ডেডলি গেম(Crime Thriller)দ্বিতীয় পর্ব

বিকাশের কথাতে জোরে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন আইসি দেব, এগজ্যাক্টলি… আমিও ঠিক এই অ্যাঙ্গেলটাই ধরতে চেয়েছি। তুমি ওই কেসের পুরো ডিটেলসটা জোগাড় করো। তবে শান্তার কল রেকর্ডের ব্যাপারে আগেই কিছু বলতে যেও না। ওটা সিক্রেট ইস্যু। খুব প্রয়োজন ছাড়া ফাঁস করা যাবে না। খুনি অ্যালার্ট হয়ে যাবে।

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার।

এবার সাহাবাবুর দিকে তাকিয়ে আইসি দেব বললেন, দেবদূতের ব্যাপারে কিছু ইনফর্মেশন পাওয়া গেল সাহাবাবু?

উত্তম সাহা বললেন, তেমন ব্রেকিং নিউজ কিছু নেই স্যার। ছেলেটা নেহাতই সাদামাটা। শরীর চর্চা আর দোকানদারি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। একটা নন বেঙ্গলি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। এই নিয়ে বাড়িতে মাঝেমধ্যেই অশান্তি হয়। তবে একটা ব্যাপারে একটু খটকা আছে…

কী ব্যাপারে?

দেবদূত মাঝে মাঝে হাওড়ার একটা নিষিদ্ধ পল্লিতে যায়। ওখানে মুকেশ কুমার নামে একজনের সাথে খুব দোস্তি। মুকেশ কুমার সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি তাতে ছেলেটা খতরনাক গুন্ডা। খুন, জখম, রাহাজানি, ধর্ষণ, সুপারি কিলিং… এসবই ওর পেশা। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন জাগে, ওই রকম একটা ছেলের সাথে দেবদূতের কী সম্পর্ক থাকতে পারে? কিন্তু এবিষয়ে সঠিক কোনও তথ্য এখনও পাইনি।

লেগে থাকুন। আপাত দৃষ্টিতে তুচ্ছ মনে হলেও কোনও বিষয়কেই নেগলেক্ট করা যাবে না। কোথায় যে এই রহস্যের টিকি বাঁধা আছে আমরা কেউ জানি না। সুমিত সেন সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন?

যেটুকু পেয়েছি বলছি। ওর আদি বাড়ি কৃষ্ণনগর। বনেদি পরিবার। বাবা কাকারা সব একসাথেই থাকেন, যৌথ পরিবার। অনেক রকমের ব্যাবসা আছে। সুমিত সেন পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর দুবছর বিদেশে চাকরি করেন। তারপর চলে আসেন কলকাতায়। পড়ার সময়ে শান্তার সাথে প্রেম। বিদেশ থেকে ফিরেই বিয়ে করেন দুজনে। আগে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। রিসেন্টলি ফ্ল্যাট নিয়েছেন বালিগঞ্জে। বন্ধু-বান্ধব মহলে ভালো ছেলে বলেই পরিচিত। পরকিয়ার গল্পটা সম্পূর্ণ বানানো, এমনই তার মত। শান্তা মার্ডারের সাথে সুমিতের কোনও প্রত্যক্ষ যোগ নেই বলেই মনে হচ্ছে স্যার।

হাসলেন আইসি দেব, মঞ্চে নাটক শো হয় সাহাবাবু। কিন্তু নাটক যিনি নির্মাণ করেন তিনি থাকেন পর্দার আড়ালে। কলাকুশলীরা তার হাতের পুতুল মাত্র। আপনি সুমিতের ফোন চেক করুন। আমরা জানি পারফেক্ট মার্ডার বলে কিছু হয় না। কিছু না কিছু খুঁত থাকেই। সেটাই খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। কাজটা অত সহজ নয়।

ঠিক আছে স্যার।

আইসি দেব এবার ঘুরলেন পলাশ মিত্রের দিকে, আশেপাশের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছিলে মিত্র? সেরকম কোনও খবর পাওয়া গেল?

না স্যার। একে বর্ষার রাত ছিল, তার ওপর সবাই ঘরবন্দি। কেউ কিছুই জানে না, কেউ কিছুই দেখেনি। শুনে ওরাই অবাক। আমাকেই প্রশ্ন করতে শুরু করল, কীভাবে হল স্যার? কে খুন করল স্যার? ইত্যাদি ইত্যাদি। ওই বাড়ির গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী সম্পর্কে লোকের ধারণা ভালোই। নির্বিবাদী, সাতে-পাঁচে থাকেন না। নির্ঝঞ্ঝাট অবসর জীবনযাপন করেন।

ওদের সাথে কথা বলেছ তুমি?

হ্যাঁ স্যার। ভীষণ ভয় পেয়েছেন দুজনেই। আপাতত দেবদূতদের বাড়িতেই আছেন। নিজেদের বাড়িতে যেতে ভয় পাচ্ছেন।

ওদের সন্তানরা বিদেশে থাকে দেবদূতের মুখেই শুনেছি। কী করে তারা?

দুজনেই সুপ্রতিষ্ঠিত। একজন ডাক্তার, অন্যজন ইঞ্জিনিয়ার। বড়ো ধৃতিমান থাকে জার্মানিতে, ছোটো ধীরাজ থাকে সুইডেনে। এই ধীরাজের সাথে খুব সামান্য হলেও একটা লিঙ্ক রয়েছে শান্তা কুলকার্নি ও সুমিত সেনের।

ভ্রু সামান্য বাঁকা হল আইসি দেবের, কী রকম?

দেবদূতের মেসোমশাই ধীমান তালুকদারই আমাকে একটা পুরানো গ্রুপ ফটো এনে দেখালেন। দেখিয়ে বললেন, যে-মেয়েটি খুন হয়েছে সে আমার ছেলে ধীরাজের সাথে পড়াশোনা করত। একই কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে। ধীরাজের মুখে নামটা বহুবার শুনেছেন। তাই তাঁর সন্দেহ হয়, দুটো একই মেয়ে নয়তো? নিজের কৌতূহলেই শান্তার এখনকার ছবি আর পুরোনো ছবি মিলিয়ে দেখেন। দেখে অবাক হয়ে যান! আমাকেও দেখালেন। ওই ছবিতে সুমিত সেনও আছেন।

আশ্চর্য সংযোগ তো! যদিও এতে কিছুই প্রমাণিত হয় না। তবুও কেমন জানি একটা রহস্যের ধোঁয়া উঠছে যেন। আর ধোঁয়া দেখলে স্বাভাবিক ভাবে যেটা মনে আসে, ধোঁয়া যখন আছে তখন আগুনের অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। তাই না?

দারুণ বললেন স্যার। আমার মনেও ঠিক তেমনই অনুভূতি হয়েছিল। ওনাকে নানা ভাবে প্রশ্ন করেছিলাম, যদি কোনও ক্লু পাওয়া যায়। কিন্তু কিছুই পাইনি। নেহাতই একটা কাকতালীয় সংযোগ। পাশ করার পর ওরা যে-যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। তারপরে আর কোনও দেখা সাক্ষাৎ হয়নি।

তুমি ওনাকে জিজ্ঞেস করোনি, শান্তার নামটা ধীরাজের মুখে কীভাবে শুনেছিলেন?

করেছিলাম স্যার। শান্তা ওদের ব্যাচে টপার ছিল। অসাধারণ মেধাবী। তাই ধীরাজের মুখেও উঠে আসত ওর মেধার কথা। তখনই জেনেছিলেন শান্তার কথা। সেই শান্তা এভাবে তাঁরই বাড়িতে খুন হয়েছে, বিশ্বাসই করতে পারছেন না ভদ্রলোক।

স্বাভাবিক। শান্তা সম্পর্কে আর কিছু জানেন উনি?

না স্যার।

তুমি ধীরাজের ফোন নম্বর কালেক্ট করে রেখো। দরকার হতে পারে।

করেছি স্যার। এটা আমারও মনে হয়েছিল। তাই তখনই নিয়ে সেভ করে রেখেছি আমার মোবাইলে।

গুড। আর কোনও খবর আছে তোমার কাছে?

ওই বাড়িতে পরের দিন সকালে তল্লাশি চালাতে গিয়ে আর একটা জিনিস পেয়েছিলাম স্যার, সেটা বলাই হয়নি। একটা রক্তমাখা গ্লাভস। বাড়ির সামনের লনে একটা গাছের মধ্যে আটকে ছিল। বৃষ্টির জলে বেশির ভাগ ধুয়ে গেলেও কিছুটা রক্ত তখনও লেগে ছিল।

তিন জনেই একসাথে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকালেন পলাশ মিত্রের দিকে। আইসি দেব বেশ উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, সেটা তুমি আজ বলছ? গ্লাভসটা এখন কোথায়?

বিকাশ বলল, ফরেনসিকের লোকেরা দেখেছেন? ওটা কিন্তু আমাদের একটা দারুণ কাজের সূত্র হতে পারত মিত্রদা।

পলাশ মিত্র দুজনকেই  আস্বস্ত করে বললেন, গ্লাভসটা আমি ওদের হাতেই দিয়েছি। নানা ব্যস্ততায় বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আই অ্যাম সরি।

আইসি দেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তবুও বাঁচোয়া, ফেলে-টেলে দাওনি।

পলাশ মিত্র হেসে বললেন, কী যে বলেন স্যার। সাত বছর হয়ে গেল পুলিশে। কোনটা দরকারি আর কোনটা অকেজো এখন বুঝতে পারি।

আমি সেটা মিন করিনি মিত্র। তুমিও জানো একটা সামান্য এভিডেন্সও আমাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় কখনও কখনও। তাই ভয় পেয়েছিলাম! যাকগে, রক্তমাখা গ্লাভস ওখানে এল কী করে? খুন হয়েছে বিষ প্রয়োগে, রক্তারক্তি তো কিছু হয়নি।

উত্তম সাহা বললেন, এটা আবার কোন রহস্য! ভীষণ কনফিউজিং ম্যাটার। ও বাড়িতে ঠিক কী হয়েছিল সত্যি বলা মুশকিল।

বিকাশ মজা করে বলল, এমনও তো হতে পারে সাহাবাবু, কনফিউজ করার জন্যই এই কনফিউজিং ম্যাটার তৈরি করা হয়েছে। এর আগেও আমরা অনেক কেসে দেখেছি, খুব হোম ওয়ার্ক করে-টরে যারা ক্রাইম করে, তাদের একটা টার্গেট থাকে পুলিশকে মিসগাইড করা।

আইসি দেব বললেন, বিকাশ কথাটা খারাপ বলেনি সাহাবাবু। কোনও রক্তপাত হয়নি, অথচ রক্তমাখা গ্লাভস। একটা কাল্পনিক রহস্য তৈরি করে দেওয়ার পক্ষে কিন্তু ব্যাপারটা খারাপ নয়। আসলটাকে ছেড়ে নকলটাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে বাধ্য করানো। একটা ইলিউশন তৈরি করে দেওয়া। তাই যদি হয় তবে মানতেই হবে, হি অর শি ইজ আ স্মার্ট গাই।

শি? আপনি কি মনে করেন কোনও মহিলাও খুনি হতে পারে? উত্তম সাহা অবাক হয়ে বললেন।

হোয়াই নট। নাথিং ইজ ইম্পসিবল। খুনি যে পুরুষই আপনি জানেন?

চুপ করে গেলেন উত্তম সাহা।

আইসি দেব চিন্তিত মুখে বললেন, আরও একটা ব্যাপার হতে পারে। কোনও ভাবে তার নিজের শরীরের কোথাও কেটে যায়। তাড়াহুড়োতে মুছতে গিয়ে রক্ত লাগিয়ে ফেলে গ্লাভসে। অসতর্ক মুহূর্তে সেটা ছুড়ে ফেলে বাগানের মধ্যে।

বিকাশ বলল, সম্ভবনার দিক থেকে বিচার করলে হতেই পারে। কিন্তু একজন শার্প খুনি এরকম রিস্ক নেবে বলে আপনার মনে হয়?

হিসেব মতো নেওয়ার কথা নয়। কিন্তু সবকিছু তো সবসময় হিসেব মতো চলে না। পরিবেশ পরিস্থিতি যে সবসময় তাকে সাপোর্ট করবে, এমন তো কথা নেই। হয়তো সে করতে বাধ্য হয়েছিল। গ্লাভসটা ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনও উপায় ছিল না। কারণ আমরা রাতে দুজন কনস্টেবলকে ওই বাড়িতে পাহারায় বসিয়ে রেখে এসেছিলাম।

আপনার কথাতেও যুক্তি আছে। কোনটা ঠিক, সময়ই বলবে। তবে একটা কথা পরিষ্কার যে, শান্তা মারা যাবার পর ওই বাড়িতে কেউ একজন অবশ্যই ঢুকেছিল, অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পূর্ণ করার জন্য। যেমন, লাইট নেভানো, প্রমাণ লোপাট ইত্যাদি ফাইনাল টাচ দেওয়ার জন্য।

উত্তম সাহা বললেন, সব মিলিয়ে সামারিটা দাঁড়াল এরকম, আপাতত আমরা অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে চলেছি, কোনও আলোর কিরণের আশা নিয়ে৷ সেরকম জোরালো কিছু আমাদের হাতে নেই যেটা ধরে বলতে পারি কেস সলভ হবেই। তাই তো?

আইসি দেব বললেন, আমি চিরকালই চুড়ান্ত অপটিমিস্ট। চেষ্টা জারি রাখলে কোনও না কোনও সূত্র ঠিক পেয়ে যাব। তবে এই কেসের নেচারটা একটু অন্যরকম। অনেক বেশি ছড়ানো বলেই মনে হচ্ছে। আর কে না জানে, যে-জিনিস যত বেশি ছড়ানো, তাকে গোটানো তত বেশি কঠিন। তাই টিম ওয়ার্ক ভালো হতেই হবে। একা একা জাল গোটানো যাবে না।

মিত্র বললেন, আমরা সবাই আপনার সাথে আছি স্যার। আমরা আমাদের ডিউটি মনপ্রাণ দিয়ে পালন করব।

ঠিক আছে এখন আপনারা আসুন। যার যে দায়িত্ব আছে সেটা ফলো করুন। টাইম টু টাইম আমাকে রিপোর্ট করুন। আবারও বলছি, কোনও ছোটোখাটো বিষয়ও যেন এড়িয়ে না যায়। ইজ ইট ক্লিয়ার?

চার

এবার ঠিক দশ দিনের মাথায়। বেহালার একটা নির্জন বাড়িতে। তিনতলা বাড়ির নীচের তলার ফ্ল্যাটে, যে-ভদ্রলোক ফ্যামিলি নিয়ে ভাড়া থাকেন, তিনি ফ্যামিলি সমেত কয়েক দিনের জন্য কল্যাণীতে গিয়েছেন। মাঝের তলাতে আপাতত কেউ থাকেন না। তিনতলায় বাড়ির মালিক বয়স্ক বিধবা মহিলা বলতে গেলে একাই থাকেন। ছেলেমেযেরা বাইরে থাকে, মাঝে মাঝে এসে দেখে যায়। রাতে আলো দেখে উনি ভেবেছিলেন ওরা হয়তো ফিরে এসেছে। কিন্তু সকালে ডেকেও ওদের সাড়া না পেয়ে সন্দেহ হয়। ভেজানো দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখেন বেডরুমে পড়ে রয়েছে একটি মেয়ের লাশ। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে খবর দেন। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, বিষ প্রয়োগে মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে।

খবরটা মন দিয়ে পড়ছিল রক্তিম। রক্তিম বিশ্বাস। প্রাইভেট ডিটেকটিভ। ক্রাইম সংক্রান্ত যত ছোটো খবরই হোক, মন দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে রক্তিম। সেরকম মনে হলে পেপার কাটিং ফাইলবন্দি করে রেখে দেয়। আজকের খবরটা পড়েই নড়েচড়ে বসল রক্তিম। একই পদ্ধতিতে তিন তিনটে খুন! প্রায় চোখের সামনেই ঘটে যাচ্ছে খুনগুলো। ফাইল থেকে পুরোনো দুটো পেপার কাটিং বের করে আনল। প্রথমটা সল্টলেক, দ্বিতীয়টা পদ্মপুকুর, তৃতীয়টা বেহালা। তিনটে ক্ষেত্রেই ভিকটিম বাড়ি থেকে দূরে কোথাও গিয়ে খুন হয়েছে। তিনটেই ছিল দুর্যোগের রাত। একমাত্র পদ্মপুকুরের ঘটনাটিকে লোকাল থানার আইসি আত্মহত্যার ঘটনা বলেছেন। কিন্তু ওই যুক্তি খাটে না। প্রথম দুটো খবর ছোটো করে ছাপলেও আজকের খবর বেশ বড়ো করে ছেপেছে কয়েকটি সংবাদপত্র। অর্থাৎ মিডিয়াও সচকিত হচ্ছে ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু পুলিশ এখনও সিরিয়াসলি নিচ্ছে না কেন ব্যাপারটা?

রক্তিমের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা গেল। তবে কি কলকাতার বুকে কোনও সিরিয়াল কিলিং শুরু হয়ে গিয়েছে? বেছে বেছে অল্পবয়স্ক বিবাহিত মেয়েদেরকে নিশানা করছে এই কিলার ! কিন্তু কেন? নিঃসন্দেহে খবরটা ভয়ের। কে জানে, খুনি হয়তো এরমধ্যেই তার নেক্সট টার্গেট ঠিক করে ফেলেছে! সে কথা ভাবতেই রক্তিমের মাথার মধ্যে রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হল। আপন মনেই বিড়বিড় করে বলে উঠল, আই হেট ক্রাইম। আই হেট ক্রিমিনালস। আই হ্যাভ টু স্টপ দিস ডেডলি গেম।

ডেডলি গেম! কথাটা উচ্চারণ করে নিজেই অবাক হল রক্তিম। পরক্ষণেই একটা বাঁকা হাসি খেলে গেল ঠোঁটের কোণে। কিছু লোকের কাছে মানুষ-হত্যাটাও একটা খেলা! যে-খেলা খেলে, তারা বিকৃত আনন্দ উপভোগ করে। এরকম একটা মানুষ এখনও খোলা আকাশের নীচে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্যমনস্ক ভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করল রক্তিম। ঠিক তক্ষুণি চেনা সুরে বেজে উঠল ওর মুঠো ফোন। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ভীষণ অবাক হল। এর নামই কি টেলিপ্যাথি! মনে মনে এরকম একজনের ফোনই কি আশা করেছিল সে? গৌতম চ্যাটার্জীর ফোন, ডেপুটি কমিশনার অফ পুলিশ। ফোন ধরে সহাস্যে বলল, নমস্কার গৌতমদা। এতদিন পর এই অধমকে মনে পড়ল?

আরে না না ভাই… নানা কাজের চাপে হয়ে ওঠে না। কিছুটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারো। কত ধরনের প্রেশার নিয়ে কাজ করতে হয় আমাদের। সত্যি কথা বলতে আমরা তো আর যথার্থ শান্তির চাকরি করি না ৷ একটা না একটা ঝুট ঝামেলা লেগেই আছে। আজকের খবরের কাগজ পড়েছ?

রক্তিম হেসে বলল, হ্যাঁ পড়েছি। বুঝতে পারছি আপনি কেন ফোন করেছেন। বেহালার মার্ডার কেস নিয়ে কিছু বলতে চান তো?

ঠিকই ধরেছ। সল্টলেকের ঘটনার তদন্ত করছেন যিনি, তার নাম প্রিয় প্রসাদ দেব। আমার পরিচিত ও কাছের মানুষ। উনি এসেছিলেন একটু আগেই। ভদ্রলোক যা ব্যাখ্যা দিলেন তাতে যথেষ্ট চিন্তার বিষয় রয়েছে। খুন করার টেকনিক অভিনব। ওঁর আশঙ্কা এই খুনি সহজে থামার নয়। কিন্তু না থামাতে পারলে আমাদের বারোটা বেজে যাবে। মিডিয়া, পাবলিক সব যদি একযোগে আক্রমণ শানে, ল অ্যান্ড অর্ডার সামলানো দায় হয়ে যাবে।

ওঁর কথা খুব একটা অমূলক নয়। ইতিমধ্যেই আমার কাছে অনেকগুলো ফোন এসেছে। মিডিয়া, টিভি চ্যানেল ধীরে ধীরে রক্তের স্বাদ পেতে শুরু করেছে। হোম সেক্রেটারি ফোন করেছিলেন কমিশনারকে। এখন জাস্ট ঘটনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এরকম চলতে থাকলে সেটা আর জানতে চাওয়ার পর্যায় থাকবে না। সো ইমিডিয়েটলি আমাদের কিছু করতে হবে।

রক্তিম বলল, আপনাদের গোয়েন্দা বিভাগকে লাগিয়ে দিন। আমার ইন্টারফিয়ারেন্স কি ভালো দেখাবে?

আমাদের সমস্ত উইংসকে অ্যালার্ট করে দেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দা বিভাগের একটা স্পেশাল টিমও তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু আমি পার্সোনালি চাই তুমি আমাদের সহযোগিতা করো। কারণ তোমার প্রতি আমার আলাদা একটা বিশ্বাস আছে। সেই বিশ্বাসের মর্যাদাও তুমি রেখেছ। আসলে আমি কোনও রকম রিস্ক নিতে চাইছি না। আমি আইসি প্রিয় প্রসাদ বাবুর সাথে তোমার বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। ভদ্রলোক তোমার নাম ভালো করেই জানেন। উনিও বেশ আগ্রহ দেখালেন। তুমি আর না কোরো না।

না করার প্রশ্নই নেই। যেখানে মানুষের জীবন বাঁচানোর প্রশ্ন জড়িত থাকে সেখানে আমি ইগো দেখি না। আরও কিছু মেয়ের জীবন বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। ওদের রক্ষা করতে পারলে আমার গোয়েন্দা-জীবন সার্থক হবে। আমি আজ থেকেই কাজ শুরু করতে চাই।

দ্যাটস বেটার। আমিও সেটাই চাই। কোথাও কোনও সমস্যা হলে তুমি আমার পার্সোনাল নম্বরে ফোন করবে।

আমি প্রথমেই আইসি দেবের সাথে দেখা করে কেস ডিটেলসটা একটু ভালো করে বুঝে নিতে চাই। আপনি ওঁকে একটু জানিয়ে দিন।

নো প্রবলেম, আমি এক্ষুণি ফোন করে দিচ্ছি। এখন তাহলে রাখছি, পরে আবার কথা হবে।

ফোন রেখে আপন খেয়ালেই বেশ কয়েকবার ঘরের মধ্যে পায়চারি করে ফেলল রক্তিম। এরমধ্যে মা কখন ঘরে ঢুকেছে টেরই পায়নি। চায়ের কাপ টি-টেবিলে রাখতে রাখতে মা বললেন, কী রে নতুন কোনও কেস হাতে এসেছে নিশ্চয়ই ? তোর এই পায়চারি দেখলেই আমি বুঝতে পারি। কেসটা কীসের?

রক্তিম ধরা পড়ার হাসি হাসল। মা তার বন্ধু কাম গাইড। একসময় আইপিএস অফিসার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি নানা কারণে। স্বামী অর্থাৎ রক্তিমের বাবা ইন্ডিয়ান আর্মির একজন কর্নেল। কার্গিল যুদ্ধে বীরের মতো প্রাণ দেন। মা একা ওদের দুই ভাই বোনকে মানুষ করেছেন। রক্তিম প্রাইভেট ডিটেকটিভ হতে চাইলে, বাধা দেননি। নতুন কেস এলে মায়ের সাথেই প্রথম ডিসকাশন করে নেয়। সে দেখেছে ভদ্রমহিলার দুর্ধর্ষ আই কিউ। কোন কেসের কোন অ্যাঙ্গেল, কতটা গুরুত্বপূর্ণ এক নিমেষে বুঝে যান। মনে মনে তাই মাকেই নিজের গোয়েন্দাগিরির গুরু মানে রক্তিম।

এ পর্যন্ত যতটা জেনেছে সবটাই খুলে বলল মাকে। সবশেষে যোগ করল, তোমার কী মনে হচ্ছে, কোথা থেকে শুরু করা উচিত আমার?

মা গম্ভীর মুখে বললেন, আমার মনে হয় তোর প্রথম কাজ হওয়া উচিত ভিকটিম তিনটে মেয়ে সম্পর্কে খোঁজ করা। আমার ধারণা ওরাই এই রহস্যের প্রবেশদ্বার। কোনও না কোনও লিঙ্ক ওদের মধ্যে অবশ্যই আছে। আরও একটা জিনিস মনে হচ্ছে জানিস, তবে কতটা সঠিক সময়ই বলবে।

কী?

খুনি কোনও অধিবিদ্যায় পারদর্শী। যা দেখানো হচ্ছে সেটা আসলে মরীচিকা। আসলটা অন্য কিছু।

রক্তিম হেসে বলল, আই মাস্ট বি অ্যালার্ট। আপাতত আমি সল্টলেকে চললাম। দেখি কেসের ডিটেলসটা জোগাড় করতে পারি কিনা। ক’টা দিন খুব চাপে থাকব মনে হচ্ছে। রাত করে খাবার টেবিলে তোমার সাথে বসব।

———-

 

আইসি দেব সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ডিসিপি স্যার আমাকে সব বলেছেন। ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম মিস্টার বিশ্বাস। আপনার কথা আমি পড়েছি। বলুন কীভাবে আমি সাহায্য করতে পারি।

রক্তিম বলল, পুরো কেস হিস্ট্রিটা আমাকে একবার প্রথম থেকে বলুন। কতটুকু এগোতে পেরেছেন সেটাও বলবেন। ওই দুটো থানা থেকেও আমি শুনব।

বেশ বলছি। তার আগে একটু চায়ের কথা বলে দিই।

ঘন্টাখানেক বাদে থানা থেকে বেরিয়ে এল রক্তিম। আকাশ থমথমে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। একটা ক্যাব বুক করে তাতে উঠে বসল সে। সুমিত সেনের ফ্ল্যাটে যখন পৌঁছোল তখন বৃষ্টির তোড় আর একটু বেড়েছে। কলিংবেল টিপতে দরজা খুললেন সুমিত সেন নিজেই। ছবি দেখেছে, তাই চিনতে অসুবিধা হল না রক্তিমের। পরনে বারমুডা আর আকাশি রঙের হাতকাটা গেঞ্জি। অবাক চোখে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না। হু আর ইউ?

আমি রক্তিম বিশ্বাস। প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আপনার ওয়াইফের মৃত্যুর ব্যাপারে দুচারটে কথা বলতে চাই। আইসি দেব নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে বলেছেন আপনাকে।

হ্যাঁ, একটু আগেই ফোন করে বললেন আমি যেন বাড়িতেই থাকি, কোথাও না যাই। আর আমি যেন আপনার সাথে কো-অপারেট করি।

দেখুন সুমিতবাবু আমি আনঅফিসিয়ালি এই কেসে পুলিশকে সহায়তা করছি। তাই বেশি জানাজানি হওয়াটা কাম্য নয়।

হুম… বুঝলাম। আমার কাছে কী জানতে চান?

আপনার ওয়াইফকে যেভাবে খুন করা হয়েছে সেটা নিঃসন্দেহে কুল ব্রেনের কাজ। কোনও ধুরন্ধর অপরাধীই এতটা অ্যাডভান্স ভাবতে পারে। আপনি কি জানেন গত কয়েক দিনে আরও দুজন মহিলা একই ভাবে খুন হয়েছেন? একজন বেহালায়, অন্যজন পদ্মপুকুরে! কিছু শুনেছেন?

না তো। বলেন কী? এ তো মারাত্মক ব্যাপার !

ঠিকই বলেছেন। ইটস আ ভেরি ভেরি সিরিয়াস ম্যাটার। কোনও ভাবে সিরিয়াল কিলিং-এর ইঙ্গিতও দিচ্ছে। বাকি যে-দুজন মহিলা খুন হয়েছেন, তাদের একজনের নাম তিয়াসা সরকার, অন্যজনের নাম দেবলীনা পাত্র। তিয়াসা একটা বেঙ্গলি মিডিয়াম স্কুলের দিদিমণি। দেবলীনা মডেল। আপনি এই নাম দুটো কখনও শুনেছেন?

না। প্রথম শুনলাম।

আপনার মিসেসের সাথে কোনও কানেকশন?

যতদূর জানি, ছিল না। শান্তার বন্ধু-বান্ধবদের বেশির ভাগকেই আমি চিনি। শান্তা ভীষণ খোলামেলা টাইপের মেয়ে ছিল। আমাকে সব খুলে বলত।

আপনি ধীরাজ তালুকদারকে চেনেন?

জানি না আপনি কোন ধীরাজের কথা বলছেন। ধীরাজ নামে আমাদের এক সহপাঠী ছিল। বেঙ্গালুরুতে একসাথে পড়তাম।

হ্যাঁ, আমি সেই ধীরাজের কথাই বলছি। আপনি কি জানেন শান্তাকে যে-বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়েছে, সেটা ধীরাজদের বাড়ি?

হোয়াট! কিন্তু ধীরাজ তো বহুদিন আগেই বিদেশে চলে গিয়েছে বলেই জানি। আমরা যখন বিদেশে ছিলাম একবার ফেরার সময় দেখাও হয়েছিল। সম্ভবত হিথরো এয়ারপোর্টে। তারপর আর কোনও যোগাযোগ নেই। ও কি ফিরে এসেছে?

না। ওই বাড়িতে ওর বাবা মা থাকেন। কানেকশনটা একটু অদ্ভুত! তাই না?

কীসের কানেকশন? আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না।

আমিও বুঝতে পারিনি। বোঝার চেষ্টা করছি মাত্র। ওটা যদি ধীরাজদের বাড়ি না হয়ে অন্য কোনও বাড়ি হতো, তাহলে প্রশ্নটা উঠত না। এমনও হতে পারে খুনি ইচ্ছে করেই ওই বাড়ি চয়েস করেছিল। ইটস জাস্ট আ প্ল্যান ফর ক্রিয়েংটি আ মিস্ট্রি। একটা পার্সোনাল কোয়েশ্চেন করব কিছু মনে করবেন না প্লিজ।

ভ্রূ তুলে তাকালেন সুমিত সেন, কী কোয়েশ্চেন?

কখনও কি শান্তার সাথে ধীরাজের কোনও রিলেশন গড়ে উঠেছিল?

খেঁকিয়ে উঠলেন সুমিত, কী যা তা বলছেন? আমার মৃত স্ত্রীকে নিয়ে আপনি এসব কথা বলতে পারেন না। আই থিঙ্ক ইউ ক্রসড ইওর লিমিট।

রক্তিম শান্ত গলায় বলল, সরি মিস্টার সেন। আপনাকে হার্ট করার উদ্দেশ্য আমার নেই। আসলে মার্ডার কেস বলে কথা, সবদিক খতিয়ে দেখতে হয়। আপনি স্বীকার করুন বা না করুন, ব্যাপারটা কি খুব অসম্ভব? যদি এটার কোনও সত্যতা পরবর্তীতে খুঁজে পাই, তাহলে এটুকু বলতে পারি, আপনি অবশ্যই বিপদে পড়বেন। গোয়েন্দা হিসাবে আমার কমিটমেন্ট হল, দরকার পড়লে মাটি খুঁড়ে সত্যটা বের করে আনা। কোনও কিছুই আমাকে আটকাতে পারবে না।

আপনি কি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন মিঃ ডিটেকটিভ? এসব কী? আপনি কি ধরেই নিয়েছেন আমার স্ত্রীর হত্যাকারী আমি?

রক্তিম হেসে বলল, হুমকি নয়, আমার কমিটমেন্ট। আপনি অতটা রিঅ্যাক্ট করছেন কেন? আমি জাস্ট একটা সম্ভবনার কথা বলেছিলাম। আপনি এমন করছেন যেন ওটাই সত্যি !

থতমত খেয়ে চুপ করে গেলেন সুমিত সেন।

রক্তিম বলল, আপনার স্ত্রীকে ফিরিয়ে দিতে পারব না সুমিতবাবু। তবে তার হত্যাকারীকে অবশ্যই প্রকাশ্যে আনব। আপনি সহযোগিতা করুন বা না-ই করুন।

রক্তিমের শক্ত চোয়ালের দিকে তাকিয়ে সুমিত সেন নরম গলায় বললেন, আই অ্যাম স্যরি। আসলে এই মুহূর্তে আমার মাথার ঠিক নেই। শান্তাকে হয়তো অনেকেই পছন্দ করত। কিন্তু ও কাউকে পাত্তা দিত না। ধীরাজের সাথে কোনও রিলেশন থাকলে আমি ঠিক জানতে পারতাম। এখন একতরফা ভাবে কিছু থাকলে সেটা আমার জানার কথা নয়।

এই কথাগুলো আগেই বলতে পারতেন। যাকগে, আপনার আসল বাড়ি তো কৃষ্ণনগর। ওখান থেকে কেউ আসেননি?

বাবা, মা, কাকা, ভাই, খুড়তুতো ভাই অনেকেই এসেছিল। অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন করে ওরা চলে গিয়েছেন। শুধু ভাই আছে। পুলিশের বারণ না থাকলে আমিও চলে যেতাম। একদম ভালো লাগছে না।

বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা। আপনার ভাই কী করে?

ইকনমিক্সে মাস্টার্স কমপ্লিট করে পিএইচডি করছে।

আপনাদের বিয়েটা প্রেমের বিয়ে ছিল, আমি শুনেছি। অনেক অশান্তিও হয়েছিল।

ঠিকই শুনেছেন। শান্তার বাবা ভীষণ গোঁড়া। পরে অবশ্য মেনে নিয়েছিলেন। আমার বাড়িতে কোনও প্রবলেম হয়নি। আমার বাবা মা পুরো ফ্যামিলির সাপোর্ট পেয়েছি।

কাউকে সন্দেহ হয় আপনার?

না। শান্তাকে মেরে কার কী লাভ?

লাভ লোকসান সবসময় খালি চোখে দেখা যায় না সুমিতবাবু। শান্তাদেবীর বাড়ি থেকে কেউ আসেননি?

ওর দাদা এসেছিল। বাবা মা অসুস্থতার কারণে আসতে পারেননি।

নাকি পুরোনো অভিমান?

হতে পারে। কী করে বলি বলুন? শান্তাও ওদের এড়িয়ে চলত। তবে ওর মামা এখন বিদেশে, উনি থাকলে অবশ্যই আসতেন এবং আমার পাশে দাঁড়াতেন। শান্তার দাদা কোনও রকমে বুড়ি ছোঁয়া করেই পালিয়ে গেল।

ঠিক আছে… এখন উঠছি। দরকার পড়লে আবার আসব।

বাইরে বেরিয়ে ঘড়ি দেখল রক্তিম। একটা দশ। তিয়াসা সরকারের বাড়ি ঢাকুরিয়া। এখান থেকে খুব একটা দূরও নয়। একবার ঢুঁ মারলে কেমন হয়? আজ রবিবার। ওর স্বামী সরকারি চাকুরে। নিশ্চয়ই বাড়িতে পাওয়া যাবে। ইনভেস্টিগেশনের কাজে ডিলে করার কোনও মানে হয় না, মুহুর্তে ডিসিশন নিয়ে ফেলল রক্তিম। খুঁজে পেতে খুব একটা অসুবিধা হল না। বিশাল তিনতলা বাড়ি, তিয়াসার স্বামী দিবাকর দাশগুপ্তের। বেশ বড়ো পোস্টে আছেন। কলিংবেল টিপতে একজন বয়স্ক মহিলা দরজা খুললেন। পিছনে একটি শিশুকন্যা দাঁড়িয়ে ভারি মিষ্টি দেখতে।

নমস্কার জানিয়ে রক্তিম বলল, দিবাকরবাবুর সাথে একটু কথা বলতে চাই। আপনি কি ওঁর মা?

হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না? কোথা থেকে আসছেন?

থানা থেকেই বলতে পারেন। আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আমার নাম রক্তিম বিশ্বাস। তিয়াসা সরকারের মৃত্যুর তদন্তের ব্যাপারে পুলিশকে সহায়তা করার চেষ্টা করছি।

ভেতরে আসুন। আমি বাবুকে ডেকে দিচ্ছি। পুলিশ হলে ভেতরে ডাকতাম না। বউমার হঠাৎ করে এরকম মৃত্যু আমি মেনে নিতে পারিনি। পুলিশ আত্মহত্যা বললেও আমার কিন্তু তা মনে হয় না। বউমা এভাবে অন্য জায়গায় গিয়ে আত্মহত্যা করতে যাবে কেন? তাছাড়া ওসব বিষ বউমা পাবে কোথায়? আপনি আসল রহস্য খুঁজে বের করুন।

আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব এই রহস্যের কিনারা করতে।

বসার ঘরটা সুন্দর করে গোছানো। দামি আসবাবপত্র। দেয়ালে দামি পেইন্টিং-এর পাশাপাশি বেশ কিছু বাঁধানো স্টিল ফটোগ্রাফও রয়েছে। তার মধ্যে দু-তিনটে গ্রুপ ফটো। চিনামাটির ফুলদানিতে এখনও কিছু ফুল শুকোচ্ছে। শো কেসের নীচটা জুড়ে গল্পের বই। শো কেসের মাথায় বত্রিশ ইঞ্চি এলইডি টিভি দেওয়ালে ঝুলছে। ডানদিকে তিয়াসাদের হাসি মুখের ফ্যামিলি ছবি। খুব সুন্দর দেখতে ছিলেন তিয়াসা সরকার। সেই তুলনায় দিবাকর দাশগুপ্ত অনেকটাই বেমানান। মোটাসোটা, টেকো, ভুঁড়িওয়ালা বাবু।

 

নমস্কার, আসতে পারি?

রক্তিম হেসে বলল, অনুমতি নেবার কিছু নেই। এটা আপনারই বাড়ি। আসুন দিবাকরবাবু, বসুন। ঘরটা দেখছিলাম। খুব সুন্দর করে গোছানো, নিপুণ হাতের কাজ, এটাও কিন্তু এক ধরনের আর্ট। আমি রক্তিম বিশ্বাস, প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তিয়াসা সরকারের মৃত্যুর ব্যাপারে দুচারটে কথা জানতে এসেছি।

দেখুন পুলিশকে আমি সবই বলেছি। আর কী জানতে চান বলুন? তিয়াসার মৃত্যুতে আমি বেসামাল হয়ে পড়েছি। বাড়িতে তিন বছরের ওইটুকু বাচ্চা মেয়ে ওকে সামলানো কি সহজ কথা! তবুও মা আছে বলে রক্ষে। জানি না এর পরে কী হবে। যাইহোক, আপনি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ বলছেন। কে নিয়োগ করেছে আপনাকে?

অবশ্যই এটা জানার অধিকার আপনার আছে। যাচাই করারও। আপনি চাইলে সরাসরি ডিসিপি গৌতম চ্যাটার্জীর সাথে কথা বলে নিতে পারেন। লাগিয়ে দেব ফোন?

না না, তার দরকার নেই। আমি জাস্ট কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করছিলাম। নকল গোয়েন্দা সেজে বিশেষ কী লাভ হবে? দেখুন চেষ্টা করে, কোনও কিনারা করতে পারেন কিনা। আমি কিন্তু পুলিশের সাথে একমত। তিয়াসা আত্মহত্যাই করেছে। ওকে খুন করার মতো কোনও কারণ আমি দেখছি না। তবে স্পটটা নিয়ে একটু কনফিউশন আছে। বুঝতে পারছি না, ও ওই বাড়িতে কেন গেল মরার জন্য?

রক্তিম বলল, কনফিউশন আরও অনেক আছে দিবাকরবাবু। এটা একটা প্রিপ্ল্যানড মার্ডার, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আরও দুজন তিয়াসার মতো একই পদ্ধতিতে খুন হয়েছেন। একজন সল্টলেক, অন্যজন বেহালায়। শান্তা কুলকার্নি ও দেবলীনা পাত্র ওদের নাম। ওই দুটো নাম শুনেছেন কখনও?

না। এসব কী বলছেন আপনি? ওইসব মৃত্যুর সাথে তিয়াসার কী কানেকশন?

এখনও পাইনি কিছু। ওদের ছবি দেখাচ্ছি, দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা?

রক্তিম মোবাইলের গ্যালারি খুলে শান্তা আর দেবলীনার ছবি বের করল। আইসি দেব তিনটে কেসের যাবতীয় ডকুমেন্টস পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তার মোবাইলে। রক্তিমই চেয়ে নিয়েছিল। দেবলীনার ছবি দেখেই কেমন জানি চমকে উঠলেন দিবাকর দাশগুপ্ত। রক্তিমের গোয়েন্দা চোখ সেটা ঠিক ধরে ফেলল। তবে সেটা প্রকাশ করল না। মনে মনে আশান্বিত হল, খুব ক্ষীণ হলেও একটা সূত্রের ইঙ্গিত যেন দিয়ে দিলেন দিবাকর দাশগুপ্ত।

তাহলে আপনি এদের কোনও দিন দেখেননি, নামও শোনেননি… তাই তো?

হানড্রেড পার্সেন্ট। মিথ্যে বলে আমার কী লাভ?

তা ঠিক। না চেনাই স্বাভাবিক। এত বড়ো শহর আমাদের এই কলকাতা! ঠিক আছে আজ তবে উঠছি। মনে হয় খুব শিগগিরই আবার আসতে হবে।

কেন? কেন?

রক্তিম হেসে বলল, আপনি কী ভাবছেন, দুদিনেই এই তদন্তের কিনারা হয়ে যাবে? আমরা কেউ সুপারম্যান নই মিঃ দাশগুপ্ত।

 

 

মেইন রোডে এসে রক্তিম ফোন করল ডিসিপি গৌতম চ্যাটার্জীকে। ফোন করে বলল, একটা ফোন নম্বর ট্র‌্যাক করার ব্যবস্থা করতে হবে গৌতমদা। খুব আর্জেন্ট।

কার নম্বর?

তিয়াসা সরকারের হাজব্যান্ড দিবাকর দাশগুপ্তের। চিনতে পারছেন তো! পদ্মপুকুরের ভিকটিম তিয়াসা সরকার, তার স্বামী।

বুঝতে পেরেছি। তুমি নম্বরটা পাঠিয়ে দাও, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

পাঁচ

অভীক পাত্র ঠোঁটকাটা লোক। নিঃসংকোচে ক্ষোভ উগরে দিয়ে বললেন, দেখুন এটা তো একদিন হবারই ছিল। যেমন কর্ম তেমন ফল। অসৎ সঙ্গে পড়ে গিয়েছিল আমার ওয়াইফ। সংসারের দিকে কোনও মন ছিল না। মানি, ফেম, বিলাস এসবই ছিল ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। এসবের জন্য ও সব করতে পারত… সবকিছু।

রক্তিম জিজ্ঞাসা করল, আপনাদের বিয়ে কীভাবে হয়েছিল?

প্রেম করে। তখন দেবলীনার রূপে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। অন্ধও বটে, অন্য কিছু দেখতেই পাইনি! আমাদের ফ্যামিলি একটু সেকেলে। প্রথমে মেনে নিলেও কিছুদিন পর যখন দেবলীনার শরীর দেখানো ছবি বিভিন্ন জায়গায় বেরোতে লাগল, বাবা একদিন ডেকে বললেন, ওকে এসব বন্ধ করতে হবে, লোকে ছিঃ ছিঃ করছে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল অশান্তি। অশান্তি এমন একটা পর্যায় পৌঁছে গেল যে, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলাম। কালীঘাটের নবীনপল্লির এই ফ্ল্যাট কিনলাম লোন-টোন নিয়ে দেবলীনাই সব ব্যবস্থা করে ফেলল। এখানে আসার পর শুরু হল আমার সাথে অশান্তি। ব্যাপারটা একটা সময় রুটিনের মতো হয়ে দাঁড়াল।

তারপর?

ইদানীং একজন নন-বেঙ্গলি প্রোডিউসারের সঙ্গে খুব সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। প্রায়ই বলত, এবার আমি হিরোইন হব। দাগাজি তার নতুন প্রোজেক্টে আমাকে সিলেক্ট করেছেন।

কে এই দাগাজি, আপনি চেনেন?

দূর, পুরো নামটাও জানি না। শোনারও চেষ্টা করিনি। আমি ভালো করেই জানি এই দাগারা কেমন লোক হয়! কেমন করে নায়িকা সিলেক্ট করে। আমি পরিষ্কার বলে দিয়েছিলাম, যদি এসব করতে হয় তবে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। তারপর তোমার যা ইচ্ছা হয় তাই করো। নায়িকা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর দেবলীনা তাতে রাজিও হয়েছিল। কিন্তু তারপরেই এই ঘটনা ঘটে গেল।

আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?

ও যাদের সাথে মিশত, তারা কেউ ভালো লোক নয়। ওদের সাথে না মিললেই খুন করে দেবে। সুতরাং ওরা সবাই সন্দেহের মধ্যে থাকবে। একই ছাদের তলায় থাকলেও আমরা কেউ কারও পার্সোনাল লাইফ নিয়ে ইন্টারফেয়ার করতাম না। সকালে দুজনে  যে যার  কাজে বেরিয়ে পড়তাম, ফিরতাম রাতে। কোনও কোনও রাতে দেবলীনা ফিরতই না। এটাই অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তবে…

তবে কী?

মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে এক রাতে, দেবলীনাকে একটি ছেলের নামে কাউকে নালিশ করতে শুনেছিলাম। সম্ভবত ছেলেটা ওকে কোনও ভাবে খুব বিরক্ত করছিল। জানি না ব্যাপারটা কতটা সিরিয়াস ছিল। তবে দেবলীনা বেশ উত্তেজিত ছিল। কথা বলতে গিয়ে প্রচন্ড রাগ দেখাচ্ছিল।

একটু খুলে বলুন প্লিজ।

বলছি। সে রাতে বেশ দেরি করেই ফিরেছিল দেবলীনা। আমি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। সারা দিন অফিসে প্রচন্ড ধকল গিয়েছিল, তাই চোখে ঘুম এসে গিয়েছিল। দেবলীনা কখন ফিরেছে টেরই পাইনি। হঠাৎ ওর উত্তেজিত গলা পেয়ে ঘুম ভেঙে যায়। ও ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কথা বললেও, ভেতর থেকে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল।

ছেলেটার নাম শুনেছিলেন?

হ্যাঁ। মুকেশ কুমার।

আপনি জানার চেষ্টা করেননি, ব্যাপারটা কী?

করেছি। কিন্তু হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, ওসব শুনে তুমি কী করবে? এসব লাইনে ওসব একটু আধটু হয়ে থাকে। তুমি অত চিন্তা কোরো না, আই উইল হ্যান্ডেল দেম। এই উত্তরের পর আর কি কিছু বলার থাকে?

মুকেশ কুমারকে আপনি কোনও দিন দেখেছেন?

না।

দেবলীনা যাদের সাথে ওঠাবসা করত, তাদের আপনি চেনেন? মানে প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল?

কী করে থাকবে? দেবলীনা মনে করত আমি ওর কেরিয়ারের পথে বাধা। তাই আমাকে কখনওই ওর লাইনের লোকদের সাথে মিট করাত না। তাছাড়া আরও একটা কারণ ছিল…

সেটা কী?

ম্যারেড মেয়েদের হিরোইন হিসাবে গ্রেড কমে যায়। তাই ও বাইরে প্রচার করত, সে আন ম্যারেড। কখনও কাউকে বাড়িতে ইনভাইট করত না। এই ফ্ল্যাটে আসার পর থেকেই শাখা-সিঁদুরের পাট চুকিয়ে দিয়েছিল। আমিও বলা ছেড়ে দিয়েছিলাম। জানতাম ওর এই বেলাগাম উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য একদিন মারা পড়বে! সেটাই হল শেষপর্যন্ত।

ক্রমশ…

 

ডেডলি গেম (Crime Thriller) প্রথম পর্ব

শ্রাবণ মাস। ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ। সামযিক বিরতির পর আবার শুরু হয়েছে হালকা চালে। প্রায় সারাদিন ধরেই লাগাতার বৃষ্টি হয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে একটু বিরতি নিলেও সেটা দীর্ঘস্থাযী হচ্ছে না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল শান্তা, আটটা বাজে। রাত বেশি না হলেও চারপাশটা ঝিমিয়ে আছে। সেটা অতিবৃষ্টির কারণে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই দুর্যোগের মধ্যে কে আর সাধ করে বাইরে বেরুবে!

চিপস আর কফির কাপ হাতে টিভি খুলে বসল শান্তা। শান্তা কুলকার্নি। মারাঠি মেয়ে বাঙালি ছেলে সুমিত সেনকে বিয়ে করে এখন পুরোদস্তুর বাঙালি বউ। দুজনেই সফটওয্যার ইঞ্জিনিয়ার। বেঙ্গালুরুতে পড়ার সময় আলাপ, আলাপ থেকে প্রেম, তারপর বিয়ে। এখন শুনতে সহজ মনে হলেও, বিয়ের পিঁড়িতে বসতে দুজনকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল।

শান্তার পরিবার বেশ গোঁড়া। প্রথমে যথেষ্ট আপত্তি তুলেছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়। তার পিছনে ছিল শান্তার অদম্য জেদ আর ছোটোমামা সুনীল আপ্তের ফুল সাপোর্ট।

সুমিতদের আদি নিবাস কৃষ্ণনগরে। ওখানেই থাকে পুরো ফ্যামিলি। সুমিতরা কর্মসূত্রে কলকাতাতেই থাকে। উইকএন্ডে চলে যায় বাড়িতে। দুএকদিন খুব হই-হুল্লোড় করে কাটিয়ে আসে। প্রথমে একটু অসুবিধা হলেও এখন বাংলাটা বেশ ভালোই বলে শান্তা।

ফোন বেজে উঠল চেনা রিং টোনে। টিভির সাউন্ড মিউট করে দিল শান্তা। প্রথমে ভেবেছিল সুমিতের ফোন। সুমিত এই মুহূর্তে দিল্লিতে। বিশেষ একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে গিয়েছে, অফিস থেকেই পাঠিয়েছে। অচেনা নম্বর দেখে ভ্রু-টা ঈষৎ কোঁচকাল শান্তার। এই সময় আবার কে ফোন করল?

রিসিভ করে বলল, হ্যালো… কে বলছেন?

ওপার থেকে ভেসে এল গম্ভীর পুরুষ কন্ঠ, আপনি কী শান্তা কুলকার্নি বলছেন?

শান্তা অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ বলছি… আপনি কে বলছেন বলুন তো, ঠিক চিনতে পারছি না।

মাইসেল্ফ অবিনাশ রুদ্র। আপনি আমাকে চিনবেন না কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। আমি কয়েকটা জরুরি কথা বলার জন্য আপনাকে ফোন করেছি। কথাগুলো আপনার পক্ষে খুবই ইম্পর্ট্যান্ট। হয়তো আপনার শুনতে খুব একটা ভালো লাগবে না, তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ আমার মনে হয়েছে কথাগুলো আপনাকে বলা দরকার।

শান্তা এবার সত্যি সত্যি ভীষণ অবাক হল। ভেতরে ভেতরে একটা অদম্য কৌতূহল তৈরি হচ্ছে তার, বেশ বুঝতে পারছে। লোকটা কে? কী এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চায় যাতে শান্তার খারাপ লাগতে পারে?

আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন বলুন তো… আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

সেটাই তো বলতে যাচ্ছি। একটু মন দিয়ে শুনুন প্লিজ। মিষ্টার সুমিত সেন আপনার হাজব্যান্ড, তাই তো?

হ্যাঁ। কী হয়েছে সুমিতের? কোনও বিপদ টিপদ…

আরে না না… সেসব কিছু না। বহাল তবিয়তেই আছেন তিনি। বাই দ্য ওয়ে আমার কথাটা কিন্তু ওনাকে নিয়ে। আপনি কি জানেন সুমিতবাবু এখন কলকাতাতেই আছেন?

তড়াক করে লাফিয়ে উঠল শান্তা।

কী যা তা বলছেন আপনি? আপনার উদ্দেশ্যটা কী বলুন তো? সুমিত এখানে আসবে কোথা থেকে?

বসুন… বসুন… বুঝতে পারছি উত্তেজনায় আপনি দাঁড়িয়ে পড়েছেন। সেটাই স্বাভাবিক। মাথা ঠান্ডা করে আমার বাকি কথাগুলো শুনুন প্লিজ।

লজ্জা পেল শান্তা। লোকটার কি এক্সট্রা চোখ আছে? আবার বসে পড়ল সোফাতে।

দেখুন ম্যাডাম আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী। তাই ফোনটা করেছি। অন্যের ফ্যামিলি ম্যাটার নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও ইচ্ছাই আমার নেই। আপনার স্বামী সুমিত সেন, পায়েল মিত্র নামে একটা মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িত… সেটা কি আপনি জানেন?

শান্তা যেন হাজার ভোল্টের শক্ খেল। কোনও কথাই মুখ দিয়ে বের হল না।

আপনার বাকরুদ্ধ অবস্থা দেখে বুঝতে পারছি, আপনি এসব কিছুই জানেন না। আমি কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম, আপনাকে বোকা বানানো হচ্ছে।

শান্তা বলল, আমি বিশ্বাস করি না। আপনি যে সত্যি বলছেন তার প্রমাণ কী?

জানতাম আপনি একথাই বলবেন। আপনি হয়তো ওকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। বিশ্বাস করেন। ভালোবাসার মানুষ সর্ম্পকে এসব কথা শুনলে মেনে নিতে কষ্ট হয় বৈকি। কিন্তু ম্যাডাম সত্যি তো সত্যিই, তাকে অস্বীকার করবেন কী করে?

এতটা কনফিডেন্স নিয়ে বলছেন। আপনার কাছে কী প্রমাণ আছে?

না সেরকম কোনও প্রমাণ নেই। আমার চোখ দুটোই প্রমাণ। কোনও ছবি তুলে রাখিনি, ভয়ে রেকর্ডও করিনি। তবে আপনি চাইলে ওদের হাতে-নাতে ধরতে পারেন।

মানে?

মানেটা খুব সহজ ম্যাডাম। ওরা কোথায় আছে আমি জানি। ঠিকানাটা দিয়ে দিচ্ছি। সেখানে চলে যান, হাতে নাতে ধরে ফেলতে পারবেন। আপনি চাইলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। তবে…

আপনি কোথায় থাকেন?

ওরা যে-ঠিকানায় আছে তার আশেপাশেই। এখন ভেবে দেখুন কী করবেন।

শান্তা অন্যমনস্ক ভাবে বলল, ঠিক আছে আপনি ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিন।

ফোন কেটে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল শান্তা। সুমিত এত বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করল তার সাথে! কনফারেন্সের নাম দিয়ে এত বড়ো মিথ্যাচার? মাত্র দুবছরের মধ্যে সমস্ত ভালোবাসা উবে গেল? অথচ এই ভালোবাসা রক্ষার জন্য শান্তাকে কী লড়াইটাই না লড়তে হয়েছিল একদিন। নিজের কাছের মানুষগুলোকে দূরে ঠেলে দিতে পিছপা হয়নি। বিশ্বাস করতে মন চাইছে না, তবুও কেন জানি মন বলছে এটাই সত্যি। একটা অজানা অচেনা লোক আগ বাড়িয়ে মিথ্যে বলতে যাবে কেন? যদি অন্য কোনও অভিসন্ধি থাকত, তাহলে শান্তাকে ফোন না করে সুমিতকে ফোন করত। শান্তাকে এসব জানিয়ে ওর অন্য কিছু লাভ আছে বলে মনে হল না। অর্থাৎ সান্ত্বনা খুঁজে কোনও লাভ নেই। সত্যিটা নির্মম হলেও রূঢ় বাস্তবতা নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে, মুখ ফেরানোর আর কোনও উপায় নেই।

ফোন খুলে দেখল ইনবক্সে ঠিকানা পাঠিয়ে দিয়েছেন অবিনাশ রুদ্র। সল্টলেকের একটা বাড়ির ঠিকানা। ওই এলাকা ভালো করেই চেনে শান্তা। খুঁজে পেতে খুব একটা সমস্যা হবে না। মনে মনে ডিসিশন নিয়ে ফেলল, সত্যটাকে যাচাই করে দেখা দরকার। ঘরের পোশাক পালটে জিন্স আর টপ পরে নিল শান্তা। ঘর বন্ধ করে নেমে এল গ্যারেজে। গাড়ি বের করতে গিয়ে একবার মনে হল, এই দুর্যোগের রাতে এভাবে একা যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? পরক্ষণেই মনে হল, কাকে নেবে সাথে? যত বন্ধুই হোক, এসব খবরে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ উপভোগ করে সবাই। তাছাড়া ওদের সুখী বিবাহিত জীবন নিয়ে জেলাসি করার লোকের অভাব নেই।

এখন এরকম একটা খবর ওদের হাতে এসে পড়লে জীবন অতিষ্ট করে ছাড়বে। সুতরাং খবরটার সত্যতা যাচাই তার নিজে করাই ভালো বলে মনে হল শান্তার। যাকে সাথে নিয়ে যাবে সেও তো দেখবে সত্যিটা, দেখেশুনে সে কি মৌন হয়ে থাকবে? কানাঘুষোয় ঠিক বেরিয়ে পড়বে সব। সেরকম কোনও বন্ধুর কথা মনে পড়ল না শান্তার, যে এই মুহুর্তে তাকে সাহায্য করতে পারে। দাঁতে দাঁত চেপে গাড়ি বের করে ফেলল শান্তা। সিচুযেশন যাই হোক নিজেই হ্যান্ডেল করবে। কঠিন পরিস্থিতি সে জীবনে কম দেখেনি!

অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে আবার। রেইনকোট, ছাতা দুটোই সঙ্গে নিল শান্তা। ইস্টার্ন বাইপাস ধরে গাড়ি চলল যথাসম্ভব দ্রুত বেগে। ড্রাইভিংটা খারাপ করে না শান্তা। প্রথমে শেখার ইচ্ছেই ছিল না, সুমিত জোর করে ভর্তি করে দিয়েছিল পরিচিত একটা ড্রাইভিং স্কুলে। বলেছিল আমরা দুজন মানুষ, কত ধরনের বিপদ আপদ হয়, রাতবিরেতে কিছু হলে কোথায় ড্রাইভার খুঁজে বেড়াবে? শেষ পর্যন্ত এই কাজে লাগছে! মেজাজটা তিরিক্ষে হয়ে উঠল শান্তার। স্পিড বাড়িয়ে দিল আরও।

অন্যদিনের তুলনায় আজ গাড়ির ঢল অনেকটা কম। নিজ নিজ বাড়িতে বর্ষা রাতের মজা উপভোগ করছে শহরবাসী। একটু আগে শান্তাও সেটাই করছিল। একটা ফোন এসে দমকা বাতাসের মতো এতদিনের বিশ্বাসকে এক নিমেষে তছনছ করে দিয়ে গেল। এই বিশ্বাস আর কি ফিরে আসবে কোনও দিন! ভেতরটা মুচড়ে উঠল কিন্তু চোখ ঝাপসা হতে দিল না কিছুতেই।

এই এলাকাটা বেশ নির্জন। বাড়ি আছে বটে কিন্তু বাইরে কোনও লোকজন নেই। ঠিকানা কনফার্ম করার জন্য কাউকে জিজ্ঞেস করবে তার কোনও উপায় নেই। নিরুপায় হয়ে শান্তা ফোন করল অবিনাশ রুদ্রকে। ওর ইন্সট্রাকশন অনুযাযী সামনের মোড় ঘুরতেই দেখতে পেল হলুদ রঙের ছিমছাম দোতলা বাড়িটা। এটাই তাহলে পায়েল মিত্রের বাড়ি! মিস্টার সুমিত সেনের শান্তির জায়গা! একরাশ ঘৃণা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল যেন শান্তার গলা দিয়ে। তেতো ঘৃণাটাকে গলাধঃকরণ করে নিয়ে শান্তা বলল, আপনি আসছেন তো?

আমার আসাটা কি ঠিক হবে ম্যাডাম? ব্যাপারটা আপনাদের পার্সোনাল ম্যাটার… আগে আপনি গিয়ে ব্যাপারটা বুঝুন। সমস্যা হলে ডাকবেন, অবশ্যই যাব। আসলে আমি…

শান্তা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, বুঝেছি… ঠিক আছে আমি দেখছি।

 

রাস্তার ধার ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করাল শান্তা। গাড়িতে বসেই রেইনকোট পরে নিল। আশেপাশের বাড়িগুলোতে আলো জ্বলছে। তবে রাস্তায় একটা লোকও নেই। পুরো শুনশান। গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বের হতেই বৃষ্টি-ভেজা হাওয়ার ঝাপটা লাগল মুখে। এলোপাথাড়ি বৃষ্টি রেইনকোট ভেদ করে ভিজিয়ে দিচ্ছে শরীর। ছাতাটাও খুলে নিল শান্তা। প্রায় দৌড়ে বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গেটের গ্রিলে হ্যাজবোল্ট লাগানো। তবে কোনও তালা লাগানো নেই। হ্যাজবোল্ট খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল শান্তা। গেট পেরিয়ে একফালি লন। নানা রকম দেশি-বিদেশি গাছের সম্ভার। একটা সময় শান্তারও খুব গাছের শখ ছিল। নানা কাজের চাপে সেসব হারিয়ে গিয়েছে।

কলিং বেল টিপল। দুতিনবার টেপার পরেও কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। ভেতরে আলো জ্বলছে, তার মানে লোক তো অবশ্যই আছে। তবে কি ওরা বুঝে গিয়েছে, শান্তা এখানে এসে পড়েছে? বারান্দায় কোনও সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে কিনা ভালো করে দেখল শান্তা। কিন্তু সেরকম কিছু নজরে পড়ল না। এমনও হতে পারে হিডেন ক্যামেরা লাগানো আছে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আরও দুবার কলিং বেল টিপল। কোনও সাড়া নেই। দরজায় কড়া নেড়ে বেশ জোরেই ডাকল এবার, ভেতরে কেউ আছেন?

না এভাবে ওরা সাড়া দেবে না। দরজায় বেশ জোরে ধাক্কা দিল শান্তা। কাপুরুষ কোথাকার! ধরা পড়ার ভয়ে লুকিয়ে পড়েছে অন্য একটা মেয়ে শাড়ির আঁচলের তলায়! কিন্তু কী আশ্চর্য! ধাক্কা দিতেই দরজা হাট করে খুলে গেল। শান্তা ভেবে পেল না, এটা কী ধরনের কাণ্ড হল? যদি ওরা টেরই পেয়ে থাকে তবে দরজা খুলে রাখবে কেন? নাকি কোনও গোপন পথে পালিয়ে গিয়েছে?

পায়ে পায়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল শান্তা। সুসজ্জিত ড্রযিংরুম। ড্রযিংরুম পেরিয়ে প্রশস্ত হলঘর। দুদিকে বেডরুম। মাঝ বরাবর সিঁড়ি। মেজেনাইন ফ্লোর পর্যন্ত আলাদা একটা ঘোরানো সিঁড়ি। সবগুলো ঘরেই আলো জ্বলছে, অথচ মানুষের কোনও সাড়া শব্দ নেই। এবার কী করবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারল না শান্তা। আবার ফোন করল অবিনাশ রুদ্রকে।

এটা কী হল? আমার সাথে এসব করলেন কেন? আমারই ভুল… একজন অচেনা অজানা লোককে বিশ্বাস করে…

অবিনাশ রুদ্রের গলায় অবিশ্বাসের সুর, ওরা নেই ভিতরে? হতেই পারে না, আমার ইনফরমেশন কখনও মিথ্যে হয় না! আমি নিজের চোখে দেখেছি। আপনি ভালো করে দেখুন।

শান্তা বিরক্ত গলায় বলল, আর দেখার কিছু নেই। ফাঁকা বাড়ি, খোলা দরজা, একটা লোকেরও সাড়াশব্দ নেই। এভাবে আমাকে হ্যারাস করার জন্য আপনাকে পস্তাতে হবে। আপনি আমাকে চেনেন না অবিনাশবাবু।

বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, আমি কোনও ভুল ইনফরমেশন দিইনি। আপনি ভালো করে দেখুন। ওরা যদি পালিয়ে গিয়ে থাকে কোনও না কোনও সূত্র অবশ্যই পাবেন। আমি ফোনে আছি, আপনি দেখুন…।

এভাবে অন্যের বাড়িতে ঢুকে সার্চ করা আমার ভালো লাগছে না। তবুও এতটা এসেছি যখন একবার দেখছি। এই মুহূর্তে ড্রযিংরুমে দাঁড়িয়ে আছি। সেরকম সন্দেহজনক কিছুই নজরে পড়ছে না। দেয়ালে এক বয়স্ক দম্পতির ছবি টাঙানো রয়েছে, ওঁরা কারা?

আমি কী করে বলব? পায়েল মিত্রের বাবা-মা হতে পারেন। এরপরে কোন ঘর?

হলঘর… তারপরে পরপর তিনটি বেডরুম। হলঘরে এসেছি। সোফা, আলমারি, শো কেস, টি টেবিল এসব দিয়ে ভর্তি।

তাহলে আপনি বেডরুমে যান। ওরা পালালেও বেশিক্ষণ হয়নি, তাজা প্রমাণ কিছু না কিছু ঠিক পাবেন। গো ফাস্ট।

ঢুকেছি। একদম সামনের বেডরুমে আছি এই মুহুর্তে। কেমন জানি একটা ভ্যাপসা গন্ধ বের হচ্ছে ঘরটা থেকে। মনে হয় কেউ শোয় না এই ঘরে। দীর্ঘ দিন ফাঁকা পড়ে থাকলে যেমন গন্ধ হয় ঠিক সেরকম।

তাহলে পরেরটায় যান।

এসেছি। সুযোগ পেয়ে ভালোই বাঁদর নাচাচ্ছেন। এখানে তো উলটো কেস। বিছানা পুরো এলোমেলো। মনে হয় কেউ শুয়েছে কিন্তু শোওয়ার পর আর বিছানা গুছিয়ে রাখেনি। এখানে কোনও কিছুই নেই যেটা আপনার তাজা প্রমাণ হতে পারে।

শেষ বেডরুমটা দেখুন। লাস্ট ট্রাই। ওখানেও যদি কিছু না পান তাহলে আমি দোষ স্বীকার করে নেব। আপনি যা শাস্তি দেবেন মাথা পেতে নেব। মিথ্যে বলে আমার কী লাভ ছিল বলুন? আমি আপনার ভালোর জন্যই…

ভালো করতে গিয়ে আমার কতটা ক্ষতি করে দিলেন আপনি জানেন? আপনাকে আমি জেল খাটিয়ে ছাড়ব। এক সেকেন্ড… ওখানে ওটা কী?

আপনি কী পরের ঘরে ঢুকে পড়েছেন? মনে হচ্ছে কিছু একটা পেয়েছেন! পেতেই হবে… আমি নিশ্চিত জানি, ওরা ওই বাড়িতেই ছিল। কী পেলেন ম্যাডাম?

আহা… অত উতলা হচ্ছেন কেন? আমাকে ভালো করে দেখতে দিন আগে। দুটো চায়ের কাপ… অর্ধেক চা রয়েছে দুটো কাপেই। পাশে বিস্কুটের টুকরো। মনে হয় কিছুক্ষণ আগেই কেউ খেয়েছে। টেবিলের ওপাশে ওটা কী? আমার ছবি… আশ্চর্য আমার ছবি এখানে এল কী করে!

কী, এবার নিশ্চয়ই কনফার্ম হলেন, আমি মিথ্যে বলিনি। একটু আগে তো হাত দিয়ে আমার গর্দান নিতে যাচ্ছিলেন। এবার বিশ্বাস হল তো?

স্ট্রেঞ্জ! ছবির উপর এগুলো কী? কিছু একটা লেগে রয়েছে যেন।

কী আবার হবে, বিস্কুটের গুঁড়োটুরো হবে হয়তো।

না না অন্য কিছু। দাঁড়ান একটু মুখে দিয়ে দেখি, জিনিসটা কী?

অদ্ভুত একটা শব্দ হল। তারপর সব চুপ।

অবিনাশ রুদ্র বেশ জোরেই বলে উঠলেন, কী হল ম্যাডাম? হঠাৎ চুপ করে গেলেন কেন? আর ইউ ওকে? অবশ্য যে ধাক্কাটা খেলেন, কথা বলবেনই বা কী করে? ভগবান আপনাকে শান্তি দিন।

দুই

আইসি প্রিয়প্রসাদ দেব গম্ভীর মুখে সাব ইন্সপেক্টর উত্তম সাহার দিকে তাকিয়ে বললেন, ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারছেন সাহাবাবু?

ভীষণ গোলমেলে লাগছে স্যার। সত্যি কথা বলতে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ভদ্রমহিলা এখানে থাকেন না। এখানকার কেউ দেখেওনি তাকে। এই বাড়ির সাথে কোনও কানেকশন নেই। অথচ উনি দুর্যোগের রাতে এখানে এলেন এবং মারা পড়লেন। এখানে এলেনই বা কেন? আর মারাই বা পড়লেন কেন? এটা খুন না আত্মহত্যা, সেটাও তো বোধগম্য হচ্ছে না।

আইসি দেব অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযাযী এটা খুন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে কীভাবে খুন হলেন সে বিষয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। বাইরে ওর গাড়ি দাঁড় করানো। সম্ভবত নিজেই গাড়ি চালিয়ে এখানে এসেছিলেন। লাশের পাশে ওর মোবাইল পড়ে রয়েছে। আত্মহত্যার জন্য অজানা অচেনা একটা বাড়িতে এসে পড়বেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে উনি এখানে এসেছিলেন অথবা ওকে ডেকে আনা হয়েছিল। আমার অনুমান মিথ্যে না হলে এটা নিঃসন্দেহে প্রি-প্ল্যানড মার্ডার। যাই হোক ঘরটা সার্চ করে কিছু পাওয়া গেল?

সেরকম কিছু না। সার্চ চলছে।

পুরো বাড়িটা ভালো করে দেখুন। যে-ঘরে খুন হয়েছে লাশ নিয়ে যাবার পর সিল করে দিন। একটা জিনিসেও কেউ হাত না দেয়। বাড়ির মালিক কোথায়?

বাইরের ড্রযিংরুমে বসে আছেন। ইযং ছেলে। ভয়ে রীতিমতো কাঁপছেন।

ঠিক আছে, আমি ওর সাথে কথা বলছি, আপনি এদিকটা দেখুন।

পায়ের শব্দ পেয়ে চমকে উঠলেন বাড়ির মালিক। চোখে মুখে আতঙ্ক মেশানো বিস্ময়। আইসি দেবকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। আইসি বললেন, রিলাক্স মিস্টার…

দেবদূত… দেবদূত ঘোষ।

আপনি এই বাড়ির মালিক?

আজ্ঞে না স্যার। এই বাড়ির মালিক আমার মেসোমশাই ধীমান তালুকদার। আমি তো জাস্ট বাড়ি পাহারা দিচ্ছিলাম। এভাবে ফেঁসে যাব স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। এরকম একটা কাণ্ড ঘটবে জানলে কিছুতেই রাজি হতাম না। বিশ্বাস করুন স্যার আমি কিচ্ছু জানি না, কিচ্ছু করিনি।

তাহলে অত ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনি সবকিছু একটু খুলে বলুন প্লিজ। আমাকে একটু বুঝে নিতে দিন।

বলছি স্যার। বাড়িটা আমার মেসোমশাইয়ের। ওরাই থাকেন এখানে। ওদের দুই ছেলে বিদেশে থাকে। গত পরশু মাসি মেসো দুর্গাপুরে গিয়েছেন একটা বিয়ের নেমতন্ন রক্ষা করতে। ওরা যখন বাইরে কোথাও যান, আমি রাতে এসে এখানে থাকি। বলতে পারেন পাহারা দিই আর কী। দেখতেই পাচ্ছেন এদিকটা একটু নির্জন। ফাঁকা বাড়ি পেলে মাঝে মাঝেই চুরিটুরিও হয়। এর আগেও অনেকবার থেকেছি। কোনও দিন কিছু হয়নি। কিন্তু এবার…

দুহাতে মুখ ঢাকলেন দেবদূত। সাতাশ-আটাশ বছরের গাট্টা গোট্টা যুবক। জিম করা শরীর। টাইট গেঞ্জি ভেদ করে পেশিগুলো ফুটে উঠেছে। চওড়া মুখমণ্ডল। একটু ভোঁতা টাইপের নাক। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সামনের দিকের চুল বেশ হালকা।

দেখুন দেবদূতবাবু এসব ঘটনা তো বলেকয়ে ঘটে না। আপনার অবস্থাটা বুঝতে পারছি। তবে অযথা ভয় পাবেন না। আপনি যদি কিছু না করে থাকেন তবে আপনার কোনও ভয় নেই। পুলিশ আপনার পাশে থাকবে। কিন্তু যেহেতু এই ঘটনার সঙ্গে আপনি সরাসরি জড়িয়ে আছেন, কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া, কিছু আইনি ফর্মালিটি মেনে চলতেই হবে। আমি আশা রাখি আপনি সব রকমের সহযোগিতা করবেন।

নিশ্চয়ই স্যার।

আপনি আজ সকাল কটার দিকে এখান থেকে বেরিয়েছিলেন?

সাড়ে নটা-দশটা হবে। অন্যদিন আগেই উঠে পড়ি, আজ বৃষ্টির জন্য ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়ে যায়। সকালে চা খেয়ে কোনও রকমে স্নান সেরেই বেরিয়ে পড়ি।

আপনি কী করেন?

ফুলবাগানে আমার একটা ভ্যারাইটি স্টোর্স আছে স্যার।

আর আপনাদের বাড়িটা কোথায়?

ফুলবাগানেই স্যার। উপেন্দ্র কিশোর সরনিতে।

এখান থেকে যাওয়ার পর কী কী করেছেন একটু ডিটেলসে বলুন।

এখান থেকে সোজা বাড়িতে যাই। কিছু খেয়ে চাবি নিয়ে দোকানে চলে যাই। আমার দোকানের কর্মচারী রাজেশ একটু দেরিতে আসায় আমি নিজেই দোকান খুলে ঝাড়াপোছা করে ধূপধুনো দিই। রাজেশ এলে দোকানে বসিয়ে আমি কিছু দরকারি কাজ সারতে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। ফিরতে ফিরতে অনেকটা বেলা হয়ে যায়। রাজেশ খেয়ে আসার পর আমিও খেতে চলে যাই বাড়িতে। খাওয়ার পর কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আবার চলে আসি দোকান। আটটার দিকে দোকান বন্ধ করে বাড়ি গিয়ে মাকে তাড়াতাড়ি খেতে দিতে বলি। কারণ বৃষ্টির জন্য আমি এখানে আসতে দেরি করতে চাইছিলাম না। তবুও বেরোতে বেরোতে সাড়ে নটা বেজে গেল। বাবা মা দুজনেই বলেছিল, এই দুর্যোগের মধ্যে আজ আর যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু আমি শুনিনি। আমার ভয় ছিল, কিছু একটা অঘটন ঘটে গেলে ওদের কাছে মুখ দেখাতে পারব না। দাযিত্বটা আমি নিজে থেকেই নিয়েছিলাম। কিন্তু এরকম একটা অঘটন ঘটবে… আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। সবকিছু একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।

এখানে এসে কী দেখলেন?

দেখি সামনের গ্রিলের গেট কিছুটা খোলা। বাড়ির সামনে একটা দামি গাড়ি দাঁড় করানো। বারান্দায়, ভেতরে সব জায়গায় লাইট জ্বলছে। ভীষণ অবাক লাগল। কারণ সকালবেলা বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমি নিশ্চয়ই লাইট জ্বেলে যাইনি, তবে কীভাবে জ্বলল? একবার মনে হল, তাহলে নিশ্চয়ই মেসো-মাসি ফিরে এসেছেন। কারণ বাড়ির চাবি একটা আমার কাছে আর একটা ওদের কাছে থাকে। তবুও খটকা গেল না। মেসোমশাই ভীষণ প্যাংচুয়াল লোক, এই রকম দুর্যোগের রাতে আমাকে এরকম হয়রানি করাবেন বলে বিশ্বাস হচ্ছিল না। যদি এসেই থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই ফোন করে সেকথা জানিয়ে দিতেন। একথা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মনে হল, চোর ঢোকেনি তো? পরক্ষণেই মনে হল, চোর কখনও লাইট জ্বেলে চুরি করে? বাইরের দামি গাড়িটাও সংশয়ে ফেলে দিল। আর বেশি না ভেবে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। একরাশ বিস্ময় নিয়ে এ-ঘর ও-ঘর করতে করতে পৌঁছে গেলাম ওই বেডরুমে যেখানে লাশটা পড়ে ছিল। পড়ে থাকার ভঙ্গিমা দেখেই বুঝেছিলাম দেহে প্রাণ নেই। এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম যে কী করব, কী করা উচিত কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি প্রথমে। একটু পরে বাবা আর ভাইকে ফোন করে সব জানালাম। ওরা বলল, তুই এক্ষুনি পুলিশকে ফোন কর, আমরা আসছি। ফোন করার পনেরো কুড়ি মিনিটের মধ্যেই আপনারা চলে এলেন।

আপনি লাশ দেখেছেন, মহিলাকে চেনেন?

জীবনে কোনও দিন দেখিনি স্যার। চেনা তো দূরের কথা। উনি কেন এখানে এলেন? কীভাবে মরলেন? কিছুই বুঝতে পারছি না।

প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে বিষ প্রযোগে হত্যা। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কোনও কিছুই কনফার্ম বলা যাবে না। শুধু শুধু তো কেউ খুন হয় না, মোটিভ একটা থাকেই। ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়েছে, ধীরে ধীরে সব বেরিয়ে আসবে।

ঘরে ঢুকলেন একজন তরুণ পুলিশ অফিসার। আইসি দেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, লাশ আইডেন্টিফাই করা গিয়েছে স্যার। সি ওয়াজ শান্তা কুলকার্নি। স্বামীর নাম সুমিত সেন। দুজনেই সফটওয্যার ইঞ্জিনিয়ার। ওর মোবাইল থেকেই ডেটাগুলো পেয়েছি। গাড়িটা ওর হাজব্যান্ড সুমিত সেনের নামে।

আইসি দেব চিন্তিত মুখে বললেন, ওর স্বামীকে ফোন করেছিলেন?

হ্যাঁ স্যার। উনি এখন দিল্লিতে। দুদিন আগে একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে গিয়েছেন। শুনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আপনি চলে আসুন অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল।

খুব ভালো করেছ। গুড জব। ওকে আমাদের দরকার হবে। একটা বিষয় বারবার মনে স্ট্রাইক করছে, বুঝলে বিকাশ…

কোন বিষয় স্যার?

মোবাইলের বিষয়। যদি কেউ ওকে সাথে করে নিয়ে এসে থাকে তাহলে তার পক্ষে মোবাইলটা সরিয়ে দেওয়াটাই বেশি সেফটি ছিল না? তোমার কী মনে হয়?

আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার। আমার হিসেবে এর পিছনে দুটো কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, সে জানে মোবাইলে এমন কোনও ডেটা নেই যাতে সে বিপদে পড়তে পারে। দ্বিতীয়ত, পুলিশকে মিসগাইড করা। কোনও কিছু না পেয়ে কনফিউজড পুলিশও একসময় ভাবতে শুরু করবে, ইটস আ সুইসাইড কেস। আমার কিন্তু দ্বিতীয় সম্ভবনটাই বেশি জোরালো মনে হচ্ছে।

গুড অর্বজারভেশন। আমিও তোমার সাথে একমত। ইচ্ছে করেই মোবাইল সরানো হয়নি। তবে ওতে কিছুই নেই সেটা বলা যাবে না। ওটা থানায় নিয়ে চলো। আর মিত্রকে একটু পাঠিয়ে দাও ওর বয়ানটা লিখে নিক। দেবদূতের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বিকাশকে নির্দেশ দিলেন আইসি দেব।

তারপর দেবদূতকে বললেন, অনেক রাত হল। বয়ান লিখিয়ে আপনি বাড়ি চলে যেতে পারেন। এ বাড়ি আপাতত পুলিশ পাহারা দেবে। ফরেনসিক ভিজিট না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোনও রকম রিস্ক নেব না। তবে এই মুহূর্তে আপনি শহর ছেড়ে কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। আপনার মেসোমশাইকে জানিয়েছেন ব্যাপারটা? না জানিয়ে থাকলে জানিয়ে দিন।

পরের দিন বিকেলেই থানায় হাজির হলেন সুমিত সেন। বিধ্বস্ত চেহারা। চোখের নীচে কালি। সঙ্গে তার এক বন্ধু এসেছেন। আইসি দেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করে নিলেন একবার। দীর্ঘকায় সুদর্শন যুবক। ত্রিশ বত্রিশ বছর বয়স হবে হয়তো। বেশ ফর্সা গায়ের রং। একমাথা ঝাঁকড়া চুল। টিকালো নাক। গালে একদিন বা দুদিনের না কাটা দাড়ির কালচে আভাস। চশমা বারবার ভিজে যাচ্ছে চোখের জলে।

আইসি দেব গম্ভীর মুখে বললেন কন্ট্রোল ইওরসেল্ফ মিস্টার সেন। ঘটনাটি আপনার কাছে কতটা বেদনাদায়ক, বুঝতে পারছি। সরি টু সে, ইটস আ কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার বলেই মনে হচ্ছে আমাদের। ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়েছে। আশা করি খুব শীঘ্রই সত্যটা বেরিয়ে আসবে। এবিষয়ে আপনার কিছু বলার আছে?

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না অফিসার। শান্তা ভীষণ মিশুকে স্বভাবের মেয়ে ছিল। কখনও কোনও কনট্রোভার্সিতে জড়াত না। অসম্ভব হেল্পফুল মেন্টালিটি। ওকে কেউ কেন খুন করতে যাবে?

তাহলে তো ধরে নিতে হয় উনি সুইসাইড করেছেন। সেরকম কোনও কারণ আছে বলে কি আপনি মনে করেন?

না। সুইসাইড করার মতো কোনও কারণও আমি দেখছি না। সবসময় পজিটিভ চিন্তা করত। কখনও ডিপ্রেসড হতে দেখিনি।

আইসি দেব মৃদু হেসে বললেন, বিনা কারণে এই জগতে কিছু হয় না। অকারণটাও একটা কারণ হয়ে যায় কোনও কোনও সময়। আপনাকে এই মুহূর্তে খুব টায়ার্ড লাগছে, তাই বেশি বিরক্ত করব না।

বেল টিপে কাউকে ডাকলেন আইসি দেব। পাশের ঘর থেকে উত্তম সাহা এলে তাকে বললেন, সাহাবাবু আপনি ওদের বুঝিয়ে দিন। আপনারা ওনার সাথে যান, কিছু জরুরি ফর্মালিটিজ করতে হবে।

পোস্টমর্টেম রিপোর্ট-এ আইসি দেবের ধারণাই সত্যি প্রমাণিত হল। পটাশিয়াম সায়ানাইডে মৃত্যু হয়েছে শান্তা কুলকার্নির। ফরেনসিক এক্সপার্টরাও ওই ঘর থেকে তার নমুনা পেয়েছে। টি টেবিলে শান্তার যে ছবিটা পাওয়া গিয়েছে তাতেই ছিল বিষের ছোঁয়া। সেখান থেকেই আঙুলে করে নিজের মুখে পুরেছিলেন নিজের মৃত্যুর কারণ। শান্তার ডান হাতের তর্জনীর মাথাতেও পাওয়া গিয়েছে বিষের অস্তিত্ব। কিন্তু ওই ঘরে দেবদূত ছাড়া আর কোনও সন্দেহজনক ব্যক্তির ফরেনসিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাহলে বিষ মেশানো ছবিটা ওখানে রাখল কে? দেবদূত? নাকি শান্তা নিজেই? তাই যদি হয় তবে এটা নিঃসন্দেহে আত্মহত্যার কেস।

চিন্তান্বিত মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন আইসি দেব। উলটো দিকে বসে আছেন উত্তম সাহা। তার মুখেও চিন্তার ছাপ। হঠাৎ বলে উঠলেন, আপনি কী দেবদূতকে সন্দেহ করছেন স্যার?

কিছুটা হলেও করতে বাধ্য হচ্ছি সাহাবাবু। ওই ঘরে যদি অন্য কেউ ঢুকে না থাকে তাহলে বিষ মেশানো ছবিটা রাখল কে? ছবিটা প্ল্যান করে আগে থেকেই কেউ রেখেছিল। কারণ শান্তা কুলকার্নি গাড়ি করে বিষ সমেত ছবি নিয়ে এসে আবার নিজেই সেই বিষ চেখে দেখবেন, সেটা তো হতে পারে না, তাই না?

তা ঠিক। তবে এটাও ঠিক ফরেনসিক টিমকে ধোঁকা দেওয়া কী খুব কঠিন কাজ? পাকা ক্রিমিনালরা কী দিয়ে কী হয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে পুলিশের চেয়ে বেশি জানে। আমি কী বলতে চাইছি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন স্যার।

ইয়েস। পয়েন্টটা আপনি বেশ ভালো ধরেছেন। আর এসব প্রমাণ লোপাটের জন্য অফুরন্ত সময়ও সে পেয়েছে। এবার প্রশ্ন আসছে, শান্তা কুলকার্নি হঠাৎ করে এই বাড়িতে এলেন কী করে? এমনও হতে পারে কোনও মিথ্যে ইনফরমেশন দিয়ে তাকে এবাড়িতে ডেকে আনা হয়েছিল।

আমারও কিছুটা সেরকমই মনে হচ্ছে। কিন্তু একটা খটকা আছে। শান্তার তর্জনীর মাথায় লেগে থাকা বিষ প্রমাণ করে, সে নিজেই নিজের মুখে বিষ পুরেছিল। এমন নয় তো, ওকে ভুল বুঝিয়ে মানে ওটা কোনও খাদ্যবস্তু, এসব বলেটলে খাওয়ানো হয়েছিল বিষটা?

হতেই পারে। আমাদের এখন প্রথম কাজ হল, শান্তা এবাড়িতে কেন এসেছিলেন সেটা খুঁজে বের করা। এই প্রশ্নের উত্তর পেলে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে। আপনি একটা কাজ করুন, সুমিত সেনের ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই করুন। আর সেই সাথে দেবদূতের পেছনে একজন ইনফর্মার লাগিয়ে দিন। সব রকম ট্রাই করতে হবে আমাদের।

এই সময় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন সাব ইন্সপেক্টর বিকাশ। আইসি দেব ওকে সামনের চেয়ার দেখিয়ে বললেন, বোসো বিকাশ। তোমাকে খুব এক্সাইটেড লাগছে। এনিথিং রং?

বিকাশ বলল, তা বলতে পারেন। শান্তা কুলকার্নির মোবাইল থেকে একটা দারুণ জিনিস পাওয়া গিয়েছে স্যার।

কী জিনিস?

শান্তা ওর মোবাইলে লাস্ট কল রেকর্ড করেছিলেন। মৃত্যুর সময়, ওই কল টাইম, সব মিলে যাচ্ছে। এইমাত্র আমি পুরোটা শুনে এলাম। সাইবার এক্সপার্ট বিশ্বাসকে বলে এসেছি আপনার মোবাইলে পাঠিয়ে দিতে। শুনলে আপনি চমকে যাবেন। অবিনাশ রুদ্র নামে একজন ব্যক্তি শান্তাকে ডেকে এনেছিলেন এই বাড়িতে। পায়েল মিত্র নামে একটা মেয়ের সাথে ওর স্বামী সুমিত সেনের পরকীয়া ধরিয়ে দেবেন বলে। শান্তা তার কথা বিশ্বাস করে চলে আসেন। অবিনাশ ফোনে ফোনেই ওকে নিয়ে যান ওই ঘর পর্যন্ত। কথায় কথায় শান্তাকে দিয়ে বিষটা খাওয়ান। সম্পূর্ণ অভিনব পদ্ধতিতে খুন, অন লাইন মার্ডার। ক্রাইম ইতিহাসে বোধহয় প্রথম। ওদের কথাবার্তা শুনে আমি তো স্টান্ট হয়ে গিয়েছি স্যার। হোয়াট আ ব্রেন!

মোবাইল বেজে উঠল বিকাশের। পকেট থেকে বের করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলল, বিভাসের ফোন। মনে হয় পাঠিয়ে দিয়েছে স্যার। আপনি মোবাইল খুলুন। আমি ওকে বলে এসেছিলাম পাঠানো হলে একটি মিসকল দিস।

মোবাইল খুলে নোটিফিকেশন দেখে আইসি দেব বললেন, হ্যাঁ, পাঠিয়েছে মনে হচ্ছে। দাঁড়াও ওপেন করি।

তিনজনে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন অবিনাশ রুদ্র ও শান্তা কুলকার্নির রেকর্ড করা কথোপকথন। শেষ হবার পর আইসি দেবের কোঁচকানো ভ্রু স্বাভাবিক হতে অনেকটা সময় লাগল।

উত্তম সাহা প্রথম কথা বললেন, এ তো মারাত্মক ব্যাপার স্যার। রীতিমতো লোকেশন সেট করে চিত্রনাট্য মেনে সিনেমা বানানোর মতো ব্যাপার। বিকাশ ঠিকই বলেছে। একদম অভিনব স্টাইল। পাকা মাথার কাজ। সবচেয়ে বড়ো কথা, শান্তা ম্যাডাম বুদ্ধি করে কল রেকর্ড না করলে কিছুই বুঝতে পারতাম না।

আইসি দেব বললেন, অবিনাশ রুদ্র লোকটা কে? ওই নম্বর ধরে কিছু বের করতে পেরেছ বিকাশ?

সিমটা অবিনাশ রুদ্রের নামেই আছে। কিন্তু সেই অবিনাশ রুদ্র এক বছর আগে মারা গিয়েছেন। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা কী হয়েছে? সুতরাং এই সূত্র ধরে এগোনোর রাস্তা নেই ধরে নেওয়া যায়।

আইসি দেব আপন মনেই বলে উঠলেন, আমার মনে হয় এই কল রেকর্ডের ব্যাপারটা নকল অবিনাশ রুদ্র জানে না। হয়তো তার ভাবনাতেও আসেনি শান্তা একরকম একটা কাণ্ড করে বসবে। তাহলে ফোনটা কিছুতেই রেখে যেত না।

বিকাশ বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে স্যার। এই অ্যাডভান্টেজ আমাদের কাজে আসতে পারে।

একদম ঠিক বলেছ। তবে ব্যাপারটা আপাতত গোপন রাখতে হবে। কাউকে কিচ্ছু বলার দরকার নেই। বিকাশ তুমি শান্তার ফোন থেকে পুরো এক মাসের কলারস লিস্ট বের করে দিতে বলো ওদের। তারপর সেটা ভালো করে ভেরিফাই করো। সামান্য কোনও সন্দেহজনক কিছু পেলেই আমাকে দেখাও। আমার মন বলছে, এটা কিন্তু আর পাঁচটা সাধারণ খুনের কেস নয়, এর পিছনে বড়োসড়ো কোনও ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে।

তিন

কয়েক দিন যেতে না যেতেই আবার খুন। একই স্ক্রিপ্ট, শুধু লোকেশনটা আলাদা। এবার পদ্মপুকুর থেকে একটু ভেতরে, সদ্য নির্মিত একটি ফ্ল্যাটে। লোকাল থানার আইসি সরাসরি সুইসাইড কেস বলে দেগে দিয়েছেন। খবরটা সংবাদপত্রে খুব ছোট্ট করে ছাপা হয়েছে। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াও সেরকম কোনও গুরুত্ব দেয়নি।

কিন্তু খবরটা পড়েই নড়েচড়ে বসলেন আইসি দেব। বিকাশ আর উত্তম সাহা ঢুকতেই খবরের কাগজটা দেখিয়ে বললেন, আমার কথা কেমন মিলে গেল দেখলে? এখনও পাবলিক, মিডিয়া সেভাবে বুঝে উঠতে পারেনি। তবে সেটা হতে আর বেশি বাকি নেই। ওরা খেপলে পুলিশের ঘুম মাথায় উঠবে, তুমি মিলিয়ে নিও।

বিকাশ গম্ভীর মুখে বলল, লোকাল থানার আইসি ব্যাপারটা এত লাইটলি নিলেন কেন, বুঝে উঠতে পারছি না। উনি কি কিছুই বুঝতে পারলেন না?

কী জানি। কিন্তু আমার মনে হয় উনি ভুল করছেন। এখনই এই কেস নিয়ে সিরিয়াসলি না ভাবলে, পরে পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে ল্যাজে গোবরে হতে হবে। আমাদের থানাতেই যেহেতু প্রথম কেস, আমাদেরকেই বেশি ইনিশিয়েটিভ নিতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে এক্সপ্ল্যানেশন দিতে কোনও অসুবিধায় পড়তে না হয়।

আপনার কথা একদম সত্যি স্যার। আপনি লিড করুন, আমরা তদন্তে কোনও ফাঁক রাখব না।

গুড। সাহাবাবু আর মিত্রকে ডাকো। সবাই মিলে একটু ডিসকাস করে নিই। একটা গাইডলাইন ঠিক করে নেওয়া দরকার।

তিনজন অফিসারকে নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসলেন আইসি দেব। পদ্মপুকুরের ঘটনা উল্লেখ করে প্রথমেই বললেন, এটাকে আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলতে রাজি নই আমি। একই পদ্ধতিতে দু-দুটো খুন, আর যে হবে না গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাবে না। তাই নতুন করে কিছু ঘটার আগেই আমাদের তদন্ত শেষ করতে হবে।

উত্তম সাহা বললেন, এ বিষয়ে আপনি কিছু ভেবেছেন স্যার?

হ্যাঁ। কীভাবে এগোব, কাদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে, এসব নিয়ে মনে মনে একটা প্ল্যান করেছি। আমার মনে হয় দুটো খুনের মধ্যে অবশ্যই একটা লিঙ্ক আছে। পদ্মপুকুরের ভিকটিম এরকম কোনও ফোন পেয়েছিল কিনা, তিনিও কল রেকর্ড করেছিলেন কিনা এইসব তথ্যগুলো আমাদের জানা দরকার।

মিত্র বললেন, চান্স কম। হঠাৎ করে কোনও আজেবাজে কল এলে কজন আর সেটা রেকর্ড করার কথা ভাবে?

আইসি দেব বললেন, শান্তার উপস্থিত বুদ্ধির জন্য আমরা এটা পেয়েছি। আমার মনে হয় ওরা এরকম কিছু পায়নি। পেলে ওখানকার আইসি হুট করে সুইসাইড বলে দেগে দিতেন না। তোমার কী মত বিকাশ?

আমি আপনার সাথে একমত স্যার। নিশ্চয়ই ওরা ভিকটিমের ফোন কল ঘাঁটাঘাঁটি করে ফেলেছে এতক্ষণে। ওরা কতদূর কী জানল আমাদের জানা দরকার। দুটো ঘটনার মধ্যে আদৌ কোনও লিঙ্ক আছে কিনা, থাকলেও কতটা আছে, তার একটা আভাস পাওয়া যাবে। তাছাড়া মোটিভ অফ ক্রাইম সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই, সেটাও জানা দরকার। সব মিলিয়ে ওই ঘটনাটাকেও একসাথে বিশ্লেষণ করা জরুরি বলেই আমার মনে হয়।

ক্রমশ…

 

মৌন-মুখর

দিল্লি এয়ারপোর্ট-এর অ্যারাইভাল টার্মিনাল দিয়ে বেরোতেই, সদ্য বিবাহিত বর-কনেকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে এল শ্বশুরবাড়ির সকলে। ফুল দিয়ে সাজানো একটা ইনোভা অপেক্ষা করছিল ওদেরই জন্য। আর বরণের জিনিসপত্র নিয়ে গাড়ির সামনেই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুজাতা।

তাঁর বহুদিনের স্বপ্ন আজ বাস্তবায়িত হল। একমাত্র ছেলে অভিরূপের বিয়ে হবে, এই স্বপ্ন সেই কতবছর ধরে দেখে আসছিলেন সুজাতা। স্বামী বীরেন্দ্র দেখতে পেলেন না এটাই যা আক্ষেপের। অভি অবশ্য তার পছন্দের পাত্রীকেই বিয়ে করেছে। কর্মসূত্রে কলকাতায় কিছুদিন ছিল অভি। সেই কোম্পানিতেই কর্মরতা বৃষ্টির সঙ্গে প্রেম হয়ে যায় অভির। বছর দুয়েক আগে দিল্লিতে নিজের শহরে ফিরে এলেও, বৃষ্টি আর অভি, লং ডিস্ট্যান্স সম্পর্কটা সফল ভাবে রাখতে পেরেছিল।

কিন্তু শেষ অবধি সুজাতা একদিন ছেলেকে, ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলেন কী বাপু তোদের এযুগের প্রেম বুঝি না। বিয়ে করে বৃষ্টিকে এ বাড়িতে নিয়ে চলে আসবি তা নয়, ফোনে আর ই-মেলে চলছে তোদের সম্পর্ক! মায়ের কাছে খোঁচা খেয়ে হয়তো শেষ অবধি একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় দুজনে।

বৃষ্টিকে আপাত ভাবে দেখলে একটু কেরিয়ারিস্ট-ই মনে হতে পারে। হবেই বা না কেন। তার মা মানসী রায় ভৌত বিজ্ঞানের শিক্ষিকা, বাবা প্রতুল রায় একজন অধ্যাপক। বাড়িতে বরাবরই পড়াশোনার আবহাওয়া। সফটওয্যার কোম্পনিতে বৃষ্টি জয়ে করার পর, তার দ্রুত উন্নতিই হয়েছে। অভির সঙ্গে প্রেমটা তার কাছে সত্যিই কেরিয়ারের মতো প্রায়োরিটি ছিল না।

বৃষ্টি একটু রিজার্ভ। আসলে বাড়িতে মা তাঁর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। বাবাও অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রটাতে নানা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। নানা বড়ো পদে তাঁর অধিষ্ঠান। ফলে সংসারে তেমন সময় দিতে পারেননি। বৃষ্টির সে অর্থে বন্ধুবান্ধবও নেই। যেটুকু যা আছে ওই সোশ্যাল সাইট-এ আর কর্মক্ষেত্রে।

অভি তুলনায় খুব প্রাণখোলা। হইচই করতে ভালোবাসে। আপাত গুরুগম্ভীর চেহারার হবু শ্বশুর-শাশুড়িকে কোন মন্ত্রবলে এমন পকেটস্থ করেছিল অভি, বৃষ্টি আজও তা জানে না। তবে এর সুফল মিলেছে দ্রুত। বৃষ্টির সঙ্গে অভির বিয়ে প্রস্তাবে আপত্তি করেননি মানসী ও প্রতুল। শুধু একটিবার মেয়েে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, কলকাতার কালচার ছেড়ে দিল্লিওয়ালাদের সঙ্গে অ্যাডজার্স্ট করতে পারবি তো মা? তোর শাশুড়ি কিন্তু একটু সেকেলে। বাড়ির বাইরে পা রাখেন না। পুজোপাট, ব্রত উপবাস নিয়ে কেটে যায়। পারবি তো মানাতে?

মায়ের এই সাবধান বাণী নিয়ে একেবারেই যে ভাবেনি বৃষ্টি, তা নয়। কিন্তু অভির সঙ্গে সম্পর্কটা অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। অভিকে স্বামী হিসাবে বরণ করলে, তার পরিবারকেও মেনে নিতে হবে। সুতরাং বৃষ্টি মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল। এই মুহূর্তে যে-মহিলা বধূবরণ করে তাকে ঘরে তুলছেন, এক নজরে তাঁকে খারাপ লাগেনি বৃষ্টির। সামান্য ভারিক্কি চেহারা, ফর্সা সুন্দর মুখশ্রী, দেখে বোঝা যায় কমবয়সে বেশ সুন্দরী ছিলেন। নিজের প্রতি তেমন মনযোগ দেননি বলে বয়সের চাইতে বেশি বয়স্ক দেখায়, কিংবা অকাল বৈধব্য তাঁকে বুড়িয়ে দিয়েছে।

চিত্তরঞ্জন পার্কের বাড়িতে পেঁছে আত্মীয়স্বজনরা নানা রকম আচার অনুষ্ঠান শুরু করল। খুব ক্লান্ত লাগছিল বৃষ্টির। একে বিয়ে ধকল, তারপর ভোরের ফ্লাইট, চোখ টেনে আসছিল। অভি ব্যাপারটা বুঝে আচার অনুষ্ঠান থামাতে বলার আগেই, সুজাতাদেবীই হই হই করে উঠলেন আত্মীয়দের উদ্দেশ্যে। আরে থামো তোমরা এবার। মেযোকে একটু বিশ্রাম দেবে না, নাকি? জার্নি করে এসেছে অত দূর থেকে।

বৃষ্টি রীতিমতো অবাক হল। সুজাতাদেবী সম্পর্কে তার ধারণা ছিল মহিলা একদম ওল্ড ফ্যাশনড। কিন্তু তিনিই যে ওর ত্রাণে এভাবে এগিয়ে আসবেন, এটা তার কাছে বেশ চমকপ্রদ।

দিন যায়, বৃষ্টি আর সুজাতা আজ গল্প করতে বসেছে। আত্মীয়স্বজনরা এক এক করে বিদায় নিয়েছে, এক সপ্তাহ ধরে বিয়ে হই হুল্লোড় সেরে। তাই আজ ফুরসত মিলেছে দুজনে মুখোমুখি বসার। অফিস থেকে কটা দিন ছুটি নিয়েছে বৃষ্টি আর অভি। তাদের প্ল্যান আছে হনিমুন সেরে আবার কাজে যোগ দেবে। বৃষ্টি কলকাতার অফিস থেকে ট্রান্সফার নিয়েছে গুরগাঁওতে। ফলে অভি আর বৃষ্টি এখন সহকর্মী।

কাজে যোগ দেওয়ার আগে হনিমুন করে মনটা ফ্রেশ করে নিতে হবে। অভি বলেছিল। সেইমতো তারা পরদিনই চলে যাচ্ছে মানালি। আজ ডাইনিং টেবল-এ টুকিটাকি সবজি কাটায় সাহায্য করছিল বৃষ্টি, তার শাশুড়িকে। খুবই চুপচাপ মানুষ। কথায় কথায় বৃষ্টি বোঝে, মানুষটা একটু নিঃসঙ্গও। সুজাতা বলেন, অভি সারাদিনের জন্য বেরিয়ে যায়। ফেরে সেই রাতে। সারাদিন আমি একাই থাকি। যাক, এখন তুই এসে গেছিস, মনের কথা বলার একটা লোক পেলাম। তুই কড়াইশুঁটিগুলো ছাড়া, আমি পুজোটা সেরে নিই। সকাল থেকে উপোস করে আছি।

বৃষ্টি আন্তরিকতার সঙ্গে বলে, কেন মা, উপোস করে পুজো করলে কি ঠাকুর বেশি খুশি হবেন? এবার থেকে এত উপোস কোরো না। অসুস্থ হয়ে পড়লে তো পুজোটাই করতে পারবে না। তাতে তো ঠাকুর আরও অসন্তুষ্ট হবেন, তাই না? সুজাতা হাসেন বৃষ্টির কথায়। বলেন, ওরে মেয়ে তুই ভালো যুক্তি দিয়েছিস তো! বেশ শুনব পরের বার থেকে তোর কথা। বৃষ্টির মাথায় আঙুল দিয়ে চুলে বিলি কেটে দেন সুজাতা। খুব অদ্ভুত একটা অনুভতি হয় বৃষ্টির। সত্যিই মা   দিন এ ভাবে তাকে আদর করেনি। সময়ই পেত না মা। আজ বৃষ্টির ভেতর থেকে যেন একটা স্নেহ-কাঙাল সত্তা বেরিয়ে আসতে চাইছে। কেন যেন খুব ভালোবেসে ফেলল সে সুজাতাদেবীকে।

মাসদুয়েক কেটে গেছে। বৃষ্টি আর অভি এখন একসঙ্গেই অফিস বেরোয়। সকালের দিকটায় তাই দম ফেলার ফুরসত পান না সুজাতা। ওদের ব্রেকফাস্ট বানিয়ে টিফিন প্যাক করে দেন। বৃষ্টি বার দুয়েক প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে বলেছিল, মা লাঞ্চটা বাইরেই করে নেব, তোমায় কষ্ট করতে হবে না। তা সে কথা কানেই নেন না সুজাতা। নিজে হাতে রান্না করে খাওয়ানোর মধ্যেই তাঁর তপ্তি।

আজ সান ডে। বৃষ্টি সবাইকে সারপ্রাইজ দেবে বলে আজ সুজাতাদেবীরও আগে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে ঢুকেছে। আলুর পরোটা বানাবে বলে। সুজাতাদেবী আলুথালু শাড়ি সামলে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে অবাক। আরে তুই কেন এলি, একটা দিন ছুটি পাস। আমি করে দিচ্ছি। তুই যা বিশ্রাম নে। বৃষ্টি দুহাতে সুজাতাকে হাতে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে বলে, চুপচাপ এখানে বসে থাকবে। আজ তোমার সান ডে। তুমি রেস্ট নেবে। এবেলার পুরো দাযিত্ব আমার। রাতে ডিনার বাইরে। সুজাতার কোনও ওজর আপত্তি শুনল না বৃষ্টি।

অভি শাশুড়ি-বউয়ে এই রাগ-অনুরাগের খেলা দেখে বেশ মজা পায়। সে বোঝে বৃষ্টির সঙ্গে সুজাতার একটা আলাদা ইকোয়েন কাজ করে। তাই মিটিমিটি হাসে, কিছু বলে না। ব্রেকফাস্টের পর বৃষ্টি চুপি চুপি সুজাতার কানের কাছে মুখ এনে বলে, আজ বিকেলে একটা জায়গায় তোমায় নিয়ে যাব। কাউকে কিছু বলবে না আগে থেকে। এমনকী তোমার ছেলেকেও নয়। সুজাতা বেশ অবাক। উত্তেজিত হয়ে বলতে যান, কোথায় নিয়ে যাবি রে বৃষ্টি! বৃষ্টি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে, চুপ জানতে পারবে সময় মতো।

একটা উবর বুক করতে করতে বৃষ্টি অভিকে বলে, আমি মা-কে নিয়ে একটু বেরোচ্ছি। তুমি রাত নটা নাগাদ চাইনিজ টেম্পল রেস্টুরেন্ট-এ একটা টেবিল বুক করে রাখো। ওখানেই তোমার সঙ্গে দেখা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে অভি কী, কেন এসব !9  করে না। সে বৃষ্টিকে ভালো মতোই চেনে। জানে  করেও লাভ হবে না। বৃষ্টির প্ল্যান আগে থেকে সে কিছুতেই বলে না। তাই সে সংক্ষেপে, যথা আজ্ঞা ম্যাডাম বলে নেটফ্লিক্স-এর নতুন সিরিজ-এ মনোনিবেশ করে।

উবরটা এসে একটা বিউটি পার্লারের সামনে দাঁড়ায়। সুজাতাকে সঙ্গে নিয়ে বৃষ্টি দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে পার্লারে। তারপর একজন বিউটিশিয়ানকে ইশারায় ডেকে, তাকে কী যেন বুঝিয়ে দেয়। সুজাতার অবাক হওয়ার আরও কিছুটা বাকি ছিল। বিউটিশিয়ান মেয়েটি সুজাতাকে বসিয়ে দেয় একটা ঘোরানো চেয়ারে। সুজাতা বৃষ্টিকে বলার চেষ্টা করেন, আরে কী হচ্ছে এসব! বৃষ্টি ঠোঁটে আঙুল রেখে কপট রাগের ভঙ্গি করে। তারপর হাসি মুখে বলে, এত সুন্দরী একজন মহিলা, এভাবে এলোঝেলো কেন থাকবে। চুপটি করে বসো। ওরা যা যা করছে করতে দাও।

সুজাতা আড়ষ্ট হয়ে বসলেও, আস্তে আস্তে শরীরে আরাম নেমে আসে। দুটি মেয়ে তাঁর মাথা হেলিয়ে বেসিনে শ্যাম্পু করে দিচ্ছে চুল। চোখ বুজে আসে সুজাতার। মেয়ে দুটি বলে, আন্টি আপকে বাল কিতনে সুন্দর হ্যায়, আপ স্পা করেঙ্গে তো অউর ভি সুন্দর হো জাযো। সুজাতা একটু হেসে ওদের হাতে নিজেকে সমর্পণ করেন।

চোখ বুজে চেয়ারে গা এলিয়ে কত কথা মনে পড়ে সুজাতার। তাঁর সেই বিয়ে দিনটা, কনের সাজে সাজা। তারপর বর্ধমানের মেয়ে দিল্লির প্রবাসী বাঙালি পরিবারে বউ হয়ে আসার কথা। তখন শরিকি বাড়িতে যৌথ পরিবারে থাকতেন সুজাতা। ভাসুর, দেওর, নিয়ে বিরাট পরিবার। সময়ই পেতেন না নিজের যত্ন নেওয়ার। স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলেকে বড়ো করতে করতে আর সুযোগই পাননি নিজেকে সাজানোর। আজ ছেলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সিআর পার্কের এই ছিমছাম ফ্ল্যাটে অঢেল সময় সুজাতার হাতে কিন্তু কী আশ্চর‌্য সাজার ইচ্ছেটাই যেন মরে গেছে।

চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল বৃষ্টির ডাকে। দ্যাখো তো মা, তোমায় কত সুন্দর দেখাচ্ছে। ইতিমধ্যেই শ্যাম্পু করা চুলে সুন্দর করে ইউ কেটে দিয়েছে পার্লার প্রসাধিকারা। ফেসিয়ালের প্রলেপ, আইব্রো, ওয়াক্সিং, সব নিখুঁত। সুজাতা নিজেকে পার্লারের আয়নায় দেখে হতবাক। এই ঘরের ছটা আয়নায় যার মুখ প্রতিবিম্বিত হচ্ছে, সত্যিই তিনি! বয়সটা যেন হঠাৎই কমে গেছে সুজাতার। কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। কথা হাতড়াচ্ছেন।

বৃষ্টি কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়েছে, মুগ্ধতা তার চোখে স্পষ্ট। বলে, এত সুন্দর তুমি, কেউ ভাবতে পারত। কী চেহারা করে রেখেছিলে নিজের! আমি কিন্তু ওজর শুনব না। প্রতি মাসে একবার করে এখানে আসবে তুমি। আমি কথা বলে রাখব। বৃষ্টির জোরের কাছে হার মেনেছেন সুজাতা। এই পাগলি মেয়ের যে কী করবে, আগে থেকে কিছু বোঝা যায় না।

পার্লার থেকে সুজাতা যখন বেরোলেন, অনেকেই যে তাঁকে দেখছে, তা টের পেতে তাঁর অসুবিধে হল না। একটা হালকা নীল শাড়ি পরে বেরিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। বিধবা হওয়ার পর শুধু সাদাই পরতেন। কিন্তু অভি ওই বেশে মাকে দেখলেই কান্না জুড়ে দিত। তাই মনের সংস্কার কাটিয়ে খুব হালকা রঙের শাড়ি পরা শুরু করেছিলেন সুজাতা। আপাত ভাবে দেখলে তাঁকে সেকেলে ভাবতে পারে অন্যরা। কিন্তু সুজাতা নিজে জানেন, ভেতর থেকে তিনি অনেকের থেকে বেশি সংস্কারমুক্ত। সমাজের চাপে পড়ে কিছু নিয়ম তাঁকে মানতে হয়েছে ঠিকই কিন্তু সবেতে যে তাঁর সায় ছিল, তেমন নয়।

পার্লারে যে প্রায় তিন ঘন্টা অতিক্রান্ত হয়েছে তা এতক্ষণে খেয়াল হল সুজাতার। মণিবন্ধে বাঁধা ঘড়িটা দেখে তিনি বৃষ্টিকে তাড়া দিলেন, ওরে ভয়ংকর দেরি হয়ে গেল যে!

উফ্ কীসের দেরি মা। রাতে তো আর তোমায় রান্না করতে হচ্ছে না। আমরা বাইরে ডিনার করব বললাম না?

বৃষ্টি সুজাতাকে নিয়ে চাইনিজ টেম্পল রেস্তোরাঁয় ঢুকল। অভি ইতমধ্যেই পেঁছে অপেক্ষা করছে নির্দিষ্ট টেবিলে। এবার আরও একবার অবাক হওয়ার পালা সুজাতার, অভি ওদের দেখেই উঠে দাঁড়াল। এসো মা, এসব বৃষ্টির প্ল্যান, আমি করলে হইচই বাধাতে, বকতে। নাও এবার সামলাও তোমার বউমা-কে, বলে হাসতে থাকে অভি।

সুজাতা টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখেন একটা ঢাউস কেক-এ লেখা হ্যাপি বার্থডে মা। মোমবাতি আর বেলুন দিয়ে পার্সোনালাইজ করে এই টেবিলটা সাজানো। সুজাতা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখেন সে মিটিমিটি হাসছে। সুজাতার নিজের জন্মদিন মনেই থাকে না। এভাবে পালন করার তো প্রশ্নই নেই। অভি নির্ঘাৎ তারিখটা বলেছে বৃষ্টিকে। পরম মমতায় বৃষ্টিকে কাছে টেনে নেন সুজাতা। দ্যাখো তো পাগলির কাণ্ড! ইশ এই বয়েছে আমার জন্মদিন! লজ্জায় লাল হয়ে যান সুজাতা।

অভি এবার ভালো করে লক্ষ্য করে মা-কে, মা তুমি কী করেছ বলো তো। দারুণ গ্ল্যামারাস দেখাচ্ছে তোমাকে!

সারপ্রাইজ। বুঝলে অভিবাবু। মা-কে পার্লারে নিয়ে গেছিলাম আজ, হাসতে হাসতে বলে বৃষ্টি। গল্পে, আড্ডায় জমিয়ে খাওয়াদাওয়া করে তিনজনে। বৃষ্টি আসার পর যেন জীবনটাই বদলে গেছে সুজাতার। আর পাঁচ জায়গায় তিনি শোনেন শাশুড়ি-বউয়ে নাকি বনিবনা হয় না। বাড়িতে ঝগড়া, অশান্তিতে কাক চিল বসতে পারে না। কিন্তু তাঁর বেলায় ঘটেছে এর ঠিক উলটো। এই মেয়ে এতই আপন করে নিয়েছে তাঁকে, যেন নিজের মা।

সেদিন গা ধুয়ে টিভি-টা চালিয়েছেন। ছেলে-বউ এখনও অফিস থেকে ফেরেনি। ফোনটা বেজে উঠল সুজাতার। তাঁর ওই হাত দিয়ে সুইচ টেপা আদ্যিকালের ফোনটা ধরতে ধরতেই কেটে গেল। আবার নম্বর খুঁজে কল ব্যাক করা এক হয়রানি। ছেলে অনেকবার বলা সত্ত্বেও ফোন বদলাননি সুজাতা। তাঁর বাড়িতে এখনও একটা ল্যান্ড লাইন আছে। আত্মীয়স্বজনরা তাতেই ফোন করে। কিন্তু এই নম্বরটা কার? ফোনের কী টিপে হাতড়াতে গিয়ে আবার ফোন এল একই নম্বর থেকে। এবার আর দেরি হল না ধরতে। সুজাতা হ্যালো বলতেই ওপার থেকে ভেসে এল মানসীদেবীর গলা। খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ফোন করেছেন। কুশল বিনিময় হল দুই বেয়ানে। তারপর মানসী একটু অভিমানের সুরেই যেন বললেন, কী জাদু করেছেন দিদি। মেযো তো বাপের বাড়ি আসার নামই করছে না, বলে হাসতে থাকলেন মানসী। হাসির আড়ালে অনুযোগটা কিন্তু চিনতে ভুল হল না সুজাতার। খুবই বিনীত ভাবে বললেন, খুব ভালো মেয়েটি আপনার দিদি। কী যে আপন করে নিয়েছে আমায়। তবে ওরা দুটিতে বড্ড ব্যস্ত। একটু সময় পেলে নিশ্চয়ই যাবে আপনার কাছে। আজ এলেই বলছি।

এরপর আরও কিছুক্ষণ চলল গল্পগাছা। তারপর আবার টিভি দেখায় মন দিলেন সুজাতা। কলিংবেল বাজল। ঝড়ের বেগে ঢুকল বৃষ্টি। মা চটপট তৈরি হও। বেরোব। শপিংয়ে যাব। এরকম প্রায়ই করে বৃষ্টি। কখনও তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে বাড়ি এসে শপিংয়ে নিয়ে যায় সুজাতাকে। কখনও আবার ফিল্ম দেখতে যায় দুজনে। এখানে বাংলা ছবি এলেই মাল্টিপ্লেক্স-এ টিকিট কাটে বৃষ্টি। অনলাইন-এ ওরা খুব চটপটে। ব্যাংক থেকে সিনেমার টিকিট সবই ফোন-এ করে। সুজাতা এসব ব্যাপারে ভীষণ আনাড়ি। তাই সভয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন ছেলে-বউয়ে কাণ্ড। ছেলে যতবারই বলেছে নতুন ফোন কিনে দিই, হাঁ হাঁ করে ওঠেন সুজাতা। বলেন, খেপেছিস। এই বয়সে কী করতে কী করে ফেলব। অত দামি ফোন। পাগল! আমার ওই সুইচ টেপা ফোনই ভালো।

কিন্তু এই আপত্তিও ধোপে টিকল না। আজ শপিংয়ের প্ল্যানটা বৃষ্টি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে করেছে। মল-এর একটা মোবাইল স্টোর-এ জোর করে ঢোকাল সুজাতাকে। তারপর বেশ দামি একটা অ্যান্ড্রয়ে ফোন একরকম জোর জবরদস্তি করে কিনে দিল বৃষ্টি। এটা তোমায় নিতেই হবে। কোনও কথা শুনব না, জোর করে বৃষ্টি। সুজাতা কী যে করবেন এই মেয়েকে নিয়ে ভেবেই পান না।

ফোন বাড়িতে আসার পরও সুজাতা যত্ন করে সেটাকে তুলে রেখে  দেন, কাজ চালান সেই পুরোনো ফোনটাতেই। বৃষ্টি ব্যাপারটা খেয়াল করে মৃদু ধমক লাগায় শাশুড়িকে, ব্যাপারটা কী! ফোন-টা তোমায় ব্যবহার করার জন্যই তো কিনে দিলাম নাকি?

ও আমার দ্বারায় হবে না। বলার চেষ্টা করেন সুজাতা।

আলবাত হবে। নিয়ে এসো ফোন। বৃষ্টি নাছোড়। এরপর সারা দুপুর ধরে চলল ফোন ব্যবহার করার টুকিটাকি শেখানো। সুজাতা ভুল করেন, হাসেন, বকুনি খান কিন্তু মনের ভেতর একটা ভারি ভালো লাগা কাজ করে। এই বয়সে পেঁছেও তিনি এদের বোঝা নন। ওনার প্রতি এদের অকৃত্তিম ভালোবাসা ভরিয়ে রাখে সুজাতাকে। বিয়ের পর ছেলে পর হয়ে যাবে, এরকম অমূলক ভয় তাঁর জীবনে কাজ করেনি। স্বামী হারিয়েছেন অল্প বয়সে ঠিকই, অনেক দুঃখ যন্ত্রণা পেরিয়েছেন এটাও ঠিক কিন্তু এখন তাঁর আর কোনও দুঃখ নেই, নিঃসঙ্গতা নেই। বৃষ্টি তাঁর জীবনের সব একাকীত্ব দূর করে দিয়েছে।

কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন দুঃখ যেমন মানুষের জীবনে থাকে না, সুখেরও সেটাই ধর্ম। একদিন বিকেলে সুজাতা ব্যস্ত স্যান্ডউইচ বানাতে, ছেলে-বউমা অফিস থেকে এসে যাবে। কলিংবেল বাজল। বৃষ্টি একাই ফিরেছে। সুজাতা বললেন, কইরে সে কোথায়?

বৃষ্টি ব্যাগটা সোফার উপর ছুড়ে দিয়ে গা এলিয়ে বসল। আসবে আসবে। আমি আগে বেরিয়েছি। আচ্ছা মা, তোমাকে একটা সিরিয়াস কথা বলার আছে, বলে বৃষ্টি।

কী কথা? বল শুনি। পাশে এসে বসেন সুজাতা।

আমায় ছমাসের জন্য চেন্নাই ব্রাঞ্চে পাঠানো হচ্ছে একটা বিশেষ কাজের দাযিত্ব দিয়ে পরশু সকালেই ফ্লাইট।

কথাটা শুনে সুজাতার মুখটা ম্লান হয়ে গেল। বৃষ্টিকে ছাড়া বাড়িটাই যেন আর বাড়ি মনে হবে না। মন খারাপ করা গলায় সুজাতা বললেন, তোকে ছাড়া আর কাউকে পেল না ওরা? অভিটাই বা কী! সে কী করে অফিসে? বলতে পারল না, আমি সদ্য বিয়ে করেছি, আমার বউ যাবে না?

বৃষ্টি হেসে ফেলে শাশুড়ির কথায়। মা এটা খুব প্রেস্টিজিয়াস ব্যাপার। আমার প্রমোশন হয়েছে। সেই জন্যই কোম্পানি আমায় দাযিত্ব দিয়ে পাঠাচ্ছে। এবার সুজাতা একটু ধাতস্থ হন। বলেন, কিন্তু তুই ছাড়া আমি তো খুব একলা হয়ে যাব রে।

কে বলল একলা হয়ে যাবে। তোমার ফোন আছে না!

সুজাতার বৃষ্টির কথাটা মোটেই গ্রহণযোগ্য মনে হল না। একজন মানুষের পরিপূরক কি কখনও একটা মোবাইল ফোন হতে পারে?

বৃষ্টি উৎসাহ নিয়ে বলে, মা এখন সোশ্যাল সাইট-এ। আজই তোমায় একটা অ্যাপ নামিয়ে দেব ফোন-এ। এর নাম ফেসবুক। দেখবে তোমার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদেরও খুঁজে পাবে সেখানে। আরে সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পারের লোকেদেরও ওখানে চাক্ষুস দেখতে পাবে। তারপর করো না ভিডিযো চ্যাট, গল্প, আড্ডা। একটুও একা লাগবে না আর তোমার!

সুজাতা চুপ করে রইলেন। সত্যি বলতে কী, তাঁর মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেছে বৃষ্টির চেন্নাই যাওয়ার খবরে।

মা-কে রাজি করাতে বৃষ্টিরও খুব খারাপ লেগেছিল। চেন্নাইয়ে অ্যাপার্টমেন্ট-এ সে এখন একা। ভীষণ মিস করছে সুজাতাকে। হ্যাঁ অভিকে মিস করাটা আছে, কিন্তু সুজাতা তার মনে একটা অন্য জায়গা জুড়ে আছেন। এমন স্নেহ সে ছোটো থেকে পায়নি। এক সপ্তাহ হল এসেছে। কাজে যোগ দিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সারা সপ্তাহ ব্যস্ততায় এই একলা লাগাটা ফিল করেনি বৃষ্টি। কিন্তু আজ প্রথম উইক এন্ড-এ বেশ ফাঁকা ফাঁক লাগছে। অভির সঙ্গে কথা হয়েছে একটু আগে। মায়ের সঙ্গেও কিন্তু তাতে মনখারাপটা আরও বেড়ে গেছে।

মোবইলটা একাকিত্বের শেষ ভরসা। সেটা নিয়ে বিছানায় গা এলাল বৃষ্টি। খানিক ইনস্টাগ্রাম ঘাঁটাখাঁটি করল। তারপর পাশে রেখে দিল ফোনটা। একটু চোখ বুজে শুয়ে থাকবে ঠিক করল। হঠাৎই একটা নোটিফিকেশন আসার শব্দ হল। আলস্যে ভর করে ফোনটা আবারও হাতে তুলে নিল বৃষ্টি। ফেসবুক-এর নোটিফিকেশন। একটা ফ্রেন্ড রিকোযে্ট এসেছে। অবহেলায় ক্লিক করে বৃষ্টি। সুজাতা সেন সেন্ড ইউ আ ফ্রেন্ড রিকোযে্ট।

বৃষ্টি উঠে বসে বিছানায়। মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে বৃষ্টির। অ্যাকসেপ্ট বাটনটা প্রেস করে। সুজাতার একটা খুব সুন্দর ছবি রয়েছে প্রোফাইলে। একটা ছোট্ট সাফল্যের আনন্দে মনটা ভরে ওঠে বৃষ্টির। এই প্রথম যেন একটা অন্য জগতের সঙ্গে যোগাযোগ হতে যাচ্ছে সুজাতার। আর তার সেতুটা তৈরি করেছে সে, অর্থাৎ বৃষ্টি। ভিডিযো কল বাটনটা টিপে দেয় বৃষ্টি। স্ক্রিনের ওপর ভেসে ওঠে সুজাতার হাস্যময় মুখ।

কেমন আছিস সোনা, বাড়িটা কী যে ফাঁকা লাগছে…। বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন সুজাতা। বৃষ্টিরও ভারি কান্না পাচ্ছিল, সে যথা সম্ভব সেটা চেপে নিয়ে বলে, কোথায় বাড়ি ছেড়ে গেছি আমি মা? এই আছি তোমার স্ক্রিনে।

অন্ধের দিনরাত্রি

এস্থার ঘড়ির দিকে তাকাল। বেশ কয়েক সেকেন্ড ধরে হয়তো অ্যালার্ম-টা বাজছে। এত তাড়াতাড়ি সকালে ওঠার অভ্যাস আগে একেবারেই ছিল না। সকাল আটটার আগে ওর ঘুমই ভাঙত না। কিন্তু এখানে এটা শোভনীয় নয়! এটা শ্বশুরবাড়ি। মাত্র দুদিন হল তার বউভাত হয়েছে। একেবারে নতুন বউ। কিন্তু এ-বাড়ির প্রতিটা সদস্য যেভাবে তাকে আপন করে নিয়েছে, এস্থারেরও মনে হচ্ছে, পরিবর্তে ওদের জন্যও তার কিছু হলেও করা উচিত।

প্রসূনের মুখেই শুনেছিল, প্রসূনের মা সুনন্দা খুব সকালে উঠে পড়েন সংসারের কাজ সামলাতে। সুনন্দার নাকি ওটাই বরাবরের অভ্যাস। এস্থার দেখল ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে, তার মানে শাশুড়ি এতক্ষণে উঠে পড়েছেন। বাড়ির সকলের সকাল সকাল চা পানের অভ্যাস। সেও তাড়াতাড়ি রাতের পোশাক বদলে চোখমুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।

এস্থার কল্পনাও করেনি প্রসূনের মা-বাবা এত সহজে প্রসূনের সঙ্গে তার বিয়েতে রাজি হয়ে যাবেন। কারণ সব সময় প্রসূনের মুখে শুনেছে, এদের পরিবার খুব গোঁড়া ব্রাহ্মণ আর সেখানে এস্থার খ্রিস্টান পরিবারের মেয়ে কিন্তু বউভাতের দিনই তার মনের এই শঙ্কা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যেও ওর মনে হয়নি, ও অন্য ধর্মের এবং ভিন্ন জাতের।

জাতি, ধর্ম কখনওই স্নেহ, ভালোবাসার মধ্যে দেয়াল হয়ে উঠতে পারে না, তার জ্বলন্ত উদাহরণ প্রসূনের পরিবার। এই সবই ভাবতে ভাবতে এস্থার রান্নাঘরে ঢুকতে যাবে, হুঁশ ফিরল প্রসূনের একমাত্র পিসির চিৎকারে, আরে আরে… বউমা এ কী অনর্থ করতে যাচ্ছো…।

প্রসূনের বিধবা পিসি সুমিত্রা বেশিরভাগ সময়ে নিজের শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে ভাইয়ের সংসারেই পড়ে থাকেন। সকাল সকাল উঠে পড়েন এবং হাতে জপের মালা নিয়ে একটা ধুনুচি জ্বালিয়ে আসন পেতে হলঘরটায় বসে থাকেন। ভান করেন জপ করছেন কিন্তু আসলে নজর রাখেন বাড়ির কে কী করছে। হলঘরটা থেকে সব ঘরগুলো পরিষ্কার দেখা যায়।

সুমিত্রার চিৎকারে, ভাইয়ের বউ সুনন্দা তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে দৌড়ে এসে ঘরে ঢোকে। এস্থারও হঠাৎ পিসিমার চিৎকারে স্থানুবৎ রান্নাঘরের দরজায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়, ভয়ে ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে।

সুনন্দা কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই পিসিমা এস্থারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এই বাড়িতে পা দিয়ে তুমি আমার ভাইয়ের নাক কাটিয়েছ সমাজে। জাত-কুল সব নষ্ট হয়েছে। এখন আবার স্নান না করেই রান্নাঘরে ঢুকে আমাদের ধর্মও নষ্ট করার ইচ্ছে রয়েছে? ধর্ম নিয়ম বলে কিছু আছে তো নাকি? অবশ্য তোমরা মোমবাতি জ্বালানো ছাড়া আর কী-ই বা জানো? কিন্তু সুনন্দা, তুমি… তোমার তো এই পরিবারে এতগুলো বছর কেটে গেল, এখনও কি তুমি নিয়মগুলো শিখতে পারলে না?

সুনন্দা উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। পিসিমা আবার বলেন, বউমাকে বুঝিয়ে দাও এ সংসারের কিছু রীতি নিয়ম আছে। এখানে কী কী করা যাবে আর কী না, সেটা ওকে পরিষ্কার করে বলে দাও। ছেলের মোহ-তে এতটাও অন্ধ হয়ে যেও না যে বাড়ির পুরোনো নিয়ম বদলে ফেলতে হবে।

এস্থার ভয়ে রান্নাঘরের দরজাতেই কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রথম দুদিন সুনন্দা ওকে কোনও কাজ করতে দেয়নি। আজ এস্থার নিজে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিল শাশুড়িকে যতটা সম্ভব সাহায্য করবে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না কাল অবধি যে-পিসিমা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, আজ এমন কী দোষ করে ফেলল যে তার উপর পিসিমা এতটা রেগে উঠলেন?

সুনন্দা ভয় মিশ্রিত গলায় উত্তর দিলেন, ও তো একেবারে নতুন দিদি, আস্তে আস্তে সব শিখে যাবে। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি নিজে হাতে করে সব শিখিয়ে দেব। এবারের মতো ওকে ক্ষমা করে দিন।

হ্যাঁ শিখতে তো হবেই। তোমার ছেলে শুধু বেজাতের বউ-ই নয় অন্য ধর্মেরও মেয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছে। সব শুনে সুনন্দা চুপচাপ ওখান থেকে চলে যেতে যেতে এস্থারকেও ইশারা করলেন সঙ্গে আসার জন্য।

ননদের চোখের আড়াল হতেই সুনন্দা, এস্থারকে কাছে টেনে নিয়ে স্নেহবশত ওর মাথায় হাত রাখলেন, দিদির কথায় কষ্ট পেও না। একটু কড়া কড়া কথা বলেন ঠিকই কিন্তু মনের দিক থেকে খুবই ভালো মানুষ। তুমি বরং স্নানটা সেরে নাও, ততক্ষণ আমি পুজোটা করে নিচ্ছি। তারপর দুজনে মিলে চা-জলখাবার করব, বলে সুনন্দা পুজোর ঘরের দিকে চলে গেলেন।

এত সকালবেলায় স্নানের কথা এস্থার ভাবতেও পারে না। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির সকলের মন জিততে গেলে সকালেই তাকে স্নান করতে হবে। প্রসূন আগেই বলে দিয়েছে, এস্থারকে নিয়ে কোনও অভিযোগ পরিবারের মুখ থেকে শুনতে সে রাজি নয়। কারণ এই ব্যাপারে ও স্ত্রীকে কোনও সাহায্যই করতে পারবে না।

 

সকালের ঘটনায় এস্থার কিছুটা নিরাশ হয়ে পড়েছিল। মনের মধ্যে কোথাও যেন বাড়ির সদস্যদের প্রতি একটা বিতৃষ্ণার মনোভাব উঁকি মারার চেষ্টা চালাচ্ছিল। এস্থার জোর করে মন থেকে নেতিবাচক মনোভাব সরিয়ে রেখে স্নানে চলে গেল। স্নান সেরে তৈরি হয়ে বাইরে এসে দেখল সকলে খাবার টেবিলে এসে বসেছে।

শাশুড়িমা চা-জলখাবার বানিয়ে টেবিলে পরিবেশন করে দিয়েছেন। সকলেই খাওয়ায় মনোনিবেশ করেছে। একা সুনন্দা সকলকে পরিবেশন করছেন। কেউ লুচি চাইছে তো কেউ তরকারি। কেউ আর এক কাপ চায়ের ফরমায়েশ করছে। এমনকী সুনন্দার একমাত্র মেয়ে শিল্পীও মা-কে দুপুরে কী খাবে তার ফরমায়েশ জানাচ্ছে। বেচারি সুনন্দা একা হিমশিম খাচ্ছেন!

এসব দেখে এস্থার ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড রেগে উঠলেও মুখে কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সকলের ওর উপর চোখ পড়লেও, কেউই মুখে কিছু বলল না। এমনকী প্রসূনও না! সুনন্দা রান্নাঘরে ছিলেন। সকলের ব্যবহারে এস্থার এতটাই মনে আঘাত পাচ্ছিল যে, ওর চোখে জল এসে গেল। সুনন্দা এস্থারকে দেখতে পেয়ে বললেন, এস্থার তুমিও চা খেয়ে নাও।

সুনন্দার কথা শেষ হতেই টেবিলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে প্রসূনের ঠাকুমা বলে ওঠেন, বউমা, এখন তুমি বাড়ির বউ শুধু নও, শাশুড়ি হয়ে গেছ। সুতরাং তোমার দাযিত্ব এখন যে, ভুল করেও এমন কিছু কোরো না যেটা নিয়ে পরে তোমাকে পস্তাতে হতে পারে। এটা তোমার বাপের বাড়ি নয়, যেখানে সবকিছু সবাই মেনে নেবে।

ঠিক আছে মা, মাথা নীচু করে সুনন্দা উত্তর করলেন।

প্রসূনের ঠাকুমা আবার বললেন, আর একটা কথা বউমা, কাল আমার গুরুদেবকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছি। যা যা ব্যবস্থা করার সব করে রেখো। পুজোর সমস্ত সামগ্রী গুরুদেব নিজেই নিয়ে আসবেন। পুরো বাড়ি শুদ্ধ করে দেবেন এবং একই সঙ্গে এই ছুঁড়িটার নাম বদলে ওকেও শুদ্ধ করে দেবেন।

মায়ের কথা শুনেই সুমিত্রা জপের মালা আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে ঈশ্বরের আরাধনায় সামান্য বিরাম টেনে জিজ্ঞেস করলেন, নাম বদলে… কিন্তু কেন?

তোরও কি জ্ঞানগম্যি সব লোপ পেল সুমি? ছুঁড়িটার নাম মুখে এলেও জিভ মনে হয় অশুদ্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া গুরুদেবও বলেছেন, নাম বদলালেই প্রসূনের বিবাহিত জীবন সুখময় হতে পারবে, ভবিষ্যতে নয়তো বিচ্ছেদের সম্ভাবনা থাকবে। তাছাড়াও ছুঁড়িটার কারণে পরলোকে আমাদের পূর্বপুরুষদের উপর যে-কলঙ্ক লেগেছে, সেটাও গুরুদেব যজ্ঞ করে দূর করে দেবেন। ওনাদের ওখানে তাহলে আর নরকবাস করতে হবে না। একই সঙ্গে শিল্পীর বিয়ের জন্যও গ্রহশান্তির ব্যবস্থা করাবার কথা বলছিলেন গুরুদেব। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থেমে যান সুনন্দার শাশুড়ি গায়ত্রীদেবী।

একটু দম নিয়ে এবার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, প্রদীপ, ব্যাংক খুললেই সকাল সকাল গিয়ে এক লক্ষ টাকা তুলে আনিস। পুজোর জন্য লাগবে।

টাকার অঙ্ক শুনেই প্রসূনের বাবা আঁতকে উঠে মায়ের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বললেন, মা এক লক্ষ টাকা, তাও শুধু পুজোর জন্য! একটু বেশি নয় কি?

ভাইয়ের কথা শুনে সুমিত্রা বলে উঠলেন, বেশি কোথায় রে ভাই। এটা খুবই কম! আমাদের পরিবারের উপর গুরুদেবের আশীর্বাদ রয়েছে। এছাড়া মা গুরুদেবের পরমভক্ত, তাই এতটা কমে এই পুজোপাঠ করতে রাজি হয়েছেন তিনি। তুই আর সুনন্দা তো ছেলের প্রতি অন্ধ হয়ে একটা বিধর্মী মেয়েকে বাড়ির বউ করে নিয়ে এসেছিস। তোদের জন্য আমাদের পরলোকগত পূর্বপুরুষদের সারাজীবন কষ্ট পেতে হবে।

প্রসূন এতক্ষণ চুপ করে থেকে বাবার মুখে চিন্তার আনাগোনা লক্ষ করছিল। ও বাবাকে নিশ্চিন্ত করতে বলল, বাবা, তোমাকে কোথাও যেতে হবে না, আমি আমার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে আনব।

এস্থার অবাক হয়ে যায় প্রসূনের ব্যবহারে। এতদিন ধরে ওর সঙ্গে মেলামেশা করছে, প্রসূনের এরকম অন্ধবিশ্বাস আগে কখনও সে দেখেনি। সেই সঙ্গে প্রসূনের পুরো পরিবার এতটা শিক্ষিত এবং আধুনিক হয়ে কীভাবে এই অন্ধবিশ্বাসের অন্ধকার গারদে স্বেচ্ছায় বন্দি থেকে গেছে, সেটা এস্থারের কিছুতেই বোধগম্য হল না। তার খালি মনে হচ্ছিল, এই ধরনের মানসিকতার মানুষগুলো কী করে প্রসূনের সঙ্গে তার বিয়েতে রাজি হয়েছিল।

 

আসলে এস্থারের এটা অজানাই ছিল যে, এই গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবার তাকে বউ হিসেবে এইজন্যই মেনে নিয়েছিল, যাতে তাদের একমাত্র রোজগেরে ছেলে বিয়ের পরে আলাদা না থাকতে শুরু করে দেয়। তাছাড়া এস্থারও খুব বড়ো চাকরি করে। ফলে ছেলে, বউমা দুজনকেই প্রযোজনে কাজে লাগবে। এছাড়াও বাড়ির একমাত্র মেয়েরও বিয়ে দিতে হবে সুতরাং সেখানেও টাকার দরকার পড়বে।

এইসব নানা কথা চিন্তা করতে করতে হঠাৎ এস্থারের খেয়াল হল যখন গুরুদেব আর গ্রহশান্তির কথা হচ্ছিল, তখন সে কথা শুনে শাশুড়িমা-র মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে পড়েছিল আর শিল্পীর মধ্যেও একটা অস্থিরতা এস্থার টের পেয়েছিল।

যে-মেয়ে হেসে হেসে এতক্ষণ সকলের সঙ্গে গল্প করছিল, গ্রহশান্তির কথা শুনেই তার মুখের এই ভাবান্তর, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া এবং শিল্পীর পিছনে সুনন্দারও চলে যাওয়াটা এস্থারকে ভাবিয়ে তুলছিল। এস্থারও একটু বসে নিজের ঘরে যেতে গিয়ে শিল্পীর ঘরের সামনে পৌঁছোতেই, সুনন্দা আর শিল্পীর কথোপকথন তার কানে এল।

শিল্পী বলছে, মা আমি গ্রহশান্তির জন্য কিছুতেই পুজোয় বসব না, তাতে আমার বিয়ে হোক আর নাই হোক।

সুনন্দা মেয়েকে বোঝাবার চেষ্টা করতে করতে বলছেন, শিল্পী, ঠাকুমা আগে থেকেই তোমার গ্রহশান্তির জন্য গুরুদেবকে বলে রেখেছেন, সুতরাং তোমাকে তো পুজোতে বসতেই হবে। এই পুজোর ফলে তোমার ভালো বাড়িতে বিয়ে হবে। স্বামী, শ্বশুরবাড়ি সব ভালো হবে।

এস্থার আর অপেক্ষা করতে পারল না, দরজা ঠেলে ঘরের ভিতর ঢুকে এল। শাশুড়িকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, মা কী হয়েছে, গ্রহশান্তির কথা শুনে শিল্পী এত কাঁদছে কেন? সুনন্দা উত্তর করলেন না। একই ভাবে মেয়েকে বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

হঠাৎই শিল্পী নিজের রাগ সামলাতে না পেরে সুনন্দার উপর চেঁচিয়ে উঠল, মা তুমি কেন বুঝতে পারছ না, পুজোর পর প্রতিবার আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার সারা গায়েহাতে প্রচণ্ড ব্যথা করে। মা, আমার ভীষণ ভয় লাগে। প্লিজ মা আমি পুজোতে বসব না।

শিল্পীর কথার থেকে বেশি ওর চোখে, মনের ভয়টা পরিষ্কার ফুটে উঠেছিল। শিল্পীর অবস্থা দেখে স্বাভাবিক কণ্ঠেই এস্থার শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করল, মা, শিল্পীর পুজোতে বসা কি খুব দরকার?

এস্থার, তোমার এ বাড়িতে মাত্র তিন-চারদিনই হয়েছে। সুতরাং প্রশ্ন করা ছেড়ে কালকে গুরুদেবের সেবায় এবং খাওয়াদাওয়ার আযোজনে আমাকে সাহায্য কোরো। আর প্রসূনকে বোলো এক লক্ষের একটু বেশি টাকা তুলতে। কারণ পুজোর খরচ ছাড়াও গুরুদেবকে দক্ষিণাও দিতে হবে, যাতে শিল্পীর জন্য ভালো সম্বন্ধ আসে।

শাশুড়ির কথা শুনে এস্থার বুঝে গিয়েছিল, সময় থাকতে তাকেই সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়তো তার সংসার ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে, সেই সঙ্গে তার নিজের পরিচয়, অস্তিত্ব সবই ধুলোয় চাপা পড়ে যাবে।

এই পরিবারের লোকেদের চোখে অন্ধবিশ্বাসের এমন ঠুলি পরানো আছে, যা বার করে ফেলাটা খুব সহজ নয়। এস্থার এও জানে সে চেষ্টা করলেই সফল হবে এমন কোনও নিশ্চয়তাও নেই। তাই শুদ্ধিকরণ, নামকরণ, বিয়ের জন্য গ্রহশান্তির পুজো এসব যে কতটা বুজরুকি তা জেনেও, পরের দিন সকালে উঠে এস্থার, শাশুড়িকে সাহায্য করার জন্য তৈরি হয়ে নিল।

 

যথাসময়ে গুরুদেব পাঁচ শিষ্যকে সঙ্গে করে এস্থারের শ্বশুরবাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। এস্থার বাদে সকলে গুরুদেবের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিল। সবার হয়ে গেলে গায়ত্রীদেবী এস্থারকে ইশারা করলেন, গুরুদেবের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিতে।

আশীর্বাদ দেওয়ার নামে গুরুদেব যেভাবে এস্থারকে স্পর্শ করলেন, তাতে এস্থারের সারা শরীর শিউরে উঠল। গুরুদেবের শিষ্যদের দৃষ্টিও ক্ষুধার্ত পশুর মতো মনে হল এস্থারের। সেই মুহূর্তে গায়ত্রীদেবী পুজো শুরু করে দেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করতেই এক রহস্যময় হাসি খেলে গেল গুরুদেবের মুখে। এস্থারকে দেখিয়ে বললেন, আমি প্রথমে এই মেয়েটিকে শুদ্ধ করে তবে পুজোয় বসব। পুজোর ঘরে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ থাকবে না, বলে গুরুদেব সকলকে বাইরে যেতে বলে পুজোর ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন।

প্রায় দুঘন্টা পর গুরুদেব ও এস্থার ঘর থেকে বেরোতেই তৎক্ষণাৎ শিষ্যদের নিয়ে গুরুদেব পুজোয় বসে পড়লেন। পুজো করতে করতে বারবার এস্থারের সঙ্গে কাটানো সময়ের প্রতিটা মুহূর্ত গুরুদেবের মনে পড়তে লাগল। এরকম অবস্থার সম্মুখীন আগে কখনও তাঁকে হতে হয়নি।

এস্থার চালাকি করে আগে থেকেই মোবাইলে ভিডিও ক্যামেরা অন করে এমন ভাবে লুকিয়ে রেখেছিল যাতে ঘরের মধ্যে যা-যা ঘটবে সব মোবাইল ক্যামেরায় রেকর্ড হতে থাকবে। গুরুদেব কীভাবে পুজোর সামগ্রীর সঙ্গে আনা মাদক পুরিয়া এস্থারকে খেতে দিয়েছেন, এস্থার অজ্ঞান হয়ে পড়েছে ভেবে তার সঙ্গে অশালীন আচরণ করতে উদ্যত হয়েছেন, এস্থার কীভাবে ওঁর মুখ থেকে সব সত্য বার করে আনতে ওঁকে বাধ্য করেছে সব মোবাইলে রেকর্ড হয়েছে। গুরুদেব ভালো করেই জানেন, এই সত্যি প্রকাশ পেলে জেলের ঘানি টানা থেকে তাঁকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।

তাড়াতাড়ি পুজো সেরে ওই বাড়ি থেকে কখন বেরোবেন ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে পড়ছিলেন গুরুদেব। কারণ এস্থারের দেওয়া হুমকি তখনও কানে বাজছিল গুরুদেবের। সকলের অগোচরে বদ্ধ ঘরের আড়ালে এস্থার তাঁকে সাবধান করে দিয়েছিল, চুপচাপ শান্তিপূর্ণ ভাবে পুজো সেরে এ-বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, নয়তো পুলিশ ডেকে ভিডিও সমেত আপনাকে ধরিয়ে দেব। ভিডিও সামনে এলেই সকলে বুঝতে পারবে আপনার পুরোটাই সাজানো একটা চক্র যার প্রধান পাণ্ডা আপনি। পুজো, ধর্ম, গ্রহশান্তির নাম করে বাড়ির মেয়েদের সতীত্ব নষ্ট করা, তাদেরকে নিজের শিকার বানাবার সঙ্গে সঙ্গে পুরো পরিবারকে আর্থিক ভাবে লুঠে নেওয়া ইত্যাদি কারসাজি আমি সবার সামনে নিয়ে আসব যাতে জেলে যাওয়া থেকে আপনাকে কেউ আটকাতে না পারে।

পুজো শেষ করেই গুরুদেব শিষ্যদের নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরোবার জন্য হুড়োহুড়ি করতে গায়ত্রীদেবী একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এত তাড়াহুড়ো কেন করছেন গুরুদেব? এখনও তো এই ছুঁড়ির নামকরণ এবং আমার নাতনির গ্রহশান্তির পুজো করেননি।

গুরুদেব এস্থারের দিকে তাকিয়ে উত্তর করলেন, নামকরণের কোনও দরকার নেই। খুবই শুভলগ্নে ওদের বিয়ে হয়েছে। এই মেয়ে ঈশ্বরের আশীর্বাদ। এই বাড়িতে ওর পা পড়তেই বাড়ির সব বাধাবিঘ্ন দূর হয়ে গেছে। সমস্ত গ্রহও সুস্থানে বিচরণ করছে। সুতরাং গ্রহশান্তি করাবারও আর কোনও দরকার নেই। আর এই পুজোর জন্য আমি কোনও দক্ষিণাও গ্রহণ করব না। এই বলে গুরুদেব শিষ্যদের নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন।

মুহূর্তে এস্থার অনুভব করল বাড়ির সকলের দৃষ্টি তার উপরে। সকলেরই চোখের ভাষা একদম বদলে গেছে। হঠাৎ করেই ভালোবাসার ফল্গুধারা সকলের চোখ থেকে প্রবাহিত হতে দেখে মনে মনে হাসল এস্থার। নিজের মনেই বলল, এদের অন্ধবিশ্বাস এখনও কাটেনি ঠিকই কিন্তু এই অন্ধবিশ্বাসের কারণে না-তো শিল্পীর বিয়ে আটকাবে আর না-তো এই মেয়ের উপর গুরুদেবের দৈহিক অত্যাচার চলতে থাকবে, যা এতদিন ধরে এ বাড়িতে চলে এসেছে।

 

বিষবৃক্ষ

ঘটনাটা ১৯৮১ সালের। সুজয় তখন ব্যাচেলার। চাকরি পেয়ে কলকাতা থেকে দিল্লি এসেছে বেশ কিছুদিন হল। অ্যান্ড্রুজগঞ্জে অমিতের সাথে মেসে থাকে। বাড়ি থেকে এসে মনটাও বেশ খারাপ লাগছিল। দিল্লিতে অমিতের বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে। একদিন সুজয় অমিতকে বলল দ্যাখ, একটু আশেপাশে বেড়াতে গেলে হয়। অমিতও রাজি হয়ে গেল। পরেরদিনই বেরিয়ে গেল হরিদ্বার ও ঋষিকেশের উদ্দেশে।

হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যখন যাচ্ছিল তখন বেশ ভালোই লাগছিল। সে সময় হরিদ্বারের চণ্ডী পাহাড়ে বা মনসাদেবী পাহাড়ে রোপওয়ে হয়নি। পায়ে হেঁটেই উঠতে হতো। প্রথম দিন মনসাদেবী পাহাড়ে চড়ে সুজয় বেশ আপ্লুত হল। একটা বেশ নতুন অনুভূতি। তাই অমিতকে বলল চল কাল খুব সকাল সকাল আমরা চণ্ডী পাহাড়ে চড়তে যাব।

দ্যাখ, অত সকালে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?

কিছু হবে না। চল তো।

পরের দিন সকালে চণ্ডী পাহাড়ে উঠতে গিয়ে একটা জিনিস লক্ষ্য করল। আর অন্য কোনও লোকজনই ওদের আশেপাশে নেই। তাই একটু অবাক হল। চণ্ডী পাহাড়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ দেখতে পেল, কে যেন চিত্কার করে হিন্দিতে তাদের ডাকছে। ওপরে তাকিয়ে দেখল একজন সাধু কমণ্ডলু হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের উঁচু একটা জায়গায় আর তাদের নিষেধ করছে ওপরে যেতে। সেই সাধুটি চণ্ডী পাহাড় থেকে নামার সিঁড়ির ওপরের দিকে একজায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল।

তার হিন্দি থেকে যা বোঝা গেল, তা হল সাধুবাবা তাদের ওপরে উঠতে এখন নিষেধ করছে। ওরা দুজনেই কিছু বুঝতে না পেরে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল। এর মিনিট পাঁচেক পর আবার সেই সাধু চিত্কার করে তাদের জানাল যে, তারা এখন ওপরে উঠতে পারে। এসবের কিছু মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে দুই বন্ধু আবার যাত্রা শুরু করল। হঠাৎ নজরে পড়ল, সিঁড়ির দুপাশের গাছপালা কেউ যেন দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে চলে গেছে। কিছু গাছপালা সিঁড়ির মাঝখানেও পড়ে আছে। দেখে মনে হবে কিছুক্ষণ আগে এখানে কেউ তোলপাড় করে গেছে। ওপরে উঠতে উঠতে সিঁড়ির মাঝপথেই দেখা হয়ে গেল সেই সাধুর সঙ্গে।

সাধু হিন্দিতে যা বললেন তা তরজমা করলে এরকম দাঁড়ায় দেখে তো তোমাদের লেখাপড়া জানা শিক্ষিত লোক বলে মনে হয়। এই পাহাড়ে অনেক জন্তু, জানোয়ার আছে। কাকভোরে এই পাহাড়ে আসা ঠিক নয়, এটাও কি তোমরা জানো না? দেখছ না আর অন্য কোনও লোক এই ত্রিসীমানায় নেই। তোমরা আজ বেঁচে গেলে। একটু আগে বুনো হাতির দল এখান দিয়ে যাওয়ার সময় সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। আমি তোমাদের সতর্ক না করলে তোমরা ওই হাতিদের আক্রমণের শিকার হতে। এর পর থেকে আর এরকম ভুল কোরো না। সন্ধের পরেও এদিকে আসবে না। আর হ্যাঁ, তোমরা নতুন মনে হচ্ছে এখানে। ঋষিকেশ যাওয়ার পথে যে-জঙ্গলটা অতিক্রম করে যেতে হয়, তার ভেতরে ঢুকতে যেও না। যদিও পাশেই একটা ছোটো গ্রামে কিছু লোক বসবাস করে, তবে সেখানে না যাওয়াই ভালো। একথা বলেই সাধু সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল।

চণ্ডী পাহাড় থেকে ফিরে হর-কি-পৌরিতে স্নান সেরে দাদা বউদির হোটেলে সুস্বাদু খাবার খেয়ে দুজনেই হোটেলে ফিরে একটা ঘুম দিল। ঘুম থেকে উঠে দুজনে মিলে ঠিক করল আগামীকাল তারা গাড়ি নিয়ে ঋষিকেশ রওনা হবে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। পরের দিন গাড়িতে রওনা হল ঋষিকেশের উদ্দেশে।

অমিত পাকা ড্রাইভার, খালি রাস্তা পেয়ে গাড়ির গতিবেগ বাড়িয়ে দিল। সুজয় বলল অমিত অত জোরে চালাস না। তার ওপর গতকাল রাতে বৃষ্টি হয়ে রাস্তাও পেছল হয়ে আছে।

তুই ভাবিস না, আমি দিল্লির রাস্তায় চালিয়ে অভ্যস্ত। তুই একদম ভাবিস না।

কিছুদূর যাবার পর একটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল। দুপাশে কয়েকটা হরিণও চোখে পড়ল। বাঁদরের পাল খাবারের উদ্দেশে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুজনেই এই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে মোহিত হয়ে পড়েছিল। যখন দুজনেই গল্পে মশগুল, হঠাৎ অমিত ব্রেক কষল। হঠাৎ করে এমন ব্রেক মারাতে দুজনেই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল।

গাড়ির সামনে হঠাৎ একজন বৃদ্ধ এসে গেছে। তাকেই বাঁচাতে এই ব্রেক মারতে হল। মনে হল বাঁচাতে পেরেছি। চল নীচে নেমে দেখি। দুজনেই তাড়াতাড়ি দরজা খুলে গাড়ির সামনে গিয়ে দেখল এক বৃদ্ধ পড়ে আছে গাড়ির সামনে।

চামড়া ঝুলে কুঁচকে গেছে। চোখের দৃষ্টি ঘষা কাচের মতো। মাথার চুলগুলো বেশিরভাগই পেকে সাদা। খুব বাঁচা বেঁচে গেছে। না, কোনও ক্ষতি হয়নি। উঠে বসার চেষ্টা করছে বৃদ্ধ লোকটি। গায়ে ছেলে ছোকরাদের হাফ শার্ট ও পরনে একটা

থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট। এসব বেশি বয়সের জন্য বেমানান। কাঁপছে তার শরীর। সুজয় ও অমিত দুজনে তাকে তুলে বসাল। গাড়ি থেকে জলের বোতল বের করে খেতে দিল। মুখে, চোখে একটু জল ছিটিয়ে দিল। লক্ষ্য করল, লোকটা ঢকঢক করে বোতলের অর্ধেকের বেশি জল শেষ করে দিল। টেনে টেনে আস্তে আস্তে করে বলল ভুখ লাগা হ্যায়।

লোকটিকে দুজনে ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে রাস্তার পাশে একটি গাছের নীচে হেলান দিয়ে বসাল। জায়গাটা বেশ ছায়াময়। বাতাসও বইছে। সুজয় গাড়ি থেকে কেক, বিস্কুট, জুস এনে খেতে দিল। গোগ্রাসে খেতে লাগল লোকটা। মুহূর্তের মধ্যে সব খাবার শেষ করে দিল। একটু সুস্থ হতেই বলল ম্যায় নেহি বাঁচ পঊঙ্গা (আমি বাঁচব না)। এরপর লোকটি হিন্দিতে যা যা বলল তার তরজমা করলে এরূপ দাঁড়ায়

কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হয় মরে যাব।

কেন? তোমার তো চোট লাগেনি, অমিত প্রশ্ন করল।

যা দেখেছি, আমার চোখের সামনে যে আশ্চর্য রোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে, তার ব্যাখ্যা আমার জানা নেই।

সুজয় জিজ্ঞাসা করল, কী ঘটনা? তুমি সুস্থ না হলে আমরাও যেতে পারছি না। আমরা জানতে চাই, কী সে রোমহর্ষক ঘটনা! আমাদের দুজনেরই শুনতে খুব ইচ্ছে করছে।

লোকটি কিছুক্ষণ গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে রইল, তারপর সহসাই চোখ মেলে তাকাল। বড়ো বড়ো দুটো চোখে আতঙ্কের ছায়া স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বলতে শুরু করল…

কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হয় আমি মারা যাব। আমি যা দেখেছি, যা আমার চোখের সামনে ঘটেছে। এর কোনও ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই।

অমিত জিজ্ঞাসা করল কি ঘটনা? আমাদের বলুন।

সুজয় বলল, বুঝতে পারছি আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ঘটনাটা না শুনে যাওয়াটা ঠিক হবে না। লোকটা যেমন হিন্দি বলছেন তাতে একদম অশিক্ষিত বলে মনে হচ্ছে না তাঁকে। আপনি বলুন। আমরা শুনতে চাই।

আমার নাম রতন সিং। এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে আমার খামারবাড়ি ছিল। পাহাড়ে আমার কিছু নিজের জমি আছে এবং কিছুটা লিজে নিয়েছি। সেখানে এই ঠান্ডায় বাঁধাকপি, ফুলকপি আর টম্যাটো লাগিয়েছিলাম। প্রতিবছর বেশ ভালো ফলন হয়। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। একা সব সামলাতে পারি না বলে চাষবাসে সাহায্য করার জন্য কয়েকজন লোকও রেখেছিলাম। আমার ছোট্ট পরিবার, স্ত্রী আর একটি ছেলে। আমার বাড়িটা পাহাড়ের ঢালেই ছিল। ওপরে টালির ছাদ দেওয়া। সামনে সুন্দর ফুলের বাগান।

একদিন সন্ধেবেলা সব কাজকর্ম সেরে ফিরছি, হঠাৎ নজরে পড়ল আকাশ থেকে কী যেন একটা নীচের দিকে ধেয়ে আসছে। লাল রঙের আগুনের গোলক ছিল সেটা। আমার বাড়ির থেকে প্রায় দুশো গজ দূরে একটা ঝোপের মধ্যে এসে পড়ল সেটা। ঝপাৎ করে বেশ জোরে একটা শব্দ হল। ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম আগুন না লেগে যায় চারিদিকে। কিন্তু না, তা হল না। মনে হল আগুনের পিণ্ডটা যেন নিভে গেছে। জায়গাটা দেখে রাখলাম। ঠিক করলাম, পরের দিন সকালে গিয়ে দেখতে হবে ওটা কী ছিল! শব্দটা শুনে মনে হল না যে ওটা ভেঙে গেছে। এমনকী আশেপাশে আগুনও ধরে যায়নি। এত রাতে জীবজন্তুর ভয়ে ওই ঝোপের দিকে যেতে সাহস হল না।

রাতটা বেশ দুঃশ্চিন্তা ও আতঙ্কে কাটালাম। স্ত্রী ও ছেলেকে রাতে ওই ঘটনার কথা জানাইনি। ভোর হতেই সূর্য ওঠার আগে পৌঁছে গেলাম ওই ঝোপের কাছে। চারিদিকে ফুলের বাহার দেখে মনটাও আনন্দে ভরে গিয়েছিল। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। ওখানে একটা বেশ বড়ো স্বচ্ছ পাথরখণ্ড দেখতে পেয়ে অবাক হলাম। স্বচ্ছ পাথর খণ্ডের মধ্যে কালচে রঙের কী যেন দেখা যাচ্ছিল।

পাথরটা যেন কেমন আমায় টানছিল। একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করলাম। দৌড়ে গিয়ে ওটা হাতে তুলে নিলাম। দেখে মনে হল মহাজাগতিক কোনও বস্তু এই প্রথম হাতে নিয়েছি। অনন্ত কোটি গ্রহাণুর কোনও একটির থেকে হয়তো খসে পড়েছে বলে নানারকম উদ্ভট কল্পনা মাথায় আসছিল। শরীরটা কেমন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। ইতিমধ্যেই সূর্য‌্য উদয় হয়েছে।

পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে আলো এসে আমার হাতের স্ফটিক খণ্ডটার ওপর পড়াতে ওটা যেন আরও ঝলমলে হয়ে উঠল। ভেতরের কালো জিনিসগুলো স্পষ্ট দেখতে পেলাম। আগে যেগুলোকে কালো মনে হচ্ছিল সেগুলো সূর্য‌্যের আলোয় মনে হল বেদানার বীজের মতো লালচে রঙের। মনে মনে ভাবলাম, এগুলো অন্য কোনও গ্রহের গাছের বীজ নয়তো! আজকাল তো পৃথিবীর মতো দেখতে আরও অন্য গ্রহেও জীবন আছে বলে নানা পরীক্ষা চলছে। ভাবলাম তেমনও হতে পারে।

এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে স্ফটিকটা ভেঙে ফেললাম। ঘাসের ওপর ওটার টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়ল। বীজগুলোও চারিদিকে ছড়িয়ে গেল। ওগুলো দেখতে এতই অদ্ভুত ছিল যে, সেগুলো থেকে কেউ চোখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না। আমিও ওখান থেকে চারটে বীজ তুলে নিয়ে আমার ফতুয়ার পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম। পাথরগুলো এতই অসাধারণ ছিল যে সূর্য‌্যের আলোতে ওগুলো থেকে যেন দু্যতি ছড়িয়ে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল ওগুলো চুনি, পান্নার মতো দামি পাথর। ঠিক তখনই মাথার মধ্যে একটা ইচ্ছে জাগল। এগুলো যদি কোনও গাছের বীজ হয় তবে বীজগুলো রোপণ করেই দেখা যাক না। রোজ জল দিয়ে দেখব গাছ জন্মায় কিনা।

তখনও বুঝতে পারিনি যে, ওই বীজ রোপণ করাটাই আমার কাল হবে। চলে গেলাম আমার অন্য একটা জমিতে যেখানে অন্যান্য ফসল ফলাতাম। পাহাড়ের একটা ঢাল দেখে সেখানে গিয়ে খুরপি দিয়ে মাটি খুঁড়ে একটা বীজ পুঁতে দিলাম। জায়গাটা জল দিয়ে ভিজিয়ে ফিরে গেলাম নিজের আস্তানায়। ভাবলাম পরের দিন এসে আবার জল ঢেলে দেব।

পরের দিন সকালে উঠেই জল দিতে চলে গেলাম সেই জায়গায়। ওপর থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। পাহাড়ের নীচে আমার জমিটাতে আমার স্ত্রী, ছেলে ও কাজের লোকেরা জমি ও গাছের পরিচর‌্যা করে চলেছে। গতকালের বীজের জায়গাটায় পৌঁছে অবাক হয়ে গেলাম। গতকাল যে-বীজটা লাগিয়ে গিয়েছিলাম, সেটা থেকে একটা চারাগাছ হয়েছে। গাছের পাতাগুলো ভেলভেটের মতো। মনমাতানো তার অদ্ভুত রং। আমি এর আগে এমন গাছ কখনও দেখিনি। অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম গাছটার দিকে। তারপর জল ঢেলে ফিরে গেলাম অন্যান্য মজুরদের কাজকর্ম দেখতে।

পরের দিন আবার যখন সেখানে গাছটাতে জল দিতে গেলাম, অবাক করা কাণ্ড দেখতে পেলাম। দেখলাম গাছটা এই একদিনে আরও প্রায় তিন-চার হাত লম্বা হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকল গাছটার প্রতিদিন বেড়ে ওঠা। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে গাছটা বিশাল রূপ নিল। সূর্য‌্যের আলোয় দেখতে পেলাম গাছের পাতাগুলো অদ্ভুতরকম দ্যুতি ছড়াচ্ছে। সূর্য‌্যের রক্তিম ছটায় পাতাগুলো লাল হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন আগুন ছড়াচ্ছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। গাছটা যেন আমাকে কেমন সম্মোহিত করে ফেলেছে। লাল রঙের ফুলও ফুটেছে।

গাছটাকে উঁচু পাহাড় থেকে কেমন লাগছে দেখতে দেখার জন্য একটু উঁচু জায়গায় উঠে গেলাম। গাছটাকে দেখতে দেখতে চোখ চলে গেল আমার খেতের দিকে। সেখানে আমার বউ, বাচ্চাকে দেখলাম ফসলের পরিচর‌্যা করে চলেছে। একবার ভেবেছিলাম, বাড়ির লোকেদের এই গাছটার কথা বলে দেব। আবার পরক্ষণেই ভাবলাম কয়েকদিন বাদেই সব জানিয়ে একটু অবাক করে দেব ওদের। পাহাড়ের চড়ায় উঠে গাছটাকে দেখলে দেখতে পেতাম এক অদ্ভুত দৃশ্য। মনে হতো গাছটা থেকে যেন সূর্য‌্যের সাত রং ছিটকে পড়ছে। দেখে মনে হতো, গাছটা রং বদলাচ্ছে। সকালে এক রং, দুপুরে অন্য রং আর বিকেলে আর এক অন্য রং। এমনকী সূর্য‌্যাস্তের পরও গাছের আশপাশটায় তীব্র আলো ছড়িয়ে থাকত। এরপর হঠাৎই ঘটল এক অঘটন।

সেদিনও আমি পাহাড়ের অন্য একটা চড়া থেকে গাছটাকে দেখছিলাম। কিছু বোঝার আগেই বিনা শব্দে বিস্ফোরিত হল গাছটা। গাছের ডালপালা, পাতা সবকিছু চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র কাণ্ডটা দাঁড়িয়ে আছে সোজা হয়ে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম গাছের কাণ্ডটার ভেতরের গর্ত থেকে গুবরে পোকার চেয়ে বড়ো বড়ো কিন্তু লাল রঙের পোকা বেরিয়ে আসছে লক্ষ লক্ষ নয়, কোটি কোটি। এ যেন আগ্নেয়গিরির লাভা। শেষ-ই হচ্ছে না। পোকাগুলো পিল পিল করে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। পোকাগুলো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচের দিকে নেমে চলেছে। যেখান দিয়ে যাচ্ছে সেখানকার সব গাছপালা, ঝোপঝাড়, সবকিছুকে এমনকী ছোটো প্রাণীগুলোকেও নিমেষে ধ্বংস করে এগিয়ে চলেছে।

এই দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে গেলাম, যখন দেখলাম ওই পোকাগুলো ঢালটা পেরিয়ে আমার খেতের দিকে, আমার বউ-বাচ্চার দিকে এগিয়ে চলেছে। চিত্কার করে

বউ-বাচ্চাকে সাবধান করার জন্য ডাকতে লাগলাম। কিন্তু আমার ডাক ওদের কানে পৌঁছোনোর আগেই আমার বউ, বাচ্চা, খেত সব কিছুকেই বন্যার জলের মতো ধ্বংস করে এগিয়ে যেতে লাগল প্রাণীগুলো। এ ধ্বংসলীলা সহ্য করার মতো শক্তি আমার ছিল না। ওগুলো যখন আমার জমি পেরিয়ে গেল, তখন দেখলাম কয়েকটা কঙ্কাল পড়ে আছে আর কিছু নেই। আমার ফসল, স্ত্রী, বাচ্চা কেউ আর বেঁচে নেই।

তবুও সাহস করে দৌড়ে নামতে গেলাম, আর তখনই দেখতে পেলাম পোকাগুলো শব্দ করে ফাটছে আর একরকম লালাজাতীয় রস বের করে মরে যাচ্ছে। এই বিভীষিকা মনের মধ্যে আর সহ্য করতে পারছিলাম না। পোকাগুলোই বা কেন মরল, বুঝতে পারলাম না। ভাবছিলাম ওগুলো তো মরল। একটু আগে মরলে আমার পরিবার ও ফসলগুলো বেঁচে যেত। কিন্তু আমাকে শেষ করে দিয়ে গেল।

অনুশোচনায় ভুগতে লাগলাম, আমি নিজেই এই বীজ বপন করেছি এই কথা ভেবে। আর এই বীজই আমার সব কিছু কেড়ে নিল। হাতের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলাম। দেখলাম আমার হাতের চামড়া কুঁচকে গেছে নব্বই বছরের বৃদ্ধের মতো। দৌড়ে বাড়ি গেলাম। আয়নার সামনে নিজেকে দেখে চমকে উঠলাম। দেখে মনে হল আমি আর টগবগে ৩৫ বছরের যুবক নেই। আমার বয়স বেড়ে নব্বই হয়ে গেছে। এমনকী আমার কালো চুলগুলোও সাদা হয়ে গেছে। আমি নিজের এই দশা দেখে অসহায় বাচ্চার মতো কাঁদতে লাগলাম।

তখন মনে পড়ল, গাছটায় যখন বিস্ফোরণ হয় তখন ওখান থেকে নীলাভ আলো এসে আমার গায়ে লেগেছিল। নিজের এই অবস্থা দেখে নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছিল। একবার ভাবলাম আত্মহত্যা করি কিন্তু শেষ অবধি করতে পারলাম না…। এই কথাগুলো বলার পর লোকটি হঠাৎ স্থির হয়ে গেল।

গাছে হেলান দেওয়া অবস্থাতেই মারা গেল। হাতের মুঠোটা আপনা থেকেই খুলে গিয়ে কয়েকটা লাল স্ফটিকের মতো পাথর গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। দেখে মনে হচ্ছিল বেদানা ফলের বীজের মতো। ওগুলো বেশ চিকমিক করছিল।

সুজয় আর অমিত একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল সেদিকে। এটা কি গল্প ছিল, না সত্যি ঘটনা? নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না! সুজয় ওই বীজগুলোর দিকে হাত বাড়াতে যেতেই অমিত হাতটা চেপে ধরল সুজয়ের। চিত্কার করে উঠল, ওগুলো ছুঁতে যাস না। বিষবৃক্ষের ফল হতে পারে!

রোবোট?

হাউ ফ্যানটাস্টিক,  উদীয়মান সূর্য‌্যের দিকে তাকিয়ে বলল জয়িতা।

মি. দাস বিরক্ত হয়ে দেশলাই বাক্সটা ছুড়ে ফেলে দিলেন। একটাও কাঠি জ্বলছে না। কুয়াশার জন্য? কি বিচ্ছিরি কুয়াশা বটে। একটু আগেও ছিল না, এখন আবার হুড়মুড়িয়ে এসে পড়েছে। সূর্য‌্যটাও ঢাকা পড়ে গেল। যাকগে। একটা সিগারেট কি খাওয়া যাবে না?

পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সুমন। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে বলল, খাবেন নাকি একটা? ডু ইউ স্মোক?

ওঃ, অফ্ কোর্স।

দুজনেই সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে টান দিল। সুমন বলল, আমাদের ভাগ্য কিন্তু ভালো, তাই না?

হোয়াই?

দেখলেন না কেমন কুয়াশা নেমে এল। আর একটু আগে নামলেই তো এই অসাধারণ দৃশ্যটা দেখা হতো না। কী বলেন?

কোন অসাধারণ দৃশ্যের কথা বলছ?

সানরাইজ মশাই!

হুঁ। তেমন অসাধারণ কিছু নয়। ম্যাল থেকেও এটা দেখা যায়।

দুটো কি এক হল?

প্রায় এক। সে যাই হোক। এটা দেখার জন্য এত ভোর ভোর উঠে এত দূরে ছুটে আসার কোনও মানেই হয় না।

তাহলে এলেন কেন?

মিসেস বলল,

খুব শোনেন বুঝি মিসেসের কথা।

একটু তো শুনতেই হয়।

আচ্ছা দেখি, আমার মিসেস আবার কোথায় গেল?

সুমন সরে পড়তে চাইছিল, কিন্তু ততক্ষণে মলি এগিয়ে এসেছে। মলি ওর নতুন বিয়ে করা বউ। দুজনে মিলে হনিমুনে এসেছে। সে এসেই সুমনের হাত ধরে বলল, তোমরা এখানে? ওঃ সিগারেট খাওয়া হচ্ছে। ফেলো ওটা। ওদিকটায় দ্যাখো খুব সুন্দর ভিউ পাওয়া যাচ্ছে। দেখেছ, কেমন পাগলের মতো ছবি তুলছে সবাই। তারপরেই মি. দাসের দিকে ফিরে তাকিয়ে সে বলল, আপনি কটা ছবি তুললেন?

একটাও না।

কেন?

কারণ আমি পাগল নই। তাছাড়া সূর্য‌্যদেবকে ক্যামেরাবন্দি করার ইচ্ছেও নেই।

হাসল মলি। কথাটা খারাপ বলেননি তো!

সুমনও হাসল। বলল, উনি বলছিলেন এই একটা সূর্যদয় দেখার জন্য এত দূর ছুটে আসার কোনও মানে হয় না।

মলি ভুরু কোঁচকাল। তারপরেই বলল, খুব ভুল বলেননি কিন্তু। হাতের কাছেই কত ভালো জিনিস আমরা দেখি না। ওই যে রবিঠাকুরও বলেছিলেন না, কত দেশ ঘুরে কত ক্রোশ দূরে তার পরের লাইনটা বলো না।

মনে নেই, আমার কিন্তু এখন অন্য একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে। বেশ উঁচু গলায় আবৃত্তি করল সুমন,

আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের পর কবিতাটা পড়েছেন নিশ্চয়ই মি. দাস?

আমি কবিতা পড়ি না।

যাঃ, কিন্তু এই কবিতাটা তো সব বাঙালির-ই জানা।

তোমার সঙ্গে বুঝি সব বাঙালির পরিচয় আছে?

মলি হাসল। ওর সঙ্গে তুমি ক়থায় পারবে না।

হঠাৎই কী মনে হতে সুমন মলির হাত ধরে টানে, আচ্ছা মি. দাস। আমি একটু ওকে নিয়ে ওদিকটায় ঘুরে আসি। আপনি থাকুন বরং। ডোন্ট মাইন্ড।

মাইন্ড করব কেন? তুমি তোমার বউকে ঘোরাতে নিয়ে এসেছো। আমাকে তো নয়?

দুজনে এগিয়ে গেল।

জয়িতা ওখানে কী করছে?

মি. দাস এগিয়ে গেলেন।

জয়িতা, সরে এসো, খাদের পাশে দাঁড়িয়ো না।

সরে দাঁড়াল জয়িতা।

কী করছিলে ওখানে?

কুয়াশা দেখছিলাম। কত নীচ থেকে উঠে আসছে হামাগুড়ি দিয়ে, সুন্দর না?

কুয়াশা হামাগুড়ি দেয় না আর দাঁড়াবে না খাদের পাশে।

জয়িতা ঘাড় নাড়ায়, আচ্ছা।

গাড়ি নামছে টাইগার হিল থেকে। হঠাৎ করেই ব্রেক কষে। পাশেই একটা ভিড় জমেছে। অ্যাক্সিডেন্ট শব্দটা শোনা গেল।

সুমন ও মি. দাসরা একই গাড়িতে ফিরছিল। গাড়ির ড্রাইভার নেমে দেখতে গেল ব্যাপারটা। পেছন পেছন সুমনও নামল।

একটু পরেই ফিরে এসে সে বলল, হরিবল্ ব্যাপার বুঝলেন? মুখোমুখি দুটো গাড়ির ধাক্কা। ড্রাইভারটা স্পট ডেড। মাথা ছাতু হয়ে গেছে। আর একজন গুরুতর ভাবে জখম। একটা পা ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে। বাঁচবে কিনা সন্দেহ।

মলি শুনেই দেখতে ছুটল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এল বিবর্ণ মুখে।

ইস্, লোকটার মাথার ঘিলু বেরিয়ে গেছে না দেখলেই ভালো করতাম।

দেখতেই তো গেছিলেন বিরস মুখে বললেন মি. দাস।

জয়িতা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। হঠাৎ বলল, আচ্ছা, লোকটাকে আমাদের গাড়িতে তুলে নিলে হয় তো।

তার মানে! চোয়াল ঝুলে গেছে সুমনের।

আপনি বললেন না জখম হয়েছে? ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো বেঁচে যাবে।

সেটা হয় নাকি একটু অস্বস্তি নিয়ে যেন মাথা নাড়ে সুমন, এটা পুলিশের কেস্। আর স্থানীয় লোকেরা তো আছেই। দরকার পড়লে ওরাই নিয়ে যাবে নিশ্চয়ই।

মি. দাস আপন মনেই বিড়বিড় করলেন, বাইস্ট্যান্ডারস এফেক্ট।

কী বললেন?

কিছু না ড্রাইভার, গাড়ি স্টার্ট করো।

যেতে যেতে মলি বলল, জয়িতাদি কিন্তু ঠিকই বলেছিল। হাসপাতালে এক্ষুণি নিয়ে গেলে হয়তো…

মি. দাস জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললেন, সুমন বলছিল লোকটার পা চলে গেছে। এভাবে না বাঁচাই ভালো।

অদ্ভুত মানুষ আপনি, মলি ভুরু কোঁচকায়।

পথে তেনজিং পযে্ট দেখে একটা বড়ো গুম্ফার সামনে এসে দাঁড়ায় ওদের গাড়ি। ওরা নামে।

গুম্ফাটা একটা ছোটো টিলার ওপরে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হল। সুন্দর জায়গাটা। গুম্ফার পাঁচিল থেকে অনেক দূর পর্য়ন্ত দেখা যায়। জয়িতা আরেকবার বলে ফেলল, ফ্যানটাস্টিক।

এর পরেই অবশ্য হতাশ হতে হল ওদের। মূল প্রার্থনা ঘরটা বন্ধ। বোধিসত্ত্বের মূর্তিটা দেখা যাবে না। দশটার আগে দরজা খোলে না। এখন সবে সাতটা বাজে।

পাঁচিলের কাছে দাঁড়িয়ে সুমনরা কয়েকটা ছবি তুলল। মি. দাসকে বলল, ওদের দুজনের ছবি তুলে দিতে।

প্রার্থনা-মন্দিরটার পাশেই একটা ফাঁকা উঠোনের মতো জায়গা। সেখানে কয়েকটা বাচ্চা লাল আলখাল্লা পরে ঘুরছে। একজন একটা ছোট্ট লোমওয়ালা কুকুরের সঙ্গে খেলা করছে।

জয়িতা জিজ্ঞেস করল, ওরা কারা?

দে আর লিটল্ লামা বুদ্ধিস্ট মংকস্।

সুমন হেসে বলল, ওদের সঙ্গে আলাপ করবেন নাকি? অবশ্য, আমাদের ভাষা ওরা বোধহয় বুঝবে না।

সো কিউট্ দে আর। ভুরু কোঁচকায় জয়িতা, এত ছোটো বয়সে সন্ন্যাসী হয়?

দেখছেনই তো হয়েছে। এটা কিন্তু ঠিক নয় বলুন?

কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায় জয়িতা। তার ভুরু দুটো আবার কুঁচকে গেছে। একদৃষ্টে সে তাকিয়ে আছে একটা বাচ্চার দিকে। এই বাচ্চাটাই একটু আগে কুকুরের সঙ্গে খেলছিল।

কী দেখছেন এত মন দিয়ে সুমনের গলায় কৌতূহল।

দেখুন না, ওর হাতে একটা পোকা বসে আছে, কামড়াচ্ছে মনে হয়। ও কিন্তু ওটা ফেলে দিচ্ছে না। চুপ করে দেখছে পোকাটাকে। অদ্ভুত না!

সুমনও ব্যপারটা দেখল। ততক্ষণে আর একটা বাচ্চা, এ একটু বড়ো, পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ছেলেটার। পোকাটাকে খুব সাবধানে, যেন সযত্নে তুলে সে পাশেই একটা উঁচু জায়গায় রেখে দিল।

ওঃ… এরা তো বৌদ্ধ, তাই বোধহয় সুমন বলল।

এখানে কী করছ? মি. দাস এসে দাঁড়িয়েছেন।

সুমন পুরো ঘটনাটা শুনিয়ে হাসতে হাসতে বলল, আপনার মিসেস কিন্তু বেশ ইনকুইজিটিভ। ছোটো ছোটো ব্যপারও ওঁনার চোখ এড়ায় না।

মেযোনুষ যে, ঘাড় ঝাঁকালেন মি. দাস। চলো এবার কিছু দেখার নেই এখানে।

বাচ্চাগুলোর সঙ্গে বোধহয় কথা বলার ইচ্ছে ছিল জয়িতার। কিন্তু আর কিছু না বলে ফেরার পথ ধরল।

হোটেলে ফিরে সুমন ও মলি রেস্ট নিচ্ছে। টিভি চালিয়েছে। হঠাৎ করেই মলি বলল, মি. দাস লোকটা যেন কেমন, তাই না?

হ্যাঁ, একটু অদ্ভুত বটে।

অ্যাক্সিডেন্টের কথাটা ভাবো। কোনও রিঅ্যাক্ট করলেন না!

সে তো সানরাইজটাই উনি ভালো করে দেখলেন না। অথচ লোকে ওটা দেখতেই… আমি সিগারেট খাওয়ালাম দুতিনবার কিন্তু উনি একবারও আমাকে অফার করলেন না। ভাবো!

আমরা এতক্ষণ একসঙ্গে ঘুরলাম, উনি নিজে থেকে একটা কথাও বলেননি। এটা খেয়াল করেছ? আমারাই শুধু যেচে আলাপ করেছি।

হ্যাঁ, ভদ্রলোক সামাজিকতার ধার ধারেন না। কাঠ কাঠ আচরণ।

হ্যাঁ, কেমন যেন রোবট রোবট।

হয়তো সত্যিই উনি একটা রোবট! হাসতে হাসতে বলে সুমন।

শোনো না স্বামীর পাশে ঘন হয়ে আসে মলি। আমারও কিন্তু তা-ই মনে হচ্ছে।

কী মনে হচ্ছে?

হাসি নয়। সেদিন খবরের কাগজে পড়লাম না রোবোট কোম্পানিগুলো এখন অবিকল মানুষের মতো দেখতে যান্ত্রিক এসকর্ট তৈরি করছে। কোনও সঙ্গীহীন লোক তাদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে যেতে পারে। যাচ্ছেও অনেকে। এই লোকটা নিশ্চয়ই সেরকম কিছু।

তোমার মাথায় আসেও বটে! রোবট কি সিগারেট খায়?

সিগারেট ধরাচ্ছিল কিন্তু ইন করছিল না আমি লক্ষ্য করেছি।

বাঃ, বেশ খুঁটিয়ে দেখেছ দেখি ওকে। মনে ধরেছে বুঝি?

ঠাট্টা কোরো না, ভদ্রমহিলার আই মিন জয়িতাদির দেখেছ মাথায় সিঁদুর নেই। স্বামী মারা গেছেন হয়তো।

আর তাই একটা রোবট ভাড়া করে দার্জিলিং ভ্রমণে এসেছেন, তুমি গল্প লেখা শুরু করে দাও বুঝলে। ভালো কল্পনাশক্তি আছে।

তুমি তো আমার কথা একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছ! হতে পারে না বুঝি এরকম?

পারে, পারে সব হতে পারে মলিকে কাছে টানে সুমন। তার রাগ রাগ মুখে একটা চকাস করে চুমু খেয়ে বলে,নতুন বউ চাইলে এই হোটেলটাও তাজমহল হতে পারে, আর আমি হতে পারি সম্রাট শাজাহান… ঠোঁটটা দাও না।

আঃ, আমার মুড নেই এখন নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় মলি। জয়িতাদির কথা ভেবে খারাপ লাগছে।

কেন? একটু ক্ষুণ্ণ সুরেই বলে সুমন, ভালোই তো আছেন মহিলা। সারাক্ষণ হাসছেন।

ওটা জোর করা হাসি। তোমরা ছেলেরা বুঝবে না। একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে মলি। বলে এত প্রাণবন্ত মহিলা, অনুভূতিপ্রবণ কিন্তু সঙ্গীহীন রোবট কি আর মানুষের একাকিত্ব ঘোচাতে পারে। তার ওপর ওরকম গম্ভীর একটা রোবট!

যাঃ, তুমি সত্যিই ভাবছ নাকি উনি একটা রোবট!

রোবট যদি না হয়, তাহলে তো লোকটাকে আরও-ই সহ্য করা যাবে না। রবিঠাকুরের কবিতাও লোকটা জীবনে পড়েনি। ভাবা যায়!

 

রাত দশটা। খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় এসে শুয়েছেন মি. দাস। জয়িতা ঘরে ঢুকল। একটা গোলাপি রঙের হাত কাটা নাইটি পরেছে। স্বচ্ছ পোশাকটার ভেতরে তার পরিপূর্ণ শরীর কুয়াশা ঢাকা চাঁদের মতো সুন্দর লাগছে।

মি. দাসের পাশে এসে জয়িতা বসল। মি. দাসের গায়ে হাত রেখে বলল, চলো ঘুমোই।

আর একটু পরে, মি. দাস বললেন।

জয়িতা একটু ঝুঁকে মি. দাসের ঠোঁটে একটা আলতো করে চুমু খেল। তারপর তার একটা হাত ধরে নিজের বুকের ওপর রাখল।

হাত ছাড়ো জয়িতা, আমার ভাল্লাগছে না।

জয়িতা হাতটা ছেড়ে দিল। মনোযোগ দিয়ে একটা একটা করে মি. দাসের জামার বোতাম খুলতে লাগল।

আঃ, কী করছ? এক ঝটকায় জয়িতার হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিলেন মি. দাস।

জয়িতা তাকিয়ে আছে। তার ভুরুটা একটু কুঁচকেছে। যেন কিছু একটা জিনিস তার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে। একটু চুপ থেকে সে আবার হাত বাড়াল। মি. দাস একটা পাজামা-প্যান্ট পরেছিলেন, সেটা ধরে টেনে নামিয়ে দিল জয়িতা।

ইউ ডার্টি গার্ল, প্যান্ট টানতে টানতে উঠে দাঁড়ালেন মি. দাস। রাগ রাগ মুখে জয়িতার গলার পেছনে একটা বিশেষ অংশে দুই আঙ্গুল দিয়ে জোরে চাপ দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই বিছানার ওপর ঢলে পড়ল জয়িতা। তার চোখ বন্ধ হয়ে গেছে। নিঃসাড় শুয়ে আছে।

যেমন নিঃসাড় আমার এই পা টা, নিজের মনেই বললেন মি. দাস। পাজামার ওপর দিয়ে নিজের কৃত্রিম ডান পা-টার ওপর সস্নেহে ধীরে ধীরে হাত বোলালেন। জয়িতার দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। বেচারি। ওর তো কোনও দোষ নেই। রাত হলেই ক্লায়েন্ট কে ও সেক্সুয়াল সার্ভিস দেবে। এভাবেই ওকে প্রোগ্রাম করা আছে।

নিজের মনেই একটু হাসলেন মি. দাস। সানরাইজ দেখে, কুয়াশা দেখে কেমন সুন্দর মুগ্ধ হবার ভান করে মেয়েটি। যেমন তিনি ভান করছেন একটি স্বাভাবিক সুস্থ, মানুষের মতো বাঁচার…

নীচু হয়ে জয়িতার কপালে একটা ছোট্ট চুমু দিলেন মি. দাস। তারপর পাশে এসে শুয়ে পড়লেন।

 

গল্পকার হয়ে ওঠার গল্প

এক গাদা সাংবাদিকের ভিড় মানেই কানের কাছে আজকাল মশা-মৌমাছির ভোঁ ভোঁ শব্দ শুনতে পাই। প্রেস ক্লাবে পা রাখতেই ভনভনানিটা চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরল। বইয়ের প্রকাশ আর বিক্রির মধ্যিখানে এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ সালতামামি। খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিনের লোকজন ছাড়াও প্রায় সবকটি বাংলা খবরের চ্যানেলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত। অথচ লেখিকা অপর্ণা ঘোষের এটি প্রথম গল্পগ্রন্থের প্রকাশ। কিন্তু এতে সবটা বলা হল না।

লেখিকা অপর্ণা ঘোষ মৃত স্বনামধন্য লেখক পঙ্কজ ঘোষের স্ত্রী। যার অন্তত তিনটি উপন্যাস আর দুটি গল্পগ্রন্থ দৈনিকের বেস্টসেলারের তালিকায় হামেশায়-ই দেখা যায়। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রার কারণে বছর দুয়েক আগে এই লেখকের মৃত্যুতে গোটা বাংলার সাহিত্যকুলকেই প্রায় গেল গেল রব তুলতে দেখেছিলাম। সামনের মাসেই পঙ্কজ ঘোষের জন্মদিন। যে-কাগজে কাজ করি, তার রবিবারের সাপ্লিতে পঙ্কজ ঘোষ সংখ্যা হবার কথা হয়ে আছে। ঠিক এই সময় পঙ্কজ ঘোষের স্ত্রীর নিজের গল্পগ্রন্থ প্রকাশ সংবাদেরই বিষয় বটে।

প্রশ্ন-উত্তর পর্ব এখনও শুরু হয়নি। মনে হচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আসরে প্রবেশ করবেন অপর্ণা ঘোষ। বেশ ব্যস্ত ভাবে এদিক সেদিক দৌড়োদৌড়ি করছে সুদীপ্ত মজুমদার। দীর্ঘদিন ধরে পঙ্কজ ঘোষকে আপ্তসহায়তা করে এসেছে এই সুদীপ্ত মজুমদার। ঘোষ পরিবারের বিশেষ স্নেহধন্য ছিল জানতাম। লেখকের স্ত্রী আবার ওকে নিজের জন্য পুনর্বহাল করলেন কি না ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। কামানো মুখ আর পাট ভাঙা হলুদ পাঞ্জাবিতে নিজের মধ্যে প্রাণপনে একটা লেখক লেখক ভাব আনার চেষ্টা করছে সুদীপ্ত।

জেট নিউজের কৌশিকের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সামনের মুলোর মতো দাঁত দুটো বের করে মন ভুলিয়ে দেওয়া একটা এক্সপ্রেশন ঝাড়ল। যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রিত ভাবে হাসিটা ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে সদ্য ইলেকট্রনিক্স-এ জয়েন করার পরে নিজের মধ্যে একটা হামবড়াই ভাব এনেছে কৌশিক। তবে ওর দেঁতো হাসির উপহার সবাই পায় না। সম্পাদকীয় বিভাগে থাকলে কেউ কেউ ওর এই হাসি উপহার পায়। যেমন আমি।

এতজন মানুষের উপস্থিতিতে কিনা জানি না এসি-র কনকনে ঠান্ডা ভাবটাও শরীরকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল না, যে-শীতল অনুভূতিটা পেতে চাইছিলাম। অপর্ণা ঘোষের সাক্ষাৎকার পর্ব কয়েকটা পয়েন্ট-এর আকারে তুলে নিয়ে ছুটতে হবে আবার অফিসে। প্রতিবেদন আকারে সেটার পেজ সেটিং না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি নেই। দৈনন্দিন কাজের মধ্যে কেমন করে যেন একঘেয়েমি ঢুকে পড়ছে।

একটু গুঞ্জন, তারপরই অপর্ণা ঘোষের প্রবেশ। সাদামাটা, হালকা ঘি রঙের তাঁতের শাড়িতে বিধবাভাবকে লুকোনোর কোনও চেষ্টা নেই। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এবং কাটা মুখে চোখ দুটো আমার নজরে এল। দামি রিমলেস চশমার আড়ালে সে চোখ বেশ উজ্জ্বল এবং বুদ্ধিদীপ্ত মনে হচ্ছে। গরমের মধ্যে আসতে হয়েছে, তাই বোধহয় তৃষ্ণা দূর করতে টেবিলের উপর রাখা জলের গেলাসের অনেকটা জল এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেললেন।

আমি ছাড়াও, অনেকেই প্রস্তুত। মনেই হচ্ছিল সোজাসুজি কাজের কথায় যেতে বিশ্বাসী লেখিকা।

অনন্ত বার্তা দৈনিকের বিকাশ সেন-ই প্রথম প্রশ্ন ছুড়লেন। অপর্ণাদি, পঙ্কজবাবুর মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর আপনার প্রথম গল্পগ্রন্থের প্রকাশ। বেশ অবাক ঘটনা নয় কি?

বেশ সাবলীল ভাবেই উত্তর বেরিয়ে এল লেখিকার মুখ থেকে, আসলে সংসারের আকর্ষণটা তখন অনেক বেশি করে কাজ করছিল ভিতরে। ওর হঠাৎ চলে যাওয়ায় বেশ কিছুটা দিশাহারা লেগেছিল। একসময় আবিষ্কার করলাম সংসারের সেই ভয়ানক আকর্ষণটা যেন পেনের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। বলতে পারেন পেন যেন সংসারকে প্রতিস্থাপন করল।

বিকাশদার পরবর্তী প্রশ্নের আগেই সান্ধ্য খবরের রমা ঘোষ ফায়ার করল, দিদি পঙ্কজবাবু বাংলা সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য সাহিত্যিক। তাঁর লেখা ছোটো গল্প এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে টেক্সট বুকে স্থান পেয়েছে। তিনি বর্তমানে থাকলে আপনার এই বই প্রকাশ কতটা প্রাসঙ্গিক হতো?

অল্পক্ষণের জন্য লেখিকাকে স্মৃতিমেদুরতায় ডুবতে দেখলাম। কিছু বলবেন উনি। অপেক্ষা করছি আমরা। কার মোবাইল ফোন নিজের অস্তিত্ব জাহির করে বসল। পিছন ফিরে দু-একজন তাকাতে তড়িঘড়ি সেটি বন্ধ হয়। বাঁ হাতে রুমাল ধরে থাকা হাত নিজের মুখের ওপর একবার বুলিয়ে নিয়ে ব্যাখ্যা দিলেন উনি, অনেকটাই। উনি যে-মানসিকতার মানুষ ছিলেন তাতে তো মনে হয় এ ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়াটাই ওনার পক্ষে ছিল স্বাভাবিক।

আবার প্রশ্ন উড়ে এল, আচ্ছা ম্যাডাম এ গল্পগ্রন্থে স্থান পাওয়া গল্পগুলি কি কোনও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত?

না-সূচক ঘাড় নাড়লেন অপর্ণা। না, লেখা অনেকদিন আগেই হয়ে গিয়েছিল। আসলে লেখাগুলোর কনস্ট্রাকশন সম্পর্কে একদম নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। তাই বারবার এডিট করতে হচ্ছিল। বই যে করতে হবে সে ব্যাপারে চাপটা অবশ্য সুদীপ্তর তরফেই আসে, তৃপ্তি মেশানো এক মায়াময় হাসি ছুটে যায় সহকারীর দিকে।

নড়েচড়ে উঠি আমি। অস্বস্তিকর গরমটা কিছুতেই যেন ছেড়ে যাচ্ছিল না। লেখিকা অপর্ণার সঙ্গে বারবার লেখক পঙ্কজের নামটা জুড়ে যাচ্ছিল। আমরা এখানে যারা এই বই প্রকাশ কভারেজ করতে এসেছি, ঠিক কার কাছে এসেছি! লেখিকা অপর্ণার সত্তাটা স্বাধীন কিনা দেখে নেবার ইচ্ছা জাগছিল। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে প্রশ্নটা এগিয়ে দিই, দিদি একটু অন্যরকম প্রসঙ্গ। লেখিকা অপর্ণা যদি পঙ্কজবাবুর স্ত্রী না হতেন তবে কি তাঁর বইপ্রকাশ ঘিরে সংবাদ মাধ্যমের এই উচ্ছ্বাস থাকত?

মুখে লেগে থাকা হাসিটা যেন ওনার একটু ম্লান হয়ে এল। ক্লান্তি মেশানো স্বরে বলে উঠলেন, কী মন্তব্য করি বলুন তো? সেটা আপনারাই ঠিক করুন না।

রাতে অফিস থেকে যখন বেরোলাম, তখনও ঘুরে ফিরে লেখিকা অপর্ণার মুখটা আমার মধ্যে ফিরে আসছিল।

দুই

একটা ঘোরের মধ্যে কাজ করে যাচ্ছিলাম। রোববারের পাতার জন্য ফিচার চেয়েছিলাম পরিচিত এক লেখকের কাছে। সাবধানি চোখ নিয়ে তার জমা দেওয়া লেখাটা পড়ছিলাম। লেখার বাঁধুনিটা ভীষণ ভালো। কিন্তু প্যারাগ্রাফের চেঞ্জগুলো একদম ঠিকঠাক করতে পারেননি। সেগুলিকেই সম্পাদকীয় দৃষ্টিতে যতটা সম্ভব দেখে নেবার চেষ্টা করছিলাম।

সামনে এসে দাঁড়াল অনিরূপা। বছর ২৭-এর মেয়েটি রবিবারের পাতার সম্পাদকীয় বিভাগে আছে প্রায় দেড় বছর। তারও আগের দু-বছর প্রথম শ্রেণির একটা দৈনিক ডেস্কে চাকরি করে এসেছে। বাংলা ভাষায় এত কম বয়সে এই জ্ঞান খুব কম মেয়ের মধ্যে দেখা যায় অথচ কোনওরকম আঁতলামো নেই, উলটে এক নম্বর ফক্কড়। সাহিত্যলোকের এ সপ্তাহতেই প্রকাশিত সংখ্যাটা আমার দিকে এগিয়ে ধরে চোখ দুটো বড়ো করে বলল, সৌম্যদা, এবার না তুমি খবর হয়ে যাবে।

নিজের হাতঘড়িটা কনুইয়ে দিকে একটু ঠেলে তুলে দিয়ে বলি, কেন রে!

অপর্ণা ঘোষের স্টোরিটা তুমি করেছিলে না?

হ্যাঁ, তো!

ভালো করে পড়ে দেখো এটা। চলে যায় অনিরূপা।

সাহিত্যলোকের বইয়ে আলোচনার বিভাগটা খুলে রেখে গেছে ও। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি। বাজারে এই মুহূর্তে সাহিত্য পত্রিকার সংখ্যা অনেকগুলো। সদ্য প্রকাশিত বইগুলির আলোচনাও থাকে সে সমস্ত সংখ্যায়। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে সাহিত্যলোকের আলোচনা বিভাগটিকে অন্যরকম গুরুত্ব দিই। দীর্ঘদিন ধরে এই বিভাগটিতে লেখেন গণেশ মুখোপাধ্যায়। লোকটার পড়াশোনা, বিশ্লেষণ এবং তথ্য পেশ করার ক্ষমতা চমকে দেবার মতো। গণেশ মুখোপাধ্যায়ের মতো সমালোচক কোনও লেখক বা বই সম্পর্কে যে মন্তব্য করবে, সেটা আমার মতো অনেকের কাছেই আপ্তবাক্য। সবচেয়ে বড়ো কথা লোকটা সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার ক্ষমতা রাখে। সুতরাং, তার মতো ব্যক্তিত্ব যখন অপর্ণা ঘোষের লেখার সঙ্গে পঙ্কজ ঘোষের লেখার অত্যাশ্চর্য মিল খুঁজে পেয়েছে, সেটা আর যাই হোক ধান ছড়িয়ে বুলবুলিতে খাওয়ার মতো ঘটনা নয়।

স্টোরিটা করার সময় অপর্ণা ঘোষের বইয়ের দুএকটি গল্প পড়ে আমি কিছু মন্তব্যও করেছিলাম। সত্যি কথা বলতে গেলে কী, কোনও লেখিকার প্রথম গল্প গ্রন্থেরই ভাষা এত সাবলীল অথচ গভীর হতে পারে তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। গোটা স্টোরিটাই তৈরি করেছিলাম একটু মুগ্ধ ভাব নিয়ে। গণেশ মুখোপাধ্যায়ের আলোচনার কোনও কোনও অংশ ব্যাঙ্গাত্মক তীর হয়ে যে আমার কাগজের রবিবারের স্টোরিটাকেও বিদ্ধ করেছে স্পষ্টই বুঝতে পারলাম। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর লেখার ধরনের মধ্যে মিল থাকা কি খুব অস্বাভাবিক! দীর্ঘদিন একজনের সাথে থাকতে থাকতে তার অনেক কিছুই তো অজান্তেই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। তবে সাহিত্যলোকের আলোচনাটা যে অপর্ণা ঘোষের সদ্য শুরু হওয়া সাহিত্য জীবনকে অনেকটাই জটিল করে তুলবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই।

হাতের কাছে রাখা নিজের মোবাইল থেকে সান্ধ্য নিউজের রমাদি-কে ধরলাম। ভদ্রমহিলার লিটারেচার ফিল্ডের জ্ঞানটা যেমন গভীর তেমনি খবরও রাখেন নানারকম। প্রথমবার বেজে বেজে থেমে গেল। দ্বিতীয়বার ফোন করার সাথে সাথেই গম্ভীর অথচ সুরেলা গলা নিয়ে আমার কানের কাছে উঠে এলেন রমাদি। আমি সোজাসুজি আসল দরকারে আঘাত হানার চেষ্টা করলাম, দিদি, সেদিন তো অপর্ণা ঘোষের বইয়ের লঞ্চিং-এ আপনিও ছিলেন। সাহিত্যলোকে এবারে যে-আলোচনাটা বেরিয়েছে চোখে পড়েছে নাকি?

হ্যাঁ পড়েছে, সংক্ষিপ্ত, উদাসীন প্রতিক্রিয়া মনে হল আমার।

কী মনে হচ্ছে আপনার?

কী আবার! গণেশবাবু যখন লিখেছেন তখন একটা কিছু ব্যাপার তো রয়েছেই।

আপনার কী মনে হচ্ছে? ভেতরে ভেতরে অধৈর্য হয়ে উঠছিলাম।

কী বলি বলো তো! বেশ বিতর্কিত ব্যাপার। তবে আমার মনে হচ্ছে পঙ্কজদার কিছু লেখা অপ্রকাশিত পড়েছিল। সেগুলোকেই এখন নিজের নামে চালানোর চেষ্টা চলছে। অপর্ণা চিরকালই সংসারিক মেয়ে কোনও সাহিত্যের অনুষ্ঠানেও স্বামীকে সঙ্গ দিতে দেখিনি, অথচ পঙ্কজদা বরাবর নারীবাদের স্বপক্ষে কথা বলে এসেছেন।

সেন্ট্রাল এসি-র মধ্যে বসেও নিজের চারপাশে একটা গরম আবহাওয়ার বেষ্টনী পেলাম। ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। কেন জানি না মনে হচ্ছিল, ব্যাপারটা আর একটু খুঁড়ে দেখা দরকার। ও প্রান্তে রমাদি অবশ্য আমার উত্তেজনায় ঠান্ডা জল ঢেলে দিলেন।

এটাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে কী হবে সৌম্য! বাংলা সাহিত্যে লেখালিখিতে এটা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফোনটা কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলাম। সুদীপ্তর ফোন নাম্বারটা যতদূর মনে হচ্ছে ফোন বুকে তোলা আছে। একটু খুঁজতে পেয়ে গেলাম। অনুরোধটা করতেই ওর মুখ থেকে যেন একরাশ বিরক্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল।

কেন কথা বলতে হবে, কেন? অপর্ণাদি তার মতো লিখেছেন। আপনারা যেটা লিখবেন সেটাকেই কেন সবচেয়ে বড়ো সত্যি বলে মেনে নিতে হবে!

দেখুন সুদীপ্তবাবু, কথাটা অনেকাংশে সত্যি। কিন্তু কথাটা বোধহয় আমার সম্পর্কে খাটে না। বইটা পড়েই অপর্ণাদি সম্পর্কে আমার একটু অন্যরকম ধারণা হয়েছিল। আমি একটু ওনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনি প্লিজ একটা অ্যাপয়েনটমেন্ট…

কথা দিতে পারছি না। চেষ্টা করে দেখছি।

সুদীপ্তর কন্ঠস্বরকে এতটুকু নরম মনে হল না!

তিন

মিনিট পনেরো হল চা-টা শেষ করেছি। দাঁত এবং মাড়ির আশেপাশে লেপটে থাকা বিস্কুটের স্তরটাকে জিভ চালিয়ে পরিষ্কার করে নেবার চেষ্টা করছিলাম। ফুল স্পিড-এ মাথার ওপরে পাখা ছাড়াও পাশে থাকা সুপার স্পিড-এর স্ট্যান্ডফ্যানটা মাথার চুলগুলোকে এলোমেলো করে যাচ্ছিল।

অপর্ণা ঘোষ উলটো দিকের সোফায় এসে বসেছেন বেশ কিছুক্ষণ কিন্তু এখনও অবধি মুখ খোলেননি। একই সোফার কোণে বসে আছে সুদীপ্ত। প্রশ্নগুলো মোটামুটি নিজের মনে সাজিয়ে রেখেছি। রিডিং লাইটের আধা আলো আঁধারিতে লেখিকার মুখের ভাব ও মনের তরঙ্গের ঠিক হদিশ মিলছিল না। ঘোর লাগা গলায় একসময় সূচনাহীন এবড়োখেবড়ো প্রবন্ধ পড়ার ভঙ্গিমায় ওনার হঠাৎ করে বলতে শুরু করাটা আমাকে সচকিত করে দেয়। নিজের উরুর ওপরে প্যাডটা খুলে রাখাই ছিল। ডট পেনের পিছনটা আঙুল চালিয়ে টিপে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো তুলে নেবার জন্য প্রস্তুত হই।

এত বছর পঙ্কজবাবুর সঙ্গে কাটানোর কারণেই কি তার অন্বয়রীতি, বাক্যবিস্তার, প্লট আপনার গল্পে গৃহীত হয়েছে? খুব ধীর গতিতে প্রশ্নটাকে ওনার সামনে রাখার চেষ্টা করলাম।

প্রশ্নটার সরাসরি জবাব দেবার কোনও তাগিদ লক্ষ করলাম না ওনার মধ্যে। স্মৃতির অতল গহ্বরে ডুবে পুনরায় ভেসে উঠতে চাইলেন তিনি। সত্যেন বোস লেনের মেসটাতে ও যখন থাকতে এল, তখনই ও ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিয়েছে। পড়াশোনায় কোনওদিনই সেভাবে মন ছিল না ওর। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার অফিসে নিয়মিত ঘোরাঘুরি করছিল বটে কিন্তু সেভাবে কলকে পাচ্ছিল না। বেশ হতাশ। এইরকম একটা সময়ে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে ওর সঙ্গে আমার দেখা। ইংরাজি অনার্সের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী আমি। প্রথম দেখাতেই উদ্দাম প্রেম আর তার মাস ছয়েকের মধ্যেই বিয়ে। একটি খবরের কাগজে যৎসামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে ও কলাম লিখত। একটু দম নেবার জন্য যেন থামতে চাইলেন অপর্ণা।

পরের প্রশ্নটা করব কিনা ভাবছি, এমন সময় পূর্ব প্রসঙ্গকে আরও টেনে বলতে শুরু করলেন অপর্ণা। তখন কাগজে ও যে-সব রিভিউগুলো লিখছে সেগুলোও সম্পাদকের ঠিকমতো পছন্দ হচ্ছে না। বেশ হতাশ ও। সংসার চলতে চাইছে না। সংসার ক্রমশ আমার কাছে বিভীষিকা তখন। এরই মধ্যে মোটামুটি একটি নামি পত্রিকায় আমার একটি গল্প বেরোয়। লেখাটি মোটামুটি প্রশংসিত হয়েছিল। আপনি ভাবছেন এসব কথা আপনাকেই বা কেন বলছি! আসলে এই মুহূর্তে অনেকেই যখন অফিসের ঠান্ডা ঘরে বসে আমার বিরুদ্ধে কলম চালাচ্ছে, তখন আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি সত্যিকথার অনুসন্ধান করেন। আর এত বছরে আমারও তো কিছু বলার থাকতে পারে…।

সাদা সাংবাদিকতাকে কীভাবে হলুদ সাংবাদিকতা নিজের বশে এনে ফেলেছে তা এই কবছরে ভালোই উপলব্ধি করেছি। কিন্তু অপর্ণা ঘোষের শেষ বাক্যটি আমাকে রীতিমতো চমকে দিল। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে ওনাকে বলি, বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমার কিন্তু কোথাও একটু গণ্ডগোল ঠেকছে। কোথাও একটা ফাঁক। একটা মস্ত বড়ো সত্যি যেন মেঘে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। আমার ধারণা এই ধোঁয়াশা আপনিই দূর করতে পারেন।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন অপর্ণা। মুখ তুলে এরপর উনি সুদীপ্তর দিকে তাকাতে মুখে অল্প হাসি এনে সুদীপ্ত যেন ওনাকে কিছুর সম্মতি দেয়।

উনি বলতে শুরু করলে ওনার গলাটা আগের থেকে দৃঢ় শোনাচ্ছিল, ক্রিয়েটিভ রাইটিংটা কোনওদিন আপনাদের পঙ্কজদার আসত না। খেতে পাচ্ছি না অথচ রোজই ওর মুখে গালভরা স্বপ্ন শুনতাম। আর কখনও-কখনও রাতে বাড়ি ফিরে গায়ে হাত তুলত। অনেক বড়ো বড়ো সভায় গিয়ে সমাজে নারী স্বাধীনতার স্বপক্ষে অনেক বক্তৃতাই ও শুনিয়েছে। কিন্তু নিজের দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর সঙ্গে কী ব্যবহার করত আপনাদের সংবাদমাধ্যম কি তার খবর রেখেছে? আমার গল্পটা প্রশংসিত হবার পর আরও একটি গল্প লিখি এবং একটি নামি দৈনিকের রবিবারের পাতায় গল্পটি ওর নামে পাঠিয়ে দিই। আমার স্বামীকে এর পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এতদিন পঙ্কজ ঘোষের নামে যা যা বেস্টসেলার পাবলিক জেনে এসেছে তার প্রতিটি অক্ষর আসলে আমার সৃষ্টি। দুহাতে নিজের মুখ ঢাকলেন অপর্ণা।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো এতক্ষণ শুনে যাচ্ছিলাম। স্টোরিটা কীভাবে নিজের কাগজে প্লেস করব, এবার তার ভাবনা আমাকে ধাক্কা দেয়। খুব ধীর গলায় সুদীপ্ত বলে ওঠে, কিন্তু লেখার রীতিটা যে দিদির, সেটা বোধহয় প্রমাণ করা সম্ভব নয়, না?

মৃদু হেসে বলে উঠি, কেন নয়? পঙ্কজ ঘোষের প্রবন্ধের ভাষা ও গল্প-উপন্যাসের ভাষা পরীক্ষা করে, আমার ধারণা একজন ভাষাবিদ অবশ্যই বলতে পারবেন। আর তা ছাড়া সত্যিটা প্রকাশিত হলে জনগণের সামনে একটা দুটো গল্প একজন জাত লেখিকা লিখে দিতে পারে। এটা নিয়ে ভাবার দরকার আছে বলে মনে করি না।

ধীর পায়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়াই। এ বাড়িতে ঢোকার আগে সাক্ষাৎকার শিরোনাম কী দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না। শিরোনামটা হঠাৎই মাথায় এসে যায়। নিজের ব্যাগ থেকে প্যাডটা বের করে ভুলে যাবার আগেই তা দ্রুত হাতে লিখে নিতে থাকি আমি…

 

আবার আসিব ফিরে

একদৃষ্টে সাগরের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল রাজীব। আরব সাগরের অশান্ত, উত্তাল ঢেউ সহজে চোখে পড়ে না। কিন্তু আজ কেন জানি না রাজীবের উত্তাল অশান্ত হৃদয়ের চেহারাই বারবার প্রতিফলিত হচ্ছিল সাগরের অন্তহীন বুক জুড়ে।

সঞ্জনার চেহারাটা বারবার ভেসে উঠছিল রাজীবের চোখের সামনে। কিছুই আর চিন্তা করতে পারছিল না সঞ্জনা ছাড়া। সারা পৃথিবীতে কী ঘটে চলেছে তার সঙ্গে রাজীবের কিছুমাত্র যোগাযোগ ছিল না। ও শুধু নিজের জগতেই নিজেকে বন্দি করে নিয়েছিল।

সঞ্জনা রাজীবের বিবাহিতা স্ত্রী। মা, বাবার দেখে দেওয়া পাত্রীকে এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল রাজীবের। তিন বছরের বিবাহিত জীবন ওদের। সঞ্জনা ছাড়া নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার কল্পনাও করতে পারত না রাজীব। এক স্বর্গীয় ভালোবাসায় নিজেকে উজাড় করে রাজীব তুলে ধরেছিল সঞ্জনার হাতে।

চাকরি এবং স্ত্রী সঞ্জনাকে নিয়ে রাজীব মুম্বই শহরে এসে পৌঁছেছিল। তিন বছর ওদের কোনও সন্তান হয়নি। এই নিয়ে কোনও দুঃখও ছিল না রাজীবের মনে। সঞ্জনাই ওর পুরোটা জুড়ে ছিল। সংসারে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি রাজীব। সঞ্জনা ছাড়া ও কিছুই প্রত্যাশা করত না। তবুও দুজনের সংসারে তৃতীয়জনের আসার সংবাদ ডাক্তারের মুখে শুনে খুশি হয়েছিল রাজীব। বেশি খুশি হয়েছিল সঞ্জনার জন্য।

কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস স্বীকার করা ছাড়া আর কী-বা করতে পারল রাজীব? সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে চিরতরে রাজীবকে ত্যাগ করে সঞ্জনা কোথায় হারিয়ে গেল। রাজীব, কন্যাসন্তান, গোছানো সংসার সবই পড়ে থাকল শুধু গুছিয়ে রাখার মানুষটাই স্নেহ, মায়ার বন্ধন কাটিয়ে রাজীবের হৃদয়টাকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেল।

বাড়িতে কিছুতেই মন বসাতে পারছিল না। চারিদিকে শুধু সঞ্জনার স্মৃতি। সবথেকে বেশি সঞ্জনার কথা মনে হতো সঞ্জনার ফেলে যাওয়া একরত্তি ওই মেয়েকে দেখলে। রাজীব যেন মনে মনে সঞ্জনার মৃত্যুর জন্য মেয়েকেই দাযী করে বসল। ওর দিকে তাকালেই মনটা আরও বেশি হুহু করে উঠত।

বেঙ্গালুরু থেকে রাজীবের মা-বাবা মুম্বই এসেছিলেন পুত্রবধূ বাড়ি ফিরলে সংসার সামলাতে যাতে কষ্ট না হয় সঞ্জনার ছোটো বাচ্চা নিয়ে কিন্তু সেই সঞ্জনাই ফিরল না। ঠাকুমা-ঠাকুরদাই নাতনিকে আপন করে নিলেন। স্নেহ মমতা দিয়ে ওইটুকু প্রাণকে আগলে রাখার চেষ্টা করে চললেন। ছেলেকে ওনারা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলেন কিন্তু রাজীবের মন কিছুতেই ভিজল না। জীবন থেকে মেয়েকে দূরে সরিয়ে রাখল সে।

অগত্যা উপায়ান্তর না দেখে রাজীবের মা-বাবা একমাত্র নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে বেঙ্গালুরু ফিরে গেলেন। রাজীব মুম্বইতে একাই রয়ে গেল। তার জীবনে ভালোবাসা রূপকথা হয়ে রয়ে গেল।

সঞ্জনার মৃত্যুর প্রায় আট মাস হয়ে গেছে। যন্ত্রের মতো কেটে গেছে এই দীর্ঘ সময়টা। চারপাশে কী হচ্ছে কিছুরই খেয়াল করেনি রাজীব। তাহলে আজ হঠাৎ আবার সাগরের একের পর এক ভেঙে পড়া ঢেউ দেখতে দেখতে, কেন তার হৃদয় এতটা উদ্বেলিত হচ্ছে রাজীব বুঝতে পারছে না! সঞ্জনাকে দেখে তো এমনটা হতো কিন্তু সেই মুহূর্তটুকু তো জীবনে একবারই আসে। তাহলে আজ কীসের জন্য মন এতটা অশান্ত? তাহলে কারও প্রতি কি তার মন আকর্ষিত হচ্ছে? না না এ হতে পারে না। সঞ্জনার উপর কোনও অন্যায় অবিচার সে হতে দিতে পারে না। এ অন্যায়।

রাজীব স্বপ্নেও ভাবেনি এই মুহূর্তটুকু আবার তার জীবনে প্রবেশ করবে। মানসিক এই টানাপোড়েন অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলছিল রাজীবের ভিতর। প্রতিবেশী মেয়েটির চেহারা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। একজন প্রতিবেশীর জন্য চিন্তা করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয় কিন্তু সবকিছুকে রাজীব কিছুতেই একটা সরলরেখায় ফেলতে পারছিল না।

ছয় মাসের হয়তো একটু বেশিই হবে সামনের খালি ফ্ল্যাট-টায় ওই মেয়েটি এসেছে। মেয়ে না বলে মহিলা বললেই হয়তো ঠিক হবে কারণ রাজীবের মনে হয়েছিল মহিলার বয়স তিরিশের আশেপাশে। বারান্দায় দাঁড়ালে রাজীবের ঠিক উলটো দিকে সেই ফ্ল্যাট। দুটো ফ্ল্যাটের মুখোমুখি বারান্দা।

রাজীবের প্রথম চোখে পড়ে যখন মেয়েটিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে দেখে। এছাড়া খোলা বারান্দার দরজা দিয়ে চোখে পড়েছিল লোক দিয়ে বাড়ির জিনিসপত্র সব গুছিয়ে তুলছিল ওই মহিলা। ব্যস অতটুকুই।

অফিসে যাওয়া-আসার পথে, লিফট-এ প্রায়শই দেখা হতো। অনেকেরই সাথে তো রোজ দেখা হয়, তাহলে বিশেষ করে ওই একজনের প্রতি কেন আকর্ষণ অনুভব করত রাজীব, নিজেই বুঝতে পারত না। হয়তো একাকিত্ব বোধ থেকে অথবা শরীরের অপ্রতিরোধ্য চাহিদা থেকে, এর মধ্যে কোনটা সেটা রাজীবের কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না।

একদিন লিফ্ট থেকে বেরোতে গিয়ে তাড়াহুড়োতে কোনও ভাবে পা মুচকে গিয়ে মহিলা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, রাজীব কোনওরকমে ধরে ফেলে। হাত ধরে বাইরে রাখা একটি চেয়ারে ওকে বসিয়ে দেয় রাজীব।

দেখি কোথায় লাগল আপনার, বলে নীচু হয়ে রাজীব আঘাতের জায়গাটা দেখার চেষ্টা করতেই এক ঝটকায় মহিলা পা-টা সরিয়ে নিল।

না না, আমি ঠিক আছি। একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে, বলতে বলতে মহিলা চেয়ারে বসেই পা-টাকে একটু নাড়াচাড়া করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

কোনও সাহায্য লাগলে বলুন…

না না ধন্যবাদ। ঠিক সামলে নেব…

কথা না বাড়িয়ে রাজীব অফিসের পথে পা বাড়াল। কিন্তু সারাটা দিন মুহূর্তের ওই স্পর্শটুকু কিছুতেই মাথা থেকে বার করতে পারল না।

দুতিন দিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখল মহিলাকে। এর মধ্যে দেখা হলে মৌখিক হাসি বিনিময় হতো আর মাঝেমধ্যে একটা দুটো করে কথা। মহিলা রাজীবের মনে চেপে বসে থাকা বরফের চাঁইটাকে একটু একটু করে গলাতে শুরু করল।

এর পর হঠাৎ করেই তিন-চারদিন আবার দেখা নেই। ভিতরে ভিতরে একটা অস্বস্তিতে ভুগতে লাগল রাজীব। বারান্দার দরজাও রাতদিন বন্ধ। অজানা আশঙ্কায় রাজীবের মন কেঁপে উঠল।

মহিলার ফ্ল্যাটে যাওয়া উচিত হবে কিনা কিছুতেই মনস্থির করতে পারছিল না রাজীব। হঠাৎ দরজায় কলিংবেল-এর আওয়াজ শুনে দরজা খুলতেই দেখল ওই মহিলার বাড়ির কাজের মাসি সামনে দাঁড়িয়ে

সাহাব, একবার ওই ফ্ল্যাটে চলো। মেমসাহেবের শরীর খুব খারাপ, কী করব আমি বুঝতে পারছি না। এক নিঃশ্বাসে হড়বড় করে বলে ওঠে মাসি।

রাজীব তত্ক্ষণাৎ মহিলার ফ্ল্যাটে এসে হাজির হয় মাসির সঙ্গে। বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে মহিলা, দেখে হুঁশ আছে বলে মনে হল না।

কোনও ডাক্তার দেখেছে? চিন্তিত হয়ে মাসিকেই জিজ্ঞেস করে রাজীব।

মাথা নাড়ায় মাসি।

সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ফোন করে বাড়িতে আসতে বলে রাজীব। ডাক্তার এসে দেখে ওষুধপত্র সব লিখে দিয়ে যান। ওষুধগুলো মাসিকে দিয়ে আনিয়ে নেয় রাজীব। পালা করে মাসির সঙ্গে মাথায় জলপট্টি করতে থাকে যাতে জ্বরের পারদ একটু নামে। ডাক্তারবাবুর ওষুধগুলো একটা একটা করে খাইয়ে দেয় মহিলাকে। ধীরে ধীরে জ্বর কিছুটা কম হলে রাজীব নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে আসে।

পরের দিন মহিলাকে একটু সুস্থ দেখে রাজীব জিজ্ঞেস করে, আপনার আত্মীয় কেউ আছেন যাকে খবর দিতে হবে? আপনি বললে আমি ফোন করে দিতে পারি। হালকা করে মাথা নেড়ে না বলে মহিলা। সুতরাং তার খাওয়াদাওয়া, সময়ে সময়ে ওষুধ খাওয়ানোর দাযিত্ব রাজীব নিজের উপরেই নিয়ে নেয়। রাজীব বুঝতে পারছিল এর ফলে মহিলা সংকোচ বোধ করছে। কিন্তু শরীর এতটাই দুর্বল যার জন্য কিছু বলতে পারছে না।

চারদিন পর রাজীব মহিলার ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখল, এতদিন পর বিছানায় উঠে বসেছে মহিলা। অনেক সুস্থ লাগছে ওকে। রাজীব ঘরে ঢুকতেই মহিলা বলে উঠল, আপনাকে এতদিন ধরে অনেক কষ্ট দিলাম। আমাকে ক্ষমা করবেন।

ক্ষমা কীসের জন্য? প্রতিবেশীই তো প্রতিবেশীর কাজে আসে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।

হ্যাঁ, ভাবছি কালকের দিনটা বিশ্রাম নিয়ে পরশু থেকে অফিস জয়েন করব। কোনও কিছুর দরকার আছে কিনা জেনে নিয়ে রাজীব অফিস বেরিয়ে পড়ে।

এর পর মেলামেশা আরও একটু গাঢ় হয়। একসঙ্গে ডিনার সারা, একসঙ্গে বসে গল্পগুজব করা ওদের দুজনের বন্ধুত্বকে আরও সুদৃঢ় করে তোলে।

জানলায় দাঁড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল রাজীব। আকাশ এত নীল আগে কখনও খেয়াল করেনি। হয়তো কখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখার কথাই মনে হয়নি। হৃদয়ে যখন শূন্যতা জায়গা জুড়ে বসে তখন সবকিছুই কেমন অর্থহীন হয়ে পড়ে। এই কয়েক মাস হল আকাশে রঙের আনাগোনা লক্ষ্য করছে রাজীব।

আজ সন্ধেবেলা দুজনে ডিনারে যাওয়ার কথা আছে। এতদিন ধরে মেলামেশা করছে, রাজীবের মনে হল আজ পর্যন্ত সঙ্গিনীর নামটা পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করা হয়নি। অবশ্য দুজনের কেউই আজ পর্যন্ত নিজেদের অতীত নিয়ে কখনও কথা তোলেনি।

ডিনার টেবিলে মুখোমুখি বসে কথা বলা শুরু করলে রাজীবই প্রসঙ্গ তুলল, এতদিন হয়ে গেল, আপনার নামটাই এখনও জানা হল না।

অনসূয়া, হাসিতে ভরে গেল মহিলার মুখ।

বাঃ, ভারী সুন্দর আপনার নাম। অত্রি মুনির স্ত্রী ছিলেন সতীসাধ্বী অনসূয়াদেবী। রামায়ণে আমরা তাঁর বর্ণনা পাই, আপনিও নিশ্চয়ই পড়ে থাকবেন?

মায়ের মুখে এই গল্প বহুবার শুনেছি। হেসে উত্তর দেয় অনসূয়া।

কথা বলতে বলতেই খাবারের অর্ডারটা দিয়ে দেয় রাজীব।

আরও কিছু বলুন নিজের সম্পর্কে। আমরা কেউই একে অপরের সম্পর্কে কিছুই জানি না। অবশ্য আপনার যদি আপত্তি না থাকে তবেই বলুন! সামান্য দ্বিধা নিয়ে কথাগুলো বলে রাজীব।

অনসূয়া চোখ নামিয়ে হাতের নখ খুঁটতে থাকে।

ঠিক আছে, আপনাকে কিছু বলতে হবে না, ব্যস্ত কণ্ঠে রাজীব বলে ওঠে।

না না, সেরকম কিছু নয়। এতদিনে এইটুকু বন্ধুত্ব তো হয়ে গেছে। আমি নিজের কথা আপনাকে খুলে বলতে পারি। চলুন, খাওয়ার পর বাইরে বেরিয়ে সব বলব। চোখ নীচে নামিয়ে অনসূয়া কিছুটা সময় চেয়ে নিল নিজেকে গুছিয়ে নিতে।

খাওয়ার পর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল অনসূয়া তারপর ধীর স্বরে বলতে আরম্ভ করল, আমরা দুজনেই এমবিএ করছিলাম। ছেলেটিও আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসত। আমরা লিভ ইন করতে শুরু করি। আমার মা-বাবা আমাকে অনেক বুঝিয়েছিল এই সম্পর্ক থেকে সরে আসার জন্য। প্রচুর বকাবকিও করেছিল। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না। মা আমাকে বুঝিয়েছিল যে, বিয়ের পর আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি কিন্তু আমিই শুনিনি।

আমার মনে হয়েছিল, যখন দুজনে দুজনকে ভালোবাসি তখন বিয়ের বন্ধনের দরকারটা কোথায়? এছাড়া তখন বিয়ে করা সম্ভবও ছিল না। মা-বাবা রাগ করে আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এর পর আমরাও চাকরি পেয়ে যাই। কিন্তু আলাদা আলাদা শহরে। চেষ্টা করছিলাম দুজনের চাকরি যাতে এক শহরে হয়।

আমার বয়ফ্রেন্ড কখনও ছুটি পেলে আমার কাছে চলে আসত, কখনও আমি ওর কাছে চলে যেতাম। এই ভাবে প্রায় একটা বছর কেটে যায়। তার পর হঠাৎই খেয়াল করি ও না আসতে পারার জন্য রোজ নতুন নতুন বাহানা দিচ্ছে। একটু জোর দিতেই ও স্বীকার করে নেয়, অন্য একটি মেয়েকে নাকি সে এখন ভালোবাসে। এটা কী করে সম্ভব? আমি তো জানতাম ভালোবাসার আনন্দ একবারই হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা যায়। দ্বিতীয়বার কি আর কখনও সেভাবে ভালোবাসা যায়? আপনিই বলুন…। কথা বলতে বলতে দু-হাতে মুখ ঢাকে অনসূয়া।

রাজীব অনসূয়ার হাত ধরে সামনে থাকা একটা বেঞ্চের উপর বসিয়ে দেয়।

না না আপনিই বলুন দ্বিতীয়বার কি আর ভালোবাসা আসে জীবনে? অশ্রুসজল নয়নে অনসূয়া প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায় রাজীবকে।

উত্তর দেয় না রাজীব। দৃষ্টি মাটির দিকে নিবদ্ধ করে চুপচাপ বসে থাকে সে। অনসূয়া ধৈর্য হারিয়ে বলে ওঠে, তার মানে আপনি বলতে চান প্রথমটা ভালোবাসা ছিলই না। শুধুই শরীরী আকর্ষণ মাত্র!

না আমি সেরকম কিছু তো বলিনি, তবে ভালোবাসা…, চুপ করে যায় রাজীব।

হ্যাঁ, ভালোবাসা… কী বলতে চাইছেন পরিষ্কার করে বলুন। অনসূয়ার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল।

আমিও এতদিন এটাই বিশ্বাস করতাম, গভীর নিঃশ্বাস নেয় রাজীব। যে ভালোবাসা জীবনে একবারই আসে। আমিও প্রাণের থেকে স্ত্রীকে বেশি ভালোবাসতাম কিন্তু মেয়ে জন্ম দিতে গিয়ে ওর মৃত্যু হয়। তখন মনে হয়েছিল এটাই আমার জীবনে শেষ ভালোবাসা যতদিন না… বলতে বলতে রাজীব চুপ হয়ে যায়।

যতদিন না… একরাশ প্রশ্ন নিয়ে অনসূয়া রাজীবের দিকে তাকায়। রাজীব দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।

কী হল, বললেন না? তাহলে কি এখন অন্য কাউকে ভালোবাসেন? অনসূয়ার দৃষ্টির গভীরতা রাজীবকে বিদ্ধ করে।

হঠাৎ রাজীব তাড়া দেয় অনসূয়াকে, চলুন রাত হয়ে যাচ্ছে বাড়ি ফেরা যাক।

অনসূয়া রাজীবের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে ফেলে, আগে কথা শেষ করুন।

অনেক রাত হল, এবার ফেরা যাক।

না, আগে আমাকে বলুন, অধীর হয়ে ওঠে অনসূয়া।

কী বলব। হ্যাঁ ভালোবাসি। তোমাকে ভালোবাসি অনসূয়া। উত্তেজিত হয়ে রাজীব বলে ওঠে, চোখের থেকে জল গড়িয়ে পড়ে তার।

না, না এ কিছুতেই হতে পারে না! অনসূয়া ছেড়ে দেয় রাজীবের হাত।

অনসূয়া শোনো, তোমার প্রতি আমার এই অনুভতি যে তোমারও থাকবে এই দাবি কখনও-ই করি না। আমার এই অনুভতি যে আমাদের বন্ধুত্বের উপর কোনও প্রভাব ফেলবে না সেটা আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি।

পরের দিন দুজনের দেখা হলেও কথা বলার খুব একটা সুযোগ হল না। রাজীবও নিজেকে সংযত করে নিয়েছিল।

দ্বিতীয় দিন অনসূয়া জানাল, তাকে পাঁচদিনের জন্য অফিসের কাজে শহরের বাইরে যেতে হচ্ছে।

এরই মধ্যে মায়ের শরীর খারাপের খবর আসাতে রাজীব ছুটি নিয়ে বেঙ্গালুরু চলে এল। মেয়েকে এই প্রথম নিজে থেকে কোলে তুলে নিল রাজীব। আজ এই প্রথমবার তার মনে হল না এই মেয়ের জন্যই সে সঞ্জনাকে হারিয়েছে চিরজীবনের মতো। মনে আজ আর কোনও বিদ্বেষ নেই, রাজীব মনে শান্তি অনুভব করল। সঞ্জনার স্মৃতি আজ দুঃখ দিল না। বরং তার মনে হল, সঞ্জনা জীবনে পুরো ভালোবাসা পেয়ে যেতে পেরেছে। এই সন্তান সঞ্জনার অস্তিত্ব নয় বরং রাজীবের জীবনের একটা অংশ এবং এই অংশকে কোনওদিন অবহেলা করার নয়, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল রাজীব।

রাজীবের মা-ও ছেলের এই পরিবর্তন ভালো করেই বুঝতে পারছিলেন। পুরোনো আগের সেই রাজীবকে ফিরে পেয়ে উনিও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠলেন। এক সপ্তাহ সকলের সঙ্গে হইহই করে কাটিয়ে রাজীব ফিরে এল মুম্বই।

সকালে অফিসের জন্য তৈরি হতে তাড়াতাড়ি স্নানে ঢুকেছিল রাজীব। তখনই টের পেল বারবার কেউ কলিংবেল বাজাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে বাথরোব পরে নিয়ে রাজীব বাইরে বেরিয়ে এল। যে-কেউই দরজায় থাক না কেন অপেক্ষা করতে রাজি নয় বেশ বুঝতে পারছিল।

দরজা খুলতেই দেখে অনসূয়া দাঁড়িয়ে, একপ্রকার রাজীবকে ঠেলেই ভিতরে ঢুকে এল সে। রাজীব দরজা বন্ধ করতেই চেঁচিয়ে উঠল রাজীবের উপর।

কোথায় চলে গিয়েছিলেন? বলেও যাননি কিছু? ফোন নম্বরও দিয়ে যাননি। আপনার কোনও আইডিয়া আছে, আমার অবস্থা কী হতে পারে? চিন্তা করে কোনও কুল পাচ্ছিলাম না। খালি মনে হচ্ছিল আপনিও আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন না তো? এমনিতে দাবি করেন আমাকে ভালোবাসেন অথচ একবারও আমার চিন্তা আপনার মাথায় এল না? বলতে বলতে কেঁদে ফেলে অনসূয়া।

সামান্য হেসে এগিয়ে এসে রাজীব অনসূয়াকে নিজের বুকে টেনে নেয়। এতদিনে ভালোবাসাও অনসূয়ার হৃদয়ের আঙিনায় জানান দিয়ে গেছে, আবার আসিয়াছি ফিরে।

 

পৌনঃপুনিক

আত্মহত্যা করার জন্য দমদমে রেল-লাইনের ধারে এসে দাঁড়াল অম্বরীশ। রাত তখন দশটা বেজে গেছে। মাঘ মাসের রাত। বেশ ঠান্ডা। অম্বরীশের হাতে সিগারেট। একটা লম্বা টান দিতেই, আগুনটা জোরালো হল। সেই আগুনের হালকা আলোয় দেখতে পেল, তিনটে ইটের ওপর মাটির হাঁড়ি রেখে লাইনের ধারে ঝোপের পাশে একটা লোক ভাত রান্না করছে। পাশে একটা বাচ্চা খেলা করছে।

অম্বরীশের মায়ের কথা, বেশি করে, মায়ের মুখটা মনে পড়ছে। দুর্বল করে দিচ্ছে তাকে। পরক্ষণেই শক্ত করে নিচ্ছে নিজেকে। না হলে সে পারবে না। সবাইকে নিজের কাছে খারাপ করে তুলতে হবে। মনকে বিষিয়ে নিতে হবে। অনুভূতিটাকে কেউ ভালোবাসে নার জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। অম্বরীশ ভাবে, শুধু তো মালবিকার বাবা-মা নয়, আমার নিজের বাবা-মা-ও তো ষড়যন্ত্রী। তারাও তো একবারও ভাবেনি মালুকে না পেলে অম্বুর কতটা কষ্ট হবে!

আজকে এই বিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে এখনও রাশি, গণ, গোত্র, কুষ্ঠির দোহাই দিয়ে একটা প্রেমকে ওরা হত্যা করল। অম্বরীশ শুধু একটা রহস্যই ভাবতে লাগল যে, কীভাবে ভবিষ্যতের অকল্যাণের ভয় দেখিয়ে ওরা মালবিকাকে রাজি করাল। দূরে সরিয়ে দিল আমার থেকে। এক কথায়, ওর বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল। আমি হাতজোড় করে, বুক চিরে মনটা দেখাতে চেয়েছি, কেউ করুণা করেনি। আজকে সব শেষ করে বুঝিয়ে দেব, আমাদের কীসে কল্যাণ।

যে-মালবিকার ভোরবেলা ভৈরবী রাগের আরোহণ, অবরোহণের প্রতিটি স্বরনিক্ষেপ জানলা দিয়ে ভেসে এসে হৃদয় আন্দোলিত করে দিত। প্রথম বুঝেছিলাম কর্ণ একটা ইন্দ্রিয়। সামান্য হলুদ জামাটা বারান্দায় একবার চোখের দেখা দেখলে বুঝতাম ইন্দ্রিয়সুখ কাকে বলে। গত অষ্টমীতে, পাশে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি দেবার সময় যে-গন্ধটা পেয়েছিলাম, সেটা আজও নাকে স্পষ্ট। গত বছর দোলে মালু বুঝিয়ে দিয়েছিল, জিহ্বা, ত্বক সবই ইন্দ্রিয়। সেই মালবিকাকে তোমরা কেড়ে নিলে! শাস্তি তোমাদের পেতেই হবে।

পাঁচ নম্বর রেল লাইনের দিকটা নির্জন কিন্তু অনেকক্ষণ কোনও ট্রেন আসছে না। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আবার; গত বছর সরস্বতী পুজোয় শাপমোচন নৃত্যনাট্যর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আলোকের এই ঝরনাধারায় গানের সাথে আলতার ফোঁটা দেওয়া নরম ফর্সা রক্তাভ ওই পেলব হাতের যে-নৃত্যভঙ্গিমা আজও আমার বুকে মোচড় দেয়, সেই হাত দুটো আজ মঙ্গলঘটে অন্য পুরুষের হাতের ওপর। এ অসম্ভব! এ নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না।

আমি মঞ্চের পিছনে অন্ধকারে ভাষ্যপাঠ করছি, গন্ধর্বকুমার, অরুনেশ্বরের কথা কমলিকাকে…। কিন্তু না! কেন এত ভালো হচ্ছে, আমি জানি। আসলে অম্বরীশ তো মালবিকাকেই বলছে। সবাই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। নাচের সাথে, মালবিকার যে-হাসিটা আমি প্রাণভরে দেখেছি, সেটার জন্য, শুধু সেটার জন্য, আমি এক পৃথিবী সুখ হেলায় ছেড়ে দিতে পারি। ওই তো! ট্রেন আসছে। অম্বরীশ প্রস্তুত। একবার আকাশের দিকে তাকাল, চাঁদের দিকে, নাকি তার জ্যোত্স্নার দিকে। বিদায় পৃথিবী। ঝাঁপ দিয়ে দিল অম্বরীশ।

চোখে একটা ঠান্ডা জলের ঝাপটা। তা-ও চোখ খুলতে পারছে না অম্বরীশ। মাথার পিছনে অসহ্য একটা ব্যথা অনুভব হচ্ছে। ধীরে ধীরে একটু ফাঁক করল চোখটা। আবার সেই একই চাঁদ-টা মুখের ওপর। তবে জ্যোত্স্না-টা এবার ভেজা। সেই পাগলাটে ধরনের লোকটা, মুখটা ওর মুখের কাছে নিয়ে এসে পরিষ্কার ঝকঝকে বাংলায় বলল, মরতে যাচ্ছিলেন কেন? পৃথিবীতে এমন কোনও কারণ হতে পারে না, যা থেকে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও পথ খোলা নেই। মৃত্যু কোনও সমাধান নয়, ওটা হেরে যাওয়া। বাঁচার রসদ সবসময় আছে, মানুষ খুঁজে পায় না। আপনার ইচ্ছে করলেও আপনি চিরকাল বাঁচতে পারবেন না। এত তাড়া কীসের? অম্বরীশ বোকার মতো তাকিয়ে আছে।

আমার গল্প শুনলে তাহলে আপনি কী করবেন?

অম্বরীশ ধীরে ধীরে উঠে বসল।

লোকটি শুরু করল, আমি মালদার বাসিন্দা। কলেজের পড়াশোনা শেষ করে, একটা ছোটো চাকরি নিলাম। মন বসছিল না সেই চাকরিতে। নিজের ব্যাবসা ছোটো করে শুরু করলাম। একটা ছোটো ঘর নিয়ে এসটিডি বুথ করলাম। ফ্যাক্সও বসালাম। বেশ ভালো চলছিল। বিয়ে করলাম। একটি ছোটো ফুটফুটে মেয়ে হল। মেয়ে আমার লক্ষ্মী। পেজার-এর ব্যাবসায় নামলাম। ব্যাবসা ফুলেফেঁপে উঠতে লাগল। বাড়ি, দোকান, ব্যাংক-এ বন্ধক দিয়ে অনেক টাকা লোন নিয়ে ব্যাবসায় পুঁজি বাড়ালাম। পেজার তখন মুড়ি-মুড়কির মতো বিক্রি হতো। প্রচুর টাকার মাল, সস্তায় তুললাম। হঠাৎ বাজারে এল মোবাইল। ধীরে ধীরে তার দাম, কলচার্জ সব কমতে লাগল। মানুষ পেজার ছেড়ে মোবাইলের দিকে ঝুঁকে পড়ল। এসটিডি, ফ্যাক্স সব ধীরে ধীরে বন্ধ হতে শুরু করল। যাদের পুঁজি অনেক বেশি, তারা লাইন চেঞ্জ করতে পারল।

প্রচুর ছোটো ব্যবসায়ী নিঃশব্দে নিঃস্ব হয়ে গেল। আমার বাড়ি দোকান সব চলে গেল। সংসারে শুরু হল চরম অশান্তি। স্ত্রী একদিন মেয়েকে নিয়ে বিষ খেল। সব শেষ। ছমাসের মধ্যে আমার সুন্দর পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল। ওখানে আর লজ্জায় থাকা সম্ভব নয়। অল্প

যে-টাকাপয়সা ছিল, সঙ্গে নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। এক স্টেশন থেকে আর এক স্টেশনে।

মাস ছয়েক হল এই দমদম স্টেশনে এসেছি। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে বেঁচে থাকার শক্তি ক্রমশ হারিয়ে ফেলছিলাম। একদিন মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, সব যখন শেষ হয়ে গেছে,আর এভাবে জীবনকে টেনে লাভ নেই। সেই সময় ঈশ্বর বাঁচার রসদ জুগিয়ে দিলেন। ওই বাচ্চা মেয়েরা। কে যেন ফেলে দিয়ে চলে গেছে। সেই থেকে ওকে নিয়ে আছি।

দু-তিনটে দোকানে ফাইফরমাস খাটি। ভালোই আছি। রান্না করি, দুজনে খাই। তবে এবার ওই সামনের বস্তিতে একটা ঘরভাড়া নেব।

অম্বরীশ মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখে নিয়েছে। এবার যেন জীবনকে দূর থেকে দেখতে পাচ্ছে। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হল।

বিশ বছর কেটে গেছে। যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে কিছুদিন পর চাকরি নিয়েছিল অম্বরীশ। বাবা-মার অনুরোধে সংসারও পাতল। স্ত্রী অতসী। ভারী ভালো মেয়ে প্রেমিকার গুণ কম থাকলে, স্ত্রীগুণ বেশি থাকে মেয়েদের। সেটাই সংসার গড়তে বেশি কাজের। আর ছেলেদের কথা আমি লিখতে পারব না, কারণ কোনও ক্ষেত্রেই আমি সফল নয়। যে-সব পুরুষের কাছে সেই শংসাপত্র আছে, অন্তত পরিপূর্ণ প্রেমিক বা সফল স্বামী যে-কোনও একটা বা দুটোই তকমা আছে তারা বলতে পারবে। ওদের দুটো

ছেলে-মেয়ে আছে। বজ্র, আর বৃষ্টি। ছেলে বড়ো, মেয়ে ছোটো। এখন অম্বরীশ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। দক্ষিণ কলকাতায় থাকে।

ওদিকে মালবিকার বিয়ে হয়েছিল মযূখের সাথে। মযূখ ব্যাংক-এ চাকরি করে। যাদবপুরে নিজেদের বাড়ি। ওদের একটাই ছেলে। মৈনাক, ডাক্তারি পড়ে। মালবিকা বরাবরই নাচে গানে পারদর্শী। ছেলেকে তবলা শিখিয়েছে। ভালোই বাজায়।

ঘটনাটা ঘটল একদিন প্যান্ট কাচতে গিয়ে মালবিকার বরাবরের অভ্যাস সব পকেট হাতড়ে তারপর ওয়াশিংমেশিনে দেওয়া। মৈনাকের প্যান্টে মানিব্যাগটা থেকে গেছে। ব্যাগের ভেতরের খাপে একটি মেয়ে ফটো। মুখটা মালবিকার খুব চেনা। কিন্তু কোথায় দেখেছে, মনে করতে পারছে না।

মেয়ে বন্ধু এখন সব ছেলেরই অনেক থাকে। সবই এখন কো-এডু স্কুল। সেই আগের পাঁচিল এখন ভেঙে গেছে। আগে যেমন আইবুড়ো ছেলেমেয়ে কথা বললেই, বড়োরা ভাবত প্রেম করছে। আর এখন প্রেম করলেও কথা বলে না। সবটাই তরঙ্গবাহিত। ডিজিটাল প্রেম। তবে প্রেম করলে, সাজ বাড়বে, আর গলায় সুর না থাকলেও একটু গুন গুন করবেই। মালবিকারও ছেলের হাবভাব কিছুদিন হল ভালো ঠেকছিল না।

মৈনাক বাথরুমে ঢোকার পর ওর মোবাইলটা দেখল মালবিকা। একটা মেসেজ রয়েছে একটা নাম্বার থেকে, প্রোফাইলে কোনও ছবি নেই। একটা গোলাপ ফুলের ফটো। লেখা রয়েছে বৃষ্টি ঠিক সময়ে আসবে, তুমি দেরি করবে না।

বাথরুম থেকে বেরাবোর পর মালবিকা সরাসরি মৈনাক-কে জিজ্ঞেস করল, মানিব্যাগের ভেতর ছবিটা কি বৃষ্টির? এসব ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার সেরা উপায় হল আক্রমণাত্মক হওয়া। স্বাভাবিক ভাবেই মৈনাক সেই রাস্তাই নিল। বলে উঠল, কে বৃষ্টি?

মালবিকা অনেক বুঝিয়ে বলল, এটা কোনও অপরাধ নয়। আসলে এখনকার অভিভাবকরা অনেক আধুনিক। সাহস পেয়ে মৈনাক স্বীকার করল। ওরা পরস্পরকে ভালোবাসে। পুরো নাম বৃষ্টি সেনগুপ্ত।

এক নিঃশ্বাসে মালবিকা প্রশ্ন করল, বাবার নাম?

অম্বরীশ সেনগুপ্ত।

মুহূর্তে, তদন্ত করতে গিয়ে নিজের মুখটাই অপরাধীর মতো হয়ে গেল মালবিকার। মুখে আচ্ছা বলে নিজেই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে নিল। চোখ দুটো কিন্তু অম্বরীশের মতো টানা আর উজ্জ্বল। তবে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে বৃষ্টির নাম্বারটা আগেই টুকে রেখেছে। মৈনাক বেরিয়ে যাবার পর, অনেক দোটানা কাটিয়ে মালবিকা বৃষ্টি-কে ফোন করল।

হ্যালো? আমি মৈনাকের মা বলছি।

হ্যাঁ আন্টি, বলো…।

মালবিকা ভাবল নতুন প্রজন্মের মেয়েরা কত চৌখস। জানা নেই, শোনা নেই, দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়া একটা মেয়ে প্রথমেই তুমি, আর কী আপন সম্মোধন!

তুমি মৈনাককে চেনো?

হ্যাঁ আন্টি, আমি তো ঢাকুরিয়া কলাকুঞ্জে নাচ শিখি। ওখানেই আলাপ।

মৈনাক কি তোমার বন্ধু?

হ্যাঁ, আমাদের নাচের ক্লাসে তবলা বাজায় তো।

জানি, তোমরা কি শুধুই বন্ধু?

হ্যাঁ আন্টি, মৈনাকদা খুব ভালো ছেলে।

মালবিকা মনে মনে ভাবল, অম্বরীশের মেয়েটা খুব পাকা হয়েছে তো! ওইটুকু মেয়ে দুমিনিটে ফোনেই মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে। মেয়েটিকে ভালো লাগছে মালবিকার। দেখতেও বেশ চটক আছে। মালবিকা ওর বাবার ফোন নাম্বারটা চাইল।

এবার একটু ভয় পেয়েছে বৃষ্টি! জিজ্ঞেশ করল, কেন আন্টি? না মানে; আমি কিন্তু কোন ইয়ে..

তোমার কোনও ভয় নেই। তোমার বাবা তোমায় একটা কথাও বলবে না। আমি কথা দিলাম।

বাবা বকবে না তো আন্টি?

না রে বাবা, তোর কোনও ভয় নেই। ফস্ করে মুখ থেকে তুই বেরিয়ে গেল মালবিকার। বৃষ্টি, ওর বাবার নাম্বার পাঠিয়ে দিল।

মালবিকা ভাবছে, এই মেয়ে তুলনায় ওর ছেলে তো ভীষণ বোকা। আসলে, ছেলেরা পুরুষ হয় বিয়ে পর। আর মেয়েরা বযঃসন্ধিতেই নারী হয়ে যায়। তবে মেয়েটি ভারি মিষ্টি। অম্বরীশকে কি ফোন করা উচিত হবে? মযূখ যদি জানতে পারে। মযূখ ওকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। পরক্ষণেই ভাবল, একজন অভিভাবক আর একজন অভিভাবকের সঙ্গে দেখা করবে, এতে বিশ্বাসভঙ্গের কোনও ব্যাপার নেই। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে অম্বরীশকে ফোনটা করেই ফেলল মালবিকা।

হ্যালো… হ্যালো… হ্যালো…? কথা বলতে পারছে না মালবিকা।

অম্বরীশ গম্ভীর গলায় আবৃত্তি করত। এখন গলা আরও গম্ভীর হয়ে গেছে। মালবিকার গলা কেঁপে গেল।

আ…মি মালু।

ওপারেও নীরবতা। তারপর ভীষণ আস্তে। কেমন আছো?

সুখের সংসারে যেমন সবাই ভালো থাকে। তোমার খবর বলো।

ভালোই। আমার নাম্বার পেলে কোত্থেকে?

বৃষ্টি দিয়েছে।

তুমি বৃষ্টিকে চেনো?

হ্যাঁ, কলাকুঞ্জে আমার ছেলে তবলা বাজায়।

একদিন দেখা করবে?

বলো… কোথায়?

শনিবার বিকেল চারটে, গড়িয়াহাট আনন্দমেলা।

আসার আগে ফোন করে নিও। আমি এখন অন্যের বউ, তোমার প্রেমিকা নয়। বলে হাসল।

ফোন রেখে মালবিকা ভাবতে লাগল, সে আবার দুর্বল হয়ে পড়বে না তো! পরক্ষণেই ভাবল, জীবনের মধ্যাহ্বে যে-উত্তাপকে সে চেপে রাখতে পেরেছে, এখন এই গোধূলি বেলায় রং ছড়াতে পারে বড়োজোর, রঙিন করতে পারবে না।

কেন জানি না! আজ একটু অন্যরকম সাজল মালবিকা। আবির রঙের ফিনফিনে সিফনের শাড়ি, সঙ্গে ফিরোজা ব্লাউজ। পিঠে একরাশ খোলা চুল। কয়েক গোছা অবাধ্য কপালের ওপর। চল্লিশ পেরিয়ে শাঁখের মতো বক্ষ। কলকে ফুলের মতো নাভি। মনকে যতই অভিভাবক বলে সান্ত্বনা দিক, পুরোনো ব্যথা সারে না। আজকে আয়নায় একটু বেশিই দেখছে নিজেকে। হয়তো আর একবার একটু দুর্বল করতে চাইছে অম্বরীশকে। এমনিই…।

ঠিক বিকেলবেলা গড়িয়াহাট মোড়ে গিয়ে দাঁড়াল। দূর থেকে দেখল, অম্বরীশ আসছে। বরাবরই গম্ভীর প্রকৃতির। গাম্ভীর‌্যটা আরও বেড়েছে। দুজনে চোখাচোখি হল। পুরোনো হিন্দি সিনেমায়, মেলায় বা নৌকাডুবিতে হারিয়ে যাওয়া যমজ ভাইকে খুঁজে পেলে যে-দৃষ্টি বিনিময় হতো, ঠিক সেই ভাবে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকল। দুজনে গিয়ে কফি ক্যাফে ডে-তে বসল। দু-একটা কথা বলার পরেই স্বাভাবিক নারীসুলভ প্রশ্নটাই করল মালবিকা, তোমার বউয়ের কথা বলো।

অম্বরীশ বলল, ভালো।

আমার থেকে সুন্দরী?

মোবাইলে অতসীর ছবিটা দেখাল, তারপর বলল, পাহাড়ও সুন্দর, আবার সমুদ্রও সুন্দর। এর তুলনা চলে না। এক জায়গায় ঢেউ বিশেষ মুহূর্তে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে, অপর জায়গায় অনন্তকাল ধরে তরঙ্গ গতিশীল।

বাব্বা! এখনও সেই গম্ভীর গলায় ভারী ভারী কথা।

যাকগে, তোমার কথা বলো।

মযূখ দারুণ মানুষ। ছেলেটাকেও ভালো মানুষ করেছি। ঠিকই আছে। আচ্ছা, আমাদের বিয়ে হলে কি আমরা বেশি সুখী হতাম?

প্রেমের শ্রেষ্ঠ পরিণতি বিরহ, বিবাহে তার মৃত্যু। সংসারে একটা সুখের অভ্যাস আছে, বিরহবেদনায় একটা বিলাস আছে। দৈনন্দিন জীবনের বিক্ষিপ্ত মনামোলিন্য, কখনও হতে পারে তিক্ত। কিন্তু সেটার অভাবে তুমি আরও বেশি রিক্ত।

তাহলে মশাই, আমদের ছেলে-মেয়েরা যে প্রেম করছে তার কী হবে?

মনে করো না একই হিমবাহ থেকে তৈরি দুটো ঝরনা। নদী হয়ে কিছুটা যাবার পর আবার সমুদ্রে মিশছে। ওদের-কে এখন ওদের মতো ভাসতে দাও।

মালবিকা অম্বরীশের হাতের ওপর হাত রাখল। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। গোধূলির আকাশে শরীর না মিললেও, দিগন্তে রক্তের সাথে রক্ত মিশে যাচ্ছে।

হাত্থি ঠাকুরের গল্প

আলের উপর দিয়ে হেঁটে পিচের রাস্তার দিকে যাচ্ছিল জিয়ন। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, মেঘ জমছে। যে-কোনও সময় বৃষ্টি নামতে পারে। সকালবেলায় খটঙ্গা গ্রাম থেকে ও যখন বেরিয়েছিল, তখন ঝকঝকে রোদ্দুর। সাইকেল চালিয়ে ওর খেত জমিতে আসার সময় দরদর করে ঘামছিল। জিয়ন তখন মনে মনে মারাংবুরুর কাছে প্রার্থনাও করেছিল, যেন দু’একদিনের মধ্যে বৃষ্টি নামে। অনেক কষ্টে সেচের জল এনে ধান রুয়েছে। সেই ধানগাছ এখন হাঁটুর সমান বেড়ে উঠেছে। জলের অভাবে যেন শুকিয়ে না যায়। কানালি জমি এমনিতে নীচু, ধানচাষ খুব শক্ত। কিন্তু, উপায় নেই। বাপ-ঠাকুদ্দার রেখে যাওয়া জমি জিয়ন শুখা ফেলে রাখবে কী করে?

পিয়াল গাছের নীচে সাইকেলটা রাখা আছে। বৃষ্টি নামার আগেই ওকে বাড়ি ফিরতে হবে। বছর দুয়েক আগে পুবের দেশে জনমজুরি খাটতে গিয়ে কিছু টাকা জমিয়েছিল জিয়ন। তখনই বর্ধমানে ঠিকাদারের এক সর্দারের কাছ থেকে ও পুরোনো সাইকেলটা কেনে। এখন খুব কাজে লাগছে। খেতের নজরদারির জন্য যখন-তখন ও চলে আসতে পারে। সাইকেল নিয়ে হুটহাট ঝালদা শহরে চলে যায়। চাষ দফতরের বাবুদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে। আজকাল সরকার থেকে বিনে পয়সায় বীজধান পাওয়া যায়। প্রয়োজনমতো রাসায়নিক সার ইউরিয়া আর কীটনাশকও। ঠিক সময়ে পাওয়ার জন্য পঞ্চায়েত আপিসে গিয়ে মুরুব্বিদের তোয়াজ করতে হয়। এ বারই যেমন, এখনও ইউরিয়া পাওয়া যায়নি। জিয়ন ভেবে রেখেছিল, বাড়ি ফিরে কিছু মুখে দিয়ে একবার ঝালদা শহরে যাবে। কবে ইউরিয়া পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার জন্য। কিন্তু, বৃষ্টি নামলে যে বাড়ি থেকে ওর আর বেরোতেই ইচ্ছে করবে না।

সাইকেল নিয়ে পিচের রাস্তায় উঠে আসার সময়ই জিয়ন দেখতে পেল, উলটো দিক থেকে সুবোধ খুটদার মোটর বাইকে করে আসছেন। মাঝবয়সি, পঞ্চায়েতের মেম্বার। থাকেন ওদের খটঙ্গাতেই। বদমাশ টাইপের লোক। মানুষটাকে দেখেই ওর ভ্রু কুঁচকে গেল। উনি এদিকে কোত্থেকে আসছেন? নিশ্চয় আনন্দপুর আশ্রমে গিয়েছিলেন। আবার কোনও অশান্তি ঘটাতে না কি? আশ্রমের সন্ন্যাসীদের সঙ্গে পঞ্চায়েতের সম্পর্ক খুব খারাপ। দোষটা খুটদার খুড়াদের মতো লোকেদেরই। সন্ন্যাসীরা গেরামের উন্নতির জন্য অনেক কিছু করতে চান। রাস্তা-ঘাট, স্কুল, টিউবওয়েল বসানো। কিন্তু খুটদার খুড়ারা ওঁদের কিছুতেই করতে দেবেন না। আশ্রমের জিপগাড়ি নাকি অনেকদিন আগে একবার চাপা দিয়েছিল একটা বাচ্চাকে। তারপর থেকে মুরুব্বিরা আশ্রমের উপর খাপ্পা।

খুড়াকে আসতে দেখে জিয়নের মনে হল, যাক, ঝালদায় যাওয়ার ঝামেলা তা হলে আর পোয়াতে হবে না। উনি নিশ্চয়ই খবর দিতে পারবেন ইউরিয়া সম্পর্কে। জিয়ন দ্রুত রাস্তায় উঠে এল যাতে খুটদার খুড়া ওকে দেখতে পান। বাইক কাছে এসে দাঁড়াতেই খুড়ার গলায় মোটা সোনার চেনটা ওর চোখে পড়ল। এই বছর তিনেক আগেও বাজারে খুড়ার টেলরিং শপ ছিল। পঞ্চায়েতে ঢোকার পর উনি অবস্থা ফিরিয়ে ফেলেছেন। ও কিছু বলার আগেই বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ করে খুটদার খুড়া বললেন, ‘তু কুত্থায় থাকিস রে জিয়ন? পরশু মিছিলে এলি না ক্যানে? মুর্মুদা তুর নামে কাইল যা তা কইছিলঅ পঞ্চায়েত আপিসে।’

মিছিলের কথা মনেই ছিল না জিয়নের। পার্টির লোকজন বাড়ি বয়ে এসে বলে গিয়েছিল বটে। দিল্লির সরকার টাকা পাঠাচ্ছে না। একশো দিনের কাজের প্রোগ্রাম আটকে গিয়েছে। গাঁয়ের লোকেদের কাজ দেওয়া যাচ্ছে না। তাই প্রতিবাদ মিছিল খটঙ্গা, মারামু, বেরাদি… আশপাশের গ্রাম থেকে বেরিয়ে ঝালদার দিকে যাবে। ওই মিছিলে যাওয়াটা কত জরুরি, অনেকক্ষণ ধরে তা বুঝিয়েছিলেন স্কুলের মাস্টার দশরথ মুর্মু। বলেছিলেন, বেলা দশটার সময় স্কুলের মাঠে হাজির হতে। কিন্তু আগের রাতে বুধিরামের বাড়িতে পরব ছিল। একটু বেশি হাঁড়িয়া খাওয়া হয়ে গিয়েছিল জিয়নের। ঘুম থেকে উঠতেই সেদিন বেলা এগারোটা। সত্যি কথা বলতে কী, মিছিলের কথা মনে থাকলেও ও যেত কি না সন্দেহ। পঞ্চায়েতের সব শালা হারামখোর।

কথাটা বললে সুবোধ খুটদার চটে উঠতে পারেন। তাই ও বলল, ‘শরীলটা জুত ছিল না খুড়া।’

‘ই কথা কইলে চইলবে?’ খুটদার খুড়া বললেন, ‘মিটিন ত তুদের জন্যেই। তুরা যাতে কাজকম্ম পাস, তার জন্যঅ। তুদের মতো জুয়ান মরদরা যদি লা আসিস, মোদের খেইটে লাভ কী?’

খুড়ার গলায় বিরক্তির ঝাঁঝ। শুনে মুখ নীচু করে রইল জিয়ন। মুর্মু খুড়া ওর নামে কী বলেছেন, সেটা শোনার খুব কৌতূহল হল ওর। কিন্তু সে কথা সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায় না। মুর্মু খুড়া ইদানীং স্কুলে পড়ানোর থেকে অনেক বেশি সময় দেন পার্টির কাজে। আর সুযোগ পেলেই ওকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করেন। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে খুটদার খুড়া জিজ্ঞেস করলেন, ‘তু লা কি আইজগাল রুজ সন্তোষ হাঁসদার ঘরকে যাচ্ছিস? মুর্মুদা কইছেল। ই তো ভালো কতা লয় বাপ।’

প্রশ্নটা করেই খর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন সুবোধ খুটদার। যেন জরিপ করে নিচ্ছেন। কথাটা অবশ্য মিথ্যে নয়। ইদানীং মাঝে মাঝেই ওকে সন্তোষ খুড়ার বাড়িতে যেতে হচ্ছে। খুড়া এখন ঘরছাড়া। পার্টিগত বিবাদ। উনি আশ্রয় নিয়েছেন বলরামপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সন্তোষ খুড়ার মেয়ে রাইমণি বাড়িতে এখন একা। মিত্তিরবাবুদের বাড়িতে কাজ করে। সেইসঙ্গে শুয়ারের খোঁয়াড় করেছে। সেই কাজে সাহায্য করার জন্যই কখনও সখনও রাইমণি ওকে ডেকে নিয়ে যায়। এই লোকগুলো কি তাহলে রাইমণির পিছনেও লেগেছে! গেরাম থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করছে না কি? যদি তা করে, তা হলে কিন্তু ও ছেড়ে দেবে না। রাইমণিকে ও প্রথম দেখে চাকলাদাঁড়ি পরবের সময়। অন্য মেয়াদের সঙ্গে ঝিকা নাচছিল। সেদিনই জিয়ন ঠিক করে ফেলেছিল, বিহা যদি করে, তো এই মেয়াকেই করবে। খুড়ার প্রশ্ন করার ধরনটা জিয়নের ভালো লাগল না। ও কার বাড়িতে যাবে, সেটা পঞ্চায়েতের লোকেরা ঠিক করে দেবে না কি?

কৈফিয়ত চাওয়ার ভঙ্গিতে খুটদার খুড়া ফের জিজ্ঞেস করলেন, ‘বইল না ক্যানে?’

আকাশে মেঘ গুড়গুর করে উঠল। জিয়নের বুকের ভিতরে রাগটাও। মুখ কঠিন করে ও তাকাল। ওর মুখ দেখে খুটদার খুড়া কী বুঝলেন, কে জানে? আকাশের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে, বাইকের ইঞ্জিন চালু করে, খানিকটা বোঝানোর ভঙ্গিতেই খুড়া বললেন, ‘সন্তোষের মেয়াছেনাটা ভালো লয় রে বাপ। রাইত-বিরেতে ল্যাংটা হইয়ে ঘুইরে বেরায়। জানগুরু বলছে, উ মেয়া ডাইন। উয়ার সঙ্গে তু পীড়িত কইরিস না।’

শুনে চমকে উঠল জিয়ন। সাঁওতাল সমাজে যে মেয়ার নামে ডাইন অপবাদ জোটে, তার কপালে অশেষ দুর্ভোগ অনিবার্য। ও জানে, রাইমণি কত দুঃখী মেয়া। কী দুর্দশার মধ্যে ও জীবন কাটাচ্ছে। একটার বেশি দুটো কাপড় ওর নেই। রাতে সেই কাপড় শুকোতে দিলে ওকে ল্যাংটা হয়েই থাকতে হয়। খুড়া শুধুশুধু বদনাম দিচ্ছেন। জিয়ন তা মানবে কেন? পালটা কিছু বলতে না চাইলেও ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘ই তু কী কইছিস খুড়া? রাইমণি সে র’ম মেয়া লয়। তুর কথা মাইনতে পারলাম লাই।’

‘অ… না মাইনতে চাস, মানিস লাই।’ ভ্রু কুঁচকে খুড়া বললেন, ‘তুরে কিন্তুক সাবধান কইরে দিলাম। পরে মোকে দুষ দিবি নাই।’

হিমশীতল গলায় কথাটা বলেই খুটদার খুড়া আর অপেক্ষা করলেন না। ধুলো উড়িয়ে বাইক ছুটিয়ে দিলেন গেরামের দিকে। খুড়াকে আসল কথাটাই জিজ্ঞেস করা হল না। ইউরিয়া কবে পাওয়া যাবে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে জিয়ন সাইকেলে উঠে বসল। মনে মনে বলল, ‘রাইমণির কুনও ক্ষেতি হলে তুদের ছাইড়বক না খুড়া।’ কথাটা বলেই ও একবার আকাশের দিকে তাকাল। ঘরে পৌঁছোতে ওর মিনিট দশেক লেগে যাবে। এর মধ্যে জোরে বৃষ্টি নেমে গেলে কোথাও গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই। কাঁচা রাস্তায় এত পাঁক হবে, নিশ্চিন্তে সাইকেল চালানো যাবে না। গেরামের ভিতর রাস্তা মেরামতির দিকে খুড়াদের কারও নজর নেই।

কাঁচা রাস্তার একপাশে জঙ্গল। ছোটোবেলায় মায়ের সঙ্গে জিয়ন এই জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে আসত। তখন আশেপাশে প্রচুর শাল, সেগুন, মহুয়া, পিয়াল, কুসুম, কেঁদ, আমলকী গাছ ছিল। মহুয়া ফুলের গন্ধে ম ম করত পুরো অঞ্চল। কিন্তু ঝাড়খণ্ডের কাঠ মাফিয়ারা রাতের অন্ধকারে এসে শাল, সেগুন গাছ কেটে নিয়ে গেছে। সবাই জানে, কারা তাদের মদত দিয়েছিল। রাস্তার এইদিকটা এখন আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস আর রাধাচূড়া গাছে ভর্তি। বাপের কাছে জিয়ন শুনেছে, রাস্তায় কোনও গাছই হয়তো আর অবশিষ্ট থাকত না, আনন্দপুর আশ্রমের সন্ন্যাসীরা যদি না এসে এইসব গাছ তখন লাগিয়ে দিতেন। বাপ প্রায়ই ওই আশ্রমে গিয়ে পড়ে থাকত। ফাইফরমাশ খেটে রোজ দশ-বিশ টাকা রোজগার করে আনত। বাপের সুবাদে সন্ন্যাসীদের অনেকেই জিয়নকে চেনেন। রাস্তা-ঘাটে কোথাও দেখা হলে তাঁরা দু’দণ্ড কথা বলেন।

সাইকেল চালানোর ফাঁকেই জিয়ন পিছন থেকে গাড়ি আসার শব্দ শুনল। পিছন দিকে তাকিয়ে ও দেখল, আনন্দপুর আশ্রমের দিক থেকে একটা জিপগাড়ি আসছে। গাড়িটাকে জায়গা দেওয়ার জন্য ও দাঁড়িয়ে পড়ল। ওকে দেখে জিপগাড়িটাও দাঁড়িয়ে গেল। গেরুয়া রঙের পোশাক পরা দু’জন সন্ন্যাসী জিপে বসে আছেন। তাঁদের একজনকে জিয়ন চিনতে পারল। দয়ানন্দ মহারাজ। সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত জোড় করে ও প্রণাম জানাল। আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে মহারাজ ওকে বললেন, ‘তুমি ঠাকুরদাস টুডুর ছেলে… জিয়ন না?’

শুনে ঘাড় নাড়ল জিয়ন। দয়ানন্দ মহারাজ বললেন, ‘একটা খারাপ খবর আছে জিয়ন। রাঁচির জঙ্গল থেকে একটা হাতির দল এসে বেলামু পাহাড়ের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করছে। দু’একদিনের মধ্যেই দলটা গাঁয়ের মধ্যে ঢুকে পড়বে। সব্বাইকে সাবধান করে দিও।’

শুনে উত্তেজনায় সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াল জিয়ন। এ বারও গণেশ ঠাকুরের দল খেতের ফসল নষ্ট করে দেবে? গত বছর গেরামের কয়েকটা বাড়ি ভেঙে দিয়েছিল। ওদের আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে মারা গিয়েছিল দুর্যোধন হাঁসদা বলে ওরই বয়সি একজন। সেই গণেশ ঠাকুর শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে তুলে দুর্যোধনকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। তাতেও সন্তুষ্ট হয়নি। পরে পায়ে পিষে ওকে মেরে ফেলে। রাতের অন্ধকারে এমন সময় হাত্থির দল এসে হাজির হয়, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকজনকে পর্যন্ত খবর দেওয়া যায় না। আশ্রমের সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে এবার অন্তত একটা আগাম খবর পাওয়া গেল। দয়ানন্দ মহারাজ সাবধান করে দেওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু গেরামের মানুষের করার কী আছে? গণেশ ঠাকুরের প্রতি লোকের এত ভক্তি, ওদের পালটা আঘাত করার কথা কেউ ভাবতেও পারে না।

ও জিজ্ঞেস করল, ‘গণেশ ঠাকুরদেরকে বেলামুতেই আটকে দ্যান না ক্যানে মহারাজ?’

‘মনে হয়, সম্ভব না। আশ্রমের পাঁচিল ভেঙে ওরা ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি। আমরা শূন্যে ফায়ার করে ওদের ভয় দেখিয়েছি বলে। দলটা বেশ বড়ো। দশ-বারোজনের মতো। আমরা এও খবর পেয়েছি, ওদের মধ্যে একটা খুনিয়া হাতি আছে। দাঁতাল, সে-ই লিডার।’

খুনিয়া হাত্থি মানে যে হাত্থি ইতিমধ্যেই মানুষ খুন করেছে। গত বছরও এই রকম একটা হাত্থি এসেছিল দলের সঙ্গে। এবার কার কপালে মৃত্যু লেখা আছে, কে জানে? জিয়ন শূন্যচোখে তাকিয়ে রইল। হাত্থির দল এত ক্ষতি করে যাচ্ছে, তবুও ওদের শিক্ষা দেওয়ার কথা কেউ ভাবে না! গেরামের দু’চারজনের সঙ্গে জিয়ন কথা বলেছিল। ‘পাগলা হইয়েনছিস তু’ বলে তারা সরে গিয়েছিল। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে দয়ানন্দ মহারাজ বললেন, ‘তোমাদের সুবোধ খুটদার একটু আগে আশ্রমে এসেছিলেন। তাঁকে সব জানিয়েছি। আমরা এখন ঝালদার দিকে যাচ্ছি। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের আপিসে খবর দিতে। তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো, গাঁয়ের লোকদের জানাও।’

দয়ানন্দ মহারাজ চলে যাওয়ার পর জিয়ন নিজেকেই প্রশ্ন করল, ‘কী করা যায়, বল ক্যানে?’

গণেশ ঠাকুরদের অত্যাচার কী করে বন্ধ করা যায়, সে কথা গত তিন বছর ধরে জিয়ন ভাবছে। এই একটি ভাবনাই ওকে এখন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কীভাবে ওদের শায়েস্তা করা যায়? পরপর তিন বছর ওরা খেতের ফসল নষ্ট করে দিয়েছে। ওর জীবনের চূড়ান্ত সর্বনাশ করে দিয়েছে, এই হাত্থির একটা দল। সেই কথা যখনই জিয়ন ভাবে, অসহ্য রাগে ওর পেশিগুলো ফুলে ওঠে। বদলা নেওয়ার ইচ্ছেয় হাত নিসপিস করে। কিন্তু ঠাকুর-দ্যাবতার বিরুদ্ধে ও লড়বে কী করে? ওদের সাঁওতাল সমাজে হাত্থি যে ঠাকুর। গেরামের সবাই তাদের পুজো করে। অক্ষমতা ওর ক্রোধ আরও বাড়িয়ে দেয়। তখন কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। মারাত্মক এক বিষণ্ণতা ওকে গ্রাস করে। তখনই বাড়ির উঠোনে ও ধামসা মাদল বাজাতে শুরু করে। যতক্ষণ না ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ে, ততক্ষণ মাদল বাজিয়েই যায়।

গেরামে ঢোকার মুখে বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটা পড়তে শুরু করল। পরনের টি শার্ট আর পাজামা যাতে ভিজে না যায়, সেজন্য নকুল মণ্ডলের দোকানে চালার নীচে এসে দাঁড়াল জিয়ন। বাড়িতে ফিরে পোশাক বদলে ও লুঙ্গি পরে নেবে। খটঙ্গার স্কুলে ও আর নকুল একসঙ্গে আট ক্লাস অবধি পড়েছিল। ছোটোবেলার বন্ধু। স্কুল ছেড়ে দেওয়ার পর বাপের মুদিখানা দোকানে বসে যায় নকুল। আর জিয়ন চাষের কাজে হাত লাগিয়েছিল বাপের সঙ্গে। নকুলের দোকানটা বাজারের ঠিক পাশে। বুদ্ধি করে ও একটা চায়ের ঠেক বানিয়েছে। পুরুলিয়া শহর থেকে একটা সাদা-কালো টিভি সেট কিনে এনে লাগিয়েছে লাগোয়া দোকানে। চা খাওয়ার ফাঁকে অনেকেই বসে খবর শোনে। এই মুহূর্তে অবশ্য দোকানে কোনও খদ্দের নেই। অন্য সময় নকুল কথা বলার সময় পায় না। আজ জিয়নকে দেখে একটা টুল এগিয়ে দিয়ে ও বলল, ‘বোস না ক্যানে।’

গেরামে এই একটি লোকের সঙ্গেই জিয়ন মন খুলে কথা বলে। মাঝেমধ্যে এলে নকুলের কাছে গেরামের অনেক খবর পায়। রাইমণিকে ডাইন অপবাদ কারা দিল, কেন দিল, কথায় কথায় ও জিজ্ঞেস করবে, ভেবে নিয়ে টুলে বসে পড়ল জিয়ন। বেশ জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। স্কুলের মাঠটা ঝাপসা দেখাচ্ছে। লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছগুলো মাথা নাড়াচ্ছে বাতাসের দমকে। দৃষ্টি সরিয়ে এনে জিয়ন দেখল, দ্রুত হাতে চা বানাচ্ছে নকুল। দোকানে এলে এইটুকু আতিথ্য ও পায়। একটু পরেই চা ঢেলে মাটির ভাঁড় ওর দিকে এগিয়ে দিল নকুল। কাচের বয়াম খুলে বেকারির বিস্কুট বাড়িয়ে দিল। গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে দু’জনে কথা বলতে লাগল। চা খাওয়ার অভ্যাস আগে জিয়নের ছিল না। ভিন দেশে জনমজুরির কাজ করতে গিয়ে অভ্যাসটা করে ফেলেছে। কানালি জমিতে একবারের বেশি চাষ করা যায় না। খেতির কাজকর্ম যখন থাকে না, তখনই ও বেরিয়ে পড়ে। বছরে পাঁচ-ছ’মাস গেরামেই থাকে না।

বাজারের হালচাল, পঞ্চায়েতের পক্ষপাতিত্ব, গেরামের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে লাগল নকুল। একটা সময় সন্তোষ খুড়া হয়ে ওদের আলোচনা চলে এল রাইমণিতে। খুটদার খুড়া হুমকি দিয়েছেন শুনে নকুল বলল, ‘উকে লষ্ট কইরে দিবেক শালা হড়ডপটরা। তুকে এগটা কথা কইব ভাবছিলাম জিয়ন। তু ত উকে ভালোবাসিস। রাইমণিকে তু বিহা কইরে ফ্যাল না ক্যানে?’

রাইমণিকে ঘরে আনার ইচ্ছেটা জিয়নের মাঝেমধ্যেই জাগে, যখন ও ভিন দেশে কাম করতে যায়। সেখানে মরদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জনমজুর খাটে মেয়ারা। প্রবাসে তাদের সুখী দাম্পত্য জীবন দেখে, প্রতিবারই জিয়ন ভাবে, গেরামে ফিরে রাইমণির সঙ্গে বিহাটা সেরে ফেলবে। দু’জনে মিলে পাকাপাকিভাবে রাঁচি অথবা হাজারিবাগ চলে যাবে। খটঙ্গার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্কই রাখবে না। কিন্তু গেরামে ফেরার পরই ওর আক্রোশ ফের চাগাড় দিয়ে ওঠে। বদলা নেওয়ার আগুন জ্বলতে থাকে ওর বুকে। প্রতি রাতেই নির্জন ঘরে শুয়ে থাকার সময় সেই দুঃস্বপ্নের দৃশ্যগুলো ওর চোখের সামনে ভাসে। সেকথা মনে করে জিয়ন বলল, ‘তু কইলি, আর আমি ঝপ কইরে বিহা কইরে লুব! অ্যাখুন আমি বিহা কইরতে পারবক লাই ভাই। মোর এগটা কাম বাকি আছে। তু ত জানিস।’

‘হাত্থিদের ফাইন্দে ফ্যালার কাম বুঝি?’ নকুল বলল, ‘পাগলার মতন কথা বলিস না ভাই। গেরামের মানুষ তুর নামে কী কয়, তু জানিস? তুর মাতথায় ব্যামো হইনছে।’

‘বলুক গা। তাতে কিছু আইসে যায় না।’

‘শুন ভাই, অতীতে কী হইনছে, মুনের মধ্যে চেইপে রাখিস না। ভুইলে যা। হাত্থি ঠাকুরের সঙ্গে তুই লড়বি কী কইরে? উয়াদের সঙ্গে লড়া অততো সহজ কথা লয়। উয়াদের কাছে মানুষ ত লিইলিপুট। তু একা কী কইরবি, বল? হাত্থি ঠাকুরকে মেইরে ফেলবি? উ চেষ্টা করিস লা ভাই। কইরলে ফরেস্টবাবুরা তুকে ধরে লিয়ে যাবেক।’

নকুল আরও কী বলতে যাচ্ছিল, দু’তিনজন খদ্দের এসে যাওয়ায় চুপ করে গেল। বৃষ্টির তোড় কমে এসেছে। আনন্দপুর আশ্রমের দিকটা এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। গেরাম আর আশ্রমের মাঝে প্রায় এক কিলোমিটার পাথুরে রুক্ষ জমি। অনেক ঘুরে ঘুরে, পায়ে হেঁটে আশ্রমে যেতে হয়। আশ্রমটা কীসের, সে সম্পর্কে জিয়নের কোনও ধারণা নেই। তবে ভিতরটা বিশাল, বলতে গেলে ছোটোখাটো একটা শহরের মতো। কী নেই তাতে? স্কুল, ব্যাংক, হাসপাতাল, পোস্ট অফিস, বাজার… সব আছে। বাপের মুখে জিয়ন শুনেছে, ওখানে যারা থাকে, তারা বেশিরভাগই বিদেশি। ওখানে যাকে তাকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। বিনা অনুমতিতে পুলিশও ওখানে ঢুকতে পারে না। বাপের সঙ্গে অবশ্য বেশ কয়েকবার জিয়ন আশ্রমের ভিতরে গিয়েছে। সে এক আশ্চর্য জগৎ।

‘শুইনেছিস, গণেশ ঠাকুরের দল লা কি আবার গেরামের দিকে আইসছে।’

নকুলের কথা শুনে জিয়ন এদিকে মুখ ফেরাল। খবরটা খদ্দেরদের মধ্যেই কেউ নিশ্চয় ওকে দিয়ে গেল।

জিয়ন ঘাড় নেড়ে বলল, ‘শুইনেছি। আজকাইলের মধ্যেই গেরামে ঢুইকবেক।’

‘গেরামের মানুষ রাইত জেইগে খেত সামাল দিবে বইলে তৈরি হইনছে। খুটদার খুড়া মিটিন ডেইকেছেন। তু একবার যা না ক্যানে পঞ্চায়েতে।’

কোনও উত্তর না দিয়ে জিয়ন মুখ গোঁজ করে বসে রইল। পঞ্চায়েতের অফিসে গিয়ে কী আর হবে? না, না, কিছুতেই ও খুটদার খুড়াদের কাছে যাবে না। বেলামু পাহাড়ের দিক থেকে হাত্থির দল যখন এ দিকে আসবে, তখন প্রথমেই পড়বে ওর খেত। হাত্থিদের দাপাদাপিতে ধানগাছের কী অবস্থা হবে, ভাবতেই রাগ হতে লাগল জিয়নের। গত দু’মাসের পরিশ্রম বৃথা যাবে। রাতে ক্যানেস্তারা পিটিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে, হই হট্টগোল করে হয়তো হাত্থি তাড়ানোর চেষ্টা করা হবে। পাহারাদারদের লক্ষ্য থাকবে, নিজের খেত বাঁচিয়ে অন্যের খেতের দিকে হাত্থির পালকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাতে কোনও লাভ হবে না।

গণেশ ঠাকুরের দল আগে দলমা থেকে বেরিয়ে অযোধ্যা পাহাড় হয়ে নেমে আসত। কিন্তু, তিন বছর আগে সেই প্রথম রাঁচির দিক থেকে আচমকাই একটা দল বেলামু পাহাড়ের পাশ দিয়ে ঢুকে পড়েছিল ওদের গেরামে। মানুষজন সচেতন হওয়ার আগেই গেরামে কান্নার রোল উঠেছিল। গভীর রাতে পোষা কুকুরের ডাকে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল জিয়নের। ভয়ার্ত সেই ডাক। বিছানা ছেড়ে দাওয়ায় এসে দাঁড়াতেই মূর্তিমান বিভীষিকা চোখে পড়েছিল ওর। একটা দাঁতাল হাত্থি উঠোনে দাঁড়িয়ে। প্রবল বেগে মাথা নাড়াচ্ছে। মুলো বাঁশের মতো তার দুটো দাঁত। বিরাট কান দুটো ফটরফটর করছে। কুকুরের ডাক শুনে বিরক্ত। প্রায় জমি ছোঁয়া ওর লম্বা শুঁড় থেকে ভোঁস ভোঁস শব্দ ভেসে আসছে। হাত্থিটা এক পা বাড়িয়ে লক্ষ্য স্থির করায় ব্যস্ত। শুঁড়ে পেঁচিয়ে কুকুরটাকে শূন্যে তুলে নেবে।

মাটির বাড়ির ভিতরের ঘরে বাপ-মা আর বোন শুয়ে আছে। তাদের ঘুম ভেঙে গিয়েছে কি না, জিয়ন বুঝতে পারেনি। ওর কাছে এমন সময়ও ছিল না, ভিতরে ঢুকে সবাইকে ডেকে তোলে। বাড়ির উঠোনে প্রকাণ্ড জীবটাকে আগে কখনও দেখেনি। কুকুরের আস্ফালন তাই আরও বেড়ে গিয়েছিল। কাছাকাছি কোথাও একটা গাছ ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পেয়েছিল জিয়ন। তার মানে আশেপাশে আরও সঙ্গী নিয়েই দাঁতালটা ঢুকেছে। শুক্লপক্ষের রাত। হালকা জ্যোৎস্নায় কী চোখে পড়েছিল কে জানে? কুকুরটা হঠাৎই রণে ভঙ্গ দিয়েছিল। ভয় পেয়ে পিছু হটে, ঘরের ভিতর ঢুকে আশ্রয় নিয়েছিল চৌকির নীচে। সেখান থেকেই কুঁইকুঁই আওয়াজ করছিল। ওকে তাড়া করে, এর পর ঘরে ঢোকার চেষ্টায় হাত্থিটা যখন মাটির দেয়ালে ঢুঁসো মারে, তখনই প্রাণভয়ে দাওয়া থেকে লাফিয়ে নেমে জিয়ন খিড়কির দিকে ছুটে গিয়েছিল। পরক্ষণেই ও টালির চাল হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে দেখে। খিড়কি থেকেই ও বাপ-মায়ের আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিল। সেইসঙ্গে উন্মত্ত হাত্থির হুঙ্কার।

শেষ রাতে গণেশ ঠাকুরের দলটাকে পিচের রাস্তা ধরে চলে যেতে দেখেও জিয়ন জঙ্গল থেকে বেরোনোর সাহস পায়নি। আতঙ্কে থরথর করে কেঁপেছিল পিয়াল গাছের আড়ালে। আলো ফোটার পর ফিরে এসে দেখে বাড়ির কোনও চিহ্নই নেই। কুকুরকে খুঁজে পাওয়ার তাগিদে ভগ্নস্তুপের উপর দাপাদাপি করে গিয়েছে হাত্থির দল। মাটির কলসিতে রাখা হাঁড়িয়াও খেয়ে গিয়েছে। গেরামের লোক চৌকির নীচ থেকে টেনে বের করেছিল থেঁতলে যাওয়া তিনটে দেহ। ওর বাপ, মা আর বোনকে। কুকুরটার কোনও হদিশই পাওয়া যায়নি। মনে আছে, জিয়নের সব মনে আছে। উঠোনে তিনটে মৃতদেহ পড়েছিল অনেক বেলা পর্যন্ত। পঞ্চায়েতের লোকজন বলেছিল, ফরেস্টবাবুরা না আসা পর্যন্ত সৎকার করা যাবে না। হাত্থির তাণ্ডবে কেউ মারা গেলে না কি ফরেস্টবাবুদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। সারাটা দুপুর জিয়ন শোকস্তব্ধ হয়ে বসে ছিল। এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলেনি। ওর বুকে তখন আগুন জ্বলছিল ধিকধিক করে। ফরেস্টবাবুরা বিকেলের দিকে এসে রিপোর্ট নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। না, পরে কোনও ক্ষতিপূরণ জিয়নের কপালে জোটেনি। বাবুরা বলেছিলেন, নিছক দুর্ঘটনা। টালির চালা ভেঙে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের।

নকুলের দোকানে চালার নীচে বসে অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে জিয়নের ফের একবার কৈলাস স্যারের কথা মনে পড়ল। স্কুলের বাংলা টিচার ছিলেন কৈলাস স্যার। ক্লাসে পড়ানোর সময় স্যার একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আচ্ছা বল তো, সবথেকে বুদ্ধিমান প্রাণী কে?’ ওরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছিল। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর স্যার নিজে থেকেই বলেন, ‘পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে, তার মধ্যে সব চাইতে বুদ্ধিমান হল মানুষ। বুদ্ধিতে মানুষের সঙ্গে অন্যরা পেরে উঠবে না।’ গত তিন বছরে জিয়ন অনেকবারই ভেবেছে, স্যারের কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে এই গুন্ডা হাত্থিগুলোকে শিক্ষা দেওয়ার মতো বুদ্ধি কেন মানুষ দেখাতে পারছে না? এমন উপায় কেন খুঁজে পাচ্ছে না, যাতে ওরা আর না আসে? তা হলে কি হাত্থিদের বুদ্ধি আরও বেশি? না হলে কয়েকশো মাইল দূর থেকে রাস্তা চিনে প্রতিবছর ফসলের সময়ই ওরা আসে কী করে।

‘জল থেইমে গেনছে। ঘরকে যাবিক নাই?’

নকুলের প্রশ্নে সম্বিত ফিরল জিয়নের। সামনের দিকে তাকিয়ে ও দেখতে পেল বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। টুল ছেড়ে উঠে ও সাইকেলের কাছে নেমে এল। মনের মধ্যে যে-প্রশ্নটা এতক্ষণ পাক খাচ্ছিল, হঠাৎ সেটাই ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘তু বুল ত ভাই নকুল। হাত্থিদের বুদ্ধি কি মানুষের থেইকে বেশি?’

প্রশ্নটা শুনে নকুল হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল।

চাদর মুড়ি দিয়ে দাওয়ায় শুয়ে ছিল জিয়ন। অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে। তবুও, শুয়ে নিজের দুর্দশার কথা ভাবছিল। হঠাৎ রাইমণির গলা শুনতে পেল, ‘শুইয়ে আনছিস ক্যানে? শরীলডা খারাপ?’

দাওয়ায় উঠে এসে মাথার কাছে বসল রাইমণি। কপালে হাত দিয়ে পরীক্ষা করল গা গরম কি না? চোখ মেলে ওর সোন্দর মুখটা দেখে জিয়নের মন ভালো হয়ে গেল। রাইমণির হাতটা ধরে ও নিজের গালে ছোঁয়াল। গত তিন-চারটে দিন ওর অসহ্য মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে কেটেছে। হাত্থি ঠাকুরের দল ফের লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গিয়েছে ওর খেত। বুধিরাম এসে যখন খবরটা দেয়, তখন খেতে দৌড়ে যাওয়ার ইচ্ছেটুকুও জিয়নের হয়নি। নিজেকে বাড়ির মধ্যেই ও আটকে রেখেছিল। পরে শুনেছে, ঝালদার দিকে যাওয়ার সময় হাত্থির দল গেরামের অনেক ক্ষতি করে দিয়েছে। গাছপালা উপড়েছে। শুধু মাটির বাড়িই নয়, বুধিরামদের পাকা গাঁথনির দেওয়ালও ওদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এই প্রথম বুধিরাম বলে গিয়েছে, এবার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। কদ্দিন আর সহ্য করা হবে হাত্থি ঠাকুরের অত্যাচার?

মাঝে রাইমণি একদিন এসেছিল। ওকে স্ত্বান্না দিয়ে গিয়েছে। জানতে চেয়েছিল, এ বার ও কী করবে? তখনও জিয়ন কিছু ঠিক করেনি। গেরামে পড়ে থাকার কোনও মানে নেই। কিন্তু, যাবেই বা কোথায়? বর্ষার সময় ইমারতির কাজ বন্ধ থাকে। বাইরে জনমজুরির কাজ পাওয়াও শক্ত। একমাত্র বর্ধমানের দিকে গেলে হয়তো কাজ পাওয়া যেতে পারে। ওখানে বড়ো বড়ো বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। জিয়ন মাঝেমধ্যেই ভাবছে, রাইমণিকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। ওখানে গিয়ে নতুন সংসার পাতবে। কথাটা ভাবা মাত্র, এই বিপর্যয়ের মধ্যেও, একটা সুখের কম্পন ও শরীরে অনুভব করছে। এই মুহূর্তে রাইমণির হাতের ছোঁয়া আরও নিবিড়ভাবে পাওয়ার জন্য জিয়ন ওর কোলে মাথা রাখল। এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল ওর কোমর।

চুলে হাত বোলাচ্ছে রাইমণি। খানিকক্ষণ পর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ও বলল, ‘উঠ না ক্যানে। দয়া মহারাজ তুকে ডেইকেনছেন।’

দয়া মহারাজ মানে, আনন্দপুর আশ্রমের দয়ানন্দ মহারাজ। এই তো ক’দিন আগে রাস্তায় ওর সঙ্গে দেখা হল। হঠাৎ ওকে ডেকেছেন কেন, জানার জন্য জিয়ন উঠে বসল। জিজ্ঞেস করল, ‘তুর সঙ্গে উয়ার দেখা হইয়েনছিল লা কি?’

‘হ। মো আইশ্রমে কাম কইরতে গেইনছিলাম কাইল।’

‘কী কইলেন তুকে?’

‘মুর্মু খুড়া জানগুরু লিয়ে এইসেছেন রাঁঞ্চি থেইকে। মোকে ডাইন অপবাদ দিবার লেগ্যে।’

খবরটা খুটদার খুড়ার কাছ থেকে আগেই শোনা জিয়নের। এইবার ও বুঝতে পারল, ষড়যন্ত্রের মূলে তা হলে মুর্মু খুড়া। নিশ্চয় কোনও বদ মতলব আছে। সন্তোষ খুড়ার ঘরটাও হাতিয়ে নিতে চান। রাঁচি থেকে জানগুরু নিয়ে আসা চাট্টিখানি কথা নয়। হাজার খানিক টাকা তো তাঁকে দিতেই হবে। সেইসঙ্গে শুঁয়ার আর পাঁঠা। এত খরচ মুর্মু খুড়া এমনি এমনি করবেন না। জিয়ন কিন্তু অবাক হল এই ভেবে, খবরটা এত তাড়াতাড়ি দয়ানন্দ মহারাজের কানে পেৌঁছোল কী করে? পরক্ষণেই ওর মনে হল, গেরামে আশ্রমের কৃপাপ্রার্থী অনেকেই আছে। গেরামের ভালো-মন্দ অনেক খবরই তাই সন্ন্যাসীরা আগাম পেয়ে যান।

ওদের সাঁওতাল সমাজে নানারকম কুসংস্কার আছে। দয়ানন্দ মহারাজরা সেইসব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। এর আগে একবার ডাইন অপবাদ থেকে ওঁরা বাঁচিয়েছিলেন বারুদি গেরামের একজনকে। সেই মেয়াকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়েছিল রাতের অন্ধকারে ঘরে আগুন লাগিয়ে। আগে খবর পেয়ে সন্ন্যাসীরা পুলিশ নিয়ে হাজির হন সেখানে। তা হলে কি রাইমণিকেও উয়ারা বাঁচাতে চান? সেই কারণেই ওকে ডেকে পাঠিয়েছেন? কথাটা মনে হওয়া মাত্র জিয়ন উঠে পড়ল। বলল, ‘তু ইগট্টু বোস ক্যানে। আমি চট কইরে রেডি হইয়ে লিই। মোর সঙ্গে তু আইশ্রমে যাবিক।’

… ঘণ্টাখানেক পর পাথুরে রুক্ষ জমির উপর দিয়ে দু’জনে যখন সাইকেলে আনন্দপুর আশ্রমে পৌঁছোল, তখন মাঝ দুপুর। প্রকাণ্ড গেটটার খানিক আগে কালভার্টের উপর এসে ওরা দাঁড়াল। বেলামু পাহাড় থেকে নেমে আসা ছোটো একটা নদী নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ছোটোবেলায় হেঁটেই জিয়নরা শুখা নদীটা পেরিয়ে যেত। কিন্তু, গত কয়েকদিনের বৃষ্টির কারণে নদীর জল এখন টইটুম্বর। সাইকেলটা কালভার্টের নীচের ঢালে দাঁড় করানোর ফাঁকে ওরা দেখতে পেল, কাঁধে রাইফেল নিয়ে দু’জন গেট পাহারা দিচ্ছে। প্রায় পাঁচ-ছ’বছর পর জিয়ন এই আশ্রমের দিকে এল। আগে কখনও আর্মড গার্ড ওর চোখে পড়েনি। দেখে, কেন জানে না, ওর মনে হল, পার্টির লোকেরা যাতে দলবল নিয়ে হঠাৎ চড়াও না হতে পারে, সেই কারণেই এত কড়াকড়ি।

অফিস ঘরে দয়ানন্দ মহারাজের সঙ্গে দেখা হতেই উনি হাসিমুখে বললেন, ‘এসো জিয়ন। একটু আগে তোমার কথাই ভাবছিলাম।’

হাতজোড় করে প্রণাম জানিয়ে জিয়ন বলল, ‘আপনি ডেইকেছিলেন মহারাজ?’

‘আগে বোসো। তোমার সঙ্গে কয়েকটা ব্যাপারে আলোচনা করার ছিল। হাতিরা কতটা ক্ষয়ক্ষতি করেছে, তা দেখার জন্য কাল আমি তোমাদের গ্রামে গেছিলাম। তোমার খেতে তো ধানগাছের চিহ্ন আর নেই বললেই চলে। এখন কী করবে বলে তুমি ভাবছ?

গত তিন বছর ধরে যে-ইচ্ছেটা ও লালনপালন করছে, রাগের মাথায় সেটাই জিয়ন বলে বসল, ‘মুনে লয়, হাত্থিগুলানকে গুলি কইরে মারি।’

শুনে হাসি মিলিয়ে গেল মহারাজের মুখ থেকে। ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে উনি বললেন, ‘হাতিদের উপর তোমার এত রাগ কেন জিয়ন? কখনও কি ভেবে দেখেছ, জঙ্গল ছেড়ে প্রতি বছর ওরা লোকালয়ে আসে কেন? এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী তো আমরা… মানুষরা। বসতি বাড়ানোর জন্য আমরা জঙ্গল কেটে নিয়েছি। জঙ্গলে ওদের খাবার ভাঁড়ারে টান পড়েছে। খাবারের খোঁজে তাই ওরা মানুষের ডেরায় ঢুকছে। হাতিদের কি দোষ দেওয়া যায়, বলো? ওদেরও কি বাঁচার অধিকার নেই? এই পৃথিবীর উপর ওদের দাবি তো অনেক বেশি। কেন-না, মানুষের অনেক আগে ওরা এই পৃথিবীতে এসেছে। যা বলছি, তুমি কি বুঝতে পারছ, জিয়ন?’

শুনে হাঁ করে তাকিয়ে রইল জিয়ন। এক ঝটকায় ওর চিন্তাভাবনা এলোমেলো হয়ে গেল। দয়ানন্দ মহারাজ যা বলছেন, তার পিছনে যুক্তি আছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, মানুষের মতো হাত্থিরাও প্রাণী। ওদেরও খিদে আছে। বেঁচে থাকার আকুতি আছে। নিজের প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছে আছে। তবুও, মনে মনে পালটা প্রশ্ন হাতড়াতে লাগল জিয়ন। জঙ্গল কেটে বাপ-ঠাকুর্দারা যদি ভুল করে গিয়ে থাকে, তা হলে তার খেসারত ওদের দিতে হবে কেন? ওদের মুখে অন্ন তা হলে কে জোটাবে?

দয়ানন্দ মহারাজ বোধহয় মনের কথা বুঝতে পারেন। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে ফের বললেন, ‘হাতিদের নিয়ে সমস্যাটা শুধু তোমাদের খটঙ্গা গ্রামেরই নয়… সারা দেশের। ওদের অন্নসংস্থানের কথা যে আমাদেরই ভাবতে হবে জিয়ন। এক জঙ্গলে যদি ওদের খাবার শেষ হয়ে যায়, তা হলে ওরা যাতে কাছাকাছি অন্য জঙ্গলে গিয়ে খাবার পায়, তার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সেইসঙ্গে দুটো জঙ্গলের মাঝে যাতায়াতের সময় ওদের জন্য নিরাপদ একটা করিডর। তাহলে গ্রামে ঢোকার কথা ওরা আর ভাববেই না।’

হাত্থি ঠাকুর সম্পর্কে আরও অনেক কথা বলতে লাগলেন দয়ানন্দ মহারাজ। লেখাপড়া জানা মানুষ… কত কী জানেন! ভিন্ রাজ্যে নাকি হাতি আটকানোর জন্য গেরামের চারপাশে ইলেকট্রিকের বেড়া লাগানো হয়। একবার শক্ খেলে হাতি আর গেরামে ঢোকার সাহস পায় না। পথ বদলে অন্যদিকে সরে যায়। হাত্থি ঠাকুরের না কি অসীম বুদ্ধি। ওরা ঠিক বুঝতে পারে, কে ওদের ক্ষতি করতে চায়, কে নয়? কয়েকটা উদাহরণও দিলেন দয়ানন্দ মহারাজ। কথাগুলো শুনতে শুনতে জিয়ন দ্বিধায়। ওর বাপ, মা, বোন তো হাত্থি ঠাকুরের কোনও ক্ষতি করেনি? তাহলে ওদের মরতে হল কেন? একটা সময় হাতি প্রসঙ্গ থেকে সরে এসে মহারাজ হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘চাষ করার ইচ্ছে কি আর তোমার আছে, জিয়ন?’

উত্তরটা ও ঠিক করে রেখেছে। জিয়ন বলল, ‘না।’

‘তোমার কাছে একটা প্রস্তাব আছে। খটঙ্গা থেকে আশ্রম পর্যন্ত একটা রাস্তা বানানোর কথা আমরা ভাবছি। তার জন্য মাটি দরকার। তোমার খেত থেকে যদি আমরা মাটি তুলে নিই, তাহলে কি তোমার আপত্তি আছে? মাটি কেনার টাকা তুমি পাবে। মাটি তোলা নিয়েও তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমরাই লোকজন দিয়ে মাটি কাটার ব্যবস্থা করে নেব। তুমি কি তাতে রাজি?’

প্রস্তাবটা শুনে জিয়নের মন্দ লাগল না। কানালি জমি এমনিতেই নীচু। বছরে একবারের বেশি চাষ করা যায় না। চাষ করেই বা আর লাভ কী? একে গেরাম থেকে ওর মন উঠে গিয়েছে। পঞ্চায়েতের লোকজনদের ওর সহ্য হচ্ছে না। খেতের ওই জমি আর রাইমণির টানেই ও অ্যাদ্দিন খটঙ্গায় পড়ে আছে। পাকাপাকিভাবে এবার সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলে ক্ষতি কী? রাইমণির দিকে তাকিয়ে জিয়ন বুঝতে পারল, ওর অসম্মতি নেই। তাই বলল, ‘মো রাজি।’

‘গুড। তা হলে টাকা পয়সার কথা তোমাকে পরে জানিয়ে দেব।’

একটু থেমে রাইমণির দিকে তাকিয়ে দয়ানন্দ মহারাজ মৃদু হেসে বললেন, ‘আর একটা কথা। রাইমণি সম্পর্কে কি তুমি কোনও সিদ্ধান্ত নিয়েছ? যদি না নিয়ে থাকো, তাহলে আমি বলি কি, ও এখন আমাদের আশ্রমেই থাক। ও যে কী বিপদের মধ্যে আছে, নিশ্চয়ই তুমি তা জানো। ঘরে একা থাকা ওর পক্ষে ঠিক হবে না। আশ্রমের হেঁসেলে নানা রকম কাজ থাকে, রাইমণি আপাতত সেই কাজ করুক।’

দয়ানন্দ মহারাজের সঙ্গে আরও কিছু কথা বলে জিয়ন যখন আনন্দপুর থেকে বেরিয়ে এল, তখন মন খুশিতে ভরপুর। রাইমণিকে নিয়ে আর কোনও আশঙ্কা ওর নেই। তার থেকেও বড়ো কথা, একটা দিশা পাওয়া গিয়েছে। বুদ্ধির খেলায় এইবার হাত্থি ঠাকুরদের ও হারিয়ে দিতে পারবে। আশ্রম থেকে বেরোনোর সময় জিয়ন লম্বা একটা শ্বাস নিল।

গেরামে ওকে একঘেরিয়া করে দেওয়া হবে, এমন একটা কথা খুব রটেছে। পরিস্থিতিটা এমন, পারলে খুটদার খুড়ারা জিয়নকে ছিঁড়ে খান। ওর খেতের জমির কাছে যেদিন মাটি কাটার যন্তর এসে দাঁড়ায়, সেদিনই সবাই বলাবলি করেছিল, ঠাকুরদাসের ব্যাটার মাথার ঠিক নেই। ব্যামোটা আবার বেড়েছে। না হলে চাষের জমিতে কেউ খাদান করে? কী শুনেছিল, কে জানে? সেদিনই দুপুরে নকুল ওর কাছে এসে বিরক্ত গলায় জিগ্যেস করেছিল, ‘তুর মতলবটা কী বুল ত? গেরামে থাকার ইচ্ছে তুর আছে?’

প্রশ্নটা কেন করছে জিয়ন তা জানে। তবুও বলেছিল, ‘ই কথা কইছিস ক্যানে?’

‘আইশ্রমের সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তুকে কে ইত ভাবভালোবাসা কইরতে বুলেছে? উয়াদের কানছে তু জমি বিককিরি কইরেছিস ক্যানে? তু জানিস না, পঞ্চায়েতের কেউ উয়াদের পছন্দ করে না?’

‘মুই ত জমি বিককিরি করি লাই। মোর জমি… মুই কী কইরব, পঞ্চায়েত বলার কে বটে?’

নকুলের সঙ্গে সেদিন অনেকক্ষণ কথাকাটাকাটি হয়েছিল জিয়নের। ও ভয় দেখিয়েছিল, খুটদার খুড়ারা ভয়ানক চটে রয়েছেন। মুখিয়া যে-কোনওদিন মিটিন ডেকে শাস্তি দিতে পারেন। সাঁওতাল সমাজে সেই বিধান গেরামের সবাই মানবে। পরবের সময় কেউ ওকে ডাকবে না। হাটে-বাজারে কেউ ওর সঙ্গে কথা বলবে না। ও একঘরে হয়ে যাবে। এসব শুনেও জিয়ন একটুও পিছিয়ে আসেনি। নকুলকে কিছু বলা মানে, সবার কানে তা পেৌঁছে দেওয়া। জোর গলায় ও বলে দিয়েছিল, মাটি কাটা হয়ে গেলে আপাতত ও তাতে জল ভরে রাখবে। তারপর কী করবে, পরে ঠিক করবে।

নকুল মোটামুটি একটা ধারণা নিয়ে গিয়েছিল, জমিতে ধরে রাখা জল জিয়ন সেচের জন্য দেবে। জেলার নানা জায়গায় এই রকম জলাধার তৈরি করার জন্য গেরামের লোকেদের আজকাল উৎসাহ দিচ্ছে সেচবাবুরা। মুখে নকুলকে যা-ই বলুক না কেন, জিয়ন ঠিক করেই ফেলেছে, ও কী করবে। মাটি খননের কাজ চলছে প্রায় তিন হপ্তা ধরে। খেতের এক দিকটায় প্রায় পাঁচ-ছ’ফুট মাটি তোলা হয়ে গিয়েছে এক্সক্যাভেটর দিয়ে। এই যন্তরটা জিয়ন চেনে। জনমজুরি খাটতে গিয়ে দেখেছিল। রাঁচি থেকে দুটো এক্সক্যাভেটর নিয়ে এসেছেন দয়ানন্দ মহারাজরা। সেইসঙ্গে চার-পাঁচটা ডাম্প ট্রাকও। মাটি তোলার সঙ্গে সঙ্গে ডাম্প ট্রাকে করে তা ওঁরা নিয়ে যাচ্ছেন আশ্রমের দিকে।

রাতে রোজই একবার করে টর্চ নিয়ে খেতের দিকে যায় জিয়ন। আজও বেরিয়েছে, কত মাটি কাটা হয়েছে, তা দেখার জন্য। বিকেলের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল। মেঘশূন্য আকাশে বাঁকা চাঁদ। পিছল আল ধরে এক চক্বর মারার সময় হঠাৎ ওর চোখে পড়ল, একটা এক্সক্যাভেটর গাছের উপর কাত হয়ে রয়েছে। এত বড়ো যন্তরটার ওই অবস্থা হল কী করে, তা নিয়ে খানিকক্ষণ ভাবতেই জিয়নের মনে হল, এ মানুষের কম্ম নয়। নিশ্চয়ই হাত্থি ঠাকুরদের কাজ। ঝালদা থেকে এই রাস্তা দিয়েই হয়তো ওরা আজই ফিরে গিয়েছে বেলামুর দিকে। ওদের আক্রোশ থেকে যন্তরও রেহাই পায়নি। আজব যন্তরটা কী, জানার জন্য নিশ্চয় ওরা ঢুঁসো মেরে গিয়েছে। জিয়ন ভেবে একটু অবাকই হল, হাত্থি ঠাকুরের দল খটঙ্গার পাশ দিয়ে চলে গেল, অথচ গেরামের লোক কেউ টের পেল না!

মেঠো রাস্তার দিকে এগোনোর সময  হঠাৎ ক্ষীণ স্বরে হাত্থির ডাক শুনতে পেল জিয়ন। ডাক না বলে, আর্তনাদ বলা ভালো। টর্চের আলো ফেলতেই ওর চোখে পড়ল, বাচ্চা একটা হাত্থি প্রাণপণ খাদ থেকে উঠে আসার চেষ্টা করছে। বোধহয় দলছুট হয়ে গিয়েছে। অন্ধকারে বুঝতে পারেনি, তাই গড়িয়ে পড়ে গিয়েছে খাদে। দলের বড়োদেরও সেটা চোখে পড়েনি। কয়েক মিনিট ধরে বাচ্চাটার ভয়ার্ত ডাক শুনে জিয়ন আর স্থির খাকতে পারল না। খাদে বৃষ্টির জল জমে রয়েছে। হাল ছেড়ে দিয়ে, বাচ্চাটা একটা সময় জলে ডুবেও মারা যেতে পারে। ওর খেতে যদি তা হয়, তা হলে কী হবে ভাবতেই শিউরে উঠল জিয়ন। গেরামের মানুষের ধারণা হবে, বদলা নিতে গিয়ে ও-ই মেরে ফেলেছে হাত্থি ঠাকুরকে। সবার রোষ এসে পড়বে ওর উপর। না, না, রাতের মধ্যে যে করেই হোক, বাচ্চাটাকে উদ্ধার করতে হবে। কথাটা ভাবতেই হাত্থি বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে ও দৌড়োতে শুরু করল বুধিরামের বাড়ির দিকে।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই গেরামের মানুষ এসে হাজির খেতের চারপাশে। জুয়ান মরদরা তো বটেই, এমনকী মেয়া-বউরাও। হাত্থি ঠাকুরকে বাঁচাতেই হবে। না হলে পুরো গেরাম মারাংবুরুর কোপে পড়বে। কারও হাতে রশি, বাঁশ। কারও হাতে মশাল, হ্যাজাক, টর্চ আর কাঠের পাটাতন। অতি উৎসাহে অনেকেই খাদে নেমে পড়ল। কিন্তু, এত মানুষজন আর আলো দেখে মারাত্মক ভয় পেয়ে গিয়েছে বাচ্চাটা। বারবার চেষ্টা করছে খাদের ঢাল দিয়ে উপরে ওঠার। কিন্তু নরম কাদায় পা পিছলে বারবারই নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। খানিকক্ষণ এদিক ওদিক দৌড়োদৌড়ি করে, শেষে লুকোনোর জন্যই জলে গা ডুবিয়ে দিল বাচ্চা হাত্থিটা। কিছুতেই তাকে আর ডাঙ্গায় তোলা যায় না। গেরামের মাতব্বররা একেকজন এক এক রকম পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু, ওই হই হট্টগোলে, কে শোনে কার কথা?

ঘণ্টা পাঁচেক যুদ্ধ করে মরদরা গলদঘর্ম। কে যেন বুদ্ধি করে কলাগাছ কেটে এনেছিল। সেটা মুখের কাছে ধরতেই জল থেকে বাচ্চা হাতিটা উঠে এল। বোধহয় খিদে পেয়েছিল। নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে সে কলাগাছ চিবোতে শুরু করল। দৃশ্যটা দেখে আলে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো উৎফুল্ল, ‘হাত্থি ঠাকুর সেবা লিয়েছে গ।’ সেই সুযোগে নকুল ফিসফিস করে জিয়নকে বলল, ‘চল ভাই, পেইটে রশির ফাঁস দেই বটে। পরে টেইনে উপরে তুইলে লিব।’ জিয়ন তখন পরম মমতায় বাচ্চাটার মাথায় হাত বোলাচ্ছে।

বাচ্চাটাকে আলের উপর তোলা হয়েছে। চারদিকে গোল হয়ে তাকে সবাই ঘিরে রয়েছে। ভোরের আলোয় একটা অদ্ভুত দৃশ্য জিয়নদের চোখে পড়ল। পূব দিক থেকে মত্ত হাত্থির দল এদিকে আসছে। মাঝ রাস্তায় হয়তো ওদের খেয়াল হয়েছে, বাচ্চাটা সঙ্গে নেই। তাকে উদ্ধার করার জন্য রণহুংকার দিয়ে ফের ওরা ফিরে আসছে। ভয়ে গেরামের মানুষ পালিয়ে গেলেও নকুলের সঙ্গে জিয়ন কিন্তু আলের উপর দাঁড়িয়ে রইল। হাত্থি ঠাকুরদের আর ও ভয় পাচ্ছে না। ওদের উপর ওর আর কোনও রাগও নেই। দয়ানন্দ মহারাজের কথাই ঠিক। এই পৃথিবীটা শুধু মানুষদেরই নয়, সব প্রাণীর। মানুষ যেহেতু সবথেকে বুদ্ধিমান, তাদেরই সবথেকে বেশি মানিয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে। আলের উপর দাঁড়িয়ে জিয়ন দেখতে পেল, বাচ্চাটাকে পেয়ে হাত্থি ঠাকুরের দল প্রচণ্ড খুশি। শুঁড় দিয়ে সবাই ওকে আদর করছে। শুঁড় উঁচিয়ে ওরা ডাকছে। দেখে জিয়নের মনে হল, গেরামের মানুষদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে। খানিক পরে থামের মতো পাগুলোর আড়াল দিয়ে ওরা বাচ্চাটাকে নিয়ে রওনা হল বেলামু পাহাড়ের দিকে।

জিয়নের সারা মন জুড়ে এখন আনন্দের অনুভূতি। মেঠো রাস্তা দিয়ে নকুলের সঙ্গে বাড়ির দিকে আসার সময় মনে মনে ও স্থির করে নিল, বেলায় ও একবার আনন্দপুর আশ্রমে যাবে। দয়ানন্দ মহারাজের আশীর্বাদ নিয়ে আসবে। মহারাজ ওকে একটা ভালো পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘মাটি কাটা হয়ে যাওয়ার পর বৃষ্টির জল ধরে রেখে তুমি মাছের চাষ শুরু করো জিয়ন। তোমার মাছ আমরাই কিনে নেব। এর পর থেকে হাতির দল গেরামে এলেও তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।’ কথাটা ওর মনে ধরেছিল। হাত্থি ঠাকুরদের জব্দ করার এই সুযোগটা ছাড়তে চায়নি জিয়ন। মাঝে দয়ানন্দ মহারাজ কিছু টাকা ওকে দিয়েছেন। একদিন তাই পুরুলিয়া শহরে গিয়ে ও কথাও বলে এসেছে মৎস্য দফতরের বাবুদের সঙ্গে। ওঁরা বলেছেন, সবরকম সাহায্য করবেন।

এই মুহূর্তে আরও একটা কাজ বাকি রয়েছে জিয়নের। তার জন্য ওকে বলরামপুর যেতে হবে। গিয়ে সন্তোষ খুড়াকে বলতে হবে, ‘রাইমণিকে বিহা কইরতে চাই। কত্তো টাকা গন্নকাউডি (পণ) দিইতে হবেক, দয়া কইরে বলেন।’

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব