরও রাখেন নানারকম। প্রথমবার বেজে বেজে থেমে গেল। দ্বিতীয়বার ফোন করার সাথে সাথেই গম্ভীর অথচ সুরেলা গলা নিয়ে আমার কানের কাছে উঠে এলেন রমাদি। আমি সোজাসুজি আসল দরকারে আঘাত হানার চেষ্টা করলাম, দিদি, সেদিন তো অপর্ণা ঘোষের বইয়ের লঞ্চিং-এ আপনিও ছিলেন। সাহিত্যলোকে এবারে যে-আলোচনাটা বেরিয়েছে চোখে পড়েছে নাকি?

হ্যাঁ পড়েছে, সংক্ষিপ্ত, উদাসীন প্রতিক্রিয়া মনে হল আমার।

কী মনে হচ্ছে আপনার?

কী আবার! গণেশবাবু যখন লিখেছেন তখন একটা কিছু ব্যাপার তো রয়েছেই।

আপনার কী মনে হচ্ছে? ভেতরে ভেতরে অধৈর্য হয়ে উঠছিলাম।

কী বলি বলো তো! বেশ বিতর্কিত ব্যাপার। তবে আমার মনে হচ্ছে পঙ্কজদার কিছু লেখা অপ্রকাশিত পড়েছিল। সেগুলোকেই এখন নিজের নামে চালানোর চেষ্টা চলছে। অপর্ণা চিরকালই সংসারিক মেয়ে কোনও সাহিত্যের অনুষ্ঠানেও স্বামীকে সঙ্গ দিতে দেখিনি, অথচ পঙ্কজদা বরাবর নারীবাদের স্বপক্ষে কথা বলে এসেছেন।

সেন্ট্রাল এসি-র মধ্যে বসেও নিজের চারপাশে একটা গরম আবহাওয়ার বেষ্টনী পেলাম। ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। কেন জানি না মনে হচ্ছিল, ব্যাপারটা আর একটু খুঁড়ে দেখা দরকার। ও প্রান্তে রমাদি অবশ্য আমার উত্তেজনায় ঠান্ডা জল ঢেলে দিলেন।

এটাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে কী হবে সৌম্য! বাংলা সাহিত্যে লেখালিখিতে এটা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফোনটা কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলাম। সুদীপ্তর ফোন নাম্বারটা যতদূর মনে হচ্ছে ফোন বুকে তোলা আছে। একটু খুঁজতে পেয়ে গেলাম। অনুরোধটা করতেই ওর মুখ থেকে যেন একরাশ বিরক্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল।

কেন কথা বলতে হবে, কেন? অপর্ণাদি তার মতো লিখেছেন। আপনারা যেটা লিখবেন সেটাকেই কেন সবচেয়ে বড়ো সত্যি বলে মেনে নিতে হবে!

দেখুন সুদীপ্তবাবু, কথাটা অনেকাংশে সত্যি। কিন্তু কথাটা বোধহয় আমার সম্পর্কে খাটে না। বইটা পড়েই অপর্ণাদি সম্পর্কে আমার একটু অন্যরকম ধারণা হয়েছিল। আমি একটু ওনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনি প্লিজ একটা অ্যাপয়েনটমেন্ট…

কথা দিতে পারছি না। চেষ্টা করে দেখছি।

সুদীপ্তর কন্ঠস্বরকে এতটুকু নরম মনে হল না!

তিন

মিনিট পনেরো হল চা-টা শেষ করেছি। দাঁত এবং মাড়ির আশেপাশে লেপটে থাকা বিস্কুটের স্তরটাকে জিভ চালিয়ে পরিষ্কার করে নেবার চেষ্টা করছিলাম। ফুল স্পিড-এ মাথার ওপরে পাখা ছাড়াও পাশে থাকা সুপার স্পিড-এর স্ট্যান্ডফ্যানটা মাথার চুলগুলোকে এলোমেলো করে যাচ্ছিল।

অপর্ণা ঘোষ উলটো দিকের সোফায় এসে বসেছেন বেশ কিছুক্ষণ কিন্তু এখনও অবধি মুখ খোলেননি। একই সোফার কোণে বসে আছে সুদীপ্ত। প্রশ্নগুলো মোটামুটি নিজের মনে সাজিয়ে রেখেছি। রিডিং লাইটের আধা আলো আঁধারিতে লেখিকার মুখের ভাব ও মনের তরঙ্গের ঠিক হদিশ মিলছিল না। ঘোর লাগা গলায় একসময় সূচনাহীন এবড়োখেবড়ো প্রবন্ধ পড়ার ভঙ্গিমায় ওনার হঠাৎ করে বলতে শুরু করাটা আমাকে সচকিত করে দেয়। নিজের উরুর ওপরে প্যাডটা খুলে রাখাই ছিল। ডট পেনের পিছনটা আঙুল চালিয়ে টিপে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো তুলে নেবার জন্য প্রস্তুত হই।

এত বছর পঙ্কজবাবুর সঙ্গে কাটানোর কারণেই কি তার অন্বয়রীতি, বাক্যবিস্তার, প্লট আপনার গল্পে গৃহীত হয়েছে? খুব ধীর গতিতে প্রশ্নটাকে ওনার সামনে রাখার চেষ্টা করলাম।

প্রশ্নটার সরাসরি জবাব দেবার কোনও তাগিদ লক্ষ করলাম না ওনার মধ্যে। স্মৃতির অতল গহ্বরে ডুবে পুনরায় ভেসে উঠতে চাইলেন তিনি। সত্যেন বোস লেনের মেসটাতে ও যখন থাকতে এল, তখনই ও ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিয়েছে। পড়াশোনায় কোনওদিনই সেভাবে মন ছিল না ওর। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার অফিসে নিয়মিত ঘোরাঘুরি করছিল বটে কিন্তু সেভাবে কলকে পাচ্ছিল না। বেশ হতাশ। এইরকম একটা সময়ে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে ওর সঙ্গে আমার দেখা। ইংরাজি অনার্সের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী আমি। প্রথম দেখাতেই উদ্দাম প্রেম আর তার মাস ছয়েকের মধ্যেই বিয়ে। একটি খবরের কাগজে যৎসামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে ও কলাম লিখত। একটু দম নেবার জন্য যেন থামতে চাইলেন অপর্ণা।

পরের প্রশ্নটা করব কিনা ভাবছি, এমন সময় পূর্ব প্রসঙ্গকে আরও টেনে বলতে শুরু করলেন অপর্ণা। তখন কাগজে ও যে-সব রিভিউগুলো লিখছে সেগুলোও সম্পাদকের ঠিকমতো পছন্দ হচ্ছে না। বেশ হতাশ ও। সংসার চলতে চাইছে না। সংসার ক্রমশ আমার কাছে বিভীষিকা তখন। এরই মধ্যে মোটামুটি একটি নামি পত্রিকায় আমার একটি গল্প বেরোয়। লেখাটি মোটামুটি প্রশংসিত হয়েছিল। আপনি ভাবছেন এসব কথা আপনাকেই বা কেন বলছি! আসলে এই মুহূর্তে অনেকেই যখন অফিসের ঠান্ডা ঘরে বসে আমার বিরুদ্ধে কলম চালাচ্ছে, তখন আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি সত্যিকথার অনুসন্ধান করেন। আর এত বছরে আমারও তো কিছু বলার থাকতে পারে…।

সাদা সাংবাদিকতাকে কীভাবে হলুদ সাংবাদিকতা নিজের বশে এনে ফেলেছে তা এই কবছরে ভালোই উপলব্ধি করেছি। কিন্তু অপর্ণা ঘোষের শেষ বাক্যটি আমাকে রীতিমতো চমকে দিল। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে ওনাকে বলি, বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমার কিন্তু কোথাও একটু গণ্ডগোল ঠেকছে। কোথাও একটা ফাঁক। একটা মস্ত বড়ো সত্যি যেন মেঘে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। আমার ধারণা এই ধোঁয়াশা আপনিই দূর করতে পারেন।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন অপর্ণা। মুখ তুলে এরপর উনি সুদীপ্তর দিকে তাকাতে মুখে অল্প হাসি এনে সুদীপ্ত যেন ওনাকে কিছুর সম্মতি দেয়।

উনি বলতে শুরু করলে ওনার গলাটা আগের থেকে দৃঢ় শোনাচ্ছিল, ক্রিয়েটিভ রাইটিংটা কোনওদিন আপনাদের পঙ্কজদার আসত না। খেতে পাচ্ছি না অথচ রোজই ওর মুখে গালভরা স্বপ্ন শুনতাম। আর কখনও-কখনও রাতে বাড়ি ফিরে গায়ে হাত তুলত। অনেক বড়ো বড়ো সভায় গিয়ে সমাজে নারী স্বাধীনতার স্বপক্ষে অনেক বক্তৃতাই ও শুনিয়েছে। কিন্তু নিজের দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর সঙ্গে কী ব্যবহার করত আপনাদের সংবাদমাধ্যম কি তার খবর রেখেছে? আমার গল্পটা প্রশংসিত হবার পর আরও একটি গল্প লিখি এবং একটি নামি দৈনিকের রবিবারের পাতায় গল্পটি ওর নামে পাঠিয়ে দিই। আমার স্বামীকে এর পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এতদিন পঙ্কজ ঘোষের নামে যা যা বেস্টসেলার পাবলিক জেনে এসেছে তার প্রতিটি অক্ষর আসলে আমার সৃষ্টি। দুহাতে নিজের মুখ ঢাকলেন অপর্ণা।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো এতক্ষণ শুনে যাচ্ছিলাম। স্টোরিটা কীভাবে নিজের কাগজে প্লেস করব, এবার তার ভাবনা আমাকে ধাক্কা দেয়। খুব ধীর গলায় সুদীপ্ত বলে ওঠে, কিন্তু লেখার রীতিটা যে দিদির, সেটা বোধহয় প্রমাণ করা সম্ভব নয়, না?

মৃদু হেসে বলে উঠি, কেন নয়? পঙ্কজ ঘোষের প্রবন্ধের ভাষা ও গল্প-উপন্যাসের ভাষা পরীক্ষা করে, আমার ধারণা একজন ভাষাবিদ অবশ্যই বলতে পারবেন। আর তা ছাড়া সত্যিটা প্রকাশিত হলে জনগণের সামনে একটা দুটো গল্প একজন জাত লেখিকা লিখে দিতে পারে। এটা নিয়ে ভাবার দরকার আছে বলে মনে করি না।

ধীর পায়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়াই। এ বাড়িতে ঢোকার আগে সাক্ষাৎকার শিরোনাম কী দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না। শিরোনামটা হঠাৎই মাথায় এসে যায়। নিজের ব্যাগ থেকে প্যাডটা বের করে ভুলে যাবার আগেই তা দ্রুত হাতে লিখে নিতে থাকি আমি…

 

আবার আসিব ফিরে

একদৃষ্টে সাগরের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল রাজীব। আরব সাগরের অশান্ত, উত্তাল ঢেউ সহজে চোখে পড়ে না। কিন্তু আজ কেন জানি না রাজীবের উত্তাল অশান্ত হৃদয়ের চেহারাই বারবার প্রতিফলিত হচ্ছিল সাগরের অন্তহীন বুক জুড়ে।

সঞ্জনার চেহারাটা বারবার ভেসে উঠছিল রাজীবের চোখের সামনে। কিছুই আর চিন্তা করতে পারছিল না সঞ্জনা ছাড়া। সারা পৃথিবীতে কী ঘটে চলেছে তার সঙ্গে রাজীবের কিছুমাত্র যোগাযোগ ছিল না। ও শুধু নিজের জগতেই নিজেকে বন্দি করে নিয়েছিল।

সঞ্জনা রাজীবের বিবাহিতা স্ত্রী। মা, বাবার দেখে দেওয়া পাত্রীকে এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল রাজীবের। তিন বছরের বিবাহিত জীবন ওদের। সঞ্জনা ছাড়া নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার কল্পনাও করতে পারত না রাজীব। এক স্বর্গীয় ভালোবাসায় নিজেকে উজাড় করে রাজীব তুলে ধরেছিল সঞ্জনার হাতে।

চাকরি এবং স্ত্রী সঞ্জনাকে নিয়ে রাজীব মুম্বই শহরে এসে পৌঁছেছিল। তিন বছর ওদের কোনও সন্তান হয়নি। এই নিয়ে কোনও দুঃখও ছিল না রাজীবের মনে। সঞ্জনাই ওর পুরোটা জুড়ে ছিল। সংসারে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি রাজীব। সঞ্জনা ছাড়া ও কিছুই প্রত্যাশা করত না। তবুও দুজনের সংসারে তৃতীয়জনের আসার সংবাদ ডাক্তারের মুখে শুনে খুশি হয়েছিল রাজীব। বেশি খুশি হয়েছিল সঞ্জনার জন্য।

কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস স্বীকার করা ছাড়া আর কী-বা করতে পারল রাজীব? সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে চিরতরে রাজীবকে ত্যাগ করে সঞ্জনা কোথায় হারিয়ে গেল। রাজীব, কন্যাসন্তান, গোছানো সংসার সবই পড়ে থাকল শুধু গুছিয়ে রাখার মানুষটাই স্নেহ, মায়ার বন্ধন কাটিয়ে রাজীবের হৃদয়টাকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেল।

বাড়িতে কিছুতেই মন বসাতে পারছিল না। চারিদিকে শুধু সঞ্জনার স্মৃতি। সবথেকে বেশি সঞ্জনার কথা মনে হতো সঞ্জনার ফেলে যাওয়া একরত্তি ওই মেয়েকে দেখলে। রাজীব যেন মনে মনে সঞ্জনার মৃত্যুর জন্য মেয়েকেই দাযী করে বসল। ওর দিকে তাকালেই মনটা আরও বেশি হুহু করে উঠত।

বেঙ্গালুরু থেকে রাজীবের মা-বাবা মুম্বই এসেছিলেন পুত্রবধূ বাড়ি ফিরলে সংসার সামলাতে যাতে কষ্ট না হয় সঞ্জনার ছোটো বাচ্চা নিয়ে কিন্তু সেই সঞ্জনাই ফিরল না। ঠাকুমা-ঠাকুরদাই নাতনিকে আপন করে নিলেন। স্নেহ মমতা দিয়ে ওইটুকু প্রাণকে আগলে রাখার চেষ্টা করে চললেন। ছেলেকে ওনারা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলেন কিন্তু রাজীবের মন কিছুতেই ভিজল না। জীবন থেকে মেয়েকে দূরে সরিয়ে রাখল সে।

অগত্যা উপায়ান্তর না দেখে রাজীবের মা-বাবা একমাত্র নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে বেঙ্গালুরু ফিরে গেলেন। রাজীব মুম্বইতে একাই রয়ে গেল। তার জীবনে ভালোবাসা রূপকথা হয়ে রয়ে গেল।

সঞ্জনার মৃত্যুর প্রায় আট মাস হয়ে গেছে। যন্ত্রের মতো কেটে গেছে এই দীর্ঘ সময়টা। চারপাশে কী হচ্ছে কিছুরই খেয়াল করেনি রাজীব। তাহলে আজ হঠাৎ আবার সাগরের একের পর এক ভেঙে পড়া ঢেউ দেখতে দেখতে, কেন তার হৃদয় এতটা উদ্বেলিত হচ্ছে রাজীব বুঝতে পারছে না! সঞ্জনাকে দেখে তো এমনটা হতো কিন্তু সেই মুহূর্তটুকু তো জীবনে একবারই আসে। তাহলে আজ কীসের জন্য মন এতটা অশান্ত? তাহলে কারও প্রতি কি তার মন আকর্ষিত হচ্ছে? না না এ হতে পারে না। সঞ্জনার উপর কোনও অন্যায় অবিচার সে হতে দিতে পারে না। এ অন্যায়।

রাজীব স্বপ্নেও ভাবেনি এই মুহূর্তটুকু আবার তার জীবনে প্রবেশ করবে। মানসিক এই টানাপোড়েন অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলছিল রাজীবের ভিতর। প্রতিবেশী মেয়েটির চেহারা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। একজন প্রতিবেশীর জন্য চিন্তা করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয় কিন্তু সবকিছুকে রাজীব কিছুতেই একটা সরলরেখায় ফেলতে পারছিল না।

ছয় মাসের হয়তো একটু বেশিই হবে সামনের খালি ফ্ল্যাট-টায় ওই মেয়েটি এসেছে। মেয়ে না বলে মহিলা বললেই হয়তো ঠিক হবে কারণ রাজীবের মনে হয়েছিল মহিলার বয়স তিরিশের আশেপাশে। বারান্দায় দাঁড়ালে রাজীবের ঠিক উলটো দিকে সেই ফ্ল্যাট। দুটো ফ্ল্যাটের মুখোমুখি বারান্দা।

রাজীবের প্রথম চোখে পড়ে যখন মেয়েটিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে দেখে। এছাড়া খোলা বারান্দার দরজা দিয়ে চোখে পড়েছিল লোক দিয়ে বাড়ির জিনিসপত্র সব গুছিয়ে তুলছিল ওই মহিলা। ব্যস অতটুকুই।

অফিসে যাওয়া-আসার পথে, লিফট-এ প্রায়শই দেখা হতো। অনেকেরই সাথে তো রোজ দেখা হয়, তাহলে বিশেষ করে ওই একজনের প্রতি কেন আকর্ষণ অনুভব করত রাজীব, নিজেই বুঝতে পারত না। হয়তো একাকিত্ব বোধ থেকে অথবা শরীরের অপ্রতিরোধ্য চাহিদা থেকে, এর মধ্যে কোনটা সেটা রাজীবের কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না।

একদিন লিফ্ট থেকে বেরোতে গিয়ে তাড়াহুড়োতে কোনও ভাবে পা মুচকে গিয়ে মহিলা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, রাজীব কোনওরকমে ধরে ফেলে। হাত ধরে বাইরে রাখা একটি চেয়ারে ওকে বসিয়ে দেয় রাজীব।

দেখি কোথায় লাগল আপনার, বলে নীচু হয়ে রাজীব আঘাতের জায়গাটা দেখার চেষ্টা করতেই এক ঝটকায় মহিলা পা-টা সরিয়ে নিল।

না না, আমি ঠিক আছি। একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে, বলতে বলতে মহিলা চেয়ারে বসেই পা-টাকে একটু নাড়াচাড়া করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

কোনও সাহায্য লাগলে বলুন…

না না ধন্যবাদ। ঠিক সামলে নেব…

কথা না বাড়িয়ে রাজীব অফিসের পথে পা বাড়াল। কিন্তু সারাটা দিন মুহূর্তের ওই স্পর্শটুকু কিছুতেই মাথা থেকে বার করতে পারল না।

দুতিন দিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখল মহিলাকে। এর মধ্যে দেখা হলে মৌখিক হাসি বিনিময় হতো আর মাঝেমধ্যে একটা দুটো করে কথা। মহিলা রাজীবের মনে চেপে বসে থাকা বরফের চাঁইটাকে একটু একটু করে গলাতে শুরু করল।

এর পর হঠাৎ করেই তিন-চারদিন আবার দেখা নেই। ভিতরে ভিতরে একটা অস্বস্তিতে ভুগতে লাগল রাজীব। বারান্দার দরজাও রাতদিন বন্ধ। অজানা আশঙ্কায় রাজীবের মন কেঁপে উঠল।

মহিলার ফ্ল্যাটে যাওয়া উচিত হবে কিনা কিছুতেই মনস্থির করতে পারছিল না রাজীব। হঠাৎ দরজায় কলিংবেল-এর আওয়াজ শুনে দরজা খুলতেই দেখল ওই মহিলার বাড়ির কাজের মাসি সামনে দাঁড়িয়ে

সাহাব, একবার ওই ফ্ল্যাটে চলো। মেমসাহেবের শরীর খুব খারাপ, কী করব আমি বুঝতে পারছি না। এক নিঃশ্বাসে হড়বড় করে বলে ওঠে মাসি।

রাজীব তত্ক্ষণাৎ মহিলার ফ্ল্যাটে এসে হাজির হয় মাসির সঙ্গে। বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে মহিলা, দেখে হুঁশ আছে বলে মনে হল না।

কোনও ডাক্তার দেখেছে? চিন্তিত হয়ে মাসিকেই জিজ্ঞেস করে রাজীব।

মাথা নাড়ায় মাসি।

সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ফোন করে বাড়িতে আসতে বলে রাজীব। ডাক্তার এসে দেখে ওষুধপত্র সব লিখে দিয়ে যান। ওষুধগুলো মাসিকে দিয়ে আনিয়ে নেয় রাজীব। পালা করে মাসির সঙ্গে মাথায় জলপট্টি করতে থাকে যাতে জ্বরের পারদ একটু নামে। ডাক্তারবাবুর ওষুধগুলো একটা একটা করে খাইয়ে দেয় মহিলাকে। ধীরে ধীরে জ্বর কিছুটা কম হলে রাজীব নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে আসে।

পরের দিন মহিলাকে একটু সুস্থ দেখে রাজীব জিজ্ঞেস করে, আপনার আত্মীয় কেউ আছেন যাকে খবর দিতে হবে? আপনি বললে আমি ফোন করে দিতে পারি। হালকা করে মাথা নেড়ে না বলে মহিলা। সুতরাং তার খাওয়াদাওয়া, সময়ে সময়ে ওষুধ খাওয়ানোর দাযিত্ব রাজীব নিজের উপরেই নিয়ে নেয়। রাজীব বুঝতে পারছিল এর ফলে মহিলা সংকোচ বোধ করছে। কিন্তু শরীর এতটাই দুর্বল যার জন্য কিছু বলতে পারছে না।

চারদিন পর রাজীব মহিলার ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখল, এতদিন পর বিছানায় উঠে বসেছে মহিলা। অনেক সুস্থ লাগছে ওকে। রাজীব ঘরে ঢুকতেই মহিলা বলে উঠল, আপনাকে এতদিন ধরে অনেক কষ্ট দিলাম। আমাকে ক্ষমা করবেন।

ক্ষমা কীসের জন্য? প্রতিবেশীই তো প্রতিবেশীর কাজে আসে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।

হ্যাঁ, ভাবছি কালকের দিনটা বিশ্রাম নিয়ে পরশু থেকে অফিস জয়েন করব। কোনও কিছুর দরকার আছে কিনা জেনে নিয়ে রাজীব অফিস বেরিয়ে পড়ে।

এর পর মেলামেশা আরও একটু গাঢ় হয়। একসঙ্গে ডিনার সারা, একসঙ্গে বসে গল্পগুজব করা ওদের দুজনের বন্ধুত্বকে আরও সুদৃঢ় করে তোলে।

জানলায় দাঁড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল রাজীব। আকাশ এত নীল আগে কখনও খেয়াল করেনি। হয়তো কখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখার কথাই মনে হয়নি। হৃদয়ে যখন শূন্যতা জায়গা জুড়ে বসে তখন সবকিছুই কেমন অর্থহীন হয়ে পড়ে। এই কয়েক মাস হল আকাশে রঙের আনাগোনা লক্ষ্য করছে রাজীব।

আজ সন্ধেবেলা দুজনে ডিনারে যাওয়ার কথা আছে। এতদিন ধরে মেলামেশা করছে, রাজীবের মনে হল আজ পর্যন্ত সঙ্গিনীর নামটা পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করা হয়নি। অবশ্য দুজনের কেউই আজ পর্যন্ত নিজেদের অতীত নিয়ে কখনও কথা তোলেনি।

ডিনার টেবিলে মুখোমুখি বসে কথা বলা শুরু করলে রাজীবই প্রসঙ্গ তুলল, এতদিন হয়ে গেল, আপনার নামটাই এখনও জানা হল না।

অনসূয়া, হাসিতে ভরে গেল মহিলার মুখ।

বাঃ, ভারী সুন্দর আপনার নাম। অত্রি মুনির স্ত্রী ছিলেন সতীসাধ্বী অনসূয়াদেবী। রামায়ণে আমরা তাঁর বর্ণনা পাই, আপনিও নিশ্চয়ই পড়ে থাকবেন?

মায়ের মুখে এই গল্প বহুবার শুনেছি। হেসে উত্তর দেয় অনসূয়া।

কথা বলতে বলতেই খাবারের অর্ডারটা দিয়ে দেয় রাজীব।

আরও কিছু বলুন নিজের সম্পর্কে। আমরা কেউই একে অপরের সম্পর্কে কিছুই জানি না। অবশ্য আপনার যদি আপত্তি না থাকে তবেই বলুন! সামান্য দ্বিধা নিয়ে কথাগুলো বলে রাজীব।

অনসূয়া চোখ নামিয়ে হাতের নখ খুঁটতে থাকে।

ঠিক আছে, আপনাকে কিছু বলতে হবে না, ব্যস্ত কণ্ঠে রাজীব বলে ওঠে।

না না, সেরকম কিছু নয়। এতদিনে এইটুকু বন্ধুত্ব তো হয়ে গেছে। আমি নিজের কথা আপনাকে খুলে বলতে পারি। চলুন, খাওয়ার পর বাইরে বেরিয়ে সব বলব। চোখ নীচে নামিয়ে অনসূয়া কিছুটা সময় চেয়ে নিল নিজেকে গুছিয়ে নিতে।

খাওয়ার পর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল অনসূয়া তারপর ধীর স্বরে বলতে আরম্ভ করল, আমরা দুজনেই এমবিএ করছিলাম। ছেলেটিও আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসত। আমরা লিভ ইন করতে শুরু করি। আমার মা-বাবা আমাকে অনেক বুঝিয়েছিল এই সম্পর্ক থেকে সরে আসার জন্য। প্রচুর বকাবকিও করেছিল। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না। মা আমাকে বুঝিয়েছিল যে, বিয়ের পর আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি কিন্তু আমিই শুনিনি।

আমার মনে হয়েছিল, যখন দুজনে দুজনকে ভালোবাসি তখন বিয়ের বন্ধনের দরকারটা কোথায়? এছাড়া তখন বিয়ে করা সম্ভবও ছিল না। মা-বাবা রাগ করে আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এর পর আমরাও চাকরি পেয়ে যাই। কিন্তু আলাদা আলাদা শহরে। চেষ্টা করছিলাম দুজনের চাকরি যাতে এক শহরে হয়।

আমার বয়ফ্রেন্ড কখনও ছুটি পেলে আমার কাছে চলে আসত, কখনও আমি ওর কাছে চলে যেতাম। এই ভাবে প্রায় একটা বছর কেটে যায়। তার পর হঠাৎই খেয়াল করি ও না আসতে পারার জন্য রোজ নতুন নতুন বাহানা দিচ্ছে। একটু জোর দিতেই ও স্বীকার করে নেয়, অন্য একটি মেয়েকে নাকি সে এখন ভালোবাসে। এটা কী করে সম্ভব? আমি তো জানতাম ভালোবাসার আনন্দ একবারই হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা যায়। দ্বিতীয়বার কি আর কখনও সেভাবে ভালোবাসা যায়? আপনিই বলুন…। কথা বলতে বলতে দু-হাতে মুখ ঢাকে অনসূয়া।

রাজীব অনসূয়ার হাত ধরে সামনে থাকা একটা বেঞ্চের উপর বসিয়ে দেয়।

না না আপনিই বলুন দ্বিতীয়বার কি আর ভালোবাসা আসে জীবনে? অশ্রুসজল নয়নে অনসূয়া প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায় রাজীবকে।

উত্তর দেয় না রাজীব। দৃষ্টি মাটির দিকে নিবদ্ধ করে চুপচাপ বসে থাকে সে। অনসূয়া ধৈর্য হারিয়ে বলে ওঠে, তার মানে আপনি বলতে চান প্রথমটা ভালোবাসা ছিলই না। শুধুই শরীরী আকর্ষণ মাত্র!

না আমি সেরকম কিছু তো বলিনি, তবে ভালোবাসা…, চুপ করে যায় রাজীব।

হ্যাঁ, ভালোবাসা… কী বলতে চাইছেন পরিষ্কার করে বলুন। অনসূয়ার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল।

আমিও এতদিন এটাই বিশ্বাস করতাম, গভীর নিঃশ্বাস নেয় রাজীব। যে ভালোবাসা জীবনে একবারই আসে। আমিও প্রাণের থেকে স্ত্রীকে বেশি ভালোবাসতাম কিন্তু মেয়ে জন্ম দিতে গিয়ে ওর মৃত্যু হয়। তখন মনে হয়েছিল এটাই আমার জীবনে শেষ ভালোবাসা যতদিন না… বলতে বলতে রাজীব চুপ হয়ে যায়।

যতদিন না… একরাশ প্রশ্ন নিয়ে অনসূয়া রাজীবের দিকে তাকায়। রাজীব দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।

কী হল, বললেন না? তাহলে কি এখন অন্য কাউকে ভালোবাসেন? অনসূয়ার দৃষ্টির গভীরতা রাজীবকে বিদ্ধ করে।

হঠাৎ রাজীব তাড়া দেয় অনসূয়াকে, চলুন রাত হয়ে যাচ্ছে বাড়ি ফেরা যাক।

অনসূয়া রাজীবের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে ফেলে, আগে কথা শেষ করুন।

অনেক রাত হল, এবার ফেরা যাক।

না, আগে আমাকে বলুন, অধীর হয়ে ওঠে অনসূয়া।

কী বলব। হ্যাঁ ভালোবাসি। তোমাকে ভালোবাসি অনসূয়া। উত্তেজিত হয়ে রাজীব বলে ওঠে, চোখের থেকে জল গড়িয়ে পড়ে তার।

না, না এ কিছুতেই হতে পারে না! অনসূয়া ছেড়ে দেয় রাজীবের হাত।

অনসূয়া শোনো, তোমার প্রতি আমার এই অনুভতি যে তোমারও থাকবে এই দাবি কখনও-ই করি না। আমার এই অনুভতি যে আমাদের বন্ধুত্বের উপর কোনও প্রভাব ফেলবে না সেটা আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি।

পরের দিন দুজনের দেখা হলেও কথা বলার খুব একটা সুযোগ হল না। রাজীবও নিজেকে সংযত করে নিয়েছিল।

দ্বিতীয় দিন অনসূয়া জানাল, তাকে পাঁচদিনের জন্য অফিসের কাজে শহরের বাইরে যেতে হচ্ছে।

এরই মধ্যে মায়ের শরীর খারাপের খবর আসাতে রাজীব ছুটি নিয়ে বেঙ্গালুরু চলে এল। মেয়েকে এই প্রথম নিজে থেকে কোলে তুলে নিল রাজীব। আজ এই প্রথমবার তার মনে হল না এই মেয়ের জন্যই সে সঞ্জনাকে হারিয়েছে চিরজীবনের মতো। মনে আজ আর কোনও বিদ্বেষ নেই, রাজীব মনে শান্তি অনুভব করল। সঞ্জনার স্মৃতি আজ দুঃখ দিল না। বরং তার মনে হল, সঞ্জনা জীবনে পুরো ভালোবাসা পেয়ে যেতে পেরেছে। এই সন্তান সঞ্জনার অস্তিত্ব নয় বরং রাজীবের জীবনের একটা অংশ এবং এই অংশকে কোনওদিন অবহেলা করার নয়, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল রাজীব।

রাজীবের মা-ও ছেলের এই পরিবর্তন ভালো করেই বুঝতে পারছিলেন। পুরোনো আগের সেই রাজীবকে ফিরে পেয়ে উনিও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠলেন। এক সপ্তাহ সকলের সঙ্গে হইহই করে কাটিয়ে রাজীব ফিরে এল মুম্বই।

সকালে অফিসের জন্য তৈরি হতে তাড়াতাড়ি স্নানে ঢুকেছিল রাজীব। তখনই টের পেল বারবার কেউ কলিংবেল বাজাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে বাথরোব পরে নিয়ে রাজীব বাইরে বেরিয়ে এল। যে-কেউই দরজায় থাক না কেন অপেক্ষা করতে রাজি নয় বেশ বুঝতে পারছিল।

দরজা খুলতেই দেখে অনসূয়া দাঁড়িয়ে, একপ্রকার রাজীবকে ঠেলেই ভিতরে ঢুকে এল সে। রাজীব দরজা বন্ধ করতেই চেঁচিয়ে উঠল রাজীবের উপর।

কোথায় চলে গিয়েছিলেন? বলেও যাননি কিছু? ফোন নম্বরও দিয়ে যাননি। আপনার কোনও আইডিয়া আছে, আমার অবস্থা কী হতে পারে? চিন্তা করে কোনও কুল পাচ্ছিলাম না। খালি মনে হচ্ছিল আপনিও আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন না তো? এমনিতে দাবি করেন আমাকে ভালোবাসেন অথচ একবারও আমার চিন্তা আপনার মাথায় এল না? বলতে বলতে কেঁদে ফেলে অনসূয়া।

সামান্য হেসে এগিয়ে এসে রাজীব অনসূয়াকে নিজের বুকে টেনে নেয়। এতদিনে ভালোবাসাও অনসূয়ার হৃদয়ের আঙিনায় জানান দিয়ে গেছে, আবার আসিয়াছি ফিরে।

 

হাত্থি ঠাকুরের গল্প

আলের উপর দিয়ে হেঁটে পিচের রাস্তার দিকে যাচ্ছিল জিয়ন। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, মেঘ জমছে। যে-কোনও সময় বৃষ্টি নামতে পারে। সকালবেলায় খটঙ্গা গ্রাম থেকে ও যখন বেরিয়েছিল, তখন ঝকঝকে রোদ্দুর। সাইকেল চালিয়ে ওর খেত জমিতে আসার সময় দরদর করে ঘামছিল। জিয়ন তখন মনে মনে মারাংবুরুর কাছে প্রার্থনাও করেছিল, যেন দু’একদিনের মধ্যে বৃষ্টি নামে। অনেক কষ্টে সেচের জল এনে ধান রুয়েছে। সেই ধানগাছ এখন হাঁটুর সমান বেড়ে উঠেছে। জলের অভাবে যেন শুকিয়ে না যায়। কানালি জমি এমনিতে নীচু, ধানচাষ খুব শক্ত। কিন্তু, উপায় নেই। বাপ-ঠাকুদ্দার রেখে যাওয়া জমি জিয়ন শুখা ফেলে রাখবে কী করে?

পিয়াল গাছের নীচে সাইকেলটা রাখা আছে। বৃষ্টি নামার আগেই ওকে বাড়ি ফিরতে হবে। বছর দুয়েক আগে পুবের দেশে জনমজুরি খাটতে গিয়ে কিছু টাকা জমিয়েছিল জিয়ন। তখনই বর্ধমানে ঠিকাদারের এক সর্দারের কাছ থেকে ও পুরোনো সাইকেলটা কেনে। এখন খুব কাজে লাগছে। খেতের নজরদারির জন্য যখন-তখন ও চলে আসতে পারে। সাইকেল নিয়ে হুটহাট ঝালদা শহরে চলে যায়। চাষ দফতরের বাবুদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে। আজকাল সরকার থেকে বিনে পয়সায় বীজধান পাওয়া যায়। প্রয়োজনমতো রাসায়নিক সার ইউরিয়া আর কীটনাশকও। ঠিক সময়ে পাওয়ার জন্য পঞ্চায়েত আপিসে গিয়ে মুরুব্বিদের তোয়াজ করতে হয়। এ বারই যেমন, এখনও ইউরিয়া পাওয়া যায়নি। জিয়ন ভেবে রেখেছিল, বাড়ি ফিরে কিছু মুখে দিয়ে একবার ঝালদা শহরে যাবে। কবে ইউরিয়া পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার জন্য। কিন্তু, বৃষ্টি নামলে যে বাড়ি থেকে ওর আর বেরোতেই ইচ্ছে করবে না।

সাইকেল নিয়ে পিচের রাস্তায় উঠে আসার সময়ই জিয়ন দেখতে পেল, উলটো দিক থেকে সুবোধ খুটদার মোটর বাইকে করে আসছেন। মাঝবয়সি, পঞ্চায়েতের মেম্বার। থাকেন ওদের খটঙ্গাতেই। বদমাশ টাইপের লোক। মানুষটাকে দেখেই ওর ভ্রু কুঁচকে গেল। উনি এদিকে কোত্থেকে আসছেন? নিশ্চয় আনন্দপুর আশ্রমে গিয়েছিলেন। আবার কোনও অশান্তি ঘটাতে না কি? আশ্রমের সন্ন্যাসীদের সঙ্গে পঞ্চায়েতের সম্পর্ক খুব খারাপ। দোষটা খুটদার খুড়াদের মতো লোকেদেরই। সন্ন্যাসীরা গেরামের উন্নতির জন্য অনেক কিছু করতে চান। রাস্তা-ঘাট, স্কুল, টিউবওয়েল বসানো। কিন্তু খুটদার খুড়ারা ওঁদের কিছুতেই করতে দেবেন না। আশ্রমের জিপগাড়ি নাকি অনেকদিন আগে একবার চাপা দিয়েছিল একটা বাচ্চাকে। তারপর থেকে মুরুব্বিরা আশ্রমের উপর খাপ্পা।

খুড়াকে আসতে দেখে জিয়নের মনে হল, যাক, ঝালদায় যাওয়ার ঝামেলা তা হলে আর পোয়াতে হবে না। উনি নিশ্চয়ই খবর দিতে পারবেন ইউরিয়া সম্পর্কে। জিয়ন দ্রুত রাস্তায় উঠে এল যাতে খুটদার খুড়া ওকে দেখতে পান। বাইক কাছে এসে দাঁড়াতেই খুড়ার গলায় মোটা সোনার চেনটা ওর চোখে পড়ল। এই বছর তিনেক আগেও বাজারে খুড়ার টেলরিং শপ ছিল। পঞ্চায়েতে ঢোকার পর উনি অবস্থা ফিরিয়ে ফেলেছেন। ও কিছু বলার আগেই বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ করে খুটদার খুড়া বললেন, ‘তু কুত্থায় থাকিস রে জিয়ন? পরশু মিছিলে এলি না ক্যানে? মুর্মুদা তুর নামে কাইল যা তা কইছিলঅ পঞ্চায়েত আপিসে।’

মিছিলের কথা মনেই ছিল না জিয়নের। পার্টির লোকজন বাড়ি বয়ে এসে বলে গিয়েছিল বটে। দিল্লির সরকার টাকা পাঠাচ্ছে না। একশো দিনের কাজের প্রোগ্রাম আটকে গিয়েছে। গাঁয়ের লোকেদের কাজ দেওয়া যাচ্ছে না। তাই প্রতিবাদ মিছিল খটঙ্গা, মারামু, বেরাদি… আশপাশের গ্রাম থেকে বেরিয়ে ঝালদার দিকে যাবে। ওই মিছিলে যাওয়াটা কত জরুরি, অনেকক্ষণ ধরে তা বুঝিয়েছিলেন স্কুলের মাস্টার দশরথ মুর্মু। বলেছিলেন, বেলা দশটার সময় স্কুলের মাঠে হাজির হতে। কিন্তু আগের রাতে বুধিরামের বাড়িতে পরব ছিল। একটু বেশি হাঁড়িয়া খাওয়া হয়ে গিয়েছিল জিয়নের। ঘুম থেকে উঠতেই সেদিন বেলা এগারোটা। সত্যি কথা বলতে কী, মিছিলের কথা মনে থাকলেও ও যেত কি না সন্দেহ। পঞ্চায়েতের সব শালা হারামখোর।

কথাটা বললে সুবোধ খুটদার চটে উঠতে পারেন। তাই ও বলল, ‘শরীলটা জুত ছিল না খুড়া।’

‘ই কথা কইলে চইলবে?’ খুটদার খুড়া বললেন, ‘মিটিন ত তুদের জন্যেই। তুরা যাতে কাজকম্ম পাস, তার জন্যঅ। তুদের মতো জুয়ান মরদরা যদি লা আসিস, মোদের খেইটে লাভ কী?’

খুড়ার গলায় বিরক্তির ঝাঁঝ। শুনে মুখ নীচু করে রইল জিয়ন। মুর্মু খুড়া ওর নামে কী বলেছেন, সেটা শোনার খুব কৌতূহল হল ওর। কিন্তু সে কথা সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায় না। মুর্মু খুড়া ইদানীং স্কুলে পড়ানোর থেকে অনেক বেশি সময় দেন পার্টির কাজে। আর সুযোগ পেলেই ওকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করেন। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে খুটদার খুড়া জিজ্ঞেস করলেন, ‘তু লা কি আইজগাল রুজ সন্তোষ হাঁসদার ঘরকে যাচ্ছিস? মুর্মুদা কইছেল। ই তো ভালো কতা লয় বাপ।’

প্রশ্নটা করেই খর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন সুবোধ খুটদার। যেন জরিপ করে নিচ্ছেন। কথাটা অবশ্য মিথ্যে নয়। ইদানীং মাঝে মাঝেই ওকে সন্তোষ খুড়ার বাড়িতে যেতে হচ্ছে। খুড়া এখন ঘরছাড়া। পার্টিগত বিবাদ। উনি আশ্রয় নিয়েছেন বলরামপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সন্তোষ খুড়ার মেয়ে রাইমণি বাড়িতে এখন একা। মিত্তিরবাবুদের বাড়িতে কাজ করে। সেইসঙ্গে শুয়ারের খোঁয়াড় করেছে। সেই কাজে সাহায্য করার জন্যই কখনও সখনও রাইমণি ওকে ডেকে নিয়ে যায়। এই লোকগুলো কি তাহলে রাইমণির পিছনেও লেগেছে! গেরাম থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করছে না কি? যদি তা করে, তা হলে কিন্তু ও ছেড়ে দেবে না। রাইমণিকে ও প্রথম দেখে চাকলাদাঁড়ি পরবের সময়। অন্য মেয়াদের সঙ্গে ঝিকা নাচছিল। সেদিনই জিয়ন ঠিক করে ফেলেছিল, বিহা যদি করে, তো এই মেয়াকেই করবে। খুড়ার প্রশ্ন করার ধরনটা জিয়নের ভালো লাগল না। ও কার বাড়িতে যাবে, সেটা পঞ্চায়েতের লোকেরা ঠিক করে দেবে না কি?

কৈফিয়ত চাওয়ার ভঙ্গিতে খুটদার খুড়া ফের জিজ্ঞেস করলেন, ‘বইল না ক্যানে?’

আকাশে মেঘ গুড়গুর করে উঠল। জিয়নের বুকের ভিতরে রাগটাও। মুখ কঠিন করে ও তাকাল। ওর মুখ দেখে খুটদার খুড়া কী বুঝলেন, কে জানে? আকাশের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে, বাইকের ইঞ্জিন চালু করে, খানিকটা বোঝানোর ভঙ্গিতেই খুড়া বললেন, ‘সন্তোষের মেয়াছেনাটা ভালো লয় রে বাপ। রাইত-বিরেতে ল্যাংটা হইয়ে ঘুইরে বেরায়। জানগুরু বলছে, উ মেয়া ডাইন। উয়ার সঙ্গে তু পীড়িত কইরিস না।’

শুনে চমকে উঠল জিয়ন। সাঁওতাল সমাজে যে মেয়ার নামে ডাইন অপবাদ জোটে, তার কপালে অশেষ দুর্ভোগ অনিবার্য। ও জানে, রাইমণি কত দুঃখী মেয়া। কী দুর্দশার মধ্যে ও জীবন কাটাচ্ছে। একটার বেশি দুটো কাপড় ওর নেই। রাতে সেই কাপড় শুকোতে দিলে ওকে ল্যাংটা হয়েই থাকতে হয়। খুড়া শুধুশুধু বদনাম দিচ্ছেন। জিয়ন তা মানবে কেন? পালটা কিছু বলতে না চাইলেও ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘ই তু কী কইছিস খুড়া? রাইমণি সে র’ম মেয়া লয়। তুর কথা মাইনতে পারলাম লাই।’

‘অ… না মাইনতে চাস, মানিস লাই।’ ভ্রু কুঁচকে খুড়া বললেন, ‘তুরে কিন্তুক সাবধান কইরে দিলাম। পরে মোকে দুষ দিবি নাই।’

হিমশীতল গলায় কথাটা বলেই খুটদার খুড়া আর অপেক্ষা করলেন না। ধুলো উড়িয়ে বাইক ছুটিয়ে দিলেন গেরামের দিকে। খুড়াকে আসল কথাটাই জিজ্ঞেস করা হল না। ইউরিয়া কবে পাওয়া যাবে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে জিয়ন সাইকেলে উঠে বসল। মনে মনে বলল, ‘রাইমণির কুনও ক্ষেতি হলে তুদের ছাইড়বক না খুড়া।’ কথাটা বলেই ও একবার আকাশের দিকে তাকাল। ঘরে পৌঁছোতে ওর মিনিট দশেক লেগে যাবে। এর মধ্যে জোরে বৃষ্টি নেমে গেলে কোথাও গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই। কাঁচা রাস্তায় এত পাঁক হবে, নিশ্চিন্তে সাইকেল চালানো যাবে না। গেরামের ভিতর রাস্তা মেরামতির দিকে খুড়াদের কারও নজর নেই।

কাঁচা রাস্তার একপাশে জঙ্গল। ছোটোবেলায় মায়ের সঙ্গে জিয়ন এই জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে আসত। তখন আশেপাশে প্রচুর শাল, সেগুন, মহুয়া, পিয়াল, কুসুম, কেঁদ, আমলকী গাছ ছিল। মহুয়া ফুলের গন্ধে ম ম করত পুরো অঞ্চল। কিন্তু ঝাড়খণ্ডের কাঠ মাফিয়ারা রাতের অন্ধকারে এসে শাল, সেগুন গাছ কেটে নিয়ে গেছে। সবাই জানে, কারা তাদের মদত দিয়েছিল। রাস্তার এইদিকটা এখন আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস আর রাধাচূড়া গাছে ভর্তি। বাপের কাছে জিয়ন শুনেছে, রাস্তায় কোনও গাছই হয়তো আর অবশিষ্ট থাকত না, আনন্দপুর আশ্রমের সন্ন্যাসীরা যদি না এসে এইসব গাছ তখন লাগিয়ে দিতেন। বাপ প্রায়ই ওই আশ্রমে গিয়ে পড়ে থাকত। ফাইফরমাশ খেটে রোজ দশ-বিশ টাকা রোজগার করে আনত। বাপের সুবাদে সন্ন্যাসীদের অনেকেই জিয়নকে চেনেন। রাস্তা-ঘাটে কোথাও দেখা হলে তাঁরা দু’দণ্ড কথা বলেন।

সাইকেল চালানোর ফাঁকেই জিয়ন পিছন থেকে গাড়ি আসার শব্দ শুনল। পিছন দিকে তাকিয়ে ও দেখল, আনন্দপুর আশ্রমের দিক থেকে একটা জিপগাড়ি আসছে। গাড়িটাকে জায়গা দেওয়ার জন্য ও দাঁড়িয়ে পড়ল। ওকে দেখে জিপগাড়িটাও দাঁড়িয়ে গেল। গেরুয়া রঙের পোশাক পরা দু’জন সন্ন্যাসী জিপে বসে আছেন। তাঁদের একজনকে জিয়ন চিনতে পারল। দয়ানন্দ মহারাজ। সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত জোড় করে ও প্রণাম জানাল। আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে মহারাজ ওকে বললেন, ‘তুমি ঠাকুরদাস টুডুর ছেলে… জিয়ন না?’

শুনে ঘাড় নাড়ল জিয়ন। দয়ানন্দ মহারাজ বললেন, ‘একটা খারাপ খবর আছে জিয়ন। রাঁচির জঙ্গল থেকে একটা হাতির দল এসে বেলামু পাহাড়ের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করছে। দু’একদিনের মধ্যেই দলটা গাঁয়ের মধ্যে ঢুকে পড়বে। সব্বাইকে সাবধান করে দিও।’

শুনে উত্তেজনায় সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াল জিয়ন। এ বারও গণেশ ঠাকুরের দল খেতের ফসল নষ্ট করে দেবে? গত বছর গেরামের কয়েকটা বাড়ি ভেঙে দিয়েছিল। ওদের আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে মারা গিয়েছিল দুর্যোধন হাঁসদা বলে ওরই বয়সি একজন। সেই গণেশ ঠাকুর শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে তুলে দুর্যোধনকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। তাতেও সন্তুষ্ট হয়নি। পরে পায়ে পিষে ওকে মেরে ফেলে। রাতের অন্ধকারে এমন সময় হাত্থির দল এসে হাজির হয়, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকজনকে পর্যন্ত খবর দেওয়া যায় না। আশ্রমের সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে এবার অন্তত একটা আগাম খবর পাওয়া গেল। দয়ানন্দ মহারাজ সাবধান করে দেওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু গেরামের মানুষের করার কী আছে? গণেশ ঠাকুরের প্রতি লোকের এত ভক্তি, ওদের পালটা আঘাত করার কথা কেউ ভাবতেও পারে না।

ও জিজ্ঞেস করল, ‘গণেশ ঠাকুরদেরকে বেলামুতেই আটকে দ্যান না ক্যানে মহারাজ?’

‘মনে হয়, সম্ভব না। আশ্রমের পাঁচিল ভেঙে ওরা ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি। আমরা শূন্যে ফায়ার করে ওদের ভয় দেখিয়েছি বলে। দলটা বেশ বড়ো। দশ-বারোজনের মতো। আমরা এও খবর পেয়েছি, ওদের মধ্যে একটা খুনিয়া হাতি আছে। দাঁতাল, সে-ই লিডার।’

খুনিয়া হাত্থি মানে যে হাত্থি ইতিমধ্যেই মানুষ খুন করেছে। গত বছরও এই রকম একটা হাত্থি এসেছিল দলের সঙ্গে। এবার কার কপালে মৃত্যু লেখা আছে, কে জানে? জিয়ন শূন্যচোখে তাকিয়ে রইল। হাত্থির দল এত ক্ষতি করে যাচ্ছে, তবুও ওদের শিক্ষা দেওয়ার কথা কেউ ভাবে না! গেরামের দু’চারজনের সঙ্গে জিয়ন কথা বলেছিল। ‘পাগলা হইয়েনছিস তু’ বলে তারা সরে গিয়েছিল। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে দয়ানন্দ মহারাজ বললেন, ‘তোমাদের সুবোধ খুটদার একটু আগে আশ্রমে এসেছিলেন। তাঁকে সব জানিয়েছি। আমরা এখন ঝালদার দিকে যাচ্ছি। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের আপিসে খবর দিতে। তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো, গাঁয়ের লোকদের জানাও।’

দয়ানন্দ মহারাজ চলে যাওয়ার পর জিয়ন নিজেকেই প্রশ্ন করল, ‘কী করা যায়, বল ক্যানে?’

গণেশ ঠাকুরদের অত্যাচার কী করে বন্ধ করা যায়, সে কথা গত তিন বছর ধরে জিয়ন ভাবছে। এই একটি ভাবনাই ওকে এখন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কীভাবে ওদের শায়েস্তা করা যায়? পরপর তিন বছর ওরা খেতের ফসল নষ্ট করে দিয়েছে। ওর জীবনের চূড়ান্ত সর্বনাশ করে দিয়েছে, এই হাত্থির একটা দল। সেই কথা যখনই জিয়ন ভাবে, অসহ্য রাগে ওর পেশিগুলো ফুলে ওঠে। বদলা নেওয়ার ইচ্ছেয় হাত নিসপিস করে। কিন্তু ঠাকুর-দ্যাবতার বিরুদ্ধে ও লড়বে কী করে? ওদের সাঁওতাল সমাজে হাত্থি যে ঠাকুর। গেরামের সবাই তাদের পুজো করে। অক্ষমতা ওর ক্রোধ আরও বাড়িয়ে দেয়। তখন কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। মারাত্মক এক বিষণ্ণতা ওকে গ্রাস করে। তখনই বাড়ির উঠোনে ও ধামসা মাদল বাজাতে শুরু করে। যতক্ষণ না ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ে, ততক্ষণ মাদল বাজিয়েই যায়।

গেরামে ঢোকার মুখে বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটা পড়তে শুরু করল। পরনের টি শার্ট আর পাজামা যাতে ভিজে না যায়, সেজন্য নকুল মণ্ডলের দোকানে চালার নীচে এসে দাঁড়াল জিয়ন। বাড়িতে ফিরে পোশাক বদলে ও লুঙ্গি পরে নেবে। খটঙ্গার স্কুলে ও আর নকুল একসঙ্গে আট ক্লাস অবধি পড়েছিল। ছোটোবেলার বন্ধু। স্কুল ছেড়ে দেওয়ার পর বাপের মুদিখানা দোকানে বসে যায় নকুল। আর জিয়ন চাষের কাজে হাত লাগিয়েছিল বাপের সঙ্গে। নকুলের দোকানটা বাজারের ঠিক পাশে। বুদ্ধি করে ও একটা চায়ের ঠেক বানিয়েছে। পুরুলিয়া শহর থেকে একটা সাদা-কালো টিভি সেট কিনে এনে লাগিয়েছে লাগোয়া দোকানে। চা খাওয়ার ফাঁকে অনেকেই বসে খবর শোনে। এই মুহূর্তে অবশ্য দোকানে কোনও খদ্দের নেই। অন্য সময় নকুল কথা বলার সময় পায় না। আজ জিয়নকে দেখে একটা টুল এগিয়ে দিয়ে ও বলল, ‘বোস না ক্যানে।’

গেরামে এই একটি লোকের সঙ্গেই জিয়ন মন খুলে কথা বলে। মাঝেমধ্যে এলে নকুলের কাছে গেরামের অনেক খবর পায়। রাইমণিকে ডাইন অপবাদ কারা দিল, কেন দিল, কথায় কথায় ও জিজ্ঞেস করবে, ভেবে নিয়ে টুলে বসে পড়ল জিয়ন। বেশ জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। স্কুলের মাঠটা ঝাপসা দেখাচ্ছে। লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছগুলো মাথা নাড়াচ্ছে বাতাসের দমকে। দৃষ্টি সরিয়ে এনে জিয়ন দেখল, দ্রুত হাতে চা বানাচ্ছে নকুল। দোকানে এলে এইটুকু আতিথ্য ও পায়। একটু পরেই চা ঢেলে মাটির ভাঁড় ওর দিকে এগিয়ে দিল নকুল। কাচের বয়াম খুলে বেকারির বিস্কুট বাড়িয়ে দিল। গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে দু’জনে কথা বলতে লাগল। চা খাওয়ার অভ্যাস আগে জিয়নের ছিল না। ভিন দেশে জনমজুরির কাজ করতে গিয়ে অভ্যাসটা করে ফেলেছে। কানালি জমিতে একবারের বেশি চাষ করা যায় না। খেতির কাজকর্ম যখন থাকে না, তখনই ও বেরিয়ে পড়ে। বছরে পাঁচ-ছ’মাস গেরামেই থাকে না।

বাজারের হালচাল, পঞ্চায়েতের পক্ষপাতিত্ব, গেরামের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে লাগল নকুল। একটা সময় সন্তোষ খুড়া হয়ে ওদের আলোচনা চলে এল রাইমণিতে। খুটদার খুড়া হুমকি দিয়েছেন শুনে নকুল বলল, ‘উকে লষ্ট কইরে দিবেক শালা হড়ডপটরা। তুকে এগটা কথা কইব ভাবছিলাম জিয়ন। তু ত উকে ভালোবাসিস। রাইমণিকে তু বিহা কইরে ফ্যাল না ক্যানে?’

রাইমণিকে ঘরে আনার ইচ্ছেটা জিয়নের মাঝেমধ্যেই জাগে, যখন ও ভিন দেশে কাম করতে যায়। সেখানে মরদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জনমজুর খাটে মেয়ারা। প্রবাসে তাদের সুখী দাম্পত্য জীবন দেখে, প্রতিবারই জিয়ন ভাবে, গেরামে ফিরে রাইমণির সঙ্গে বিহাটা সেরে ফেলবে। দু’জনে মিলে পাকাপাকিভাবে রাঁচি অথবা হাজারিবাগ চলে যাবে। খটঙ্গার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্কই রাখবে না। কিন্তু গেরামে ফেরার পরই ওর আক্রোশ ফের চাগাড় দিয়ে ওঠে। বদলা নেওয়ার আগুন জ্বলতে থাকে ওর বুকে। প্রতি রাতেই নির্জন ঘরে শুয়ে থাকার সময় সেই দুঃস্বপ্নের দৃশ্যগুলো ওর চোখের সামনে ভাসে। সেকথা মনে করে জিয়ন বলল, ‘তু কইলি, আর আমি ঝপ কইরে বিহা কইরে লুব! অ্যাখুন আমি বিহা কইরতে পারবক লাই ভাই। মোর এগটা কাম বাকি আছে। তু ত জানিস।’

‘হাত্থিদের ফাইন্দে ফ্যালার কাম বুঝি?’ নকুল বলল, ‘পাগলার মতন কথা বলিস না ভাই। গেরামের মানুষ তুর নামে কী কয়, তু জানিস? তুর মাতথায় ব্যামো হইনছে।’

‘বলুক গা। তাতে কিছু আইসে যায় না।’

‘শুন ভাই, অতীতে কী হইনছে, মুনের মধ্যে চেইপে রাখিস না। ভুইলে যা। হাত্থি ঠাকুরের সঙ্গে তুই লড়বি কী কইরে? উয়াদের সঙ্গে লড়া অততো সহজ কথা লয়। উয়াদের কাছে মানুষ ত লিইলিপুট। তু একা কী কইরবি, বল? হাত্থি ঠাকুরকে মেইরে ফেলবি? উ চেষ্টা করিস লা ভাই। কইরলে ফরেস্টবাবুরা তুকে ধরে লিয়ে যাবেক।’

নকুল আরও কী বলতে যাচ্ছিল, দু’তিনজন খদ্দের এসে যাওয়ায় চুপ করে গেল। বৃষ্টির তোড় কমে এসেছে। আনন্দপুর আশ্রমের দিকটা এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। গেরাম আর আশ্রমের মাঝে প্রায় এক কিলোমিটার পাথুরে রুক্ষ জমি। অনেক ঘুরে ঘুরে, পায়ে হেঁটে আশ্রমে যেতে হয়। আশ্রমটা কীসের, সে সম্পর্কে জিয়নের কোনও ধারণা নেই। তবে ভিতরটা বিশাল, বলতে গেলে ছোটোখাটো একটা শহরের মতো। কী নেই তাতে? স্কুল, ব্যাংক, হাসপাতাল, পোস্ট অফিস, বাজার… সব আছে। বাপের মুখে জিয়ন শুনেছে, ওখানে যারা থাকে, তারা বেশিরভাগই বিদেশি। ওখানে যাকে তাকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। বিনা অনুমতিতে পুলিশও ওখানে ঢুকতে পারে না। বাপের সঙ্গে অবশ্য বেশ কয়েকবার জিয়ন আশ্রমের ভিতরে গিয়েছে। সে এক আশ্চর্য জগৎ।

‘শুইনেছিস, গণেশ ঠাকুরের দল লা কি আবার গেরামের দিকে আইসছে।’

নকুলের কথা শুনে জিয়ন এদিকে মুখ ফেরাল। খবরটা খদ্দেরদের মধ্যেই কেউ নিশ্চয় ওকে দিয়ে গেল।

জিয়ন ঘাড় নেড়ে বলল, ‘শুইনেছি। আজকাইলের মধ্যেই গেরামে ঢুইকবেক।’

‘গেরামের মানুষ রাইত জেইগে খেত সামাল দিবে বইলে তৈরি হইনছে। খুটদার খুড়া মিটিন ডেইকেছেন। তু একবার যা না ক্যানে পঞ্চায়েতে।’

কোনও উত্তর না দিয়ে জিয়ন মুখ গোঁজ করে বসে রইল। পঞ্চায়েতের অফিসে গিয়ে কী আর হবে? না, না, কিছুতেই ও খুটদার খুড়াদের কাছে যাবে না। বেলামু পাহাড়ের দিক থেকে হাত্থির দল যখন এ দিকে আসবে, তখন প্রথমেই পড়বে ওর খেত। হাত্থিদের দাপাদাপিতে ধানগাছের কী অবস্থা হবে, ভাবতেই রাগ হতে লাগল জিয়নের। গত দু’মাসের পরিশ্রম বৃথা যাবে। রাতে ক্যানেস্তারা পিটিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে, হই হট্টগোল করে হয়তো হাত্থি তাড়ানোর চেষ্টা করা হবে। পাহারাদারদের লক্ষ্য থাকবে, নিজের খেত বাঁচিয়ে অন্যের খেতের দিকে হাত্থির পালকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাতে কোনও লাভ হবে না।

গণেশ ঠাকুরের দল আগে দলমা থেকে বেরিয়ে অযোধ্যা পাহাড় হয়ে নেমে আসত। কিন্তু, তিন বছর আগে সেই প্রথম রাঁচির দিক থেকে আচমকাই একটা দল বেলামু পাহাড়ের পাশ দিয়ে ঢুকে পড়েছিল ওদের গেরামে। মানুষজন সচেতন হওয়ার আগেই গেরামে কান্নার রোল উঠেছিল। গভীর রাতে পোষা কুকুরের ডাকে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল জিয়নের। ভয়ার্ত সেই ডাক। বিছানা ছেড়ে দাওয়ায় এসে দাঁড়াতেই মূর্তিমান বিভীষিকা চোখে পড়েছিল ওর। একটা দাঁতাল হাত্থি উঠোনে দাঁড়িয়ে। প্রবল বেগে মাথা নাড়াচ্ছে। মুলো বাঁশের মতো তার দুটো দাঁত। বিরাট কান দুটো ফটরফটর করছে। কুকুরের ডাক শুনে বিরক্ত। প্রায় জমি ছোঁয়া ওর লম্বা শুঁড় থেকে ভোঁস ভোঁস শব্দ ভেসে আসছে। হাত্থিটা এক পা বাড়িয়ে লক্ষ্য স্থির করায় ব্যস্ত। শুঁড়ে পেঁচিয়ে কুকুরটাকে শূন্যে তুলে নেবে।

মাটির বাড়ির ভিতরের ঘরে বাপ-মা আর বোন শুয়ে আছে। তাদের ঘুম ভেঙে গিয়েছে কি না, জিয়ন বুঝতে পারেনি। ওর কাছে এমন সময়ও ছিল না, ভিতরে ঢুকে সবাইকে ডেকে তোলে। বাড়ির উঠোনে প্রকাণ্ড জীবটাকে আগে কখনও দেখেনি। কুকুরের আস্ফালন তাই আরও বেড়ে গিয়েছিল। কাছাকাছি কোথাও একটা গাছ ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পেয়েছিল জিয়ন। তার মানে আশেপাশে আরও সঙ্গী নিয়েই দাঁতালটা ঢুকেছে। শুক্লপক্ষের রাত। হালকা জ্যোৎস্নায় কী চোখে পড়েছিল কে জানে? কুকুরটা হঠাৎই রণে ভঙ্গ দিয়েছিল। ভয় পেয়ে পিছু হটে, ঘরের ভিতর ঢুকে আশ্রয় নিয়েছিল চৌকির নীচে। সেখান থেকেই কুঁইকুঁই আওয়াজ করছিল। ওকে তাড়া করে, এর পর ঘরে ঢোকার চেষ্টায় হাত্থিটা যখন মাটির দেয়ালে ঢুঁসো মারে, তখনই প্রাণভয়ে দাওয়া থেকে লাফিয়ে নেমে জিয়ন খিড়কির দিকে ছুটে গিয়েছিল। পরক্ষণেই ও টালির চাল হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে দেখে। খিড়কি থেকেই ও বাপ-মায়ের আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিল। সেইসঙ্গে উন্মত্ত হাত্থির হুঙ্কার।

শেষ রাতে গণেশ ঠাকুরের দলটাকে পিচের রাস্তা ধরে চলে যেতে দেখেও জিয়ন জঙ্গল থেকে বেরোনোর সাহস পায়নি। আতঙ্কে থরথর করে কেঁপেছিল পিয়াল গাছের আড়ালে। আলো ফোটার পর ফিরে এসে দেখে বাড়ির কোনও চিহ্নই নেই। কুকুরকে খুঁজে পাওয়ার তাগিদে ভগ্নস্তুপের উপর দাপাদাপি করে গিয়েছে হাত্থির দল। মাটির কলসিতে রাখা হাঁড়িয়াও খেয়ে গিয়েছে। গেরামের লোক চৌকির নীচ থেকে টেনে বের করেছিল থেঁতলে যাওয়া তিনটে দেহ। ওর বাপ, মা আর বোনকে। কুকুরটার কোনও হদিশই পাওয়া যায়নি। মনে আছে, জিয়নের সব মনে আছে। উঠোনে তিনটে মৃতদেহ পড়েছিল অনেক বেলা পর্যন্ত। পঞ্চায়েতের লোকজন বলেছিল, ফরেস্টবাবুরা না আসা পর্যন্ত সৎকার করা যাবে না। হাত্থির তাণ্ডবে কেউ মারা গেলে না কি ফরেস্টবাবুদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। সারাটা দুপুর জিয়ন শোকস্তব্ধ হয়ে বসে ছিল। এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলেনি। ওর বুকে তখন আগুন জ্বলছিল ধিকধিক করে। ফরেস্টবাবুরা বিকেলের দিকে এসে রিপোর্ট নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। না, পরে কোনও ক্ষতিপূরণ জিয়নের কপালে জোটেনি। বাবুরা বলেছিলেন, নিছক দুর্ঘটনা। টালির চালা ভেঙে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের।

নকুলের দোকানে চালার নীচে বসে অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে জিয়নের ফের একবার কৈলাস স্যারের কথা মনে পড়ল। স্কুলের বাংলা টিচার ছিলেন কৈলাস স্যার। ক্লাসে পড়ানোর সময় স্যার একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আচ্ছা বল তো, সবথেকে বুদ্ধিমান প্রাণী কে?’ ওরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছিল। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর স্যার নিজে থেকেই বলেন, ‘পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে, তার মধ্যে সব চাইতে বুদ্ধিমান হল মানুষ। বুদ্ধিতে মানুষের সঙ্গে অন্যরা পেরে উঠবে না।’ গত তিন বছরে জিয়ন অনেকবারই ভেবেছে, স্যারের কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে এই গুন্ডা হাত্থিগুলোকে শিক্ষা দেওয়ার মতো বুদ্ধি কেন মানুষ দেখাতে পারছে না? এমন উপায় কেন খুঁজে পাচ্ছে না, যাতে ওরা আর না আসে? তা হলে কি হাত্থিদের বুদ্ধি আরও বেশি? না হলে কয়েকশো মাইল দূর থেকে রাস্তা চিনে প্রতিবছর ফসলের সময়ই ওরা আসে কী করে।

‘জল থেইমে গেনছে। ঘরকে যাবিক নাই?’

নকুলের প্রশ্নে সম্বিত ফিরল জিয়নের। সামনের দিকে তাকিয়ে ও দেখতে পেল বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। টুল ছেড়ে উঠে ও সাইকেলের কাছে নেমে এল। মনের মধ্যে যে-প্রশ্নটা এতক্ষণ পাক খাচ্ছিল, হঠাৎ সেটাই ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘তু বুল ত ভাই নকুল। হাত্থিদের বুদ্ধি কি মানুষের থেইকে বেশি?’

প্রশ্নটা শুনে নকুল হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল।

চাদর মুড়ি দিয়ে দাওয়ায় শুয়ে ছিল জিয়ন। অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে। তবুও, শুয়ে নিজের দুর্দশার কথা ভাবছিল। হঠাৎ রাইমণির গলা শুনতে পেল, ‘শুইয়ে আনছিস ক্যানে? শরীলডা খারাপ?’

দাওয়ায় উঠে এসে মাথার কাছে বসল রাইমণি। কপালে হাত দিয়ে পরীক্ষা করল গা গরম কি না? চোখ মেলে ওর সোন্দর মুখটা দেখে জিয়নের মন ভালো হয়ে গেল। রাইমণির হাতটা ধরে ও নিজের গালে ছোঁয়াল। গত তিন-চারটে দিন ওর অসহ্য মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে কেটেছে। হাত্থি ঠাকুরের দল ফের লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গিয়েছে ওর খেত। বুধিরাম এসে যখন খবরটা দেয়, তখন খেতে দৌড়ে যাওয়ার ইচ্ছেটুকুও জিয়নের হয়নি। নিজেকে বাড়ির মধ্যেই ও আটকে রেখেছিল। পরে শুনেছে, ঝালদার দিকে যাওয়ার সময় হাত্থির দল গেরামের অনেক ক্ষতি করে দিয়েছে। গাছপালা উপড়েছে। শুধু মাটির বাড়িই নয়, বুধিরামদের পাকা গাঁথনির দেওয়ালও ওদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এই প্রথম বুধিরাম বলে গিয়েছে, এবার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। কদ্দিন আর সহ্য করা হবে হাত্থি ঠাকুরের অত্যাচার?

মাঝে রাইমণি একদিন এসেছিল। ওকে স্ত্বান্না দিয়ে গিয়েছে। জানতে চেয়েছিল, এ বার ও কী করবে? তখনও জিয়ন কিছু ঠিক করেনি। গেরামে পড়ে থাকার কোনও মানে নেই। কিন্তু, যাবেই বা কোথায়? বর্ষার সময় ইমারতির কাজ বন্ধ থাকে। বাইরে জনমজুরির কাজ পাওয়াও শক্ত। একমাত্র বর্ধমানের দিকে গেলে হয়তো কাজ পাওয়া যেতে পারে। ওখানে বড়ো বড়ো বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। জিয়ন মাঝেমধ্যেই ভাবছে, রাইমণিকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। ওখানে গিয়ে নতুন সংসার পাতবে। কথাটা ভাবা মাত্র, এই বিপর্যয়ের মধ্যেও, একটা সুখের কম্পন ও শরীরে অনুভব করছে। এই মুহূর্তে রাইমণির হাতের ছোঁয়া আরও নিবিড়ভাবে পাওয়ার জন্য জিয়ন ওর কোলে মাথা রাখল। এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল ওর কোমর।

চুলে হাত বোলাচ্ছে রাইমণি। খানিকক্ষণ পর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ও বলল, ‘উঠ না ক্যানে। দয়া মহারাজ তুকে ডেইকেনছেন।’

দয়া মহারাজ মানে, আনন্দপুর আশ্রমের দয়ানন্দ মহারাজ। এই তো ক’দিন আগে রাস্তায় ওর সঙ্গে দেখা হল। হঠাৎ ওকে ডেকেছেন কেন, জানার জন্য জিয়ন উঠে বসল। জিজ্ঞেস করল, ‘তুর সঙ্গে উয়ার দেখা হইয়েনছিল লা কি?’

‘হ। মো আইশ্রমে কাম কইরতে গেইনছিলাম কাইল।’

‘কী কইলেন তুকে?’

‘মুর্মু খুড়া জানগুরু লিয়ে এইসেছেন রাঁঞ্চি থেইকে। মোকে ডাইন অপবাদ দিবার লেগ্যে।’

খবরটা খুটদার খুড়ার কাছ থেকে আগেই শোনা জিয়নের। এইবার ও বুঝতে পারল, ষড়যন্ত্রের মূলে তা হলে মুর্মু খুড়া। নিশ্চয় কোনও বদ মতলব আছে। সন্তোষ খুড়ার ঘরটাও হাতিয়ে নিতে চান। রাঁচি থেকে জানগুরু নিয়ে আসা চাট্টিখানি কথা নয়। হাজার খানিক টাকা তো তাঁকে দিতেই হবে। সেইসঙ্গে শুঁয়ার আর পাঁঠা। এত খরচ মুর্মু খুড়া এমনি এমনি করবেন না। জিয়ন কিন্তু অবাক হল এই ভেবে, খবরটা এত তাড়াতাড়ি দয়ানন্দ মহারাজের কানে পেৌঁছোল কী করে? পরক্ষণেই ওর মনে হল, গেরামে আশ্রমের কৃপাপ্রার্থী অনেকেই আছে। গেরামের ভালো-মন্দ অনেক খবরই তাই সন্ন্যাসীরা আগাম পেয়ে যান।

ওদের সাঁওতাল সমাজে নানারকম কুসংস্কার আছে। দয়ানন্দ মহারাজরা সেইসব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। এর আগে একবার ডাইন অপবাদ থেকে ওঁরা বাঁচিয়েছিলেন বারুদি গেরামের একজনকে। সেই মেয়াকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়েছিল রাতের অন্ধকারে ঘরে আগুন লাগিয়ে। আগে খবর পেয়ে সন্ন্যাসীরা পুলিশ নিয়ে হাজির হন সেখানে। তা হলে কি রাইমণিকেও উয়ারা বাঁচাতে চান? সেই কারণেই ওকে ডেকে পাঠিয়েছেন? কথাটা মনে হওয়া মাত্র জিয়ন উঠে পড়ল। বলল, ‘তু ইগট্টু বোস ক্যানে। আমি চট কইরে রেডি হইয়ে লিই। মোর সঙ্গে তু আইশ্রমে যাবিক।’

… ঘণ্টাখানেক পর পাথুরে রুক্ষ জমির উপর দিয়ে দু’জনে যখন সাইকেলে আনন্দপুর আশ্রমে পৌঁছোল, তখন মাঝ দুপুর। প্রকাণ্ড গেটটার খানিক আগে কালভার্টের উপর এসে ওরা দাঁড়াল। বেলামু পাহাড় থেকে নেমে আসা ছোটো একটা নদী নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ছোটোবেলায় হেঁটেই জিয়নরা শুখা নদীটা পেরিয়ে যেত। কিন্তু, গত কয়েকদিনের বৃষ্টির কারণে নদীর জল এখন টইটুম্বর। সাইকেলটা কালভার্টের নীচের ঢালে দাঁড় করানোর ফাঁকে ওরা দেখতে পেল, কাঁধে রাইফেল নিয়ে দু’জন গেট পাহারা দিচ্ছে। প্রায় পাঁচ-ছ’বছর পর জিয়ন এই আশ্রমের দিকে এল। আগে কখনও আর্মড গার্ড ওর চোখে পড়েনি। দেখে, কেন জানে না, ওর মনে হল, পার্টির লোকেরা যাতে দলবল নিয়ে হঠাৎ চড়াও না হতে পারে, সেই কারণেই এত কড়াকড়ি।

অফিস ঘরে দয়ানন্দ মহারাজের সঙ্গে দেখা হতেই উনি হাসিমুখে বললেন, ‘এসো জিয়ন। একটু আগে তোমার কথাই ভাবছিলাম।’

হাতজোড় করে প্রণাম জানিয়ে জিয়ন বলল, ‘আপনি ডেইকেছিলেন মহারাজ?’

‘আগে বোসো। তোমার সঙ্গে কয়েকটা ব্যাপারে আলোচনা করার ছিল। হাতিরা কতটা ক্ষয়ক্ষতি করেছে, তা দেখার জন্য কাল আমি তোমাদের গ্রামে গেছিলাম। তোমার খেতে তো ধানগাছের চিহ্ন আর নেই বললেই চলে। এখন কী করবে বলে তুমি ভাবছ?

গত তিন বছর ধরে যে-ইচ্ছেটা ও লালনপালন করছে, রাগের মাথায় সেটাই জিয়ন বলে বসল, ‘মুনে লয়, হাত্থিগুলানকে গুলি কইরে মারি।’

শুনে হাসি মিলিয়ে গেল মহারাজের মুখ থেকে। ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে উনি বললেন, ‘হাতিদের উপর তোমার এত রাগ কেন জিয়ন? কখনও কি ভেবে দেখেছ, জঙ্গল ছেড়ে প্রতি বছর ওরা লোকালয়ে আসে কেন? এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী তো আমরা… মানুষরা। বসতি বাড়ানোর জন্য আমরা জঙ্গল কেটে নিয়েছি। জঙ্গলে ওদের খাবার ভাঁড়ারে টান পড়েছে। খাবারের খোঁজে তাই ওরা মানুষের ডেরায় ঢুকছে। হাতিদের কি দোষ দেওয়া যায়, বলো? ওদেরও কি বাঁচার অধিকার নেই? এই পৃথিবীর উপর ওদের দাবি তো অনেক বেশি। কেন-না, মানুষের অনেক আগে ওরা এই পৃথিবীতে এসেছে। যা বলছি, তুমি কি বুঝতে পারছ, জিয়ন?’

শুনে হাঁ করে তাকিয়ে রইল জিয়ন। এক ঝটকায় ওর চিন্তাভাবনা এলোমেলো হয়ে গেল। দয়ানন্দ মহারাজ যা বলছেন, তার পিছনে যুক্তি আছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, মানুষের মতো হাত্থিরাও প্রাণী। ওদেরও খিদে আছে। বেঁচে থাকার আকুতি আছে। নিজের প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছে আছে। তবুও, মনে মনে পালটা প্রশ্ন হাতড়াতে লাগল জিয়ন। জঙ্গল কেটে বাপ-ঠাকুর্দারা যদি ভুল করে গিয়ে থাকে, তা হলে তার খেসারত ওদের দিতে হবে কেন? ওদের মুখে অন্ন তা হলে কে জোটাবে?

দয়ানন্দ মহারাজ বোধহয় মনের কথা বুঝতে পারেন। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে ফের বললেন, ‘হাতিদের নিয়ে সমস্যাটা শুধু তোমাদের খটঙ্গা গ্রামেরই নয়… সারা দেশের। ওদের অন্নসংস্থানের কথা যে আমাদেরই ভাবতে হবে জিয়ন। এক জঙ্গলে যদি ওদের খাবার শেষ হয়ে যায়, তা হলে ওরা যাতে কাছাকাছি অন্য জঙ্গলে গিয়ে খাবার পায়, তার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সেইসঙ্গে দুটো জঙ্গলের মাঝে যাতায়াতের সময় ওদের জন্য নিরাপদ একটা করিডর। তাহলে গ্রামে ঢোকার কথা ওরা আর ভাববেই না।’

হাত্থি ঠাকুর সম্পর্কে আরও অনেক কথা বলতে লাগলেন দয়ানন্দ মহারাজ। লেখাপড়া জানা মানুষ… কত কী জানেন! ভিন্ রাজ্যে নাকি হাতি আটকানোর জন্য গেরামের চারপাশে ইলেকট্রিকের বেড়া লাগানো হয়। একবার শক্ খেলে হাতি আর গেরামে ঢোকার সাহস পায় না। পথ বদলে অন্যদিকে সরে যায়। হাত্থি ঠাকুরের না কি অসীম বুদ্ধি। ওরা ঠিক বুঝতে পারে, কে ওদের ক্ষতি করতে চায়, কে নয়? কয়েকটা উদাহরণও দিলেন দয়ানন্দ মহারাজ। কথাগুলো শুনতে শুনতে জিয়ন দ্বিধায়। ওর বাপ, মা, বোন তো হাত্থি ঠাকুরের কোনও ক্ষতি করেনি? তাহলে ওদের মরতে হল কেন? একটা সময় হাতি প্রসঙ্গ থেকে সরে এসে মহারাজ হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘চাষ করার ইচ্ছে কি আর তোমার আছে, জিয়ন?’

উত্তরটা ও ঠিক করে রেখেছে। জিয়ন বলল, ‘না।’

‘তোমার কাছে একটা প্রস্তাব আছে। খটঙ্গা থেকে আশ্রম পর্যন্ত একটা রাস্তা বানানোর কথা আমরা ভাবছি। তার জন্য মাটি দরকার। তোমার খেত থেকে যদি আমরা মাটি তুলে নিই, তাহলে কি তোমার আপত্তি আছে? মাটি কেনার টাকা তুমি পাবে। মাটি তোলা নিয়েও তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমরাই লোকজন দিয়ে মাটি কাটার ব্যবস্থা করে নেব। তুমি কি তাতে রাজি?’

প্রস্তাবটা শুনে জিয়নের মন্দ লাগল না। কানালি জমি এমনিতেই নীচু। বছরে একবারের বেশি চাষ করা যায় না। চাষ করেই বা আর লাভ কী? একে গেরাম থেকে ওর মন উঠে গিয়েছে। পঞ্চায়েতের লোকজনদের ওর সহ্য হচ্ছে না। খেতের ওই জমি আর রাইমণির টানেই ও অ্যাদ্দিন খটঙ্গায় পড়ে আছে। পাকাপাকিভাবে এবার সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলে ক্ষতি কী? রাইমণির দিকে তাকিয়ে জিয়ন বুঝতে পারল, ওর অসম্মতি নেই। তাই বলল, ‘মো রাজি।’

‘গুড। তা হলে টাকা পয়সার কথা তোমাকে পরে জানিয়ে দেব।’

একটু থেমে রাইমণির দিকে তাকিয়ে দয়ানন্দ মহারাজ মৃদু হেসে বললেন, ‘আর একটা কথা। রাইমণি সম্পর্কে কি তুমি কোনও সিদ্ধান্ত নিয়েছ? যদি না নিয়ে থাকো, তাহলে আমি বলি কি, ও এখন আমাদের আশ্রমেই থাক। ও যে কী বিপদের মধ্যে আছে, নিশ্চয়ই তুমি তা জানো। ঘরে একা থাকা ওর পক্ষে ঠিক হবে না। আশ্রমের হেঁসেলে নানা রকম কাজ থাকে, রাইমণি আপাতত সেই কাজ করুক।’

দয়ানন্দ মহারাজের সঙ্গে আরও কিছু কথা বলে জিয়ন যখন আনন্দপুর থেকে বেরিয়ে এল, তখন মন খুশিতে ভরপুর। রাইমণিকে নিয়ে আর কোনও আশঙ্কা ওর নেই। তার থেকেও বড়ো কথা, একটা দিশা পাওয়া গিয়েছে। বুদ্ধির খেলায় এইবার হাত্থি ঠাকুরদের ও হারিয়ে দিতে পারবে। আশ্রম থেকে বেরোনোর সময় জিয়ন লম্বা একটা শ্বাস নিল।

গেরামে ওকে একঘেরিয়া করে দেওয়া হবে, এমন একটা কথা খুব রটেছে। পরিস্থিতিটা এমন, পারলে খুটদার খুড়ারা জিয়নকে ছিঁড়ে খান। ওর খেতের জমির কাছে যেদিন মাটি কাটার যন্তর এসে দাঁড়ায়, সেদিনই সবাই বলাবলি করেছিল, ঠাকুরদাসের ব্যাটার মাথার ঠিক নেই। ব্যামোটা আবার বেড়েছে। না হলে চাষের জমিতে কেউ খাদান করে? কী শুনেছিল, কে জানে? সেদিনই দুপুরে নকুল ওর কাছে এসে বিরক্ত গলায় জিগ্যেস করেছিল, ‘তুর মতলবটা কী বুল ত? গেরামে থাকার ইচ্ছে তুর আছে?’

প্রশ্নটা কেন করছে জিয়ন তা জানে। তবুও বলেছিল, ‘ই কথা কইছিস ক্যানে?’

‘আইশ্রমের সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তুকে কে ইত ভাবভালোবাসা কইরতে বুলেছে? উয়াদের কানছে তু জমি বিককিরি কইরেছিস ক্যানে? তু জানিস না, পঞ্চায়েতের কেউ উয়াদের পছন্দ করে না?’

‘মুই ত জমি বিককিরি করি লাই। মোর জমি… মুই কী কইরব, পঞ্চায়েত বলার কে বটে?’

নকুলের সঙ্গে সেদিন অনেকক্ষণ কথাকাটাকাটি হয়েছিল জিয়নের। ও ভয় দেখিয়েছিল, খুটদার খুড়ারা ভয়ানক চটে রয়েছেন। মুখিয়া যে-কোনওদিন মিটিন ডেকে শাস্তি দিতে পারেন। সাঁওতাল সমাজে সেই বিধান গেরামের সবাই মানবে। পরবের সময় কেউ ওকে ডাকবে না। হাটে-বাজারে কেউ ওর সঙ্গে কথা বলবে না। ও একঘরে হয়ে যাবে। এসব শুনেও জিয়ন একটুও পিছিয়ে আসেনি। নকুলকে কিছু বলা মানে, সবার কানে তা পেৌঁছে দেওয়া। জোর গলায় ও বলে দিয়েছিল, মাটি কাটা হয়ে গেলে আপাতত ও তাতে জল ভরে রাখবে। তারপর কী করবে, পরে ঠিক করবে।

নকুল মোটামুটি একটা ধারণা নিয়ে গিয়েছিল, জমিতে ধরে রাখা জল জিয়ন সেচের জন্য দেবে। জেলার নানা জায়গায় এই রকম জলাধার তৈরি করার জন্য গেরামের লোকেদের আজকাল উৎসাহ দিচ্ছে সেচবাবুরা। মুখে নকুলকে যা-ই বলুক না কেন, জিয়ন ঠিক করেই ফেলেছে, ও কী করবে। মাটি খননের কাজ চলছে প্রায় তিন হপ্তা ধরে। খেতের এক দিকটায় প্রায় পাঁচ-ছ’ফুট মাটি তোলা হয়ে গিয়েছে এক্সক্যাভেটর দিয়ে। এই যন্তরটা জিয়ন চেনে। জনমজুরি খাটতে গিয়ে দেখেছিল। রাঁচি থেকে দুটো এক্সক্যাভেটর নিয়ে এসেছেন দয়ানন্দ মহারাজরা। সেইসঙ্গে চার-পাঁচটা ডাম্প ট্রাকও। মাটি তোলার সঙ্গে সঙ্গে ডাম্প ট্রাকে করে তা ওঁরা নিয়ে যাচ্ছেন আশ্রমের দিকে।

রাতে রোজই একবার করে টর্চ নিয়ে খেতের দিকে যায় জিয়ন। আজও বেরিয়েছে, কত মাটি কাটা হয়েছে, তা দেখার জন্য। বিকেলের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল। মেঘশূন্য আকাশে বাঁকা চাঁদ। পিছল আল ধরে এক চক্বর মারার সময় হঠাৎ ওর চোখে পড়ল, একটা এক্সক্যাভেটর গাছের উপর কাত হয়ে রয়েছে। এত বড়ো যন্তরটার ওই অবস্থা হল কী করে, তা নিয়ে খানিকক্ষণ ভাবতেই জিয়নের মনে হল, এ মানুষের কম্ম নয়। নিশ্চয়ই হাত্থি ঠাকুরদের কাজ। ঝালদা থেকে এই রাস্তা দিয়েই হয়তো ওরা আজই ফিরে গিয়েছে বেলামুর দিকে। ওদের আক্রোশ থেকে যন্তরও রেহাই পায়নি। আজব যন্তরটা কী, জানার জন্য নিশ্চয় ওরা ঢুঁসো মেরে গিয়েছে। জিয়ন ভেবে একটু অবাকই হল, হাত্থি ঠাকুরের দল খটঙ্গার পাশ দিয়ে চলে গেল, অথচ গেরামের লোক কেউ টের পেল না!

মেঠো রাস্তার দিকে এগোনোর সময  হঠাৎ ক্ষীণ স্বরে হাত্থির ডাক শুনতে পেল জিয়ন। ডাক না বলে, আর্তনাদ বলা ভালো। টর্চের আলো ফেলতেই ওর চোখে পড়ল, বাচ্চা একটা হাত্থি প্রাণপণ খাদ থেকে উঠে আসার চেষ্টা করছে। বোধহয় দলছুট হয়ে গিয়েছে। অন্ধকারে বুঝতে পারেনি, তাই গড়িয়ে পড়ে গিয়েছে খাদে। দলের বড়োদেরও সেটা চোখে পড়েনি। কয়েক মিনিট ধরে বাচ্চাটার ভয়ার্ত ডাক শুনে জিয়ন আর স্থির খাকতে পারল না। খাদে বৃষ্টির জল জমে রয়েছে। হাল ছেড়ে দিয়ে, বাচ্চাটা একটা সময় জলে ডুবেও মারা যেতে পারে। ওর খেতে যদি তা হয়, তা হলে কী হবে ভাবতেই শিউরে উঠল জিয়ন। গেরামের মানুষের ধারণা হবে, বদলা নিতে গিয়ে ও-ই মেরে ফেলেছে হাত্থি ঠাকুরকে। সবার রোষ এসে পড়বে ওর উপর। না, না, রাতের মধ্যে যে করেই হোক, বাচ্চাটাকে উদ্ধার করতে হবে। কথাটা ভাবতেই হাত্থি বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে ও দৌড়োতে শুরু করল বুধিরামের বাড়ির দিকে।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই গেরামের মানুষ এসে হাজির খেতের চারপাশে। জুয়ান মরদরা তো বটেই, এমনকী মেয়া-বউরাও। হাত্থি ঠাকুরকে বাঁচাতেই হবে। না হলে পুরো গেরাম মারাংবুরুর কোপে পড়বে। কারও হাতে রশি, বাঁশ। কারও হাতে মশাল, হ্যাজাক, টর্চ আর কাঠের পাটাতন। অতি উৎসাহে অনেকেই খাদে নেমে পড়ল। কিন্তু, এত মানুষজন আর আলো দেখে মারাত্মক ভয় পেয়ে গিয়েছে বাচ্চাটা। বারবার চেষ্টা করছে খাদের ঢাল দিয়ে উপরে ওঠার। কিন্তু নরম কাদায় পা পিছলে বারবারই নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। খানিকক্ষণ এদিক ওদিক দৌড়োদৌড়ি করে, শেষে লুকোনোর জন্যই জলে গা ডুবিয়ে দিল বাচ্চা হাত্থিটা। কিছুতেই তাকে আর ডাঙ্গায় তোলা যায় না। গেরামের মাতব্বররা একেকজন এক এক রকম পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু, ওই হই হট্টগোলে, কে শোনে কার কথা?

ঘণ্টা পাঁচেক যুদ্ধ করে মরদরা গলদঘর্ম। কে যেন বুদ্ধি করে কলাগাছ কেটে এনেছিল। সেটা মুখের কাছে ধরতেই জল থেকে বাচ্চা হাতিটা উঠে এল। বোধহয় খিদে পেয়েছিল। নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে সে কলাগাছ চিবোতে শুরু করল। দৃশ্যটা দেখে আলে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো উৎফুল্ল, ‘হাত্থি ঠাকুর সেবা লিয়েছে গ।’ সেই সুযোগে নকুল ফিসফিস করে জিয়নকে বলল, ‘চল ভাই, পেইটে রশির ফাঁস দেই বটে। পরে টেইনে উপরে তুইলে লিব।’ জিয়ন তখন পরম মমতায় বাচ্চাটার মাথায় হাত বোলাচ্ছে।

বাচ্চাটাকে আলের উপর তোলা হয়েছে। চারদিকে গোল হয়ে তাকে সবাই ঘিরে রয়েছে। ভোরের আলোয় একটা অদ্ভুত দৃশ্য জিয়নদের চোখে পড়ল। পূব দিক থেকে মত্ত হাত্থির দল এদিকে আসছে। মাঝ রাস্তায় হয়তো ওদের খেয়াল হয়েছে, বাচ্চাটা সঙ্গে নেই। তাকে উদ্ধার করার জন্য রণহুংকার দিয়ে ফের ওরা ফিরে আসছে। ভয়ে গেরামের মানুষ পালিয়ে গেলেও নকুলের সঙ্গে জিয়ন কিন্তু আলের উপর দাঁড়িয়ে রইল। হাত্থি ঠাকুরদের আর ও ভয় পাচ্ছে না। ওদের উপর ওর আর কোনও রাগও নেই। দয়ানন্দ মহারাজের কথাই ঠিক। এই পৃথিবীটা শুধু মানুষদেরই নয়, সব প্রাণীর। মানুষ যেহেতু সবথেকে বুদ্ধিমান, তাদেরই সবথেকে বেশি মানিয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে। আলের উপর দাঁড়িয়ে জিয়ন দেখতে পেল, বাচ্চাটাকে পেয়ে হাত্থি ঠাকুরের দল প্রচণ্ড খুশি। শুঁড় দিয়ে সবাই ওকে আদর করছে। শুঁড় উঁচিয়ে ওরা ডাকছে। দেখে জিয়নের মনে হল, গেরামের মানুষদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে। খানিক পরে থামের মতো পাগুলোর আড়াল দিয়ে ওরা বাচ্চাটাকে নিয়ে রওনা হল বেলামু পাহাড়ের দিকে।

জিয়নের সারা মন জুড়ে এখন আনন্দের অনুভূতি। মেঠো রাস্তা দিয়ে নকুলের সঙ্গে বাড়ির দিকে আসার সময় মনে মনে ও স্থির করে নিল, বেলায় ও একবার আনন্দপুর আশ্রমে যাবে। দয়ানন্দ মহারাজের আশীর্বাদ নিয়ে আসবে। মহারাজ ওকে একটা ভালো পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘মাটি কাটা হয়ে যাওয়ার পর বৃষ্টির জল ধরে রেখে তুমি মাছের চাষ শুরু করো জিয়ন। তোমার মাছ আমরাই কিনে নেব। এর পর থেকে হাতির দল গেরামে এলেও তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।’ কথাটা ওর মনে ধরেছিল। হাত্থি ঠাকুরদের জব্দ করার এই সুযোগটা ছাড়তে চায়নি জিয়ন। মাঝে দয়ানন্দ মহারাজ কিছু টাকা ওকে দিয়েছেন। একদিন তাই পুরুলিয়া শহরে গিয়ে ও কথাও বলে এসেছে মৎস্য দফতরের বাবুদের সঙ্গে। ওঁরা বলেছেন, সবরকম সাহায্য করবেন।

এই মুহূর্তে আরও একটা কাজ বাকি রয়েছে জিয়নের। তার জন্য ওকে বলরামপুর যেতে হবে। গিয়ে সন্তোষ খুড়াকে বলতে হবে, ‘রাইমণিকে বিহা কইরতে চাই। কত্তো টাকা গন্নকাউডি (পণ) দিইতে হবেক, দয়া কইরে বলেন।’

সংবর্ধনা

প্রফুল্লনগর উদ্বাস্তু কলোনির নাম পালটানোর প্রস্তাব হল মিটিং-এ। একটা কলোনি কমিটি আছে ঠিকই, কিন্তু আজকাল কাজকর্ম কিছু নেই। তবু ঘরটা আছে পুকুরের পাশে। ওখানে কয়েকজন বুড়ো মানুষ জড়ো হয়। পুকুরের পাশে সিমেন্টের চেয়ার আছে কয়েকটা, ওখানে সকালে প্রাতর্ভ্রমণকারীরা, দুপুরে কাক ও কুকুর, সন্ধের সময় চ্যাংড়াগুলো বসে। চ্যাংড়া ছেলেছোকরাদের সঙ্গে আজকাল দু’-একটা মেয়েও এসে আড্ডা মারে। একদিন একটি কিশোরীকে সিগারেট খেতে দেখলেন কালীপদবাবু। কিশোরীটি একটি ছেলের ঠোঁট থেকে সিগারেট ছিনিয়ে নিয়ে টানতে লাগল। কলোনির কমিটি রুম থেকে দেখলেন। কয়েকবছর আগে হলে সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে ঠাস করে চড় মারতেন। এখন চোখ সরিয়ে নিলেন। একটা দোকান হয়েছে কলোনিতে ঢুকতেই, নাম মোমো-চোমো। মোমো নাকি সিঙাড়া জাতীয় একটি খাবার, ওটা নাকি ভাপে সেদ্ধ হয়। কিন্তু চোমোটা কী? এইগুলি বদমায়েশি। অশ্লীল ইঙ্গিত যা নামের মধ্যেই প্রচ্ছন্ন। কালীপদ চক্রবর্তী ইস্কুলের মাস্টার ছিলেন। এখন বয়েস আশির কাছাকাছি। কলোনির জন্য লড়েছেন প্রচুর।

প্রাইমারি স্কুল, ব্যায়ামাগার, এইসব ছাড়াও লেখালিখির কাজটা কালীপদবাবুই করতেন। এই যে এখন কলোনিগুলোর হাল ফিরে গেছে, এটা তো পাট্টা পাওয়ার জন্যই হয়েছে। এই পাট্টা পাওয়ার জন্য কম লড়াই করতে হয়েছে নাকি! সেই নেহরু-লিয়াকত চুক্তি। নেহরু পঞ্জাবে জন-বিনিময়ে রাজি হলেন, কিন্তু বাংলার জন্য রাজি হলেন না। সে সময় হেমেন ঘোষ লিখেছিলেন, লিয়াকত-র সঙ্গে দিয়াকত-র চুক্তি হইল। নেহরু তো সবই মেনে নিলেন– দিয়ে দিলেন লিয়াকত যা চেয়েছিল। ওপার থেকে আসা লোকগুলি ভারত সরকারের কাছে অনভিপ্রেত হয়েই রইল। সম্পূর্ণ পুনর্বাসন হল না, ফলে জবরদখল। এটাই জবরদখল কলোনিই ছিল। সবাই ছিল বেআইনি দখলদার। সরকার বলেছিল ওদের দখলদার শব্দটা থেকে মুক্ত করবে। করেও ছিল। কিন্তু আইনের জট খোলা সহজ নাকি? শেষ পর্যন্ত হয়েছিল। এবং এরপরই পালটে গেল কলোনি।

বছর কুড়ি আগেও রাস্তার একপাশে ছিল মাছি ভনভন ড্রেন। টিন আর টালির ঘর। তেলেভাজার দোকান, রাস্তার ছাগলের ভ্যাঁ, কুকুরের ঝগড়া, আর কুকুরের গু। সারমেয় বিষ্ঠা এখনও থাকে, তবে ওসব বিলাতি কুকুরের। বাবুরা কুত্তা হাগাতে নিয়ে আসে সকালে। এখন কতরকমের বাবু। টালির ঘরের মালিকরা প্রোমোটারদের দিয়ে বড়ো বড়ো ফ্ল্যাট করিয়েছে। সব জবরদখলকারী উদ্বাস্তুরা এখন ফ্ল্যাটের মালিক। এমনকী কালীপদ চক্রবর্তী নিজেও। ভেবেছিল কখনও যে জবরদখল করা চার কাঠা জমির বিনিময়ে একটা ফ্ল্যাট-সহ কয়েক লক্ষ টাকা পাবে? এখন ওইসব ফ্ল্যাটে অনেক বাইরের লোকজন থাকে। পুরোনো লোকের তুলনায় নতুন আসা মানুষজনই বেশি। ঠেলায় করে সবজি বিক্রি হয়, সবজিওয়ালারা হাঁকে টমট্টর… লাউকি… পরবল…। বোঝাই যাচ্ছে প্রচুর অবাঙালির বাস। হনুমান মন্দির হয়েছে একটা। হরিপদ চক্রবর্তী আগে এদিকের পুজো-আচ্চা করতেন। ওঁর নাতি সংস্কৃতে অনার্স। সে নাকি হনুমান পুজো করতে পারে। ও কিন্তু কম্পিউটার জানে, বাইক চালায়। জিন্সের প্যান্ট পরে, আবার পুজো-আচ্চাও করে। পাড়ায় তিনটে ভ্রূ ওঠাবার দোকান– বিউটি পার্লার যারে কয়। তেলেভাজার দোকান আর নাই। চাট-রোল এইসব। পুকুরটা এখনও আছে, তবে বক-পানকৌড়ি এইসব আসে না। পুকুরঘাটে বাসন ধুতে আসে না ঘরের বউরা। দুপুরবেলায় পুঁটি মাছ ধরার জন্য ছিপ হাতেও বসে না কেউ। পুকুরপাড়ের এই কলোনি অফিসটুকু আছে, এই অঞ্চলে টিনের চালের ঘর এখন একটাই। সঙ্গে ছিল একটা কুস্তির আখড়া। ওইখানে এখন জঙ্গল। অফিস ঘরের পাশেই ছিল ব্যায়াম স্থান। পরে ওটা হল ক্যারাম স্থান, এখন ব্যারাম স্থান।

যেহেতু দরজা-টরজা চুরি হয়ে গেছে, ওখানে সামাজিক ব্যারাম সংগঠিত হয়। দ্বিপ্রহরে উঠতি যুবা-যত, কখনও সদ্য যুবতিও ওই আড়াল ব্যবহার করে। মোমো-চোমো দোকানে চোমোর মধ্যে যে গুপ্ত অর্থ নিহিত আছে, তার ভাব সম্প্রসারণ করে। আগে ওই একই স্থানে বারবেল, ডাম্বেল, মুগুর ইত্যাদি ছিল। স্বাস্থ্যই সম্পদ এই রচনা যেন কেবল রচনা বইয়ের বাইরে গিয়ে মাংসপেশি অভ্যাসের ভিতর চলে যায়– কালীপদবাবু সেই চেষ্টা করতেন। এই ব্যায়ামাগার তৈরি হয়েছিল সুখবিলাস বিশ্বাসের উদ্যোগে। কুস্তির আখড়াও। ‘বোম ফট্!’ উরু চাপড়ানোর শব্দটা মনে এল। কুস্তির মাস্টার ছিল একজন এলাহাবাদি। কৃষ্ণকুমার হিন্দু আকাদেমির দারোয়ান। বোম ফট্ জয় বজরংবলি কি… বলে উরু চাপড়াত। বাঙালগুলির মুখ দিয়ে কিন্তু কিছুতেই ‘জয় বজরংবলি’ বের হতো না। বাঙাল কখনও হনুমানের পূজা করে না। সেই প্রফুল্লনগর কলোনিতে এখন দুইটা হনুমান মন্দির। পাড়ায় প্রচুর হিন্দুস্থানি। হনুমানের নিত্যপুজো হয়। বাঙালি নব্য গৃহিণীদের অনেকেই টক করে হনুমান প্রণাম করে, ঢক করে চরণামৃত খেয়ে নেয়, ঠক করে প্রণামির বাক্সে একটা কয়েন ফেলে দেয়। নব্য বাঙালি যুবতিগণ আজকাল দেখা যায় হাতে মেহেন্দি ধারণ করে, শাঁখা-পলা ধারণ করে না যদিও, দুর্গাপুজোর দশমীতে মুখমণ্ডলে সিঁদুর লেপন করে। নব্য যুবকের বাম হস্তে রঙিন সুতো বাঁধা থাকে। ওইটা কি ফ্যাশন? কালীপদবাবু একটা নব্য যুবাকে প্রশ্ন করে উত্তর পেয়েছিলেন– সৌরভের হাতে থাকে। ওটা মঙ্গলচণ্ডীর ডোর। কালীপদ চক্রবর্তীর বয়েস হলেও এখনও ন্যুব্জ নয়। ওঁর ধারণা এটা যৌবনের ব্যায়ামের ফল। রোজই পাড়া পরিক্রমায় বের হন। আধুনিক ভাষায় ওটা মর্নিংওয়াক। একদিন তিনি দেখলেন এক নব্যমাতা তার সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দিচ্ছে। শিশু সন্তানের বয়েস চারের বেশি নয়। মায়ের হাতে শিশুর ব্যাগ। মায়ের হাতেই জলের বোতল। শিশু সন্তান মাকে বলল, মা– আতল-বাতলটা দাও।

মা জলের বোতলটা দিল। ওয়াটার বটল শব্দটা এখনও উচ্চারণ করতে পারে না ওই শিশু। ওদের পিছনে মর্নিংওয়াকে কালীপদবাবু। একটি গরু দেখে বাচ্চাটা বলেছিল ওটা হাম্বা। মা বলল– হাম্বা বলে না, কাউ। এরপর একটা কুকুর। বাচ্চাটা বলল ঘেউ ঘেউ। মা বলল, ডগ বলো সোনা। এরপরই হনুমান মন্দির। ছেলেটা বলে মাংকি। মা বলে মাংকি বলে না বাবা, এটা ঠাকুর, নমো করো। ওরা ‘জয় গার্ডেন’-এ যাচ্ছে। এটা একটা ইস্কুল। গার্ডেন মানে কয়েকটা প্লাস্টিকের গাছ আছে বারান্দায়, গ্রিলের লোহায় লাগানো বাঁদর ছানা। ভালুক ছানা। বিজয় সাহার পুত্রবধূ ওর বাসাটা ফ্ল্যাট বানিয়ে একতলার ফ্ল্যাটে গার্ডেন করেছে। ওখানে শ’খানেক শিশু গাদাগাদি করে কাউ-ডগ-আন্টি-আঙ্কেল শেখে।

এখন কলোনি কমিটির চেয়ে বড়ো হল কাউন্সিলারের অফিস। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলার এখন ঘেমো। ওর ছবি দেখা যায় এখানে-ওখানে। হাতজোড় করা। এলাকাবাসীদের নববর্ষের শুভেচ্ছা, বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা… এলাকাবাসীদের প্রতি আবেদন– সুস্থ সংস্কৃতি বজায় রাখুন, রবীন্দ্র-নজরুল জন্মদিন পালন করুন…। তলায় পৌরপিতা ঘেমোর ছবি। পৌরপিতা চাইছেন কলোনি শব্দটা উঠিয়ে দিতে।

কলোনি কমিটির মিটিংয়ে বিজয় সাহা বলল– অরা যা করে করুক গিয়া। আমাগোর কথার কিছু দাম আছে নাকি! বাচুম কয়দিন? কইলকাত্তা লন্ডন হইব, আর প্রফুল্লনগর কলোনি যদি প্রফুল্লকানন হয় হোক, আমাগর কী? কালীপদবাবু বলল– নাম পাল্টামু কইলেই হইল? একি কোর্টে গিয়া এফিডেভিট কইরা উলঙ্গিনী দাসীর নাম পালটাইয়া দিব্যাঙ্গনা দাসী হওয়ন নাকি? এটা হইল একটা জবরদখল কলোনি। সরকারি খাতায় তো কলোনি কথাটা আছেই। নারায়ণ দাস বলল– সরকারি খাতায় যা খুশি থাকুক গা। আমরা নিজেরাও আর কলোনি কমু না। আমরা প্রফুল্লকাননে বাস করলে ক্ষতিটা কী! প্রস্তাব আকারে ঘেমোরে কইয়া দিমু আমরাও একমত। কালীপদ বলে, এবার একখান কথা আছে। আমরা যে প্রস্তাব আকারে সম্মতি দিমু, আমাগোর প্যাডে লিখ্যাই তো? প্যাডে কী আছে? প্রফুল্লনগর কলোনি কমিটি নাই?

বিজয় সাহা বলে– কী দরকার প্রস্তাব আকারে দেওয়ার। চুপ কইরা থাকো। আমার কী বলি, না বলি, তার কিছু দাম আছে নাকি! কিচ্ছু ল্যাখালিখির দরকার নাই। এখানে আমরা বুড়ারা যেমন যাই আসি, তেমন যাব আসব। নারায়ণ দাস বলে– আমরা কি শ্যাষ নাকি? প্রস্তাব আকারেই দিব। আমরা জানাব যে আমরাও আছি। রাস্তার সামনে যদি গেট হয়, সেখানে প্রফুল্ল দাসের নামটা লেখা থাকবে। প্রফুল্ল দাসের কথা কেউ জানে না। একবার ক্লাবে গিয়া জিগাইলাম– এই যে প্রফুল্লনগর, এইটা কার নামে কও দেখি কে জানে? সবাই চুপ। একজন কয় শহিদ প্রফুল্ল চাকীর নামে। ক্লাবের চ্যাংড়াগুলির কথা বাদ দাও। অনেক বয়স্ক লোকও জানে না। কেউ ভাবে এইটা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের নামে, কেউ প্রফুল্ল সেনের নামেও ভাবতে পারে। আসলে প্রফুল্ল দাসের নামে। কালীপদবাবু এটা জানেন। জবরদখল পর্বে গুণ্ডাদের লাঠির আঘাতে মারা গিয়েছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র দাস। এই নারায়ণ দাসের কাকা। প্রফুল্ল দাসের বয়স তখন মাত্র বাইশ। নারায়ণ দাসের বয়স তখন নয়-দশ।

নারায়ণ দাস ছিলেন এই অঞ্চলের সবচেয়ে ধনী। এই অঞ্চলের প্রথম তিনতলা বাড়িটা ওরই। ওর বাবার শ্রাদ্ধে এক হাজার লোককে খাইয়ে ছিলেন। ছাদে হরিনাম বসিয়েছিলেন। ওর কথার একটা ওজন আছে। তিনি কিছু বললে সেটাকে অগ্রাহ্য করা যায় না। বহুদিন ধরে তিনিই এই প্রফুল্লনগর কলোনির কমিটির প্রেসিডেন্ট। একটা গামছার দোকান করেছিলেন নারায়ণবাবুর বাবা। নারায়ণবাবু সেই ব্যাবসাকে বড়ো করেন। বড়ো রাস্তার শাড়ি প্যালেস ছাড়াও তিনটে দোকান। ছেলেরা দেখাশোনা করে। ব্যাবসা ছাড়াও কলোনির জন্যও অনেক করেছেন নারায়ণ দাস। কলোনির দুর্গাপুজোয় অনেক চাঁদা দিতেন। এখন তো দুর্গাপুজোটা চলে গেছে জ্বলন্ত সংঘের কাছে। ওরাই সব করে।

প্রস্তাব চলে গেল ঘেমোর কাছে। ঘেমো মানে মলয় মল্লিক। ওকে দু’একটি আধুনিকা মম্দা বলে ডাকে। যদিও ঘেমোদা সম্ভাষণে ওর কোনও নীতিগত আপত্তি নেই। ছেলেটি উদার প্রকৃতির।

মলয় মল্লিক জ্বলন্ত সংঘের ছোঁড়াগুলিকে ডাকল। বলল– তোদের হেল্প ছাড়া তো এটা হবে না। আমরা কলোনিতে ঢুকবার মুখে তোরণ বানাব। তোরণে লেখা থাকবে প্রফুল্লকানন। তোরা আর কলোনিতে ঢুকবি না, কাননে ঢুকবি। মন্ত্রী-টন্ত্রী ডাকব। সেইসঙ্গে একটা গুণীজন সংবর্ধনা করে দেব। পাড়ার গুণীজনগুলোর একটা লিস্ট করে দিস তো আমাকে…।

জ্বলন্ত সংঘ প্রায় সবসময় নিভন্তই। জ্বলন্ত হয় দুর্গাপুজোর আগে। ক্লাবঘরে তাস-টাস চলে, টুকটাক জুয়াও। ক্লাবে যারা আসে তাদের মধ্যে দু’চারজন বেকার, দু’চারজন ইট-বালি সাপ্লায়ার, দু’একজন ছোটো চাকুরে…। আইটি পড়া ভাইটিরা আসে পরে, পুজো প্যান্ডেলে বসে থাকে। ক্লাবের সেক্রেটারি বিশু, মানে বিশ্বনাথ ঘোষ প্রস্তাব করল গেট উদ্বোধনের দিন একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও করা হোক।

সংস্কৃতির কথা শুনে সবাই বলল হোক-হোক। বিশু একজন তরুণ সাপ্লায়ার। প্রোমোটারদের লোহা-বালি-পাথর সাপ্লাই করে। সব খালাসির যেমন লক্ষ্য থাকে ড্রাইভার হওয়ার, ফেনা ভাত চায় বিরিয়ানি হতে, পাউরুটি চায় কেক, পেস্ট্রি হতে, সাপ্লায়ারও প্রোমোটার হতে চায়। প্রোমোটার হলেই সমাজসেবী হওয়া যায়। সমাজসেবী হলে কাউন্সিলার হওয়া যায়। বিশু জগদীশকে বলল, গুণীজনের সন্ধান করতে। জগদীশ যেহেতু ফ্ল্যাটের দালালি করে, পাড়ার সব খবরও রাখে। কোন্ ফ্ল্যাটে কে থাকে, কোন্ বাড়িতে ভাইয়ে-ভাইয়ে ঝগড়াটা বেশ পেকেছে, কোন্ ফ্ল্যাটে দুপুরবেলা বাইরের পুরুষমানুষ আসে, এসব তথ্য ওর মন-কম্পিউটারে মজুত।

মলয় মল্লিক, নারায়ণ দাসের কাছে তোরণের নকশা ফেলে দিল। বলল– দেখুন জ্যাঠাবাবু, পছন্দ হয় কিনা। দু’পাশে গোল মার্বেলের পিলার। উপরে গ্র্যানাইট। স্টিলের হরফে লেখা থাকবে প্রফুল্লকানন। তার তলায় লেখা থাকবে মান্যবর নারায়ণ দাসের অর্থানুকুল্যে প্রতিষ্ঠিত।

নারায়ণবাবু বললেন– তা কেন? তা কেন? আমার নাম কেন?

বিশু বলল– এটা কোনও দোষের নয় জ্যাঠামশাই, দেখেননি নতুন বাস স্টপেজের শেড? ভিতরে রবীন্দ্রনাথের একটা ছবি, তার উপর এক বিঘত বড়ো অক্ষরে কী লেখা– দেখেন নাই? কী লেখা?

আমাদের এমপি-র নাম। তা থাকুক গিয়া। আমার লিখার দরকার নাই। শাজাহান কি তাজমহলের গায়ে নিজের নাম লিখ্যা রাখছে? আমি চাই আমার কাকার নামটা থাউক। কলোনির শহিদ প্রফুল্ল দাসের নামটা থাউক।

মলয় মল্লিক বলল– আবার কলোনি কেন? কলোনি শব্দটা উঠিয়ে দেওয়ার জন্যই তো ‘কানন’।

নারায়ণবাবু বললেন– কিন্তু প্রফুল্ল দাসের নামটা রাখতে চাই।

মলয় মল্লিক বলল– তাহলে পুকুরপাড়ে নয় একটা বেদি বানিয়ে দেব অমর শহিদ প্রফুল্ল দাস, তোমায় আমরা ভুলছি না ভুলব না।

নারায়ণবাবু বললেন, তাই হোক তবে।

এবার চলল গুণীজন হান্টিং। একটা ফ্ল্যাটের সামনে প্রায়ই একটা প্রেসের গাড়ি আসে। জানা গেল, বিখ্যাত এক কাগজের কোনও সাংবাদিক ফ্ল্যাটটা কিনেছেন। একজোড়া সিরিয়াল অভিনেত্রীও এ পাড়ায় ফ্ল্যাট নিয়েছে। একজন জোজো-কণ্ঠীও আছে। এছাড়া পুরোনো বাসিন্দাদের মধ্যে একজন বুড়ো ম্যাজিশিয়ান আছেন, বহুদিন খেলা দেখাতে পারেন না। তিনি কি গুণীজন? তিন-চারজন ইস্কুল মাস্টার, আর একজন প্রফেসর আছেন। প্রফেসরটা গুণীজন হলেও হতে পারেন। এক পিস কবিও আছে। কবি নিশ্চই গুণীজন! এদের অনেক সময় বিদ্বজ্জনও বলা হয়। ছবি আঁকলে বিদ্বজ্জন হয়। এ পাড়ায় তেমন ছবি-আঁকিয়ের সন্ধান নেই। দুটো হোমিওপ্যাথ আছে, এখনও পুরিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। পঞ্চাশ টাকা করে নেয়। ওরা গুণীজনের মধ্যে পড়ে কিনা কে জানে? বিশুর ইচ্ছে ওদের গুণীজনের মধ্যে ফেলার। দেখা যাক শুডঢারা কি বলে। ও! হারুদার মেয়েটা তো গুণীজন। ওকে

সংবর্ধনা দিতেই হবে। নাচো পাগলি নাচো রিয়ালিটি শোয়ে ও অনেক রাউন্ড পর্যন্ত নেচেছিল। প্রচুর গিফ্ট হ্যাম্পার পেয়েছিল। একবার ছিটকে গিয়েও দর্শকের এসএমএস-এর জোরে ফিরে এসেছিল।

দেখা গেল গুণীজনের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অনেকেই নতুন নতুন গুণীজন সাজেস্ট করছে। গুণীজন সংবর্ধনায় রসগোল্লার হাঁড়ি স্পনসর করছে ‘আবার খাব সুইটস্’ এবং উত্তরীয় স্পনসর করছে ‘লজ্জা নিবারণ বস্ত্রালয়’। ওরাও একডজন করে গুণীজন পুশ করার চেষ্টা করছে। সাংস্কৃতিক উৎসবে বাংলা ব্যান্ড ‘ধুমধাড়াকা’-র পুরো টাকাটা স্পনসর করছে এ পাড়ার নতুন ফাস্ট ফুডের দোকান মোমো-চোমো।

কালীপদবাবু এখন কিছুটা গুটিয়ে নিয়েছেন। নারায়ণবাবু, বিজয়বাবুদের সঙ্গে বসল ওরা। মতভেদ হতে লাগল। নারায়ণবাবু বলছে ওইসব সিরিয়ালে নামা চ্যাংড়া-চেংড়িরা মোটেই গুণীজন নয়। গানবাজনার লাইনে যদি কাউকে সংবর্ধনা দিতেই হয় তবে অক্ষয় সরখেলকে দাও। এখনও বেঁচে আছে। কী অপূর্ব শ্যামাসংগীত গাইতেন এককালে। কতজন ওর কাছে গান শিখতে যেত। অক্ষয়বাবুর কল্যাণে কলোনির বহু মাইয়ার বিয়া হয়েছে। পাত্রপক্ষ কনে দেখতে এলে দুই-চাইর খান গান তো গাইতেই হতো। বিবাহযোগ্যা কন্যাদের মায়েরা অক্ষয়বাবুর কাছে নিয়ে যেত। দুই-একখান রবীন্দ্রসংগীত, একখান নজরুলের গান– ভরিয়া পরাণ শুনিতেছি গান আসিবে আজি বন্ধু মোর, একখান শ্যামাসংগীত… অক্ষয়দা সবরকম গান জানত। কি গলা। জিন্দাবাদের গানও কম গাইছে নাকি? তোমাদের জনম হয় নাই। মনোরঞ্জন গুহ একটা গানের দল করেছিল। হেই সামালো ধান, আলোর পথযাত্রী, মানব না বন্ধনে এইসব কমুনিস্টি গান গাইত। অক্ষয়দা ওই দলেও গাইত। সবরকম, সবরকম গানের ওস্তাদ…। মনোরঞ্জনদা তো নাই, অক্ষয়দা আছে।

সিপিএমের গান গাইত? আর ওকেই সংবর্ধনা দিতে বলছেন? বিশু কেমন রে রে করে উঠল।

নারায়ণবাবু বললেন– তখন সিপিএম আছিল নাকি! ওইসব গান তো তোরাও খামচাইয়া নিয়া নিছস। জগদীশ বলে ওইসব লোককে ঘেমোদা হয়তো অ্যাপ্রুভ করবে না। আমরা তো খালি গুণীজনের লিস্ট দেব, টিক মারবে তো ঘেমোদা… নারায়ণবাবুর দুঃখ হয়। উনি ছিলেন প্রেসিডেন্ট। কত কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আজ ওর প্রস্তাব অ্যাপ্রুভ করে সেদিনের ছোঁড়া ঘেমো। আগে কাউন্সিলার ছিল সুবীর। বললে কথা শুনত। এখন ওরা গর্তে। কোনও সাড়াশব্দ নাই। ছ্যামড়ারা অপরাধবোধে ভোগে আর কি! বিশু বলল– সাংবাদিকটাকে আমাদের হাতে রাখতেই হবে। ওকে সংবর্ধনাটা দিতেই হবে। সাংবাদিক হাতে থাকলে কত সুবিধে।

– থামো দেখি। সাংবাদিক চিনাও আমারে! রেগে গেলে বাঙাল কথাটাই বলেন নারায়ণবাবু। বিবেকানন্দ মুখার্জিরে দেখছি আমি। হেমেন ঘোষের নাম শুনছ! দেবজ্যোতি বর্মন? কাপড়ের ব্যাবসা করতে পারি, কিন্তু হেইসব খবর রাখতাম। হঃ, সাংবাদিক! খবর কাগজের বড়ো খবর হয় সিনেমার হিরোর বিয়ায় কি কি পদ খাওয়াইছে। সাংবাদিক দরকার নাই। আমার কথা না শুনলে তোরণের দরকার নাই, টাকাও দিমু না। তোমরা যা পারো করো।

– রাগ করছেন কেন জ্যাঠামশাই। বলুন, আপনি সাজেশান তো দিতেই পারেন। বয়োজ্যেষ্ঠ লোক।

নারায়ণ বলেন, সুখবিলাস বিশ্বাসরে ভুইল্যা গেলা? এই ব্যায়ামাগার কে করছিল? কে করছিল কুস্তির আখড়া? মনোহর আইচরে নিয়া আসছিল সে। লাঠিখেলা হইত। বারবেল-ডাম্বেল-মুগুর– সব কিছু আছিল। আমিও ছোটোবেলায় মুগুর ভাঁজতাম। এখন সুখবিলাস অথর্ব। এখন তো সব জিম হইছে, জিম। জিম না ঘোড়ার ডিম! উনি ছিলেন জিমের বাপ। আমার ইচ্ছা অক্ষয়দাদা আর সুখবিলাসদাদারে সংবর্ধনা দাও।

নামগুলো লিখল। বোধহয় ওদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। বোধহয় ওদের ঘেমোদার সঙ্গে পরামর্শ করবে।

ক’দিন পরে ওরা এল। সেদিন কালীপদবাবু, সাধনবাবু, বিজয় সাহা এরাও ছিল।

বিশু বলল– জ্যাঠামশাই, আপনার কথাই রইল, কিন্তু টফি আর কফি এই দুই বোনকে আমরা চাই। মৌবনের ভোমরা, সতীসাবিত্রী, তোমায় আমি ছাড়ব না– এইসব সিরিয়ালে ওরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। স্পনসররা ওদের চাইছে।

কালীপদ চক্রবর্তী বললেন, ওদের ছাড়ো তো, ওরা ক’দিনের? কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। পুরোনো লোকদের দিকে দেখো।

বিশু বলল– এভাবে আমরা-ওরা করবেন না জেঠু। ওরা নতুন এসেছে তো কী হয়েছে? সবাইকে নিয়েই তো এই পাড়া। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য।

জগদীশ বলল– নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান।

কালীপদবাবু বললেন– বাবা। তোমরাও দেখি কথায় কথায় কোটেশন ছাড়ো।

– শুনে শুনে হয়ে গেছে। সলাজ হাসি হাসে।

– পুরোনো লোকের কথা যদি বলেন– ভানু জ্যাঠা তো পুরোনো লোক। ভানু জ্যাঠার নাতনিই তো নাচো পাগলি নাচোতে মাতিয়ে দিয়েছে। মেয়েটাকে উৎসাহ দিতে হবে না। স্পনসরদের বুঝিয়ে পটিয়ে-পাটিয়ে ছ’জন করার চেষ্টা করব।

– ছ’জন কে!

– ওই তো, আপনার কোটার দু’জন, আর কফি-টফি, সাংবাদিক আর ভানুদার নাতনি বা হারুদার মেয়ে বুলবুলি।

নারায়ণবাবু বললেন– যা খুশি করগা।

মলয় মল্লিক একটু ভ্রূ কুঁচকে সুখবিলাস বিশ্বাস আর অক্ষয় সরখেলে টিক মারল। আর অন্যদেরও।

অক্ষয় সরখেল এখন চোখে দেখেন না একদম। গ্লুকোমা হয়েছিল। বয়েস আশি ছাড়িয়েছে। ওঁর স্ত্রীর বয়েসও সত্তরের বেশি। গানবাজনা ছেড়ে দিতে হয়েছে বহুদিন। একটাই গান এখনও আপন মনে করেন– গান কে নিল আমার কণ্ঠ হতে।

বিশু ওদের বাড়িতে গেল। দেখল একজন বুড়ো বিছানায় শুয়ে রেডিয়ো শুনছে। রেডিয়োয় ঘড়ঘড় শুনছে। গান-টান কিছু তো হচ্ছে না। ঘরের কোণায় ধূলিধূসরিত বাঁয়া-তবলা। তবলার আচ্ছাদন ফেটে গেছে। টেবিলের উপরে একটা হারমোনিয়াম। হারমোনিয়ামের উপরের কাঠের আচ্ছাদনের উপর কয়েকটা শিশি। একটা শিশির গায়ে লেখা জাদুমালিশ। ঘরে একটা বোঁটকা গন্ধ। তাঁর স্ত্রী বললেন, তোমার সঙ্গে দ্যাখা করতে আইছে।

অক্ষয় সরখেল বলল– ক্যাডা?

বিশু বলল– আমি বিশ্বনাথ।

– বাপের নাম?

– হারাধন রায়।

– তার বাপ?

– জনার্দন।

মাথা চুলকে বললেন, হ। বুজছি। তোমার বাপটা সেই কবে চইল্যা গেল গিয়া। হারু। হারু আমারে খুড়া ডাকত। কও। কিসের কারণে আইছ?

বিশু বলে– আমরা ঠিক করেছি আমাদের পাড়ায় ঢোকার মুখে একটা তোরণদ্বার তৈরি করব। উদ্বোধন করবেন গৌতম রায়।

– সে কেডা?

– মাননীয় সাংসদ।

– জোরে কও।

– সাংসদ। সাংসদ। মাননীয় এমপি।

– তাতে আমার কী।

– সেই সঙ্গে আপনাকে আমরা সংবর্ধনা দেব।

– কী দিবা?

– সংবর্ধনা। সন্মান, সন্মান।

– ক্যান?

– আপনি কতজনকে গান শিখিয়েছেন। কত বড়ো সংগীতশিল্পী আপনি।

– কে কইল?

– বলেছে অনেকে। নারায়ণ জেঠু, বিজয় জেঠু…

– নারায়ণ তো বিরাট ধনী। মনে রাখছে আমারে?

– ওঁরাই তো আপনার কথা বললেন।

– ভালো কথা শুনাইলা! এখন কণ্ঠে আর গান নাই। ওই দ্যাখো ম্যাডেল। ঝুলতাছে। যুব উৎসবে ফার্স্ট হইছিলাম।

উনি চোখে দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু আঙুলের নির্দেশ খাপে খাপ। মেডেলটা দেয়ালে টাঙানো চৈতন্যদেবের ক্যালেন্ডারের উপর ঝুলছে।

একখান রেডিও দিও, বুঝলা, চক্ষে তো দেখি না, রেডিও শুনি। এইটা বড়ো ঘড়ঘড় করে। সারানোর লোক নাই। যারা টিভি সারায়, তারা রেডিও পারে না। রেডিও তে বোঝলা, আগের মতো গান নাই। কি সব হইহল্লা হয়, বুঝি না। কইলকাতা ক কেন্দ্রে তবু কিছু পুরানো গান হয়। কিন্তু রেডিওটা বড়ো ঘড়ঘড়াইয়া কিচ্ছু শুনা যায় না।

বিশু বলে– ঠিক আছে। ও হিসেব করে নিয়েছে শালের চেয়ে রেডিওর দাম কমই পড়বে।

– আমারে কি বক্তৃতাও দিতে হইব?

– তা তো নিশ্চই।

– কিন্তু স্টেজে উঠুম কি কইরা! ভালো কইরা দেখতেও পাই না…। আহারে… কত স্টেজে উঠছি, স্টেজে উইঠ্যা…

– সে ভাবতে হবে না। আমরা উঠিয়ে দেব।

– আইচ্ছা। আইসো মাঝে-মইধ্যে। কেউ তো আসে না…।

সুখবিলাস বিশ্বাসের বাড়িটাও ছোটোই। তবে অক্ষয় সরখেলের মতো এতটা দীর্ণ নয়। ওঁর এক ছেলে মিলিটারিতে কাজ করত। চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে হয়তো বারবেল-ডাম্বেলের কিছুটা ভূমিকা থাকতে পারে। সেই ছেলেটা নাকি হায়দরাবাদ না সেকেন্দ্রাবাদ কোথায় থাকে। আর এক ছেলে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। এখানেও দু’জন। এদের ডিটেলস্ বিশুরা রাখে না। এরা এখন পুরোনো। ভালো মনে এল, ফাংশনে পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায় গানটা চালাতে হবে যখন ওদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে।

– আপনার ছেলে, কী করছে এখন!

– সিকিউরিটি অফিসার। গর্বের সঙ্গে বললেন সুখবিলাস।

এই ঘরেও বোঁটকা গন্ধ। বারান্দায় পাতা বেঞ্চি। বারান্দার গ্রিলে একটা লেটারবক্স দড়ি দিয়ে বাঁধা। বোঝাই যায় বহুদিন ওখানে কোনও চিঠিপত্র পড়ে না। লেটারবক্সের গায়ে লেখা সুখবিলাস বিশ্বাস, দেহশ্রী। দেহশ্রীর স্ত্রী কফ থুথু ফেলার কৌটোটা ঘর থেকে নিয়ে বারান্দায় রাখলেন। দেহশ্রী এখন হতশ্রী। বোঝাই যায় কাঁধটা খুব চওড়া ছিল। এখন হ্যাঙার থেকে জামা ঝোলার মতো ওর শরীরে চামড়া ঝুলছে।

বিছানায় বসে একটা স্টিলের থালায় কড়াইশুঁটি ছুলছিলেন দেহশ্রী।

– কড়াইশুঁটি ছুলছেন?

– হু। ডাইবিটিস ধরেছে। কড়াইশুঁটি খাইতে কইল ডাক্তার। ভাত ঠিক এই দুইটা। আঙুলে আয়তন দেখায় দেহশ্রী। কড়াইশুঁটির বড়ো দাম। তবুও কিনতে বাধ্য। নিজেই ছুলতাছি। আঙুলের এক্সারসাইজ হয়। তুমি কে? ট্যাক্স নিবা?

– না। পাড়ার ছেলে।

– চাঁদা-টাদা নিবা বুঝি কিছু।

– না, চাঁদা নয়। আপনাকে সংবর্ধনা দেব।

– ক্যান? কি দোষ করছি?

– ছিঃ, দোষ কেন করবেন। পাড়ায় এত সুন্দর একটা ব্যায়ামাগার তৈরি করেছিলেন… বিশু বিরক্ত হয়। জগদীশ, তারু, অনিল কেউ এল না। ওকেই সব সামলাতে হচ্ছে। লোকটার কথায় একটা ব্যাঁকা-ট্যারা স্পিন বল।

– হ। ব্যায়ামাগার তো করছিলাম। তোমরা যাও? ব্যায়াম-ট্যায়াম করো?

– না, সময় পাই না…।

– ব্যায়ামের সময় নাই, যত কুকর্মের সময় পাও।

দেহশ্রীর স্ত্রী বাধা দেয়। কি অকথা কুকথা কও। ওরা আইসে, বইতে কও…।

বিশু পিতৃপরিচয় দেয়। এরপর সংবর্ধনার কথাটা পাড়ে।

সুখবিলাস বলে– আমি সুখী হইতাম যদি তোমরা আবার ব্যায়ামাগারটা চালু করতে পারো। যদি আবার একটু কুস্তি-টুস্তি করো। মুগুর-টুগুর ভাঁজো।

– এখন আর কুস্তিতে কাউকে পটকানো যায় না। কুংফু-ক্যারাটে এসে গেছে। আর মুগুর দিয়ে আত্মরক্ষা করা যায় না। পিস্তল এসে গেছে।

সুখবিলাস বলে– বেকুবের মতো কথা কও ক্যান? মুগুর ঘুরাইলে মাএ মজবুত হয়। এই হাত, কাঁধ আর বুকে দুইশো মাএ আছে। ডাইবিটিসটা না থাকলে দেখাইয়া দিতাম। ডাইবিটিস সব শ্যাষ করছে। ওই দ্যাখো আমার জুয়ান বয়েসের ছবি। ওই দ্যাখো মনোহর আইচের লগে। ওই যে ব্যাঙ্গল বডি বিল্ডিং চ্যাম্পিয়ন কাপ। পিয়োর সিলভার, ওনারও আঙুল যেন কম্পাস। ওই সিলভার কাপটায় কতটা সিলভার আছে জানো? পাক্বা ফাইভ হানড্রেড গ্রাম। আমার এত অভাব সত্ত্বেও ওইটা বেচি নাই। ক্যান জানো। আমার নাতি-নাতনি আইস্যা দেখুক। এইগুলার মর্ম বুঝুক। আসে না, বুঝলা, আসে না…। কণ্ঠস্বর হঠাৎ আইসক্রিম হয়ে যায় দেহশ্রীর। ওরা সেকেন্দ্রাবাদে নিজেরা নিজেরা থাকে। নাতি-নাতনিরা পড়াশুনা করে। আসে না। তিন বছর দেখি নাই। ফুটবলই খেল আর ডান্ডাগুলিই খেল, বডি ফিট না থাকলে কিচ্ছু হয় না। এক আনা দুই আনা কইরা জমাইয়া একে একে ডাম্বেল, বারবেল খরিদ কইর্যা আনছি।

– এসব জানি তো… জন্যই তো একটু ঋণ স্বীকার।

স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে সুখবিলাস বললেন, দেখলা তো, কিছু বৃথা যায় না। আর এই দুনিয়াটা এখনও খারাপ হইয়া যায় নাই।

অক্ষয় সরখেল ‘গান কে নিল আমার কণ্ঠ হতে’ ছাড়াও অন্য দু’একটা গানেরও সুর ভাঁজেন। অন্য কেউ বুঝতে পারবে না হয়তো, কিন্তু ওর স্ত্রী ঠিক বুঝতে পারেন– এ মণিহার আমায় নাহি সাজে। অক্ষয় বলেন– গরদের পাঞ্জাবিখানা ঠিক আছে তো? ধুতি?

– হেইসব তোমার চিন্তার কথা না। আমি ঠিকই বাইর কইরা রাখমু অনে।

তারপর বলে– একখান ভাষণ লিখতে হইব তো, লিখ্যা দিব্যা?

– কইয়া দিও, লিখ্যা দিমু। পড়ব কে?

– তুমি পইড়া দিও– তবে আগে পইড়া শুনাইও। ঠিক আছে, তুমি কয়েকবার পইড়া শুনাইয়া দিলেই আমি পারুম। পয়েন্টে পয়েন্টে কইয়া দিমু।

বিশুর একটা বাড়তি ঝামেলার কাজ মানপত্র তৈরি করানো। এই সুযোগে টফি-কফিদের বাড়িতে কয়েকবার গিয়েছে। ওদের গুণাবলী লিখে নিয়েছে, চা-কেক খেয়েছে। বাংলার স্যার বিভাসবাবুকে দিয়ে ভালো করে মানপত্রগুলির বয়ান লিখিয়ে ডিটিপি করিয়ে নিতে হবে।

প্রচুর ঝামেলা। সাংবাদিকটা অবশ্য নিজের মানপত্রটা নিজেই লিখে নিয়েছে। একটা ঝামেলা কমল।

বিভাসবাবু বললেন– মানপত্র? কোনও সমস্যাই নয়। লিখে দেব। গানের মাস্টার! – হে সুরসাধক আপনার সুরমুর্ছনা ছড়িয়ে পড়েছিল এ অঞ্চলের ঘর থেকে ঘরে… আর ব্যায়ামবিদ? হে চির সবুজ, চির নবীন, স্বাস্থ্যই সম্পদ এই মন্ত্র গ্রহণ করে আপনার তত্ত্বাবধানে কত যুবা হাতে তুলে নিয়েছিল বারবেল… আজকের এই জিম যুগেও আপনার কীর্তিকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি…।

অক্ষয় সরখেলের তর সয় না। মহামায়াকে দিয়ে ভাষণ লেখায়। মহামায়ার লেখার অভ্যেস নেই। হাতও অল্প অল্প কাঁপে। অক্ষয়বাবু বলে যাচ্ছেন– আজকের এই সংবর্ধনায় আমি বড়োই আনন্দিত। কিন্তু আমি কি এই সংবর্ধনার যোগ্য?

মহামায়া বলে– এই কথাটা কও ক্যান?

অক্ষয় বলে– এইটা কইতে লাগে। সরস্বতী বন্দনার মতন।

– লিখ– যাহা হউক, উদ্যোক্তাগণকে ধন্যবাদ। কলোনি পত্তনের দিনে দেখিলাম জীবন সংগ্রাম চলিতেছে। আমার অগ্রজ মনোরঞ্জন গুহ মহাশয় সেই সংগ্রামের মধ্যে সংগীত দিলেন। নেতাজির জন্মদিনে, স্বাধীনতা দিবসে আমরা গান গাহিতাম। পরে এখানে সংগীত প্রতিষ্ঠান তৈয়ারি হইল। আমার কাঁচাঘরেই মহড়া চলিত। সেইসব কথা মনে পড়ে।

বেশি কথা হইয়া যায়। অক্ষয় নিজেই বলে।

লিখ। আমি সামান্য চাকুরি করিতাম। সেখানে ওভারটাইমের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু আমি সংগীতের টানে সন্ধ্যার পরই ঘরে ফিরিতাম। পল্লির পোলাপান আমার কাছে গান শিখিতে আসিত।

– বক্তৃতার মধ্যে কেউ পোলাপান কয় নাকি? ছেলে-মেয়ে কও।

তিনদিন ধরে অনেক কাটাকুটির পর একটা ভাষণ তৈরি হল। মহামায়া পড়ে শোনাল। অক্ষয় বলে– তোমার হাতখান দাও। অক্ষয় ওর হাতে হাত বুলোল। অনেক– অনেকদিন পর। বলে বড়ো কষ্ট করো না তুমি গো…।

মহামায়া বলে– ঢং।

তিন চারদিন আগে থেকেই মাইকে ঘোষণা হতে লাগল– বিরাট বিচিত্রানুষ্ঠান। তোরণ উদ্বোধন করবেন মাননীয় সাংসদ গৌতম রায়, উপস্থিত থাকবেন অমুক-অমুক। সংগীত পরিবেশন করবেন বিখ্যাত ব্যান্ড ধুমধাড়াক্বা। সংগীত পরিবেশন করবেন জোজোকণ্ঠী পিংকি। জনপ্রিয় সিরিয়ালের সংলাপ পরিবেশন করবেন এলাকার গর্ব, অভিনেত্রী কফি ও টফি। নৃত্য পরিবেশনায় নাচো পাগলি নাচো খ্যাত বুলবুলি। সমগ্র অনুষ্ঠানটি নিবেদন করবেন মোমো-চোমো।

মহামায়া বলে– তোমার নাম তো কইল না…

অক্ষয় বলে, না কউক গা।

অনুষ্ঠানের দু’দিন আগে থেকেই অক্ষয়ের বেশ শরীর খারাপ। বমি হল। ডাক্তার ডেকে আনে মহামায়া। প্রেশার বেশ হাই। ডাক্তার বললেন, শুয়ে থাকুন। অক্ষয়ের খুব মাথা ভোঁ ভোঁ করে।

মহামায়া জানে উত্তেজনা হলে প্রেশার বাড়ে।

অক্ষয় বলে– তাহলে উপায়?

মহামায়া বলে– ম্যাডেল বেশি না জীবন বেশি! তোমার ম্যাডেল আমি গিয়া নিয়া আসুম।

– কিন্তু আমার ভাষণ?

– ভাষণের দরকার নাই।

– কী পাগলের মতন কথা কও। অরা সংবর্ধনা দিব। তার উত্তরে আমি একখান ভাষণ দিমু না?

– ক্যামনে দিবা। মাথাখান উঠাইতে পার না। আইচ্ছা, তোমার এই ভাষণ কাউরে দিয়া পড়াইয়া দিমু।

– কাউরে ক্যান? আমার স্ত্রী হিসাবে তুমি নিজে পড়তে পারবা না?

– আমি ইস্টেজে উইঠ্যা! আমার ভয় করে।

– ভয়? কী কথা কও। আমি ভয় করব না ভাই ভয় করব না। ভয় কী? একটু স্মার্ট হইবার পারবা না!

– উঁহু!

– উঁহু না, হুঁ কও– সোনা আমার।

মহামায়া বলে, ঢং।

বেছে বেছে একটা ভালো শাড়ি পরেছে মহামায়া। সিল্কের, লালপাড়, ভিতরে কলকা। মেয়ের বিয়েতে প্রণামি পাওয়া। ভাষণটা বেশ কয়েকবার পড়ে নিয়েছে, সিঁদুরের একটা বেশ বড়ো টিপও পরে নিয়েছে।

প্যান্ডেলে তখনও খুব একটা লোকজন হয়নি। সবুজ সবুজ চেয়ার। ওকে সামনের সারিতে বসানো হল। এরেই কয় খাতির। চেনা লোকজন খুব কম। বিশু এসে এক্বেবারে সামনের দিকের চেয়ারে বসিয়ে দিল। কে একজন এসে হাতজোড় করল। ভালো আছেন বউদি? ও। নারায়ণবাবু। মোটাসোটা হয়েছে এখন। আরও কেউ কেউ এসে তত্ত্বতালাশ নিচ্ছে। কতদিন পর একটা অন্যরকম সন্ধ্যা। যে সন্ধ্যাবেলাটা মনে হয় আমি আছি। বাঁইচ্যা আছি।

একটু পরে ঘোষণা হল মাননীয় সাংসদ রওনা হয়েছেন, এক্ষুণি এসে পড়বেন।

আবার দেশপ্রেম। আওয়াজটা বড়ো বেশি। ওরা পাশাপাশি বসেও নিজেদের কথা শুনতে পারছে না।

আবার মাইকে ঘোষণা হল আসার পথে মাননীয় সাংসদ একটা নবনির্মিত জিম উদ্বোধন করেই সোজা এখানে চলে আসছেন। চারিদিকে উন্নয়নের কাজ চলছে। যে কারণে সামান্য দেরি। আর কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরুন। কিন্তু পাবলিক ধৈর্য ধরছে না। চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। তখন বিশ্বনাথ মঞ্চে উঠে বলল– আমরা এখনই অনুষ্ঠান শুরু করে দিচ্ছি। তোরণ উদ্ঘাটন-পর্ব সাংসদ এলেই হবে।

এখন উদ্বোধনী সংগীত।

এবারে গুণীজন সংবর্ধনা।

কাজ-করা পাঞ্জাবি পরা ঘোষক হাতে মাইক ধরে বললেন– আমরা কিছুতেই আমাদের অতীতকে ভুলতে পারি না। সেই অতীত সোনালি রুপালি যাইহোক না কেন। সংগ্রামময়। কণ্টকাকীর্ণ পথ বেয়ে আজ আমরা এখানে পৌঁছেছি। এক-পা এক-পা করে এগিয়েছি…। এসব কিছুক্ষণ বকে বলল, এই এলাকার প্রবীণ মানুষ নারায়ণ দাস মহাশয়কে আমরা মঞ্চে ডেকে নিচ্ছি। উনিই সংবর্ধিত করবেন দুই প্রবীণ গুণী মানুষকে। প্রথমে ডাক পড়ল সুখবিলাস বিশ্বাসের। নারায়ণবাবুর হাতে একটা ট্রে ধরল একটা রংচং-করা মেয়ে। নারায়ণবাবু সেই ট্রে-সমেত উত্তরীয়, মানপত্র, মিষ্টির বাক্স তুলে দিল সুখবিলাসের হাতে। সুখবিলাসের মেডেল পাওয়া, কাপ পাওয়া অভ্যাস ছিল। একটা হাত উপরে তুলল, ট্রফি জিতলে যা করে। কিন্তু একটা হাত চোখে। চোখ মুছল।

কিছু বলতে বলা হলে শুধু বললেন– ভাইরে, স্বাস্থ্য, নিয়ম। ডিসিপ্লিন। সৎ হও। আর কিছু না। মরার আগে যেন…

সব গুলিয়ে যাচ্ছে সুখবিলাসের। কী বলতে চাইছেন নিজেই বুঝতে পারছেন না। নেমে গেলেন।

মহামায়ার এরকম হবে না। ওর তো সব লেখা আছে।

এবার অক্ষয় সরখেলের ডাক। বলা হ’ল ওর পক্ষ থেকে সংবর্ধনা গ্রহণ করবেন ওঁর স্ত্রী মহামায়াদেবী।

এইসব শব্দ– যেমন সংবর্ধনা, এইগুলি মহামায়া নামের সঙ্গে যুক্ত হবে, মহামায়া কি কোনওদিন ভেবেছিল?

মহামায়া ট্রে-টা গ্রহণ করছে, এ সময় সাইরেনের হইহই শোনা গেল। সবাই চঞ্চল হয়ে উঠল।

মহামায়া নারায়ণবাবুকে জিজ্ঞাসা করে ভাষণটা। উনি কইয়া দিছিলেন, আমি লিখ্যা আনছি।

মলয় মল্লিক ঘোষকের কানে কিছু বলল।

ঘোষক বলল– সু-সংবাদ। অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি আমাদের মাননীয় সাংসদ এসে গেছেন। আমরা এবার তোরণের দিকে যাব। প্রথমে উনি ফিতে কেটে তোরণদ্বার উদ্বোধন করবেন…

মহামায়া নারায়ণবাবুকে আবার বলল– ভাষণটার কি হইব?

নারায়ণবাবু বলল– অহন নাইব্যা যান ঠাইরেন।

সাংসদ এলেন। মানে এমপি। ওকেই ভোট দিয়েছিল মহামায়া। ওর ছবি দেখেছে দেয়ালে। এই প্রথম সামনাসামনি দেখল। সামনাসামনি কোথায়। দূর থেকে। ওর সঙ্গে আরও ছ’সাত জন নামল। ফুলের তোড়া। মালা। এবার উনি মঞ্চে। সঙ্গে অনেক লোক। পৌরমাতা-পিতা কতজন। এলাকার কত উন্নয়নের কথা জানালেন। চেয়ারম্যান তোরণের অনুদানের জন্য নারায়ণবাবুকে ধন্যবাদ দিলেন। গুণীজনদের নামও বললেন। শুধু অক্ষয় নামটাই ভুল হয়ে গেল।

সাংসদ জানালেন বিপদে-আপদে উনি আছেন। এই এলাকাকে বড়ো ভালোবেসে ফেলেছেন। ছেড়ে যেতে মন চাইছে না, তাই তিনি সহজে মাইক ছাড়বেন না। কত কী হবে বললেন হাজার হাজার চাকরির কথা বললেন, আর বললেন– এই তোরণটা হল অগ্রগতি আর উন্নয়নের দ্বার।

উনি চলে যেতেই মোমো-চোমোর ম্যানেজার স্টেজে উঠে কফি-টফিকে ডেকে নিলেন। তুমুল তালি।

বাড়ি ফিরে আসে মহামায়া। রিকশায়। ভাষণ হ’ল না।

– আইসা গেছ?

– হ।

– কিছু অসুবিধা হয় নাই তো! পড়তে পারছিলা তো ভাষণখান!

– পারছি।

– হাততালি দিছে?

– খুব।

চোখের জল মুছল মহামায়া। ভাগ্যিস উনি দেখতে পেলেন না।

কী দিছে অরা, দেখি?

ট্রে-টা অক্ষয়ের কোলে বসিয়ে হাতটা টেনে ট্রে-র উপর রেখে দেয়। অক্ষয়ের হাতটা স্পর্শ করতে থাকে মাটি খুঁড়ে নিয়ে আসা সব গুপ্তধন। এইটা বুঝি মিষ্টির বাক্স? বাক্সটা তো বেশ বড়োই গো…। এইটা বুঝি রেডিও। দেখছ, কথা রেখেছে কেমন। আর কি হইল? আমি যাইতে পারলাম না বইলা দুঃখ করল না অরা।

– কত দুঃখ করল।

– আরও কও। বর্ণনা কইর‍্যা যাও। রেডিও-র মাইয়াগো মতন কও।

– কী কমু। তোমার কত সুখ্যাতি, কত প্রশংসা, কইল তুমি পাড়ার গৌরব! কইল তুমি কত বড়ো মানুষ।

– কেডা কইল?

– নেতায়।

আইচ্ছা মানপত্রটা দেহি।

মানপত্রটা হাতে তুলে দেয়। একটা রোল করা কাগজ।

কাগজটার গায়ে হাত বুলোলেন অক্ষয়।

– বাধাইয়া রাইখ্যো। নাতনি আইলে দেখামু।

পড় দেহি কি লেখছে।

মহামায়া পড়তে থাকে– হে চির সবুজ, চির নবীন। স্বাস্থ্যই সম্পদ এই মন্ত্রে বিশ্বাসী আপনি। এই অঞ্চলের তরুণদের শরীরচর্চার জন্য আপনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি ব্যায়ামাগার।

হে বীর…

থেমে যায় মহামায়া।

 

শ্রাবণের ধারার মতো

‘জায়গাটা কেমন, আমায় একটু বলে দাও না।’

খুব আস্তে আস্তে দুলছে দোলনাটা। দু’হাতে দু’পাশের দড়ি ধরে রেখেছে বল্লরী। দোলার তালে গোড়ালির কাছে শাড়ির থোকা লুটিয়ে যাচ্ছে। তার পায়ের বুড়ো আঙুলও তখন আলতো করে মাটি ছুঁয়ে আবার উঠে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু-একবার পাখির ডাক ছাড়া একফোঁটাও শব্দ নেই কোথাও। তাই ভালো লাগছে বল্লরীর। বেশি শব্দ তার মাথার ভেতরে যন্ত্রণা ছিটিয়ে দেয়।

মাটির দাওয়ায় তিন ধাপ সিঁড়ি। মাঝেরটিতে বসে ছিল প্রত্যুষ। বল্লরীর দিকে তাকাল সে। পিঠে পড়ে আছে লম্বা বেণি। এককুচি চুল কানের পাশ দিয়ে এসে গালের কাছে দুলছে। ফরসা, গোল ছাঁদের মুখে পাতলা ঠোঁট। বল্লরী তাকিয়ে রয়েছে সামনে। কিন্তু তার চোখের মণি স্থির।

প্রত্যুষ বলল, ‘বাড়িটা মাটির, বলেছি তো তোমায়। তবে ঘরের দুটো দিকের দেয়াল মাটির হলেও বাকি দু’দিকে কাচ লাগানো। সেখানে ছবি আঁকা, লতা-পাতা, ফুল, হরিণ। পিছনের আর বাঁদিকের বাগানটা দেখা যাচ্ছে কাচের ভেতর দিয়ে। ঘরের ছাদটা চুড়ো মতো, অনেক উঁচুতে। সেখানেও ছবি আছে, আদিবাসীদের ঘরের দেয়ালে যেমন থাকে, তেমন। বাইরের চালে খড়।’

বল্লরী বলল, ‘আমরা তাহলে গ্রামের বাড়িতে আছি বলো।’

‘বলতে পারো।’

‘আর সামনেটা?’

দাওয়ার খুব কাছে তিনটে চড়ুই আর দুটো শালিখ তুড়ুক তুড়ুক লাফাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঘাসে মুখ ডুবিয়ে কী খুঁটে তুলছে, আবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে ছটফট করে। প্রত্যুষ সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে বলল, ‘এই তো, ছোটো ছোটো বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঘেরা একটা পুকুর। জল থইথই করছে। শালুক ফুটে রয়েছে তাতে। পাশ দিয়ে একটা সরু রাস্তা। পুরো জায়গাটাই নীচুমতো মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। রাস্তাটা যেখানে শেষ সেখানে একটা কাঠের দরজা আছে। কালো রঙের। ওটা দিয়েই আমরা এখানে ঢুকেছি। তার বাইরে আরেকটা মাটির বাড়ি। তবে দোতলা। জানো, আমরা যেখানে আছি সেটার নাম এক্বা। আর ওই বাড়িটার নাম দোক্বা।’

‘বাঃ, ভালো নাম তো। একা আর দোকা। একজনে আর দুজনে।’

কথাটা খেয়াল করল প্রত্যুষ কিন্তু সেদিকে না গিয়ে বলল, ‘দোক্বার সামনে ছড়ানো জায়গা রয়েছে খানিকটা। তার পরে আরও একটা বড়ো গেট আছে লোহার। তারও ওপাশে লালমাটির রাস্তা। ওই রাস্তাটা দিয়েই গাড়িতে এসেছিলাম আমরা। অনেক গাছ চারদিকে। ডানদিকে খুব বড়ো একটা পুকুর। তাকে ঘিরে অনেক তালগাছ।’

বল্লরীর ঠোঁটে হালকা হাসি। সে বলল, ‘উঁহু, পুকুর নয়। দিঘি। দিঘি তার মাঝখানটিতে / তালবন তারি চারিভিতে / বাঁকা এক সরু গলি বেয়ে / জল নিতে আসে যত মেয়ে / বাঁশগাছ ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ে / ঝুরুঝুরু পাতাগুলি নড়ে। লালমাটির রাস্তাটার ধারে একটা বাঁশবন আছে না?’

প্রত্যুষ চমকে তাকাল বল্লরীর চোখের দিকে। ‘হ্যাঁ, আছে তো। তুমি কি কিছু…?’

এবার শব্দ করে হেসে উঠল বল্লরী। সেই হাসিতে এই মেঘলা দুপুরের ছায়া। ‘না, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না আমি। এমনিই বললাম। জায়গাটা খুব সুন্দর, না?’

প্রত্যুষ কোনও কথা বলল না। জায়গাটার হদিশ দিয়েছিল তার অফিসের বন্ধু সায়ন্তন। থাকার ব্যবস্থাও সে-ই করে দেয়। বলেছিল, ‘ঘুরে আয়। যাওয়া দরকার তোদের।’ বল্লরী যেতে চায় না কোথাও কিন্তু সেও রাজি হয়ে গেল। কেন যে হল তা এখনও জানে না প্রত্যুষ। তাদের দুজনের বাড়ি থেকেই আপত্তি ছিল। ভয়ও। তবু আসা হল।

প্রত্যুষের বাবা মারা গেছেন বছর আটেক হল। বোনের বিয়ে হয়েছে তার পর। এখন বাড়িতে শুধু মা। হাঁটুর ব্যথায় বলতে গেলে নড়াচড়াই করতে পারেন না। সঙ্গে আরও নানা অসুখ। একতলা ছেড়ে দোতলায় উঠতেও কষ্ট। এখানে আসার কথা শুনেই তিনি বলেছিলেন, ‘ওই মেয়েকে নিয়ে তুই যেতে পারবি? নিজে নিজে তো কিছুই করতে পারে না। বাড়িতে থাকলে সে একরকম। বাইরে নিয়ে গিয়ে সামলাবি কী করে? যাওয়ার দরকারটা কী?’

প্রত্যুষ বলেছিল, ‘কিছু ভেবো না। আমি পেরে যাব।’

সুব্রতা মনের আঁচ চেপে রাখতে পারেনি। ‘ভাবব না! ছ’ বছর হয়ে গেল বিয়ে হয়েছে, প্রথম বছরটাই যা একটু ভালো ছিলি। তারপর থেকে যা চলছে তাতে কেউ না ভেবে থাকতে পারে! ওর জীবনটা তো নষ্ট হয়েইছে, তোরটাও হচ্ছে।’

‘এখনই অত খারাপ ভাবছ কেন?’

‘যা ভাবছি, ঠিকই ভাবছি। এখানে থাকতেও পারল না, সংসারও করতে পারল না, ছেলেপুলেও হল না। হয়েই বা কী হবে? সামলাবে কে? আমি কি কিছুই আশা করব না বলিস? চোখে যে দেখতেই পাচ্ছে না একদম, তাকে নিয়ে তুই সারাজীবন কাটাতে পারবি? ওই বোঝা বয়ে বেড়াতে পারবি?’

‘আঃ মা।’ হালকা ধমকের মতো করে প্রত্যুষ বলেছিল, ‘বোঝা বলছ কেন? একটু দেখতে দাও। সময় তো চলে যাচ্ছে না।’

‘যাচ্ছে। তুইও জানিস সেটা। এরপর আর কিছুই হবে না। আমি যা বলছি, কষ্টে বলছি। নিজের ছেলেকে সুখী দেখতে চাওয়াটা অন্যায় তো নয়। মঞ্জুষা বলল আর আমিও রাজি হয়ে গেলাম। এইরকম দুর্ভাগ্যও যে কারও হয়–।’

বল্লরী আর প্রত্যুষের বিয়েটা দেখাশোনার হলেও খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে নয়। মঞ্জুষা প্রত্যুষের মাসি। মায়ের নিজের বোন নয় তবে সম্পর্ক ভালোই ছিল। যাতায়াতও ছিল বেশ। বল্লরীর পরিবারের সঙ্গেও তারই যোগাযোগ। সেই সুতোতেই তিনি বাঁধতে চেয়েছিলেন ওদের। এখন তিনি প্রত্যুষদের বাড়িতে খুব কমই আসেন। যখন আসেন তখনই প্রত্যুষের মাকে বলেন, ‘আমি তো ভালোই চেয়েছিলাম। এত সুন্দর মেয়েটার এরকম হয়ে যাবে কী করে জানব বলো!’

কথাগুলো এড়িয়ে যায় প্রত্যুষ। মায়ের কথাও এড়িয়ে এখানে এসেছে সে।

আকাশে ঘনিয়ে আসছে মেঘ। হাওয়ায় হাওয়ায় গাছগুলোর মাথা এলোমেলো। শ্রাবণের শেষ। সকাল থেকেই বৃষ্টি ছুটোছুটি খেলছে। আসার সময়ে ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছিল সে। মাঝে কিছুক্ষণ তার নিজেরই হাঁফ ধরে গিয়েছিল হয়তো। জিরিয়ে নিয়ে এখন সে আবার খেলা শুরু করতে চায়।

ওরা চুপ করে বসেছিল। প্রত্যুষ দেখতে পেল সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে বাসুদেব। ঘরের কাছে এসে সে দাঁড়াল। বলল, ‘আমাদের খাওয়ার জায়গাটা ওই দরজার বাইরে, দোক্বাবাড়ির পাশে। আপনারা কি ওখানে যাবেন? বলেন তো এখানেও দিয়ে যাওয়া যায়।’ বলতে বলতে লোকটি আড়চোখে বল্লরীকে দেখে নিল একবার।

বোলপুর স্টেশনের বাইরে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল এই বাসুদেব বিশ্বাস। বুকের কাছে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা– আমার আকাশ। প্রত্যুষের হাত ধরে নড়বড়ে পায়ে বল্লরীকে আসতে থেকে অবাক হয়েছিল। তারপর বুঝতে পেরে দৌড়ে এসে প্রত্যুষের হাত থেকে ট্রলিব্যাগটা নিতে নিতে বলেছিল, ‘দিন, আমায় দিন।’ সে-ই এখানকার ম্যানেজার। এখনও নিশ্চয়ই বল্লরীর কথা ভেবেই খাবার দিয়ে যাওয়ার কথা বলছে।

প্রত্যুষ কিছু বলার আগেই বল্লরী বলল, ‘আমি ওখানে যেতে পারব। কিছু হবে না।’

বাসুদেব ঘাড় কাত করে বলল, ‘ওঃ, তাহলে তো ঠিকই আছে। বরঞ্চ রাতেরবেলা সাধুর বউকে বলব এখানে খাবার দিয়ে যেতে। ওই খাবার জায়গার কাছেই ওদের ঘর।’

প্রত্যুষ বাসুদেবের কাছে জানতে চাইল, ‘এখানে আর কেউ আসবে না? কারও বুকিং নেই?’

বাসুদেব বলল, ‘সারাবছরই লোক আসে, তবে এই বর্ষার সময়টায় কম। মাঝে মাঝে চলে এল হয়তো কেউ। কিন্তু এখন কারও আসার নেই। দোক্বাবাড়ি তো ফাঁকা আর এখানে শুধু আপনারা দুজন।’

খাবার জায়গায় একমানুষ সমান মাটির দেয়াল। কোনও জানলা নেই। খোলামেলা চারদিক। বসার জন্য কাঠের বেঞ্চ। সামনে কাঠের লম্বা টেবিল।

সাধু আর সাধুর বউ খুব যত্ন করে খাওয়াল তাদের। ভাত, ডাল, পোস্তর বড়া, পাঁচমিশেলি সবজির তরকারি আর রুই মাছের ঝোল। থালায় বেড়ে দেওয়ার পর বল্লরীকে পুরোটাই বলে দিতে যাচ্ছিল প্রত্যুষ। সাধুর বউ কনক মাথায় ঘোমটা টেনে এগিয়ে এল। সে-ই বলে দিল সব।

বল্লরীর থালায় মাছের কাঁটা বেছে দিচ্ছিল প্রত্যুষ। দেখতে দেখতে কনক বলল, ‘আমাদের এখানে মাত্তর কয়েকটা মাছ পাওয়া যায়। আগে জানলে– ।’

গলার স্বরে সাধুর বউয়ের দিকে মুখ ফেরাল বল্লরী। হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, অসুবিধে হয়নি আমার।’

খেতে খেতে একবার মুখ তুলতেই খোড়ো চালের বাতায় গোঁজা আড়বাঁশিটা চোখে পড়ল প্রত্যুষের।

‘বাঁশি কে বাজায়?’

লাজুক হাসি সাধুর মুখে। ‘আমি বাজাই বাবু।’

‘কী বাজান?’

‘ওই, রবিঠাকুরের গান।’

এবার বল্লরী বলল, ‘কী করে জানলেন?’

‘যে দাদাবাবু এই জায়গাটা বানিয়েছেন তিনি তো ছবি আঁকেন। কলকাতায় থাকেন, আবার এখানেও এসে থাকেন। অনেকদিন আগে জমিটা কিনেছিলেন, আস্তে আস্তে ঘর তুলেছেন। তিনি যখন আসেন তখন ওই এক্বাবাড়ির দাওয়ায় বসে অনেক রাত পর্যন্ত গান করেন। আমি শুনে শুনে বাঁশিতে ধরেছি। কাজ শেষ করে রাতে বসে বসে বাজাই। ম্যানেজারবাবুর বাড়ি তো দূরে, গ্রামের ভেতর, চলে যায়। এখানে আমরা এই দুই বুড়োবুড়ি থাকি। আর তো কেউ নেই আমাদের।’

সারা দুপুর ধরে হাওয়ার সঙ্গে সাঁতার কেটে বিকেল প্রায় পার করে দিল বৃষ্টি। জলের স্মৃতি মেখে দাঁড়িয়ে চারপাশের সবুজ। রাঙামাটির রাস্তা নরম কাপড়ের পাড়। সেই রাস্তা ধরে ওরা হাঁটছিল। হাঁটতে হাঁটতে তালগাছে ঘেরা সেই দিঘিটা পেরিয়ে গেল। বাঁদিকে একটা উঁচু বাঁধমতো জায়গা রয়েছে। তার ওপাশে নিশ্চয়ই কোনও ঝিল। বুঝেও সেদিকে যেতে পারল না প্রত্যুষ। বল্লরীকে নিয়ে অতটা ওঠানামা করা যাবে না। দূর থেকে কোনও পাখির ডাক ভেসে আসছে। টি-টি-টি। মাথার ওপর দিয়ে আরও কতগুলো উড়ে গেল। কী পাখি জানে না প্রত্যুষ। আরও দূরে ধানখেত, মাঠ, গ্রামের ঝাপসা ছবি। দু’একজন মেঠো লোক ওদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ফিরে ফিরে দেখছে। বল্লরীকে নিয়ে তো বেরোতেই পারে না। প্রয়োজনে যতটুকু বেরোতে হয়েছে তখন এরকমই ঘটেছে। এতদিনে জেনে গেছে প্রত্যুষ। তবু যেন বুকের কোথায় খোঁচা লাগে।

বেরোনোর আগে বল্লরী জানতে চেয়েছিল, ‘তুমি নীল পাঞ্জাবিটা পরেছ, না?’

একটা পাঞ্জাবি বছর খানেক আগে বল্লরীর মা দিয়েছিলেন তাকে। বল্লরী তখন রঙের কথা জানতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটা তো নয়, অন্য পাঞ্জাবি পরেছে প্রত্যুষ। একবার ভেবেছিল হ্যাঁ বলে দেয়। তারপরেই থমকে গেল। বলল, ‘না, এটা পুরোনো। পেস্তা রঙের। তখন বলেছিলাম তোমায়।’

‘ও।’ হাসল বল্লরী। ‘ওটাও ভালো রং।’

বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ প্রত্যুষের হাত ধরে চলেছিল বল্লরী। শক্তসমর্থ হাত। ভাবতে চেষ্টা করছিল পেস্তা রঙের পাঞ্জাবিতে কেমন লাগছে প্রত্যুষকে। সেও তো ফরসা। কোঁকড়ানো চুল। কিন্তু ভালো দেখালেও সে ভালো বলতে পারবে না।

এখন প্রত্যুষের হাত ছেড়ে দিয়ে বল্লরী বলল, ‘শান্তিনিকেতন এখান থেকে কাছেই, না?’

‘হ্যাঁ, অন্যদিকে কিন্তু খুব দূরে নয়। যাবে?’

‘না। এখান থেকেই ফিরে যাব।’

‘তুমি তো কোথাও যেতে চাইতে না। এবার হঠাৎ এখানে এলে যে?’

বল্লরীর চোখ কাছে-দূরের কিছুই ছুঁতে পারছে না। ধীর পায়ে শুধু হেঁটে যাচ্ছে সে। বলল, ‘বাড়ি আর হাসপাতালই তো এখন আমার সবচেয়ে চেনা জায়গা। অসুবিধে হয় না। কিন্তু চারপাশের এসবও তো আমার জানা ছিল একদিন। ভাবলাম, দেখি, যদি আবার চিনতে পারি।’

বলতে বলতে নিজেকে থামাল বল্লরী। সত্যি বলছে না সে। প্রত্যুষের সঙ্গে এই শেষবার তার একসঙ্গে হাঁটা। অনেকদিন ধরেই যা মনে হচ্ছে এবার সেই কথাটা বলে দিতে হবে। এখন তার তেত্রিশ। প্রত্যুষ পঁয়ত্রিশ ছাড়িয়েছে। আর দেরি করা যায় না। এরপর হয়তো শুধু দয়া নিয়ে থাকতে হবে না হলে। বাবা আর মাকে কথাটা জানিয়ে এসেছে বল্লরী। শুনে গোপা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন। ‘তোর কেন এমন হল রে মা! আমাদের কি অপরাধ হয়েছে কোথাও?’

চোখে জল এসে পড়লে কষ্ট হল বল্লরীর। মনে হতে থাকে আবার মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়ে যাবে। এক একদিন ওইরকম যন্ত্রণায় মায়ের হাত চেপে ধরে বসে থাকতে হয়েছে তাকে। তাছাড়া যে চোখে দৃষ্টি নেই সেখানে জল আসা না আসায় কী হয়! মায়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বল্লরী বলেছে, ‘অপরাধ কেন হতে যাবে? ওরকম ভেবো না। বরং ভাবো যাতে কোথাও কারও প্রতি অন্যায় না হয়। আমিও সেটাই করতে চাইছি।’

বল্লরীর বাবা এসে তাকে ছুঁয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ‘আমার তোকে কিছু বলার নেই। অনেক কিছুই তো মেনে নিতে হচ্ছে। এরপর যা হবে সেটাও মেনে নেব।’

ছ’ বছর আগে যখন তাদের বিয়ে হয় তখন কত আনন্দ আর হাসি-গানের ভেতরে চোখে চোখ রেখেছে তারা। কত দমকা হাওয়ায় উড়েছে দুজনে। পুরীতে সমুদ্রস্নান। পাহাড়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের ছবির সঙ্গে এক ফ্রেমে দুজনে। জীবন যেন ঝলমলে রোদ্দুর। বিয়ের আগে থেকেই চাকরি করত বল্লরী। শ্বশুরবাড়ি, সংসার সামলে হাসিমুখেই সব করতে পেরেছে। দুজনে দুদিকে গেলেও সে আর প্রত্যুষ রোজ একসঙ্গে বেরোত। দুজনেরই সরকারি চাকরি। কম্পিউটার ইনচার্জ বল্লরী যেত আলিপুরের ট্রেজারি বিল্ডিংয়ে আর স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ার প্রত্যুষ সোনারপুরে। কিন্তু এক বছরের কিছু পরেই কাজ ছেড়ে দিতে হল বল্লরীকে। মাথায় যন্ত্রণা। হালকা ওষুধ খেয়ে যাচ্ছিল। কাজ হয়নি। যন্ত্রণা বাড়তে বাড়তে তারপর অবিরাম ডাক্তার, ইঞ্জেকশন, ছুটোছুটি ভেলোর। ডাক্তাররা বলল সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস হয়েছিল অনেকদিন আগেই। বল্লরী নাকি বুঝতেই পারেনি।

যন্ত্রণা কমাতে মাথায় অপারেশন হল। তবু বারবার রক্ত জমেছে মাথার ধমনিতে। কাটাছেঁড়া চলেছে চোখেও। কিছু হল না। আবছা দেখতে দেখতে আরও এক বছরের মধ্যেই সব নিভে গিয়ে একেবারে অন্ধকার। কর্নিয়া নষ্ট হয়ে গেছে ততদিনে। অপটিক নার্ভও কাজ করছে না যে নতুন চোখ দিলে দেখতে পাবে সে।

এখন পাঁচ-ছ মাস অন্তর বল্লরী ভেলোরে যায়। ভর্তি হয়। হাসপাতালে সাদা চাদরের বিছানা। বারবার টেস্ট। স্টেরয়েড। পালটে দেওয়া ওষুধ নিয়ে ফেরত আসে। সঙ্গে বাবা কিংবা মা যায় মাঝে মাঝে। তিনবার কাজের চাপে প্রত্যুষ যেতে পারেনি, বাকি সময়ে সে গিয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে আর থাকতে পারে না বল্লরী। সেখানে কে দেখাশোনা করবে তার? চার বছর হয়ে গেল বাপের বাড়িতেই রয়েছে বল্লরী। কোনওদিন প্রত্যুষ সকালে নিজের বাড়ি থেকে বল্লরীর কাছে আসে। অফিসে যায়। কোনওদিন ফেরার পথে আসে। তখন বল্লরীর ঘরের দরজা ভেজানো থাকে। প্রত্যুষও উঠে গিয়ে ছিটকিনি তুলে দিতে পারে না।

আজ দুপুরে বল্লরী যখন শুয়ে, তখন তার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়েছিল প্রত্যুষ। সে কিছু বলেনি। শুধু অন্য পাশে ফিরে গিয়েছিল। প্রত্যুষ ভেবেছিল তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেবে। মুখ রাখবে তার বুকে। পারল না। গোলমাল হচ্ছে কোথাও। কেউ যেন ডেকে ফিরে যাচ্ছে। তারপর দরজা খুলেও আর দেখা যাচ্ছে না তাকে।

কটকট করে ব্যাঙের ডাক। সঙ্গে ঝিঁঝির আওয়াজ। মাঝে মাঝে থামছে। আবার শুরু হচ্ছে। ভেজা অন্ধকার ঘিরে রেখেছে চারপাশ। শুধু পুকুরপাড়ে বাঁশের খুঁটিতে ঝুলছে হলুদ ম্লান আলো।

খাবার সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছিল সাধুর বউ। খাওয়ার পর বল্লরীকে ইঞ্জেকশন দিয়েছে প্রত্যুষ। তারপরেই বল্লরী বলেছিল, ‘আলোটা নিভিয়ে দেবে?’

এখন ঘরের ভেতরের অন্ধকারে বল্লরী বলে উঠল, ‘ডাক্তার কী বলেছে তা তো তুমি জানো। মেনে নাও। আমি আর কোনওদিন দেখতে পাব না।’

হাত বাড়িয়ে বল্লরীর হাত চেপে ধরল প্রত্যুষ। ‘ভুল বলছ কেন? বলেছে অনেকদিন সময় লাগবে। আরও পাঁচ-সাত বছরও লাগতে পারে, দশ বছরও লাগতে পারে। কিন্তু অল্প হলেও আবার দেখতে পাবে তুমি।’

‘না, ওটা সান্ত্বনার কথা। তুমিও জানো সেটা। আমার চোখ আর ঠিক হবে না। তুমি এবার ভাবো।’

হেসে উঠল প্রত্যুষ। ‘কী ভাবব?’

‘আমি তোমাকে কোনও স্বাভাবিক জীবন দিতে পারব না প্রত্যুষ। আমাকে তুমি ছেড়ে দাও। মা-বাবার কাছেই থেকে যেতে পারব আমি। তারপর দেখব কী হয়।’

‘হাসপাতাল ছাড়া চার-পাঁচ বছরে একসঙ্গে আমরা আর কোথাও যাইনি। আসলে এই কথাটা বলবে বলে তুমি এখানে আসতে চেয়েছ, না বল্লরী?’

‘হ্যাঁ।’ বলে চুপ করে রইল বল্লরী। বাড়িতে নয়, কথাটা বলার জন্য সত্যিই তার একটা জায়গা দরকার ছিল। যেখান থেকে সে ফিরে যেতে পারবে। বাড়িতে প্রত্যুষ আসে। সেখান থেকে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া কঠিন। অনেক নয়, একটা কথা বলার জন্যই সে একটা জায়গা চাইছিল।

ঝিঁঝির আওয়াজ বন্ধ হয়ে গিয়ে এখন শুধু ব্যাঙের ডাকই শোনা যাচ্ছে। প্রত্যুষ বলল, ‘আমি যদি কোনও অন্ধ মেয়েকেই বিয়ে করতাম, তাহলে?’

‘তা তো হয়নি। আর তা হতোও না। এখন আমার এরকম হয়েছে বলে কথাটা তুমি বলছ। যে কোনওদিন কিছু দেখেনি সে একরকম। আমার তো তা নয়। আমি যে দেখেও দেখতে পারছি না।’

‘আমার এরকম হলে তুমি কি আমাকে ছেড়ে যেতে?’

‘একটা মেয়ের অন্ধ হয়ে যাওয়া মানে ভীষণ গোলমাল প্রত্যুষ।’

প্রত্যুষ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। কথাটা ভুল নয়। সে হঠাৎ অন্ধ হয়ে গেলে বল্লরী তাকে ঠিক সামলাতে পারত। সে কি পারবে? কিন্তু এরকম কি হয়ও না? হতে পারে না?

বল্লরী আবার বলল, ‘তুমি কি জানো না, তোমার-আমার বাড়ির লোকজনকে কতজনের কত কথা শুনতে হচ্ছে?’

‘জানি। কিন্তু যারা বলছে, আমি মনে করি তারা অন্ধ, বল্লরী।’

‘আমার সঙ্গে থাকতে থাকতে তুমিও যদি কোনওদিন অন্ধ হয়ে যাও!’

এই কথায় নিজের কথা হারিয়ে ফেলছিল প্রত্যুষ। যেন আচমকা কেউ একটা আলপিন ফুটিয়ে দিয়েছে আঙুলে।

বল্লরী আর কিছু বলছিল না। প্রত্যুষ কিছুটা সামলে নিতে পারল। বলল, ‘আমিও একটা কথা বলব বলে এখানে আসতে চেয়েছি। আমি অন্ধ না হয়ে তুমি আমার সঙ্গে থেকে আবার তো দেখতেও পেতে পারো বল্লরী।’

‘এভাবে কেউ জীবন কাটাতে পারে না। তোমার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে প্রত্যুষ।’

‘তোমার আর আমার সময় কি আলাদা বল্লরী?’

‘হ্যাঁ। আলাদা ছিল না। হয়ে গেছে।’

‘না, হয়নি। ওই যে তুমি সকালে বললে, বাঁশগাছ ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ে, তখন আমারও খেয়াল হল। তার আগে তো আমি দেখেও দেখিনি। তোমার আর আমার সময় তখন এক হয়ে গেছিল বল্লরী।’

ঝিঁঝির শব্দ আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন ব্যাঙের ডাকটাও থেমে গেছে। বল্লরী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘বৃষ্টি হচ্ছে আবার।’

‘কই না তো।’

‘হ্যাঁ হচ্ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি।’ বলতে বলতে বল্লরী নেমে পড়ল খাট থেকে। খাটের প্রায় পাশেই দরজা। বন্ধ করা হয়নি। প্রত্যুষ তার হাত ধরার আগেই সেই দরজা খুলে বল্লরী বেরিয়ে গেল বাইরে।

বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল প্রত্যুষ। সত্যি বৃষ্টি নেমেছে। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে– ঝিরঝিরে জলের গুঁড়ো উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। পুকুর পাড়ে বাঁশের খুঁটির আশেপাশে ছোটো বেঁটে গাছগুলোর পাতায় আলো পড়ে চকচক করে উঠছে বৃষ্টির জল। মাটির সিঁড়ি দিয়ে খালি পায়ে ঘাসজমিতে নেমে পড়েছে বল্লরী। কোনও কথা বলতে পারছিল না প্রত্যুষ। বল্লরী হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যাচ্ছে কী করে? দেখতে পাচ্ছে বল্লরী? এই অন্ধকারেও? যাক সে। দেখা না দেখায় কী যায় আসে!

বাতাসে ভেসে আসছে সুর। বাঁশি বাজাচ্ছে সাধু। হালকা অথচ গভীর। কী গান ধরেছে সে বাঁশিতে? যেন কার গলা মিশে যাচ্ছে এবার সেই সুরে। ও তো বল্লরী। গান গাইছে সে– ।

শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে পড়ুক ঝরে… তোমারি সুরটি আমার মুখের প’রে, বুকের প’রে… পূরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে দুই নয়ানে… নিশীথের অন্ধকারে গভীর ধারে পড়ুক প্রাণে… নিশিদিন এই জীবনের সুখের প’রে, দুখের প’রে… শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে…

 

বৃষ্টি থামার শেষে

কলেজ থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়েই সোজা বিছানা নিয়েছে কেয়া। আর পেরে উঠছে না। কয়েকদিন যাবৎ একটু বাড়তি খাটনি হয়ে যাচ্ছে তার। ছাত্র-ছাত্রীদের আবদার মেটাতে প্রায় রোজই কলেজের পরে তাদের ঘন্টা-দুয়েক করে এক্সট্রা টাইম দিতে হচ্ছে। সামনেই এক্সাম, তাই না করতে পারেনি কেয়া। বাচ্চাগুলোকে বড্ড ভালোবাসে সে। আর তারাও কেয়াদি বলতে অজ্ঞান। আসলে কেয়ার ব্যবহারটাই এত মিষ্টি। কলিগদের পছন্দের তালিকায় তার নামটা সবার আগে। সাইকোলজির ডিপার্টমেন্টে বেশ ফেমাস।

আজও বাড়ি ফিরতে প্রায় সাতটা হয়ে গেছে। ফেরার পথে খানিক সবজি নিয়ে ফিরেছে। সেগুলো টেবিলের উপরেই রাখা রয়েছে। ফ্রিজে তোলা হয়নি, শুয়ে শুয়ে এসবই সাতপাঁচ ভাবছিল কেয়া। এমন সময় কৌশানীর হাসির শব্দ কানে এল। সঙ্গে খুব চেনা একটা স্বর। বুঝতে একমিনিটও সময় লাগেনি কেয়ার। নিশ্চয়ই সুশোভন। মনে মনে বিরক্তই হয় কেয়া। আজকাল এ বাড়িতে তার যাতায়াত বড্ড বেড়ে গিয়েছে। সময় নেই, অসময় নেই যখন তখন চলে আসে। তাড়াতাড়ি উঠে হাউসকোট-টা চড়িয়ে নেয়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই মেয়ে কৌশানীকে প্রশ্ন করে ‘কে রে কৌশী?’

‘শুভ অঙ্কল মা।’ হঠাৎই মেয়ের ‘সুশোভন আঙ্কল’-এর পরিবর্তে ‘শুভ আঙ্কল’ সম্বোধন মনটাকে যেন আরও সংকুচিত করে দেয় কেয়ার। ক’দিন যাবৎ কেয়া নোটিস করছে, কৌশী-র প্রতি একটু বাড়তি-ই স্নেহ দেখাচ্ছে সে। সুশোভন আঙ্কল থেকে শুভ আঙ্কলের অন্তরালে আরও কত কী রহস্য আছে কে জানে। ভেবেই শিউরে ওঠে কেয়া। মনে মনে ভাবতে থাকে অনেক আদর যত্ন আর শিক্ষার সঙ্গে মানুষ করেছে কৌশী আর কুশলকে। সেই কারণেই তো লোকে এত প্রশংসা করে বাচ্চাদের। কিন্তু যতই লালন-পালন ভালো হোক না কেন, বয়স– বয়স মানুষকে ভুল পথে চলতে বাধ্য করে। বিশেষত কৌশী-র বয়সি মেয়েদের। সবে স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে। তার আর কত বোধ তৈরি হবে। মেয়ের মা হওয়াটা যে কতবড়ো দায়িত্বের। না কিছুতেই মেয়েকে বিপথে চালিত হতে দেওয়া যাবে না। ধৈর্য আর বুদ্ধি দিয়ে বিষয়টা ট্যাকল করতে হবে।

ভাবনায় বাধ সাধে সুশোভন। ‘কেমন আছেন বউদি?’ বোধকরি এর আগেও বার কয়েক জিজ্ঞাসা করেছে? ‘কী ভাবছেন?’

চমকে ওঠে কেয়া। খানিক সহজ হওয়ার চেষ্টা করে। ‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ। না না কিছু ভাবছি না তো।’

‘উঁহু, মনে হল।’

‘আরে না না, ওই একটু ক্লান্ত আর কী, জানেনই তো, সবকিছু।’ মনের মধ্যে বিতৃষ্ণা থাকলেও হাসার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে কেয়া। তারপর প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘তা, কী মনে করে?’

‘ওই আরকী, কাছেই একটা কাজ ছিল, তাড়াতাড়ি মিটে গেল, তাই ভাবলাম একটু খবর নিয়ে যাই। নইলে তো বন্ধুর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। ফিরে এসে বলবে তার অনুপস্থিতিতে আমি দায় এড়িয়ে গেছি।’

‘তা বটে, আমাদের ভালো থাকা না থাকাটা তো এখন আপনারই হাতে।’ কথাটা একটু আস্তে বললেও সুশোভনের কান পর্যন্ত ঠিকই পৌঁছোয়। কেয়ার কথার কী মানে করে কে জানে, একটু অপ্রতিভ হয়েই সুশোভন বলে, ‘এমন করে বলছেন কেন, এটা তো আমার কর্তব্য।’

‘চা খাবেন নিশ্চয়ই’– উত্তরের অপেক্ষা না করে, মেয়ের দিকে ফিরে বলে, ‘কৌশী দু-কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এসো তো।’

এর মিনিট পনেরো পর চা-খাইয়ে সুশোভনকে বিদায় করে বারান্দায় এসে বসে কেয়া। মন খারাপ হলে এখানেই এসে বসে সে। বাগানের গাছগুলো যেন কথা বলে তার সঙ্গে। আজ গাছেরাও যেন তার মন ভালো করতে অসমর্থ্য। খুব ভারাক্রান্ত লাগে কেয়ার। কুশীলব দেশে নেই। ছেলে ব্যাঙ্গালোরে। বাড়িতে মা আর মেয়ে। তার মাঝে এই দুশ্চিন্তা, তাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। কখনও ভাবেনি কুশীলবের অনুপস্থিতিতে তাকে এরকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।

মাস ছয়েক আগেও সবকিছু ঠিক ছিল। যখন আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি সম্পর্কিত বিশেষ জ্ঞান আর যোগ্যতার জন্য, ছাত্রদের সুবিধার্থে কুশীলবকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, সংসারের কথা ভেবে পিছিয়ে গিয়েছিল কুশীলব। এক বছর মানে তিনশো পঁয়ষট্টিটা দিন পরিবারকে ছেড়ে সুদূর আমেরিকায় থাকা সম্ভব নাকি? তাছাড়া ছেলেও পড়াশোনার কারণে বাড়ি থেকে দূরে ব্যাঙ্গালোরে থাকে। সে চলে গেলে বাড়িতে কেয়া আর কৌশী একা, ভাবতেই পারে না কুশীলব। কাছাকাছি তেমন কোনও রিলেটিভও নেই যাদের ভরসায় রেখে যাওয়া যায়। কুশীলবের মা-বাবা কবেই গত হয়েছেন। দুই দাদাও থাকে অ্যাব্রডে। কেয়ার বাপের বাড়িও বেশ ঘন্টা পাঁচেকের পথ। বিপদে-আপদে যে তারা পাশে এসে দাঁড়াবে সে উপায়ও নেই। এসব ভেবেই আরও পিছিয়ে যাচ্ছিল কুশীলব। তখন কেয়াই বুঝিয়ে সুঝিয়ে…।

‘মানছি এটা আমার জন্য খুবই গর্বের বিষয়। কিন্তু একবার ভেবে দেখেছ, তুমি একা এতগুলো দিন কীভাবে সামলাবে?’ কুশীলবের ভাবনাও অমূলক নয়।

‘কেন আমার উপর বিশ্বাস নেই তোমার?’ স্বামীর কাছ ঘেঁষে আসে কেয়া।

‘বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসছে না কেয়া, আমি জানি তুমি তোমার সামর্থ্য অনুযায়ী সবটুকু দিয়ে সামলে নেবে। কিন্তু তবুও…’। ভাবনাগুলো আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরে কুশীলবকে।

‘তুমি দেখো আমি সব সামলে নেব। এমন অপারচুনিটি বারবার আসে না কুশীলব। আর তাছাড়া তুমি এমন ভাবে রিঅ্যাক্ট করছ যেন আমি প্রথম গ্রাম থেকে শহরে এসেছি।’ কুশীলবকে চিন্তামুক্ত করার চেষ্টা করে কেয়া।

‘তোমাদের ছেড়ে একটা বছর’। চোখের কোণা চিকচিক করে ওঠে কুশীলবের। আবেগপ্রবণ হয়ে বুকে টেনে নেয় কেয়াকে। দূরে থাকার কথা ভেবে কেয়াও মুহূর্তের জন্য ইমোশনাল হয়ে পড়ে। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কুশীলবকে। চোখ জলে ভরে আসে। বেগতিক বুঝে কোনওমতে নিজেকে সামলে নেয় কেয়া। মনে মনে ভাবে… না, স্বামীর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য তাকে শক্ত হতেই হবে। তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কুশীলবের হাত দুটো ধরে দৃঢ় কণ্ঠে বলে, ‘একটা তো বছর। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। তাছাড়া বদলে কী পাচ্ছ সেটাও তো দেখতে হবে। কিছু পেতে হলে কিছু তো ছাড়তেই হয়।’ হাসার চেষ্টা করে কেয়া।

‘কিন্তু…।’

‘আবার কিন্তু কীসের? আর কোনও কিন্তু নেই। তুমি যাচ্ছ, এটা ফাইনাল।’ শেষ পর্যন্ত কেয়ার কাছে হার মানতে হয় কুশীলবকে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজনদের আশ্বাস পায় বটে, তবে খটকা থেকেই যায় তার। আসলে কুশীলব যে ধরনের মানুষ, তাতে তার বিচলিত না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। ভীষণ দায়িত্বশীল। অন্যান্য বন্ধুবান্ধবদের মতো কলেজের পরে কোনওদিন আড্ডাতে বসেনি, পরিবার নিয়ে থাকতেই সে ভালোবাসে। কোথাও যাওয়ার থাকলে দুজনে একসাথে।

নির্ধারিত দিনে আমেরিকার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয় কুশীলব। বাড়িতে এখন শুধু কেয়া আর কৌশানী। কুশীলব যাওয়ার পর বাড়িটা বড়ো খালি খালি লাগে কেয়ার। সপ্তাহে তিনদিন সন্ধের দিকে কৌশীর টিউশন থাকে। তখন একাকীত্ব যেন আরও চেপে ধরে কেয়াকে। নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য গান শোনে। পুরোনো দিনের গান। এগুলো বরাবরই কেয়ার খুব পছন্দের। কিন্তু আজকাল আর এসবও শুনতে ইচ্ছে করে না। মনে পড়ে যায় গানের মাঝে কুশীলবের গলা ছেড়ে গান ধরা, ‘ওগো কাজল নয়না হরিণী…’ মনটা আরও ভারাক্রান্ত হয়ে যায় তার। কৌশী-র বন্ধুবান্ধবরা এলে অবশ্য ঘরটা গমগম করে, বেশ ভালো লাগে কেয়ার। তাদের আবদার মেটাতে মেটাতেই টাইম চলে যায় তখন।

দিনগুলো একরকম কাটছিল। তবে কৌশী বরাবরই একটু বাবা ঘেঁষা। বাবা পাশে থাকলেই যত খুনশুটি, যত আবদার। বাবাই ছিল সবথেকে বড়ো বন্ধু। বাবার অনুপস্থিতিতে কৌশী বেশ একা হয়ে গিয়েছিল। বাবাতে-মেয়েতে মিলে পুরো বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখত। সঙ্গে মাঝেমধ্যেই কৌশীর বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ। ‘দ্যাখো না মা, বাবা যাবে না বলছে… এটা আনেনি… টিভির চ্যানেল ঘুরিয়ে দিয়েছে…’ হাজারো নালিশ। এখন বাড়িতে কৌশীর উপস্থিতি ফিল করতে পারে না কেয়া। এর মাঝে কুশীলবের বন্ধু কখনও একা, আবার কখনও পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে খোঁজখবর নিয়ে যেত। গল্পগুজব করে খানিকটা সময় কাটিয়ে যেত। কেয়ার বন্ধুরাও আসে মাঝে মাঝে। তবে কুশীলবের বন্ধু সুশোভন আর কেয়ার বন্ধু মীরার যাতায়াত ছিল অনেক বেশি। সুশোভন, কুশীলবের খুব কাছের বন্ধু। ওর সঙ্গে একই ডিপার্টমেন্টে রয়েছে। বিয়ে-থা করেনি। যাকে বলে, ঝাড়া হাত-পা আর কী। খুব সহজেই সকলের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। মন জিতে নিতে পারে। আকর্ষকও বটে। এই ক’দিনেই কৌশীর সঙ্গে বেশ ভাব জমেছিল সুশোভনের। আর মীরা কেয়ার কলিগ হলেও খুব ঘনিষ্ঠ। দুজনের ভাবনাচিন্তায় অদ্ভুত মিল থাকায় তাদের অন্তরঙ্গতা। একে-অপরের সঙ্গে সমস্ত কিছু শেয়ার করে তারা। মীরার বর ডাক্তার। দুই ছেলে অক্ষয় আর অভয়। এই বছরেই অক্ষয় পিসিএস-এর জন্য নির্বাচিত হয়েছে। আর অভয় বিএসসি ফাইনাল ইয়ার।

এর মাঝে ছেলে কুশলও কলকাতায় এসে দিন দশ-বারো কাটিয়ে গেছে। কুশলের আসাতে বাড়িতে বেশ একটা আনন্দের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। দুই ভাই-বোনের হাসি-ঠাট্টায় সামিল হতে হতো কেয়াকেও। কোনও প্ল্যানিং ছাড়াই তিনজনে হুট করে শপিং করা, খাওয়াদাওয়া করা, ঘোরা, সারাদিন পরে ঘরে ফেরা। সবকিছুর মাঝেও কুশীলবকে খুব মিস করছে কেয়া। এতগুলো বছর একসাথে থাকার একটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। কোনওদিন কেউ কাউকে ছেড়ে থাকেনি। এমনকী কুশল, কৌশী হবার সময়তেও কেয়াকে বাপের বাড়িতে পাঠায়নি কুশীলব। সেই নিয়ে কম ঠাট্টা শুনতে হয়নি কুশীলবকে বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে। হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছে ‘বউকে ভালোবাসা কি অন্যায় নাকি?’ এতদিনের অভ্যাস বদলাতে একটু সময় তো লাগবেই। সপ্তাহে দু’দিন ফোন করে কুশীলব। সারা সপ্তাহ মুখিয়ে থাকে কেয়া ওই দিনটার জন্য। কুশীলবের সঙ্গে কথা বলার মুহূর্তটা নিয়েই বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিত সে।

একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসের মধ্যেই মাথা ঘুরে একদম মাটিতে পড়ে গেল কেয়া। কলেজের ছাত্র আর কলিগদের তৎপরতায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় কেয়াকে। উচ্চরক্তচাপ, হার্টের সমস্যার কারণে লম্বাচওড়া প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে একমাস রেস্টে থাকতে বলে ছেড়ে দিলেন চিকিৎসক। সংসারের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে কৌশীর উপর। একাকী ছোট্ট একটা মেয়ের পক্ষে ঘর সামলে, অসুস্থ মায়ের দেখভাল করে কলেজে পৌঁছোনোটা খুব মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। তখন সুশোভন আর মীরাকে পাশে পেয়েছিল কেয়া। বাজার, দোকানপাট সমস্ত কিছুই করে দিত সুশোভন।

সেই সময় কেয়া অসুস্থ থাকায়, বাড়িতে অতিথি অভ্যাগতদের আপ্যায়ন কৌশীকেই করতে হতো। মীরা এলে কেয়ার পাশে দু-দণ্ড বসে গল্পগুজব করত, কিন্তু সুশোভন মায়ের থেকে বেশি মেয়ের সঙ্গেই সময় কাটাতে পছন্দ করত। অথচ আশ্চর্যরকম ভাবে কেয়ার উপস্থিতিতে দুজনের ব্যবহারেই কেমন যেন জড়তা লক্ষ্য করত কেয়া। তারা একাকী থাকলে যতটা উচ্ছল থাকে, কেয়ার উপস্থিতিতে সেটা বদলে যায়, এটা একাধিকবার খেয়াল করেছে কেয়া। আর এক অজানা ভয় ঘিরে ধরেছে তাকে। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে আর ভেবেছে, সুশোভন আর কৌশী? দুজনের মধ্যে বয়সের কত তফাত। কুশীলবের থেকে দু-চার বছরের ছোটো হবে হয়তো সুশোভন। বাবার বয়সি একজন লোক এভাবে একটা কচি মেয়ের সঙ্গে ইনভল্ভড… ছিছি, মনটা বিষিয়ে ওঠে কেয়ার। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় কেয়ার সুস্থতার খবর নিতে এসে, তাকে ভুলে গিয়ে বেহায়ার মতো নীচ থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চ্যাঁচাতে থাকে, ‘কৌশী, বড়ো রাস্তার দিকে যাচ্ছি, যাবে নাকি? চলো একটু ঘুরে এলে মনটা ভালো লাগবে। আর তোমার যদি কিছু নেওয়ার থাকে নিয়ে নিও।’ কৌশীও ‘আসছি’ বলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই চেঞ্জ করে খটখটিয়ে বেরিয়ে যেত।

কৌশী তো না হয় ছোটো, ভালোমন্দ সেভাবে বুঝতে শেখেনি? কিন্তু সুশোভন। ও কী করে এই অন্যায়টা করছে। সরলতার সুযোগ নিয়ে একটা ছোট্ট মেয়েকে… আচ্ছা ওরা ফিজিকালি ইনভল্ভ নয় তো? দৈহিক ক্ষিদে কী ওর এতটাই বেড়ে গেছে যে বয়সের ব্যবধানও তার নজরে পড়ছে না। মনটা ভয়ে শিউরে ওঠে কেয়ার। কথায় কথায় কৌশীর জন্য গিফট আনাটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না কেয়া। শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল কেয়া। ভাগ্য আজ ক্লিকও করে গেছে। চুড়িদারের সেট-এর সঙ্গে ম্যাচিং অ্যাকসেসরি নিয়ে ফিরেছে কৌশী আর সুশোভন। ঘরে ঢুকেই হাসতে হাসতেই প্যাকেটটা মায়ের দিকে বাড়িয়ে দেয় কৌশী, ‘এই দ্যাখো মা, আমাকে এগুলো কিনে দিয়ে…’ মেয়েকে কথা শেষ করার সুযোগ দেয় না কেয়া। তার আগেই বলে বসে, ‘ঠিক আছে দেখছি। তার আগে তুই একটা কাজ করতো, উপরে ওষুধটা রয়ে গেছে, নিয়ে আয় তো মা। আর শোন প্রেসক্রিপশনটার সাথে একবার মিলিয়ে নিস। নাহলে কোনটা বলতে কোনটা খেয়ে নেব।’ তারপরেই মুখের চেহারা বদলে যায় কেয়ার। ‘এসবের কিন্তু কোনও দরকার ছিল না। রোজ রোজ এভাবে। ওর কিছু কমতি তো রাখিনি আমি।’, বেশ দৃঢ় শোনায় কেয়াকে।

‘কেন এভাবে বলছেন বউদি, আমি কি ওকে কিছু দিতে পারি না। এটুকু অধিকারও কি আমার নেই? স্নেহ করি বলেই তো…’ বলেই কৌশীর মুখের দিকে তাকায় সুশোভন। সে নজরে স্নেহ নেই, আছে শুধু কামনা। সেই দৃষ্টি চোখ এড়ায় না কেয়ার। আপ্রাণ চেষ্টা করে কেয়া একটু সংযত হবার, কিন্ত যেখানে মেয়ের সম্মানের প্রশ্ন সেখানে তাকে রুখে দাঁড়াতে হবেই।

‘সরি কিছু মনে করবেন না, জানি আপনি আমাদের জন্য অনেক করেছেন। তার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। এর বেশি কিছু চাই না। আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন, আমি কী বলতে চাইছি। এবার আপনি আসুন।’ মাথা নীচু করে বেরিয়ে যায় সুশোভন।

খানিক হালকা লাগে কেয়ার। কতদিন ভেবেছে কুশীলবকে সবকিছু খুলে বলবে। নাম্বার ডায়াল করেও ফোনটা কেটে দিয়েছে এই ভয়ে যে, সবকিছু শুনলে কুশীলব কিছুতেই আর বিদেশবিভুঁইয়ে পড়ে থাকবে না। সবকিছু উপেক্ষা করে ছুটে আসবে। আর তো ক’টা মাস। সে ঠিক সামলে নেবে। ছেলেকে পর্যন্ত বলেনি এই সমস্যার কথা। ফাইনাল ইয়ার। পড়াশোনার ক্ষতি হোক চায় না কেয়া। মেয়ের কথায় সম্বিৎ ফেরে কেয়ার। ‘মা, ও-মা প্রেসক্রিপশনটা কোথায় রেখেছে সেটাই তো খুঁজে পেলাম না। মেলাব কী করে?’ বলতে বলতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নেয় কৌশী। তারপর খুব সহজ ভাবে প্রশ্ন করে বসে, ‘শুভ আঙ্কল কোথায় গেল?’ মেয়ের মুখে সুশোভনের নাম শুনে যেন মুহূর্তেই জ্বলে উঠল কেয়া।

‘ওনার কী কোনও কাজ নেই যে, দিবারাত্রি এখানে পড়ে থাকবেন। যাও নিজের ঘরে যাও।’ হঠাৎই মায়ের ধমকে চমকে ওঠে কৌশী। মায়ের রাগের কারণ খুঁজে পায় না সে। ধীর পায়ে নিজের ঘরের দিকে এগোতে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মায়ের সেই স্নেহমাখা ডাক, ‘শোনো কৌশী। এখন আর তুমি ছোট্টটি নও। বড়ো হয়েছ, কলেজে পড়ছ। নিজের ভালোমন্দগুলো নিজেকেই বুঝে নিতে হবে। আশপাশের মানুষগুলোকে চিনতে হবে। বুঝতে হবে, তারা কেমন। তারা তোমার থেকে ঠিক কী চাইছে। তারা কী সত্যিই তোমার শুভাকাঙক্ষী, নাকি…’ আর কথা বলতে পারে না কেয়া। মেয়ের মাথায় একবার হাতটা বুলিয়ে দেয়।

মায়ের কথার অর্থ আঁচ করতে পারে কৌশী। লজ্জায় সংকুচিত হতে থাকে সে। ‘ইস্ এতদিন তো সেভাবে ভাবেনি কখনও। তাহলে কি সত্যিই সে নিজের অজান্তে ভুল পথে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল, নাকি সে শুধু বাবার বন্ধু হিসেবেই বাবার শুন্যস্থানটা পূরণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু মায়ের অভিজ্ঞ চোখ, তাহলে কি কাকুর খারাপ কোনও অভিসন্ধি রয়েছে।’ মুখে কোনও কথা বলতে না পারলেও মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে কৌশীর।

‘কী হল, যাও। এভাবে দাঁড়িয়ে রইলে কেন?’ মায়ের কথায় চমকে ওঠে কৌশী। মায়ের হাতদুটো চেপে ধরে। ‘বিশ্বাস করো মা, আমি জানি না কাকু আমাকে কী নজরে দেখে, কিন্তু আমি কখনও ওনাকে…’ কেঁদে ফেলে কৌশী।

‘আমিও তোমার থেকে ঠিক এটাই আশা করেছিলাম। ঠিক আছে যাও, ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নেবে এসো। কাল সকালে আবার তোমার কলেজ আছে।’

রাতটা খুব নিশ্চিন্তে কাটে কেয়ার। অনেকদিন পর ভালো করে ঘুমিয়েছে সে। বুকের উপর চেপে বসা পাথরটা সরে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছে সে। সকালে টিফিন সেরে আর এক কাপ চায়ে চুমুক দিতে যাবে, ঠিক তখনই মোবাইলটা বেজে উঠল। মীরা কল করেছে। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে গলা ভেসে আসে মীরার, ‘শোন আজ আড্ডা মারার মুডে আছি, ভাবছি তোর বাড়িতে চলে যাই। তোর কোনও অসুবিধে নেই তো?’

‘অসুবিধের কী আছে, তুই এলে খুব ভালো লাগবে। জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। কিন্তু তোর কলেজ?’

‘আরে মাঝে মাঝে তো আমাদেরও ফাঁকি দিতে ইচ্ছে করে নাকি’ বলে হেসে ওঠে মীরা।

বারোটা নাগাদ মীরা এসে হাজির হয়। কেয়ার হাতে হাতে সে-ও খানিক কাজ এগিয়ে দেয়। তারপর খাওয়াদাওয়ার পর হাজারো প্রসঙ্গের মাঝে এসে ঢুকে পড়ে কৌশী।

‘জানিস আজকাল মেয়েটাকে নিয়ে খুব টেনশন হয়। একদম চালাকচতুর নয়। খুব ভয় করে। কতদিন আর নিজের কাছে রাখব বল, একটা সময় তো বিয়ে দিতেই হবে। অন্যের হাতে তুলে দিতেই হবে, কী যে করবে কে জানে।’ চিন্তার ভাঁজ পড়ে কেয়ার কপালে।

‘কী বোকা বোকা কথা বলিস বলতো, কতই বা বয়স ওর। এখনই এই সমস্ত ভাবছিস। তুই বরং এক কাজ কর, তোর অসুবিধা থাকলে ওকে আমাকে দিয়ে দে, আমি আমার অক্ষয়ের বউ করে নিয়ে যাব।’

‘ভেবে বলছিস, এ-মেয়ে কিন্তু কিচ্ছু পারে না। পরে বলিস না যে, আমি বলিনি।’

‘ওসব আমার উপর ছেড়ে দে। তাছাড়া পারার আছেটা কী-রে। আজ অবধি আমি সংসারের ক’টা কাজ করেছি যে ও-কে বলব কাজ করতে। পড়াশোনা করবে, বাড়ির মেয়ের মতো থাকবে ঘুরবে-ফিরবে। ব্যস আর কী চাই। তাছাড়া অমন মেয়ে আমি চাইলেই পাব কোথা থেকে।’ বলেই হো-হো করে হেসে ওঠে দুজনে। কেয়া কিছু বলার আগে মীরা প্রস্তাব রাখে, ‘বরং আগামী রবিবার তুই তোর মেয়েকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আয়।’

কথা কাটে কেয়া। ‘তার চেয়ে বরং সপরিবারে তোরাই চলে আয়। রাতের খাওয়াটা এখানে সারবি কিন্তু।’

‘শুধু আমরা কেন, যদি বলিস আরও দশ-বারো জনকে ডেকে নেব। শরীর একটু ভালো না হতে হতেই শুরু করে দিয়েছিস না।’

‘ইয়ার্কি ছাড় তো। বাড়িতে তো আমরা ওই মা আর মেয়ে। তোরা এলে ভালো লাগবে।’

‘ঠিক হ্যায় হুজুর। আপকে মনোরঞ্জন কে লিয়ে হাম আ জায়েঙ্গে’ বলেই আবার হো হো করে হেসে ওঠে মীরা। সঙ্গে কেয়াও।

এর মাঝে কুশীলবকে কিছুটা আভাস দিয়ে রাখে কেয়া। দু-বছর পরে হলেও, একমাত্র মেয়ের বিয়ের কথা ভেবেই মনটা ভিজে যায় কুশীলবের। কিন্তু মীরার পরিবারকে সে ভালোমতোই চেনে। এরকম পরিবারে সম্বন্ধ করার জন্য মা-বাবারা মুখিয়ে থাকে, সেখানে বাড়ি বয়ে এমন সম্বন্ধ এসেছে, এড়িয়ে যাওয়াটা বোকামো হবে। তাই আর কেয়ার প্রস্তাবে না করেনি কুশীলব।

আজ সকাল থেকেই মনটা বেশ ফুরফুরে কেয়ার। বাজার দোকান সমস্ত নিজের হাতে করেছে। তারপর থেকে চলছে রান্নার তোড়জোড়। এত আয়োজন দেখে কৌশী তো প্রশ্নই করে বসল, ‘কী ব্যাপার মা। এত তোড়জোড় কীসের? কেউ আসছে নাকি?’

‘এমনিই… অনেকদিন পর আজ শরীরটা ভালো আছে, তাই তোর মীরা আন্টিদের ডেকেছি। ওর ছেলে অক্ষয় এতদিন পর বাড়ি ফিরেছে, না ডাকলে খুব খারাপ লাগত রে। ও হ্যাঁ তুই-ও বাড়িতে থাকিস।’

‘কিন্তু মা, আমার তো টিউশন আছে।’

‘একটা দিন না গেলে কিছু হবে না। একবার ভেবে দ্যাখ, বাড়িতে লোক বলতে তো তুই আর আমি। ওদের ডাকলাম, এখন তুই যদি চলে যাস, ওদের খারাপ লাগবে না। তুই বরং তোর বন্ধুদের থেকে নোট নিয়ে নিস।’

‘ঠিক আছে মা।’

কথামতো সন্ধেবেলা মীরা, ডাক্তারসাহেব, অক্ষয়, অভয় সকলে এসে পৌঁছেছে কেয়াদের বাড়িতে। রসিক স্বভাবের ডাক্তারসাহেব ঢুকতে না ঢুকতেই বলেন, ‘কী ব্যাপার কেয়া, অসুস্থতার পরে মনে হচ্ছে আরও একটু বেশি সুন্দর লাগছে।’

‘এই বুড়ো বয়সে আমার বন্ধুর দিকে কেন নজর দিচ্ছ শুনি।’

‘কী করব বলো, সারাজীবন তো তোমাকে ছাড়া আর কাউকে দেখতেই দিলে না। এই বুড়ো বয়সে তো একটু ছাড়ো।’ সকলে মিলে হেসে ওঠে।

‘আগে ভিতরে তো আসুন। কথা তো আমারও আপনার সঙ্গে আছে।’

‘কী কথা, কী কথা, সবার সামনে বলা যায় নাকি, অন্য কোথাও যাবে…’

‘ও সত্যি পারেনও আপনি।’ মাকে অনেকদিন পর এভাবে হাসতে দেখে কৌশানীরও ভালো লাগে।

কৌশীও খুব তৎপরতার সঙ্গে সকলকে স্বাগত জানায়। স্ন্যাক্স আর কফি খেতে খেতে অক্ষয়-অভয়ের সঙ্গে বিভিন্ন কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে কৌশী।

কথার ফাঁকেই অক্ষয়কে লক্ষ্য করতে থাকে কেয়া। যেমন দেখতে তেমনি ব্যক্তিত্ব। টল, ডার্ক অ্যান্ড হ্যান্ডসাম যাকে বলে। আজকালকার ছেলেদের থেকে যেন একটু আলাদা। ব্যবহারের মধ্যেও একটা শালীন ব্যাপার রয়েছে তার। খুব মিশুকে, সবসময় মুখে হাসি লেগে রয়েছে। কেয়া যেমনটা চেয়েছিল ঠিক তেমনটাই। কৌশীর সাথে খুব ভালো মানাবে।

ডাক্তারসাহেব আর মীরা তো কৌশীকে ভালোমতো চেনে। আগাগোড়াই শান্ত স্বভাব আর ব্যবহারের কারণে কৌশী তাদের সুনজরে ছিলই। অক্ষয়কে দেখেও কেয়ার মনে হল তারও অমত হবে না। তবে এব্যাপারে কৌশীর কী প্রতিক্রিয়া হয় সেটাই দেখার।

গল্প করতে করতে হঠাৎই চোখ যায় ঘড়ির দিকে। কেয়া তৎপর হয়ে ওঠে। ‘দেখেছ, কথা বলতে বলতে বুঝতেই পারিনি দশটা বেজে গেছে। চলো চলো সবাই টেবিলে চলে এসো। এই যে ডাক্তারসাহেব আপনাকে কি আবার আদরআহ্লাদ করে নিয়ে যেতে হবে নাকি?’

‘সেই সৌভাগ্য কি আর আমার হবে?’

‘চলুন চলুন।’

‘হ্যাঁ, চলো।’

সকলে টেবিলে বসে পড়ে। কেয়া আর মীরা এক এক করে প্লেটে খাবার সার্ভ করতে থাকে। মায়ের কাজে হেল্প করে কৌশীও। খাবার শেষে অক্ষয় তারিফ না করে পারে না। ‘আন্টি, তোমার হাতের খাবার না, জাস্ট লাজবাব। মনে হচ্ছে তোমার হাতে খাওয়ার জন্য বারবার আসতে হবে তোমার কাছে।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার যখন মনে হবে চলে আসবে।’ হাসতে হাসতে জবাব দেয় কেয়া।

খাওয়াদাওয়ার পর্ব মেটার পর ফিরে যাবার সময় নিজের স্ত্রী-র উদ্দেশ্যে বলেন ডাক্তারসাহেব, ‘কী ম্যাডাম আপনি কি শুধু খেতে জানেন, নাকি খাওয়াতেও জানেন?’ মীরাও একবার বরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, ‘ওসব, আমাদের সারা হয়ে গেছে মশাই। ওরা আমাদের বাড়িতে রবিবার দিনই আসছে বুঝেছ।’

‘চলো তাহলে তো ঠিকই আছে। দুই বন্ধুতে মিলে যখন আগেই সেরে রেখেছ। বেশ বেশ, আসছি রে মা, ভালো থাকিস।’ ডাক্তারসাহেবের কথায় মাথা নাড়ে কৌশী। যাওয়ার সময়তে অক্ষয় একঝলক ভালো করে দেখে নেয় কৌশীকে। তারপর মুচকি হেসে গাড়িতে উঠে পড়ে।

ল্যান্ডফোনে সচরাচর এখন আর ফোন আসে না। মোবাইল হয়ে গিয়ে ওটা এখন খানিকটা শো-পিসের মতোই। কখনও-সখনও কোম্পানি থেকে ফোন আসে, কখনও আবার ফোনটা সচল রাখার জন্য কুশীলব ফোন করে। ল্যান্ডফোনের ব্যবহার বলতে এই। পরদিন সক্বালবেলাই ফোনটা হঠাৎ করে বেজে ওঠাতে চমকে ওঠে কেয়া। আগের দিনের খাটাখাটনির কারণে তখনও বিছানা ছেড়ে ওঠা হয়নি তার। ফোনের আওয়াজ পেয়ে উঠে পড়ে সে। সিঁড়ি বেয়ে নামার আগেই ফোনটা কেটে যায়। ফোনটা আবার বেজে ওঠে। কেয়া শুনতে পায় কৌশী ফোনটা ধরে বলছে, ‘দ্যাখো কাকু, আমার মা চায় না আমি তোমার সাথে কথা বলি। আর কী এমন প্রয়োজনীয় কথা যে, মোবাইল সুইচ অফ বলে ল্যান্ডে করতে হচ্ছে। মায়ের ধারণাই তাহলে ঠিক।’ রিসিভারটা নামিয়ে রাখে কৌশী। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সবটাই কানে আসে কেয়ার। একটু আশ্বস্ত হয়।

দেখতে দেখতে কেটে যায় আরও চারটে দিন। এর মাঝে মীরার সাথে বেশ কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে। অক্ষয়ের নাকি বেশ পছন্দ হয়েছে কৌশীকে। বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তে সে রাজি। আজও সকালে ফোন করেছে সক্বাল সক্বাল ওদের বাড়ি পৌঁছানোর জন্য। সেই মতো যাওয়ার তোড়জোড়ও শুরু করেছে কেয়া।

‘কৌশী আজ তুই ওই গোলাপি সালোয়ার-কামিজটা পরিস। ওটা তোকে খুব ভালো মানায়।’

‘কোনটা মা, গতবছর পুজোয় বাবা যেটা দিয়েছে।’

‘হ্যাঁ, ওটাই। চল চল তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। ওদিকে তোর মীরা আন্টির তিনচারবার ফোন করা হয়ে গেছে।’

তৈরি হয়ে পৌঁছোতে পৌঁছোতে সোয়া বারোটা বেজে গেছে। পৌঁছে দেখে ডাক্তারসাহেব, অক্ষয় সকলে হাত মিলিয়েছে রান্নার কাজে। কেয়াও হাত লাগানোর জন্য এগিয়ে যায়।

‘আরে তুই বস তো। একটা দিন ওদের করতে দে। আজ ওদের পরীক্ষা। দেখি না কেমন টেস্টি খাবার বানাতে পারে। দেখছিস না বাবা-ছেলে কেমন কোমর বেঁধে নেমেছে।’ কথাগুলো বলতে বলতেই মীরার চোখ চলে যায় কৌশীর উপর। ‘ওমা তোকে কী মিষ্টি লাগছে রে।’ বলেই গালদুটো টিপে দেয় মীরা। তারপর ডাক্তারসাহেবের দিকে ফিরে বলে। ‘আরে ডাক্তারসাহেব একটু এদিকেও দ্যাখো। একে দেখে তোমার রান্না যদি একটু সুস্বাদু হয়।’

লজ্জা পেয়ে যায় কৌশী– ‘ও আন্টি তুমিও না।’

অক্ষয়ের চোখে চোখ পড়ে যায় কৌশীর। সে-ও একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। চোখ নামিয়ে অন্যদের সাথে ব্যস্ত হওয়ার ভান করে সে। এদিক-ওদিককার নানা কথা হওয়ার পর মীরা চা বানাবার জন্য উঠতে গেলে কৌশী বলে, ‘চা আমি বানাচ্ছি আন্টি, তোমরা কথা বলো।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ মা, তাই কর। এরা যে কখন খেতে দেবে তার তো কোনও ঠিক নেই। ততক্ষণ না হয় একটু চা-ই খাই। তাছাড়া তোর আঙ্কল বানালে সে চা মুখে দেওয়া যাবে না।’ ডাক্তারসাহেবের বক্র দৃষ্টি দেখে সকলে হেসে ফেলে।

কৌশী চা বানাবার জন্য এগোতেই অক্ষয় তার দিকে এগিয়ে যায়– ‘চলো আমি তোমাকে হেল্প করছি।’

ততক্ষণে ডাক্তারসাহেবও রান্নার পরিসর ছেড়ে মীরার কাছে এসে বসেছে। দুজনকে একসাথে যেতে দেখে বলেন– ‘দুজনকে দারুণ মানাবে গিন্নি। কী বলো?’

‘সত্যিই মানাবে’ ডাক্তারসাহেবের কথায় সম্মতি প্রকাশ করে মীরা। তারপর কেয়ার উদ্দেশ্যে বলে, ‘কেয়া, ডাক্তারবাবুর আর আমার দুজনেরই কৌশীকে খুব পছন্দ। আমার মনে হয় অক্ষয়েরও মনে ধরেছে কৌশীকে। নাহলে অন্য সময় বিয়ের কথা বললে হাজারো বাহানা শুরু করে দেয়। কাল কৌশীর কথা বলতে হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দ্যাখ আমাকে তো ছেলের বিয়ে দিতেই হবে। এখন তুই যদি বলিস তাহলে কুশীলবদা ফিরলে আশীর্বাদটা সেরে রাখব। দু-বছর পর কৌশীর গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হলে বিয়ে হবে, ক্ষতি কী। তুই বরং কৌশীর মতামতটা জেনে নে।’

আনন্দে চোখে জল চলে আসে কেয়ার। মীরা যে তার কত বড়ো উপকার করল, সেটা একমাত্র কেয়াই জানে। গলা ভারী হয়ে আসে তার। ‘আমার মেয়ের কপালে যে এত ভালো একটা সম্বন্ধ লেখা রয়েছে, ভাবতেও পারিনি। অক্ষয়ের মতো ছেলে, তোদের মতো শ্বশুর-শাশুড়ি, এত ভালো পরিবার,’ আর কথা বলতে পারে না কেয়া। গলা আরও বুজে আসে তার।

পরিবেশ হালকা করতে ডাক্তারসাহেব বলে বসেন, ‘আরে ভাই আমরাই কী ভেবেছি আমাদের বুদ্ধুটার কপালে…’ বলতে বলতে থেমে যান ডাক্তারসাহেব। কপালে রেখার ভাঁজগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।’ ‘আচ্ছা চা-টা কী দার্জিলিং থেকে আসছে।’ সত্যিই তো কথার মাঝে কেউ খেয়াল করেনি সময়তো অনেকটাই গড়িয়েছে। এতক্ষণে তো বোধহয় চারবার চা বানানো খাওয়া হয়ে যেত। তখন মীরা আর কেয়া কয়েক কদম এগিয়েই আবার পিছিয়ে আসে। সম্ভবত বিয়ের প্রসঙ্গেই কথা হচ্ছে তাদের। যতদূর তাদের কানে আসে, ‘বাড়ির সবার ইচ্ছে তোমার সাথে আমার বিয়ে হোক।’

‘আঙ্কল, আন্টি তো বুঝলাম। আর তোমার?’ ক্ষীণ স্বর কানে আসে অক্ষয়ের।

‘তোমার কী মনে হয়?’ কৌশীর হাতদুটো ধরে অক্ষয়।

‘জানি না যাও’ বলে মাথা নীচু করে নেয় কৌশী।

আর সেখানে দাঁড়ায় না মীরা আর কেয়া। ধীর পায়ে ড্রয়িংরুমে ফিরে দুজনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর একসাথে হেসে ওঠে।

 

বৃষ্টি বৃষ্টি

আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে অঝোরে।

আকাশে কালো ঝাঁক মেঘ। বৃষ্টির দাপটে আর হাওয়ার ভারে কোথায় কোন দিকে চলে যাচ্ছে বোঝা মুশকিল। সকাল গড়িয়ে দুপুর হল ভিজতে ভিজতে, দুপুর গড়িয়ে বিকেলের মুখোমুখি অন্ধকার নামল। পুরো শহরটা বৃষ্টিতে ঝাপসা, তার ভেতরেই চলছে বাস, ট্রাম। ছাতা মাথায় লোকজন, বৃষ্টি বলে কাজ থেকে কোনও ছুটি নেই। তবে সব দৃশ্যাবলি পালটে গেছে! মনে হচ্ছে, অচেনা শহর যেখানে সব সময় বৃষ্টি হয়, খানিকটা চেরাপুঞ্জির মতন। কলকাতা তবে অঝোর বর্ষণে চেরাপুঞ্জি হল? হোক না। পালটে যাক সবকিছু– প্রকৃতি, শহরের ধুলোমাটি, মানুষজন।

গড়িয়াহাট থেকে ত্রিকোণ পার্কের রাস্তার কোনায় এই দোতলা রেস্তোরাঁ। দোতলায় জানলার ধারে বসে আছে শ্রেয়া। বৃষ্টিভেজা চেনা শহর সামনে। না, ঠিক চেনা নয়, নতুন শহর। ভেজা ট্রাম, বাস, ট্রাম লাইনে বুলেভার্ডের নাম জলে ডুবে গেছে। ডোবা ট্রাম লাইন, একটা ট্রাম দাঁড়িয়ে গেছে, এগোচ্ছে না, জল নামলে এগোবে। বুলেভার্ডের জলে মনে হচ্ছিল, এই শহরের গায়ে বড়ো নদী থেকে বান এসেছে। তার এখানে আসার পরে সন্ধে নেমেছে, মনে হচ্ছে, বেশ রাত। তাকে হাওড়ায় কদমতলায় ফিরতে হবে, অত দূরের গাড়ি পাওয়া একটু অনিশ্চিত এই ঝাম বৃষ্টিতে।

নীলেশের দেখা নেই, হয়তো আসবে না, বসিয়ে রাখবে।

যতটুকু সে জেনেছে, আজকাল তার আড্ডাখানা খালাসিটোলায়, মদে টালমাটাল হলেই সে নিজের মধ্যে নিজেকে ফিরে পায়। কোনও দিন ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ওদিকের বারের ছোটো নাচনি জুটে যায়। কোনও দিন গার্ডেনরিচের জুয়োর আড্ডা থেকে ফিরতে ফিরতে রাত ফুরোয়। সব কিছু খুইয়ে ওটাই খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরেছে নীলেশ। এমন পুরুষের ছায়াগ্রহ থেকে বেরিয়ে অনেকটা স্বস্তি পেয়েছে শ্রেয়া। প্রথমে সংকোচ, কষ্ট, লজ্জা ছিল, এখন কিছু নেই।

এই রেস্তোরাঁয় আসা নতুন নয়। যখন ওদের দু’জনের জানাচেনা, তখন থেকে। নীলেশ একটা পেন্টস্ কোম্পানির সেলসের নীচুতলার অফিসার ছিল। সপ্রতিভ, স্মার্ট চেহারা, মুখে অনর্গল বাংলা, ইংরেজি, কিছুটা হিন্দি। শ্রেয়া হাওড়ার বেলিলিয়াস রোডে একটা নামি ইংলিশ মিডিয়াম গার্লস স্কুলের টিচার। স্কুল রং করাবার টেন্ডারে নীলেশ এসেছিল। প্রিন্সিপালকে খুব স্মার্টভাবে রাজি করিয়েছিল। শ্রেয়ার দেখাশোনার মাধ্যমে কাজটি।

প্রথম পরিচয়টুকু যখন গাঢ় হল, টেন্ডারের লাভ-ক্ষয়ের পাওনাটুকু ওদের লুকোচুরি দিয়ে আরও এত কাছে এনেছিল, মনে হয়েছিল, ইট কাঠের বাড়ি কোনও আশ্রয় নয়। তারা দু’জনে পরস্পরের আশ্রয়। দুই বাড়িতে ওদের বিয়ের অভিমত একরকম ছিল না। তবু তারা সান্ত্বনা পেয়েছিল, যখন কোর্ট ম্যারেজ হয়ে গেল। নীলেশ ঠাট্টা করে ছুটির দিনে মাঝে মাঝে বলত, ‘তুমি কাগজের বউ’। সঙ্গে কিছুটা আদর আতিশয্য, মনে হতো, মেয়েলি জীবনে যা কিছু ধরাবাঁধা, তার বাইরে, শুধুই আনন্দ! দিশেহারা হয়ে যেত শ্রেয়া। তার মেয়েলি বয়সের আনাচেকানাচে।

ব্রাউন ড্রেস পরা কাজের ছেলেটা ওকে অনেকদিন থেকে চেনে, বছর তিনেক আগে তারা যখন এখানে প্রায়ই আসত। জানলার ওপিঠে রাস্তা, এপিঠে ছোটো টেবিল, এটাই ছিল তাদের পছন্দের জায়গা। কথা বলতে বলতে শহরটাকে মগ্ন চোখে দেখা। নীলেশ আচ্ছন্নের মতো অন্যরকম বলত। তারা শহরের কেউ নয়, শুধু দুটি মানুষের ভালোলাগা বলে এখানে থাকা। শহরটি নিজেই বড়ো জটিল, বিশ্রাম বলে কিছু নেই। তাদের দু’জনের পরস্পরের মনের জটিলতা কোথায়, কখন কেটে গেল, তারা বুঝতে পারেনি। জীবন তো এমনই, বোঝা যায় না!

নীলেশ তিরিশ, শ্রেয়া পঁচিশ। পাঁচ বছরের ফাঁকটুকু নিয়ে শ্রেয়া অন্য চোখে দেখত নীলেশকে। প্রথমে সমীহ খানিকটা দূরত্ব। ওটা একদিন সরে গিয়ে প্রেম-ভালোবাসা, সেটাও সরে গিয়ে প্রথম কদম ফুলের আমোদে শারীরিক সম্পর্ক। শ্রেয়ার বয়সটা আকুল-বিকুল। তখন মেয়েরা অবলম্বনই খোঁজে। পছন্দ-অপছন্দের আড়াল পড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক বা ওটা সরিয়ে আরও কাছাকাছি আসা।

কাজের ছেলেটা কাছে এসে দাঁড়াল, ‘দিদি, আর একবার চা, না কফি?’ শ্রেয়া মাথা নাড়াল, এখন নয়। ছেলেটা চলে গেল অন্য টেবিলে। ঘড়ি দেখল শ্রেয়া। নীলেশের আসার সময় ফুরিয়ে গেছে। মোবাইল নাড়াচাড়া করে দেখল। কোনও কল মেসেজ আসেনি। তার মোবাইল নম্বরটা এখনও নীলেশের ফোনে আছে. না মুছে গেছে?

বিয়ের দিনকাল বছর দুয়েক গড়াতেই তারা পরস্পরের কাছ থেকে মুছে যাচ্ছিল।

বাঘাযতীন স্টেশনে দু’ নম্বর প্ল্যাটফর্মের উলটোদিকে জলাজমি, ডোবা। তবু বাড়িঘর উঠছিল। ওখানেই একটা দোতলা ঘরের ওপরে দু’কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল নীলেশ। এদিকটা নাবাল বলে আরও অনেক ফাঁকা জমি ছিল তখন, এলোমেলো ছাঁদের কিছু বাড়িঘর। তখন ভোরের মিহি নৈঃশব্দ্য ভেঙে কয়েকজনের কীর্তনের দল চৈত্র-বৈশাখ দু’মাস খোল খঞ্জনি বাজিয়ে ঘরে ঘরে নামগান শোনাত। প্রোমোটারদের জমি দখল চলছিল। একদিন দলটা কবে, কোথায় চলে গেল, কেউ জানল না তেমন করে।

বাড়ির একটু দূরে একটা জলাভূমি ছিল, সেখানে থোকা থোকা শালুক, জলপিপি, কোঁচবক, কখনও কখনও পানকৌড়ি। মজা জলাভূমি, বর্ষার জল থৈ থৈ, অন্য সময় প্রায় শুকনো। বর্ষায় জলাভূমির পাড়ে কাশফুল ফোটে। ওটাও প্রোমোটারের দখলে, বুজিয়ে আবাসন উঠবে, বদলে যাবে চারপাশ।

তার আগেই বদলে গিয়েছিল নীলেশ।

বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে নানা অসংগতি ধরা পড়ছিল শ্রেয়ার চোখে। নীলেশের জুয়োখেলার, মদের নেশা, কাজে মন নেই। সে বুঝতে পারছিল, নীলেশের কাছে পরিবার, সংসার এসব অবান্তর কথা। জীবন আছে বলে, ওদিকে একটা মোড় নেবে, তা কেন? বিয়ের আগে স্বাভাবিক মেলামেশায় নিজের চরিত্রের অনেক কিছু আড়ালে রেখেছিল, জানতে দেয়নি।

কাজের প্রতি কোনও নিষ্ঠা ছিল না নীলেশের। পেন্টস্ কোম্পানিতে সেলসের কাজ, মাসের সেলস্ টার্গেট ছিল, সেটা কোনও দিনও পূর্ণ করতে পারেনি, চেষ্টাও ছিল না। পরিণতি এগিয়ে এল, একদিন চাকরিটা আর রইল না। তারপরই উড়নচন্ডী ও ছন্নছাড়া জীবন। টাকাপয়সা ও অন্যান্য ব্যাপারে শ্রেয়ার মুখাপেক্ষী, তাও বেশ জোর খাটিয়ে। খালাসিটোলায় মদের আড্ডা, নাচনি-বারের মেয়েদের কাছে যাওয়া, জুয়োর দান ফেলা, টাকা উঠলে ঘরে না ফেরা। এক অবাঞ্ছিত কষ্ট, ভাঙচুর নিয়ে শ্রেয়ার জীবন নানা নিন্দায় জড়িয়ে যাচ্ছিল।

শেষে ঘর ছাড়তে হল। বাঘাযতীনের ভাড়ার ঘর ছেড়ে হাওড়ার কদমতলায় বাবার বাড়ি। একবছরের মাথায় ডিভোর্স নেওয়ার সব কাগজপত্র তৈরি। কেস আদালতে উঠবে। নিজেকে নতুন করে গুছিয়ে নিয়েছে শ্রেয়া। মুছে ফেলেছে পুরোনো জীবন। একটা ঘটনা কোনও দিনই মোছা যাবে না, তার যৌবনের কুমারীত্ব নেই, সেটা লুঠ হয়ে গেছে নীলেশের হাতে। এই লুকোনো জায়গাটা কাউকে বোঝানো যায় না, দেখানোও যায় না। নীলেশ ভেবেছিল, ওটুকু দিয়েই সে শ্রেয়ার হাতে দড়ি পরিয়ে বেঁধে রেখেছে কিন্তু শ্রেয়া ততদিনে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, সব কাছের মানুষ কাছের হয় না। নীলেশ তার জীবনে প্রকৃত মানুষ ছিল না, চোখে একটাই শৌখিন নেশা ছিল শরীর লুঠপাটের।

নীলেশ এখনও বাঘাযতীনের ভাড়ার ঘরে থাকে, টাকাপয়সা কোথা থেকে পাচ্ছে, কে জানে। শ্রেয়ার জানারও দরকার নেই। সে পাঠ বছর খানেক হল উঠিয়ে দিয়েছে। আজ সকালে তাকে ফোনে বলেছিল, ডিভোর্সের কাগজে সই করতে হবে। দু’জনের বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া ভালো।

শ্রেয়া যখন কথা বলছিল, ঘরের দরজা বন্ধ, বাইরে অশ্রান্ত বৃষ্টি, ফোনের আওয়াজ ভালো শোনা যাচ্ছিল না, তবু নীলেশকে সব বলেছিল, পুরোপুরি বিচ্ছেদের কথা। সঙ্গে সঙ্গে সে রাজি। বিকেল বা সন্ধের সময় ত্রিকোণ পার্কের রেস্তোরাঁয় আসতে বলেছিল। তার বাড়ি থেকে ত্রিকোণ পার্ক দূর নয় কিন্ত শ্রেয়ার কদমতলা থেকে দূর। সেই দূর ভেঙে এসে পড়েছে শ্রেয়া। এর পেছনে আর একটা নতুন জীবনের হাতছানি ছিল।

এখনও সমানে বৃষ্টি, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, মেঘ ডাক দিচ্ছে, নীলেশ আসেনি।

তার শর্তে শ্রেয়া রাজি হয়েছিল। ডিভোর্সের কাগজপত্রে নীলেশ সই করবে, তার বদলে হাজার দশেক টাকা চাই। এটাই তার শেষ দাবি, এরপর তো জীবন থেকে মুক্তি। কথাগুলোয় কোনও হূদ্যতা ছিল না। হাসি ছিল চিবিয়ে চিবিয়ে। কাছাকাছি না থেকেও যথেষ্ট অত্যাচার করা যায়। নীলেশের বাইরে ও ভেতরটা সবই ধরা পড়ছিল। এ জিনিস যে লুকোনো যায় না।

শ্রেয়া মোবাইলে ডায়াল করল নীলেশকে, রিং হচ্ছে, তুলছে না। লাইন কাটল সে। এখন অনিশ্চিতভাবে বসে থাকতে হবে এখানে, কতক্ষণ কে জানে। হয়তো নীলেশ আসবে না। তার বিদ্রূপের হাসি বারবার কানে বেজে উঠছিল। কাগজে সই করার বাহানায় বারবার তাকে ডেকে পাঠাবে, সইয়ের দরও বাড়িয়ে দেবে, তবু আসবে না। স্বস্তি নেই। রাগে, ক্ষোভে শ্রেয়া আনমনা হয়ে যাচ্ছিল। নীলেশ মানুষটা যে এত স্বার্থপর, এটুকু জানা ছিল না। তার জীবনটা বারবার বৃষ্টিতে ভিজেছে– প্রথম প্রথম শান্ত, নির্মল আনন্দে, আনন্দটুকু ফুরিয়ে গেলে বেলাটুকু ফুরিয়ে গেল, তখন ঝমঝম দামাল বৃষ্টি।

অনেকক্ষণ থেকে চায়ের কাপটা সামনে রাখা। বৃষ্টি বাতাসে কখন ঠান্ডা হয়ে সর পড়েছে। এটা আর খাওয়া যাবে না। রাস্তায় বাস, ট্রাম আগের মতো, বৃষ্টি বলে কোথাও কিছু বন্ধ হয়নি। শহর থামতে জানে না। সুখ দুঃখ নিয়ে তার জীবন যে কোথায়, কখন থেমে গেল, সেটা আজ আর মনে পড়ে না। ওখানে উঁকিঝুঁকি দিয়ে আর লাভ কী? ওই জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা উদ্বেগ, দুর্ভাবনা, নীলেশের তাকে নিয়ে ছেলেখেলা। সব কিছু ফুরিয়ে তার চারপাশে শূন্য হয়ে যাওয়ার বেদনা, দুঃখ।

সেই শূন্য জীবনটা আবার ভরে দিতে চাইছে অতীন বলে একজন।

তাদের গার্লস স্কুলের সায়েন্সের টিচার অতীন মিত্র, একই বয়সি। স্কুলের পরিবেশে নানা কিছুতে মানিয়ে নিতে তাকে সাহায্য করেছে। দু’জনে বেশ কাছাকাছি এখন। বাইরে কত খোলা আলো বাতাস নির্জনতা! শ্রেয়া হাঁপিয়ে উঠেছিল। এখন তার নানা অনুশোচনা কিছুটা খেয়ালিপনায় চাপা পড়ে গেছে, মূর্ত হয়ে উঠেছে নতুন জীবন।

গত রবিবারে মেঘলা দিনে তারা চলে গিয়েছিল ত্রিবেণী সঙ্গমে।

হুগলি-রূপনারায়ণ-দামোদর এই তিন নদীর সঙ্গম গাদিয়াড়ায়। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য! মেঘলা দিন, কিন্তু সারা দুপুর বৃষ্টি ছিল না। লোকাল ট্রেনে উলুবেড়িয়া স্টেশন। ওখান থেকে বাস, ঘন্টা দেড়েক পরে গাদিয়াড়া। ভ্যান রিকশায় নদীর পিকনিক স্পটে। খাবারের প্যাকেট সঙ্গে। সারা দুপুরটা সেখানেই কাটিয়েছিল শ্রেয়া ও অতীন। বিকেলের মুখে ঝেঁপে বৃষ্টি চারদিক আঁধার করে, নদীর মোহনা ঝাপসা। ফেরা হয়ে ওঠেনি সেদিন। একটা হোটেলে দু’জনকে রাত কাটাতে হয়েছিল। পরের দিন সকালে ফেরা।

সারারাত নদী মোহনার, সঙ্গমের ঝড়বৃষ্টি।

তিন নদীতে বৃষ্টির শব্দ, আলাদা নয়, একই – ঝমঝমাঝম। রাতে আলো চলে গেল। লোডশেডিং। সেদিন শ্রেয়ার জীবনে এক পশলা বৃষ্টি নেমেছিল সেই নির্জন, নিঃসঙ্গ রাতে। আগের সমস্ত গ্লানি তাকে জড়িয়ে ছিল না, ক্রমশ খুলে যাচ্ছিল, এক পরম শান্তি। অতীন মিশে যাচ্ছিল পুরোপুরি শ্রেয়ার সঙ্গে। অতীনের কাছে টর্চ, জ্বালতে দেয়নি শ্রেয়া।

বাইরে বৃষ্টি, ঘরে বৃষ্টি।

দুটো বৃষ্টি এক নয়। দুটো বৃষ্টি এক নয়, দাপট এবং গহনতা, মগ্নতা, সব আলাদা আলাদা, কারও সঙ্গে কারও মিল নেই। এত বৃষ্টির ধারা? তবু মনে হচ্ছিল, এক স্তব্ধতার ভেতর তারা দু’জনে হয়ে উঠেছিল ব্যাকুলতর। শ্রেয়ার ব্যাকুলতা ফুল কুড়োবার মতো কুড়োচ্ছিল অতীন।

সকালে ব্রেকফাস্টের সময় কথাটা তুলেছিল সে। সারারাত বৃষ্টির পরে শান্ত, ধোয়া, ঝিমধরা ভোর। নদীর বাতাসে গাছপালায় দোলন। কোথাও মলিনতা নেই। তিন নদী মিলেমিশে একাকার। রাতেও তো তারা ওরকম মিলেমিশে…।

‘আমাদের বিয়ের আগে তোমার ডিভোর্সটা হয়ে যাওয়া দরকার।’ অতীন কফি খাচ্ছিল।

‘হ্যাঁ, তাই হবে।’

কথা দিয়েছিল শ্রেয়া। যেটুকু দিলে নিজের বিমূঢ়তা বোঝানো যায়, সেটুকু সে অতীনকে সে রাতেই দিয়েছে। কোথাও কোনও উদ্বেগ ছিল না। সব ব্যাকুলতা শান্ত হয়ে ছিল নিজের মতো। খোলা ছাদে অন্ধকারে জ্যোৎস্নার আবিলতায়। কী সুখ, কী সুখ! একবারও নীলেশের কথা মনে হয়নি। সে আর অতীন, দু’জন মানুষ তুমুল বৃষ্টিতে মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল। নদীটা উঠে এসেছিল ঘরে, তারা ডুবে গিয়েছিল। স্পষ্টই মনে হচ্ছিল, এ-ডোবা জলে ডোবা নয়, অন্য কিছু।

শ্রেয়া দেখল, নীলেশ ঢুকছে।

অবিন্যস্ত, ভেজা চেহারা। ভেজা চুল, মুখ। ভেঙে পড়া চেহারা। ভাঙা গাল, চোখ বসা, চোখের নীচে কালো ছাপ। ময়লা শার্ট। আগে হাতে ঘড়ি থাকত। এখন নেই, জুয়োর অড্ডায় হয়তো বিক্রি হয়ে গেছে। টলায়মান চেহারা। শ্রেয়ার সামনে চেয়ারে বসতে মদের গন্ধ পেল শ্রেয়া। গা গুলিয়ে উঠছিল। নিজেকে চেপে রাখল। যে কাজে এসেছে, তার ভাঙনটুকু নয়, আসলটুকু নিয়ে ফেরা। মুখ বুজে নীলেশের সব বিরোধিতা সহ্য করতে হবে, অপূর্ণ বলে কিছু নিয়ে সে ফিরবে না।

‘বৃষ্টির জন্যে আসতে দেরি হল।’ হাসল নীলেশ। ‘স্কুলে পড়েছিলাম ইমপেশন্ট রেইন, এটা তাই।’

‘কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আমি কখন থেকে বসে আছি এখানে।’

‘গার্ডেনরিচ, বেহালা হয়ে আসছি। দুটো জুয়োর আড্ডায় জিতেছি।’

জামার কলার তোলা, এলোমেলো। মুখে দাড়ি, হয়তো শেভ-টেভ করে না। কথাগুলো স্পষ্ট নয়, জড়িয়ে যাচ্ছিল। অর্ডার নিতে সেই ছেলেটা এল, নীলেশকে দেখে মাথা ঝোঁকাল। দু’কাপ কফি আর এক প্লেট ডিম টোস্টের অর্ডার দিল শ্রেয়া। নিজের জন্যে শুধু কফি। বাইরে সমানে বৃষ্টি, গাদিয়াড়ার নয়, কলকাতার। এখানে কোনও বিস্তৃত মোহনা নেই, শুধু ঘরবাড়ি। সাগরের নিম্নচাপ কি বাড়ল? তাকে তো ভিজতে ভিজতে অনেক দূর যেতে হবে– সেই কদমতলা।

শ্রেয়া ব্যাগ থেকে ডিভোর্সের কাগজ বের করল। কোথায় কোথায় সই করতে হবে দেখাল। নীলেশের জামার পকেটে পেন নেই। ব্যাগ থেকে নিজের পেন বের করে দিল শ্রেয়া। নীলেশ চেয়ে আছে তার দিকে, কৌতূহল নেই। অন্যমনস্ক। মুখ তুলে বাইরের বৃষ্টি দেখল। কাগজ দেখছে না, পেনটা ঘোরাচ্ছে। হাওয়ায় কাগজ উড়ে যাচ্ছিল, হাত দিয়ে চেপে রাখল শ্রেয়া। মনে হল, জীবনকে সে হাত দিয়ে চেপে রেখেছে, কাগজ নয়। নীলেশের কাছে এ কাগজ হুড়মুড় করে বৃষ্টি ঢোকার মতো নয়। কিছু একটা পৌরুষেয় অপূর্ণতা, কোথায় তার কষ্ট, মুখে ফুটে উঠছে। মুখ ঘোরাল সে শ্রেয়ার দিকে, সেখানে একরাশ দুর্বলতা, হাসিখুশির চিহ্ন নেই। এ মুখে একদিন আনন্দ ছিল, এখন কিছু নেই।

‘তুমি চলে গেলে বাড়ি ছেড়ে’ নীলেশ আরও অন্যমনস্ক হয়ে গেল নিজের ভেতর। হয়তো ওরকম প্রচ্ছন্নে থাকতে তার ভালো লাগে। ‘আমি এখনও ওখানেই আছি। কষ্ট করে ভাড়া জুটিয়ে আসছি, যে মাসে জুয়োয় টাকাপয়সা পাই, অসুবিধে হয় না, না পারলে ভাড়া বাকি। বাড়িওলা মেনে নিয়েছে। সবসময় যে কাজের মেয়েটি ছিল, তাকে এখনও রেখেছি। যেদিন খুব ড্রিংক করে আসি, সে আমাকে যত্ন করে ঘরে তোলে। তারও জানা হয়ে গেছে, আমার সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা নেই, নপুংসক। তুমি জানার পরে বাড়ি ছেড়েছিলে, ও কিন্তু ছাড়েনি।’

রেস্তোরাঁর ছেলেটা কফি, টোস্ট নিয়ে এল। সাজিয়ে চলে গেল। টেবিলে ডিভোর্সের কাগজের ওপর ব্যাগ চাপা দিল শ্রেয়া, উড়ে না যায়। এ যেন মাটির তলার কোনও একটা বীজ, মাটির ওপরে উঠে এসেছে, সামলে রাখতে হবে। নীলেশ একবারও কাগজটা দেখল না। কাঁটাচামচে ডিমটোস্ট খাচ্ছে। বেশ খিদে, ঠোঁট দিচ্ছে কফিতে। ওর হাত কাঁপছে, কফির কাপটা পড়ে না যায়, হয়তো মদটা আজ বেশি হয়ে গেছে বৃষ্টির দিনে। আগেও বৃষ্টিভেজা রাতে ঘরে মদের বোতল ঢুকত।

সংসারে যা কিছু মেয়েলি প্রাপ্য তা পাবে বলেই নীলেশকে নিয়ে ঘর বেঁধেছিল শ্রেয়া। তার কিছুই সে পায়নি। রাতে বিছানায় নীলেশ শুধু জেগে থাকত, বুকে ব্যথা বা নেশার ঘোরে ঘুমিয়ে পড়ত। একবারও ফিরে তাকাত না শ্রেয়ার দিকে। শ্রেয়ার তখন বড়ো কষ্টে মনে হতো, সে বিবাহিত হলেও সংসারে প্রাপ্য বলে মানুষটির কাছে কিছুই নেই। দু’জনের সম্পর্ক ভেঙে দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করেছিল।

‘তোমার কি বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালো লাগে?’ নরম, হালকা, আন্তরিক গলায় এমন একটা কথা শুনে অবাক হল শ্রেয়া। বৃষ্টিও কি মানুষকে বদলে দেয়? সম্পর্কগুলো ধুয়ে মুছে যায়, না নতুন করে জোড়া লাগে? চেনা মানুষটাকে কৌতূহল নিয়ে দেখল শ্রেয়া।

টোস্ট খাওয়া হয়ে যেতে প্লেট সরিয়ে রাখল নীলেশ। খালি কফির কাপটা শ্রেয়ার কাপের পাশে রাখল, পাশাপাশি কিন্তু মাঝখানে একটু ফাঁক। দুটো খালি কাপের এটাই হয়তো সান্ত্বনা, তারা পাশাপাশি আছে।

নীলেশ কাগজের দিকে হাত বাড়াল। ব্যাগের নীচ থেকে কাগজটা বেশ আগ্রহ নিয়ে বের করে দিল শ্রেয়া। পাশেই পেন পড়ে আছে। পেন তুলে নিল নীলেশ, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল। দেখছিল না, ভাবছিল কিছু। তার ভাঙাচোরা চেহারা দেখে শ্রেয়ার হঠাৎ মনে হল, এই নীলেশকে সে চেনে না। সে কি কাগজে সত্যিই সই করবে, কি করবে না? বড়ো আশা নিয়ে এসেছে শ্রেয়া আজকের প্রবল বৃষ্টিতে। আর একটা জীবন তার নাগালের বাইরে, যদিও গাদিয়াড়ার বৃষ্টিতে ভিজেছিল দু’জনে। ওই জীবনটাও কি কোনও শূন্য জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে? এক জীবনে কত পুরুষকে সে দেখবে?

‘সই দেওয়ার পরে আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে?’

নীলেশ সই করল! পেনটা শুইয়ে রাখল কাগজের পাশে। অবাক হল শ্রেয়া। রোগীরা ওষুধ খাওয়ার আগে যেমন শুকনো হাসি হাসে, বাহানা করে, নীলেশের ইচ্ছে তেমনই যেন কিছু, বলছে না।

‘সম্পর্ক শেষ করার জন্যই তো কাগজপত্রে সই করা। এ কাগজ যাবে কোর্টে, জজের বিচারে ডিভোর্স হবে। আমরা তখন বিচ্ছিন্ন পরস্পরের কাছ থেকে।’

‘বি-চ্ছি-ন্ন শব্দটি বেশ। এই বৃষ্টিবাদলার দিনে শব্দটি শুনতে ভালো লাগছে। আমার কিন্তু আরও শর্ত আছে। আসলে আজ দু’বোতল ঠাররা নিয়েছি, মাথাটা ঠিক কাজ করছে না, কোনটা নকল কোনটা আসল বুঝতে পারছি না, ঝাপসা লাগছে। তোমাকে ঠিক দেখা যাচ্ছে না, চেনা যাচ্ছে না– সব ঝাপসা ঝাপসা, অথচ একদিন তুমি আমার ছিলে। তোমার সবই আমার চেনা– রূপ, যৌবন, শরীর।’

চমকে উঠল শ্রেয়া। নীলেশের অনেক কথাতে চমক ছিল। স্পষ্ট হয়ে উঠত না অনেক কিছু– তাদের একসঙ্গে থাকা, নরনারীর স্বাভাবিক বা গোপন সম্পর্ক, কিন্তু আজ অন্যরকম লাগছে তাকে। পুরুষ যখন ঝাপসা হতে থাকে তখন তার আর নিজের অন্তর নিয়ে হয় বড়ো মুশকিল।

‘শর্ত তো তোমার একটাই, দশ হাজার টাকা চেয়েছিলে, এনেছি।’ শ্রেয়া ব্যাগে হাত রাখল– ‘চেন খুলতে হবে, টাকাটা ভেতরে।’

‘আমি তো ভুলেই গেছলাম। দাও।’

ব্যাগের ভেতর পাঁচশ টাকার কুড়িটা নোট রবার ব্যান্ডে বাঁধা। সেটা বের করে নীলেশকে দিল শ্রেয়া। টাকাটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল নীলেশ। হাতের তালুতে কয়েকবার বাজাল। বৃষ্টি দেখল জানলা দিয়ে। ঘন বৃষ্টি, ট্রাম লাইন ঝাপসা, ভেজা আলোর নীচে বাস, ট্রাম। এই দুর্যোগের বেলাতেও সবাই চলমান।

হঠাৎ শ্রেয়ার ব্যাগ কাছে টেনে নিল নীলেশ। চেন খুলে পুরো টাকার বান্ডিল ঢুকিয়ে রাখল। ‘এটা আমার কাছে থাকলে জুয়োয় বা মদে উড়ে যাবে। খালাসিটোলায় পড়ে থাকব, কোথাও যাব না। আমার শর্ত ফিরিয়ে নিলাম।’

শ্রেয়া দেখল ডিভোর্সের কাগজটা এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে টেবিলে, পেনটা চাপা দেওয়া। হাওয়ায় কাঁপছে, বিয়ে ভাঙার কাগজ। শ্রেয়া কাগজের বউ নয়। মানুষ, যুবতি। অতীনকে গুছিয়ে নিয়েছে নতুন ঘর বাঁধার। চিরটা কাল সে ভাঙা ঘাটে নৌকো লাগিয়ে থাকবে না, ঘাট বদল করবে।

‘আমার অন্য শর্ত আছে সই করার।’

নীলেশ হাসল। দুর্বল মুখে হাসিটা আরও দুর্বল, বেমানান। শ্রেয়ার সঙ্গে সে বাগড়া করতে আসেনি, কোনও অসদাচরণ নয়। শ্রেয়া কথা বলল না, বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। মুখ তুলল, সে মুখে প্রশ্নের চিহ্ন কিন্তু শব্দ নেই। ঘরের ভেতরে উজ্জ্বল আলো, পাখাও চলছে।

‘আজকের রাতটা আমার সঙ্গে কাটাতে হবে, বাঘাযতীনের বাড়িতে, তারপর কাগজে সই করব।’

শ্রেয়ার মনে হল, চারদিকে নিরবচ্ছিন্ন আঁধার, ঘুটঘুটে, দামাল বৃষ্টি। কত রকম শব্দ ভাসছে। ভাসতে ভাসতে দূরে চলে যাচ্ছে। নীলেশ তুচ্ছ, তার খালাসিটোলাটা উঠে আসছে দু’হাত বাড়িয়ে। জুয়োর পাশা ফেলেছে নীলেশ। পাশার দান বেয়ে তাকে ঘরে উঠতে হবে, সেখানে শুরু হবে রাতের দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ খেলা।

শক্ত হল শ্রেয়া, ‘তোমার শর্তে আমি রাজি নই।’

‘আসলে বাইরে বৃষ্টি পড়ছে তো। বৃষ্টি পড়লে মন নরম হয়। আমি মোদো-মাতাল। বৃষ্টিতে বদলে যাই। অ্যান্টিসোশ্যাল লোকও বৃষ্টি দেখে ভাবে, কোনও মেয়েকে ভালোবাসবে। বৃষ্টি দেখে আজ আমার পুরোনো ঘরের কথা মনে পড়ল, তুমি আর আমি। বেশ যেও না।’ নীলেশের নরম গলা।

নীলেশ ডিভোর্সের কাগজটা নিয়ে শ্রেয়া যেখানে সই করতে বলেছিল, সই করল। কাগজটা হাতে দিল। ব্যাগবন্দি করল শ্রেয়া। ‘রাত হচ্ছে, বৃষ্টির রাত। আমাকে সেই কদমতলায় ফিরতে হবে।’

‘সেইজন্যই তো কাছাকাছি করে তোমাকে ডেকে ছিলাম। যা কিছু পাপ, ধুয়ে ফেলার ইচ্ছে, এই বৃষ্টিতেও সেটা হল না। ঠিক আছে, যাও।’

নীলেশের দিকে তাকাল শ্রেয়া। আত্মতৃপ্তি না হলে মুখ যেমন বিষণ্ণ ভাঙাচোরা মনে হয়, ঠিক তেমনি। মদের ঘোরে টলমলে, চকচকে চোখ, একটা অসহায় অন্য জগতের মানুষ। এলোমেলো চুল নেমে এসেছে কপালে, সবই হতশ্রী, বোঝা যায়।

‘বৃষ্টিটা পুরোনো কথা মনে পড়িয়ে দেয়।’ বলল নীলেশ। ‘একবার বৃষ্টির দিনে ছাদে আমরা দু’জনে ভিজেছিলাম, মনে আছে? তুমি গাইছিলে– বারি ঝরে ঝরঝর, আজ বারি সারাদিন। এখনও ভুলিনি কিছু। ছোটোবেলায় বৃষ্টিতে কাগজের নৌকো ভাসাতাম, ডুবে যেত। তোমার ডিভোর্সের কাগজে তৈরি নৌকোটা ভাসিয়ে দিলে ভেসে যাবে, ডুবে যাবে।’

‘না, ডিভোর্সটা আমার চাই।’

অতীনকে নিয়ে শ্রেয়া মুক্তির আনন্দ চাইছে। খালাসিটোলার মানুষের বৃষ্টিতে ভেসে যাবে না সে। কতদিন একা একা। ভালো লাগছে না কিছু। কাঁধে ব্যাগ নিল সে, দরজার কাছে গিয়ে একবার পেছন ফিরল শেষবারের মতো। নীলেশ জানলায় বৃষ্টি দেখছে। এই বৃষ্টিতে তার পুরোনো নেশা ফিরে এসেছে, শ্রেয়াকে নিয়ে রাত কাটাবে। ওটা কি খালাসিটোলার নেশা থেকে আরও গাঢ়, আরও আনন্দময়, নাকি পুরোটাই বেদনাময়?

সে দেখল, দুটো খালি কাপ পাশাপাশি, মাঝে একটু ফাঁক বা দূরত্ব। থাক না দূরত্বটুকু। কী দরকার কাছাকাছি আসার? এলেই টুঙ্ শব্দ উঠবে, সেই নাড়াচাড়ায় হয়তো একটা কাপ ভেঙেও যেতে পারে। দূরত্বে থেকেও তো তার জীবনটা ভেঙে গেল। সবই অসময়– জীবন, বৃষ্টি।

রাস্তায় বেরিয়ে শ্রেয়া দেখল, বেশ জোরেই বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা খুলল সে। একটা ডবলডেকার বাস ভিজতে ভিজতে আসছে, মাথায় লেখা – হাওড়া। এই বাস অনেক বছর বন্ধ ছিল, আবার শুরু হয়েছে। এগিয়ে গেল সে বাসের দিকে।

পেছনে তাকালে সে দেখতে পেত, রেস্তোরাঁর জানলার বাইরে নীলেশের মুখ ঝুঁকে আছে। কাউকে খুঁজছে। বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে আসছে মুখটা, সেই সঙ্গে ঝাপসা– সমস্ত নিঃসঙ্গতা, সম্পর্ক, ঘরবাড়ি। কারও কোনও অপেক্ষা নেই। বৃষ্টি– বৃষ্টির মতো ঝরল। শ্রেয়া চলে গেল।

সম্পর্কের সমীকরণ

সময় কারও জন্য থেমে থাকে না রাহুল। সে তার নিয়মেই বয়ে চলে। মানুষ বর্তমান নিয়েই বাঁচে। কাল কে দেখেছে বলতো?’

‘ফিলোজফি ঝেড়ো না তো অরিদা। যখনই দেখা হয়, তোমার সেই একই কথা। সবসময় মানুষের মনে আঘাত দিতে ভালো লাগে? তোমাদের মতো করে যারা ভাবে তাদের জন্যই আমাদের মতো কষ্টে জর্জরিত মানুষগুলো বাঁচার আশাই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।’

‘বাঁচার আশা ছাড়বে না, বরং আরও ভালো করে বাঁচতে শিখবে! কখনও কারও মনে দুঃখ দেবে না, আর কেউ কষ্টে থাকলে তাকে মাঝ দরিয়ায় ছেড়েও দেবে না। আমরা মানুষ রাহুল। সমাজে বাস করি। রোজ না জানি কত লোকের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, তাদের সকলের সঙ্গেই যে আমরা ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি এমনটা তো সম্ভব নয়। কখনও কখনও তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে ফেলি। কটু কথাও বলে ফেলি। সেক্ষেত্রে তৎক্ষনাৎ একটা ‘সরি’ বললেই প্রবলেম সলভড্। কোনও কিছু কালের উপর না ছাড়াই ভালো, কারণ কাল কখনও আসে না।’

‘গতকাল দেরি করে অফিসে আসার জন্য আমি আমার চাপরাশিকে দু-চার কথা শুনিয়েছি। তাই বলে আমি তার কাছে ক্ষমা চাইব নাকি?’

‘ওনার দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করেছিস একবারও? যদি তিনি রোজই দেরি করে অফিস পৌঁছন তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু যদি তিনি আগে কোনওদিন দেরি না করে থাকেন, শুধুমাত্র সেইদিনই… তাহলে নিশ্চয়ই কোনও বিশেষ কারণ থাকবে। ওই ভদ্রলোক তোর বাবার বয়সি। সারাদিনে সকলের সঙ্গে কত তো কথা বলিস। তার থেকে যদি দু-চারটি বাক্য ওই মানুষটার জন্য ব্যয় করিস, তাতে তোর জাত যাবে? যদি একটা ‘সরি’ বলিস, কী হবে তাতে? মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?’

‘কী বলতে চাইছ বলোতো? তোমার কথা অনুযায়ী আমাকে তাহলে সুগার কোটেড ট্যাবলেট-এর মতো করে বাঁচতে হবে। বাইরে থেকে মিষ্টি আর ভিতরে তেতো।’

‘বাইরে মিষ্টি ভিতরে তেতো কেন হবে? তাহলে তো ভিতরে ভিতরে নিজেকেই জ্বলতে হবে। আমরা নিজেকেও জ্বালাব না আর কাউকে কষ্টও পেতে দেব না।’

রবিবার। কোথায় রাহুল ভেবেছিল আজ একটু বেশি ঘুমোবে, এগারোটার আগে কোনও মতেই বিছানা ছাড়বে না। রোজই তো সকাল সাতটায় উঠে কোনওরকমে নাকে-মুখে গুঁজে অফিস ছুটতে হয় তাকে। যদিও তার দুশ্চিন্তা তাকে কতটা শান্তিতে ঘুমোতে দেয় কে জানে! সে ছুটে বেড়ায় শান্তির খোঁজে। আজকাল বাড়িতেও ভালো লাগে না রাহুলের। সংসারে মোটে তিনটে প্রাণী। মা-বাবা আর সে। তারা কেউ কথা বলে না রাহুলের সঙ্গে। রাহুলও কথা বলার সাহস পায় না।

ঘড়িতে তখন সবে আটটা দশ। কানের কাছে বেজে উঠল মোবাইল ফোনটা। ঘুম চোখে বিরক্তিমাখা মুখে ফোনটা কানে দেয় রাহুল—

‘হ্যালো, কে বলছেন?’

‘আরে অরিজিৎ বলছি রে।’

‘আরে হ্যাঁ। বলো বলো। হঠাৎ কী মনে করে এত সকালে ফোন করলে? সিরিয়াস কিছু?’

‘না রে তেমন সিরিয়াস না হলেও তোর সঙ্গে কিছু দরকারি কথা আছে। তাছাড়া অনেকদিন দেখাও তো হয়নি। আজ বিকালে আমাদের বাড়িতে আয়, তখনই সব কথা হবে। তোর বউদিও বাপের বাড়ি গেছে। তুই এলে আমারও কম্প্যানি হবে।’

‘এই কথাগুলো একটু বেলায় বললে খুব অসুবিধা হতো? শুধুশুধু আমার ঘুমটা মাটি করে দিলে। আচ্ছা ঠিক আছে, কখন যেতে হবে বলো?’

‘এক কাজ কর সকালেই চলে আয়। একসঙ্গে লাঞ্চ করব। দুজনে মিলে যা হোক একটা কিছু বানিয়ে নেওয়া যাবেখন।’

‘ঠিক আছে, আমি ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আসছি।’

অরিজিৎ, অতুলের বেস্ট ফ্রেন্ড। লম্বা, চওড়া, সুঠাম দেহ তার। দেখতেও বেশ সুদর্শন। কলকাতারই একটি নামিদামি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চিফ্ অ্যাকাউন্ট্যান্ট, মাত্র সাত মাস বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে সে।

অতুলদের বাড়িতে নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল অরিজিতের। সে প্রায় বাড়িরই একজন হয়ে উঠেছিল। বাড়িতে হইহুল্লোড়, আনন্দ, হাসি-ঠাট্টা, মজা, সুখ-দুঃখ সবেতেই সামিল হতো সে। অতুলের মতো অরিজিৎও হয়ে উঠেছিল রাহুলের অরিদা। অতুলের অকাল মৃত্যুতে তার আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রাহুলদের বাড়িতে।

আজ সেই সম্পর্কের টানেই একটা ফোন পেয়ে অরিদার বাড়িতে ছুটে আসা রাহুলের। এর আগেও বহুবার এখানে এসেছে সে অতুলদার সঙ্গে। চার মাস আগে যখন এসেছিল তখন বারান্দায় বসানো বেলফুলের চারাগুলি সবে ডানা মেলছিল। আজ তাতে ফুল ভরে গেছে। পুরো বারান্দা গন্ধে ম ম করছে। কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল রাহুল।

— ‘কী রে শুনছিস কী বললাম? কোথায় হারিয়ে গেলি?’ অরিজিতের কথায় চমকে উঠল রাহুল।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, কী যেন বলছিলে? মাঝে মাঝে কী যে হেঁয়ালি করে কথা বলো না, কিছুই বুঝি না। মাথার উপর দিয়ে যায়। লোককে ভুরিভুরি উপদেশ দেওয়ার রসদ কোথা থেকে পাও বলো তো। কপালে একটা বড়ো লাল তিলক আর গেরুয়া বস্ত্র গায়ে চড়িয়ে বসে যাও। প্রচুর টাকা কামাবে।’

‘দ্যাখ, ভগবানের দয়ায় টাকার অভাব নেই আমার। আর গেরুয়া বস্ত্র কেন পরব বলতো? যারা সংসার ত্যাগ করে তাদের ওই পোশাক মানায়। তাদের মতো আমি তো মহামানব নই, আর ভবিষ্যতেও সংসার ত্যাগ করার কোনও পরিকল্পনাও আমার নেই। আমি সংসারী মানুষ। সারাজীবন সংসার নিয়েই সুখে-দুঃখে কাটাতে চাই। দায়িত্ব থেকে পিছপা হওয়ার মতো ছেলে আমি নই। আর অতটা দয়িত্বজ্ঞানহীনও হতে পারব না।’ অরিজিৎ বেশ উত্তেজিত হয়েই কথাগুলি বলল।

‘কোথা থেকে কোথায় চলে এলে অরিদা? কী বলছ কিছুই বুঝলাম না। আর হঠাৎ করে এত উত্তেজিতই বা হয়ে গেলে কেন?’

‘এত ছোটো তো তুই নোস, যে আমার কথা বুঝতে পারছিস না। কী করছিস ভেবে দেখেছিস একবারও। নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছিস? মেয়েটার কী হবে বলতো?’

এতক্ষণে রাহুলের বোধগম্য হল যে অরিদা কী বলতে চাইছে। তার আর মৌসুমির সম্পর্ককে ঘিরেই এত জল্পনা। সেই সম্পর্ক যেটা না রাহুল বহন করতে পারে আর না সহন করতে পারে।

‘তুমি আমার জায়গায় থাকলে কী করতে?’

‘হয়তো আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতাম। দাদার মৃত্যুর পর কখনও তার বিধবা স্ত্রীকে গ্রহণ করতাম না। মা-বাবা যতই চ্যাঁচামেচি করুক, অন্যায় আবদার করুক, না বলে কাটিয়ে দিতাম। অন্তত তাদের রোজ তিল তিল করে মরার জন্য ছেড়ে দিতাম না। যদি সম্পর্ক রাখারই না ছিল তাহলে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলি কেন? আমি এরকম সম্পর্কে কখনও আবদ্ধ হতাম না যেটা আমার নিজের এবং অন্যের জীবনের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াবে।’

‘যদি এই সম্পর্ক ওর মৃত্যুর কারণ হয়, তাহলে আমিও তো ক্রমশ সেই দিকেই এগোচ্ছি। না পারছি গিলতে, না পারছি ফেলতে। আমিও যে ভালো নেই অরিদা।’

‘ভালো থাকবি কী করে বলতো? চার মাস ধরে মেয়েটা বাপের বাড়িতে পড়ে আছে। অতুলের মৃত্যুর পর একবারও তাকে চোখের দেখা দেখতে যাসনি। এখনও সময় আছে রাহুল, সব দ্বিধা কাটিয়ে যা ওর কাছে। দায়িত্ব যখন নিয়েছিস ওকে ওর মর্যাদা দিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আন ভাই।’

চুপ করে থাকে রাহুল। এর কী জবাব দেবে সে নিজেই জানে না। বোধহয় সেই উত্তর খোঁজার জন্যই হারিয়ে যায় তার উদাসীন মন।

মৌসুমি বাবা-মায়ের আদরের একটিই মাত্র মেয়ে। লম্বা, ফর্সা, ছিপছিপে চেহারা। টানা টানা চোখ, টিকালো নাক, ছোট্ট কপাল–যাকে বলে প্রকৃত সুন্দরী। বিএ পড়তে পড়তেই বান্ধবীর সূত্রে অতুলের সঙ্গে আলাপ। তারপর প্রেম এবং পরে বিবাহ। অতুল সরকারি কর্মচারী এবং সৎ হওয়ার কারণেই মৌসুমিদের বাড়ি থেকে কোনও আপত্তি ওঠেনি।

শ্বশুর, শাশুড়ি, দেওর আর স্বামীকে নিয়েই ছিল তার সুখের সংসার। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সে সুখ তার কপালে বেশিদিন সইল না। বিয়ের সাত মাস পরেই ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট-এ মারা গেল অতুল। সেদিন মৌসুমির জন্মদিন ছিল। মৌসুমিকে উপহার দেওয়ার জন্য একটা লাল রঙের জরিপাড় শাড়ি এবং একতোড়া গোলাপফুল কিনেছিল সে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়েই এই দুর্ঘটনা। খবর পেয়ে তারা যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছল, তখনও লাল টুকটুকে শাড়ি আর গোলাপের তোড়া সেইখানেই পড়ে ছিল। শাড়িটা হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল মৌসুমি। একটা সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল সে।

তিনদিনে সমস্ত কাজ মিটে যাওয়ার পর অখিলেশবাবু তার মেয়ে মৌসুমিকে পাকাপাকি ভাবে সঙ্গে করে নিয়ে চলে যেতে চাইলেন তাদের বেহালার বাড়িতে।

সেকথা শোনা মাত্রই রাহুলের মা-বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এমনিতেই পুত্রশোকে তারা মৃতপ্রায়, তার উপর আবার তাদের স্নেহের বউমার বাড়ি থেকে চলে যাওয়াটা তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তারা কাঁদতে কাঁদতে শুধু অখিলেশবাবুর পায়ে ধরতে বাকি রেখেছেন। কত অনুনয়-বিনয় করেছেন মৌসুমিকে এ বাড়িতে রাখার জন্য। কিন্তু তাঁর একটাই কথা, এখানে থেকে সে কী করবে। কী পরিচয়ে থাকবে? অতুলের বিধবার পরিচয়ে! সেটা তিনি কিছুতেই হতে দেবেন না। আবার তিনি অন্যত্র মেয়েকে পাত্রস্থ করবেন।

এ সমস্তকিছুই লক্ষ্য করছিল রাহুল। এমন সময় তাকে দেখে মা মীনাদেবী ছুটে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার হাত দুটি ধরে পীড়াপীড়ি শুরু করে দেন। একমাত্র সে-ই পারে মৌসুমিকে এ বাড়িতে রাখতে। সে যদি মৌসুমিকে বিয়ে করে তাহলে মৌসুমি এ বাড়িতে বউয়ের সম্মান নিয়েই চিরজীবন থেকে যেতে পারে।

কিন্তু সেটা রাহুলের পক্ষে কীভাবে সম্ভব? যাকে সে এতদিন বউদি বলে ডেকে এসেছে, বন্ধুর মতো মিশেছে তার সঙ্গে, তাকে সে কীভাবে নিজের স্ত্রী হিসাবে মেনে নেবে? শুধু তার কেন, কারওর পক্ষেই কি এটা সম্ভব?

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এই প্রস্তাবটা নিয়ে কোনও জোরালো প্রতিবাদ করলেন না অখিলেশবাবু। শেষ পর্যন্ত শত চেষ্টা করেও মা-বাবার এই শোকার্ত আবেদন এড়িয়ে যেতে পারেনি রাহুল। সে বাধ্য হয়েছিল মৌসুমির মাথায় সিঁদুর তুলে দিতে। কিন্তু হায়, ভাগ্যের কী পরিহাস! যাকে নিয়ে এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত, সে স্থানুবত এক পুতুল। অতুলের নয়, রাহুলের স্ত্রী, হিসাবে জীবনটা অতিবাহিত করতে তার আপত্তি আছে কিনা তা নিয়ে কোনও মতামত চাওয়া হয়নি মৌসুমির।

এরপর অখিলেশবাবু প্রায় জোরাজুরি করেই পনেরো দিনের জন্য মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের বাড়িতে। তারপর কেটে গেছে চার চারটি মাস। এবাড়ির কেউ মৌসুমিকে আনেওনি, এমনকী ফোন পর্যন্ত করে খবর নেয়নি। এই নিয়েই যত অশান্তি। বাবা-মা রাগে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছেন রাহুলের সঙ্গে। তাদের রাগ বাড়ির বউ আর কতদিন বাপের বাড়িতে পড়ে থাকবে।

সহসা কলিং বেল-এর আওয়াজে চমকে ওঠে রাহুল। দুধওয়ালা দুধ দিয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে আবার বলতে শুরু করল রাহুল। ‘সময় মানুষকে কখন কোন পরিস্থিতিতে দাঁড় করাবে আগে থেকে তা কে বলতে পারে অরিদা? মানছি ওর দায়িত্ব আমি নিয়েছি। দায়িত্ব এড়াতেও চাই না। ভেবেছিলাম যে, সমস্যা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা আরও জটিলাকার ধারণ করল। সব থেকে বড়ো সমস্যা হল আগে একরকম করতাম আর এখন অন্যরকম ব্যবহার। মৌসুমির সঙ্গে নতুন সম্পর্ক তো দূর, পুরোনো সম্পর্কটাই কীভাবে সামলাব বুঝতে পারছি না। ও ছিল আমার বউদি কাম বেস্ট ফ্রেন্ড। সমস্ত আলোচনাই করতাম ওর সঙ্গে। এমনকী কবে কোন মেয়ের পিছনে লাগলাম, কার প্রেমে পড়লাম সমস্ত কিছুই। মাঝেমধ্যে দাদা আমাকে বলত, ‘কখনও তোর বউদিকে আমার সঙ্গেও একটু-আধটু সময় কাটাতে দে।’

একদিন তো এমনও হয়েছে, ‘বউদি বউদি’ করে ডেকেই যাচ্ছি। বউদির কোনও সাড়া নেই। যে-বউদিকে ডাক দিলেই সমস্ত হাতের কাজ ফেলে ছুটে আসে, তার আজ কী হল! আবার ডাকলাম, – এল না। ‘বউদি একবার এসো, তোমাকে কিছু দেখানোর আছে।’ খেতে বসেও সেই একই ব্যাপার। সকলের সঙ্গে কথা বলছে, শুধু আমার সঙ্গে বলছে না।

এইসব দেখে মা ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করার কারণ। সেদিন কোনও উত্তর দিতে পারেনি সে। উত্তরের পরিবর্তে শুধু মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে ও।

পুরো ব্যাপারটাই বুঝতে পেরেছিল দাদা। বসে বসে মুচকি হাসি হাসছিল। পরে দাদার থেকে জানতে পারি দাদা নাকি ইয়ার্কি করে ওকে বলেছে, ও দাদার থেকে আমাকেই বেশি ভালোবাসে। তাই সারাদিন মুখ গোমড়া করে রেখেছিল।

কথাটা যে আমিও ভালোভাবে নিতে পেরেছিলাম তা কিন্তু নয়। আমারও কেমন যেন একটা খটকা লেগেছিল। শুধু মনের কোণে একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল, আমাদের দেওর-বউদির সম্পর্ককে দাদা অন্যরকম ভাবে নিচ্ছে না তো?

বাড়িতে বেশ একটা গুরুগম্ভীর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। মৌসুমির মুখের হাসি ফিরিয়ে আনতে দাদা যখন ওকে আমার ঘরে নিয়ে এসেছিল, তখনও কাঁদছিল ও। আমাকে দেখে আরও বেশি করে কাঁদতে শুরু করেছিল। সেদিন প্রথম আমি ওর মাথায় হাত রেখেছিলাম।

সব শুনে অরিজিৎ বলল, ‘মৌসুমিকে ভালো যে বাসিস তা তোর কথায় স্পষ্টই বোঝা যায়। তবে এটা ঠিক যে তোর ভালোবাসার ধরনটা ছিল আলাদা। এখন তোদের সম্পর্কের সমীকরণটা বদলেছে। মানছি এক সম্পর্ক থেকে হঠাৎ করে অন্য সম্পর্কে যাওয়াটা খুব সোজা নয়। কিন্তু অসম্ভবও তো নয়। এই সংসারে কত লোকই তো আছে যারা এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, তারা কি সুখে ঘর করছে না বল?’

অতীত ভুলে যা ভাই, বর্তমানে ফিরে আয়। আমার বিশ্বাস তুই পারবি।’

‘কী করে বলো?’

‘আজ বিকেলে মৌসুমিদের বাড়িতে যা। ওর সঙ্গে কথা বল। আগের মতো ওর ভালো বন্ধু হয়ে যা। পাশে বস। তুই যেমন তোর ভাইকে হারিয়েছিস ও-ও তো স্বামীকে হারিয়েছে, তাই না?’

‘ওর স্বামী নাকি বন্ধু কোন পরিচয়ে গিয়ে দাঁড়াব ওর কাছে? তুমি যাবে আমার সঙ্গে?’

‘অবশ্যই যাব। এক কাজ করি আমি মৌসুমিকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। তখন কথা বলে নিস।’

‘না অরিদা। প্লিজ ওকে এনো না।’

রাহুল হঠাৎই থামিয়ে দিয়েছিল অরিজিৎকে। সে ভয় পেতে শুরু করেছিল। কীভাবে সে মৌসুমির সামনে গিয়ে দাঁড়াবে?

রাতে বাড়ি ফিরে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ে রাহুল। মনে মনে ভাবতে থাকে তার সমস্ত সুখশান্তি দাদা কেড়ে নিয়ে গেছে। অরিদা ঠিকই বলেছে, কতদিন আর এরকম চলবে? কিছু তো একটা ডিসিশন নিতেই হবে। কিন্তু তার আগে এটাও তো জানা দরকার মৌসুমি তার ব্যাপারে কী ভাবে? সে কী চায়? এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে রাহুল।

পরদিন সকাল সাতটায় অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙে রাহুলের। কোনও রকমে নাকে মুখে গুঁজে রওনা দেয় অফিসে। পথটাও অনেকটা। সেক্টর ফাইভ। প্রায় দশ কিলোমিটার। ভালো পোস্টে আছে রাহুল। বেতনও পায় বেশ মোটা অঙ্কের।

অফিস শেষ করে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয় রাহুল। চড়ে বসে গাড়িতে। কিন্তু আশ্চর্যের কথা বাড়ি না গিয়ে এ কোথায় এল সে! তার অবচেতন মন তাকে কোথায় নিয়ে এল? এ যে মৌসুমিদের দরজার সামনে এসে গেছে সে! মৌসুমির মা-বাবা তাকে দেখতে পেয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন। তাদের কাছ থেকে সে জানতে পারে মৌসুমি অসুস্থ। অতুলের মৃত্যুর পর থেকেই সে অবসাদে ভুগছে।

মৌসুমির ঘরে ঢোকা মাত্রই চমকে উঠল রাহুল-এ কী অবস্থা তার। চোখে-মুখে কালি পড়ে গেছে, চুল উশকোখুশকো, জরাজীর্ণ চেহারা। ফর্সা টুকটুকে রং একেবারে কালো হয়ে গেছে।

অতুল মৌসুমিকে খুব ভালোবাসত। বলত ‘এই পাগলিটাকে নিয়ে কী করি বলতো? এই যুগে এত সহজ, সরল হলে সমাজে বাঁচবে কী করে। কী করে সামলাব এই মেয়েকে আমি?’

রাহুল বলতো, ‘ভালোই তো, আসল সোনা পেয়েছ, তাতে খাদ মেশানোর চেষ্টা করছ কেন?’

‘আমি মরে গেলে কী হবে ওর? বাঁচবে কেমন করে? সমাজে বাস করতে হলে একটু চালাক-চতুর হতে হয়।’

‘কেন বাজে কথা বলো, বলো তো। ভালো কথা বলতে পারো না।’ সেদিন দাদার এই কথায় চেঁচিয়ে উঠেছিল রাহুল। কী জানি, দাদা কী তার মৃত্যুর কিছু পূর্বাভাস পেয়েছিল, নাকি এমনিই! মৌসুমিকে দেখে রাহুলের মনে পড়ে গেল কথাগুলো।

মনে মনে ভাবতে থাকল বাবা-মা বিশ্বাস করে তার হাতে সঁপে দিয়েছিল মৌসুমিকে। আর সে কী করছে। তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। তার এই অবস্থার জন্য নিজেকেই দূষতে থাকে সে।

এমন সময় মৌসুমির বাবা বলেন, ‘মউ দ্যাখ মা আমার, কে এসেছে তোর সঙ্গে দেখা করতে। দ্যাখ রাহুল এসেছে। রাহুলের সঙ্গে কথা বল মা। কতটা দূর থেকে এসেছে তোর সঙ্গে দেখা করতে।’

চুপ করে বসেছিল মৌসুমি। আর কী কথাই বা বলবে? কী-ই বা বলার আছে? তাদের দুজনেরই ভবিষ্যৎ অন্ধকারে আর অতীত তো চিরজীবনের মতো দিশাহীন করে দিয়ে গেছে। রাহুলের দিকে দেখল সে। সেই নিশ্চল চোখ। রাহুলের চোখে জল এসে যায়। দাদার মুখটা চোখের উপর ভেসে ওঠে। যেন আসল সোনা তার হাতে তুলে দিয়ে দাদা বলছে ‘দেখিস ভাই আমার মৌসুমির দায়িত্ব এবার তোর। তুই ছাড়া আর কাকেই বা এই গুরুদায়িত্ব দিতাম বল। বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যা রাহুল। বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যা।’

রাহুলের চোখ জলে ভরে গিয়েছিল। সহসা নিজের হাতের উপর একটা স্পর্শ অনুভব করার সঙ্গে সঙ্গে কানে এল, ‘কেমন আছো রাহুল?’

উত্তর দিতে না পেরে হাউহাউ করে কেঁদেই ফেলল রাহুল। মনে হচ্ছিল যেন দাদার দাহ সংস্কার করে সবে ফিরেছে সে। দাদা মরে গিয়ে বেঁচে আছে, আর তারা বেঁচেও মরে আছে।

‘রাহুল। কাঁদছ কেন?’

অল্পক্ষণেই রাহুলের মনে হল যেন তার দেহ-মনের জ্বালা একেবারে জুড়িয়ে গেছে। কোথা থেকে যেন শান্তি ফিরে এসেছে। মৌসুমি তার আঁচল দিয়ে রাহুলের চোখ মুছিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।

মৌসুমির বাবা রাহুলকে ঘরে দিয়েই চলে গিয়েছিলেন। কেউ থাকলে মৌসুমিকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথাটা অন্তত পাড়তে পারত সে।

মৌসুমি বলে ওঠে, ‘সোজা অফিস থেকে এসেছ না? কিছু তো খাওয়াও হয়নি মনে হয়। তুমি বসো। আমি কিছু নিয়ে আসি।’ এই বলে কোনওরকমে দেয়াল ধরে ওঠার চেষ্টা করে সে।

‘না খেতে ইচ্ছে করছে না’, বলে মাথা নাড়ায় রাহুল।

‘সবাই কেমন আছে? আমার কথা বাবা-মায়ের মনে পড়ে?’

‘আগে বলো বাড়ি যাবে আমার সাথে? সবাই তোমাকে খুব মিস করে।’ সাহস করে বলেই ফেলে রাহুল।

‘এখন আর ওখানে গিয়ে কী করব, কে আছে আমার?’

‘কেন এরকম বলছ?’

‘তুমি খুব ভালো করে জানো রাহুল, ওখানে আর আমার আপন বলতে কেউ নেই, তবুও…।’

কথাগুলি শুনে দম বন্ধ হয় আসে রাহুলের। তাহলে কি মৌসুমি মনে করতে চাইছে না তাদের সম্পর্কটা এখন কী? হতবাক দৃষ্টি নিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে রাহুল। যদি তাকে সাহায্য করার জন্য কেউ আসে। ওর মা-বাবা যে কেউ একজন।

‘কী হল রাহুল? তোমাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?’ মৌসুমি তার হাত দুটি ধরে বলল।

‘তুমি আমার সঙ্গে বাড়িতে চলো। তোমাকে ছাড়া কিছু ভালো লাগে না। বাড়ি যেন গিলতে আসে। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায়। কেউ কারওর সঙ্গে কথা বলে না’, বলতে বলতে আবার কেঁদে ফেলে রাহুল।

‘আমি গিয়ে কী করব বলো তো? ভগবান ও বাড়িতে ওই পর্যন্ত অন্ন মেপেছিল আমার জন্য।’

‘বারবার অতীতটাকে ফিরিয়ে আনতে চাইছ কেন? যে গেছে সে কি আর ফিরে আসবে?’ বেশ চিৎকার করেই কথাগুলো বলল রাহুল। কথাগুলো যেন নিজের কানেই বড়ো বাজল রাহুলের।

চিৎকার শুনে ছুটে এল মৌসুমির মা-বাবা। কখন যে তার মধ্যে অধিকারবোধ জন্মাল সে নিজেই জানে না।

রেগেমেগে তার মা-বাবার উদ্দেশ্যে রাহুল বলতে থাকে, ‘আপনারা কেন সবকিছু জানাননি ওকে। আপনারাই তো জোর করেছিলেন। তাহলে ওকে বলেননি কেন? চুপ করে আছেন কেন? আমাকে মাটির পুতুল ভেবেছেন, যখন যা খুশি তখন তাই করাবেন। বোঝান ওকে সত্যটা কী। আমি আর পারছি না মৌসুমি। তুমি কি কিছুই বুঝতে পারছ না, নাকি আমাকে যাচাই করছ? প্লিজ দয়া করো আমাকে, চলো বাড়ি চলো। আমি মানছি আমার ভুল হয়ে গেছে, বিগত চার মাসে একবারও তোমার খোঁজ নিইনি। কিন্তু সঙ্গে এটাও তো সত্যি একটা মুহূর্তের জন্যও তোমাকে ভুলতে পারিনি।’ বলতে বলতে সকলের সামনেই মৌসুমিকে জড়িয়ে ধরে সে।

এতদিন রাহুল-যে সম্পর্কটাকে বোঝা ভাবত, সেটা যে তার কাছে কী তা সে আজ টের পাচ্ছে। মৌসুমির তাকে অস্বীকার করা, সেটা কোনওভাবেই মানতে পারছে না সে।

‘আবার কাঁদে। আরে কাঁদছ কেন? কী হয়েছে তোমার রাহুল? আমি তো ভলোই আছি এখানে। এখানে আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না।’

এমন সময় মৌসুমির বাবা অখিলেশবাবু রাহুলকে অন্য ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ‘চার মাস একটা খবর পর্যন্ত নাওনি। আমার মেয়ে আমার কাছে বোঝা নয়। তাকে দুবেলা খেতে দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। ঘাড় থেকে বোঝা নামাব বলে তোমার উপর মেয়ের দায়িত্ব দিইনি রাহুল। ভেবেছিলাম আমরা বুড়ো-বুড়ি আর ক’দিন। তারপর অন্তত মেয়েটাকে দেখার কেউ থাকবে।’

‘বাবা, তুমি রাহুলের সঙ্গে এইভাবে কথা বলছ কেন?’ কোনওরকম ভাবে মৌসুমি উঠে এসেছিল তাদের কাছে।

‘দাদার মৃত্যুর পর আমাদের এই আকস্মিক বিয়ে। তারপর থেকে আমিও তো ভালো নেই। শুধু ভেবেছি কী করব? ওর কী হবে? ও কীভাবে নেবে। প্রতিদিন একটু একটু করে মরছি। আর আপনারা ভাবছেন আমি চিন্তা করি না।’

‘রাহুল তুমি কি সত্যি কথা বলছ? তুমি মন থেকে মেনে নিতে পেরেছ এই বিয়ে? বলো আমাকে।’

‘ঘরে চলো তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার।’, হয়তো বাবা-মায়ের জুড়ে দেওয়া সেই অধিকারের জোরেই মৌসুমির হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে রাহুল নিয়ে যায় পাশের ঘরে। দরজা বন্ধ করে দেয়। অল্পক্ষণের জন্য দুজনেই চুপ করে যায়।

জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় মৌসুমি। কাছে যায় রাহুল। বলতে থাকে—‘খুব কষ্ট দিয়েছি না তোমাকে? আচ্ছা তুমিও কি তাই মনে করো? আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই তোমার খোঁজ নিইনি? কিন্তু বিশ্বাস করো একটা মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি তোমার উপস্থিতির কথা। তখন বুঝতেই পারিনি তুমি আসলে আমার কী? দাদা চলে গেছে কিন্ত আমি তো বেঁচে আছি। তোমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাব না। সারাজীবন তোমার সঙ্গেই থাকব। যেদিন তোমার মাথায় সিদুঁর দিয়েছিলাম সেদিন যে-শপথ নিইনি আজ তা নিলাম।’

কথাটা শোনা মাত্রই চিৎকার করে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে মৌসুমি। বাইরে থেকে মেয়ের কান্না শুনে পড়িমরি করে দরজা খুলে ছুটে আসেন মৌসুমির মা-বাবা। মেয়েকে চুপ করানোর জন্য এগিয়ে আসতেই হাত দেখিয়ে বাধা দেয় রাহুল। হাত জোড় করে বলে ‘দয়া করে আপনারা যান আমি সামলে নেব।’

‘মৌসুমি শোনো, আমার কথা শোনো। দ্যাখো আমার দিকে একবার দ্যাখো।’

তাকে কিছুতেই সামলাতে পারছে না রাহুল। একপ্রকার জোর করেই মৌসুমিকে চেপে জড়িয়ে ধরে রেখেছে কোনওমতে। ‘অভিমান হয়েছে? রাগ হয়েছে? বলো তুমি সত্যিই বোঝো না তোমার আমার সম্পর্ক?’

মৌসুমি শুধু একটা কথাই বলে চলে–‘না এটা হতে পারে না। আমি তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিতে পারি না।’

রাহুল বাহুবলে আরও কাছে টেনে নেয় মৌসুমিকে। একেবারে বুকের কাছে। এতটাই কাছে যে তার প্রতিটি হূদয়ের স্পন্দন অনুভব করে সে। সে এক আলাদা অনুভূতি, যেটা সে আগে কোনওদিন অনুভব করেনি।

রাহুল বলতে থাকে-‘কে বলেছে তুমি আমার জীবন নষ্ট করেছ? তুমি জানো না তুমি আমাদের কাছে কী সোনা–বলতে বলতে মৌসুমির কপালে চুমু খায় রাহুল। যাকে গলার কাঁটা ভাবতাম সেটাই যে গলার হার হয়ে দাঁড়াবে তা কি আগে জানতাম? বুঝলামই যখন তখন…’

চুপ করে রাহুলের বুকে মাথা দিয়ে থাকে মৌসুমি। এখন সে অনেকটা শান্ত।

দুই হাত দিয়ে মৌসুমির মুখটি তুলে ধরে বলে, ‘যাবে তো আমার সঙ্গে, যাবে না? কিছু বলবে না? আচ্ছা ঠিক আছে বলতে হবে না।’

রাহুল বুঝে যায় মৌসুমির নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ।

 

ফেরা

বদলির চাকরি অনুজার। রিটায়ারমেন্ট-এর আর বছর ছয়েক বাকি। তার মধ্যে আবার নাগপুরে ট্রান্সফারের অর্ডার। চাকরির সুবাদে প্রায় তিরিশটা বছর ঘরসংসার, স্বামী-সন্তান ছেড়ে থাকতে হয়েছে তাকে। তিনবছর আগে কলকাতায় পোস্টিং হওয়ার সময়তেই ঠিক করেছিল এবার কলকাতার বাড়িতেই পাকাপাকিভাবে থেকে যাবে। হাজার হোক এখানেই তার পরিবার। ভিআরএস নেওয়ার ডিসিশন নিয়েই ফেলেছিল। সেইমতো আজ কদিন যাবৎ-ই অফিস আর ব্যাংক-এ ছুটোছুটি করতে হচ্ছে তাকে। স্বামী অলোক ইউনিভার্সিটি যাওয়ার পথেই তাকে ব্যাংক-এ ড্রপ করে দিয়ে গেছে। কাজ শেষ করে বাইরে বেরোতেই অনুজার চোখে পড়ে আকাশের ভয়ংকর করাল রূপ। রাশি রাশি কালো মেঘ সূর্যকে একেবারে গ্রাস করে ফেলেছে। মেঘ ভেদ করে বিদ্যুত্যের তীব্র ঝলকানি যেন মেঘের বুক চিরে বেরিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এক লহমায় আকাশটা ভেঙ্গে পড়বে মাটিতে।

আর এক মুহূর্তও দেরি না করে একটা রিকশা ধরে সোজা বাড়ির পথে রওনা দেয় অনুজা। মাঝপথেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। সঙ্গে হাওয়ার ভীষণ রকম দাপট। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই রিকশা কোনওরকমে এগিয়ে চলে বাড়ির দিকে। ততক্ষণে ভিজে একেবারে কাকস্নান অবস্থা। রিকশা থেকে নেমে কোনওরকমে তালাটা খুলে সোজা বাথরুমে ঢুকে যায় অনুজা। তখনই কলিং-বেল-এর আওয়াজ কানে যায় তার। একবার নয় একাধিকবার। যেনতেনপ্রকারে শাড়িটা জড়িয়ে আইহোলে চোখ রাখতেই নজর পড়ে দরজায় পাশের বাড়ির মায়া। বেশ অবাকই লাগল অনুজার। এরকম ঝড়-জল মাথায় করে… কিছু ঘটল নাকি…!

দরজা খুলতেই হাঁফাতে হাঁফাতে ঘরে ঢুকে আসে মায়া। তার শরীরের বেশ খানিকটা অংশ ভিজে গেছে। চোখ একেবারে রক্তবর্ণ। কোনও কিছু বলার আগেই সামনে থাকা একটা তোয়ালে মায়ার দিকে এগিয়ে দেয় অনুজা। ‘কী হয়েছে এরকম অবস্থা কেন তোমার?’

‘রিনিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না অনুজা।’ শুনেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে অনুজার।

‘কী যা-তা বলছ?’

‘সেই কোন সকালে বাজার যাচ্ছি বলে বেরিয়েছে, আড়াইটে বাজতে চলল এখনও ফেরেনি। ফোনেও পাচ্ছি না, লাগাতার সুইচড্ অফ আসছে। আমি একা মানুষ কী করি বলোতো?’

মায়ার স্বামী অনেক বছর আগেই গত হয়েছেন।

সংসার বলতে ছেলে নীহার আর ওই বউমা রিনি। ছেলে মাস ছয়েক হল কর্মসূত্রে দুবাইতে। ওখানে সেটেল করেই বউকে নিয়ে যাওয়ার কথা। তার মাঝেই এই বিপত্তি।

‘দাঁড়াও দাঁড়াও এখনি এত ঘাবড়িয়ো না। ঝড়জলে কোথাও আটকে পড়েছে হয়তো। বৃষ্টি থামলেই চলে আসবে।’ সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে অনুজা।

‘না গো প্রসূনরা পর্যন্ত খুঁজে এসেছে। আমি নিজে দু-বার বাজারের দিকটা দেখে এসেছি।’

‘কিন্তু বাজারের উপর দিয়ে তো একটু আগে আমি-ই ফিরলাম। কই কিছু চোখে তো পড়ল না। তবে বিশুর দোকানে একদল ছেলে কী যেন একটা বলা-বলি করছিল, কানে এল… কার বউ? কার বউ এরকম কিছু একটা… বৃষ্টির মাঝে ওইটুকু সময়ের মধ্যে আমিও ঠিক বুঝতে পারিনি।’ চোখেমুখে বিস্ময়ের স্পষ্ট ছাপ ফুটে ওঠে মায়ার। অনুজার মুখের দিকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে মায়া। যেন ও-ই একমাত্র অবলম্বন। পারলে ও-ই পারবে তাকে উদ্ধার করতে। ফ্ল্যাট কালচারে অভ্যস্ত ব্যস্ত মানুষজন কেউ কারওর খোঁজ না রাখলেও এই তিন বছরে বেশ বন্ধুত্ব হয়েছে তাদের দুটির। তাই মায়ার আশার পারদটাও বোধকরি একটু বেশিই।

কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পরে অনুজা আবার প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা রিনির বন্ধুবান্ধবদের ফোন করে খোঁজ নিয়েছিলে?’

‘এখানে ওর বন্ধুবান্ধব কে-ই বা আছে। এই তো কটাদিন হল বিয়ে হয়েছে।’

‘হ্যাঁ, সেটাও ঠিক। ঝগড়া-টগড়া কিছু হয়েছিল নাকি?’

‘তুমি তো জানো, আমি ওকে কীভাবে আগলে আগলে রাখি। নীহার থাকে না বলে উঁচু গলায় কথা পর্যন্ত বলি না। পাছে মেয়েটা কষ্ট পায়।’ বলতে বলতে থেমে যায় মায়া। কী যেন ভাবতে শুরু করে। হঠাৎই চমকে উঠে অনুজার হাতদুটো চেপে ধরে, ‘কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি তো?’ মুখে একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে সামনে রাখা চেয়ারে সজোরে বসে পড়ে মায়া। দুচোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ে তার।

‘না না বাজার তো মোটে মিনিট দশেকের রাস্তা। সেরকম কিছু ঘটলে এতক্ষণে খবর পাওয়া যেত। তাছাড়া আমি তো ওখান দিয়েই এলাম, কিছু ঘটলে অ্যাটলিস্ট কানে তো আসত।’

রাত পর্যন্ত রিনির কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। দশটা নাগাদ অনুজার স্বামী অলোকের সাথে মায়া থানায় একটা ডায়ারি লিখিয়ে এল। সেখানেও এক বিপত্তি, যিনি ডায়ারি লিখবেন তাঁর হাজারো রকম প্রশ্ন, ‘ছেলে-বউ কেন আলাদা থাকত? নিশ্চয়ই কোনও গড়বড় কেস… পণ দিতে পারেনি তাই বোধহয় আপনারা অত্যাচার করতেন? দেখুন কোনও ইয়ারের সঙ্গে পাত্তাড়ি গুটিয়ে বেমালুম ফুর্তিতে আছে। আপনারা অযথাই টেনশন করছেন আর রাতবিরেতে আমাদেরও টেনশন দিচ্ছেন।’

সকাল থেকে কেঁদে কেঁদে মায়ার বেহাল অবস্থা, তার উপর ওনার এইধরনের অপ্রত্যাশিত প্রশ্নবাণে যেন আরও ভেঙে পড়ে মায়া। এই নিয়ে পুলিশ অফিসারের সঙ্গে অলোকের প্রায় বচসা বাধতে বসেছিল।

‘এক্সকিউজ মি অফিসার। একজন মহিলার সঙ্গে আপনি এভাবে কথা বলতে পারেন না।’

‘আপনি কে মশাই? আপনি আমাকে বলে দেবেন আমি কার সাথে কীভাবে কথা বলব?’

‘অফকোর্স। প্রয়োজন পড়লে তা-ও করব।’ চ্যাঁচামেচি শুনে ভিতর থেকে আর এক উচ্চপদস্থ অফিসার সামনে আসতেই ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়। মেয়ের কলেজের প্রফেসার বলে কথা। ব্যাপারটা সেখানেই গুটিয়ে যায়। ওনাকে পার্সোনালি এই কেসটা দেখার জন্য অনুরোধও করে আসে অলোক।

বছর ঘুরে গেলেও এই কেসের কোনও সুরাহা করতে পারে না পুলিশ। এই ঘটনার পরে পরেই দুবাই থেকে মায়ার ছেলে এসে চার-পাঁচ মাস থানা-পুলিশ করে করে অবশেষে নিরাশ হয়ে সেও পুলিশের অনুমতি নিয়ে কাজের জগতে ফিরে যায়। রিনির বাপের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে মায়াদের ভীষণ ভালো সম্পর্ক। তারাও খুব ভালো করেই জানত রিনির অন্তর্ধানের পিছনে অন্তত তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিলক্ষণ কোনও হাত নেই। প্রথম প্রথম সকলে ভেবেছিল অপহরণ হলেও হতে পারে। কিন্তু কয়েকদিন পরেই সে ভুল ভেঙে যায় সকলের। কারণ অপহরণ হলে অন্ততপক্ষে অপহরণকারীরা টাকার দাবি করত। সেরকম কিছু ঘটেনি।

এতদিনে তাদের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে হয়তো অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে মারা গেছে মেয়েটা। ট্রেস না পেয়ে হয়তো মর্গ থেকে বার করে আর-পাঁচটা বডির সাথে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর নয়তো দুষ্কৃতীদের হাতে…।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খোঁজখবর করা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল সকলেই। এমনকী পুলিশও হাত গুটিয়ে নিয়েছিল এই কেসটা থেকে। মায়া-ই মেয়েটার আত্মিক বন্ধন ছিঁড়ে বেরোতে পারেনি। মাঝে মাঝেই রিনিকে নিয়ে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠত। রিনির বাবা-মা তো কবেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ওই একরত্তি মেয়েটাকে দাদা-বউদির ভরসায় ছেড়ে গিয়েছিল সেই দাদা-বউদিও বোধকরি মেয়েটাকে নিয়ে অত ভাবে না, যতটা মায়া। কথা বলতে বলতে কোনও না কোনও কারণে রিনির প্রসঙ্গে ঠিক টেনে আনবেই। ‘কত শখ করে বাড়ির বউ করে এনেছিলাম মেয়েটাকে। নিজের পছন্দ নিয়ে কত গর্ব ছিল আমার। কোনওদিন একা কোথাও যেত না, সবসময় আমাকে সঙ্গে নিয়ে…। কী যে হয়ে গেল…’ অনুজা বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলেও মনে মনে খুব ভালো করেই জানত এই ঘা সারাজীবনেও যাওয়ার নয়।

একদিন বিকেলে অনুজা আর মায়ার কথা হচ্ছিল। ‘দ্যাখো মায়া, মনে হয় না রিনি আর কোনওদিন ফিরে আসবে। দেখতে দেখতে তো অনেকগুলো দিন-ই কেটে গেল। এবার ছেলের একটা বিয়ের বন্দোবস্ত করো। ওর তো সারা লাইফটা পড়ে রয়েছে। এভাবে তো আর একা একা…’ অনুজার কথাগুলো শুনেই মুহুর্তে মায়া-র চোখমুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ স্থির থাকার পর একটা ক্ষীণ স্বর কানে গেল অনুজার। ‘রিনির জায়গায় অন্য কেউ….?’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়া, ‘জানি নীহারের কথাও তো ভাবতে হবে। এখন ও যা ভালো বোঝে।’ মায়ার কথা শুনে একটুও অবাক হয়নি অনুজা। বরং মনে মনে ভেবেছে একটা মানুষকে কতটা ভালোবাসলে তবে তার থেকে এই ধরনের উত্তর আশা করা যায়। মায়ার মনের অবস্থা বুঝে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায় অনুজা। এদিক-ওদিককার নানারকম কথায় ব্যস্ত করে তোলে মায়াকে।

‘ওহ্ পাওলির বিয়ের গিফট-টা তোমাকে দেখানো হয়নি না?’

‘দেখেছ, একদম মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল, পাওলি-র বিয়েতে তোমার আবার দিল্লি যাওয়ার আছে না। কবে যেন বলেছিলে। ছাব্বিশ না সাতাশ কী যেন একটা…’ মনে করতে পারে না মায়া।

‘আরে সামনের সপ্তাহেই তো। বুধবার রাতে ট্রেন। দাঁড়াও তোমাকে জিনিসটা দেখাই।’ বলে মিনিট খানেকের মধ্যেই জিনিসটা নিয়ে এসে মায়ার হাতে ধরিয়ে দেয় অনুজা।

‘বাহ্, সেট-টা খুব সুন্দর হয়েছে। খুব ভালো মানাবে ওকে।’

সময়ের চাকা কখন যে কোনদিকে ঘোরে তা বোধকরি স্বয়ং উপরওয়ালারও বোধগম্যের বাইরে। অনুজার বড়দির ওই একমাত্র মেয়ে পাওলি। বাঙালি পরিবার হলেও বিগত বাইশ বছর দিল্লিতে থেকে ওখানকার রঙেই রাঙিয়ে নিয়েছে নিজেদের। অনুজারা দু’দিন আগেই বড়দির বাড়ি পৌঁছে গিয়েছে। আলাদা করে একটা মেহেন্দির অনুষ্ঠানও রাখা হয়েছে। ডিজে-র তালে তালে সকলে মেতে উঠেছে। অনুজারও বেশ ভালো লাগছিল। এমন সময় জনাকয়েক রব তুলল, ‘পাম্মি গেল কোথায়? এখনও এসে পৌঁছোয়নি? ও না এলে কী মেহেন্দির অনুষ্ঠান জমে?’

‘এই পাম্মি-টা আবার কে রে? বিশেষ কেউ?’ দিদি অনুভাকে প্রশ্ন করে অনুজা।

‘আরে না-না, দিল্লি, মুম্বইতে আজকাল মেহেন্দির অনুষ্ঠানে লাইভ গানের বেশ একটা চল হয়েছে। পাম্মি ওই একটা অর্কেস্ট্রা সেটের সঙ্গে গান করে। বেশ ভালো গলা মেয়েটার। একটা শোয়ের জন্য তিন হাজার টাকা করে নেয়।’ হাসতে হাসতে জবাব দেয় দিদি অনুভা।

মিনিট দশ বাদে বেশ একটা সুরেলা, মধুর কণ্ঠ কানে আসে অনুজার। সেই সুরকে লক্ষ্য করে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতেই এক ঝটকায় মাথাটা ঘুরে যায় অনুজার। অনায়াসেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, ‘রিনি’!

অনুভা মেহেন্দি লাগাতে লাগাতেই মুখটা ঘুরিয়ে বলে, ‘রিনি! সেটা আবার কে?’

‘এযে অবিকল রিনি। আমার পাশের বাড়িতে মায়া আছে না। তুই তো দেখেছিস। ওর বউমা, বছরখানেক হল নিখোঁজ। তারপর আর…’ অর্ধেক কথা মনের মধ্যেই চাপা রয়ে গেল অনুজার। সকলে মেহেন্দি আর গানবাজনার মধ্যে ডুবে রয়েছে। পাম্মিও গাইতে গাইতে পাওলির পরিবারের একএকজনকে স্টেজে ডেকে নিয়ে বেশ জমিয়ে নাচাচ্ছে। অনুজার দিকে এগিয়ে আসতেই পাম্মির অমন চাঁদপানা মুখটা কেমন যেন তামাটে হয়ে গেল।

অনুজার মুহূর্তও লাগেনি ব্যাপারটা আঁচ করতে। রিনি নিশ্চয়ই তাকে চিনে ফেলেছে। কিন্তু ও যদি সত্যি সত্যি রিনি-ই হয়ে থাকে, তাহলে এখানে কী করছে? ছোটোখাটো এরকম একটা অর্কেস্ট্রা গ্রুপ-এ…? এটা কীভাবে সম্ভব? এমন হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে অনুজার মনে। মনে মনে ঠিক করে যে ভাবেই হোক একবার মেয়েটার মুখোমুখি হতেই হবে। আসল ব্যাপারটা কী, তাকে জানতেই হবে। সেই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল অনুজা। মেহেন্দি লাগাতে বসেও চোখ আটকে রইল সেই পাম্মির দিকেই।

মেহেন্দির পরেই খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। খাওয়ার ফাঁকেই মেয়েটা কোথায় যেন সরে পড়েছে। মেয়েটার খোঁজে অনুজার চোখ নিরন্তর এদিক-ওদিক করতে থাকে। অনুষ্ঠান শেষে যে-যার বাড়ির দিকেও রওনা দিয়েছে। এমন সময় হঠাৎ-ই দিদি অনুভাকে হন্তদন্ত হয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখে অনুজা। ‘কি হল এভাবে এদিক-ওদিক করছ কেন?’

‘আর বলিস না। পাম্মিকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। ওর টাকাটাও তো দেওয়ার ছিল। কত কাজ ওদিকে।’

‘ঠিক আছে তুমি যাও। আমি থাকছি এখানে। টাকা নিতে এলে দিয়ে দেব।’

কিছুক্ষণ পর একটা পায়ের শব্দ কানে আসে অনুজার। ধীর পায়ে কেউ এগিয়ে আসছে সেই ঘরের দিকেই। ধারণা একদম ঠিক।

‘ম্যাডাম, আমার টাকাটা।’

‘রিনি, টাকাটা আমার কাছে আছে। ভিতরে এসে নিয়ে যাও।’

একটু সাহস সঞ্চয় করে ঘরে ঢুকে পাম্মি জবাব দেয়, ‘আপনি বোধহয় ভুল করছেন, আমার নাম পাম্মি।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু তবু কেন জানি না মনে হচ্ছে তুমি আমাদের সেই রিনি-ই। যার জন্য তার শাশুড়ি আজও পথ চেয়ে বসে আছে। যদি কখনও তার আদরের বউমা…’

‘এসব শোনার সময় আমার নেই। টাকাটা দিন তাড়া আছে।’ একটু কঠোর হওয়ার চেষ্টা করে পাম্মি। অনুজার হাত থেকে টাকার খামটা নিয়ে উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

পাম্মি চলে যাওয়ার পরও অনুজা সেখানে দীর্ঘক্ষণ বসে রইল। মাথায় কতকিছু যে ঘুরপাক খাচ্ছে তার। মনটা কেমন যেন ভার ভার লাগছে। রাতেও ঠিক করে ঘুমোতে পারেনি অনুজা। চোখ বুজলেই সেই সরল সাধাসিধে মুখটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। বারবার যেন কেউ কানের কাছে বলে চলেছে, ‘ওর জায়গায় অন্য কেউ?’

সকালে একদম আলাদা পরিবেশ। বিয়ের দিন বলে কথা। চতুর্দিকে হইহুল্লোড়, ব্যস্ততা। সাজো সাজো রব। তার উপর সানাইয়ের সুর। মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠেছিল অনুজার। সব ভুলে সেও বিয়েতে মেতে উঠেছিল। মেক-আপ করাতে বিউটিশিয়ানের পাশে বসতেই সে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে উঠল, ‘দিদি ম্যায় রশ্মি। আপনি-ই অনুজা দিদি আছেন, না?’

অনুজা বেশ চমকে গেল, তাকে কী করে চিনল রে বাবা? এর আগে কোথাও। দেখতেও বেশ। বাঙালির সঙ্গে থেকে থেকে বাংলা হিন্দি মিশিয়ে একটা আলাদাই ভাষা তৈরি করেছে এরা। সাঁতপাঁচ ভাবতে থাকে অনুজা। এমন সময় সে আবার বলে ওঠে, ‘দিদি কাল দোপহর কো কুছক্ষণ কে লিয়ে বাহার আসতে পারেন কী? আপসে জরুরি কাম হ্যায়।’

‘আমার সাথে, মেরা মতলব হ্যায় কে মুঝ সে? ম্যায় তো ইহা রহতি ভি নেহি অউর কিসি কো পহচানতি ভি নেহি…’

‘দিদি উয়ো পাম্মি আছে না ও আপনার সাথে দেখা করতে চায়। উয়ো ভি আকেলে মে। একদম আমার পাশেই থাকে, আপনি যাবেন দিদি?’

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় অনুজা। মনে মনে ভাবে পাম্মি দেখা করতে চেয়েছে মানেই– সে ঠিক তার অনুজা আন্টিকে চিনতে পেরেছে।

পরের দিন সময়মতো রশ্মির সাথে বেরিয়ে পড়ে অনুজা। এই নিয়ে আগে থেকেই দিদি অনুভার সঙ্গে সাঁট করে রেখেছিল সে। কথাই ছিল তারা বেরোনো মাত্রই ড্রাইভার সদানন্দ গাড়ি নিয়ে তাদের পিছু পিছু যাবে। যদি কিছু বেগতিক দেখে সদানন্দ সামলে নেবে। রশ্মির অটোতে ওঠার কথা বলতেই বেশ ভয় ভয় করছিল অনুজার, পাম্মি-র সাথে দেখা করতে যাওয়ার চক্বরে যদি কোনও ঝামেলায় ফেঁসে যায়। পরে সদানন্দের কথা ভেবে ভয় কেটে যায়। অটোতে উঠে বসে। মিনিট দশ পরে অটোটা একটা বস্তির সামনে এসে দাঁড়াতেই মুখে রুমাল চাপা দিয়েই রশ্মিকে জিজ্ঞাসা করে অনুজা, ‘তোমরা এখানে থাকো?’ রশ্মি ধীর গলায় জবাব দেয়, ‘দিদি, আমাদের মতো….’

‘ঠিক আছে।’ আরও কিছু বলার আগেই রশ্মিকে থামিয়ে দেয় অনুজা। অটো থেকে নেমে মিনিট পাঁচেক ভিতরে গিয়েই একটা দরজা ধাক্বায় রশ্মি। দরমার বাড়ি। একেবারে হাইড্রেনের গা ঘেঁষে রয়েছে। খানিকটা হেলেও পড়েছে। রাস্তার দুপাশে থরে থরে হাইড্রেন থেকে নোংরা তুলে রাখা। দুর্গন্ধে গা ঘিনঘিন করে ওঠে অনুজার। কোনওরকমে সামলে নেয় নিজেকে। অভিজ্ঞ চোখ পরখ করতে থাকে সবকিছু। ঠিক তখনই দরজাটা খুলে দেয় পাম্মি। হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গিয়ে একটা ভাঙা চেয়ারে বসতে দেয়।

‘তাহলে আমার ধারণাই ঠিক। কী রিনি তাই তো?’ কোনও জবাব দিতে পারে না পাম্মি। মাথা নীচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে অনুজার সামনে। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। রিনির হাতটা ধরে সামনের চৌকিতে বসায় অনুজা। মিনিট কয়েক এভাবেই কেটে যায়। কাঁদলে খানিক হালকা হবে এই ভেবে অনুজাও বাধা দেয়নি। এর মাঝে চা নিয়ে ঢুকে পড়ে রশ্মি। দু-জনকে দু-ভাঁড় চা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। চা খেতে খেতে ঘরের ভিতরটায় ভালো করে চোখ বুলিয়ে নেয় অনুজা। আসবাব বলতে এই একটা চৌকি আর একটা আলনা। এক কোনায় রাখা রয়েছে একটা স্টোভ আর কয়েকটা বাসনপত্র। অনুজা তার ক্ষুরধার দৃষ্টি দিয়েই রিনির অবস্থাটা খানিক আঁচ করে ফেলে। চেহারাতেও দৈন্যতার ছাপ ফুটে উঠেছে। চোখের নীচে কালি পড়েছে। পরনের কামিজটাও দু-এক জায়গায় ছেঁড়া। নিজের মনটা ঘোরায় অনুজা। চায়ে চুমুক দিতে দিতেই প্রশ্ন করে, ‘এবার বলো তো এখানে কী করে এলে? কেউ কি জবরদস্তি…?’

ততক্ষণে পাম্মি নিজেকে খানিক সামলে নিয়েছে। খুব ধীরভাবে বলে ওঠে, ‘না কেউ জবরদস্তি করেনি। আমি স্ব-ইচ্ছায় চলে এসেছি।’

রিনির কথা শুনে অবাক হয়ে যায় অনুজা। বোকার মতো তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। মেয়েটা এসব কী বলছে নিজের ইচ্ছায়…! মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছিল অনুজার। তাকে এতদিন সে যেভাবে চিনত, জানত– মেলাতে পারছিল না কিছুতেই। ওদিকে এতদিন পরে কাছের একজনকে পেয়ে জমাট বাঁধা আবেগগুলো ঝড়ের গতির মতো বেরিয়ে আসছিল রিনির মুখ দিয়ে। ‘ছোটো থেকেই ইচ্ছে ছিল বড়ো গায়িকা হব। স্কুলকলেজেও সবাই আমার গানের গলার খুব তারিফ করত। যতদিন বাবা-মা ছিল ততদিন একরকম ছিলাম, তারপর দাদা-বউদি একপ্রকার জোর করেই আমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়েটা দিয়ে দিল। ধরেই নিয়েছিলাম আর-পাঁচটা মেয়ের মতো আমার এত দিনের সাজিয়ে রাখা স্বপ্নটাও চারদেয়ালের মধ্যে আটকে রয়ে যাবে। ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসত। কেমন যেন একটা জেদ চেপে বসেছিল। নিজেকে প্রমাণ করবার। সুযোগও পেয়ে গেলাম। বিয়ের পাঁচ মাস পরে নীহার দুবাই চলে গেল। সংসারে তখন মা আর আমি। তখনও ভাবিনি এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসব। ও যাওয়ার পর শূন্যতা যেন আরও ঘিরে ধরল আমায়। একাকীত্ব কাটাতে আঁকড়ে ধরলাম গানকে। দিনরাত ওই নিয়েই পড়ে থাকতাম। সময় তো কাটাতে হবে। ঠিক ওই সময়েই স্বাতীর সাথে আলাপ।’

‘স্বাতীটা কে?’

‘ওই যে দিনকতকের জন্য প্রসূনদাদের বাড়িতে এসেছিল না। মা তখন নিয়ে গিয়েছিল ওদের বাড়িতে। ওনার মুখেই শুনেছিলাম দিল্লিতে কোনও একটা বড়ো চ্যানেলে নাকি গানের অডিশন শুরু হচ্ছে। একবার সিলেক্ট হতে পারলেই আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। টিভিতেও সেই অডিশনের সম্পর্কে জানতে পারি। আর ধরে রাখতে পারিনি নিজেকে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস দেখুন, দুদিন ধরে দীর্ঘ লম্বা লাইনে অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎই একজন অসুস্থ হয়ে পড়ে যাওয়াতেই বিপত্তি ঘটে গেল। উত্তেজিত জনতার মারামারি, পুলিশের লাঠিচার্জ– অডিশনটাই আর দেওয়া হল না।’ ঘরটার মধ্যে কেবল একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল।

এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিল অনুজা। এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, ‘তোমার গানের গলা খুব সুন্দর, এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই। কিন্তু তাই বলে তুমি যে পদক্ষেপ নিয়েছ সেটা কি ঠিক? তুমি তো শ্বশুরবাড়িতে থেকেও তোমার স্বপ্নপূরণ করতে পারতে। মায়াকে আমি যতদূর চিনি-জানি, ও কোনওদিন বাধা দিত না।’

‘তখন বুঝিনি, কতবড়ো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে চলেছি। আমার জীবনটাই নষ্ট হতে বসেছে। কী যে হল সেদিন… না হলে ওইরকম স্বামীকে ছেড়ে মাকে ছেড়ে চলে আসি কখনও। নীহারও কতবার ফোনে বলেছে ‘আর ক’টা দিন একটু কষ্ট করো। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি তোমাকে আমার কাছে নিয়ে চলে আসব।’ তবুও কেন যে… শুধু মনে হতো সংসারে থাকলে আমি জীবনে কিছু করতে পারব না। আমাকে এখান থেকে বেরোতেই হবে। আসলে সবই আমার নিয়তি।’

‘বুদ্ধিবিভ্রম বলো বা নিয়তি-ই বলো ভুল তো তুমি করেইছ। আচ্ছা একটা কথা বলো তো শুধুমাত্র অডিশন দেওয়ার জন্য একটা অজানা-অচেনা শহরে কোনও চেনাপরিচিতি ছাড়াই হুট করে চলে এলে? এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হল না!’

‘আমার কলেজের এক বান্ধবী থাকে এখানে। ওর ঠিকানা সম্বল করেই বেরিয়ে পড়ি। এখানে এসে দেখি ওরাই একটা ঘরে কোনওরকমে দিন গুজরান করছে। সেখানে আবার বাড়তি আমি।

কষ্ট করে কটাদিন থেকে গেলাম ওখানে। একটু সুযোগের জন্য এই স্টুডিয়ো থেকে সেই স্টুডিয়ো– পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছি। তখনই বুঝেছি এই দিল্লি, মুম্বইয়ের মতো শহরে কিছু না দিলে কিছু পাওয়া যায় না। আর নয়তো নামিদামি বাবা-মায়ের ট্যাগ-টা গায়ে লেগে থাকতে হবে। তবেই এখানকার মাটিতে টিকে থাকা সম্ভব। যা টাকাপয়সা এনেছিলাম ততদিনে সব শেষ হয়ে গেছে। মাঝে সুনীতার থেকেও বারকয়েক টাকা ধার করেছি। আর কোনও রাস্তা না দেখে বারে গান গাওয়া শুরু করি। ওখান থেকেই অর্কেস্ট্রা গ্রুপ-এর সঞ্জয়ের সঙ্গে আলাপ। তারপর থেকে এভাবেই চলছে। এখন এটাই আমার ঠিকানা।’ নিরাশা ঘিরে ধরে রিনিকে।

‘এই জীবন তো স্বেচ্ছায় বেছেছ। এখন আর আপশোশ করে লাভ কী?’ জবাব দিতে পারে না রিনি। জবাব দেওয়ার মতো আছেটাই বা কী! তার ভুলের মাশুল যে তাকেই গুনতে হবে। মনে মনে ভাবে এখন শহরের প্রান্তে এই নোংরা বস্তি-ই তার ঠিকানা। জীবনের শেষ দিনটা পর্যন্ত এখানেই কাটাতে হবে তাকে। রিনির মনের অবস্থা বুঝে রাগ সংবরণ করে খানিক নরম হওয়ার চেষ্টা করে অনুজা। গলা নামিয়ে ধীর ভাবে বলে, ‘অডিশনের পরেও তো ফিরে যেতে পারতে?’

‘কোন মুখে যেতাম আন্টি, সব পথ যে আমি নিজে বন্ধ করে এসেছি। একবার অবশ্য বাড়িতে ফোন করেছিলাম। ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল। আর সাহস হয়নি করার।’

‘তা এবার কী করবে ভেবেছ?’

রিনির ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি লক্ষ্য করে অনুজা। সে হাসি আনন্দের নয়, বিদ্রুপের। ‘ব্যস বাঁচা-মরা সব এখন এখানেই। আর কোনও রাস্তাও তো খোলা নেই আমার কাছে। মা আমার জন্য এখনও অপেক্ষা করে আছে জেনে, মনটা আনন্দে ভরে গেল। এ পৃথিবীতে কেউ তো আছে, যে আজও আমাকে মনে রেখেছে। তাতেই আমার শান্তি। মা-র কথা শোনার পর থেকেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। প্লিজ আন্টি, এব্যাপারে ওনাকে কিছু জানাবেন না। আমি চাই না ওনার কাছে আমার ছবিটা বদলে যাক। জানেন আন্টি মাকেও দু-বার ফোন করেছি। কিন্তু সাহস হয়নি কথা বলার। মা হ্যালো বলতেই ভয়ে ফোনটা রেখে দিয়েছি। ভয় লেগেছে, মা যদি বলে দেয় মায়ের কাছে আমি মৃত…। নীহারকেও…শুধু একটু গলা শোনার জন্য… কতবার ভেবেছি সবকিছু খুলে বলি ওকে, সেই সৎসাহস দেখাতে পারিনি। ভয়ে আঁতকে উঠেছি, আমার গলা শুনলেই যদি আমার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসে। সহ্য করতে পারতাম না। একদিন তো ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে ছিলাম। ফোন করি অথচ কথা বলি না। এতেই ও ধরে ফেলেছিল, ওটা আমি, তারপর থেকে আর…’, বলতে বলতে কেঁপে কেঁপে উঠছিল রিনি। অপরাধবোধের স্পষ্ট ছাপ তার চোখেমুখে ছেয়ে যায়। সান্ত্বনা দিতে রিনির হাতদুটো চেপে ধরে অনুজা। কী যেন চিন্তা করে বলে, ‘আর একবার চেষ্টা করে দ্যাখো না। হতে পারে ওরা তোমাকে গ্রহণ করবে না বা হয়তো… … কিছুই জানি না আমি। কিন্তু তবু বলছি এই আপশোশ তো অন্তত থাকবে না ‘ইস্ যদি একবার চেষ্টা করে দেখতাম।’ কাঁপা গলায় রিনি কোনওরকমে তার অনুজা আন্টিকে জিজ্ঞাসা করে, ‘ফিরে যেতে বলছেন আমাকে? কিন্তু কোন্ মুখে যাব?’

‘ঠিক যেমন করে বাড়ি ছেড়ে এসেছিলে, সেইভাবেই’ এইবার একটু রুক্ষ্ম শোনায় অনুজাকে। কেঁদে ফেলে রিনি। ‘রোজ যে তিলতিল মরছি, এটা তারই সাজা আন্টি।’

রিনিকে কাঁদতে দেখে তার মাথায় হাত রাখে অনুজা। ‘আমার কথাটা হয়তো শুনতে খারাপ লাগছে তোমার। কিন্তু আমি তোমার ভালোর জন্যই বলছি, ফিরে যাও। গিয়ে সব সত্যিটা খুলে বলো ওদের। তারপর সবই ভগবানের ইচ্ছে। অন্তত ভুল শোধরানোর একটা চেষ্টা তো করো। তোমাদের প্রতি একটা আন্তরিক টান আছে বলেই বলছি’, বলতে বলতে উঠে পড়ে অনুজা। তারও চোখে জল ভর্তি। ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে গাড়িতে উঠে পড়ে। সদানন্দ গাড়ি ঘুরিয়ে নেয় বাড়ির দিকে। মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে যায় তার। সারাক্ষণ মনের মধ্যে ঘুরতে থাকে, ‘মেয়েটা কী করবে, কে জানে।’ মিনিট দশেক পর বাড়ি ফিরলে সবাই তার উদাসীনতার কারণ জিজ্ঞেস করে। এড়িয়ে যায় সে।

বিয়ের পরেও আরও কয়েকটা দিন দিল্লিতে থাকার কথা ছিল অনুজার। তারপর ওখান থেকে গোয়া। কোথাও গিয়ে যেন শান্তি পাচ্ছে না সে। সারাক্ষণ ওই একই চিন্তা। কথাবার্তার মাঝে ফোন নাম্বার-টাও নিতে ভুলে গেছে। নিজেকেই দূষতে থাকে সে। নাম্বারটা নিলে অন্তত যোগাযোগ তো করা যেত। অবশ্য দিদির থেকে নিতে পারত। কিন্তু কাউকে আর ঘাঁটাতে চায়নি সে।

দিন পনেরো পর গোয়া থেকে বাড়ি ফিরে আসে অনুজা। ফিরেছে একেবারে কাকভোরে। তখনও কেউ ওঠেনি। বাড়িতে তেমন বাজার-দোকান না থাকায় প্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিস নিতে বেলার দিকে বেরোতেই মায়াকে দেখতে পেল সে। বাজার সেরে ফিরছে। বেশ হাসিখুশি লাগছে মায়াকে। অনুজাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে আসে তার দিকে। ‘ঘোরা হল তোমার? তুমি জানো এর মাঝে কী হয়েছে? আমার বউমা গত পরশু বাড়ি ফিরে এসেছে।’ এক মুহুর্তে মনটা ভীষণ রকম ভালো হয়ে যায় অনুজার। মনে মনে ভাবে তার বোঝানো তাহলে বিফলে যায়নি। রিনি তার আন্টি-র কথা রেখেছে। সে পেরেছে জীবনের মূল স্রোতে ফিরে আসতে।

ভাবনায় বাধ সাধে মায়া। কানে কানে বলে ওঠে, ‘তুমি তো ঘরের লোক অনুজা, তোমার কাছে আর কী লুকোব। এমন মেয়ে, কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গিয়েছিল দিল্লি, গানের অডিশন দিতে। এরকম ভুল কেউ করে বলো? ছোটো মেয়ে। যদি কিছু একটা অঘটন ঘটে যেত, তাহলে তখন তুই কী করতিস! বাবুও আসছে। ও-ও বলেছে গান-টান যা করার সব এখান থেকেই করতে হবে। একা একা কোথাও যাওয়া চলবে না। তুমি বলো কী দুঃসাহস! একা একা…’ থেমে যায় মায়া। কী যেন ভেবে নেয়। তারপর আবার বলতে শুরু করে, ‘কিন্তু পাড়াপড়শিদের তো আর এসব বলা যায় না। এমনিতেই তো কম কুৎসা রটায়নি তারা। কানপাতা দায় হয়ে গিয়েছিল। ওদের সকলকে বলেছি অ্যাক্সিডেন্ট-এ স্মৃতিশক্তি চলে গিয়েছিল। মারাঠি একটি পরিবারের দয়ায় হাসপাতালে ছিল। সবকিছু মনে পড়তেই ফিরে এসেছে।’ অনুজা আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকিয়েছিল মায়ার মুখের দিকে।

আকাশটা আজ অনেক পরিষ্কার। ঝড়-ঝঞ্ঝা-মেঘ কাটিয়ে সূর্য যেন মাথার উপর আবার জ্বলজ্বল করছে।

 

মাউথ অর্গান

ছুটতে ছুটতে ট্রেনটা ধরল অভীক। দিনের শেষ ট্রেন। এটা ধরতে না পারলে ফিরতে পারত না সে। সকালে বাবার শরীরটা খারাপ দেখে এসেছে। হার্টের রোগী বাবা। হঠাৎ কিছু হলে মায়ের পক্ষে একা সামলানো মুশকিল। অন্যদিন হলে এতটা ঝুঁকি নিত না। ছেলেবেলার বন্ধু তাপসের কোয়ার্টারেই থেকে যেত।

তাপস বর্ধমান স্টেশনের রেলপুলিশের বড়োবাবু। সে একাই থাকে এখানে। ওর কাছে থাকলে ছেলেবেলা কিছুটা ফেরত পাওয়া যায়। শেষ কামরায় খুব ভিড়। ভেতরে ঢোকা যাচ্ছে না। শরীরের অনেকটা কামরার বাইরে। একটু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই কাঁধের ব্যাগ খুলে প্ল্যাটফর্মে। গাড়ির যথেষ্ট গতি এখন। চলন্ত অবস্থায় নামা আত্মহত্যার সামিল। মুখ ঘুরিয়ে ব্যাগটার দিকে তাকাল অভীক। স্টেশনের বোতল কুড়োনো একটা ছেলে ব্যাগটা তুলছে।

ছেলেটাকে ভালো করে লক্ষ্য করল ও। গায়ে চেক জামা, নীল হাফ প্যান্ট, মাথায় কোঁকড়া চুল। গবেষণার কিছু কাগজপত্র, বই, নতুন কেনা দামি মোবাইল, পাঁচশো টাকা ও তার সাধের মাউথ অর্গানটা আছে ব্যাগের মধ্যে। পাবে তো ব্যাগটা? বিশেষ করে ওর মাউথ অর্গানটার জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

বছর তিনেক আগে ওরা চার বন্ধু মিলে ব্যাঙ্কক-পাটায়া বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানেই কিনেছিল ওটা। বেশ দামি। ওর অনেক দিনের শখ ছিল বিদেশি মাউথ অর্গানের। সাংহাই কোম্পানির চেঞ্জার অর্গানটা। দুটো দিকেই বাজানো যায়। এত সুরেলা আওয়াজ হয় যে, আশপাশে একটা ভালো লাগার পরিবেশ তৈরি হয় সুরের ঝরনাধারায়।

ভিড় ঠেলে একটু ভেতরে ঢুকল ও। তাপসকে ফোন করে সব জানাল। ব্যাগটার বিষয়ে আশ্বাস দিল তাপস। ও এখনি যাচ্ছে বলল। তবে চলন্ত ট্রেনে ওঠার জন্য খুব বকাবকি করল ওকে। মশাগ্রাম স্টেশনে ও জানলার ধারে বসার জায়গা পেল একটা। চোখ বুজে হাওয়ার আদর খেতে লাগল।

অভীক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করছে। বিষয়- গ্রামীণ উন্নয়নে ক্ষুদ্র ঋণের প্রভাব। স্বনির্ভর গোষ্ঠী বিষয়টায় জুড়ে গেছে বলে বিগত তিন বছর হুগলি জেলার গ্রামগুলোতে চষে বেড়িয়েছে তথ্য সংগ্রহের জন্য। ঘোড়ার মুখের তথ্য সমৃদ্ধ করেছে ওর লেখা। সবই প্রাথমিক তথ্য নির্ভর লেখা। কোনও গৌণ তথ্যের ওপর নির্ভর করেনি। এতে গবেষণার বিষয় আরও বাস্তবোচিত ও গ্রহণযোগ্য হবে। এটা ওর বিশ্বাস।

প্রতি শনিবার স্কুল করে ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে চলে আসে। স্যারের সাথে সারা সপ্তাহের কাজ নিয়ে আলোচনা করে। গ্রন্থাগারে যায়। নোটস নেয়। এসব করতে করতে একদম শেষ ট্রেন হয়। আজ ও স্যারের কাছে এসেছিল অন্য শনিবারের মতোই। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল! মনখারাপের কালো মেঘ ওর সারা হৃদয় জুড়ে।

পরদিন আরামবাগের একটা গ্রামে ফিল্ড ভিজিট সেরে ও বর্ধমানে পৌঁছোল প্রায় সন্ধেয। তাপস অফিসেই ছিল। হারানো ব্যাগটা এগিয়ে দিল তাপস। অভীক দেখল সব ঠিক আছে। শুধু মাউথ অর্গানটা নেই। চা টিফিন করে ওরা বের হল হারানো অর্গান উদ্ধারে। যদি বুঝিয়ে ফেরত পাওয়া যায়! বড়ো ব্যথা ওর বুকের ভেতর। ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল ওটা। বন্ধু বিচ্ছেদের কষ্ট যেন সারা মন জুড়ে।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা গিয়ে পৌঁছোল ছেলেটার আস্তানায়। হঠাৎ কানে এল সুর। সি শার্প-এ অগোছালো সুর। কিছু রিড মিস হচ্ছে। তবুও এক অদ্ভুত ভালোলাগা আছে সুরটায়। শুনেই বোঝা যায় কত ভালোবাসা নিয়ে বাজাচ্ছে। অভীক বুঝল সব। উৎসের দিকে একটু এগোতেই নজরে এল, সেই কালকের ছেলেটা চোখ বুজে তন্ময় হয়ে বাজিয়ে চলেছে অভীকের প্রিয় মাউথ অর্গানটা। আধো অন্ধকারে যেন আত্মমগ্ন ও। ওর সারা শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক আনন্দ খেলা করছে। মুখে যেন সব পাওয়ার আলপনা। বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল অভীকের। অদ্ভুত এক ভালোলাগায় মনটা ছেয়ে গেল ওর। অনেক না-পাওয়ার মাঝে ছেলেটা একটা বাঁচার অবলম্বন খুঁজে পেয়েছে যেন। ওর এই পাওয়াটুকু আর কেড়ে নিতে চায় না অভীক । বাজাক মাউথ অর্গান ওর প্রাণের সুরে সুখের অঞ্জলিতে। তাপসের হাত ধরে ফেরার পথ ধরল অভীক মাউথ অর্গানের সুর পিছনে ফেলে।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব